ইমাম মাহদী ও গাযওয়ায় হিন্দ








তিন জিনিসের কোন ভিত্তি নেই – মাগাযি, মালাহিম ও তাফাসির
ইমাম আহমদ কেন এটা বলতেন?

ক্লাসিকাল তাফসিরের কিতাবগুলো ঘাঁটলে আশ্চর্যজনক ও অদ্ভুত সব ঘটনা খুঁজে পাবেন। সুলায়মান নবির জাদুর আংটি, হারুত মারুত ফেরেশতার গল্প, যুল কারনাইনের দুনিয়া ভ্রমণের বৃত্তান্ত কিংবা খিযির অথবা রানি বিলকিসের যেসব আখ্যান এই বইগুলোতে পাওয়া যায় তা রূপকথার গল্পের চেয়েও কম না। একই রকম আজগুবি বিবরণ পাওয়া যায়, শেষ যুগে কী কী ঘটবে সে সংক্রান্ত হাদীসগুলোতে। 

ইমাম আহমদ বলেছেন,

ثلاثة ليس لها أصل: التفسير والملاحم والمغازي

“তিনটি বিষয় এমন যার কোন ভিত্তি নেই – তাফসির, মাগাযি ও মালাহিম।”

তাফসির অর্থ তো আমরা বুঝি। মাগাযি অর্থ আক্ষরিকভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহ হলেও, পারিভাষিক অর্থে মাগাযি বলে মূলত রাসুলের জীবনী বোঝায় কারণ এই জীবনী গ্রন্থগুলোতে বেশিরভাগ বর্ণনাই হচ্ছে বিভিন্ন যুদ্ধ-বিগ্রহ কেন্দ্রিক। এছাড়াও রাসুলের জীবনীর শেষে বইগুলোতে খুলাফায়ে রাশেদার ইতিহাসও থাকে। তাই মাগাযি বলে আমরা ইতিহাসও বুঝতে পারি। বিখ্যাত ক্লাসিকাল সিরাতের গ্রন্থগুলোকে মাগাযির গ্রন্থ বলে অভিহিত করা হয়। মালাহিম শব্দ মালহামার বহুবচন। মালহামা অর্থও যুদ্ধ। তবে এটা এমন যুদ্ধ যা শেষ যামানায় ঘটবে এবং যার সাথে বহু ফিতনা, বড় বড় ঘটনা ও কেয়ামতের আলামত রিলেটেড বিষয় জড়িত থাকে। সহজ ভাষায় মালাহিম বললে আমরা শেষ যামানা কেন্দ্রিক আলোচনা বুঝতে পারি। ইমাম আহমদের বক্তব্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলেমরা আলোচনা করেছেন।

আল্লামা যারাকশি তার আল বুরহান গ্রন্থে লিখেছেন:

مراده أن الغالب أنه ليس لها أسانيد صحاح متصلة

“এই কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বিষয়গুলোর অধিকাংশই সহিহ ও মুত্তাসিল অর্থাৎ বিশুদ্ধ ও অবিচ্ছিন্ন সুত্রে বর্ণিত নয়।”

আল্লামা সুয়ুতী বলেন তার আল ইতকান গ্রন্থে:

الذي صح من ذلك قليل جدا، بل أصل المرفوع منه في غاية القلةِ

“বিশুদ্ধ সুত্রে এগুলো অতি অল্প সংখ্যকই বর্ণিত হয়েছে। মারফু অর্থাৎ সরাসরি রাসুল থেকে বর্ণিত বর্ণনা এখানে চূড়ান্ত পরিমানে নগণ্য।”

ইবন তায়মিয়্যাহ তার আর রদ্দু আলাল বাকরি পুস্তিকায় বলেন:

ومعنى ذلك أن الغالب عليها أنها مرسلة و منقطعة فإذا كان الشيء مشهورا عند أهل الفن قد تعددت طرقه فهذا مما يرجع إليه أهل العلم بخلاف غيره

“এর অর্থ হচ্ছে এগুলোর অধিকাংশ মুরসাল (অজ্ঞাত সুত্রে রাসুল থেকে বর্ণিত) ও মুনকাতি' (বর্ণনার ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন)। তবে কোন একটি বিষয় যদি নির্দিষ্ট শাস্ত্র বিশারদদের নিকট প্রসিদ্ধ হয় যা বহু সংখ্যক সুত্রে বর্ণিত আছে, আলেমরা সেগুলোকে রেফারেন্স হিসেবে গ্রহণ করেন।”

লিসানুল মিযানে ইবনে হাজার আসকালানি বলেন :

قلت : ينبغي أن يضاف إليها : الفضائل ، فهذه أودية الأحاديث الضعيفة والموضوعة ، إذ كانت العمدة في المغازي على مثل الواقدي ، وفي التفسير على مثل مقاتل والكلبي ، وفي الملاحم على الإسرائيليات . وأما الفضائل ، فلا يحصى كم وضع الرافضة في فضل أهل البيت ، وعارضهم جهلة أهل السنة بفضائل معاوية ؛ بل بفضائل الشيخين ، وقد أغناهما الله ، وأعلى مرتبتهما .

“আমি বলব: এই তিনটির সাথে চতুর্থ আরেকটি বিষয় যোগ করা উচিত – ফাযায়েল। এই চারটি বিষয় হচ্ছে দূর্বল ও বানোয়াট হাদিসের একেকটি উপত্যকা। কেনই বা হবে না যখন মাগাযির ক্ষেত্রে নির্ভর করা হয় ওয়াকেদির মত ব্যক্তির উপর, তাফসিরের ক্ষেত্রে মুকাতিল ও কালবির উপর, মালাহিমের ক্ষেত্রে ইসরাইলি বর্ণনায় উপর!? আর ফাযায়েল সম্পর্কে কথা হচ্ছে - রাফেযিরা আহলে বায়তের ফযিলত প্রমাণে কত সংখ্যক জাল হাদিস রচনা করেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। আর তাদের মোকাবেলায় আহলে সুন্নতের মূর্খ লোকেরাও মুয়াবিয়ার ফযিলতে হাদিস জাল করেছে। এমনকি শায়খাইন (আবু বকর ও উমর) এর ফযিলত সম্পর্কে তারা হাদিস জাল করেছে। অথচ শায়খাইনের জন্য এসবের কোন প্রয়োজন নেই, আল্লাহ তাদের অমুখাপেক্ষী বানিয়েছেন এবং তাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন।”



গা*জওয়া*তুল হি*ন্দ সম্পর্কিত হাদিসগুলো কতটুকু নির্ভরযোগ্য?

দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমদের মধ্যে গা*জওয়া*তুল হি*ন্দ সম্পর্কে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। তারা মনে করে গা*জওয়া*তুল হি*ন্দ দ্বীন-ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, রাসুল (স) এ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন এবং এটি ঘটবে। এর ফলে যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মুসলিমরা গা*জওয়া*তুল হি*ন্দের আলোচনা টেনে আনে। এ পর্যায়ে আমরা দেখার চেষ্টা করব হাদিসের মধ্যে গা*জওয়া*তুল হি*ন্দ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা কতটুকু সত্য।

গা*জওয়া*তুল হি*ন্দ সম্পর্কে ইমাম নাসাঈ তার ‘সুনানে’ এবং আহমদ ইবনে হাম্বল তার ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে দুটি হাদিস খুবই প্রসিদ্ধ এবং এই হাদিস দুটির বর্ণনাকারীদের ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি ন্যারেটিভ হয়েছে। 

প্রথম হাদিস: 

রাসুল (স) বলেছেন, আমার উম্মতের দুটি জামাআত আল্লাহ তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন। একটি জামাআত যারা হি*ন্দু্স্তা*নের বি*পক্ষে যু*দ্ধ করবে আর অপর জামাআত যারা ঈসা ইবনে মারইয়ামের সাথে থাকবে। 
এই হাদিসটি সামান্য পরিবর্তনের সাথে দুটি হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। নিচে দুটি গ্রন্থ থেকে বর্ণনাকারীদের চেইন উল্লেখ করা হলো।

১. মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল রহিম, আসাদ ইবনে মুসা, বাকিয়া, আবু বকর আল জুবাইদি, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, লুকমান ইবনে আমির, আব্দুল্লাহ ইবনে আদি আল বাহরানী, রাসুল (স)।(সুনানে নাসাঈ)

২.আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে হাম্বল, আহমদ ইবনে হাম্বল, আবু নাজার, বাকিয়াহ, আবদুল্লাহ ইবনে সালিম, আবু বকর ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, লুকমান ইবনে আমির আল ওয়াসাবি, আবদুল আলা ইবনে আদি আল বাহরানী, রাসুল (স)। (মুসনাদে আহমদ)

দ্বিতীয় হাদিস:

মহানবী (স) আমাদেরকে ‘আল হি*ন্দ’ যু*দ্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এইভাবে যদি এটি আমার জীবদ্দশায় ঘটে, তবে আমি আমার জীবন এবং এতে আমার সমস্ত জিনিসপত্র বিলিয়ে দেবো। যদি আমি এতে নি*হত হই তবে আমি (ইসলামের) শ্রেষ্ঠ শ*হীদ হব এবং যদি আমি (জীবিত) ফিরে যাই তবে আমি মুক্ত আবু হুরায়রাহ হয়ে যাব! (অর্থাৎ জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত)।

এই হাদিসটি সামান্য পরিবর্তনের সাথে দুটি হাদিস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। নিচে দুটি গ্রন্থ থেকে বর্ণনাকারীদের চেইন উল্লেখ হলো।

১. আহমাদ ইবনে উসমান ইবনে হাকিম, জাকারিয়া ইবনে আদি, উবাইদুল্লাহ ইবনে আমর, জায়েদ ইবনে আবি উনাইসাহ, জাবির ইবনে আবেদাহ, আবু হুরায়রা (রা)। (সুনানে নাসাঈ)

২.আহমাদ ইবনে উসমান ইবনে হাকিম, জাকারিয়া ইবনে আদি, হুশাইম, সাইয়ার, জাবির ইবনে আবেদা, আবু হুরায়রা (রা)। (সুনানে নাসাঈ)

৩.মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম, ইয়াজিদ, হুশাইম, সাইয়ার, জাবির ইবনে আবেদাহ, আবু হুরায়রা (রা)। (সুনানে নাসাঈ)

৪.আবদুল্লাহ ইবনে আহমদ ইবনে হাম্বল, আহমদ ইবনে হাম্বল, হুশাইম, ইয়াসার, জাবির ইবনে আবেদা, আবু হুরায়রা (রা)। (মুসনাদে আহমদ)

এবার আমরা হাদিস দুটির বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করে দেখব। উল্লেখ্য যে, ইসলাম সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে নিতে হবে। যেহেতু কুরআন এবং সুন্নাহর মধ্যে গা*জওয়া*তুল হি*ন্দ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি; সুতরাং আমরা হাদিস গবেষণার মূলনীতি অনুযায়ী উপরে উল্লেখিত হাদিস দুটি যাচাই করব। 

প্রথম হাদিসের বর্ণনাকারীগণ: 

প্রথম চেইন 

১.আসাদ ইবনে মুসা

আসাদ ইবনে মুসার পুরো নাম আসাদ ইবনে মুসা ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল ওয়ালিদ ইবনে আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ান ইবনে আল হাকাম। ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে আসাদ ইবনে মুসা সম্পর্কে কয়েকজন আলেমের (ইবনে ইউনুস, আবদুল হক) মতামত উল্লেখ করেছেন। ইবনে ইউনুস বলেন, আসাদ ইবনে মুসা বেশ কিছু মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করেছেন। ইবনে হাযমের মতে আসাদ ইবনে মুসা তার বর্ণনায় জঘন্য এবং দুর্বল বর্ণনাকারী। আবদুল হক বলেছেন, তিনি আসাদ ইবনে মুসার বর্ণনাকে যুক্তিযুক্ত এবং গ্রহণযোগ্য মনে করেন না।

২.বাকিয়াহ

আসাদ ইবনে মূসা এই হাদিসটি ‘বাকিয়াহ’ থেকে বর্ণনা করেছেন। বাকিয়াহর পুরো নাম বাকিয়াহ ইবনে আল-ওয়ালিদ ইবনে সাঈদ। ইমাম যাহাবী তার গ্রন্থ ’মীজানুল ইতেদাল’ এ লিখেছেন, একাধিক ব্যক্তি বলেছেন বাকিয়াহ তার বর্ণনাগুলি এমন লোকদের কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন যাদের থেকে তিনি এই বর্ণনাগুলি শোনেননি। আবু হাতিম বলেন, বাকিয়ার বর্ণনাগুলোকে যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। আবু ইসহাক আল জুজানি বলেছেন, আল্লাহ বাকিয়ার উপর রহম করুন, তিনি কার কাছ থেকে এই ধরনের বর্ণনা নিচ্ছেন তা যাচাই করার পরোয়া না করেই তিনি মূল্যহীন বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে খুজাইমাহ বলেছেন, আমি বাকিয়ার বর্ণনাগুলোকে যৌক্তিক হিসেবে  গ্রহণযোগ্য মনে করি না। আহমাদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত হয়েছে, আমি মনে করতাম যে বাকিয়াহ কেবল গ্রহণযোগ্য বর্ণনাগুলি অজানা লোকদের কাছে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তারপর আমি দেখতে পেলাম  তিনি (ভুলভাবে) অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাগুলিকে পরিচিত এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছে বর্ণনা করেছেন।
হাফিজ আল মিযযী তার ‘তাহযীবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থে ইয়াহিয়া ইবনে মুঈনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, বাকিয়াহ  উদ্ধৃত করার আগে দুর্বল এবং অগ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে একশত বর্ণনা বর্ণনা করতেন। 

৩. আবু বকর আল জুবাইদি 

তার পুরো নাম আবু বকর ইবনে আল ওয়ালিদ ইবনে আমির আল জুবাইদি। রাসুল (স)-এর বাণী বর্ণনা করেছেন এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহে তার সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। সামান্য যা পাওয়া গেছে তা নির্ভরযোগ নয়। ইবনে হাজার তার ‘তাকরীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেন, আবু বকর আল জুবাইদির জীবন ও চরিত্র জানা নেই।

হাফিজ আল মিযযী তার ‘তাহযীবুল-কামাল ফি আসমাইর-রিজাল; গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে লিখেছেন, শুধুমাত্র বাকিয়াহ আবু বকর আল জুবাইদির থেকে বর্ণনা করেছেন। আর এটি একজন বর্ণনাকারী অবিশ্বস্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। 

৪. মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি

ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে আল খলিলিকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদির বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে যদি সেগুলি একজন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী দ্বারা বর্ণিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ হাদিসের অন্যান্য বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হলে তার বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হবে; আর তা না হলে মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদির বর্ণিত বর্ণনা নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না।

৫. আব্দুল আলা ইবন আদি আল বাহরানী

আবদুল আলা ইবনে আদি আল বাহরানী সম্পর্কে মন্তব্যগুলি সাধারণত যথেষ্ট ইতিবাচক। কারণ তাকে একজন নির্ভরযোগ্য এবং সত্যবাদী ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ইবন আল কাত্তানের মতে, একজন বর্ণনাকারী হিসাবে তার অবস্থান সুপরিচিত নয়। এ কথাটি ইবনে হাজার তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। 
প্রথম হাদিসটির দ্বিতীয় চেইনের মধ্যে উপরে উল্লেখিত বর্ণনাকারীরা উপস্থিত রয়েছেন। যেমন বাকিয়াহ, আবু বকর ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি, মুহাম্মদ ইবনে আল ওয়ালিদ আল জুবাইদি। সুতরাং এই ন্যারেটিভও গ্রহণযোগ্য নয়। 

দ্বিতীয় হাদিস বর্ণনাকারীগণ: 

প্রথম চেইন:

১.যাকারিয়া ইবনে আদি 

জাকরিয়া ইবনে আদী সম্পর্কে হাদিস গবেষকগণ ইতিবাচক মতামত পোষণ করেছেন। তবে হাফিজ আল মিযযী তার ‘তাহযীবুল-কামাল ফি আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থে এবং হাফিজ ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, নুয়াইম বলেছেন, যাকারিয়া ইবনে আদি হাদিস শাস্ত্রের থেকে তাওরাত শাস্ত্রে অনেক বেশি পারদর্শী ছিলেন।

২. উবায়েদুল্লাহ ইবনে আমর

উবায়েদুল্লাহ ইবনে আমর সম্পর্কে মন্তব্যগুলি সাধারণত বেশ ইতিবাচক। তবে ইমাম যাহাবী তার ‘তাজকিরাতুল হুফ্ফাজ’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে মোহাম্মদ ইবনে সাদের মতামত উল্লেখ করেছেন। ইবনে সাদ বলেছেন, যদিও উবায়েদুল্লাহ ইবনে আমর যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য, তবুও মাঝে মাঝে তিনি ভুল করেছেন। আবু ওয়াহাব আল আসাদির মতামত উল্লেখ করে ইবনে হাজার তার ‘তাকরীবুত-তাহযীব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আমর কখনও কখনও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন।

৩. জাবির ইবনে আবিদাহ

জাবিরের নাম কিছু ক্ষেত্রে জাবর ইবনে আবীদাহ বর্ণিত হয়েছে।
ইমাম যাহাবি তার ‘মীজানুল-ইতেদাল’ গ্রন্থে লিখেছেন,  জাবির কে ছিলেন তা জানা যায়নি এবং হিন্দের (ভারত) যুদ্ধ সম্পর্কিত তার বর্ণনা  অগ্রাহনযোগ্য এবং মিথ্যা। হাফিজ মিযযী তার ‘তাহযীবুল কামাল ফি আসমাইর রিজাল’ গ্রন্থে লিখেছেন, হিন্দের যুদ্ধের বর্ণনাটি একমাত্র জাবিরের দ্বারা বর্ণিত।

দ্বিতীয় চেইন:

১. হুশাইম 

তার পুরো নাম হুশাইম ইবনে বুশাইর ইবনে আল কাসিম ইবনে দীনার আস সুলামি। হুশাইম সম্পর্কে ইবনে হাজার তার ‘তাহযীবুত তাহযীব’ গ্রন্থে যে সকল কথা বর্ণনা করেছেন তা নিচে তুলে ধরা হলো:

ইবনে সাদ বলেন, হুশাইম অনেক হাদিস বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি ভুলভাবে এমন লোকদের কাছে থেকে বর্ণনা করেছেন যাদের কাছ থেকে তিনি সেগুলো শুনেননি। আহমাদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, হুশাইম তার বর্ণনাগুলি এমন অনেক লোকের কাছে থেকে বর্ণনা করেছেন যাদের কাছ থেকে তিনি শোনেননি। হুশাইম সাইয়ারের কাছ থেকে হিন্দের যুদ্ধ সম্পর্কিত হাদিস বর্ণনা করেছে। আহমদ ইবনে হাম্বলের মতে হুশাইমের বর্ণনার কোনো মূল্য নেই। 

তৃতীয় এবং চতুর্থ চেইন:

তৃতীয় এবং চতুর্থ চেইনে হুশাইম ও সাইয়ার উপস্থিত রয়েছেন। এছাড়াও রয়েছেন জাবির ইবনে আবেদা। আর এ সকল বর্ণনাকারীদের অনির্ভরযোগ্য হওয়ার বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এছাড়াও চতুর্থ চেইনে সাইয়ার বানান ত্রুটির কারণে ইয়াসার হয়ে গিয়েছে। 

এ সকল আলোচনার মাধ্যমে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, উপরে উল্লেখিত দুটি হাদিসের বর্ণনাকারীদের ছয়টি চেইনের মধ্যে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর উপস্থিতি নেই। সুতরাং গা*জওয়া*তুল হিন্দের মতো একটি স্প*র্শকা*তর বিষয়ে আমরা এই অনির্ভরযোগ্য হাদিসের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। 

https://youtu.be/NjXJHNNsVfg?si=lN1JGA2E0XQvx0xk

https://youtu.be/IsnDx9lVdu0?si=KPYwVme-pI44fjDH

https://youtu.be/1N6lvsmmAcI?si=37rmXMQDJP_5cHUM






ইমাম মাহদীর উল্লেখ কি আকীদার অন্তর্ভুক্ত এবং তার উপ্রে ঈমান আনা কি ওয়াজিব? ❕

ইমাম আব্দুল কাদির বিন আহমাদ বিন মুহাম্মদ বাদরান আল-হাম্বলী আল-আছারী (রহ্.) বলেন:

যতদূর আমরা জানি, কোনো ইসলামি পণ্ডিত বা আলেম এমন কোনো দাবি করেননি যে, মাহদীর আগমনে বিশ্বাস করা ইসলামী আকীদার একটি অপরিহার্য অংশ। আমরা হাম্বলী মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যেও এমন কোনো দাবি পাইনি, এবং অন্যান্য মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যেও এমন কোনো দাবি শুনিনি।

কিছু লেখক এটাকে উপদেশমূলক গ্রন্থের তাকলীদ করে কিয়ামতের লক্ষণ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন।

আর তারা আকীদার গ্রন্থগুলি থেকে سمعیات অর্থাৎ অদেখা খবরের ধরনকে উপদেশমূলক বক্তৃতার মতো করে তুলে ধরেছে এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। আর এই কারণেই সাফারানি তার আকীদার বইতে এই ধরনের বিশ্বাসকে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। 

(العقود الياقوتية في جيد الأسئلة الكويتية ص٦٣)

ইমাম মাহদীর আগমনের হাদীস নিয়ে মতবিরোধ ❕

শায়খ আবদুল্লাহ বিন জায়েদ আল মাহমুদ আরবের একজন প্রখ্যাত নজদী সালাফী বিদ্বান। তিনি ১৯৯৭ সালে মারা যান। তিনি আলে শায়খ আব্দুল মালেক বিন ইব্রাহিম বিন আব্দুল লতিফ আশ শায়খ, আব্দুল আজিজ বিন মুহাম্মদ আশ শিথরী, মুহাম্মদ বিন ইব্রাহিম আলে শায়খের মতো কিবার নজদি সালাফী আলেমদের নিকটে অধ্যয়ন করেছেন। 

তিনি একটি কেতাব রচনা করেন:
"لا مهدي يُنتظر بعد الرسول محمد ﷺ خير البشر"
খায়রুল বাশার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পর কোনো মাহদী নেই যার অপেক্ষা করা হয়।

এই বইতে শায়খ এক জায়গায় লিখেন:

মাহদীর ধারণা মুতাকাদ্দিমীন আহলে সুন্নাতের আকীদার অংশ ছিল না। প্রথম যুগের সাহাবী এবং তাবেয়ীনদের মধ্যে তাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হয় নি। মূলত এই আকীদা শিয়াদের তৈরিকৃত যারা একজন গায়েবী ইমামের উপর বিশ্বাস রাখে। আহলে সুন্নাত এই আকীদা শিয়াদের সাথে মিশ্রিত হয়ে নিয়েছে। মাহদীর ধারণা মূলত আহলে সুন্নাতের মূল আকীদার অন্তর্ভুক্ত নয়। 

وأن فكرة المهدي ليست في أصلها من عقائد أهل السنة القدماء، فلم يقع لها ذكر بين الصحابة في القرن الأول، ولا بين التابعين، وأن أصل من تبنى هذه الفكرة والعقيدة هم الشيعة الذين من عقائدهم الإيمان بالإمام الغائب المنتظر، يملأ الأرض عدلاً كما ملئت جورًا، وهو الإمام الثاني عشر: محمد بن الحسن العسكري، فسرت هذه الفكرة وهذا الاعتقاد، بطريق المجالسة والمؤانسة والاختلاط إلى أهل السنة، فدخلت في معتقدهم، وهي ليست من أصل عقيدتهم.

আরও স্পষ্ট করে বলেন:

এই মর্মে সমস্ত বর্ণনা দুর্বল এবং অনুমান করা হয় যে, এগুলো রাসূল সাঃ এর নামে বর্ণনা করা হয়েছে অথচ তিনি (সা.) তা বলেন নি। 

وكل الأحاديث الواردة فيه ضعيفة ويترجح أنها موضوعة على لسان رسول الله ولم يحدث بها

এই মর্মে সকল হাদীসের উপরে কালাম করে শায়খ নিম্নোক্ত রিছালাহ লিখেছেন:
التحقيق المعتبر عن أحاديث المهدي المنتظر۔

❕শায়খ আহমাদ রজব বলেন:

ইমাম মাহদী মর্মে সমস্ত হাদীস আমার তাহক্বীকে দুর্বল এবং এটাই আমাদের শায়খ মুস্তাফা আল আদাউই'র অভিমত। 

أحاديث المهدي -في تحقيقي- كلها ضعاف لا يثبت منها شيء، وهو قول شيخنا العدوي.

যে ব্যক্তি ঈসা (আ.)-এর অবতরণ এবং ইমাম মাহদীর আবির্ভাবকে অস্বীকার করে সে কাফের নয়। ❕

শায়খ সালেহ আলুশ শাইখকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ফেরেশতা, জীন, দাজ্জাল ও মাহদীর আবির্ভাব অস্বীকারকারী কি কাফির?

তিনি উত্তরে বলেন: ফেরেশতা ও জীনদের প্রতি ঈমান আনা ঈমানের রুকন থেকে, যে ব্যক্তি এ দুটিকে অস্বীকার করে সে কাফির, তবে মাহদীর আবির্ভাব এ দুটির বরাবর নয়, যে ব্যক্তি মাহদীর আবির্ভাব অস্বীকার করে সে কাফির নয়। যে পণ্ডিতরা এটি অস্বীকার করেছেন তারা ভুল করেছেন।

http://shamela.ws/browse.php/book-934/page-323#page-323

শায়খ আলবানীকে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে ঈসা (আ.)- এর অবতরণ এবং মাহদীর আবির্ভাব অস্বীকার করে,

তিনি উত্তরে বলেন, এ বিষয়গুলো কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত কিন্তু যে ব্যক্তি এসবকে অস্বীকার করবে সে কাফের হয়ে যাবে এমন কোনো নস নেই।

http://shamela.ws/browse.php/book-36190/page-4057

ইমাম মাহদীটা কে আসলে? ❕

সালাফদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ ছিল। আবদুল্লাহ বিন মাসউদের সাথীরা এবং ইবনে সিরীন বলেছেন, ইমাম মাহদী আলাদা কোনো ব্যক্তিত্ব নন। তিনি হলেন ঈসা ইবনে মরিয়ম। 

ইব্রাহীম নাখেয়ী বলেন:

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের সাথীরা বলতেন: মাহদী হলেন ঈসা ইবনে মরিয়ম। 

حَدَّثَنَا عَبْدُ الْوَاحِدِ بْنُ زِيَادٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا الْأَعْمَشُ، عَنْ [ص: 1076] إِبْرَاهِيمَ، قَالَ: " كَانَ أَصْحَابُ عَبْدِ اللَّهِ يَقُولُونَ: الْمَهْدِيُّ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ "

السنن الواردة في الفتن للداني

হাদিস: “মাহদির আগমন।”

প্রশ্ন: আসসালামু আলাইকুম ড. শাইখ খালিদ আল-হায়েক হাফিজাকা লিল্লাহ। সম্প্রতি আমাদের ভাইদের মধ্যে একটি বিতর্ক উত্থিত হয়েছে যে, প্রথমত: মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-মাহদির আগমনের ব্যাপারে হুকুম কি? দ্বিতীয়ত: এমন ব্যক্তির হুকুম কি যে তার আগমন অস্বীকার করে এবং এই সম্পর্কিত হাদিসগুলোকে অস্বীকার করে বা সেগুলোর শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে? তৃতীয়ত: আহলুস সুন্নাহ ও সালাফগণের মাহদির আগমনের ব্যাপারে শরয়ী অবস্থান কি? এটি বিশ্বাস করা বা অস্বীকার করা কি একজন মুসলিমের জন্য অপরিহার্য? আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন ও আপনার মাধ্যমে উম্মাহকে উপকৃত করুন।

উত্তর: ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লহি ওয়াবারকাতুহ।

প্রথমত: মাহদি সম্পর্কিত সকল হাদিসে দুর্বলতা রয়েছে। কিছু মুতা’আখখিরিন উলামাগণ শাহেদ ও মুতাবা’আতের ভিত্তিতে এগুলোকে সহিহ বলেছেন। অনেকে এই ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছেন এমনকি কেও কেও একে মুতাওয়াতিরও বলেছেন। 

এবং এর ভিত্তিতে, দ্বিতীয়ত: (বলা হয় যে) যে এটিকে অস্বীকার করেছে সে কুফরে লিপ্ত হয়েছে। কারণ যে ব্যক্তি কোনো রকম ব্যাখ্যা ব্যতিত মুতাওয়াতির হাদিসকে অস্বীকার করে সে কাফির। তবে অনেকে এর অস্বীকারকারীকে কাফের মনে করেন না তবে তারাও তার আক্বীদার ব্যাপারে ভয় করেন।

তৃতীয়ত: এই বিষয়টি মুতাওয়াতিরকে অস্বীকার করার বিষয়ের মধ্যে পড়েনা কারণ প্রকৃতপক্ষে এই ব্যাপারে হাদিস মওজুদ থাকা সত্ত্বেও তা মুতাওয়াতির নয়। আর এই মুতাওয়াতির বিষয়টি মুতাক্বাদ্দিমিন আহলুল হাদিসদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিলোনা। এটি আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে উসূলবিদদের মাধ্যমে যারা উলুমুল হাদিসকে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন যাদের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন হাফেজ ইবনুস সালাহ। 

মাহদির উপর বিশ্বাস হচ্ছে এক ধরণের রক্ষাকর্তার উপর বিশ্বাস যার উপর মানুষ তাদের উদ্ধারের জন্য অপেক্ষা করে আছে। এই বিশ্বাস বহু তথাকথিত ধর্মেও বিদ্যমান এমনকি অনেক মানবসৃষ্ট ও জাগতিক ধর্মেও। এই দ্বীন হচ্ছে মহান এবং এটি কোনো রক্ষাকর্তার জন্য অপেক্ষা করেনা। এই জাতিকে এ ধরণের হাদিসের সাথে নিজেকে সম্বন্ধ না করে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যেতে হবে যেসব হাদিস বুখারি, মুসলিম তাদের সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করেনি এবং আক্বিদার এইরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তাদের উপেক্ষা করা এর অশুদ্ধতার দিকেই ইঙ্গিত করে। তারা যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে যে, ঈসার সাথে যিনি সালাত আদায় করাবেন তিনিই মাহদি, এটি সঠিক নয়, বরং ঈসাই লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করবেন। এই হাদিসটির শব্দে কিছুটা ইখতিলাফ রয়েছে। আল্লাহই ভালো জানেন।

————-————-————-————-

Source: الأجوبة الحايكية علو الأسئلة الحديثية، ص: ٢٢-٢٣


ইতিহাসে শত শত ‘ইমাম মাহদী’-র সন্ধান পাওয়া যায় যাদের মাধ্যমে হাজার হাজার মুসলিম বিভ্রান্ত হয়েছেন, হত্যাকারী বা নিহত হয়েছেন এবং অনেকে ঈমানহারা হয়েছেন। মাহদী দাবিদার ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে অনেক ভ- ও প্রতারক থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক আলিম, আবিদ ও নেককার মানুষও ছিলেন। তাদের বিভ্রান্তির পিছনে তিনটি মৌলিক কারণ কার্যকর বলে আমরা দেখি:

(১) সমাজ পরিবর্তনের অন্ধ আবেগ। সকল সমাজেই পাপ ও জুলুম বিদ্যমান। পাপাচারী, জালিম ও ধর্মহীনদের সংখ্যা সবসময়ই ধার্মিকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি। আবেগী ধার্মিক মানুষ, বিশেষত যুবক, এ সকল অন্যায় দূর করে ‘আদর্শ’ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। স্বাভাবিকভাবে ইলম প্রসার ও দাওয়াতের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন ‘কষ্টকর’, ‘দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ’ ও ‘অসম্ভব’ বলে মনে হয়। এজন্য ‘জিহাদ’ বা ‘ইমাম মাহদী’ বিষয়টি খুবই আকর্ষণীয় বলে গণ্য করেন অধিকাংশ আবেগী ধার্মিক মানুষ। ফলে এ জাতীয় কোনো কথা শুনলে বাছবিচার না করেই শরীক হয়ে যান তারা।

অষ্টম-নবম শতকের সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানী ইবন খালদূন আব্দুর রাহমান ইবন মুহাম্মাদ (৭৩২-৮০৮ হি) মাহদীর প্রত্যাশায় শীয়া ও সূফীগণের বিভিন্ন মত আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, মাহদীর ধারণার সাথে মুজাদ্দিদের ধারণা মিশ্রিত হয়ে গিয়েছে। সকলেই অপেক্ষা করেন, এই তো মুজাদ্দিদ বা মাহদী এসে ধর্ম, দেশ, জাতি ও সমাজকে ভাল করে ফেলবেন।

ইবন খালদূন, তারীখ ১/৩২৭। এগুলো সবই পলায়নী মনোবৃত্তির প্রকাশ। ফলাফলের চিন্তা না করে দীন পালন ও প্রচারের দায়িত্ব সাধ্যমত আঞ্জাম দেওয়াই মুমিনের কাজ। দুনিয়ায় ফলাফল যা-ই হোক না কেন এরূপ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে মুমিন আখিরাতের অফুরন্ত নিয়ামত ও মর্যাদা লাভ করেন। মাহদী বা মুজাদ্দিদ অনুসন্ধান বা অনুসরণের নামে মুমিন মূলত নিজের এ দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়ান।

(২) স্বপ্ন-কাশফের উপর নির্ভর করা। মাহদী দাবিদার অধিকাংশ ব্যক্তি ও তার অনুসারীগণ আল্লাহর কসম করে দাবি করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ৎ) উক্ত ব্যক্তিকে মাহদী বলে স্বপ্নে বা কাশফ-ইলহামের মাধ্যমে তাদেরকে জানিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহ (ৎ)-কে স্বপ্নে দেখার কথা শুনলেই মুমিন দুর্বল হয়ে পড়েন। অথচ রাসূলুল্লাহ (ৎ) বলেছেন যে, শয়তান তাঁর আকৃতি গ্রহণ করতে পারে না; তাঁর নাম ধরে জালিয়াতি করতে পারে না- তা তিনি বলেন নি। স্বপ্নে যদি তাঁকে হুবহু দুনিয়ার আকৃতিতে দেখা যায় তবেই তাঁকে দেখা বলে গণ্য হবে। তারপরও স্বপ্নের বক্তব্য অনুধাবন ও ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। এছাড়া স্বপ্নে বা জাগ্রত অবস্থায় শয়তান নিজেকে রাসূলুল্লাহ (ৎ) দাবি করে মিথ্যা বলতে পারে। বস্তুত, মুসলিমদের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ স্বপ্ন, ইলহাম ইত্যাদিকে দীনের দলীল হিসেবে গণ্য করা।

বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আমরা বিশ্বাস করি যে, শেষ যুগে একজন ন্যায়পরায়ণ সুপথপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান মুসলিম বিশ্ব শাসন করবেন। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে ইমাম মাহদী বলে দাবি করার প্রমাণ কী? যদি কারো নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইতুল্লাহর পাশে বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি সব মিলে যায় তারপরও তাকে ‘মাহদী’ বলে বিশ্বাস করার কোনোরূপ দলীল নেই। কারণ মাহদীর মধ্যে এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকবে, কিন্তু এ সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেই তিনি মাহদী নন।

কোনো হাদীসে কোনোভাবে বলা হয় নি যে, মহান আল্লাহ কাউকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ হিসেবে গ্রহণ করলে তাকে বিষয়টি জানিয়ে দিবেন। কাজেই যিনি নিজেকে মাহদী বা মুজাদ্দিদ বলে দাবি করেন তিনি নিঃসন্দেহে মিথ্যাচারী প্রতারক বা প্রতারিত। তিনি কিভাবে জানলেন যে, তিনি মাহদী বা মুজাদ্দিদ? একমাত্র ওহীর মাধ্যমেই কারো বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানা যায়। নবীগণ ওহীর মাধ্যমে তাঁদের নুবুওয়াতের কথা জেনেছেন। এ সকল দাবিদার কিভাবে তাদের বিষয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানলেন?

সাধারণত তারা ওহীর দাবি করেন না; কারণ তাতে মুসলিম সমাজে তারা ভ- নবী বলে গণ্য হবেন। এজন্য তারা স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে তা জানার দাবি করেন। সরলপ্রাণ মুসলিমগণ এতে প্রতারিত হন। অথচ স্বপ্ন বা কাশফের মাধ্যমে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার দাবি করা আর ওহীর লাভের দাবি একই। কারণ যে ব্যক্তি তার স্বপ্ন বা কাশফের বিষয়কে নিজের বা অন্যের বিশ্বাসের বিষয় বানিয়ে নিয়েছেন তিনি নিঃসন্দেহে তার স্বপ্ন বা কাশফকে নবীদের স্বপ্নের মত ওহীর সম-পর্যায়ের বলে দাবি করেছেন। অনুরূপভাবে কারো মাহদী বা মুজাদ্দিদ হওয়ার স্বপ্ন-কাশফ নির্ভর দাবি বিশ্বাস করার অর্থ মুহাম্মাদ (ৎ)-এর পরে কাউকে ওহীপ্রাপ্ত বলে বিশ্বাস করা।

মাহদী ও অন্য সকল বিষয়ে মুমিন শুধু কুরআন ও হাদীসের কথায় বিশ্বাস করেন। মাহদী ও কিয়ামতের আলামত বিষয়ক হাদীসগুলো বর্ণনামূলক। ভূমিধ্বস হবে, পাহাড় স্থানচ্যুত হবে… অন্যান্য বিষয়ের মত মাহদীর রাজত্বও আসবে। কিয়ামতের কোনো আলামত ঘটিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব মুমিনের নয়। অন্যান্য আলামতের মত এ ক্ষেত্রেও ঘটে যাওয়ার পরে মুমিন বলবেন যে, আলামতটি প্রকাশ পেয়েছে। যখন কোনো শাসকের বিষয়ে হাদীসে নির্দেশিত সকল আলামত প্রকাশিত হবে এবং মুসলিমগণ তাকে মাহদী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মেনে নিবেন তখনই মুমিন তাকে মেনে নিবেন।

মুমিনের হয়ত মনে হতে পারে যে, মাহদীকে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব। চিন্তাটি ভিত্তিহীন। যদি কেউ নিজেকে মাহদী বলে দাবি করেন তবে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে যে তিনি মিথ্যাবাদী। আর যদি দাবি-দাওয়া ছাড়াই কারো মধ্যে মাহদীর অনেকগুলো আলামত প্রকাশ পায় তবে তার থেকে সতর্কতার সাথে দূরে থাকতে হবে, অবশিষ্ট আলামতগুলো প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত। কারণ তিনি যদি সত্যিকার মাহদী হন তবে আল্লাহই ভূমিধ্বস ও অন্যান্য অলৌকিক সাহায্যের মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় পৌঁছে দেবেন। সকল আলামত প্রকাশ পাওয়ার পরে অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয় ও সকল দেশের মুসলিমগণ তাকে মেনে নেওয়ার পরেই শুধু মুমিনের দায়িত্ব তার বাইয়াত করা।

(৩) ব্যাখ্যার নামে ওহীর সরল অর্থ পরিত্যাগ। আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মাহদী বিষয়েও ওহীর অপব্যাখ্যা বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ। উপরে আলোচিত মাহদীগণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, নাম, পিতার নাম, বংশ, আকৃতি, বাইয়াতের স্থান, রাজত্বলাভ, জুলুম দূর করে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আলামতগুলোর অধিকাংশ বা কোনোটিই পাওয়া যায় না। তারপরও হাজার হাজার মুসলিম তাদের দাবি নির্বিচারে বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছেন ও হচ্ছেন। হাদীসের স্পষ্ট বক্তব্যগুলো তারা নানান ব্যাখ্যা করে বাতিল করছেন। কারো বিষয়ে একবার সুধারণা প্রতিষ্ঠিত হলে তার সকল দাবিই ভক্তরা নানা অজুহাতে মেনে নেয়। এজন্য প্রতারকগণ প্রথমে ইবাদত-বন্দেগি, দরবেশি, নির্লোভতা, কাশফ-কারামত ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। এরপর নিজেদের দাবি-দাওয়া পেশ করে। ফলে তাদের ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তিও ভক্তগণ নির্বিচারে বিশ্বাস করেন। ঈমানী দুর্বলতার কারণেই প্রতারকগণ সফল হয়। আমরা দেখেছি, ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য দাবি যে, আমরা তাঁর কথা ছাড়া আর কারো কথাই নির্বিচারে গ্রহণ করব না। প্রত্যেকের প্রতিটি কথা সুন্নাত দিয়ে যাচাই করব। আর এটিই মুমিনের রক্ষাকবজ।

আল-মাহদী শব্দের অভিধানিক অর্থ হলো হিদায়াতপ্রাপ্ত। অব্শ্য কুরআনে আল-মাহদী শব্দের ব্যাবহার নেই। আল-মুহতাদী হচ্ছে কুরআনের ব্যাবহৃত এ জাতীয় শব্দ। তবে কোন কোন হাদীসে আলীর (রা.) প্রশংসায় আল-মাহদী শব্দ ব্যাবহৃত হয়েছে। যেমন - আলীকে যদি তোমরা তোমাদের আমীর মনোনীত করতে অবশ্য এরুপ করবে বলে মনে করিনা - তাহলে তোমরা তাকে হিদায়াত দানকারী এবং হিদায়াতপ্রাপ্ত ইমাম রুপেই পেতে। তোমাদেরকে তিনি সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে নিয়ে যেতেন।

হুসাইন বিন আলী (রা.) কেও মাহদী বিন মাহদী উপাধি দান করা হয়েছে। উমাইয়া খলীফাদের দুএকজনও কবিদের হাতে মাহদী উপাধী পেয়েছেন। তবে এসব ক্ষেত্রে মাহদী শব্দটি অাভিধানিক অর্থই শুধু বহন করত। অর্থাৎ অল্লাহ তাকে হিদায়েত দান করেছেন। ফলে তিনি হিদায়েত প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এক পর্যায়ে দেখতে পাই শব্দটি নতুন একটি পারিভাষিক অর্থ গ্রহণ করেছে। যার সারমর্ম হলো প্রতীক্ষিত একজন ইমাম, যিনি পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়ে পাপাচার অনাচারের স্থানে ন্যায় ও ইনসাফের রাজত্ব কায়েম করবেন। এই অর্থবোধক শব্দটির প্রথম প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই আলীর (রা.) আযাদকৃত গোলাম কায়সান কর্তৃক মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়া এর ক্ষেত্রে। কায়সানের আকীদা ছিল যে, মুহাম্মদ ইমামত গ্রহণ করে মাদীনা থেকে সাত মঞ্জিল দুরের রাযওয়া পর্বতে অন্তর্হিত হেয়ছেন। কায়সানী কবি কুসসায়র ইযযত ও মুখতার বিন আবী উবায়দা সাকাফী অনুরুপ ধারনা প্রচার করতেন। তাদের দাবী মুহাম্মদই হচ্ছেন প্রতীক্ষিত আল-মাহদী।

মুসলমানদের মধ্যে বিশেষত: শীয়া সমপ্রদায়ের মধ্যে মাহদী সম্পর্কিত বিশ্বাস ব্যাপক আকার ধারণ করে। ফলে মাহদী সংক্রান্ত অনেক হাদীসও তৈরী হয়ে যায়। ইমাম বুখারী ও মুসলিম মাহদী সম্পর্কিত কোন হদীস গ্রহণ করেননি। তাতে মনে হয় তাদের দৃষ্টিতে হাদীসগুলো বিশুদ্ধ ও মানোত্তীর্ণ ছিল না। তিরমিযী, আবু দাুদ ও ইবনে মাজা অবশ্য মাহদী সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। এ ধরনের হাদীসগুলোর মূল বক্তব্য হচ্ছে শেষ যুগে আহলে বায়তভুক্ত এমন এক মহা পুরুষের আবির্ভাব অবশ্যই ঘটবে যিনি দ্বীনের পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন। ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করবেন, আর মুসলমানরা তাকে অনুসরণ করবে। তখন গোটা ইসলামী জাহান তার অধিকারে চলে আসবে। মাহদী হবে তার উপাধি। খোদ মুহাদ্দীসগণই প্রচুর শ্রম স্বীকার করে আলোচ্য হাদীসগুলোর সনদের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষন করেছেন এবং বর্ণিত রিজালদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সর্ব সমক্ষ্যে তুলে ধরেছেন।

মোটকথা উমাইয়া সালতানাতের পরিবেশে প্রতীক্ষিত মাহদী ধারণা ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এবং উক্ত আকীদার প্রবক্তাদের অধিকাংশই ছিল শীয়া। সে সময় উমাইয়া পরিবারেও একজন মাহদীর অভ্যুদয় ঘটেছিল। তবে তার নাম আল-মাহদী ছিলনা, বরং ছিল আসসুফইয়ানী। বিভিন্ন মহলে বিশেষত উমাইয়অ পরিমন্ডলে সুফইয়ানী সমাচার বেশ প্রচার লাভ করেছিল। প্রতীক্ষিত সুফইয়ানী ছিলেন প্রতিক্ষিত মাহদীরই অনুরুপ। 




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

৭১ এর যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস