আল-কোরআন ও আত্মদর্শন
যে নিজেকে চিনেছে, সে তার সৃষ্টিকর্তাকেও চিনেছে। যে সৃষ্টিকর্তাকে
আন্তরিক বিশ্বাস নিয়ে অনুসন্ধান করেছে সে নিজেকেই অনুসন্ধান করেছে। Know
the self 'নিজেকে জানো' বলে সক্রেটিসের একটি কথা আছে, আমাদের মহানবীও
বলেছেন, নিজের মধ্যে তোমার প্রভুকে সন্ধান কর। ইসলামের সূফীবাদের মূল কথাতো
নিজের মধ্যে আল্লাহকে আবিষ্কার করা। মনসুর হল্লাজের ঘটনায় তো আল্লাহর মাঝ
বান্দার সত্তাবিলুপ্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। আবার ইকবালের খুদীর বিষয়টাও
আত্মার এক অপূর্ব আলোকিত অবস্থার স্বীকৃতি।
নিজেকে জানার মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে জানার বিষয়টি যদি সত্যি লুকিয়ে থাকে তাহলে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। প্রশ্ন হলো, কিভাবে আমরা নিজেদেরকে জানব ? আয়নার সামনে দাড়ালে আমরা নিজেদের ছবি দেখি, কিন্তু এমন কি আছে যার সামনে দাড়ালে আমাদের অন্তরের ছবি ভেসে উঠবে ? জ্ঞানের কোন শাখায় বিচরণ করলে আমরা আত্মার সঠিক গতি প্রকৃতি জানতে পারব ? আত্মদর্শন সম্পর্কীয় এরকম অনেক প্রশ্ন এসে হাজির হয়।
যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, তাদের জন্য কোরআন হচ্ছে জীবন জগত ও ইহকাল-পরকালকে সঠিকভাবে জানার নিভূল উৎস। এটাই হচ্ছে একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য। আমরা কিভাবে কোরআন থেকে আত্মদর্শনমূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি ? কোরআনের মধ্যে আল্লাহ যে বিষয়বস্তুকে আমাদের শিক্ষার জন্য বর্ণনা করেছেন তা তো অতীত জাতিসমূহের উত্থান-পতনের কারণ ও কাহিনী এবং সেই প্রেক্ষিতে, আমাদের কর্তব্য-করণীয় বিষয়ে নির্দেশ রয়েছে। এখানে আত্মদর্শন মূলক কথাবার্তা কোথায় ?
যখন আত্মদর্শনের কথা উঠে তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা আমাদের মনের কাছে কি প্রশ্ন করব, যা ভিত্তি হবে নিজেকে জানার ও বুঝার ? কতকগুলো প্রশ্ন আমরা নিজেদের কাছে করতে পারি। যেমন, আমি কে ? উ: মানুষ। আমি কি মারা যাব ? উ : অন্যরা যখন মরছে তখন আমিও মারা যাব। আমার মৃত্যুর পর আমি কোথায় যাব ? উ: ইসলাম ধর্মমতে কবরে এবং আল্লাহর কাছে। কারণ, আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমার মধ্যে অন্তরাত্মা আসল কিভাবে ? উ: কোরআন বলছে আল্লাহ ফুকে দিয়েছেন। আমি কেন চিরকাল এখানে থাকতে পারব না ? উ: কেউই থাকতে পারেনি। আমি নিজেকে সৃষ্টি করিনি, তাহলে আমার উতৎপত্তি কিভাবে ? উ: আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে। আমার কাজের ভাল মন্দ বিচার হয় কেন ? উ: যদি ভালমন্দের বিচার না হয় তাহলে মানুষ হিসেবে আমরা কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলি। আল্লাহকে বিশ্বাস করা জরুরী কেন ? উ : আমরা কি এই পৃথিবী, মহাকাশ সহ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান কোন কিছু সৃষ্টি করেছি ? যিনি এসবের স্রষ্টা তিনি আমারও স্রষ্টা। অতএব তাকে বিশ্বাস করতে হবে। এভাবে আমরা অসংখ্য প্রশ্ন নিজেদের কাছে করতে পারি এবং উত্তরও পাবার চেষ্টা করতে পারি। সম্ভবত এভাবে আমরা আমাদের অন্তরের গুহায় প্রবেশ করতে পারি। যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষের অন্তর বা আত্মা কি ? উ : কোরআন বলছে- এটা তোমার সৃষ্টিকর্তার আদেশ ঘটিত ব্যাপার।
"আত্মার মুক্তি" বলতে যে কথাটা আমরা প্রায়ই বলে থাকি, আসলে সেটা কি ? দেহের অভ্যন্তরে আত্মা নিশ্চয়ই কোন মাংসপিন্ড নয়, যা অসুস্থ হলে আধুনিক শৈল্য চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করা যাবে। আল্লাহ বলেন- 'আমি তোমাদের বাহ্যিক জগতে এবং দেহে ও আত্মার মধ্যে আমার ক্ষমতার নিদর্শন দেখিয়ে থাকি, যার ফলে সত্যের গূঢ়তত্ব তাদের নিকট প্রকাশিত হয়। (সূরা হামীম আস সীজদাহ)। আল্লাহর সৃষ্টিগত কৌশল এবং বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষ কেবল দুটি চোখ দিয়ে দেখতে পায়না। আমরা আধুনিক কালের একটি বড় জাহাজের ইঞ্জিনের গঠন শৈলী দেখি, তার বিভিন্ন পার্টস, নাট বল্টু দিয়ে জোড়া লাগানো প্রত্যক্ষ করি, চাবি দিয়ে ইঞ্জিন চলতে দেখি। কিন্তু একটা জিনিস আমরা চোখে দেখি না, সেটা হলো হর্স পাওয়ার। এটা ইঞ্জিনের কোন অংশে তা কিন্তু আমরা বলতে পারব না। এটা ইঞ্জিনের নির্মতা কোম্পানী বলতে পারবে। এভাবে আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করে আল্লাহ তায়ালা ঐ হর্স পাওয়ার স্বরুপ আত্মশক্তি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অত:পর আমরা স্পন্দিত হয়ে উঠেছি। দেহের সঙ্গে আত্মা এক নিবিড় ঐক্যে জড়িত। দেহের কোন অংশে সমস্যা হলে আত্মার কষ্ট হয়। আবার আত্মার মন-মরা ভাব হলে শরীরও ম্যাজ ম্যাজ করতে থাকে। তবে আত্মা যে ধরনের শক্তি ধারণ করতে সক্ষম, আমাদের দেহ কিন্তু সেরকম শক্তি ধারণ করতে পারে না। দেহ যেমন বস্তুর তৈরী, দেহের শক্তি পারে একটি বস্তুকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তুলে আনতে। দেহের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়গুলো আছে তার কিছু নির্দিষ্ট প্রকাশভঙ্গি আছে এবং কিছু শক্তিও আছে। আমরা যখন পর্যাপ্ত সূষম খাদ্য খাই, তখন আমাদের দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলো সবল হয়ে উঠে এবং সজীব ও সতেজ ইন্দ্রিয়ের কামনা বাসনা বেড়ে যায়। যেমন- যৌন-ইন্দ্রিয়ের কথা বলা যায়। হিন্দু বিধবা রমনীরা নিরামিষ তরকারি এবং আতব চালের ভাত খেয়ে জীবন কাটায় কেবল পূণ্যের কারণে নয়, রিপু দমনের জন্য। আমিষ জাতীয় খাদ্য বেশী খাওয়া হলে যৌন ইন্দ্রিয়ের সজীবতা বৃদ্ধি পায় এবং সেক্ষেত্রে বিবেক বুদ্ধির সুন্দর বিবেচনাগুলো অগ্রাহ্য করে দেহকে নিয়ে যায় নষ্ট অন্ধকারের দিকে। একারনে আট-ইঞ্চি পেটই হচ্ছে সকল পাপের উৎস। ভূরি ভোজনে যারা অভ্যস্ত একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে নিগূঢ় চিন্তা শক্তি তাদের মধ্যে বিকশিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। পরিমিত খাদ্য দেহকে রক্ষা করতে যথেষ্ট। কিন্তু যাদের মন কেবল খাই খাই করে, তারা শুধু দেহটাকে বাচিয়ে রাখা নয়, ফুলিয়ে তোলার জন্যই খায় আর নাক ডেকে ঘুমায়। এরা আসলে জীবনে হয়তো জানে ও না যে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলে একটি ইন্দ্রিয় আছে, তারও একটা ক্ষুধা আছে এবং সেজন্য কিছু লেখাপড়া দরকার।
আত্মার স্বরুপ জানতে পারলে আমরা আত্মার সাধনার কথা ভাবতে পারব। আত্মার স্বরুপ সম্পর্কে ইসলামের খ্যাতনামা দার্শনিক ও বুজুর্গগণ কোরআন-হাদিসের সমর্থনে অনেক কথা বলেছেন। এদের মধ্যে ইমাম গাজ্জালীর অনুসন্ধান সর্বাধিক নিখুত এবং বাস্তব ।আমরা ভাত খেয়ে যেমন পেট ভর্তি করি, তৃপ্তি পাই, তেমনি নিকট আত্মীয় সজনের সুখবর শুনে মনে আনন্দ জাগে, আত্মা তৃপ্তি পায়। ক্ষুধায় পেট যেমন কষ্ট পায়, কোন বিচ্ছেদের সংবাদে আত্মাও কষ্ট পায়। দেহ আত্মাকে ধারণ করে যেমন একটি জীবন্ত ব্যাপার, আত্মাও অনুভুতি লাভের ক্ষমতার জন্য একটি সজিব পদার্থ। অবশ্য চর্মচোখে আত্মাকে দেখা যায় না। এই অদৃশ্যমান অথচ মানবদেহের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ সম্পর্কে আমরা বেখবর থাকতে পারি না। ইন্দ্রিয় সুখের জন্য আমরা যেমন অনেক কিছু করি, আত্মার সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য তেমনি আমাদের অনেক কিছু করনীয় আছে। জড়বস্তুর চেয়ে আত্মা শুধু স্বতন্ত্রই নয়, উচ্চতরও বটে। আত্মা থেকেই আমাদের যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও ক্রিয়ার উৎপত্তি। জড়ের কাজ হলো আত্মার নির্দেশ মেনে চলা। আত্মার উপর যদি ইন্দ্রিয় লিপ্সা প্রাধান্য পায় তাহরে ধীরে ধীরে আত্মার পর্দায় কালিমা পড়ে যায় এবং সে স্রষ্টার মাহাত্ম, ধর্মের নীতিবোধ, প্রতিবেশির কল্যান কিংবা আসন্ন মৃত্যুর ভয়ংকরতা-এর কোন কিছুই তার মধ্যে টেনশন সৃষ্টি করে না। এমন আত্মাকে আমরা মৃত বলে মনে করি। সে জ্ঞান বৃদ্ধির চর্চা মানবজীবন ও সমাজকে উন্নতির পর্যায়ে বিকশিত করেছে তা হলো আত্মারই কার্যাবলী। দেহ মাটির তৈরী তা মাটিতে মিশে যায়, কিন্তু আত্মা আল্লাহর নিজস্ব ভগ্নাংশ, তার মৃত্যু নেই। দেহের কার্যাবলীর উপর ক্ষমতাবান হয়েও আত্মা দেহনিরপেক্ষ এবং অবিনশ্বর। বলতে হয়, চিরন্তন স্বর্গীয় সত্তাই মানুষের সব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতির ভিত্তি। সে জন্য আমরা আত্মার কার্যাবলীকে আধ্যাত্মিক কার্যাবলী হিসেবে গণ্য করি। আত্মার নিয়ন্ত্রণে যাকে অন্তর্চক্ষু সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্যকে দেখতে পায়। আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করার মধ্যেই আত্মার পরম শান্তি, একটা ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রা্প্তি।
অন্তর্চক্ষু খোলার যে কথা আমরা মাঝে মাঝে আলোচনা করি মূলত সেটা হলো আত্মসাধনার উৎকর্ষ। মাথার চারপাশে চোখ থাকলে আমরা মাছির মত বিশ্বের সবকিছু একবারে দেখতে পারতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তবে আমাদের মনের চোখ বাড়াতে পারি। তার মাধ্যম হলো বই পড়া। যে যত বেশি বই পড়ছে, তার ততবেশি মনের চোখ খুলে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা নতুন বই আমাদেরকে একটা নতুন অভিজ্ঞতা দান করছে। এই অভিজ্ঞতাই একধরণের আলো যা দিয়ে আমরা জীবনের অন্যতর সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি। আবার একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল বই পড়ে জীবনের সব সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভব নয়। বই পুস্তকের বাইরেও জীবনের সীমানা বিস্তৃত এবং সেটা আমরা জীবনের ঘটনাগত বাস্তবতার অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করি। এ কারণে প্রত্যেক ধর্মের ধ্যানের একটা গুরুত্ব আছে। ধ্যানের জন্য নি:সীম নির্জনতাও আবশ্যক। বুদ্ধের ধ্যান ব্যর্থ হয় নি। নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ধ্যান ছিল তার সমস্ত মিশনের অংশ। পাদ্রিদের গীর্জা গুলোতে ধ্যানীর সংখ্যাই বেশি। আবার সূফীরা তো ধ্যানজগতের শ্রেষ্ঠ সন্তান। এরা নিজ নিজ ধ্যানলব্ধ অভিজ্ঞতা দ্বারা মানবজীবনের রহস্য, আল্লাহ এবং বিশ্বলোকের রহস্য উপলব্ধি করেন আর সে কারনে বলঅ হয়, প্রকৃত ধ্যান, যেখানে ধ্যানীর আত্মা অসীম সত্তার সঙ্গে মিলনের আকুতিতে মগ্ন সেখানে চিরন্তন কোন সত্যের সাক্ষাত পাওয়া যাবেই।
জ্ঞানার্জন অন্যের জন্য হতে পারে। কিন্তু ধ্যান সম্পূর্ণ নিজের জন্য। ধ্যান নিজেকে জানারা। সীমাহীন বিশ্বের মাঝখানে নিজের স্থানটুকু আবিষ্কার করার জন্য ধ্যান। ধ্যানের কাছে তথ্য নয়, বিশ্লেষণ নয়, বিবেকের যুক্তি নয়, আত্মার নির্মল উপলব্ধি। ভাবুকের পথ ধ্যানের, করিব পথ ধ্যানের, ধার্মিকের পথ ধ্যানের। শিক্ষকের অধ্যয়নে অনেক পাঠবিভাজন থাকে, কিন্তু শিক্ষক যখন ধ্যানী হন তখন তিনি অখন্ড অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করেন। ধ্যান ধ্যানগত উপলব্ধির বিণ্যাস, একটি অখন্ড প্রনোদনা। কিন্তু অঙ্ক বা পদার্থ বিজ্ঞান ধ্যান নয়, গবেষণা। অবশ্য গাণিতিক গীতিকারের মত আবেগমন্ডিত হন যখন তার অনুমান সত্যের কাছাকাছি তাকে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে আইনস্টাইনই বড় উদাহরণ।
ধ্যান আত্মার গভীরে ডুব দেওয়া। শিক্ষা বিবেককে যু্ক্তি দ্বারা শানিত করা। একটি সম্পূর্ণ ভাবাত্মক, অন্যটি তথ্যনির্ভর। এখানে ইসলাম কিন্তু দুটোকে সমন্বিত করেছে। ধ্যান ও শিক্ষা দুটোর সমবায়ে সমন্বয়ে ইসলামের সংস্কৃতি গঠিত। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে পরম সত্তার শাশ্বত সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ধ্যানের মধ্যে ব্যাক্তির অহম, বা আমিত্বের বিলোপ ঘটে। যেটা শরীয়তের ভাষায় অহঙ্কার না করা, সূফীর ভাষায় রিয়ামুক্ত হওয়া। আর সাধারণ ভাবে এটা হলো সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে সমান করে দেখা।
মহানবী (স.) ধ্যাণ করে আল্লাহর ইঙ্গিত লাভ করলেন, হেরা গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। জিব্রাইল (আ.) আনিত বানী, পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষ জানত না। ধ্যানলব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি পরম প্রভুর বাস্তব অস্তিত্বকে অবিষ্কার করলেন। অত:পর তার কাছে আনীত বানীর দ্বারা নিজের জ্ঞান ভান্ডারকে করলেন ব্যাপক ও বিস্তৃত। তার মাঝে কেবল ভাবাত্মক শব্দগুচ্ছ এলোনা, তার কাছে মানব জাতির ইতিহাস, বিভিন্ন যুগের ঘটনা, বিচিত্র রহস্য-উন্মোচিত হল এবং কোরআনের বিস্তৃত পরিসরে লিপিবদ্ধ সেই সব কাহিনী মানুষের শিক্ষার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। এটা হলো বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এমন এক অবিস্মরনীয় ঘটনা যা আর কখনোই ঘটবে না। ধ্যানের চুড়ান্ত শিখরে উন্নীত এক মহা মানব, বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সতর্কসংকেত শুনিয়ে গেলেন, দিয়ে গেলেন পতিদিন পড়ার মত একটি গ্রন্থ এবং রেখে গেলেন নিজের জীবন চরিত্র তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ অপরিহার্য এবং শেষ বিচারে করজোড়ে দন্ডায়মান হতে হবে।
যে ধ্যান করবে তার যোগ্যতা কি ? অন্ধকারে আসন গেড়ে বসলেই কি ধ্যান হবে ? ধ্যানীর জীবিকা তো বন্ধ হলে চলবে না। কিন্তু তিনি কিভাবে একই সঙ্গে জীবিকার্জন করবেন এবং ধ্যান করবেন ? দেহের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য যে কাজটুকু অনিবার্য তা নিজহাতে করতেই হবে এবং সেটা হতে হবে সম্পূর্ণ সততার মানদন্ডে যাচাইকৃত। কোন অসৎলোকের ইবাদত আল্লাহ কামনা করেন না। আত্মাকে ধ্যানের যোগ্য করার পূর্বশর্ত হলো সৎ উপার্জন। বিলাস ব্যাসনে থেকে ধ্যান হয় না, গুন গুন করা হয়। A Pure soul may hope to be illuminate. সততা ও আন্তরিকতা ধ্যানের পূর্বশর্ত। সততা ও আন্তরিকতা এক ধরনের আলোকিত অবস্থা; এটা আত্মার কাছে বিবেকের অঙ্গীকার এবং বিবেকের প্রতি আত্মার দাবীও বটে। আবার এ সততা অবলম্বন ও আন্তরিকতা পোষণ সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ব্যাতিত হতে পারে না। কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট বলেন, তোমরা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যাতিত কিছুই ইচ্ছা করতে পার না। হ্যা আমরা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যাতিত কোন কিছুর ইচ্ছা করতে পারি না। কিন্তু তাই বলে আমরা কি নিয়তির হতের পুতুল ? না, সেটাও নয়। দার্শনিক যুক্তিতে, নয়তির হাতে মানুষ যদি পুতুল হয়, তাহলে মানুষের ভাল মন্দ কাজের দায় মানুষের ঘাড়ে চাপাতে পারে না। মানুষ বাহ্যত কর্মে স্বাধীন এবং ফলাফল তার কর্মানুসারে হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু যদি কখনো না হয়, সে জন্য আমরা কাকে দোষ দিব ? আল্লাহকে ? আল্লাহে তো মহান ও পবিত্র। আমরা যখন দেখি কোন বৃদ্ধের একমাত্র অবলম্বন তার কর্মক্ষম ছেলেটি বজ্রাঘাতে মারা গেছে, এবং মহিলার স্বামী সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে, তখন উভয়ের শোকাহত আত্মাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য নিয়তি নির্ভরতা ছাড়া আর কি থাকতে পারে ? জীবনের জন্য শেষ অবলম্বন হয়ে উঠে নিয়তি। আত্মার অনুসন্ধানে নেমে আমরা নিয়তির কাছে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করি, সেটা আমাদের অগ্রযাত্রার স্বাভাবিক পরিণতি।
মানব মনে প্রতিদিন যে প্রত্যাশাগুলো গুঞ্জরিত হয়, তা তার কর্মপ্রবণসত্তার উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং সে দেহকে কর্মের দিকে ঐ প্রত্যাশা পূরণের জন্য চালিত করে। শেষে সাফল্য বা ব্যার্থতা যাই আসুক কাজের মধ্যে থাকাই মানব ধর্ম। আত্মদর্শনের মধ্যে এটাও একটি ব্যাপার যে, আমরা কেবল বায়বীয় একটা সত্তার চিন্তায় মগ্ন থেকে কর্মহীন প্রহরগুলো নি:শেষ করতে পারি না। আমরা মনে করি, ব্যাক্তির দেহে জ্বলন্ত প্রদীপের মত যে আত্মার অবস্থান তার মধ্যে জিকির সৃষ্টি করার যে সব সূফীতত্ত্ব রয়েছে, তা বেকারত্বের এযুগে খুবই কাজের কথা। কিন্তু দুবেলা কাজ করে যাদের বাচতে হয় তারা তো কাজের মধ্যে আল্লাহকে স্মরণ করে। আত্মার কার্যাবলী সম্পর্কে ভাববাদী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তেমনটা না গিয়েও বলতে হয়, আত্মার পরিচয় লাভ মানে সব কিছুর পরিচয় লাভ করা বোঝায়। খেয়ে পরে আরাম-আয়েশে জীবনটাকে অতিবাহিত করাই যাদের উদ্যেশ্য, তাদের কাছে আত্মার গল্প করে লাভ নেই। তাদের মধ্যে আত্মা চিরসমাহিত লাশের মত মৃত। জীবনের অর্থ তাদের কাছে-এই পৃথিবীটুকুই সব। দুচোখে যা দেখা যায়, তার বাইরে কিছু নেই- এটা যাদের বিশ্বাস তাদের কাছে আল্লাহর অপার মহিমার কথা বলে লাভ নেই। কোরআনের ভাষায়- " নিশ্চিতই যারা কাফের হয়েছে, তাদেরকে আপনি ভয় প্রদর্শন করুন আর নাই করুন তাতে কিছুই আসে যায় না, তারা ইমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন আর তাদের চোখ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (বাকারা:৬-৭)
কোরআনের আলোকে আত্মদর্শন একটি নিগুঢ় ব্যাপার। এটা অনেক চিন্তা ও অনেক সাধনার বিষয়। সর্বপরি আল্লাহর অনুগ্রহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষ এক ঐশী প্রেরণায় নিজেকে চিনতে পারে। রাশিয়ান একটি প্রবাদ আছে। যদি তোমার চেহারা কুৎষিৎ দেখায়, তুমি আয়নাকে দোষ দিও না। আমরা কোরআনকে একটা স্বচ্ছ আয়না হিসেবে যদি ধরে নেই, এবং আমরা এর সামনে যদি দাড়াই, তাহলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে আমরা কি নিজেদের মধ্যে মধ্যে অসংখ্য অপূর্ণতা দেখতে পাই না ? যারা কোরআনকে বিশ্বাস করার পর ত্যাগ করেছে তাদের অন্তর্জগতের ধারণা কি এটা নয় যে, এ গ্রন্থের বক্তব্য ও উপদেশ তাদের কোন কাজে আসেনি ? অতএব তারা এটাকে অগ্রাহ্য করেছে্ আসলে এটাকে অগ্রাহ্য করার মত প্রজ্ঞা কি আমাদের আছে ? কোরআনের মানবজীবন ও তার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা যদি বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে আমরা এটাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারব না ? তাহেলে কোরআনের ভাষায় আমরা সুস্পষ্ট গোমরাহীর পথে আছি। কোরআন মানব জাতীর জন্য একটি দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধান। ফলে মানুষ তার আচরণ ও ইচ্ছার মধ্যে নিয়ত পরিবর্তনশীল থেকে আধুনিক জীবনের এমন এক অবস্থায় উন্নীত হয়েছে যে এখানে যদি তাকে কোরআন মোতাবেক হারাম ও হালাল বাছাই করে ভোগ করতে বলা হয় তাহলে কয়েকজন দৃঢ় চিত্তের খাটি ইমানদ্বার ব্যতীত, অন্যরা হতাশ হবে এবং দৌড়ে পালাবে। বলবে, কোরআনের কিছু বিধান অনুপুঙ্খ মেনে চলা সম্ভব নয়, অথচ আল্লাহ বলেছেন, এ কোরআনের কিছু অংশ মানবে কিছু অংশ মানবে না, তা হবে না। এটা আমাদের আত্মগত উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ।
আত্মানুসন্ধানের এযুগে ইসলাম কেন বিভিন্ন সমাজে পচনশীল পঙ্কের মধ্যে আটকে গেছে ? ইসলাম নিয়ে যারা খুব ভাবেন তারা কি বলবেন, মুসলমানরা তাদের পরম সত্তাকে চিনতে ব্যার্থ হচ্ছে। বৈশ্বিক বিবর্তনের ধারাকে নিজেদের প্রজ্ঞার দ্বারা অনুধাবনে অক্ষম হয়ে গা ভাসিয়ে চলছে। আমরা ইসলামী জগতের ধারাবাহিক অধ:পতন দেখে কোন কিছুতে আর বিশ্বাস রাখতে পারছিনা। ইকবালের খুদী, ইমাম গাজ্জালীর আত্মাবস্তু কিংবা মাওলানা রুমীর প্রেমিক সত্তা যাই বলি না কেন, মানুষের ভেতরের জগতটি কিন্তু চিন্তার জটিলতার সঙ্গে না জড়িয়ে বাহ্যিক, মোহপ্রবণ তুচ্ছ হীনতর কাজ কর্মের সঙ্গে মিশে গেছে এমনভাবে যে উন্নতরুচিশীল লোকজনকেও আমরা আলাদা করতে পারি না। মানুষের অহংবোধ বা আমিত্ব বজার রাখার মধ্যে একটা মানবীয় গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাও যেন আজ বিলুপ্ত প্রায়।
কোরআনের সংহত বক্তব্যের রেশ ধরে আনেক দার্শনিক তাদের নিজস্ব অভিমতকে নানা ভাবে আলোচনা করেছেন। আমাদের মাঝে যে সসীম সত্তা বিরাজমান তা ইকবালের কাছে খুদী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে এবং তিনি মনে করেন, "খুদী আমাদের অভিজ্ঞতার নাগালের বাইরের জিনিস নয়। অন্তনির্হিত অভিজ্ঞতাই সক্রিয় খুদীর নামান্তর।" আত্মা বা খুদী ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যায়, সেটা হয় আমাদের ধারাবাহিক অপকর্মের জন্য। আল্লাহ বলেন " আমার বানী কখনোগুজব নয়, বরং তাদের অর্জিত কর্মের দোষে তাদের আত্মার উপর মরিচা পড়েছে। (সুরা মুতাফফিফীন : ১৪)
আত্মা কিভাবে কালিমা লিপ্ত হয়, বা মরিচা পড়ে যায় আত্মার পর্দায় তা কিন্তু একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার বিষয়। যাদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তি ও মিথ্যা বলার প্রবণতা আছে, তারা সুযোগ পেলেই চুরি করে এবং মিথ্যা কথা বলে। এভাবে দীর্ঘ দিনের চুরি ও মিথ্যা বলার অভ্যাস ঐ ব্যাক্তির মধ্যে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, দুচারটা গালাগাল বা চড় ঘুষিতে তার বদ অভ্যাস দূর হয় না এবং লোকের অপমান তার মধ্যে কোন কোন প্রতিক্রিয়া করে না এবং অন্যের অনিষ্টের জন্যে দৌড়ে যায় নতুন ফন্দি এটে। এ সমাজের পকেটমার, ঘুষখোর সুদখোর, দালাল, চোরাচালানী, অন্যায় বিচারক, অসত রাজনীতিবিদ সহ বড় বড় দাগী সন্ত্রাসীদের আত্মা কালিমাপূর্ণ। তাদের কাছে ভাল কথা পছন্দ হয় না, ভাল উপদেশকে বিষাক্ত মনে হয় তাদের। যেমন কোন গণিকালয়ের বারণবনিতাদের কাছে যদি ভাল থাকা খাওয়ার প্রস্তাব করা হয়, তাহলে তারা মুখ ভেঙচি দিয়ে উপহাস করে উড়িয়ে দেবে। কারণ যে দুষ্কর্মের মধ্যে তারা ডুবেছে, তা তাদের দৈনিক রুটি রুজির ব্যাবস্থা করছে, তাদের মনে এমন উচ্চাশা অবশিষ্ট নেই যে তারা ওখান থেকে বেরিয়ে এসে অন্য পাচটা ভদ্র মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারবে।
ইকবাল ও গাজ্জালী খুদি বা আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যথেষ্ট গভীর তাৎপর্যের সঙ্গে। তবে তাদের আলোচনা দার্শনিক স্তরে সীমিত রয়েছে। আমরা দেখেছি, আত্মা সম্পর্কে কোরআন খুব বেশী আলোচনা না করে বরং মানুষের ভাল ও মন্দ কাজের ফলাফল সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর গুনাবলী, পরকাল, কিয়ামত, নবী রাসূল, বেহেস্ত-দোযখ, জীন-ফেরেশ্তা সহ অনেক বিষয়ের আলোচনা এসেছে সবিস্তারে, পৌন:পুনিক রীতিতে। এসব বিষয় নিয়ে দার্শনিকরা যখন আলোচনা করেন তখন তা হয় দার্শনিকক আলোচনা-সমালোচনা। সেটা ধর্মগ্রন্থের আলোচনা নয়। অথচ কোরআন কোন দার্শনিকের দর্শন-গ্রন্থ নয়, এটি নির্দোষ একটি ধর্মগ্রন্থ এবং এর উদ্দেশ্য বিশ্বাসীদের মধ্যে ধর্মের বিধানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার, চিন্তায় এবং আচরণে প্রতিফলিত করা। আর সেজন্য একই বক্তব্য বহুবার এখানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে যাতে পাঠকের মনোলোকে খোদিত হয় এর বিষয়বস্তু। অতএব আত্মার বহুবিধ পরিচয় প্রদানে ইমাম গাজ্জালীর আলোচনা উচ্চাঙ্গের সন্দেহ নেই, তবে আমরা কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গিকে অধিকতর সহজ ও সরল মনে করি। "নিস্কলঙ্ক আত্মা সহকারে আল্লাহর দরবারে আগমণকারী ব্যাতিত কেহই মুক্তি পাবে না।" (সুরা আরাফ )।
ইসলামে জ্ঞানার্জনের পথ উন্মুক্ত। কিন্তু যে জ্ঞান কেবল পার্থিব কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে অর্জিত হয়, তার জন্য কোন পূণ্য নেই। আত্মজ্ঞান মানব জীবনে এমন বস্তু যার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে তার প্রকৃত অবস্থা। মানুষের প্রকৃত অবস্থা কি ? মানুষের প্রকৃত অবস্থা যে কি সেটা আমরা জানব কিভাবে ? আমরা দেখি শিশু হয়ে জন্মে, বৃদ্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়, কেউ শিশু বয়সেই মৃত্যবরণ করে, কেউ কৈশোরে, বা কেউ ভরা যৌবনেও মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবন ক্ষণস্থায়ী যদিও তার প্রত্যাশা সে দীর্ঘকাল বেচে থাকবে। মানুষের আর একটি অবস্থা হলো, বিপদে পড়লে সে অদৃশ্য কোন এক শক্তির কাছে সাহায্য চেয়ে ক্রন্দন করে এবং বিপদ কেটে গেলে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। তৃতীয়ত: অবস্থা হলো মানুষ সৃষ্টিগতভাবে দূবল এবং তর্কপ্রিয়। একজন সৃষ্টিকর্তার প্রতি নি:শর্ত বিশ্বাস স্থাপন মানুষের জন্য খুব কঠিন কাজ। চতুর্থত: বস্তুগত ভাবে মানুষ যা ভোগ করতে সক্ষম ; তার চেয়ে সে অনেক বেশি আকাংখা করে এবং মৃত্যুর কোন চিন্তাই করে না। মানুষের এই জাগতিক অবস্থা- এগুলো কি তার জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনছে ? বস্তুতপক্ষে মানুষ তার ক্ষতিকর অবস্থাগুলো অতিক্রম করে কল্যাণকর অবস্থার দিকে অগ্রসর হবে- সেটাই উন্নতি এবং এই উন্নতি সম্ভব হতে পারে জীবন ও জগতের রহস্য জানার মাধ্যমে। জীবন ও জগতের রহস্য উদঘাটন করা গেলে আমরা নিজেদের অস্তিত্বকে বুঝতে পারব। বিজ্ঞান যেমন বিশ্বের অনেক রহস্য-ভেদ করে ছুটে চলেছে অসীম আকাশে, নভনীলাময়। আত্মজ্ঞানও একটা বিজ্ঞান। যাকে ইংরেজিতে বলা যায় Spiritual science, আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান এবং অধিবিদ্যা এক নয়।
আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান এমন এক ধরনের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করে যা মানুষের অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দেয়। আত্মজ্ঞান অর্জনের কৌশলই হল আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমরা জানি দুধের মধ্যে মাখন,ছানা, ননি ইত্যাদি আছে। এখন এক ব্যারেল দুধের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেই কি আমাদের হাতে মাখন আসবে ? আসবে না; কস্মিনকালেও মাখন বা ছানা পাওয়া যাবে না যতক্ষণ না দুধ জ্বাল দিয়ে গোয়ালার দ্বারা টানানো হয়। অর্থাৎ একটি পদ্ধতির প্রয়োগ করে কাম্যবস্তু পাওয়া যাবে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, 'তোমরা কি দেখনা, গাছপালা আমাকে সিজদা করে?' আমরা কি দেখি গাছপালা আল্লাহকে সিজদা করছে ? না আমাদের চোখে ধরা পড়ছে না, তবে কি কোরআনে আল্লাহ মিথ্যা বলেছেন ? না আল্লাহতো কোরআনে মিথ্যাও বলতে পারেন না। তাহলে এখানে অবশ্যই এমন একটি পদ্ধতি গোপন রয়েছে যা প্রেয়োগ না করে আমরা গাছপালার ইবাদত বন্দেগী দেখতে পাব না। সেই পদ্ধতিটা কি ? হযরত সুলাইমান (আ.) কে আল্লাহ পশুপাখির ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর দাউদ আ. এর সাথে ইবাদত করত পাহাড় পর্বত। আল্লাহ যদি কাউকে তার অপার রহস্য উদঘাটনের পদ্ধতি শিক্ষা না দেন তাহলে কারো পক্ষেই সম্ভব নয় তা উদঘাটন করা। আমরা জানি আউলিয়ায়ে কেরামগণ অনেক কারাত দেখিয়েছেন এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেক অমুসলিম মুসলিম হয়েছে। তবে ইসলামকে অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ বললে ভুল হবে। অলৌকিকতা ইসলামে আছে, তবে সেটাকে ছাপিয়ে উঠেছে বাস্তবতা। বাস্তবতাই ইসলামের প্রাণশক্তি; কারণ অনেকগুলো যদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে ইসলামকে টিকে থাকতে হয়েছে। অতএব আমরা যখন ইসলামকে জানব, তখন দেখব আমরা সত্যের সঙ্গে মিথ্যার লড়াই, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, ভালর সঙ্গে মন্দের। কেবল ব্যাক্তি সত্তার বিচিত্রবিধ অনূভুতির অনুসন্ধানই সত্যানুসন্ধান নয়, ইসলামের জীবন আগাগোড়া টিকে থাকে বিরুদ্ধ পরিবেশে সংগ্রাম করে সেটা জানাও সত্যানুসন্ধান। সূফীরা ব্যাক্তির ভিতর খোদার প্রেম অনুভব করতে গিয়ে যে মতবাদ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে পার্থিব লালসার অংশটুকু বাদ দিলে, সেটা ইসলামের চরম উৎকর্ষ বলা যায় নি:সন্দেহে কিন্তু তাতে ইসলামের জাগতিক উদ্দেশ্যকে পুরোপুরি বানচাল করার ঝুকি থাকে। কারণ আগেই বলা হয়েছে, ইসলামে আবেগের চেয়ে নীতির, অলসতার চেয়ে কর্মশীলতার, তর্কের চেয়ে নি:সংশয় বিশ্বাসের মূল্য অনেক বেশি।
আমরা দেখছি বিজ্ঞান বিশ্ব প্রকৃতির অনেক রহস্য জেনেছে এবং যা একদা মানুষের কাছে ভীতিকর ছিল, তা মানুষের কল্যাণে কাজে ব্যাবহৃত হয়েছে। আমরা যখন জানব মানুষের চরিত্রনীতি, পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থা, যখন আমরা জানব সৃষ্টিকর্তার মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তার মৌলিক পরিচয় তখন আমরা নিজেদেরকেও জানব, নিজেদেরকে তখন জানা হয়ে যাবে। মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে মূল্যায়ন না করে নিজের সত্তাকে কোথাও স্থায়ীভাবে স্থাপন করতে পারে না। আমাদের জীবন শুধু খেয়ে পরে বেচে থাকার জন্য নয়, দিনে কাজ আর রাতে ঘুম এটাই জীবন নয়; এর বাইরে জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ পড়ে আছে। একারণে একজন জমিদারের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের পর কেউ তাকে নিয়ে আলোচনা করে না, কিন্তু হাজার বছর আগের একজন কবি বা চিন্তাবিদ বা মরমী জ্ঞান তাপসকে নিয়ে মানুষ আলোচনা করে। তাই মানুষ কেবল খেয়েই বাচে না, তার বাচার জন্য দরকার অনন্ত সত্যের সাধনা, যে অনন্ত সাবান-কাপড়ের মতো জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। তা কেউ কাব্যকুশলতার মধ্যদিয়ে ধরতে চায়, কেউ শিল্পের তুলিতে আকতে চায়, কেউ গদ্যের ঝাঝালো বাক্যের বন্ধনে আটকাতে চায়, আবার কেউ মরমী সাধনায় আত্মার সেই অফুরন্ত অনন্তের বানী শুনতে পায়।
সাধকের সাধনাবলে যে সত্য বাস্তবে ধরা দেয় তা মানব জীবনে নিয়ে আসে পরিবর্তন। অমুল পরিবর্তনের জন্য সত্যের প্রয়োজন প্রতিযুগে; কারো কারো সাধনায় সেই সত্য নিশ্চিত ধরা দেয়। নয়তো মানব সভ্যতা টিকে থাকে কি করে ? আমরা শুধু সাড়ে তিনহাত দেহের সমপরিমাণ গৃহ নির্মান করে বাচতে পারি না, যদিও মৃতের জন্য ওটুকুই দরকার। আমরা নিজেদেরকে জানব, এর বিকল্প আর কিছু নেই। তাহলে আমরা বুঝতে পারব, কোরআন কেন অধ্যায়নের উপর সর্বাধিক জোর দিয়েছে। ধ্যানকে অধ্যায়নের বিকল্প করা হয় নি। ধ্যানের কাজ নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে এক শাশ্বত ঐক্যের মধ্যে এন উপলব্ধি করা, আর অধ্যায়ন হলো পরিপার্শ্ব ও সমাজ, ধর্ম ও সভ্যতা, ভাল ও মন্দ, আইন ও অপরাধ শাস্ত্র, বিজ্ঞান ও ভুমার পরিচয় লাভ। এদুটোই ব্যক্তিকে জাগ্রত করে। অতএব নিজেকে জানার যে কথা বলা হয়েছে, তা সৃস্টিকর্তার পরিচয় জানার সাপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়া। মূল কথা, সৃষ্টিকর্তাকে সামনে না রেখে নিজেকে জানা কখনো সম্পন্ন হবে না। যেহেতু ব্যাক্তি তার নিজের স্রষ্টা নন, সেহেতু স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তার কোন সাধনাই মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা বা সত্যানুসন্ধানের পথে সহায়ক নয়, দেহের অভ্যন্তরে মোহপ্রবণ যে ইন্দ্রিয় সক্রিয়, নারী ও মদ, অর্থ ও অট্টালিকার আরাম আয়েশ লাভ করলে সেটা আরো সক্রিয় ও উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং অন্তর্চক্ষুর আলো পুরোপুরি নিভিয়ে দেয়। ফলে সে অর্থ সম্পদ ব্যায় করে বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করেও ইন্দ্রয় লালসা নিবৃত্ত করতে পারে না। অন্তর্চক্ষু যার খুলে যায় সে পবিত্র ও অপবিত্র, ন্যায় ও অন্যায়, ভাল ও মন্দের পার্থক্য সহজে সনাক্ত করতে পারে এবং পবিত্রতার উপর স্থির থাকতে পারে। কিন্তু জীবনটা যখন ভোগ সর্বস্ব হয়ে উঠবে, তখন মানব কল্যাণ, ইশ্বর চিন্তা, খোদাতত্ত্ব জ্ঞান, পরিণাম ভাবনা, কিংবা দেশ প্রেমের মত বিষয়গুলো বিবেকের কাছে গুরুত্ব পাবে না। বর্তমান যুগের ছবি-সিনেমা-মডেলিং ব্যাবসায় জড়িত তরুন-তরুনীদের অর্থ ও বিত্তের সঙ্গে এমন সস্তা প্রশংসা ও হাততালির জন্য লালায়িত যে, ধর্ম সম্পর্কে ওদের না আছে কোন ধারনা, না আছে অন্তরে কোন ভয়। পার্থিব জীবনের যে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ পথের ধূলিতূল্য যে যশ ও খ্যাতি, তার পিছনে এরা মৌমাছির মত ছুটে চলছে, জীবন সম্পর্কে এদের ধারনা কেবল এটাই, দেহজ সৌন্দর্য ছড়িয়ে কামনার জাল ফেলে মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে দ্রুত ধনী হওয়া, বিত্তবানদের তালিকাভুক্ত হওয়া। "তার কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না ? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ ? " (সূরা মুহাম্মদ)। মানুষের দেহের মধ্যে একটি অন্তরই দেওয়অ হয়েছে। অতএব ঐ অন্তরের যে অংশটুকু পার্থিব সুখ সম্ভোগে ব্যস্ত, এতটুকু আধ্যাত্মিক চিন্তা বঞ্চিত। এখন যদি একজন মানুষ দিনরাত ২৪ ঘন্টাই পার্থিব সুখ-সুবিধার চিন্তায় ব্যস্ত থাকে, একবেলা নামায পড়া, অথবা পাচজন মিসকিনকে খাওয়ানোর কিংবা বছরের রমজানের ৩০ টা রোজা রাখার সময় না পায়-তাহলে আমরা এমন লোকের কাছে আত্মজ্ঞান বা সত্যানুসন্ধানের প্রস্তাব করলে সে কি আমাদেরকে সঠিক কোন উত্তর দিতে পারবে ? আজ এ ধরনের লোকের সংখ্যা কি সমাজে বিশি না ? আমরা পচনশীল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থার ধ্বংসস্তুপের উপর দাড়িয়ে-কিভাবে পুনর্গঠনের কথা চিন্তা করব যদি আমরা একজন মহান সৃস্টিকর্তাকে অন্তরে ঠাই না দেই, যেভাবে ঠাই দেয়া উচিত ? আত্মদর্শন যে কোন দর্শনশাস্ত্রের সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বুদ্ধের আত্মদর্শন, মানব জীবন দু:খপূর্ণ, কর্মের মাধ্যমে দু:খ থেকে মুক্তি লাভই নির্বাণ বা মোক্ষলাভ। খ্রিষ্ট মতে, আত্মদর্শনে রয়েছে তত্ত্ব এবং নিষ্পাপ হয়ে খোদার স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ এবং সেজন্য মানব সেবাই তাদের ব্রত। হিন্দু ধর্মের আত্মদর্শন, নিষ্কাম সাধনা বলে সর্বভূতে ভগবানকে লাভ করা। আর ইসলামে আত্মদর্শন মানে, দেহ ও আত্মার বাস্তব পরিচয় জানা, মানুষ ও বিশ্ব পরিমন্ডলের স্রষ্টাকে জানা, স্রষ্টার নির্দেশিত পথে আরাধনা করা এবং পরকালীন জীবনকে দৃঢ় বিশ্বাসের মধ্যে রেখে মৃত্যুপর্যন্ত সৎ জীবন যাপন করা। আমরা যদি সত্যিকারভাবে ইসলামকে জীবনের জন্য অনিবার্য ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে কোরআনের উপদেশই আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ আত্মদর্শন।
"তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমন কর এবং দেখ - যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশাবলী।" (সূরা আল-ইমরান : ১৩৭-১৩৮)।
ত্রিশপারা কোরআনের পাতায় পাতায় মানুষের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপনের জন্য রয়েছে শত সহস্র উপদেশ ও নির্দেশনা। সেসবগুলোর আলোচনার জন্য প্রয়োজন সুবিশাল গ্রন্থ রচনা। আমরা সমগ্র কোরআনে বর্ণিত উপদেশ বানীর সারাংশ মাত্র একটি কথার মধ্যেই পাই তা হলো - "তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎ রিযিক সন্ধান কর যদি পরকালে বিশ্বসী হও।" এই একটি উপদেশই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিতে পারে। জ্ঞানীদের জন্য ঈঙ্গিতই যথেষ্ট।
নিজেকে জানার মধ্যে সৃষ্টিকর্তাকে জানার বিষয়টি যদি সত্যি লুকিয়ে থাকে তাহলে নিজেকে জানার প্রচেষ্টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। প্রশ্ন হলো, কিভাবে আমরা নিজেদেরকে জানব ? আয়নার সামনে দাড়ালে আমরা নিজেদের ছবি দেখি, কিন্তু এমন কি আছে যার সামনে দাড়ালে আমাদের অন্তরের ছবি ভেসে উঠবে ? জ্ঞানের কোন শাখায় বিচরণ করলে আমরা আত্মার সঠিক গতি প্রকৃতি জানতে পারব ? আত্মদর্শন সম্পর্কীয় এরকম অনেক প্রশ্ন এসে হাজির হয়।
যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, তাদের জন্য কোরআন হচ্ছে জীবন জগত ও ইহকাল-পরকালকে সঠিকভাবে জানার নিভূল উৎস। এটাই হচ্ছে একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের সৌভাগ্য। আমরা কিভাবে কোরআন থেকে আত্মদর্শনমূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি ? কোরআনের মধ্যে আল্লাহ যে বিষয়বস্তুকে আমাদের শিক্ষার জন্য বর্ণনা করেছেন তা তো অতীত জাতিসমূহের উত্থান-পতনের কারণ ও কাহিনী এবং সেই প্রেক্ষিতে, আমাদের কর্তব্য-করণীয় বিষয়ে নির্দেশ রয়েছে। এখানে আত্মদর্শন মূলক কথাবার্তা কোথায় ?
যখন আত্মদর্শনের কথা উঠে তখন প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা আমাদের মনের কাছে কি প্রশ্ন করব, যা ভিত্তি হবে নিজেকে জানার ও বুঝার ? কতকগুলো প্রশ্ন আমরা নিজেদের কাছে করতে পারি। যেমন, আমি কে ? উ: মানুষ। আমি কি মারা যাব ? উ : অন্যরা যখন মরছে তখন আমিও মারা যাব। আমার মৃত্যুর পর আমি কোথায় যাব ? উ: ইসলাম ধর্মমতে কবরে এবং আল্লাহর কাছে। কারণ, আল্লাহ আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমার মধ্যে অন্তরাত্মা আসল কিভাবে ? উ: কোরআন বলছে আল্লাহ ফুকে দিয়েছেন। আমি কেন চিরকাল এখানে থাকতে পারব না ? উ: কেউই থাকতে পারেনি। আমি নিজেকে সৃষ্টি করিনি, তাহলে আমার উতৎপত্তি কিভাবে ? উ: আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে। আমার কাজের ভাল মন্দ বিচার হয় কেন ? উ: যদি ভালমন্দের বিচার না হয় তাহলে মানুষ হিসেবে আমরা কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলি। আল্লাহকে বিশ্বাস করা জরুরী কেন ? উ : আমরা কি এই পৃথিবী, মহাকাশ সহ দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান কোন কিছু সৃষ্টি করেছি ? যিনি এসবের স্রষ্টা তিনি আমারও স্রষ্টা। অতএব তাকে বিশ্বাস করতে হবে। এভাবে আমরা অসংখ্য প্রশ্ন নিজেদের কাছে করতে পারি এবং উত্তরও পাবার চেষ্টা করতে পারি। সম্ভবত এভাবে আমরা আমাদের অন্তরের গুহায় প্রবেশ করতে পারি। যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষের অন্তর বা আত্মা কি ? উ : কোরআন বলছে- এটা তোমার সৃষ্টিকর্তার আদেশ ঘটিত ব্যাপার।
"আত্মার মুক্তি" বলতে যে কথাটা আমরা প্রায়ই বলে থাকি, আসলে সেটা কি ? দেহের অভ্যন্তরে আত্মা নিশ্চয়ই কোন মাংসপিন্ড নয়, যা অসুস্থ হলে আধুনিক শৈল্য চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করা যাবে। আল্লাহ বলেন- 'আমি তোমাদের বাহ্যিক জগতে এবং দেহে ও আত্মার মধ্যে আমার ক্ষমতার নিদর্শন দেখিয়ে থাকি, যার ফলে সত্যের গূঢ়তত্ব তাদের নিকট প্রকাশিত হয়। (সূরা হামীম আস সীজদাহ)। আল্লাহর সৃষ্টিগত কৌশল এবং বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা মানুষ কেবল দুটি চোখ দিয়ে দেখতে পায়না। আমরা আধুনিক কালের একটি বড় জাহাজের ইঞ্জিনের গঠন শৈলী দেখি, তার বিভিন্ন পার্টস, নাট বল্টু দিয়ে জোড়া লাগানো প্রত্যক্ষ করি, চাবি দিয়ে ইঞ্জিন চলতে দেখি। কিন্তু একটা জিনিস আমরা চোখে দেখি না, সেটা হলো হর্স পাওয়ার। এটা ইঞ্জিনের কোন অংশে তা কিন্তু আমরা বলতে পারব না। এটা ইঞ্জিনের নির্মতা কোম্পানী বলতে পারবে। এভাবে আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করে আল্লাহ তায়ালা ঐ হর্স পাওয়ার স্বরুপ আত্মশক্তি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। অত:পর আমরা স্পন্দিত হয়ে উঠেছি। দেহের সঙ্গে আত্মা এক নিবিড় ঐক্যে জড়িত। দেহের কোন অংশে সমস্যা হলে আত্মার কষ্ট হয়। আবার আত্মার মন-মরা ভাব হলে শরীরও ম্যাজ ম্যাজ করতে থাকে। তবে আত্মা যে ধরনের শক্তি ধারণ করতে সক্ষম, আমাদের দেহ কিন্তু সেরকম শক্তি ধারণ করতে পারে না। দেহ যেমন বস্তুর তৈরী, দেহের শক্তি পারে একটি বস্তুকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তুলে আনতে। দেহের মধ্যে যে ইন্দ্রিয়গুলো আছে তার কিছু নির্দিষ্ট প্রকাশভঙ্গি আছে এবং কিছু শক্তিও আছে। আমরা যখন পর্যাপ্ত সূষম খাদ্য খাই, তখন আমাদের দৈহিক ইন্দ্রিয়গুলো সবল হয়ে উঠে এবং সজীব ও সতেজ ইন্দ্রিয়ের কামনা বাসনা বেড়ে যায়। যেমন- যৌন-ইন্দ্রিয়ের কথা বলা যায়। হিন্দু বিধবা রমনীরা নিরামিষ তরকারি এবং আতব চালের ভাত খেয়ে জীবন কাটায় কেবল পূণ্যের কারণে নয়, রিপু দমনের জন্য। আমিষ জাতীয় খাদ্য বেশী খাওয়া হলে যৌন ইন্দ্রিয়ের সজীবতা বৃদ্ধি পায় এবং সেক্ষেত্রে বিবেক বুদ্ধির সুন্দর বিবেচনাগুলো অগ্রাহ্য করে দেহকে নিয়ে যায় নষ্ট অন্ধকারের দিকে। একারনে আট-ইঞ্চি পেটই হচ্ছে সকল পাপের উৎস। ভূরি ভোজনে যারা অভ্যস্ত একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে নিগূঢ় চিন্তা শক্তি তাদের মধ্যে বিকশিত হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। পরিমিত খাদ্য দেহকে রক্ষা করতে যথেষ্ট। কিন্তু যাদের মন কেবল খাই খাই করে, তারা শুধু দেহটাকে বাচিয়ে রাখা নয়, ফুলিয়ে তোলার জন্যই খায় আর নাক ডেকে ঘুমায়। এরা আসলে জীবনে হয়তো জানে ও না যে জ্ঞানেন্দ্রিয় বলে একটি ইন্দ্রিয় আছে, তারও একটা ক্ষুধা আছে এবং সেজন্য কিছু লেখাপড়া দরকার।
আত্মার স্বরুপ জানতে পারলে আমরা আত্মার সাধনার কথা ভাবতে পারব। আত্মার স্বরুপ সম্পর্কে ইসলামের খ্যাতনামা দার্শনিক ও বুজুর্গগণ কোরআন-হাদিসের সমর্থনে অনেক কথা বলেছেন। এদের মধ্যে ইমাম গাজ্জালীর অনুসন্ধান সর্বাধিক নিখুত এবং বাস্তব ।আমরা ভাত খেয়ে যেমন পেট ভর্তি করি, তৃপ্তি পাই, তেমনি নিকট আত্মীয় সজনের সুখবর শুনে মনে আনন্দ জাগে, আত্মা তৃপ্তি পায়। ক্ষুধায় পেট যেমন কষ্ট পায়, কোন বিচ্ছেদের সংবাদে আত্মাও কষ্ট পায়। দেহ আত্মাকে ধারণ করে যেমন একটি জীবন্ত ব্যাপার, আত্মাও অনুভুতি লাভের ক্ষমতার জন্য একটি সজিব পদার্থ। অবশ্য চর্মচোখে আত্মাকে দেখা যায় না। এই অদৃশ্যমান অথচ মানবদেহের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ সম্পর্কে আমরা বেখবর থাকতে পারি না। ইন্দ্রিয় সুখের জন্য আমরা যেমন অনেক কিছু করি, আত্মার সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য তেমনি আমাদের অনেক কিছু করনীয় আছে। জড়বস্তুর চেয়ে আত্মা শুধু স্বতন্ত্রই নয়, উচ্চতরও বটে। আত্মা থেকেই আমাদের যাবতীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও ক্রিয়ার উৎপত্তি। জড়ের কাজ হলো আত্মার নির্দেশ মেনে চলা। আত্মার উপর যদি ইন্দ্রিয় লিপ্সা প্রাধান্য পায় তাহরে ধীরে ধীরে আত্মার পর্দায় কালিমা পড়ে যায় এবং সে স্রষ্টার মাহাত্ম, ধর্মের নীতিবোধ, প্রতিবেশির কল্যান কিংবা আসন্ন মৃত্যুর ভয়ংকরতা-এর কোন কিছুই তার মধ্যে টেনশন সৃষ্টি করে না। এমন আত্মাকে আমরা মৃত বলে মনে করি। সে জ্ঞান বৃদ্ধির চর্চা মানবজীবন ও সমাজকে উন্নতির পর্যায়ে বিকশিত করেছে তা হলো আত্মারই কার্যাবলী। দেহ মাটির তৈরী তা মাটিতে মিশে যায়, কিন্তু আত্মা আল্লাহর নিজস্ব ভগ্নাংশ, তার মৃত্যু নেই। দেহের কার্যাবলীর উপর ক্ষমতাবান হয়েও আত্মা দেহনিরপেক্ষ এবং অবিনশ্বর। বলতে হয়, চিরন্তন স্বর্গীয় সত্তাই মানুষের সব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রগতির ভিত্তি। সে জন্য আমরা আত্মার কার্যাবলীকে আধ্যাত্মিক কার্যাবলী হিসেবে গণ্য করি। আত্মার নিয়ন্ত্রণে যাকে অন্তর্চক্ষু সৃষ্টিকর্তার অপার রহস্যকে দেখতে পায়। আল্লাহ সম্পর্কিত জ্ঞান লাভ করার মধ্যেই আত্মার পরম শান্তি, একটা ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রা্প্তি।
অন্তর্চক্ষু খোলার যে কথা আমরা মাঝে মাঝে আলোচনা করি মূলত সেটা হলো আত্মসাধনার উৎকর্ষ। মাথার চারপাশে চোখ থাকলে আমরা মাছির মত বিশ্বের সবকিছু একবারে দেখতে পারতাম। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। তবে আমাদের মনের চোখ বাড়াতে পারি। তার মাধ্যম হলো বই পড়া। যে যত বেশি বই পড়ছে, তার ততবেশি মনের চোখ খুলে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা নতুন বই আমাদেরকে একটা নতুন অভিজ্ঞতা দান করছে। এই অভিজ্ঞতাই একধরণের আলো যা দিয়ে আমরা জীবনের অন্যতর সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি। আবার একথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল বই পড়ে জীবনের সব সমস্যার সমাধান বের করা সম্ভব নয়। বই পুস্তকের বাইরেও জীবনের সীমানা বিস্তৃত এবং সেটা আমরা জীবনের ঘটনাগত বাস্তবতার অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করি। এ কারণে প্রত্যেক ধর্মের ধ্যানের একটা গুরুত্ব আছে। ধ্যানের জন্য নি:সীম নির্জনতাও আবশ্যক। বুদ্ধের ধ্যান ব্যর্থ হয় নি। নবুওয়াতপ্রাপ্তির পূর্বে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর ধ্যান ছিল তার সমস্ত মিশনের অংশ। পাদ্রিদের গীর্জা গুলোতে ধ্যানীর সংখ্যাই বেশি। আবার সূফীরা তো ধ্যানজগতের শ্রেষ্ঠ সন্তান। এরা নিজ নিজ ধ্যানলব্ধ অভিজ্ঞতা দ্বারা মানবজীবনের রহস্য, আল্লাহ এবং বিশ্বলোকের রহস্য উপলব্ধি করেন আর সে কারনে বলঅ হয়, প্রকৃত ধ্যান, যেখানে ধ্যানীর আত্মা অসীম সত্তার সঙ্গে মিলনের আকুতিতে মগ্ন সেখানে চিরন্তন কোন সত্যের সাক্ষাত পাওয়া যাবেই।
জ্ঞানার্জন অন্যের জন্য হতে পারে। কিন্তু ধ্যান সম্পূর্ণ নিজের জন্য। ধ্যান নিজেকে জানারা। সীমাহীন বিশ্বের মাঝখানে নিজের স্থানটুকু আবিষ্কার করার জন্য ধ্যান। ধ্যানের কাছে তথ্য নয়, বিশ্লেষণ নয়, বিবেকের যুক্তি নয়, আত্মার নির্মল উপলব্ধি। ভাবুকের পথ ধ্যানের, করিব পথ ধ্যানের, ধার্মিকের পথ ধ্যানের। শিক্ষকের অধ্যয়নে অনেক পাঠবিভাজন থাকে, কিন্তু শিক্ষক যখন ধ্যানী হন তখন তিনি অখন্ড অভিজ্ঞতার মধ্যে প্রবেশ করেন। ধ্যান ধ্যানগত উপলব্ধির বিণ্যাস, একটি অখন্ড প্রনোদনা। কিন্তু অঙ্ক বা পদার্থ বিজ্ঞান ধ্যান নয়, গবেষণা। অবশ্য গাণিতিক গীতিকারের মত আবেগমন্ডিত হন যখন তার অনুমান সত্যের কাছাকাছি তাকে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে আইনস্টাইনই বড় উদাহরণ।
ধ্যান আত্মার গভীরে ডুব দেওয়া। শিক্ষা বিবেককে যু্ক্তি দ্বারা শানিত করা। একটি সম্পূর্ণ ভাবাত্মক, অন্যটি তথ্যনির্ভর। এখানে ইসলাম কিন্তু দুটোকে সমন্বিত করেছে। ধ্যান ও শিক্ষা দুটোর সমবায়ে সমন্বয়ে ইসলামের সংস্কৃতি গঠিত। ধ্যানের মাধ্যমে আত্মার সঙ্গে পরম সত্তার শাশ্বত সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ধ্যানের মধ্যে ব্যাক্তির অহম, বা আমিত্বের বিলোপ ঘটে। যেটা শরীয়তের ভাষায় অহঙ্কার না করা, সূফীর ভাষায় রিয়ামুক্ত হওয়া। আর সাধারণ ভাবে এটা হলো সব কিছুর সঙ্গে নিজেকে সমান করে দেখা।
মহানবী (স.) ধ্যাণ করে আল্লাহর ইঙ্গিত লাভ করলেন, হেরা গুহা আলোকিত হয়ে উঠল। জিব্রাইল (আ.) আনিত বানী, পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি মানুষকে কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন, যা মানুষ জানত না। ধ্যানলব্ধ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি পরম প্রভুর বাস্তব অস্তিত্বকে অবিষ্কার করলেন। অত:পর তার কাছে আনীত বানীর দ্বারা নিজের জ্ঞান ভান্ডারকে করলেন ব্যাপক ও বিস্তৃত। তার মাঝে কেবল ভাবাত্মক শব্দগুচ্ছ এলোনা, তার কাছে মানব জাতির ইতিহাস, বিভিন্ন যুগের ঘটনা, বিচিত্র রহস্য-উন্মোচিত হল এবং কোরআনের বিস্তৃত পরিসরে লিপিবদ্ধ সেই সব কাহিনী মানুষের শিক্ষার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। এটা হলো বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এমন এক অবিস্মরনীয় ঘটনা যা আর কখনোই ঘটবে না। ধ্যানের চুড়ান্ত শিখরে উন্নীত এক মহা মানব, বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সতর্কসংকেত শুনিয়ে গেলেন, দিয়ে গেলেন পতিদিন পড়ার মত একটি গ্রন্থ এবং রেখে গেলেন নিজের জীবন চরিত্র তাদের জন্য যারা বিশ্বাস করে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ অপরিহার্য এবং শেষ বিচারে করজোড়ে দন্ডায়মান হতে হবে।
যে ধ্যান করবে তার যোগ্যতা কি ? অন্ধকারে আসন গেড়ে বসলেই কি ধ্যান হবে ? ধ্যানীর জীবিকা তো বন্ধ হলে চলবে না। কিন্তু তিনি কিভাবে একই সঙ্গে জীবিকার্জন করবেন এবং ধ্যান করবেন ? দেহের ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য যে কাজটুকু অনিবার্য তা নিজহাতে করতেই হবে এবং সেটা হতে হবে সম্পূর্ণ সততার মানদন্ডে যাচাইকৃত। কোন অসৎলোকের ইবাদত আল্লাহ কামনা করেন না। আত্মাকে ধ্যানের যোগ্য করার পূর্বশর্ত হলো সৎ উপার্জন। বিলাস ব্যাসনে থেকে ধ্যান হয় না, গুন গুন করা হয়। A Pure soul may hope to be illuminate. সততা ও আন্তরিকতা ধ্যানের পূর্বশর্ত। সততা ও আন্তরিকতা এক ধরনের আলোকিত অবস্থা; এটা আত্মার কাছে বিবেকের অঙ্গীকার এবং বিবেকের প্রতি আত্মার দাবীও বটে। আবার এ সততা অবলম্বন ও আন্তরিকতা পোষণ সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা ব্যাতিত হতে পারে না। কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট বলেন, তোমরা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যাতিত কিছুই ইচ্ছা করতে পার না। হ্যা আমরা আল্লাহর ইচ্ছা ব্যাতিত কোন কিছুর ইচ্ছা করতে পারি না। কিন্তু তাই বলে আমরা কি নিয়তির হতের পুতুল ? না, সেটাও নয়। দার্শনিক যুক্তিতে, নয়তির হাতে মানুষ যদি পুতুল হয়, তাহলে মানুষের ভাল মন্দ কাজের দায় মানুষের ঘাড়ে চাপাতে পারে না। মানুষ বাহ্যত কর্মে স্বাধীন এবং ফলাফল তার কর্মানুসারে হওয়াই বাঞ্চনীয়। কিন্তু যদি কখনো না হয়, সে জন্য আমরা কাকে দোষ দিব ? আল্লাহকে ? আল্লাহে তো মহান ও পবিত্র। আমরা যখন দেখি কোন বৃদ্ধের একমাত্র অবলম্বন তার কর্মক্ষম ছেলেটি বজ্রাঘাতে মারা গেছে, এবং মহিলার স্বামী সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে, তখন উভয়ের শোকাহত আত্মাকে প্রবোধ দেয়ার জন্য নিয়তি নির্ভরতা ছাড়া আর কি থাকতে পারে ? জীবনের জন্য শেষ অবলম্বন হয়ে উঠে নিয়তি। আত্মার অনুসন্ধানে নেমে আমরা নিয়তির কাছে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পন করি, সেটা আমাদের অগ্রযাত্রার স্বাভাবিক পরিণতি।
মানব মনে প্রতিদিন যে প্রত্যাশাগুলো গুঞ্জরিত হয়, তা তার কর্মপ্রবণসত্তার উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং সে দেহকে কর্মের দিকে ঐ প্রত্যাশা পূরণের জন্য চালিত করে। শেষে সাফল্য বা ব্যার্থতা যাই আসুক কাজের মধ্যে থাকাই মানব ধর্ম। আত্মদর্শনের মধ্যে এটাও একটি ব্যাপার যে, আমরা কেবল বায়বীয় একটা সত্তার চিন্তায় মগ্ন থেকে কর্মহীন প্রহরগুলো নি:শেষ করতে পারি না। আমরা মনে করি, ব্যাক্তির দেহে জ্বলন্ত প্রদীপের মত যে আত্মার অবস্থান তার মধ্যে জিকির সৃষ্টি করার যে সব সূফীতত্ত্ব রয়েছে, তা বেকারত্বের এযুগে খুবই কাজের কথা। কিন্তু দুবেলা কাজ করে যাদের বাচতে হয় তারা তো কাজের মধ্যে আল্লাহকে স্মরণ করে। আত্মার কার্যাবলী সম্পর্কে ভাববাদী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তেমনটা না গিয়েও বলতে হয়, আত্মার পরিচয় লাভ মানে সব কিছুর পরিচয় লাভ করা বোঝায়। খেয়ে পরে আরাম-আয়েশে জীবনটাকে অতিবাহিত করাই যাদের উদ্যেশ্য, তাদের কাছে আত্মার গল্প করে লাভ নেই। তাদের মধ্যে আত্মা চিরসমাহিত লাশের মত মৃত। জীবনের অর্থ তাদের কাছে-এই পৃথিবীটুকুই সব। দুচোখে যা দেখা যায়, তার বাইরে কিছু নেই- এটা যাদের বিশ্বাস তাদের কাছে আল্লাহর অপার মহিমার কথা বলে লাভ নেই। কোরআনের ভাষায়- " নিশ্চিতই যারা কাফের হয়েছে, তাদেরকে আপনি ভয় প্রদর্শন করুন আর নাই করুন তাতে কিছুই আসে যায় না, তারা ইমান আনবে না। আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন আর তাদের চোখ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। (বাকারা:৬-৭)
কোরআনের আলোকে আত্মদর্শন একটি নিগুঢ় ব্যাপার। এটা অনেক চিন্তা ও অনেক সাধনার বিষয়। সর্বপরি আল্লাহর অনুগ্রহ। সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষ এক ঐশী প্রেরণায় নিজেকে চিনতে পারে। রাশিয়ান একটি প্রবাদ আছে। যদি তোমার চেহারা কুৎষিৎ দেখায়, তুমি আয়নাকে দোষ দিও না। আমরা কোরআনকে একটা স্বচ্ছ আয়না হিসেবে যদি ধরে নেই, এবং আমরা এর সামনে যদি দাড়াই, তাহলে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে আমরা কি নিজেদের মধ্যে মধ্যে অসংখ্য অপূর্ণতা দেখতে পাই না ? যারা কোরআনকে বিশ্বাস করার পর ত্যাগ করেছে তাদের অন্তর্জগতের ধারণা কি এটা নয় যে, এ গ্রন্থের বক্তব্য ও উপদেশ তাদের কোন কাজে আসেনি ? অতএব তারা এটাকে অগ্রাহ্য করেছে্ আসলে এটাকে অগ্রাহ্য করার মত প্রজ্ঞা কি আমাদের আছে ? কোরআনের মানবজীবন ও তার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা যদি বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে আমরা এটাকে সত্য বলে মেনে নিতে পারব না ? তাহেলে কোরআনের ভাষায় আমরা সুস্পষ্ট গোমরাহীর পথে আছি। কোরআন মানব জাতীর জন্য একটি দুস্পরিবর্তনীয় সংবিধান। ফলে মানুষ তার আচরণ ও ইচ্ছার মধ্যে নিয়ত পরিবর্তনশীল থেকে আধুনিক জীবনের এমন এক অবস্থায় উন্নীত হয়েছে যে এখানে যদি তাকে কোরআন মোতাবেক হারাম ও হালাল বাছাই করে ভোগ করতে বলা হয় তাহলে কয়েকজন দৃঢ় চিত্তের খাটি ইমানদ্বার ব্যতীত, অন্যরা হতাশ হবে এবং দৌড়ে পালাবে। বলবে, কোরআনের কিছু বিধান অনুপুঙ্খ মেনে চলা সম্ভব নয়, অথচ আল্লাহ বলেছেন, এ কোরআনের কিছু অংশ মানবে কিছু অংশ মানবে না, তা হবে না। এটা আমাদের আত্মগত উপলব্ধির ক্ষেত্রে বিশেষ উদাহরণ।
আত্মানুসন্ধানের এযুগে ইসলাম কেন বিভিন্ন সমাজে পচনশীল পঙ্কের মধ্যে আটকে গেছে ? ইসলাম নিয়ে যারা খুব ভাবেন তারা কি বলবেন, মুসলমানরা তাদের পরম সত্তাকে চিনতে ব্যার্থ হচ্ছে। বৈশ্বিক বিবর্তনের ধারাকে নিজেদের প্রজ্ঞার দ্বারা অনুধাবনে অক্ষম হয়ে গা ভাসিয়ে চলছে। আমরা ইসলামী জগতের ধারাবাহিক অধ:পতন দেখে কোন কিছুতে আর বিশ্বাস রাখতে পারছিনা। ইকবালের খুদী, ইমাম গাজ্জালীর আত্মাবস্তু কিংবা মাওলানা রুমীর প্রেমিক সত্তা যাই বলি না কেন, মানুষের ভেতরের জগতটি কিন্তু চিন্তার জটিলতার সঙ্গে না জড়িয়ে বাহ্যিক, মোহপ্রবণ তুচ্ছ হীনতর কাজ কর্মের সঙ্গে মিশে গেছে এমনভাবে যে উন্নতরুচিশীল লোকজনকেও আমরা আলাদা করতে পারি না। মানুষের অহংবোধ বা আমিত্ব বজার রাখার মধ্যে একটা মানবীয় গুণের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেটাও যেন আজ বিলুপ্ত প্রায়।
কোরআনের সংহত বক্তব্যের রেশ ধরে আনেক দার্শনিক তাদের নিজস্ব অভিমতকে নানা ভাবে আলোচনা করেছেন। আমাদের মাঝে যে সসীম সত্তা বিরাজমান তা ইকবালের কাছে খুদী হিসেবে চিত্রিত হয়েছে এবং তিনি মনে করেন, "খুদী আমাদের অভিজ্ঞতার নাগালের বাইরের জিনিস নয়। অন্তনির্হিত অভিজ্ঞতাই সক্রিয় খুদীর নামান্তর।" আত্মা বা খুদী ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যায়, সেটা হয় আমাদের ধারাবাহিক অপকর্মের জন্য। আল্লাহ বলেন " আমার বানী কখনোগুজব নয়, বরং তাদের অর্জিত কর্মের দোষে তাদের আত্মার উপর মরিচা পড়েছে। (সুরা মুতাফফিফীন : ১৪)
আত্মা কিভাবে কালিমা লিপ্ত হয়, বা মরিচা পড়ে যায় আত্মার পর্দায় তা কিন্তু একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার বিষয়। যাদের মধ্যে চৌর্যবৃত্তি ও মিথ্যা বলার প্রবণতা আছে, তারা সুযোগ পেলেই চুরি করে এবং মিথ্যা কথা বলে। এভাবে দীর্ঘ দিনের চুরি ও মিথ্যা বলার অভ্যাস ঐ ব্যাক্তির মধ্যে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় যে, দুচারটা গালাগাল বা চড় ঘুষিতে তার বদ অভ্যাস দূর হয় না এবং লোকের অপমান তার মধ্যে কোন কোন প্রতিক্রিয়া করে না এবং অন্যের অনিষ্টের জন্যে দৌড়ে যায় নতুন ফন্দি এটে। এ সমাজের পকেটমার, ঘুষখোর সুদখোর, দালাল, চোরাচালানী, অন্যায় বিচারক, অসত রাজনীতিবিদ সহ বড় বড় দাগী সন্ত্রাসীদের আত্মা কালিমাপূর্ণ। তাদের কাছে ভাল কথা পছন্দ হয় না, ভাল উপদেশকে বিষাক্ত মনে হয় তাদের। যেমন কোন গণিকালয়ের বারণবনিতাদের কাছে যদি ভাল থাকা খাওয়ার প্রস্তাব করা হয়, তাহলে তারা মুখ ভেঙচি দিয়ে উপহাস করে উড়িয়ে দেবে। কারণ যে দুষ্কর্মের মধ্যে তারা ডুবেছে, তা তাদের দৈনিক রুটি রুজির ব্যাবস্থা করছে, তাদের মনে এমন উচ্চাশা অবশিষ্ট নেই যে তারা ওখান থেকে বেরিয়ে এসে অন্য পাচটা ভদ্র মহিলার মত জীবন যাপন করতে পারবে।
ইকবাল ও গাজ্জালী খুদি বা আত্মা সম্পর্কে আলোচনা করেছেন যথেষ্ট গভীর তাৎপর্যের সঙ্গে। তবে তাদের আলোচনা দার্শনিক স্তরে সীমিত রয়েছে। আমরা দেখেছি, আত্মা সম্পর্কে কোরআন খুব বেশী আলোচনা না করে বরং মানুষের ভাল ও মন্দ কাজের ফলাফল সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহর গুনাবলী, পরকাল, কিয়ামত, নবী রাসূল, বেহেস্ত-দোযখ, জীন-ফেরেশ্তা সহ অনেক বিষয়ের আলোচনা এসেছে সবিস্তারে, পৌন:পুনিক রীতিতে। এসব বিষয় নিয়ে দার্শনিকরা যখন আলোচনা করেন তখন তা হয় দার্শনিকক আলোচনা-সমালোচনা। সেটা ধর্মগ্রন্থের আলোচনা নয়। অথচ কোরআন কোন দার্শনিকের দর্শন-গ্রন্থ নয়, এটি নির্দোষ একটি ধর্মগ্রন্থ এবং এর উদ্দেশ্য বিশ্বাসীদের মধ্যে ধর্মের বিধানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার, চিন্তায় এবং আচরণে প্রতিফলিত করা। আর সেজন্য একই বক্তব্য বহুবার এখানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে যাতে পাঠকের মনোলোকে খোদিত হয় এর বিষয়বস্তু। অতএব আত্মার বহুবিধ পরিচয় প্রদানে ইমাম গাজ্জালীর আলোচনা উচ্চাঙ্গের সন্দেহ নেই, তবে আমরা কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গিকে অধিকতর সহজ ও সরল মনে করি। "নিস্কলঙ্ক আত্মা সহকারে আল্লাহর দরবারে আগমণকারী ব্যাতিত কেহই মুক্তি পাবে না।" (সুরা আরাফ )।
ইসলামে জ্ঞানার্জনের পথ উন্মুক্ত। কিন্তু যে জ্ঞান কেবল পার্থিব কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে অর্জিত হয়, তার জন্য কোন পূণ্য নেই। আত্মজ্ঞান মানব জীবনে এমন বস্তু যার মাধ্যমে মানুষ জানতে পারে তার প্রকৃত অবস্থা। মানুষের প্রকৃত অবস্থা কি ? মানুষের প্রকৃত অবস্থা যে কি সেটা আমরা জানব কিভাবে ? আমরা দেখি শিশু হয়ে জন্মে, বৃদ্ধ হয়ে মানুষ মারা যায়, কেউ শিশু বয়সেই মৃত্যবরণ করে, কেউ কৈশোরে, বা কেউ ভরা যৌবনেও মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ পৃথিবীতে জীবন ক্ষণস্থায়ী যদিও তার প্রত্যাশা সে দীর্ঘকাল বেচে থাকবে। মানুষের আর একটি অবস্থা হলো, বিপদে পড়লে সে অদৃশ্য কোন এক শক্তির কাছে সাহায্য চেয়ে ক্রন্দন করে এবং বিপদ কেটে গেলে ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। তৃতীয়ত: অবস্থা হলো মানুষ সৃষ্টিগতভাবে দূবল এবং তর্কপ্রিয়। একজন সৃষ্টিকর্তার প্রতি নি:শর্ত বিশ্বাস স্থাপন মানুষের জন্য খুব কঠিন কাজ। চতুর্থত: বস্তুগত ভাবে মানুষ যা ভোগ করতে সক্ষম ; তার চেয়ে সে অনেক বেশি আকাংখা করে এবং মৃত্যুর কোন চিন্তাই করে না। মানুষের এই জাগতিক অবস্থা- এগুলো কি তার জন্য কোন কল্যাণ বয়ে আনছে ? বস্তুতপক্ষে মানুষ তার ক্ষতিকর অবস্থাগুলো অতিক্রম করে কল্যাণকর অবস্থার দিকে অগ্রসর হবে- সেটাই উন্নতি এবং এই উন্নতি সম্ভব হতে পারে জীবন ও জগতের রহস্য জানার মাধ্যমে। জীবন ও জগতের রহস্য উদঘাটন করা গেলে আমরা নিজেদের অস্তিত্বকে বুঝতে পারব। বিজ্ঞান যেমন বিশ্বের অনেক রহস্য-ভেদ করে ছুটে চলেছে অসীম আকাশে, নভনীলাময়। আত্মজ্ঞানও একটা বিজ্ঞান। যাকে ইংরেজিতে বলা যায় Spiritual science, আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান এবং অধিবিদ্যা এক নয়।
আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান এমন এক ধরনের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে আলোচনা করে যা মানুষের অনেক অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাব দেয়। আত্মজ্ঞান অর্জনের কৌশলই হল আধ্যাত্মিক বিজ্ঞান। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমরা জানি দুধের মধ্যে মাখন,ছানা, ননি ইত্যাদি আছে। এখন এক ব্যারেল দুধের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেই কি আমাদের হাতে মাখন আসবে ? আসবে না; কস্মিনকালেও মাখন বা ছানা পাওয়া যাবে না যতক্ষণ না দুধ জ্বাল দিয়ে গোয়ালার দ্বারা টানানো হয়। অর্থাৎ একটি পদ্ধতির প্রয়োগ করে কাম্যবস্তু পাওয়া যাবে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, 'তোমরা কি দেখনা, গাছপালা আমাকে সিজদা করে?' আমরা কি দেখি গাছপালা আল্লাহকে সিজদা করছে ? না আমাদের চোখে ধরা পড়ছে না, তবে কি কোরআনে আল্লাহ মিথ্যা বলেছেন ? না আল্লাহতো কোরআনে মিথ্যাও বলতে পারেন না। তাহলে এখানে অবশ্যই এমন একটি পদ্ধতি গোপন রয়েছে যা প্রেয়োগ না করে আমরা গাছপালার ইবাদত বন্দেগী দেখতে পাব না। সেই পদ্ধতিটা কি ? হযরত সুলাইমান (আ.) কে আল্লাহ পশুপাখির ভাষা শিক্ষা দিয়েছিলেন, আর দাউদ আ. এর সাথে ইবাদত করত পাহাড় পর্বত। আল্লাহ যদি কাউকে তার অপার রহস্য উদঘাটনের পদ্ধতি শিক্ষা না দেন তাহলে কারো পক্ষেই সম্ভব নয় তা উদঘাটন করা। আমরা জানি আউলিয়ায়ে কেরামগণ অনেক কারাত দেখিয়েছেন এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অনেক অমুসলিম মুসলিম হয়েছে। তবে ইসলামকে অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ বললে ভুল হবে। অলৌকিকতা ইসলামে আছে, তবে সেটাকে ছাপিয়ে উঠেছে বাস্তবতা। বাস্তবতাই ইসলামের প্রাণশক্তি; কারণ অনেকগুলো যদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে ইসলামকে টিকে থাকতে হয়েছে। অতএব আমরা যখন ইসলামকে জানব, তখন দেখব আমরা সত্যের সঙ্গে মিথ্যার লড়াই, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের, ভালর সঙ্গে মন্দের। কেবল ব্যাক্তি সত্তার বিচিত্রবিধ অনূভুতির অনুসন্ধানই সত্যানুসন্ধান নয়, ইসলামের জীবন আগাগোড়া টিকে থাকে বিরুদ্ধ পরিবেশে সংগ্রাম করে সেটা জানাও সত্যানুসন্ধান। সূফীরা ব্যাক্তির ভিতর খোদার প্রেম অনুভব করতে গিয়ে যে মতবাদ সৃষ্টি করেছেন, সেখানে পার্থিব লালসার অংশটুকু বাদ দিলে, সেটা ইসলামের চরম উৎকর্ষ বলা যায় নি:সন্দেহে কিন্তু তাতে ইসলামের জাগতিক উদ্দেশ্যকে পুরোপুরি বানচাল করার ঝুকি থাকে। কারণ আগেই বলা হয়েছে, ইসলামে আবেগের চেয়ে নীতির, অলসতার চেয়ে কর্মশীলতার, তর্কের চেয়ে নি:সংশয় বিশ্বাসের মূল্য অনেক বেশি।
আমরা দেখছি বিজ্ঞান বিশ্ব প্রকৃতির অনেক রহস্য জেনেছে এবং যা একদা মানুষের কাছে ভীতিকর ছিল, তা মানুষের কল্যাণে কাজে ব্যাবহৃত হয়েছে। আমরা যখন জানব মানুষের চরিত্রনীতি, পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যাবস্থা, যখন আমরা জানব সৃষ্টিকর্তার মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তার মৌলিক পরিচয় তখন আমরা নিজেদেরকেও জানব, নিজেদেরকে তখন জানা হয়ে যাবে। মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে মূল্যায়ন না করে নিজের সত্তাকে কোথাও স্থায়ীভাবে স্থাপন করতে পারে না। আমাদের জীবন শুধু খেয়ে পরে বেচে থাকার জন্য নয়, দিনে কাজ আর রাতে ঘুম এটাই জীবন নয়; এর বাইরে জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ পড়ে আছে। একারণে একজন জমিদারের শেষ কৃত্যানুষ্ঠানের পর কেউ তাকে নিয়ে আলোচনা করে না, কিন্তু হাজার বছর আগের একজন কবি বা চিন্তাবিদ বা মরমী জ্ঞান তাপসকে নিয়ে মানুষ আলোচনা করে। তাই মানুষ কেবল খেয়েই বাচে না, তার বাচার জন্য দরকার অনন্ত সত্যের সাধনা, যে অনন্ত সাবান-কাপড়ের মতো জীবনের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। তা কেউ কাব্যকুশলতার মধ্যদিয়ে ধরতে চায়, কেউ শিল্পের তুলিতে আকতে চায়, কেউ গদ্যের ঝাঝালো বাক্যের বন্ধনে আটকাতে চায়, আবার কেউ মরমী সাধনায় আত্মার সেই অফুরন্ত অনন্তের বানী শুনতে পায়।
সাধকের সাধনাবলে যে সত্য বাস্তবে ধরা দেয় তা মানব জীবনে নিয়ে আসে পরিবর্তন। অমুল পরিবর্তনের জন্য সত্যের প্রয়োজন প্রতিযুগে; কারো কারো সাধনায় সেই সত্য নিশ্চিত ধরা দেয়। নয়তো মানব সভ্যতা টিকে থাকে কি করে ? আমরা শুধু সাড়ে তিনহাত দেহের সমপরিমাণ গৃহ নির্মান করে বাচতে পারি না, যদিও মৃতের জন্য ওটুকুই দরকার। আমরা নিজেদেরকে জানব, এর বিকল্প আর কিছু নেই। তাহলে আমরা বুঝতে পারব, কোরআন কেন অধ্যায়নের উপর সর্বাধিক জোর দিয়েছে। ধ্যানকে অধ্যায়নের বিকল্প করা হয় নি। ধ্যানের কাজ নিজের সমগ্র অস্তিত্বকে এক শাশ্বত ঐক্যের মধ্যে এন উপলব্ধি করা, আর অধ্যায়ন হলো পরিপার্শ্ব ও সমাজ, ধর্ম ও সভ্যতা, ভাল ও মন্দ, আইন ও অপরাধ শাস্ত্র, বিজ্ঞান ও ভুমার পরিচয় লাভ। এদুটোই ব্যক্তিকে জাগ্রত করে। অতএব নিজেকে জানার যে কথা বলা হয়েছে, তা সৃস্টিকর্তার পরিচয় জানার সাপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়া। মূল কথা, সৃষ্টিকর্তাকে সামনে না রেখে নিজেকে জানা কখনো সম্পন্ন হবে না। যেহেতু ব্যাক্তি তার নিজের স্রষ্টা নন, সেহেতু স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তার কোন সাধনাই মানুষের আত্মজিজ্ঞাসা বা সত্যানুসন্ধানের পথে সহায়ক নয়, দেহের অভ্যন্তরে মোহপ্রবণ যে ইন্দ্রিয় সক্রিয়, নারী ও মদ, অর্থ ও অট্টালিকার আরাম আয়েশ লাভ করলে সেটা আরো সক্রিয় ও উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং অন্তর্চক্ষুর আলো পুরোপুরি নিভিয়ে দেয়। ফলে সে অর্থ সম্পদ ব্যায় করে বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করেও ইন্দ্রয় লালসা নিবৃত্ত করতে পারে না। অন্তর্চক্ষু যার খুলে যায় সে পবিত্র ও অপবিত্র, ন্যায় ও অন্যায়, ভাল ও মন্দের পার্থক্য সহজে সনাক্ত করতে পারে এবং পবিত্রতার উপর স্থির থাকতে পারে। কিন্তু জীবনটা যখন ভোগ সর্বস্ব হয়ে উঠবে, তখন মানব কল্যাণ, ইশ্বর চিন্তা, খোদাতত্ত্ব জ্ঞান, পরিণাম ভাবনা, কিংবা দেশ প্রেমের মত বিষয়গুলো বিবেকের কাছে গুরুত্ব পাবে না। বর্তমান যুগের ছবি-সিনেমা-মডেলিং ব্যাবসায় জড়িত তরুন-তরুনীদের অর্থ ও বিত্তের সঙ্গে এমন সস্তা প্রশংসা ও হাততালির জন্য লালায়িত যে, ধর্ম সম্পর্কে ওদের না আছে কোন ধারনা, না আছে অন্তরে কোন ভয়। পার্থিব জীবনের যে ক্ষণস্থায়ী আনন্দ পথের ধূলিতূল্য যে যশ ও খ্যাতি, তার পিছনে এরা মৌমাছির মত ছুটে চলছে, জীবন সম্পর্কে এদের ধারনা কেবল এটাই, দেহজ সৌন্দর্য ছড়িয়ে কামনার জাল ফেলে মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে দ্রুত ধনী হওয়া, বিত্তবানদের তালিকাভুক্ত হওয়া। "তার কি কোরআন সম্পর্কে গভীর চিন্তা করে না ? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ ? " (সূরা মুহাম্মদ)। মানুষের দেহের মধ্যে একটি অন্তরই দেওয়অ হয়েছে। অতএব ঐ অন্তরের যে অংশটুকু পার্থিব সুখ সম্ভোগে ব্যস্ত, এতটুকু আধ্যাত্মিক চিন্তা বঞ্চিত। এখন যদি একজন মানুষ দিনরাত ২৪ ঘন্টাই পার্থিব সুখ-সুবিধার চিন্তায় ব্যস্ত থাকে, একবেলা নামায পড়া, অথবা পাচজন মিসকিনকে খাওয়ানোর কিংবা বছরের রমজানের ৩০ টা রোজা রাখার সময় না পায়-তাহলে আমরা এমন লোকের কাছে আত্মজ্ঞান বা সত্যানুসন্ধানের প্রস্তাব করলে সে কি আমাদেরকে সঠিক কোন উত্তর দিতে পারবে ? আজ এ ধরনের লোকের সংখ্যা কি সমাজে বিশি না ? আমরা পচনশীল বর্তমান সমাজ ব্যাবস্থার ধ্বংসস্তুপের উপর দাড়িয়ে-কিভাবে পুনর্গঠনের কথা চিন্তা করব যদি আমরা একজন মহান সৃস্টিকর্তাকে অন্তরে ঠাই না দেই, যেভাবে ঠাই দেয়া উচিত ? আত্মদর্শন যে কোন দর্শনশাস্ত্রের সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বুদ্ধের আত্মদর্শন, মানব জীবন দু:খপূর্ণ, কর্মের মাধ্যমে দু:খ থেকে মুক্তি লাভই নির্বাণ বা মোক্ষলাভ। খ্রিষ্ট মতে, আত্মদর্শনে রয়েছে তত্ত্ব এবং নিষ্পাপ হয়ে খোদার স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ এবং সেজন্য মানব সেবাই তাদের ব্রত। হিন্দু ধর্মের আত্মদর্শন, নিষ্কাম সাধনা বলে সর্বভূতে ভগবানকে লাভ করা। আর ইসলামে আত্মদর্শন মানে, দেহ ও আত্মার বাস্তব পরিচয় জানা, মানুষ ও বিশ্ব পরিমন্ডলের স্রষ্টাকে জানা, স্রষ্টার নির্দেশিত পথে আরাধনা করা এবং পরকালীন জীবনকে দৃঢ় বিশ্বাসের মধ্যে রেখে মৃত্যুপর্যন্ত সৎ জীবন যাপন করা। আমরা যদি সত্যিকারভাবে ইসলামকে জীবনের জন্য অনিবার্য ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করি, তাহলে কোরআনের উপদেশই আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠ আত্মদর্শন।
"তোমাদের আগে অতীত হয়েছে অনেক ধরনের জীবনাচরণ। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমন কর এবং দেখ - যারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে। এই হলো মানুষের জন্য বর্ণনা। আর যারা ভয় করে তাদের জন্য উপদেশাবলী।" (সূরা আল-ইমরান : ১৩৭-১৩৮)।
ত্রিশপারা কোরআনের পাতায় পাতায় মানুষের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপনের জন্য রয়েছে শত সহস্র উপদেশ ও নির্দেশনা। সেসবগুলোর আলোচনার জন্য প্রয়োজন সুবিশাল গ্রন্থ রচনা। আমরা সমগ্র কোরআনে বর্ণিত উপদেশ বানীর সারাংশ মাত্র একটি কথার মধ্যেই পাই তা হলো - "তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎ রিযিক সন্ধান কর যদি পরকালে বিশ্বসী হও।" এই একটি উপদেশই আমাদের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিতে পারে। জ্ঞানীদের জন্য ঈঙ্গিতই যথেষ্ট।
বিষয়: বিবিধ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন