আধুনিকতা-ধর্মবোধ এবং আল-কুরআন
আমাদের শিল্পে-সাহিত্যে কিসের বিকাশ ঘটছে ? এখন কি আধুনিক প্রবনতার প্রকাশ ঘটছে না ? নিশ্চয়ই ঘটছে। কিন্তু তাতে মাত্রাগত ব্যাবধান রয়েছে। ঊনিশ শতকে জীবনকে যেভাবে দেখা হয়েছে, মধ্যযুগে নিশ্চয়ই সেভাবে দেখা হয়নি; আরো সত্য হল, ঊনিশ শতকীয় জীবনবোধ একুশ শতকে এসে ব্যাপক পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। করো কারো মতে, এখন চলছে উত্তর-আধুনিক কাল।
আধুনিক জিনিসটা কি? ধর্মতাত্বিক আলোচনায় আধুনিকতার বিষয়টা কি প্রাসঙ্গিক ? ধর্মের শাশ্বত আবেদন সৃষ্টিকর্তার প্রতি মানুষের নি:শর্ত আনুগত্যের আহবানকে কালগত সমাজ ও সময় কি প্রভাবিত করে ? মধ্যযুগের র্দৈবানুগত্য মিশ্রিত কাব্যচর্চা আধুনিককালে এসে একদম থেমে গেছে। এমনি বস্তুবাদি জীবন ভাবনা আধুনিককালে মানুষকে এত বেশি পার্থিব স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যাস্ত করে তুলেছে যে মানুষ ইশ্বর, ধর্ম কিংবা পরম সত্ত্বার কাছে আত্মসমর্পণ করার প্রয়োজনবোধ করছে না বা আত্মনিবেদনে আনন্দও বোধ করছে না। তাহলে আমরা কি দেখছিনা, আধুনিককাল ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কাল যা মানুষকে সার্বিকভাবে শক্তিশালী কনে নি বরং মানুষকে সমূহ ধ্বংসের মুখোমুখ করেছে ? শয়তানের চক্রান্তে স্বর্গচ্যুত হওয়ার দুর্ভোগ এবং মহাপুরুষীয় সাধনা বলে পুনরায় স্বর্গারোহণ মিলটনের 'প্যারাডাইস লষ্ট' ও 'প্যারাডাইস রিগেইন্ড' এ বিধৃত এমন মহৎ জীবন ভাবনা আধুনিককালের কাব্যাঙ্গিকে আর জায়গা-পেল না সেখানে এল মানুষের প্রতিদিনকার ক্ষুদ্রতুচ্ছ অভাব ও শূন্যতা, রোমান্টিক বেদনা ও নির্বেদ, আর্থিক অস্বচ্ছলতার কষ্ট এবং ব্যক্তিগত নি:সঙ্গতা । আধুনিককালের কাব্যে এগুলোই হল বিষয়বস্তু। অবশ্য আমাদেরকে একথা স্বীকার করতে হবে, আধুনিককাল মানে ব্যাক্তি মানুষের আত্ম-জাগরনের কাল, ব্যক্তি ও ব্যাক্তিত্ব বিকাশের কাল; ধর্ম বা ইশ্বর ভাবনা নয়, মানুষ এবং তার অন্তরজটিলতার নানান ব্যাখ্যা ও বিশ্ললষণের কাল হল আধুনিক কাল। ফলে, মনোসমীক্ষণের সূত্রাবলির বিস্তারে, আধুনিক যুগে একজন রবীন্দ্রনাথও যথেষ্ট অনাধুনিক হয়ে পড়েন। আমরা দেখব, আসলে আধুনিকতা, ধর্মবোধ এবং আল কোরআন কিভাবে অবস্থান করছে।
যে কালটি আধুনিক নামে খ্যাত হল, সেকালের কতগুলো প্রবণতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেহেতু বড় মোটা দাগে আমরা বিগত দেড় হাজার বছরের সময়কে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক যুগ। সেহেতু আমরা নিখুঁত আলোচনার স্বার্থে, আধুনিককাল, আধুনিক মন ও মানসের কিছু বাস্তবচিত্র যাচাই করে দেখতে পারি।
ইটালির ফ্লোরেন্স নগরে প্রথম রেনেসাঁসের উজ্জীবন ঘটে। আধুনিকতার সূত্রপাতও সেখানে। আধুনিকতা যদি ব্যক্তির আত্মাবিষ্কারের সুতীব্র অভীপ্সা হয়, তাহলে রেনেসাঁসের চেতনার মধ্যে নিহিত ছিল আধুনিকতা। সামাজিক কর্তৃত্ববাদ, যা মূলত গড়ে উঠেছিল খৃষ্টান চার্চ ও পাদ্রীদের সীমাহীন ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে, তার নিয়ন্ত্রন থেকে ব্যক্তিমন মুক্তির জন্য যে আন্দোলনের সুচনা করে তার নাম দেয়া হল রেনেসাঁ এবং প্রকারান্তরে সেই রেনেসাঁসের চেতনা তৎকালীন খৃষ্ট ধর্ম ও ধর্মযাজকদের বিরুদ্ধে চলে গেল। খোদার রাজ্য দখল করে নিল, আত্মবিশ্বাসী পার্থিব জীবন সংগ্রামে অগ্রসর নায়কেরা। তারা উদ্ভাবন করল শিল্পকলা জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা সহ মানবজীবনের জন্য অনিবার্য অনেক বিষয়ের। পরবর্তী শিল্পবিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব, ঊনিশশতকীয় পূঁজীবাদ এবং বিশশতকের ব্যর্থ সমাজতন্ত্র-এ সবই আধুনিককালের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। গত তিনশ বছর পৃথিবীর ইতিহাসে যা কিছু সৃষ্টিশীল ঘটনা সবই আধুনিক মনের ফসল।
মানুষের চিন্তাধারার বিকাশমানতার পথ ধরে এগিয়ে যায় সভ্যতা, পরিবর্তন ঘটে সংস্কৃতির এবং জীবনের ক্রমবিকাশ ঘটে নানা প্রক্রিয়ায়। এটা বুঝতে কোন তাত্বিক হওয়ার দরকার হয় না। আমরা আধুনিককালের রেখায় ধর্মকে যদি বিচার করি তাহলে দেখব, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ পালনের চেয়ে মানুষ সমকালীন যুগের প্রবণতা দ্বারা অনেক বেশী প্রভাবিত। প্রাচীনকালকে যদি বলি অন্ধকারের যুগ, মধ্যযুগ তাহলে ধর্মের এবং আধুনিক কাল মানুষের চিন্তা ও বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাতের যুগ। প্রত্যকটি বড় ধর্মের মৌলিক পরিচয়ের মধ্যে অলৌকিক ঘটনার যুক্ততা রয়েছে, আধুনিক বিজ্ঞান যা পুরোপুরি অস্বীকার করে। কেন আধুনিক কাল ধর্মের খুঁত ধরতে চায়? ধর্মের মহিমা নিয়ে জয়গান গাইতে বিজ্ঞান কেন নারাজ? এ পশ্নের উত্তর কিছুটা গবেষণা সাপেক্ষ।
ঊনিশ শতক ছিল শিল্প ও বানিজ্যে বিকাশমান পাশ্চাত্য শক্তির ব্যাপক উত্থানের কাল এবং পূঁজীবাদরে বিস্তার। ফলে ঊনিশ শতকের শেষ দশকে এসে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ পরষ্পর স্বার্থে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে এবং বাস্তবে, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায়। দীর্ঘ পাঁচ বছরের যুদ্ধে তুর্কীরা শুধু পরাজিত হয় না, খিলাফতও হারায় এবং তিনকোটি মানুষের মৃত্যুতে তৎকালীন কবি দার্শনিক বুদ্ধিজীবী ও সমাজতাত্ত্বিকগণ মানুষের জীবনকে অতি তুচ্ছ ভাবতে বাধ্য হন এবং দেখেন যে সমাজে সত্য-সুন্দর ন্যায় বা উদারতার মত উত্তম গুণাবলির কোন অস্তিত্ব নেই। রবং এগুলোর বিপরীতে, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারনা গড়ে উঠে। ইউরোপীয় জনগন এ বিপুল ধ্বংসের মুখোমুখি দাড়িয়ে উপলব্ধি করতে বাধ্য হয় পৃথিবীতে ভাল কিছু আশা করার নেই। মানুষের উপর বিশ্বাস রাখাও কঠিন এবং সময়টা অত্যন্ত জটিল। সবমিলিয়ে জীবনে অতৃপ্তি ও নৈরাশ্ববোধ, আত্মবিরোধ ও অনিকেত যন্ত্রনা, বাহ্য আচরনের চেয়ে মনস্তত্ত্বের প্রাধান্য, সাম্যবাদী চেতনার বিকাশ, জ্ঞান চর্চায় পদ্যের চেয়ে গদ্যের উপযোগিতা বৃদ্ধি, অতীন্দ্রিয় ভাবাবেগের চেয়ে ইন্দ্রিয় লালসার স্বীকৃতি এবং সর্বোপরি সমাজ থেকে ধর্ম ও ঈশ্বরের ধারনার বিলুপ্তি। এগুলো হল আধুনিকার লক্ষণ। আমরা নতুন যুগ ও জীবনের এই নেতিবাচক ধারনার মধ্যে কিভাবে ধর্মের বহমানতা অব্যাহত রাখব ?
ফ্রান্স কাফকা তার উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়ে মানুষ হারিয়েছে মানবিক গুণ ও ব্যাক্তিত্ব, পরিনত হয়েছে যন্ত্রে। Human being reduced to apparatus. আধুনিক সভ্যতা মূলত যান্ত্রিক সভ্যতা। প্রাকিৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে ক্রমবর্ধমান মানুষের চাহিদা পূরনের লক্ষ্যে স্থাপিত কলকারখানা-এক ধরনের নির্মম যান্ত্রিকতা নিয়ে এসেছে। যন্ত্রকে নিজের সেবায় ব্যবহার করতে গিয়ে মানুষ হয়ে উঠেছে যন্ত্রের দাস, মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে যান্ত্রিক।
রেনেসাঁসের সময় সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে ঐতিহাসিকভাবে ঘটেছিল ব্যক্তির জাগরণ এবং সেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের মধ্যেই নিহিত ছিল মানুষের নি:সঙ্গতার বীজ। ভেঙ্গে পড়েছে গোষ্ঠীগত ঐক্য, ভেঙ্গে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবারের অটুট কাঠামো। মানুষ হয়ে পড়েছে নিরাশ্রয় এবং মানুষ এখন তার নিজের সঙ্গে নিজেই দ্বন্দে জড়িত। কারন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সাযুজ্য নেই। ধমের সত্যসুন্দর বিশ্বাস নিয়ে মানুষের জীবন যেন আর চলছে না। আধুনিক মানুষ শেকড়হীন, সংযোগহীন এবং একাকী।
সভ্যতার বিকাশ চরমে উঠেছে, কিন্তু মানুষের জীবনে শুরু হয়েছে একটি ক্ষয়িষ্ণু ধারা। আত্মা হয়ে পড়েছে বিকার গ্রস্ত; অস্তিত্ব এখন সংকটময়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক গেছে নষ্ট হয়ে। ইচ্ছার স্বাধীনতা মরে গেছে অভাবের তাড়নায়। গ্রাম উজাড় হয়ে নগর পত্তনের জন্য যান্ত্রিকতা যেমন বেড়েছে, গ্রামীণ জনতার সেই প্রবাদ প্রতীম সরলতা ও স্বাভাবিকতা তেমনি নষ্ট হয়ে গেছে। আধুনিক সভ্যতার একটি বড় অংশ হল, সমাজের ক্লেদ ও নৈরাজ্য, ব্যক্তির আত্মদান ও অস্তিত্ব সমস্যা, নি:সঙ্গতা এবং আশ্রয় শূন্যতা কেন্দ্রিক রচন। ফলে মানুষের চেতনাবোধে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার প্রকাশ অপ্রসঙ্গিক নয়। ন্যায়-অন্যায়ের মানদন্ড এখন নীতিগতভাবে সত্যের উপাসনা নয় বরং যুলুম ও অত্যাচারই বিচারের মানদন্ড। কলকারখানার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন গনর দূর্গের অভ্যন্তরে বসবাসরত সংগ্রামশীল, ব্যস্ত নর-নারীর কাছে শান্ত সৌম্য, ভদ্রোজনিত মানবিকতাপূর্ন জীবনেচ্ছাকে ছাপিয়ে যাচ্চে। ফলে গীর্জার পাদ্র্রী, মসজিদের ইমাম, মন্দিরের পুরোহিত কিংবা প্যাগোডার ভিক্ষুও ধর্মীয় নৈতিকতার মান বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন।
আধুনিকতা মানুষের জন্য বেচ থাকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে প্রশান্ত স্থিরতা। ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে প্রতি পদক্ষেপে। জাকজমকপূর্ণ আলিশান মসজিদ গড়ে উঠছে প্রতিটি অলি গলিতে, মুসল্লির সংখ্যাও বাড়ছে, জুমার দিন উপছে পড়ে নামাযিদের স্রোত; অথচ কোন অফিসেই ঘুষ ছাড়া কার্য হাসিল হয় না। অর্থাৎ এ কালটিকে ধুরন্ধর অসৎ মানুষের কাল বললে ভুল হবে না। ফলে এখানে ধর্মের ওয়াজ-নসিহতে আগত বক্তার সারগর্ভ বক্তৃতার বিষয়বস্তু, প্রত্যাহিক জীবনে তার প্রতিফলন কিন্তু নেই বললেই চলে।
আধুনিক মানুষ প্রশ্ন না করে আগাতে চায় না; কারণ বিজ্ঞানের মূলসূত্রগুলো সন্দেহজনক প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের মধ্যদিয়েই আবিষ্কৃত। আর বিজ্ঞান এ যুগে মানুষের জীবন চলার পথকে সহজ করায় ধর্মের চেয়ে বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে।
ধর্ম যেভাবে জীবনকে দেখতে বলে, বিশেষত খৃষ্টিয় ভাববাদের আলোকে, জীবন সেভাবে চলতে গেলে, বস্তুগত জীবন তৃষ্ণার কোন অর্থ থাকে না। কারণ ইহকালের চেয়ে খোদার রাজ্যে অনন্ত শান্তির জন্য ইশ্বর যে যাত্রাপথ দেখিয়েছেন, আধ্যাত্মিক সাধনায় সে পথ আমাদের অবলম্বন করা জরুরী। আমরা ধর্ম বলতে মধ্যযুগের খৃষ্টবাদকে বুঝব, আর ইসলামকে আমরা কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিতে আধুনিকতার পাশাপাশি আলোচনা করব। পৃথিবীর জ্ঞান জগতের পরিমন্ডলে দুটি ধারণা বিদ্যমান-ভাব ও বস্তু। আত্মা এবং দেহ। পরস্পর সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু এ দুটো একত্রে সন্নিবেশিত না হলে উভয়ের তাৎপর্য অর্থহীন হয়ে পড়ে। যদি আত্মাই সর্বত্মক হয়, জীবন হয় নৈতিকতাহীন ও মানবিকবোধশুন্য। অন্যদিকে বস্তুই যদি একমাত্র বিষয় হয় তাহলে মানুষের মধ্যে হাস-কান্না ও বিরহ-মিলনের কোন নান্দনিক পরিভাষা খুজে পাওয়া যাবে না। সে কারনে একমাত্র ইসলামে বস্তু ও আত্মার সমন্নয় ঘটেছে। 'ইসলাম আত্মা ও বস্তুর স্বাভাবিক ঐক্যের এক নাম, যার সর্বোচ্চ রুপ স্বয়ং মানুষ।' মানব জীবনের সম্পূর্ণ রূপ বিকশিত হয় তখন, যখন শরীর ও আত্মা একসঙ্গে কাজ করে।
মধ্যযুগে ধর্মের ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পাওয়ায় সমাজে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের কর্তৃত্ব বেশি ছিল। অন্যদিকে, আধুনিককালে মধ্যযুগীয় অবরুদ্ধ চেতনার প্রতিক্রিয়ায় মুক্ত উদারতার সঙ্গে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিজ্ঞান প্রভূত্ব কায়েম করেছে। আধুনিককালে আমরা দু'ধরনের চিন্তাবুদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছি। বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ। বিজ্ঞান মানবতাবাদের দিকটি বিবেচনা করে না। আর মানবতাবাদও অগ্রসর হয় না বিজ্ঞানের দিকে । সমাজ কিন্তু বিজ্ঞানকে বাদ দিতে পারে না, আবার মানবতা বর্জিত হলেও চলবে না সমাজ। যদি আমরা একটি সমাজ কল্পনা করি তাহলে সমাজের জীবন্ত ও গতিশীল সত্তাকে আমরা টিকিয়ে রাখার জন্য মানবতা ও বিজ্ঞান-এ দুয়ের সমন্যয় করতে বাধ্য।
শুধু বিজ্ঞন বা প্রগতি জীবনকে ধরে রাখতে পারে না, বা নৈতিকতা বর্জিত প্রগতি জীবনকে বিকারগ্রস্ত করে ফেলে, বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজ তার দৃষ্টান্ত। আবার কেবল ধর্মতত্ত্বের কুয়াশার মধ্যে জীবনের গতি থাকে না, বর্তমান প্রাচ্য তার প্রমাণ। আবার কেবল বস্তুবাদ সামাজিক দর্শন জীবনের সকল প্রত্যাশা পূরণেও যে ব্যার্থ, সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তি ও সমাজতন্ত্রের পতনে সেটাও স্পষ্ট। তাহলে এখন আমরা, বিশশতকের বিজ্ঞান, পাশ্চাত্য পূজীবাদ এবং ক্ষয়িষ্ণু সমাজবাদ-এর পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মানব মুক্তির জন্য কোন বিষয়টি গ্রহণ করতে পারি? এমন প্রশ্ন, একবিংশ শতকের নতুন প্রজন্মের কাছে স্বাভাবিকভাবে জাগতে পারে। কেউ যদি বলে, একমাত্র কোরআনই মানব জাতির মুক্তি দিতে পারে। যেমন আমাদের আলেমগণ বলেন। না, কোরআনের কথা এভাবে চটজলদি এক শব্দে বলে দিলেই মানুষ যত বিপদেই থাকুক দৌড়ে কুরআনের কাছে আসবে না। একথা বলার অর্থ এই নয় যে, আমরা কোরআনকে খাটো করে দেখছি। বরং কোরআন-এর ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং জীবনের সার্বিক অবস্থার সঙ্গে এর যে সূক্ষ্ম ঐক্যবদ্ধতা সেটা অনুধাবনের জন্য মানুষকে প্রস্তুত করে তারপর বলতে হবে।
মনে রাখতে হবে মহানবী (স

মনে রাখতে হবে আধুনিক যুগ যুক্তি ও শৃঙ্খলার যুগ; মধ্যযুগীয় গালগপ্প মেরে পাশ্চাত্য সভ্যতার বিপরীত কোন শক্তিশালী জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলা যাবে না। যদি তা সম্ভব হত, তা হলে শতবর্ষ ধরে এ দেশে কম ওয়াজ, নসিহত হয় নি, কই জনগনের আমল আখলাক কতটুকু বদলিয়েছে? ধর্মভীরুতার পরিচয় দিতে গিয়ে মহল্লায় মহল্লায় মসজিদ উঠেছে, ছাপড়ার মসজিদ টিনের হয়েছে, টিনের মসজিদ দালানের আর দালানের মসজিদে বসেছে মোজাইক পাথর। কিন্তু জ্ঞান চর্চার জন্য খোদ জেলা পর্যায়ও একটি ভাল লাইব্রেরী কি আছে? অথবা এত মুসল্লির দেশে দারিদ্র ও নিরক্ষরতা, কুসংস্কার ও দুর্নিতি কি এতটুকু কমেছে ? তাহলে আমরা কি নিয়ে আধুনিক জীবন যুদ্ধে লড়াই করব? বিশ্বের নেতৃত্ব এখন পশ্চিমাদের হাতে। অর্থ ও খাদ্যের মজুতদারও তারা। পার্থিব জীবনের সার্বিক উন্নতির পারাকাষ্ঠাও দেখিয়েছে তারা। আমাদের গৌরব করার মত কি আছে? আমাদের আছে ধর্ম। আমরা কজনে ধর্মগ্রন্থের পাঠ অনুসরণ করে চলি? কোরআনতো নেকড়ায় পেচানো থাকে ঘরের মাচার সঙ্গে ঝুলানো অথবা মসজিদের তাকে, সকাল বিকাল তেলাওয়াত করে সওয়াব হাছিলের উদ্দেশ্যে। কই, সমাজে চুরি হলে, চোরের হাত কেটে কোরআন মোতাবেক কি বিচর হয়? তাহলে কোরআনের বাস্তবায়ন কোথায়? সুদের কারবারে জড়িত নন, এমন হাজিদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। দুষিত রাজনীতির দীক্ষা নেই এমন আলেম কতজন আছেন সমাজে? থেকেই বা লাভ কি, তাদের প্রভাব তো সমাজে পড়ছে ন। যে সমাজ সন্ত্রাস কবলিত, সেখানে জ্ঞানীদের কথা কে শুনবে? আমরা আধুনিক যুগে মানুষের ধর্মবোধের মূল্যায়ন করে কোরআনের অবস্থান ব্যাখ্যার যে প্রয়াস নিয়েছি, বাস্তব কারনে তা অমীমাংসিত থাকছে। কোরআনের বক্তব্যের গভীরতা ও গাম্ভীর্য ধারণ করার মত সমাজ কি এদেশে আছে? আর যারা নেকী হাছিলের জন্য আরবী ভাষায় কোরআন তেলাওয়াত করছেন, তাদের কথা আলাদা ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন