বিজ্ঞান, ধর্ম আর God of the gaps
যে কোনো কারণেই হোক না
কেন, আজকাল অনেকেই বিজ্ঞান আর ধর্ম— এ দুয়েরমধ্যে সংঘাত খুঁজে পান। এই
বিশ্বাসের পেছনে প্রেরণাটা যে কী, সেটা ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার
বিষয়বস্তু হতে পারে।
.
অনেক ধর্মবিশ্বাসী মানুষ পর্যন্ত এই সংঘাতের ভয়ে ধর্ম আর বিজ্ঞানকে আলাদাভাবে দেখতে পছন্দ করেন, ভাবটা এমন— ঐ বিজ্ঞানীরা থাকুক তাদের যুক্তিতর্ক নিয়ে, আমরা থাকি আমাদের ধর্ম নিয়ে। এই মনোভাবটা কিন্তু একদিক থেকে ঠিকই আছে। বিজ্ঞান আর ধর্ম বিষয় দুটোর কর্মপদ্ধতি আর আওতা (scope) ভিন্ন। কাজেই কেউ যদি টেলিস্কোপের ওপারে গ্রহ-তারা না খুঁজে ফেরেশতা খুঁজতে যায়, সেটা স্রেফ বোকামি হবে। এই কর্মপদ্ধতি বা methodology এর দিক দিয়ে আমি ধর্ম আর বিজ্ঞানকে মোটের ওপর আলাদাভাবে দেখতেই ভালবাসি। কথায় আছে – Good fences make good neighbours.
কিন্তু এর মানে এই নয় যে বিজ্ঞানের ‘খপ্পর’ থেকে ধর্মকে পালিয়ে বাঁচতে হবে। আমার মতে বিজ্ঞান আর ধর্ম জ্ঞানের উৎস হিসেবে সম্পূরক, বিজ্ঞানের আওতা যেখানে শেষ হয়; metaphysics বা অধিবিদ্যা আর ধর্মের আওতা সেখান থেকে শুরু হয়। দুটোর আওতা ভিন্ন থাকায় একটার সাথে আরেকটার ঠোকাঠুকি লাগার সম্ভাবনা নেই। বিজ্ঞান আর ধর্ম জিনিস দুটোর সঠিক সম্পর্ক কী হবে এবং কেন সেটা হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে একাধিক বই লিখে ফেলা সম্ভব। অত বিস্তৃত আলোচনায় আপাতত যেতে চাচ্ছি না। এই লেখাটার বিষয়বস্তু হচ্ছে এই সংঘাতের একটা সুনির্দিষ্ট দিক— দার্শনিকরা যেটাকে বলেন God of the gaps.
এর আইডিয়াটা মোটামুটি এরকম: একটা সময় মানুষ বিশ্বাস করত, রোগ-বালাই হয় দেবতাদের অভিশাপের কারণে। বিজ্ঞান পরে প্রমাণ করল— নাহ, রোগ-বালাই হয় ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি আণুবীক্ষণিক জীবের কারণে। প্রাচীনকালে ভাইকিংরা বিশ্বাস করত, দেবতা থর বজ্রপাত ঘটান। বিজ্ঞান পরে বলল, মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার ফলে বজ্রপাত হয়। একইভাবে ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি প্রকৃতির যত ব্যাপার-স্যাপার আছে সবকিছু মানুষ ঈশ্বরের নাম দিয়ে ব্যাখ্যা করে দিত। বিজ্ঞান পরে এসে সবকিছুরই প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলো। বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এরকম একটা ট্রেন্ড দেখা যায় যে বিজ্ঞান যতই এগোয়, ধর্মের ব্যাখ্যেয় আওতা ততই কমে। কাজেই এখন আমরা যারা ধর্মে বিশ্বাস করি, দুদিন পর বিজ্ঞান সেই বিশ্বাসটুকুর জায়গা রাখবে না। ধর্ম, ঈশ্বর, দেবতা— এগুলোতে বিশ্বাস আমাদের জ্ঞানের কিছু অস্থায়ী ‘গ্যাপ’ মাত্র, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে যারা পূর্ণ হয়ে যায়।আমরা যদি আমাদের ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে বসে থাকি তাহলে বিজ্ঞান এগোতে পারবে না। ঈশ্বর তাই God of the universe নন, তিনি God of the gaps.
এই অভিযোগটাই লেখার আলোচ্য বিষয়। লেখার প্রথম পর্বটা হবে destructive বা সমালোচনামূলক যেখানে আমরা God of the gaps ধারণাটার সমস্যাগুলো দেখব। দ্বিতীয় পর্ব হবে constructive, সেখানে আমরা জিনোমিক্স আর পার্টিকল ফিজিক্সের দুটো উদাহরণ থেকে দেখব ধর্মবিশ্বাস বিজ্ঞানকে বাধা দেওয়া দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রেই একে এগুতে সাহায্য করে। এসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে বাধা দেয় ধর্ম নয়, বরং নাস্তিকতা আর ধর্মহীনতা।
বিজ্ঞানের কিভাবে, ধর্মের কেন

টেবিলের ওপর সুন্দর করে সাজানো একটা ব্ল্যাক-ফরেস্ট কেক আপনি একদল বিজ্ঞানীকে দেখিয়ে বললেন, ‘এটার ব্যাপারে যা কিছু জানা সম্ভব, জেনে বের করুন।’ রসায়নবিদরা দুধ-ডিম-ময়দা-কোকো পাউডার থেকে শুরু করে একদম অ্যামিনো অ্যাসিডের পার্সেন্টেজ পর্যন্ত হয়ত আউড়ে দিতে পারবেন, কেকটা কখন কিভাবে মেশানো হয়েছিল, কতক্ষণ ওভেনে রাখা হয়েছিল, সেগুলোও।
যেটা তারা বলতে পারবে না সেটা হচ্ছে কেকটা কেন বানানো হয়েছিল— বাচ্চার জন্মদিন বলে, প্রবাসী আত্মীয় ফিরেছে বলে, না অন্য কোনো কারণে। সেটা শুধু বলতে পারবেন কেকটা যিনি বানিয়েছেন তিনি।
এই উদাহরণটা থেকে আমরা ধর্ম আর বিজ্ঞানের আওতার একটা ভাল ধারণা পেতে পারি। বিজ্ঞানকে আমরা যে প্রশ্নগুলো করি সেগুলোর মধ্যে একটা কী অথবা কিভাবে (what and how) থাকে। অন্যদিকে ধর্মের কাছ থেকে আমরা জানতে চাই ‘কেন’।
বিজ্ঞান দেখায় mechanism বা কলাকৌশল, ধর্ম দেখায় purpose বা উদ্দেশ্য। এ কারণে বিজ্ঞান যতই বলুক অসুখ হয় জীবাণুর কারণে, সে যে প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছে সেটা হচ্ছে রোগবালাই কিভাবে হয়। কিন্তু এর পেছনে কোনো ‘কেন’ আছে কিনা, আর থাকলে সেটা কী— তার উত্তর শুধু ধর্মই দিতে পারবে। ধর্ম আর বিজ্ঞান জিনিস দুটোর আওতাই আলাদা, ভিন্ন ভিন্ন লেভেলে। এ দুটোর মধ্যে সংঘাত আর রাজনীতি-জীবাশ্মবিদ্যার দ্বন্দ্ব একই কথা। কাজেই বিজ্ঞান যতই এগোক না কেন—আর সেটাই আমাদের কাম্য—“কেন”-এর জগতে ধর্মের বিচরণ এক বিন্দু কমেনি, কমার সম্ভাবনাও নেই।
মোল্লার দৌড় মসজিদ, কিন্তু বিজ্ঞানের দৌড়…
God of the gaps–এর পক্ষ নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে বিজ্ঞানের দৌড় কদ্দূর, এটা কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আর কোন প্রশ্নের পারে না, সে সম্পর্কে তাদের খুব স্বচ্ছ ধারণা নেই।
.
বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের একটা পদ্ধতি বা সিস্টেম, আর যেকোনো সিস্টেমের গোড়াতেই কিছু স্বীকার্য বা assumption থাকে। এই স্বীকার্যগুলোর বাইরে বিজ্ঞান চিন্তা করতে পারে না।
.
যেমন ধরুন Induction: বিজ্ঞানের একটা মূল স্বীকার্য হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মকানুনগুলো মোটের ওপর একই থাকে। আজকে যদি সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, তবে কালকেও তা পূর্বদিকেই উঠবে, যদি না সৌরজগতের কাঠামোতে বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন হয়।
আর্সেনিক আজ বিষাক্ত, বিষাক্ত ছিল কালকেও; তামা বরাবরই তাপে প্রসারিত হয়। নিউটনের কোলে আপেল পড়ার পর মুহূর্তের জন্যও তিনি ভাবেননি— মোটে তো একটা আপেল পড়ল, একটু অপেক্ষা করে দেখি তো এর পরেরটাও এভাবে পড়ে, নাকি শূন্যে ঝুলে থাকে। ওরকম সন্দেহবাদী হলে বিজ্ঞানের ভাত থাকবে না।
.
বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র মাত্রই Lehninger এর বই চেনে; সেটার সূচনায় খুব সুন্দর একটা অবজার্ভেশন আছে,
Science will not work in a universe that plays tricks on us.
মহাবিশ্বের এই রেগুলারিটি বা নিয়মতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস বিজ্ঞানের জন্য খুবই জরুরি। এই যে এই বিশ্বাস—প্রকৃতির নিয়মকানুনগুলো একই রকম থাকা—এটাকে বলে induction.
.
আপনি যদি কোনো বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করেন— বলুন তো Induction কেন কাজ করে?
বুদ্ধিমান হলে তিনি বলবেন— দার্শনিকদের জিজ্ঞেস করুন, আমি induction স্বীকার্য মেনে কাজ করি, স্বীকার্যটা কোত্থেকে আসল তা আমার মাথাব্যথা নয়।
.
একইভাবে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব কেন আছে, সেটার উত্তর দেওয়াও বিজ্ঞানের কাজ নয়। বিগ-ব্যাং বলুন আর কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বলুন, এরা যেটা ব্যাখ্যা দেয় সেটা হচ্ছে উৎপত্তির ঠিক পর পর সৃষ্টিজগতের চেহারাটা কীরকম ছিল। কিন্তু অস্তিত্বশীলতা ব্যাপারটা আদৌ কেন সম্ভব হলো, সেটার উত্তর পাবেন দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যেসব ব্যাপার বিজ্ঞান স্বীকার্য ধরে নিয়ে কাজ করে, ধর্মের কৃতিত্ব কিন্তু ঠিক সেখানেই। আল্লাহ কুরআনে সূরাহ তূরে অবিশ্বাসীদের কটাক্ষভরে প্রশ্ন করেছেন (আক্ষরিক অনুবাদ দেওয়া হচ্ছে না)—তারা কী তবে শূন্য থেকেই এসে পড়ল? Creatio ex Nihilo বা শূন্য থেকে সৃষ্টির ব্যাপারটা সেই প্লেটোর সময় থেকেই দার্শনিকদের মাথাব্যথার কারণ।
.
বিজ্ঞান শুধু এটুকুই বলতে পারে যে বাঁধা কিছু নিয়মকানুনের ভিত্তিতে কিভাবে কোয়ার্ক-ফিল্ড-ম্যাটার-এনার্জি এদিক-সেদিক হয়ে ইতিহাস তৈরি হলো। কিন্তু শূন্য থেকে গোড়ার সেই কিছু-একটার অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব হলো, তা বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে। আজকাল কোনো কোনো বিজ্ঞানী ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন শূন্যতা জিনিসটাকে অন্য কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করে। ব্যাপারটা মরিয়া চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়— যেকোনো দার্শনিককে প্রশ্ন করুন, উনি বলে দেবেন শূন্যতা জিনিসটার সংজ্ঞা দেওয়া আদৌ সম্ভব নয় কারণ শূন্যতা জিনিসটার কোনো বৈশিষ্ট্য বা property নেই। যেটার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই তার ওপর প্রাকৃতিক নিয়মকানুন কাজ করার প্রশ্নই আসে না। অক্সফোর্ড দার্শনিক Richard Swinburne ভালোই বলেছেন, এই প্রশ্নগুলো “too big for science”, কাজেই এসব ক্ষেত্রে God of the gaps লজিক খাটবে না মোটেই।
Induction বা মহাবিশ্বের নিয়মতান্ত্রিকতার বিষয়টাও হুবহু তাই। সেই স্কটিশ দার্শনিক David Hume-এর সময় থেকে এ নিয়ে কালিক্ষয় কম হয়নি, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন, বিজ্ঞানীরা এই আলোচনায় কখনো অংশ নেননি। তারা জানতেন এটা দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়। কাজেই David Hume, Karl Popper, Bas van Fraassen, Michael Tooley, David Armstrong, John Foster পর্যন্ত যারাই induction নিয়ে গবেষণা করেছেন, সবাই এটাকে দেখেছেন একটা দার্শনিক প্রশ্ন হিসেবে। বিজ্ঞান যেটাকে ধরে নিয়ে কাজ করে সেটার ব্যাখ্যা দেওয়ার সামর্থ্য এর নেই।
.
মজার ব্যাপার হচ্ছে মহাবিশ্বের এই নিয়মতান্ত্রিকতাকেই ধর্মতাত্ত্বিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখেন। হাল আমলে ডেল র্যাৎশ, রিচার্ড সুইনবার্ন, ন্যান্সি কার্টরাইট, জন ফস্টারসহ অনেক দার্শনিকই দেখিয়েছেন— মহাবিশ্বের আইন-কানুন মেনে চলা বা নিয়মতান্ত্রিকতার যে গুণ, সেটা ব্যাখ্যার একমাত্র উপায় হলো এটা ধরে নেওয়া যে মহাবিশ্বের একজন নিয়ন্তা বা ডিজাইনার আছেন, যিনি ঠিক করে রেখেছেন যাতে সবকিছু নিয়মমাফিক চলে। আল্লাহ সূরা ইয়াসিনে প্রকৃতির এই নিয়মতান্ত্রিকতার দিকে দেখিয়ে বলেছেন, সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদকে অতিক্রম করা, রাতেরও দিনকে অতিক্রম করা সম্ভব নয় (আক্ষরিক অনুবাদ নয়)।
এরকম আরো বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যেখানে ধর্ম বা আল্লাহতে বিশ্বাস রহস্যের সমাধান করে, অথচ বিজ্ঞানের সংজ্ঞাটাই এরকম যে তার সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অপসৃয়মান নাকি ক্রমবর্ধমান?
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসে গিয়ে যদি আপনি কারো সাথে ধর্ম বা আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলতে যেতেন, কথোপকথনটা হতে পারত এরকম:
আপনি: মহাবিশ্বের সৃষ্টি হল কিভাবে?
গ্রীক: মহাবিশ্বের আবার সৃষ্টি কী? এটা বরাবরই ছিল, বরাবরই থাকবে।
আপনি: গ্রহ-নক্ষত্রগুলো এত নিয়ম মেনে চলাফেরা করে কেন?
গ্রীক: কেন, অ্যারিস্টটল পড়োনি? বৃত্ত হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতি, তাই আকাশমুলুকে সবকিছুই বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে।
আপনি: বুঝলাম, কিন্তু প্রাণিজগত এলো কিভাবে?
গ্রীক: তুমি তো আচ্ছা অশিক্ষিত বাপু। অ্যারিস্টটল বলেছেন, জড় থেকে আপনা-আপনিই প্রাণী সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। গাছের পাতা থেকে মাছ, ময়লা পানি থেকে ব্যাঙ ইত্যাদি তৈরি হয়। অন্যান্য প্রাণীরও এরকম আপনা-আপনি সৃষ্টির ব্যবস্থা আছে।
ওপরের কোনো উত্তরই একজন ধর্মবিশ্বাসীর পছন্দ হবে না, একজন বিজ্ঞানীরও নয়। কিন্তু অনেককাল পর্যন্ত মানুষের বিশ্বাস ছিল এরকমই। সেসময়কার গ্রীসে ঈশ্বরে অবিশ্বাস করা তাই ছিল বেশ সহজ। এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন, বিশেষ করে এই বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে। গেল শতাব্দীর মাঝখানে মলিক্যুলার বায়োলজির বিপ্লবের পর মানুষ যখন কোষ জিনিসটার ভেতরে তাকাতে শিখল, তার বিস্ময় বাড়ল বই কমল না:

সেই আঠারো শতকে ব্রিটিশ দার্শনিক উইলিয়াম পেইলি জীবদেহকে তুলনা করেছিলেন ঘড়ির সাথে। ঐসব ঘড়ি-ফড়িতে এখন আর কুলোবে না। বেশি কিছু না, কোষের ইনফরমেশন প্রোসেসিং সিস্টেমটুকুর জটিলতাই ধারণার বাইরে।
.
বিল গেটস বলেছেন, ডিএনএ একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মত, শুধু আমাদের বানানো যেকোনো প্রোগ্রামের চেয়ে হাজার কোটিগুণ জটিল। এই কোষ সম্পর্কে বিজ্ঞানের অগ্রগতিটার ইতিহাস যদি পড়ে দেখেন, একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করবেন। God of the gaps এর সমর্থকরা যা বলছে, এই ইতিহাস তার সম্পূর্ণ উলটো। গ্রীকদের সময় তো বাদই দিলাম, উনিশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন কোষ হচ্ছে প্রোটোপ্লাজমের দলা। বিশ শতকের শুরুতে এনজাইম আবিষ্কারের ফলে কোষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা একটু বাড়ল, কিন্তু ষাটের দশকে ওয়াটসন-ক্রিক ডিএনএর গঠন দেখিয়ে সব আন্দাজ উড়িয়ে দিলেন। ক্রিক শেষ জীবনে ডিএনএর জটিলতা দেখে নিতান্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন—এসব বানানো প্রকৃতির কর্ম নয়, এখানে নির্ঘাত এলিয়েনদের হাত আছে। এটাকেই বলে Directed panspermia হাইপোথিসিস, ড্যান ব্রাউন-টাউনরা যেটাকে জনপ্রিয় করেছেন।
পদার্থবিজ্ঞান থেকেও এরকম উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু পয়েন্টটা আশা করি বুঝেছেন—বিজ্ঞান যে শুধু সবসময় আমাদের জ্ঞানের গ্যাপ পূরণ করে তাই নয়, মাঝেমাঝে সেটাকে হা করে খুলে দেয়।
মলিক্যুলার বায়োলজি তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এরকম বিশাল, ক্রমবর্ধমান গ্যাপ পূরণ করা আদৌ বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নাকি সেটা একটা প্রশ্ন। প্রকৃতির বিশেষ করে জীবজগতেরএরকম অনেক জটিল গঠনশৈলী দেখে অনেকেই শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরকে আনতে বাধ্য হন। তাদের মতে, ধর্ম বা ঈশ্বর এখানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে বাধা নয়, বরং বিজ্ঞান আমাদের ঈশ্বরের দিকেই নির্দেশ করছে। রিচার্ড সুইনবার্ন এদের সম্পর্কে বলেছেন, এই ব্যাপারগুলো “too odd for science”.
কাজেই আমরা দেখলাম—
প্রথমত, বিজ্ঞান আর ধর্মের করা প্রশ্নগুলোই আলাদা।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানের একটা নির্দিষ্ট সীমা বা আওতা আছে, তার বাইরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর এই প্রশ্নগুলোই ধর্মের পছন্দের।
তৃতীয়ত, আমাদের জ্ঞানের শূন্যতা মাঝে মাঝে বিজ্ঞান দিয়ে পূরণ হয় বটে, কিন্তু কখনো কখনো অনেক অনেক বেড়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে হাইপোথিসিস হিসেবে ধর্মবিশ্বাস বেশ কার্যকর।
.
অনেক ধর্মবিশ্বাসী মানুষ পর্যন্ত এই সংঘাতের ভয়ে ধর্ম আর বিজ্ঞানকে আলাদাভাবে দেখতে পছন্দ করেন, ভাবটা এমন— ঐ বিজ্ঞানীরা থাকুক তাদের যুক্তিতর্ক নিয়ে, আমরা থাকি আমাদের ধর্ম নিয়ে। এই মনোভাবটা কিন্তু একদিক থেকে ঠিকই আছে। বিজ্ঞান আর ধর্ম বিষয় দুটোর কর্মপদ্ধতি আর আওতা (scope) ভিন্ন। কাজেই কেউ যদি টেলিস্কোপের ওপারে গ্রহ-তারা না খুঁজে ফেরেশতা খুঁজতে যায়, সেটা স্রেফ বোকামি হবে। এই কর্মপদ্ধতি বা methodology এর দিক দিয়ে আমি ধর্ম আর বিজ্ঞানকে মোটের ওপর আলাদাভাবে দেখতেই ভালবাসি। কথায় আছে – Good fences make good neighbours.
কিন্তু এর মানে এই নয় যে বিজ্ঞানের ‘খপ্পর’ থেকে ধর্মকে পালিয়ে বাঁচতে হবে। আমার মতে বিজ্ঞান আর ধর্ম জ্ঞানের উৎস হিসেবে সম্পূরক, বিজ্ঞানের আওতা যেখানে শেষ হয়; metaphysics বা অধিবিদ্যা আর ধর্মের আওতা সেখান থেকে শুরু হয়। দুটোর আওতা ভিন্ন থাকায় একটার সাথে আরেকটার ঠোকাঠুকি লাগার সম্ভাবনা নেই। বিজ্ঞান আর ধর্ম জিনিস দুটোর সঠিক সম্পর্ক কী হবে এবং কেন সেটা হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে একাধিক বই লিখে ফেলা সম্ভব। অত বিস্তৃত আলোচনায় আপাতত যেতে চাচ্ছি না। এই লেখাটার বিষয়বস্তু হচ্ছে এই সংঘাতের একটা সুনির্দিষ্ট দিক— দার্শনিকরা যেটাকে বলেন God of the gaps.
এর আইডিয়াটা মোটামুটি এরকম: একটা সময় মানুষ বিশ্বাস করত, রোগ-বালাই হয় দেবতাদের অভিশাপের কারণে। বিজ্ঞান পরে প্রমাণ করল— নাহ, রোগ-বালাই হয় ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি আণুবীক্ষণিক জীবের কারণে। প্রাচীনকালে ভাইকিংরা বিশ্বাস করত, দেবতা থর বজ্রপাত ঘটান। বিজ্ঞান পরে বলল, মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হওয়ার ফলে বজ্রপাত হয়। একইভাবে ভূমিকম্প, বৃষ্টিপাত, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি প্রকৃতির যত ব্যাপার-স্যাপার আছে সবকিছু মানুষ ঈশ্বরের নাম দিয়ে ব্যাখ্যা করে দিত। বিজ্ঞান পরে এসে সবকিছুরই প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলো। বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে এরকম একটা ট্রেন্ড দেখা যায় যে বিজ্ঞান যতই এগোয়, ধর্মের ব্যাখ্যেয় আওতা ততই কমে। কাজেই এখন আমরা যারা ধর্মে বিশ্বাস করি, দুদিন পর বিজ্ঞান সেই বিশ্বাসটুকুর জায়গা রাখবে না। ধর্ম, ঈশ্বর, দেবতা— এগুলোতে বিশ্বাস আমাদের জ্ঞানের কিছু অস্থায়ী ‘গ্যাপ’ মাত্র, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে যারা পূর্ণ হয়ে যায়।আমরা যদি আমাদের ধর্মবিশ্বাস আঁকড়ে বসে থাকি তাহলে বিজ্ঞান এগোতে পারবে না। ঈশ্বর তাই God of the universe নন, তিনি God of the gaps.
এই অভিযোগটাই লেখার আলোচ্য বিষয়। লেখার প্রথম পর্বটা হবে destructive বা সমালোচনামূলক যেখানে আমরা God of the gaps ধারণাটার সমস্যাগুলো দেখব। দ্বিতীয় পর্ব হবে constructive, সেখানে আমরা জিনোমিক্স আর পার্টিকল ফিজিক্সের দুটো উদাহরণ থেকে দেখব ধর্মবিশ্বাস বিজ্ঞানকে বাধা দেওয়া দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রেই একে এগুতে সাহায্য করে। এসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে বাধা দেয় ধর্ম নয়, বরং নাস্তিকতা আর ধর্মহীনতা।
বিজ্ঞানের কিভাবে, ধর্মের কেন

টেবিলের ওপর সুন্দর করে সাজানো একটা ব্ল্যাক-ফরেস্ট কেক আপনি একদল বিজ্ঞানীকে দেখিয়ে বললেন, ‘এটার ব্যাপারে যা কিছু জানা সম্ভব, জেনে বের করুন।’ রসায়নবিদরা দুধ-ডিম-ময়দা-কোকো পাউডার থেকে শুরু করে একদম অ্যামিনো অ্যাসিডের পার্সেন্টেজ পর্যন্ত হয়ত আউড়ে দিতে পারবেন, কেকটা কখন কিভাবে মেশানো হয়েছিল, কতক্ষণ ওভেনে রাখা হয়েছিল, সেগুলোও।
যেটা তারা বলতে পারবে না সেটা হচ্ছে কেকটা কেন বানানো হয়েছিল— বাচ্চার জন্মদিন বলে, প্রবাসী আত্মীয় ফিরেছে বলে, না অন্য কোনো কারণে। সেটা শুধু বলতে পারবেন কেকটা যিনি বানিয়েছেন তিনি।
এই উদাহরণটা থেকে আমরা ধর্ম আর বিজ্ঞানের আওতার একটা ভাল ধারণা পেতে পারি। বিজ্ঞানকে আমরা যে প্রশ্নগুলো করি সেগুলোর মধ্যে একটা কী অথবা কিভাবে (what and how) থাকে। অন্যদিকে ধর্মের কাছ থেকে আমরা জানতে চাই ‘কেন’।
বিজ্ঞান দেখায় mechanism বা কলাকৌশল, ধর্ম দেখায় purpose বা উদ্দেশ্য। এ কারণে বিজ্ঞান যতই বলুক অসুখ হয় জীবাণুর কারণে, সে যে প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছে সেটা হচ্ছে রোগবালাই কিভাবে হয়। কিন্তু এর পেছনে কোনো ‘কেন’ আছে কিনা, আর থাকলে সেটা কী— তার উত্তর শুধু ধর্মই দিতে পারবে। ধর্ম আর বিজ্ঞান জিনিস দুটোর আওতাই আলাদা, ভিন্ন ভিন্ন লেভেলে। এ দুটোর মধ্যে সংঘাত আর রাজনীতি-জীবাশ্মবিদ্যার দ্বন্দ্ব একই কথা। কাজেই বিজ্ঞান যতই এগোক না কেন—আর সেটাই আমাদের কাম্য—“কেন”-এর জগতে ধর্মের বিচরণ এক বিন্দু কমেনি, কমার সম্ভাবনাও নেই।
মোল্লার দৌড় মসজিদ, কিন্তু বিজ্ঞানের দৌড়…
God of the gaps–এর পক্ষ নিয়ে যারা কথা বলেন, তাদের আরেকটা সমস্যা হচ্ছে বিজ্ঞানের দৌড় কদ্দূর, এটা কোন প্রশ্নের জবাব দিতে পারে আর কোন প্রশ্নের পারে না, সে সম্পর্কে তাদের খুব স্বচ্ছ ধারণা নেই।
.
বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের একটা পদ্ধতি বা সিস্টেম, আর যেকোনো সিস্টেমের গোড়াতেই কিছু স্বীকার্য বা assumption থাকে। এই স্বীকার্যগুলোর বাইরে বিজ্ঞান চিন্তা করতে পারে না।
.
যেমন ধরুন Induction: বিজ্ঞানের একটা মূল স্বীকার্য হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মকানুনগুলো মোটের ওপর একই থাকে। আজকে যদি সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, তবে কালকেও তা পূর্বদিকেই উঠবে, যদি না সৌরজগতের কাঠামোতে বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন হয়।
আর্সেনিক আজ বিষাক্ত, বিষাক্ত ছিল কালকেও; তামা বরাবরই তাপে প্রসারিত হয়। নিউটনের কোলে আপেল পড়ার পর মুহূর্তের জন্যও তিনি ভাবেননি— মোটে তো একটা আপেল পড়ল, একটু অপেক্ষা করে দেখি তো এর পরেরটাও এভাবে পড়ে, নাকি শূন্যে ঝুলে থাকে। ওরকম সন্দেহবাদী হলে বিজ্ঞানের ভাত থাকবে না।
.
বায়োকেমিস্ট্রির ছাত্র মাত্রই Lehninger এর বই চেনে; সেটার সূচনায় খুব সুন্দর একটা অবজার্ভেশন আছে,
Science will not work in a universe that plays tricks on us.
মহাবিশ্বের এই রেগুলারিটি বা নিয়মতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস বিজ্ঞানের জন্য খুবই জরুরি। এই যে এই বিশ্বাস—প্রকৃতির নিয়মকানুনগুলো একই রকম থাকা—এটাকে বলে induction.
.
আপনি যদি কোনো বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করেন— বলুন তো Induction কেন কাজ করে?
বুদ্ধিমান হলে তিনি বলবেন— দার্শনিকদের জিজ্ঞেস করুন, আমি induction স্বীকার্য মেনে কাজ করি, স্বীকার্যটা কোত্থেকে আসল তা আমার মাথাব্যথা নয়।
.
একইভাবে, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব কেন আছে, সেটার উত্তর দেওয়াও বিজ্ঞানের কাজ নয়। বিগ-ব্যাং বলুন আর কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বলুন, এরা যেটা ব্যাখ্যা দেয় সেটা হচ্ছে উৎপত্তির ঠিক পর পর সৃষ্টিজগতের চেহারাটা কীরকম ছিল। কিন্তু অস্তিত্বশীলতা ব্যাপারটা আদৌ কেন সম্ভব হলো, সেটার উত্তর পাবেন দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যেসব ব্যাপার বিজ্ঞান স্বীকার্য ধরে নিয়ে কাজ করে, ধর্মের কৃতিত্ব কিন্তু ঠিক সেখানেই। আল্লাহ কুরআনে সূরাহ তূরে অবিশ্বাসীদের কটাক্ষভরে প্রশ্ন করেছেন (আক্ষরিক অনুবাদ দেওয়া হচ্ছে না)—তারা কী তবে শূন্য থেকেই এসে পড়ল? Creatio ex Nihilo বা শূন্য থেকে সৃষ্টির ব্যাপারটা সেই প্লেটোর সময় থেকেই দার্শনিকদের মাথাব্যথার কারণ।
.
বিজ্ঞান শুধু এটুকুই বলতে পারে যে বাঁধা কিছু নিয়মকানুনের ভিত্তিতে কিভাবে কোয়ার্ক-ফিল্ড-ম্যাটার-এনার্জি এদিক-সেদিক হয়ে ইতিহাস তৈরি হলো। কিন্তু শূন্য থেকে গোড়ার সেই কিছু-একটার অস্তিত্ব কিভাবে সম্ভব হলো, তা বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে। আজকাল কোনো কোনো বিজ্ঞানী ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন শূন্যতা জিনিসটাকে অন্য কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করে। ব্যাপারটা মরিয়া চেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়— যেকোনো দার্শনিককে প্রশ্ন করুন, উনি বলে দেবেন শূন্যতা জিনিসটার সংজ্ঞা দেওয়া আদৌ সম্ভব নয় কারণ শূন্যতা জিনিসটার কোনো বৈশিষ্ট্য বা property নেই। যেটার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই তার ওপর প্রাকৃতিক নিয়মকানুন কাজ করার প্রশ্নই আসে না। অক্সফোর্ড দার্শনিক Richard Swinburne ভালোই বলেছেন, এই প্রশ্নগুলো “too big for science”, কাজেই এসব ক্ষেত্রে God of the gaps লজিক খাটবে না মোটেই।
Induction বা মহাবিশ্বের নিয়মতান্ত্রিকতার বিষয়টাও হুবহু তাই। সেই স্কটিশ দার্শনিক David Hume-এর সময় থেকে এ নিয়ে কালিক্ষয় কম হয়নি, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন, বিজ্ঞানীরা এই আলোচনায় কখনো অংশ নেননি। তারা জানতেন এটা দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিকদের গবেষণার বিষয়। কাজেই David Hume, Karl Popper, Bas van Fraassen, Michael Tooley, David Armstrong, John Foster পর্যন্ত যারাই induction নিয়ে গবেষণা করেছেন, সবাই এটাকে দেখেছেন একটা দার্শনিক প্রশ্ন হিসেবে। বিজ্ঞান যেটাকে ধরে নিয়ে কাজ করে সেটার ব্যাখ্যা দেওয়ার সামর্থ্য এর নেই।
.
মজার ব্যাপার হচ্ছে মহাবিশ্বের এই নিয়মতান্ত্রিকতাকেই ধর্মতাত্ত্বিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখেন। হাল আমলে ডেল র্যাৎশ, রিচার্ড সুইনবার্ন, ন্যান্সি কার্টরাইট, জন ফস্টারসহ অনেক দার্শনিকই দেখিয়েছেন— মহাবিশ্বের আইন-কানুন মেনে চলা বা নিয়মতান্ত্রিকতার যে গুণ, সেটা ব্যাখ্যার একমাত্র উপায় হলো এটা ধরে নেওয়া যে মহাবিশ্বের একজন নিয়ন্তা বা ডিজাইনার আছেন, যিনি ঠিক করে রেখেছেন যাতে সবকিছু নিয়মমাফিক চলে। আল্লাহ সূরা ইয়াসিনে প্রকৃতির এই নিয়মতান্ত্রিকতার দিকে দেখিয়ে বলেছেন, সূর্যের পক্ষে সম্ভব নয় চাঁদকে অতিক্রম করা, রাতেরও দিনকে অতিক্রম করা সম্ভব নয় (আক্ষরিক অনুবাদ নয়)।
এরকম আরো বহু উদাহরণ দেওয়া সম্ভব, যেখানে ধর্ম বা আল্লাহতে বিশ্বাস রহস্যের সমাধান করে, অথচ বিজ্ঞানের সংজ্ঞাটাই এরকম যে তার সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অপসৃয়মান নাকি ক্রমবর্ধমান?
আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসে গিয়ে যদি আপনি কারো সাথে ধর্ম বা আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলতে যেতেন, কথোপকথনটা হতে পারত এরকম:
আপনি: মহাবিশ্বের সৃষ্টি হল কিভাবে?
গ্রীক: মহাবিশ্বের আবার সৃষ্টি কী? এটা বরাবরই ছিল, বরাবরই থাকবে।
আপনি: গ্রহ-নক্ষত্রগুলো এত নিয়ম মেনে চলাফেরা করে কেন?
গ্রীক: কেন, অ্যারিস্টটল পড়োনি? বৃত্ত হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট আকৃতি, তাই আকাশমুলুকে সবকিছুই বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে।
আপনি: বুঝলাম, কিন্তু প্রাণিজগত এলো কিভাবে?
গ্রীক: তুমি তো আচ্ছা অশিক্ষিত বাপু। অ্যারিস্টটল বলেছেন, জড় থেকে আপনা-আপনিই প্রাণী সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। গাছের পাতা থেকে মাছ, ময়লা পানি থেকে ব্যাঙ ইত্যাদি তৈরি হয়। অন্যান্য প্রাণীরও এরকম আপনা-আপনি সৃষ্টির ব্যবস্থা আছে।
ওপরের কোনো উত্তরই একজন ধর্মবিশ্বাসীর পছন্দ হবে না, একজন বিজ্ঞানীরও নয়। কিন্তু অনেককাল পর্যন্ত মানুষের বিশ্বাস ছিল এরকমই। সেসময়কার গ্রীসে ঈশ্বরে অবিশ্বাস করা তাই ছিল বেশ সহজ। এখন প্রেক্ষাপট ভিন্ন, বিশেষ করে এই বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে। গেল শতাব্দীর মাঝখানে মলিক্যুলার বায়োলজির বিপ্লবের পর মানুষ যখন কোষ জিনিসটার ভেতরে তাকাতে শিখল, তার বিস্ময় বাড়ল বই কমল না:

সেই আঠারো শতকে ব্রিটিশ দার্শনিক উইলিয়াম পেইলি জীবদেহকে তুলনা করেছিলেন ঘড়ির সাথে। ঐসব ঘড়ি-ফড়িতে এখন আর কুলোবে না। বেশি কিছু না, কোষের ইনফরমেশন প্রোসেসিং সিস্টেমটুকুর জটিলতাই ধারণার বাইরে।
.
বিল গেটস বলেছেন, ডিএনএ একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের মত, শুধু আমাদের বানানো যেকোনো প্রোগ্রামের চেয়ে হাজার কোটিগুণ জটিল। এই কোষ সম্পর্কে বিজ্ঞানের অগ্রগতিটার ইতিহাস যদি পড়ে দেখেন, একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ্য করবেন। God of the gaps এর সমর্থকরা যা বলছে, এই ইতিহাস তার সম্পূর্ণ উলটো। গ্রীকদের সময় তো বাদই দিলাম, উনিশ শতকের শেষ দিকে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন কোষ হচ্ছে প্রোটোপ্লাজমের দলা। বিশ শতকের শুরুতে এনজাইম আবিষ্কারের ফলে কোষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা একটু বাড়ল, কিন্তু ষাটের দশকে ওয়াটসন-ক্রিক ডিএনএর গঠন দেখিয়ে সব আন্দাজ উড়িয়ে দিলেন। ক্রিক শেষ জীবনে ডিএনএর জটিলতা দেখে নিতান্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন—এসব বানানো প্রকৃতির কর্ম নয়, এখানে নির্ঘাত এলিয়েনদের হাত আছে। এটাকেই বলে Directed panspermia হাইপোথিসিস, ড্যান ব্রাউন-টাউনরা যেটাকে জনপ্রিয় করেছেন।
পদার্থবিজ্ঞান থেকেও এরকম উদাহরণ দেওয়া যায়, কিন্তু পয়েন্টটা আশা করি বুঝেছেন—বিজ্ঞান যে শুধু সবসময় আমাদের জ্ঞানের গ্যাপ পূরণ করে তাই নয়, মাঝেমাঝে সেটাকে হা করে খুলে দেয়।
মলিক্যুলার বায়োলজি তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এরকম বিশাল, ক্রমবর্ধমান গ্যাপ পূরণ করা আদৌ বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নাকি সেটা একটা প্রশ্ন। প্রকৃতির বিশেষ করে জীবজগতেরএরকম অনেক জটিল গঠনশৈলী দেখে অনেকেই শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরকে আনতে বাধ্য হন। তাদের মতে, ধর্ম বা ঈশ্বর এখানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে বাধা নয়, বরং বিজ্ঞান আমাদের ঈশ্বরের দিকেই নির্দেশ করছে। রিচার্ড সুইনবার্ন এদের সম্পর্কে বলেছেন, এই ব্যাপারগুলো “too odd for science”.
কাজেই আমরা দেখলাম—
প্রথমত, বিজ্ঞান আর ধর্মের করা প্রশ্নগুলোই আলাদা।
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞানের একটা নির্দিষ্ট সীমা বা আওতা আছে, তার বাইরের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। আর এই প্রশ্নগুলোই ধর্মের পছন্দের।
তৃতীয়ত, আমাদের জ্ঞানের শূন্যতা মাঝে মাঝে বিজ্ঞান দিয়ে পূরণ হয় বটে, কিন্তু কখনো কখনো অনেক অনেক বেড়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে হাইপোথিসিস হিসেবে ধর্মবিশ্বাস বেশ কার্যকর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন