আল-কোরআনে মানবতাবাদ
মানুষের জীবন সম্পর্কে সহজ-সরল বিধান প্রণয়নে অন্য সকল ধর্ম গন্থের
চেয়ে পবিত্র কোরআনে তিনটি কারনে শ্রেষ্ঠ। এক. অনাথ-এতীমদের সম্পদ সংরক্ষণ
করা, দুই. পক্ষপাতিত্বের দোষ থেকে মুক্ত থাকার জন্য অধিকারভুক্ত দাসীকে
দেনমোহর দিয়ে স্ত্রীর মর্যাদা প্রদান করা, তিন. কোন মাধ্যম ব্যাতিত
দুনিয়ার যে কোন স্থানে দাড়িয়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা। কেবল এ
তিনিটি কাজের জন্য ইসলাম, যে কোন ধর্মের চেয়ে মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ এবং
শ্রেষ্ঠ। যে এতীমের সম্পদ রক্ষা করে সে ব্যবসা-বানিজ্যসহ সকল পার্থিব কাজে
সততা অবলম্বনের ক্ষমতা রাখে। যে দাসীকে দেনমোহর দিয়ে স্ত্রীর মর্যাদা
দিতে পারে সে লোভ-লালসাকে সহজে দমন করতে পারে এবং জীবনের অন্য সব দু:খ
কষ্টের দিনে কর্মক্লান্ত মুহুর্তে যে অযু করে নামাযে দাড়িয়ে আল্লাহর কাছে
আশ্রয় ও সাহায্য চাইতে পারে-সে অন্যসব বিধিবিধানও পালনের যোগ্যতা রাখে।
কোরআনের মানবতাবাদ নিয়ে যুগে যুগে বহু গবেষক অনেক মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। আজ সারা বিশ্বে মানবতার চরম অবক্ষয় চলছে। কোরআন এর অনুসারী মুসলিম জাতি আজ সর্বত্র নির্যতিত। বিশ্বের মানুষ যাদের কাছ থেকে জ্ঞানের আলো পেয়েছে, তারা আজ অজ্ঞ ও অন্ধ। তাদের মহান ধর্মগ্রন্থ তাদের মধ্যে এখন নতুন কোন জাগরন সৃষ্টিতে অক্ষম। আসলে কি তাই ? আমরা সেটা বিশ্বাস করি না। কারন আল্লাহ তার কৃত ওয়াদা মোতাবেক কোরআনকে অবিকৃত রেখেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে।
মানবতাবাদ সম্পর্কে পাশ্চাত্য লেখকদের কোন সংজ্ঞা ব্যবহার না করেই, আমরা সরাসরি পবিত্র কোরআনের কিছু অংশের পাঠ শ্রবণ করব। কারণ ওসব দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোন থেকে মানবতার সংজ্ঞা নির্ধারন করেন। পাশ্চাত্যর নিজস্ব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়া হয় এবং পশ্চাৎপদ দেশের অনাহার ক্লিষ্ট, রোগজর্জরিত মানুষগুলোকে সব সময় পেরেশান করে রাখে। মানবতা লংঘনের ধুয়া তুলে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা, যা নিতান্তই অমানবিক। সে বিষয়ে আমরা পরে যাব। এবার আমরা কোরআনের কিছু অংশ পাঠ করব।
১. হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রতার কারনে কখনো ন্যায় বিচার পরিত্যগ করো না। সুবিচার কর। এটাই খোদাভিতীর অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত।
২. নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদরে নির্দেশ দেন যে তোমরা যেন প্রাপ্য আমানত সমূহ প্রাপকদের নিকট পৌছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মিমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।
৩. আর যখন তারা আপনার কাছে আসবে যারা আমার নিদর্শন বিশ্বাস করে, তখন আপনি বলে দিন; তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের পালনকর্তা রহমত করা নিজ দায়িত্বে লিখে নিয়েছেন যে, তোমাদের মধ্যে যে কেউ অজ্ঞতাবশত কোন মন্দ কাজ করে, অনন্তর এর পরে তওবা করে নেয় এবং সৎ হয়ে যায়, তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুনাময়।
৪. হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্পত্তি ক্রয়ে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্য করো না। নি:সন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।
৫. এতীমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের আদল-বদল করো না। নিশ্চয়ই এটা বড় মন্দ কাজ। আর যদি তোমরা ভয় কর যে এতীম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশংকা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাঝতে পারবে না, তবে একটিই বিয়ে কর। আথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে, এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।
৬. সম্পত্তি বন্টনের সময় যখন আত্মীয় স্বজন ইয়াতীম মীসকিন উপস্থিত হয়, তখন তা থেকে তাদরেকে কিছু খাইয়ে দাও। এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ কর।
৭. যারা এতীমদের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করছে। অতিসত্বর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
৮. নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানত সমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মিমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন ন্যায় বিচার কর।
৯. কিন্তু পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা অসহায়, তারা কোন উপায় করতে পারে না এবং পথও জানে না। অতএব আশা করা যায়, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।
উদ্বৃত আয়াতগুলো পাঠ করার পর এটা কি মনে হয়, আল্লাহ অন্যায়ভাবে মানুষের স্বাভাবিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায় কোরআনে ব্যাক্ত করেছেন ? কেবল ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের দৃষ্টিকোন থেকে নয়, মানবকুলের স্রষ্টা মহান আল্লাহর দৃষ্টিকোন থেকে মানবতার সংজ্ঞা নিধারিত হয়ে আাছে আলোচ্য আয়াতগুলোতে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বাস করে, কিন্তু মেধা, বুদ্ধি, অর্থ-সম্পদ, জনবল ও আত্মীয়-পরিজনের দিক থেকে সবাই সমান নয়। এ কারনে সমাজে মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন, আমি মানুষকে আত্মীয়তা ও রক্তের সম্পর্কশীল করে সৃষ্টি করেছি। মানুষ যাতে একতাবদ্ধ থাকার জন্য প্রেরণা বোধ করে সে কারনে এই আত্মীতার সম্পর্ক। এছাড়া মানব জাতি তো একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে থেকে বিকশিত হয়েছে । কিন্তু কালক্রমে মানুষ বিভিন্ন জাতি, গোত্র, বংশ ও সমাজে বিভক্ত হয়ে গেছে। বৈচিত্রের মধ্যে নতুন ঐক্যের সাধনা, সে কারনে ধর্মের শিক্ষা অনিবার্য। কোরআন নির্ধরিত মনবতার সংজ্ঞা আলোচনার আগে আমরা দেখব, কোরআন তার বানীকে কাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছে।
"হে মানব জাতি! তোমাদের পালনকর্তার যথার্থবানী নিয়ে তোমাদের নিকট বাসূল এসেছেন, তোমরা তা মেনে নাও, যাতে তোমাদের কল্যাণ হতে পারে।"
"হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে।"
মানুষের মধ্যে একটি দল একনিষ্ঠভাবে কোরআনিক বিধি-বিধান পালন করে। এবং সেটা অনাগত ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু কোরআন সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত একটি বিধান, মানুষের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে; ফলে সেখানে মানবতাবাদের ব্যাপ্তি-বিস্তৃতি ও সংজ্ঞা বিশ্বের অন্য কোন পন্ডিত বা বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞার সাথে তুল্য হতে পারে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি মনের সংকীর্ণতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু কোরআন যে ধর্মের উপর ভিত্তি করে মানবতাবাদের কথা বলছে, সেটা কি সংকীর্ণতার দোষে আক্রান্ত ? মানুষের দৃষ্টিকোন থেকে মানুষের মূল্য বিচার এবং স্রষ্টার দৃষ্টিতে মানুষের মূল্য বিচার কখনো সমান হবে না। স্রষ্টা হিসেবে মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, বিশ্বাসীদের কোরআনের সবরকম বক্তব্যের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্বাস স্থাপনের পরেই কেবল মানবজীবনের অন্যসব অনুসঙ্গকে বিবেচনা করতে পারেন। যতক্ষন মানুষ নি:সংশয়ে কোরআন বিশ্বাস না করছে, ততক্ষণ মানবতাবাদ কিংবা মানবতার কোন প্রশ্ন নেই। এটা আল্লাহর সিদ্ধান্ত। হয়তো তাদেরকে পার্থিব জীবনে পাকড়াও করা হচ্ছে না। তবে একথা কি ভেবে দেখার বিষয় নয়, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কতজন আল্লাহ, পরকাল, সকল নবী, রাসূল, বেহেশ্ত, দোযখ বিশ্বাস করে ? অথচ আল্লাহ কিন্তু এই সূর্য নক্ষত্র আলো-অন্ধকার, আকাশ-বাতাস, নদী-পর্বত-সাগর ও বনভূমি দ্বারা কি বিশ্বাসী কি অবিশ্বাসী সকলকে, নির্বিশেষে সাহায্য করছেন না ? এর চেয়ে বড় মানবতা আর কি ? মানুষ তার বিরোধী প্রতিবেশীকে এভাবে প্রতিপালন করতে পারে ? এতটা উদার কি মানুষ হয়েছে ? হযরত আলী (রা
বা মাহাত্মা গান্ধী কি সবাই হতে পারে ? অতএব মানব রচিত সংবিধানে
মানবতাবাদের অধ্যায় এ কারনে সংকীর্ণ ও অশুদ্ধ যে, ঐ সংজ্ঞার রচয়িতা একদল
মানুষ, যারা সামান্য ক্ষতিতে বিমর্ষ হয়, সামান্য আনন্দে উত্তেজিত হয়।
মানুষ হিসেবে জ্ঞানী-পন্ডিতেরা মানবতাবাদের যে চিত্র একেছেন তাতে করুনার
ছবিই বেশী ফুটে উঠে। ভিক্ষুককে ভিক্ষা দান, আর্তির অশ্রু মোচন, অভাবীর অভাব
দূর করা, জাতি, বর্ণ, ধর্ম, নির্বিশেষে এগুলোই হল মানবতার কাজ এবং এগুলো
সম্পাদনের প্রতি পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীরা আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর
দিকে আঙ্গুল উচিয়ে বসে আছেন। কারণ খৃষ্টের সেবামূলক কাজের ভেতর দিয়ে যে
মানবতার মুক্তি তারা দেখেছেন, ওটাকেই তারা সারা বিশ্বর জন্য মডেল করতে
আগ্রহী। কিন্তু কোরআন শুধু আর্তির অশ্রুমোচন করেই ক্ষন্ত হয় নি,
নির্যাতিতদের পক্ষ্যে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার করে মানবতার নতুন মাত্র সংযোজন
করেছে। কোরআন যেভাবে মানবতার প্রশ্নটি আলোচনা করে তা ব্যাপক এবং গভীর।
"দানশীলতা, ক্ষমা কিংবা সহনশীলতা মানবতা নয়, যদিও এগুলো মানবতারই
ফলশ্রুতি। মানবতা হল প্রথম মানুষ এবঙ তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি অর্থাৎ মানুষ
হিসেবে তার মূল্য প্রদান। যা কিছু মানুষের ব্যাক্তিত্বকে হীন করে, যা তাকে
সামান্য বস্তুতে নামিয়ে আনে, তা অমানবিক। যেমন, মানুষকে তার কৃতকর্মের
জন্য অনুতাপ করতে বলা, তার মতকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করা, অত:পর তাকে
ক্ষমা করা-এটা মানবিক। একজন মানুষকে তার বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন
করার অপচেষ্টার চেয়ে তাকে হত্যা করা অনেক বেশী মানবিক। সুতরাং এমন কিছু
ক্ষমা আছে যা অমানবিক, আবার একন কিছু শাস্তি আছে যা মানবিক।" ইসলাম একটি
অমানবিক ধর্ম হত যদি এর মধ্যে স্থিতিস্থাপকতার গুণ না থাকত।
"তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃতজীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীবজন্তু যা আল্লাহ ব্যাতিত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালংঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নি:সন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু"।
বিপদগ্রস্তের জন্য হারাম হালালের প্রশ্নটি আল্লাহ বিবেচনায় রাখবেন না। তা কি হতে পারে ? এটাই তো সবচেয়ে মানবিক আচরণ। কোরআনের মানবতাবাদ ব্যাখ্যা করতে গেলে-মানুষের প্রতি আল্লাহ কি ব্যাবহার করার অঙ্গিকার করেছেন এবং মানুষের প্রতি মানুষকে কি ব্যাবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন এদুটো বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন। উদ্ধৃত আয়াতগুলোতে আমরা দেখছি, আল্লাহ মানুষকে ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন, প্রাপকের দ্রব্য প্রাপকের কাছে পৌছে দেয়ার তাগিদ করেছেন, একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতে নিষেধ করেছেন, হত্যা, যুলুম ও রাহাজানি সৃষ্টি করতে বারণ করেছেন। সেই সাথে আল্লাহ নিজেই স্বীকার করেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে বসে, অনন্ততর তওবা করে এবং সৎ হয়ে যায়, তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু। সমাজে অনাচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকরার হুকুম আল্লাহ দিয়েছেন। তবে সীমালংঘন না করার ব্যপারেও সতর্ক করেছেন।
"আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। "
মানবজীবনের সমস্ত কাজের উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাহলে সীমালংঘন করার প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, আপন খায়েশের কাছ বন্দী হয়ে যায় তখন সৎ বিবেচনা, ন্যায় আচরন এবং যুক্তি ভুলে যায়। আত্মাকে এই সব অসুখ থেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা দেয় না, সেটাই অমানবিক। পাশ্চাত্যের শিক্ষানীতির মধ্যে আধুনিক কালে মৌলিকভাবে মানবতার প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। সামরিক শক্তির দাপটে তারা একটি দুর্বর নিরীহ দেশকে দখল করে নেবে, আর সেই পদলিত দেশের পরাধীন জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রের মখোমুখি রেখে প্রতিদিন রেসন সাহায্য বরাদ্ধ করবে এটাই ওদের মহান মানবতা। বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েদ, অভাবী জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সাহায্যদানের নাম পাশ্চাত্য-উদ্ভাবিত মানবতা। বিশ্বে আজ চরম অমানবিকতা চলছে। ব্যাক্তি বা সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তার নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি ও ধর্মের মৌলিক শিক্ষানীতির উপর দাড়িয়ে যদি কথা বলতে না পারে, তাহলে বেচে থাকার সার্থকতা কোথায় ? মানুষের মধ্যে যে গুনাবলী বিদ্যমান সেটাই তাকে স্বাধীনভাবে কর্তব্য সম্পাদনের প্রেরণা যোগায়। মানবতার মূল অর্থ হল মানুষের মূল্য উপলব্ধি করা। ধর্ম ও অন্তর্চৈতন্যেই মানুষের সর্বোচ্চ মূল্যমানতা উপলব্ধিতে সাহায্য করে। এবং এ কথা বলা মোটেও অসঙ্গত নয়, যিনি মানুষকে সৃষ্টিজীব হিসেবে স্বীকার করেন না, তিনি মানবতার সত্যিকার ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করেন না। সৃষ্টিকর্তা যখন বলেন, তিনি মানুষকে কষ্ট দিতে চান না, সরল সত্য পথের দিকে তিনি আহ্বান জানান তখন তিনি সত্যকে গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টা মানুষের বিবেকের উপর ছেড়ে দেন এবং সেটাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষকে প্রদেয় গুণাবলীর স্বীকৃতি। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মানুষকে ভাল মন্দ নির্বাচনের ক্ষমতা প্রদানের অর্থ মানুষের সর্বোচ্চ মূল্যটিকেই সংযুক্ত করা তার সাথে।
"আমি কি তাকে দেইনি চক্ষুদ্বয়, জিহ্বা, ও ওষ্ঠদয় ? বস্তুত আমি তাকে দুটি পথই প্রদর্শন করেছি। অত:পর সে ধর্মের ঘাটিতে প্রবেশ করে নি। আপনি জানেন সে ঘাটি কি? তা হচ্ছে দাস মুক্তি আথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্ন দান ইয়াতীম আত্মীয়কে আথবা ধূলি ধূসরিত মিসকিনকে। অত:পর তাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে ও পরস্পরকে ধৈর্য ও দয়ার উপদেশ দেয়। তারাই সৌভাগ্যশীল। "- সূরা বালাদ:১৮।
স্রষ্ট হিসেবে সীমাহীন ক্ষমতার অধিশ্বর-আল্লাহ মানুষকে প্রতিবার কোরআনে ধমকের সুরে শাসিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা বলেন নি। বরং মানুষের বোধগম্য যুক্তির আলোকে আল্লাহ তার প্রতি মানুষের আনুগত্যকে আহ্বান করেছেন।
"তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থোকে। অতএব তোমরা তোমাদের পালনকর্তর কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?"
"তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহই ভূ-ভাগকে তার মৃত্যুর পর পুনুরুজ্জীবিত করেন। আমি পরিস্খারভাবে তোমাদের জন্য আয়াতগুলো ব্যক্ত করেছি, যাতে তোমরা বুঝ। "
আল্লাহর অনুগ্রহভূজী মানুষ কিভাবে অকৃতজ্ঞ হয় ? তারা যাতে অকৃতজ্ঞ না হয়, বুঝে, মহাঙন আল্লাহর ইবাদত করা উচিত; সে জন্যই-নাযিল হয়েছে আল-কোরআন, এবং সেটা সকল মানুষের জন্য। ফলে এর মধ্যে সাম্য, ভালবাসা, উদারতা ও মহত্ব প্রদর্শনের কথা তো অবশ্যই থাকবে। মানুষকে আল্লাহ নম্রমধুর ভাষায় ভয় ও শাস্তির ইঙ্গিত দিয়ে সত্য পথে চলার আহ্বান জানান, এর চেয়ে মানবিক আচরণ আমরা কোথায় আশা করতে পারি ?
পশ্চিমা জগতে সাম্য ও মানবতার জন্য যে চিৎকারগুলো দিচ্ছে, তা এ কারনে অন্তসারশুন্য যে তারা বিশ্বের জাতিগুলোকে এই সব মার্কামারা কথা বলে, নানাভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে চায়। আমরা পাশ্চাত্যভঙ্গির মানবতাকে ঘৃনা করি। কারন তা তাদের নিজস্ব স্বার্থের সাথে জড়িত। মানুষের চিরন্তন আকাঙ্খার সঙ্গে জড়িত নয়। সৃষ্টিগত ভাবে সকল মানুষ সমান; শিক্ষাগত জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের হকদার প্রতিটি মানুষ। তাহলে একটি দেশকে পদানত করে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে কি ধরনের মানবতা শিক্ষা দেয়া যায় ? পাশ্চাত্য এর চেয়ে বেশি কিছু কি আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছে ?
আমাদের এ দেশীয় শিক্ষিত সমাজের অনেকেই ধরে নিয়েছেন, আধুনিক শিক্ষা দর্শনে ইউরোপ যেমন পথিকৃৎ- এর ভূমিকা পালন করছে, মনবতাবাদী দর্শনেরও সেই বুঝি স্বপ্নদ্রষ্টা। কিন্তু আসলেই কি তাই ? আধুনিক কালের ব্যাপ্তি যদি হয় আড়াইশত বছর, তাহলে পৃথিবীব্যাপ্তি ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী চেহারার মধ্যে কোথায় কতটুকু মানবতাবাদ আছে ? এশিয়া ও আফ্রিকার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠিকে পদানত রেখে, শত শত বছর ধরে শোসন করেছে। তার ফলে আজ এক অপ্রতিদ্বন্দী ইউরোপের উত্থান। জাতিসংঘ কি নির্যাতিত মানুষকে রক্ষা করার কোন প্রতিষ্ঠান ? আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীতে সাম্য-ন্যয় ও মানবতার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদের এবং সেই দায়িত্ব পালনে আমরা জাতিগতাভাবে অক্ষম ও অসমর্থ বিধায়, অন্যের আরোপিত মানবতাবাদের সংজ্ঞায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি। 'তিনশ' বছর ধরে ইউরোমার্কিন সভ্যতার ধারকেরা যে দাস ব্যাবসা চালিয়ে এসেছে তা কি ইতিহাস থেকে মুছে যাবে কখনো ? ঐ সময় তের থেকে পনের মিলিয়ন আফ্রিকীয় আদমজাত ধরা হয়েছিল নিতান্ত পশুর মত গুলি মেরে। এটা ছিল সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের মানবতাবাদ।
আর উনিশ ও বিশশতকের মানবতাবাদ যদি আমরা চাক্ষুস করি, ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রেক্ষিতে তাহলে এ কথা বলা অসঙ্গত যে, আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ যা পশ্চিমা ও অনুন্নত অল্প সভ্য মানুষের মধ্যেকার সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত; সেখানে সভ্যতার ধারকেরা কি ছল-চাতুরি, ভন্ডামি ও অর্থনৈতিক দাসত্ব আরোপ করে নি ? তারা কি দুর্বলদের বস্তুগত, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যোবোধ ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত না ?কোরআনে আল্লাহ একদা মহানবীকে এভাবে বলেন, 'কাফেরদের মধ্য থেকে কেউ যদি আপনার কাছে আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দেবেন, তাড়াবেন না; সে আপনার মাধ্যমে সম্ভবত আপনার আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা করতে পারবে।' - এই হচ্ছে আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গি। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে শত্রুর প্রতি শত্রুতা পোষণ স্বভাবিক। কিন্তু শত্রু যখন আশ্রয়প্রার্থী হয়, তাকে আশ্রয়দান এবং শিক্ষাদান আল্লাহর নির্দেশ মত অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহর এই মহান শিক্ষা থেকে বর্তমান সময়ের মুসলমান এবং খৃষ্টান সহ গোটা মানব জাতিই অনেক দূরে সরে গেছে।
ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য কিংবা ধর্মবিদ্যা মানুষের জন্য যতকিছু এনে থাকুক, মানুষকে সমাজে শান্তিতে বসবাসের জন্য প্রয়োজন সাম্যবোধ যা মহৎ মানুষের জীবনাশ্রিত চরিত্র ব্যতীত পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারনে ইতিহাসের রচয়িতা মূখ্য নয়, বিজ্ঞানে বিজ্ঞানীর ব্যক্তি জীবন জরুরী নয়, কিন্তু সাহিত্যে এবং ধর্মে সাহিত্যিক ও ধর্ম প্রবর্তকের ব্যক্তি জীবন অবশই মূখ্য। ধর্মের শিক্ষা কিতাবের চেয়ে ধর্মপুরুষের জীবনযাপনে, জীবন চরিতে। শিল্পির যেমন শিল্প, ধার্মিকের জীবন তেমনি ধর্ম। শিল্পির কল্পনায় থাকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য মন্থন; ধার্মিকের উদ্দেশ্য পার্থিব জীবনে স্রষ্টার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং পারিত্রিক জীবনের কল্যাণ উপার্জন। শিল্পির মানবতা হল নির্মোহ সত্তা নিয়ে সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা; ধার্মিকের মানবতা হল মনুষ্যত্বকে সকল অপমান থেকে রক্ষা করা। এ কারনে যুদ্ধকে আইন সঙ্গত করেছে। ফিৎনা ফাসাদ নরহত্যার মত মহাপাপ বলে ঘোষনা করেছে। "ফিৎনা সমাজে নরহত্যার চেয়ে মহাপাপ।"(আল-কোরআন)। এ ঘোষনার মধ্য দিয়ে সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করা হয়েছে। দেশে দেশে বিশ্বমানবতার পক্ষে মানুষের মিছিল শোনা যায়। কিন্তু চরিত্রহীন সাম্রাজ্যবাদীরা কি তাতে এতটুকু কর্ণপাত করে ? সঠিক ধর্মের শিক্ষাগ্রহণ করলে মানুষকে যে শোষণ করা যাবে না, সে জন্য তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। অথচ তাদের লেবাসে যে প্লে-কার্ড লাগান তাতে লেখা, মানবতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। এ মানুষকে খুনি আসামী বানাতেই হবে। বিজ্ঞান মানুষের বস্তুগত জীবনের সুখ-সুবিধার পরিধিকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে, কিন্তু সভ্যতাকে বাচিয়ে রাখার জন্য মানুষকে আত্মগত উৎকর্ষতার দিকে অগ্রসর করছে না। এটা করার দায়িত্ব অবশ্য বিজ্ঞানের নয়, ধর্মের। ধর্মও আবার একদল যাজক, পুরোহিত, মোল্লামুন্সির হাতে পড়েছে, যারা মনুষ্যত্যের সার্বিক মূল্যবোধ রক্ষার চেয়ে, কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করতেই ভালবাসে। মানবতাবাদের অধগতির জন্য এ শ্রেনীও কম দায়ী নয়।
তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠিকে পাশ্চাত্যের খয়রাতি সাহায্যে বেচে থাকতে হয়; ফলে দাতাদের গলাভরা বুলির নিষ্ঠাবান তোষামদকারী যদি হওয়া না যায়, অনাহার ও দুভিক্ষের জ্বালায় মরতে হবে। এই ধারণাই প্রাচ্য জনমকে ইসলামের শাশ্বত বাণীর নিহিতার্থ উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা; আর সে কারনে কোরআনের মানবতাবাদ এখানে এ সমাজে অনুপস্থিত। সত্যবিচারের মানদন্ড কি ? আমি যেভাবে বাচতে চাই, আর একজনকে আমার মতই বাচতে দিতে হবে। এই অঙ্গীকার যেমন গনতান্ত্রিক, তেমনি তা ঐশ্বরিক বিধানেরও ভাষ্য। অবশ্য একটি সমাজ কতটা সভ্য, সেটা বোঝা যায়, সেই সমাজবদ্ধ মানুষগুলো একে অপরের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করছে তার উপর। আমরা যে এখনও একটি অসভ্যসমাজে বাস করছি সেটা রাষ্ট্রপালিত সন্ত্রাসীগ্রুপ-পুলিশ বাহিনীর ব্যবহার দেখে বোঝা যায়। আমাদের দেশে মনবতাবাদের চরম লঙ্ঘন ঘটছে, যা প্রায় প্রতিদিন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে উল্লেখিত হচ্ছে। এখানে মানুষ অর্থ ও পেশা ক্ষমতা ও সম্পদের দ্বারা মূল্যায়িত। ফলে মানবতাবাদের ধারনা কেবল কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেতারা যখন সম্পদ লুন্ঠন করে, আমলারা কি সেটা তাকিয়ে তাকেয়ে দেখে ? আমলারা যখন অফিসে অফিসে ফাইল ঠেকিয়ে অন্যায়ভাবে ঘুষ আদায় করে তখন ছোট কেরানীগোছের অফিসাররা কি বসে থাকে ? একজন কেরানীর যদি পাচটা বাড়ি থাকে তাহলে বুঝাই যাচ্ছে অবৈধ অর্থ রোজগার কিভাবে চলছে। এসব কিছুতো স্থায়ীভাবে চাকুরীরত অবস্থার মধ্যে থেকে চলছে । বেকার যুব সমাজ কি করছে ? সন্ত্রাস কবলিত গোটা বাংলাদেশ এখন একটি বেহিসেবি খুন-খারাবীর সন্ত্রস্ত জনপদ। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দারিদ্র ও অশিক্ষা-সমাজে মানবতাবাদের অর্থকে বিবর্ণ করে দিয়েছে। আমরা কিভাবে মানুষের নায্য অধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টা করব ? আমরা নিজেরাই অসহায়। 'বচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে' বলে যে কথাটি শোনা যায়, সেটা বাংলাদেশে পুরোপুরি বিদ্যমান।
মানবতাবাদের সংজ্ঞা যাই হোক, ন্যায় বিচারের মানদন্ড প্রতিষ্ঠা ব্যাতিত মানবতাবাদরে প্রসার ঘটেনা। "ন্যায় বিচার তাকওয়ার কাছাকাছি" কোরআন যখন একথা বলে তখন আলেম সমাজের ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা কর্তব্য। কিন্তু এ দেশের আলেম সমাজ প্রথাবাদী চিন্তার কুঠুরির মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। মদ, গাঁজা, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এদের কোন জিহাদ নেই। ইতিহাসের কোন শিক্ষাই এদের কাজে লাগছে না। অথচ তারা প্রতিদিন সুরেলা কন্ঠে কোরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা শুনিয়ে যাচ্ছেন স্রোতাদের।
হযরত শোয়ায়েব (আ
এর জবানীতে আল্লাহ বলেন, "হে আমরা জাতি, ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে ঠিকভাবে
পরিমাপ কর ও ওজন দাও এবং লোকদের জিনিসপত্রে কম দিওনা আর পৃথিবীতে বিপর্যয়
সৃষ্টি করো না। (সূরা হুদ:৮৫)
পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ রাখা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে মানুষ কিন্তু একটি সমাজের বাসিন্দা। আর সেটা হল বিশ্ব সমাজ। মানব সভ্যতা। সেটাকে একক ভাবে ধ্বংস করার অধিকার কারো নেই। কিন্তু দেখা গেছে, যুগে যুগে এক একটা পাপাচারী সম্প্রদায় সভ্যতা ধংসের উন্মাদনায় মেতেছে। সাধারণ শান্তি প্রিয় মানুষের আকুতি উপেক্ষা করে যুদ্ধবাজ দস্যুরা ধংস করছে নগর, লুন্ঠন করছে ধন-সম্পদ, হত্যা করছে নিরীহ নারী পুরুষ ও শিশুদের, জ্বালিয়ে দিয়েছে শস্য ক্ষেত, পুড়িয়েছে সভ্যতার চিহৃবহনকারী লইব্রেরীসমূহ। এবং পৃথিবীকে পরিনত করেছে শশ্মানে, বধ্যভূমিতে। মানবতাবাদ -এর লাঞ্ছনা এত ব্যাপক যা কয়েক পৃষ্ঠায় শেষ হবার নয়। Battle of Dictionary তে, ১৯৬০ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যন্ত গত দুহাজার বছরে ১৪৪৩ টিরও বেশী যুদ্ধের উল্লখ পাওয়া যায়। এত যুদ্ধ কেন হল ? অন্যসব গুণাবলীর চেয়ে মানুষের মধ্যে যুদ্ধ করার প্রবণতাইকি বেশী ? সংগ্রাম করে পৃথিবীতে বাচতে হয়, এ কথা সত্য, কিন্তু মানুষ কি শুধু যুদ্ধ করেই বাচবে ? মানবতাবাদ ও যুদ্ধ দুটি বিপরীত বিষয়। আবার দেখা যাচ্ছে, মানবতাবাদ রক্ষার জন্য যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে উঠে। মানুষকে রক্ষা করার জন্য যদি যুদ্ধের প্রয়োজন হয়-সেটা তো প্রশংসার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধনিতা যুদ্ধ মানুষ ও মানবতা অর্থাৎ মানুষের বাক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ছিল এক অপরিহার্য যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধে পাক সেনাদের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা বিশ্বে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমরা মানবতা লঙ্ঘনের সেই নির্মম ইতিহাস ভুলিনি।
কোরআনে মানবতাবাদ প্রসঙ্গ লিখতে বসলে এত সুন্দর কিছু লেখা যায় যা মনে করিয়ে দেয় স্বর্গীয় জীবনের কথা। অথচ কোরআন অনুসারী মুসলমানদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নানান অজুহাতে এরা সর্বাধিক তরবারির ভাষায় কথা বলেছে। আশির দশকে আট বছর ব্যাপি ইরান-ইরাক যুদ্ধে মানবতা লঙ্ঘনের নতুন রেকর্ড হয়েছে। নিরীহ ইরানীদের উপর সাদ্দাম হোসেন রাসায়নিক ও জীবানু অস্ত্র ব্যাবহার করেন। কোরআনের কোন শিক্ষাই তাদের জন্য কাজে লাগে নি। অথচ এরা বিশ্বে সচ্চা মুসলমান।
মানবতাবাদের শত্রু হিসেবে পাশ্চাত্যকে গালাগাল দেয়ার আগে মুসলিম শাসকবর্গকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো উচিত। কোটি কোটি প্রজাসাধারণের ভাগ্যের সঙ্গে প্রতারণা করে তুর্কী সুলতানরা করেছে অত্যচার, মুঘলরা করেছে বিলাসিতা, পরিণামে আজ গোটা মসিলিম বিশ্ব পাশ্চাত্যের কাছে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। পাশ্চাত্যের শাসক গোষ্ঠির সঙ্গে প্রাচ্যের শাসক গোষ্ঠির পার্থক্য হল, পাশ্চাত্যের শাসকগোষ্ঠি জনগনের মৌলিক চাহিদা পুরন সহ সবরকম বিনোদনের ব্যাবস্থা করতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যথানিয়মে প্রয়োগ করেছে। আর প্রাচ্যের মুসলিম শাসকবর্গ নিজেদের অভিমত চাপিয়ে দিয়ে, জনগণের মৌলিক চাহিদা উপেক্ষা করে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ফলে দেশের জনগন তাদের শাসকবর্গকে উৎখাত করে বিদেশি শাসকদের আমন্ত্রন জানাতে উৎসাহবোধ করছে। ঠিক এভাবে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে ধস্ নেমেছে। যা আরো একশ বছরে পূনর্গঠনের কোন সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল, মুসলমানদের মধ্যে সিশিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব এত বেশি যে দারিদ্র আর নিরক্ষরতার অভিশাপের মধ্যে এরা হামাগুড়ি দিচ্ছে। মানবতার উপলব্ধি করবে কিভাবে ? মুসলিম শাসকদের কল্যাণ বোধের অভাবকে পুঁজি করে পশ্চিমা বিশ্ব দেশের অভ্যন্তর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এটা এখন গোপন কিছু নয়। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মুসলমানদের শিক্ষা। কোরআনে মানবতাবাদের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা এক শাশ্বত বিধান-সেটাকে লঙ্ঘন করে মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির মধ্যে টেনে এনেছে। বইয়ের পাতায় এর চমৎকার আলোচনা পাওয়া যায়, কিন্তু মুসলমানদের সামগ্রিক আচরনে এগুলোর কোন প্রমাণ পাওয়া দুষ্কর। কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা আছে, অথচ মালিক এর যাকাত দেয় না; মুসলিম সরকারগুলো পর্যটন এর নামে অনেক অর্থ ব্যায় করে, কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সরান্জাম নেই, নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ডাক্তার। মূলকথা ইয়াতীম ও মিসকিনদের প্রতি, রোগী ও নিম্নবিত্ত্বের জনতার প্রতি মুসলিম শাসকদের উদাসীনতা বার বার এক অপরিবর্তনীয় দু:শাসনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মানবতাবাদ হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের স্বত:স্ফুর্ত কল্যাণ চেতনা। কিন্তু মুসলিম সমাজে সাধারণ ধারণাই হচ্ছে অন্যের অমঙ্গল তো নিজের মঙ্গল । অবশ্য এটা এসেছে দলীয় প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতির প্রভাবে। একটি দল অন্য দলের সভা মিছিল ও মিটিংয়ে হামলা চালানের বিষয়টাকে দলীয় সংবিধানে এক নম্বরে রেখেছে। এ কারনে মুসলিম দেশগুলোর সমাজ ব্যাবস্থায় হিংসা হানাহানি-নিরর্থক দলাদলি এবং অহেতুক রক্তারক্তি ক্রমবর্ধমান হারে অব্যাহত। ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের প্রতি সদ্ব্যাবহারের নির্দেশ নেই এমন কোন ধর্ম বিশ্বে নেই । সেক্ষেত্রে ইসলাম, একজন মহান নবীর প্রবর্তিত ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে এত আত্মকলহে লিপ্ত কেন ? মানবতাবাদ শুধু দুবেলা ইয়াতীম ও মিসকীন খাওয়ানের মধ্যে ? না আল্লাহর রজ্জু বা কোরআেনকে সর্বাংশে আকড়েঁ ধরার মধ্যে ? আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি, আল্লাহ তার মহানবীর মধ্যে মানুষের জন্য সবোত্তম চরিত্র গুণের অভিব্যক্তি রেখেছেন। আমরা মহানবীকে অনুসরন করলেই সমল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারি।
মনে রাখতে হবে, মানবতাবাদ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমি যাকে স্রষ্টা বলে বিশ্বাস করি, তিনিই তো আমার প্রতিবেশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন ও পার্সি সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে এ নির্দিষ্ট সময়টুকুতে বাস করার জন্য, সামাজিক, বানিজ্যিক, প্রশাসনিক তথা ধর্মীয় বিষয়ে তাদের সঙ্গ যোগাযোগ না রক্ষা না করে কি পারব ? কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, খৃষ্টানদের মধ্যে যারা বুযুর্গ তারাই মুসলমানদের অতি নিকটে, আত্মীয়ের মত। একটি মধ্যপন্থা জাতি হিসেবে মুসলমানদের জন্য কর্তব্যের পাল্লা অনেক ভারী। দায়িত্বও অনেক বেশী। যুগের প্রয়োজনে মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ বহু নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর সে কারনে বিশ্ব সমাজে সৃষ্টি হয়েছে ধর্মের ভেদাভদ। আর ধর্ম ও বহু জাতরি উৎসমূল এক এ দাবী করে একটি অপরটির উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করছে। ইহুদীরা মানছে না খৃষ্টানদের, খৃষ্টানরা পাত্তা দিতে চায় না মুসলমানদের, মুসলমানরা সর্বশেষ ধর্ম সম্প্রদায় হিসেবে নবীন এবং আল্লাহর পছন্দের অনুসারী। আবার হিন্দুরা ভারতবর্ষের প্রচীন পৌত্তলিক হিসেবে নিজেদের মধ্যে ভগবানকে আবিষ্কার করেছেন নানান মূর্তিতে। এসব মিলিয়েইতো বিশ্বে ছড়িয়ে আছে ধর্মের কোন্দল। যাকে বলে সাম্প্রদায়িক বেদবুদ্ধি। আর পরস্পরকে হিংসা করার অজুহাত তারা পেয়ে যায় ভেদজ্ঞানের প্রেরণা নিয়ে। কিন্তু আল্লাহ মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক দলাদলি থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। " তোমরা তাদেরকে (দেব-দেবী) মন্দ বল না, যারা তাদের আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে মন্দ বলবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজকর্ম সুশোভিত করে দিয়েছি। অত:পর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদেরকে প্রত্যাবর্তন কতের হবে। তখন তিনি তাদেরকে বলে দিবেন যা কিছু তারা করত। (সূরা আল-আনআম:১০৮)
পিতা যেমন পুত্রকে অন্যের প্রতি অন্যায় করতে নিষেধ করেন, আল্লাহ তিমনি মুসলমানদেরকে পৌত্তলিকদের গালাগাল করতে নিষেধ করেছেন। যে সব বিষয়ে আল্লাহ ফয়সালার জন্য একটি সময়কে নির্ধারন করে রেখেছেন পরোকালে, সে বিষয়ে আমরা যেন দলাদলি না করি। এইতো মানবতাবাদের চুড়ান্ত রূপ। ইচ্ছার স্বাধীন প্রকাশ কি মানবতাবাদের স্বীকৃতি নয় ? সামাজিক শান্তি বজায় রাখার জন্য মানবতা রক্ষার কোন বিকল্প নেই।
কোরআনের সমস্ত বক্তব্য একত্রিত করলে, মানুষের পার্থিব জীবনকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার যে বিধানগুলো বেরিয়ে আসে তার চেয়ে সুন্দর বিধান কি মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে ? মানুষ তার স্রষ্ট হিসেবে একজনকে স্কীকার করবে এটা তার মানবিক দায়িত্ব। আর সব কিছুর উর্দ্ধে স্রষ্ট মানুষকে ভরণপোষন দিয়ে যাবেন, এটাও তার দায়িত্ব। আমরা দেখছি কোরআনের মতে, আল্লাহ মানবজাতিকে নিরন্তর প্রতিপালন করে যাচ্ছেন, কিন্তু মানুষ তার স্রষ্টার প্রতি না করছে আনুগত্য, না করছে প্রতিবেশির উপর সুবিচার।
ইসলাম মানবতার ধর্ম একথা বলার মধ্যে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি। বরং ইসলাম মানুষের ধর্ম। তবে সেটাকি সকল মানুষের ধর্ম ? নিশ্চয়ই নয়। অবিশ্বাসী যালেমরা মানবতাবাদ কিংবা জীবনবাদকে বিশ্বাস করে না। অতএব অবিশ্বাসী যালেমদের জন্য ইসলাম নয়। কোরআন এমন তুচ্ছ কিতাব নয়, যা জালেমরা অবজ্ঞাভরে পাঠ করতে পারে। যারা বিশ্বাস করে নিচ্ছে যে কোরআন এক সর্বশক্তিমান আল্লাহর তরফ থেকে আগত, মহান এক রাসূলের দ্বারা প্রচারিত এবং এর মধ্যে কোন ভুল বা সন্দেহ নেই যে সব কিছু একদা ধংস হয়ে যাবে, কেবল মহান আল্লাহর সত্তাই থাকবে তাদের জন্য মানবতারক্ষার প্রশ্ন উঠে এবং তারা মানবিক যুক্তি বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতে পারে।
কোরআন যখন কঠোরভাবে মানুষের ক্ষতি না করার নির্দেশ দেয় এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য পোষণের তাগিদ দেয় তখন কোরআনকে আমরা কেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম গ্রন্থ বলব না ? সমাজে ন্যায় ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে মানবিক পদক্ষেপ। এ কারনে কোরআন বারবার জোর দিচ্ছে, তোমরা মানুষের মধ্যে ন্যায় ভিত্তিক মিমাংসা করে দাও। মানুষের মধ্যে দানশীলতা, ক্ষমা ও সহনশীলতার মত মহৎ গুণাবলি চর্চা করার নির্দেশ কোরআন প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। এ কারনে অতীব গুরুত্বের সঙ্গে আল্লাহ বলেন- " এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে। "
কোরআনের মানবতাবাদ নিয়ে যুগে যুগে বহু গবেষক অনেক মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। আজ সারা বিশ্বে মানবতার চরম অবক্ষয় চলছে। কোরআন এর অনুসারী মুসলিম জাতি আজ সর্বত্র নির্যতিত। বিশ্বের মানুষ যাদের কাছ থেকে জ্ঞানের আলো পেয়েছে, তারা আজ অজ্ঞ ও অন্ধ। তাদের মহান ধর্মগ্রন্থ তাদের মধ্যে এখন নতুন কোন জাগরন সৃষ্টিতে অক্ষম। আসলে কি তাই ? আমরা সেটা বিশ্বাস করি না। কারন আল্লাহ তার কৃত ওয়াদা মোতাবেক কোরআনকে অবিকৃত রেখেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত থাকবে।
মানবতাবাদ সম্পর্কে পাশ্চাত্য লেখকদের কোন সংজ্ঞা ব্যবহার না করেই, আমরা সরাসরি পবিত্র কোরআনের কিছু অংশের পাঠ শ্রবণ করব। কারণ ওসব দেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিকোন থেকে মানবতার সংজ্ঞা নির্ধারন করেন। পাশ্চাত্যর নিজস্ব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রাচ্যের উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়া হয় এবং পশ্চাৎপদ দেশের অনাহার ক্লিষ্ট, রোগজর্জরিত মানুষগুলোকে সব সময় পেরেশান করে রাখে। মানবতা লংঘনের ধুয়া তুলে আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা, যা নিতান্তই অমানবিক। সে বিষয়ে আমরা পরে যাব। এবার আমরা কোরআনের কিছু অংশ পাঠ করব।
১. হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রতার কারনে কখনো ন্যায় বিচার পরিত্যগ করো না। সুবিচার কর। এটাই খোদাভিতীর অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত।
২. নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদরে নির্দেশ দেন যে তোমরা যেন প্রাপ্য আমানত সমূহ প্রাপকদের নিকট পৌছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মিমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপদেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী।
৩. আর যখন তারা আপনার কাছে আসবে যারা আমার নিদর্শন বিশ্বাস করে, তখন আপনি বলে দিন; তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের পালনকর্তা রহমত করা নিজ দায়িত্বে লিখে নিয়েছেন যে, তোমাদের মধ্যে যে কেউ অজ্ঞতাবশত কোন মন্দ কাজ করে, অনন্তর এর পরে তওবা করে নেয় এবং সৎ হয়ে যায়, তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুনাময়।
৪. হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কর না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্পত্তি ক্রয়ে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্য করো না। নি:সন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।
৫. এতীমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালামালের সাথে ভালো মালামালের আদল-বদল করো না। নিশ্চয়ই এটা বড় মন্দ কাজ। আর যদি তোমরা ভয় কর যে এতীম মেয়েদের হক যথাযথভাবে পূরণ করতে পারবে না, তবে সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশংকা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাঝতে পারবে না, তবে একটিই বিয়ে কর। আথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে, এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।
৬. সম্পত্তি বন্টনের সময় যখন আত্মীয় স্বজন ইয়াতীম মীসকিন উপস্থিত হয়, তখন তা থেকে তাদরেকে কিছু খাইয়ে দাও। এবং তাদের সাথে কিছু সদালাপ কর।
৭. যারা এতীমদের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করছে। অতিসত্বর তারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
৮. নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানত সমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার মিমাংসা করতে আরম্ভ কর, তখন ন্যায় বিচার কর।
৯. কিন্তু পুরুষ, নারী ও শিশুদের মধ্যে যারা অসহায়, তারা কোন উপায় করতে পারে না এবং পথও জানে না। অতএব আশা করা যায়, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মার্জনাকারী, ক্ষমাশীল।
উদ্বৃত আয়াতগুলো পাঠ করার পর এটা কি মনে হয়, আল্লাহ অন্যায়ভাবে মানুষের স্বাভাবিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায় কোরআনে ব্যাক্ত করেছেন ? কেবল ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের দৃষ্টিকোন থেকে নয়, মানবকুলের স্রষ্টা মহান আল্লাহর দৃষ্টিকোন থেকে মানবতার সংজ্ঞা নিধারিত হয়ে আাছে আলোচ্য আয়াতগুলোতে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে বাস করে, কিন্তু মেধা, বুদ্ধি, অর্থ-সম্পদ, জনবল ও আত্মীয়-পরিজনের দিক থেকে সবাই সমান নয়। এ কারনে সমাজে মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন, আমি মানুষকে আত্মীয়তা ও রক্তের সম্পর্কশীল করে সৃষ্টি করেছি। মানুষ যাতে একতাবদ্ধ থাকার জন্য প্রেরণা বোধ করে সে কারনে এই আত্মীতার সম্পর্ক। এছাড়া মানব জাতি তো একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে থেকে বিকশিত হয়েছে । কিন্তু কালক্রমে মানুষ বিভিন্ন জাতি, গোত্র, বংশ ও সমাজে বিভক্ত হয়ে গেছে। বৈচিত্রের মধ্যে নতুন ঐক্যের সাধনা, সে কারনে ধর্মের শিক্ষা অনিবার্য। কোরআন নির্ধরিত মনবতার সংজ্ঞা আলোচনার আগে আমরা দেখব, কোরআন তার বানীকে কাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছে।
"হে মানব জাতি! তোমাদের পালনকর্তার যথার্থবানী নিয়ে তোমাদের নিকট বাসূল এসেছেন, তোমরা তা মেনে নাও, যাতে তোমাদের কল্যাণ হতে পারে।"
"হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে।"
মানুষের মধ্যে একটি দল একনিষ্ঠভাবে কোরআনিক বিধি-বিধান পালন করে। এবং সেটা অনাগত ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু কোরআন সমগ্র মানবজাতির উদ্দেশ্যে প্রেরিত একটি বিধান, মানুষের সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে; ফলে সেখানে মানবতাবাদের ব্যাপ্তি-বিস্তৃতি ও সংজ্ঞা বিশ্বের অন্য কোন পন্ডিত বা বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞার সাথে তুল্য হতে পারে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি মনের সংকীর্ণতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু কোরআন যে ধর্মের উপর ভিত্তি করে মানবতাবাদের কথা বলছে, সেটা কি সংকীর্ণতার দোষে আক্রান্ত ? মানুষের দৃষ্টিকোন থেকে মানুষের মূল্য বিচার এবং স্রষ্টার দৃষ্টিতে মানুষের মূল্য বিচার কখনো সমান হবে না। স্রষ্টা হিসেবে মহান আল্লাহ কোরআনে বলেন, বিশ্বাসীদের কোরআনের সবরকম বক্তব্যের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্বাস স্থাপনের পরেই কেবল মানবজীবনের অন্যসব অনুসঙ্গকে বিবেচনা করতে পারেন। যতক্ষন মানুষ নি:সংশয়ে কোরআন বিশ্বাস না করছে, ততক্ষণ মানবতাবাদ কিংবা মানবতার কোন প্রশ্ন নেই। এটা আল্লাহর সিদ্ধান্ত। হয়তো তাদেরকে পার্থিব জীবনে পাকড়াও করা হচ্ছে না। তবে একথা কি ভেবে দেখার বিষয় নয়, কোটি কোটি মানুষের মধ্যে কতজন আল্লাহ, পরকাল, সকল নবী, রাসূল, বেহেশ্ত, দোযখ বিশ্বাস করে ? অথচ আল্লাহ কিন্তু এই সূর্য নক্ষত্র আলো-অন্ধকার, আকাশ-বাতাস, নদী-পর্বত-সাগর ও বনভূমি দ্বারা কি বিশ্বাসী কি অবিশ্বাসী সকলকে, নির্বিশেষে সাহায্য করছেন না ? এর চেয়ে বড় মানবতা আর কি ? মানুষ তার বিরোধী প্রতিবেশীকে এভাবে প্রতিপালন করতে পারে ? এতটা উদার কি মানুষ হয়েছে ? হযরত আলী (রা

"তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃতজীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীবজন্তু যা আল্লাহ ব্যাতিত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালংঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নি:সন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু"।
বিপদগ্রস্তের জন্য হারাম হালালের প্রশ্নটি আল্লাহ বিবেচনায় রাখবেন না। তা কি হতে পারে ? এটাই তো সবচেয়ে মানবিক আচরণ। কোরআনের মানবতাবাদ ব্যাখ্যা করতে গেলে-মানুষের প্রতি আল্লাহ কি ব্যাবহার করার অঙ্গিকার করেছেন এবং মানুষের প্রতি মানুষকে কি ব্যাবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন এদুটো বিষয় অনুধাবন করা প্রয়োজন। উদ্ধৃত আয়াতগুলোতে আমরা দেখছি, আল্লাহ মানুষকে ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন, প্রাপকের দ্রব্য প্রাপকের কাছে পৌছে দেয়ার তাগিদ করেছেন, একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতে নিষেধ করেছেন, হত্যা, যুলুম ও রাহাজানি সৃষ্টি করতে বারণ করেছেন। সেই সাথে আল্লাহ নিজেই স্বীকার করেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অজ্ঞতাবশত মন্দ কাজ করে বসে, অনন্ততর তওবা করে এবং সৎ হয়ে যায়, তবে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু। সমাজে অনাচার সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকরার হুকুম আল্লাহ দিয়েছেন। তবে সীমালংঘন না করার ব্যপারেও সতর্ক করেছেন।
"আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীকে পছন্দ করেন না। "
মানবজীবনের সমস্ত কাজের উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাহলে সীমালংঘন করার প্রশ্ন উঠে না। কিন্তু মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, আপন খায়েশের কাছ বন্দী হয়ে যায় তখন সৎ বিবেচনা, ন্যায় আচরন এবং যুক্তি ভুলে যায়। আত্মাকে এই সব অসুখ থেকে মুক্ত রাখার উদ্দেশ্যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা দেয় না, সেটাই অমানবিক। পাশ্চাত্যের শিক্ষানীতির মধ্যে আধুনিক কালে মৌলিকভাবে মানবতার প্রসঙ্গ অনুপস্থিত। সামরিক শক্তির দাপটে তারা একটি দুর্বর নিরীহ দেশকে দখল করে নেবে, আর সেই পদলিত দেশের পরাধীন জনগোষ্ঠীকে দারিদ্রের মখোমুখি রেখে প্রতিদিন রেসন সাহায্য বরাদ্ধ করবে এটাই ওদের মহান মানবতা। বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েদ, অভাবী জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সাহায্যদানের নাম পাশ্চাত্য-উদ্ভাবিত মানবতা। বিশ্বে আজ চরম অমানবিকতা চলছে। ব্যাক্তি বা সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তার নিজস্ব বিবেক বুদ্ধি ও ধর্মের মৌলিক শিক্ষানীতির উপর দাড়িয়ে যদি কথা বলতে না পারে, তাহলে বেচে থাকার সার্থকতা কোথায় ? মানুষের মধ্যে যে গুনাবলী বিদ্যমান সেটাই তাকে স্বাধীনভাবে কর্তব্য সম্পাদনের প্রেরণা যোগায়। মানবতার মূল অর্থ হল মানুষের মূল্য উপলব্ধি করা। ধর্ম ও অন্তর্চৈতন্যেই মানুষের সর্বোচ্চ মূল্যমানতা উপলব্ধিতে সাহায্য করে। এবং এ কথা বলা মোটেও অসঙ্গত নয়, যিনি মানুষকে সৃষ্টিজীব হিসেবে স্বীকার করেন না, তিনি মানবতার সত্যিকার ব্যঞ্জনা উপলব্ধি করেন না। সৃষ্টিকর্তা যখন বলেন, তিনি মানুষকে কষ্ট দিতে চান না, সরল সত্য পথের দিকে তিনি আহ্বান জানান তখন তিনি সত্যকে গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টা মানুষের বিবেকের উপর ছেড়ে দেন এবং সেটাই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানুষকে প্রদেয় গুণাবলীর স্বীকৃতি। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক মানুষকে ভাল মন্দ নির্বাচনের ক্ষমতা প্রদানের অর্থ মানুষের সর্বোচ্চ মূল্যটিকেই সংযুক্ত করা তার সাথে।
"আমি কি তাকে দেইনি চক্ষুদ্বয়, জিহ্বা, ও ওষ্ঠদয় ? বস্তুত আমি তাকে দুটি পথই প্রদর্শন করেছি। অত:পর সে ধর্মের ঘাটিতে প্রবেশ করে নি। আপনি জানেন সে ঘাটি কি? তা হচ্ছে দাস মুক্তি আথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্ন দান ইয়াতীম আত্মীয়কে আথবা ধূলি ধূসরিত মিসকিনকে। অত:পর তাদের অন্তর্ভূক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে ও পরস্পরকে ধৈর্য ও দয়ার উপদেশ দেয়। তারাই সৌভাগ্যশীল। "- সূরা বালাদ:১৮।
স্রষ্ট হিসেবে সীমাহীন ক্ষমতার অধিশ্বর-আল্লাহ মানুষকে প্রতিবার কোরআনে ধমকের সুরে শাসিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা বলেন নি। বরং মানুষের বোধগম্য যুক্তির আলোকে আল্লাহ তার প্রতি মানুষের আনুগত্যকে আহ্বান করেছেন।
"তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন পোড়ামাটির ন্যায় শুষ্ক মৃত্তিকা থেকে এবং জিনকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থোকে। অতএব তোমরা তোমাদের পালনকর্তর কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?"
"তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহই ভূ-ভাগকে তার মৃত্যুর পর পুনুরুজ্জীবিত করেন। আমি পরিস্খারভাবে তোমাদের জন্য আয়াতগুলো ব্যক্ত করেছি, যাতে তোমরা বুঝ। "
আল্লাহর অনুগ্রহভূজী মানুষ কিভাবে অকৃতজ্ঞ হয় ? তারা যাতে অকৃতজ্ঞ না হয়, বুঝে, মহাঙন আল্লাহর ইবাদত করা উচিত; সে জন্যই-নাযিল হয়েছে আল-কোরআন, এবং সেটা সকল মানুষের জন্য। ফলে এর মধ্যে সাম্য, ভালবাসা, উদারতা ও মহত্ব প্রদর্শনের কথা তো অবশ্যই থাকবে। মানুষকে আল্লাহ নম্রমধুর ভাষায় ভয় ও শাস্তির ইঙ্গিত দিয়ে সত্য পথে চলার আহ্বান জানান, এর চেয়ে মানবিক আচরণ আমরা কোথায় আশা করতে পারি ?
পশ্চিমা জগতে সাম্য ও মানবতার জন্য যে চিৎকারগুলো দিচ্ছে, তা এ কারনে অন্তসারশুন্য যে তারা বিশ্বের জাতিগুলোকে এই সব মার্কামারা কথা বলে, নানাভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে চায়। আমরা পাশ্চাত্যভঙ্গির মানবতাকে ঘৃনা করি। কারন তা তাদের নিজস্ব স্বার্থের সাথে জড়িত। মানুষের চিরন্তন আকাঙ্খার সঙ্গে জড়িত নয়। সৃষ্টিগত ভাবে সকল মানুষ সমান; শিক্ষাগত জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের হকদার প্রতিটি মানুষ। তাহলে একটি দেশকে পদানত করে দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে কি ধরনের মানবতা শিক্ষা দেয়া যায় ? পাশ্চাত্য এর চেয়ে বেশি কিছু কি আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত করতে পেরেছে ?
আমাদের এ দেশীয় শিক্ষিত সমাজের অনেকেই ধরে নিয়েছেন, আধুনিক শিক্ষা দর্শনে ইউরোপ যেমন পথিকৃৎ- এর ভূমিকা পালন করছে, মনবতাবাদী দর্শনেরও সেই বুঝি স্বপ্নদ্রষ্টা। কিন্তু আসলেই কি তাই ? আধুনিক কালের ব্যাপ্তি যদি হয় আড়াইশত বছর, তাহলে পৃথিবীব্যাপ্তি ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী চেহারার মধ্যে কোথায় কতটুকু মানবতাবাদ আছে ? এশিয়া ও আফ্রিকার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠিকে পদানত রেখে, শত শত বছর ধরে শোসন করেছে। তার ফলে আজ এক অপ্রতিদ্বন্দী ইউরোপের উত্থান। জাতিসংঘ কি নির্যাতিত মানুষকে রক্ষা করার কোন প্রতিষ্ঠান ? আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, পৃথিবীতে সাম্য-ন্যয় ও মানবতার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর বিধানকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদের এবং সেই দায়িত্ব পালনে আমরা জাতিগতাভাবে অক্ষম ও অসমর্থ বিধায়, অন্যের আরোপিত মানবতাবাদের সংজ্ঞায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছি। 'তিনশ' বছর ধরে ইউরোমার্কিন সভ্যতার ধারকেরা যে দাস ব্যাবসা চালিয়ে এসেছে তা কি ইতিহাস থেকে মুছে যাবে কখনো ? ঐ সময় তের থেকে পনের মিলিয়ন আফ্রিকীয় আদমজাত ধরা হয়েছিল নিতান্ত পশুর মত গুলি মেরে। এটা ছিল সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকের মানবতাবাদ।
আর উনিশ ও বিশশতকের মানবতাবাদ যদি আমরা চাক্ষুস করি, ইতিহাসের উজ্জ্বল প্রেক্ষিতে তাহলে এ কথা বলা অসঙ্গত যে, আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ যা পশ্চিমা ও অনুন্নত অল্প সভ্য মানুষের মধ্যেকার সম্পর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত; সেখানে সভ্যতার ধারকেরা কি ছল-চাতুরি, ভন্ডামি ও অর্থনৈতিক দাসত্ব আরোপ করে নি ? তারা কি দুর্বলদের বস্তুগত, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক মূল্যোবোধ ধ্বংসের চক্রান্তে লিপ্ত না ?কোরআনে আল্লাহ একদা মহানবীকে এভাবে বলেন, 'কাফেরদের মধ্য থেকে কেউ যদি আপনার কাছে আশ্রয় চায়, তাকে আশ্রয় দেবেন, তাড়াবেন না; সে আপনার মাধ্যমে সম্ভবত আপনার আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা করতে পারবে।' - এই হচ্ছে আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গি। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে শত্রুর প্রতি শত্রুতা পোষণ স্বভাবিক। কিন্তু শত্রু যখন আশ্রয়প্রার্থী হয়, তাকে আশ্রয়দান এবং শিক্ষাদান আল্লাহর নির্দেশ মত অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহর এই মহান শিক্ষা থেকে বর্তমান সময়ের মুসলমান এবং খৃষ্টান সহ গোটা মানব জাতিই অনেক দূরে সরে গেছে।
ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য কিংবা ধর্মবিদ্যা মানুষের জন্য যতকিছু এনে থাকুক, মানুষকে সমাজে শান্তিতে বসবাসের জন্য প্রয়োজন সাম্যবোধ যা মহৎ মানুষের জীবনাশ্রিত চরিত্র ব্যতীত পাওয়া সম্ভব নয়। এ কারনে ইতিহাসের রচয়িতা মূখ্য নয়, বিজ্ঞানে বিজ্ঞানীর ব্যক্তি জীবন জরুরী নয়, কিন্তু সাহিত্যে এবং ধর্মে সাহিত্যিক ও ধর্ম প্রবর্তকের ব্যক্তি জীবন অবশই মূখ্য। ধর্মের শিক্ষা কিতাবের চেয়ে ধর্মপুরুষের জীবনযাপনে, জীবন চরিতে। শিল্পির যেমন শিল্প, ধার্মিকের জীবন তেমনি ধর্ম। শিল্পির কল্পনায় থাকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য মন্থন; ধার্মিকের উদ্দেশ্য পার্থিব জীবনে স্রষ্টার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন এবং পারিত্রিক জীবনের কল্যাণ উপার্জন। শিল্পির মানবতা হল নির্মোহ সত্তা নিয়ে সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা; ধার্মিকের মানবতা হল মনুষ্যত্বকে সকল অপমান থেকে রক্ষা করা। এ কারনে যুদ্ধকে আইন সঙ্গত করেছে। ফিৎনা ফাসাদ নরহত্যার মত মহাপাপ বলে ঘোষনা করেছে। "ফিৎনা সমাজে নরহত্যার চেয়ে মহাপাপ।"(আল-কোরআন)। এ ঘোষনার মধ্য দিয়ে সামাজিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সম্প্রদায়কে সতর্ক করা হয়েছে। দেশে দেশে বিশ্বমানবতার পক্ষে মানুষের মিছিল শোনা যায়। কিন্তু চরিত্রহীন সাম্রাজ্যবাদীরা কি তাতে এতটুকু কর্ণপাত করে ? সঠিক ধর্মের শিক্ষাগ্রহণ করলে মানুষকে যে শোষণ করা যাবে না, সে জন্য তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছে। অথচ তাদের লেবাসে যে প্লে-কার্ড লাগান তাতে লেখা, মানবতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। এ মানুষকে খুনি আসামী বানাতেই হবে। বিজ্ঞান মানুষের বস্তুগত জীবনের সুখ-সুবিধার পরিধিকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে, কিন্তু সভ্যতাকে বাচিয়ে রাখার জন্য মানুষকে আত্মগত উৎকর্ষতার দিকে অগ্রসর করছে না। এটা করার দায়িত্ব অবশ্য বিজ্ঞানের নয়, ধর্মের। ধর্মও আবার একদল যাজক, পুরোহিত, মোল্লামুন্সির হাতে পড়েছে, যারা মনুষ্যত্যের সার্বিক মূল্যবোধ রক্ষার চেয়ে, কিছু কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পৌরহিত্য করতেই ভালবাসে। মানবতাবাদের অধগতির জন্য এ শ্রেনীও কম দায়ী নয়।
তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠিকে পাশ্চাত্যের খয়রাতি সাহায্যে বেচে থাকতে হয়; ফলে দাতাদের গলাভরা বুলির নিষ্ঠাবান তোষামদকারী যদি হওয়া না যায়, অনাহার ও দুভিক্ষের জ্বালায় মরতে হবে। এই ধারণাই প্রাচ্য জনমকে ইসলামের শাশ্বত বাণীর নিহিতার্থ উপলব্ধির ক্ষেত্রে প্রধান বাধা; আর সে কারনে কোরআনের মানবতাবাদ এখানে এ সমাজে অনুপস্থিত। সত্যবিচারের মানদন্ড কি ? আমি যেভাবে বাচতে চাই, আর একজনকে আমার মতই বাচতে দিতে হবে। এই অঙ্গীকার যেমন গনতান্ত্রিক, তেমনি তা ঐশ্বরিক বিধানেরও ভাষ্য। অবশ্য একটি সমাজ কতটা সভ্য, সেটা বোঝা যায়, সেই সমাজবদ্ধ মানুষগুলো একে অপরের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করছে তার উপর। আমরা যে এখনও একটি অসভ্যসমাজে বাস করছি সেটা রাষ্ট্রপালিত সন্ত্রাসীগ্রুপ-পুলিশ বাহিনীর ব্যবহার দেখে বোঝা যায়। আমাদের দেশে মনবতাবাদের চরম লঙ্ঘন ঘটছে, যা প্রায় প্রতিদিন পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে উল্লেখিত হচ্ছে। এখানে মানুষ অর্থ ও পেশা ক্ষমতা ও সম্পদের দ্বারা মূল্যায়িত। ফলে মানবতাবাদের ধারনা কেবল কিতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। রাষ্ট্র ক্ষমতার অপব্যবহার করে নেতারা যখন সম্পদ লুন্ঠন করে, আমলারা কি সেটা তাকিয়ে তাকেয়ে দেখে ? আমলারা যখন অফিসে অফিসে ফাইল ঠেকিয়ে অন্যায়ভাবে ঘুষ আদায় করে তখন ছোট কেরানীগোছের অফিসাররা কি বসে থাকে ? একজন কেরানীর যদি পাচটা বাড়ি থাকে তাহলে বুঝাই যাচ্ছে অবৈধ অর্থ রোজগার কিভাবে চলছে। এসব কিছুতো স্থায়ীভাবে চাকুরীরত অবস্থার মধ্যে থেকে চলছে । বেকার যুব সমাজ কি করছে ? সন্ত্রাস কবলিত গোটা বাংলাদেশ এখন একটি বেহিসেবি খুন-খারাবীর সন্ত্রস্ত জনপদ। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দারিদ্র ও অশিক্ষা-সমাজে মানবতাবাদের অর্থকে বিবর্ণ করে দিয়েছে। আমরা কিভাবে মানুষের নায্য অধিকার সমুন্নত রাখার চেষ্টা করব ? আমরা নিজেরাই অসহায়। 'বচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে' বলে যে কথাটি শোনা যায়, সেটা বাংলাদেশে পুরোপুরি বিদ্যমান।
মানবতাবাদের সংজ্ঞা যাই হোক, ন্যায় বিচারের মানদন্ড প্রতিষ্ঠা ব্যাতিত মানবতাবাদরে প্রসার ঘটেনা। "ন্যায় বিচার তাকওয়ার কাছাকাছি" কোরআন যখন একথা বলে তখন আলেম সমাজের ইসলামের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা কর্তব্য। কিন্তু এ দেশের আলেম সমাজ প্রথাবাদী চিন্তার কুঠুরির মধ্যে কুন্ডলী পাকিয়ে আছে। মদ, গাঁজা, চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে এদের কোন জিহাদ নেই। ইতিহাসের কোন শিক্ষাই এদের কাজে লাগছে না। অথচ তারা প্রতিদিন সুরেলা কন্ঠে কোরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা শুনিয়ে যাচ্ছেন স্রোতাদের।
হযরত শোয়ায়েব (আ

পৃথিবীকে শান্তিপূর্ণ রাখা মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে মানুষ কিন্তু একটি সমাজের বাসিন্দা। আর সেটা হল বিশ্ব সমাজ। মানব সভ্যতা। সেটাকে একক ভাবে ধ্বংস করার অধিকার কারো নেই। কিন্তু দেখা গেছে, যুগে যুগে এক একটা পাপাচারী সম্প্রদায় সভ্যতা ধংসের উন্মাদনায় মেতেছে। সাধারণ শান্তি প্রিয় মানুষের আকুতি উপেক্ষা করে যুদ্ধবাজ দস্যুরা ধংস করছে নগর, লুন্ঠন করছে ধন-সম্পদ, হত্যা করছে নিরীহ নারী পুরুষ ও শিশুদের, জ্বালিয়ে দিয়েছে শস্য ক্ষেত, পুড়িয়েছে সভ্যতার চিহৃবহনকারী লইব্রেরীসমূহ। এবং পৃথিবীকে পরিনত করেছে শশ্মানে, বধ্যভূমিতে। মানবতাবাদ -এর লাঞ্ছনা এত ব্যাপক যা কয়েক পৃষ্ঠায় শেষ হবার নয়। Battle of Dictionary তে, ১৯৬০ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যন্ত গত দুহাজার বছরে ১৪৪৩ টিরও বেশী যুদ্ধের উল্লখ পাওয়া যায়। এত যুদ্ধ কেন হল ? অন্যসব গুণাবলীর চেয়ে মানুষের মধ্যে যুদ্ধ করার প্রবণতাইকি বেশী ? সংগ্রাম করে পৃথিবীতে বাচতে হয়, এ কথা সত্য, কিন্তু মানুষ কি শুধু যুদ্ধ করেই বাচবে ? মানবতাবাদ ও যুদ্ধ দুটি বিপরীত বিষয়। আবার দেখা যাচ্ছে, মানবতাবাদ রক্ষার জন্য যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে উঠে। মানুষকে রক্ষা করার জন্য যদি যুদ্ধের প্রয়োজন হয়-সেটা তো প্রশংসার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধনিতা যুদ্ধ মানুষ ও মানবতা অর্থাৎ মানুষের বাক স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ছিল এক অপরিহার্য যুদ্ধ। কিন্তু এ যুদ্ধে পাক সেনাদের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা বিশ্বে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। আমরা মানবতা লঙ্ঘনের সেই নির্মম ইতিহাস ভুলিনি।
কোরআনে মানবতাবাদ প্রসঙ্গ লিখতে বসলে এত সুন্দর কিছু লেখা যায় যা মনে করিয়ে দেয় স্বর্গীয় জীবনের কথা। অথচ কোরআন অনুসারী মুসলমানদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নানান অজুহাতে এরা সর্বাধিক তরবারির ভাষায় কথা বলেছে। আশির দশকে আট বছর ব্যাপি ইরান-ইরাক যুদ্ধে মানবতা লঙ্ঘনের নতুন রেকর্ড হয়েছে। নিরীহ ইরানীদের উপর সাদ্দাম হোসেন রাসায়নিক ও জীবানু অস্ত্র ব্যাবহার করেন। কোরআনের কোন শিক্ষাই তাদের জন্য কাজে লাগে নি। অথচ এরা বিশ্বে সচ্চা মুসলমান।
মানবতাবাদের শত্রু হিসেবে পাশ্চাত্যকে গালাগাল দেয়ার আগে মুসলিম শাসকবর্গকে বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো উচিত। কোটি কোটি প্রজাসাধারণের ভাগ্যের সঙ্গে প্রতারণা করে তুর্কী সুলতানরা করেছে অত্যচার, মুঘলরা করেছে বিলাসিতা, পরিণামে আজ গোটা মসিলিম বিশ্ব পাশ্চাত্যের কাছে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। পাশ্চাত্যের শাসক গোষ্ঠির সঙ্গে প্রাচ্যের শাসক গোষ্ঠির পার্থক্য হল, পাশ্চাত্যের শাসকগোষ্ঠি জনগনের মৌলিক চাহিদা পুরন সহ সবরকম বিনোদনের ব্যাবস্থা করতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যথানিয়মে প্রয়োগ করেছে। আর প্রাচ্যের মুসলিম শাসকবর্গ নিজেদের অভিমত চাপিয়ে দিয়ে, জনগণের মৌলিক চাহিদা উপেক্ষা করে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ফলে দেশের জনগন তাদের শাসকবর্গকে উৎখাত করে বিদেশি শাসকদের আমন্ত্রন জানাতে উৎসাহবোধ করছে। ঠিক এভাবে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতার কেন্দ্রভূমিতে ধস্ নেমেছে। যা আরো একশ বছরে পূনর্গঠনের কোন সম্ভাবনা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হল, মুসলমানদের মধ্যে সিশিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব এত বেশি যে দারিদ্র আর নিরক্ষরতার অভিশাপের মধ্যে এরা হামাগুড়ি দিচ্ছে। মানবতার উপলব্ধি করবে কিভাবে ? মুসলিম শাসকদের কল্যাণ বোধের অভাবকে পুঁজি করে পশ্চিমা বিশ্ব দেশের অভ্যন্তর বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এটা এখন গোপন কিছু নয়। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মুসলমানদের শিক্ষা। কোরআনে মানবতাবাদের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা এক শাশ্বত বিধান-সেটাকে লঙ্ঘন করে মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির মধ্যে টেনে এনেছে। বইয়ের পাতায় এর চমৎকার আলোচনা পাওয়া যায়, কিন্তু মুসলমানদের সামগ্রিক আচরনে এগুলোর কোন প্রমাণ পাওয়া দুষ্কর। কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা আছে, অথচ মালিক এর যাকাত দেয় না; মুসলিম সরকারগুলো পর্যটন এর নামে অনেক অর্থ ব্যায় করে, কিন্তু দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার সরান্জাম নেই, নেই প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ডাক্তার। মূলকথা ইয়াতীম ও মিসকিনদের প্রতি, রোগী ও নিম্নবিত্ত্বের জনতার প্রতি মুসলিম শাসকদের উদাসীনতা বার বার এক অপরিবর্তনীয় দু:শাসনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। মানবতাবাদ হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের স্বত:স্ফুর্ত কল্যাণ চেতনা। কিন্তু মুসলিম সমাজে সাধারণ ধারণাই হচ্ছে অন্যের অমঙ্গল তো নিজের মঙ্গল । অবশ্য এটা এসেছে দলীয় প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনীতির প্রভাবে। একটি দল অন্য দলের সভা মিছিল ও মিটিংয়ে হামলা চালানের বিষয়টাকে দলীয় সংবিধানে এক নম্বরে রেখেছে। এ কারনে মুসলিম দেশগুলোর সমাজ ব্যাবস্থায় হিংসা হানাহানি-নিরর্থক দলাদলি এবং অহেতুক রক্তারক্তি ক্রমবর্ধমান হারে অব্যাহত। ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের প্রতি সদ্ব্যাবহারের নির্দেশ নেই এমন কোন ধর্ম বিশ্বে নেই । সেক্ষেত্রে ইসলাম, একজন মহান নবীর প্রবর্তিত ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে এত আত্মকলহে লিপ্ত কেন ? মানবতাবাদ শুধু দুবেলা ইয়াতীম ও মিসকীন খাওয়ানের মধ্যে ? না আল্লাহর রজ্জু বা কোরআেনকে সর্বাংশে আকড়েঁ ধরার মধ্যে ? আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি, আল্লাহ তার মহানবীর মধ্যে মানুষের জন্য সবোত্তম চরিত্র গুণের অভিব্যক্তি রেখেছেন। আমরা মহানবীকে অনুসরন করলেই সমল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারি।
মনে রাখতে হবে, মানবতাবাদ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমি যাকে স্রষ্টা বলে বিশ্বাস করি, তিনিই তো আমার প্রতিবেশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন ও পার্সি সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে এ নির্দিষ্ট সময়টুকুতে বাস করার জন্য, সামাজিক, বানিজ্যিক, প্রশাসনিক তথা ধর্মীয় বিষয়ে তাদের সঙ্গ যোগাযোগ না রক্ষা না করে কি পারব ? কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, খৃষ্টানদের মধ্যে যারা বুযুর্গ তারাই মুসলমানদের অতি নিকটে, আত্মীয়ের মত। একটি মধ্যপন্থা জাতি হিসেবে মুসলমানদের জন্য কর্তব্যের পাল্লা অনেক ভারী। দায়িত্বও অনেক বেশী। যুগের প্রয়োজনে মানুষের কল্যাণের জন্য আল্লাহ বহু নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর সে কারনে বিশ্ব সমাজে সৃষ্টি হয়েছে ধর্মের ভেদাভদ। আর ধর্ম ও বহু জাতরি উৎসমূল এক এ দাবী করে একটি অপরটির উপর শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করছে। ইহুদীরা মানছে না খৃষ্টানদের, খৃষ্টানরা পাত্তা দিতে চায় না মুসলমানদের, মুসলমানরা সর্বশেষ ধর্ম সম্প্রদায় হিসেবে নবীন এবং আল্লাহর পছন্দের অনুসারী। আবার হিন্দুরা ভারতবর্ষের প্রচীন পৌত্তলিক হিসেবে নিজেদের মধ্যে ভগবানকে আবিষ্কার করেছেন নানান মূর্তিতে। এসব মিলিয়েইতো বিশ্বে ছড়িয়ে আছে ধর্মের কোন্দল। যাকে বলে সাম্প্রদায়িক বেদবুদ্ধি। আর পরস্পরকে হিংসা করার অজুহাত তারা পেয়ে যায় ভেদজ্ঞানের প্রেরণা নিয়ে। কিন্তু আল্লাহ মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক দলাদলি থেকে দূরে থাকার জন্য কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। " তোমরা তাদেরকে (দেব-দেবী) মন্দ বল না, যারা তাদের আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। তাহলে তারা ধৃষ্টতা করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে মন্দ বলবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজকর্ম সুশোভিত করে দিয়েছি। অত:পর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদেরকে প্রত্যাবর্তন কতের হবে। তখন তিনি তাদেরকে বলে দিবেন যা কিছু তারা করত। (সূরা আল-আনআম:১০৮)
পিতা যেমন পুত্রকে অন্যের প্রতি অন্যায় করতে নিষেধ করেন, আল্লাহ তিমনি মুসলমানদেরকে পৌত্তলিকদের গালাগাল করতে নিষেধ করেছেন। যে সব বিষয়ে আল্লাহ ফয়সালার জন্য একটি সময়কে নির্ধারন করে রেখেছেন পরোকালে, সে বিষয়ে আমরা যেন দলাদলি না করি। এইতো মানবতাবাদের চুড়ান্ত রূপ। ইচ্ছার স্বাধীন প্রকাশ কি মানবতাবাদের স্বীকৃতি নয় ? সামাজিক শান্তি বজায় রাখার জন্য মানবতা রক্ষার কোন বিকল্প নেই।
কোরআনের সমস্ত বক্তব্য একত্রিত করলে, মানুষের পার্থিব জীবনকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার যে বিধানগুলো বেরিয়ে আসে তার চেয়ে সুন্দর বিধান কি মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে ? মানুষ তার স্রষ্ট হিসেবে একজনকে স্কীকার করবে এটা তার মানবিক দায়িত্ব। আর সব কিছুর উর্দ্ধে স্রষ্ট মানুষকে ভরণপোষন দিয়ে যাবেন, এটাও তার দায়িত্ব। আমরা দেখছি কোরআনের মতে, আল্লাহ মানবজাতিকে নিরন্তর প্রতিপালন করে যাচ্ছেন, কিন্তু মানুষ তার স্রষ্টার প্রতি না করছে আনুগত্য, না করছে প্রতিবেশির উপর সুবিচার।
ইসলাম মানবতার ধর্ম একথা বলার মধ্যে যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি। বরং ইসলাম মানুষের ধর্ম। তবে সেটাকি সকল মানুষের ধর্ম ? নিশ্চয়ই নয়। অবিশ্বাসী যালেমরা মানবতাবাদ কিংবা জীবনবাদকে বিশ্বাস করে না। অতএব অবিশ্বাসী যালেমদের জন্য ইসলাম নয়। কোরআন এমন তুচ্ছ কিতাব নয়, যা জালেমরা অবজ্ঞাভরে পাঠ করতে পারে। যারা বিশ্বাস করে নিচ্ছে যে কোরআন এক সর্বশক্তিমান আল্লাহর তরফ থেকে আগত, মহান এক রাসূলের দ্বারা প্রচারিত এবং এর মধ্যে কোন ভুল বা সন্দেহ নেই যে সব কিছু একদা ধংস হয়ে যাবে, কেবল মহান আল্লাহর সত্তাই থাকবে তাদের জন্য মানবতারক্ষার প্রশ্ন উঠে এবং তারা মানবিক যুক্তি বিবেচনাকে গুরুত্ব দিতে পারে।
কোরআন যখন কঠোরভাবে মানুষের ক্ষতি না করার নির্দেশ দেয় এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্য পোষণের তাগিদ দেয় তখন কোরআনকে আমরা কেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম গ্রন্থ বলব না ? সমাজে ন্যায় ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে মানবিক পদক্ষেপ। এ কারনে কোরআন বারবার জোর দিচ্ছে, তোমরা মানুষের মধ্যে ন্যায় ভিত্তিক মিমাংসা করে দাও। মানুষের মধ্যে দানশীলতা, ক্ষমা ও সহনশীলতার মত মহৎ গুণাবলি চর্চা করার নির্দেশ কোরআন প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। এ কারনে অতীব গুরুত্বের সঙ্গে আল্লাহ বলেন- " এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে। "
বিষয়: বিবিধ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন