হাদীসের মর্যাদা ও হাদীস অমান্য করার পরিণতি




কোরআন মানলে সুন্নাহ নয় কেন? 


(বিশ্বনবীর বাণী ও নির্দেশিত জীবনব্যবস্থা অর্থে) সুন্নাহর সম্পূরকতা ছাড়া ইসলাম পরিপূর্ণ নয়। যারা বলে, ইসলাম পালনে কোরআনই যথেষ্ট, সুন্নাহর প্রয়োজন নেই, তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ব্যাপকতা এবং কোরআনের সাথে সুন্নাহর অন্তর্নিহিত সংযোগ উপলব্ধি করতে অক্ষম। 

আমি যা বুঝি, ইসলাম কার্যত জ্ঞান ও আমলের (ইবাদতসহ) নান্দনিক সংমিশ্রণ। দুটোর নিখুঁত সমন্বয় ছাড়া ধর্ম ইসলাম কখনোই যথাযথভাবে উপস্থাপিত হতে পারে না। 

পবিত্র কোরআনের প্রথম উচ্চারিত আয়াত, “পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।”—সূরা আলাক: ১। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, “বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান হতে পারে? বুদ্ধিমানরাই কেবল অবধান করে।”—জুমার: ৯। 

আমল সম্পর্কে আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি, “তবে যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তাদের জন্য থাকবে উপযুক্ত প্রতিদান...”—কাহফ: ৮৮। আরও বলা আছে, “যারা আমাদের পথে সংগ্রাম করবে, অবশ্যই আমরা তাদেরকে আমাদের পথ প্রদর্শন করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ আমলকারীগণের পাশে আছেন।”—(আনকাবূত: ৬৯)।

ফলত, কেউ তথ্য আহরণ করলো (বিদ্যালয়ে গিয়ে কিংবা স্বউদ্যোগে), কিন্তু আমল থেকে দূরে থাকলো—এমন ব্যক্তি ইসলামের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। তথ্যসমৃদ্ধ হলেও তারা জ্ঞানী নয়, কেননা তাদের বোধগম্যতার চারণক্ষেত্র সংকুচিত। আপনি শুধু জানলেন, প্রয়োগ করলেন না—তাহলে ইসলামের সত্যিকার রুপ দর্শন আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। কয়েকটি কিতাব পড়ে আপনার মনে হতে পারে, আপনি সব শিখে ফেলেছেন। কিন্তু জ্ঞানসমু্দ্রের বেলাভূমিতে আপনি হয়তো কুড়াতে পেরেছেন একটিমাত্র নুড়ি। এ অবস্থায় আপনি যে ইসলামের বয়ান দিবেন, তা অসম্পূর্ণ। আপনার কাছে ইসলাম নিরাপদ না থাকার সম্ভাবনাও প্রবল। 

তবে না জেনে যারা মুখস্থবিদ্যা চর্চা করে আমৃত্যু, তারা ইসলামের মূল প্রতীতির বাইরে বসবাস করলেও তাদের হাতে ইসলাম ততটা অনিরাপদ নয় যতটা আমলবিহীন পণ্ডিতগণের হাতে। ইবাদতের কারণে প্রথমোক্তদের পরকালও হয়তো শান্তিময় হবে। তা যত যা-ই হোক, আফসোস! প্রকৃত ইসলামের আশপাশ না ঘেঁষেই অভাগারা দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে।

যে সরল পথের সন্ধান পেতে মানবজাতি নিরন্তর আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করে, সে পথচলার একেবারে গোড়া থেকেই আছে পঠন আর অনুশীলন। পড়তে হবে, জানতে হবে এবং চর্চা করতে হবে। পড়লো-জানলো কিন্তু আমল করলো না, ইসলামের প্রেক্ষাপটে এমন মানুষ অজ্ঞতার মধ্যেই ডুবে থাকলো। তারা প্রকৃত জ্ঞানের খোঁজ পায় বলে আমি মনে করি না। কথা হচ্ছে, কোরআন দিকনির্দেশনামূলক ঐশী গ্রন্থ, কিন্তু আমল সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত ধারণা পাই সুন্নাহ থেকে। সালাত, সিয়াম, হজ্ব, জাকাত, বিবিধ—যে বিষয়ই আপনি সামনে আনুন না কেন সুন্নাহ ব্যতিরেকে শুদ্ধ আমল অসম্ভব। কোরআনের নির্দেশনাও অভিন্ন। আল্লাহ বলেন, “(হে নবী) বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার অনুসরণ করো।”—ইমরান, ৩১। “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।”—আহযাব, ২১। 

সুন্নাহবিরোধীরা হয়তো বলবে, সুন্নাহ সবসময় সামন্জস্যপূর্ণ নয়, কখনো কখনো বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সুন্নাহর আনুষ্ঠানিক সংকলন শুরু হয়েছিলো নবীজীর ওফাতের শত বছর পরে, তার আগে কি সুন্নাহ ছাড়া চলেনি? না চলেনি। হয়তো পরিপূর্ণ লিপিবদ্ধ ছিলো না, কিন্তু নবী করীম (সা.) যেভাবে শিখিয়ে গিয়েছিলেন, যেভাবে বলেছিলেন, শত বছর সেসব নিয়ম মেনেই ইসলাম চর্চিত হয়েছে। সুন্নাহর বিকাশ, বিস্তার ও চর্চা কোরআনের সমসাময়িক ও পারস্পরিক। ফলে কোরআন ও সুন্নাহর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আমলকেন্দ্রিক মাযহাবগুলোর ভিন্ন ভিন্ন রীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটা বৈচিত্র্য, এটাই ইসলামের সৌন্দর্য। যতক্ষণ পর্যন্ত শিরকের উপাদান না এসে পড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বীকৃত সব ত্বরিকাই সঠিক। ইমামের পেছনে সুরা ফাতিহার পর ‘আমিন’ শব্দ করে যেমন পড়া যায়, নিরবে পড়লেও ক্ষতি নেই। ঈদের সালাতে অতিরিক্ত তাকবীর ৬টি পড়বেন না ১২টি, তারাবিহ ৮ রাকাত না ২০ রাকাত—এসব নিয়ে হৈচৈ করার কিছু নেই। যে কোন একটি মানলেই হলো। কোথাও অসামন্জস্যতা বা গ্রহণযোগ্যতার ইস্যু থাকলে স্কলাররা সেটার সমাধান করবেন। কিন্তু ঠুনকো অজুহাতে সুন্নাহ অস্বীকারের ভুল আয়োজনকে স্বাগত জানানো যাবে না। হাজার বছরের প্রতিষ্ঠান সুন্নাহ আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তা কোরআনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কোরআন ও সুন্নাহর হৃদ্যতাপূর্ণ আত্মীয়তাই ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি।

আসলে সুন্নাহবিরোধী ভাই-ব্রাদারদের মূল শত্রু আমল। এরা আমলের ক্ষেত্র সংকুচিত করতে বদ্ধপরিকর। খেয়াল করলে দেখবেন, ব্যক্তিগত জীবনে এদের আমল অকিঞ্চিৎকর—সালাত, সিয়াম ও বিবিধ সৎকাজে। এরা হারামকে হালাল বানাতে যতটা মস্তিষ্ক খাটায়, তার ধারেকাছে সময় ব্যয় করে না আমলে। সুন্নাহকে ইসলাম থেকে মুছে ফেলার জন্য এরা যে ওস্তাদি করে, প্রকারান্তরে তা অজ্ঞতার পরিচায়ক। লব্ধজ্ঞান শুদ্ধ উপায়ে আমলে প্রয়োগ করলে, আশা করি, ভাই-ব্রাদারদের ভ্রান্তি দূর হবে। 

কোরআন মানব, সুন্নাহ মানব না, তা কি হয়? 




হাদীস অস্বীকার প্রসঙ্গে দুটি কথা:

সুপ্রিয় বন্ধুগণ, বর্তমান যুগে অগণিত ফিতনার মাঝে একটি বড় ফিতনা হল হাদীস অস্বীকার করা ফিতনা। এই হাদীস অস্বীকার কারীর দল তাদের নোংরা নখর বের করে সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বত্বা এবং হাদীসে রাসূলের উপর কঠিন ভাবে আক্রমণ শুরু করেছে। কারণ, হাদীস থেকে মুসলমানদের দূরে সরাতে পারলে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো পানির মত সোজা। এ জন্য তারা ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও ওয়া মাহফিল, সভা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের এই জঘন্য অপ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে তারা হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলছে। হাদীসের অপব্যাখ্যা করে তার মানহানি করছে। হাদীসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। তারা বলতে চায় শুধু কুরআন যথেষ্ট। হাদীস মানার প্রয়োজন নাই। হাদীস বা সুন্নাহ শব্দটি তারা শুনতে চায় না। যার কারণে এরা নিজেদেরকে নাম দিয়েছে আহলে কুরআন বা কুরআনের অনুসারী।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যৎ বাণী কত সত্য ভাবে প্রকাশিত হয়েছে!! তিনি বলেছেন:

(ألا إني أوتيت الكتاب ومثله معه لا يوشك رجل شبعان على أريكته يقول عليكم بهذا القرآن فما وجدتم فيه من حلال فأحلوه وما وجدتم فيه من حرام فحرموه)

“জেনে রাখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার সাথে আরও অনুরূপ আরেকটি জিনিস (তা হল হাদীস)। অচিরেই দেখা যাবে, এক লোক ভরা পেটে তার খাটের উপর থেকে বলবে: তোমরা এই কুরআনকে আঁকড়ে ধর। এতে যে সকল বস্তু হালাল পাবে সেগুলোকে হালাল মনে কর, আর যে সব বস্তুকে হারাম পাবে সেগুলোকে হারাম মনে কর।“ (আবু দাউদ, মিকদাদ ইবনে মাদিকারাব থেকে বর্ণিত, সনদ সহীহ)

উক্ত হাদীসটি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ বহন করে। কারণ, নবুওয়তের যুগ পার হওয়ার পরপরই শিয়া ও খারেজী সম্প্রদায়ের হাত ধরে বিভিন্ন দল তৈরি হয় তারা হাদীসের উপর আক্রমণ শুরু করে। তারা বলে কুরআনই যথেষ্ট এবং হাদীস ও সু্ন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করে।

উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে নতুন করে এই ভ্রান্ত মতবাদের উৎপত্তি হয়। তারপর তা পাকিস্তানে জায়গা নেয়। এরপরে ক্রমান্বয়ে তা আরও বিভিন্ন মুসলিম দেশে সংক্রমিত হতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ তাদের জমজমাট কার্যক্রম রয়েছে। এমতের অনুসারীদের কেউ কেউ ইউরোপ-আমেরিকায় বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের এই বিষাক্ত মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। ফেসবুকে গড়ে তুলেছে বড় একটা গ্রুপ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামে হাদীসের মর্যাদা ও হাদীসের অস্বীকার কারীদের পরিণতি সম্পর্কে নিন্মোক্ত প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে যেন, বাংলাভাষী মুসলমানগণ হাদীসের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তার হেফাজতের জন্য সর্ব শক্তি নিয়োগ করে এবং বাতিলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকে। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে তাওফীক দান করুন।

প্রবন্ধটি লিখেছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট, দাঈ, ও গবেষক শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। আমীন। -সম্পাদক

লেখকের ভূমিকা: আল হামদুলিল্লাহ্ ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ্ ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া মান ওয়ালাহ।

মহানবী মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে জাতির সাধারণ মানুষদের মতই জীবন-যাপন করতেন। আল্লাহ তাকে নির্বাচিত করে পথভ্রষ্ট সমগ্র মানব জাতিকে (৩৪:২৮) সঠিক পথে আহ্বানের জন্যে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করলেন। শিক্ষা দিলেন কুরআন ও ঈমান। তারপর দায়িত্ব দিলেন সেই পথে মানুষকে আহ্বানের। আল্লাহ বলেন:

وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

“আর এইভাবে আমি আপনার প্রতি ওহী করেছি রূহ (কুরআন) আমার নির্দেশে; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি ও ঈমান কি, পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে দেই। আর আপনি অবশ্যই সরল সঠিক পথে মানুষকে আহ্বান করতেই থাকবেন।”(সূরা শূরা: ৫২) আল্লাহ্‌ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আদেশ করলেন মানুষকে হেদায়াত করার, আর মানুষকে আদেশ করলেন তিনি যা বলেন তা গ্রহণ করার।

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দিয়েছেন তাই হচ্ছে হাদীছ। আল্লাহ বলেন:

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا

“রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর তিনি যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশর: ৭)

এই রাসূল আমাদেরকে যেমন কুরআন দিয়েছেন, সেই সাথে কুরআনকে কিভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হও, তাও আল্লাহর নির্দেশ মোতাকেব দিয়েছেন। আর বাস্তব জীবনের ঐ প্রয়োগটাই হচ্ছে বিদগ্ধ বিদ্বানদের ভাষায় হাদীছ। কুরআনে যা নিষেধ করা হয়েছে, তার মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাসূলও কিছু বিষয় নিষেধ করেছেন। যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ আল্লাহ্‌ দিয়েছেন। রাসূলের আদেশ-নিষেধের কোন দরকার না থাকলে, আল্লাহ্‌ তাঁর কথা উল্লেখ করতেন না। বলতেন এই কুরআনে যা আছে তোমরা তা মেনে নাও, যা নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাক। অথচ কুরআনকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্‌ বহু জায়গায় নির্দেশ দিয়েছেন। এ স্থানে বিশেষ ভাবে রাসূলের প্রদান এবং নিষেধের কথা উল্লেখ করায় বুঝা যায় তিনিও আদেশ করেন এবং নিষেধ করেন। তবে অবশ্যই তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে হয়ে থাকে। আর তাঁর এই আদেশ-নিষেধই হচ্ছে হাদীছ।

১) মতভেদ হলে আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ থেকে সমাধান নিতে হবে:

অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর কথা মেনে নেয়ার সাথে সাথে রাসূলের কথাকেও মানতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর..।” (মুহাম্মাদঃ ৩৩) আরও সূরা নূর: ৫৪। রাসূলের কোন কথা না থাকলে আলাদাভাবে তাঁর অনুগত্য করার জন্যে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহারের দরকার ছিল না।

পার্থক্য লক্ষ্য করুন, সূরা নিসার ৫৯নং আয়াতে আল্লাহ্‌ তাঁর এবং রাসূলের অনুগত্য করার সাথে সাথে উলুল আমর তথা মুসলিম শাসকেরও আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের শাসকবর্গের।”

এখানে أَطِيعُوا শব্দটি যেমন আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে একইভাবে রাসূলের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়েছে; কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্যের ক্ষেত্রে শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়নি। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহর আনুগত্য যেমন বিনাবাক্য ব্যয়ে করতে হবে, অনুরূপ রাসূলের আনুগত্যও। কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্য করার সময় খেয়াল রাখতে হবে তার কথা আল্লাহ এবং রাসূলের কথার সাথে মিল আছে কি না। অর্থাৎ তাঁর অনুগত্য তাঁদের আনুগত্যের মাপকাঠিতে হতে হবে।

এই জন্যে মতভেদ বা সমস্যা হলে সমাধান কিভাবে করতে হবে আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ্‌ তা বলে দিয়েছেন:

فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ

“তোমরা কোন বিষয়ে মতবিরোধ করলে তার সমাধানে জন্যে আল্লাহ্‌ এবং রাসূলের শরণাপন্ন হবে।” এখানে আর উলুল আমরের কথা বলা হয়নি। কেননা তাদের সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়। সমাধান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল দিবেন। অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে। তিনি জীবদ্দশায় নিজে সমাধান দিয়েছেন, আর তাঁর মৃত্যুর পর কুরআন এবং সেই সাথে তাঁর রেখে যাওয়া সমাধান সমূহ যার অপর নাম হাদীছ।

২) আল্লাহ যেমন ফায়সালা করেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও তেমন করেন:

কুরআনের অনেক স্থানে রাসূলও নির্দেশ দেন ফায়সালা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ্‌ বলেন:

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا

“আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রাসূল কোন বিষয় ফায়সালা করলে কোন ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোন অধিকার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করবে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।” (সূরা আহযাবঃ ৩৬)

এখানে, আল্লাহর ফায়সালা যেমন লঙ্ঘন করার কারো অধিকার নেই, তেমনি রাসূলের আদেশ লঙ্ঘনেরও কোন অধিকার কারো নেই। আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে যেমন পথভ্রষ্ট হতে হবে তেমনি রাসূলের আদেশ লঙ্ঘন করলেও একই পরিণতি হবে। রাসূলের কোন আদেশ নিষেধ না থাকলে তাঁর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা অনর্থক হয়ে যায়।

৩) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ফায়সালা না মানলে ঈমান থাকবে না:

রাসূলের ফায়সালা ও আদেশ-নিষেধের গুরুত্ব কত বেশী যে তা না মানলে মানুষ মুমিনই থাকবে না। আল্লাহ্‌ বলেন,

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

“আপনার পালনকর্তার শপথ তারা ইমানদার হতে পারবে যে পর্যন্ত তারা পরস্পর বিরোধের বিষয়ের সমাধানের জন্যে আপনাকে বিচারক বা ফায়সালা কারী হিসেবে মেনে না নিবে, তারপর আপনি যে ফায়সালা করবেন তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না এবং তার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ না করবে।” (সূরা নিসা: ৬৫)

এখানে ভাষার প্রয়োগ রূপটা দেখুন কিভাবে তাঁকে সম্বোধন করে ‘উপস্থিত একবচন’ শব্দ يُحَكِّمُوكَ “আপনাকে বিচারক মানবে” এবং قَضَيْتَ “আপনি ফায়সালা করেন।” আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বিচার বা ফায়সালা করেছেন তাই হচ্ছে হাদীছ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যদি কোন ফায়সালা না থাকে বা তাঁর কথার কোন দরকার না থাকে, তবে তাঁকে বিশেষভাবে সম্বোধন করে এভাবে কথা বলা অনর্থক হয়ে যায়।

৪) আল্লাহর ন্যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হালাল ও হারাম করেন:

আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হালাল করেন এবং হারামও করেন- আল্লাহ তাঁকে এই অনুমতি দিয়েছেন । আল্লাহ্‌ বলেন:

الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

“যারা নিরক্ষর নবী রাসূল (মুহাম্মাদ) এর অনুসরণ করে, যার কথা তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায় (সেই নিরক্ষর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেন ও অন্যায় করতে নিষেধ করেন। তিনি তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু সমূহ হালাল করে দেন এবং অপবিত্র বস্তু সমূহকে তাদের জন্যে হারাম করে দেন। আর তাদের উপর চাপানো বোঝা ও বন্ধন হতে তাদের মুক্ত করেন। অতএব যেসব লোক তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য লাভ করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সেই নূরের (কুরআনের) অনুসরণ করেছে যা তাঁর নিকট নাযিল হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই সফলতা লাভ করেছে। (সূরা আরাফ: ১৫৭)

এই আয়াতও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও আল্লাহর নির্দেশক্রমে কিছু বিষয় হালাল করেছেন এবং কিছু হারাম করেছেন। অচিরেই আমরা তার উদাহরণ উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। এই আয়াতেও লক্ষ্য করুন প্রথম দিকে নবীজীর অনুসরণের কথা বলার পর আবার তাঁর নিকট নাযিল কৃত নূর তথা কুরআনের অনুসরণের কথা আলাদাভাবে বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় কুরআনের অনুসরণ যেমন দরকার, তেমনি কুরআন প্রচারকারী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণও দরকার। আর সেই অনুসরণই হচ্ছে তাঁর সীরাতের অনুসরণ তাঁর জীবনীর অনুসরণ অন্য কথায় তাঁর হাদীছের অনুসরণ।

৫) হাদীছ না মানলে কুরআন মানা হবে না:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কুরআনের অনুসরণ, কেননা তিনি কুরআনকে কিভাবে অনুসরণ করতে হবে তা নিজের জীবনে যেমন বাস্তবায়ন করেছেন, অনুরূপ তার যথাযথ তা’লীম সাহাবায়ে কেরামকেও দিয়ে গেছেন। এজন্যে আল্লাহ্‌ বলেছেন:

مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ

“যে রাসূলের অনুসরণ করবে সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহরই অনুসরণ করবে।” (সূরা নিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৮০) আর তাঁর সুন্নাত বা জীবনীর অনুসরণ না করলে কুরআনের অনুসরণ সম্ভব নয়। যদি কুরআনের অনুসরণই যথেষ্ট হত, তবে আলাদাভাবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণের প্রতি তাগিদ দেয়া হত না। বরং আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাইলে, তাঁর মাগফিরাত কামনা করলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আল্লাহ বলেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

“বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের সমুদয় পাপ মার্জনা করবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল করুণাময়।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৩১)

আলাদাভাবে রাসূলের অনুসরণের দরকার না থাকলে এখানে ي (আমার) সর্বনাম দ্বারা বাক্যটিকে উল্লেখ করার দরকার ছিল না। অতএব কুরআন অনুসরণ করতে চাইলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণ দরকার। অন্যকথায় রাসূলের তথা তাঁর হাদীছের অনুসরণ না করলে আল্লাহর কুরআনের অনুসরণ হবে না, তাঁর ভালবাসা পাওয়া যাবে না এবং তাঁর মাগফিরাতও লাভ করা যাবে না।

৬) প্রশ্ন: কুরআন থাকতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন আদেশ-নিষেধ করবেন? আর তার অনুসরণই বা আমরা করব কেন? তাহলে কি কুরআন পরিপূর্ণ গ্রন্থ নয়?

কেন তাঁর অনুসরণ করতে হবে? তার জবাব তো পূর্বের আয়াতগুলো থেকেই বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যাচ্ছে। বাকী থাকল কুরআন থাকতে কেন তিনি আদেশ-নিষেধ করবেন? এর জবাব হচ্ছে ইসলামকে পরিপূর্ণ করার দায়িত্ব আল্লাহর এবং তিনি তা করেছেনও। তিনি ইসলামের সবকিছু বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। আর তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে। তিনি বলেন:

يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ

“হে রাসূল! আপনার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তা পৌঁছিয়ে দিন।” (মায়েদাঃ ৬৭) সাথে সাথে এই পৌঁছে দেয়ার সময় যেন বিশদভাবে তা ব্যাখ্যা করে দেন। তাই আল্লাহ্‌ বলেন:

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ

“নিশ্চয় আমি আপনার নিকট জিকির (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে করে আপনি বিশদভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা করে দেন যা তাদের নিকট নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহাল: ৪৪)

তাঁর এই বর্ণনা দুটি পদ্ধতিতে হয়েছে। একটি মানুষকে সরাসরি কুরআন তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। যে কুরআন আল্লাহ্‌ জিবরীল (আঃ) কর্তৃক সরাসরি নাযিল করেছেন। এটাকে বলা হয় ওহী মাতুল। অর্থাৎ এর ভাব ও ভাষা উভয়টি আল্লাহর নিকট থেকে সরাসরি এসেছে। আরেকটি পদ্ধতি কুরআনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে। অর্থাৎ শব্দ বা বাক্যের ব্যাখ্যা উম্মতকে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। যা তিনি পরোক্ষ অহির মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে লাভ করেছেন। অর্থাৎ কুরআনের সংক্ষেপ ও সাধারণ আয়াত সমূহকে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ আয়াতকে সীমাবদ্ধ করেছেন। আবার শর্তযুক্ত আয়াতকে সাধারণ করেছেন। ব্যাপক অর্থবোধক আয়াতকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন ইত্যাদি। আর তা হয়েছে তাঁর কথা, কাজ ও সমর্থনের মাধ্যমে। যার অপর নাম হচ্ছে হাদীছ।

তিনি এসব করার অধিকার কিভাবে পেলেন? এই অধিকার আল্লাহই তাকে দিয়েছেন যেমনটি সূরা নাহালের ৪৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে তিনি নিজের পক্ষ থেকেও এটা করেননি; পরোক্ষভাবে আল্লাহর নিকট ওহী বা নির্দেশনা লাভ করেই তিনি করেছেন। যেমন আল্লাহ্‌ বলেন:

وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى

“তিনি নিজের পক্ষ থেকে প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে কোন কথা বলেন না, তিনি যা বলেন তা ওহী, যা তাঁর নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।” (সূরা নাজমঃ ৩-৪)

এখানে ওহী বলতে যেমন কুরআন উদ্দেশ্য, তেমনি কুরআন বুঝানোর জন্যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ব্যাখ্যাও উদ্দেশ্য। যার প্রমাণ আমরা অচিরেই পেশ করছি।

৭) ওহীর নিয়ম:

আল্লাহ তিনটি নিয়মে মানুষের কাছে তথা নবী-রাসূলদের কাছে ওহী প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন:

وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ

“কোন মানুষের জন্যে সমীচীন নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন; কিন্তু (১) ওহীর মাধ্যমে অথবা (২) পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা (৩) তিনি কোন দূত প্রেরণ করবেন, অতঃপর আল্লাহ্‌ যা চান, সে তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেবে। (সূরা শূরা: ৫১) অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই ওহী করেন।

মোটকথা, আল্লাহ তায়ালা তিনভাবে নবী-রাসূলদের প্রতি ওহী করেন:

১) এলহাম:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর র অন্তরে যে বিষয়কে জাগ্রত করতেন সেটাই হল এলহাম। সেটাই হল পরোক্ষ ওহী বা ওহী গাইর মাতুল। এটা কোন ফেরেশতার মাধ্যমে ছিল না। বিষয়টি যেমন জাগ্রত অবস্থায় হত তেমনি স্বপ্ন যোগেও হত। এমতাবস্থায় সাধারণত: আল্লাহ্‌ তাআলার পক্ষ থেকে শব্দ বা বাক্য অবতীর্ণ হয় না; কেবল বিষয়বস্তু অন্তরে জাগ্রত হয়, যা পয়গম্বরগণ নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন। আর সেটাই হচ্ছে মুহাদ্দেছীনদের পরিভাষায় হাদীছ বা সুন্নাহ্।

২) পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি কথা বলা:

আল্লাহ তায়ালা মুসা (আঃ)এর সাথে তূর পর্বতে পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি কথা বলেছিলেন। আর আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে মেরাজে গিয়ে আরশে পাকে হয়েছিল। আল্লাহ দর্শন না দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে তাঁদের সাথে কথা বলেছেন এবং ওহী করেছেন আর সে সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।

৩) জিবরাঈল (আঃ) এর মারফতে:

তৃতীয় পদ্ধতিটিই সবচেয়ে বেশী ব্যবহার হয়েছে আল্লাহর ওহী বা নির্দেশনা নাযিলের ক্ষেত্রে। আর তা হয়েছে জিবরাঈল (আঃ)এর মারফত। তাঁকে আমীনুল ওহী বলা হয়। কুরআনে রূহুল আমীন বলা হয়েছে। রাসূল কারীম (সম্মানিত দূত) বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:

نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ

“বিশ্বস্ত রূহ (জিবরীল ফেরেশতা) উহা (কুরআন) নিয়ে অবতরণ করেছেন।”(সূরা শুআরাঃ ১৯৩) আল্লাহ্‌ আরও বলেন:

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ (19) ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ (20) مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ

“নিশ্চয় উহা (কুরআন) সম্মানিত রাসূল (দূত জিবরীল (আঃ)এর আনিত বাণী। যিনি শক্তিশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাশালী, ফেরেশতাগণের মান্যবর এবং আল্লাহর বিশ্বাসভাজন।” (সূরা তাকভীরঃ ১৯-২১) আল্লাহ আরও বলেন,

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ

“নিশ্চয় এই কুরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনিত বাণী।” (সূরা হাক্কাহঃ ৪০)

হাদীছ অস্বীকারকারীরা এই আয়াতগুলোতে ‘রাসূল’ বলতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বুঝাতে চায়। অথচ আয়াতের প্রসঙ্গতেই বুঝা যায় এখানে জিবরীল (আঃ)কে বুঝানো হয়েছে।

৮) আল্লাহ্‌ হাদীছ নাযিল করেছেন:

এখানে উল্লেখিত প্রথম পদ্ধতিটি হচ্ছে এমন ওহী যা আল্লাহ কোন ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়া নাযিল করেছেন। আর সেটার সমর্থনে কুরআনে আরও অনেক আয়াত পাওয়া যায়। ইবরাহীম (আ) কাবা গৃহ নির্মাণ করার পর ইসমাঈল (আ)এর বংশের জন্যে দুআ করেছিলেন। সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন,

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

“হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের মধ্যে থেকে তাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের নিকট আপনার আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করে শোনাবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা প্রদান করবে এবং তাদেরকে শিরক ও পাপাচারের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি মহা পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।” (সূরা বাকারাঃ ১২৯)

আল্লাহ্‌ এই দুআ কবুল করে তাদের মধ্যে তথা ইসমাঈলের বংশধর আরব জাতির মধ্যে সেই রাসূল প্রেরণ করেছেন। সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ

“আল্লাহ্‌ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদেরই ভিতর থেকে তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যে তাদেরকে তাঁর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করে শোনাবে, তাদেরকে পবিত্র করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে। যদিও তারা ইতোপূর্বে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।” (সূরা আল ইমরান: ১৬৪)

এ দু’টি আয়াতে হিকমত হচ্ছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ, তিনি যা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন।

আল্লাহ্‌ যেমন কুরআন নাযিল করেছেন তেমনি হিকমত তথা হাদীছও নাযিল করেছেন। আল্লাহ্‌ বলেন,

وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُمْ بِهِ

“তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, আর যে কিতাব ও হিকমত তোমাদের নিকট নাযিল করেছেন, যা দ্বারা তিনি তোমাদের উপদেশ প্রদান করেন।” (সূরা বাকারাঃ ২৩১)

এখানে হিকমত অর্থ সুন্নাত বা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীছ যা আল্লাহ্‌ পরোক্ষভাবে কোন ফেরেশতার মাধ্যম ব্যতীত তাঁর নবীর কাছে নাযিল করেছেন।

ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)বলেন, “আল্লাহ্‌ এই আয়াতে الْكِتَابِ উল্লেখ করেছেন তার অর্থ হচ্ছে কুরআন। আর উল্লেখ করেছেন وَالْحِكْمَةِ। আমি কুরআনের পণ্ডিতদের নিকট শুনেছি তাঁরা বলেছেন এখানে হিকমত হচ্ছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাত। তিনি বলেন, এখানে হিকমত অর্থ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাত ব্যতীত অন্য কিছু করা জায়েজ হবে না। কেননা উহা কিতাবের কথা উল্লেখ করার সাথে সাথেই উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের আনুগত্যের সাথে সাথে তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করা মানুষের উপর ফরয করে দিয়েছেন

৯) হাদীছ ব্যতীত কুরআনের প্রতি আমল করা অসম্ভব:

কুরআন আল্লাহর বাণী। আল্লাহ ইহা নাযিল করেছেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর। তিনি নিজে কুরআনের প্রতি আমল করেছেন এবং কিভাবে আমল করতে হবে তা তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে শিখিয়েছেন। সুতরাং কুরআনের প্রতি আমল করতে চাইলে নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট থেকেই জানতে হবে তিনি কিভাবে এই কুরআনের প্রতি আমল করেছেন। তাঁর অনুসরণ না করলে কখনই কুরআন পুরাপুরি রূপে বুঝা যাবে না এবং আমলও করা যাবে না। কেননা কুরআনের প্রতিটি কথার বিবরণ ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব আল্লাহ্‌ তাআলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে দিয়েছেন। তিনি বলেন,

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ

“নিশ্চয় আমি আপনার নিকট জিকির (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে করে আপনি বিশদভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা করে দেন যা তাদের নিকট নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহাল: ৪৪)

আয়েশা সিদ্দীকা (রাHappy বলেন, “তাঁর চরিত্র ও জীবনী ছিল কুরআন।” অর্থাৎ কুরআন পাঠ করার সাথে তাঁর জীবনী পাঠ করলে এবং তাঁর হাদীছ পাঠ করলে কিভাবে তিনি কুরআনের প্রতি আমল করেছেন তা বাস্তব ভাবে বুঝা যাবে।

আইয়ুব সুখতিয়ানী থেকে বর্ণিত। জনৈক ব্যক্তি মুতাররেফ বিন আবদুল্লাহ বিন শিখ্খীরকে বলল, কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু আমাদের নিকট বর্ণনা করবেন না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমরা কুরআনের বিপরীতে কিছু চাই না। কিন্তু আমরা তাঁকে চাই যিনি কুরআন সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখতেন।” (ইবনে আবদুল বার্ জামে বায়ানুল ইলম ২/১১৯৩)

অতএব রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সম্পূর্ণ জীবনীর অনুসরণ না করে বাহ্যিকভাবে কুরআন মানার দাবী করা হলেও, মূলত: তা অমান্য করারই শামিল। কেননা তাঁর জীবনী আমাদের আদর্শ। (আহযাব: ৩২) তাঁকে অনুসরণ করলেই আমরা সঠিক হেদায়াত লাভ করব। (বাকারা: ১৩৫) তাঁকে অনুসরণ করলে আল্লাহকেই অনুসরণ করা হয়। (নিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: ৮০) তাঁকে অনুসরণ করলে আল্লাহ্‌ আমাদের ভালবাসবেন এবং আমাদের গুনাহ মাফ করে দিবেন। (আল ইমরান: ৩১)

১০) হাদীছ না মানলে কুরআনকে যথাযথভাবে মানা হয় না:

(১) সালাত: মুসলমানের উপর সবচেয়ে বড় ফরয ইবাদত। এই ইবাদত কার উপর, কোন কোন সময়, দিনে-রাতে কতবার, কত রাকাত, কি পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, রুকু-সিজদার নিয়ম ইত্যাদি কোন কিছুই কুরআনে উল্লেখ হয় নি। সালাতের জন্যে কি পদ্ধতিতে কি শব্দ উচ্চারণ করে আহ্বান করতে হবে? মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার জানাযা সালাত কি পড়তে হবে? দু’ঈদের সালাত বলতে কি কিছু আছে? এগুলো নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ থেকেই জানতে হবে।

(২) যাকাত: ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। কোন ধরণের সম্পদ,কি পরিমাণ, কত দিন কাছে থাকলে, কি পরিমাণ যাকাত বের করতে হবে। উট, গরু, ছাগল, শস্য, স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি সম্পদের যাকাতের বিস্তারিত বিবরণ কি? রমাযান শেষে যাকাতুল ফিতর দিতে হবে কি না? ইত্যাদি হাদীছ থেকে জানতে হবে।

(৩) পবিত্রতা: পবিত্রতার ক্ষেত্রে কুরআনে কিছুটা বিস্তারিত থাকলেও নারীদের ঋতু অবস্থায় তার সাথে কি আচরণ করতে হবে তার বিবরণ হাদীছ থেকে নিতে হবে। কুরআনের বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী ঐ অবস্থায় ঋতুবতীর সাথে উঠা-বসা, পানাহার, কথা বলা, শুয়ে থাকা, স্পর্শ করা কোন কিছুই করা যাবে না (২:২২২)। কিন্তু হাদীছ বলেছে, ঐ অবস্থায় শুধুমাত্র সহবাস ব্যতীত সবকিছু করা যাবে।

(৪) হজ্জ: ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। জীবনে কয়বার হজ্জ ফরয? ইহরাম কিভাবে করতে হবে, কাবা ঘরের তওয়াফ কিভাবে, কয়বার করতে হবে? কিভাবে কতবার সাফা-মারওয়া সাঈ করতে হবে, মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা, কুরবানী করতে হবে? ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ হাদীছ থেকেই নিতে হবে।

(৫) সিয়াম: এ সম্পর্কে কিছু মাসআলা কুরআনে থাকলেও বিস্তারিত বিবরণ হাদীছ থেকেই নিতে হবে।

(৬) চুরির শাস্তি: চোরের হাত করতে হবে কুরআনে আছে। কিন্তু কি পরিমাণ সম্পদ চুরি করলে হাত কাটা যাবে আর কি পরিমাণে হাত কাটা যাবে না তার বিবরণ হাদীছ থেকে নিতে হবে। কেননা ১টাকা চুরি করা আর ১ লক্ষ টাকা চুরি করার অপরাধ কিন্তু একই। উভয় ক্ষেত্রে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হবে। কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই এক সমান হবে না। তাছাড়া হাত কাটলে কি পরিমাণ কাটতে হবে? কব্জি থেকে না কনুই থেকে না সম্পূর্ণ হাত কাটতে হবে?

(৭) মীরাছ: মা অনুপস্থিত থাকলে দাদী মীরাছ পাবে কি না?

(৮) বিবাহ: স্ত্রীর ফুফু অথবা খালাকে বিবাহ করা কি বৈধ? দুগ্ধ সম্পর্কিত কোন্ কোন্ নারীকে বিবাহ করা হারাম ইত্যাদি বিবরণ কুরআনে নেই। আছে হাদীছে।

(৯) মদপান: কুরআনে মদ্যপান হারাম করা হয়েছে। এখন হেরোইন, আফিম, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য কুরআনের কোন আয়াতের মাধ্যমে হারাম করবেন? হাদীছের মূলনীতির মাধ্যমে তা হারাম হবে। “যা বেশী খেলে বা সেবন করলে মাদকতা আসে, তার অল্পটাও হারাম।” (আবু দাউদ)

(১০) মৃত প্রাণী খওয়া: কুরআন বলছে মৃত প্রাণী খওয়া হারাম। কিন্তু হাদীছ বলছে পানির মাছ মৃত হলেও তা খাওয়া হালাল। কুরআনে পশুকুলের মধ্যে শুধু শুকরকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুকুর-শিয়াল, বিড়াল, বাঁদর, বাঘ-ভল্লুক, সাপ-বিচ্ছু, পোকা-মাকড়, কিট-পতঙ্গ, ঈগল, চিল, বাজ, শুকন… ইত্যাদি হারাম হওয়ার ব্যাপারে হাদীছে মূলনীতি বেঁধে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে, “দাঁত দ্বারা শিকার করে এরকম সকল হিংস্র পশু হারাম। আর থাবা দিয়ে শিকার করে এমন প্রত্যেক পাখি হারাম।” (বুখারী ও মুসলিম)

(১১) সালাত কসর করা: কুরআনে সূরা নিসায় (আয়াত ১০১) সফর অবস্থায় শত্রুর ভয় থাকলে সালাতকে কসর করতে বলা হয়েছে; অথচ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয় থাকুক আর না থাকুক উভয় অবস্থায় সালাত কসর করে বলেছেন, “সালাত কসর করা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সদকা, অতএব তোমরা আল্লাহর সদকা গ্রহণ কর।” (মুসলিম)

(১২) পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম ব্যাবহার করা: কুরআন বলে, “কে আল্লাহর সৌন্দর্যকে হারাম করেছে, যা তিনি তার বান্দাদের জন্যে পাঠিয়েছেন? (আরাফ: ৩২) অথচ হাদীছে রাসূলু্ল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরুষদের জন্যে স্বর্ণ ও রেশম ব্যবহারকে হারাম করেছেন। (হাকেম)

এধরণেরে আরও অসংখ্য অগণিত বিষয় আছে যা কুরআনকে সামনে রেখে তার ব্যাখ্যা হাদীছ থেকেই জেনে নিতে হবে।

জনৈক মহিলা ইবনে মাসউদ (রাHappyকে বলল, আপনারা নাকি বলেন, “যে নারীরা (হাতে বা মুখমণ্ডলে) খোদাই করে নকশা করে এবং যারা নকশা করিয়ে নেয়, যে নারীরা ভ্রুর চুল উঠিয়ে নেয় এবং যে নারীরা দাঁত সুন্দর করার জন্যে তাতে ফাঁক সৃষ্টি করে এদের সবাইকে আল্লাহ্‌ লানত করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, সত্য কথা। মহিলাটি বলল, আমি আল্লাহর কিতাব প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করেছি, কিন্তু কোথাও তো একথা পাই নি? ইবনে মাসউদ (রাHappy বললেন, তুমি যদি কুরআন পড়তে তবে তা পেতে। তুমি কি পড়নি আল্লাহর বাণী:

ومَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا

“রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” (হাশরঃ ৭) সে বলল, একথা তো কুরআনে আছে। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে উক্ত কথা বলতে শুনেছি। (বুখারী ও মুসলিম)

অতএব যারা কুরআন মানার দাবী করবে,তাদের হাদীছ না মেনে উপায় নেই। হাদীছ মানলেই কুরআন মানা হবে এবং সত্যিকার অর্থে তারা কুরআনের অনুসারী হবে এবং প্রকৃত মুসলমান হবে।

মজলুম ইমাম বুখারী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে হাদীস লেখার প্রচলন:

হাদীছের অস্বীকারকারীরা ইমাম বুখারী (রহঃ)এর উপর সবচেয়ে বেশী আক্রমণ করে। বলে যে, তিনিই নাকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর মৃত্যুর ২০০/৩০০ বছর পর সবার আগে হাদীছ লিখেছেন এবং মিথ্যা ছড়িয়েছেন! কি দুঃখজনক আশ্চর্য ধরণের মূর্খতা! সত্যিই আপনি মাজলুম হে ইমাম বুখারী! তাতে কি? ওরা তো আপনার পূর্বে নবী-রাসূলদেরকেও মিথ্যাবাদী বলতে ছাড়ে নি, আপনাকে তো বলবেই।

فَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ جَاءُوا بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ وَالْكِتَابِ الْمُنِيرِ

“তাছাড়া এরা যদি তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তবে তোমার পূর্বেও এরা এমন বহু নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, যারা নিদর্শন সমূহ নিয়ে এসেছিলেন এবং এনেছিলেন সহীফা ও প্রদীপ্ত গ্রন্থ। (সূরা আলে ইমরান: ১৮৪)

যে ইমাম বুখারী হাদীছ সংকলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন, বিশুদ্ধ হাদীছ সংগ্রহ করতে সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছেন। সেই ইমাম বুখারী (রহঃ) আজ মিথ্যা অপবাদে আক্রান্ত। ইসলামের শত্রুরা এরূপই বলে থাকে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে হাদীস লেখার প্রচলন:

আমি এখানে উল্লেখ করব যে ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম হাদীছ সংকলন করেননি বা লিপিবদ্ধ করেন নি; বরং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যুগেই কিছু কিছু হাদীছ লিপিবদ্ধ শুরু হয়েছিল। যেমনটি তিনি নিজেই হাদীছ সংরক্ষণ করার তাগিদও দিয়েছিলেন।

তিনি বিদায় হজ্জে ভাষণ দেয়ার পর বলেছিলেন, আমার এই কথাগুলো যারা উপস্থিত তারা অনুপস্থিত লোকদের নিকট যেন পৌঁছে দেয়। (বুখারী ও মুসলিম)

জুবাইর বিন মুততেম (রাHappy থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জে, মিনার মসজিদে খায়ফে আমাদের সম্মুখে বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন:

مَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لا فِقْهَ لَهُ ، وَرُبُّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ

“আল্লাহ সেই বান্দাকে উজ্জ্বলতা দান করুন, ‍যে আমার কথা শুনেছে, মুখস্থ করেছে ও ধারণ করে রেখেছে। অতঃপর যারা তা শুনে নি তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কেননা কতক জ্ঞান বহনকারী, নিজে জ্ঞানী নয়। আর কতক জ্ঞান বহনকারী ব্যক্তি তার চেয়ে বেশী জ্ঞানীর নিকট তা পৌঁছিয়ে থাকে।” (ত্বাবরানী)

১) আবু হুরাইরা (রাHappy বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাহাবীদের মধ্যে আমার চেয়ে বেশী কেউ হাদীছ বর্ণনা করেন নি। তবে আবদুল্লাহ বিন আমরের কথা ভিন্ন। কারণ তিনি হাদীছ লিখে রাখতেন, আর আমি লিখতাম না। (সহীহ্ বুখারী, ১/১৯৩)

২) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের পর একটি ভাষণ দিলেন এবং মুসলিম জাতির জন্যে কিছু বিধি-বিধান আলোচনা করলেন। তাঁর ভাষণ শেষ হলে আবু শাহ্ নামে জনৈক ব্যক্তি যে ইয়েমেনে থেকে এসেছিল বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এগুলো লিখে দিন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বললেন, اكْتُبُوا لِأَبِي شَاهٍ তোমরা আবু শাহকে হাদীছ লিখে দাও।(বুখারী ৮/২৯৩, হা/২২৫৪)

৩) আবু জুহাইফা বলেন, আমি আলী (রাHappyকে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর কিতাব ব্যতীত কোন কিতাব কি আপনাদের নিকট আছে? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব ব্যতীত কোন কিতাব আমার নিকট নেই। তবে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান যা কোন মুসলমানকে আল্লাহ দিয়েছে এবং এই সহীফা (দফতর)এর ভিতর যা লিখা আছে। আমি বললাম, সহীফাতে কি লিখা আছে? তিনি বললেন, রক্তপণ, বন্দী মুক্তির নিয়ম, আরও লিখা আছে, কাফেরকে হত্যা করার কারণে মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না।

৪) বুখারীর অন্য বর্ণনায় আলী (রাHappy থেকে আরও উল্লেখ আছে, সহীফাতে আরও লিখা আছে কেউ কাউকে জখম করলে তার বিচার কি পন্থায় করতে হবে, উটের বয়স কত হলে যাকাত দিতে হবে, মদীনা শরীফের হারাম এলাকার সীমানা কতদূর? কোন মুসলমান যদি কাউকে নিরাপত্তা দেয় তার বিধান কি? আর ঐ নিরাপত্তা লঙ্ঘন করলে তার করণীয় কি? ইত্যাদি। (দীর্ঘতার ভয়ে পূরা হাদীছটি উল্লেখ করলাম না) (দ্রঃ বুখারী ১/১৯১,হা/১০৮ ও ১০/৪৩৪ হা/২৯৩৬ হাদীছটি আরও বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম, হা/১৩৭০। ইমাম আহম)

৫) ইমাম আহমাদ এবং হাকেম আরও বর্ণনা করেছেন যে, আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রাHappyএর নিকট একটি কিতাব ছিল, যা তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট থেকে লিখে রেখেছিলেন। ঐ কিতাবটির নাম ছিল ‘সাহীফা সাদেকা। (ঐ)

এই সকল বর্ণনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, সাহাবীয়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীছ লিপিবদ্ধ করতেন। তাঁদের মধ্যে আলী (রাHappy আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস, জাবের বিন আবদুল্লাহ (রাHappy অন্যতম। এছাড়া আরও অনেক সাহাবী হাদীছ লিখে রেখেছিলেন। তাদের প্রত্যেকের নিকট সহীফা ছিল।

বিশিষ্ট গবেষক ও মুহাদ্দিস মুহাম্মদ মোস্তফা আযামী ‘দেরাসাহ্ ফীল হাদীছ আন্‌ নববী ওয়া তারিখে তাদভীনেহী’ (পৃঃ ৯২-১৪২) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রায় ৫২জন সাহাবী হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈদের মধ্যেও অনেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তাদের নিকট সহীফা ছিল। আর তাঁদের সংখ্যা প্রায় ১৫২ ছিল।

হাদীছ না লিখার দলীল:

বিরুদ্ধবাদীরা হাদীছ লিপিবদ্ধ না করা সংক্রান্ত একটি হাদীছ পেয়ে খুবই লাফালাফি করে বলে যে হাদীছ লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীছটি নিম্নরূপ:

আবু সাঈদ খুদরী (রাHappyবলেন,রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “তোমরা আমার নিকট থেকে কোন কিছু লিখিও না। যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখবে সে যেন তা মিটিয়ে দেয়। আর তোমরা আমার নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা কর অসুবিধা নেই। যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা রোপ করবে সে তার ঠিকানা জাহান্নামের নির্ধারণ করে নিবে।” (মুসনাদে আহমাদ, ১৭/৪৪৩ হা/১১৩৪৪, মুসলিম ১৪/২৯১)

তাদের দাবী যেহেতু এই হাদীছে কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখা নিষেধ করা হয়েছে, সুতরাং পরবর্তী যুগেও হাদীছ লিখা নিষেধ। তারা যে হাদীছটিকে তাদের মতের পক্ষের পায়, সেটি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়। তাদের নিকট এই হাদীছটি যদি সত্য বলে গণ্য হয়, তবে উপরে উল্লেখিত হাদীছগুলোও সত্য। মতের পক্ষে কিছু পাওয়া গেলে গ্রহণ করতে হবে, আর বিপক্ষের সঠিক কথা গেলেও তা গ্রহণ করা যাবে না, এটা তো সুবিধাবাদীদের নীতি।

কিন্তু সঠিক নীতি হল, সবগুলো হাদীছের প্রতি আমল করতে চাইলে উভয় ধরণের হাদীছের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাদীছগুলো বলা হয়েছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।

এখানে তিন ধরণের সমাধান উল্লেখ করা যেতে পারে:

প্রথমত: প্রাধান্য দেয়া। অনুমতি সংক্রান্ত হাদীছগুলোকে নিষেধের হাদীছের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা হাফেয ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম বুখারী ও আবু দাউদ এই হাদীছের একজন রাবী ‘হাম্মাম’ হাদীছটিকে মারফূ’ সূত্রে বর্ণনা করে ভুল করেছেন। হাদীছটি মাওকূফ হিসেবেই সঠিক। অর্থাৎ ইহা আবু সাঈদ খুদরী (রাHappyএর কথা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কথা নয়। তখন আর কোন সমস্যা থাকে না। হাদীছ লিখার অনুমতির ক্ষেত্রে যে মারফূ’ হাদীছ সমূহ আছে তাই প্রাধান্য পাবে।

দ্বিতীয়ত: রহিত। অর্থাৎ হাদীছ লিখার অনুমতি সংক্রান্ত হাদীছ দ্বারা নিষিদ্ধতার হাদীছ রহিত হয়ে গেছে। কেননা অনুমতি সংক্রান্ত হাদীছগুলো পরের। অর্থাৎ বিদায় হজ্জের সময়ের, যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর তিরোধানের অল্পকিছু দিন পূর্বে ছিল।

তৃতীয়ত: সামঞ্জস্য বিধান। ইমাম বাইহাকী বলেন, সম্ভবত: ভুলে যাওয়া যে সকল সাহাবীর ব্যাপারে আশংকা করা হয়েছিল তাদেরকে লিখতে অনুমতি দিয়ো হয়েছে। আর যার স্মরণ শক্তি দৃঢ় তাকে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। অথবা যারা কুরআন থেকে হাদীছকে পার্থক্য করতে পারবে না বা যাদের কাছে কুরআন ও হাদীছ সংমিশ্রণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাদেরকে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। আর যাদের ক্ষেত্রে ঐ সম্ভাবনা নেই তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।

ইমাম যারকাশী সামঞ্জস্য বিধানের আরও কয়েকটি মত উল্লেখ করেছেন:

(১) নিষেধের হাদীছ শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবদ্দশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা রহিত করণ তখনও হতেই ছিল। তখন হাদীছ লিখলে রহিত কারী হাদীছ ও রহিত কৃত হাদীছ সংমিশ্রিত হয়ে যাবে, তাই নিষেধ করা হয়েছিল। দেখুন না, বিদায় হজ্জের খুতবায় ‘আবু শাহ’ নামক লোকটিকে হাদীছ লিখে দিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে।

(২) নিষেধের কারণ ছিল, যাতে করে লিখক শুধু হাদীছের লিখিত বস্তুর উপর ভরসা করবে, ফলে মুখস্থ করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।

(৩) যাতে করে কুরআনের সমতুল্য আরেকটি কিতাব না রাখা হয়। তাই নিষেধ করা হয়েছিল।

এই মতবিরোধ শুধু প্রথম যুগের জন্যে প্রযোজ্য ছিল। পরবর্তীতে উম্মতে মুসলিমার সকলেই হাদীছ লিপিবদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত পোষণ করেন।

তাই গ্রন্থাকারে ইমাম মালিক (রহঃ) সর্বপ্রথম হাদীছের গ্রন্থ লিখেছেন, যা ‘মুআত্বা’ নামে মুসলমান সমাজে পরিচিত। আজ পর্যন্ত সেই কিতাব মুসলমানদের নিকট নির্ভরযোগ্য সমাদৃত হাদীছ গ্রন্থ। তিনি ৯৩হিঃ সনে জন্ম গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মের প্রায় একশত বছর পূর্বে। আর ইমাম মালিক ‘রাবীয়া’র নিকট থেকে হাদীছ নিয়েছেন। যিনি মৃত্যু বরণ করে ১৩৬ হি: সনে। রাবীয়া অসংখ্য সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের থেকে হাদীছ নিয়েছিলেন।

ইমাম মালিক ইবনে শিহাব যুহরী থেকেও হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দশের অধিক সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন।

ইমাম মালিক ‘নাফে’ থেকে ৮০টি হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। তিনি বড় তাবেঈদের অন্যতম ছিলেন। তিনি সাহাবী ইবনে ওমার (রাHappyএর তিরিশ বছর খেদমত করেছেন এবং তাঁর নিকট থেকে হাদীছ নিয়েছেন। নাফে আরও হাদীছ নিয়েছেন আবু সাঈদ খুদরী, আয়েশা, উম্মে সালামা, আবু হুরাইরা (রাHappy প্রমুখ থেকে। নাফে’ মদীনায় মৃত্যু বরণ করেন ১৫৯হিজরিতে। অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মের ২৫বছর পূর্বে।

পঞ্চম খলীফা নামে পরিচিত ওমার বিন আবদুল আযীয যখন খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১০১ হিজরিতে অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মের ৯৩ বছর পূর্বে, তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর হাদীছ সংগ্রহের জন্যে অধ্যাদেশ জারি করেন।

এই আলোচনার পর সত্য উদ্ঘাটন হয়েছে অতএব فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ “সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর গুমরাহী ব্যতীত কিছু বাকী থাকে না।” (সূরা ইউনুস: ৩২) يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ “হে নবী আল্লাহই আপনার জন্যে যথেষ্ট এবং আপনার অনুসরণকারী মু’মিনগণ।” (সূরা আনফালঃ ৬৪)

আফসোস হাদীছ অস্বীকারকারীদের জন্যে তারা বলল না:سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ “শুনলাম ও মানলাম, তোমার ক্ষমা চাই হে আমাদের পালনকর্তা, তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।” (২:২৮৫) বরং তারা বলল سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا وَاسْمَعْ غَيْرَ مُسْمَعٍ وَرَاعِنَا لَيًّا بِأَلْسِنَتِهِمْ وَطَعْنًا فِي الدِّينِ “শুনলাম ও অমান্য করলাম, আরও বলে শোন, না শোনার মত। আর তারা স্বীয় জিহ্বা কুঞ্চিত করে ও ধর্মের প্রতি দোষারোপ করে বলে ‘রয়েনা’। (৪:৪৬

লেখক: শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী

সম্পাদক: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী

ইসলামে সুন্নাহ’র অবস্থান

নিশ্চয় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দীনসহ সুসংবাদদানকারী, সতর্ককারী ও উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে এমন সময় প্রেরণ করেছেন, যখন রাসূল প্রেরণের বিরতিকাল চলছিল এবং হেদায়াত পাওয়ার সকল পথ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল; অতঃপর তিনি তার মাধ্যমে অজ্ঞতার অন্ধকারকে আলোকিত করেছেন এবং ভ্রষ্টতা থেকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন; আর তিনি সবকিছু স্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর উম্মতকে সমুজ্জ্বল পথের উপর রেখে গেছেন, তার রাত্রি যেন দিনের আলোর মত; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إنى تارك فيكم ما إن تمسكتم به لن تضلوا بعدى كتاب الله و سنتي .» ( أخرجه الإمام مالك )

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে পার, তবে আমার পরে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না, তা হল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ বা জীবনপদ্ধতি।”[2] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

« ... فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ.» (أخرجه أبو داود) .

“... কারণ, তোমাদের মধ্য থেকে যে আমার পরে জীবনযাপন করবে (বেঁচে থাকবে), সে অচিরেই বহু ধরনের মতবিরোধ দেখতে পাবে; সুতরাং তোমাদের উপর আমার সুন্নাত এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের উপর অবিচল থাকা অপরিহার্য। তোমরা তা শক্তভাবে আঁকড়িয়ে ধরে থাকবে। সাবধান! তোমরা নতুন উদ্ভাবিত জিনিস (বিদ‘আত) পরিহার করবে। কারণ, প্রত্যেক বিদ‘আতই গুমরাহী।”[3]

এই বরকতময় অধিবেশনে আপনাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ চায়তো আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করব, তা হল: ‘সুন্নাতে নববী ও ইসলামে তার অবস্থান’।

আভিধানিক অর্থে সুন্নাত: সুন্নাত ( السنة ) শব্দটি আভিধানিক অর্থে তরিকা বা পদ্ধতি অর্থে ব্যবহৃত; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ فَهَلۡ يَنظُرُونَ إِلَّا سُنَّتَ ٱلۡأَوَّلِينَۚ فَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ ٱللَّهِ تَبۡدِيلٗاۖ وَلَن تَجِدَ لِسُنَّتِ ٱللَّهِ تَحۡوِيلًا ٤٣ ﴾ [فاطر: ٤٣]

[তবে কি এরা প্রতীক্ষা করছে পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রযুক্ত পদ্ধতির? কিন্তু আপনি আল্লাহর পদ্ধতিতে কখনও কোন পরিবর্তন পাবেন না এবং আল্লাহর পদ্ধতির কোন ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করবেন না। - (সূরা ফাতির: ৪৩)]; অর্থাৎ পদ্ধতি অথবা স্বভাব বা রীতি, যার উপর ভিত্তি করে রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী বিরোধীদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার বিধান জারি হয়; সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার বিধান হল: তাদেরকে শাস্তি প্রদান করা এবং তাদের কর্তৃক রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণে তাদেরকে শাস্তির মাধ্যমে পাকড়াও করা।

আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« لتتبعن سنن من كان قبلكم .» ( أخرجه البخاري و مسلم )

“তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতির অনুসরণ করবে।”[4] অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের রীতিনীতি; সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, আভিধানিক অর্থে সুন্নাত ( السنة ) শব্দটি পদ্ধতি বা রীতিনীতিকে বুঝায়।

আর শরীয়তের আলেম, মুহাদ্দিস, উসূলবীদ ও ফকীহগণের পরিভাষায় সুন্নাত ( السنة ) শব্দটি দ্বারা উদ্দেশ্য হল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে স্বীকৃত ও প্রমাণিত কথা, অথবা কাজ, অথবা মৌনসম্মতি; তাঁদের কেউ কেউ আরও একটু বৃদ্ধি করে বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলীকেও সুন্নাত ( السنة ) বলা হয়; সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এসব বিষয় থেকে যা প্রমাণিত হয়, তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত (سنة الرسول) বলা হয়; আর সুন্নাতের এই সংজ্ঞাটি শরী‘য়তের বিষয়ে প্রাজ্ঞ আলেমগণের পক্ষ থেকে প্রদত্ত।

ইসলামে সুন্নাতের গুরুত্ব ও অবস্থান: ইসলামে তার অবস্থান ও মর্যাদা খুবই মহান ও তাৎপর্যপূর্ণ; কারণ, আল-কুরআনের পরেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের (দ্বিতীয়) অবস্থান; কেননা, দীনের প্রথম মূলনীতি হল আল্লাহ তা‘আলার কিতাব, যা তিনি নাযিল করেছেন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর হিদায়াত ও ব্যাখ্যাসহ।

দ্বিতীয় উৎস: শরী‘য়তের দ্বিতীয় উৎস হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ; আর কুরআন ও সুন্নাহ’র পরে যেসব দলিল-প্রমাণ মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃত, সেগুলো এতদুভয়ের দিকেই প্রত্যাবর্তিত; সুতরাং ইসলামে দলিল-প্রমাণসমূহের মূলনীতির ভিত্তি হল এই দু’টি মহান উৎস: তন্মধ্যে একটি হল আল্লাহর কিতাব এবং অপরটি হল তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ; আর এই জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু’টিকে অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন; সুতরাং তিনি বলেন:

« إنى تارك فيكم ما إن تمسكتم به لن تضلوا بعدى كتاب الله و سنتي .» ( أخرجه الإمام مالك )

“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মাঝে এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে পার, তবে আমার পরে তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হবে না, তা হল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ বা জীবনপদ্ধতি।”[5] আর এটা এই জন্য যে, সুন্নাতে নববী হল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক প্রকারের ওহী; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ ﴾ [النجم: ٣، ٤]

“আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরিত হয়।” - (সূরা আন-নজম: ৩, ৪);

সুতরাং সুন্নাহ হল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রেরীত এক ধরনের ওহী, যা তিনি তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন; আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও মানুষের নিকট বিভিন্ন কাজের আদেশ ও নিষেধ করার মাধ্যমে এই ওহী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া সুন্নাহ আল-কুরআনকে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে; অতঃপর তার মোটামুটি ও সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত বিষয়গুলোকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে; তার সাধারণভাবে বর্ণিত বিষয়গুলোকে সুনির্দিষ্ট করে; তার ব্যাপক (‘আম) অর্থে বর্ণিত বিষয়গুলোকে নির্দিষ্ট (খাস) করে; আবার কখনও কখনও তার কোন কোন বিধানকে মানসূখ (রহিত) করে; আবার কখনও কখনও আল-কুরআনের মধ্যে যা বর্ণিত আছে, তার উপর বর্দ্ধিত হুকুম (বিধান) নিয়ে আসে।

আর এখান থেকেই আমাদের নিকট সুন্নাহ’র গুরুত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে; যেমন তা (সুন্নাহ) হল আল-কুরআনের তাফসীর বা ব্যাখ্যা, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤]

“আর তোমার প্রতি যিকির (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।” - (সূরা আন-নাহল: ৪৪); সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআন নাযিল করেছেন এবং তা বয়ান (ব্যাখ্যা) করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি; আর এই বয়ানই (ব্যাখ্যা) হল সুন্নাহ, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهِۦ لِيُبَيِّنَ لَهُمۡۖ ﴾ [ابراهيم: ٤]

“আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।” - (সূরা ইবরাহীম: ৪); সুতরাং এই হল সেই উম্মত (জাতি), যার নিকট তার রাসূল এসেছে তাকে বর্ণনা করে শুনানোর জন্য; সুতরাং এই বয়ান (বর্ণনা)-র কিছু দৃষ্টান্ত হল: আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনের মধ্যে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি বর্ণনা করে দেন নি ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও এশা’র সালাতের রাকাতসমূহের সংখ্যা; বরং আল্লাহ তা‘আলা মোটামুটি সংক্ষিপ্তভাবে তার নির্দেশ দিয়েছেন, যেমন তিনি বলেন:

﴿وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَۖ إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِۗ ﴾ [العنكبوت: ٤٥]

“আর তুমি সালাত প্রতিষ্ঠা কর, নিশ্চয় সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে।” - (সূরা আল-‘আনকাবুত: ৪৫); তিনি আরও বলেন:

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ ﴾ [البينة: ٥]

“আর তাদেরকে কেবল এ নির্দেশই প্রদান করা হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তাঁরই জন্য দ্বীনকে একনিষ্ঠ করে এবং সালাত কায়েম করে।” - (সূরা আল-বায়্যিনাহ: ৫); তিনি আরও বলেন:

﴿ فَإِن تَابُواْ وَأَقَامُواْ ٱلصَّلَوٰةَ ﴾ [التوبة: ٥]

“সুতরাং তারা যদি তাওবা করে এবং সালাত কায়েম করে ...।” - (সূরা আত-তাওবা: ৫); এই প্রসঙ্গে আয়াতের সংখ্যা অনেক; অনুরূপভাবে আল্লাহ্‌ তা‘আলা সালাত কায়েম করার নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তার সময়সমূহ বর্ণনা করে দেন নি, যদিও তিনি সালাতের সময়সমূহ সাধারণভাবে উল্লেখ করেছেন, যেমন তিনি বলেন:

﴿أَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ لِدُلُوكِ ٱلشَّمۡسِ إِلَىٰ غَسَقِ ٱلَّيۡلِ وَقُرۡءَانَ ٱلۡفَجۡرِۖ إِنَّ قُرۡءَانَ ٱلۡفَجۡرِ كَانَ مَشۡهُودٗا ٧٨ ﴾ [الاسراء: ٧٨]

“সূর্য হেলে পরার পর থেকে রাতের ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করবে এবং কায়েম করবে ফজরের সালাত। নিশ্চয়ই ফজরের সালাত (ফেরেশতাদের) উপস্থিতির সময়।” - (সূরা আল-ইসরা: ৭৮); তিনি আরও বলেন:

﴿ فَسُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ حِينَ تُمۡسُونَ وَحِينَ تُصۡبِحُونَ ١٧ وَلَهُ ٱلۡحَمۡدُ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَعَشِيّٗا وَحِينَ تُظۡهِرُونَ ١٨ ﴾ [الروم: ١٧، ١٨]

“কাজেই তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যখন তোমরা সন্ধ্যা কর এবং যখন তোমরা ভোর কর, আর বিকেলে এবং যখন তোমরা দুপুরে উপনীত হও। আর তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা আসমানে ও যমীনে।” - (সূরা আর-রূম: ১৭, ১৮); সুতরাং এই হল সালাতের সময়সমূহের উল্লেখকরণ, তবে তা হল সাধারণ উল্লেখ; আর এই ইজমালী বা সাধারণ বর্ণনাটিকে সুস্পষ্ট করে ব্যাখ্যামূলকভাবে বর্ণনা করেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ; কারণ, তিনি তাঁর সাহবীদেরকে সাথে করে সালাত আদায় করেছেন এবং বলেছেন:

«صلوا كما رأيتموني أصلي » ( أخرجه البخاري )

“তোমরা এমনভাবে সালাত আদায় কর, যেমনিভাবে তোমরা আমাকে সালাত আদায় করতে দেখ।”[6]

এভাবে এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের রাকাতসমূহের সংখ্যা বর্ণনা করে দিয়েছেন; সুতরাং আমরা সালাত আদায় করি, যেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত করেছেন; আমরা যোহরের সালাত আদায় করি চার রাকাত এবং সফরের মধ্যে কসর করে দুই রাকাত আদায় করি; আর আসরের সালাত আদায় করি চার রাকাত এবং সফরের মধ্যে কসর করে দুই রাকাত আদায় করি; আর মাগরিবের সালাত আদায় করি তিন রাকাত সফরের মধ্যে এবং বাসস্থানে অবস্থানকালীন সময়ে, তাতে কসর করা হয় না; আর এশা’র সালাত আদায় করি চার রাকাত এবং সফরের মধ্যে কসর করে দুই রাকাত আদায় করি; আর ফজরের সালাত আদায় করি দুই রাকাত সফরের মধ্যে এবং বাসস্থানে অবস্থানকালীন সময়ে। আর সালাতের ওয়াক্ত বা সময়সমূহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করে দিয়েছেন, যখন তিনি যোহরের সালাত আদায় করেছেন তার জন্য নির্ধারিত সময়ে, আসরের সালাত আদায় করেছেন তার জন্য নির্ধারিত সময়ে, মাগরিবে সালাত আদায় করেছেন তার জন্য নির্ধারিত সময়ে, এশা’র সালাত আদায় করেছেন তার জন্য নির্ধারিত সময়ে এবং ফজরের সালাত আদায় করেছেন তার জন্য নির্ধারিত সময়ে, যেমনটি সাব্যস্ত হয়েছে বিশুদ্ধ (সহীহ) হাদিসের মধ্যে: জিবরাঈল আ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সালাতের ইমামতি করেছেন (দুই দিন) সালাতের প্রথম সময়ে ও শেষ সময়ে এবং তিনি বলেছেন:

« الصلاة بين هذين الوقتين . » ( أخرجه أبو داود و الترمذي )

“সালাতের সময় হচ্ছে এই দুই সময়ের মাঝামাঝি।”[7] সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য সালাতের রাকাত সংখ্যা, পদ্ধতি ও সময় বর্ণনা করেছেন; আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ব্যতীত আমরা সালাতের পদ্ধতি ও সময় সম্পর্কে জানতে পারব না, যদিও আমরা তার আবশ্যকতা সম্পর্কে আল-কুরআনুল কারীম থেকে জানতে পেরেছি; যা আমাদেরকে নির্দেশনা প্রদান করে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা বয়ান (ব্যাখ্যা) করার দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, তা হল কথা ও কাজের মাধ্যমে বয়ান বা ব্যাখ্যা করা; আর এ জন্যই যখন খারেজী সম্প্রদায়ের যারা সুন্নাহকে অস্বীকার করে, তাদের মধ্য থেকে এক দল ওমর ইবন আবদুল আজিজ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু’র নিকট আসল এবং তারা তাঁর সাথে সুন্নাহ’র মাধ্যমে প্রমাণ পেশের আবশ্যকতার প্রশ্নে বিতর্ক করল, তখন ওমর ইবন আব্দিল আযীয রাহেমাহুল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন:

" الله جل و علا أمرنا بالصلاة في القرآن فكيف نصلي؟ هاتوا لي آية من القرآن تبين كيفية الصلاة "

(আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আল-কুরআনের মধ্যে সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন, সুতরাং আমরা কিভাবে সালাত আদায় করব? তোমরা আমার নিকট আল-কুরআন থেকে একটি আয়াত নিয়ে আস তো, যা সালাত আদায়ের পদ্ধতি বর্ণনা করে।) অতঃপর তারা স্তম্ভিত হয়ে গেল এবং তাদের বিতর্ক থেমে গেল; আর তিনি তাদেরকে সুন্নাহ’র মাধ্যমে প্রমাণ পেশের আবশ্যকতাকে মেনে নিতে বাধ্য করলেন।

আর সালাতের দৃষ্টান্তের মত যাকাতের বিষয়টিও: আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে যাকাত দানের নির্দেশ দিয়েছেন; অতঃপর আমরা কিভাবে ঐ সম্পদ সম্পর্কে জানতে পারব, যাতে যাকাত আবশ্যক হবে? সুন্নাহ ব্যতীত এই সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে না; আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছেন; নিশ্চয়ই তা আবশ্যক হবে স্বর্ণ, রৌপ্য, শস্য, ফলমূল, চতুষ্পদ জন্তু এবং ব্যবসায়ীক পণ্যে এবং তা প্রত্যেক মাল-সম্পদে ওয়াজিব (আবশ্যক) হবে না; বরং তা ওয়াজিব হবে শস্য, ফলমূল, নগদ টাকাপয়সা ও মুক্তভাবে বিচরণশীল চতুষ্পদ জন্তুর মত বর্দ্ধনশীল সম্পদের মধ্যে, যেমনিভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাতের ক্ষেত্রে কি পরিমাণ গ্রহণ করা হবে, তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ: উৎপাদন উপকরণ সরবরাহ করা বা না করার বিবেচনায় শস্য, ফলমূল ও জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের যাকাত হিসেবে উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ (ওশর) অথবা বিশ ভাগের একভাগ ( نصف العشر ) গ্রহণ করা হবে।

আর স্বর্ণ ও রৌপ্য থেকে গ্রহণ করা হবে চল্লিশ ভাগের একভাগ বা শতকরা ২.৫%।

আর ছাগলের ক্ষেত্রে প্রতি চল্লিশটি ছাগলের জন্য একটি ছাগল যাকাত হিসেবে দিতে হবে এবং অনুরূপভাবে নেসাবের সাথে সংশ্লিষ্ট বাকি সংখ্যার মধ্যেও (প্রতি চল্লিশটির জন্য একটি হারে) এই বিধান প্রযোজ্য হবে।

আর উটের যাকাতের ক্ষেত্রেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নেসাব বর্ণনা করে দিয়েছেন; সুতরাং পাঁচটি উটের ক্ষেত্রে একটি ছাগল যাকাত হিসেবে দিতে হবে; আর দশটির ক্ষেত্রে দু’টি ছাগল যাকাত হিসেবে দিতে হবে; আর পনেরটির ক্ষেত্রে তিনটি ছাগল যাকাত হিসেবে দিতে হবে; আর বিশটির ক্ষেত্রে চারটি ছাগল যাকাত হিসেবে দিতে হবে; আর পঁচিশটির ক্ষেত্রে একটি এক বছর বয়সী উট যাকাত হিসেবে দিতে হবে; আর ছত্রিশটি উটের ক্ষেত্রে একটি দুই বছর বয়সী উট যাকাত হিসেবে দিতে হবে; আর অনুরূপভাবে উটের যাকাতের অবশিষ্ট নেসাবের মধ্যে যাকাত হিসেবে যা আবশ্যক হবে, তা দিতে হবে; যেমনিভাবে তিনি যাকাতের ক্ষেত্রে যাকাত হিসেবে আবশ্যকীয় উটের বয়স বর্ণনা করে দিয়েছেন; সুতরাং যদি হাদিসে নববী’র অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে আমরা জানতে পারতাম না যে, কিভাবে আমরা যাকাত দেব, যদিও আমরা আল-কুরআন থেকে যাকাতের আবশ্যকতার বিষয়ে জানতে পেরেছি; কিন্তু সুন্নাহ যাকাতের পরিমাণ এবং যাকাতযোগ্য মালের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করে দিয়েছে, যেমনিভাবে সুন্নাহ সুস্পষ্টভাবে সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে, যাতে যাকাত ওয়াজিব (আবশ্যক) হবে; কারণ, কোন মালের উপর ততক্ষণ পর্যন্ত যাকাত আবশ্যক হবে না, যতক্ষণ না তার উপর এক বছর অতিবাহিত হবে; তবে জমিন থেকে উৎপাদিত ফসলের উশরের ব্যাপারটি ভিন্ন; সুতরাং তাতে যাকাত ওয়াজিব (আবশ্যক) হবে, যখন তার উপযুক্ততা প্রকাশ পায়; যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَءَاتُواْ حَقَّهُۥ يَوۡمَ حَصَادِهِۦۖ ﴾ [الانعام: ١٤١]

“আর ফসল তোলার দিন সে সবের হক প্রদান করে দাও।” - (সূরা আল-আন‘আম: ১৪১)।

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা রমযান মাসে সিয়াম (রোযা) পালনের নির্দেশ দিয়েছেন, আর তা হচ্ছে ইসলামের অন্যতম একটি রুকন; কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা সিয়ামের সীমারেখা বর্ণনা করেন নি এবং আরও বর্ণনা করেন নি তা বিনষ্টকারী ও বাতিলকারক বিষয়সমূহ; আর ঐসব বিষয়গুলোও বর্ণনা করেন নি, যেগুলো সিয়াম পালনকারীকে (রোযাদারকে) বর্জন করে চলতে হবে; আর সুন্নাতে নববী এসব বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে এসেছে।

অনুরূপভাবে সম্মানিত ঘর বাইতুল্লাহ’র উদ্দেশ্যে হজ্জের বিষয়টিও; আল্লাহ তা‘আলা তার আবশ্যকতার বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ ﴾ [ال عمران: ٩٧]

“আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্জ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য।” - (সূরা আলে ইমরান: ৯৭); সুতরাং এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে, বাইতুল্লায় হজ্জ করাটা আবশ্যকীয় বিষয়, কিন্তু আয়াতটি তার সময় ও পদ্ধতি স্পষ্ট করে কিছুই বলে নি; আর এই হজ্জ আদায়ের পদ্ধতি সামগ্রিকভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করে দিয়েছেন, যখন তিনি জনসাধারণকে নিয়ে বিদায় হজ্জ পালন করেন এবং তিনি বলেছেন:

« خذوا عني مناسككم. » ( أخرجه مسلم )

“তোমরা আমার নিকট থেকে তোমাদের হজ্জ আদায়ের পদ্ধতি গ্রহণ কর।”[8] অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জ আদায়ের পদ্ধতিসমূহ একটি একটি করে বর্ণনা করে দিয়েছেন এবং তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে আমরা তাঁর নিকট থেকে পদ্ধতিসমূহ গ্রহণ করি, যেমনটি আমাদের জন্য বর্ণনা করেছেন এমন বর্ণনাকারী, যিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজের মধ্য থেকেই হজ্জ আদায়ের পদ্ধতিসমূহ প্রত্যক্ষ করেছেন।

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা চোরের হাত কেটে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন; সুতরাং তিনি বলেন:

﴿ وَٱلسَّارِقُ وَٱلسَّارِقَةُ فَٱقۡطَعُوٓاْ أَيۡدِيَهُمَا جَزَآءَۢ بِمَا كَسَبَا نَكَٰلٗا مِّنَ ٱللَّهِۗ ﴾ [المائ‍دة: ٣٨]

“আর পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের উভয়ের হাত কেটে দাও; তাদের কৃতকর্মের ফল ও আল্লাহর পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হিসেবে।” - (সূরা আল-মায়িদা: ৩৮) ...; কিন্তু হাত কাটার জন্য অনেকগুলো শর্ত রয়েছে, যেগুলো আল-কুরআনের মধ্যে উল্লেখ করা হয় নি; আর সুন্নাহ সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ নিয়ে এসেছে, যেমন সুন্নাহ বর্ণনা করে দিয়েছে যে, চোরের হাত কাটা যাবে না, যতক্ষণ না সে নেসাব পরিমাণ সম্পদ চুরি করবে, আর তা হল এক দিনারের এক চতুর্থাংশ অথবা তিন দিরহাম অথবা তার সমমূল্য মানের সম্পদ; আর আয়াতটি হাতের[9] বিষয়টিও স্পষ্ট করে নি এবং চুরির ক্ষেত্রে হাতের কোন জায়গায় কাটা হবে, তাও স্পষ্ট করে বলা হয় নি; কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, আর তা হল, ডান হাতের তালুর গ্রন্থি থেকে কাটা হবে, আর তাকে কবজির হাঁড় বলা হয়।

এখানে অনুসন্ধান করার মাধ্যমে আল-কুরআনের ব্যাখ্যায় সুন্নাহ’র অনুসরণের সবকিছু লেখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়; আমরা তো শুধু এর কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছি মাত্র; নতুবা আল-কুরআনের ব্যাখ্যায় সুন্নাহ’র অনুসরণের বহু বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে।

আর আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল; সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ ﴾ [النساء: ٨٠]

“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।” - (সূরা আন-নিসা: ৮০); রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য মানে তাঁর নিকট থেকে সুন্নাহ হিসেবে যা প্রমাণিত, তা মেনে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করা; আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ ﴾ [الحشر: ٧]

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক” - (সূরা আল-হাশর: ৭); সুতরাং আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যেসব আদেশ, নিষেধ ও শরী‘য়ত দান করেছেন, তা যাতে আমরা যথাযথভাবে গ্রহণ করি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যেসব বিষয় থেকে নিষেধ করেছেন, তা থেকে যেন আমরা বিরত থাকি।

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের নির্দেশ এসেছে;

· কখনও আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের সাথে তাঁর আনুগত্য করাকে সংযুক্ত করে দেন, যেমন তিনি বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ ﴾ [النساء: ٥٩]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের।” - (সূরা আন-নিসা: ৫৯); তিনি আরও বলেন:

﴿ قُلۡ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَۖ ﴾ [ال عمران: ٣٢]

“বল, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর।” - (সূরা আলে ইমরান: ৯৭); সুতরাং তিনি তাঁর আনুগত্য করার আবশ্যকতার সাথে তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার আবশ্যকতাকে মিলিয়ে দিয়েছেন।

· আবার কখনও কখনও আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার বিষয়টি এককভাবে উল্লেখ করেছেন; যেমন তিনি বলেন:

﴿ مَّن يُطِعِ ٱلرَّسُولَ فَقَدۡ أَطَاعَ ٱللَّهَۖ ﴾ [النساء: ٨٠]

“কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে, সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল।” - (সূরা আন-নিসা: ৮০); আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ٥٦ ﴾ [النور: ٥٦]

“আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের উপর রহমত করা যায়।” - (সূরা আন-নূর: ৫৬); আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذۡنِ ٱللَّهِۚ ﴾ [النساء: ٦٤]

“আল্লাহর অনুমতিক্রমে কেবলমাত্র আনুগত্য করার জন্যই আমরা রাসূলদের প্রেরণ করেছি।” - (সূরা আন-নিসা: ৬৪)।

· যেমনিভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সময় তাঁর কিতাব আল-কুরআন ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ’র দিকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছেন; সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَأُوْلِي ٱلۡأَمۡرِ مِنكُمۡۖ فَإِن تَنَٰزَعۡتُمۡ فِي شَيۡءٖ فَرُدُّوهُ إِلَى ٱللَّهِ وَٱلرَّسُولِ إِن كُنتُمۡ تُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلًا ٥٩ ﴾ [النساء: ٥٩]

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর, আরও আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের, অতঃপর কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপন কর আল্লাহ ও রাসূলের নিকট, যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাক। এ পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।” - (সূরা আন-নিসা: ৫৯);

আর আয়াতে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়ার মানে আল্লাহর কিতাবের দিকে ফিরিয়ে দেয়া; আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ফিরিয়ে দেয়ার মানে তিনি জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় স্বয়ং তাঁর দিকে ফিরিয়ে দেয়া, আর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুন্নাহ’র দিকে ফিরিয়ে দেয়া।

আর আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র দিকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশটি সাধারণভাবে কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী, তার প্রমাণ হল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর তাঁর দিকে ফিরিয়ে দেয়ার মানে তাঁর সুন্নাহ’র দিকে ফিরিয়ে দেয়া; আর এটাই প্রমাণ করে যে, উম্মতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফয়সালার উৎস হল সুন্নাহ, যখন তারা আহকাম তথা বিধানসমূহের কোনো একটি বিধান নিয়ে বিতর্ক করবে, চাই তারা ইবাদতসমূহের মধ্য থেকে কোনো একটি ইবাদত বিষয়ে দীনী বিধানের ব্যাপারে মতবিরোধ করুক, অথবা জনগণের অধিকার প্রশ্নে তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ সৃষ্টি হউক; আর এই ক্ষেত্রে সমাধানের জন্য আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

আর এটা প্রমাণ করে যে, সুন্নাহ হল আল-কুরআনের সঙ্গী; আর তা হল ইসলামী শরী‘য়তের মূলনীতিমালার অন্যতম উৎস, কোনো সময়ে বা কোনো অবস্থাতেই মুসলিমগণ তা থেকে অমনোযোগী হবে না।

আর যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র বিরুদ্ধাচারণ করবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদেরকে কঠিন শাস্তির হুমকি প্রদান করেছেন; সুতরাং তিনি বলেন:

﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧ ﴾ [الحشر: ٧]

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।” - (সূরা আল-হাশর: ৭); সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, কোনো কাজের আদেশ অথবা কোনো কাজ থেকে নিষেধের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র বিরোধিতা করবে, সেই ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ فَإِن لَّمۡ يَسۡتَجِيبُواْ لَكَ فَٱعۡلَمۡ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهۡوَآءَهُمۡۚ ﴾ [القصص: ٥٠]

“তারপর তারা যদি আপনার ডাকে সাড়া না দেয়, তাহলে জানবেন তারা তো শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশীরই অনুসরণ করে।” - (সূরা আল-কাসাস: ৫০); আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى, قالوا: يا رسول الله ومن يأبى ؟ قال: من أطاعني دخل الجنة ومن عصاني فقد أبى. » ( أخرجه البخاري )

“যে ব্যক্তি অস্বীকার করে, সেই ব্যক্তি ব্যতীত আমার সকল উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে; সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! কোন ব্যক্তি অস্বীকার করে? তখন তিনি বললেন: যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্য, সে ব্যক্তিই অস্বীকার করে।”[10] সুতরাং যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হয় এবং তাঁর সুন্নাহ’র বিরুদ্ধাচরণ করে, সে ব্যক্তিই জান্নাতে প্রবেশ করতে অস্বীকার করে; আর আবদ্ধ হয় জাহান্নামের প্রচণ্ড হুমকির জালে।

আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

﴿ فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور: ٦٣]

“কাজেই যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” - (সূরা আন-নূর: ৬৩); সুতরাং যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে ব্যক্তি এ‌ই দু’টি বিষয়ের কোন একটির দ্বারা কঠিন হুমকির সম্মুখীন হবে:

প্রথম বিষয়: মানসিকভাবে বিপর্যয়ের শিকার হওয়া; ফলে সে সত্য থেকে বিচ্যুত হবে, ঈমানের পর কুফরী করবে এবং ভ্রষ্টতা ও গোমরাহীর মাধ্যমে তার হৃদয় বিপর্যস্ত হবে; সুতরাং এর পরে সে সত্য পথের সন্ধান পাবে না; কারণ, সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছে; আর এটা পরবর্তীতে উল্লেখিত শাস্তির চেয়েও কাঠিন শাস্তি।

দ্বিতীয় বিষয়: আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ﴾ -এর মধ্যে " عذاب " (শাস্তি) শব্দটির দ্বারা উদ্দেশ্য হল হত্যা, রোগ-ব্যাধি ও ধ্বংসের মাধ্যমে দুনিয়ায় শাস্তি, যা ঐসব কাফিরদের বেলায় প্রযোজ্য হয়েছিল, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। আর দ্বিতীয় শাস্তি হবে আখেরাতে।

যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে, তার জন্য এই দু’টি শাস্তি থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই; দু‘টির একটি শাস্তি হল মানসিক শাস্তি (না‘উযুবিল্লাহ); আর অপর শাস্তিটি হল শারীরিক অথবা আর্থিক শাস্তি; হয় তা হবে মৃত্যু ও ধ্বংসের মাধ্যমে, নতুবা ধন-সম্পদ বিনষ্ট ও জীবনহানির মাধ্যমে; আর এটা হল কঠিন সতর্কবাণী ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করে।

আর আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلٗا مُّبِينٗا ٣٦ ﴾ [الاحزاب: ٣٦]

“আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ের ফয়সালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য সে বিষয়ে তাদের কোন (ভিন্ন সিদ্ধান্তের) ইখতিয়ার সংগত নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করল, সে স্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হল।” - (সূরা আল-আহযাব: ৭); এটা হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পক্ষ থেকে মুমিনের অবস্থার বিবরণ; অতএব সে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান সম্পর্কে জানতে পারবে, তখন তার জন্য ঐ বিষয়ে কোন স্বাধীনতা থাকবে না, যার উপর আমল করা তার উপর ওয়াজিব (আবশ্যক) বলে সাব্যস্ত হয়েছে; বরং সে সন্তুষ্ট চিত্তে উদার মনে খুশি হয়ে তা গ্রহণ করবে; সুতরাং তার জন্য এমন স্বাধীনতা নেই যে, ইচ্ছা করলে সে কাজ করবে, আর ইচ্ছা করলে সে কাজ করবে না; কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সকল নির্দেশই হিদায়াত ও কল্যাণে ভরপুর। সুতরাং সে যদি এই নির্দেশটি কাজে পরিণত না করে এবং ধারণা পোষণ করে যে, এই নির্দেশ পালন করা বা না করার ব্যাপারে তার স্বাধীনতা রয়েছে, তবে সে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে; আর ভ্রষ্টতা ( ضلال ) শব্দটি হিদায়াত ( الهدى ) শব্দের বিপরীত; আর এখানে ভ্রষ্টতা ( ضلال ) শব্দটিকে বিশেষিত করা হয়েছে ‘সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতা (ضلال مبين ) দ্বারা; অর্থাৎ স্পষ্ট বা পরিষ্কার (واضح); কারণ, সে সঠিক পথের বিরোধিতা করেছে; আর সঠিক পথ হল আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ এবং ভ্রষ্টতার পথ হল আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করা।

আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে, তার শাস্তির বর্ণনা করে এমন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল: হাদিসে এসেছে কোনো এক ব্যক্তি তার বাম হাত দ্বারা খাবার গ্রহণ করত; অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার ডান হাত দ্বারা খাবার গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন; অতঃপর লোকটি এতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বলল: আমি সক্ষম নই; বস্তুত তার অহঙ্কারই তাকে সুন্নাহ’র অনুসরণ করতে বাধা দিল; অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (বদদোয়ার সূরে) বললেন:

« لاَ اسْتَطَعْتَ » (তুমি সক্ষম না হও); নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিরুদ্ধে বদদোয়া করলেন; সুতরাং সেই সময়ে তার হাত শুকিয়ে যায় এবং এর পর তার শাস্তিস্বরূপ সে তার হাতকে তার মুখ পর্যন্ত উত্তোলন করতে সক্ষম হয়নি।[11] সুতরাং এই হল তাৎক্ষণিক শাস্তি (না‘উযুবিল্লাহ); অতএব এটা প্রমাণ করে যে, যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র বিরুদ্ধাচরণ করবে, সেই ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে শাস্তির সম্মুখীন হবে (না‘উযুবিল্লাহ)।

আর এর বিপরীত হল ঐ ব্যক্তির ঘটনা, যাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখলেন এমন অবস্থায় যে, তার হাতে স্বর্ণের আংটি রয়েছে; অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:

«يعمد احدكم إلى جمرة من نار فيجعلها في يده»

(তোমাদের কেউ জাহান্নামের জ্বলন্ত অঙ্গারের প্রতি মনোযোগ দেয়, অতঃপর সে তা তার হাতের মধ্যে রাখে); অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গ্রহণ করলেন এবং জমিনের মধ্যে ছুড়ে ফেললেন। তারপর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর মজলিস থেকে দাঁড়ালেন, আর আংটিটি মাটিতে পড়ে আছে এবং তার মালিক উপস্থিত, তখন উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন: তুমি তোমার আংটিটি গ্রহণ করে উপকৃত হও, তখন এই মুমিন ব্যক্তিটি বলল: আল্লাহর কসম! আমি তা গ্রহণ করব না, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুড়ে ফেলেছেন।[12] সুতরাং আনুগত্যের ক্ষেত্রে উভয় ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্য লক্ষ্য করুন; কারণ, প্রথম ব্যক্তি অহঙ্কার করে বলে: আমি পারব না (না‘উযুবিল্লাহ); আর এই ব্যক্তি বলল: ‘আল্লাহর কসম! আমি তা গ্রহণ করব না, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুড়ে ফেলেছেন।’ সুতরাং এটাই হল ঈমান; আর এটাই হল মহান আনুগত্য।

আর আমরা সাহাবীগণ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অপর আরেকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করছি: মুসলিমগণ হিজরতের প্রথম দিকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নির্দেশক্রমে বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করত, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কাবা শরীফের দিকে মুখ করে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিলেন; সুতরাং তিনি বললেন:

﴿ فَوَلِّ وَجۡهَكَ شَطۡرَ ٱلۡمَسۡجِدِ ٱلۡحَرَامِۚ ﴾ [البقرة: ١٤٤]

“অতএব আপনি মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরান।” - (সূরা আল-বাকারা: ১৪৪); অতএব বাইতুল মাকদাসের দিক থেকে কাবা শরীফের দিকে কিবলা পরিবর্তন হয়ে গেল এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নির্দেশক্রমে মুসলিমগণ কাবার দিকে মুখ ফিরালেন; যদিও তারা আল্লাহর নির্দেশেই প্রথম দিকে বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করত, আর সেই নির্দেশটি ছিল এমন:

﴿ قُل لِّلَّهِ ٱلۡمَشۡرِقُ وَٱلۡمَغۡرِبُۚ يَهۡدِي مَن يَشَآءُ إِلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ ١٤٢ ﴾ [البقرة: ١٤٢]

“বলুন, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই। তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথের হিদায়াত করেন।” - (সূরা আল-বাকারা: ১৪২); অতএব তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নিকট কোন আপত্তি বা প্রতিবাদ করে নি; অতঃপর আসমান থেকে কাবা শরীফের দিকে কিবলা পরিবর্তনের বিধান অবতীর্ণ হল, তখনও সাহাবীগণের মধ্য থেকে কিছু লোকজন বাইতুল মাকদাসের দিকে মুখ করে আসরের সালাত আদায় করছিলেন, কেননা তারা কিবলা পরিবর্তনের কথা জানতে পারে নি; অতঃপর সাহাবীগণের মধ্য থেকে একজন তাদের নিকট আসলেন এমতাবস্থায় যে, তারা তখন সালাত আদায়ে ব্যস্ত এবং তিনি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: নিশ্চয়ই কাবার দিকে কিবলা পরিবর্তন হয়ে গেছে; অতঃপর তারা কোন প্রকার প্রতিবাদ ও প্রশ্ন (?) করা ছাড়াই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার নির্দেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে সকলেই সালাত আদায়রত অবস্থায় বাইতুল মাকদাসের দিক থেকে কাবা শরীফের দিকে ঘুরে গেলেন; আর এটাই হল ঈমান; সুতরাং মুমিন ততক্ষণ পর্যন্ত আনুগত্য স্বীকার করবে, যতক্ষণ প্রমাণিত হবে যে, আল্লাহ এই নির্দেশ দিয়েছেন অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্দেশ দিয়েছেন; আর এটাই হল ওয়াজিব (আবশ্যক): ‘কোন প্রকার প্রতিবাদ করা ছাড়াই আনুগত্য স্বীকার করা’।

আর যাদের অন্তরে রোগ আছে, অথবা যাদের অন্তরে নিফাক বা কুটিলতা আছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবস্থা আলোচনা করেছেন, সুতরাং তিনি বলেন:

﴿ ۞سَيَقُولُ ٱلسُّفَهَآءُ مِنَ ٱلنَّاسِ مَا وَلَّىٰهُمۡ عَن قِبۡلَتِهِمُ ٱلَّتِي كَانُواْ عَلَيۡهَاۚ ﴾ [البقرة: ١٤٢]

“মানুষের মধ্য হতে নির্বোধরা অচিরেই বলবে যে, এ যাবত তারা যে কেবলা অনুসরণ করে আসছিল তা থেকে কিসে তাদেরকে ফিরালো? ” - (সূরা আল-বাকারা: ১৪২); সুতরাং তারা আনুগত্যের উদ্যোগ গ্রহণ করে না, বরং তারা বেশি বেশি প্রশ্ন ও আপত্তি উত্থাপন করে; আর ঈমানদারগণ আনুগত্য করে এবং তারা কোন প্রকার প্রতিবাদ ও আপত্তি করে না।

আর এগুলো হল মুসলিমদের সামনে সুন্নাতে নববীর মর্যাদা বা অবস্থান, তার প্রতি তাদের কর্মতৎপরতা এবং পরিতৃপ্ত হওয়ার কিছু নমুনা; কেননা সুন্নাতে নববী হচ্ছে ইসলামের দলিল-প্রমাণের মূলনীতিমালার দ্বিতীয় উৎস, তারা তাকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দান করে; কারণ, তা হল তাদের ঐ নবীর বাণী, যিনি মনগড়া কথা বলেন না; আর তা মেনে নেয়ার মধ্যে উম্মতের (জাতির) জন্য কল্যাণ, বরকত ও পুণ্য রয়েছে; আর এটাই হল মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের অবস্থান, যদিও তাদের যুগ-যামানা অনেক দূর পেরিয়ে এসেছে, তবুও তারা তাকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দান করে এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে, মনে হচ্ছে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সেই ব্যাপারে কথা বলতে শুনতে পাচ্ছে; কারণ, তাদের নিকট তা (সুন্নাহ) বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে পৌঁছেছে; সুতরাং তার ব্যাপারে অথবা তার নির্দেশিত ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই; অতএব মুমিন ব্যক্তি তার অনুসরণ করবে এবং তার নিজের উপর ও অন্যের উপর তা প্রয়োগ করবে; আর এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«نضر الله امرأ سمع منا شيئا فبلغه كما سمع فرب مبلغ أوعى من سامع. » (أخرجه الترمذي )

“যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে একটি হাদিস শুনে তা অন্যের কাছে পৌঁছিয়ে দেয়, আল্লাহ তাকে হাস্যোজ্জ্ব ও পরিতৃপ্ত করবেন। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে শ্রোতার চেয়ে যার নিকট প্রচার করা হয়, সে বেশি সংরক্ষণকারী হয়ে থাকে।”[13] সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সুন্নাহকে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর পরবর্তী উম্মতের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে উৎসাহিত করেছেন; আর তিনি বিদায় হাজ্জে যখন আরাফাতের ময়দানে তাঁর মহান ভাষণ পেশ করেন, তখন বলেন:

« ليبلغ الشاهد منكم الغائب فإن الشاهد عسى أن يبلغ من هو أوعى له منه » ( أخرجه البخاري و مسلم )

“তোমাদের মধ্যকার উপস্থিত ব্যক্তির উচিত অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছিয়ে দেয়া; কারণ, উপস্থিত ব্যক্তি অচিরেই এমন ব্যক্তির নিকট পৌঁছিয়ে দেবে, যে ব্যক্তি তার চেয়ে অধিক সংরক্ষণকারীর ভূমিকা পালন করবে।”[14] সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাথে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যাতে তাঁর অনুপস্থিত উম্মতের নিকট তাঁর বাণী পৌঁছিয়ে দেয়; আর এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র প্রতি মনোযোগ, তার শিক্ষা, সংরক্ষণ ও সুবিন্যস্তকরণে মুসলিমগণের ভূমিকা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, অন্য সকল জাতির চেষ্টা-প্রচেষ্টার উপরে; কারণ, পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্য থেকে এমন একটি জাতিও নেই, যারা তাদের নবী ও রাসূলের সুন্নাহ বা আসারসমূহকে (নিদর্শনসমূহকে) এই উম্মতে মুহাম্মদী’র মত যত্ন করতে পেরেছে; কেননা তারা আন্তরিকতার সাথে সুন্নাহকে তাদের হৃদয়ে সংরক্ষণ করতেন, তার প্রশিক্ষণ দিতেন এবং অন্যদের নিকট তা প্রচার করতেন; পূর্ববর্তী ব্যক্তি তার পরবর্তী ব্যক্তির নিকট প্রচার করত প্রজন্মের পর প্রজন্ম; আর তারা তা সংরক্ষণ ও আয়ত্তে রাখার জন্য হাদিসসমূহ লিপিবদ্ধ করতেন; সুতরাং তারা তা সংরক্ষণ করতেন মুখস্থকরণ ও লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে। তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে তিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করতেন; তিনি বলেছিলেন:

« من كتب عني شيئا فليمحه » ( أخرجه مسلم )

“যে ব্যক্তি আমার পক্ষ থেকে কিছু লিপিবদ্ধ করেছে, সে যেন তা মুছে ফেলে।”[15] আর এর উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আল-কুরআনের সাথে হাদিসের মিশ্রণ না ঘটে; ফলে তিনি হাদিস লিপিবদ্ধ করতে নিষেধ করতেন, যাতে কেউ তাকে (হাদিসকে) কুরআনের অংশ মনে না করে; অতঃপর তিনি তাঁর সাহাবীদের মধ্য থেকে কোনো কোনো সাহাবীকে লেখার অনুমতিও প্রদান করেছেন, যেমন আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনুল ‘আস রা., কেননা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শ্রবণ করতেন, তা লিপিবদ্ধ করে রাখতেন; আর এ জন্যই আবদুল্লাহ ইবন ‘আমর ইবনুল ‘আস রা. ছিলেন সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম; কারণ, তিনি ঐসব হাদিস লিপিবদ্ধ করে রাখতেন, যা তিনি শুনতেন; কিন্তু মুসলিমগণের লেখার চেয়ে মুখস্থ করার প্রতি মনোযোগ ছিল খুব বেশি; সুতরাং তারা সুন্নাহকে সংরক্ষণ করতেন, বহন করতেন তাদের হৃদয়ে, তার প্রশিক্ষণ দিতেন এবং তা প্রচার করতেন; এমনকি তাঁদের কেউ কেউ অনেক কষ্ট সত্ত্বেও হেজায থেকে মিসর পর্যন্ত ভ্রমণ করতেন একটি মাত্র হাদিসের সন্ধানে, যা সাহাবীদের কারও কারও নিকট পৌঁছেছে; আর এটাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের প্রতি তাঁদের মনোযোগ, সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ প্রমাণ করে।

আর এর পরে খলিফা রাশেদ ওমর ইবন আবদুল আযীযের আমলে হাদিস লেখা ও গ্রন্থবদ্ধের কাজ শুরু হয়; অতঃপর হাদিস লেখার ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে; তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ’র উপর সহীহ, মুসনাদ, জামে‘ ও মু‘জাম গ্রন্থসমূহ লিপিবদ্ধ হয় এবং বর্তমান সময়ে আল-হামদুলিল্লাহ (আল্লাহর শুকরিয়া) আজকের মুসলিমদের হাতে সুন্নাহ লিপিবদ্ধ অবস্থায় বিদ্যমান আছে; আর এই মওজুদ গড়ে তুলেছেন উম্মতের (জাতির) হাফেযগণ; সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মাধ্যমে সুন্নাতে নববীকে ত্রুটি-বিচ্যূতি ও বৃদ্ধি-ঘাটতির হাত থেকে রক্ষা করেছেন; আর তাঁরাই তাকে জালিয়াত ও মিথ্যাবাদীদের হাত থেকে হেফাজত করেছেন এবং তাঁরাই সুন্নাহ’র উপর অনেক মূল্যবান গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন, যা মুসলিমগণ ব্যতীত অন্য কোন জাতির নিকট পাওয়া যায় না। আর তাঁরা রিওয়ায়াত বা বর্ণনাকে গ্রহণ করার জন্য সূক্ষ্ম নীতিমালা তৈরি করেছেন এবং মিথ্যাবাদী, জালিয়াত, দূর্বল ও বর্ণনার ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত বর্ণনাকারীদের অবস্থা বর্ণনা করে দিয়েছেন; আর সুন্নাহ’র এই সংরক্ষণটি আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণেরই অন্তর্ভুক্ত, যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]

“নিশ্চয় আমরাই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরা অবশ্যই তার সংরক্ষক।” - (সূরা আল-হিজর: ৯); সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যেমনিভাবে আল-কুরআনকে তার মধ্যে বৃদ্ধি অথবা কমতি করা থেকে হেফাজত করেছেন, ঠিক তেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকেও তার রিওয়ায়াত বা বর্ণনার মাধ্যমে হেফাজত করেছেন, কেননা তা আল-কুরআনকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তাফসির করে; আর এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এই জাতির প্রতি রহমতস্বরূপ, কেননা তিনি তাদের জন্য আল-কুরআন ও সুন্নাতে নববীর মত এই দু’টি মহান উৎসকে হেফাজত করেছেন।

আর এখানে পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় থেকে সতর্ক করা আবশ্যক, যারা এই যুগে তাদের কর্মকাণ্ড ও অন্যায়-অপকর্ম প্রকাশ করে— তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে সন্দিহান করে তুলে এবং বলে: নিশ্চয়ই আল-কুরআনই আমাদের জন্য যথেষ্ট, সুন্নাহ’র কোনো প্রয়োজন নেই; আর তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ مَّا فَرَّطۡنَا فِي ٱلۡكِتَٰبِ مِن شَيۡءٖۚ ٣٨ ﴾ [الانعام: ٣٨]

[“এ কিতাবে আমরা কোন কিছুই বাদ দেই নি ...।” - (সূরা আল-আন‘আম: ৩৮)] এবং তাঁর বাণী:

﴿ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ ﴾ [النحل: ٨٩]

[“প্রত্যেক বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যাস্বরূপ ...।” - (সূরা আন-নাহল: ৮৯)]- এর দ্বারা প্রমাণ পেশ করে; কারণ, তাদের ধারণা অনুযায়ী সুন্নাহ মুতাওয়াতির[16] পদ্ধতিতে বর্ণিত নয়, বরং তা আহাদ[17] পদ্ধতিতে বর্ণিত এবং বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে ভুল-ত্রুটি ও মিথ্যার আশঙ্কা করা হয়; আর আল-কুরআন হল নির্ভরযোগ্য, যেমন তারা বলে: নির্ভরযোগ্য, অকাট্যভাবে প্রমাণিত ও বিশ্বস্ত বস্তুই যথেষ্ট এবং আমরা এমন বস্তু পরিত্যাগ করি, যাতে সন্দেহ রয়েছে।

ঐসব ব্যক্তিবর্গ (আল্লাহ তাদেরকে ভাল কাজ থেকে বঞ্চিত রাখুন) এরকমই বলে থাকে, বাস্তবে তারা শরী‘য়তকেই বাতিল করতে চায়, তবে পদ্ধতিটি হল অত্যন্ত ঘৃণিত ও ষড়যন্ত্রমূলক; কারণ, তারা মানুষকে এই কথা বলার ক্ষমতা রাখে না যে, তোমরা শরী‘য়তকে পরিত্যাগ কর অথবা ইসলাম ছেড়ে দাও; তারা শুধু কুৎসিত ও শয়তানী পদ্ধতি নিয়ে এসে বলে: তোমরা আল-কুরআনের উপর আমল কর এবং এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হবে, সুন্নাহ’র প্রয়োজন নেই; কারণ, তারা জানে যে, যখন সুন্নাহকে অকার্যকর করা হবে (আল্লাহ সক্ষম না করুক), তখন আল-কুরআন অকার্যকর হয়ে যাবে; আর এক পর্যায়ে গোটা শরী‘য়তই অকার্যকর হয়ে যাবে; কারণ, আমরা যা জানতে পারলাম, সুন্নাহ আল-কুরআনকে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে; সুতরাং যখন আমরা ঐসব ব্যক্তিবর্গের অনুসরণ করব (আল্লাহ তাদের তাওফিক না দিন) এবং সুন্নাহ’র উপর আমল না করব, তখন আমরা কিভাবে সালাত আদায় করব, কিভাবে সাওম (রোযা) পালন করব, কিভাবে যাকাত দান করব, কিভাবে হাজ্জ পালন করব এবং কিভাবে লেনদেন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে হারাম থেকে হালালকে চিনতে পারব, আর কিভাবেই বা চিনতে পারব বিবাহ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মুহাররামা[18] নারীদেরকে; আর এসব বিষয়ের জন্য সুন্নাহর কোনো বিকল্প নেই; সুতরাং সুন্নাহ’র অনুপস্থিতিতে ইসলামী শরী‘য়ত অকার্যকর হয়ে পড়বে।

আর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চৌদ্দশত বছর পূর্বে ঐসব দুষ্কৃতকারীদের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« ألا هل عسى رجل يبلغه الحديث عني وهو متكئ على أريكته فيقول بيننا وبينكم كتاب الله فما وجدنا فيه حلالا استحللناه وما وجدنا فيه حراما حرمناه وإن ماحرم رسول الله صلى الله عليه و سلم كما حرم الله. » ( أخرجه الترمذي )

“জেনে রাখ, অচিরেই কোন কোন ব্যক্তির কাছে আমার পক্ষ থেকে হাদিস পৌঁছবে এমতাবস্থায় যে, সে তার খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে আছে, অতঃপর সে বলবে: আমাদের এবং তোমাদের মাঝে আল্লাহর কিতাব বিদ্যমান রয়েছে; সুতরাং আমরা তাতে যা হালাল হিসেবে পাব, তাকে হালাল বলে গ্রহণ করব, আর তাতে যা হারাম হিসেবে পাব, তাকে হারাম বলে গ্রহণ করব; অথচ (তাদের জেনে রাখা উচিত) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা হারাম করেছেন, তা আল্লাহ যা হারাম করেছেন, তার মতই।”[19]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন:

«ألا إني أوتيتُ هذا الكتاب ، ومثلَهُ معهُ ، ألا يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعان على أريكته ، يقولُ : عليكم بِهذَا القُرآن ، فيما وَجدْتُم فيه من حلالٍ فأحِلُّوهُ ، وما وجدْتُم فيه من حرام فَحَرِّموهُ ».

“জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আমাকে এই কিতাব দেয়া হয়েছে এবং তার সাথে তার বাস্তব উদাহরণ তথা সুন্নাহ দেয়া হয়েছে। সাবধান! অচিরেই কোন কোন যুবক ব্যক্তি তার খাটের উপর বসে বসে বলবে: তোমাদের উপর আবশ্যক হল এই কুরআনকে গ্রহণ করা; সুতরাং তোমরা তাতে যা হালাল হিসেবে পাবে, তাকে হালাল বলে মেনে নেবে, আর তাতে যা হারাম হিসেবে পাবে, তাকে হারাম বলে ঘোষণা করবে।[20]” আর এই হাদিসটির মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মু‘জেযাসমূহের মধ্য থেকে অন্যতম একটি মহান মু‘জেযা নিহিত রয়েছে, কেননা যে বিষয়ে জানিয়ে গিয়েছিলেন, তা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়েছে; সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ঐসব (অসৎ) ব্যক্তিদের থেকে সতর্ক করেছেন এবং তিনি আমাদের নিকট সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আল-কুরআন ও সুন্নাহ উভয়টিই প্রদান করেছেন, যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ ﴾ [النجم: ٣، ٤]

“আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরিত হয়।” - (সূরা আন-নজম: ৩, ৪);

আর তারা যা বলে যে, আল-কুরআন মুতাওয়াতির পদ্ধতিতে সংকলিত হয়েছে এবং তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত, আর সুন্নাহ আহাদ পর্যায়ের বর্ণনাকারীদের বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত এবং তার ভিতরে ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অন্য কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সুতরাং এটা আল-কুরআনের মত নয়, তবে এই কথাটি বাতিল পর্যায়ের এবং এটি একটি খোঁড়া যুক্তি; কারণ, সুন্নাহ’র বিষয়টি আমরা যেমন বর্ণনা করেছি, তা নিঁখুতভাবে এসেছে; আর এটা কবি-সাহিত্যক, গল্পকার ও অন্যান্যদের গল্প ও কল্পকাহিনীর মত কিছু নয়, বরং তা বর্ণনা করার জন্য কিছু স্বতসিদ্ধ নিয়ম-পদ্ধতি ও নীতিমালা রয়েছে; আর তার জন্য রয়েছে এমন কিছু ব্যক্তিবর্গ, যারা তার হেফাজত ও যথযথ সংরক্ষণ করছেন এবং করবেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আমাদের যুগ পর্যন্ত এবং আল্লাহ তা‘আলা যে সময়কাল পর্যন্ত চাইবেন, সে সময় পর্যন্ত; আর এই সুন্নাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ করার মাধ্যমেই সংরক্ষিত; সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ নিয়ে কোনো প্রকার ছিনিমিনি খেলা ও কারচুপি করার অবকাশ নেই।

আর পূর্বেই বলা হয়েছে সুন্নাহ’র হাফেযগণ প্রত্যেক মিথ্যাবাদী ও দুর্বল বর্ণনাকারীর অবস্থা বর্ণনা করে দিয়েছেন; আরও বর্ণনা করে দিয়েছেন ঐসব বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের অবস্থা, যাদের বর্ণনার মধ্যে কিছু কিছু সংশয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, অথবা যাদের মধ্যে এমন কোনো দোষ প্রবেশ করেছে, যা তাদের বর্ণনাকে দুর্বল করে দিয়েছে, যেমন হাদিসের মধ্যে তাদলীস[21]কারী ও সংমিশ্রণকারী ব্যক্তিগণ। সুতরাং অপরাধীদের হাতে সুন্নাহ বিনষ্ট হওয়া অথবা মিথ্যাবাদী ও জালিয়াতগণ কর্তৃক তার ক্ষতি সাধিত হওয়ার কোনো সুযোগ তাতে নেই, মুসলিমগণের জীবনে এর মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক বেশী। অতএব, সব সময় সকল প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য, এ সুন্নাতগুলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে যেভাবে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তা বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীগণ থেকে বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীগণ বর্ণনা করেছেন, আর তা সংকলিত অবস্থায় সুন্নাহ’র কিতাবসমূহের মধ্যে বিদ্যমান আছে; সুতরাং এর মাধ্যমে ঐসব সংশয় সৃষ্টিকারী ও মিথ্যাবাদীদের সন্দেহ-সংশয় দূর হয়ে যাবে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ বিশুদ্ধ অবস্থায় অবশিষ্ট থাকবে, যা তাঁর নিকট থেকে সাব্যস্ত ও প্রমাণিত, যে ব্যাপারে কোন প্রকার ত্রুটিপূর্ণ অথবা সন্দেহজনক পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় নি; আর এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁর সৃষ্ট মানব জাতির উপর একান্ত অনুগ্রহ ও দয়া।

আর যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে অপবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করবে, আর ধারণা করবে তার উপর আমল করা অবৈধ এবং শুধু এককভাবে আল-কুরআনের উপর আমল করবে বলে মনে করে, তবে সেই ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে; কারণ, সে শরী‘য়তের মূলনীতিমালার দ্বিতীয় উৎসকে অস্বীকার করেছে, আর তা হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ; তার অবস্থা যেন বলে: তোমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করো না, বরং শুধু আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য কর; আর সেই ধারাবাহিকতায় ঐ ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করে নি, কেননা আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন; সুতরাং সে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যও করে নি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যও করে নি; অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَآ ءَاتَىٰكُمُ ٱلرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَىٰكُمۡ عَنۡهُ فَٱنتَهُواْۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۖ إِنَّ ٱللَّهَ شَدِيدُ ٱلۡعِقَابِ ٧ ﴾ [الحشر: ٧]

“রাসূল তোমাদেরকে যা দেয়, তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে, তা থেকে বিরত থাক এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।” - (সূরা আল-হাশর: ৭); আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:

﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ ﴾ [النجم: ٣، ٤]

“আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না। তা তো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরিত হয়।” - (সূরা আন-নজম: ৩, ৪)।

আর বর্তমানে নিজেদেরেকে আলেম বলে যাহির করা ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকে একটি দল আমাদের মধ্যে প্রকাশ লাভ করেছে, যারা আলেমদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নি, তারা শিক্ষা লাভ করেছে শুধু বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এবং তারা কাগজ বা পাতার নিকট শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে; তারপরও তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে বিশুদ্ধ, দুর্বল ও সনদ (সার্টিফিকেট) দানের ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে, অথচ তাদের নিকট ইলমে হাদিস (হাদিস শাস্ত্র) ও তার আনুসাঙ্গিক নীতিমালা সংক্রান্ত কোনো জ্ঞান নেই; সুতরাং সুন্নাহ’র ব্যাপারে (ক্ষতির দিক বিবেচনায়) প্রথম দলের পক্ষ থেকে আশাঙ্কার চেয়ে এসবের পক্ষ থেকে আশঙ্কার দিকটি অত্যন্ত প্রবল; কারণ, প্রথম দলের অজ্ঞতা ও মূর্খতা স্পষ্ট; আর এরা শিক্ষা ও অধ্যয়নের ঢাল ব্যবহার করে চলেছ, অতএব, لا حول و لا قوة إلا بالله (আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোন ক্ষমতা নেই এবং কোন শক্তি নেই)।

আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আবেদন করছি, তিনি যেন সকলকে উপকারী জ্ঞান অর্জন ও সৎ আমল করার তাওফীক (যোগ্যতা) দান করেন; আর আমাদেরকে সঠিক পথের সন্ধান দান করেন; আর আমাদেরকে সত্যকে যথাযথভাবে দেখিয়ে দেন এবং তা অনুসরণ করার ভাগ্য সুপ্রসন্ন করেন; আর আমাদের সামনে বাতিলকে বাতিল হিসেবে পেশ করেন এবং তার থেকে দূরে থাকার তাওফীক দান করেন; আর তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতবান।

و صلى الله و سلم على نبينا محمد .

* * *

[1] ইমাম আহমদ র, মুসনাদ: ৪ / ১৩০

[2] ইমাম মালেক, মুয়াত্তা: ২ / ৮৯৯ / হাদিস নং- ১৫৯৪

[3] আবূ দাউদ, আস-সুনান: ৪ / ২০ / হাদিস নং- ৪৬০৭; তিরমিযী, আল-জামে‘: ৫ / ৪৪ / হাদিস নং-২৬৭৬; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১ / ১৫ / হাদিস নং- ৪২; আহমদ, মুসনাদ: ৪ / ১২৬

[4] বুখারী, আস-সহীহ: ৩ / ১২৭৪ / হাদিস নং- ৩২৬৯; মুসলিম, আস-সহীহ: ৪ / ২০৫৪ / হাদিস নং- ২৬৬৯

[5] ইমাম মালেক, মুয়াত্তা: ২ / ৮৯৯ / হাদিস নং- ১৫৯৪

[6] বুখারী, আস-সহীহ: ১ / ২২৬ / হাদিস নং- ৬০৫

[7] আবূ দাউদ, আস-সুনান: ১ / ১০৭ / হাদিস নং- ৩৯৩; তিরমিযী, আল-জামে‘: ১ / ২৭৮ / হাদিস নং- ১৪৯

[8] মুসলিম, আস-সহীহ: ২ / ৩৪৯ / হাদিস নং- ১২৯৭

[9] অর্থাৎ কয় হাত কাটা হবে, এক হাত, নাকি উভয় হাত, আল-কুরআনে তাও স্পষ্ট করে বলা হয় নি। - অনুবাদক।

[10] বুখারী, আস-সহীহ: ৬ / ২৬৫৫ / হাদিস নং- ৬৮৫১

[11] মুসলিম, আস-সহীহ: ৩ / ৫৯৯ / হাদিস নং- ২০২১

[12] মুসলিম, আস-সহীহ: ৩ / ১৬৫৫ / হাদিস নং- ২০৯০

[13] তিরমিযী, আল-জামে‘: ৫ / ৩৪ / হাদিস নং- ২৬৫৭

[14] বুখারী, আস-সহীহ: ১ / ৩৭ / হাদিস নং- ৬৭; মুসলিম, আস-সহীহ: ৩ / ১৩০৫ / হাদিস নং- ১৬৭৯

[15] মুসলিম, আস-সহীহ: ৪ / ২২৯৮ / হাদিস নং- ৩০০৪

[16] মুতাওয়াতির ঐ বর্ণনা বা হাদিসকে বলে, যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা এত অধিক যে, তাদের স্থান ও অঞ্চেলের ভিন্নতার কারণে তারা মিথ্যার উপর ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন বলে ধারণা করা অসম্ভব। - অনুবাদক।

[17] আহাদ ঐ বর্ণনা বা হাদিসকে বলে, যার বর্ণনাকারীর সংখ্যা কোনো যুগে এক থেকে তিন পর্যন্ত, যদিও অন্য যুগে তার চেয়েও বেশী থাকুক না কেন। - অনুবাদক।

[18] যাদের সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ, এমন নারীকে মুহাররামা বলা হয়। - অনুবাদক।

[19] তিরমিযী, আস-সুনান, ইলম অধ্যায়, বাব নং- ১০, হাদিস নং- ২৬৬৪

[20] মুসনাদ আহমাদ ৪/১৩০।

[21] বর্ণনাকারী যে শায়খ (বর্ণনাকারী) থেকে হাদিস শুনেছেন, তার নাম উল্লেখ না করে ঊর্ধ্বতন কোন শায়খের নাম উল্লেখ করে এমন ভাষায় হাদিস বর্ণনা করা, যাতে হাদিস শোনার ধারণা সৃষ্টি হয়, তবে মিথ্যার ধারণা হয় না, এরূপ করাই তাদলীস ( تدليس )। - অনুবাদক।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

৭১ এর যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস