স্রষ্টার অনস্তিত্বের সম্ভাবনা কতটুকু ?
এ মহা বিশ্বের স্রষ্টা আছেন কি নেই- এই প্রশ্নের বিচার করার আগে
প্রথমেই বলে নেই যে, প্রমাণ বলতে চাক্ষুস প্রমান বোঝালে তা নেই এবং তা
থাকতেও পারে না। তিনি যদি থেকে থাকেন তবে কোনদিন তিনি এসে আমাদের সামনে
দাড়িয়ে বলেন নি যে-এই যে আমি তোমাদের স্রষ্টা এবং নি:সন্দেহে বলা যায়
যে, কোনদিন তা দাঁড়াবেন না।
কারণ, তাহলে মানুষ নামের এই বিশেষ সৃষ্টিটি অর্থহীন হয়ে যেত, আমরা গাছ-পাথর, হাতি-ঘোড়ার মত শুধু আরেকটি সৃষ্টি হয়ে যেতাম। দ্বিতীয়ত : আমাদের বিশ্বাস জন্মানই যদি কথা হয়ে থাকে তবেও তাকে নিজে দেখা দিয়ে চাক্ষুস প্রমাণ দেয়ার দরকার নেই। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান স্রষ্টা হয়ে থাকলে তিনি ইচ্ছা করলেই তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এই মুহুর্তে তাকে না দেখেই বিশ্বাস করবে। (সূরা আল-আনআম:৩৫, সূরা ইউনুস:৯৯, সূরা নাহল: ০৯)। তাকে সামনে এসে দাড়াবার প্রয়োজনই হবে না। এতে প্রমাণ হচ্ছে যে, স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন তবে তিনি নিজে দেখা দিয়ে বা ইচ্ছে করে আমাদের মনে তার অস্তিত্বের বিশ্বাস এনে দিতেু চান না। তিনি দেখতে চান তিনি যে একটি মাত্র সৃষ্টিকে বুদ্ধি, যুক্তির শক্তি, উপলব্ধির শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করলেন সেটা অর্থাৎ মানুষ তার ঐ শক্তিগুলো দিয়ে চাক্ষুস নয়, তাকে উপলব্ধি করে কিনা। এ জন্য তিনি লক্ষ কোটি নিদর্শন দিয়েছেন। মানুষকে এ যুক্তি বোঝার শক্তি দিয়েছেন যে, ধোঁয়া থাকলে আগুন থাকবেই। এখন আমাদের দেখতে হবে ধোয়া অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্বের এ ধরনের প্রমাণ আছে কিনা।
মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ব বিষয়ে বিজ্ঞান এখনো কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছতে পারে নি। Big bang (প্রচন্ড বিষ্ফোরণ), Steady State (স্থিতাবস্থা), এবং Oscillating (স্পন্দনশীল) নিয়ে মতবিরোধ যাই থাকুক একথা অনস্বীকার্য যে, সম্ভাবনা মাত্র দুটির মধ্যেই সিমাবদ্ধ। হয় মহাবিশ্ব নিজে নিজে আচম্বিত হয়ে গেছে (Accidental) নয়ত এটা পরিকল্পিত সৃষ্টি (Planned)। তৃতীয় কোন সম্ভাবনা নেই।
এখন দেখা যাক আচম্বিতের ধারণা। এই থিওরী মতে মহাশুন্য শুধু গ্যাস আর ধুলিকণা (Dust) দিয়ে পূর্ণ ছিল। এই গ্যাস আর ধুলিকণা কোথা থেকে এল তা কিন্তু তারা বলাতে পারে না। শুধু বলে আগে থেকেই ছিল- যদিও স্রষ্টা ছাড়া এগুলোর সৃষ্টি কেমন করে হল তার কিন্তু কোন উত্তর নেই। যাই হোক এই গ্যাস আর ধুলিকনার উৎপাদন দিয়েই মহাবিশ্বের সৃষ্টি আরম্ভ হল। ক্রমে ক্রমে কোটি কোটি অর্বুদ, অর্বুদ বছর ধরে নানা রকম আচম্বিত ঘটনার মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কিভাবে কি কি ঘটনার ভিতর দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌছল তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মতবিরোধ, নানা থিওরী বিদ্যমান। তো এই আচম্বিতের থিউরী মতে অর্বুদ অর্বুদ বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত সৃষ্টিতে যা কিছু হয়ে আসছে তাতে কোন পরিকল্পনা (Plan) নেই। কারন স্রষ্টাইতো নেই-সব হয়েছে এবং হচ্ছে আচম্বিত। পরিকল্পনার কথা আসলেইতো স্রষ্টা এসে যান। আরেকটা কথা হচ্ছে-এই যে আচম্বিত ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং ঘটছে এগুলো যেখানে খুশি, যখন খুশি ভাবে ঘটেনি। এগুলোকে ঘটতে হয়েছে ধারাবাহিক ভাবে (In sequence)। একটা আচম্বিত ঘটনা যখন ঘটেছে বলে মানুষ ও প্রাণীজগৎ বেচে আছে, ঐ ঘটনাটা তখন না ঘটে যদি তার আগে বা পরে ঘটতো তবে কোন প্রাণী পৃথিবীতে থাকত না, কোন প্রানীর অস্তিত্বে আসাই সম্ভব হত না। কাজেই অচম্বিত ঘটনা ঘটেছে এবং ধারাবাহিক ভাবেই ঘটেছে। এরূপ ঘটনাগুলোর (Accident) সংখ্যা কোটি, কোটি-অগনিত। এবার দেখা যাক এটা কতটুকু সম্ভব।
আমরা ঠিক একই আকারের দশটি গোল চাকতি নেই এবং এগুলোর উপর এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা লিখি। এ চাকতিগুলো হল সেই কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনাগুলোর মাত্র দশটি প্রতীক এবং সংখ্যাগুলো হল ওগুলোর ধারাবাহিকতা (Sequence)- যার কথা বলে এলাম। এই দশটি নাম্বারের দশটি চাকতি উলটপালট করে পকেটে ঢুকালাম। এবার পকেট থেকে একটি চাকতি বের করলাম। এ চাকতিটি এক থেকে দশ নাম্বারের যে কোনটি হতে পারে। এবং প্রথম বারেই ১ নাম্বার ওয়ালা চাকতি বের হবার সম্ভাবনা দশের মধ্যে এক। (১ : ১০)। এবার এটাকে পকেটে ঢুকিয়ে আবার একটা চাকতি বের করলাম। এবার ২ নাম্বার ওয়ালা চাকতিটি বের হবার সম্ভাবনা একশর মধ্যে এক। অর্থাৎ আমরা যদি একশ বার পকেট থেকে একটা একটা করে চাকতি বের করি তাহলে এক নাম্বার উঠবার ঠিক পরের বারে দুই নাম্বার ওয়ালা চাকতিটি উঠে আসার সম্ভাবনা থাকবে একশ বারের মধ্যে একবার। অর্থাৎ (১ : ১০ x ১০ = ১০০)। ঠিক তেমনি ভাবে পরের বারে তিন নাম্বারটা উটে আসার সম্ভাবনা থাকবে এক হাজার বারের মেধ্যে একবার। অর্থাৎ (১ : ১০০ x ১০ = ১০০০)। অর্থাৎ আমরা যদি দশবার পকেট থেকে চাকতি বের করি তাহলে এক থেকে ধারাবাহিক ভাবে দশ পর্যন্ত সিরিয়াল ভাবে বের হবার সম্ভাবনা হল এক হাজার কোটি বারের মধ্যে একবার (১ : ১০০০০০০০০০০)।
আমরা কোটি কোটি নয়, অসংখ্য অগনিত আচম্বিত ঘটনার মধ্যে মাত্র দশটির প্রতীক নিয়েছিলাম। তাতেই এই সংখ্যার সম্ভাবনা পাচ্ছি। তাহলে কোটি কোটি নিলে দেখা যাবে সৃষ্টিজগৎ আচম্বিত ধারাবাহিক ভাবে সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অসীম সংখ্যার মধ্যে একবার অর্থাৎ অসম্ভব। এখন দুটো সম্ভাবনার মধ্যে একটি অসম্ভব হলে দ্বিতীয় থিওরী অর্থাৎ "সৃষ্টি জগৎ পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্টি হয়েছে" মেনে নেয়া ছায়া তৃতীয় কোন পন্থা নেই।
আর এ হিসেব ঠিক উল্টো দিক থেকেও করা যায়। অর্থৎ যে কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে আসার দরুন আমরা আজ বর্তমান যে অবস্থানে এসে পৌছেছি; ঠিক তেমনি কোটি কোটি অন্য রকম আচম্বিত ঘটনা এই মহাকালের মধ্যে ঘটতে পারত। যার একটি মাত্র ঘটনাও সমস্ত সৃষ্টি জগৎ লন্ড ভন্ড করে দিত। কিন্তু তেমন একটি মাত্র ঘটনাও ঘটেনি। যেমন ধরুন, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর জমানো বরফ যদি গলে যেত তবে বিজ্ঞানীদের মতে পাহাড়-পর্বত ছাড়া সমগ্র পৃথিবী পানির নীচে ডুবে যাবে। যা ঘটতে পারত কিন্তু ঘটেনি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অংকের হিসেবে (Mathematics Figure of chance) স্রষ্টার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। এবার আসি নাস্তিকভাই দের এ প্রসঙ্গে যে, মানুষকে ভাল পথে পরিচালনার জন্য মানুষ নিজেই স্রষ্টার ধারনাকে সৃষ্টি করেছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, স্রষ্টার ধারণা আজকের নয়। ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই যখন থেকে মানুষ সম্বন্ধে জানা যায় তখন থেকেই মানুষ একজন স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিল। প্রত্নতাত্বিকরা মাটি খুড়ে হাজার হাজার বছর আগের যে সব জনবসতির সন্ধান পেয়েছেন, তাতে দেখা যায় সর্বত্রই ধর্মের অর্থাৎ স্রষ্টার কোন না কোন রকমের ধারণা ছিল। বিভিন্ন মহাদেশে, পৃথিবীর যেখানেই কোন প্রাক-ঐতিহাসিক জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানেই পাওয়া গেছে ধর্মের চিহৃ। অর্থৎ স্রষ্টা সম্বন্ধে একটা চেতনা পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিল এটা সন্দেহাতীত। পৃথিবীর প্রধান ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতেও যেসব প্রাক-ঐতিহাসিক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে সেসবগুলোর চিত্র ও এক। যখন এ সব বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে কোন সংযোগ বা পরিচিতি ছিলনা, ভাষা-সংস্কৃতি সব কিছুই ছিল ভিন্ন, একে অন্নের অস্তিত্ব পর্যন্ত জানত না, তখন ঐ একটি ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিল এটাও কি বিজ্ঞানীদের সেই আচম্বিত ঘটনা ? পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠিগুলো যে শুধু স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিল তাই নয়, তারা ঐ স্রষ্টার গুণাবলী বা সিফাতের ব্যাপারেও ঐকমত্য ছিল। অর্থৎ স্রষ্টা মহা শক্তিশালী, সর্বব্যাপী, দয়ালু, যা ইচ্ছা তা করতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ যদি স্রষ্টার ধারণাকে সৃষ্টি করে থাকে তাহলে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী বিচ্ছিন্ন ও অকল্পনীয় বিভিন্ন স্থানে মানুষ একটা জুজুর ভয় সৃষ্টি করল, যে জুজুটার গুণাবলীও অকষ্মাৎ ভাবে সকলের কাছে একি রকম ছিল। অর্থাৎ ঐ জুজুটা সর্বশক্তিমান, সবত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞানী, অতীব ক্ষমাশীল, দয়াময় ইত্যাদি। এবার দেখা যাক এ আচম্বিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু।
পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব এখন একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং এ মধ্যাকর্ষণ শক্তি যে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে তাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এটা এক মুহুর্তে জন্যেও থামেনি তাহলে পৃথিবী অচল হয়ে যেত। কিন্তু মানুষ এই সর্বব্যাপি শক্তির কথা জানতে পারল এই কিছু দিন আগে। কেন ? এতদিন কি মানুষ তার মগজ ব্যাবহার করেনি ? নিশ্চয়ই করেছে। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের আগেই মানুষ বহু কিছু আবিষ্কার করেছে। পিরামিডের মত কালজয়ী সৌধ তৈরী করেছে, কিন্তু যে শক্তির অধীনে থেকে তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত অতিবাহিত হচ্ছে, যে শক্তি এক মুহুর্ত বিরতি দিলে সে পৃথিবীর বহির্মুখ, অপকেন্দ্রিক শক্তির ফলে ছিটকে মহাশুন্যে নিক্ষিপ্ত হবে সে শক্তি সম্বন্ধে সে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ-মাত্র কয়েক বছর আগ পর্যন্ত।
যেটা নেই (স্রষ্টা) তাকে মানুষ সেই প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকে কল্পনা করে নিল, শুধু কল্পনাই নয় বরং সেটা কিরকম তার বিস্তৃত বিবরণ পৃথিবীর এধার থেকে ওধার পর্যন্ত বিশ্বাস করে নিল-কিন্তু যেটা আছে (মধ্যাকর্ষণ) সেটাকে মানুষ হাজার হাজার বছরেও আবিষ্কার করতে পারলো না ? আসল কথা হচ্ছে স্রষ্টা তার প্রেরিতদের দিয়ে সেই প্রথম মানুষটি থেকেই তার অস্তিত্ব ও গুণাবলী অর্থাৎ তিনি কেমন তা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন বলেই মানুষ তার সম্পর্কে জানে, আর মধ্যাকর্ষণ সম্বন্ধে নিউটনর আগে কাউকে জানাননি বলেই মানুষ তা জানতে পারেনি। স্রষ্টা যদি মানুষ সৃষ্টি করে তাকে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হতেন, প্রেরিতদের দিয়ে নিজের সম্বন্ধে কিছু না জানাতেন তবে নি:সন্দেহে বলা যায় যে, মানুষ আজও তার সম্বন্ধে কিছুই জানত না কিংবা জানলেও তার গুণাবলী ও সিফাতের ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞই থেকে যেত।
এখন প্রশ্ন হল আমরা তার অস্তিত্বের প্রমাণ পেলাম, কিন্তু আমরা কি তাকে ধারণা করতে পারি ? এর উত্তরে তিনি নিজে বলেছেন- না, তোমরা তা পার না। (সূরা আল-আনাম:১০৩)। কারন আমরা সৃষ্ট, আমাদের শক্তি সীমিত। ধারণার শক্তিও সীমিত। স্রষ্টা অসীম। স্রষ্টাকে কেন, এই মহা সৃষ্টির একটা সামান্য অংশকেও আমরা ধারণা করতে পারি না। যেখানে সৃষ্টির অসীম Space এবং অসীম Time এর বিন্দুমাত্র আমরা ধারণায় আনতে অক্ষম সেখানে অসীম স্রষ্টার ধারণা করতে আমরা কি করে সক্ষম হব ?
কারণ, তাহলে মানুষ নামের এই বিশেষ সৃষ্টিটি অর্থহীন হয়ে যেত, আমরা গাছ-পাথর, হাতি-ঘোড়ার মত শুধু আরেকটি সৃষ্টি হয়ে যেতাম। দ্বিতীয়ত : আমাদের বিশ্বাস জন্মানই যদি কথা হয়ে থাকে তবেও তাকে নিজে দেখা দিয়ে চাক্ষুস প্রমাণ দেয়ার দরকার নেই। কারণ তিনি সর্বশক্তিমান স্রষ্টা হয়ে থাকলে তিনি ইচ্ছা করলেই তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এই মুহুর্তে তাকে না দেখেই বিশ্বাস করবে। (সূরা আল-আনআম:৩৫, সূরা ইউনুস:৯৯, সূরা নাহল: ০৯)। তাকে সামনে এসে দাড়াবার প্রয়োজনই হবে না। এতে প্রমাণ হচ্ছে যে, স্রষ্টা যদি থেকে থাকেন তবে তিনি নিজে দেখা দিয়ে বা ইচ্ছে করে আমাদের মনে তার অস্তিত্বের বিশ্বাস এনে দিতেু চান না। তিনি দেখতে চান তিনি যে একটি মাত্র সৃষ্টিকে বুদ্ধি, যুক্তির শক্তি, উপলব্ধির শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করলেন সেটা অর্থাৎ মানুষ তার ঐ শক্তিগুলো দিয়ে চাক্ষুস নয়, তাকে উপলব্ধি করে কিনা। এ জন্য তিনি লক্ষ কোটি নিদর্শন দিয়েছেন। মানুষকে এ যুক্তি বোঝার শক্তি দিয়েছেন যে, ধোঁয়া থাকলে আগুন থাকবেই। এখন আমাদের দেখতে হবে ধোয়া অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্বের এ ধরনের প্রমাণ আছে কিনা।
মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ব বিষয়ে বিজ্ঞান এখনো কোন চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছতে পারে নি। Big bang (প্রচন্ড বিষ্ফোরণ), Steady State (স্থিতাবস্থা), এবং Oscillating (স্পন্দনশীল) নিয়ে মতবিরোধ যাই থাকুক একথা অনস্বীকার্য যে, সম্ভাবনা মাত্র দুটির মধ্যেই সিমাবদ্ধ। হয় মহাবিশ্ব নিজে নিজে আচম্বিত হয়ে গেছে (Accidental) নয়ত এটা পরিকল্পিত সৃষ্টি (Planned)। তৃতীয় কোন সম্ভাবনা নেই।
এখন দেখা যাক আচম্বিতের ধারণা। এই থিওরী মতে মহাশুন্য শুধু গ্যাস আর ধুলিকণা (Dust) দিয়ে পূর্ণ ছিল। এই গ্যাস আর ধুলিকণা কোথা থেকে এল তা কিন্তু তারা বলাতে পারে না। শুধু বলে আগে থেকেই ছিল- যদিও স্রষ্টা ছাড়া এগুলোর সৃষ্টি কেমন করে হল তার কিন্তু কোন উত্তর নেই। যাই হোক এই গ্যাস আর ধুলিকনার উৎপাদন দিয়েই মহাবিশ্বের সৃষ্টি আরম্ভ হল। ক্রমে ক্রমে কোটি কোটি অর্বুদ, অর্বুদ বছর ধরে নানা রকম আচম্বিত ঘটনার মধ্য দিয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কিভাবে কি কি ঘটনার ভিতর দিয়ে আজকের অবস্থানে পৌছল তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানা মতবিরোধ, নানা থিওরী বিদ্যমান। তো এই আচম্বিতের থিউরী মতে অর্বুদ অর্বুদ বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত সৃষ্টিতে যা কিছু হয়ে আসছে তাতে কোন পরিকল্পনা (Plan) নেই। কারন স্রষ্টাইতো নেই-সব হয়েছে এবং হচ্ছে আচম্বিত। পরিকল্পনার কথা আসলেইতো স্রষ্টা এসে যান। আরেকটা কথা হচ্ছে-এই যে আচম্বিত ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং ঘটছে এগুলো যেখানে খুশি, যখন খুশি ভাবে ঘটেনি। এগুলোকে ঘটতে হয়েছে ধারাবাহিক ভাবে (In sequence)। একটা আচম্বিত ঘটনা যখন ঘটেছে বলে মানুষ ও প্রাণীজগৎ বেচে আছে, ঐ ঘটনাটা তখন না ঘটে যদি তার আগে বা পরে ঘটতো তবে কোন প্রাণী পৃথিবীতে থাকত না, কোন প্রানীর অস্তিত্বে আসাই সম্ভব হত না। কাজেই অচম্বিত ঘটনা ঘটেছে এবং ধারাবাহিক ভাবেই ঘটেছে। এরূপ ঘটনাগুলোর (Accident) সংখ্যা কোটি, কোটি-অগনিত। এবার দেখা যাক এটা কতটুকু সম্ভব।
আমরা ঠিক একই আকারের দশটি গোল চাকতি নেই এবং এগুলোর উপর এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা লিখি। এ চাকতিগুলো হল সেই কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনাগুলোর মাত্র দশটি প্রতীক এবং সংখ্যাগুলো হল ওগুলোর ধারাবাহিকতা (Sequence)- যার কথা বলে এলাম। এই দশটি নাম্বারের দশটি চাকতি উলটপালট করে পকেটে ঢুকালাম। এবার পকেট থেকে একটি চাকতি বের করলাম। এ চাকতিটি এক থেকে দশ নাম্বারের যে কোনটি হতে পারে। এবং প্রথম বারেই ১ নাম্বার ওয়ালা চাকতি বের হবার সম্ভাবনা দশের মধ্যে এক। (১ : ১০)। এবার এটাকে পকেটে ঢুকিয়ে আবার একটা চাকতি বের করলাম। এবার ২ নাম্বার ওয়ালা চাকতিটি বের হবার সম্ভাবনা একশর মধ্যে এক। অর্থাৎ আমরা যদি একশ বার পকেট থেকে একটা একটা করে চাকতি বের করি তাহলে এক নাম্বার উঠবার ঠিক পরের বারে দুই নাম্বার ওয়ালা চাকতিটি উঠে আসার সম্ভাবনা থাকবে একশ বারের মধ্যে একবার। অর্থাৎ (১ : ১০ x ১০ = ১০০)। ঠিক তেমনি ভাবে পরের বারে তিন নাম্বারটা উটে আসার সম্ভাবনা থাকবে এক হাজার বারের মেধ্যে একবার। অর্থাৎ (১ : ১০০ x ১০ = ১০০০)। অর্থাৎ আমরা যদি দশবার পকেট থেকে চাকতি বের করি তাহলে এক থেকে ধারাবাহিক ভাবে দশ পর্যন্ত সিরিয়াল ভাবে বের হবার সম্ভাবনা হল এক হাজার কোটি বারের মধ্যে একবার (১ : ১০০০০০০০০০০)।
আমরা কোটি কোটি নয়, অসংখ্য অগনিত আচম্বিত ঘটনার মধ্যে মাত্র দশটির প্রতীক নিয়েছিলাম। তাতেই এই সংখ্যার সম্ভাবনা পাচ্ছি। তাহলে কোটি কোটি নিলে দেখা যাবে সৃষ্টিজগৎ আচম্বিত ধারাবাহিক ভাবে সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অসীম সংখ্যার মধ্যে একবার অর্থাৎ অসম্ভব। এখন দুটো সম্ভাবনার মধ্যে একটি অসম্ভব হলে দ্বিতীয় থিওরী অর্থাৎ "সৃষ্টি জগৎ পরিকল্পিত ভাবে সৃষ্টি হয়েছে" মেনে নেয়া ছায়া তৃতীয় কোন পন্থা নেই।
আর এ হিসেব ঠিক উল্টো দিক থেকেও করা যায়। অর্থৎ যে কোটি কোটি আচম্বিত ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে আসার দরুন আমরা আজ বর্তমান যে অবস্থানে এসে পৌছেছি; ঠিক তেমনি কোটি কোটি অন্য রকম আচম্বিত ঘটনা এই মহাকালের মধ্যে ঘটতে পারত। যার একটি মাত্র ঘটনাও সমস্ত সৃষ্টি জগৎ লন্ড ভন্ড করে দিত। কিন্তু তেমন একটি মাত্র ঘটনাও ঘটেনি। যেমন ধরুন, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর জমানো বরফ যদি গলে যেত তবে বিজ্ঞানীদের মতে পাহাড়-পর্বত ছাড়া সমগ্র পৃথিবী পানির নীচে ডুবে যাবে। যা ঘটতে পারত কিন্তু ঘটেনি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, অংকের হিসেবে (Mathematics Figure of chance) স্রষ্টার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে। এবার আসি নাস্তিকভাই দের এ প্রসঙ্গে যে, মানুষকে ভাল পথে পরিচালনার জন্য মানুষ নিজেই স্রষ্টার ধারনাকে সৃষ্টি করেছে।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে, স্রষ্টার ধারণা আজকের নয়। ইতিহাসের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই যখন থেকে মানুষ সম্বন্ধে জানা যায় তখন থেকেই মানুষ একজন স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিল। প্রত্নতাত্বিকরা মাটি খুড়ে হাজার হাজার বছর আগের যে সব জনবসতির সন্ধান পেয়েছেন, তাতে দেখা যায় সর্বত্রই ধর্মের অর্থাৎ স্রষ্টার কোন না কোন রকমের ধারণা ছিল। বিভিন্ন মহাদেশে, পৃথিবীর যেখানেই কোন প্রাক-ঐতিহাসিক জনপদের সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানেই পাওয়া গেছে ধর্মের চিহৃ। অর্থৎ স্রষ্টা সম্বন্ধে একটা চেতনা পৃথিবীময় ছড়িয়ে ছিল এটা সন্দেহাতীত। পৃথিবীর প্রধান ভূ-ভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়াতেও যেসব প্রাক-ঐতিহাসিক মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে সেসবগুলোর চিত্র ও এক। যখন এ সব বিভিন্ন জনগোষ্ঠির মধ্যে কোন সংযোগ বা পরিচিতি ছিলনা, ভাষা-সংস্কৃতি সব কিছুই ছিল ভিন্ন, একে অন্নের অস্তিত্ব পর্যন্ত জানত না, তখন ঐ একটি ব্যাপারে সবাই সচেতন ছিল এটাও কি বিজ্ঞানীদের সেই আচম্বিত ঘটনা ? পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এ জনগোষ্ঠিগুলো যে শুধু স্রষ্টার ব্যাপারে সচেতন ছিল তাই নয়, তারা ঐ স্রষ্টার গুণাবলী বা সিফাতের ব্যাপারেও ঐকমত্য ছিল। অর্থৎ স্রষ্টা মহা শক্তিশালী, সর্বব্যাপী, দয়ালু, যা ইচ্ছা তা করতে পারেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ যদি স্রষ্টার ধারণাকে সৃষ্টি করে থাকে তাহলে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী বিচ্ছিন্ন ও অকল্পনীয় বিভিন্ন স্থানে মানুষ একটা জুজুর ভয় সৃষ্টি করল, যে জুজুটার গুণাবলীও অকষ্মাৎ ভাবে সকলের কাছে একি রকম ছিল। অর্থাৎ ঐ জুজুটা সর্বশক্তিমান, সবত্র বিরাজমান, সর্বজ্ঞানী, অতীব ক্ষমাশীল, দয়াময় ইত্যাদি। এবার দেখা যাক এ আচম্বিত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কতটুকু।
পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব এখন একটা প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং এ মধ্যাকর্ষণ শক্তি যে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আছে তাও প্রতিষ্ঠিত সত্য। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এটা এক মুহুর্তে জন্যেও থামেনি তাহলে পৃথিবী অচল হয়ে যেত। কিন্তু মানুষ এই সর্বব্যাপি শক্তির কথা জানতে পারল এই কিছু দিন আগে। কেন ? এতদিন কি মানুষ তার মগজ ব্যাবহার করেনি ? নিশ্চয়ই করেছে। নিউটনের মধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কারের আগেই মানুষ বহু কিছু আবিষ্কার করেছে। পিরামিডের মত কালজয়ী সৌধ তৈরী করেছে, কিন্তু যে শক্তির অধীনে থেকে তার জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত অতিবাহিত হচ্ছে, যে শক্তি এক মুহুর্ত বিরতি দিলে সে পৃথিবীর বহির্মুখ, অপকেন্দ্রিক শক্তির ফলে ছিটকে মহাশুন্যে নিক্ষিপ্ত হবে সে শক্তি সম্বন্ধে সে ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ-মাত্র কয়েক বছর আগ পর্যন্ত।
যেটা নেই (স্রষ্টা) তাকে মানুষ সেই প্রাক-ঐতিহাসিক কাল থেকে কল্পনা করে নিল, শুধু কল্পনাই নয় বরং সেটা কিরকম তার বিস্তৃত বিবরণ পৃথিবীর এধার থেকে ওধার পর্যন্ত বিশ্বাস করে নিল-কিন্তু যেটা আছে (মধ্যাকর্ষণ) সেটাকে মানুষ হাজার হাজার বছরেও আবিষ্কার করতে পারলো না ? আসল কথা হচ্ছে স্রষ্টা তার প্রেরিতদের দিয়ে সেই প্রথম মানুষটি থেকেই তার অস্তিত্ব ও গুণাবলী অর্থাৎ তিনি কেমন তা মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন বলেই মানুষ তার সম্পর্কে জানে, আর মধ্যাকর্ষণ সম্বন্ধে নিউটনর আগে কাউকে জানাননি বলেই মানুষ তা জানতে পারেনি। স্রষ্টা যদি মানুষ সৃষ্টি করে তাকে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত হতেন, প্রেরিতদের দিয়ে নিজের সম্বন্ধে কিছু না জানাতেন তবে নি:সন্দেহে বলা যায় যে, মানুষ আজও তার সম্বন্ধে কিছুই জানত না কিংবা জানলেও তার গুণাবলী ও সিফাতের ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞই থেকে যেত।
এখন প্রশ্ন হল আমরা তার অস্তিত্বের প্রমাণ পেলাম, কিন্তু আমরা কি তাকে ধারণা করতে পারি ? এর উত্তরে তিনি নিজে বলেছেন- না, তোমরা তা পার না। (সূরা আল-আনাম:১০৩)। কারন আমরা সৃষ্ট, আমাদের শক্তি সীমিত। ধারণার শক্তিও সীমিত। স্রষ্টা অসীম। স্রষ্টাকে কেন, এই মহা সৃষ্টির একটা সামান্য অংশকেও আমরা ধারণা করতে পারি না। যেখানে সৃষ্টির অসীম Space এবং অসীম Time এর বিন্দুমাত্র আমরা ধারণায় আনতে অক্ষম সেখানে অসীম স্রষ্টার ধারণা করতে আমরা কি করে সক্ষম হব ?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন