হাদীসের নামে জালিয়াতি ও জাল হাদীসের কবলে সুফিবাদ
তাবে তাবেয়ীনদের যুগ থেকেই সুফিরা জাল হাদীস প্রচারে লিপ্ত হয়েছিল। এ
জন্য অনেক মুহাদ্দীস ই তাদের কোন হাদীস ই গ্রহণ করেন নি। ইমাম মালিক
বলতেন, মদীনায় অনেক দরবেশ আছেন, যাদের কাছে আমি লক্ষ টাকা আমানত রাখতে রাজি
আছি, কিন্তু তাদের বর্ণিত একটি হাদীসও আমি গ্রহণ করতে রাজি নই । ইয়াহইয়া
ইবনে সাইদ আল কাত্তান বলেন, নেককার বুযর্গরা রাসূলুল্লাহ স. এর হাদীসের
বিষয়ে যত বেশী মিথ্যা বলেন অন্য কোন বিষয়ে তারা এত মিথ্যা বলেন না। কিন্তু
বেখেয়ালে তারা মিথ্যাচারে লিপ্ত হন। কারন তারা হাদীস সঠিকভাবে মুখস্ত রাখতে
পারেন না, উল্টে পাল্টে ফেলেন, অধিকাংশ সময় মনের আন্দাজে হাদীস বলেন, ফলে
অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যাচারে লিপ্ত হন।
নেককার বলে পরিচিত কিছু মানুষ এর চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হতেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ স.এর নামে বলতেন। হাদিস জালিয়াতির ক্ষেত্রে এরাই ছিলেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক। তারা যে সকল বিষয়ে হাদীস বানিয়েছেন তার অনেক বিষয়ে অনেক সহিহ হাদীস রয়েছে। কিন্তু এসকল নেককার ! মানুষ অনুভব করেছেন যে, এ সকল সহিহ হাদীসের ভাষা ও সেগুলোতে বর্ণিত পুরষ্কার বা শাস্তিতে মানুষের আবেগ আস না। তাই তারা আরো জোড়ালো ভাষায় বিস্তারিত কথায় অগণিত পুরষ্কার ও কঠিনতম শাস্তির কথা বলে হাদীস বানিয়েছেন, যেন মানুষেরা তা শুনেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এভাবে তারা ওহীর অপূর্ণতা ! মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে পুরন ! করতে চেয়েছেন। সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল যে, তাদের ধার্মিকতার কারনে সমাজের অনেক মানুষই তাদের এসকল জালিয়াতির ক্ষপ্পরে পড়তেন। তারা এগুলোকে হাদীস বলে বিশ্বাস করেছেন।
শয়তান এদেরকে বুঝিয়েছিল যে, আমরা তো রাসূল স. এর বিরুদ্ধে নয়, পক্ষেই মিথ্যা বলছি। এ সকল মিথ্যা ছাড়া মানুষদের হেদায়েত করা সম্ভব নয়। কাজেই ভাল উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা শুধু জয়েযই নয় বরং ভাল কাজ। শয়তান তাদেরকে বুঝতে দেয় নি যে, তাদের সব চিন্তাই ভুল খাতে প্রবাহিত হয়েছে। মিথ্যা ছাড়া মানুষদেরকে ভাল পথে আনা যাবে না একথা ভাবার অর্থ হলো ওহী মানুষকে হেদায়েত করতে সক্ষম নয়। কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধ হাদীস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই আজগুবি মিথ্যা দিয়ে মানুষকে হেদায়েত করতে হবে ! কি জঘন্য চিন্তা !
তাদের এ সকল মনগড়া কথা যে ওহীর পক্ষে বা আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষে সে কথা দাবী করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে ? তারা যে কথাকে ইসলামের পক্ষ্যে বলে মনে করেছে তা সর্বদা ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। আজগুবি গল্প, অল্প কাজের অকল্পনীয় সওয়াব, সামান্য অন্যায়ের ঘোরতর শাস্তি, সৃষ্টির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাল্পনিক কাহিনী, কাল্পনিক অলৌকিক কারাতমতের কাহিনী, বিভিন্ন বানোয়াট ফজিলতের কাহিনী ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করেছে। অগনিত কুসংস্কার ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে। নফল ইবাদতের সওয়াবের বানানো মনগড়া কল্প কাহিনী মুসলিম উম্মাহকে ফরয দায়িত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে। অগনিত মনগড়া আমল মুসলমানদেরকে কুরআন ও সহিহ হাদীসে বর্ণিত কর্ম ও দায়িত্ব থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা পরবর্তিতে বানোয়াট হাদীসগুলো আলোচনার সময় এসবের অনেক উদাহরন দেখতে পাব।
ওহীর পক্ষ্যে মিথ্যা বলার কারনেই যুগে যুগে সকল ধর্ম বিকৃত হয়েছে। ওহীর পক্ষ্যে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃষ্টধর্মের বিকৃতকারী পৌল নামধারী শৌল এবং তার অনুসারী খৃষ্টানগণ। এরা ইশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, যিশুর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ও অধিক সংখ্যক মানুষকে সুপথে আনয়ন করার জন্য ওহীর নামে মিথ্যা বলেছে। এরা ভেবেছে যে, আমরা ইশ্বরের বা যীশুর পক্ষে বলছি, কাজেই এ মিথ্যায় কোন দোষ নেই। কিন্তু তারা মুলত শয়তানের খেদমত করেছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, "বল হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না। এবং যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না।"
মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এই ধরনের পথভ্রষ্ট খেয়াল খুশীমত ওহী বানানো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে। এ সকল নেককার জালিয়াত বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাদীস তৈরী করতেন।
১. কিছু মানুষ কুরআন এবং কুরআনের বিভিন্ন সুরা তিলাওয়াতের অগনিত কাল্পনিক সওয়াব বর্ণনা করে হাদীস তৈরী করতেন।
২. অনেকে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত বিভিন্ন নেক আমলের সওয়াব বর্ণনায় হাদীস তৈরী করতেন। যেমন তাসবীহ, যিকির, তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি নামাজের অকল্পনীয় সওয়াবের বানোয়াট ফজিলত।
৩. কেউ কেউ বিভিন্ন প্রকার নেক আমল তৈরী করে তার ফযীলতে হাদীস বানাতেন। যেমন বিভিন্ন মাসের জন্য বিশেষ পদ্ধতির সালাত, সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্য বিশেষ সালাত, আল্লাহকে স্বপ্নে দেখা, রাসূলুল্লাহ স. কে স্বপ্নে দেখা, জান্নাতে নিজের স্থান দেখা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ সালাত। অনুরুপভাবে বিভিন্ন দরুদ, যিকির, দোয়া, মুনাজাত ইত্যাদি বানিয়ে সেগুলোর বানোয়াট ফজিলত উল্লেখ করে হাদীস তৈরী করেছেন। এরুপ অগনিত ইবাদত তারা তৈরী করেছেন এবং সেগুলোর ফযীলতের কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অগনিত সওয়াব ও ফজীলতের কাহিনী বলেছেন।
৪. অনেক মানুষের অন্তর নরম করার জন্য সংসার ত্যাগ, ক্ষুধার ফযীলত, দারিদ্রের ফজীলত, বিভিন্ন কাহিনী, শাস্তি, পুরষ্কার বা অনুরুপ গল্প কাহিনী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ স. এর নামে চালিয়েছেন।
আল্লামা সাইয়্যেদ শরীফ জুরজানী হানাফি লিখেছেন, মওযু বা বানোয়াট হাদীস প্রচলনে সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন দুনিয়াত্যাগী দরবেশগণ, তারা অনেক সময় সওয়াবের নিয়াতেও মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলতেন। ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, বর্ণিত আছে যে, কোন কোন সুফি সওয়াবের বর্ননায় ও পাপাচারের শাস্তির বর্ণনায় মিথ্যা হাদীস বানানো ও প্রচার করা জায়েজ মনে করতেন। সুয়ুতী বলেন, জালিয়াতির উদ্যেশ্য অনুসারে মিথ্যাবাদী জালিয়াতিগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারত্মক ও ক্ষতিকর ছিলেন কিছু মানুষ যাদেরকে সংসারত্যাগী নিলোর্ভ নেককার মনে করা হত। তারা তাদের বিভ্রান্তির কারনে আল্লাহর নিকট সওয়াব পাবার আশায় মিথ্যা হাদীস বানাতেন। ২য় শতকের প্রখ্যাত দরবেশ আবু দাউদ নাখয়ী সুলাইমান ইবনু আমর রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ে ও দিনের পর দিন নফল সিয়াম পালনে ছিলেন অতুলনীয়। তা সত্বেও তিনি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতেন। আবু বিশর আহমদ ইবনু মুহাম্মদ আল-মারওয়াযী খোরাসানের অন্যতম ফকীহ, আবেদ ও সুন্নতের সৈনিক ছিলেন। সুন্নাতের পক্ষ্যে এবং বিদাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথাকে হাদীসের নামে প্রচার করতেন। ওয়াহাব ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু হাফস তার যুগের অন্যতম নেককার আবিদ ও ওয়ায়িয ছিলেন। ২০ বছর তিনি কারো সাথে কোন জাগতিক কথা পর্যন্ত বলেন নাই। তিনিও হাদীসের নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলতেন।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় ৪ শতাব্দি পর্যন্ত হাদীস সংকলনের যে ধারা চালু থাকে এর প্রধান উদ্দেশ্য্ই ছিল রাসূলুল্লাহ স. এর নামে কথিত ও প্রচারিত সকল হাদীস সংকলিত করা। যাতে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দীসগণ নিরীক্ষাভিত্তিক বিধানের আলোকে এগুলির মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হাদীস বেছে নিতে পারেন। অনেকে বর্ণনাকারী রাবী বা বর্ণনাকারী সাহাবীর নামের ভিত্তিতে হাদীস সংকলন করতেন। কেউ বা বিষয়ভিত্তিক হাদীস সংকলন করতেন। সবারই মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীস নামে প্রচলিত সব কিছু সংকলিত করা।
এজন্য আমরার দেখতে পাই প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে সহীহ. যয়ীফ, জাল সকল প্রকার হাদীস সংকলিত হয়েছে। এখানে অজ্ঞতার কারনে অনেকে ভুল ধারনার কবলে পড়েন। উপরের পরিচ্ছেদগুলিতে আলোচিত সাহাবী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণের হাদীস বিচার, সনদ যাচাই, নিরীক্ষা ইত্যাদি থেকে অনেকে মনে করেন যে, মুহাদ্দিসদের এ সকল বিচার ও নিরীক্ষার মাধ্যমে যাদের ভুল বা মিথ্যা ধরা পড়েছে তাদের হাদীস তো তারা গ্রহণ করেননি এবং সংকলনও করেন নি। কাজেই কোন হাদীসের গ্রন্থে হাদীস সংকলনের অর্থ হলো এসকল হাদীস নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেই উক্ত মুহাদ্দীস হাদীসগুলিকে তার গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।
এ ধারনাটি একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত এবং প্রকৃত অবস্থার একেবারেই বিপরীত। কয়েকজন সংকল বাদে কোন সংকলকই শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেন নি। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, আলিম ও ইমাম হাদীস সংকলন করেছেন সহীহ, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকার হাদীস সনদ সহ একত্রিত করার উদ্দেশ্যে; যেন রাসূলুল্লাহ স. এর নামে কথিত বা প্রচারিত সকলকিছুই সংরক্ষিত হয়। তার কোন হাদীসই রাসূলুল্লাহ স. এর কথা বা কাজ হিসেবে সরাসরি বর্ণনা করেন নি। বরং সনদসহ, কে তাদেরকে হাদীসটি কার সূত্রে বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। তারা মূলত বলেছেন; "অমুক ব্যাক্তি বলেছেন যে, 'এই কথাটি হাদীস', আমি তা সনদসহ সংকলিত করলাম। হাদীস প্রেমিক পাঠকগণ এবার সহিহ, যয়ীফ ও জাল বেছে নিন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তার সনদের আলোচনা করেছেন এবং দূর্বলতা বা সবলতা বর্ণনা করেছেন।
অল্প কয়েকজন সংকলক শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল বুখারী, ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী অন্যতম। তাদের পরে আব্দুল্লাহ ইবনে আলী ইবনে জারদ (৩০৭ হি
, মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে খুযাইমা (৩১১ হি
, আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনুশ শারকী (৩২৫ হি
, কাসিম বিন ইউসুফ আল-বাইয়ানী (৩৪০ হি
, সাইদ ইবনে উসমান ইবনুস সাকান (৩৫৩ হি
, আবু হাতিম মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান আল-বসুতি (৩৫৪ হি
, আবু আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ হাকীম নাইসপুরি (৪০৫ হি
,
জিয়াউদ্দিন মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহিদ আল-মাকদাসী (৬৪৩ হিজরী) প্রমুখ
মুহাদ্দিস শুধুমাত্র সহিহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করে সহীহ গ্রন্থ রচনা
করেছেন। কিন্তু পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসদের চুলচেরা নিরীক্ষার মাধ্যমে
শুধুমাত্র বুখারী ও মুসলিমের গ্রন্থদয়েরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমানিত
হয়েছে। বাকী কোন গ্রন্থেরই সকল হাদীস সহীহ বলে প্রমানিত হয় নি। বরং অধিকাংশ
গ্রন্থই যয়ীফ ও জাল হাদীস সংকলিত হয়েছে বলে প্রমণিত হয়েছে।
দ্বাদশ শতকের অন্যতম আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে শুধুমাত্র তিনটি গ্রন্থ। বুখারী, মুসলিম ও মুয়াত্তায় ইমাম মালেক। এ গ্রন্থতিনটিস সকল সনদসহ বর্ণিত সকল হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে বলে হলেও সেগুলিতে অনেক অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এসকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন ও তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনটি গ্রন্থ। সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাই, সুনানে তিরমিযী। ইমাম আহমদের মুসনাদও প্রায় এই পর্যায়ের।
তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসিলম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সহিহ, যয়ীফ ও মিথ্যা সব ধরনের হাদীসই রয়েছে। যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দীস ছাড়া এ সকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দীসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছে, মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বায়হাকীর হাদীস গ্রন্থ সমূহ, ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থ সমূহ, তাবরানীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ সমূহ। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তারা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।
চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলো হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রন্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন প্রকারের হাদীস সংকলন করেছেন। ১. যে সকল হাদীস পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারনে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, ২. যে সকল হাদীস কোন অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, ৩. লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়ায়েযদের ওয়াযে প্রচলিত বিভিন্ন কথা যা কোন হাদীসের গ্রন্থে স্থান পায়নি, ৪. বিভিন্ন দূর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, ৫. যে সকল হাদীস মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদীদের গল্প বা পূর্ববর্তী যামানার জ্ঞানী ব্যাক্তিদের কথা, যেগুলোকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোন বর্ননাকারী হাদীস বলে বর্ননা করেছেন, ৬. কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতিয় কথা যা ভুলক্রমে কোন সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, ৭. হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূর্বক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন অথবা বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ননা করেছেন। এ ধরনের হাদীস সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইবনে হিব্বানের আদ-দুয়াফা, ইবনে আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নাইম আল-ইসফাহানী, ইবনে ইসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদে ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এই পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় যযীফ অথবা জাল।
অজ্ঞতা বশত অনেকেই মনে করেন যে, কোন হাদীস কোন হাদীস-গ্রন্থ সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহিহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহিহ। যেমন কোন হাদীস যদি সুনানে ইবনে মাজাহ বা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো হাদীসটি নিশ্চিত সহিহ, নইলে ইবনে মাজাহ তার গন্থে হাদীসটির স্থান দিতেন না। এ ধারনাটির উভয় দিক ই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দীস ই তার গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, জাল সকল প্রকার হাদীস ই সংকলন করেছেন। তারা কখনোই দাবী করেন নি যে, তাদের গ্রন্থে শুধু সহিহ হাদীস সংকলন করবেন। কাজেই কোন হাদীস সুনানে আবনে মাজাহ বা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে এ সংকলিত থাকাতে কখনোই বুঝা যায় না যে, হাদীসটি সহিহ বা ইবনে মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মতে সহীহ।
ইবনে হিব্বান, ইবনে খুযাইমা, ইবনুস সাকান, হাকেম ও অন্যান্ন যে কল মুহাদ্দীস তাদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করার চেষ্টা করেছেন, তাদের গ্রন্থে কোন হাদীস সংকলিত হলে আমরা মনে করব যে, হাদীসটি উক্ত মুহাদ্দীসের মতে সহিহ। তবে এতে প্রমানিত হয় না যে, হাদীসটি প্রকৃতপক্ষে সহিহ। কোন মুহাদ্দীসের দাবীই উম্মাহর পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ নিরীক্ষা ছাড়াই গ্রহণ করেন নি। এ জন্য আমরা অন্যা্ন্ন মুহাদ্দীসের নিরীক্ষার আলোকে হাদীসটির বিধান নির্ধারন করব।
আমাদের সমাজে সিহাহ সিত্তাহ নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২ টি সহীহ গ্রন্থ; বুখারী ও মুসলিম ছাড়া বাকী ৪ টি সঃকলকও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোন সিদ্ধান্ত নেননি। তারা তাদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ এবং জাল হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাদের গ্রন্থগুলির অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারনে পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ সাধারনভাবে তাদের গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর করেছেন সাথে সাথে তারা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দূর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রদান করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪ হি
এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন এ চার গ্রন্থে সংকলিত সংকলিত সকল হাদীস সহীহ
নয়। বরং এ সকল গ্রন্থে সহীহ, হাসান, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকারের হাদীস রয়েছে।
ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীস দেহলভীর বিবরণ দেখেছি। তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাই, সুনানে তিরমিযী এ তিনটি গ্রন্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন। যে সকল গ্রন্থের হাদীস সমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি সুনান ইবনে মাজাহকে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেন নি। এর কারন হল মুহাম্মদ ইবনে মাজাহ আল-কাযবিনী সংকলিত সুনান গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণযোগ্য গ্রন্থাবলীর অন্তর্ভূক্ত করেন নি। হিজরী ৭ম শতক পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমের অতিরিক্ত এ তিনটি সুনান গ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনু তাহির মাকদিসী, আবুল ফদল ইবনুল কাইসুরানী এগুলোর সাথে সুনান ইবন মাজাহ যোগ করেন।
তার এ মত পরবর্তী ২ শতাব্দি পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেন নি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রহমান, আল্লামা আবু যাকারিয়া ইবনু শারাফ আন-নববী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসেবে উপরের ৫ টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহকে তারা এগুলির মধ্যে গন্য করেন নি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মদ ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে ইমাম মালিকের মুয়াত্তাকে গন্য করেছেন।
ইমাম ইবনে মাজাহ এর সুনান গ্রন্থ মোট ৪৩৪১ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ ইবনু আবী বকর আল-বুসিরী ইবনে মাজাহর এসকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বুসিরী ১৪৭৬ টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন যেগুলি উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয়নি, শুধুমাত্র ইবনে মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলির মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। আর প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযু বা জাল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।
হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্ন বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকাহ, ওয়াজ, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারনত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতা বশত ধারনা করেন যে, এসকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয়ই যাচাই বাছাই করে হাদীসগুলো লিখেছেন। সহিহ না হলেকি আর তিনি হাদীস লিখতেন ?
এ ধারনাটিও ভিত্তিহীন, ভুল এবং উপরের ধারনাটির চেয়েও বেশী বিভ্রান্তিকর। সাধারনত প্রত্যেক ইলমের জন্য পৃথক পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত বেশী সময় দিতে পারেন না। মুফাস্সির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সুফি, ওয়ায়িজ ও অন্যান্ন ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদেসের নিরীক্ষা যাচাই বাছাই ও পর্যালচনায় যেতে পারেন না। সাধারনভাবে তারা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপর নির্ভর করেন। এ জন্য তাদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
আল্লামা নববী তার তাকরীব গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ুতি তার তাদবীরুর রাবী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সুরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীস বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোন কোন মুফাস্সির যেমন আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম আস সালাবী নিশাপুরী তার তাফসীর গ্রন্থে তার ছাত্র আল্রামা আলী ইবনে আহমদ আল ওয়াহিদী নিশাপুরী তার বাসীত, ওয়াসিত, ওয়াজীয ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাসেম মাহমুদ ইবনে উমর আয যামাখশারী তার কাশাশাফ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আল বাইযাবী তার আনওয়ারুত তানযীল বা তাফসীরে বা্ইযাবীতে এ সকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তারা এই কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ুতী বলেন ইরাকী (৮০৬ হি
বলেছেন যে, প্রথম দুইজন সালাবী ও ওয়াহিদী সনদ উল্লেখ পূর্বক এসকল বানোয়াট
বা জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। ফলে তাদের ওজর কিছুটা গ্রহণ করা যায়, কারন
তারা সনদ বলে দিয়ে পাঠককে সনদ বিচারের দিকে ধাবিত করেছেন, যদিও মওযু বা
মিথ্যা হাদীস সনদ সহ উল্লেখ করলেও সঙ্গে সঙ্গে তাকে মওযু না বলে চুপ করে
যাওয়া জায়েজ নয়। কিন্তু পরবর্তী দুইজন যামাখশারী ও বায়যাবী এর ভুল খুবই
মারাত্মক। কারন তারা সনদ উল্লেখ করেন নি বরং রাসূলুল্লাহ স. এর কথা বলে
সরাসরি ও স্পষ্টভাবে এ সকল বানোয়াট কথা উল্লেখ করেছেন।
মোল্লা আলী কারী কোন কোন জাল হাদীস উল্লেখ পূর্বক লিখেছেন, কুতুল কুলব, এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, তাফসীরে সালাবী ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ দেখে ধোকা খাবেন না । আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী ফিকহের নির্ভোরযোগ্য গ্রন্থাবলীর নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্যেক করে বলেন, আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলীর নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্যেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপার। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরুপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলির উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন কিন্তু সেগুলি জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ফতওয়া বিষয়ক পুস্তকাদী। বিস্তারিত আলোচনা করে আমাদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সকল পুস্তকের লিখকগণ যদিও কামিল ছিলেন তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তারা অসতর্ক ছিলেন।"
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিকাহ তাফসীর তাসাউফ আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নীরিক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর আল-মারগিনানী তার লেখা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ হেদায়ায় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসেবে ফিকহী মাসায়েল নির্ধারন ও বর্ণনার প্রতিই তার মনযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যায় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোন হাদীসের সহিহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোন মন্তব্যও করতে যাননি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ যায়লানী হানাফী, আল্লামা আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদিস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষনা করে এর মধ্য থেকে সহিহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস নির্ধারন করেছেন।
অনুরুপভাবে ইমাম গাজ্জালী তার প্রসিদ্ধ এহইয়ায় উলুমুদ্দীন গ্রন্থে ফিকাহ ও তাসাউফ অলোচনার ফাকে ফাকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকিহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেন না। এজন্য হাদীসের সনদের বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদল আব্দুর রহীম ইবনে হুসাইন আল-ইরাকী ও অন্যান্ন সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তার উল্লেখিত হাদীস সমূহের সনদ ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষন করে সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলো নির্ধারন করেছেন। এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু আলী আস-সুবকী (৭৭১ হি
এহইয়ায় উলুমুদ্দীন গ্রন্থে উল্লেখিত কয়েক শত জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস একটি
পৃথক পুস্তকে সংকলিত করেছেন। পুস্তকটির নাম আল-আহাদীস লা আসলা লাহা ফী
কিতাবিল এহইয়া অর্থাৎ এহইয়াউল উলুমুদ্দীন গ্রন্থে উল্লেখিত ভিত্তিহীন হাদীস
সমূহ।
কাশফ-ইলহাম বনাম জাল হাদীস :
সবচেয়ে বেশী সমস্যা হয় সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর প্রিয় ওলী রুপে প্রসিদ্ধ অলিমগণের বিষয়ে। যেহেতু তারা সাহেবে কাশফ বা কাশফ সম্পন্ন ওলী ছিলেন, সেহেতু আমরা ধারনা করি যে, কাশফের মাধ্যমে প্রদত্ত তথ্যের বিশুদ্ধতা যাচাই না করে তো আর তারা লিখেন নি। কাজেই তারা যা লিখেছেন বা বলেছেন সবই বিশুদ্ধ বলে গন্য হবে।
আল্লামা সুয়ুতী, আব্দুল হাই লাখনভী প্রমুখ আলিম এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তারা ইমাম গাজ্জালীর এহইয়ায় উলুমুদ্দীন ও অন্যান্ন গ্রন্থে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী লিখিত কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখিত অনেক জাল ও বানোয়াট হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, "কেউ হয়ত প্রশ্ন করবেন; এতবড় আলেম ও এতবড় সাহেবে কাশফ ওলী তিনি কি বুঝতে পারলেন না যে, এই হাদীসটি বানোয়াট ? তার মত একজন ওলী কি ভাবে নিজ গ্রন্থে বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করলেন ? তার উল্লেখের দ্বারা কি বুঝা যায় না যে, হাদীসটি সহিহ ? এ সন্দেহের জবাবে তারা যে বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন সেগুলো নিম্নরুপ -
১. বস্তুত সরলপ্রাণ বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লিখেন। এজন্য কোন বুযুর্গের গ্রন্থে তার কোন সুস্পষ্ট মন্তব্য ছাড়া কোন হাদীস উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলে নিশ্চিত হয়েছেন। মূলত তারা যা পড়েছেন বা শুনেছেন তা উল্লেখ করেছেন মাত্র। তারা আশা করেছেন হয়ত এর কোন সনদ থাকবে, হাদীসের বিশ্লেষকগণ তা খুজে দেবেন।
২. হাদীস বিচারের ক্ষেত্রে কাশফের কোন অবদান নেই। কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া নেয়ামত মাত্র, আনন্দ ও শুকরিয়ার উৎস। ইচ্ছামত প্রয়োগের কোন বিষয় নয়। আল্লাহ তায়ালা হযরত উমর কে কাশফের মাধ্যমে শত শত মাইল দুরে অবস্থিত সারিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখিয়েছিলেন, অথচ সেই উমরকে হত্যা করতে তারই পিছনে দাড়িয়ে থাকা আবু লুলুর কথা তিনি টেরই পেলেন না।
এছাড়া কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা কখনোই হক বাতিলের বা ঠিক বেঠিকের ফয়সালা হয় না। সাহাবায় কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও সমস্যা ঘটেছে। কথনই একটি ঘনটাতেও তারা কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমে হক্ক বা বাতিল জানার চেষ্টা করেন নি। খুলাফায় রাশেদীন এর দরবারে অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তির সন্দেহ হলে তারা সাক্ষি চেয়েছেন অথবা বর্ণনাকারীকে কসম করিয়েছেন। কখনো কখনো তারা বর্ণনাকারীর ভুলের বিষয়ে বেশি সন্দিহান হলে তার বর্ণিত হাদীসকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কখনোই তারা কাশফের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য বিচার করেন নি। পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দিকাল সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, শুনেছেন ও হাদীসের সহীহ, যয়ীফ ও জাল নির্ধারনের জন্য সনদ বর্ণনার ব্যাবস্থা নিয়েছেন। বর্ননাকারীর অবস্থা অনুসারে হাদীস গ্রহণ করেছেন বা যয়ীফ হিসেবে বর্জন করেছেন। কিন্তু কখনোই তারা কাশফের উপর নির্ভর করেননি।
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্নয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করা সুন্নাতে খুলাফায় রাশেদীন ও সুন্নাতে সাহাবা। আর এ বিষয়ে কাশফ, ইলহাম বা স্বপ্নের উপর নির্ভর করা খেলাফে সুন্নাত বিদাত ও ধ্বংসাত্মক।
৩. বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক প্রখ্যাত সাধক, যাদেরকে আমরা সাহেবে কাশফ বলে জানি, তারা তাদের বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক কথা লিখেছেন যা নি:সন্দেহে ভুল ও অন্যায়। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী লিখেছেন যে, ঈমান বাড়ে ও কমে। ইমানের হ্রাস-বৃদ্ধি স্বীকার করাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ফেরকায় নাজিয়ার আলামত বলে গন্য করেছেন এবং ইমান হ্রাস বৃদ্ধি না মানাকে বাতিলদের আলামত বলে গন্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কোন মুসলমানের উচিত নয় যে, সে বলবে : আমি নিশ্চিত মুমিন', বরং তাকে বলতে হবে যে, ইনশাআল্লাহ আমি মুমিন। ইমাম আবু হানিফা ও তার অনুসারীগণ যেহেতু ইমানের হ্রাস-বৃদ্ধি স্বীকার করেন না, এবং ইনশাআল্লাহ আমি মুমিন বলাকে আপত্তিকর বলে মনে করেন, সেজন্য তিনি তাকে ও তার অনুসারীগণকে বাতিল ও জাহান্নামী ফিরকা বলে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম গাজ্জালী লিখেছেন যে, গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন ইত্যাদি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার পথে সহায়ক ও বিদাতে হাসানাহ। তিনি গান বাজনার পক্ষ্যে অনেক দূর্বল ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।
এরুপ অগণিত উদাহরণ তাদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজেই তারা যদি কোন হাদীসকে সহীহ বলেও ঘোষনা দেন তারপরেও তার সনদ বিচার ব্যাতিরেকে তা গ্রহণ করা যাবে না। কারন রাসূলুল্লাহ স. এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সকল বানোয়াট কথাকে চিহিৃত করা দ্বীনের অন্যতম ফরয। কেউ সন্দেহযুক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ স. এর নামে বর্ণনা করলেও তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কাজেই এ ক্ষেত্রে কোন শিথিলতার অবকাশ নেই।
বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি :
এখানে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হলো হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় নেককার বুযুর্গ ও ওলী আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে প্রচুর। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষনিয় :
১. জালিয়াতিগণ ধর্মের ক্ষতি করার জন্য অথবা ধর্মের উপকার করার জন্য জালিয়াতি করত। বিশেষ করে যারা ধর্মের অপুর্ণতা দূর করে ধর্মকে আরো বেশী জননন্দিত ও আকর্ষনীয় করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের জালিয়াতিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। আর উভয় দলের জন্য এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় দলের জন্য রাসূল স. এর নামে জালিয়াতি করার চেয়ে ওলি আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি করা অধিক সহজ ও অধিক সুবিধাজনক ছিল।
২. বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি অধিকতর সুবিধাজনক এজন্য যে, সাধারন মানুষদের মধ্যে তাদের নামের প্রভাব হাদীসের চেয়েও বেশী। অনেক সাধারন মুসলমানকে হাদীস বলে বুঝানো কষ্টকর। তাকে যদি বলা যায় যে, আব্দুল কাদের জিলানী বা খাজা মইনুদ্দীন চিশতী বা ওমুক ওলী এই কাজটি করেছেন বা করতে বলেছেন তবে অনেক বেশী সহজে তাকে প্রতারিত করা যাবে এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি তা মেনে নিবেন। ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দীর সোনালী দিনগুলির পরে যুগে যুগে সাধারন মুসলিমদের এ অবস্থা। কাজেই বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি বেশী কার্যকর ছিল।
৩. ওলী আল্লাহর নামে জালিয়াতি সহজতর ছিল এজন্য যে, হাদীসের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর নিবেদিত প্রাণ মুহাদ্দিসগণ যেভাবে সতর্ক প্রহরা ও নিরীক্ষার ব্যাবস্থা রেখেছিলেন, এক্ষেত্রে তা কিছুই ছিল না বা নেই । কোন নীরিক্ষা নেই, পরিক্ষা নেই, সনদ নেই, মতন নেই, ঐতিহাসিক বা অর্থগত নিরীক্ষা নেই ----------- যে যা ইচ্ছা বলেছেন। কাজেই অতি সহজে জালিয়াতিগণ নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারতেন।
৪. হাদীস জালিয়াতির জন্যও এসকল বুযর্গের নাম ব্যাবহার ছিল খুবই কার্যকর। এ সকল বুযুর্গের নামে বানোয়াট কথার মধ্যে অগনিত জাল হাদীস ঢূকিয়ে দিয়েছে তারা। এসকল বুযুর্গের প্রতি ভক্তির প্রাবল্যর কারণে অতি সহজেই ভক্তিভরে এ সকল বিষ গলধ:করণ করেছেন মুসলমানরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরেছে জালিয়াতিগণ।
কাদেরীয়া তরীক :
আব্দুল কাদের জিলানী হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের প্রসিদ্ধতম ব্যাক্তিত্ব। একদিকে তিনি হাম্বলী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। অন্যদিকে তিনি প্রসিদ্ধ সাধক ও সুফি ছিলেন। তার নামে অনেক তরীকা, কথা ও পুস্তক মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত। এ সকল তরীকা কথা ও পুস্তক অধিকাংশই বানোয়াট। কিছু কিছু পুস্তক তার নিজের রচিত হলেও পরবর্তীকালে এগুলির মধ্যে অনেক বানোয়াট কথা ঢুকানো হয়েছে। এখানে আমরা তার নামে প্রচলিত কাদিরিয়া তরীকা ও সিররুল আসরার পুস্তকটির পর্যালোচনা করব।
প্রচলিত কাদিরিয়া তরীকার আমল, ওযীফা, মুরাকাবা ইত্যাদি পদ্ধতির বিবরন আব্দুল কাদের জিলানী এর পুস্তকে পাওয়া যায়না। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, আব্দুল কাদের জিলানী এর ওফাতের প্রায় দুইশত বছর পরে তার এক বংশধর গাওস জিলানী ৮৮৭ হিজরী সালে (১৪৮২ খৃষ্টাব্দে) কাদেরীয়া তরীকার প্রচলন করেন। বিভিন্ন দেশে কাদেরীয়া তরীকার নামে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর নিজের লিখা প্রচলিত বইগুলিতে যে সকল আমল ওযীফা ইত্যাদি লিখিত আছে প্রচলিত কাদেরিয়া তরীকার মধ্যে সেগুলি নেই।
আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরিয়া তরীকার সূত্র বা সাজরা থেকে আমরা দেখি যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু শাহ ওয়ালি উল্লাহ তার আল-কাওলুল জামিল গ্রন্থে কাদেরিয়া তরীকার যে বিবরণ দিয়েছেন তার সাথে সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভীর/ইসমাইল দেহলভীর সিরাতে মুস্তাকীমের বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাদের শিখানো পদ্ধতির সাথে আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরীয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটা তার নিজের প্রবর্তিত ও কোনটা তার নামে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত তা জানার কোন উপায় নেই।
সিররুল আসরার :
হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর নামে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি পুস্তক সিররুল আসরার। পুস্তকটিতে কুরআন-হাদীসের আলোকে অনেক ভাল কথা রয়েছে। পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস ও বানোয়াট কথা পুস্তকটিতে বিদ্যমান। অবস্থাদৃষ্টে বুঝা যায় যে, পরবর্তী যুগের কেউ এ বইটি লিখে তার নামে চালিয়েছে। কয়েকটি বিষয় এই জালিয়াতি প্রমান করে :
১. এ পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে লেখক ফরীদ উদ্দীন আত্তার বলেন ----- " এখানে লক্ষনীয় যে, ফরীদ উদ্দীন আত্তার ৫১২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬২৬ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। আর আব্দুল কাদের জিলানী ৪৭১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৬১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ফরীদ উদ্দীন আত্তার বয়সে তার চেয়ে ৪০ বছরের ছোট এবং তার ইন্তেকালের সময় ফরীদ উদ্দীন আত্তারের কোন প্রসিদ্ধি ছিল না। কাজেই হযরত শায়েখ --------- ইত্যাদি বলে তিনি আত্তারের উদ্বৃতি প্রদান করবেন একথা কল্পনা করা যায় না।
২. এই পুস্তকে শামস তাবরীয এর উদ্বৃতি দেয়া হয়েছে। লেখক বলেন : হযরত শামস তাবরীয বলেছেন -----------। উল্লেখ্য যে, শামস তাবরীয ৬৪৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন। তার জন্ম তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে ৫৬০ হিজরীর পরে তার জন্ম বলে মনে হয়। অর্থাৎ আব্দুল কাদের জিলানীর ইন্তিকালের সময় শামস তাবরীযের জন্মই হয় নি। অথচ তিনি তার বক্তব্য উদ্বৃত করেছেন।
৩. এই পুস্তকে বারংবার জালাল উদ্দীন রুমীর উদ্বৃতি প্রদান করা হয়েছে। যেমন লেখক বলেছেন, " আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী তার অমর কাব্য মসনবীতে বলেছেন ------- "। লক্ষ্যনীয় যে, জালাল উদ্দীন রুমী (৬০৪-৬৭৬ হি
আব্দুল কাদের জিলানীর ইন্তিকালের প্রায় অর্ধ শতাব্দি পরে জন্মগ্রহণ করেন।
রুমীর জন্মের অর্ধ শত বছর আগে তার মসনবীর উদ্বৃতি প্রদান করা হচ্ছে!!
এভাবে আমরা বুঝিতে পারি যে, এই পুস্তকটি পুরোটাই জাল অথবা এর মধ্যে অনেক জাল কথা পরবর্তীকালে ঢুকানো হয়েছে। এই পুস্তকটির মধ্যে অগনিত জাল হাদীস ও জগন্য মিথ্যা কথা লিখিত রয়েছে। আর আব্দুল কাদের জিলানীর নামে এগুলি অতি সহজেই বাজার পেয়েছে।
চিশ্তিয়া তরীকা :
আমাদের দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত খাজা মইন উদ্দীন চিশতি, কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী, ফরীদ উদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শক্কর ও নিযাম উদ্দীন আউলিয়া রহিমাহুমুল্লাহ। এদের নামেই চিশ্তিয়া তরীকা প্রচলিত। এছাড়া এদের নামে অনেক কথা, কর্ম, বই পুস্তক প্রচলিত। এগুলির মধ্যে এমন অনেক কথা রয়েছে যা স্পষ্টতই মিথ্যা ও বানোয়াট। এখানে চিশ্তিয়া তরীকা ও এদের নামে প্রচলিত দু একটি বই এর বিষয়ে আলোচনা করব।
ভারতের বিভিন্ন দরবারের চিশতিয়া তরীকার আমল ওযীফা ইত্যাদির মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। উপর্যুক্ত বুযুর্গগনের নামে প্রচলিত পুস্তকাদিতে এ সকল তরীকা বা পদ্ধতির কিছুই দেখা যায় না। আবার এ সকল পুস্তকে যে সকল যিকির ওযিফার বিবরণ রয়েছে সেগুলিও প্রচলিত চিশতিয়া তরীকার মধ্যে নেই। চিশ্তিয়া তরীকার ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর বিবরনের সাথে সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভীর বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাদের দুইজনের শেখানো পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত চিশ্তিয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটি অরিজিনাল ও কোনটি বানোয়াট তা জানার কোন উপায় নেই।
আনিসুল আরওয়াহ, রাহাতিল কুলুব ----- ইত্যাদি :
এ সকল মহান মাশাইখ রচিত বলে কিছু পুস্তক প্রচলিত। এগুলি উস্তাদ বা পীরের সাহচর্যের স্মৃতি ও আলোচনা হিসেবে রচিত। খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী তার উস্তাদ উসমান হারুনীর সাথে তার দীর্ঘ সাহচর্যের বিবরণ লিখেছেন আনিসুল আরওয়াহ নামক পুস্তকে। খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী
তার উস্তাদ মঈন উদ্দীন চিশ্তির সাথে তার সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন দলিলুল আরেফীন পুস্তকে। খাজা ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর তার উস্তাদ কুতুব উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ফাওয়ায়েদুস সালেকীন পুস্তকে। খাজা নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তার উস্তাদ ফরীদ উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন রাহাতিল কুলুব পুস্তকে। প্রসিদ্ধ গায়ক আমীল খসরু তার উস্তাদ নিজাম উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতি ও নির্দেশাবলী লিখেছেন রাহাতুল মুহিব্বীন পুস্তকে।
এ সকল পুস্তক পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলি পরবর্তী যুগের মানুষদের রচিত জাল পুস্তক। অথবা তারা কিছু লিখেছিলেন সেগুলির মধ্যে পরবর্তী যুগের জালিয়াতগণ ইচ্ছামত অনেক কিছু ঢুকিয়েছে। এই পুস্তকগুলিতে কুরআন-হাদীস ভিত্তিক অনেক ভাল কথা আছে। পাশাপাশি অগনিত জাল হাদীস ও মিথ্যা কথায় সেগুলি ভরা। এছাড়া ঐতিহাসিক তথাবলি উল্টাপাল্টা লেখা হয়েছে। এমন সব ভুল রয়েছে যা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে।
প্রত্যেক বুযুর্গ তার মাজালিসগুলির তারিখ লিখেছেন। সন তারিখগুলি উল্টাপাল্টা লেখা। যাতে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, পরবর্তীকালে এদের নামে এগুলি জালিযাতি করা হয়েছে। শাওয়াল মাসের ৪ তারিখ বৃহস্পতিবার ও ৭ তারিখ রবিবার লিখা হয়েছে। অর্থাৎ শাওয়ালের শুরু সোমবারে। কিন্তু ১৫ ই জিলক্বদ সোমবার লিখা হয়েছে। অর্থাৎ জিলক্বাদের শুরুও সোমবারে ! শাওয়াল মাস ২৮ দিনে হলেই শুধু তা সম্ভব ! আবার পরের মজলিস হয়েছে ৫ ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার। জিলকাদের শুরু সোম, মঙ্গল বা বুধবার যেদিনই হোক, কোনভাবেই ৫ ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার হয় না ! আবার পরের মজলিস ২০ শে জিলহজ্জ শনিবার ! ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে ২০ তারিখ শনিবার হয় কিভাবে ? ২০ শে রজব সোমবার এবং ২৭ শে রজব রবিবার লেখা হয়েছে। ৫ ই শাওয়াল শনিবার অথচ ২০ শে শাওয়াল বৃহস্পতিবার --------- এইরুপ অগণিত অসঙ্গতি যা প্রথম নজরেই ধরা পড়ে।
কাকী (র) উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীতে তিনি বাগদাদে মুইন উদ্দীন চিশ্তির নিকট মুরিদ হন। এরপর কয়েক মজলিস তিনি বাগদাদেই থাকেন। এরপর তিনি তার সহচরদের নিয়ে আজমীরে গমণ করেন। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারছি যে, ৬১৩ হিজরী এর পরে মুইন উদ্দীন চিশতি ভারতে আগমন করেন। বখতিয়ার কাকী আরো উল্লেখ করেছেন যে, আজমীরে অবস্থান কালে আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমি পৃথ্বিরাজকে মুসলমানদের হাতে জীবিত বন্দি অবস্থায় অর্পন করলাম। এর কয়েক দিন পরেই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর সৈন্যগণ পৃথ্বীরাজকে পরাজিত ও বন্দী করে।
অথচ ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, ৬১৩ হিজরীর প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ৫৮৮ হিজরীতে তারাঈনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে আজমীর দখল করেন। আর ৬১৩ হিজরীতে খাজা মুঈন উদ্দীনের আজমীর আগমনের ১০ বছর পূর্বে ৬০৩ হিজরীতে শিহাবু্দ্দীন ঘোরী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। অথবা মুইন উদ্দীন অনেক আগে ভারতে আসেন। এক্ষেত্রে আনিসুল আরওয়াহ, দলীলুল আরেফিন, ফওয়ায়েদুস সালেকীন ইত্যাদি পুস্তকে লেখা সন-তারিখ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বানোয়াট।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় বুযুর্গদের নামেও জলিয়াতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট নিরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, বুযুর্গদের ক্ষেত্রে তা না থাকাতে এদের নামে জালিয়াতি ধরার কোন পথ নেই ।জালিয়াতগণ বুযুর্গদের নামে জাল পুস্তক লিখে সিগুলির মধ্যে জাল হাদীস উল্লেখ করেছে এবং তাদের লেখা বইয়ের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন এসকল জাল হাদীসের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সাধারন মুসলিম বলবেন, অমুক বুযুর্গের পুস্তকে এই হাদীস রয়েছে, তা জাল হয় কিভাবে ? এভাবে জালিয়াতগণ এক ঢিলে দুই পখি মেরেছে !
নেককার বলে পরিচিত কিছু মানুষ এর চেয়েও জঘন্য কাজে লিপ্ত হতেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বানোয়াট কথা রাসূলুল্লাহ স.এর নামে বলতেন। হাদিস জালিয়াতির ক্ষেত্রে এরাই ছিলেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকারক। তারা যে সকল বিষয়ে হাদীস বানিয়েছেন তার অনেক বিষয়ে অনেক সহিহ হাদীস রয়েছে। কিন্তু এসকল নেককার ! মানুষ অনুভব করেছেন যে, এ সকল সহিহ হাদীসের ভাষা ও সেগুলোতে বর্ণিত পুরষ্কার বা শাস্তিতে মানুষের আবেগ আস না। তাই তারা আরো জোড়ালো ভাষায় বিস্তারিত কথায় অগণিত পুরষ্কার ও কঠিনতম শাস্তির কথা বলে হাদীস বানিয়েছেন, যেন মানুষেরা তা শুনেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এভাবে তারা ওহীর অপূর্ণতা ! মানবীয় বুদ্ধি দিয়ে পুরন ! করতে চেয়েছেন। সবচেয়ে কঠিন বিষয় ছিল যে, তাদের ধার্মিকতার কারনে সমাজের অনেক মানুষই তাদের এসকল জালিয়াতির ক্ষপ্পরে পড়তেন। তারা এগুলোকে হাদীস বলে বিশ্বাস করেছেন।
শয়তান এদেরকে বুঝিয়েছিল যে, আমরা তো রাসূল স. এর বিরুদ্ধে নয়, পক্ষেই মিথ্যা বলছি। এ সকল মিথ্যা ছাড়া মানুষদের হেদায়েত করা সম্ভব নয়। কাজেই ভাল উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলা শুধু জয়েযই নয় বরং ভাল কাজ। শয়তান তাদেরকে বুঝতে দেয় নি যে, তাদের সব চিন্তাই ভুল খাতে প্রবাহিত হয়েছে। মিথ্যা ছাড়া মানুষদেরকে ভাল পথে আনা যাবে না একথা ভাবার অর্থ হলো ওহী মানুষকে হেদায়েত করতে সক্ষম নয়। কুরআন কারীম ও বিশুদ্ধ হাদীস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই আজগুবি মিথ্যা দিয়ে মানুষকে হেদায়েত করতে হবে ! কি জঘন্য চিন্তা !
তাদের এ সকল মনগড়া কথা যে ওহীর পক্ষে বা আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষে সে কথা দাবী করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে ? তারা যে কথাকে ইসলামের পক্ষ্যে বলে মনে করেছে তা সর্বদা ইসলামের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। আজগুবি গল্প, অল্প কাজের অকল্পনীয় সওয়াব, সামান্য অন্যায়ের ঘোরতর শাস্তি, সৃষ্টির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাল্পনিক কাহিনী, কাল্পনিক অলৌকিক কারাতমতের কাহিনী, বিভিন্ন বানোয়াট ফজিলতের কাহিনী ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে বিচ্যুত করেছে। অগনিত কুসংস্কার ছড়িয়েছে তাদের মধ্যে। নফল ইবাদতের সওয়াবের বানানো মনগড়া কল্প কাহিনী মুসলিম উম্মাহকে ফরয দায়িত্ব ভুলিয়ে দিয়েছে। অগনিত মনগড়া আমল মুসলমানদেরকে কুরআন ও সহিহ হাদীসে বর্ণিত কর্ম ও দায়িত্ব থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। আমরা পরবর্তিতে বানোয়াট হাদীসগুলো আলোচনার সময় এসবের অনেক উদাহরন দেখতে পাব।
ওহীর পক্ষ্যে মিথ্যা বলার কারনেই যুগে যুগে সকল ধর্ম বিকৃত হয়েছে। ওহীর পক্ষ্যে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত হওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ খৃষ্টধর্মের বিকৃতকারী পৌল নামধারী শৌল এবং তার অনুসারী খৃষ্টানগণ। এরা ইশ্বরের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য, যিশুর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ও অধিক সংখ্যক মানুষকে সুপথে আনয়ন করার জন্য ওহীর নামে মিথ্যা বলেছে। এরা ভেবেছে যে, আমরা ইশ্বরের বা যীশুর পক্ষে বলছি, কাজেই এ মিথ্যায় কোন দোষ নেই। কিন্তু তারা মুলত শয়তানের খেদমত করেছে। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, "বল হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না। এবং যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরলপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না।"
মুসলিম উম্মাহর মধ্যেও এই ধরনের পথভ্রষ্ট খেয়াল খুশীমত ওহী বানানো সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব দেখা দিয়েছে। এ সকল নেককার জালিয়াত বিভিন্ন পদ্ধতিতে হাদীস তৈরী করতেন।
১. কিছু মানুষ কুরআন এবং কুরআনের বিভিন্ন সুরা তিলাওয়াতের অগনিত কাল্পনিক সওয়াব বর্ণনা করে হাদীস তৈরী করতেন।
২. অনেকে প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত বিভিন্ন নেক আমলের সওয়াব বর্ণনায় হাদীস তৈরী করতেন। যেমন তাসবীহ, যিকির, তাহাজ্জুদ, চাশত ইত্যাদি নামাজের অকল্পনীয় সওয়াবের বানোয়াট ফজিলত।
৩. কেউ কেউ বিভিন্ন প্রকার নেক আমল তৈরী করে তার ফযীলতে হাদীস বানাতেন। যেমন বিভিন্ন মাসের জন্য বিশেষ পদ্ধতির সালাত, সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্য বিশেষ সালাত, আল্লাহকে স্বপ্নে দেখা, রাসূলুল্লাহ স. কে স্বপ্নে দেখা, জান্নাতে নিজের স্থান দেখা ইত্যাদি বিভিন্ন উদ্যেশ্য সাধনের জন্য বিশেষ সালাত। অনুরুপভাবে বিভিন্ন দরুদ, যিকির, দোয়া, মুনাজাত ইত্যাদি বানিয়ে সেগুলোর বানোয়াট ফজিলত উল্লেখ করে হাদীস তৈরী করেছেন। এরুপ অগনিত ইবাদত তারা তৈরী করেছেন এবং সেগুলোর ফযীলতের কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অগনিত সওয়াব ও ফজীলতের কাহিনী বলেছেন।
৪. অনেক মানুষের অন্তর নরম করার জন্য সংসার ত্যাগ, ক্ষুধার ফযীলত, দারিদ্রের ফজীলত, বিভিন্ন কাহিনী, শাস্তি, পুরষ্কার বা অনুরুপ গল্প কাহিনী বানিয়ে রাসূলুল্লাহ স. এর নামে চালিয়েছেন।
আল্লামা সাইয়্যেদ শরীফ জুরজানী হানাফি লিখেছেন, মওযু বা বানোয়াট হাদীস প্রচলনে সবচেয়ে ক্ষতি করেছেন দুনিয়াত্যাগী দরবেশগণ, তারা অনেক সময় সওয়াবের নিয়াতেও মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলতেন। ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, বর্ণিত আছে যে, কোন কোন সুফি সওয়াবের বর্ননায় ও পাপাচারের শাস্তির বর্ণনায় মিথ্যা হাদীস বানানো ও প্রচার করা জায়েজ মনে করতেন। সুয়ুতী বলেন, জালিয়াতির উদ্যেশ্য অনুসারে মিথ্যাবাদী জালিয়াতিগণ বিভিন্ন প্রকারের। এদের মধ্যে সবচেয়ে মারত্মক ও ক্ষতিকর ছিলেন কিছু মানুষ যাদেরকে সংসারত্যাগী নিলোর্ভ নেককার মনে করা হত। তারা তাদের বিভ্রান্তির কারনে আল্লাহর নিকট সওয়াব পাবার আশায় মিথ্যা হাদীস বানাতেন। ২য় শতকের প্রখ্যাত দরবেশ আবু দাউদ নাখয়ী সুলাইমান ইবনু আমর রাত জেগে তাহাজ্জুদ আদায়ে ও দিনের পর দিন নফল সিয়াম পালনে ছিলেন অতুলনীয়। তা সত্বেও তিনি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে প্রচার করতেন। আবু বিশর আহমদ ইবনু মুহাম্মদ আল-মারওয়াযী খোরাসানের অন্যতম ফকীহ, আবেদ ও সুন্নতের সৈনিক ছিলেন। সুন্নাতের পক্ষ্যে এবং বিদাতের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন খড়গহস্ত। কিন্তু তিনি মিথ্যা কথাকে হাদীসের নামে প্রচার করতেন। ওয়াহাব ইবনু ইয়াহইয়া ইবনু হাফস তার যুগের অন্যতম নেককার আবিদ ও ওয়ায়িয ছিলেন। ২০ বছর তিনি কারো সাথে কোন জাগতিক কথা পর্যন্ত বলেন নাই। তিনিও হাদীসের নামে জঘন্য মিথ্যা কথা বলতেন।
দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় ৪ শতাব্দি পর্যন্ত হাদীস সংকলনের যে ধারা চালু থাকে এর প্রধান উদ্দেশ্য্ই ছিল রাসূলুল্লাহ স. এর নামে কথিত ও প্রচারিত সকল হাদীস সংকলিত করা। যাতে মুসলিম উম্মাহর মুহাদ্দীসগণ নিরীক্ষাভিত্তিক বিধানের আলোকে এগুলির মধ্য থেকে বিশুদ্ধ ও নির্ভূল হাদীস বেছে নিতে পারেন। অনেকে বর্ণনাকারী রাবী বা বর্ণনাকারী সাহাবীর নামের ভিত্তিতে হাদীস সংকলন করতেন। কেউ বা বিষয়ভিত্তিক হাদীস সংকলন করতেন। সবারই মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীস নামে প্রচলিত সব কিছু সংকলিত করা।
এজন্য আমরার দেখতে পাই প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে সহীহ. যয়ীফ, জাল সকল প্রকার হাদীস সংকলিত হয়েছে। এখানে অজ্ঞতার কারনে অনেকে ভুল ধারনার কবলে পড়েন। উপরের পরিচ্ছেদগুলিতে আলোচিত সাহাবী ও পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিসগণের হাদীস বিচার, সনদ যাচাই, নিরীক্ষা ইত্যাদি থেকে অনেকে মনে করেন যে, মুহাদ্দিসদের এ সকল বিচার ও নিরীক্ষার মাধ্যমে যাদের ভুল বা মিথ্যা ধরা পড়েছে তাদের হাদীস তো তারা গ্রহণ করেননি এবং সংকলনও করেন নি। কাজেই কোন হাদীসের গ্রন্থে হাদীস সংকলনের অর্থ হলো এসকল হাদীস নিরীক্ষার মাধ্যমে বিশুদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়েছে বলেই উক্ত মুহাদ্দীস হাদীসগুলিকে তার গ্রন্থে সংকলিত করেছেন।
এ ধারনাটি একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত এবং প্রকৃত অবস্থার একেবারেই বিপরীত। কয়েকজন সংকল বাদে কোন সংকলকই শুধুমাত্র বিশুদ্ধ বা নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলনের উদ্দেশ্যে গ্রন্থ রচনা করেন নি। অধিকাংশ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির, আলিম ও ইমাম হাদীস সংকলন করেছেন সহীহ, যয়ীফ ও জাল সকল প্রকার হাদীস সনদ সহ একত্রিত করার উদ্দেশ্যে; যেন রাসূলুল্লাহ স. এর নামে কথিত বা প্রচারিত সকলকিছুই সংরক্ষিত হয়। তার কোন হাদীসই রাসূলুল্লাহ স. এর কথা বা কাজ হিসেবে সরাসরি বর্ণনা করেন নি। বরং সনদসহ, কে তাদেরকে হাদীসটি কার সূত্রে বর্ণনা করেছেন তা উল্লেখ করেছেন। তারা মূলত বলেছেন; "অমুক ব্যাক্তি বলেছেন যে, 'এই কথাটি হাদীস', আমি তা সনদসহ সংকলিত করলাম। হাদীস প্রেমিক পাঠকগণ এবার সহিহ, যয়ীফ ও জাল বেছে নিন। এ সকল সংকলকের কেউ কেউ আবার হাদীস বর্ণনার সাথে সাথে তার সনদের আলোচনা করেছেন এবং দূর্বলতা বা সবলতা বর্ণনা করেছেন।
অল্প কয়েকজন সংকলক শুধু সহীহ হাদীস সংকলনের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে তৃতীয় শতকের প্রসিদ্ধতম মুহাদ্দিস ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল বুখারী, ইমাম মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল-কুশাইরী অন্যতম। তাদের পরে আব্দুল্লাহ ইবনে আলী ইবনে জারদ (৩০৭ হি







দ্বাদশ শতকের অন্যতম আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী হাদীসের গ্রন্থগুলিকে পাচটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। প্রথম পর্যায়ে রয়েছে শুধুমাত্র তিনটি গ্রন্থ। বুখারী, মুসলিম ও মুয়াত্তায় ইমাম মালেক। এ গ্রন্থতিনটিস সকল সনদসহ বর্ণিত সকল হাদীস গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত।
দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে সে সকল গ্রন্থ যেগুলির হাদীস মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে বলে হলেও সেগুলিতে অনেক অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। মোটামুটিভাবে মুসলিম উম্মাহ এসকল গ্রন্থকে গ্রহণ করেছেন ও তাদের মধ্যে এগুলি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই পর্যায়ে রয়েছে তিনটি গ্রন্থ। সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাই, সুনানে তিরমিযী। ইমাম আহমদের মুসনাদও প্রায় এই পর্যায়ের।
তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঐ সকল গ্রন্থ যা ইমাম বুখারী, ইমাম মুসিলম প্রমুখ মুহাদ্দিসের আগের বা পরের যুগে সংকলিত হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে সহিহ, যয়ীফ ও মিথ্যা সব ধরনের হাদীসই রয়েছে। যার ফলে বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দীস ছাড়া এ সকল গ্রন্থ থেকে উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়। এ সকল গ্রন্থ মুহাদ্দীসদের মধ্যে তেমন প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এই পর্যায়ে রয়েছে, মুসনাদে আবী ইয়ালা, মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক, মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, মুসনাদে তায়ালিসী, ইমাম বায়হাকীর হাদীস গ্রন্থ সমূহ, ইমাম তাহাবীর সংকলিত হাদীস গ্রন্থ সমূহ, তাবরানীর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ সমূহ। এ সকল গ্রন্থের সংকলকগণের উদ্দেশ্য ছিল যা পেয়েছেন তাই সংকলন করা। তারা নিরীক্ষা ও যাচাইয়ের দিকে মন দেননি।
চতুর্থ পর্যায়ের গ্রন্থগুলো হলো ঐ সকল গ্রন্থ যা কয়েক যুগ পরে সংকলিত হয়। এ সকল গ্রন্থের সংকলকরা মূলত নিম্ন প্রকারের হাদীস সংকলন করেছেন। ১. যে সকল হাদীস পূর্ব যুগে অপরিচিত বা অজানা থাকার কারনে পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহে সংকলিত হয়নি, ২. যে সকল হাদীস কোন অপরিচিত গ্রন্থে সংকলিত ছিল, ৩. লোকমুখে প্রচলিত বা ওয়ায়েযদের ওয়াযে প্রচলিত বিভিন্ন কথা যা কোন হাদীসের গ্রন্থে স্থান পায়নি, ৪. বিভিন্ন দূর্বল ও বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত কথাবার্তা, ৫. যে সকল হাদীস মূলত সাহাবী বা তাবেয়ীদের কথা, ইহুদীদের গল্প বা পূর্ববর্তী যামানার জ্ঞানী ব্যাক্তিদের কথা, যেগুলোকে ভুলক্রমে বা ইচ্ছাপূর্বক কোন বর্ননাকারী হাদীস বলে বর্ননা করেছেন, ৬. কুরআন বা হাদীসের ব্যাখ্যা জাতিয় কথা যা ভুলক্রমে কোন সৎ বা দরবেশ মানুষ হাদীস বলে বর্ণনা করেছেন, ৭. হাদীস থেকে উপলব্ধিকৃত অর্থকে কেউ কেউ ইচ্ছাপূর্বক হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন অথবা বিভিন্ন সনদে বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসের বাক্যকে একটি হাদীস বলে বর্ননা করেছেন। এ ধরনের হাদীস সংকলন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ইবনে হিব্বানের আদ-দুয়াফা, ইবনে আদীর আল-কামিল, খতীব বাগদাদী, আবু নাইম আল-ইসফাহানী, ইবনে ইসাকের, ইবনুন নাজ্জার ও দাইলামী কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থসমূহ। খাওয়ারিজমী কর্তৃক সংকলিত মুসনাদে ইমাম আবু হানীফাও প্রায় এই পর্যায়ে পড়ে। এ পর্যায়ের গ্রন্থসমূহের হাদীস হয় যযীফ অথবা জাল।
অজ্ঞতা বশত অনেকেই মনে করেন যে, কোন হাদীস কোন হাদীস-গ্রন্থ সংকলিত থাকার অর্থ হলো হাদীসটি সহিহ, অথবা অন্তত উক্ত গ্রন্থের সংকলকের মতে হাদীসটি সহিহ। যেমন কোন হাদীস যদি সুনানে ইবনে মাজাহ বা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক গ্রন্থে সংকলিত থাকে সংকলিত থাকে তার অর্থ হলো হাদীসটি নিশ্চিত সহিহ, নইলে ইবনে মাজাহ তার গন্থে হাদীসটির স্থান দিতেন না। এ ধারনাটির উভয় দিক ই ভিত্তিহীন। অধিকাংশ মুহাদ্দীস ই তার গ্রন্থে সহীহ, যয়ীফ, জাল সকল প্রকার হাদীস ই সংকলন করেছেন। তারা কখনোই দাবী করেন নি যে, তাদের গ্রন্থে শুধু সহিহ হাদীস সংকলন করবেন। কাজেই কোন হাদীস সুনানে আবনে মাজাহ বা মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাকে এ সংকলিত থাকাতে কখনোই বুঝা যায় না যে, হাদীসটি সহিহ বা ইবনে মাজাহ বা আব্দুর রায্যাকের মতে সহীহ।
ইবনে হিব্বান, ইবনে খুযাইমা, ইবনুস সাকান, হাকেম ও অন্যান্ন যে কল মুহাদ্দীস তাদের গ্রন্থে শুধু সহীহ হাদীস সংকলন করার চেষ্টা করেছেন, তাদের গ্রন্থে কোন হাদীস সংকলিত হলে আমরা মনে করব যে, হাদীসটি উক্ত মুহাদ্দীসের মতে সহিহ। তবে এতে প্রমানিত হয় না যে, হাদীসটি প্রকৃতপক্ষে সহিহ। কোন মুহাদ্দীসের দাবীই উম্মাহর পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ নিরীক্ষা ছাড়াই গ্রহণ করেন নি। এ জন্য আমরা অন্যা্ন্ন মুহাদ্দীসের নিরীক্ষার আলোকে হাদীসটির বিধান নির্ধারন করব।
আমাদের সমাজে সিহাহ সিত্তাহ নামে প্রসিদ্ধ ৬ টি গ্রন্থের মধ্যে ২ টি সহীহ গ্রন্থ; বুখারী ও মুসলিম ছাড়া বাকী ৪ টি সঃকলকও শুধুমাত্র সহীহ হাদীস বর্ণনা করবেন বলে কোন সিদ্ধান্ত নেননি। তারা তাদের গ্রন্থগুলিতে সহীহ হাদীসের পাশাপাশি অনেক যয়ীফ এবং জাল হাদীসও সংকলন করেছেন। তবে তাদের গ্রন্থগুলির অধিকাংশ হাদীস নির্ভরযোগ্য হওয়ার কারনে পরবর্তী মুহাদ্দীসগণ সাধারনভাবে তাদের গ্রন্থগুলির উপর নির্ভর করেছেন সাথে সাথে তারা এসকল গ্রন্থে সংকলিত দূর্বল ও বানোয়াট হাদীস সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বিধান প্রদান করেছেন। আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী (১৩০৪ হি

ইতোপূর্বে আমরা এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীস দেহলভীর বিবরণ দেখেছি। তিনি সুনানে আবী দাউদ, সুনানে নাসাই, সুনানে তিরমিযী এ তিনটি গ্রন্থকে দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত করেছেন। যে সকল গ্রন্থের হাদীস সমূহ মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হলেও সেগুলিতে কিছু অনির্ভরযোগ্য হাদীসও রয়েছে। কিন্তু তিনি সুনান ইবনে মাজাহকে এই পর্যায়ে উল্লেখ করেন নি। এর কারন হল মুহাম্মদ ইবনে মাজাহ আল-কাযবিনী সংকলিত সুনান গ্রন্থটিকে অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণযোগ্য গ্রন্থাবলীর অন্তর্ভূক্ত করেন নি। হিজরী ৭ম শতক পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ সহীহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমের অতিরিক্ত এ তিনটি সুনান গ্রন্থকেই মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং হাদীস শিক্ষা ও শিক্ষাদানের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন। ৫ম-৬ষ্ঠ হিজরী শতকের মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনু তাহির মাকদিসী, আবুল ফদল ইবনুল কাইসুরানী এগুলোর সাথে সুনান ইবন মাজাহ যোগ করেন।
তার এ মত পরবর্তী ২ শতাব্দি পর্যন্ত মুহাদ্দিসগণ গ্রহণ করেন নি। ৭ম শতকের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনুস সালাহ আবু আমর উসমান ইবনু আব্দুর রহমান, আল্লামা আবু যাকারিয়া ইবনু শারাফ আন-নববী প্রমুখ মুহাদ্দিস হাদীসের মূল উৎস হিসেবে উপরের ৫ টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। সুনানে ইবনে মাজাহকে তারা এগুলির মধ্যে গন্য করেন নি। পরবর্তী যুগের অনেক মুহাক্কক আলিম এদের অনুসরণ করেছেন। অপরদিকে ইমাম ইবনুল আসীর মুবারাক ইবনু মুহাম্মদ ও অন্য কতিপয় মুহাদ্দিস ৬ষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে ইমাম মালিকের মুয়াত্তাকে গন্য করেছেন।
ইমাম ইবনে মাজাহ এর সুনান গ্রন্থ মোট ৪৩৪১ টি হাদীস সংকলিত হয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় তিন হাজার হাদীস উপরের পাচটি গ্রন্থে সংকলিত। বাকী দেড় হাজার হাদীস অতিরিক্ত। ৯ম শতকের মুহাদ্দিস আল্লামা আহমদ ইবনু আবী বকর আল-বুসিরী ইবনে মাজাহর এসকল অতিরিক্ত হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন। আল্লামা বুসিরী ১৪৭৬ টি হাদীসের সনদ আলোচনা করেছেন যেগুলি উপরের ৫টি গ্রন্থে সংকলিত হয়নি, শুধুমাত্র ইবনে মাজাহ সংকলন করেছেন। এগুলির মধ্যে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ সহীহ বা হাসান হাদীস এবং প্রায় এক তৃতীয়াংশ হাদীস যয়ীফ। আর প্রায় অর্ধশত হাদীস মাউযু বা জাল হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন মুহাদ্দিসগণ।
হাদীসের গ্রন্থ ছাড়াও অন্যান্ন বিভিন্ন ইসলামী গ্রন্থে হাদীস উল্লেখ করা হয়। তাফসীর, ফিকাহ, ওয়াজ, আখলাক, ফযীলত, তাসাউফ, দর্শন, ভাষা, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ক পুস্তকাদিতে অনেক হাদীস উল্লেখ করা হয়। সাধারনত এ সকল গ্রন্থে সনদবিহীনভাবে হাদীস উল্লেখ করা হয়। অনেকেই অজ্ঞতা বশত ধারনা করেন যে, এসকল গ্রন্থের লেখকগণ নিশ্চয়ই যাচাই বাছাই করে হাদীসগুলো লিখেছেন। সহিহ না হলেকি আর তিনি হাদীস লিখতেন ?
এ ধারনাটিও ভিত্তিহীন, ভুল এবং উপরের ধারনাটির চেয়েও বেশী বিভ্রান্তিকর। সাধারনত প্রত্যেক ইলমের জন্য পৃথক পৃথক ক্ষেত্র রয়েছে। এ জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে এক বিষয়ের আলিম অন্য বিষয়ে অত বেশী সময় দিতে পারেন না। মুফাস্সির, ফকীহ, ঐতিহাসিক, সুফি, ওয়ায়িজ ও অন্যান্ন ক্ষেত্রে কর্মরত আলিম ও বুযুর্গ স্বভাবতই হাদেসের নিরীক্ষা যাচাই বাছাই ও পর্যালচনায় যেতে পারেন না। সাধারনভাবে তারা হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচলিত গ্রন্থ জনশ্রুতি ও প্রচলনের উপর নির্ভর করেন। এ জন্য তাদের গ্রন্থে অনেক ভিত্তিহীন সনদহীন ও জাল কথা পাওয়া যায়।
আল্লামা নববী তার তাকরীব গ্রন্থে এবং আল্লামা সুয়ুতি তার তাদবীরুর রাবী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কুরআন কারীমের বিভিন্ন সুরার ফযীলতে অনেক মিথ্যা কথাকে কিছু বুযুর্গ দরবেশ হাদীস বলে সমাজে চালিয়েছেন। কোন কোন মুফাস্সির যেমন আল্লামা আহমদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম আস সালাবী নিশাপুরী তার তাফসীর গ্রন্থে তার ছাত্র আল্রামা আলী ইবনে আহমদ আল ওয়াহিদী নিশাপুরী তার বাসীত, ওয়াসিত, ওয়াজীয ইত্যাদি তাফসীর গ্রন্থে, আল্লামা আবুল কাসেম মাহমুদ ইবনে উমর আয যামাখশারী তার কাশাশাফ গ্রন্থে, আল্লামা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর আল বাইযাবী তার আনওয়ারুত তানযীল বা তাফসীরে বা্ইযাবীতে এ সকল বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করেছেন। তারা এই কাজটি করে ভুল করেছেন। সুয়ুতী বলেন ইরাকী (৮০৬ হি

মোল্লা আলী কারী কোন কোন জাল হাদীস উল্লেখ পূর্বক লিখেছেন, কুতুল কুলব, এহইয়াউ উলুমুদ্দীন, তাফসীরে সালাবী ইত্যাদি গ্রন্থে হাদীসটির উল্লেখ দেখে ধোকা খাবেন না । আল্লামা আব্দুল হাই লাখনবী হানাফী ফিকহের নির্ভোরযোগ্য গ্রন্থাবলীর নাম ও পর্যায় বিন্যাস উল্যেক করে বলেন, আমরা ফিকহী গ্রন্থাবলীর নির্ভরযোগ্যতার যে পর্যায় উল্যেখ করলাম তা সবই ফিকহী মাসায়েলের ব্যাপার। এ সকল পুস্তকের মধ্যে যে সকল হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোর বিশুদ্ধতা বা নির্ভরযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস মোটেও প্রযোজ্য নয়। এরুপ অনেক নির্ভরযোগ্য ফিকহী গ্রন্থ রয়েছে যেগুলির উপর মহান ফকীহগণ নির্ভর করেছেন কিন্তু সেগুলি জাল ও মিথ্যা হাদীসে ভরপুর। বিশেষত ফতওয়া বিষয়ক পুস্তকাদী। বিস্তারিত আলোচনা করে আমাদের নিকট প্রমাণিত হয়েছে যে, এ সকল পুস্তকের লিখকগণ যদিও কামিল ছিলেন তবে হাদীস উল্লেখ করার ক্ষেত্রে তারা অসতর্ক ছিলেন।"
এজন্য মুহাদ্দিসগণ ফিকাহ তাফসীর তাসাউফ আখলাক ইত্যাদি বিষয়ক গ্রন্থে উল্লেখিত হাদীসগুলি বিশেষভাবে নীরিক্ষা করে পৃথক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেমন ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের প্রখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী ইবনে আবু বকর আল-মারগিনানী তার লেখা ফিকাহ শাস্ত্রের প্রখ্যাত গ্রন্থ হেদায়ায় অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি ফকীহ হিসেবে ফিকহী মাসায়েল নির্ধারন ও বর্ণনার প্রতিই তার মনযোগ ও সার্বিক প্রচেষ্টা ব্যায় করেছেন। হাদীস উল্লেখের ক্ষেত্রে তিনি যা শুনেছেন বা পড়েছেন তা বাছবিচার না করেই লিখেছেন। তিনি কোন হাদীসের সহিহ বা যয়ীফ বিষয়ে কোন মন্তব্যও করতে যাননি। পরবর্তী যুগে আল্লামা জামালুদ্দীন আবু আব্দুল্লাহ ইবনে ইউসুফ যায়লানী হানাফী, আল্লামা আহমদ ইবনে আলী ইবনে হাজার আসকালানী প্রমুখ মুহাদ্দিস এসকল হাদিস নিয়ে সনদভিত্তিক গবেষনা করে এর মধ্য থেকে সহিহ, যয়ীফ ও জাল হাদীস নির্ধারন করেছেন।
অনুরুপভাবে ইমাম গাজ্জালী তার প্রসিদ্ধ এহইয়ায় উলুমুদ্দীন গ্রন্থে ফিকাহ ও তাসাউফ অলোচনার ফাকে ফাকে অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তিনি দার্শনিক ও ফকিহ ছিলেন, মুহাদ্দিস ছিলেন না। এজন্য হাদীসের সনদের বাছবিচার না করেই যা শুনেছেন বা পড়েছেন সবই উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী যুগে আল্লামা যাইনুদ্দীন আবুল ফাদল আব্দুর রহীম ইবনে হুসাইন আল-ইরাকী ও অন্যান্ন সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস তার উল্লেখিত হাদীস সমূহের সনদ ভিত্তিক বিচার বিশ্লেষন করে সহীহ, যয়ীফ ও জাল হাদীসগুলো নির্ধারন করেছেন। এছাড়া ৮ম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ শাফিয়ী ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব ইবনু আলী আস-সুবকী (৭৭১ হি

কাশফ-ইলহাম বনাম জাল হাদীস :
সবচেয়ে বেশী সমস্যা হয় সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও আল্লাহর প্রিয় ওলী রুপে প্রসিদ্ধ অলিমগণের বিষয়ে। যেহেতু তারা সাহেবে কাশফ বা কাশফ সম্পন্ন ওলী ছিলেন, সেহেতু আমরা ধারনা করি যে, কাশফের মাধ্যমে প্রদত্ত তথ্যের বিশুদ্ধতা যাচাই না করে তো আর তারা লিখেন নি। কাজেই তারা যা লিখেছেন বা বলেছেন সবই বিশুদ্ধ বলে গন্য হবে।
আল্লামা সুয়ুতী, আব্দুল হাই লাখনভী প্রমুখ আলিম এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তারা ইমাম গাজ্জালীর এহইয়ায় উলুমুদ্দীন ও অন্যান্ন গ্রন্থে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী লিখিত কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখিত অনেক জাল ও বানোয়াট হাদীসের আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, "কেউ হয়ত প্রশ্ন করবেন; এতবড় আলেম ও এতবড় সাহেবে কাশফ ওলী তিনি কি বুঝতে পারলেন না যে, এই হাদীসটি বানোয়াট ? তার মত একজন ওলী কি ভাবে নিজ গ্রন্থে বানোয়াট হাদীস উল্লেখ করলেন ? তার উল্লেখের দ্বারা কি বুঝা যায় না যে, হাদীসটি সহিহ ? এ সন্দেহের জবাবে তারা যে বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন সেগুলো নিম্নরুপ -
১. বস্তুত সরলপ্রাণ বুযুর্গগণ যা শুনেন তাই লিখেন। এজন্য কোন বুযুর্গের গ্রন্থে তার কোন সুস্পষ্ট মন্তব্য ছাড়া কোন হাদীস উল্লেখ করার অর্থ এই নয় যে, তিনি হাদীসটিকে সহীহ বলে নিশ্চিত হয়েছেন। মূলত তারা যা পড়েছেন বা শুনেছেন তা উল্লেখ করেছেন মাত্র। তারা আশা করেছেন হয়ত এর কোন সনদ থাকবে, হাদীসের বিশ্লেষকগণ তা খুজে দেবেন।
২. হাদীস বিচারের ক্ষেত্রে কাশফের কোন অবদান নেই। কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া নেয়ামত মাত্র, আনন্দ ও শুকরিয়ার উৎস। ইচ্ছামত প্রয়োগের কোন বিষয় নয়। আল্লাহ তায়ালা হযরত উমর কে কাশফের মাধ্যমে শত শত মাইল দুরে অবস্থিত সারিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থা দেখিয়েছিলেন, অথচ সেই উমরকে হত্যা করতে তারই পিছনে দাড়িয়ে থাকা আবু লুলুর কথা তিনি টেরই পেলেন না।
এছাড়া কাশফ, স্বপ্ন ইত্যাদি দ্বারা কখনোই হক বাতিলের বা ঠিক বেঠিকের ফয়সালা হয় না। সাহাবায় কেরামের মধ্যে বিভিন্ন মতবিরোধ ও সমস্যা ঘটেছে। কথনই একটি ঘনটাতেও তারা কাশফ, ইলহাম, স্বপ্ন ইত্যাদির মাধ্যমে হক্ক বা বাতিল জানার চেষ্টা করেন নি। খুলাফায় রাশেদীন এর দরবারে অনেক সাহাবী হাদীস বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীর ভুলভ্রান্তির সন্দেহ হলে তারা সাক্ষি চেয়েছেন অথবা বর্ণনাকারীকে কসম করিয়েছেন। কখনো কখনো তারা বর্ণনাকারীর ভুলের বিষয়ে বেশি সন্দিহান হলে তার বর্ণিত হাদীসকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কখনোই তারা কাশফের মাধ্যমে হাদীসের সত্যাসত্য বিচার করেন নি। পরবর্তী প্রায় অর্ধ শতাব্দিকাল সাহাবীগণ হাদীস বর্ণনা করেছেন, শুনেছেন ও হাদীসের সহীহ, যয়ীফ ও জাল নির্ধারনের জন্য সনদ বর্ণনার ব্যাবস্থা নিয়েছেন। বর্ননাকারীর অবস্থা অনুসারে হাদীস গ্রহণ করেছেন বা যয়ীফ হিসেবে বর্জন করেছেন। কিন্তু কখনোই তারা কাশফের উপর নির্ভর করেননি।
হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্নয়ের জন্য সনদের উপর নির্ভর করা সুন্নাতে খুলাফায় রাশেদীন ও সুন্নাতে সাহাবা। আর এ বিষয়ে কাশফ, ইলহাম বা স্বপ্নের উপর নির্ভর করা খেলাফে সুন্নাত বিদাত ও ধ্বংসাত্মক।
৩. বাস্তবে আমরা দেখতে পাই যে, অনেক প্রখ্যাত সাধক, যাদেরকে আমরা সাহেবে কাশফ বলে জানি, তারা তাদের বিভিন্ন গ্রন্থে অনেক কথা লিখেছেন যা নি:সন্দেহে ভুল ও অন্যায়। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী লিখেছেন যে, ঈমান বাড়ে ও কমে। ইমানের হ্রাস-বৃদ্ধি স্বীকার করাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ও ফেরকায় নাজিয়ার আলামত বলে গন্য করেছেন এবং ইমান হ্রাস বৃদ্ধি না মানাকে বাতিলদের আলামত বলে গন্য করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, কোন মুসলমানের উচিত নয় যে, সে বলবে : আমি নিশ্চিত মুমিন', বরং তাকে বলতে হবে যে, ইনশাআল্লাহ আমি মুমিন। ইমাম আবু হানিফা ও তার অনুসারীগণ যেহেতু ইমানের হ্রাস-বৃদ্ধি স্বীকার করেন না, এবং ইনশাআল্লাহ আমি মুমিন বলাকে আপত্তিকর বলে মনে করেন, সেজন্য তিনি তাকে ও তার অনুসারীগণকে বাতিল ও জাহান্নামী ফিরকা বলে উল্লেখ করেছেন।
ইমাম গাজ্জালী লিখেছেন যে, গান-বাজনা, নর্তন-কুর্দন ইত্যাদি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার পথে সহায়ক ও বিদাতে হাসানাহ। তিনি গান বাজনার পক্ষ্যে অনেক দূর্বল ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন।
এরুপ অগণিত উদাহরণ তাদের গ্রন্থে পাওয়া যায়। কাজেই তারা যদি কোন হাদীসকে সহীহ বলেও ঘোষনা দেন তারপরেও তার সনদ বিচার ব্যাতিরেকে তা গ্রহণ করা যাবে না। কারন রাসূলুল্লাহ স. এর হাদীসের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সকল বানোয়াট কথাকে চিহিৃত করা দ্বীনের অন্যতম ফরয। কেউ সন্দেহযুক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ স. এর নামে বর্ণনা করলেও তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। কাজেই এ ক্ষেত্রে কোন শিথিলতার অবকাশ নেই।
বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি :
এখানে আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার। তা হলো হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় নেককার বুযুর্গ ও ওলী আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি হয়েছে প্রচুর। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষনিয় :
১. জালিয়াতিগণ ধর্মের ক্ষতি করার জন্য অথবা ধর্মের উপকার করার জন্য জালিয়াতি করত। বিশেষ করে যারা ধর্মের অপুর্ণতা দূর করে ধর্মকে আরো বেশী জননন্দিত ও আকর্ষনীয় করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের জালিয়াতিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক। আর উভয় দলের জন্য এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় দলের জন্য রাসূল স. এর নামে জালিয়াতি করার চেয়ে ওলি আল্লাহগণের নামে জালিয়াতি করা অধিক সহজ ও অধিক সুবিধাজনক ছিল।
২. বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি অধিকতর সুবিধাজনক এজন্য যে, সাধারন মানুষদের মধ্যে তাদের নামের প্রভাব হাদীসের চেয়েও বেশী। অনেক সাধারন মুসলমানকে হাদীস বলে বুঝানো কষ্টকর। তাকে যদি বলা যায় যে, আব্দুল কাদের জিলানী বা খাজা মইনুদ্দীন চিশতী বা ওমুক ওলী এই কাজটি করেছেন বা করতে বলেছেন তবে অনেক বেশী সহজে তাকে প্রতারিত করা যাবে এবং তিনি খুব তাড়াতাড়ি তা মেনে নিবেন। ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দীর সোনালী দিনগুলির পরে যুগে যুগে সাধারন মুসলিমদের এ অবস্থা। কাজেই বুযুর্গদের নামে জালিয়াতি বেশী কার্যকর ছিল।
৩. ওলী আল্লাহর নামে জালিয়াতি সহজতর ছিল এজন্য যে, হাদীসের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর নিবেদিত প্রাণ মুহাদ্দিসগণ যেভাবে সতর্ক প্রহরা ও নিরীক্ষার ব্যাবস্থা রেখেছিলেন, এক্ষেত্রে তা কিছুই ছিল না বা নেই । কোন নীরিক্ষা নেই, পরিক্ষা নেই, সনদ নেই, মতন নেই, ঐতিহাসিক বা অর্থগত নিরীক্ষা নেই ----------- যে যা ইচ্ছা বলেছেন। কাজেই অতি সহজে জালিয়াতিগণ নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারতেন।
৪. হাদীস জালিয়াতির জন্যও এসকল বুযর্গের নাম ব্যাবহার ছিল খুবই কার্যকর। এ সকল বুযুর্গের নামে বানোয়াট কথার মধ্যে অগনিত জাল হাদীস ঢূকিয়ে দিয়েছে তারা। এসকল বুযুর্গের প্রতি ভক্তির প্রাবল্যর কারণে অতি সহজেই ভক্তিভরে এ সকল বিষ গলধ:করণ করেছেন মুসলমানরা। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পেরেছে জালিয়াতিগণ।
কাদেরীয়া তরীক :
আব্দুল কাদের জিলানী হিজরী ৬ষ্ঠ শতকের প্রসিদ্ধতম ব্যাক্তিত্ব। একদিকে তিনি হাম্বলী মাযহাবের বড় ফকীহ ছিলেন। অন্যদিকে তিনি প্রসিদ্ধ সাধক ও সুফি ছিলেন। তার নামে অনেক তরীকা, কথা ও পুস্তক মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত। এ সকল তরীকা কথা ও পুস্তক অধিকাংশই বানোয়াট। কিছু কিছু পুস্তক তার নিজের রচিত হলেও পরবর্তীকালে এগুলির মধ্যে অনেক বানোয়াট কথা ঢুকানো হয়েছে। এখানে আমরা তার নামে প্রচলিত কাদিরিয়া তরীকা ও সিররুল আসরার পুস্তকটির পর্যালোচনা করব।
প্রচলিত কাদিরিয়া তরীকার আমল, ওযীফা, মুরাকাবা ইত্যাদি পদ্ধতির বিবরন আব্দুল কাদের জিলানী এর পুস্তকে পাওয়া যায়না। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, আব্দুল কাদের জিলানী এর ওফাতের প্রায় দুইশত বছর পরে তার এক বংশধর গাওস জিলানী ৮৮৭ হিজরী সালে (১৪৮২ খৃষ্টাব্দে) কাদেরীয়া তরীকার প্রচলন করেন। বিভিন্ন দেশে কাদেরীয়া তরীকার নামে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর নিজের লিখা প্রচলিত বইগুলিতে যে সকল আমল ওযীফা ইত্যাদি লিখিত আছে প্রচলিত কাদেরিয়া তরীকার মধ্যে সেগুলি নেই।
আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরিয়া তরীকার সূত্র বা সাজরা থেকে আমরা দেখি যে, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু শাহ ওয়ালি উল্লাহ তার আল-কাওলুল জামিল গ্রন্থে কাদেরিয়া তরীকার যে বিবরণ দিয়েছেন তার সাথে সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভীর/ইসমাইল দেহলভীর সিরাতে মুস্তাকীমের বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাদের শিখানো পদ্ধতির সাথে আমাদের দেশে প্রচলিত কাদেরীয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটা তার নিজের প্রবর্তিত ও কোনটা তার নামে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত তা জানার কোন উপায় নেই।
সিররুল আসরার :
হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর নামে প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি পুস্তক সিররুল আসরার। পুস্তকটিতে কুরআন-হাদীসের আলোকে অনেক ভাল কথা রয়েছে। পাশাপাশি অনেক জাল হাদীস ও বানোয়াট কথা পুস্তকটিতে বিদ্যমান। অবস্থাদৃষ্টে বুঝা যায় যে, পরবর্তী যুগের কেউ এ বইটি লিখে তার নামে চালিয়েছে। কয়েকটি বিষয় এই জালিয়াতি প্রমান করে :
১. এ পুস্তকের বিভিন্ন স্থানে লেখক ফরীদ উদ্দীন আত্তার বলেন ----- " এখানে লক্ষনীয় যে, ফরীদ উদ্দীন আত্তার ৫১২ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬২৬ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। আর আব্দুল কাদের জিলানী ৪৭১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৬১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। ফরীদ উদ্দীন আত্তার বয়সে তার চেয়ে ৪০ বছরের ছোট এবং তার ইন্তেকালের সময় ফরীদ উদ্দীন আত্তারের কোন প্রসিদ্ধি ছিল না। কাজেই হযরত শায়েখ --------- ইত্যাদি বলে তিনি আত্তারের উদ্বৃতি প্রদান করবেন একথা কল্পনা করা যায় না।
২. এই পুস্তকে শামস তাবরীয এর উদ্বৃতি দেয়া হয়েছে। লেখক বলেন : হযরত শামস তাবরীয বলেছেন -----------। উল্লেখ্য যে, শামস তাবরীয ৬৪৪ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন। তার জন্ম তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে ৫৬০ হিজরীর পরে তার জন্ম বলে মনে হয়। অর্থাৎ আব্দুল কাদের জিলানীর ইন্তিকালের সময় শামস তাবরীযের জন্মই হয় নি। অথচ তিনি তার বক্তব্য উদ্বৃত করেছেন।
৩. এই পুস্তকে বারংবার জালাল উদ্দীন রুমীর উদ্বৃতি প্রদান করা হয়েছে। যেমন লেখক বলেছেন, " আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট মাওলানা জালালউদ্দীন রুমী তার অমর কাব্য মসনবীতে বলেছেন ------- "। লক্ষ্যনীয় যে, জালাল উদ্দীন রুমী (৬০৪-৬৭৬ হি

এভাবে আমরা বুঝিতে পারি যে, এই পুস্তকটি পুরোটাই জাল অথবা এর মধ্যে অনেক জাল কথা পরবর্তীকালে ঢুকানো হয়েছে। এই পুস্তকটির মধ্যে অগনিত জাল হাদীস ও জগন্য মিথ্যা কথা লিখিত রয়েছে। আর আব্দুল কাদের জিলানীর নামে এগুলি অতি সহজেই বাজার পেয়েছে।
চিশ্তিয়া তরীকা :
আমাদের দেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত খাজা মইন উদ্দীন চিশতি, কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী, ফরীদ উদ্দীন মাসউদ গঞ্জে শক্কর ও নিযাম উদ্দীন আউলিয়া রহিমাহুমুল্লাহ। এদের নামেই চিশ্তিয়া তরীকা প্রচলিত। এছাড়া এদের নামে অনেক কথা, কর্ম, বই পুস্তক প্রচলিত। এগুলির মধ্যে এমন অনেক কথা রয়েছে যা স্পষ্টতই মিথ্যা ও বানোয়াট। এখানে চিশ্তিয়া তরীকা ও এদের নামে প্রচলিত দু একটি বই এর বিষয়ে আলোচনা করব।
ভারতের বিভিন্ন দরবারের চিশতিয়া তরীকার আমল ওযীফা ইত্যাদির মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। উপর্যুক্ত বুযুর্গগনের নামে প্রচলিত পুস্তকাদিতে এ সকল তরীকা বা পদ্ধতির কিছুই দেখা যায় না। আবার এ সকল পুস্তকে যে সকল যিকির ওযিফার বিবরণ রয়েছে সেগুলিও প্রচলিত চিশতিয়া তরীকার মধ্যে নেই। চিশ্তিয়া তরীকার ক্ষেত্রে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীর বিবরনের সাথে সাইয়্যেদ আহমদ ব্রেলভীর বিবরণের পার্থক্য দেখা যায়। আবার তাদের দুইজনের শেখানো পদ্ধতির সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রচলিত চিশ্তিয়া তরীকার ওযীফা ও আশগালের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলির কোনটি অরিজিনাল ও কোনটি বানোয়াট তা জানার কোন উপায় নেই।
আনিসুল আরওয়াহ, রাহাতিল কুলুব ----- ইত্যাদি :
এ সকল মহান মাশাইখ রচিত বলে কিছু পুস্তক প্রচলিত। এগুলি উস্তাদ বা পীরের সাহচর্যের স্মৃতি ও আলোচনা হিসেবে রচিত। খাজা মুঈন উদ্দীন চিশতী তার উস্তাদ উসমান হারুনীর সাথে তার দীর্ঘ সাহচর্যের বিবরণ লিখেছেন আনিসুল আরওয়াহ নামক পুস্তকে। খাজা কুতুব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী
তার উস্তাদ মঈন উদ্দীন চিশ্তির সাথে তার সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন দলিলুল আরেফীন পুস্তকে। খাজা ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শক্কর তার উস্তাদ কুতুব উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন ফাওয়ায়েদুস সালেকীন পুস্তকে। খাজা নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তার উস্তাদ ফরীদ উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতিগুলি লিখেছেন রাহাতিল কুলুব পুস্তকে। প্রসিদ্ধ গায়ক আমীল খসরু তার উস্তাদ নিজাম উদ্দীনের সাহচর্যের স্মৃতি ও নির্দেশাবলী লিখেছেন রাহাতুল মুহিব্বীন পুস্তকে।
এ সকল পুস্তক পাঠ করলে প্রতীয়মান হয় যে, এগুলি পরবর্তী যুগের মানুষদের রচিত জাল পুস্তক। অথবা তারা কিছু লিখেছিলেন সেগুলির মধ্যে পরবর্তী যুগের জালিয়াতগণ ইচ্ছামত অনেক কিছু ঢুকিয়েছে। এই পুস্তকগুলিতে কুরআন-হাদীস ভিত্তিক অনেক ভাল কথা আছে। পাশাপাশি অগনিত জাল হাদীস ও মিথ্যা কথায় সেগুলি ভরা। এছাড়া ঐতিহাসিক তথাবলি উল্টাপাল্টা লেখা হয়েছে। এমন সব ভুল রয়েছে যা প্রথম দৃষ্টিতেই ধরা পড়ে।
প্রত্যেক বুযুর্গ তার মাজালিসগুলির তারিখ লিখেছেন। সন তারিখগুলি উল্টাপাল্টা লেখা। যাতে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, পরবর্তীকালে এদের নামে এগুলি জালিযাতি করা হয়েছে। শাওয়াল মাসের ৪ তারিখ বৃহস্পতিবার ও ৭ তারিখ রবিবার লিখা হয়েছে। অর্থাৎ শাওয়ালের শুরু সোমবারে। কিন্তু ১৫ ই জিলক্বদ সোমবার লিখা হয়েছে। অর্থাৎ জিলক্বাদের শুরুও সোমবারে ! শাওয়াল মাস ২৮ দিনে হলেই শুধু তা সম্ভব ! আবার পরের মজলিস হয়েছে ৫ ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার। জিলকাদের শুরু সোম, মঙ্গল বা বুধবার যেদিনই হোক, কোনভাবেই ৫ ই জিলহজ্জ বৃহস্পতিবার হয় না ! আবার পরের মজলিস ২০ শে জিলহজ্জ শনিবার ! ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে ২০ তারিখ শনিবার হয় কিভাবে ? ২০ শে রজব সোমবার এবং ২৭ শে রজব রবিবার লেখা হয়েছে। ৫ ই শাওয়াল শনিবার অথচ ২০ শে শাওয়াল বৃহস্পতিবার --------- এইরুপ অগণিত অসঙ্গতি যা প্রথম নজরেই ধরা পড়ে।
কাকী (র) উল্লেখ করেছেন যে, ৬১৩ হিজরীতে তিনি বাগদাদে মুইন উদ্দীন চিশ্তির নিকট মুরিদ হন। এরপর কয়েক মজলিস তিনি বাগদাদেই থাকেন। এরপর তিনি তার সহচরদের নিয়ে আজমীরে গমণ করেন। এভাবে আমরা নিশ্চিত জানতে পারছি যে, ৬১৩ হিজরী এর পরে মুইন উদ্দীন চিশতি ভারতে আগমন করেন। বখতিয়ার কাকী আরো উল্লেখ করেছেন যে, আজমীরে অবস্থান কালে আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতো। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমি পৃথ্বিরাজকে মুসলমানদের হাতে জীবিত বন্দি অবস্থায় অর্পন করলাম। এর কয়েক দিন পরেই সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরীর সৈন্যগণ পৃথ্বীরাজকে পরাজিত ও বন্দী করে।
অথচ ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেন যে, ৬১৩ হিজরীর প্রায় ২৫ বছর পূর্বে ৫৮৮ হিজরীতে তারাঈনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে আজমীর দখল করেন। আর ৬১৩ হিজরীতে খাজা মুঈন উদ্দীনের আজমীর আগমনের ১০ বছর পূর্বে ৬০৩ হিজরীতে শিহাবু্দ্দীন ঘোরী মৃত্যুবরণ করেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, এ সকল কাহিনী সবই বানোয়াট। অথবা মুইন উদ্দীন অনেক আগে ভারতে আসেন। এক্ষেত্রে আনিসুল আরওয়াহ, দলীলুল আরেফিন, ফওয়ায়েদুস সালেকীন ইত্যাদি পুস্তকে লেখা সন-তারিখ ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বানোয়াট।
এভাবে আমরা দেখছি যে, হাদীসের নামে জালিয়াতির ন্যায় বুযুর্গদের নামেও জলিয়াতি হয়েছে ব্যাপকভাবে। হাদীসের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্ট নিরীক্ষা পদ্ধতি রয়েছে, বুযুর্গদের ক্ষেত্রে তা না থাকাতে এদের নামে জালিয়াতি ধরার কোন পথ নেই ।জালিয়াতগণ বুযুর্গদের নামে জাল পুস্তক লিখে সিগুলির মধ্যে জাল হাদীস উল্লেখ করেছে এবং তাদের লেখা বইয়ের মধ্যে জাল হাদীস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এখন এসকল জাল হাদীসের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সাধারন মুসলিম বলবেন, অমুক বুযুর্গের পুস্তকে এই হাদীস রয়েছে, তা জাল হয় কিভাবে ? এভাবে জালিয়াতগণ এক ঢিলে দুই পখি মেরেছে !
ইমাম গাযযালী (রহঃ) হাদীস শাস্ত্রে
পণ্ডিত ছিলেন না ।
ইমাম গাযযালী (রহঃ) নিজেই তাঁর 'কানুনুত্তাবীল' পুস্তিকায় পৃষ্ঠা-১৬ লিখেছেন-
بِضَاعَتِي فِي عِلْمِ الْحَدِيثِ مُزْجَاةٌ
অর্থাৎ ইলমে হাদীসে আমার পুঁজি সামান্য।
দেওবন্দীদের হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/২০৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ইমাম গায্যালী (রহঃ) বিশেষ শাস্ত্রে অগাধজ্ঞানের অধিকারী ছিলেন হাদীস শাস্ত্রে নয়।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা রহ এবং ইবনুল কায়্যিম (রহঃ) এঁর উক্তিও অনুরূপ। (ইতহা-ফুস সা'দাতিল মুত্তাকীন: ১/২৮)
উলামায়ে কিরাম বলেছেন-ইমাম গায্যালীর বিভিন্ন গ্রন্থাবলী বিশেষ- করে 'ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন'-এ অনেক 'জালহাদীস' আছে। এ ব্যাপারে ইমাম যাহাবী হাফিয ইবনে হাজার আসকলানী, আল্লামা ইবনুল জাওযী, আল্লামা সুয়ূতী, ইমাম ইবনে তাইমিয়া প্রমুখ সতর্ক করেছেন।
(দ্রষ্টব্য: সিয়ারু আলামিন নুবালা: ১৯/৩৩৯-৩৪১, মাজমুউ ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া: ১০/৫৫২, ইতহা-ফুস সা'দাতিল মুত্তাক্বীন: ১/২৮, আত্তা'লিকাতুল হাফিলা: ১১৮-১২০)
মাওলানা আব্দুল মালিক দেওবন্দী হানাফী হাফি এর আদেশে লিখিত গ্রন্থ এসব হাদীস নয়: ১/৬১-৬২ বলেছেন,
স্মর্তব্য, যেহেতু ইহয়াউ উলুমিদ্দীন-এ সহীহ হাদীসের সাথে বাতিল, মাওযূ ও ভিত্তিহীন রিওয়ায়াত আছে। যার সংখ্যা একেবারে কম নয়। এজন্য মুহাদ্দিসীনে কিরাম ভিন্ন কিতাব রচনা করে সেগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছেন। যেমন-একটি কিতাব 'ইহইয়া' (আরবী) এর টীকায় ছাপানো আছে, যার নাম 'আলমুগ্ধনী আন হামলিল আসফার ফিল আসফার ফী তাখরীজি মা-ফিল ইহইয়া মিনাল আহাদীসি ওয়াল আখবার।'
ছিঃ ছিঃ এত্তা জঞ্জাল?
উত্তরমুছুন