রাসুল স. এর কাছে ইসতিগাছা

 বিপক্ষের দলীল


১। নবীজি সঃ কবরে জীবিত আছে। তবে এই বারযাখি জীবন দুনিয়ার জীবনের মতো নয়। তাই দুনিয়ার জীবনের বৈশিষ্ট্য বারযাখী জীবনের উপর কিয়াস করা উচিত নয়।
২। বারযাখি জীবন গায়েবী। তাই নুসুসে এই জীবন সম্পর্কে যা বলা আছে শুধু সেটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত।
৩। নবীজির (সঃ) রওযার নিকট গিয়ে তাঁর কাছে শাফায়াত ও দুয়া চাওয়ার পক্ষে যেসব দলিল উল্লেখ করা হয় তা (ক) দূর্বল, নয়তো (খ) দ্ব্যার্থবোধক, নয়তো (গ) এক্সেপশনাল কেইস যা বাকি সাহাবি-তাবেয়ীগন জেনারেলি আমল করেননি।
৪। দলিলগুলো দ্ব্যার্থবোধক হওয়ার কারণে বিশাল সংখ্যক আলেম এই মাসআলা নিয়ে ইখতিলাফ করেছেন। অতএব এমন ইখতিলাফি বিষয়ের উপর সরাসরি শিরক তকমা দেয়া অনুচিত।
৫। হাদিসে কবরকেন্দ্রীক সতর্কতামূলক বক্তব্য, বিশেষ করে খোদ নবীদের কবরকেন্দ্রীক সতর্কতামূলক হাদিস সংখ্যায় যেমন প্রচুর, অর্থেক দিক থেকেও তেমনি স্পষ্ট ও ব্যাপকতর।
৬। সন্দেহজনক বিষয় থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।
৭। দূর থেকে সালাম পেশ করাই যথেষ্ট, কাছে আসা বাধ্যতামূলক নয়।
৮। যদি এমন কাজ এতোই ভালো হতো, সাহাবীগন খুব বেশী করেই করতেন। অথচ নবীজির (সঃ) কবরকেন্দ্রীক এমন কোন কর্মশালাই তাদের মধ্যে হয়নি।
৯। এমনকি মসজিদে নববীতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে এলেও নিয়মিতভাবে মদিনার সাহাবীগন তাঁর কবর যিয়ারত করতেন এমন প্রমাণও পাওয়া যায়না।
১০। আহলে বাইত আলী ইবনু হুসাইন ইবনু আলী (জয়নুল আবেদীন) একদা এক ব্যক্তিকে নিয়মিত নবীজির (স) কবরের কাছে বসে দুয়া করতে দেখে তাকে নবীর কবরকে ঈদের স্থান না বানানো ও দূর থেকে সালাম পাঠানোর হাদিস শুনিয়ে নিষেধ করে দেন।
১১। আলেমগন যেসব শর্ত মেনে এই দুয়া ও শাফায়াতের অনুরোধকে জায়েয বলেছেন, বাস্তবিকভাবে সেই শর্ত বেশীরভাগ মানুষের মধ্যেই অনুপস্থিত থাকে। তাই শিরক-কুফর ও বিদআতের রাস্তা আগে থেকেই বন্ধ করে দেয়া উচিত।



পক্ষের দলীল

অনেক আলিম, চার মাযহাবের অনেক ফকীহ ও মুহাদ্দিস নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজার সামনে উপস্থিত হয়ে দোয়া ও শাফায়াত চাওয়াকে বৈধ মনে করতেন বা অন্ততপক্ষে এর সুযোগ আছে বলে মনে করতেন। তারা মূলত এটাকে জায়েজ বলেছেন বেশকিছু দলীলের ভিত্তিতে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: 

# (এক.) নবীজী (সা.) কবরে জীবিত। [উম্মাহর সর্বসম্মত আকীদা]  
# (দুই.) তাঁর কাছে গিয়ে সালাম দিলে তিনি শুনতে পান এবং তিনি জবাব দেন। [আবু দাঊদ ও শুআবুল ঈমান; ইবনে হাজারসহ একাধিক হাফিজ দ্বিতীয় বর্ণনার সনদকে গ্রহণেযোগ্য বলেছেন; তাছাড়া শ্রবণ কুরআন- সুন্নাহর সাধারণ নীতি দ্বারাও প্রমাণিত] 
# (তিন.) তাঁর কাছে উম্মাহর আমলনামা পেশ করা হয় এবং তিনি ভালো দেখলে খুশি হন, মন্দ দেখলে ইস্তিগফার করেন। [বাযযার] 
# (চার.) আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন শাফায়াতের অধিকার দিয়েছেন। ফলে একজন নন; একাধিক সাহাবী তাঁর কাছে জীবদ্দশায় শাফায়াত প্রার্থনা করেছেন (حَاجَتِي أَنْ تَشْفَعَ لِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ)। (أَسْأَلُكَ أَنْ تَشْفَعَ لِي إِلَى رَبِّكَ فَيُعْتِقَنِي مِنَ النَّارِ ) [আহমদ] 
# (পাঁচ.) ওফাতের পরে সাহাবী বিলাল ইবনে হারেস আল-মুযানী রওযার কাছে এসে নবীজী (সা.) কে লক্ষ করে বলেছেন, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার উম্মতের জন্য বৃষ্টির দুআ করুন। তারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে'! (فَجَاءَ رَجُلٌ إِلَى قَبْرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ : يَا رَسُولَ اللهِ ، اسْتَسْقِ لِأُمَّتِكَ فَإِنَّهُمْ قَدْ هَلَكُوا) [মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা; হাফেজ ইবনে হাজার এর সনদকে সহীহ বলেছেন] 
# (ছয়.) তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনুল মুনকাদির রওযার পাশে সঙ্গীদের নিয়ে বসতেন। কখনো কখনো উঠে গিয়ে নবীজীর রওযার ওপর নিজ গাল রাখতেন। এই ব্যাপারে সমালোচনা হলে তিনি বলেন, (إنه يصيبني خطر، فإذا وجدت ذلك، استعنت بقبر النبي -صلى الله عليه وسلم) অর্থাৎ 'আমি পেরেশান হলে নবীজী (সা.) এর কবরের কাছে/মাধ্যমে সাহায্য চাই'। [সিয়ারু আলামিন নুবালা; যাহাবী উক্ত বর্ণনার ওপর আপত্তি করেননি] 

একদিকে নবীজী কর্তৃক কবরে সালাম শোনার হাদীস অপরদিকে সাহাবা ও তাবেয়ীদের এমন একাধিক আমলী বর্ণনা থাকার কারণে পরবর্তী উলামায়ে কিরাম নবীজীর (সা.) রওযার কাছে এসে সালাত-সালামের সঙ্গে দুআ ও শাফায়াত চাওয়া বৈধ বলেছেন। নিজেরাও আমল করেছেন। কয়েকটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি: 

# (এক.) মালেকী আলিম কাযী ইয়াজ বর্ণনা করেন, ইমাম মালেক খলীফা আবু জাফরকে বলেন, (فقال ولم تصرف وجهك عنه وهو وسيلتك ووسيلة أبيك آدم عيه السلام إلى الله تعالى يوم القيامة؟ بل استقبله واستشفع به فيشفعه الله) 'আপনি কেন তাঁর থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দুআ করবেন অথচ তিনি কিয়ামতের দিন আপনার ও আপনার পিতা আদমের উসীলা। বরং তাঁর দিকে মুখ করুন। তাঁর মাধ্যমে শাফায়াত চান। আল্লাহ তাকে আপনার শাফায়াতকারী বানাবেন'। [আশ-শিফা] 

# (দুই.) হানাফী ফকীহ কামাল ইবনুল হুমাম (র.) রওযা যিয়ারতের আদব বর্ণনা প্রসঙ্গে লেখেন, (ثم يسأل النبي - صلى الله عليه وسلم - الشفاعة فيقول. يا رسول الله أسألك الشفاعة، يا رسول الله أسألك الشفاعة وأتوسل بك إلى الله في أن أموت مسلما على ملتك وسنتك) অর্থাৎ (সালাত-সালামের পরে) নবীজী (সা.) এর কাছে শাফায়াত চাইবে। বলবে, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার কাছে শাফায়াত চাই। আপনার উসীলায় আল্লাহর কাছে দুআ করি, যেন আমি আপনার মিল্লাত ও সুন্নাতের ওপর মুসলিম হিসেবে মৃত্যুবরণ করি'! [ফাতহুল কাদীর] 

# (তিন.) হাম্বলী ফকীহ ইবনে কুদামা (র.) রওযা যিয়ারতের আদব প্রসঙ্গে উতবীর উদ্ধৃতিতে একটি ঘটনা উল্লেখ করেন যাতে এসেছে, (وقد جئتك مستغفرا لذنبي، مستشفعا بك إلى ربي) 'এক ব্যক্তি নবীজী (সা.) এর রওযার কাছে এসে বললো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনার কাছে আমার গুনাহের ইস্তিগফারের জন্য এসেছি। আমার রবের কাছে আপনার মাধ্যমে শাফায়াত প্রার্থনার উদ্দেশ্যে এসেছি'! [আল-মুগনী; ইবনে কুদামা উক্ত ঘটনার ওপর কোনো আপত্তি করেননি] 

# (চার.) শাফেয়ী ফকীহ ইবনে কাসীর (র.) তাঁর বিখ্যাত তাফসীরেও পূর্বোক্ত বর্ণনা একরকম ইতিবাচক শব্দে উল্লেখ করেছেন। সনদ কিংবা মাতন নিয়ে কোনো সমালোচনা আনেননি। [তাফসীরে ইবনে কাসীর] 

# (পাঁচ.) আরেক হাম্বলী আলিম ইবনুল জাওযী রওযা যিয়ারতের আদব প্রসঙ্গে লেখেন, (وليتأدب في الوقوف وليستشفع بالحبيب وليأسف إذ لم يحظ برؤيته ولم يكن في صحابته) 'আদবের সঙ্গে (নবীজীর সামনে) দাঁড়াবে। প্রিয় হাবীব (সা.) এর কাছে/মাধ্যমে শাফায়াত চাইবে। তাঁর মুলাকাত না পাওয়া ও তাঁর সাহাবী না হতে পারার জন্য আফসোস করবে'! [আত-তাবসিরাহ] 

# (ছয়.) ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (র.) এর শাগরিদ ইমাম যাহাবী ইবনুল মুকরী হাম্বলীর উদ্ধৃতিতে লেখেন, (فلما كان وقت العشاء حضرت القبر وقلت: يا رسول الله الجوع؛ فقال لي الطبراني: اجلس فإما أن يكون الرزق أو الموت، فقمت أنا وأبو الشيخ فحضر الباب علوي ففتحنا له فإذا معه غلامان بقفتين فيهما شيء كثير وقال: شكوتموني إلى النبي -صلى الله عليه وآله وسلم- رأيته في النوم فأمرني بحمل شيء إليكم) সারকথা, তারা তিনজন সঙ্গী মসজিদে নববীতে ক্ষুধার্ত ছিলেন। এক পর্যায়ে ইবনুল মুকরী নবীজীর রওযার কাছে গিয়ে বলেন, 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! ক্ষুধা!! অতঃপর একজন  আলাভী এসে বলেন, তোমরা নবীজীর কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছো। তিনি আমাকে তোমাদের কাছে খাবার নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছেন'! [তাযকিরাতুল হুফফায; যাহাবী উক্ত ঘটনা একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেছেন] 

# ওপরে উদ্ধৃত আলিমগণের প্রত্যেকেই ইসলামের ইতিহাসের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিবর্গ নন। ফলে বলাই যায়, চার মাযহাবের অনুসারী বিভিন্ন যুগের এবং বিভিন্ন অঞ্চলের একাধিক বিখ্যাত উলামা, মুহাদ্দিস ও ফুকাহা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজার [অন্য কারও কবর নয়] সামনে উপস্থিত হয়ে [দূর থেকে নয়] তাঁর কাছে দোয়া এবং শাফায়াত [অন্য কিছু যথা সন্তান বা সম্পদ ইত্যাদি নয়) চাওয়া, দুআয় তাঁকে উসীলা হিসেবে গ্রহণ করাকে সমর্থন করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ নিজেরাই এই আমল করেছেন, অন্যকে করতে বলেছেন, আবার কেউ তাঁদের গ্রন্থাবলীতে সমালোচনা বা বিরোধিতা ছাড়াই বর্ণনা করেছেন যা তাদের মৌন সম্মতির পরিচায়ক। আর পরবর্তী যুগের শাম, মিসর ও হিন্দস্তানের চার মাযহাবের অনুসারী আলিমগণ প্রায় সর্বসম্মতভাবেই উক্ত আমলের সমর্থন করেছেন। ফলে যেই মাসআলায় উম্মতের এতো আলিমের সমর্থন রয়েছে, এবং যেটির পক্ষে সুন্নাহর দলিল ও সালাফের আমল রয়েছে, সেটিকে পছন্দ না হলে পছন্দ করি না, সর্বোচ্চ জায়েজ মনে করি না, বলা যেতে পারে। কিন্তু একবাক্যে 'শিরকে আকবর' বলা বিচ্ছিন্নতা ও বড় মাপের ধৃষ্টতা

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

৭১ এর যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস