আধুনিক নারীবাদ এবং আল-কুরআনের নারী




আল্লাহ হযরত আদম (আ.) কে আগে সৃষ্টি করেছেন এবং তার নি:সঙ্গতা দূর করার জন্য তার বাম পাজরের বাঁকা হাড় দিয়ে বিবি হাওয়াকে পরে সৃষ্টি করেছেন-এজন্য পুরুষদের আত্মঅহমিকার কিছু নেই কিংবা নারীদের হীনমন্যতয় ভোগারও কোন কারন নেই। পুরুষ এবং নারী-উভয়কে সৃষ্টি করার মহৎ পরিকল্পনা আল্লাহর ছিলো। এবং পৃথিবীতে দীর্ঘায়ত কালের জন্য একটি মানব সমাজ কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে কৌশল খাটিয়ে আল্লাহ এদের উভয়কে এখানে পাঠিয়েছেন। অত:পর তাদের সেই স্বর্গচ্যুত জীবন বিচ্ছিন্নভাবে যে নিদারুন হতাশা কষ্ট ও ধারাবাহিক দু:খের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, তার কিভাবে অবসান ঘটল, হযরত আদম (আ.) এবং বিবি হাওয়া কিভাবে সংগ্রাম করে পৃথিবীর বুকে টিকে রইলেন, সে ইতিহাস প্রত্যেক ঐশী কিতারবধারী বিশ্বাসী ধার্মিকের জানা আছে। এখানে সে ইতিহাস সে ইতিহাস বর্ণনার চেয়ে বরং আমরা দেখব, পবিত্র কোরআন কোন দৃষ্টিকোন থেকে নারীকে দেখছে, পুরুষ কি দৃষ্টিকোন থেকে দেখছে তার সঙ্গিনীকে। কারণ সভ্যতার ক্রনোন্নতির ফলে, মানুষের চিন্তা ভাবনার ব্যাপকতর পরিবর্তনের স্রোতে প্রথাবাদী অনেক মূল্যবোধ ভেসে গেছে খড়কুটোর মত। সবকিছু যাচাই করে নেয়ার এই যুগে, পরিবার ও সমাজ জীবনের বহু বিশ্বাস অধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আলগা হতে শুরু করে। ফলে, যৌথ পরিবারের ধারনা এখন বাস্তবে বিলুপ্তির পথে। স্বামীকে এখন আর পূজ্য দেবতা বলে মনে হয় না নারীর; নারীও এখন শিল্পীর তুলিতে আকা মোনালিসা ছবির মত নয় পুরুষের কাছে। কবিদের কব্যেও হৃদয়ের অতলান্ত আকুলতা দিয়ে চিত্রিত কোন মানব প্রতিমা পাওয়া যায় না। ইউসুফ-জুলায়খা, শিরী-ফারহাদ এর যুগ এখন আর নেই। পুরুষ শাসিত সমাজে আজ নারীকে দেখা হচ্ছে সম্পূর্ণ অন্যভাবে। মনে হয়, নারী আজ পুরুষের সংগ্রামী জীবনে সহায়ক সঙ্গী নয়, বরং প্রতিদ্বন্দী। যেহেতু উনিশ শতকে নারীর মূল্য মর্যাদা শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে যেটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছিল, একবিংশ শতকে সেটুকুও নি:শেষ হতে চলছে। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল পদে নারীদের উত্থান ঘটেছে, কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় নারীরা যথেষ্ট অবহেলিত ও অবমূল্যায়িত। আর সে কারনে নারী মুক্তির আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠছে সমতা অর্জন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কিছুতে নারীরা পুরুষের সমান মূল্য চায়, সমান মর্যাদা চায়। সেটা কেবল পুরুষের অনুগ্রহধণ্য শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে।

কোরআনে বর্ণিত নারীদের মূল্য মহিমা সম্পর্কে আলোচনা করার আগে আমাদের জেনে নিতে হয়, প্রাচীন সভ্যতায় বিখ্যাত চিন্তাবিদগণ নারীকে কোন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন। গ্রীকদর্শনে নারী-জীবনের স্বতন্ত্র স্বভাব ও সামাজিক মূল্যের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে। পিথাগোরাস, প্লেটো এবং এ্যারিষ্টোটল নারীদের ভুমিকা উল্লেখ করেছেন তাদের আলোচনায়। প্রকৃতিগতভাবে নারীদের চেয়ে সব ক্ষেত্রে পুরুষরা সামর্থবন হওয়ার কারনে ঐতিহাসিক বিবর্তনের পথ ধরে, পৃথিবীর সভ্যতাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়েছে পুরুষ প্রতিভাবানদের হাতে। তাজমহলের অভ্যন্তরে মমতাজ-এর মত নারীর মহিমা বারবার গোপন থেকে গেছে। আধুনিক জ্ঞান বিদ্যার অন্যতম অধ্যায় নারীবাদ। আর প্রাচীনকালে, বিশেষত গ্রীক নীতিশাস্ত্রের আলোচনায় নারীরাও স্থান পেয়েছিল। কেবল মধ্যযুগীয় ইউরোপে নারীর উপেক্ষিত ইতিহাস মানবতাবাদীদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে আছে। আর সে কারনে রেনেসাঁসের অন্যতম বৈশিষ্ঠ্য হয়ে উঠে নারীর মহিমা আবিষ্কার। নারীর মধ্যে কেবল কাম চরিতার্থ নয়, মানব মনের চিরন্তন সৌন্দর্য পিপাসা নিবৃত্তি ঘটে নারীর মনকে জেনে, ভালবেসে। আমরা কোন কব্য সমালোচনা করছি না, আমাদের লক্ষ্য নারীর ইতিহাস আলোচনা।

প্রাচীন গ্রীক দর্শনের প্রয়োগিক ক্ষেত্রের মধ্যে নীতিবিদ্যা অন্যতম এবং নীতিবিদ্যার আলোচ্য সূচিতে নারীদের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পুরুষ রচন করছে সামাজিক আইন সন্দেহ নেই, কিন্তু নারীকে সম্পূর্ণ বাদ দিলে কাজটা হয়ে যায় সম্পূর্ণ বেআইনী ও নীতিহীন। পিথাগোরীয় মরমীয়াবাদের তিনটি বিষয়ের মধ্যে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক একটি। অন্য দুটি হল, ক্রীতদাসের প্রতি ন্যায় আচরণ এবং সামাজিক জীবনে বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করা এবং তার অনুশীলন করা। এ চিন্তাগুলো নি:সন্দেহে এখনো আধুনিক এবং এগুলোর মধ্যে মানবজীবনের চিরন্তন মূল্যবোধের অঙ্কুর নিহিত।

নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে সমাজ ব্যবস্থার কূটিল দিকের যে ছবি প্রকট হয়ে উঠছে, তার ঐতিহাসিক ধারা ও প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন। আমরা বলছিলাম গ্রীক দর্শনে বিশেষত, পিথাগোরীয়ান ফিলোসোফীতে নারী ও পুরুষের পার্থক্য গ্রাহ্য করা হয়েছে। তিনি মনে করেন যে, নারী ও পুরুষের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য । সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পান, নারীর মধ্যে প্রকৃতি এমন কিছু 'পরম গুণের' সমন্বয় ঘটিয়েছে যা তাকে অন্তরালবর্তী কাজে, গৃহস্থ জীবনের অভ্যন্তরে স্বামী-সন্তানের সেবা ও লালন পালনে স্বতস্ফূর্ত করে রাখছে। এ গুণের জন্য সে তার স্বামীকে দিতে পারে সেবা ও সম্মান, সম্তানকে বড় কিছু হওয়ার জন্য যোগাতে পারে প্রেরণা। তার মতে গার্হস্থ্য কার্যাবলী মর্যাদাকর ও সম্মানীয়। সমাজের সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির জন্য সব কাজই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নারীর গার্হস্থ্য কাজগুলোর গুরুত্ব মোটেও কম নয়। কিন্তু বর্তমান সমাজের প্রেক্ষিতে আমরা চাক্ষুষ করি, নারীর গৃহাস্থলি কাজ নৈতিকভাবে মর্যাদা পাচ্ছে না বরং হীনভাবে দেখা হচ্ছে। নারীর জীবন অন্তর্মুখী, তাই বলে তাকে গ্রহ্য করা হয় না। সেবা ও পরিচর্যা প্রদানকারী আবেগ অনুভূতিপূর্ণ নারীকে আজ যতই হীনতর জীব হিসেবে গণ্য করা হোক, ব্যাক্তি ও সমাজের সার্বিক কল্যাণের কথা মনে রেখে পিথাগোরাস নারীর ভূমিকাকে ইতিবাচক, প্রয়োজনীয় এবং মর্যাদাকর বলে আখ্যায়িত করেন।

প্লেটোর নারী সম্পর্কিত মতবাদের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই তার 'রিপাবলিক' গ্রন্থের মাধ্যমে। ঐ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য হল, আদর্শ নগররাষ্ট্র এবং আদর্শ নাগরিক। আদর্শ নাগরিকের উপর তিনি জোর দেয়ার কারনে নারীও পুরুষের স্বতন্ত্র ও স্বাভাবিক পার্থক্যকে মূল্যায়ন করা হয় নি বরং পুরুষের পাশে তিনি নারীকে সমানাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করেন। তার এই সমান অধিকারের বিষয়টা একটি কমিউনিটির প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের সূত্রে আলোচিত হয়েছে। কর্তব্যের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। নারীর অবেগময় আচরণ তিনি অপছন্দ করেছেন, তবে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে পুরুষের সহযোগী সঙ্গি হিসেবে নারীর মর্যাদাকে অস্বীকার করেন নি।

আমরা এখন যে সময়ের গন্ডীতে দাঁড়িয়ে নারীর জীবন নিয়ে কথা বলছি, সে সময়টির স্রষ্টা ইউরোপ, ইউরোপীয় চিন্তাদর্শন ও অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে খৃষ্টিয় সমাজে প্রচলিত নারীবাদের ধারণাগুলো সরাসরি নানা ভঙ্গিমায় আমাদের মুসলিম সমাজে এসেছে। ইসলামের শিক্ষায় নারী কখনোই অবহেলিত নয়। কিন্তু উপনিবেশিক শাসনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে মুসলিম সমাজে নারী আজ পণ্য হয়ে উঠছে এবং সে কারণে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীর মূল্যায়ন নির্ধারনের চেষ্টা চলছে। তাই বর্তমানের নারীবাদীরা লিঙ্গ বৈষম্য মানতে চায় না। এক্ষেত্রে নারীবাদীদের বক্তব্য বেশ জোরালো, যা বাস্তব অবস্থায় অস্বীকার করা যায় না। তাদের বক্তব্য: নারী পুরুষের মাধে শরীর তত্ত্বীয় পার্থক্য অবশ্যই আছে। কিন্তু সেই পার্থক্যকে ভিত্তি করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে অধস্থন করে রাখা হয়েছে এবং নারী পুরুষের বৈষম্য কর হচ্চে। নারীবাদ এই বৈষম্যনীতির বিরোধী। আগেই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে নারীদের উত্থান ঘটলেও, সমাজের সর্বত্র সমান অধিকার পাচ্ছে না তারা। শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটলেও সেখানে বিশ শতকের আগ পর্যন্ত নারীর ভোটাধিকার ছিল না। বিয়ের মাধ্যমে নারী স্বামীর অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত হয়; এবং বিয়ের পূর্বে সে থাকে পিতার অধীনে। আবার নিজ সম্তানের উপরও তার নিয়ন্ত্রন থাকে না। আইনের অনুশাসন উপেক্ষা করে স্বামীরা যথেচ্ছা স্ত্রীকে ব্যবহার করে। কেবল শিল্প বিপ্লব এসে নারীর শ্রমকে কিছু মজুরীর বিনিময় যোগ্য জিনিস হিসেবে ধরিয়ে দিয়েছে।

নারীবাদ সম্পর্কে পাশ্চাত্যভাবধারায় যারা আলোচনা করেছেন তাদের মধ্যে মেরী উল স্টোন ক্রাফট, জুলিয়েট মিশেল, জে. এস. মিল, পিটার সিঙ্গার, সি. গিলিগান, ভার্জিনিয়া হেল্ড, ভি প্লামউড প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে নারীবাদ বিবেচনায় যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও, এদের মূল বক্তব্য, দার্শনিক পরিভাষায় Feminism এর আওতাভূক্ত এবং বর্তমান বিশ্বের নারী জাগৃতির দাহ্যশক্তি। মেরী উল স্টোন ক্রাফট তার A Vindication of the right of women (1792) গ্রন্থে বলেন, সংক্ষেপে বলতে গেলে, নারী সঠিকভাবে সভ্যতার দুর্বল ক্রটিগুলো অর্জন করেছে। এবং উপযোগী সুফলগুলো হারিয়েছে, এবং সেই সঙ্গে তাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সক্রিয় করা হয়েছে। অথচ দারুনভাবে তাদের বুদ্ধিকে অবহেলা করা হয়েছে। ফলে তারা তাদের ইন্দ্রিয়ের শিকার হয়েছে, মার্জিত ভাষায় তাদেরকে বলা হয় আবেগ প্রবণ। সেই সঙ্গে মিথ্যা সংস্কৃতি দিয়ে সভ্য নারীকে এতই দূর্বল করা হয়েছে যে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলেও তাদের নৈতিক বোধ যে অবস্থায় থাকতো সে তুলনায় তা অনেক নীচে।

জুলিয়েট মিশেল বলেন, সমাজ নারীকে পুরুষ থেকে স্বভাবগত কারনে ভিন্ন দল বলে দাবী করে এবং এ দাবী নারীকে সমাজে পৃথক সামাজিক দলে পরিণত করেছে। এবং সে কারনে পুরুষও সমাজে আরেকটি সংঘব্ধ দল। মিশেল দেখাতে চান যে নারীবাদ পুরুষের প্রিভিলেজ প্রাপ্ত জগতে যেমন প্রবেশাধিকার চায় তেমনি একজন পুরুষও নারী জগতে প্রবেশ করুক, তার কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করুক। অর্থাৎ তার ভাষায়, নারীবাদ চায় সমতা। অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক-সর্বক্ষেত্রে কেবল পুরুষ নয়, নারীও নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশী লেখিকা মালেকা বেগম-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ' উনিশ শতকে বাংলার নব জাগরণের ইতিহাসে নারীজাগরণের অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল সংগত কারণেই। আর সে কারনেই অবলা ও পরনির্ভশীল বঙ্গ লালনাদের নির্যতিত অত্যাচারিত জীবন ইতিহাস বিদ্রোহ ও লড়াই-সংগ্রামের রক্তে আপ্লু হয়েছে। এক নদীতে দুই স্রোতধারা বহমান। এবং তা বইছে দুই শতাব্দি ধরেই।' উপনিবেশিক শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তি অর্জনে বঙনারীর ভূমিক নি:সন্দেহে প্রশংসনীয়।

নারী-পুরীষের দৈহিক গঠন ও গড়নকে সামনে রেখে J. S. Mill বলেন, যে নীতি দিয়ে উভয় লিঙ্গের মাধে বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্ককে বিদিবদ্ধ করা হয়েছে- এক লিঙ্গ দিয়ে অপর লিঙ্গকে অধস্তন করার বৈধতা তা স্বয়ং ভ্র্ন্ত এবং বর্তমানে মানব উন্নতি বিধানে একটি বাধা।

পিটার সিঙ্গার বলেন, জীবতাত্ত্বিক পার্থক্য নারী পুরুষের বুদ্ধি বা সামর্থ বা শক্তি সম্বন্ধে কোন পার্থক্যের ভিত্তি নয়। তিনি বরং মনে করেন, আমাদের যদি মানুষের আসল প্রকৃতি অনুসন্ধান করতে হয়, তাহলে তাদের বিচ্ছিন্নভাবে স্ত্রী বা পুরুষ হিসেবে মূল্যায়ন না করে ব্যাক্তি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। তিনি সংসার ও সমাজ বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে বলেন, মানুষ যে কাজের জন্য সবচেয়ে বেশী উপযোগী সেই কাজটি যদি তাদের করতে হয়, তাহলে স্ত্রী ও পুরুষের জন্য নির্ধারিত কাজের ক্ষেত্রগুলোকে উন্মুক্ত রাখতে হবে।' এখানে ষোল বছরের একটি মেয়ের দাবীগুলো শোনা যাক, "বেচে থাকার বিষয়টি মানুষের জন্যে অগ্রাধিকার পাবে এবং এর জন্যে মানুষ সংগ্রাম করে। চুরি করার চাইতে অস্তিত্ব রক্ষা করা অধিক গুরুত্ব পাবে। চুরি করা নিন্দনীয় কিন্তু অস্তিত্বের জন্যে চুরি করা এমনকি হত্যা করতে হলেও আপনার করা উচিত। জীবন রক্ষা করা আমার মনে হয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে এটাই সর্বগ্রে বিবেচ্য।" এই অস্তিত্ববাদী বক্তব্যের সঙ্গে তাল রেখে আমরা আমাদের সমাজে বহমান একটি সামাজিক সমস্যার উল্লেখ করতে পারি। আমাদের সমাজটা মুসলিম সমাজ, কিন্তু পতিতাবৃত্তিটা ধর্মীয়ভাবে পাপের কাজ হলেও, সরকার এই ঘণ্য পাপের কাজে লাইসেন্স দিতে বাধ্য কেন ? অস্তিত্ব রক্ষার সমস্যায় জর্জরিত একটি নারীর দেহ দান যখন তার বেচে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে উঠে তখন এই গরীব মুসলিম সরকার বাহাদুরের কিছুই করার থাকে না। আইন মানুষের বাস্তব প্রয়োজনের মুখে নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য।

বুভোয়ার তার 'সেকেন্ড সেক্স' গ্রন্থে নারীর জৈবিক, মানবিক ও নান্দনিক জীবনকে সামাজিক পটভূমিতে রেখে যাচাই করেছেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সেই বইয়ের আলোকে বাংলা ভাষায় রচনা করেন তার উল্যেখযোগ্য গ্রন্থ 'নারী'। বাংলাদেশে নারীবাদের প্রবাহ রচনায় এই বইটি যে বিশেষ অবদান রেখেছে তার প্রমাণ, এটি সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। কারাগার থেকে বইটি আবার বাজারে ঘোরার, পাঠকের নাগালে আসার, জিজ্ঞাসু তাত্ত্বিকের টেবিলে অবস্থান করার অনুমতি পেয়েছে। নারী বইটি নারীজীবনের একটি মানচিত্র যা বয়ষ্ক পাঠক পাঠিকার মনে কেবল যৌনাবেগের শিহরণ জাগাবে না, নারীর জীবনাবেগের অনেক অকথিত মর্মবেদনার পরিচয়ও পাওয়া যাবে। নারীর জীবন, যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যে শিল্পে গত দুশ বছরে চিত্রিত, তাই নারী গন্থে বেশ খোলামেলা ভাষায় বিশ্লেষিত হওয়ার জন্য রক্ষণশীল মানসিকতার কাছে লেখক সমালোচিত হয়েছেন। বাংলাভাষায় নারীদের উপর অনেকের লেখা বেরিয়েছে যা বেশ উৎসাহ ব্যঞ্জক। সেসব গ্রন্থ ও বিবেচণাগুলোর মধ্যে প্রবেশ করার আগে, পাশ্চাত্য দর্শনের বিবেচনায় নারীর আর্থসামাজিক অস্তিত্ব ও বিকাশের প্রক্রিয়াগুলো আলিাচিত হওয়া দরকার।

তাত্ত্বিকভাবে নারীর সমস্যাগুলো বিবেচনায় রাখলে বাস্তব সমস্যা মোকাবেলা করা সহজ হবে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে যখন স্বাধীন থাকে তখন তার মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠার সুযোগ থাকে। তাই স্বাধীন চেতনা দ্বারা নৈতিক সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হওয়ার সুযোগ থাকলে আইনের প্রয়োগ বৈধতা পাবে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে স্বাধীনতা ভোগের কিছুটা সুযোগ যদি না দিতেন, মানুষের অপরাধ বিবেচনায় নেয়াটা হত অনৈতিক।

নৈতিকভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ে একটি মূল্য বহন করে এবং সেকারণে তারা আত্মসম্মানের অধিকারীও বটে। আর আত্ম সম্মান হচ্ছে এমন বৈশিষ্ট্য বা গুণ যা মানুষকে মূল্যবান করে তোলে। আত্মসম্মানের ঘাটতি হলে ব্যাক্তির মধ্যে হীনমন্যতার মনোভাব বৃদ্ধি পাবেই। এবং বিশেষভাবে নারীর ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। শতশত বছর অসম্মান ও অমর্যাদার মধ্যে বেচে থাকা নারী সমাজ ভুলেই গেছে সাহস কী জিনিস, ব্যক্তিত্ব কী বস্তু। সৃষ্টিগত দূর্বলতার জন্য হোক কিংবা সামাজিক ট্র্যাডিশনের জন্য হোক, আমাদের নারী সমাজ দারুনভাবে হীনমন্যতায় ভোগে। সমাজে চলতে চলতে, আত্মোপলব্ধি গড়ে উঠার বদলে তার মধ্যে জন্ম নেয় হীনমন্যতার। এই আত্মসম্মান অর্জনের উপায় শিক্ষা যা এ সমাজের ৮০% নারীর কাছে পৌছানো যায়নি। নারীর মধ্যে ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার জন্য যে উপায় ও উপকরণ প্রয়োজন সে বিষয়ে আমরা পরে আসছি। আমরা পাশ্চাত্য নারীবাদীদের কাছ থেকে নারী কেন্দ্রিক সমস্যাগুলোর আরো কিছু পাঠ গ্রহণ করব। ভার্জিনিয়া হোল্ড তার Feminist Morality গ্রন্থে বলেন, একজন পুরুষ পিতা হিসেবে নীতিগতভাবে 'মায়ের ভুমিকা' পালন করতে পারেন। লেখিকার এ ধারণা সার্বজনীন নয়, বিশেষ একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে বাবা মায়ের স্নেহ দিতে চেষ্টা করতে পারেন, এমনটা আমরা সিনেমায় দেখি। কিন্তু আসলে পরিচর্যা বিষয়ক যে মূল্যবোধ আমাদের সমাজে চালু আছে, তার কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী। নারীর কোমল হতের সেবা ছাড়া পুরুষের কোন রোগই তো ভাল হয় না। তাই বিশ্বের হাসপাতালগুলোতে পরিচর্যার দায়িত্বটা পালন করে নারীরা এবং এটা তাদের যত না প্রশিক্ষণ দ্বারা অর্জিত, তার চেয়ে বেশি স্বভাবগতভাবে প্রাপ্ত। ফলে এটাকেই পিথাগোরীয়ান ভাষায় বলা হয়েছে নারীর 'পরমগুণ'। এ গুণ থেকে নারীকে বিচ্ছিন্ন করা হলে, যে ছবিটা ভেসে উঠে, পুরুষতো নয়ই, নারী নিজেও নিজের সেই সেবাপরায়নতাশূন্য ছবিটা দেখবে না, দেখতে তারও ভাল লাগবে না। পাশ্চাত্যে যখন পরিচর্যা নীতিকে নারী ও পুরুষের মধ্যে আধাআধি ভাগাভাগি করার প্রবণতা চলছে এবং গ্রাহর্স্থ্য কর্মে পুরুষের অধিক মাত্রায় সময় দেয়ার ব্যাপারে নারীবাদীরা চাপাচাপি অব্যাহত রাখছে, তখন দাম্পত্য জীবনটা কিন্তু জমিদার বাড়ীর ক্ষেত খামার হয়ে উঠছে। সেটা আর দাম্পত্য জীবন থাকছে না। একথার অর্থ এই নয়, সে পুরুষ কখনো স্ত্রীকে সন্তানের সেবাযত্নে, রান্না-বান্না কিংবা অতিথি সেবায় সাহায্য করতে যেতে পারে না, অবশ্যই যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি যদি নারীবাদীরা রাস্তায় মিছিল করে পুরুষের দ্বারা গাহর্স্থ্যকর্ম আদায় করে নিতে চায় তাহলে সম্ভবত পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি বিপদগ্রস্থ হবে। যেমনটা পাশ্চাত্য নারীরা হচ্ছে। আজ আমাদের দেশের পুরুষরা যে দৃষ্টিতে নারীর দিকে তাকায় তার মধ্যে শোষণের চেয়ে ভালবাসার দৃষ্টিপাতই বেশি। নারী পাচার, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, ফতোয়া প্রভৃতি ঘটনায় দেশের কতভাগ পুরুষ জড়িত ? নিশ্চয়ই তা ৫% ভাগের বেশি হবে না। বাকীরা কি নারীদেরকে সঙ্গে নিয়ে সংসার করছে না ?

পাশ্চাত্যে সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে নারীরা যখন সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে, তখন তাদের মধ্যে পুরুষ বিদ্বেষ বেড়েছে, সর্বত্র সমানাধিকারের জন্য সোচ্চার হচ্ছে তারা। সহজ যোগাযোগের পথ ধরে সেই ঢেউ প্রাচ্য সমাজেও উত্তাল আলোড়ন সৃষ্টি করছে। নারী যে কিছুই না এ ধারণা খৃষ্টীয় চার্চের এবং চার্চ- এর ধারণা এমন যে, 'শয়তান সম্ভবত নারীর রুপ ধরে আসে।" হিন্দু সমাজে নারীর জীবন মূল্য তুচ্ছ, কিন্তু হিন্দু ধর্মে নারীরা দেবী হিসেবে পূজ্য, সেখানে বড় উৎসবটাও দেখা যায় দূর্গাকে নিয়ে, মহাদেব বা ইন্দ্রিকে নিয়ে নয়। অন্যদিকে মুসলিম সমাজে নারীর বর্তমান হাল যত খারাপ হোক পরিবেশের প্রভাবে; ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান অতীব উচ্চে এবং মহিমান্বিত রুপেই মুসলিম নারীরা ধর্মের কাছে সম্মানিত। কোরআনিক বিধি বিধান পূর্ণাঙ্গরুপে অবাস্তবায়িত থাকার কারনে এ সমাজে নারীর সঠিক মূল্য কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং ভারতীয় সামন্তবাদী সনাতন মূল্যবোধ লালিত বঙ্গ সমাজে নারীর অবস্থান বরাবরই পশ্চাতে রয়ে গেছে, হোক সেটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর জন্য বা অশিক্ষার ফলে, তা কিন্তু বদলানো যায়নি। শেষ দুই দশক বাংলাদেশের সমাজে চাকুরী, চিকিৎসা, আইন, ব্যাবসা, শিক্ষা, শিল্পোদ্যোগ তথা রাজনীতির মত পুরুষনিয়ন্ত্রিত এলাকায় নারীর উল্লেখযোগ্য উত্থান ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে গ্রাম সমাজে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার জন্য নারীদের প্রতি অবিচারের মাত্রাও বেড়ে গেছে। ফলে সমাজে শিক্ষিত নারীরা নির্যাতিত ও অসহায় নারীর মুক্তির জন্য সামাজিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছে এবং সেটাই বর্তমান সমাজে উদার নারীবাদী চেতনা প্রবাহের সৃষ্টি করেছে। আমাদেরকে এ বিষয়ে তাত্বিক আলোচনায় প্রবেশ করার আগে একথা সর্বোতভাবে মনে রাখতে হবে, এখানে ইসলামের প্রতি যত অনুরাগ বা আবেগ থাকুক, সমাজ কিন্তু ইসলামী নয়। বিয়ে, তালাক, সম্পত্তিবন্টন কিংবা অভিভাকত্ব আইনের কাঠামো প্রণয়নে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলার অর্খ এই নয় যে এটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ। কারণ এখানে মানুষের কিছু কিছু জরুরী কাজে ধর্মের চর্চা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু পুরোমানসিকতাই ইসলাম বিরোধী। এখানে ইসলামী সমাজ ব্যাবস্থা কায়েম হত, যদি হযরত মুহাম্মদ (স.) যেমন মক্কা ও মদিনায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাহলে আজ এখানে নারী ও পুরুষের লিঙ্গনির্ভর বৈষম্য নিয়ে নারীদের প্রতিবাদী হয়ে উঠার প্রয়োজন পড়ত না। সততার সঙ্গে একটি নারী যদি বলতে পারে সে ইসলামী সমাজে নির্যাতিত, তাহলে বলতে হবে সেটা আদৌ ইসলামী সমাজ নয়। আমরা আর একটু পরে কোরআনের আলোকে নারী ও পুরুষের সমস্যগুলো আলোচনা করব, তার আগে পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির তাত্ত্বিক আলোচনা সেরে নেব। বাংলার প্রকৃতির মত বাংলার নারীরাও সর্বংসহা; তাই অভাবী সংসারে স্বামীর সঙ্গে বাইরে সে মজুরের কাজ করে, ঘরে এসে সেবা করে স্বামীর, লালন পালন করে ছেলে সন্তান, তার পরও পরিবারের অধিকর্তা পুরুষ তার উপর খুশী হয় না, নানা রকম হয়রানির শিকার হন শ্রমজীবি এইসব নারীরা সেটাই এখন নারীবাদী সংগঠনগুলোর বক্তব্যবিষয়; এভাবে নারীকে নির্যাতিত হতে দেয়া যায় না, এ অবস্থার আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। এবং সেটা সম্ভব, নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে দেখা, নারীর জীবনকে সমাজের সব রকম সুবিধার মধ্যে বিকশিত করা, কেবল মা, বোন, স্ত্রী হিসেবে দৈনন্দিন গার্হস্থ্য জীবনের গন্ডীতে তাকে আটকে রাখা নয়। মৌলিকভাবে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য আজকের নারীবাদ, নারী আন্দোলন।

নারীকে স্বাধীন ব্যক্তিসত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হলে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরী। আধুনিকতা এই জরুরী পরিবর্তনের পক্ষে তাগিদ করছে। আধুনিকতার নামে পাশ্চাত্য থেকে আমদানী হচ্ছে এমন কিছু ধারণা যা প্রাচ্যের মুসলিম সমাজে সম্পূর্ণ নতুন এবং নারী-পুরুষের চিরন্তন সম্পর্কের প্রতি যথেষ্ট হুমকি স্বরুপ। নারীবাদী লেখকদের বক্তব্য একটাই যে, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা শোষিত হচ্ছে। সে শোষণের জায়গাগুলোও তারা চিহিৃত করেছেন। তাহলে বিবাহ আইন যা নারীকে পুরুষের অস্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত করে, সম্পত্তি বন্টনের উত্তরাধিকার আইন, যেখানে তারা বঞ্চিত বলে মনে করে, তালাক, যা স্বামীর ইচ্ছাধীন রাখা হয়েছে, যদিও স্বামীর মারাত্মক ত্রুটির জন্য স্ত্রী স্বেচ্ছায় স্বামীকে ছেড়ে যেতে পারে, তবুও প্রচলিত তালাক বিধানে তারা খুশি নয়, সন্তানের মালিকানা প্রশ্নে, নারীর শরীর থেকে যে সন্তান বের হয়, নারী সেই সন্তানের দাবী করতে পারে না, এটা তাদের বিবেচনায় অমানবিক। সর্বোপরি তারা জরায়ুর স্বাধীনতা চাওয়ারও পক্ষ্যে। তাদের বক্তব্যে এটাও স্পষ্ট যে, বিবাহের বাইরে নারী যতই অর্থনৈতিকভাবে সফল হোক না কেন, বাংলাদেশের সমাজে এটি কোন স্বীকৃত পরিচয় নয়। তাদের আলোচনায় এটাও এসেছে যে, বাংলাদেশের সমাজে বিয়ের মাধ্যমে পুরুষের আধিপত্য ও নারীর যৌন পবিত্রতা নিশ্চিত হয়, ফলে নারী স্বাভাবিকভাবে পুরুষের নীতি আদর্শের খাচায় বান্দী হয়ে পড়ে। তারা এটাও বুঝতে পারছে যে মুনাফা কেন্দ্রিক বাজার অর্থনীতিতে নারী উৎপাদন সহযোগী হিসেবে সবচেয়ে সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে। এ কারণে তাদের বক্তব্য হল, নারীর শ্রমকে অবমূল্যায়ন করার ফলে নারীরা পুরুষের অধীনে নিষ্পেষিত, মর্যাদাহীন। তারা উদাহরণ পেশ করে বলে, নারী কিভাবে পুরুষের পর্যায়ে রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করবে ? যেহেতু বেতন বৃদ্ধি, কাজের অবস্থান বদল, বাচ্চা রাখার স্থান, ছুটি, ওভার টাইম, সুবিধাজনক রোষ্টার, কর্মস্থালে নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে অফিসের আলোচনা সভার আলোচ্যসূচীতে নারীরা অন্তর্ভূক্ত করতে পারে না। তাদের দাবী রাষ্ট্র যদি নারীর জীবন ব্যাবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করে তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক অঙ্গণে নারীর অবাধ বিচরণের অধিকার দিতে হবে, যদি তা না হয়, সেটা কি রাষ্ট্রীয় ভাবে নারীকে নিগৃহীত করা নয় ? এদেশীয় নারীবাদীদের উগ্র মেজাজটা এসেছে এলিজাবেথ কেডি স্ট্যানটনের বক্তব্যের রেশ ধরে, তার মতে, নৈতিকতার পশ্নে নারীরা পুরুষের উপরে। ব্যক্তিক ক্ষেত্রের মূল্যবোধ লালন করায় নারী আধ্যাত্মিক ভাবে শক্তিশালী, উন্নত নৈতিকতার অধিকারী ও সত্য-ন্যায়ের পক্ষপতি। আন্যদিকে পুরুষ বাইরের জগতে কর্মময় থাকায় অন্যায়, অবিচার ও অসত্যের পথে চলে গেছে। অধিকমাত্রায় স্বার্থপরতা ও চাতুরতা চর্চা করায় রাজনীতিকেও পুরুষ কলুষিত করেছে। শক্তি প্রয়োগের প্রবণতা আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভাঙ্গির দরুণ পুরুষের কারণেই দ্বন্দ্ব বিরোধ সংঘর্ষ ও যুদ্ধ বিগ্রহ বৃদ্ধি পায় বলে উদার নারীবাদীগণ মত প্রকাশ করে পুরুষের একচ্ছত্র রাজনৈতিক অধিকারের বিরোধীতা করছে।" পাশ্চাত্যে উচ্ছৃংখল ও মোহগ্রস্থ পুরুষের দ্বারা উপেক্ষিত নারীদের মানসিক সংকট থেকে উচ্চারিত মন্তব্যের ভিত্তিতে এলিজাবেথ কেডির মত অনেকে পুরুষের জীবন চরিত্রচিন্তাকে প্রত্যক্ষভাবে ঘৃণা করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। সিমন দ্য বুভোয়ার তার 'সেকেন্ড সেক্স' এ প্রশ্ন তোলেন, কেন নারীর স্থান সব সময় পুরুষের তুলনা করে অধস্তন হিসেবে ধরা হয় ? রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সার্বিক সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী কেন অদৃশ্য কিংবা প্রান্তিক অথবা সেকেন্ড সেক্স ? পাশ্চাত্য লেখকদের এসব খোলামেলা বক্তব্যের দ্বারা উৎসাহিত হয়ে এদেশের অনেক লেখক, নারীর জীবন গাথাঁ এমনভাবে রচনা করতে উদ্যোগী যে, তারা বুভোয়ার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বলেন, "কেউ নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করে না, নারী হিসেবে তৈরী হয়।" পাশ্চাত্যের লাগামহীন বক্তব্যের উৎসাহিত এদেশীয় লেখকদের কারো কারো কলমে এমন বাক্য লেখা হয়, বিষে বেশ্যাবৃত্তির লাইসেন্স (নাউযুবিল্লাহ)। আবার বলা হয়, নারীরা ঐতিহাসিকভাবে দ্বিতীয় শ্রেনীর পশু। এসব চিন্তাধারা ব্যপকভাবে সমাজের শিথিল, উচ্চ শিক্ষিত অনিয়ন্ত্রিত স্তরে নারী পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরণের নৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। বুভোয়ার প্রশ্ন করেন, নারী কেন সেকেন্ড সেক্স বা অধস্তন শ্রেনী ? এ প্রশ্নের উত্তরে আমরা কি বলব ? যারা গোটা মানবজীবনকে একটা সুন্দর পরিণামের দিকে চালিত করার উদ্যেশ্য নিয়ে প্রতিদিনকার দায়ত্ব ও কর্তব্যকে কোন রুপ আধ্যাত্মিক অঙ্গীকারের প্রকাশ হিসেবে দেখেন না, বরং নারীর শ্রমকে বস্তুগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের কাছে নারী তো নিশ্চয়ই সেকেন্ড সেক্স। কিন্তু আমাদের কাছে নারী সেকেন্ড সেক্স বা অধস্তন শ্রেনী না, কারণ আমরা নারীকে পুরুষের পরিপুরক সহযোগী সঙ্গি হিসেবে দেখি যা একটি কল্যাণকর সমাজের জন্য অতীব জরুরী। অথচ শুলামিথ ফায়ার স্টোনের-ডায়ালেকটিক অব সেক্স' এ নারীর যৌন নির্যাতনকে রাজনৈতিক নির্যাতন হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। কারণ তার ধারণা, লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে নারীকে নিম্ন শ্রেনী হিসেবে গণ্য কার হয়। তার মতে, পুরুষের ক্ষমতা চর্চা ও যৌন নিপীড়নের কারণে নারী শ্রেণী বৈষম্য ও শ্রেণী শোষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে।

উপরের বক্তব্যের আলোকে এটা বোঝা কষ্টকর নয় যে, পরাজিত ও উপেক্ষিত সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ সামনে রেখে নারী-পুরুষের সম্পর্ক বিশ্লেষণের বিষয় কার হয়েছে। সমাজতন্ত্র কবির কাব্যচর্চাকে যেমন উৎপাদন সামগ্রী মনে করে তেমনি নারীর গৃর্হস্থালির কাজকর্মকেও। সমাজতন্ত্রের দৃষ্টিতে নারীর গার্হস্থ্যকর্ম, যা স্বামীর সহযোগিতা ছাড়াই করতে হয়, তা একটি উৎপাদনশীল শ্রম, এবং সেটা আর্থিক মূল্যে বিক্রয় যোগ্য, অথচ এদেশে গণতান্ত্রিক পুজিঁবাদরে বিকাশ ঘটায় নারী প্রত্যক্ষভাবে তার গ্রহকর্মের মজুরী থেকে বঞ্চিত। পাবলিক কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ে চাকুরিবিধি মেনে কাজ করে কিন্তু প্রাইভেট কর্মক্ষেত্রে অর্থাৎ পরিবারের মধ্যে কেবল নারীই সনাতন পদ্ধতিতে গৃহকাজে লিপ্ত হয়, পুরুষ ঘরের কাজ করে না। এভাবে দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সামন্তবাদ, পুজিবাদ বিংবা সমাজতন্ত্র সর্বত্রই নারীর অবস্থান পুরুষের নীচে।

প্রকৃতির বিধান নারীকে পুরুষের অধীন করে দিয়েছে- হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা এই প্রথা, আধুনিক কালে যথেষ্ট প্রশ্নের সম্মুখীন। পুজিবাদে নারীর গার্হস্থ্যকর্মের নগদ বিনিময় না দিলেও, নারীকে পুরুষের অধীন থাকার রীতিটা বাজায় রাখার পক্ষে, কিন্তু সমাজতন্ত্রে নারী পুরুষের সম্পর্কেল সম্পূর্ণ উল্টে দেয়। কারন মার্ক্স ও এঙ্গেলস সমাজসত্তার বিকাশে পরিবারের ধারণাই স্বীকার করতে চান না। সমাজের মূল বুনিয়াদ যে পরিবার ব্যবস্থা সেটাই যখন মার্ক্সীয় ফিলোসফীতে অস্বীকৃত, তখন প্রথাবদ্ধ নারী পুরুষের সম্পর্ককে বস্তুগত শ্রম-সেবার ভিত্তিতে বিচার্য হবে সেটাই স্বাভাবিক। যেহেতু সমাজের দিনমজুর, শ্রমজীবি ও শেষিত শ্রেনীর কাছে সমাজতন্ত্র কেবল একটি অর্থব্যবস্থাই ছিল না, তা ছিল একটি বিশ্বাস। Communism to them is not scientific Marxism Leninism but a Religion ! সমাজতন্ত্রে পরিবার না ভেঙ্গে সমাজতন্ত্র সার্থকভাবে বিকশিত হতে পারে না, সেহেতু সেখানে নারী-পুরুষের পারিবারিক সম্পর্ক যা ধর্ম কর্তৃক আরোপিত, তা উপেক্ষিত হয়েছিল এবং সেক্ষেত্রে নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে নিপীড়িত নারীর জন্যও মার্কসের একটি সমাধান ছিল। বস্তুত, মার্ক্সীয় নারীবাদের মধ্যে প্লেটোর নারীবাদের উত্তরাধিকার বহনের চিহৃ দেখা যায়। প্লেটো সার্বভৌম নগর রাষ্ট্রের স্বার্থে পরিবার কাঠামোকে ভাঙতে চেয়েছিলেন। সমাজতন্ত্র সতাদশক কষ্টকর লড়াইয়ের পর পুজিবাদের কাছে হেরে গেলেও, জীবন সমাজ ও পরিবারকে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোন থেকে দেখবার প্রবণতা শেষ হয়ে যায় নি। বরং আধুনিক নারীবাদী চিন্তায় সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের বস্তুকেন্দ্রিক ধারণাগুলো প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। ফলে নারীর সন্তানের জন্মদান, তার শিশুকে প্রতিপালন ও স্তণ্যদান যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা তা একেবারেই তুচ্ছ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যদিও প্রাচীন গ্রীস ও বিশশতকের মাঝে আড়াই হাজার বছরে পাশ্চাত্যে নারীর চিরন্তন রুপ ইসলাম আবির্ভাবে আরো বেশি সুন্দর ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে প্রাচ্যের মুসলিম সমাজে। কিন্তু যদি নারীর ক্রমবর্ধমান শিক্ষায় ব্যাক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে এবং পুরুষের পাশাপাশি দাড়িয়ে জীবন ও জগততের সমস্যা মোকাবেলায় যথার্থ ভূমিকা পালনে উৎসাহী না হয় তাহলে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব কর্তব্য ও একই সমাজে বসবাস করার কারণগুলো নতুনভাবে খুজে দেখার প্রয়োজন হবে।

নারীমুক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো সামাজিক ধর্মীয় তথা প্রাকৃতিক মূল্যবোধ যা বিশ্বের রাজধানী শহরগুলোর রাজপথে শ'পাচেক উগ্রনারীর মিছিলে শ্লোগানে সম্পূর্ণ বাতিল হতে পারে না। যদি তা হতো তাহলে, ইসলামের আবির্ভাবের আগে, যিশু খৃষ্টের আগমণেরও সহস্র বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীক সভ্যতায় নারী ও পুরুষের ভুমিকার যে রুপ রেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তা কোন ঐশী ধর্ম গ্রন্থের সত্যায়ন ছাড়াই সমাজে বিধিবদ্ধ হয়ে গেছে। গ্রীক যুক্তিবাদী দর্শনে, প্রথমত নারী ও পুরুষ প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন; এবং এদুয়ের মধ্যে সমন্বয় রফার মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও শৃংখলা রক্ষিত হয়। দ্বিতীয়ত : নারী ও পুরুষের ভুমিকা পরস্পর বিপরীত ও প্রকৃতি নির্ধারিত পরিকল্পনা একে অন্যের সম্পুরক। এভাবে সমাজের প্রয়োজনগুলো দুটি স্পষ্ট পরিমন্ডলে ভাগ করা যায় যা প্রকৃতির ও নারী পুরুষের সামর্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তৃতীয়ত : বহিরাঙ্গনের ভারী কাজ-সামরিক তৎপরতা, সামাজিক জীবন যাত্রা তথা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পুরুষের। অন্যদিকে অন্তরাঙ্গনে, কম শক্তির কাজ, অনেক বেশি ভালবাসা, মমতা ও শিশু লালনপালন মেয়েদের দায়িত্বে ন্যস্ত। চতুর্থত : পুরুষ অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিমান, সাহসী, উৎকৃষ্টতর, অন্যদিকে নারী দূর্বল, অসম্পূর্ণ, যুক্তিবর্জিত আবেগপ্রবণ। প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো নারী ও পুরুষের উপর্যুক্ত মূল্যমান কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামান্য রদবদল ঘটলেও অধিকাংশ চিত্রায়নটা বাস্তবতার দিক থেকে ঠিক আছে বলে মনে হয়। নারী-পুরুষ উভয়ের শারীরীক ও মানসিক যোগ্যতা সাপেক্ষে সমাজ ও পরিবারে তাদের স্থান গ্রীক যুক্তিবাদী দর্শনে যেভাবে নির্ধারিত হয়েছে, আধুনিক কালের সূচনা লগ্নেও সেটা সঠিক বলে সমর্থিত হয়েছে। 'এ ফাদারস লিগ্যালি টু হিস ডটার্স' গ্রন্থে ড: গ্রেগরী, রুশো তার 'এমিলি' নামক শিক্ষাবিষয়ক গ্রন্থে জেনোফেন ও অ্যারিষ্টেটলের ধারনাই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। রুশো মনে করেন, প্রকৃত স্বভাবচরিত্র ঐতিহ্য, সামাজিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে শৃংখলিত, তবু তিনি বিশ্বাস করেন, নারীদের বিদ্যমান মর্যাদা ও কর্মভুমিকা যথার্থই স্বাভাবিক। পুরুষের কাছে নারীর বশ্যতা তার বিবেচনায় নিপীড়কর নয় বিপরীত, পুরুষ সক্রিয়, নারী নিষ্ক্রিয়, পুরুষ শক্তিমান ও যুক্তিবাদী, নারী দূর্বল ও যু্ক্তিহীন, পালনের মতবাদে বিশ্বাসী রুশোর অভিমত, পুরুষের সেবা, সুখ বিধান, সন্তান দান ও লালনের জন্যই নারী'। বিশ শতকে ড: স্পোকের মতে নারীরা সূক্ষ্ণ প্রতিভার মহৎ উচ্চতায় উন্নীত হলে পরিবার ও সমাজের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে ঘৃণা করে। সে কারণে পাশ্চাত্যে নারীর ভোটাধিকার ঠেকিয়ে রাখার জন্য পুরুষেরা দল বেধে বিরুধীতা করেছিল। নারীকে রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ পদ না দেয়ার পক্ষে ড: বারম্যান সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল পত্রিকায় বলেন, ধরেন হোয়াইট হাউসে আমাদের এমন মহিলা প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাশীন রয়েছেন যিনি এমন সময় রজোনিবৃত্তিজনিত মনোবিকারে ভুগছেন যাকে ঐ মুহুর্তে 'বে অব পিগস' সঙ্কটজনিত কারনে তাৎক্ষণিক ও অতিগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেমন হবে সেটা ? তবু পরিস্থিতির যদি আদৌ কোন হেরফের না ঘটে তাহলেও আমি একজন নারীর চেয়ে তার অনুরুপ বয়সী জন এফ কেনেডীর পক্ষপাতি যিনি কিউবার মিশাইল সংকটের প্রশ্নে স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেবেন। আমি চাইব না ঐ মহিলাটি সিদ্ধান্ত নিন যার রজোনিবৃত্তিকালীন সঙ্কটময় বয়োসন্ধির কারণে যে কোন সময়ে তার অদ্ভুত মনোবিকারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মর্গারেট রীড, বেটি ইয়রবুর্গ, ন্যুটসন ও উলফেন স্টাইনের জীবতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বি কিংবা মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের বিচারে পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নারী ও পুরুষের পঠন, গড়ন, ও আচরণের উল্যেখযোগ্য পার্থক্য ধরা পড়ছে না যার ভিত্তিতে সমাজে নারী পুরুষ মূল্যায়ন বৈষম্যের প্রথাগত একটা কাঠামো তৈরী হতে পারে; এ তথ্য আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভাবিত আধুনিক উত্তর যুগে বিশ্বাস করে নিতে পারি, কিন্তু সমাজকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সমাজের মূল বুনিয়াদ পরিবার প্রতিষ্ঠান কি অটুট রাখার প্রয়োজন নেই ?

পুরুষের কাছে নারীরা অধস্তন, ঈশ্বরের নির্দেশ 'স্ত্রী-স্বামীর বৈশ্য হবেন', গৃহ- ই নারীর প্রকৃত অবস্থানস্থল, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন প্রাচীন প্রথাবাদী সংস্কার হিসেবে আধুনিক নারীবাদীরা যদি এসব উপেক্ষা করে এবং নারী জীবনকে বন্দী করে রাখার কৌশল হিসেবে এগুলো থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসতে চায় তাহলে স্বভাবত প্রশ্ন উঠে- তাদের যাত্রার গন্তব্যস্থল কোথায় এবং তারা সমাজ ও পরিবার সত্যি চায় কি না ?

আধুনিক নারীমুক্তির আন্দোলনে যারা অগ্রনী, নিশ্চয়ই তাদের প্রেরণার উৎস হতে পারে ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল, ক্যাথারিন দ্য গ্রেট, মার্গারেট থ্যাচার, ইন্দিরাগান্ধি, কিংবা শ্রীমাভ বন্দারনায়েক অথবা সাহিত্যিকদের মধ্যে ভার্জিনিয়া উলফ, বেগম রোকেয়া, অথবা অরুন্ধতী রায়। এরা সকলে সংকীর্ণ দৃষ্টির উর্দ্ধে, মানুষ ও মানবতার সেবায় কেউ প্রশাসন পরিচালনা করে, কেউ কলম চালিয়ে কেউবা স্বহস্তে আহতকে সেবার মাধ্যমে বাচিয়ে তুলতে আত্মোৎসর্গ করেছেন। তাদেরকে অনুসরণ করে শতশত নারী সমাজের বিভিন্ন পেশায় আত্মনিয়োগ করার জন্য উৎসাহিত। একথা আমরা আনন্দের সঙ্গে উচ্চারণ করব। কিন্তু পুরুষ শাসিত বিশ্বে, যে সব নারী আপন মহিমায় সমোজ্জ্বল ও খ্যাতিমান হয়েছেন, তারা কি গোটা নারী সমাজের প্রকৃত যোগ্যতার প্রতিনিধিত্ব করেছে, না তাদের তাদের মধ্যে পুরুষের গুণাবলী বিকশিত হওয়ায় একটি বর্গ হিসেবে তারা গণ্য হচ্ছে ? নারীবাদীরা বার বার একটি অভিযোগ উত্থাপন করছে, পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা অত্যাচারিত, নির্যাতিত, পিতার নিয়ন্ত্রন থেকে বিয়ের মাধ্যমে স্বামীর নিয়ন্ত্রনে যাওয়া, নারীবাদীদের পরিভাষায় 'আরোপিত নির্বাসন' এবং ধর্ম ও ইশ্বরের দোহাই দিয়ে পুরুষ সমাজ নারীর ইচ্ছার স্বাধীনতা হরণ করছে, আর সে কারনেই আজ নারীমুক্তির প্রশ্ন উঠছে, নারীর স্বাধীনতার বিষয়টা একটা রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। নারীবাদীদের ঐ অভিযোগগুলোর উত্তর দেয়ার আগে আমাদের জানা দরকার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুক্তমনের নারীরা কি ধরনের পুরুষ বা পুরুষসমাজ প্রত্যাশা করে ? উত্তর হবে, নারীদের ইচ্ছে মত। কিন্তু বাস্তবে নারীর রহস্যময় স্বাধীন ও অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছার অনুরুপ পুরুষ বা পুরুষসমাজ নিশ্চিত করে পাওয়া সম্ভব নয় একারণে যে, পুরুষরা জানে এবং বিশ্বাস করে, তাদের একজন ইশ্বর আছেন এবং তিনি পৃথিবীতে পুরুষকে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন এবং সেই উদ্দেশ্যপূরণের জন্য, তাদের বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা তাদের চলার পথের ক্লান্তি দূর করার জন্য নারী নামের একটি প্রজাতিকে সঙ্গি করে দেয়েছেন। এদের সঙ্গে খাওয়া-চলাফেরার জন্য কিছু বিধিবিধান ও সেই সঙ্গে দেয়া হয়েছে; অতপর পুরুষ সমাজ সেই বিধিবিধানকে অমান্য করে চলাকে একটি জঘন্য পাপ বলে মনে করে এবং সেকারণে তারা নব্য নারীবাদীদের দাবী, জরায়ুর স্বাধীনতা, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পদের উত্তরাধিকার প্রভৃতি একদম ছেড়ে দিতে পারেন না। এক্ষেত্রে নারী বাদীদের বক্তব্য কি ?

এ প্রশ্ন একারণে উত্থাপিত হওয়া যুক্তিসঙ্গত যে নব্যনারীবাদীরা পুরুষ শাসিত সমাজে তাদের জন্য ভাল কিছু দেখতে পায় না। তাদের চোখে পড়ে, নারী শ্রমিকের কম মজুরী, এবং যৌন নির্যাতন। তাদের মনে হচ্ছে সারা বিশ্বের পুরুষেরা শুধু নারীকে কম বেতনে খাটানো এবং যৌন নিপীড়ন চালানোর জন্যই বেচে আছে। আর এই দুটি ঘটনাকে সামনে রেখে নারীবাদ নারী-পুরুষ সম্পর্কের সরল মেরুকরণ করেছে। আসলে এভাবে যদি নারী-পুরুষ সম্পর্ক মূল্যায়ন করা হয় তাহেল, নারী সমাজকে স্বীকার করতে হবে, তাদের কোন সৃষ্টিকর্তা নেই, তাদের কোন পরিবার সন্তান সন্তুতির প্রয়োজন নেই এবং তারা কেবল পুরুষ নামের দস্যু নিপীড়কের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। সমাজে পুরুষ কর্তৃক নারীরা নিগৃহিত সে কথা উদাহরণ সহ স্বীকার করেও নারীবাদীদের ঐ ইশ্বর ধর্ম-সমাজ ও পরিবার বিহীন একটি উগ্র জীবনের লালসায় উদ্ধোধিত প্রজাতি হিসেবে ধরে নেয়া যায়। কারণ, যখন তারা বিবাহ আইন, সন্তানের অভিভাবকত্বের আইন, সম্পদের উত্তরাধিকার আইন অথবা আত্মপবিত্রতার বিষয়গুলো মানতে চায়না, তখন তারা প্রকাশ্যে ঈশ্বর ও ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে; যা মানব সভ্যতা টিকে থাকার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরুপ। বর্তমানের আর্থসামাজিক পরিবেশে নারীকে, বাস্তব প্রয়োজনে কলে কারখানায়, অফিসে-স্কুলে কাজ করতে হচ্ছে, এটা পুরুষের সঙ্গে একটি সমৃদ্ধ ও সুখী পরিবার প্রতিষ্ঠায় নারীর বিশেষ অবদানমূলক কাজ, এটা ইহুদী, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু কিংবা ইসলাম সব ধর্মই প্রশংসার সঙ্গে সমর্থন করে। এটা নারী সমাজের কাছ থেকে পুরুষের জন্য একটি বাড়তি পাওনা যার প্রশংসা নারীর প্রাপ্য। নারীবাদীরা বলেছে, নারীরা বেগম রোকেয়ার ভাষায় 'অবরোধবাসিনী' পর্দার মধ্যে বন্দিনী আসলে এটা ইসলামের একটি নিয়মকে সামাজিক প্রথায় পরিণত করে শত শত বছর যাবৎ পুরুষ সমাজ নারীকে গৃহাভ্যন্তরে অশিক্ষিত অবস্থায় রেখে দুটো ক্ষতি করেছে। এক. অবরুদ্ধ নারীকে শিক্ষিত না করে ইসলামের পূর্ণ সেবক হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দুই. নারীর অবরুদ্ধ থাকার ঘটনাটি ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক আদর্শের উপর উপর একটা কালিমা লেপন করেছে। আর সেকারণে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পাশ্চাত্য শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ নারীর কোন নিগূঢ় চিন্তা না করেই ইসলামী সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সুযোগ গ্রহণ করে। একজন তাসলিমা নাসরিনের উদ্ভবের পিছনে এধরণের পরিবেশই দায়ী। যে পুরুষ বা পুরুষ সমাজের কাছে নারীরা অকারণে নিগৃহীত ও লাঞ্চিত তাদেরকে কোন্ ধর্ম বা সমাজ সাধুবাদ জানায় ? এমন অত্যাচারী পুরুষ বা পুরুষ সমাজের জন্য কোন ধর্ম বা সমাজ অভিনন্দন জানায় না, বরং ঘৃনা করে। যদি না করে সেটা কোন ঐশী ধর্ম নয়, বা মানুষের সমাজ নয়। এদশে নারী মুক্তির আন্দোলনে যারা অগ্রনী হয়েছে তারা কেবল মনের খায়েশে রাস্তায় নেমেছে সে কথা মোটেই বলা যাবে না, বরং তারা যখন দেখছে, যৌতুকের লোভে স্বমী স্ত্রীকে খুন করছে, পাশবিক লালসা মিটানোর লোভে কিশোররীর সম্ভ্রমহানী করছে, এসিড নিক্ষেপ করে নারীর মুখমন্ডল ঝলসে দেয়া হচ্ছে, পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে ভাই বোনকে বঞ্চিত করছে, এবং গার্মেন্টস শিল্পে নামে মাত্র বেতনে নারী শ্রমীকেরা খেটে মরছে, ছুটি নেই নিরাপত্তা নেই- এসব ঘটনা যখন ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলছে তখন স্বাভাবিকভাবে শিক্ষিত অগ্রসর নারী সমাজ এসব অত্যাচার নিপীড়ন বন্ধের জন্য আন্দোলন করতে পারে, সেটা অবশ্যই মানবতার স্বার্থে কল্যাণধর্মী কাজ। কিন্তু সমাজে পরিবার সংঘঠনটি যে বুনিয়াদী বিধিবিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেটাকে ভেঙ্গে ফেরার জন্য যদি নারীবাদীদের মধ্যে পুরুষ বিদ্বেষ গড়ে উঠে তাহলে সামাজিক কাঠামোটা কিন্তু ধ্বসে পড়তে বাধ্য। সম্প্রতি বাংলা ভাষায় রচিত নারী বিষয়ক কিছু গ্রন্থের নাম উল্লেখ করছি যা প্রধানত নারী এবং তার সামাজিক সমস্যা তুলে ধরে লিখিত। যেমন : নারীর অধিকার ও অন্যান্য-সুফিয়া কামাল, নারী ও অন্যান্য প্রসঙ্গে- হাসনা বেগম, রাজনৈতিক নারীর অভ্যুদয়- (অনুবাদ) - রিটামেকেলিও মেরিবুটিলিয়ার, নারীবাদ ও দার্শনিক প্রেক্ষাপট- রাশিদা আখতার খানম, নারী প্রতিনিধিত্ব ও রাজনীতি, সম্পাদন- মেঘনাগুহ ঠাকুরতা, নারীকোষ- মাহমুদ শামসুল হ, নারীবাদ - শাহবুদ্দীন নাগরী, লীলা রায় ও নারী জাগরণ, নারী - হুমায়ুন আজাদ। এসব নারী সম্পর্কিত গ্রন্থে চলমান সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা যেভাবে শোষিত বঞ্চিত ও নির্যাতিত হচ্ছে তার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নারীকে শোষন ও নির্যাতন করা উচিত নয়। কেন উচিত নয়, তার পক্ষে মানবিক, জৈবিক, নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি পরিবেশিত হয়েছে এবং নারীবাদী লেখকরা, দুএকজন বাদে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক সামাজিক রীতিনীতিকে দায়ী করেছেন।

কিন্তু কোরআনে বর্ণিত নারী-পুরুষ এর সম্পর্কগত রুপরেখা বিষয়ে তাদের জানা থাকুক বা না থাকুক, কেউ ই ইসলাম ধর্মকে দায়ী করেননি। তবু পাশ্চাত্য নারীবাদের সূত্রে আস্থাশীল মুসলিম সমাজের শিক্ষিত প্রাগ্রসর নারীদের সুবিধার্থে নারীর সমতা ও নারীর নৈতিকতা কোরআনের আলোকে কিছুটা বিশ্লেষণ করা দরকার।

পিথাগোরাস নারীর কিছু 'পরম গুণ' আছে বলে উল্লেখ করেছেন যেমন- সতীত্ব, ধর্মভীরুতা, আনুগত্যশীলতা, কমনীয়তা, নম্রতা, বিনয় ও সাংসারিকতা- এগুলো বাদ দিলে আসলে আমাদের সামনে নারী বলে কিছু থাকে কি ? অন্যদিকে রুশোর ভাষায়, পুরুষের পরম স্বভাব শাক্তিমানতা, সাহসিকতা, যুক্তি নির্ভরতা, শাসক শোভনতা, তথা ক্ষিপ্র কর্মতৎপরতা- এগুলো যদি পুরুষের চরিত্র থেকে বাদ দেয়া হয়, তাহলে নারীর পরম গুণ বিবর্জিত যে নারী কঙ্কাল তার সামনে পৌরুষের গুণাবলী বর্জিত পুরুষকঙ্কাল- বিষয়টা কেমন দেখায় ? নিশ্চয়ই দুটি জন্তু জানোয়ারের ছবি। মানুষ হিসেবে, গুণবর্জিত- এ দুটি নারী-পুরুষ স্রেফ কঙ্কাল যা কোন তাৎপর্যই বহন করবে না। ঠিক এ কারণে প্রাচীন কাল থেকে নারী ও পুরুষের সহজাত দোষগুণের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে নারীর জন্য ঘর ও গৃহস্থলি, পুরুষের জন্য সমাজ ও রাজ্য শাসন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই চিরন্তন বিধি-নিষেধের বেড়াজাল যদি বর্তমান সমাজে আর্থসামাজিক সমস্যার জন্য উদ্ভুত নারী-পুরুষ সংঘাতের প্রেক্ষিতে উপড়ে ফেলার কথা কেউ বলে তাহলে অবশ্যই হতাশাই বাড়বে ।কারণ প্লুটার্ক এর ভাষায়- 'আমরা প্রাচীন রাজা, সভ্যতা, সাহিত্য, কিংবা থিয়েটারহীন নগরীর কথা জানি, কিন্তু কখনোই উপাসনালয়হীন কোন নগরীর কথা জানি না।' প্লাটুক এর দু হাজার বছর পর,ফরাসী দার্শনিক বার্গসোঁ বলেন, বিজ্ঞান-শিল্প-দর্শনহীন সমাজ অতীতে ছিল এবং বর্তমানেও আছে। কিন্তু ধর্মহীন সমাজের অস্তিত্ব কখনো ছিল না, এখনো নেই। ' অতএব এই দুজন দার্শনিকের বরাত দিয়ে নবীনারীবাদীদের কাছে এই বার্তা পৌছে দেয়া যুক্তিসঙ্গত যে, নারীরা যা চায়, বিশেষত নবীনারীবাদ, তা যদি আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির জন্য উদ্ভুত নারী বৈষম্যদূরীকরণ হয় তাহলে সেটা তাদেরকে প্রচলিত ধর্ম-সমাজ ও ঈশ্বরের বিধিবিধানের আওতার মধ্যে থেকেই অর্জন করতে হবে। জনৈক নারীবাদী লেখক, তার চিন্তা-কল্পনা ও চেতন-অবচেতনে সর্বত্র দেখেন নরী-পুরুষের নগ্ন রতিচর্চা আর বড় বড় নখের দাগ, এটা এক ধরনের মনোবিকারগ্রস্ত লোকের ব্যাক্তিগত অধ্যাস হতে পারে, সমাজের স্বাভাবিক চিত্রের প্রতিভাস নয়। আর এমন লেখকদের রচনা পড়ে একলা ঘরে যারা, কয়েক মুহুর্তের উত্তেজনার মধ্যে যৌবন ও জীবনরে সার্থকতার স্বপ্ন দেখেন- কেবল তারাই সবকিছু অস্বীকার করার জন্য নির্বিচারবাদী হয়ে উঠেন। অথচ আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি ক্ষুদ্র উপজাতীয় গোষ্ঠি (সওতাল বা গারো) যখন বিবাহকে রীতিবদ্ধ করছে, ধর্মের অনুভুতি দিয়ে জীবনের মঙ্গল-অমঙ্গল পার্থক্য নির্ণয় করতে চাইছে, ক্ষুদ্র সমাজে শৃংখলার জন্য কিছু নিয়মকে গড়ে তুলছে তখন আমরা কি আইন শুন্য রাষ্ট্র, রীতিহীন সমাজ, ঈশ্বরহীন ধর্ম এবং পবিত্রতাবোধ শুন্য নারী-পুরুষের সম্পর্ককে প্রত্যাশা করতে পারি ?

যখন নারী পুরুষের সম্পর্ক ও সমাজ-রাষ্ট্রের কাঠামো নির্মানের কথা উঠে তখন স্বাভাবিকভাবে নিয়ম কানুনের কথা আসে। একজন অন্যজনের জমি যেমন দলিলবিহীন ভোগদখল করতে পারে না., তেমনি নারী-পুরুষ পরস্পর একটা নিয়ম ও নৈতিকতার বন্ধন ছাড়া পরস্পর একত্রে থাকতে পারে না। এখন কথা হলো সেই নিয়ম ও নৈতিকতার উৎস কি ? যারা Live togather এ বিশ্বাসী হয়ে উঠছে তাদের জন্য না প্রয়োজন পরিবার, না দরকার সমাজের। কারণ যেখানে আইন নৈতিকতার ভিত রচন করে দেয় না বা নৈতিকতা আইন তৈরীতে সাহায্য করে না, সেখানে বস্তুত পক্ষে মানুষ সভ্য হতে পারে না। আমরা সভ্যভাবে বেচে থাকব, এবং সেই থাকার একটা মহৎ তাৎপর্য থাকবে এই যে ধারণা তা আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মের কাছ নিয়ে যায়। যেহেতু আমরা বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের অন্তভূর্ক্ত সেহেতু ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থকে আমরা মহান প্রাপ্তি হিসেবে জানি এবং ধর্মের বিধানগুলো আমাদের কাছে পবিত্র, অবশ্য পালনীয়। " আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ।" (সূরা বাকারা : ২২৮)।

নারী ও পুরুষ পরস্পরের উপর অধিকার আছে। তবে কোরআনে আল্লাহ একটি কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন , 'আর নারীদের উপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে"। পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে বলার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ নিজের সম্পর্কে বলেছেন, আর আল্লাহ হচ্ছেন পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।' মহাজ্ঞানী আল্লাহ নারী ও পুরুষ উভয়কে সৃষ্টি করেছেন এবং কি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন সেটা তিনি ভালই জানেন, এবং সেই মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নারী ও পুরুষের মধ্যে কে কর্মতৎপরতায় অগ্রগন্য সেটা স্রষ্টা হিসেবে মহান আল্লাহ কি জানেন না ? যে কোন মানুষের চেয়ে তার জানাটাই সঠিক ও সর্বোত্তম। কারণ তিনি স্রষ্টা এবং বিধান দেয়ার মালিকও তিনি। পুরুষকে নারীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া দেয়া হয়েছে। কোরআনের এই তথ্য বা আয়াত এসেছে দেড় হাজার বছর আগে। কোরআন নাযিল হওয়ার হাজার বছর আগে থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আড়াই হাজার বছরের মানবসভ্যতার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে, আমরা কি দেখিনা, জ্ঞান বিদ্যা বুদ্ধির দিক থেকে সর্বদা পুরুষ নারীর অবস্থান থেকে উর্ধ্বে এবং প্রাকৃতিক ভাবে সত্য হিসেবে সমাজে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের যথার্থ কারণগুলো সব সময় বিদ্যমান রয়েছে। এখানে আধুনিক নারীবাদে নারীর সমতার প্রশ্নটি যাচাই করে দেখার প্রয়োজন পড়ে।

নারীবাদীরা যে সমতার কথা তুলছে, তা যদি কেবল চাকুরী গৃহকর্ম তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে পুরুষের যোগ্যতার সমকক্ষ হয়, তাহলে সেই সমতা পুরুষ যখন মেনে নিতে বাধ্য হয়, তখন নারীকে দেনমোহর দিয়ে বিয়ে করার বিধানটা নারীরা বজায় রাখতে চায় কেন ? নারী-পুরুষের অধীনের থাকার যোগ্য এবং সেকারণে আল্লাহ পুরুষকে নারীর মনোসন্তুষ্টির জন্য বিয়ের সময় দেনমোহর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব এটা বিয়ের সময়ে পুরুষের পক্ষ তেকে আদায় করা একটি ফরজ কাজ। "তোমরা স্ত্রীদেরকে তাদের মোহর দিও খুশীমনে" ইসলামে মোহরানা দিয়ে পুরুষ নারীকে স্ত্রীর মর্যদায় উন্নীত করছে এবং এটি যেমন একটি পবিত্র বন্ধন, তেমনি এটি একটি দেওয়ানী চুক্তিও বটে। স্বামীকে অপছন্দ হলে, মারাত্মক ক্রুটি থাকলে স্ত্রী এ চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে এমন ইচ্ছা স্ত্রীর রয়েছে। অতএব এক্ষেত্রে পুরুষ নারীর উপর শ্রেষ্ঠ; তাই বলে নারী পুরুষের দ্বার অত্যাচারিত হবে, সেটা ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। বরং কোরআনের নির্দেশ, " নারীদের সাথে সদ্ভাবে জীবন যাপন কর"। বর্তমান সমাজে কি বিদ্যমান সেটা বড় কথা নয়, কোরআন মৌলিকভাবে পুরুষের কাছে নারীর প্রতি যে ব্যাবহার দৃঢ়ভাবে প্রত্যাশা করে সেটাই আমাদের মত বিশ্বাসী মুমিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

"যদি তোমরা এক স্ত্রীর স্থলে অন্য স্ত্রী পরিবর্তন করতে ইচ্ছা কর এবং তাদের একজনকে প্রচুর ধনসম্পদ প্রদান করে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরত গ্রহণ কর না। তোমরা কি তা অন্যায়ভাবে ও প্রকাশ্য গুনাহর মাধ্যমে গ্রহণ করবে ?" (সুরা নিসা : ২০)।

যা নারীকে বিয়ের সময় দেয়া হেয়েছে তা তাকে বিদায় করার সময় ফিরিয়ে চাওয়া লূন্ঠনের মত গুনাহর কাজ। আল্লাহ এ ধরনের রুঢ় ব্যবাহর করা থেকে পুরুষকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও রহস্যবিদ হিসেবে পুরুষের জন্য যাদেরকে হালাল করেছেন জীবন সঙ্গিনী হিসেবে, তাদেরকে ব্যাভিচার করার জন্য নয়, বিয়ে করে সঙ্গতভাবে একটি সুন্দর সাবলীল দাম্পত্য জীবন গড়ার হুকুম দিয়েছেন।

"এদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে সব নারী হালাল করা হয়েছে, শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে স্বীয় অর্থের বিনিময়ে তলব করবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য, ব্যাভিচারের জন্য নয়। অনন্তর তাদের মধ্যে যাকে তোমরা ভোগ করবে তাকে তার নির্ধারিত হক দান কর। তোমাদের কোন গুনাহ হবে না, যদি নির্ধারণের পর তোমরা পরস্পর সম্মত হও। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিজ্ঞ, রহস্যবিদ। " ( সূরা নিসা : ২৪)।

অর্থের বিনিময়ে নারীকে পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করবে এটা প্রাচীন যথেচ্ছা ব্যাভিচারের অনৈতিক প্রথাকে নিষিদ্ধ করে নারীকে সমাজে মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছে। এবং পুরুষের মর্যাদার স্তরে সামিল হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। অথচ যারা বিয়ের মাধ্যমে নারীর পুরুষের আশ্রয়ে যাওয়াকে 'আরোপিত নির্বাসন' মনে করেন এবং সেখানে নারীর একাকীত্ব, ক্ষমতাহীনতা, মানসিক দূর্বলতা ও পুরুষের আধিপত্য বিস্তার হিসেবে দেখেন তারা প্রকাশ্যে পরিবার ও বিবাহ প্রথার বিরোধী, সভ্য সমাজ বিকাশের অন্তরায়। অত:পর তাদের জন্য কোরআন সমর্থিত কোন নীতি আদর্শ উপদেশে কাজ করবে না। আজকের নারীবাদীরা সামাজিক অব্যবস্থার অজুহাতে যে সমান অধিকার চাইছে, তা ক্ষেত্র ভেদে অনেক বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত হলেও, প্রকৃতি নারী ও পুরুষকে যে শারীরীক ও মানসিক যোগ্যতা কর্মভার ও ভুমিকা দান করেছে তা রদবদল করা যায় না। এ ব্যাপারে কোরআনের বক্তব্য সুস্পষ্ট - " আর তোমরা আকাঙ্খা করো না এমন সব বিষয়ে যাতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের একের উপর অপরের শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। পুরুষ যা অর্জন করে সেটা তার অংশ এবং নারী যা অর্জন করে সেটা তার অংশ। আর আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। নি:সন্দেহে আল্লাহ তায়ালা সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। ------ পুরুষেরা নারীর উপর কর্তৃত্বশীল। এ জন্য যে আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্যে যে, তারা ব্যায় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না।" (সূরা নিসা : ৩৪)।

এই আয়াতের দ্বারা মূলনীতি স্বরুপ যে বিষয়টি প্রতিয়মান হয় তা হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী আয়াতসমূহের বক্তব্য অনুসারে পুরুষ ও নারীর অধিকার পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং পুরুষের তুলনায় নারীদের দূর্বলতার কারনে তাদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ নারীরা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে পরবে না। কিন্তু তথাপি এই সমতার অর্থ এই নয় যে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে মর্যাদার কোন পার্থক্য থাকবে না; বরং দুটি ন্যায়সঙ্গত ও তাৎপর্যের প্রেক্ষিতেই পুরুষদেরকে নারীদের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়েছে। প্রথমত : পুরুষকে তার জ্ঞানৈশ্বর্য ও পরিপূর্ণ কর্মক্ষমতার কারনে নারী জাতির উপরে মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যা অর্জন করা নারী জাতির পক্ষ্যে আদৌ সম্ভব নয়। দৈবাৎ ব্যাক্তিবিশেষের কথা স্বতন্ত্র। দ্বিতীয়ত : নারীর যাবতীয় প্রয়েঅজনের নিশ্চয়তা পুরুষরা নিজের উপার্জন কিংবা স্বীয় সম্পদের দ্বারা বিধান করে থাকে। প্রথম কারণটি হলো, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ও মানুষের নিজস্ব ক্ষমতা বহির্ভূত। আর দ্বিতীয় কারণটি নিজের উপার্জিত ও ক্ষমাতাভিত্তিক। সার কথা হলো এ আয়াতে প্রথম বাক্যে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন ব্যাবস্থার একটি মূলনীতি বাতলে দেয়া হয়েছে। তাহল এই যে, অধিকাংশ বিষয়ে অধিকারের সমতাবিধান সত্ত্বেও নারীর উপর পুরুষের শাসকোচিত বৈশিষ্ট বিদ্যমান। নারীরা হলো পুরুষের শাষিত ও অধীন। পরিবার ও সমাজের নেতৃত্বদানে পুরুষের সহজাত জ্ঞানৈশ্বর্য ও বিবেক বুদ্ধি যা আল্লাহ তাদের দান করেছেন, যাতে মানুষের কোন হাত নেই, সেটাই স্বাভাবিকভাবে পুরুষকে শাসকের আসনে বসিয়ে দিয়েছে। এখন নারীবাদের সমতার প্রত্যাশা অন্তত এ ক্ষেত্রে পুরুষের সমান উচ্চতায় উঠে আসবে, সেটা কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া কখনো সফল হবার নয়। একটি পরিবারে দুজন কর্তা সমান ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার অধিকারী হলে ঐ পরিবার সমানতালে অগ্রসর না হয়ে বরং উভয়ের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সংসারটি ধ্বংস হয়ে যায়। একটি দেশে যেমন দুজন রাজা থাকতে পারে না, তেমনি একটি পরিবারে দুজন কর্তা থাকতে পারে না। যুক্তিসঙ্গত কারনে পরিবারে পুরুষের কর্তৃত্ব নারীকে মেনে নিতেই হবে, এর বিকল্প সভ্যসমাজে অন্যকিছু চিন্তা করা যায় না। অবশ্য যে সব নারী ও পুরুষ পৃথিবীর জীবনটাকে ভোগের সামগ্রী মনে করে, কোন সৃষ্টিকর্তা আছে বলে বিশ্বাস করে না, অর্থ ও সম্পদের প্রচুর্যে ভাসছে, তাদের মধ্য দিয়ে ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তার বিধি বিধান বাস্তবায়ন সম্ভব নয় এবং তাদের জন্য কোরআনের এ আলোচনা নয়। যারা নিজেদের মধ্যে আল্লাহ এবং তার বিধানের প্রতি নি:শর্তে আনুগত্য পোষণ করে না, তারা পুরুষ হোক আর নারী হোক তাদের জন্য কোরআনের চরম শাস্তি পাওয়ার ঘোষণা ব্যতীত অন্যকোন সান্তনা বাক্য নেই। " সে লোক পুরুষ হোক কিংবা নারী, কোন সৎকর্ম করে এবং বিশ্বাসী হয় তবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রাপ্য তিল পরিমাণও নষ্ট করা হবে না।" (সুরা নিসা : ১২৪)।

আল্লাহর চোখে পুরুষ ও নারীর পূন্যবান কাজের মর্যদা সমান। এবং সে কারনে পার্থিব সংসার চালনায় আল্লাহ বলেন, "তোমরা একে অপরের চাদর স্বরুপ।"

কোরআনে আল্লাহ যখন বলেন, তোমরা একে অপরের চাদর স্বরুপ তখন সেটা একটি সমাজ বা সময়ের প্রেক্ষিতে বলেননি, বলেছেন সকল সমাজ ও সকল সময়ের প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ স্বরুপ। বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য ও দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হলো নারী এবং পুরুষ উভয়ই ভুলে যাচ্ছে, কেন তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আল্লাহর সেই মহৎ উদ্দেশ্য ভুলে পাশ্চাত্য নারী সমাজ নিজেদেরকে গৃহের লক্ষ্ণী হিসেবে না রেখে বাজারের সস্তা পণ্যে পরিণত করেছে, বিজ্ঞাপনে ও মডেলিং এ নারীর উপস্থিত হতে দ্বিধা নেই। কিছুটা ধর্মীয় বিধি নিষেধ না থাকলে, সামাজিক মূল্যবোধের ভয় না থাকলে একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে আপত্তি নেই আমাদের এ সমাজের বহু নারীর। শুনতে অশোভনীয় মনে হলেও প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, কোথায় যাচ্ছে এই বিজ্ঞাপিত নারীরা ? এই পঙ্কিলতার শেষ কোথায় ? সমাজ ও পবিত্র জীবনতো এই পঙ্কিলতার ভেতরে দিয়ে সাতার কেটে যেতে পারে না। শহরের বিউটি পর্লারগুলোতে নারীদের রুপসজ্জার আকর্ষণীয় বানিজ্যের অন্তরালে কি ঘটছে সে চিত্রপট বহু সাংবাদিকই আমাদেরকে উন্মোচন করে দেখিয়েছেন। তাছাড়া সিনেমা নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট নারীদের জীবনাচার যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা মনে হয় কারোরই অজানা নয়। উগ্রনারীবাদে বিশ্বসী, বিজ্ঞাপনের ও মডেলিং এ উৎসাহী তথাকথিত রুপবতী নারীদের মহৎ জীবন মুক্তি ও স্বাধীনতার নামে নষ্ট আহবানে দ্রুত নি:শেষ হয়ে যাচ্ছে তার কি ইয়াত্তা আছে এ সমাজে ? ব্যাক্তিত্ব অর্জনে শিক্ষা ও নীতিচর্চা করার বদলে যারা এ সমাজে পুরুষ ও অর্থের দাসত্ব করার দিকে ঝুকে পড়ে, সত্যিকার নারীমুক্তি আন্দোলনে তাদের ভুমিকা সব সময়ই নেতিবাচক।

কোরআনের নারীরা দৃষ্টিকে নত রাখে, যৌনাঙ্গের হেফাযত করে এবং অহেতুক সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ায় না। খুব পবিত্রতার মধ্যে জীবন যাপন করতে চায় তারা আল্লাহর এ নির্দেশকে তারা কঠোর ভাবে মেনে চলে- "ঈমানদ্বার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারনত প্রকাশমান তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ তাদের ব্যাতীত আর কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারনা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।" (সূরা নূর " ৩১)

উক্ত আয়াতে নারীদের পর্দা প্রথার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইসলামে হিজাব বা পর্দার গুরুত্ব যে কত বেশি তা কেবল মুমিন নর-নারীরা উপলব্ধি করতে পারেন। এ বিষয়ে বিখ্যাত আলেমদের গুরুত্বপূর্ণ বই পুস্তক রয়েছে। পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতির প্রভাবে মুসলিম তরুনীরা যেভাবে ইসলামের পর্দা প্রথা উপেক্ষা করছে তা ভীষণ উদ্দেগ জনক। যে জীবন ও ধর্ম পবিত্রতার উপর প্রতিষ্ঠিত, নারীর জন্য সেটা কেবল বিধিবদ্ধ পর্দা মেনে চলা এবং ইবাদতের অন্যান্য বিষয়াগুলো সর্বোচ্চ মনোনিবেশ সহযোগে পালন করা দৃঢ় কর্তব্যের আওতাভুক্ত করলে পর্দা পালনের প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে পারে। যেহেতু ধর্মেল মৌলিক উদ্দেশ্য কল্যাণ সেহেতু নারীর শোভনীয় পদচারণার রীতি অনুপুঙ্খ মেনে চলাই ইসলামী শরীয়ার নির্দেশ; আমরা বিশ্বাসীরা এ নির্দেশ উপেক্ষা করতে পারি না। যেহেতু মুসলমানদের কাছে ইহকাল ও পরকালের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি হলো ধর্ম। এবং তাদের ধর্ম ইসলাম সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক। ফলত বিজ্ঞানময় ধর্ম ইসলামকে জীবন ও সমাজের সর্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার মহান ব্রত নিয়ে মুমিন বান্দারা সংগ্রামে লিপ্ত। এখানে যদি ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়নে নারী সমাজ পুরুষ সমাজকে পূর্ণাঙ্গ সহায়তা না দেয়, এবং তাদের নিজস্ব দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে গাফেল থাকে, তাহলে তারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে যেভাবেই নিজেদের পার্থিব স্বার্থসুবিধা উদ্ধার করার চেষ্টা করুক-প্রকৃত প্রস্তাবে তারা ব্যার্থই হবে। এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কারণ পাশ্চাত্য পুজিবাদ, রাশিয়ার সমাজতন্ত্র কিংবা নব্য বাজার অর্থনীতি যত বৈষর্ম মূলক আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করুক, মানুষকে সমাজের অভ্যন্তরে ঐক্যবদ্ধভাবে বেছে থাকার জন্য মানতে হবে ধর্ম ও ঈশ্বরের বিধান অনুসরণ করতে হবে মহাপুরুষীয় জীবন চরিত। চর্চা করতে হবে ঐতিহ্য ও কৃষ্টির। অন্যথায় মূল্যবোধহীন আবেগশুন্য বিবেকবর্জিত পশুশ্রেনীর জীবন নিয়ে মানুষকে কেবল যৌন চর্চার ক্ষণিক আনন্দ ও দীর্ঘায়িত অবসাদের মধ্যে জীবনের মূল্যবান সময়কে নষ্ট করতে হবে।

কোরআনের নারী মানে, ইসলামের বিধি বিধানে আস্থাশীল এবং অভিজ্ঞ এমন একদল নারী যাদের জ্ঞান রয়েছে স্বামীর কাছ থেকে আইনসঙ্গত অধিকার আদায় করার এবং পরিবারের সার্বিক উন্নতির জন্য পরিস্থিতি মোতাবেক ভূমিকা রাখার এবং মহান সৃষ্টিকর্তার মানব সৃষ্টির মৌলিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের। তারা পাশ্চাত্য গবেষকদের চট্ জলধি বক্তব্য যে, সমাজে সনাতন ও পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ বিদ্যমান থাকায় নারীরা মর্যাদাহীন এবং অধস্তন, সে একথায় অন্ধের মত বিশ্বাস করবে না বরং ইসলামের নীতি আদর্শের আলোকে তারা সার্বিক দায়ায়িত্ব সর্বদা বিবেচনায় রাখবে। কোরআন তার বিশ্বাসী নারী সমাজের কাছে এটাই প্রত্যাশা করে। সময়ের প্রবাহমান ধারায় এ প্রত্যাশার রুপান্তর ঘটবে না, যেহেতু কোরআন নারীকে আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বিবেচনা করে না, বরং মানব সৃষ্টির মৌলিক উদ্দেশ্যর প্রেক্ষিতে পার্থিব জীবনে মানুষের স্রষ্টানুগত্যশীলতায় নারীর প্রেরণামূলক অবদানকে বিবেচনা করে। ফলত নারী সম্পর্কিত কোরআনিক আইন সর্বদা অপরিবর্তনীয় এক শাশ্বত সত্য হিসেবে সমাদৃত হবে তা কেবল ইমানদার নারী ও পুরুষের কাছে। কোরআনের একটি অক্ষরও বিভ্রান্তরা স্পর্শ করার যোগ্য নয়। সুমহান এই গ্রন্থের বক্তব্য উপলিব্ধির প্রয়োজনীয় প্রজ্ঞা, ধৈর্যশীলতা অর্জন না করে খানকয়েক পাশ্চাত্য পন্ডিতদের বই ঘেটে যারা সামাজিক রীতি-নীতি রাতারাতি বদলে দিতে কোমরে আচল বেধে রাস্তায় নেমেছে, ইসলামী বিপ্লব কায়েম হলে দেখা যাবে তারা কোথায় থাকে। মানুষের চিরন্তন আত্ম-স্বভাবের দোষগুণের উপর প্রতিষ্ঠিত বিধান যা নারী ও পুরুষের স্বতন্ত্র জীবনবৃত্তের প্রকৃতি অনুসারে স্থির হয়েছে, তার বিরুদ্ধে নারীবাদ যদি সত্যি আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে, সেটা সমাজ ও পরিবারের অপূরনীয় ক্ষতি ডেকে আনবে। যা ইতিমধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করা শুরু করেছি। অবশ্য তারা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য ও নিপীড়নের যে চিত্র তুলে ধরেছে তা মিথ্যে নয়, এবং সেটা দূর করার দায়িত্ব সমাজের দায়ত্বশীল শ্রেষ্ঠ বিবেকবান নারী ও পুরুষের, যারা এ বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করার অবস্থানে আছেন। একটি কথা মনে রাখাতে হবে, কোরআন নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য এমন একটি বিধান দিয়েছে, যা আমাদের সমাজ মনে আর্কিটাইপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেই আর্কিটাইপ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসকে আমরা অন্তত পাপের কাজ মনে করি; নাস্তিকদের কথা ভিন্ন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে

৭১ এর যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস