কোরআনে মানুষের চরিত্র


আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি এতটা অগ্রসর হয়েছে যে, মানুষের মন বলতে যদি কিছু থাকে তাহলে সে মন কেমন, তা গবেষণার বিষয় হয়ে গেছে। অবশ্য বলতে হয়, প্লেটো ও অ্যারিষ্টোটলের সময়ে মানুষের মন নিয়ে ভাবাত্মক আলোচনা হয়েছে; পরে সেটা মন থেকে আত্মায় উন্নীত হয়েছে। আত্মার স্থান আধুনিক কালে দখল করেছে আচরণ।

কারন মন বা আত্মাকে পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষা করে কোন মৌলিক সিদ্ধান্তে আসা যায় না, অথচ বিজ্ঞানের শর্ত হল, গবেষণার বিষয়বস্তু অবশ্যই পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে পরীক্ষার উপযোগী হতে হবে। সে কারনে মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের মন বা আত্মার স্বরূপ বোঝার জন্য মানুষের বাহ্যিক আচরণকে পরীক্ষা নিরীক্ষার বিষয় করেছেন। ফলে মনোবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু মন বা আত্মা না হয়ে, মানুষের বাহ্যিক আচরণ তার বিষয়বস্তু হিসেবে গণ্য হয়েছে। জার্মান মনোবিজ্ঞানী Wundt (1832-1920) মনের গতি বোঝার জন্য আচরণের পরীক্ষাগার স্থাপন করেন লিপজিগে। J.B waston মনোবিজ্ঞানকে জীবের আচরণ সম্পর্কীয় বিজ্ঞান বলে।

চেতনা, চিন্তন, আবেগ, প্রত্যক্ষণ, স্বপ্ন এবং বিশ্বাস এগুলো সবই মনের ব্যাপার। মানসিক ক্রিয়া বোঝার উপায় জীবের আচরণ প্রত্যক্ষ করা। মুখ দেখে মন চেনা যায় যেমন, তেমনি আচরণ দেখে মনের গতি বোঝা যায়। অবশ্য মনের সবটুকু অবস্থা যে আচরণে প্রতিভাত হবে এমন কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমরা কেবল মানুষের মন নয়, চরিত্রনীতিও কোরআনের আলোকে বিশ্লোষণের চেষ্টা করছি। স্রষ্টা হিসেবে মহান আল্লাহ মানুষের মন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জানেন, এবং সেটা কোরআনে কিভাবে এসেছে তাই আমাদের আলোচ্য বিষয়। ধর্মীয় গ্রন্থের বিষয়বস্তু হল স্রষ্টার মহিমা এবং মানুষের প্রতি আল্লাহর আচরণ এবং আল্লাহর প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ। কোরআন যখন নীরক্ষর উম্মী নবীর কাছে ওহীর মাধ্যমে নাযিল হতে থাকে তখন কাফেররা এর সরাসরি বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। যদিও আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা বুযুর্গ ছিল তাদের জানা ছিল হযরত মুহাম্মদ (সHappy শেষ রাসূল ও নবী হিসেবে আসবেন। তার প্রতি ঈমান আনা কর্তব্য হবে। কিন্তু তারা বরং এর বিরোধিতাই করেছে। ইসলাম শুরুতে কঠোর প্রতিরোধের মুখে পড়ে যায়। এবং বাধ্য হয়ে মহানবীকে হিজরত করতে হয়। দীর্ঘ তেইশ বছর ধরে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে মহানবীর কাছে ধীরে ধীরে কোরআন নাযিল হয়েছে। কোরআন বিশ্বসৃষ্টি রহস্যের যাবতীয় বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত অথচ অতীব প্রয়োজনীয় দিক আলোচিত হয়েছে। আমরা কোরআন অধ্যয়ন করতে গেলে মানব চরিত্র নীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে মন্তব্য পাই যা বাস্তবতার সঙ্গে অনুপুঙ্খ মিলে যায়। কোরআন একটি ধর্ম গ্রন্থ হিসেবে নির্ভেজাল সত্য তার অকাট্য প্রমাণ বহন করে মানব চরিত্রনীতির বিশ্লেষণে। একজন মানুষের পক্ষে, চৌদ্দশ বছর আগে, অন্য মানুষের অন্তর-অভ্যন্তরে এতটা দক্ষতার সঙ্গে প্রবেশ করা ছিল অসম্ভব, কোন অলৌকিক সাহয্য ব্যাতিত। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ কি চায় এবং তার কি চাওয়া উচিত তা কোরআনে আলোচিত হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, মনোবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ মানব মনের প্রকৃতি প্রবণতা অনুসন্ধান করেন। তাদরে কাছে আধুনিক বিজ্ঞান অনেক নিখুঁত যন্ত্রপাতিও দিয়েছে, তারপরও তারা মানব চরিত্রের অনেক রহস্যই খুজে পাচ্ছেন না। কিন্তু কোরআন যে মানব চরিত্র চিত্তের অতলতায় ডুব দিয়েছে, বলে দিয়েছে তার অন্তরের রহস্যকুটিল অবস্থা। আর সে কারণে মহানবীর পক্ষে অনেক অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়েছে।

কোরআন মানব সমাজকে দুটো ভাগে বিভক্ত করেছে। একটি বিশ্বাসীদের সমাজ, অন্যটি অবিশ্বাসী কাফেরদের সমাজ। কেবল বৌদ্ধধর্মে ঈশ্বরের স্বীকৃতি নেই; পরোকাল বলতেও তাদের কাছে কোন গ্রহণযোগ্য বিষয় নেই। কিন্তু বিশ্বের অন্য সব বড় বড় ধর্মে ইহকাল ও পরোকালের ধারনা জোরালোভাবেই আছে। সে কারনে ধর্মের প্রধান কথাই হল না দেখে বিশ্বাস করা এবং যাকে বিশ্বাস করা হল তার নির্দেশ মেনে চলাই হল ধর্মপালন। কোরআন যখন কাউকে শাস্তি দানের কথা বলে তখন দুটো বড় কারণ সেখানে প্রাধান্য পায়। এক. আল্লাহকে অস্বীকার করার শাস্তি। দুই. পার্থিব জীবনে অপরাধের সঙ্গে যুক্ততার শাস্তি। আবার কোরআন যখন কাউকে পুরস্কারের কথা বলে, তখন সেটাও কিন্তু শত দু:খ কষ্টের মধ্যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ধরে রাখার স্বীকৃতি এবং মানব কল্যাণে শ্রমের বিনিময় স্বরূপ। সমাজবদ্ধ বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মনে-কখন কি বলে, কোন পরিবেশে তারা কি কি আচরণ করে সেটা কোরআন ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে; অতএব কোরআন এ ব্যাপারে যথেষ্ট নিরপেক্ষতার সূত্র বজায় রেছে চলছে।

অধুনিক যুদ্ধ বিদ্যায়, সৈন্য সংখ্যা জানার চেয়ে প্রতিপক্ষ সৈনিকের মনোভাব জানা অত্যন্ত জরুরী। কারণ যুদ্দ কেবল সৈন্য ধ্বংসের নয়, প্রতিপক্ষের অবস্থানকে দূর্বল করার জন্য এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও বটে। আল্লাহ মহানবীর মাধ্যমে আরব জনগোষ্ঠির মধ্যে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন; এজন্য মহানবীর প্রথম দিনের দাওয়াত থেকে শুরু করে তিরোধানের দিবস পর্যন্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার নৈতিক অবস্থান বাস্তব কারনে ছিল একজন সাহসী যোদ্ধার। প্রতিপক্ষের মনোভাব, ভাবিষ্যত অবস্থা এবং অতীতকে আল্লাহ মহানবীর কাছে কখনো ওহীর মাধ্যমে, কখনো স্বপ্নের মাধ্যমে, কখনো বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে জানিয়ে দিতেন। আল্লাহ কখনো মহানবীকে পরিত্যাগ করেন নি। আর সে কারণে মানব চরিত্রনীতি সম্পর্কে তাকে যথা সময়ে সতর্ক করার দায়িত্ব আল্লাহ পালন করেন।

মহানবী (সHappy এর সঙ্গে সাক্ষাতে কাফেররা বলত, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, বস্তুত কখনোই তারা ঈমান আনে নি। বরং স্বগোত্রীয়দের কাছে গিয়ে আবার বলত, আমরা তো তার সঙ্গে একটু হাসি ঠাট্টা করলাম। এ ধরনের আচরণ মহানবী (সHappy এর সঙ্গে করাটা কত যে বেদনা দায়ক ছিল তা বর্ণনাতীত। যে মানুষ কোন প্রতিদান ছাড়াই অল্লাহর একত্ববাদের দিকে, কল্যাণের দিকে আহ্বান করেন, তার সঙ্গে মুনাফিকরা চক্রান্ত করেছে, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অবশ্য আল্লাহও তাদের ব্যাপারে এক কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। পৃথিবীতে গোটা মানব জীবনটা একটা প্রতারণা বিশেষ। কেবল অন্ধ ও অজ্ঞ ব্যতীত কোন জ্ঞানী-বুযুর্গ কোন দিন এমন সন্তোষ বাক্য উচ্চারণ করে নি যে পৃথিবীর এই বস্তুসামগ্রী তাদেরকে অতীব মুগ্ধ করেছে। নারী ও অর্থ এ দুটো উপকরণ পার্থিব জীবনকে বর্ণাঢ্য করেছে। কিন্তু আফসোস এখানে যে, নারীর অবস্থান ভোগ্যপণ্যের কাছাকাছি, আর অর্থ সেটার বিনিময়। পুরুষ পঙ্গপালের ন্যায় এ ক্ষণস্থায়ী জৌলুসের দিকে ধাবিত হচ্ছে-

" আর যখনই কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন তারা একে অন্যের দিকে তাকায় যে কোন মুসলমান তোমাদের দেখছে কি না-অত:পর সরে পড়ে। আল্লাহ ওদের অন্তরকে সত্য বিমুখ করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই তারা নির্বোধ সম্প্রদায়" (সূরা আত তাওবা:১২৭)

আল্লাহ কোরআনে বার বার যে কথাটি বলতে চেয়েছেন তাহল, পার্থিব ভোগাকাঙ্ক্ষাই মানুষকে পরপার সম্পর্কে সম্পূর্ণ গাফেল করে রেখেছে। বিষয়টা একটু দৃষ্টান্ত সহকারে বলা যায়; যখন কৈশরিক মোহকে প্রেম জেনে তরুণ-তরুণী পরস্পরকে কামনা করে তখন তাদের মধ্যে থাকে না পরিবেশ জ্ঞান ও পরিণাম চিন্তা। চারপাশে কি হচ্ছে, বয়োজ্যোষ্ঠরা কি বলছে তার দিকে আদৌ খেয়াল রাখার জ্ঞান থাকে না, প্রত্যেকেই মোহান্ধ অবস্থায় কাম্য বস্তুর দিকে তীব্র গতিতে ধাবিত হয়। তারা এমন এক প্রণয় লিপ্সায় রোমিয় জুলিয়টের মত, এই আকাশ ও পৃথিবী তাদের ভালবাসা ধারণ করতে পারে না, তার এত ভালবাসা পরস্পরের জন্য পোষণ করে। কিন্তু যখন তারা ব্যর্থ হয়, কেবল অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নেয় না, পরস্পরকে কিছুটা গালাগালও দেয়, আর তখন ভন্ড প্রতারক এজাতীয় শব্দগুলো ঐ সব ব্যর্থ নর-নারীর মুখে লেগেই থাকে। অথচ তারা কখনো এটা চিন্তা করে না, তারা আজ বয়সের কারণে যে মোহ ও আবেগে উত্তেজিত, একদা তা থাকবে না, নি:শেষ হয়ে যাবে।

অন্ধ প্রেমিকের মত পার্থিব প্রেমেও যারা অন্ধ ও উন্মত্ত, তার কিন্তু মৃত্যু উপস্থিত হলেও বলবে, তাদের বাপদাদারা যেভাবে বিশ্বাস করত তারাও সেভাবে বিশ্বাস করেছে। আসলে না দেখে বিশ্বাস করা এমন এক কঠিন পরীক্ষা যা আল্লাহর প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া উত্তীর্ণ হওয়া যায় না। কোরআন নানা বিষয়ের শপথ করে বলছে, কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে; মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার দরবারে করজোড়ে উপস্থিত হবে, এবং মানুষের সমস্ত বিভ্রান্তির ফয়সালা হবে। এ সংবাদ নবী ও রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কাছে। কেবল হযরত মুহাম্মদ (সHappy এনেছেন সকল মানব জাতির জন্য। এ কারনে কোরআনে বিভিন্ন বিষয়ের পরস্পর আলোচনায় অসম্প্রদায়িক চেতনা বজায় রয়েছে। বিধর্মীদের প্রতি শত্রুতাবশত তোমরা কখনো ন্যায় বিচারকে ত্যাগ কর না। ন্যায় বিচার তাকওয়ার কাছাকাছি।

আমরা এখানে আলোচনা করছিলাম, কোরআন কিভাবে মানবীয় চরিত্রনীতি বিশ্লেষণ করেছে। সমগ্র কোরআনে দুরকম চরিত্রনীতি আলোচনায় এসেছে। বিশ্বাসী মুমিন বান্দার আখলাক, এবং অবিশ্বাসী মুশরিক, মুনাফিক ও কাফেরদের স্বভাব। বিশ্বাসীবান্দার মধ্যে যে ধরনের চরিত্রনীতি আমরা দেখি, অবিশ্বাসী মুনাফিকের চরিত্র বলতে গেলে তার বিপরীত । কোন বিধর্মীকও যদি কোরআনের সত্যতা যাচাই করতে চায় তাহলে তিনি যেন পার্থিব সমাজ জীবনে চলাচলকারী বিশ্বাসী মুমিনদের চরিত্র এবং কাফের, মুশরেক-অবিশ্বাসীদের চরিত্রগত পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেন কোরআনকে সামনে রেখে। তাহলে তিনি কোন অলৌকিক ঘটনা বা মোজেজা ছাড়াই কোরআনের সত্যতা অনুধাবনে সক্ষম হবেন। কোরআনের শুরুতেই বলা হয়েছে, - " এ সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। পথ প্রদর্শণকারী পরহেযগারদের জন্য। যারা অদৃশ্য বিষয়ের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং নামায প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি তাদেরকে যে রিযিক দান করেছি, তা থেকে ব্যায় করে।" একটি নির্ভূল গন্থের এই বর্ণনা বিশ্বাসী বান্দার মনকে ভাবাবেগে উদ্বুদ্ধ করে এর অবিশ্বাসীরা বরাবরই অস্বীকার করে। আল্লাহ বলেন, - " যদি আমি কাগজে লিখিত কোন বিষয় তাদের প্রতি নাযিল করতাম, অত:পর তারা তা-সহস্তে স্পর্শ করত, তবু অবিশ্বাসীরা একথাই বলত যে, এটা একটা প্রকাশ্য যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।"

অবিশ্বাসীরা এখনো মনে করে কোরআন গালগপ্পই। এতে শেখার মত কিছু নেই। আধুনিক কালের নাস্তিক সম্প্রদায় ইসলামের বিরুদ্ধে দুচারটে আপত্তিকর মন্তব্য করতে না পারলে রাতে ঘুম হয় না। এটা তাদের চরিত্র স্বভাবের অংশ। অথচ মানুষ যখন দু:খে পতিত হয়, তখন তার অচরণ ও কথাবার্তা বদলে যায়। কোরআনে পরিস্কার ভাষায় বলা হয়েছে- " মানুষকে যখন দু:খ কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে আমাকে ডাকতে শুরু করে, এরপর আমি যখন তাকে আমার পক্ষ থেকে নিয়ামত দান করি, তখন সে বলে, এটা তো আমি পূর্বের জানা মতেই প্রাপ্ত হয়েছি। অথচ এটা এক পরীক্ষা, কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।" (সূরা যুমার: ৪৯)।

পার্থিব সুখ সম্ভোগ পিপাসু কাফির ও মুশরিক দল, আল্লাহকে বোকা মনে করে। মিথ্যার উপর গা ভাসিয়ে চলার জন্য এরা সর্বত্র ব্যস্ত থাকে। শয়তানের সঙ্গি হিসেবে এরা অত্যন্ত বিশ্বস্ত। কিন্তু আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল জনগনের জন্য এরা বিপজ্জনক। এদের চরিত্র নীতি বলতে কিছুই নেই। অধিকাংশ মানুষই এদের দলভূক্ত। পৃথিবীতে অনিষ্ট সৃষ্টি করা এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করা এদের নৈতিক দায়িত্ব। শয়তান যেমন আত্মস্বীকৃত শয়তান। স্রষ্টা হিসেবে আল্লাহ জানেন বিশ্বাসীর মনে কি আছে এবং তিনি ক্ষমতায় বিশ্ববাসী থেকে বেপরোয়া। তথাপিও আল্লাহ বাস্তব ঘটনার মাধ্যমে মানুষের আচরণ পরীক্ষা করেন এবং অন্তরে প্রবেশ করেন। " আর যখন মানুষ কষ্টের সম্মুখীন হয়, শুয়ে বসে, দাড়িয়ে আমাকে ডাকতে থাকে। তারপর আমি যখন তা থেকে মুক্ত করে দেই, সে কষ্ট যখন চলে যায়, তখন মনে হয়, কখনো কোন কষ্টেরই সম্মুখীন হযে যেন আমাকে ডাকেই নি।" (সূরা ইউনুস : ১২)।

কেন এমনটা হয় ? মানুষ সৃষ্টিগতভাবে অকৃতজ্ঞ। তবে খুবই নগণ্য সংখ্যক লোক আছে যারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা বজায় রাখার প্রয়োজন অন্তর থেকে অনুভব করে।

কোরআন কেন মানবচরিত্র বিষয়ে আলোচনা করে ? কারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হল চরিত্র। সকল জ্ঞন-বুদ্ধির ঊর্দ্ধে আমরা বিবেচনা করি চরিত্র। যার চরিত্র সুন্দর নয়, তার কাছ থেকে বিদ্যার্জন করা উচিত নয়। কারন সর্বপ্রকার জ্ঞান অর্জনের মূল লক্ষ্য হল-মানুষের চরিত্রকে সুন্দর করা। এ কারনে আল্লাহ বলেন, "যারা কেয়ামতে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর সাক্ষাৎকে ভয় করে তাদের জন্য মহানবী (সHappy এর চরিত্রের মধ্যে উত্তম নিদর্শন আছে।" কোরআনে এভাবে মহানবী (সHappy এর চরিত্রকে সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং আমরাও দেখি, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সHappy এর মত সর্ববিধ গুণে গুণান্বিত মানুষ দুনিয়ায় আর আসেন নি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মহানবী (সHappy এর চরিত্রের প্রশংসা করেছেন এবং বিশ্বাসী বান্দাদেরকে আহ্বান করা হয়েছে মহানবী (সHappy কে অনুসরণ করার জন্য। মানুষ সর্বাংশে ফেরেস্তা নয়, কিংবা সম্পূর্ণ শয়তানও নয়। মানব চরিত্রে দুটো ধারার সমন্বয় ঘটেছে। তবে কোরআনে আল্লাহ মানুষকে অকৃতজ্ঞ বলেই উল্লেখ করেছেন। মানুষ স্বভাবতই জালেম। মানুষ প্রতি মুহুর্তে যার নিয়ামত ভোগ করছে, তাকেই সে কথায় কথায় অস্বীকার করছে।

" আমি মানুষকে নিয়ামত দান করলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং আহংকারে দূরে সরে যায়; যখন তাকে কোন অনিষ্ট স্পর্শ করে তখন সে একেবারে হতাশ হয়ে পড়ে। " (সূরা বনী ইসরাঈল : ৮৩)

কোরআন মানব চরিত্রকে লক্ষ্য করছে পার্থিব ভোগ্যপণ্য পাওয়া ও হারানোর প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে। সেই সঙ্গে মানুষের চরিত্রনীতি বিশ্লেষিত হয়েছে প্রত্যাহিক কর্মধারা আনুসরণে। একথা সত্য যে মানুষ অভাব ও বিপদ মুক্ত থাকলেই অলসতার মধ্যে ডুবে যায়। এবং অপরাধ প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত হয়। যার পেটে ভাত থাকে না, চলার পয়সা থাকে না, তার বিশ্বাসী মন সর্বদা নি:সংশয়ে আল্লাহকে ডাকে। আমরা মাজারগুলোতে গরীব ও মিসকিনদের মনোভাব, হাসপাতালে রোগীদের মনোজগত বিশ্লেষণ করলে এ সত্যের সহজ স্বীকৃতি পাই যে মানুষকে অভাব ও রোগব্যাধি আক্রান্ত করলে মানুষ হাঁটু গেড়ে আল্লাহকে ডাকতে বসে। এটা মানবচরিত্রের এক চিরন্তন অবিভাজ্য অংশ। ধন-সম্পদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ ধনীর মনোভাব এমনভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠে যে তার চার পার্শের কোন কিছুকে সে তোয়াক্কা করে না। কোরআনে বর্ণিত কারুনের কাহিনী, ফেরাউনের ও নমরুদের ঘটনা থেকে আমরা এ সত্যের পরচিয় পাই। এ ছাড়া আমাদের প্রত্যাহিক সমাজ জীবনেও দেখি, অর্থ-সম্পদের মোহে আক্রান্ত লোকগুলো কিভাবে অহঙ্কার করে, কিভাবে অন্যের অধিকারকে অপহরণ করে। দিন ও রাতের পরিবর্তনের মতোই মানবচরিত্রনীতির পালাবদল ঘটে। মানুষ বুঝতে পারে না, কিভাবে তার চরিত্র পরিবর্তিত হচ্ছে, কিভাবে তার কথায় অহঙ্কার ও বিদ্বেষ প্রকাশ পাচ্ছে। দিনের উজ্জ্বল আলোর অবস্থানকালে আমরা যেমন রাতের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি না, তেমনি রাতের অন্ধকারে বাস করে দিবসের অভিজ্ঞতাও ভোগ করতে পারি না। ঠিক সেভাবে ধনীর মধ্যে গরীবের হাল অবস্থা থাকে না, আবার গরীবের মধ্যে ধনীর মনোভাবও পাওয়া দুষ্কর। এ কারনে এরিষ্টোটল বলেছেন, "এক ব্যাক্তি একই সময়ে ধনী ও দরিদ্র হতে পারে না।" আবার আল্লাহ মানুষের দেহে দুটি অন্তর স্থাপন করেন নি। সে কারনে ধন সম্পদ ভোগ করার মনোভাব এবং হত দরিদ্র অবস্থার শিকার হলে মনের গতি কখনো এক হতে পারে না।

" আর অবশ্যই যদি আমি মানুষকে আমার রহমতের আস্বাদ গ্রহণ করতে দেই, অত:পর তা তার থেকে ছিনিয়ে নেই; তাহলে সে হতাশ ও কৃতঘ্ন হয়। আর যদি তার উপর আপতিত দু:খ কষ্টের পরে তাকে সুখ ভোগ করতে দেই, তবে সে বলতে থাকে যে, আমার অমঙ্গল দূর হয়ে গেছে, আর সে আনন্দে আত্মহারা হয়, অহঙ্কারে উদ্ধত হয়ে পড়ে।" (সূরা হুদ : ৯-১০)

মানুষ আসেলে দ্রুত মত পরিবর্তনকারী জীব এবং অতীতকে ভোলার ব্যাপারে সে অগ্রগামী। ভবিষ্যত সম্পর্কেও মানুষ খুব সচেতন নয়। মানুষ বিশেষভাবে বর্তমানকে বিবেচনা করে না। বর্তমান অবস্থাকে মানুষ হাড়ে মাংসে অনুভব করে। অতীত থেকে মানুষ খুব কমই শিক্ষা নিয়ে থাকে। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা ঘটল, ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হল। সেটাও শুভ বুদ্ধি-উদয়ের জন্যে যথেষ্ট হল না, তারপরেও মানবজাতির বিভিন্নগোষ্ঠী যুদ্ধ করছে, মরছে, মারছে। বলতে গেলে মানব ইতিহাস তো যুদ্ধ ও শান্তির, ধনীর অহঙ্কার ও নির্ধনের আত্মাহুতির ইতিহাস।

কোরআন মানুষের চরিত্র সম্পর্কে এ কারনে অলোকপাত করছে যে, মানুষ কোন পরিস্থিতিতে কি চায় এবং কি চায় না, কি করে, কি করে না সেটা আমাদের জানা উচিত। মানুষ যত রকম জ্ঞান অর্জন করুক, অন্তত মানুষ যদি মানুষের চরিত্রনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন না করে তাহলে তার কোন জ্ঞানই অর্জিত হল না বলতে হবে। কোরআনের মৌলিক উদ্দেশ্য দুটো-পার্থিব সমাজে শান্তিতে বসবাসের জন্য মানুষকে সুন্দর একটা চরিত্রনীতি দান করা এবং দ্বিতীয়ত: পরোকালীন জীবনের অনন্ত সুখ ও দু:খের মুখোমুখী করা এবং শেষ বিচার দিবস সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বিশ্বাসী করে তোলা। এ দুটো বিষয়কে বোঝানোর উদ্দেশ্যে কোরআনে আল্লাহ মানব জাতির ইতিহাস এবং বিভিন্ন নিদর্শন নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বর্ণনা করেছেন।

"নিশ্চয়ই আমি এ কোরআনে মানুষকে নানাভাবে বিভিন্ন উপমার দ্বারা আমার বাণী বুঝিয়েছি। মানুষ সব থেকে অধিক তর্কপ্রিয়।" (সূরা কাহফ : ৫৪)।

কোরআনে নানাভাবে মানুষকে এ সত্য বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে যে, মানব ও জ্বিন জাতিকে অবশ্যই আল্লাহর সম্মুখে শেষ বিচারের দিন নত জানু হয়ে দাঁড়াতে হবে এবং তারা ইহকালে যা কিছু করছে তার প্রতিদান পাবে। কিন্তু 'তর্ক প্রিয়' মনুষ সহজে এ সত্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে চাইছে না। কারন বর্তমানতায় তার আত্মা নিবিষ্ট হয়ে গেছে। যেমন, মানুষ অসহায় অবস্থায় একদিকে বিশ্বাস করে, তবে সে ভবিষ্যত সম্পর্কে খুব দুশ্চিন্তায় লিপ্ত। আল্লাহকে রিযিকদানকারী জেনেও বাড়তি পরিশ্রমে পেরেশান হচ্ছে। মৃত্যুর বিশ্বাস তার আছে অথচ সে আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকছে। পরোকালের হিসাব তার দিতে হবে, কিন্তু সে সৎ কাজে সময় ব্যায় করে না। প্রতিদিনের পরিবর্তন সে দেখছে কিন্তু নিজের সম্পর্কে সে খুবই উদাসীন। এ হল মানুষের আসল চরিত্রনীতি।

বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের চরিত্র নীতি কিভাবে বদলে যায় তার চমৎকার বিবরণ কোরআনে পাওয়া গেল। কিন্তু মানুষের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত, তা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সHappy এর মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে। আল্লাহ নিজেই রাসূলের প্রশংসা করেছেন, বিশ্ববাসীকেও তার প্রশংসা করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ বলেন - "রাসূলুল্লাহর মধ্যে তোমাদের জন্য নিশ্চয়ই সবোত্তম আদর্শ রয়েছে।"

মানুষ সর্বাংশে শয়তান বা ফেরেস্তা নয়, সে ভাল মন্দের সমন্বয়ে গঠিত। ফলে, কিভাবে সবোত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া যায়, তার চমৎকার দৃষ্টান্ত মহানবীর জীবন চরিত্রে পাওয়া যায়। তিনি জন্মগতভাবে অনাথ, যৌবনে তিনি সামাজিক শান্তির প্রতিষ্ঠাতা, প্রোঢ় জীবনে তিনি মহান এক সাধক, এবং পরবর্তী জীবনে তিনি আল্লাহর মনোনীত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল, তথা একটি নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান। তার জীবনে এমন কিছু নেই যা তার অনুসারীদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ নয়। ধর্মের বাণী কিতাববদ্ধ থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা যখন একক কোন ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে বিকশিত না হয় সেটা তখন সাধারনের মধ্যে অনুসৃত হয় না। তবে এক্ষেত্রে কোরআন-এর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। পবিত্র কোরআনে তত্ত্বগতভাবে যে জীবনাদর্শ রয়েছে, মহানবী (সHappy এর জীবনে তার পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেছে। মানুষের ইহকাল ও পরোকাল যাতে সুন্দর হয়, তার জন্য প্রয়োজনীয় জীবন ব্যাবস্থা কোরআন মানুষের সামনে পেশ করছে। মহানবী (সHappy নিজেই কোরআনের বিধিবিধান সর্বাংশে মেনে চলেছেন এবং দেখিয়েছেন, এভাবে আল্লাহর পবিত্র কালামকে অনুসরণ করে পথ চলা যায়। কোরআনের বাস্তব ব্যাখ্যাই হচ্ছে মহানবী (সHappy এর জীবন।

স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মানব চরিত্র নীতির সার-সংক্ষেপ হল, মানুষ স্বভাবত অকৃতজ্ঞ এবং তর্ক প্রিয়। বস্তুগত প্রাপ্তি যেমন টাকা-পয়সা, সন্তান-সন্ততি, ঘর-বাড়ী ও সামাজিক প্রতিপত্তি মানুষকে মুগ্ধ করে সহজেই। মানুষের মধ্যে অধিকংশই তাদের নিজ নিজ অবস্থার উপর অসুখী। মানুষের পার্থিব জীবন নেশার কাছে পরোকাল নিতান্তই তুচ্ছ। মানুষ তার চারপাশে মৃত্যু দেখেও মনে করে সে অনন্তকাল বাচবে। অধিকাংশ মানুষ সত্য প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত।

কোরআনে বর্ণিত মানুষের অন্ত-স্বভাব সম্পর্কে চুড়ান্ত কথা এটাই যে মানুষ অধিক পারিমাণ ধন-সম্পদের অধিকারী হতে অত্যন্ত তৎপর এবং যখন সে তা হারায় তখন সে বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকে, রহমকারী আল্লাহকে ডাকতে থাকে। "যখন মানুষকে দু:খ-কষ্ট স্পর্শ করে, তখন সে একাগ্রচিত্তে তার পালনকর্তাকে ডাকে, অত:পর তিনি যখন তাকে নিয়ামত দান করেন, তখন সে কষ্টের কথা বিষ্মৃত হয়ে যায়, যার জন্যে পূর্বে ডেকেছিল এবং আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করে; যাতে করে অপরকে অল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত করে" (সূরা যুমার:৮)।

যাদের প্রচুর ধন সম্পদ থাকে, দাস-দাসী থাকে, তারা অহঙ্কার ও দম্ভভরে কথা বলে তাদের প্রতি সাধারণ হত দারদ্র মানুষগুলো লাভের প্রত্যাশায় তাকিয়ে থাকে এবং মৌখিক প্রশংসা ছড়ায়, তাতে সম্পদশালীগণ আরামবোধ করে এবং মনে করে এ সম্পদ তাদের কখনো কমবে না এবং অধীনস্তদের প্রতি দুর্ব্যবহার করাও তাদের অধিকার। দুনিয়ার প্রায় সকল রাজ বংশ ও সুখী পরিবারগুলোতে একই অবস্থা বিরাজমান। আবার হত দরিদ্র শ্রেনীর মধ্যে একজন সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ সন্ধানের ব্যাকুলতাও দেখা যায়। স্ত্রী-পুত্র পরিজন ও ধন-সম্পদ দ্বারা আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন। চরিত্রনীতি যাচাই করেন। এজন্য আল্লাহ পাক বলেন, "তোমাদের স্বজন পরিজন ও সন্তান-সন্ততি কেয়ামতের দিন কোন উপকারে আসবে না।"

শেষ বিচার এমন একটি দিবস, যেখানে সর্বাধিক নির্মমতার সঙ্গে বিচার করা হবে, এবং কারো প্রতি জুলুম কর হবে না, এমন দিবস সম্পর্কে বেখবর বান্দাদের তালিকার শীর্ষে থাকে পার্থিব সুখ-সম্ভোগকারী বিভ্রান্ত ধনী শ্রেনী যারা-সকল গরীবের হাড়িতে নিজেদের সম্পদ লুকানো দেখাতে পায়।

কোরআন ইহকাল ও পরকালের পটভুমিতে মানুষের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য সমূহের একটি বিধিবদ্ধ কার্য বিবরণী পেশ করছে, যা মানুষের চিরন্তন চরিত্র স্বভাবের স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। কোরআন সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট ধারনা আছে তারা মানব চরিত্রনীতি বিষয়ে সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন।

যার চরিত্র সুন্দর নয়, তার কাছ থোকে আমরা জ্ঞানার্জন তো দূরের কথা, তার সঙ্গে কথাও বলতে চাই না। জ্ঞানার্জন, কিংবা ধর্ম সাধনা যা কিছু আমরা করিনা কেন তার মূল লক্ষ্য চরিত্রগঠন। চরিত্র অমূল্য সম্পদ। এর মহিমা অতুলনীয়। মানব চরিত্রের মৌলিক কাঠামো যেভাবে কোরআন বর্ণনা করছে তার পরিবর্তন বাস্তবে ঘটছে না। যে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহই মানুষের চরিত্রগত প্রবণতা কোরআনে বর্ণনা করেছেন। আমরা যুগে যুগে আত্মদম্ভকারী রাজা-বাদশার একই পরিণাম প্রত্যক্ষ করি যেভাবে কোরআনে বর্ণিত হয়েছে।

মানব চরিত্রকে দাঁড় করানো হয়েছে দুটো মৌলিক স্তম্ভের উপর। এক. ইহকাল ও পরোকাল ভাবন। দুই. পার্থিব জীবনের অর্থ সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি। ধন-সম্পদের আকাঙ্ক্ষা মানুষের থাকবে, ইহকালের সীমানায় বসে পরোলকে বিশ্বাস করা ও না করার ভাবনাও থাকবে। আর সে অবস্থাকে সামনে রেখে কোরআন মানব চরিত্রের মূল প্রবণতাকে যেভাবে সনাক্ত করেছে তা চিরন্তন; অপরিবর্তনীয় এবং অতি-বাস্তব। মানুষকে বার বার বলা হয়েছে, ইহকালের জীবন ক্রীড়া কৌতুক ব্যতীত কিছু নয়। নবীন শস্যক্ষেত্রের সবুজ ধানের শীষের মত এই অর্থ সম্পদ একদা ফুরিয়ে যাবেই; মানুষের আত্মদম্ভ কোন কাজে আসবে না। তবু মানুষ বুঝতে চায় না, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মানুষকে অবশ্যই তার পালনকর্তার কাছে ফিরে যেতেই হবে।

মানব চরিত্র ব্যাখ্যায় নানা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাবহৃত হতে পারে। এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেটা মূলত সৃষ্টিকর্তার চোখে মানুষের স্বভাবচরিত্র নিরীক্ষণ করা হয়েছে। নীতিশাস্ত্র মানুষের চরিত্র আলোচনা করে। মানবিক দৃষ্টিতে তার কি করা উচিত কি করা উচিত নয় তার ব্যাখ্যা দেয় নীতি শাস্ত্র। তবে সেখানে পরকালীন জীবন ভাবনার তেমন জায়গা নেই যা ধর্মশাস্ত্রে আছে। ধর্মশাস্ত্রের কথা হল, প্রথমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অকুন্ঠ অনুগত্য এবং প্রকাশের জন্য ধর্মনুষ্ঠান পালন অত:পর মানব সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন। নীতিশাস্ত্র হয়ত বলবে, "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"। কিন্তু ধর্ম বলবে, মানুষের কল্যাণে মানুষ দ্বিধাহীনভাবে এগিয়ে আসবে, তবে সঙ্গে তার স্রষ্টাকে আনতেই হবে। কারণ সৃষ্টিকর্তাকে সঙ্গে না নিয়ে মানুষের কোন কাজই সফল হতে পারে না। হযরত ঈসা নবী বলেন, "ঈশ্বরকে সঙ্গে নিয়ে সব কিছু করা সম্ভব।"

আল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে সবকিছু করা উচিত। এটাই হল মানব জাতির প্রতি সকল ধর্মের মৌলিক আবেদন। কোরআন মানব জাতির মধ্যে দুটো শ্রেনি আবিষ্কার করে; এক. অবিশ্বাসী মুশরিক দুই. বিশ্বাসী মুসলমান। সামাজিক ও পারিবারিক কর্মকান্ডে উভয় দলের মধ্যে কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও, আল্লাহ, পরোকালে, নবী-রসূল এবং ফিরিস্তাদের অস্তত্ব সম্পর্কে বিশ্বাসের ব্যাপারে দু'দলের চরিত্রনীতি সম্পূর্ন ভিন্ন। ফলত, কোরআনের দৃষ্টিতে বিশ্বাসী মুমিন বান্দাই সচ্চরিত্র অধিকারী আর অবিশ্বাসী মাত্রই জালেম।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

শর্ষীনা, ফুরফুরা, জৌনপুরী, ফুলতলী, সোনাকান্দা সহ সকল বালাকোটি পীরগনের শেরেকী আকীদা

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে