সকল হাদীস ই কি গ্রহণযোগ্য ?




শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রঃ) –এর মতে হাদিসের কিতাবের স্তরসমুহ
প্রথম স্তর
এ স্তরের কিতাবসমূহে কেবল সাহীহ হাদিসই রয়েছে। এ স্তরের কিতাব মাত্র তিনটিঃ মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ। সকল হাদীস বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, এ তিনটি কিতাবের সমস্ত হাদীসই নিশ্চিতরূপে সহীহ।
দ্বিতীয় স্তর
এ স্তরের কিতাবসমূহ প্রথম স্তরের খুব কাছাকাছি। এ স্তরের কিতাবে সাধারনতঃ সহীহ ও হাসান হাদীসই রয়েছে। যঈফ হাদীস এতে খুব কম আছে। নাসাঈ শরীফ, আবূ দাঊদ শরীফ ও তিরমিযী শরীফ এ স্তরের কিতাব। সুনান দারিমী, সুনান ইবন মাজা এবং শাহ ও ওয়ালি উল্লাহ (রঃ)-এর মতে মুসনাদ ইমাম আহমেদকেও এ স্তরে শামিল করা যেতে পারে। এই দুই স্তরের কিতাবের উপরই সকল মাজহাবের ফাকীহগণ নির্ভর করে থাকেন।
তৃতীয় স্তর
এ স্তরের কিতাবে সহীহ, হাসান, যঈফ, মা’রুফ ও মুনকার সকল প্রকারের হাদীসই রয়েছে। মুসনাদ আবী ইয়া’লা, মুসনাদ আবদুর রাযযাক, বায়হাকী, তাহাবী ও তাবারানী (রঃ)-এর কিতাবসমূহের এ স্তরেরই অন্তর্ভুক্ত।
চতুর্থ স্তর
হাদীস বিশেষজ্ঞগণের বাছাই ব্যাতিত এ সকল কিতাবের হাদীস গ্রহণ করা হয় না। এ স্তরের কিতাবসমুহে সাধারনতঃ যইফ হাদীসই রয়েছে। ইবন হিব্বানের কিতাবুয যুআফা, ইবনুল-আছীরের কামিল ও খতীব বাগদাদী, আবূ নুআয়ম-এর কিতাবসমূহ এই স্তরের কিতাব।
পঞ্চম স্তর
উপরের স্তরেগুলোতে যে সকল কিতাবের স্থান নেই সে সকল কিতাবই এ স্তরের কিতাব।
তথ্যসুত্রঃ
১।শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রঃ) রচিত “হুজ্জাতুল্লাহহিল বালিগা”
২। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সহিহ বুখারীর ভুমিকা
৩। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত সহিহ মুসলিমের ভুমিকা

 তাবে তাবেয়ীনদের যুগ থেকেই সুফিরা জাল হাদীস প্রচারে লিপ্ত হয়েছিল। এ জন্য অনেক মুহাদ্দীস ই তাদের কোন হাদীস ই গ্রহণ করেন নি। ইমাম মালিক বলতেন, মদীনায় অনেক দরবেশ আছেন, যাদের কাছে আমি লক্ষ টাকা আমানত রাখতে রাজি আছি, কিন্তু তাদের বর্ণিত একটি হাদীসও আমি গ্রহণ করতে রাজি নই । ইয়াহইয়া ইবনে সাইদ আল কাত্তান বলেন, নেককার বুযর্গরা রাসূলুল্লাহ স. এর হাদীসের বিষয়ে যত বেশী মিথ্যা বলেন অন্য কোন বিষয়ে তারা এত মিথ্যা বলেন না। কিন্তু বেখেয়ালে তারা মিথ্যাচারে লিপ্ত হন। কারন তারা হাদীস সঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে পারেন না, উল্টে পাল্টে ফেলেন, অধিকাংশ সময় মনের আন্দাজে হাদীস বলেন, ফলে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাচারে লিপ্ত হন।

নেককার বলে পরিচিত কিছু মানুষ এর চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হতেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ স.এর নামে বলতেন। হাদিস জালিয়াতির ক্ষেত্রে এরাই ছিলেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক। তারা যে সকল বিষয়ে হাদীস বানিয়েছেন তার অনেক বিষয়ে অনেক সহিহ হাদীস রয়েছে। কিন্তু এসকল নেককার ! মানুষ অনুভব করেছেন যে, এ সকল সহিহ হাদীসের ভাষা ও সেগুলোতে বর্ণিত পুরষ্কার বা শাস্তিতে মানুষের আবেগ আস না। তাই তারা আরো জোড়ালো ভাষায় বিস্তারিত কথায় অগণিত পুরষ্কার ও কঠিনতম শাস্তির কথা বলে হাদীস বানিয়েছেন, যেন মানুষেরা তা শুনেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এভাবে তারা ওহীর অপূর্ণতা ! মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে পুরন ! করতে চেয়েছেন। সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল যে, তাদের ধার্মিকতার কারনে সমাজের অনেক মানুষই তাদের এসকল জালিয়াতির ক্ষপ্পরে পড়তেন। তারা এগুলোকে হাদীস বলে বিশ্বাস করেছেন।

শয়তান এদেরকে বুঝিয়েছিল যে, আমরা তো রাসূল স. এর বিরুদ্ধে নয়, পক্ষেই মিথ্যা বলছি। এ সকল মিথ্যা ছাড়া মানুষদের হেদায়েত করা সম্ভব নয়। কাজেই ভাল উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা শুধু জয়েযই নয় বরং ভাল কাজ। শয়তান তাদেরকে বুঝতে দেয় নি যে, তাদের সব চিন্তাই ভুল খাতে প্রবাহিত হয়েছে। মিথ্যা ছাড়া মানুষদেরকে ভাল পথে আনা যাবে না একথা ভাবার অর্থ হলো ওহী মানুষকে হেদায়েত করতে সক্ষম নয়। কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধ হাদীস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই আজগুবি মিথ্যা দিয়ে মানুষকে হেদায়েত করতে হবে ! কি জঘন্য চিন্তা !

তাদের এ সকল মনগড়া কথা যে ওহীর পক্ষে বা আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষে সে কথা দাবী করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে ? তারা যে কথাকে ইসলামের পক্ষ্যে বলে মনে করেছে তা সর্বদা ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। আজগুবি গল্প, অল্প কাজের অকল্পনীয় সওয়াব, সামান্য অন্যায়ের ঘোরতর শাস্তি, সৃষ্টির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাল্পনিক কাহিনী, কাল্পনিক অলৌকিক কারাতমতের কাহিনী, বিভিন্ন বানোয়াট ফজিলতের কাহিনী ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করেছে। অগনিত কুসংস্কার ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে। নফল ইবাদতের সওয়াবের বানানো মনগড়া কল্প কাহিনী মুসলিম উম্মাহকে ফরয দায়িত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে। অগনিত মনগড়া আমল মুসলমানদেরকে কুরআন ও সহিহ হাদীসে বর্ণিত কর্ম ও দায়িত্ব থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা পরবর্তিতে বানোয়াট হাদীসগুলো আলোচনার সময় এসবের অনেক উদাহরন দেখতে পাব।

ওহীর পক্ষ্যে মিথ্যা বলার কারনেই যুগে যুগে সকল ধর্ম বিকৃত হয়েছে। ওহীর পক্ষ্যে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃষ্টধর্মের বিকৃতকারী পৌল নামধারী শৌল এবং তার অনুসারী খৃষ্টানগণ। এরা ইশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, যিশুর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ও অধিক সংখ্যক মানুষকে সুপথে আনয়ন করার জন্য ওহীর নামে মিথ্যা বলেছে। এরা ভেবেছে যে, আমরা ইশ্বরের বা যীশুর পক্ষে বলছি, কাজেই এ মিথ্যায় কোন দোষ নেই। কিন্তু তারা মুলত শয়তানের খেদমত করেছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, "বল হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না। এবং যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না।"

মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এই ধরনের পথভ্রষ্ট খেয়াল খুশীমত ওহী বানানো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে। এ সকল নেককার জালিয়াত বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাদীস তৈরী করতেন।

১. কিছু মানুষ কুরআন এবং কুরআনের বিভিন্ন সুরা তিলাওয়াতের অগনিত কাল্পনিক সওয়াব বর্ণনা করে হাদীস তৈরী করতেন।

২. অনেকে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত বিভিন্ন নেক আমলের সওয়াব বর্ণনায় হাদীস তৈরী করতেন। যেমন তাসবীহ, যিকির, তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি নামাজের অকল্পনীয় সওয়াবের বানোয়াট ফজিলত।

৩. কেউ কেউ বিভিন্ন প্রকার নেক আমল তৈরী করে তার ফযীলতে হাদীস বানাতেন। যেমন বিভিন্ন মাসের জন্য বিশেষ পদ্ধতির সালাত, সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্য বিশেষ সালাত, আল্লাহকে স্বপ্নে দেখা, রাসূলুল্লাহ স. কে স্বপ্নে দেখা, জান্নাতে নিজের স্থান দেখা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ সালাত। অনুরুপভাবে বিভিন্ন দরুদ, যিকির, দোয়া, মুনাজাত ইত্যাদি বানিয়ে সেগুলোর বানোয়াট ফজিলত উল্লেখ করে হাদীস তৈরী করেছেন। এরুপ অগনিত ইবাদত তারা তৈরী করেছেন এবং সেগুলোর ফযীলতের কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অগনিত সওয়াব ও ফজীলতের কাহিনী বলেছেন।

৪. অনেক মানুষের অন্তর নরম করার জন্য সংসার ত্যাগ, ক্ষুধার ফযীলত, দারিদ্রের ফজীলত, বিভিন্ন কাহিনী, শাস্তি, পুরষ্কার বা অনুরুপ গল্প কাহিনী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ স. এর নামে চালিয়েছেন।

আল্লামা সাইয়্যেদ শরীফ জুরজানী হানাফি লিখেছেন, মওযু বা বানোয়াট হাদীস প্রচলনে সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন দুনিয়াত্যাগী দরবেশগণ, তারা অনেক সময় সওয়াবের নিয়াতেও মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলতেন। ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, বর্ণিত আছে যে, কোন কোন সুফি সওয়াবের বর্ননায় ও পাপাচারের শাস্তির বর্ণনায় মিথ্যা হাদীস বানানো ও প্রচার করা জায়েজ মনে করতেন। সুয়ুতী বলেন, জালিয়াতির উদ্যেশ্য অনুসারে মিথ্যাবাদী জালিয়াতিগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারত্মক ও ক্ষতিকর ছিলেন কিছু মানুষ যাদেরকে সংসারত্যাগী নিলোর্ভ নেককার মনে করা হত। তারা তাদের বিভ্রান্তির কারনে আল্লাহর নিকট সওয়াব পাবার আশায় মিথ্যা হাদীস বানাতেন। ২য় শতকের প্রখ্যাত দরবেশ আবু দাউদ নাখয়ী সুলাইমান ইবনু আমর রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ে ও দিনের পর দিন নফল সিয়াম পালনে ছিলেন অতুলনীয়। তা সত্বেও তিনি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতেন। আবু বিশর আহমদ ইবনু মুহাম্মদ আল-মারওয়াযী খোরাসানের অন্যতম ফকীহ, আবেদ ও সুন্নতের সৈনিক ছিলেন। সুন্নাতের পক্ষ্যে এবং বিদাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথাকে হাদীসের নামে প্রচার করতেন। ওয়াহাব ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু হাফস তার যুগের অন্যতম নেককার আবিদ ও ওয়ায়িয ছিলেন। ২০ বছর তিনি কারো সাথে কোন জাগতিক কথা পর্যন্ত বলেন নাই। তিনিও হাদীসের নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলতেন।

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় ৪ শতাব্দি পর্যন্ত হাদীস সংকলনের যে ধারা চালু থাকে এর প্রধান উদ্দেশ্য্ই ছিল রাসূলুল্লাহ স. এর নামে কথিত ও প্রচারিত সকল হাদীস সংকলিত করা। যাতে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দীসগণ নিরীক্ষাভিত্তিক বিধানের আলোকে এগুলির মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হাদীস বেছে নিতে পারেন। অনেকে বর্ণনাকারী রাবী বা বর্ণনাকারী সাহাবীর নামের ভিত্তিতে হাদীস সংকলন করতেন। কেউ বা বিষয়ভিত্তিক হাদীস সংকলন করতেন। সবারই মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীস নামে প্রচলিত সব কিছু সংকলিত করা।

এজন্য আমরার দেখতে পাই প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে সহীহ. যয়ীফ, জাল সকল প্রকার হাদীস সংকলিত হয়েছে। এখানে অজ্ঞতার কারনে অনেকে ভুল ধারনার কবলে পড়েন। উপরের পরিচ্ছেদগুলিতে আলোচিত সাহাবী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণের হাদীস বিচার, সনদ যাচাই, নিরীক্ষা ইত্যাদি থেকে অনেকে মনে করেন যে, মুহাদ্দিসদের এ সকল বিচার ও নিরীক্ষার মাধ্যমে যাদের ভুল বা মিথ্যা ধরা পড়েছে তাদের হাদীস তো তারা গ্রহণ করেননি এবং সংকলনও করেন নি। কাজেই কোন হাদীসের গ্রন্থে হাদীস সংকলনের অর্থ হলো এসকল হাদীস নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেই উক্ত মুহাদ্দীস হাদীসগুলিকে তার গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।

এ ধারনাটি একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত এবং প্রকৃত অবস্থার একেবারেই বিপরীত। কয়েকজন সংকল বাদে কোন সংকলকই শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেন নি। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, আলিম ও ইমাম হাদীস সংকলন করেছেন সহীহ, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকার হাদীস সনদ সহ একত্রিত করার উদ্দেশ্যে; যেন রাসূলুল্লাহ স. এর নামে কথিত বা প্রচারিত সকলকিছুই সংরক্ষিত হয়। তার কোন হাদীসই রাসূলুল্লাহ স. এর কথা বা কাজ হিসেবে সরাসরি বর্ণনা করেন নি। বরং সনদসহ, কে তাদেরকে হাদীসটি কার সূত্রে বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। তারা মূলত বলেছেন; "অমুক ব্যাক্তি বলেছেন যে, 'এই কথাটি হাদীস', আমি তা সনদসহ সংকলিত করলাম। হাদীস প্রেমিক পাঠকগণ এবার সহিহ, যয়ীফ ও জাল বেছে নিন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তার সনদের আলোচনা করেছেন এবং দূর্বলতা বা সবলতা বর্ণনা করেছেন।

অল্প কয়েকজন সংকলক শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল বুখারী, ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী অন্যতম। তাদের পরে আব্দুল্লাহ ইবনে আলী ইবনে জারদ (৩০৭ হিHappy, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে খুযাইমা (৩১১ হিHappy, আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনুশ শারকী (৩২৫ হিHappy, কাসিম বিন ইউসুফ আল-বাইয়ানী (৩৪০ হিHappy, সাইদ ইবনে উসমান ইবনুস সাকান (৩৫৩ হিHappy, আবু হাতিম মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান আল-বসুতি (৩৫৪ হিHappy, আবু আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ হাকীম নাইসপুরি (৪০৫ হিHappy, জিয়াউদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহিদ আল-মাকদাসী (৬৪৩ হিজরী) প্রমুখ মুহাদ্দিস শুধুমাত্র সহিহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করে সহীহ গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসদের চুলচেরা নিরীক্ষার মাধ্যমে শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্থদয়েরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমানিত হয়েছে। বাকী কোন গ্রন্থেরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমানিত হয় নি। বরং অধিকাংশ গ্রন্থই যয়ীফ ও জাল হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে প্রমণিত হয়েছে।

দ্বাদশ শতকের অন্যতম আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে শুধুমাত্র তিনটি গ্রন্থ। বুখারী, মুসলিম ও মুয়াত্তায় ইমাম মালেক। এ গ্রন্থতিনটিস সকল সনদসহ বর্ণিত সকল হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে বলে হলেও সেগুলিতে অনেক অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এসকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন ও তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনটি গ্রন্থ। সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাই, সুনানে তিরমিযী। ইমাম আহমদের মুসনাদও প্রায় এই পর্যায়ের।

তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসিলম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সহিহ, যয়ীফ ও মিথ্যা সব ধরনের হাদীসই রয়েছে। যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দীস ছাড়া এ সকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দীসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছে, মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বায়হাকীর হাদীস গ্রন্থ সমূহ, ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থ সমূহ, তাবরানীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ সমূহ। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তারা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।

চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলো হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রন্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন প্রকারের হাদীস সংকলন করেছেন। ১. যে সকল হাদীস পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারনে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, ২. যে সকল হাদীস কোন অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, ৩. লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়ায়েযদের ওয়াযে প্রচলিত বিভিন্ন কথা যা কোন হাদীসের গ্রন্থে স্থান পায়নি, ৪. বিভিন্ন দূর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, ৫. যে সকল হাদীস মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদীদের গল্প বা পূর্ববর্তী যামানার জ্ঞানী ব্যাক্তিদের কথা, যেগুলোকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোন বর্ননাকারী হাদীস বলে বর্ননা করেছেন, ৬. কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতিয় কথা যা ভুলক্রমে কোন সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, ৭. হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূর্বক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন অথবা বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ননা করেছেন। এ ধরনের হাদীস সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইবনে হিব্বানের আদ-দুয়াফা, ইবনে আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নাইম আল-ইসফাহানী, ইবনে ইসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদে ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এই পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় যযীফ অথবা জাল।

অজ্ঞতা বশত অনেকেই মনে করেন যে, কোন হাদীস কোন হাদীস-গ্রন্থ সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহিহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহিহ। যেমন কোন হাদীস যদি সুনানে ইবনে মাজাহ বা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো হাদীসটি নিশ্চিত সহিহ, নইলে ইবনে মাজাহ তার গন্থে হাদীসটির স্থান দিতেন না। এ ধারনাটির উভয় দিক ই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দীস ই তার গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, জাল সকল প্রকার হাদীস ই সংকলন করেছেন। তারা কখনোই দাবী করেন নি যে, তাদের গ্রন্থে শুধু সহিহ হাদীস সংকলন করবেন। কাজেই কোন হাদীস সুনানে আবনে মাজাহ বা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে এ সংকলিত থাকাতে কখনোই বুঝা যায় না যে, হাদীসটি সহিহ বা ইবনে মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মতে সহীহ।

ইবনে হিব্বান, ইবনে খুযাইমা, ইবনুস সাকান, হাকেম ও অন্যান্ন যে কল মুহাদ্দীস তাদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করার চেষ্টা করেছেন, তাদের গ্রন্থে কোন হাদীস সংকলিত হলে আমরা মনে করব যে, হাদীসটি উক্ত মুহাদ্দীসের মতে সহিহ। তবে এতে প্রমানিত হয় না যে, হাদীসটি প্রকৃতপক্ষে সহিহ। কোন মুহাদ্দীসের দাবীই উম্মাহর পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ নিরীক্ষা ছাড়াই গ্রহণ করেন নি। এ জন্য আমরা অন্যা্ন্ন মুহাদ্দীসের নিরীক্ষার আলোকে হাদীসটির বিধান নির্ধারন করব।

আমাদের সমাজে সিহাহ সিত্তাহ নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২ টি সহীহ গ্রন্থ; বুখারী ও মুসলিম ছাড়া বাকী ৪ টি সঃকলকও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোন সিদ্ধান্ত নেননি। তারা তাদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ এবং জাল হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাদের গ্রন্থগুলির অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারনে পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ সাধারনভাবে তাদের গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর করেছেন সাথে সাথে তারা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দূর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রদান করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪ হিHappy এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন এ চার গ্রন্থে সংকলিত সংকলিত সকল হাদীস সহীহ নয়। বরং এ সকল গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকারের হাদীস রয়েছে।

ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীস দেহলভীর বিবরণ দেখেছি। তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাই, সুনানে তিরমিযী এ তিনটি গ্রন্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন। যে সকল গ্রন্থের হাদীস সমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি সুনান ইবনে মাজাহকে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেন নি। এর কারন হল মুহাম্মদ ইবনে মাজাহ আল-কাযবিনী সংকলিত সুনান গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণযোগ্য গ্রন্থাবলীর অন্তর্ভূক্ত করেন নি। হিজরী ৭ম শতক পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমের অতিরিক্ত এ তিনটি সুনান গ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনু তাহির মাকদিসী, আবুল ফদল ইবনুল কাইসুরানী এগুলোর সাথে সুনান ইবন মাজাহ যোগ করেন।

তার এ মত পরবর্তী ২ শতাব্দি পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেন নি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রহমান, আল্লামা আবু যাকারিয়া ইবনু শারাফ আন-নববী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসেবে উপরের ৫ টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহকে তারা এগুলির মধ্যে গন্য করেন নি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মদ ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে ইমাম মালিকের মুয়াত্তাকে গন্য করেছেন।

ইমাম ইবনে মাজাহ এর সুনান গ্রন্থ মোট ৪৩৪১ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ ইবনু আবী বকর আল-বুসিরী ইবনে মাজাহর এসকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বুসিরী ১৪৭৬ টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন যেগুলি উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয়নি, শুধুমাত্র ইবনে মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলির মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। আর প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযু বা জাল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।

হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্ন বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকাহ, ওয়াজ, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারনত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতা বশত ধারনা করেন যে, এসকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয়ই যাচাই বাছাই করে হাদীসগুলো লিখেছেন। সহিহ না হলেকি আর তিনি হাদীস লিখতেন ?

এ ধারনাটিও ভিত্তিহীন, ভুল এবং উপরের ধারনাটির চেয়েও বেশী বিভ্রান্তিকর। সাধারনত প্রত্যেক ইলমের জন্য পৃথক পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত বেশী সময় দিতে পারেন না। মুফাস্সির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সুফি, ওয়ায়িজ ও অন্যান্ন ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদেসের নিরীক্ষা যাচাই বাছাই ও পর্যালচনায় যেতে পারেন না। সাধারনভাবে তারা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপর নির্ভর করেন। এ জন্য তাদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।

আল্লামা নববী তার তাকরীব গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ুতি তার তাদবীরুর রাবী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সুরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীস বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোন কোন মুফাস্সির যেমন আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম আস সালাবী নিশাপুরী তার তাফসীর গ্রন্থে তার ছাত্র আল্রামা আলী ইবনে আহমদ আল ওয়াহিদী নিশাপুরী তার বাসীত, ওয়াসিত, ওয়াজীয ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাসেম মাহমুদ ইবনে উমর আয যামাখশারী তার কাশাশাফ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আল বাইযাবী তার আনওয়ারুত তানযীল বা তাফসীরে বা্ইযাবীতে এ সকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তারা এই কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ুতী বলেন ইরাকী (৮০৬ হিHappy বলেছেন যে, প্রথম দুইজন সালাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখ পূর্বক এসকল বানোয়াট বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। ফলে তাদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারন তারা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মওযু বা মিথ্যা হাদীস সনদ সহ উল্লেখ করলেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে মওযু না বলে চুপ করে যাওয়া জায়েজ নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন যামাখশারী ও বায়যাবী এর ভুল খুবই মারাত্মক। কারন তারা সনদ উল্লেখ করেন নি বরং রাসূলুল্লাহ স. এর কথা বলে সরাসরি ও স্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট কথা উল্লেখ করেছেন।

মোল্লা আলী কারী কোন কোন জাল হাদীস উল্লেখ পূর্বক লিখেছেন, কুতুল কুলব, এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, তাফসীরে সালাবী ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ দেখে ধোকা খাবেন না । আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী ফিকহের নির্ভোরযোগ্য গ্রন্থাবলীর নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্যেক করে বলেন, আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলীর নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্যেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপার। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরুপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলির উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন কিন্তু সেগুলি জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ফতওয়া বিষয়ক পুস্তকাদী। বিস্তারিত আলোচনা করে আমাদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সকল পুস্তকের লিখকগণ যদিও কামিল ছিলেন তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তারা অসতর্ক ছিলেন।"

এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিকাহ তাফসীর তাসাউফ আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নীরিক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর আল-মারগিনানী তার লেখা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ হেদায়ায় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসেবে ফিকহী মাসায়েল নির্ধারন ও বর্ণনার প্রতিই তার মনযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যায় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোন হাদীসের সহিহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোন মন্তব্যও করতে যাননি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ যায়লানী হানাফী, আল্লামা আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদিস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষনা করে এর মধ্য থেকে সহিহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস নির্ধারন করেছেন।

অনুরুপভাবে ইমাম গাজ্জালী তার প্রসিদ্ধ এহইয়ায় উলুমুদ্দীন গ্রন্থে ফিকাহ ও তাসাউফ অলোচনার ফাকে ফাকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকিহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেন না। এজন্য হাদীসের সনদের বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদল আব্দুর রহীম ইবনে হুসাইন আল-ইরাকী ও অন্যান্ন সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তার উল্লেখিত হাদীস সমূহের সনদ ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষন করে সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলো নির্ধারন করেছেন। এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু আলী আস-সুবকী (৭৭১ হিHappy এহইয়ায় উলুমুদ্দীন গ্রন্থে উল্লেখিত কয়েক শত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম আল-আহাদীস লা আসলা লাহা ফী কিতাবিল এহইয়া অর্থাৎ এহইয়াউল উলুমুদ্দীন গ্রন্থে উল্লেখিত ভিত্তিহীন হাদীস সমূহ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

শর্ষীনা, ফুরফুরা, জৌনপুরী, ফুলতলী, সোনাকান্দা সহ সকল বালাকোটি পীরগনের শেরেকী আকীদা

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে