নির্দিষ্ট এক মাযহাব এর তাকলীদ এর বিপক্ষের কতিপয় দলীল- ২য় পর্ব
ভূমিকা
: সাহায্যপ্রাপ্ত দল, নাজাতপ্রাপ্ত ফিরক্বা এবং হক্বের অনুসারীদের
বৈশিষ্ট্যগত নাম ‘আহলেহাদীছ’। এরা ঐ সমস্ত মহান ব্যক্তি, যারা সর্বযুগে
ছিলেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَزَالُ
طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى مَنْصُورِينَ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ
حَتَّى تَقُوْمَ السَّاعَةُ ‘আমার উম্মতের মধ্যে ক্বিয়ামত পর্যন্ত একটি দল
(আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হ’তে) সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হ’তে থাকবে।
পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না’।[1]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث، فلا أدري من هم ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[2]
ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, ‘ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) এই হাদীছের ব্যাখ্যায় অত্যন্ত চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সাহায্যপ্রাপ্ত দলটি হচ্ছে আছহাবে হাদীছের দল। আহলেহাদীছের চাইতে কারা এ হাদীছের আওতাভুক্ত হওয়ার অধিক হক্বদার হ’তে পারেন? যারা (আহলেহাদীছগণ) সৎ মানুষদের পথে চলেন, সালাফে ছালেহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের দ্বারা বিরুদ্ধবাদীদের এবং বিদ‘আতীদের সামনে বুক ফুলিয়ে জবাব প্রদানের মাধ্যমে তাদের যবান বন্ধ করে দেন। যারা আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার জীবনকে ত্যাগ করে বিশুষ্ক মরুভূমি এবং তৃণ-লতা ও পত্রহীন এলাকায় (হাদীছ সংগ্রহের জন্য) সফর করাকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তারা আহলে ইলম এবং আহলে আখবারের সংস্পর্শে আসার জন্য ভ্রমণের কঠিন পরিস্থিতিকেও শোভনীয় মনে করেন।[3]
ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর উস্তাদ ইমাম আলী ইবনুল মাদিনী (রহঃ) বলেছেন, هم أصحاب الحديث ‘তারা হচ্ছে আছহাবুল হাদীছ’। অর্থাৎ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’ দ্বারা আহলেহাদীছগণ উদ্দেশ্য।[4]
হাদীছ জগতের সম্রাট ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ সম্পর্কে বলেন, هم أهل الحديث ‘তারা হ’লেন আহলেহাদীছ’।[5]
ইমাম ইবনে হিববান উপরোক্ত হাদীছের উপর এই মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন যে,ذِكْرُ إِثْبَاتِ النُّصْرَةِ لِأَصْحَابِ الْحَدِيثِ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ ‘ক্বিয়ামত অবধি আল্লাহ কর্তৃক আহলেহাদীছদের সাহায্যপ্রাপ্তি প্রমাণিত হওয়ার বিবরণ’।[6]
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন মুফলিহ আল-মাক্বদেসী বলেন, أَهْلُ الْحَدِيثِ هُمْ الطَّائِفَةُ النَّاجِيَةُ الْقَائِمُونَ عَلَى الْحَقِّ ‘আহলেহাদীছরাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যারা হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন’।[7]
ইমাম হাফছ বিন গিয়াছ এবং ইমাম আবুবকর বিন আইয়াশ (রহঃ)-এর বক্তব্যকে সমর্থন ও সত্যায়ন করতঃ ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, তারা দু’জন সত্যই বলেছেন যে, আহলেহাদীছগণ সৎ মানুষ। আর এমনটা কেনইবা হবেন না, তারা তো (কুরআন ও হাদীছের (মুকাবিলায়) দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে তাদের পশ্চাতে নিক্ষেপ করেছেন।[8]
প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَوْلَى النَّاسِ بِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَىَّ صَلاَةً ‘ক্বিয়ামতের দিন ঐ সমস্ত ব্যক্তি আমার সর্বাধিক নিকটবর্তী হবে, যারা সবচেয়ে বেশী আমার উপরে দরূদ পাঠ করে’।[9] এজন্যই আহলেহাদীছ পরিবারের ছোট ছোট বালক-বালিকাদের অন্তরে হাদীছের প্রতি গভীর অনুরাগ ও আকর্ষণ বিরাজিত। আর আহলেহাদীছগণ ক্বিয়াসী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ফিক্বহী মাসআলার খুঁটিনাটি বিষয়ের পরিবর্তে কেবলমাত্র নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছ বর্ণনাকেই পরকালে সৌভাগ্যবান হওয়ার মাধ্যম মনে করেন। তাই ইমাম আবূ হাতেম ইবনে হিববান আল-বাসতী (রহঃ) উপরোক্ত হাদীছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামত দিবসে আহলেহাদীছগণের রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বাধিক নিকটে থাকার দলীল উক্ত হাদীছে বিদ্যমান। কেননা এই উম্মতের মধ্যে আহলেহাদীছদের চাইতে কোন দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর বেশী দরূদ পাঠ করে না।[10]
এত ফযীলত ও মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্তেবও কতিপয় ব্যক্তি আহলেহাদীছদের বিরোধিতা করা, তাদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, উপহাস-পরিহাস এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাকে নিজেদের পৈত্রিক অধিকার মনে করে। সম্ভবত এই সকল আহলেহাদীছ বিরোধীদের উদ্দেশ্য করেই ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (রহঃ) মন্তব্য করেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[11]
ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, ‘আমি সর্বত্র যত বিদ‘আতী এবং নাস্তিকমনা মানুষ পেয়েছি, তারা সকলেই ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ তথা আহলেহাদীছদেরকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখত এবং আহলেহাদীছদেরকে নিকৃষ্টভাবে সম্বোধন করত (যেমন হাশাবিয়া)।[12]
অথচ আমরা তাদেরকে বুঝাতে চাই যে, أهل الحديث همُو أهل النبي وإن لم يصحبوا نفسه أنفاسه صحبوا ‘আহলেহাদীছগণই মূলত আহলে নবী বা নবী (ছাঃ)-এর পরিবার। যদিও তারা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর সাহচর্য লাভ করেননি। তথাপি তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সুগন্ধীযুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে নির্গত অমর বাণী দ্বারা উপকৃত হয়েই আসছেন’।
আলোচ্য গ্রন্থটি শায়খ হাফেয যুবায়ের আলী যাঈ রচিত একটি চমৎকার গ্রন্থ। এতে বৈশিষ্ট্যগত নাম ‘আহলেহাদীছ’-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত যাবতীয় প্রশ্ন, আপত্তি ও সমালোচনার জবাব প্রদান করা হয়েছে। দলীল-প্রমাণাদি উপস্থাপনের দৃষ্টিকোণ হ’তে এটি একটি সারগর্ভ ও অনন্য পুস্তক।*
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম এবং এর পরিচিতি :
মুসলমানদের অনেক গুণবাচক নাম রয়েছে। যেমন মুমিন, ইবাদুল্লাহ (আল্লাহ্র বান্দা), হিযবুল্লাহ (আল্লাহ্র দল)। তদ্রূপ ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, মুহাজির, আনছার ইত্যাদি নামসমূহ। ঠিক তেমনিভাবে ঐসকল গুণবাচক নাম সমূহের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ’ ও ‘আহলে সুন্নাত’ উপাধিদ্বয় ‘খায়রুল কুরূন’ বা সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ হ’তে সাব্যস্ত রয়েছে। মুসলমানদের মাঝে উভয় গুণবাচক উপাধির ব্যবহার নির্দ্বিধায় প্রচলিত আছে। বরং এর বৈধতার পক্ষে মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা রয়েছে।
‘আহলেহাদীছ’ এবং ‘আহলে সুন্নাত’ দু’টি সমার্থবোধক গুণবাচক নাম। যার দ্বারা ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুসলমানদের অর্থাৎ সাহায্য ও নাজাতপ্রাপ্ত দলের পরিচয় পাওয়া যায়।
‘আহলেহাদীছ’ এই গুণবাচক নাম এবং প্রিয় উপাধি দ্বারা দুই শ্রেণীর ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমান উদ্দেশ্য।
ক. সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ।
খ. তাদের অনুসারী আম জনতা, যারা হাদীছের উপরে আমল করে থাকে।
প্রথম প্রকার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) মুহাদ্দিছগণকে ‘আহলেহাদীছ’ বলে অভিহিত করেছেন।[13]
ইমাম ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান একজন রাবী প্রসঙ্গে বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছ ছিলেন না।[14]
প্রমাণিত হ’ল যে, শুধুমাত্র হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকেই আহলেহাদীছ বলা হ’ত না। বরং ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন হাদীছ বর্ণনাকারী তথা মুহাদ্দিছগণকেও আহলেহাদীছ বলা হ’ত।
এক জায়গায় হাফেয ইবনে হিববান আহলেহাদীছদের ৩টি আলামত বর্ণনা করেছেন :
ক. তারা হাদীছের উপর আমল করেন।
খ. তারা সুন্নাত তথা হাদীছের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকেন।
গ. তারা সুন্নাত বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন।[15]
আহলেহাদীছদের প্রসিদ্ধ দুশমন এবং যাকে তাকে কাফের আখ্যা দানকারী খারেজী জামা‘আত ‘জামাআতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাসঊদ আহমাদ বিএসসি পরিষ্কারভাবে লিখেছেন, আমরাও মুহাদ্দিছগণকে আহলেহাদীছ বলে থাকি।[16]
বর্তমানে জীবিত দেওবন্দী আলেমদের ‘ইমাম’ খ্যাত সরফরায খান ছফদর গাখড়ুভী লিখেছেন, আহলেহাদীছ বলতে ঐ সমস্ত ব্যক্তি উদ্দেশ্য, যারা হাদীছ সংরক্ষণ ও অনুধাবনে এবং হাদীছ অনুসরণে প্রবল অনুরাগী।[17]
অতঃপর সরফরায খান দীর্ঘ আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘এতে প্রতীয়মান হয় যে, যিনি হাদীছের ইলম হাছিল করেছেন, তা সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করেছেন এবং হাদীছ তাহকীক করেছেন, তাকেই আহলেহাদীছ বলা হয়। চাই সে ব্যক্তি হানাফী, মালেকী, শাফেঈ কিংবা হাম্বলী হৌক। এমনকি সে যদি শী‘আও হয়ে থাকে, তথাপি সে আহলেহাদীছ।[18]
এই উক্তিতে খান ছাহেব মুহাদ্দিছগণকে ‘আহলেহাদীছ’ নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তিনি শী‘আ এবং অন্যদেরকেও আহলেহাদীছ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা দলীলের ভিত্তিতে একেবারেই বাতিল এবং ভিত্তিহীন। এই বিষয়ে সামনে আলোচনা আসছে ইনশাআল্লাহ।
যুগ বিবেচনায় মুহাদ্দিছগণের কয়েকটি জামা‘আত বা দল রয়েছে। যথা :
১. ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) :
হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কীর খলীফা ও জামে‘আ নিযামিয়া, হায়দারাবাদের প্রতিষ্ঠাতা আনওয়ারুল্লাহ ফারূকী ফযীলত জঙ্গ লিখেছেন, ‘প্রত্যেক ছাহাবী (রাঃ) আহলেহাদীছ ছিলেন। কেননা হাদীছ শাস্ত্রের সূচনা তাঁদের আমল থেকেই শুরু হয়েছে। কারণ তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করে সরাসরি উম্মতের কাছে পেঁŠছে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের আহলেহাদীছ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।[19]
এখানে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ উল্লেখ্য যে, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ গ্রন্থটি ক্বারী আব্দুল ক্বাইয়ূম যহীর আমাকে উপহার দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
দেওবন্দীদের প্রসিদ্ধ আলেম এবং বহু গ্রন্থ প্রণেতা মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লাহোরী লিখেছেন, ‘সকল ছাহাবীই তো আহলেহাদীছ ছিলেন। কিন্তু আহলে রায়গণই ফৎওয়া প্রদান করতেন। পরবর্তীতে আহলে রায় উপাধিটি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং তার শিষ্যদেরকে প্রদান করা হয়েছে। ঐ যুগের সকল আহলেহাদীছ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে আহলে রায়দের ইমাম উপাধিতে ভূষিত করেছেন।[20]
এই উক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর সময়েও আহলেহাদীছগণ বিদ্যমান ছিলেন।
২. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং পরবর্তীগণ :
শী‘আ এবং বিদ‘আতীদেরকে কয়েকটি কারণে আহলেহাদীছ বলা ভুল ও বাতিল। যেমন :
প্রথমত : ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ সর্বদা বিজয়ী থাকবে...। উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছ ইমামগণ বলেছেন, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ হচ্ছে ‘আহলেহাদীছ’।[21]
সুতরাং এমন কথা বলা কেবল বাতিলই নয়, বরং চরম ভ্রষ্টতা যে, শী‘আ এবং বিদ‘আতীরাও সাহায্যপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয়ত : ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিতী (রহঃ) বলেছেনে, ليس في الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أصحاب الحديث ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই যে আহলেহাদীছের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[22]
এই মূল্যবান উক্তি দ্বারা স্পষ্টত বুঝা গেল যে, আহলেহাদীছ এবং আহলে বিদ‘আত ভিন্ন ভিন্ন দল।
তৃতীয়ত : ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ حَيًّا- ‘আমি যখন কোন ‘আহলেহাদীছ’ ব্যক্তিকে দেখি তখন যেন রাসূল (ছাঃ)-কেই জীবন্ত দেখি’।[23] অর্থাৎ আহলেহাদীছগণের মাধ্যমেই নবী করীম (ছাঃ)-এর দাওয়াত জীবিত রয়েছে।
এক্ষণে ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা যদি শী‘আ ও বিদ‘আতীকেও বুঝানো হয়, তবে কি ইমাম শাফেঈ (রহঃ) শী‘আ, মু‘তাযিলা, জাহমিয়া, মুরজিয়া এবং হরেক রকমের বিদ‘আতীদেরকে দেখে আনন্দিত হ’তেন?
চতুর্থত : আহমাদ বিন আলী লাহোরী দেওবন্দী স্বীয় ‘মালফূযাত’-এ লিখেছেন, ‘আমি ক্বাদেরী (আব্দুল কাদের জিলানী-এর তরীকা) এবং হানাফী। আহলেহাদীছগণ কাদেরীও নয়, আবার হানাফীও নয়। কিন্তু তারা আমার মসজিদে চল্লিশ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করে আসছে। আমি তাদেরকে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত মনে করি।[24]
উক্ত উক্তি থেকে পাঁচটি বিষয় সাব্যস্ত হয়েছে :
১. আহলেহাদীছগণ হকের উপরে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
২.‘আহলেহাদীছ’ ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুসলমানদের উপাধি। এজন্য শী‘আ ও অন্যান্য দল সমূহ ‘আহলেহাদীছ’ নয়। তারা তো আহলে বিদ‘আত-এর অন্তর্ভুক্ত।
৩. শুধু মুহাদ্দিছগণকেই ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয় না। বরং মুহাদ্দিছগণের অনুসারী সাধারণ জনগণকেও ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। নতুবা মুহাদ্দিছগণের কোন জামা‘আতটি লাহোরী ছাহেবের মসজিদে চল্লিশ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করেছেন?
৪. মানুষ যদি হানাফী বা কাদেরী নাও হয়, তথাপি সে আহলে হক তথা হক্বপন্থী হ’তে পারেন।
৫. জনাব সরফরায খান কর্তৃক শী‘আদেরকে আহলেহাদীছ গণ্য করা বাতিল।
এমনিতরো আরো অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে যদ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, মুহাদ্দিছ হৌক কিংবা হাদীছের অনুসারী সাধারণ জনতা হৌক, ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা ‘আহলে সুন্নাত’ তথা ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মানুষ উদ্দেশ্য। আর বিদ‘আতীরা আদৌ ‘আহলেহাদীছ’ উপাধিতে শামিল নয়। বরং তারা তো ‘আহলেহাদীছের’ প্রতি কেবল বিদ্বেষই পোষণ করে থাকে।
দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থাৎ মুহাদ্দিছগণের অনুসারী এবং হাদীছের উপরে আমলকারী সাধারণ জনতার ব্যাপারে বক্তব্য হ’ল, কতিপয় লোক এ অপপ্রচার চালিয়ে থাকেন যে, ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা কেবল সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ উদ্দেশ্য, এর দ্বারা সাধারণ জনতা উদ্দেশ্য নয়। সেকারণে এই লোকদের অপপ্রচারের জবাবে বিশটি উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল :
১. অসংখ্য হক্বপন্থী আলেম যেমন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইমাম বুখারী প্রমুখ ‘আহলেহাদীছ’-কে সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
এর আলোকে বক্তব্য হ’ল কেবল মুহাদ্দিছগণই ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল, তাদের সাধারণ অনুসারীগণ নন। অথবা শুধু মুহাদ্দিছগণ জান্নাতে প্রবেশ করবেন এবং তাদের অনুসারীগণ জান্নাতের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন’ এমন ধারণা শুধু বাতিলই নয়, বরং ইসলামের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করার শামিল।
২. হাফিয ইবনে হিববান ‘আহলেহাদীছদে’র সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘তারা হাদীছের উপরে আমল করেন, হাদীছ সংরক্ষণ করেন এবং হাদীছ বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন’।[25] আর এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, আহলেহাদীছ সাধারণ জনগণও হাদীছের উপরেই আমল করে থাকেন।
৩. ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ)-এর ছেলে ইমাম আবু বকর বলেছেন, ‘তুমি ঐ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা নিজ দ্বীন নিয়ে খেল-তামাশা করে’। (যদি তুমি দ্বীনকে তাচ্ছিল্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও) তাহ’লে তুমি আহলেহাদীছদেরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করবে।[26]
এ উক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যারা আহলেহাদীছদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন, তারা দ্বীনকে নিয়ে তামাশা করেন। অর্থাৎ তারা বিদ‘আতী। আর এও দিবালোকের ন্যায় পরিস্ফূট যে, বিদ‘আতীরা শুধু মুহাদ্দিছগণের সাথেই শত্রুতা পোষণ করে না; বরং তারা হাদীছের অনুসারী আম জনতার প্রতিও চরম-বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে।
আমীন উকাড়বী দেওবন্দী ‘গায়ের মুক্বাল্লিদের পরিচয়’ শিরোনামে লিখেছেন যে, ‘কিন্তু যে ব্যক্তি ইমামও নয়, মুক্তাদীও নয় তথা বেনামাযী। কখনো সে ইমামকে গালি দেয় আবার কখনো মুক্তাদির সাথে ঝগড়া বাধায়- তবে বুঝতে হবে সে একজন গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[27]
আবার অন্য স্থানে উকাড়বী লিখেছেন, ‘এজন্যই যে যত বড় গায়ের মুক্বাল্লিদ হবে, সে তত বড় বেআদব ও অভদ্র হবে’।[28]
উকাড়বী আরো লিখেছেন, প্রতিটি গায়ের মুক্বাল্লিদ ব্যক্তিই ‘নিজের রায় নিয়ে গর্ববোধকারী’-এর প্রতিকৃতি। আর রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষ্যানুসারে এমন লোকদের জন্য (গায়ের মুকাল্লিদদের) তওবা করার পথ রুদ্ধ।[29]
এই বক্তব্য এবং অনুরূপ অন্যান্য বক্তব্যের কারণে তাকলীদপন্থীদের আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে ‘গায়ের মুকাল্লিদ’ শব্দ ব্যবহার করা একেবারেই ভ্রান্ত, বাতিল ও পরিত্যাজ্য।
৪. ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (রহঃ) বলেছেন, দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[30]
আর এটা সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেক আহলেহাদীছ তথা মুহাদ্দিছ, আলেম ও হাদীছের অনুসারী সাধারণ মানুষদের প্রতি সকল বিদ‘আতীই বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে এবং হরেক রকমের উদ্ভট নামে যেমন ‘গায়ের মুকাল্লিদ’ বলার দ্বারা আহলেহাদীছদের সাথে মশকরা করে থাকে।
৫. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) স্বীয় প্রসিদ্ধ ‘ক্বাছীদায়ে নূনিয়াহ’তে লিখেছেন, ‘ওহে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী এবং গালি প্রদানকারী! তুমি শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা গড়ার সুসংবাদ গ্রহণ করো’।[31]
এটা আপামর জনসাধারণেরও জানা আছে যে, প্রত্যেক কট্টর বিদ‘আতী জামা‘আত হিসাবে প্রত্যেক আহলেহাদীছের সাথে শত্রুতা রাখে এবং আহলেহাদীছ আলেম হৌক কিংবা সাধারণ জনতা হৌক তাদেরকে মন্দ নামে ডাকে।
৬. হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) আহলেহাদীছদের একটি ফযীলত উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কতিপয় সালাফে ছালেহীন এই আয়াতটি (বাণী ইসরাঈল ১৭/৭১) সম্পর্কে বলেছেন,هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ إِمَامَهُمْ النَّبِىُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ ‘এটি আহলেহাদীছের জন্য সবচেয়ে বড় ফযীলত। কেননা তাদের ইমাম হচ্ছেন স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)।[32]
যেমনিভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ) মুহাদ্দিছগণের ইমামে আযম (মহান ইমাম), তদ্রূপ তিনি সাধারণ আহলেহাদীছগণেরও ইমামে আযম। এটা কোন লুকোচুরি কথা নয়; বরং আহলেহাদীছদের খ্যাতিমান বাগ্মী ও সাধারণ বক্তাদের আলোচনা থেকেও এটা সুস্পষ্ট।
৭. হাদীছের ভিত্তি (قوام السنة ) খ্যাত ইমাম ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আল-ফযল আল-ইস্পাহানী (রহঃ) আহলেহাদীছের প্রসঙ্গে বলেছেন, এরাই ক্বিয়ামত পর্যন্ত হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে।[33]
এতে প্রমাণিত হয় যে, ‘আহলেহাদীছ’ বলতে মুহাদ্দিছ এবং হাদীছের অনুসারী সাধারণ জনতা উভয়কেই বুঝানো হয়। আর এ দলটি ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান থাকবে। এজন্য মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘মুহাদ্দিছগণ তো মারা গেছেন। বর্তমানে তো ঐ সকল লোক জীবিত রয়েছেন, যারা তাঁদের গ্রন্থ সমূহ থেকে নকল করে থাকে’।[34]
৮. আবূ ইসমাঈল আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল আছ-ছাবূনী বলেছেন, ‘আহলেহাদীছগণ এই আক্বীদা পোষণ করেন এবং একথার সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ তা‘আলা সাত আসমানের উপরে স্বীয় আরশের উপরে সমাসীন আছেন’।[35]
মুহাদ্দিছীনে কেরাম হৌক কিংবা তাঁদের অনুসারী সাধারণ জনগণ হৌক সবার এটাই আক্বীদা যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে সমাসীন আছেন এবং তিনি স্বীয় সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান নন। বরং তাঁর জ্ঞানের পরিধি এবং ক্ষমতার ব্যাপকতা সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে।
৯. আবূ মানছূর আব্দুল ক্বাহের বিন ত্বাহের আল-বাগদাদী সিরিয়া ও অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ ‘তারা সকলেই আহলে সুন্নাত। আর তারা আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে রয়েছে’।[36]
১০. শায়খুল ইসলাম হাফেয ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-হাদীছের উপর আমলকারী সাধারণ লোকদেরকেও ‘আহলেহাদীছ’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।[37]
১১. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, আমার নিকটে ঐ ব্যক্তিই আহলেহাদীছ, যিনি হাদীছের উপর আমল করেন।[38]
১২. সূরা বণী ইসরাইলের ৭১ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) মন্তব্য করেছেন, আহলেহাদীছদের জন্য এর চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ আর কোন বক্তব্য নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত আহলেহাদীছদের আর কোন ইমামে আ‘যম বা বড় ইমাম নেই।[39]
১৩. রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী দেওবন্দী লিখেছেন, প্রায় দ্বিতীয় তৃতীয় হিজরী শতকে হক্বপন্থীদের মাঝে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা সমূহের সমাধানকল্পে সৃষ্ট মতভেদের প্রেক্ষিতে পাঁচটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ চার মাযহাব ও আহলেহাদীছ। তৎকালীন সময় হ’তে অদ্যাবধি উক্ত পাঁচটি তরীকার মধ্যেই হক্ব সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মনে করা হয়।[40]
উক্ত বক্তব্য দ্বারা তিনটি বিষয় পরিষ্কারভাবে সাব্যস্ত হয়।
ক. ‘আহলেহাদীছ’ হক্বের উপর রয়েছে।
খ. ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছীনে কেরাম এবং তাদের অনুসারী আম জনতা উভয়েই উদ্দেশ্য।
গ. চার মাযহাব ব্যতিরেকে পঞ্চম দল হ’ল ‘আহলেহাদীছ’। এজন্য সরফরায খান ছফদরের মতানুসারে অন্যদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ বলে স্বীকৃতি দেয়া ভুল হয়েছে ।
১৪. আহমাদ আলী লাহোরীর এই বক্তব্যটি পূর্বেই উল্লিখিত হয়ে গেছে যে, তিনি বলেছেন, আহলেহাদীছগণ কাদরিয়া তরীকার অনুসারীও নন, আবার হানাফীও নন। তবে তারা আমার মসজিদে চল্লিশ বছর যাবৎ ছলাত আদায় করে আসছে। আমি তাদেরকে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করি।[41]
আহমাদ আলী লাহোরীর বক্তব্য দ্বারা এটি একেবারেই পরিষ্কার যে, স্রেফ মুহাদ্দিছগণই আহলেহাদীছ নন। বরং তাদের অনুসারী সাধারণ লোকজনও আহলেহাদীছ।
১৫. দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুবীর পসন্দনীয় গ্রন্থ ‘হক্কানী আক্বায়েদে ইসলাম’ গ্রন্থে আব্দুল হক হক্কানী দেহলভী বলেছেন, শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী, হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর আহলেহাদীছগণও আহলে সুন্নাতের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত।[42]
এই বক্তব্যে যেমনভাবে হানাফী, শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী নামগুলি দ্বারা তাদের আম জনতাকেও বুঝানো হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে উক্ত বক্তব্যে ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছীনে কেরামের সাধারণ অনুসারীদেরকেও বুঝানো হয়েছে।
১৬. মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (দেওবন্দী) একটি প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ‘হ্যা, আহলেহাদীছগণ মুসলমান এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সাথে বিয়ে-শাদীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয। শুধু তাক্বলীদ বর্জন করাতে ইসলামে কোন যায় আসে না। এমনকি তাক্বলীদ বর্জনকারী ব্যক্তি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’তেও বের হয়ে যায় না।[43]
এই ফৎওয়া ও পূর্বোক্ত (১৩ নং) ফৎওয়া দ্বারা সুস্পষ্ট হ’ল যে, ‘আহলেহাদীছ’ আহলে সুন্নাতেরই অন্তর্ভুক্ত এবং হাদীছের উপরে আমলকারী সাধারণ লোকদেরকেও ‘আহলেহাদীছ’ উপাধিতে ভূষিত করা সম্পূর্ণ সঠিক।
১৭. চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর ইতিহাসবিদ বিশারী মাক্বদেসী (মৃঃ ৩৭৫ হিঃ) মানছূরার (সিন্ধুর) অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, أَكْثَرُهُمْ أَصْحَابُ حَدِيْثٍ ‘তাদের অধিকাংশই আহলেহাদীছ’।[44]
আর যুক্তির নিরীখে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সে সময় সিন্ধু প্রদেশের সকল অধিবাসী মুহাদ্দিছ ছিলেন না। বরং তাদের মধ্যে মুহাদ্দিছগণের অনুসারী বহু সাধারণ লোক ছিলেন।
১৮. ইশারাতে ফরীদী অর্থাৎ ‘মাক্বাবীসুল মাজালিস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ‘আহলেহাদীছগণের ইমাম হযরত ক্বাযী মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী ইয়ামানী (রহঃ) ‘সামা’ (সঙ্গীত)-এর উপর একটি প্রামাণ্য পুস্তিকা লিখেছেন। পুস্তিকাটির নাম ‘ইবত্বালু দা‘ওয়া ইজমা’ (ইজমা দাবীর অসারতা)। উক্ত বইয়ে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, ‘সামা’ জায়েয।[45]
উক্ত বক্তব্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, ‘আহলেহাদীছ’ অর্থ হিন্দুস্তান সহ অন্যান্য দেশের সাধারণ আহলেহাদীছগণ। আর অবশিষ্ট বক্তব্য সম্পর্কে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হ’ল :
প্রথমত : শাওকানী সমস্ত আহলেহাদীছের ‘ইমামে আযম’-নন। বরং আহলেহাদীছের ইমামে আযম হ’লেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। শাওকানী তো পরবর্তীদের মধ্য হ’তে একজন আলেম ছিলেন।
দ্বিতীয়ত : যদি ‘সামা’ দ্বারা কাওয়ালী, গান-বাজনা এবং বাদ্যযন্ত্র সম্বলিত সংগীত উদ্দেশ্য হয়, তাহ’লে ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী তা হারাম। অনুরূপভাবে শিরকী-বিদ‘আতী কবিতা পাঠ করাও হারাম।
১৯. দেওবন্দী মুফতী মুহাম্মাদ আনওয়ার ছূফী আব্দুল হামীদ সোয়াতী কর্তৃক প্রণীত ‘নামাযে মাসনূন’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, নিঃসন্দেহে হানাফী মাযহাব অনুসারীদের স্বীয় মাযহাবের সত্যতার এবং আত্মিক প্রশান্তির জন্য ‘নামাযে মাসনূন’-একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। ৮৩৭ পৃষ্ঠাব্যাপী উক্ত গ্রন্থে ছালাতের যরূরী বিষয়াবলী বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমার মতে এ গ্রন্থটি পাঠ করা শুধু হানাফী মাযহাবের প্রতিটি ইমাম ও খত্বীবের জন্যই উপকারী নয়। বরং সাধারণ হানাফীদের জন্যও উপকারী। এমনকি মধ্যপন্থী আহলেহাদীছ ব্যক্তিদের জন্যও উক্ত গ্রন্থখানি আলোকবর্তিকা স্বরূপ হবে ইনশাআল্লাহ।[46] উক্ত উক্তিতে মুহাম্মাদ আনওয়ারও হাদীছের অনুসারী সাধারণ ব্যক্তিদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
২০. মুহাম্মাদ ওমর নামক এক কট্টর দেওবন্দী লিখেছেন, সাধারণ আহলেহাদীছগণের নিকটে আমাদের বিনীত নিবেদন এই যে, আপনাদেরকে এই সত্য থেকে বঞ্চিত রেখে আপনাদের চিন্তাগত শূন্যতা এনে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ আহলেহাদীছগণ এটা ভেবে থাকবেন যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হানাফীগণ কেন আহলেহাদীছ আলেমদের কিতাবগুলোর উপরে আমল করেন না?[47]
এই শঠতাপূর্ণ উক্তিতেও সাধারণ আহলেহাদীছ জনগণকে ‘আহলেহাদীছ’ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
উল্লিখিত ২০টি উদ্ধৃতি স্তূপ থেকে একটি মুষ্টি মাত্র। নইলে এগুলি ব্যতীত আরো বহু উদ্ধৃতি মওজুদ রয়েছে।
কতিপয় ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নিজেকে আহলেহাদীছ বলেন না। বরং তারা নিজেকে আহলেহাদীছ বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। আবার কেউ কেউ গায়ের আহলেহাদীছদের বিরোধিতার কারণে ‘আহলেহাদীছ’ নাম বলতে ভয় পান। আবার কেউ নিজেকে ‘আহলে ছহীহ হাদীছ’ ইত্যাদি বলে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে থাকেন। এ ধরনের কাজ-কারবার ও ছলচাতুরি ভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। হকপন্থীদের বৈশিষ্ট্যগত নাম সমূহের মধ্যে আহলে সুন্নাত, আহলেহাদীছ, সালাফী, আছারী ইত্যাদি অনেক সুন্দর সুন্দর উপাধি রয়েছে। তবে এসবের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ’ নামটি সর্বশ্রেষ্ঠ। এ নামটির জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সালাফে ছালেহীনের ইজমা রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।
সময়ের অনিবার্য দাবী হ’ল সকল ‘আহলেহাদীছ’ আলেম ও আহলেহাদীছ আম জনতা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক। সমস্ত মতানৈক্যকে বিদায় জানিয়ে কুরআন ও হাদীছের ঝান্ডাকে পৃথিবীর বুকে উড্ডীন করার জন্য মনেপ্রাণে সচেষ্ট হোক। ওমা আলায়না ইল্লাল বালাগ।
[চলবে]
* সৈয়দপুর, নীলফামারী।
[1]. ইবনে মাজাহ হা/৬; তিরমিযী হা/২১৯২, সনদ ছহীহ।
[2]. ইমাম হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ হা/২, সনদ হাসান।
[3]. ঐ, পৃঃ ১১২।
[4]. তিরমিযী হা/২১৯২ প্রভৃতি।
[5]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ।
[6]. ছহীহ ইবনে হিববান, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৬১, হা/৬১।
[7]. আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ, ১/২১১।
[8]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ১১৩।
[9]. তিরমিযী, হা/৪৮৪; সনদ হাসান।
[10]. ইবনে হিববান, হা/৯১১।
* হাফেয নাদীম যহীর, ১২ই শা‘বান, ১৪৩৩ হিজরী
[11]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, হা/৬, সনদ ছহীহ।
[12]. ঐ, পৃঃ ১১৫।
[13]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[14]. ইমাম বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ২/৪২৯; আল-জারহু ওয়াত-তা‘দীল, ৬/৩০৩।
[15]. ছহীহ ইবনে হিববান, আল-ইহসান, হা/৬১২৯; অন্য একটি কপির হাদীছ নং ৬১৬২।
[16]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ বেজওয়াবে আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ৫।
[17]. ত্বায়েফাহ মানছূরাহ, পৃঃ ৩৮; আল-কালামুল মুফীদ, পৃঃ ১৩৯।
[18]. ত্বায়েফাহ মানছূরাহ, পৃঃ ৩৯।
[19]. হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, ২য় খন্ড (করাচী : ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূম আল-ইসলামিয়া), পৃঃ ২২৮।
[20]. ইজতিহাদ আওর তাক্বলীদ কী বে-মিছাল তাহক্বীক্ব (পশ্চিম পাকিস্তান : ইলমী মারকায আনারকলী লাহোর), পৃঃ ৪৮।
[21]. দ্র: মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; তিরমিযী, হা/২২২৯; ইমাম হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, হা/২।
[22]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪।
[23]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/৮৫।
[24]. মালফূযাতে ত্বাইয়েবাহ, পৃঃ ১১৫; অন্য একটি সংস্করণের পৃঃ নং ১২৬।
[25]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬১২৯; অন্য একটি সংস্করণের হাদীছ নং ৬১৬২।
[26]. ইমাম আজুর্রী, আশ-শারী‘আহ, পৃঃ ৯৭৫।
[27]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ৩/৩৭৭।
[28]. ঐ, ৩/৫৯০।
[29]. ঐ, ৬/১৬৪।
[30]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪।
[31]. ক্বাছীদায়ে নূনিয়া, পৃঃ ১৯৯।
[32]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৪/১৬৪।
[33]. আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ, ১/২৪৬।
[34]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ, পৃঃ ২৯।
[35]. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃঃ ১৪।
[36]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩১৭।
[37]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[38]. ইমাম খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘ ১/৪৪।
[39]. তাদরীবুর রাবী, ২/১২৬, ২৭তম প্রকার।
[40]. আহসানুল ফাতাওয়া, ১/৩১৬।
[41]. মালফূযাতে ত্বাইয়েবাহ, পৃঃ ১১৫; পুরানা সংস্করণের পৃঃ নং ১২৬।
[42]. হক্কানী আক্বায়েদে ইসলাম, পৃঃ ৩।
[43]. কিফায়াতুল মুফতী, ১/৩২৫।
[44]. আহসানুত তাক্বাসীম ফি মা‘রিফাতিল আক্বালীম, পৃঃ ৪৮১।
[45]. ইশারাতে ফরীদী, পৃঃ ১৫৬।
[46]. নামাযে মাসনূন, ভূমিকা দ্রঃ।
[47]. ছুপে রায, ৪/২
আহলেহাদীছ নামটি কি সঠিক?প্রশ্ন : আমরা কেন আহলেহাদীছ? আমরা কেন মুসলিম নই? কোন ছাহাবী কি আহলেহাদীছ ছিলেন বা তারা কি নিজেদের নাম আহলেহাদীছ রেখেছিলেন? দলীল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করুন যে, আমরা কেন আহলেহাদীছ? জাযাকুমুল্লাহ খায়রান (আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন)।
এ প্রশ্নগুলি ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ তথা ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার পক্ষ হ’তে করা হয়েছে এবং ছহীহ বুখারীর হাদীছও উপস্থাপন করা হয়েছে যে, জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে আঁকড়ে ধর।
-উম্মে খালেদ, ক্যান্টনমেন্ট।
জবাব : ‘মুসলিমীন’ শব্দটি মুসলিম শব্দের বহুবচন এবং সর্বসম্মতিক্রমে আত্মসমর্পণকারী, আনুগত্যকারী ও বাধ্য ও অনুগত ব্যক্তিদেরকে মুসলিম বলা হয়। মুসলমানদের অনেক নাম ও উপাধি রয়েছে। যেমন মুহাজিরীন, আনছার, ছাহাবা, তাবেঈন ইত্যাদি। একটি ছহীহ হাদীছে এসেছে, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِى سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নামে ডাকো। যিনি তোমাদেরকে মুসলিমীন, মুমিনীন এবং ইবাদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) নামে অভিহিত করেছেন’।[1]
এই হাদীছের সনদ ছহীহ। ইয়াহ্ইয়া বিন আবী কাছীর ‘আমি শুনেছি’ বাক্যটি পরিষ্কারভাবে বলেছেন।
মূসা বিন খালাফ আবু খালাফ কর্তৃক ইয়াহইয়া বিন আবী কাছীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, فَادْعُوا الْمُسْلِمِيْنَ بِأَسْمَائِهِمْ بِمَا سَمَّاهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ الْمُسْلِمِيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘তোমরা মুসলমানদেরকে তাদের নামসমূহ মুসলিমীন, মুমিনীন ও ইবাদুল্লাহ দ্বারা ডাকো। যে নামগুলি আল্লাহ তা‘আলা রেখেছেন’।[2]
এই হাদীছের সনদ হাসান লি-যাতিহি। এতে আবু খালফ মূসা বিন খালাফ নামক একজন রাবী রয়েছেন। যিনি জমহূর মুহাদ্দিছগণের নিকটে বিশ্বস্ত। এজন্য তিনি সত্যবাদী, হাসানুল হাদীছ।
মুসনাদে আহমাদে (৫/২৪৪, হা/২৩২৯৮) উক্ত হাদীছের একটি ছহীহ শাহেদ অর্থাৎ সমর্থনমূলক হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনাটি একেবারেই ছহীহ। আল-হামদুলিল্লাহ।
উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মুসলমানদের ‘মুসলিম’ ছাড়া আরো নাম রয়েছে। এজন্য ‘আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম’ কতিপয় লোকের এমনটা বলা ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য।
ছহীহ মুসলিমের ভূমিকাতে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ)-এর বক্তব্য লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ ‘সুতরাং আহলে সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য করা হ’ত। অতঃপর তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত’।[3]
এ উক্তির বর্ণনাকারীগণ এবং ইমাম মুসলিমের সম্মতিতে তা (ইবনে সিরীনের বক্তব্য) ছহীহ মুসলিমে মওজুদ রয়েছে। ছহীহ মুসলিম হাযার হাযার লক্ষ লক্ষ আলেম পড়েছেন। কিন্তু কেউই উক্ত বক্তব্যের সমালোচনা করেননি যে, মুসলমানদের ‘আহলে সুন্নাত’ নাম ভুল। প্রতীয়মান হ’ল যে, ‘আহলে সুন্নাত’ নামটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা রয়েছে।
একটি ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’ সর্বদা বিজয়ী থাকবে। এর ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (রহঃ) বলছেন, يعني أهل الحديث অর্থাৎ আহলেহাদীছগণ। তার অর্থ ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ দ্বারা আহলেহাদীছ উদ্দেশ্য।[4]
ইমাম বুখারীর শিক্ষক আলী ইবনুল মাদীনী এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, هم أهل الحديث ‘তারা হ’লেন আহলুল হাদীছ’।[5]
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ বলেছেন, إذا رأيت الرجل يحب أهل الحديث، ... فإنه على السنة ‘যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে আহলেহাদীছদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে দেখ, ... (তখন বুঝবে যে,) সেই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে (আছে)’।[6]
ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[7]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث، فلا أدري من هم. ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি দ্বারা যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) উদ্দেশ্য না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[8]
হাফছ বিন গিয়াছ আহলেহাদীছদের সম্পর্কে বলেছেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ’।[9]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ حَيًّا- ‘আমি যখন কোন আহলেহাদীছ ব্যক্তিকে দেখি, তখন যেন আমি নবী কারীম (ছাঃ)-কেই জীবিত দেখি’।[10]
সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনু কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) ‘তাবীলু মুখতালাফিল হাদীছ ফির রাদ্দি আলা আ‘দায়ি আহলিল হাদীছ’ (تأويل مختلف الحديث فى الرد على أعداء أهل الحديث) শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেখানে তিনি আহলেহাদীছদের দুশমনদের কঠিনভাবে জবাব প্রদান করেছেন।
এই বক্তব্যগুলি মুহাদ্দিছগণের মাঝে কোনরূপ অস্বীকৃতি ও আপত্তি ব্যতিরেকেই প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ রয়েছে। সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ নামটি জায়েয ও বিশুদ্ধ হওয়ার পক্ষে ইমামগণের ইজমা রয়েছে। আর একথা সূর্যকিরণের চেয়েও সুস্পষ্ট যে, মুসলিম উম্মাহ ভ্রষ্টতার উপর একমত হ’তে পারেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لا يجمع الله أمتي أو قال هذه الأمة على الضلالة أبدا ويد الله على الجماعة- ‘আল্লাহ আমার উম্মতকে কিংবা বলেছেন এই উম্মতকে কখনো গুমরাহীর উপরে একত্রিত করবেন না এবং জামা‘আতের উপরে আল্লাহর হাত রয়েছে’।[11]
উপরোল্লেখিত দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছ এবং আহলুস সুন্নাহ মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যগত নাম এবং উপাধি। আর এই দলটিই ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল।
আহলেহাদীছ-এর দু’টি অর্থই হ’তে পারে। ১. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছীনে কেরাম। ২. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণ। যারা দলীলের ভিত্তিতে মুহাদ্দিছগণের পথে চলেন এবং তাদের অনুসরণ করেন।[12]
একথা প্রমাণিত যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ জান্নাতে যাবে। কেননা এটি হক্বপন্থী জামা‘আত। তবে কি শুধু মুহাদ্দিছগণই জান্নাতে যাবেন আর তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ জান্নাতের বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন?
সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ-এর মধ্যে মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী উভয়ই শামিল রয়েছেন। স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা কুরআন-হাদীছ অনুধাবনকারী এবং ইজমা অস্বীকারকারী মাসঊদ আহমাদ (বিএসসি) তাকফীরী লিখেছেন, ‘আমরাও মুহাদ্দিছগণকে আহলুল হাদীছ বলে থাকি’। যুবায়ের ছাহেবের (লেখকের) উল্লেখিত বক্তব্যগুলি আমাদের সমর্থনে, প্রত্যুত্তরে নয়।[13]
হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে মুহাদ্দিছীন বলা হয়। সাধারণ মুসলমানগণও জানেন যে, ছাহাবী ও তাবেঈগণ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, ছাহাবী ও তাবেঈগণ মুহাদ্দিছ তথা আহলেহাদীছ ছিলেন।
মাসঊদ আহমাদের উপরে একটি নতুন অহী অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি উদ্ধত গলায় প্রচার চালাচ্ছেন যে, ‘মুহাদ্দিছগণ তো চলে গেছেন। এখন তো ঐ সমস্ত ব্যক্তি জীবিত রয়েছেন, যারা তাদের গ্রন্থ সমূহ থেকে নকল করেন মাত্র’।[14]
মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের উক্ত বক্তব্যের পর্যালোচনা করতে গিয়ে মুহতারাম ভাই ড. আবু জাবের আদ-দামানভী বলছেন, ‘মাসঊদ আহমাদের বক্তব্যের সারমর্ম এই যে, যেভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নবুঅতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে মুহাদ্দিছগণের আগমনের সিলসিলাও কোন বিশেষ মুহাদ্দিছ ব্যক্তি পর্যন্ত সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোন মুহাদ্দিছ জন্ম নিবেন না এবং বর্তমানে যারাই আসবেন তারা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছগণের গ্রন্থ হ’তে নকলকারীই হবেন। যেভাবে লোকেরা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ বারজন ইমামের পরে তাদের সিলসিলা খতম করে দিয়েছেন। মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের মনে হ’তে পারে যে, এভাবে মুহাদ্দিছগণের আগমনের ধারাবাহিকতাও বর্তমানে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি (মাসঊদ আহমাদ) এ ব্যাপারে কোন দলীল উল্লেখ করেননি। তার দৃষ্টিতে ইমামদের বক্তব্যতো ভ্রূক্ষেপযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে তিনি নিজের বক্তব্যকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অথচ যে ব্যক্তিই ইলমে হাদীছের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তাকে মুহাদ্দিছগণের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।[15]
ছহীহ বুখারীর হাদীছ, تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’।[16] এই হাদীছের অনুকূলে ইমাম বুখারী (রহঃ) লিখিত অনুচ্ছেদ كَيْفَ الأَمْرُ إِذَا لَمْ تَكُنْ جَمَاعَةٌ ‘যখন জামা‘আত থাকবে না তখন কি করতে হবে’-এর ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেছেন, وَالْمَعْنَى مَا الَّذِي يَفْعَلُ الْمُسلمُ فِي حَال الِاخْتِلاَفِ مِنْ قبل ان يَقع الْإِجْمَاعُ عَلَى خَليْفَةٍ ‘উক্ত হাদীছের মর্মার্থ এই যে, একজন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমতের পূর্বে মতভেদপূর্ণ পরিস্থিতিতে মুসলমানগণ কি করবেন’?[17]
বদরুদ্দীন আইনী হানাফী লিখছেন, وَحَاصِل معنى التَّرْجَمَة أَنه إِذا وَقع اخْتِلَاف وَلم يكن خَليفَة فَكيف يفعل الْمُسلم من قبل أَن يَقع الِاجْتِمَاع على خَليفَة ‘এ অনুচ্ছেদের সারমর্ম হ’ল, যখন মুসলমানদের মাঝে মতপার্থক্য হবে এবং কোন খলীফা থাকবে না, এমতাবস্থায় একজন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণের পূর্বে মুসলমানগণ কি করবেন’?[18]
‘জামা‘আত’ শব্দের ব্যাখ্যায় বুখারীর ভাষ্যকার ইমাম ক্বাসত্বালানী (রহঃ) লিখছেন, مجتمعون على خَليفَة ‘একজন খলীফার অধীনে ঐক্যবদ্ধ ব্যক্তিগণ’।[19]
ইমাম কুরতুবী (মৃঃ ৬৫৬ হিঃ) লিখছেন,
يعني : أنه متى اجتمع المسلمون على إمام فلا يُخرج عليه وإنْ جَارَ كما تقدّم، وكما قال في الرواية الأخرى: فاسمع، وأطع. وعلى هذا فتُشهد مع أئمة الْجَوْر الصلوات، والجماعات، والجهاد، والحج، وتُجْتَنَبُ معاصيهم، ولا يطاعون فيها.
অর্থাৎ যখন মুসলমানগণ কোন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করবেন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। যদিও তিনি অত্যাচারী হন। যেমনটি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। যেমনভাবে অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তুমি তার আদেশ শোন এবং তার আনুগত্য কর (যদিও সে তোমার পিঠে প্রহার করে)। এ হাদীছের আলোকে অত্যাচারী ইমাম তথা শাসকদের সাথে ছালাত, ঈদের জামা‘আত, জিহাদ, হজ্জ (প্রভৃতি) আদায় করা যাবে। তবে তাদের পাপকার্য সমূহ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা যাবে না।[20]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) আরো বলেন, فلو بايع أهل الحل والعقد لواحدٍ موصوف بشروط الإمامة لانعقدت له الخلافة، وحرمت على كل أحدٍ المخالفة ‘যদি জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ খেলাফতের শর্তাবলী পূরণকারী কোন ব্যক্তির নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন, তাহ’লে তার খেলাফত কায়েম হয়ে যাবে এবং প্রত্যেক মুসলমানের উপরে তার বিরোধিতা করা হারাম সাব্যস্ত হয়ে যাবে’।[21]
হাদীছের ব্যাখ্যাকারদের উক্ত ভাষ্য সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ এবং তাদের ইমাম দ্বারা খিলাফত এবং খলীফা উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যার সমর্থন এর দ্বারাও হয় যে, হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য আরেকটি বর্ণনায় এসছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, فَإِنْ لَمْ تَجِدْ يَوْمَئِذٍ خَلِيْفَةً فَاهْرَبْ حَتَّى تَمُوْتَ ‘তুমি যদি তখন কোন খলীফা না পাও, তাহ’লে মৃত্যু অবধি পালিয়ে থাকবে’।[22]
একটি গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা : ইবনু বাত্তাল কুরতুবী (মৃঃ ৪৪৯হিঃ) বলেছেন,فإذا لم يكن لهم إمام فافترق أهل الإسلام أحزابًا فواجب اعتزال تلك الفرق كلها ‘সুতরাং যখন তাদের কোন ইমাম (খলীফা) থাকবে না এবং মুসলমানেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তখন ঐ দলসমূহ হ’তে দূরে থাকা আবশ্যক’।[23]
হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছ দ্বারা দুই শ্রেণীর মানুষ ফায়েদা লোটার চেষ্টা করেছে।
১. ঐ সকল লোক, যারা ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ নামে একটি কাগুজে দল গঠন করেছে এবং একজন সাধারণ ব্যক্তি সেই পার্টির নেতা বনে গেছে। অথচ এ দলটি মুসলমানদের খেলাফতভিত্তিক জামা‘আত নয় এবং সেই দলের নেতাও ইমাম বা খলীফা নয়।
২. ঐ সকল লোক, যারা একজন কাগুজে খলীফা বানিয়েছে। যার নিকটে না আছে সৈন্য, আর না আছে কোন ক্ষমতা। এই কাগুজে খলীফার এক ইঞ্চি মাটির উপরেও কোন কর্তৃত্ব নেই। ঐ খলীফা না কোন কাফেরদের সাথে জিহাদ করেছে, আর না কোন শারঈ দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেছে। তাকে খলীফা বলা খেলাফতের সাথে ঠাট্টা করার শামিল। সূরা বাক্বারার ৩০ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) লিখেছেন,
وَقَدِ اسْتَدَلَّ الْقُرْطُبِيُّ وَغَيْرُهُ بِهَذِهِ الْآيَةِ عَلَى وُجُوبِ نَصْبِ الْخَلِيفَةِ لِيَفْصِلَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا يَخْتَلِفُونَ فِيهِ، وَيَقْطَعَ تَنَازُعَهُمْ، وَيَنْتَصِرَ لِمَظْلُومِهِمْ مِنْ ظَالِمِهِمْ، وَيُقِيمَ الْحُدُودَ، وَيَزْجُرَ عَنْ تَعَاطِي الْفَوَاحِشِ-
‘কুরতুবী প্রমুখ এ আয়াত দ্বারা খলীফা কায়েম করা ওয়াজিব হওয়া সাব্যস্ত করেছেন। যাতে তিনি লোকদের মধ্যে বিবদমান বিষয়ের ফায়ছালা করেন এবং তাদের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান। যালেমের বিরুদ্ধে মাযলূমকে সাহায্য করতে পারেন, দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেন এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে বিরত রাখেন’।[24]
ক্বাযী আবু ইয়া‘লা মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-ফার্রা এবং ক্বাযী আলী বিন মুহাম্মাদ বিন হাবীব আল-মাওয়ার্দী ও খলীফা হওয়ার জন্য জিহাদ, রাজনৈতিক শক্তি এবং হুদূদ বা দন্ডবিধি প্রয়োগ করার শর্তাবলী আরোপ করেছেন।[25]
মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রহঃ) লিখছেন, ولأن المسلمين لا بد لهم من إمام، يقوم بتنفيذ أحكامهم، وإقامة حدودهم، وسدّ ثغورهم، وتجهيز جيوشهم، وأخذ صدقاتهم. ‘মুসলমানদের জন্য এমন একজন ইমাম (খলীফা) হওয়া যরূরী, যিনি হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করবেন, তাদের মাঝে দন্ডবিধি কায়েম করবেন, সীমান্ত এলাকার হেফাযত করবেন, সৈন্য-বাহিনী প্রস্ত্তত করবেন এবং মানুষদের নিকট থেকে যাকাত-ছাদাক্বা আদায় করবেন’।[26]
ওলামায়ে কেরামের উল্লিখিত বক্তব্যের সরাসরি বিপরীত একজন কাগুজে খলীফা বানানো, যিনি নিজের ঘরেই শারঈ হুদূদ কায়েমে ব্যর্থ হন এবং নিজের ঘর-বাড়ীকে হেফাযত করতে সক্ষম হন না, এগুলি ঐ সমস্ত লোকের কাজ যারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে দলাদলি সৃষ্টি করতে এবং বাতিল মতবাদ সমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে চায়।
একটি হাদীছে এসেছে, وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মারা যায় এমতাবস্থায় যে তার গর্দানে কোন ইমামের বায়‘আত নেই, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[27]
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন,تدري ما الإمام؟ الذي يجتمع المسلمون عليه كلهم يقول: هذا إمام، فهذا معناه ‘তুমি কি জান (উক্ত হাদীছে বর্ণিত) ইমাম কাকে বলে? ইমাম তিনিই, যার ইমাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। প্রতিটি লোকই বলবে যে, ইনিই ইমাম (খলীফা)। এটাই উক্ত হাদীছের মর্মার্থ।[28]
সারসংক্ষেপ এই যে, ইমাম এবং জামা‘আতুল মুসলিমীন সংক্রান্ত হাদীছ সমূহ দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করে কিছু লোকের কাগুজে জামা‘আত এবং কাগুজে আমীর বানানো একেবারেই ভ্রান্ত এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের সরাসরি বরখেলাফ।
কিছু মানুষ ‘আহলেহাদীছ’ নাম শুনে জ্বলে-পুড়ে মরেন এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে অপচেষ্টা চালান যে, আহলেহাদীছ নামটি দলবাজি। আমরা যেহেতু মুসলিম তাই আমাদেরকে মুসলিম বলাই উচিত। সেজন্যই আমরা সালাফে ছালেহীন, মুহাদ্দিছ এবং ইমামগণের অসংখ্য দলীল পেশ করেছি এ মর্মে যে, আহলেহাদীছ বলা কেবল জায়েযই নয়; বরং পসন্দনীয়ও বটে। আর এটাই ত্বায়েফাহ মানছূরাহ তথা সাহায্যপ্রাপ্ত দল।
[1]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩; ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে হাসান ছহীহ গরীব বলেছেন। ইবনু হিববান, মাওয়ারিদ, হা/১২২২, ১৫৫০) এবং হাকেম একে ছহীহ বলেছেন (১/১১৭, ১১৮, ২৩৬, ৪২১, ৪২২) এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন।
[2]. আহমাদ, ৪/১৩০, হা/১৭৩০২; ৪/২০২, হা/১৭৯৫৩, সনদ হাসান।
[3]. মুসলিম, হা/২৭ অনুচেছদ-৫; দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের ক্রমিক নং অনুসারে।
[4]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী হা/২২২৯; ‘ফিতান’ অধ্যায়, ‘পথভ্রষ্ট শাসকদের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ; আরেযাতুল আহওয়াযী, ৯/৭৪; সনদ ছহীহ।
[6]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, পৃঃ ১৩৪; সনদ ছহীহ।
[7]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ।
[8]. ঐ, পৃঃ ২; ইবনু হাজার আসক্বালানী ফাতহুল বারীতে (১৩/২৫০) একে ছহীহ বলেছেন।
[9]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, সনদ ছহীহ।
[10]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/৮৫, পৃঃ ৯৪, সনদ ছহীহ।
[11]. মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৯৮, ৩৯৯, ১/১১৬, সনদ ছহীহ।
[12]. মুক্বাদ্দামাতুল ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ১৯; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[13]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ বা-জাওয়াবে আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ৫।
[14]. ঐ, পৃঃ ২৯।
[15]. খুলাছাতুল ফিরক্বাতিল জাদীদাহ, পৃঃ ৫৫।
[16]. বুখারী, হা/৭০৮৪।
[17]. ফাতহুল বারী, হা/৭০৮৪, ১৩/৩৫।
[18]. উমদাতুল ক্বারী, ২৪/১৯৩, ‘ফিতান’ অধ্যায়।
[19]. ইরশাদুস সারী, ১০/১৮৩।
[20]. আল-মুফহাম লিমা আশকালা মিন তালখীছে কিতাবে মুসলিম, ৪/৫৭।
[21]. ঐ, ৪/৫৭-৫৮।
[22]. আবুদাঊদ হা/৪২৪৭; ছহীহ আবু ‘আওয়ানাহ, ৪/৪৭৬; সনদ হাসান। রাবী ছাখর বিন বদরকে ইবনে হিববান ও আবু ‘আওয়ানাহ ছিক্বাহ বলেছেন। অপর রাবী সুবাই‘ ইবনে খালেদকে ইজলী এবং ইবনে হিববান ছিক্বাহ বলেছেন। এ হাদীছটির অনেক শাহেদ তথা সমর্থক হাদীছ রয়েছে।
[23]. ইবনু বাত্তাল, শারহুল বুখারী, ১০/৩২। [এই ব্যাখ্যা ভ্রমাত্মক। কেননা পৃথিবীতে সর্বত্র সর্বদা হকপন্থী খলীফা থাকবেন না। সে অবস্থায় মুসলিম উম্মাহ বাধ্যগতভাবে বাতিলপন্থী শাসকদের আনুগত্য করবে। কিন্তু ইসলামী অনুশাসন পালনের জন্য তারা নিজেদের মধ্যকার ইসলামী আমীরের আনুগত্য করবে। যদিও তিনি শারঈ দন্ডবিধি কায়েম করবেন না। যেভাবে মাক্কী জীবনে রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের আনুগত্য লাভ করেছেন। কিন্তু তাদের উপর শারঈ দন্ডবিধি জারী করেননি। কারণ এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা তখন তিনি লাভ করেননি। এ নীতি সকল যুগেই প্রযোজ্য। ইমারত ও বায়‘আত বিহীন জীবন বিশৃংখল জীবনের নামান্তর। যাকে হাদীছে জাহেলিয়াতের জীবন বলা হয়েছে এবং যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব সর্বাবস্থায় মুসলমানকে একজন শারঈ আমীরের প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।- স.স.]
[24]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/২০৪।
[25]. আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ২২; মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ৬; মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২২, পৃঃ ৩৯।
[26]. শারহুল ফিক্বহিল আকবার, পৃঃ ১৪৬।
[27]. ইবনু আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, হা/১০৫৭, সনদ হাসান; মুসলিম, হা/১৮৫১।
[28]. সুওয়ালাতু ইবনে হানী, পৃঃ ১৮৫; অনুচ্ছেদ ২০১১; খাল্লাল, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ৮১, অনুচ্ছেদ ১০; আল-মুসনাদ মিন মাসাইলিল ইমাম আহমাদ, অনুচ্ছেদ-১। গৃহীত : আল-ইমামাতুল উযমা ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ২১৭।
আহলেহাদীছ একটি গুণবাচক নাম ও ইজমা :
সালাফে ছালেহীন-এর আছার হ’তে নিম্নে ৫০টি উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল। যেগুলোর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে, আহলেহাদীছ উপাধি ও গুণবাচক নামটি সম্পূর্ণ সঠিক। আর এর উপরেই ইজমা রয়েছে।
১. বুখারী : ইমাম বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ) ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে বলেছেন, يعني أَهْلُ الْحَدِيثِ অর্থাৎ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘আহলেহাদীছ’।[1]
ইমাম বুখারী (রহঃ) ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তানের (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) সূত্রে একজন রাবী (বর্ণনাকারী) সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, لم يكن من أهل الحديث ‘তিনি আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।[2]
২. মুসলিম : ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ) ‘মাজরূহ’ বা সমালোচিত রাবীদের সম্পর্কে বলছেন, هم عند أهل الحديث متهمون ‘তারা আহলেহাদীছদের নিকটে (মিথ্যার দোষে) অপবাদগ্রস্ত’।[3]
ইমাম মুসলিম (রহঃ) আরো বলেছেন, وقد شرحنا من مذهب الحديث وأهله، ‘আমরা হাদীছ ও আহলেহাদীছদের মাযহাব-এর ব্যাখ্যা করেছি’।[4]
ইমাম মুসলিম আইয়ূব আস-সিখতিয়ানী, ইবনে আওন, মালেক বিন আনাস, শু‘বাহ বিন হাজ্জাজ, ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান, আব্দুর রহমান বিন মাহদী এবং তাদের পরে আগতদেরকে আহলেহাদীছদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত (من أهل الحديث) বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।[5]
৩. শাফেঈ : একটি দুর্বল বর্ণনার ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (মৃঃ ২০৪ হিঃ) বলেছেন, لا يثبت أهل الحديث مثله، ‘এ জাতীয় বর্ণনাকে আহলেহাদীছগণ প্রমাণিত মনে করেন না’।[6]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إذا رأيت رجلا من أصحاب الحديث فكأني رأيت النبي صلى الله عليه وسلم حيا، ‘আমি যখন আহলেহাদীছ-এর কোন ব্যক্তিকে দেখি, তখন যেন আমি রাসূল (ছাঃ)-কেই জীবিত দেখি’।[7]
৪. আহমাদ বিন হাম্বল : ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ)-কে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’লে তিনি বলেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث فلا أدري من هم؟ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[8]
৫. ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান : ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) সুলাইমান বিন ত্বারখান আত-তায়মী সম্পর্কে বলেছেন, كان التيمي عندنا من أهل الحديث، ‘আমাদের নিকট তায়মী আহলেহাদীছদের অন্যতম ছিলেন’।[9]
হাদীছের একজন রাবী ইমরান বিন কুদামাহ আল-‘আম্মী সম্পর্কে ইয়াহ্ইয়া আল-ক্বাত্তান বলেছেন,ولكنه لم يكن من أهل الحديث، ‘কিন্তু তিনি আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।[10]
৬. তিরমিযী : আবু যায়েদ নামক একজন রাবীর ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী (মৃঃ ২৭৯ হিঃ) বলেছেন, وأبو زيد رجل مجهول عند أهل الحديث، ‘আহলেহাদীছদের নিকটে আবু যায়েদ একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি’।[11]
৭. আবুদাঊদ : ইমাম আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানী (মৃঃ ২৭৫ হিঃ) বলেছেন, عند عامة أهل الحديث ‘সাধারণ আহলেহাদীছদের নিকটে...’।[12]
৮. নাসাঈ : ইমাম নাসাঈ (মৃঃ ৩০৩ হিঃ) বলেছেন, ومنفعةً لأهل الإسلام ومن أهل الحديث والعلم والفقه والقرآن، ‘ইসলামের অনুসারীগণ, আহলেহাদীছ, আহলে ইলম, আহলে ফিক্বহ এবং আহলে কুরআন-এর উপকারিতার জন্য’।[13]
৯. ইবনে খুযায়মাহ : ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব ইবনে খুযায়মাহ নিশাপুরী (মৃঃ ৩১১ হিঃ) একটি হাদীছের ব্যাপারে বলেছেন, لم نر خلافا بين علماء أهل الحديث أن هذا الخبر صحيح من جهة النقل، ‘আমরা আহলেহাদীছ আলেমদের মাঝে কোন মতানৈক্য দেখিনি যে, এই হাদীছটি বর্ণনার দিক থেকে ছহীহ’।[14]
১০. ইবনু হিববান : হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে হিববান আল-বুসতী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ) একটি হাদীছের উপর নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন : ذكر خبر شنع به بعض المعطلة على أهل الحديث، حيث حرموا توفيق الإصابة لمعناه، ‘ঐ হাদীছের বর্ণনা, যার মাধ্যমে কতিপয় মু‘আত্তিলা (নির্গুণবাদী) আহলেহাদীছদের প্রতি দোষারোপ করেছে। কেননা এরা এ হাদীছের সঠিক মর্ম অনুধাবনের তেŠফিক থেকে বঞ্চিত হয়েছে’।[15]
অন্য এক জায়গায় হাফেয ইবনু হিববান আহলেহাদীছদের এই গুণ বর্ণনা করেছেন যে, ينتحلون السنن ويذبون عنها ويقمعون من خالفها، ‘তারা হাদীছের প্রতি আমল করেন, এর হেফাযত করেন এবং সুন্নাত বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন’।[16]
১১. আবু ‘আওয়ানাহ : ইমাম আবু ‘আওয়ানাহ আল-ইসফারাইনী (মৃঃ ৩১৬ হিঃ) একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম মুযানী (রহঃ)-কে বলছেন, اختلاف بين أهل الحديث ‘এ বিষয়ে আহলেহাদীছদের মাঝে মতভেদ রয়েছে’।[17]
১২. ইজলী : ইমাম আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ আল-ইজলী (মৃঃ ২৬১ হিঃ) ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনা সম্পর্কে বলেন, وكان بعض أهل الحديث يقول هو أثبت الناس في حديث الزهري، ‘কতিপয় আহলেহাদীছ বলতেন যে, তিনি যুহরীর হাদীছ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী বিশবস্ত’।[18]
১৩. হাকেম : আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকেম নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) ইয়াহ্ইয়া ইবনে মাঈন (রহঃ) সম্পর্কে বলেছেন, إمام أهل الحديث ‘তিনি আহলেহাদীছদের ইমাম’।[19]
১৪. হাকেম কাবীর : আবু আহমাদ আল-হাকেম আল-কাবীর (মৃঃ ৩৭৮ হিঃ) شعار أصحاب الحديث ‘আহলেহাদীছদের নিদর্শন’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থটির অনুবাদ লেখকের তাহকীক সহ প্রকাশিত হয়েছে।[20]
১৫. ফিরইয়াবী : মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আল-ফিরইয়াবী (মৃঃ ২১২ হিঃ) বলেছেন, رأينا سفيان الثوري بالكوفة وكنا جماعة من أهل الحديث، ‘আমরা সুফিয়ান ছাওরীকে কুফাতে দেখেছি। এমতাবস্থায় আমরা আহলেহাদীছদের একটা জামা‘আত ছিলাম’।[21]
১৬. ফিরইয়াবী : জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ আল-ফিরইয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) ইবরাহীম বিন মূসা আল-ওয়াযদূলী (রহঃ) সম্পর্কে বলেছেন, وله ابن من أصحاب الحديث يقال له اسحاق ‘তার এক আহলেহাদীছ পুত্র রয়েছে। যার নাম ইসহাক্ব’।[22]
১৭. আবু হাতিম আর-রাযী : আসমাউর রিজালের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু হাতিম আর-রাযী (মৃঃ ২৭৭ হিঃ) বলেছেন, واتفاق أهل الحديث على شيء يكون حجة، ‘কোন বিষয়ের উপরে আহলেহাদীছদের ঐক্যমত হুজ্জাত বা দলীল হিসাবে গণ্য হয়’।[23]
১৮. আবু ওবাইদ : ইমাম আবু ওবাইদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম (মৃঃ ২২৪ হিঃ) একটি আছার সম্পর্কে বলেছেন, وقد يأخذ بهذا بعض أهل الحديث، ‘কতিপয় আহলেহাদীছ এই আছারটি গ্রহণ করেছেন’।[24]
১৯. আবুবকর বিন আবুদাঊদ : ইমাম আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানীর অধিকাংশের নিকট বিশ্বস্ত পুত্র আবুবকর বিন আবুদাঊদ বলছেন,
ولا تك من قوم تلهو بدينهم * فتطعن في أهل الحديث وتقدح
‘তুমি ঐ লোকদের দলভুক্ত হয়ো না, যারা স্বীয় দ্বীনকে নিয়ে খেল-তামাশা করে। নতুবা তুমিও আহলেহাদীছদেরকে তিরষ্কার ও দোষারোপ করবে’।[25]
২০. ইবনু আবী আছিম : ইমাম আহমাদ বিন আমর বিন আয-যাহহাক বিন মাখলাদ ওরফে ইবনে আবী আছিম (মৃঃ ২৮৭ হিঃ) একজন রাবী সম্পর্কে বলছেন, رجل من أهل الحديث ثقة ‘তিনি আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি’।[26]
২১. ইবনু শাহীন : হাফেয আবু হাফছ ওমর বিন শাহীন (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ) ইমরান আল-‘আম্মী সম্পর্কে ইয়াহ্ইয়া আল-ক্বাত্তবানের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, ولكن لم يكن من أهل الحديث ‘কিন্তু তিনি (ইমরান) আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।[27]
২২. আল-জাওযাজানী : আবু ইসহাক্ব ইবরাহীম বিন ইয়াকূব আল-জাওযাজানী (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) বলেছেন, ثم الشائع في أهل الحديث ‘অতঃপর আহলেহাদীছদের মাঝে প্রসিদ্ধ রয়েছে...’।[28]
২৩. আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী : ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) বলেছেন, ليس في الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أهل الحديث، ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[29]
প্রতীয়মান হ’ল যে, যে ব্যক্তি আহলেহাদীছদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে অথবা আহলেহাদীছদেরকে মন্দ নামে ডাকে, সে ব্যক্তি পাক্কা বিদ‘আতী।
২৪. আলী বিন আব্দুল্লাহ আল-মাদীনী : ইমাম বুখারী ও অন্যান্যদের উস্তাদ ইমাম আলী বিন আব্দুল্লাহ আল-মাদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) একটি হাদীছের ব্যাখ্যায় বলছেন, يعني أهل الحديث ‘অর্থাৎ তারা হ’লেন আহলেহাদীছ (আছহাবুল হাদীছ)’।[30]
২৫. কুতায়বা বিন সাঈদ : ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ (মৃঃ ২৪০ হিঃ) বলেছেন, إذا رأية الرجل يحب أهل الحديث ... فإنه على السنة ‘যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখ যে সে আহলেহাদীছদেরকে ভালোবাসে, তবে বুঝবে সে সুন্নাতের উপরে আছে’।[31]
২৬. ইবনু কুতায়বা দীনাওয়ারী : বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনু কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)। ‘তাবীলু মুখতালাফিল হাদীছ ফির রদ্দি আলা আ‘দায়ে আহলিল হাদীছ’ (تأويل مختلف الحديث في الرد على أعداء أهل الحديث) নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। এই গ্রন্থে তিনি আহলেহাদীছ-এর দুশমনদের কঠিনভাবে জবাব প্রদান করেছেন।
২৭. বায়হাক্বী : আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাক্বী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ) মালেক বিন আনাস, আওযাঈ, সুফিয়ান ছাওরী, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, হাম্মাদ বিন যায়েদ, হাম্মাদ বিন সালামাহ, শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ প্রমুখকে আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত (من أهل الحديث) লিখেছেন।[32]
২৮. ইসমাঈলী : হাফেয আবু বকর আহমাদ বিন ইবরাহীম আল-ইসমাঈলী (মৃঃ ৩৭১ হিঃ) একজন রাবী সম্পর্কে বলেছেন, لم يكن من أهل الحديث، ‘তিনি আহলেহাদীছ ছিলেন না’।[33]
২৯. খত্বীব : খত্বীব বাগদাদী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) আহলেহাদীছদের ফযীলত সম্পর্কে ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ (شرف أصحاب الحديث) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেটি প্রকাশিত। ‘নাছীহাতু আহলিল হাদীছ’ (نصيحة أهل الحديث) নামক গ্রন্থখানাও খত্বীবের দিকে সম্পর্কিত।[34]
৩০. আবু নু‘আইম ইস্পাহানী : আবু নু‘আইম ইস্পাহানী (মৃঃ ৪৩০ হিঃ) একজন রাবী সম্পর্কে বলেছেন, لا يخفى على علماء أهل الحديث فساده، ‘আহলেহাদীছ আলেমদের নিকটে তার ফাসাদ গোপন নয়’।[35]
তিনি বলেছেন, وذهب الشافعي مذهب أهل الحديث ‘ইমাম শাফেঈ আহলেহাদীছের মাযহাবের অনুকূলে গেছেন’।[36]
৩১. ইবনুল মুনযির : হাফেয মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আন-নায়সাপুরী (মৃঃ ৩১৮ হিঃ) স্বীয় সঙ্গী-সাথী এবং ইমাম শাফেঈ ও অন্যান্যদেরকে আহলেহাদীছ বলেছেন।[37]
৩২. আজুর্রী : ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-আজুর্রী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) আহলেহাদীছদেরকে নিজ ভাই সম্বোধন করে বলেছেন, نصيحة لإخواني من أهل القرآن وأهل الحديث وأهل الفقه وغيرهم من سائر المسلمين، ‘আমার ভ্রাতৃমন্ডলী আহলে কুরআন, আহলেহাদীছ, আহলে ফিক্বহ এবং অন্যান্য সকল মুসলিমের প্রতি আমার নছীহত’।[38]
সতর্কীকরণ : হাদীছ অস্বীকারকারীদেরকে আহলে কুরআন বা আহলে ফিক্বহ বলা ভুল। আহলে কুরআন, আহলেহাদীছ, আহলে ফিক্বহ প্রভৃতি উপাধি ও গুণবাচক নাম একই জামা‘আতের নাম। আল- হামদুলিল্লাহ।
৩৩. ইবনু আব্দিল বার্র : হাফেয ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল বার্র আল-আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন, وقالت طائفة من أهل الحديث، ‘আহলেহাদীছদের একটি দল বলেছে...’।[39]
৩৪. ইবনু তায়মিয়া : হাফেয ইবনু তায়মিয়া আল-হার্রানী (মৃঃ ৭২৮ হিঃ) একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، أَمَّا الْبُخَارِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ فَإِمَامَانِ فِي الْفِقْهِ مِنْ أَهْلِ الِاجْتِهَادِ. وَأَمَّا مُسْلِمٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَه وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَأَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ وَنَحْوُهُمْ فَهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيثِ. لَيْسُوا مُقَلِّدِينَ لِوَاحِدٍ بِعَيْنِهِ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَلَا هُمْ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْمُجْتَهِدِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ- ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। ইমাম বুখারী ও আবুদাঊদ ফিক্বহের ইমাম ও মুজতাহিদ (মুত্বলাক্ব) ছিলেন। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে খুযায়মাহ, আবু ই‘য়ালা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। আর তারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বও ছিলেন না’।[40]
সতর্কীকরণ : উক্ত বড় বড় মুহাদ্দিছ ইমামগণের সম্পর্কে ইমাম ইবনে তায়মিয়ার এমনটা বলা যে, ‘তারা কোন মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন না’ অগ্রহণযোগ্য।
৩৫. ইবনে রশীদ : ইবনে রশীদ আল-ফিহরী (মৃঃ ৭২১ হিঃ) ইমাম আইয়ূব আস-সিখতিয়ানী এবং অন্যান্য বড় বড় আলেমদের সম্পর্কে বলেছেন, من أهل الحديث ‘তারা আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[41]
৩৬. ইবনুল ক্বাইয়িম : হাফেয ইবনুল কবাইয়িম (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) স্বীয় প্রসিদ্ধ ‘ক্বাছীদা নূনিয়া’তে লিখেছেন,
يا مبغضا أهل الحديث وشاتما * أبشر بعقد ولاية الشيطان
‘হে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ও গালি প্রদানকারী! তুমি শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের সুসংবাদ গ্রহণ কর’।[42]
৩৭. ইবনু কাছীর : হাফেয ইসমাঈল ইবনে কাছীর আদ-দিমাশক্বী (মৃঃ ৭৭৪ হিঃ) সূরা বনু ইসরাঈলের ৭১ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন, وقال بعض السلف: هذا أكبر شرف لأصحاب الحديث؛ لأن إمامهم النبي صلى الله عليه وسلم. ‘কতিপয় সালাফ বলেছেন, আহলেহাদীছদের জন্য এটি সবচেয়ে বড় মর্যাদা। কেননা তাদের ইমাম হ’লেন নবী করীম (ছাঃ)’।[43]
৩৮. ইবনুল মুনাদী : ইমাম ইবনুল মুনাদী আল-বাগদাদী (মৃঃ ৩৩৬ হিঃ) ক্বাসেম বিন যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া আল-মুতার্রিয সম্পর্কে বলেছেন, وكان من أهل الحديث والصدق ‘তিনি আহলেহাদীছ ও সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[44]
৩৯. শীরাওয়াইহ আদ-দায়লামী : দায়লামের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইমাম শীরাওয়াইহ (মৃঃ ৫০৯ হিঃ) বিন শাহারদার আদ-দায়লামী আব্দূস (আব্দুর রহমান) বিন আহমাদ বিন আববাদ আছ-ছাক্বাফী আল-হামাদানী সম্পর্কে স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন, روى عنه عامت أهل الحديث ببلدنا وكان ثقت متقنا- ‘আমাদের এলাকার আম আহলেহাদীছগণ তার থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন’।[45]
৪০. মুহাম্মাদ বিন আলী আছ-ছূরী : বাগদাদের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আছ-ছূরী (মৃঃ ৪৪১ হিঃ) বলেছেন,
قل لمن عاند الحديث * وأضحى عائبا أهله ومن يدعيه
أبعلم تقول هذا، أبن لي * أم بجهل فالجهل خلق السفيه
أيعاب الذين هم حفظوا * الدين من الترهات والتمويه-
‘হাদীছের সাথে শত্রুতা পোষণকারী এবং আহলেহাদীছদেরকে দোষারোপকারীদেরকে বলে দাও! আমাকে বল যে, তুমি কি জেনে-বুঝে নাকি অজ্ঞতাবশে এমনটি বলছ? আর অজ্ঞতা তো নির্বোধের স্বভাব। তাদেরকে কি দোষারোপ করা যায়, যারা দ্বীনকে বাতিল ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা থেকে হেফাযত করেছে’?[46]
৪১. সুয়ূত্বী : يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ‘(স্মরণ কর) যেদিন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা (অর্থাৎ নবী অথবা আমলনামা সহ) আহবান করব’ (বনু ইসরাঈল ৭১) আয়াতের ব্যাখ্যায় জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেন, ليس لأهل الحديث منقبة أشرف من ذلك لأنه لا إمام لهم غيره- ‘আহলেহাদীছদের জন্য এর চাইতে অধিক ফযীলতপূর্ণ বক্তব্য আর নেই। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া আহলেহাদীছদের কোন ইমাম নেই’।[47]
৪২. ক্বিওয়ামুস সুন্নাহ : ক্বিওয়ামুস সুন্নাহ (হাদীছের ভিত্তি) খ্যাত ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ ইবনুল ফযল (মৃঃ ৫৩৫ হিঃ) ইস্পাহানী বলেছেন, ذكر أهل الحديث وأنهم الفرقة الظاهرة على الحق إلى أن ةقوم الساعة- ‘আহলেহাদীছদের বর্ণনা। আর এরাই ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে’।[48]
৪৩. রামহুরমুযী : কাযী হাসান বিন আব্দুর রহমান বিন খাল্লাদ আর-রামহুরমুযী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) বলেছেন, وقد شرف الله الحديث وفضل أهله ‘আল্লাহ হাদীছ ও আহলেহাদীছদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন’।[49]
৪৪. হাফছ বিন গিয়াছ : হাফছ বিন গিয়াছ (মৃঃ ১৯৪ হিঃ)-কে আছহাবুল হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা (আহলেহাদীছ) দুনিয়ার মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি’।[50]
৪৫. নাছর বিন ইবরাহীম আল-মাক্বদেসী : আবুল ফাতহ নাছর বিন ইবরাহীম আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৪৯০ হিঃ) লিখেছেন, باب فضيلة أهل الحديث، ‘আহলেহাদীছদের মর্যাদা সম্পর্কে অনুচ্ছেদ’।[51]
৪৬. ইবনু মুফলিহ : আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন মুফলিহ আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৭৬৩ হিঃ) বলেছেন, أهل الحديث هم الطائفة الناجية القائمون على الحق- ‘আহলেহাদীছরাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যারা হক্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত আছেন’।[52]
৪৭. আল-আমীর আল-ইয়ামানী : মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-আমীর আল-ইয়ামানী (মৃঃ ১১৮২ হিঃ) বলেছেন, عليك بأصحاب الحديث الأفاضل تجد عندهم كل الهدي والفضائل- ‘মর্যাদাবান আহলেহাদীছদেরকে অাঁকড়ে ধরবে। তুমি তাদের নিকটে সব ধরনের হেদায়াত ও গুণাবলী পাবে’।[53]
৪৮. ইবনুছ ছালাহ : ছহীহ হাদীছের সংজ্ঞা প্রদানের পরে হাফেয ইবনুছ ছালাহ আশ-শাহরাযূরী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ) লিখেছেন, فهذا هو الحديث الذي يحكم له بالصحة بلا خلاف بين أهل الحديث، ‘এটি ঐ হাদীছ, যাকে ছহীহ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে আহলেহাদীছদের মাঝে কোন মতভেদ নেই’।[54]
৪৯. আছ-ছাবূনী : আবূ ইসমাঈল আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ) عقيدة السلف أصحاب الحديث ‘সালাফ : আহলেহাদীছদের আক্বীদা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন । এতে তিনি বলেছেন, ويعتقد أهل الحديث ويشهدون أن الله سبحانه وتعالى فوق سبع سماوات على عرشه- ‘আহলেহাদীছগণ এ আক্বীদা পোষণ করেন এবং (এ কথার) সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সাত আসমানের উপরে তাঁর আরশের উপরে রয়েছেন’।[55]
৫০. আব্দুল ক্বাহির আল-বাগদাদী : আবূ মানছূর আব্দুল ক্বাহির বিন ত্বাহের বিন মুহাম্মাদ আল-বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) সিরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, كلهم على مذهب أهل الحديث من أهل السنة ‘তারা সকলেই আহলুস সুন্নাহ-এর মধ্য থেকে আহলুল হাদীছ-এর মাযহাবের উপরে আছেন’।[56]
উক্ত ৫০টি উদ্ধৃতি দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, মুহাজির, আনছার এবং আহলে সুন্নাত-এর মতই মুসলমানদের অন্যতম গুণবাচক নাম ও উপাধি হ’ল ‘আহলেহাদীছ’। এই (আহলেহাদীছ) উপাধিটি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। কোন একজন ইমামও আহলেহাদীছ নাম ও উপাধিকে কখনো ভুল, নাজায়েয বা বিদ‘আত বলেননি। এজন্য কতিপয় খারেজী এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিদের আহলেহাদীছ নামটিকে অপসন্দ করা, এটাকে বিদ‘আত এবং দলবাজি বলে আখ্যায়িত করে হাসি-ঠাট্টা করা আসলে সকল মুহাদ্দিছ এবং মুসলিম উম্মাহর ইজমার বিরোধিতা করার শামিল।[57]
এগুলো ব্যতীত আরো অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে। যেগুলোর দ্বারা ‘আহলুল হাদীছ’ বা ‘আছহাবুল হাদীছ’ প্রভৃতি গুণবাচক নামসমূহের প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্মানিত মুহাদ্দিছগণের উক্ত সুস্পষ্ট বক্তব্য সমূহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছ ঐ সকল ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুহাদ্দিছ ও সাধারণ জনগণের উপাধি, যারা তাক্বলীদ ছাড়াই সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে কুরআন ও সুন্নাহর উপরে আমল করেন। আর তাদের আক্বীদা সম্পূর্ণরূপে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার অনুকূলে। স্মর্তব্য যে, আহলেহাদীছ ও আহলে সুন্নাত একই দলের গুণবাচক নাম।
কতিপয় বিদ‘আতী একথা বলে যে, শুধু মুহাদ্দিছগণকেই ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়ে থাকে। চাই তিনি (মুহাদ্দিছ) আহলে সুনণাতের মধ্য থেকে হোন বা বিদ‘আতীদের মধ্য থেকে হোন। তাদের এ বক্তব্য সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীত হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। বিদ‘আতীদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা একথা মেনে নেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় যে, পথভ্রষ্ট লোকদেরকেও ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বলে অভিহিত করতে হবে। অথচ এ ধরনের বক্তব্য বাতিল হওয়ার বিষয়টি সাধারণ জনগণের কাছেও পরিষ্কার। কতিপয় রাবীর ব্যাপারে স্বয়ং মুহাদ্দিছগণ একথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি আহলেহাদীছের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।[58]
দুনিয়ার প্রত্যেক বিদ‘আতী আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। তবে কি প্রত্যেক বিদ‘আতীই নিজের প্রতিও ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে? অতএব হক এটাই যে, ‘আহলেহাদীছ’-এর বৈশিষ্ট্যগত নাম ও উপাধির হকদার স্রেফ দু’শ্রেণীর লোক। ১. হাদীছ বর্ণনাকারীগণ (মুহাদ্দিছগণ)। ২. হাদীছের উপরে আমলকারীগণ (মুহাদ্দিছগণ এবং তাঁদের অনুসারী সাধারণ জনগণ)। হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলছেন,ونحن لا نعني بأهل الحديث المقتصرين على سماعه أو كتابته أو روايته بل نعني بهم : كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهراً وباطناً واتباعه باطناً وظاهراً وكذلك أهل القرآن- ‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবিদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার। অনুরূপভাবে আহলে কুরআনও’।[59] হাফেয ইবনে তায়মিয়ার উক্ত বক্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ দ্বারা মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ উদ্দেশ্য।
পরিশেষে নিবেদন এই যে, আহলেহাদীছ কোন বংশানুক্রমিক ফিরক্বা নয়। বরং এটি একটি আদর্শিক জামা‘আত। প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি আহলেহাদীছ, যিনি কুরআন, হাদীছ ও ইজমার উপরে সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে আমল করেন এবং এর উপরেই স্বীয় বিশ্বাস পোষণ করেন। আর নিজেকে আহলেহাদীছ (আহলে সুন্নাত) বলার অর্থ আদৌ এটা নয় যে, এখন এই ব্যক্তি জান্নাতী হয়ে গেছে। এখন নেক আমল সমূহ বর্জন, প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং নিজের মন মতো জীবন যাপন করা যাবে। বরং ঐ ব্যক্তিই সফলকাম, যিনি আহলেহাদীছ (আহলে সুন্নাত) নামের মর্যাদা রক্ষা করে স্বীয় পূর্বসূরীদের মতো কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করবেন। প্রকাশ থাকে যে, মুক্তির জন্য কেবল নামের লেবেলই যথেষ্ট নয়। বরং হৃদয় ও মস্তিষ্কের পবিত্রতা এবং ঈমান ও আক্বীদার পরিশুদ্ধিতার সাথে সাথে সৎ কর্ম সমূহের উপরেই কেবল নাজাত নির্ভরশীল। এরূপ ব্যক্তিই আল্লাহর অনুগ্রহে চিরস্থায়ী মুক্তির হকদার হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ; আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ, ১/২৪৬।
[2]. আত-তারীখুল কাবীর, ৬/৪২৯; আয-যু‘আফাউছ ছাগীর, পৃঃ ২৮১।
[3]. ছহীহ মুসলিম, ভূমিকা, পৃঃ ৬ (প্রথম অনুচ্ছেদের আগে); অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/৫।
[4]. ঐ।
[5]. ছহীহ মুসলিম, ভূমিকা, পৃঃ ২২, ‘মু‘আন‘আন’ হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করার বিশুদ্ধতা’ অনুচ্ছেদ; অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/২৬; তৃতীয় আরেকটি সংস্করণ, ১/২৩।
[6]. ইমাম বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ১/২৬০, সনদ ছহীহ।
[7]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৮৫, সনদ ছহীহ।
[8]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ২, হা/২, সনদ হাসান; ইবনু হাজার আসক্বালানী এটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ফাৎহুল বারী, ১৩/২৯৩, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা।
[9]. মুসনাদু আলী ইবনুল জা‘দ, হা/১৩৫৪, ১/৫৯৪; সনদ ছহীহ; আরেকটি সংস্করণের হাদীছ নং ১৩১৪; ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল, ৪/১২৫, সনদ ছহীহ।
[10]. আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল, ৬/৩০৩, সনদ ছহীহ।
[11]. তিরমিযী, হা/ ৮৮।
[12]. রিসালাতু আবী দাঊদ ইলা মাক্কা ফী ওয়াছফি সুনানিহি, পৃঃ ৩০; পান্ডুলিপি, পৃঃ ১।
[13]. নাসাঈ, হা/৪১৪৭, ৭/১৩৫; আত-তা‘লীক্বাতুস সালাফিইয়াহ, হা/৪১৫২। [এখানে হাদীছকে অস্বীকারকারী প্রচলিত ‘আহলে কুরআন’ নামক ভ্রান্ত দলটিকে বুঝানো হয়নি। আর যারা হাদীছকে অস্বীকার করে তাদেরকে আহলে কুরআন বলে সম্বোধন করাও ঠিক নয়। কারণ তারা কুরআনের অনুসরণ করে না; বরং তারা প্রবৃত্তিপূজারী-অনুবাদক]।
[14]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ, হা/৩১, ১/২১।
[15]. ছহীহ ইবনে হিববান, আল-ইহসান, হা/৫৬৬; আরেকটি সংস্করণ, হা/ ৫৬৫; [যারা মহান আল্লাহর ছিফাতসমূহকে অস্বীকার করে তাদেরকে মু‘আত্তিলা বলা হয়।-অনুবাদক]।
[16]. ছহীহ ইবনে হিববান, আল-ইহসান, হা/৬১২৯; অন্য আরেকটি সংস্করণ, হা/৬১৬২; আরো দেখুন : আল-ইহসান, ১/১৪০, ৬১ নং হাদীছের পূর্বে।
[17]. মুসনাদু আবী ‘আওয়ানাহ, ১/৪৯।
[18]. মা‘রিফাতুছ ছিক্বাত, ১/৪১৭; নং ৬৩১; আরেকটি সংস্করণের নং ৫৭৭।
[19]. আল-মুস্তাদরাক, হা/৭১০, ১/১৯৮।
[20]. দেখুন: মাসিক ‘আল-হাদীছ’, ৯ম সংখ্যা, পৃঃ ৪-২৮।
[21]. আল জারহু ওয়াত তা‘দীল, ১/৬০, সনদ ছহীহ।
[22]. ইবনে আদী, আল-কামিল, ১/২৭১; আরেকটি সংস্করণ, ১/৪৪০, সনদ ছহীহ।
[23]. কিতাবুল মারাসীল, পৃঃ ১৯২, অনুচ্ছেদ ৭০৩।
[24]. আবু ওবাইদ, কিতাবুত তুহূর, পৃঃ ১৭৪; ইবনুল মুনযির, আল-আওসাত্ব, ১/২৬৫।
[25]. মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-আজুর্রী, কিতাবুশ শরী‘আহ, পৃঃ ৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[26]. আল-আহাদ ওয়াল মাছানী, ১/৪২৮, হা/৬০৪।
[27]. ইবনে শাহীন, তারীখু আসমাইছ ছিক্বাত, হা/১০৮৪।
[28]. আহওয়ালুর রিজাল, পৃঃ ৪৩, রাবী নং ১০। আরো দেখুন : পৃঃ ২১৪।
[29]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, নং ৬, সনদ ছহীহ।
[30]. তিরমিযী, হা/২২২৯; আরিযাতুল আহওয়াযী, ৯/৭৪।
[31]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, সনদ ছহীহ।
[32]. বায়হাক্বী, কিতাবুল ই‘তিকাদ ওয়াল হিদায়াহ ইলা সাবীলির রাশাদ, পৃঃ ১৮০।
[33]. মুহাম্মাদ বিন জিবরীল আন-নিসবী, কিতাবুল মু‘জাম, ১/৪৬৯, নং ১২১।
[34]. তারীখু বাগদাদ, ১/২২৪, নং ৫১।
[35]. আল-মুস্তাখরাজ আলা ছহীহ মুসলিম, ১/৬৭, অনুচ্ছেদ ৮৯।
[36]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৯/১১২।
[37]. দেখুন: আল-আওসাত্ব, ২/৩০৭, হা/৯১৫-এর আলোচনা।
[38]. আশ-শারী‘আহ, পৃঃ ৩; অন্য আরেকটি সংস্করণ, পৃঃ ৭।
[39]. আত-তামহীদ, ১/১৬।
[40]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২০/৪০।
[41]. আস-সুনানুল আবয়ান, পৃঃ ১১৯, ১২৪।
[42]. আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ ফিল ইনতিছার লিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ, পৃঃ ১৯৯, ‘নিশ্চয়ই আহলেহাদীছরাই রাসূল (ছাঃ)-এর সাহায্যকারী এবং তাদের বৈশিষ্ট্য’ অনুচ্ছেদ।
[43]. ইবনে কাছীর, ৪/১৬৪।
[44]. তারীখু বাগদাদ, ১২/৪৪১, নং ৬৯১০, সনদ হাসান।
[45]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৪/৪৩৮। আল-হামাদানীর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা সঠিক। কারণ যাহাবী তার কিতাব হ’তে বর্ণনা করেন।
[46]. যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায, ৩/১১১৭, নং ১০০২, সনদ হাসান; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৭/৬৩১; ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম, ১৫/৩২৪।
[47]. তাদরীবুর রাবী, ২/১২৬, ২৭তম প্রকার।
[48]. আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ ওয়া শারহু আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ, ১/২৪৬।
[49]. আল-মুহাদ্দিছুল ফাছিল বাইনার রাবী ওয়াল ওয়া‘ঈ, পৃঃ ১৫৯, নং ১।
[50]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, হা/৩, সনদ ছহীহ।
[51]. আল-হুজ্জাতু ‘আলা তারিকিল মাহাজ্জাহ, ১/৩২৫।
[52]. আল-আদাবুশ শারঈয়াহ, ১/২১১।
[53]. আর-রাওযুল বাসিম ফিয যাবিব আন সুন্নাতি আবিল ক্বাসিম, ১/১৪৬।
[54]. মুক্বাদ্দামা ইবনুছ ছালাহ (ইরাকীর ব্যাখ্যা সহ), পৃঃ ২০।
[55]. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ১৪।
[56]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩১৭।
[57]. এই সাথে পাঠ করুন বিগত যুগের ৩০৪ জন শ্রেষ্ঠ আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের তালিকা মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বিরচিত ডক্টরেট থিসিস ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’ পৃঃ ৫০-৫২ এবং ৬৬-৭৩।-অনুবাদক।
[58]. ৫, ২১ ও ২৮ নং উদ্ধৃতি দ্রঃ।
[59]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার জবাব
ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছীনে কেরাম এবং তাক্বলীদ ব্যতীত সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারীদের উপাধি ও বৈশিষ্ট্যগত নাম ‘আহলেহাদীছ’। আহলেহাদীছদের নিকটে কুরআন মাজীদ, ছহীহ হাদীছসমূহ (সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী) এবং ইজমা হ’ল শারঈ দলীল। এগুলিকে ‘আদিল্লায়ে শারঈয়াহ’ও বলা হয়ে থাকে। ‘আদিল্লায়ে শারঈয়াহ’ দ্বারা ইজতিহাদের বৈধতা প্রমাণিত। আর ইজতিহাদের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে।
১. কুরআন ও সুন্নাহর ‘উমূম’ (ব্যাপকতা) ও ‘মাফহূম’ (মর্ম) দ্বারা দলীল পেশ করা।
২. সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল প্রদান করা।
৩. আদিল্লায়ে শারঈয়াহর বিরোধী নয় এমন ক্বিয়াস।
৪. মাছালিহে মুরসালাহ প্রভৃতি।[1]
আহলেহাদীছদের নিকটে ইজতিহাদ জায়েয। এজন্য তিনটি শারঈ দলীল দ্বারা দলীল পেশের পরে চতুর্থ দলীলের উপরেও আমল জায়েয রয়েছে। এ শর্তে যে, তা কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও সালাফে ছালেহীনের আছার-এর বিরোধী হবে না। অন্য কথায় আহলেহাদীছদের নিকটে আদিল্লায়ে আরবা‘আহ (কুরআন, হাদীছ, ইজমা, ইজতিহাদ) উপরোল্লিখিত মর্মানুসারে হুজ্জাত বা দলীল।
সতর্কীকরণ : ইজতিহাদ আকস্মিক ও সাময়িক হয়ে থাকে। এজন্য ইজতিহাদকে স্থায়ী বিধানের মর্যাদা দেয়া যায় না। আর না একজন ব্যক্তির ইজতিহাদকে অন্য ব্যক্তির জন্য স্থায়ী ও অপরিহার্য দলীল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। উক্ত ভূমিকার পরে কিছু মানুষের আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও ধোঁকাবাজির জবাব পেশ করা হ’ল।
সমালোচনা-১ : ‘আহলেহাদীছদের নিকটে শারঈ দলীল স্রেফ দু’টি। ১. কুরআন ২. হাদীছ। তৃতীয় কোন দলীল নেই’।
জবাব : নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لا يجمع الله أمتي على ضلالة أبدا ‘আল্লাহ আমার উম্মতকে কখনো গোমরাহীর উপরে ঐক্যবদ্ধ করবেন না’।[2] এই হাদীছ দ্বারা ইজমায়ে উম্মত (উম্মতের ইজমা)-এর দলীল হওয়া প্রমাণিত হয়।[3]
হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী মুহাদ্দিছ (মৃঃ ১৩৩৭ হিঃ) বলেন, ‘এর দ্বারা কেউ যেন এটা না বুঝেন যে, আহলেহাদীছরা ইজমায়ে উম্মত ও ক্বিয়াসে শারঈকে অস্বীকার করে। কেননা যখন এ দু’টি বস্ত্ত কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হবে, তখন কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করলেই ইজমা ও ক্বিয়াসকে মানা হয়ে যাবে’।[4]
প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছদের নিকটে ইজমায়ে উম্মত (যদি প্রমাণিত হয়) শারঈ দলীল। এ কারণেই মাসিক ‘আল-হাদীছ’ (হাযরো) পত্রিকার প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাতেই লেখা থাকত যে, ‘কুরআন, হাদীছ ও ইজমার বার্তাবাহক’। এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে, আহলেহাদীছদের নিকটে ইজতিহাদ জায়েয। যেমনটা ভূমিকায় আলোচনা করা হয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।
সমালোচনা-২ : আহলেহাদীছদের নিকটে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে যে, সে সালাফে ছালেহীনের বুঝের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও হাদীছ বুঝার চেষ্টা করবে।
জবাব : এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল। বরং এর বিপরীতে হাফেয আব্দুল্লাহ রোপড়ী (মৃঃ ১৩৮৪ হিঃ) বলেন, ‘সারকথা এই যে, আমরা তো একটা কথাই জানি। তা এই যে, সালাফের খেলাফ (বিপরীত) করা নাজায়েয’।[5]
প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছদের নিকটে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও হাদীছকে বুঝতে হবে এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীতে ব্যক্তিগত বুঝকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে হবে। এ কারণেই মাসিক ‘আল-হাদীছ’ পত্রিকার প্রায় প্রত্যেক সংখ্যার শেষে লেখা থাকত যে, ‘সালাফে ছালেহীনের সর্বসম্মত বুঝের প্রচার’।
সমালোচনা-৩ : আহলেহাদীছদের নিকটে শুধু ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমই দলীল। তাঁরা অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থসমূহকে মানে না।
জবাব : এই অভিযোগও ভিত্তিহীন। কারণ আহলেহাদীছদের নিকটে ছহীহ হাদীছ সমূহ দলীল। চাই সেগুলো ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে থাকুক বা সুনানে আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থ সমূহে ছহীহ ও হাসান লি-যাতিহি সনদে মওজুদ থাকুক। মাসিক ‘আল-হাদীছ’ সহ আমাদের সকল গ্রন্থ এ কথার সাক্ষী যে, আমরা ছহীহায়েনের পাশাপাশি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থাবলীর ছহীহ বর্ণনা সমূহ দ্বারাও দলীল পেশ করে থাকি।
সমালোচনা-৪ : আহলেহাদীছরা তাক্বলীদ করে না।
জবাব : জ্বী হ্যাঁ। আহলেহাদীছরা তাক্বলীদ করে না। কারণ তাক্বলীদ জায়েয বা ওয়াজিব হওয়ার কোন প্রমাণ কুরআন, হাদীছ ও ইজমায় নেই। আর সালাফে ছালেহীনের আছার সমূহ দ্বারাও তাক্বলীদ প্রমাণিত নয়। বরং মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন,وأما زلة عالم ، فإن اهتدى فلا تقلدوه دينكم ‘আলেমের ভুলের ব্যাপারে বক্তব্য হ’ল, যদি তিনি হেদায়াতের উপরেও চলেন, তবুও তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করো না’।[6] আহলে সুন্নাতের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (রহঃ) নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন।[7]
আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ আলেম হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন যে, وإنما حدثت هذه البدعة في القرن الرابع ‘এই (তাক্বলীদের) বিদ‘আত চতুর্থ (হিজরী) শতকে সৃষ্টি হয়েছে’।[8]
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন ও সুন্নাহর উপরে আমল করা এবং বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাকার মধ্যেই ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভের নিশ্চয়তা রয়েছে।
সমালোচনা-৫ : ওয়াহীদুয্যামান হায়দারাবাদী এটা লিখেছেন এবং নওয়াব ছিদ্দীক্ব হাসান খান ওটা লিখেছেন। নূরুল হাসান এটা লিখেছেন এবং বাটালভী ওটা লিখেছেন।
জবাব : ওয়াহীদুযযামান, নওয়াব ছিদ্দীক্ব হাসান খান, নূরুল হাসান, বাটালভী যেই হোন না কেন, এদের কেউই আহলেহাদীছদের আকাবের-এর অন্তর্ভুক্ত নন। যদি হ’তেন তবুও আহলেহাদীছরা আকাবের পূজারী নয়।
ওয়াহীদুযযামান ছাহেব তো একজন প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন।[9] দেওবন্দী মুক্বাল্লিদ মাস্টার আমীন উকাড়বী এ কথা স্বীকার করেছেন যে, আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা ও সাধারণ জনগণ সর্বসম্মতিক্রমে ওয়াহীদুযযামান ও অন্যদের গ্রন্থগুলোকে ভুল আখ্যা দিয়ে সেগুলোকে নাকচ করেছেন।[10]
শাববীর আহমাদ ওছমানী দেওবন্দীর নিকটে ওয়াহীদুযযামান-এর (ছহীহ বুখারীর) অনুবাদ পসন্দনীয় ছিল।[11] ওয়াহীদুযযামান ছাহেব সাধারণ মানুষের জন্য তাক্বলীদকে ওয়াজিব মনে করতেন।[12] এজন্য ওয়াহীদুযযামানের সকল উদ্ধৃতি দেওবন্দী ও তাক্বলীদপন্থীদের বিপক্ষে পেশ করা উচিত। নওয়াব ছিদ্দীক্ব হাসান খান ছাহেব (তাক্বলীদ না করা) হানাফী ছিলেন।[13]
নূরুল হাসান একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি এবং তার দিকে সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ আহলেহাদীছদের নিকটে গ্রহণযোগ্য গ্রন্থসমূহের তালিকাতে নেই। বরং এ সকল গ্রন্থে ফাতাওয়া বিহীন ও আমলবিহীন বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে সেগুলো প্রত্যাখ্যাত।
মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (রহঃ) আহলেহাদীছ আলেম ছিলেন। তবে তিনি আকাবের-এর মধ্যে ছিলেন না। বরং একজন সাধারণ আলেম ছিলেন। যিনি সর্বপ্রথম মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে কাফের ফৎওয়া দিয়েছিলেন। তাঁর ‘আল-ইক্বতিছাদ’ গ্রন্থটি পরিত্যাজ্য গ্রন্থ সমূহের অন্তর্ভুক্ত। বাটালভী ছাহেবের জন্মের শত শত বছর পূর্ব থেকেই দুনিয়ার বুকে আহলেহাদীছ মওজুদ ছিল।[14]
সারকথা এই যে, উক্ত আলেম-ওলামা ও অন্যান্য ছোট-খাটো আলেমদের বক্তব্যকে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে পেশ করা মস্তবড় যুলুম। যদি কিছু পেশ করতেই হয় তাহ’লে আহলেহাদীছদের বিপক্ষে কুরআন মাজীদ, ছহীহ হাদীছ সমূহ, ইজমা এবং সালাফে ছালেহীন যেমন ছাহাবী, নির্ভরযোগ্য তাবেঈ ও তাবে তাবেঈ এবং বড় বড় মুহাদ্দিছগণের বক্তব্য পেশ করুক। অন্যথায় দাঁতভাঙ্গা জবাব পাবে ইনশাআল্লাহ।
সতর্কীকরণ : আহলেহাদীছদের নিকটে কুরআন, হাদীছ ও ইজমার সুস্পষ্ট বিরোধী সকল বক্তব্যই প্রত্যাখ্যাত। চাই সেগুলোর বর্ণনাকারী অথবা সেগুলোর লেখক যত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিই হোন না কেন।
সমালোচনা-৬ : ‘মুফতী’ আব্দুল হাদী দেওবন্দী ও অন্যেরা লিখেছেন যে, ‘এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য যে, গায়ের মুক্বাল্লিদীনের (যারা নিজেদেরকে আহলেহাদীছ বলে) অস্তিত্ব ইংরেজদের আমলের আগে ছিল না’।[15]
জবাব : দুই শ্রেণীর লোকদেরকে আহলেহাদীছ বলা হয়। ১. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন (নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী) মুহাদ্দিছীনে কেরাম, যারা তাক্বলীদের প্রবক্তা নন। ২. মুহাদ্দিছীনে কেরামের অনুসারী ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণ। যারা তাক্বলীদ ছাড়াই কুরআন ও সুন্নাহর উপরে আমল করে। এই দুই শ্রেণী খায়রুল কুরূন (সোনালী যুগ) থেকে অদ্যাবধি প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান রয়েছে।
প্রথম দলীল : ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে তাক্বলীদে শাখছী ও তাক্বলীদে গায়ের শাখছীর কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। বরং মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন, ‘আলেমের ভুলের ব্যাপারে বক্তব্য হ’ল, যদি তিনি হেদায়াতের উপরেও চলেন, তবুও তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করবে না’।[16] ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, لاتقلدوا دينكم الرجال ‘তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে লোকদের তাক্বলীদ করো না’।[17]
কোন ছাহাবীই তাদের বক্তব্যের বিরোধী নেই। এজন্য প্রমাণিত হ’ল যে, এ বিষয়ে ছাহাবীগণের ইজমা রয়েছে যে, তাক্বলীদ নিষিদ্ধ। আর এটাও প্রমাণিত হ’ল যে, সকল ছাহাবী আহলেহাদীছ ছিলেন। স্মর্তব্য যে, এই ইজমার বিরোধিতাকারী ও অস্বীকারকারীরা যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করে থাকেন, তাতে ‘তাক্বলীদ’ শব্দটি নেই।
দ্বিতীয় দলীল : প্রসিদ্ধ উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন তাবেঈ ইমাম শা‘বী (রহঃ) বলেছেন, ما حدثوك هؤلاء عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فخذ به وما قالوه برأيهم فالقه في الحش (স্তূপে) ছুঁড়ে মারো’।[18]
ইবরাহীম নাখঈর সামনে জনৈক ব্যক্তি সাঈদ বিন জুবায়ের (রহঃ)-এর মন্তব্য পেশ করলে তিনি বলেন, ما تصنع بحديث سعيد بن جبير مع قول رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের মোকাবিলায় সাঈদ বিন জুবায়ের-এর বক্তব্য দিয়ে তুমি কি করবে?’[19]
কোন একজন তাবেঈ থেকেও তাক্বলীদ জায়েয বা ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত নয়। এজন্য উক্ত উদ্ধৃতি সমূহ এবং অন্যান্য উক্তি দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, তাক্বলীদ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে তাবেঈগণেরও ইজমা রয়েছে। আর এটা একথার সুস্পষ্ট দলীল যে, সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন নির্ভরযোগ্য তাবেঈগণ আহলেহাদীছ ছিলেন।
তৃতীয় দলীল : তাবে তাবেঈ হাকাম বিন উতায়বা বলেন, ليس أحد من الناس إلا وأنت آخذ من قوله أو تارك إلا النبي صلى الله عليه وسلم ‘তুমি প্রত্যেক ব্যক্তির কথাকে গ্রহণ করতে পারো, আবার বর্জনও করতে পারো। কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর কথা ব্যতীত’।[20]
তাবে তাবেঈনের কোন একজন নির্ভরযোগ্য তাবে তাবেঈ থেকে তাক্বলীদে শাখছী ও তাক্বলীদে গায়ের শাখছীর কোন প্রমাণ নেই। এজন্য এ বিষয়েও ইজমা রয়েছে যে, সকল নির্ভরযোগ্য ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন তাবে তাবেঈন আহলেহাদীছ ছিলেন।
চতুর্থ দলীল : তাবে তাবেঈনের অনুসারীদের মধ্য হ’তে একটি জামা‘আত তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (রহঃ) নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন।[21] ইমাম শাফেঈ বলেছেন, لا تقلدوني ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ করো না’।[22] ইমাম আহমাদ বলেছেন,لا تقلد دينك أحدا من هؤلاء ‘তোমার দ্বীনের ব্যাপারে তাদের মধ্য হ’তে কোন একজনেরও তাক্বলীদ করো না’।[23]
একটি ছহীহ হাদীছে আছে যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ (হক্বপন্থীদের প্রকৃত দল) সর্বদাই হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। এর ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন, ‘অর্থাৎ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল আহলেহাদীছ’।[24]
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ বলেছেন, إذا رأيت الرجل يحب أهل الحديث، ... فإنه على السنة ‘তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে আহলেহাদীছদেরকে ভালোবাসতে দেখ, ... (তখন জানবে যে,) সেই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে আছে’।[25]
ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَهُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[26]
প্রমাণিত হ’ল যে, সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য আতবায়ে তাবে তাবেঈন (তাবে তাবেঈগণের অনুসারীগণ) আহলেহাদীছ ছিলেন এবং তাঁরা তাক্বলীদ করতেন না। বরং তাঁরা অন্যদেরকেও তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করতেন।
পঞ্চম দলীল : হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) লিখেছেন,
أَمَّا الْبُخَارِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ فَإِمَامَانِ فِي الْفِقْهِ مِنْ أَهْلِ الْاِجْتِهَادِ. وَأَمَّا مُسْلِمٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَه وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَأَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ وَنَحْوُهُمْ فَهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيثِ. لَيْسُوا مُقَلِّدِينَ لِوَاحِدٍ بِعَيْنِهِ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَلَا هُمْ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْمُجْتَهِدِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ-
‘ইমাম বুখারী ও আবুদাঊদ ফিক্বহের ইমাম ও মুজতাহিদ (মুত্বলাক্ব) ছিলেন। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে খুযায়মাহ, আবু ই‘য়ালা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। আর তারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বও ছিলেন না’।[27]
প্রমাণিত হ’ল যে, সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিছগণ তাক্বলীদ করতেন না। বরং তাঁরা আহলেহাদীছ ছিলেন। বর্তমানে কিছু মানুষ এ দাবী করে যে, যারা মুজতাহিদ নন তাদের উপরে তাক্বলীদ ওয়াজিব। হাফেয ইবনু তায়মিয়ার উপরোল্লিখিত উক্তি দ্বারা তাদের দাবী নাকচ হয়ে যায়। কেননা উল্লিখিত মুহাদ্দিছগণ হাফেয ইবনু তায়মিয়ার দৃষ্টিতে না মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন, আর না তাক্বলীদ করতেন। স্মর্তব্য যে, ঐ সকল উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের মুজতাহিদ না হওয়ার ব্যাপারটি অগ্রহণযোগ্য।[28]
ষষ্ঠ দলীল : হিজরী তৃতীয় শতকের শেষের দিকে মৃত্যুবরণকারী ইমাম ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ আল-কুরতুবী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) তাক্বলীদের প্রতিবাদে ‘আল-ঈযাহ ফির রাদ্দি আলাল মুক্বাল্লিদীন’ (الإيضاح فى الرد على المقلدين) শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।[29]
সপ্তম দলীল : চতুর্থ হিজরী শতকে মৃত্যুবরণকারী সত্যবাদী ইমাম আবু বকর আব্দুল্লাহ বিন আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানী (মৃঃ ৩১৬ হিঃ) বলেছেন,
ولا تك من قوم تلهو بدينهم * فتطعن في أهل الحديث وتقدح
‘তুমি ঐ লোকদের দলভুক্ত হয়ো না, যারা স্বীয় দ্বীনকে নিয়ে খেল-তামাশা করে। নতুবা তুমিও আহলেহাদীছদেরকে তিরষ্কার ও দোষারোপ করবে’।[30]
অষ্টম দলীল : ৫ম হিজরী শতকে হাফেয ইবনু হাযম যাহেরী আন্দালুসী দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, ‘তাক্বলীদ হারাম’।[31]
নবম দলীল : হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ ঘোষণা করেছেন, وإنما حدثت هذه البدعة في القرن الرابع المذموم على لسان رسول الله ‘(তাক্বলীদের) এই বিদ‘আত চতুর্থ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর (পবিত্র) যবানে যেই শতক নিন্দিত’।[32]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম স্বীয় প্রসিদ্ধ ক্বাছীদাহ ‘নূনিয়াহ’তে বলেছেন,
يا مبغضا أهل الحديث وشاتما * أبشر بعقد ولاية الشيطان
‘হে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ও গালি প্রদানকারী! তুমি শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের সুসংবাদ গ্রহণ কর’।[33]
দশম দলীল : ৫ম হিজরী শতকে মৃত্যুবরণকারী আবু মানছূর আব্দুল ক্বাহের বিন ত্বাহের আত-তামীমী আল-বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) স্বীয় গ্রন্থে বলেছেন,فِيْ ثُغُوْرِ الرُّوْمِ وَالْجَزِيْرَةِ وَثُغُوْرِ الشَّامِ وَثُغُوْرِ آذَرْبَيْجَانَ وَبَابِ الْأَبْوَابِ كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ ‘রোম সীমান্ত, আলজেরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান এবং বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসী আহলে সুন্নাতের মধ্য থেকে আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন’।[34]
উল্লেখিত (ও অন্যান্য) দলীলসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছগণ ‘আহলে সুন্নাত’-এর অন্তর্ভুক্ত এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগ থেকে শুরু করে সর্বযুগেই আহলেহাদীছগণ ছিলেন। আল-হামদুলিল্লাহ।
এক্ষণে কতিপয় ইলযামী দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা হ’ল :
প্রমাণ-১ : ‘মুফতী’ রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘কাছাকাছি দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকে হক্বপন্থীদের মাঝে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা সমূহের সমাধানকল্পে সৃষ্ট মতভেদের প্রেক্ষিতে পাঁচটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ চার মাযহাব ও আহলেহাদীছ। তৎকালীন সময় হ’তে অদ্যাবধি উক্ত পাঁচটি তরীকার মধ্যেই হক্ব সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মনে করা হয়’।[35] এই দেওবন্দীর স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছগণ ১০১ এবং ২০১ হিজরী থেকে পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান রয়েছেন।
প্রমাণ-২ : তাফসীরে হক্কানীর লেখক আব্দুল হক্ব হক্কানী দেহলভী বলেছেন, ‘শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী, হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর আহলেহাদীছগণও আহলে সুন্নাতের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত’।[36] এই গ্রন্থটি কাসেম নানূতুবীর পসন্দনীয়।[37]
প্রমাণ-৩ : উপরোল্লেখিত উদ্ধৃতির আলোকে মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুবী দেওবন্দীও আহলেহাদীছদেরকে আহলে সুন্নাত হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আর আহলে সুন্নাত সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) লিখেছেন, ومن أهل السنة والجماعة مذهب قديم معروف قبل أن يخلق الله أبا حنيفة ومالكا والشافعي وأحمد فإنه مذهب الصحابة মাযহাব বিদ্যমান রয়েছে। আর সেটি হ’ল ছাহাবীগণের মাযহাব’।[38]
এই উদ্ধৃতি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছগণ আহলে সুন্নাত ভুক্ত এবং চার মাযহাবের অস্তিত্ব লাভের পূর্ব থেকে ধরার বুকে বিদ্যমান রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।
প্রমাণ-৪ : ‘মুফতী’ কিফায়াতুল্লাহ দেহলভী দেওবন্দী একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘হ্যাঁ, আহলেহাদীছগণ মুসলমান এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সাথে বিয়ে-শাদীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয। শুধু তাক্বলীদ বর্জন করাতে ইসলামে কোন যায় আসে না। এমনকি তাক্বলীদ বর্জনকারী ব্যক্তি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকেও খারিজ হয়ে যায় না’।[39]
প্রমাণ-৫ : আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘যদিচ এ বিষয়ে ইজমা উল্লেখ করা হয়েছে যে, চার মাযহাবকে বর্জন করে পঞ্চম মাযহাব সৃষ্টি করা জায়েয নয়। অর্থাৎ যে মাসআলাটি চার মাযহাব অনুসারীদের বিরোধী হবে, তার উপরে আমল করা জায়েয নয়। কারণ এই চার মাযহাবের মধ্যেই হক সীমাবদ্ধ ও সীমিত রয়েছে। কিন্তু এর পক্ষেও কোন দলীল নেই। কেননা আহলে যাহের বা যাহেরী মতবাদের লোকজন প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান রয়েছে। আর এটাও নয় যে, তারা প্রত্যেকে প্রবৃত্তিপূজারী এবং উক্ত ঐক্যমত থেকে আলাদা থাকবে। দ্বিতীয়তঃ যদি ইজমা সাব্যস্তও হয়ে যায়, তবুও তাক্বলীদে শাখছীর উপরে তো কখনো ইজমা-ই হয়নি’।[40]
পর্যালোচনার সারসংক্ষেপ : ‘মুফতী’ আব্দুল হাদী ও অন্যান্য মিথ্যুকদের বক্তব্য ‘ইংরেজদের আমলের পূর্বে আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব ছিল না’ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বাতিল। হক্বপন্থী আলেম-ওলামার উদ্ধৃতি এবং তাক্বলীদপন্থীদের স্বীকারোক্তি ও বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে যে, তাক্বলীদ না করা আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব পুণ্যময় প্রথম হিজরী শতক থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান আছে। অন্যদিকে দেওবন্দী ও তাক্বলীদপন্থী ফির্কাগুলোর অস্তিত্ব খায়রুল কুরূন-এর বরকতময় যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরে বিভিন্ন যুগে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ইংরেজদের আমলে ১৮৬৭ সালে দেওবন্দী মাযহাবের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, যদি আপনাদের হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহ’লে ইংরেজদের সাথে কেমন আচরণ করবেন? তিনি উত্তর দেন,
محكوم بنا كر ركهيں كيونكہ جب خدا نے حكومت دي تو محكوم ہی بنا كر ركهيں گے مگر ساتھ ہى اسكے نہايت راحت اور آرام سے ركھا جاےٴ گا اس لئے كہ انهوں نے ہميں آرام ٍٍپہونچايا ہے اسلام كى بهى تعليم ہے اور اسلام جيسى تعليم تو دنيا كے كسى مذہب ميں نہيں مل سكتى-
‘প্রজা বানিয়ে রাখব। কেননা যখন আল্লাহ হুকুমত দিবেন তখন তো প্রজা বানিয়েই রাখব। তবে সাথে সাথে তাদেরকে অত্যন্ত আরাম-আয়েশের মধ্যে রাখা হবে। এজন্য যে, তারা (ইংরেজরা) আমাদেরকে শান্তি দিয়েছে। (এটা) ইসলামেরও শিক্ষা। আর পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মে ইসলামের মতো শিক্ষা পাওয়া যাবে না’।[41]
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইংরেজরা দেওবন্দীদেরকে অনেক আরাম-আয়েশের মধ্যে রেখেছিল। একজন ইংরেজ যখন দেওবন্দ মাদরাসা পরিদর্শন করেন, তখন এই মাদরাসার ব্যাপারে অত্যন্ত সুধারণা প্রকাশ করে তিনি লিখেন,
يہ مدرسہ خلاف سركار نہيں بلكہ موافق سركار ممد معاون سركار ہے
‘এই মাদরাসাটি সরকার বিরোধী নয়। বরং সরকারের অনুকূলে এবং সরকারের মদদদাতা ও সাহায্যকারী’।[42]
ইংরেজ সরকারের মদদদাতা ও অনুকূল (রক্ষাকারী ও আনুকূল্য প্রদানকারী) এবং সাহায্যকারী মাদরাসা সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি। যেটি স্বয়ং দেওবন্দীগণ লিখেছেন এবং কেউ এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেনি।
সমালোচনা-৭ : ‘মুফতী’ আব্দুল হাদী দেওবন্দী ও অন্যরা বলে যে, সকল মুহাদ্দিছই মুক্বাল্লিদ ছিলেন।
জবাব : ইংরেজদের আমলে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ক্বাসেম নানূতুবীর জন্মের শত শত বছর পূর্বে হাফেয ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) মুহাদ্দিছগণের (মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ প্রমুখ) সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁরা আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তাঁরা না কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন, আর না তাঁরা মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন’।[43]
শুধু এই একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমেও আব্দুল হাদী (এবং তার সকল পৃষ্ঠপোষকের) মিথ্যাবাদী হওয়া প্রমাণিত হয়। স্মর্তব্য যে, নির্ভরযোগ্য ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের মধ্য থেকে কোন একজনেরও মুক্বাল্লিদ হওয়া প্রমাণিত নয়। ‘ত্বাবাকাতে হানাফিয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থের উদ্দেশ্য কস্মিনকালেও এটা নয় যে, ঐ সকল গ্রন্থে উল্লিখিত সকল ব্যক্তি মুক্বাল্লিদ ছিলেন। আয়নী হানাফী (!) বলেছেন, ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ অজ্ঞতার পাপ করে। আর তাক্বলীদের কারণে সকল বস্ত্তর বিপদ’।[44]
যায়লাঈ হানাফী (!) বলেছেন, ‘বস্ত্ততঃ মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং অজ্ঞতার অপরাধ করে থাকে’।[45]
সমালোচনা-৮ : ইংরেজ আমলের আগে হিন্দুস্তানে আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
জবাব : হিজরী চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আবুবকর আল-বিশারী আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৩৭৫ হিঃ) মানছূরার (সিন্ধু) অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, مذاهبهم : أكثرهم أصحاب حديث ورأيت القاضي أبا محمد المنصوري داوديًا إمامًا في مذهبه وله تدريس وتصانيف، قد صنف كتبًا عدةً حسنةً- চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেছেন’।[46]
দাঊদ বিন আলী আয-যাহেরীর মানহাজের উপরে আমলকারীদেরকে যাহেরী বলা হ’ত। তারা তাক্বলীদ থেকে দূরে ছিলেন।
আহমাদ শাহ দুর্রানীকে পরাজিতকারী মুগল বাদশাহ আহমাদ শাহ বিন নাছিরুদ্দীন মুহাম্মাদ শাহ (শাসনকাল : ১১৬১-১১৬৭হিঃ/১৭৪৮-১৭৫৩ খ্রিঃ)-এর আমলে মৃত্যুবরণকারী শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের ইলাহাবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ/১৭৫১ ইং) বলেছেন যে, ‘জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের তাক্বলীদ করা জায়েয নয়। বরং ইজতিহাদ ওয়াজিব। হিজরী চতুর্থ শতকে তাক্বলীদের বিদ‘আত সৃষ্টি হয়েছে’।[47]
শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের আরো বলেছেন,لكن أحق مذاهب اهل حديث است ‘কিন্তু আহলেহাদীছদের মাযহাব অন্যান্য মাযহাবের চেয়ে বেশী হক্ব-এর উপরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে’।[48]
প্রতীয়মান হ’ল যে, দেওবন্দ ও ব্রেলভী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই হিন্দুস্তানে আহলেহাদীছরা মওজুদ ছিল। এজন্য ‘ইংরেজদের আমলের আগে আহলেহাদীছদের অস্তিতেবর প্রমাণ পাওয়া যায় না’- এমনটা বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভ্রান্ত।[49]
সমালোচনা-৯ : আব্দুর রহমান পানিপথী বলেছেন যে, (প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ আলেম) আব্দুল হক্ব বেনারসী (সাইয়েদা) আয়েশা (রাঃ)-কে মুরতাদ বলতেন এবং বলতেন যে, আমাদের চেয়ে ছাহাবীগণের ইলম কম ছিল।[50]
জবাব : আব্দুর রহমান পানিপথী একজন কট্টর ফির্কবাবাজ মুক্বাল্লিদ এবং মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসীর কঠিন বিরোধী ছিলেন। উক্ত পানিপথী উল্লেখিত অভিযোগের কোন সূত্র মাওলানা আব্দুল হক্বের কোন গ্রন্থ থেকে পেশ করেননি। আর না এ ধরনের কোন বক্তব্য বেনারসীর কোন গ্রন্থে আছে। এজন্য আব্দুর রহমান পানিপথী গোঁড়ামি ও বিরোধিতা প্রকাশ করতে গিয়ে মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসী (রহঃ)-এর নামে মিথ্যাচার করেছেন। মুক্বাল্লিদ আব্দুল খালেকও মাওলানা আব্দুল হক্ব-এর বিরোধী গোষ্ঠীর একজন ব্যক্তি ছিলেন।
মিয়াঁ সাইয়েদ নাযীর হুসাইন দেহলভী (রহঃ)-এর শ্বশুর হওয়ার মানে আদৌ এটা নয় যে, আব্দুল খালেক ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন ও সত্যবাদী ছিলেন। বহু দেওবন্দী শ্বশুর রয়েছেন, যাদের জামাই আহলেহাদীছ। এ কথা সাধারণ মানুষ জানে যে, কোন ব্যক্তির স্বীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সূত্রবিহীন ও অপ্রমাণিত বক্তব্য পরিত্যাজ্য হয়।
মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসী সম্পর্কে আবুল হাসান নাদভীর পিতা হাকীম আব্দুল হাই (মুক্বাল্লিদ) লিখেছেন, الشيخ العالم المحدث المعمر... أحد العلماء المشهورين- ‘তিনি শায়খ, আলেম, বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ... এবং বিখ্যাত আলেমদের একজন’।[51]
এরপর হাকীম আব্দুল হাই মাওলানা আব্দুল হক্ব-এর বিরুদ্ধে কিছু ঔদ্ধত্যপূর্ণ অসার বাক্য লিপিবদ্ধ করে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয আয-যায়নাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ولم أر بعيني أفضل منه- ‘আমি আমার দু’চোখে তাঁর (আব্দুল হক্ব বেনারসী) চেয়ে উত্তম আর কাউকে দেখিনি’।[52]
‘নায়লুল আওত্বার’ গ্রন্থের লেখক মুহাম্মাদ বিন আলী আশ-শাওকানী স্বীয় ছাত্র আব্দুল হক্ব বেনারসী সম্পর্কে লিখেছেন, الشيخ العلامة... كثر الله فوائده بمنه وكرمه ونفع بمعارفه- ‘শায়খ, আল্লামা... আল্লাহ স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে তার কল্যাণকারিতা বৃদ্ধি করে দিন এবং তার জ্ঞান দ্বারা উপকৃত করুন’।[53]
সাইয়েদ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-আমীর আছ-ছান‘আনী লিখেছেন,الولد العلامة زينة أهل الاسةقامة ذو الطريقة الحميدة والخصال الشريفة المعمورة- ‘পুত্র, আল্লামা, অবিচল বান্দাদের সৌন্দর্য, প্রশংসনীয় পথের অনুসারী এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী’।[54]
আলেমদের এসব প্রশংসাসূচক বক্তব্যের পরে মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃঃ ১২৭৬ হিঃ/১৮৬০ খ্রিঃ)-এর বিরুদ্ধে আব্দুর রহমান পানিপথী, আব্দুল খালেক এবং তাক্বলীদপন্থীদের মিথ্যা প্রচারণার কি মূল্য রয়েছে?
স্মর্তব্য যে, ‘মিনা’-তে (মক্কা মুকাররমা) মৃত্যুবরণকারী মাওলানা বেনারসীর প্রতি তাক্বলীদপন্থীদের এই শত্রুতা ও ক্রোধ রয়েছে যে, তিনি তাক্বলীদের খন্ডনে ‘আদ-দুরারুল ফারীদ ফিল মানঈ আনিত তাক্বলীদ’ (الدرر الفريد فى المنع عن التقليد) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এবং তিনি তাক্বলীদের কট্টর বিরোধী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন!
সমালোচনা-১০ : আহলেহাদীছরা ইংরেজদেরকে সহায়তা করেছে।
জবাব : ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যখন মুসলমান ও কাফেররা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল, তখন আলেমদেরকে জিহাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। আলেমরা জিহাদের ব্যাপারে ফৎওয়া দিয়েছিলেন যে, در صورت مرقومہ فرض عين ہے ‘বর্ণিত অবস্থায় জিহাদ ফরযে আইন’। এই ফৎওয়ার উপরে একজন প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ আলেম সাইয়েদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর (সাবেক হানাফী এবং তাহকীকের মাধ্যমে আহলেহাদীছ) স্বাক্ষর দিবালোকের ন্যায় চমকাচ্ছে।[55]
এই ফৎওয়া প্রদানের পর যখন ইংরেজরা হিন্দুস্তান দখল করে নিয়েছিল, তখন সাইয়েদ নাযীর হুসাইনকে গ্রেফতার করে রাওয়ালপিন্ডি জেলে এক বছর যাবৎ বন্দী করে রেখেছিল। অন্যদিকে রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী ও মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুবী প্রমুখ সম্পর্কে আশিক ইলাহী মিরাঠী দেওবন্দী লিখেছেন, جيسا كہ آپ حضرات اپنى مہربان سركار كے دلى خيرخواه تهے تازيست خير خواه ہی ثابت رہے- ‘যেমনভাবে তাঁরা তাদের মহানুভব সরকারের (ইংরেজ সরকার) আন্তরিক হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তেমনিভাবে সারাজীবন তারা (ইংরেজদের) হিতাকাঙ্ক্ষী হিসাবেই থাকেন’।[56]
সারাজীবন ইংরেজ সরকারের ‘হিতাকাঙ্ক্ষী’ হিসাবে প্রমাণিত ব্যক্তিদের বুযর্গ ফযলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদী লিখেছেন, لڑنے كا كيا فائده خضر كو تو ميں انگريزوں كى صف ميں پارہا ہوں- ‘লড়াই করে কি লাভ? খিযিরকে তো আমি ইংরেজদের কাতারে দেখতে পাচ্ছি’।[57]
এ কথা অত্যন্ত বিস্ময়কর যে, খিযির (আঃ) (তাঁর মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে) কিভাবে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন? দেওবন্দীদের খিযির (আঃ)-কে ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে শামিল করা, ইতিহাসের অত্যন্ত বড় মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজি।
সতর্কীকরণ : ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ফৎওয়ায় একজন দেওবন্দীরও স্বাক্ষর নেই।
& & &
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, صاحب الحديث عندنا من يستعمل الحديث ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি, যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[58]
[চলবে]
[1]. [এর অর্থ ঐসকল কর্ম যা কল্যাণ আনয়ন করে ও ক্ষতি প্রতিরোধ করে এবং যার আদেশে বা নিষেধে শরী‘আতে কোন দলীল পাওয়া যায় না। যেমন আবুবকর (রাঃ) ও ওছমান (রাঃ)-এর সময়ে কুরআন জমা করা এবং কুরায়শী ক্বিরাআত ব্যতীত কুরআনের অন্যান্য কপি পুড়িয়ে ফেলা, মসজিদের ক্বিবলা চিহ্নিত করার জন্য পরবর্তীতে মেহরাব নির্মাণ করা, মসজিদে মিনার নির্মাণ করা, মাইক লাগানো ইত্যাদি (আবুবকর আল-জাযায়েরী, আল-ইনছাফ (মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, তাবি), পৃঃ ২২-২৫।-স.স.]
[2]. হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ১/১১৬, হা/৩৯৯, সনদ ছহীহ।
[3]. দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’, ১ম সংখ্যা, পৃঃ ৪, জুন ২০০৪ খ্রিঃ। [এখানে উম্মত বলতে ছাহাবায়ে কেরামকে বুঝানো হয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলেন, من ادعى الاجماع فهو كاذب ‘যে ব্যক্তি (ছাহাবীগণের পরে) ইজমা-এর দাবী করে সে মিথ্যাবাদী’ (ইলামুল মুওয়াকক্বেঈন ১/২৪)।-স.স.]
[4]. ইবরাউ আহলিল হাদীছ ওয়াল কুরআন, পৃঃ ৩২।
[5]. ফাতাওয়া আহলেহাদীছ, ১/১১১।
[6]. ইমাম ওয়াকী, কিতাবুয যুহদ, ১/৩০০, হা/৭১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[7]. কিতাবুল উম্ম, মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[8]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/২০৮; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩২।
[9]. দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’ (হাযরো), সংখ্যা ২৩, পৃঃ ৩৬, ৪০।
[10]. তাহকীক মাসআলায়ে তাক্বলীদ, পৃঃ ৬।
[11]. দেখুন : মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া ছিদ্দীক্বী দেওবন্দী, ফাযলুল বারী, ১/২৩।
[12]. দেখুন : নুযুলুল আবরার, পৃঃ ৭, প্রকাশক : লাহোরের দেওবন্দীগণ।
[13]. মাআছিরে ছিদ্দীক্বী, ৪/১; হাদীছ আওর আহলেহাদীছ, পৃঃ ৮৪।
[14]. দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২৯, পৃঃ ১৩-৩৩।
[15]. নফস কে পূজারী, পৃঃ ১।
[16]. ইমাম ওয়াকী,‘ কিতাবুয যুহদ, ১/৩০০, হা/৭১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৬।
[17]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ২/১০, সনদ ছহীহ। আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫।
[18]. দারেমী ১/৬৭, হা/২০৬, সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৭।
[19]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম, ৬/২৯৩, সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[20]. আল-ইহকাম, ৬/২৯৩, সনদ ছহীহ।
[21]. কিতাবুল উম্ম, মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১।
[22]. ইবনু আবী হাতিম, আদাবুশ শাফেঈ ওয়া মানাকিবুহু, পৃঃ ৫১, সনদ হাসান।
[23]. মাসাইলু আবুদাঊদ, পৃঃ ২৭৭।
[24]. খতীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ।
[25]. ঐ, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, পৃঃ ১৩৪, সনদ ছহীহ।
[26]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ। আরো সূত্রের জন্য দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২৯, পৃঃ ১৩-৩৩।
[27]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২০/৪০।
[28]. দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৫১।
[29]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৩/৩২৯।
[30]. আজুর্রী, কিতাবুশ শরী‘আহ, পৃঃ ৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[31]. আন-নুবযাতুল কাফিয়াহ ফী আহকামি উছূলিদ্দীন, পৃঃ ৭০।
[32]. ই‘লামুল মুয়াক্কি‘ঈন, ২/২০৮।
[33]. আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ, পৃঃ ১৯৯।
[34]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩১৭।
[35]. আহসানুল ফাতাওয়া, ১/৩১৬; মওদূদী ছাহেব আওর তাখরীবে ইসলাম, পৃঃ ২০।
[36]. হক্কানী আক্বায়েদে ইসলাম, পৃঃ ৩।
[37]. দেখুন : ঐ, পৃঃ ২৬৪।
[38]. মিনহাজুস সুন্নাহ আন-নাবাবিইয়াহ (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ), ১/২৫৬।
[39]. কিফায়াতুল মুফতী, ১/৩২৫, উত্তর নং ৩৭০।
[40]. তাযকিরাতুর রশীদ, ১/১৩১।
[41]. মালফূযাতে হাকীমুল উম্মাত, ৬/৫৫, বচন নং ১০৭।
[42]. মুহাম্মাদ আইয়ূব কাদেরী, মুহাম্মাদ আহসান নানূতুবী, পৃঃ ২১৭; ফাখরুল ওলামা, পৃঃ ৬০।
[43]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ২০/৪০।
[44]. আল-বিনায়া ফী শারহিল হেদায়া, ১/৩১৭।
[45]. নাছবুর রায়াহ, ১/২১৯। আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৯, ৪৬।
[46]. আহসানুত তাক্বাসীম ফী মা‘রিফাতিল আক্বালীম, পৃঃ ৪৮১।
[47]. রিসালাহ নাজাতিয়া (উর্দূ অনুবাদ), পৃঃ ৪১, ৪২।
[48]. ঐ, পৃঃ ৪১।
[49]. আরো দেখুন : ৬ নং সমালোচনার জবাব।
[50]. দেখুন : পানিপথী রচিত গ্রন্থ ‘কাশফুল হিজাব’, পৃঃ ৪৬। আব্দুল খালেক্ব ‘তামবীহুয যল্লীন’ গ্রন্থের ১৩ পৃষ্ঠায় আব্দুল হক্ব বেনারসীর সমালোচনা করেছেন।
[51]. নুযহাতুল খাওয়াত্বির, ৭/২৬৬।
[52]. ঐ, ৭/২৬৭।
[53]. ঐ, ৭/২৬৮।
[54]. ঐ, ৭/২৭০।
[55]. দেখুন : মুহাম্মাদ মিয়াঁ দেওবন্দী রচিত ‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’ ৪/১৭৯; জানবায মির্যা দেওবন্দী প্রণীত ‘আংরেজ কে বাগী মুসলমান’, পৃঃ ২৯৩।
[56]. তাযকিরাতুর রশীদ, ১/৭৯।
[57]. হাশিয়া সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/১০৩; ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, ৪/২৮০।
[58]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘, হা/১৮৩, ১/১৪৪, সনদ ছহীহ; ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃঃ ২০৮, সনদ ছহীহ।
ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়া ও আহলেহাদীছ
[ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়াসহ কিছু লোক ও খারেজীরা এই দাবী করতে থাকে যে, আমাদের নাম স্রে্রফ মুসলিম বা মুসলিমীন এবং অন্যান্য সকল নাম (চাই গুণবাচক নাম হোক বা উপাধি) রাখা নাজায়েয অথবা উত্তম নয়। আমাদের এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে এ সকল লোকের দলীলসমূহের যথার্থ জবাব রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।]
করাচীর নতুন গজিয়ে উঠা একটি ফিরক্বা অনেক দিন যাবৎ আহলুল হাদীছ ওয়াল আছার-এর বিরুদ্ধে ‘তাকফীর’ (কাফের আখ্যায়িত করা), ‘তাবদী‘ (বিদ‘আতী আখ্যা দান), ভৎর্সনা ও তিরস্কারের বাজার গরম করে রেখেছে। কতিপয় অবুঝ লোকের উক্ত ফিরক্বার প্রতারণার জালে আটকা পড়ার আশঙ্কা থাকার কারণে এই প্রবন্ধটিকে বিস্তারিতভাবে দলীল সহ লেখা হয়েছে। যাতে ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার বাতিল দাবীসমূহ এবং অপবাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে দ্বীন ইসলামের উপরে অটল রাখেন এবং গোমরাহীর পথসমূহের শয়তানী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দাঈদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন। -আমীন!
আহলুল হাদীছ : মুহাদ্দিছদের জামা‘আতকে আহলুল হাদীছ বলা হয়। যেভাবে মুফাসসিরদের জামা‘আতকে আহলুত তাফসীর এবং ঐতিহাসিকদের জামা‘আতকে আহলুত তারীখ বলা হয়।
দলীল-১ : ছহীহ বুখারীর রচয়িতা ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘জুযউল ক্বিরাআত খালফাল ইমাম’ গ্রন্থের ১৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ولا يحتج أهل الحديث بمثله ‘এরূপ বর্ণনাকারী দ্বারা আহলুল হাদীছগণ দলীল গ্রহণ করেন না’।[1] বরং ইমাম বুখারী (রহঃ) আহলেহাদীছদেরকে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ (জান্নাতী এবং হক্বপন্থী জামা‘আত) আখ্যা দিয়েছেন।[2]
দলীল-২ : জামে‘ তিরমিযীর লেখক ইমাম তিরমিযী (রহঃ) স্বীয় ‘আল-জামে’ গ্রন্থে (১/১৬ পৃঃ) বলেছেন, وَابْنُ لَهِيعَةَ ضَعِيفٌ عِنْدَ أَهْلِ الْحَدِيثِ ‘ইবনু লাহী‘আহ আহলুল হাদীছদের নিকটে যঈফ’।[3]
সতর্কীকরণ : যেহেতু আব্দুল্লাহ ইবনু লাহী‘আহ ইখতিলাতের কারণে যঈফ ছিলেন এবং মুদাল্লিসও ছিলেন, সেহেতু তার বর্ণিত হাদীছ দু’টি শর্তের ভিত্তিতে হাসান লি-যাতিহি হয় :
১. বর্ণনাটি ইখতিলাতের[4] পূর্বের হওয়া।[5]
২. বর্ণনায় ‘সামা‘[6] অর্থাৎ ‘আমি শুনেছি’ কথাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা।[7]
দলীল-৩ : আজ পর্যন্ত কোন মুসলিম আলেম একথা অস্বীকার করেননি যে, ‘আহলুল হাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছদের জামা‘আত উদ্দেশ্য। এজন্য এই গুণবাচক নাম ও নসব জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।
আহলেহাদীছ উপাধি ও গুণবাচক নামটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে ৫০টি উদ্ধৃতির জন্য দেখুন আমার গ্রন্থ : ‘তাহক্বীক্বী, ইছলাহী আওর ইলমী মাক্বালাত’ (১/১৬১-১৭৪)।[8]
দলীল-৪ : ইমাম মুসলিমও মুহাদ্দিছগণকে আহলুল হাদীছ বলেছেন।[9]
ইমাম মুসলিম (রহঃ) নিজেও আহলেহাদীছ ছিলেন। যেমনটি হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,
ونحن لا نعني بأهل الحديث المقتصرين على سماعه أو كتابته أو روايته بل نعني بهم : كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهراً وباطناً واتباعه باطناً وظاهراً وكذلك أهل القرآن-
‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার। অনুরূপভাবে আহলে কুরআন দ্বারাও এরাই উদ্দেশ্য’।[10]
হাফেয ইবনু তায়মিয়ার নিকটে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু খুযায়মাহ এবং আবূ ই‘য়ালা প্রমুখ সকলেই আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং তারা কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।[11]
আহলুল হাদীছ-এর ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ ظَاهِرُونَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে। অবশেষে তাদের নিকটে আল্লাহর ফায়ছালা (কিয়ামত) এসে যাবে এমতাবস্থায় যে, তারা বিজয়ী থাকবে’।[12]
ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি হাদীছে আছে যে, ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হকের উপরে বিজয়ী থাকবে’।[13]
স্মর্তব্য যে, এই উচ্চমর্যাদাও দলীলের মাধ্যমে বর্ণিত হবে। যেমন-
১. আহমাদ বিন সিনান (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, هم أهل العلم وأصحاب الآثار ‘তাঁরা হ’লেন আহলুল ইলম (আলেমগণ) এবং আছহাবুল আছার (আহলেহাদীছগণ)’।[14]
২. আলী ইবনুল মাদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) বলেন, هُمْ أَصْحَابُ الْحَدِيثِ ‘তারা হ’লেন আছহাবুল হাদীছ’।[15] অন্য বর্ণনায় এসেছে, هُمْ أَهْلُ الْحَدِيثِ ‘তারা হ’লেন আহলুল হাদীছ’।[16] প্রমাণিত হ’ল যে, আছহাবুল হাদীছ এবং আহলেহাদীছ একই জামা‘আতের দু’টি নাম।
৩. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন,إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث فلا أدري من هم؟ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[17]
তিনি বলেন, صاحب الحديث عندنا من يستعمل الحديث ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি, যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[18]
সতর্কীকরণ : উপরের উদ্ধৃতিতে ‘ছাহেবুল হাদীছ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল আহলুল হাদীছ।
৪. হাফছ বিন গিয়াছ (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) আছহাবুল হাদীছ সম্পর্কে বলেছেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা হ’লেন (আহলেহাদীছগণ) দুনিয়ায় সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ’।[19]
৫. হাকেমও (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) হাফছ বিন গিয়াছ (রহঃ)-এর বক্তব্যকে সত্যায়ন করেছেন এবং বলেছেন, إن أصحاب الحديث خير الناس ‘নিশ্চয়ই আছহাবুল হাদীছগণ (মুহাদ্দিছগণ) মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম’।[20]
উক্ত আইম্মায়ে মুসলিমীন-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ সম্পর্কিত হাদীছের ব্যাখ্যা হ’ল আছহাবুল হাদীছ, আহলুল ইলম (আলেমগণ), আহলেহাদীছ (মুহাদ্দিছগণ)। আর এর উপরেই ইজমা রয়েছে।[21]
আহলুল হাদীছদের দুশমন : আহলুল হাদীছ-এর শত্রুরা তাঁদের উপরে নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে থাকে।
এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কেই ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, ليس في الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أهل الحديث وإذا ابتدع الرجل نزع حلاوة الحديث من قلبه- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আত করে, তখন তার অন্তর থেকে হাদীছের স্বাদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়’।[22]
আহলুল হাদীছদের সাথে শত্রুতার পরিণতি : মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছগণ অত্যন্ত উচ্চমর্যাদার অধিকারী এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই আল্লাহর ওলী।
আল্লাহর ওলীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ ‘যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি’।[23]
চিন্তা করুন! কত কঠিন ধমকি। এক্ষণে যে ব্যক্তি ঐসকল আল্লাহর ওলীকে কাফের বলে, তার পরিণাম কি হবে?
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-কে কাফের আখ্যা দান : তাক্বরীবুত তাহযীব, তাহযীবুত তাহযীব, আল-ইছাবাহ, লিসানুল মীযান, তা‘জীলুল মানফা‘আহ, আদ-দেরায়াহ এবং আত-তালখীছুল হাবীর প্রভৃতি উপকারী গ্রন্থসমূহের লেখক, নির্ভরযোগ্য ইমাম, সর্বশেষ হাফেয, ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর ন্যায়পরায়ণতা ও উচ্চমর্যাদার ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণের ইজমা রয়েছে এবং তাঁর গ্রন্থাবলী দ্বারা ধারাবাহিকভাবে উপকার গ্রহণ করা জারী রয়েছে।
ফিরক্বা মাসঊদিয়ার জন্ম :
কয়েক বছর আগে করাচীতে ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়াহ নামে একটি ফিরক্বার জন্ম হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাতা হ’লেন মাসঊদ আহমাদ বিএসসি ছাহেব। এই ফিরক্বাটি নিজের নাম ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ রেখে অনৈসলামী এবং তাগূত্বী সরকারের নিকট থেকে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছে। মাসঊদ ছাহেব একটি পুস্তিকা রচনা করেছেন। যার নাম রেখেছেন ‘মাযাহিবে খামসাহ’ বা পঞ্চ মাযহাব (অর্থাৎ আহলেহাদীছ, হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী) আওর দ্বীন ইসলাম’। উক্ত পুস্তিকায় ছয়টি ভাগ রয়েছে। ১. আহলুল হাদীছ ২. হানাফী ৩. শাফেঈ ৪. মালেকী ৫. হাম্বলী এবং ৬. দ্বীন ইসলাম।
এর উদ্দেশ্য হ’ল এই যে, মাসঊদ ছাহেবের নিকটে আহলেহাদীছ ও অন্যরা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। মাসঊদ ছাহেব আহলেহাদীছদের ভাগে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ)-কে তাঁর ফাতহুল বারী সহ এনেছেন (পৃঃ ২৯ দ্রঃ)।
প্রতীয়মান হ’ল যে, মাসঊদ ছাহেবের নিকটে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। (আস্তাগফিরুল্লাহ)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَيُّمَا رَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْفَرَ رَجُلاً مُسْلِمًا فَإِنْ كَانَ كَافِرًا وَإِلاَّ كَانَ هُوَ الْكَافِرَ ‘যে মুসলিম অন্য মুসলিমকে কাফের বলল, যদি সে কাফের হয় (তবে ঠিক আছে)। অন্যথায় এরূপ ব্যক্তি নিজেই কাফের’।[24]
ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার মুসলিম দাবী : মাসঊদ ছাহেব এর উপরে জোর দিয়েছেন যে, আমাদের স্রেফ একটি নাম রয়েছে অর্থাৎ মুসলিম। এ নামটি আল্লাহর রাখা। (এটা) ফিরক্বাবাজি নাম নয়’।[25]
সতর্কীকরণ : আমাদের জানা মতে, মাসঊদ ছাহেবের পূর্বে মুসলিম উম্মাহর (খায়রুল কুরূনের যুগ হোক, হাদীছ সংকলনের যুগ হোক কিংবা হাদীছ ব্যাখার যুগ হোক) কোন আলেম এ দাবী করেননি যে, ‘আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম’। যদি কারো কাছে মাসঊদ ছাহেবের উল্লিখিত দাবীর ঘোষণা কোন আলেমের পক্ষ থেকে সাব্যস্ত হয়, তবে তিনি যেন দলীল পেশ করেন।
মাসঊদ ছাহেব স্বীয় মনগড়া দাবীর ‘দলীল’ পেশ করেন, هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِين ‘তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’।[26]
জনাব মুহতারাম আবূ জাবের আব্দুল্লাহ দামানভী ছাহেব বলেছেন, ‘এই আয়াত দ্বারা এটা প্রতীয়মান হল যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন’। কিন্তু এই আয়াতের কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন। অন্য কথায় মুসলিম ছাড়া অন্য নাম রাখা নিষিদ্ধ। এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারে না যে, মুসলিমই আমাদের সত্তাগত নাম এবং দুনিয়াতে বর্তমানে আমরা এই নামেই পরিচিত। চৌদ্দশ বছর যাবৎ পৃথিবী আমাদের এ নাম সম্পর্কে অবগত আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আমরা সেই নামেই পরিচিত হ’তে থাকব। কিন্তু এই নামটি ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আরো অনেক নাম রেখেছেন। যেগুলিকে অস্বীকার করা যায় না’।
মুহতারাম দামানভী ছাহেবের সত্যায়ন : মুহতারাম দামানভী ছাহেব হাফিযাহুল্লাহর দাবীর সত্যায়নে আমরা কুরআন ও হাদীছ থেকে আরো কিছু নাম ও উপাধি পেশ করছি :
১. আল-মুমিন বা আল-মুমিনূন : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ‘যে তোমাদের সালাম করে তাকে বলো না যে তুমি মুমিন নও (অর্থাৎ কারো অন্তর ফেড়ে দেখার চেষ্টা করো না)। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অনুসন্ধান কর’ (নিসা ৪/৯৪)। তিনি আরো বলেছেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০) এবং বলেছেন, قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ‘নিশ্চয়ই ঐসব মুমিন সফলকাম’ (মুমিনূন ২৩/১)।
২. হিযবুল্লাহ : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘জেনে রাখ যে, অবশ্যই হিযবুল্লাহ সফলকাম হবে’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)।
সতর্কীকরণ : হিযবুল্লাহর (আল্লাহর দল) বিপরীতে হিযবুশ শয়তান (শয়তানের দল) রয়েছে এবং হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের অনুসারীরাই প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে (মুজাদালাহ ৫৮/১৯)।
৩. আউলিয়াউল্লাহ : আল্লাহ বলেন, أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‘মনে রেখ আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। আউলিয়াউল্লাহর (আল্লাহর বন্ধুরা) বিপরীতে আউলিয়াউশ শয়তান (শয়তানের বন্ধুরা) রয়েছে।
এগুলি ছাড়া নিম্নোক্ত নামগুলিও কুরআন মাজীদ দ্বারা সাব্যস্ত রয়েছে :
১. আল-মুহাজিরীন (তাওবাহ ৯/১০০) ২. আল-আনছার (ঐ) ৩. আস-সাবিকূনাল আউয়ালূন (ঐ) ৪. রববানিইয়ীন (আলে ইমরান ৩/৭৯) ৫. আল-ফুক্বারা (বাক্বারাহ ২/২৭৩) ৬. আছ-ছালেহীন (নিসা ৪/৬৯) ৭. আশ-শুহাদা (ঐ) ৮. আছ-ছিদ্দীক্বীন প্রভৃতি (ঐ)।
ছহীহ হাদীছসমূহেও মুসলমানদের কতিপয় নামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন : ১. উম্মাতু মুহাম্মাদ (ছাঃ)।[27] ২. আল-গুরাবা।[28] ৩. ত্বায়েফাহ।[29] ৪. হাওয়ারীইঊন।[30] ৫. আছহাব।[31] ৬. আল-খলীফাহ।[32] ৭. আহলুল কুরআন।[33] ৮. আহলুল্লাহ।[34]
উক্ত দলীলসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মুসলমানদের আরও অনেক (গুণবাচক) নাম রয়েছে। যেগুলি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) রেখেছেন। এজন্য ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার প্রতিষ্ঠাতার এ দাবী ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের স্রেফ একটি নাম ‘মুসলিম’ রেখেছেন। যদি তিনি বলেন যে, এগুলি গুণবাচক নাম। তবে আরয এই যে, গুণবাচক নামও নাম-ই হয়ে থাকে।
দলীল-১ : আল্লাহ তা‘আলার যাতী বা সত্তাগত নাম ‘আল্লাহ’ এবং তাঁর অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে। যেমন :
(১) রব (ফাতিহা ১/১)। (২) আর-রহমান (ঐ)। (৩) আর-রহীম (ঐ)। (৪) ইলাহ (নাস ১৪/৩)। (৫) আল-আলীম (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। (৬) আল-ক্বাদীর (রূম ৩০/৫৪)। (৭) আল-মালিক (হাশর ৫৯/২৩)। (৮) আল-কুদ্দূস (ঐ) ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর নাম সমূহ। সে নামেই তোমরা তাঁকে ডাক’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)।
তিনি আরো বলেছেন, قُلِ ادْعُوا اللهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى ‘তুমি বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাক বা ‘রহমান’ নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাকো না কেন, সকল সুন্দর নাম তো কেবল তাঁরই জন্য’ (বনু ইসরাঈল ১৭/১১০)। আল্লাহ তা‘আলার উক্ত গুণবাচক নাম সমূহকেও ‘নাম’-ই বলা হয়েছে।
দলীল-২ : মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সত্তাগত নাম মুহাম্মাদ এবং আহমাদও তাঁর সত্তাগত নাম। কুরআনে বলা হয়েছে, اسْمُهُ أَحْمَدُ ‘তাঁর নাম আহমাদ’ (ছফ্ফ ৬১/৬)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَحْمَدُ وَالْمُقَفِّى وَالْحَاشِرُ وَنَبِىُّ التَّوْبَةِ وَنَبِىُّ الرَّحْمَةِ ‘আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আহমাদ (অত্যধিক প্রশংসিত), মুক্বাফফী (শেষ নবী), হাশের (একত্রিতকারী), নবীয়ে তওবাহ ও নবীয়ে রহমত’।[35]
বাগাবীর শারহুস সুন্নাহ-তে আছে যে, নবী (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ لِى أَسْمَاءً أَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا مُحَمَّدٌ، وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يَمْحُو اللهُ بِهِ الْكُفْرَ، وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمِى، وَأَنَا الْعَاقِبُ ‘আমার কিছু নাম রয়েছে। আমি আহমাদ, আমি মুহাম্মাদ, আমি আল-মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ কুফরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি আল-হাশের। আমার পদতলে লোকদেরকে একত্রিত করা হবে এবং আমি আক্বিব (সর্বশেষ নবী)। ইমাম বাগাবী বলেন, ‘এ হাদীছের বিশুদ্ধতায় সবাই একমত। হাদীছটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন’।[36]
এই হাদীছগুলি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, সাইয়েদুনা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আরোও অনেক নাম রয়েছে। যেমন : আহমাদ, আল-মাহী, আল-হাশের, আল-আক্বিব, আল-মুক্বাফফী, নবীয়ে তওবাহ এবং নবীয়ে রহমত ইত্যাদি।
কুরআন ও হাদীছের উক্ত দলীলসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, গুণবাচক নামও নাম-ই হয়ে থাকে।
ছাহাবীগণ এবং মুসলিমীন :
১. হুযায়ফা (রাঃ)-এর সামনে একজন ব্যক্তি মুসলমানদেরকে ‘আল-মুছাল্লূন’ (اَلْمُصَلُّونَ) বা মুছল্লীগণ বলেছিলেন। হুযায়ফা (রাঃ) এর প্রতিবাদ করেননি; বরং তাকে অনেক ভালো পরামর্শও দিয়েছিলেন।[37]
২. ওমর (রাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ ‘হে কুরাইশদের দল’।[38]
৩. ওমর (রাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ ‘হে আনছারের দল’।[39]
৪. আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) ও অন্য খলীফাগণকে ছাহাবীগণ ‘আমীরুল মুমিনীন’ (أمير المؤمنين) বা মুমিনদের নেতা বলতেন। এ বিষয়টি মুতাওয়াতির বা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত।
এগুলি ছাড়া আরো অনেক নামও ছাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সবার উপরে সন্তুষ্ট হোন।
আহলুস সুন্নাহ : মুসলিমীন, মুহাদ্দিছীন এবং মুমিনীনকে ‘আহলুস সুন্নাহ’ (অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসারী)ও বলা হয়েছে।
দলীল-১ : তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (মৃঃ ১১০ হিঃ) বলেছেন,فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ ‘সুতরাং আহলে সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য করা হ’ত। অতঃপর তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত’।[40]
সারমর্ম এই যে, ইবনু সীরীন (রহঃ) মুসলমানদের জন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ নামটি ব্যবহার করেছেন।
সতর্কীকরণ : এই নামটি ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার নিকটে অপ্রমাণিত, বিদ‘আত এবং নতুন শরী‘আত তৈরীর শামিল। এজন্য তাদের নিকটে ইবনু সীরীন (রহঃ)-যার ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে, তিনি ইসলাম থেকে খারিজ এবং আহলুস সুন্নাহ ফিরক্বার একজন ব্যক্তি বলে গণ্য হবেন (নাঊযুবিল্লাহ)।
এবার লক্ষ্য করুন! তাবেঈ ইবনু সীরীন (রহঃ) (যিনি অসংখ্য ছাহাবীর শিষ্য এবং ছহীহায়েনের অন্যতম প্রধান রাবী) সম্পর্কে কখন ফৎওয়া দেয়া হচ্ছে?!
আহলুস সুন্নাহ বা এ জাতীয় শব্দ নিম্নোক্ত আইম্মায়ে মুসলিমীনও ব্যবহার করেছেন :
১. আইয়ূব আস-সাখতিয়ানী (মৃঃ ১৩১ হিঃ)।[41]
২. যায়েদাহ বিন কুদামাহ।[42] ৩. আহমাদ বিন হাম্বল।[43]
৪. বুখারী।[44] ৫. ইয়াহইয়া ইবনু মা‘ঈন।[45]
৬. আবূ ওবায়েদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম।[46]
৭. মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী।[47]
৮. হাকেম নিশাপুরী।[48]
৯. আহমাদ ইবনুল হুসায়েন আল-বায়হাক্বী (মৃঃ ৪৫৭ হিঃ)।[49]
১০. আবূ হাতিম আর-রাযী (মৃঃ ২৭৭ হিঃ)।
ইমাম আবূ হাতিম (রহঃ) জাহমিয়াদের[50] এই নিদর্শন বর্ণনা করেছেন যে, তারা আহলুস সুন্নাহকে ‘মুশাবিবহা’[51] বলে।[52]
১১. ইমাম আবূ জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ)।[53]
১২. ফুযায়েল বিন ‘ইয়ায (মৃঃ ১৮৭ হিঃ)।[54]
১৩. শায়খুল ইসলাম আবূ ওছমান ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ)।[55]
১৪. ইবনু আব্দিল বার্র আল-আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)।[56]
১৫. খত্বীব বাগদাদী (শারফু আছহাবিল হাদীছ)।
১৬. আবূ ইসহাক্ব ইবরাহীম বিন মূসা আল-কুরতুবী (মৃঃ ৭৯১ হিঃ)।[57]
১৭. হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)।[58]
১৮. হাফেয আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)।[59]
সুন্নী নাম :
১. হাফেয যাহাবী (রহঃ) একজন বিদ্বান সম্পর্কে বলেছেন, الرازي السني الفقيه أحد أئمة السنة ‘আর-রাযী একজন সুন্নী, ফক্বীহ এবং আহলুস সুন্নাহর অন্যতম ইমাম’।[60]
যায়েদাহ বিন কুদামাহ (রহঃ)-কে বহু ইমাম ‘ছাহেবু সুন্নাহ’ (صاحب سنة) বা হাদীছপন্থী এবং ‘আহলুস সুন্নাহ-এর অন্তর্ভুক্ত’ (من أهل السنة) বলেছেন।[61]
২. হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) তাক্বরীবুত তাহযীবে (রাবী ক্রমিক ৪২০৮) আব্দুল মালেক বিন ক্বারীব আল-আছমাঈ আল-বাছরী সম্পর্কে বলেছেন, صدوق سني ‘তিনি সত্যবাদী সুন্নী’।
মুহাম্মাদী মাযহাব : মুহাম্মাদ বিন ওমর আদ-দাঊদী (রহঃ) ইমাম, হাফেয, আল-মুফীদ (উপকারকারী), মুহাদ্দিছুল ইরাক (ইরাকের মুহাদ্দিছ) ইবনু শাহীন (রহঃ) সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, وكان إذا ذكر له مذهب أحد، يقول : أنا محمدي المذهب ‘যখন তার নিকটে কারো মাযহাবের কথা উল্লেখ করা হ’ত তখন তিনি বলতেন, ‘আমি মুহাম্মাদী মাযহাবের’।[62]
সারসংক্ষেপ : কুরআন, হাদীছ এবং মুসলিম ইমামগণের সর্বসম্মত উক্তিসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, মুসলমানদের আরো গুণবাচক নাম রয়েছে। যেগুলি দ্বারা তাদেরকে ডাকা হয়েছে। যেমন : আহলুস সুন্নাহ, আহলুল হাদীছ, সুন্নী, মুহাম্মাদী, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি। সুতরাং মাসঊদ ছাহেবের এ দাবী একেবারেই ভিত্তিহীন এবং দলীলবিহীন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন।
মাসঊদ ছাহেবের নিকটে ‘মুসলিম’ ব্যতীত অন্য সকল নাম (যেমন : আহলুস সুন্নাহ, আহলুল হাদীছ, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি) বেঠিক এবং ফিরক্বা। আর তার নিকটে ফিরক্বাবন্দী শিরক, আযাব ও লা‘নত (‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ তথা ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার স্টীকার দ্রষ্টব্য)।
এজন্য আইম্মায়ে মুসলিমীন যেমন তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) ও অন্যেরা তার নিকটে ইসলাম থেকে খারিজ এবং মুশরিক সাব্যস্ত হয়েছে। (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই)।
তাকফীরের ফিৎনা : ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়া নির্লজ্জভাবে মুহাদ্দিছগণকে কাফের আখ্যাদান করছে। কার্যতঃ এরা না কোন মুসলমানকে সালাম করে, আর না তার পিছে ছালাত আদায় করে। তাদের নিকটে স্রেফ ঐ ব্যক্তিই ‘মুসলিম’, যে ব্যক্তি তাদের ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ায় (জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্ট্রার্ড) শামিল হয়েছে এবং মাসঊদ ছাহেবের বায়‘আত গ্রহণ করেছে। অন্য কোন ব্যক্তি নিজেকে লক্ষ বার মুসলিম বললেও তারা তাদের অবস্থানেই অবিচল থাকেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا، وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا، فَذَلِكَ الْمُسْلِمُ الَّذِى لَهُ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ ‘যে ব্যক্তি আমাদের মতো ছালাত আদায় করে, আমাদের কেবলার দিকে মুখ ফিরায় এবং আমাদের যবহকৃত প্রাণী ভক্ষণ করে, সে ব্যক্তি মুসলিম। যার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের যিম্মাদারী রয়েছে’।[63]
আলোচনার অকাট্য ফায়ছালা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِى سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নামে ডাকো। যিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিমীন, মুমিনীন, ইবাদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা)’।[64]
এই সনদকে ইবনু খুযায়মাহ, হাকেম ও যাহাবী (রহঃ)ও ছহীহ বলেছেন।[65] ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেছেন, هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ ‘এটি হাসান ছহীহ গরীব হাদীছ’।[66]
ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর আবূ ইয়া‘লা ও অন্যদের সনদ সমূহে ‘সামা’ (আমি শুনেছি)-এর কথাও উল্লেখ করেছেন।
ফিরক্বার আলোচনা : ফিরক্বার প্রয়োগ হকপন্থীদের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে এবং বাতিলপন্থীদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মাসঊদ ছাহেব ঢালাওভাবে বলেন, ‘ফিরক্বাবন্দী শিরক’!
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَكُونُ فِى أُمَّتِى فِرْقَتَانِ فَتَخْرُجُ مِنْ بَيْنِهِمَا مَارِقَةٌ يَلِى قَتْلَهُمْ أَوْلاَهُمْ بِالْحَقِّ ‘আমার উম্মতের মধ্যে দু’টি ফিরক্বা হবে। তারপর তাদের মধ্য থেকে একটি ‘মারিক্বাহ’ (পথভ্রষ্ট ফিরক্বাহ, খারেজীদের দল) বের হবে। তাদের সাথে লড়াই করবে ঐ দলটি, যেটি হক্বের অধিক নিকটবর্তী হবে’।[67] অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,تَفْتَرِقُ أُمَّتِى فِرْقَتَيْنِ فَتَمْرُقُ بَيْنَهُمَا مَارِقَةٌ فَيَقْتُلُهَا أَوْلَى الطَّائِفَتَيْنِ بِالْحَقِّ ‘আমার উম্মত দু’টি ফিরক্বায় বিভক্ত হবে এবং তাদের মধ্য থেকে একটি দল বের হবে (অর্থাৎ গোমরাহ (খারেজী) ফিরক্বা)। উভয় ফিরক্বার মধ্যে যে দলটি হক্বের অধিক নিকটবর্তী সেটি ঐ গোমরাহ দলকে হত্যা করবে’।[68]
এই ফিরক্বা দু’টি আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ফিরক্বা ছিল এবং তাঁদের মধ্য থেকে খারেজীদের জামা‘আত বের হয়েছিল। সেই ‘জামা‘আত’কে আলী (রাঃ) হত্যা করেছিলেন।
প্রতীয়মান হ’ল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের দু’টি জামা‘আতকে দু’টি ফিরক্বা আখ্যা দিয়েছেন। অতএব প্রমাণিত হ’ল যে, মুসলমানদের জামা‘আতকে ‘ফিরক্বা’ও বলা হয়েছে। অর্থাৎ নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত) ফিরক্বা। আর এই দু’টি ফিরক্বা (আলী ও মু‘আবিয়ার দল) হক্বের উপরে ছিল।
[1]. নাছরুল বারী ফী তাহকীকি জুযইল ক্বিরাআহ লিল-বুখারী, পৃঃ ৮৮ হা/৩৮,।
[2]. মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ; যুবায়ের আলী যাঈ, তাহক্বীক্বী মাক্বালাত ১/১৬১।
[3]. তিরমিযী, হা/১০।
[4]. রাবীর হিফয শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া, বিবেক-বুদ্ধি দুর্বল হয়ে যাওয়া, হাদীছকে সঠিকভাবে মনে রাখতে না পারায় হাদীছের বাক্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াকে ইখতিলাত বলা হয়। বিভিন্ন কারণে ইখতিলাত হ’তে পারে। যেমন : বয়স বেড়ে যাওয়া, বই-পুস্তক জ্বলে যাওয়া, ধন-সম্পদের ক্ষতি হওয়া কিংবা সন্তান-সন্ততির মৃত্যু ঘটার কারণে মানসিক আঘাত পাওয়া ইত্যাদি (তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃঃ ১২৫ প্রভৃতি)।-অনুবাদক।
[5]. দেখুন : আমার গ্রন্থ ‘আল-ফাতহুল মুবীন’, পৃঃ ৭৭-৭৮।
[6]. ‘আমি শ্রবণ করেছি’, ‘আমাকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’ ‘আমাদেরকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’, ‘আমাকে সংবাদ প্রদান করেছেন’ কিংবা ‘আমাদেরকে সংবাদ প্রদান করেছেন’ ইত্যাদি শব্দাবলী দ্বারা হাদীছের সনদ বর্ণনা করাকে ‘সামা’ বলা হয় (তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃঃ ১৫৯ প্রভৃতি)।-অনুবাদক।
[7]. আল-ফাতহুল মুবীন, পৃঃ ৭৭।
[8]. বিস্তারিত আলোচনা দেখুন : আত-তাহরীক, জুন ২০১৫ সংখ্যা, পৃঃ ২৫-৩০।-অনুবাদক।
[9]. ছহীহ মুসলিম, শরহে নববী সহ, ১/৫৫; অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/৫, ২৬।
[10]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[11]. দেখুন : মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২০/৪০; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ১/১৬৮।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১১, মুগীরাহ বিন শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে।
[13]. মুসলিম হা/১৯২০।
[14]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ২৭, নং ৪৯, সনদ ছহীহ।
[15]. তিরমিযী, ২/৪৩, হা/২১৯২, সনদ ছহীহ।
[16]. তিরমিযী ৪/৫০৫, সুনানে তিরমিযী (আরেযাতুল আহওয়াযী সহ), ৯/৭৪।
[17]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ২, সনদ হাসান; ইবনু হাজার আসক্বালানী এটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ফাৎহুল বারী, ১৩/২৫০, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা।
[18]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘, হা/১৮৩, ১/১৪৪, অন্য আরেকটি সংস্করণ ১/১৪৪, হা/১৮৩ সনদ ছহীহ; ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃঃ ২০৭-২০৮।
[19]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, সনদ ছহীহ।
[20]. উলূমুল হাদীছ, পৃঃ ৩।
[21]. বিস্তারিত দেখুন আমার গ্রন্থ : তাহক্বীক্বী মাক্বালাত ১/১৬১-১৭৪।
[22]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, নং ৬, সনদ ছহীহ।
[23]. বুখারী হা/৬৫০২, ৮/১৩১।
[24]. আবুদাঊদ হা/৪৬৮৭, শব্দগুলি তাঁর এবং এর সনদ ছহীহ; মূল হাদীছ রয়েছে ছহীহ মুসলিমে, হা/৬০।
[25]. মাযহাবে আহলুল হাদীছ কী হাকীকাত, পৃঃ ১।
[26]. হজ্জ ২২/৭৮। গৃহীত : ‘আল-মুসলিম’ পত্রিকা ৪র্থ সংখ্যা ৪৬ পৃঃ।
[27]. ছহীহ বুখারী, হা/ ৫২২১, ৬৬৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/৯০১।
[28]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫।
[29]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৬ ইত্যাদি।
[30]. মুসলিম, হা/৫০।
[31]. মুসলিম, হা/৫০।
[32]. আহমাদ, ৫/১৩১, সনদ হাসান।
[33]. আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৫৬, হা/২০৪৬, সনদ হাসান; মুসনাদে আবী দাঊদ আত-ত্বায়ালিসী, হা/২১২৪, ‘মাকতাবা শামেলা’ হ’তে।
[34]. ঐ ৭।
[35]. মুসলিম, হা/২৩৫৫।
[36]. শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৩০, ১৩/২১২।
[37]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩৮২৮৯, ১৫/১৭; আল-মুস্তাদরাক, ৪/৪৪৪-৪৪৫; ইমাম হাকেম বলেন, ‘শায়খায়নের শর্তানুযায়ী হাদীছটি ছহীহ। তবে তারা হাদীছটি বর্ণনা করেননি। মানছূর থেকে সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাটি শক্তিশালী। আর সনদের বাকী অংশটুকু ছহীহ।
[38]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১৪/৪৮২, সনদ ছহীহ। আল-হাকাম বিন মীনা ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য রাবী।
[39]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১৪/৫৬৭, হা/৩৮১৯৯, সনদ হাসান।
[40]. মুসলিম, হা/২৭ অনুচ্ছেদ-৫; দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের ক্রমিক নং অনুসারে।
[41]. ইবনু ‘আদী, আল-কামিল, ১/৭৫, সনদ ছহীহ; হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৯; আল-জুযউছ ছানী মিন হাদীছি ইয়াইইয়া ইবনে মা‘ঈন হা/১০২।
[42]. খত্বীব, আল-জামে‘, হা/৭৫৫।
[43]. আল-মুনতাখাব মিন ইলালিল খাল্লাল, হা/১৮৫।
[44]. বুখারী, জুযউ রফয়ে ইয়াদাইন, হা/১৫।
[45]. তারীখু ইবনে মা‘ঈন, দূরীর বর্ণনা, রাবী নং ২৯৫৫, আবুল মু‘তামির ইয়াযীদ বিন তিহমান-এর জীবনী দ্রষ্টব্য।
[46]. আল-আমওয়াল হা/১২১৮, ‘লা তাজ‘আল যাকাতাকা’, কিতাবুল ঈমানের শুরুতে।
[47]. কিতাবুছ ছালাত, হা/৫৮৮।
[48]. আল-মুসতাদরাক, ১/২০১, হা/৩৯৭।
[49]. দেখুন : কিতাবুল ই‘তিক্বাদ ওয়াল হিদায়া ইলা সাবীলির রাশাদ আলা মাযহাবিস সালাফ ওয়া আছহাবিল হাদীছ সহ বায়হাক্বীর অন্যান্য গ্রন্থসমূহ।
[50]. জাহমিয়া একটি ভ্রান্ত ফিরক্বা। জাহম বিন ছাফওয়ান এই ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করতেন। তিনি কুরআনকে সৃষ্ট মনে করতেন। তিনি আরো বলতেন যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান।
[51]. মুশাবিবহা : যারা রবের সাথে অন্য কিছুকে সাদৃশ্য প্রদান করে। এটি অন্যতম একটি গোমরাহ ফিরক্বা। এই ফিরক্বা দু’টি ভাগে বিভক্ত। ১. যারা স্রষ্টার সত্তার সাথে অন্যের সত্তার সাদৃশ্য প্রদান করে। যেমন: আল্লাহর হাত, মুখমন্ডল আমাদের হাত, মুখমন্ডলের মতই। চরমপন্থী শী‘আগণ যেমন সাবী’আহ, মুগীরীয়াহ ইত্যাদি এই আক্বীদা পোষণ করে। ২. যারা আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করে। যেমন : আল্লাহর দর্শন আমাদের দর্শনের ন্যায়। তার শ্রবণ আমাদের শ্রবণের মতই। কার্রামিয়া, হিশামী শী‘আগণ এই শ্রেণীভুক্ত।- অনুবাদক।
[52]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩৮; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ২/২৩।
[53]. ত্বাবারী, ছরীহুস সুন্নাহ, পৃঃ ২০।
[54]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৮/১০৩, ১০৪, সনদ ছহীহ; ত্বাবারী, তাহযীবুল আছার, ৭/৪৪, হা/১৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[55]. তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ এবং আর-রিসালাহ ফী ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়া আছহাবিল হাদীছ ওয়াল আইম্মাহ’ দ্রষ্টব্য।
[56]. আত-তামহীদ, ১/৮, ২/২০৯ ইত্যাদি।
[57]. শাত্বিবী, আল-ই‘তিছাম, ১/৬১।
[58]. দেখুন : সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৫/৩৭৪।
[59]. ফাতহুল বারী ১/২৮১-এর বরাতে মাসঊদ আহমাদ, মাযাহিবে খামসাহ, পৃঃ ৩৯।
[60]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৪৪৬।
[61]. দেখুন : তাহযীবুত তাহযীব, ৩/২৬৪।
[62]. খত্বীব, তারীখু বাগদাদ, ১১/২৬৭, সনদ ছহীহ, ওমর বিন আহমাদ বিন ওছমান ওরফে ইবনু শাহীন-এর জীবনী।
[63]. বুখারী, হা/৩৯১।
[64]. মুসনাদে আবী ই‘য়ালা আল-মূছেলী ৩/১৪২; ছহীহ ইবনু হিববান ৮/৪৩।
[65]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ, হা/১৯৩০; আল-মুসতাদরাক, ১/৪২১, ১১৭, ২৩৬।
[66]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩।
[67]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৫।
[68]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা আল-মূছিলী, ২/৪৯৯, হা/১৩৪৫, সনদ ছহীহ; ইবনু হিববান তার ছহীহ গ্রন্থে (৮/২৫৯) এবং আহমাদ (হা/১১৩২৬, ৩/৭৯) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা কি উদ্দেশ্য?
প্রশ্ন : নিবেদন হ’ল যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড) বুখারী ও মুসলিমের এই (সামনে আসছে) হাদীছকে নিজেদের পক্ষে পেশ করে থাকে। যখন তাদের এই বুঝ ও ইসতিফাদাহ (উপকৃত হওয়া) এবং এভাবে দলীল গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের ভিন্নমত রয়েছে। দয়া করে খায়রুল কুরূনের (স্বর্ণ যুগ) বুঝ ও ইসতিফাদাহ দ্বারা উপকৃত করবেন।
كَيْفَ الأَمْرُ إِذَا لَمْ تَكُنْ جَمَاعَةٌ ‘যখন জামা‘আত থাকবে না তখন কি করতে হবে’ অনুচ্ছেদের অধীনে ১৯৬৮ নং হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-
‘জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, যদি তাদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তুমি ঐ দলগুলোকে পরিত্যাগ করবে। যদিও তোমাকে গাছের শিকড় কামড়ে ধরে থাকতে হয় এবং এমতাবস্থায় তোমার মৃত্যু এসে যায়’।[1]
মুহতারাম! এ সম্পর্কে তিনটি যুগের উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিন যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড) এ হাদীছের ভিত্তিতে-
১. সবাইকে গোমরাহ এবং নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে সঠিক মনে করে।
২. তাদের কতিপয় গ্রন্থ যেমন (১) দাওয়াতে ইসলাম (পৃঃ ৪৭-৪৮)-এ ৩৪টি মাযহাবী জামা‘আত (২) দাওয়াতে ফিকর ও নযর (পৃঃ ৪৯) গ্রন্থে ৩৩টি মাযহাবী জামা‘আত এবং লামহায়ে ফিকরিয়াহ (পৃঃ ৪২) ও অন্যান্য গ্রন্থে ৩৩টি মাযহাবী জামা‘আতের নাম গণনা করেছে। সেখানে এই বুঝ দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, এই (জামা‘আতগুলি) যেহেতু ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড)-এর সাথে সম্পৃক্ত নয়; সেহেতু (সেগুলি) গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট।
৩. সাধারণভাবে তাতে রাজনৈতিক দলসমূহের উল্লেখ থাকা কোন আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়।
দয়া করে আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় বিশেষ দিকনির্দেশনার জন্য অবশ্যই উৎসর্গ করবেন।
-সংস্কার ও কল্যাণকামী : তারেক মাহমূদ, সাঈদ অটোজ, দীনা জেহলাম।
জবাব : এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হুজ্জাত বা দলীল এবং কুরআন ও হাদীছ থেকে ইজমায়ে উম্মতের দলীল হওয়া সাব্যস্ত রয়েছে। এজন্য শরী‘আতের দলীল হ’ল তিনটি- ১. কুরআন মাজীদ ২. ছহীহ ও হাসান লি-যাতিহি এবং মারফূ‘ হাদীছ সমূহ ৩. ইজমায়ে উম্মত।
সাবীলুল মুমিনীন সংক্রান্ত আয়াত এবং অন্যান্য দলীল দ্বারা নিম্নোক্ত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও প্রমাণিত রয়েছে :
১. কুরআন ও সুন্নাহর স্রেফ ঐ মর্মই গ্রহণযোগ্য, যেটি সালাফে ছালেহীন (যেমন ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, মুহাদ্দিছগণ, ওলামায়ে দ্বীন ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন হাদীছ ব্যাখ্যাকারগণ) থেকে সর্বসম্মতিক্রমে অথবা কোন মতভেদ ছাড়াই সাব্যস্ত রয়েছে।
২. ইজতিহাদ যেমন সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা।
এই ভূমিকার পরে সাইয়েদুনা হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ ‘মুসলমানদের জামা‘আত এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’-এর ব্যাখ্যায় আরয হ’ল যে, এখানে জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মুসলমানদের খেলাফত এবং ‘তাদের ইমাম’ (إمامهم) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ‘তাদের খলীফা’ (خليفتهم) (অর্থাৎ মুসলমানদের খলীফা)। এই ব্যাখ্যার দু’টি দলীল নিম্নরূপ :
১. (সুবাই‘ বিন খালেদ) আল-ইয়াশকুরী (নির্ভরযোগ্য তাবেঈ)-এর সনদে বর্ণিত আছে যে, হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, ‘যদি তুমি তখন কোন খলীফা না পাও, তবে মৃত্যু অবধি পালিয়ে থাকবে’।[2]
এই হাদীছের রাবীদের সংক্ষিপ্ত তাওছীক্ব নিম্নরূপ :
১. সুবাই‘ বিন খালেদ আল-ইয়াশকুরী (রহঃ) : তাঁকে ইবনু হিববান, ইমাম ইজলী, হাকেম, আবূ ‘আওয়ানাহ এবং যাহাবী ছিক্বাহ (নির্ভরযোগ্য) ও ছহীহুল হাদীছ বলেছেন। সুতরাং এই শক্তিশালী সত্যায়নের পর তাঁকে ‘মাজহূল’ (অজ্ঞাত) কিংবা ‘মাসতূর’ (অপরিচিত) বলা ভুল।
২. ছাখর বিন বদর আল-ইজলী (রহঃ) : ইবনু হিববান এবং আবূ ‘আওয়ানাহ তাঁকে ছিক্বাহ ও ছহীহুল হাদীছ বলেছেন। এই তাওছীক্বের পরে শায়খ আলবানীর তাঁকে মাজহূল বলা ভুল।
৩. আবুত তাইয়াহ ইয়াযীদ বিন হুমায়েদ (রহঃ) : তিনি ছহীহায়েন এবং সুনানে আরবা‘আর রাবী এবং ছিক্বাহ-ছাবত (নির্ভরযোগ্য) ছিলেন।
৪. আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ (রহঃ) : তিনি ছহীহায়েন ও সুনানে আরবা‘আর রাবী এবং ছিক্বাহ-ছাবত (নির্ভরযোগ্য) ছিলেন।
৫. মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদ (রহঃ) : ছহীহ বুখারী ও অন্য হাদীছ গ্রন্থের রাবী এবং ছিক্বাহ-হাফেয ছিলেন।
প্রমাণিত হ’ল যে, এ সনদটি হাসান লি-যাতিহি। আর ক্বাতাদা (ছিক্বাহ-মুদাল্লিস)-এর নাছর বিন আছেম হ’তে সুবাই‘ বিন খালেদ সূত্রের বর্ণনাটি ছাখর বিন বদরের হাদীছের শাহেদ বা সমর্থক। যেটি মাসঊদ আহমাদ বিএসসির ‘উছূলে হাদীছ’-এর আলোকে সুবাই‘ বিন খালেদ (রহঃ) পর্যন্ত ছহীহ।[3]
এই হাসান (এবং মাসঊদিয়ার মূলনীতি অনুযায়ী ছহীহ) বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল খলীফা। আর স্মর্তব্য যে, হাদীছ হাদীছকে ব্যাখ্যা করে।
২. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন,
قَالَ الْبَيْضَاوِيُّ : الْمَعْنَى إِذَا لَمْ يَكُنْ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةٌ فَعَلَيْكَ بِالْعُزْلَةِ وَالصَّبْرِ عَلَى تَحَمُّلِ شِدَّةِ الزَّمَانِ وَعَضُّ أَصْلِ الشَّجَرَةِ كِنَايَةٌ عَنْ مُكَابَدَةِ الْمَشَقَّةِ-
‘বায়যাবী (মৃঃ ৬৮৫ হিঃ) বলেছেন, এর অর্থ হ’ল, যখন যমীনে কোন খলীফা থাকবে না, তখন তোমার কর্তব্য হ’ল বিচ্ছিন্ন থাকা এবং যুগের কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা। আর গাছের শিকড় কামড়ে থাকা দ্বারা কষ্ট সহ্য করার প্রতি ইশারা করা হয়েছে’।[4]
হাফেয ইবনু হাজার মুহাম্মাদ বিন জারীর বিন ইয়াযীদ আত-ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
وَالصَّوَابُ أَنَّ الْمُرَادَ مِنَ الْخَبَرِ لُزُومُ الْجَمَاعَةِ الَّذِينَ فِي طَاعَةِ مَنِ اجْتَمَعُوا عَلَى تَأْمِيرِهِ فَمَنْ نَكَثَ بَيْعَتَهُ خَرَجَ عَنِ الْجَمَاعَةِ، قَالَ : وَفِي الْحَدِيثِ أَنَّهُ مَتَى لَمْ يَكُنْ لِلنَّاسِ إِمَامٌ فَافْتَرَقَ النَّاسُ أَحْزَابًا فَلَا يَتَّبِعُ أَحَدًا فِي الْفُرْقَةِ وَيَعْتَزِلُ الْجَمِيعَ إِنِ اسْتَطَاعَ ذَلِكَ-
‘সঠিক হ’ল, হাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা, যে (দলটি) তার (ইমাম)-এর ইমারতের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আর যে ব্যক্তি তার বায়‘আতকে ভঙ্গ করল, সে জামা‘আত থেকে বের হয়ে গেল। তিনি (ইবনু জারীর) বলেন, আর হাদীছটিতে (এটাও) আছে যে, যখন মানুষের কোন ইমাম থাকবে না এবং লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন সে কোন দলেরই অনুসরণ করবে না এবং সক্ষম হলে সব দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে’।[5]
ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাতা আল্লামা আলী বিন খালাফ বিন আব্দুল মালিক বিন বাত্ত্বাল কুরতুবী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ) বলেছেন, وفيه حجة لجماعة الفقهاء فى وجوب لزوم جماعة المسلمين وترك القيام على أئمة الجور، ‘এ হাদীছে ফক্বীহদের জন্য মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরার এবং যালিম শাসকদের বিরোধিতা না করার দলীল রয়েছে’।[6]
হাফেয ইবনু হাজার উক্ত হাদীছের একটি অংশের ব্যাখ্যায় বলেছেন,وَهُوَ كِنَايَةٌ عَنْ لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ وَطَاعَةِ سَلَاطِينِهِمْ وَلَوْ عَصَوْا ‘এটি মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা এবং তাদের শাসকদের আনুগত্য করার ইঙ্গিতবাহী। যদিও তারা (শাসকবর্গ) নাফরমানী করে’।[7]
হাদীছ ব্যাখ্যাকারকদের (ইবনু জারীর ত্বাবারী, ক্বাযী বায়যাবী, ইবনু বাত্ত্বাল ও হাফেয ইবনু হাজার) উক্ত ব্যাখ্যাসমূহ (সালাফে ছালেহীনের বুঝ) দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, উল্লিখিত হাদীছ (জামা‘আতুল মুসলিমীন ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে) দ্বারা প্রচলিত জামা‘আত ও দলসমূহ (যেমন মাসঊদ আহমাদ বিএসসির জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড) উদ্দেশ্য নয়। বরং মুসলমানদের সর্বসম্মত খেলাফত ও খলীফা উদ্দেশ্য।
একটি হাদীছে এসেছে যে, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ لَهَّ إِمَامٌ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে এমতাবস্থায় যে তার কোন ইমাম (খলীফা) নেই, সে জাহেলিয়াতের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল’।[8]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) তাঁর এক ছাত্রকে বলেছেন যে, تدري ما الإمام؟ الذي يجتمع المسلمون عليه كلهم يقول: هذا إمام، فهذا معناه ‘তুমি কি জান (উক্ত হাদীছে বর্ণিত) ইমাম কাকে বলে? ইমাম তিনিই, যার ইমাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। প্রতিটি লোকই বলবে যে, ইনিই ইমাম (খলীফা)। এটাই উক্ত হাদীছের মর্মার্থ’।[9]
এই ব্যাখ্যা দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হ’ল যে, ‘তাদের ইমাম’ (إمامهم) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ ইমাম (খলীফা), যার খেলাফতের ব্যাপারে সকল মুসলমানের ইজমা হয়ে গেছে। যদি কারো ব্যাপারে প্রথম থেকেই মতানৈক্য হয়, তবে তিনি্ঐ হাদীছে উদ্দেশ্য নন। এজন্য ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার (জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড) উক্ত হাদীছ দ্বারা নিজের তৈরী ও নতুন গজিয়ে ওঠা ফিরক্বাকে উদ্দেশ্য নেয়া ভুল, বাতিল এবং অনেক বড় ধোঁকাবাজি।
আপনারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, কোন নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী ইমাম, মুহাদ্দিছ, হাদীছের ভাষ্যকার অথবা আলেম খায়রুল কুরূনের (স্বর্ণ) যুগ, হাদীছ সংকলনের যুগ এবং হাদীছ ব্যাখ্যাতাদের যুগে (১ম হিজরী শতক থেকে ৯ম হিজরী শতক পর্যন্ত) কি এ হাদীছ দ্বারা এই দলীল সাব্যস্ত করেছেন যে, জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা খেলাফত উদ্দেশ্য নয় এবং ‘তাদের ইমাম’ দ্বারা খলীফা উদ্দেশ্য নয়। বরং কাগুজে রেজিস্টার্ড জামা‘আত এবং তার কাগুজে অমনোনীত আমীর উদ্দেশ্য? যদি এর কোন প্রমাণ থাকে তবে যেন পেশ করে। অন্যথায় সাধারণ মুসলমানদেরকে যেন বিভ্রান্ত না করে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : মুহতারাম আবূ জাবের আব্দুল্লাহ দামানভী হাফিযাহুল্লাহর গ্রন্থ ‘আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ’।
আছহাবুল হাদীছ কারা?
আবূ ত্বাহের বারাকাত আল-হাউযী আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, আমি মালেক ও শাফেঈর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে আবুল হাসান (আলী বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আত-ত্বাইয়িব) আল-মাগাযিলী (মৃঃ ৪৮৩ হিঃ)-এর সাথে বিতর্ক করি। আমি শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় শাফেঈকে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করি। আর তিনি মালেকী মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় মালেক (বিন আনাস)-কে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন। অতঃপর আমরা দু’জন আবূ মুসলিম (ওমর বিন আলী বিন আহমাদ বিন লায়ছ) আল-লায়ছী আল-বুখারী (মৃঃ ৪৬৬ হিঃ বা ৪৬৮ হিঃ)-কে ফায়ছালাকারী তৃতীয় ব্যক্তি (বিচারক) নির্ধারণ করলে তিনি ইমাম শাফেঈকে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন। এতে আবুল হাসান রেগে যান এবং বলেন, ‘সম্ভবতঃ আপনি তাঁর (ইমাম শাফেঈ) মাযহাবের উপরে আছেন’? জবাবে তিনি (ইমাম আবূ মুসলিম আল-লায়ছী আল-বুখারী) বললেন, نحن أصحاب الحديث، الناس على مذاهبنا فلسنا على مذهب أحد، ولوكنا ننتسب إلى مذهب أحد لقيل انتم تضعون له الأحاديث- ‘আমরা আছহাবুল হাদীছ। লোকেরা আমাদের মাযহাবের উপরে আছে। আমরা কারো মাযহাবের উপরে নেই। যদি আমরা কারো মাযহাবের দিকে সম্পর্কিত হ’তাম তাহলে বলা হ’ত, ‘তোমরা তার (মাযহাবের) জন্য হাদীছ জাল করো’।[10]
প্রতীয়মান হ’ল যে, আছহাবুল হাদীছ (আহলুল হাদীছ) কোন তাক্বলীদী মাযহাব যেমন- শাফেঈ ও মালেকী-এর মুক্বাল্লিদ ছিল না। বরং কুরআন ও হাদীছের উপরে আমলকারী ছিল। এই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তির পরেও যদি কোন ব্যক্তি এ দাবী করে যে, আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছগণ) শাফেঈ, মালেকী ও অন্যদের তাক্বলীদকারী ছিলেন, তবে এ ব্যক্তি যেন তার মস্তিষ্কের চিকিৎসা করিয়ে নেয়।
সতর্কীকরণ : ইমাম আবূ মুসলিম আল-লায়ছী ছিক্বাহ ছিলেন।[11]
সালাফে ছালেহীন ও তাক্বলীদ
আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা, ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হ’তে পারে’? (যুমার ৩৯/৯)। এই আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মানুষদের দু’টি (বড়) শ্রেণী রয়েছে।
১. আলেমগণ (মর্যাদাগত দিক থেকে আলেমদের কয়েক প্রকার রয়েছে। আর তাদের মধ্যে ইলম অন্বেষণকারীও শামিল রয়েছে)।
২. সাধারণ মানুষ (সাধারণ মানুষের কতিপয় শ্রেণী রয়েছে। আর তাদের মধ্যে নিরক্ষর মূর্খও শামিল রয়েছে)।
সাধারণ মানুষের জন্য এই বিধান যে, তারা আহলে যিকরদের (আলেম-ওলামাদের) জিজ্ঞাসা করবে (নাহল ১৬/৪৩)। এই জিজ্ঞাসাবাদ তাক্বলীদ নয়।[12] যদি জিজ্ঞাসা করা তাক্বলীদ হ’ত তাহলে ব্রেলভী ও দেওবন্দীদের সাধারণ জনতা বর্তমান ব্রেলভী ও দেওবন্দী আলেমদের মুক্বাল্লিদ হ’ত এবং নিজেদেরকে কখনো হানাফী, মাতুরীদী বা নকশবন্দী ইত্যাদি বলত না। কেউ সরফরাযী হ’ত, কেউ আমীনী, কেউ তাকাবী এবং কেউ হত ঘুম্মানী (?)। অথচ কেউই এর প্রবক্তা নন। সুতরাং সাধারণভাবে জিজ্ঞাসা করাকে তাক্বলীদ আখ্যা দেয়া ভুল ও বাতিল।
আলেমদের জন্য তাক্বলীদ জায়েয নয়। বরং সাধ্যানুযায়ী কিতাব ও সুন্নাত এবং কথা ও কর্মে ইজমার উপরে আমল করা যরূরী। যদি তিনটি দলীলের মধ্যে কোন মাসআলা না পাওয়া যায় তাহ’লে ইজতিহাদ (যেমন- ঐক্যমত পোষণকৃত ও অবিতর্কিত সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা এবং ক্বিয়াসে ছহীহ ইত্যাদি) জায়েয আছে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) বলেছেন, وَإِذَا كَانَ الْمُقَلِّدُ لَيْسَ مِنْ الْعُلَمَاءِ بِاتِّفَاقِ الْعُلَمَاءِ لَمْ يَدْخُلْ فِي شَيْءٍ مِنْ هَذِهِ النُّصُوصِ- ‘আর যখন আলেমদের ঐক্যমত অনুযায়ী (ইজমা) মুক্বাল্লিদ আলেম নয়, তখন সে এ দলীল সমূহের (আয়াত ও হাদীছ সমূহে বর্ণিত ফযীলত সমূহের) অন্তর্ভুক্ত নয়’।[13] এ উক্তির মর্ম দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আলেম মুক্বাল্লিদ হন না।
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,قَالُوْا : وَالْمُقَلِّدُ لَا عِلْمَ لَهُ وَلَمْ يَخْتَلِفُوا فِي ذَلِكَ ‘তারা (আলেমগণ) বলেছেন, মুক্বাল্লিদের কোন ইলম নেই। আর এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই’।[14]
এই ইজমা দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হ’ল যে, আলেম মুক্বাল্লিদ হন না। বরং হানাফীদের ‘আল-হিদায়া’ গ্রন্থের টীকায় লেখা আছে যে, يُحْتَمَلُ أَنْ يَكُونَ مُرَادُهُ بِالْجَاهِلِ الْمُقَلِّدَ؛ لِأَنَّهُ ذَكَرَهُ فِي مُقَابَلَةِ الْمُجْتَهِدِ ‘সম্ভবতঃ জাহিল দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য মুক্বাল্লিদ। কেননা তিনি তাকে মুজতাহিদের বিপরীতে উল্লেখ করেছেন’।[15]
এই ভূমিকার পর এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে ১০০ জন আলেমের উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল। যাদের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে যে, তারা তাক্বলীদ করতেন না।-
১. সাইয়েদুনা আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, لاتقلدوا دينكم الرجال ‘তোমরা তোমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে লোকদের তাক্বলীদ করবে না’।[16]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, اُغْدُ عَالِمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا وَلَا تَغْدُ إِمَّعَةً بَيْنَ ذَلِكَ- ‘আলেম অথবা ছাত্র হও। এতদুভয়ের মাঝে (অর্থাৎ এছাড়া) মুক্বাল্লিদ হয়ো না’।[17] ‘ইম্মা‘আহ’র একটি অনুবাদ মুক্বাল্লিদও আছে।[18] বুঝা গেল যে, ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর নিকটে লোকদের তিনটি প্রকার রয়েছে। ক. আলেম খ. ছাত্র (طالب علم) গ. মুক্বাল্লিদ।
তিনি মানুষদেরকে মুক্বাল্লিদ হ’তে নিষেধ করে দিয়েছেন এবং আলেম অথবা ছাত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
২. মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন,وأما العالم فإن اهتدى فلا تقلدوه دينكم ‘আলেম হেদায়াতের উপরে থাকলেও তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করবে না’।[19]
সতর্কীকরণ : ছাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে কোন একজন ছাহাবী থেকেও তাক্বলীদের সুস্পষ্ট বৈধতা কথা বা কর্মে সাব্যস্ত নেই। বরং হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেছেন, ‘প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ছাহাবী এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল তাবেঈর প্রমাণিত ইজমা রয়েছে যে, তাদের মধ্য থেকে বা তাদের পূর্বের কোন ব্যক্তির সকল কথা গ্রহণ করা নিষেধ এবং না জায়েয’।[20]
৩. ইমামু দারিল হিজরাহ (মদীনার ইমাম) মালিক বিন আনাস মাদানী (মৃঃ ১৭৯ হিঃ) অনেক বড় মুজতাহিদ ছিলেন। ত্বাহত্বাবী হানাফী ইমাম চতুষ্টয়ের ব্যাপারে (ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ) বলেছেন, وهم غير مقلدين ‘তারা গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[21]
মুহাম্মাদ হুসাইন ‘হানাফী’ নামক এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক মুজতাহিদ স্বীয় ধ্যান-ধারণার উপরে আমল করেন। এজন্য চার ইমামের সবাই গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[22]
মাস্টার আমীন উকাড়বী বলেছেন, ‘মুজতাহিদের উপরে ইজতিহাদ ওয়াজিব। আর নিজের মতো (অন্য) মুজতাহিদের তাক্বলীদ করা হারাম’।[23]
সরফরায খান ছফদর গাখড়ুবী দেওবন্দী বলেছেন, ‘আর তাক্বলীদ জাহিলের জন্যেই। যে আহকাম ও দলীলসমূহ সম্পর্কে অনবগত অথবা পরস্পর বিরোধী দলীলসমূহের মাঝে সমন্বয় সাধন করার ও অগ্রাধিকার দেয়ার যোগ্যতা রাখে না...’।[24]
৪. ইমাম ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মুযানী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ) বলেছেন, ‘আমার এই ঘোষণা যে, ইমাম শাফেঈ নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। যাতে (প্রত্যেক ব্যক্তি) স্বীয় দ্বীনকে সামনে রাখে এবং নিজের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করে’।[25] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, ولا تقلد وني ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ করো না’।[26]
৫. আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ইমাম ও মুজতাহিদ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ) ইমাম আওযাঈ ও ইমাম মালেক সম্পর্কে স্বীয় ছাত্র ইমাম আবূদাঊদ সিজিস্তানী (রহঃ)-কে বলেছেন, لَا تُقَلِّدْ دِينَكَ أَحَدًا مِنْ هَؤُلَاءِ ‘তুমি তোমার দ্বীনের ব্যাপারে এদের কারো তাক্বলীদ করবে না’।[27]
ফায়েদা : ইমাম নববী বলেছেন, فَإِنَّ الْمُجْتَهِدَ لَا يُقَلِّدُ الْمُجْتَهِدَ ‘কেননা নিশ্চয়ই একজন মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[28]
ইবনুত তুরকুমানী (হানাফী) বলেছেন, فَإِنَّ الْمُجْتَهِدَ لَا يُقَلِّدُ الْمُجْتَهِدَ ‘কেননা নিঃসন্দেহে একজন মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[29]
সতর্কীকরণ : কতিপয় ব্যক্তি (নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য) কতিপয় আলেমকে ত্বাবাক্বাতে মালেকিয়া, ত্বাবাক্বাতে শাফেঈয়া, ত্বাবাক্বাতে হানাবিলাহ ও ত্বাবাক্বাতে হানাফিয়াহতে উল্লেখ করেছেন। যা উল্লিখিত আলেমদের মুক্বাল্লিদ হওয়ার দলীল নয়। যেমন-
ক. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে সুবকীর ত্বাবাক্বাতে শাফেঈয়াতে (১/১৯৯; অন্য সংস্করণ, ১/২৬৭) উল্লেখ করা হয়েছে।
খ. ইমাম শাফেঈকে ত্বাবাক্বাতে মালেকিয়াহতে (আদ-দীবাজুল মুযাহহাব, পৃঃ ৩২৬, ক্রমিক নং ৪৩৭) ও ত্বাবাক্বাতে হানাবিলাহতে (১/২৮০) উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম আহমাদ কি ইমাম শাফেঈর এবং ইমাম শাফেঈ কি ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদের মুক্বাল্লিদ ছিলেন?
প্রতীয়মান হ’ল যে, উল্লিখিত ত্বাবাক্বাতে কোন আলেমের উল্লেখ থাকা তার মুক্বাল্লিদ হওয়ার দলীল নয়।[30]
৬. ইমাম আবূ হানীফা নু‘মান বিন ছাবিত কূফী কাবুলী (রহঃ) সম্পর্কে ত্বাহত্বাবী হানাফীর বক্তব্য গত হয়েছে যে, তিনি গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন (৩নং উক্তি দ্রঃ)। আশরাফ আলী থানবী দেওবন্দী বলেছেন, ‘কেননা ইমামে আ‘যম আবূ হানীফার গায়ের মুক্বাল্লিদ হওয়া সুনিশ্চিত’।[31]
ইমাম আবূ হানীফা স্বীয় শিষ্য ক্বাযী আবূ ইউসুফকে বলেন, ‘আমার সকল কথা লিখবে না। আমার আজ এক রায় হয় এবং কাল বদলে যায়। কাল অন্য রায় হয় তো পরশু সেটাও পরিবর্তন হয়ে যায়’।[32]
ফায়েদা : শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ ও হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (উভয়ের উপর আল্লাহ রহম করুন) দু’জনেই বলেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন।[33]
নিজেদেরকে হানাফী ধারণাকারীদের নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহেও লিখিত আছে যে, ইমাম আবূ হানীফা তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন।
(১) মুক্বাদ্দামা উমদাতুর রি‘আয়াহ ফী হাল্লি শারহিল বেক্বায়া, পৃঃ ৯ (২) কাওছারী, লামাহাতুন নাযর ফী সীরাতিল ইমাম যুফার, পৃঃ ২১ (৩) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৭।
৭. শায়খুল ইসলাম আবূ আব্দুর রহমান বাক্বী বিন মাখলাদ বিন ইয়াযীদ কুরতুবী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) সম্পর্কে ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনুল ফুতূহ বিন আব্দুল্লাহ আল- হুমায়দী আল-আযদী আল-আন্দালুসী আল-আছারী আয-যাহেরী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ) স্বীয় শিক্ষক আবূ মুহাম্মাদ আলী বিন আহমাদ ওরফে ইবনু হাযম থেকে বর্ণনা করেছেন, وكان متخيرا لا يقلد أحدا ‘তিনি (কুরআন, সুন্নাহ ও প্রাধান্যযোগ্য মতকে) বেছে নিতেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[34] হাফেয ইবনু হাযমের বক্তব্য ইবনে বাশকুওয়ালের কিতাবুছ ছিলাহ-তেও(১/১০৮, জীবনী ক্রমিক নং ২৮৪) উল্লেখ আছে।
হাফেয যাহাবী বাক্বী বিন মাখলাদ সম্পর্কে বলেছেন, وكان مجتهدا لايقلد أحدا بل يفتي بالأثر ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। বরং আছার (হাদীছ ও আছার) দ্বারা ফৎওয়া দিতেন’।[35]
ফায়েদা : হাফেয আবূ সা‘দ আব্দুল করীম বিন মুহাম্মাদ বিন মানছূর আত-তামীমী আস-সাম‘আনী (মৃঃ ৫৬২ হিঃ) বলেছেন, الأثري... هذه النسبة الى الأثر يعنى الحديث وطلبه واتباعه- ‘আল-আছারী... এই সম্বন্ধটি আছারের প্রতি অর্থাৎ হাদীছ, হাদীছ অনুসন্ধান এবং তার অনুসরণের দিকে সম্বন্ধ’।[36]
হাফেয সাম‘আনী বলেছেন,الظاهري... هذه النسبة إلى أصحاب الظاهر، وهم جماعة ينتحلون مذهب داود بن على الأصبهاني صاحب الظاهر، فإنهم يجرون النصوص على ظاهرها، وفيهم كثرة- ‘আয-যাহেরী... এ সম্বন্ধটি যাহেরীদের প্রতি। আর তারা ঐ জামা‘আত, যারা দাঊদ বিন আলী ইস্পাহানী যাহেরীর মাযহাবকে গ্রহণ করে। এরা নছকে (কুরআন ও হাদীছের দলীল সমূহকে) তার বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করে। আর এরা (সংখ্যায়) অনেক’।[37]
হাফেয সাম‘আনী (রহঃ) বলেছেন, اَلسَّلَفى... هذه النسبة إلى السلف وانتحال مذهبهم على ما سمعت- ‘আস-সালাফী.... এই সম্বন্ধটি সালাফ এবং তাদের মাযহাব গ্রহণ করার প্রতি। যেমনটি আমি শ্রবণ করেছি’।[38]
এর দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমানদের অসংখ্য গুণবাচক নাম ও উপাধি রয়েছে। এজন্য সালাফী, যাহেরী, আছারী, আহলেহাদীছ এবং আহলে সুন্নাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমান, যারা কুরআন, হাদীছ ও ইজমার অনুসরণ করে এবং কোন মানুষের তাক্বলীদ করে না। আল-হামদুল্লিাহ।
৮. ইমাম আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব বিন মুসলিম আল-ফিহরী আল-মিসরী (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان ثقة حجة حافظا مجتهدا لا يقلد أحدا، ذا تعبد وزهد- ‘তিনি (হাদীছ বর্ণনায়) ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য, হুজ্জাত[39], হাফেয ও মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি ইবাদতগুযার ও দুনিয়া বিমুখ ছিলেন’।[40]
৯. মছূলের বিচারক আবূ আলী আল-হাসান বিন মূসা আল-আশয়াব আল-বাগদাদী (মৃঃ ২০৯ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وَكَانَ مِنْ أَوْعِيَةِ العِلْمِ لاَ يُقَلِّدُ أَحَداً ‘তিনি ইলমের অন্যতম ভান্ডার ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[41]
১০. আবূ মুহাম্মাদ আল-ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়াসার আল-বায়ানী আল-কুরতুবী আল-আন্দালুসী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন,
ولازم ابن عبد الحكم حتى برع في الفقه وصار إماما مجتهدا لا يقلد أحدا وهو مصنف كتاب الإيضاح في الرد على
المقلدين، ‘তিনি (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্দুল হাকাম (বিন আ‘য়ান বিন লায়ছ আল-মিসরী)-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। এমনকি তিনি ফিক্বহে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং ইমাম ও মুজতাহিদ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি আল-ঈযাহ ফির রাদ্দি আলাল মুক্বাল্লিদীন গ্রন্থের রচয়িতা’।[42]
মুক্বাল্লিদদের প্রত্যুত্তরে তাঁর উক্ত গ্রন্থের নাম নিম্নোক্ত আলেমগণও উল্লেখ করেছেন-
ক. আল-হুমায়দী আল-আন্দালুসী আয-যাহেরী।[43]
খ. আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আলী বিন আব্দুল কাফী আস-সুবকী।[44]
গ. ছালাহুদ্দীন খলীল বিন আয়বাক আছ-ছাফাদী।[45]
ঘ. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী।[46]
সতর্কীকরণ : আমাদের জানা মতে হাদীছ সংকলনের যুগ (৫ম শতাব্দী হিঃ) বরং ৮ম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত কোন নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেম কিতাবুদ দিফা‘ আনিল মুক্বাল্লিদীন, কিতাবু জাওয়াযিত তাক্বলীদ, কিতাবু উজূবিত তাক্বলীদ বা এ মর্মের কোন গ্রন্থ রচনা করেননি। যদি কারো এই গবেষণা সম্পর্কে ভিন্নমত থাকে, তবে শুধুমাত্র একটি সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি পেশ করুন। কোন জবাবদাতা আছে কি?
[চলবে]
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৮৪, ৩/৭৭৯; ছহীহ মুসলিম, ৫/১৩৭, হা/১৮৪৭ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়, ‘ফিতনা আবির্ভাবের সময় এবং সর্বাবস্থায় জামা‘আতুল মুসলিমীনকে অাঁকড়ে ধরা ওয়াজিব’ অনুচ্ছেদ।
[2]. আবূদাউদ, হা/৪২৪৭, সনদ হাসান; মুসনাদে আবী ‘আওয়ানাহ, ৪/৪২০, হা/৭১৬৮।
[3]. দেখুন : সুনানে আবূদাঊদ, হা/৪২৪৪; হাকেম (৪/৪৩২-৪৩৩) একে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাঁর সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
[4]. ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।
[5]. ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।
[6]. ইবনু বাত্ত্বাল, শরহে ছহীহ বুখারী, ১০/৩৩।
[7]. ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।
[8]. ছহীহ ইবনে হিববান, ১০/৪৩৪, হা/৪৫৭৩, হাদীছ হাসান।
[9]. সুওয়ালাতু ইবনে হানী, পৃঃ ১৮৫, অনুচ্ছেদ ২০১১; তাহকীকী মাকালাত ১/৪০৩।
[10]. সুওয়ালাতুল হাফেয আস-সালাফী লিখুমাইয়েস আল-হাউযী, পৃঃ ১১৮, ক্রমিক নং ১১৩।
[11]. দেখুন : আমার গ্রন্থ ‘আল-ফাতহুল মুবীন ফী তাহক্বীক্বি ত্বাবাক্বাতিল মুদাল্লিসীন’, পৃঃ ৫৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৮/৪০৮।
[12]. দেখুন : ইবনুল হাজিব নাহবী, মুনতাহাল উছূল, পৃঃ ২১৮-২১৯ এবং আমার গ্রন্থ : ‘দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা’, পৃঃ ১৬।
[13]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০০।
[14]. জামেউ‘ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২৩১, ‘তাক্বলীদের ফিতনা’ অনুচ্ছেদ।
[15]. হেদায়া আখীরায়েন, পৃঃ ১৩২, টীকা-৬, ‘বিচারকের বৈশিষ্ট্য’ অধ্যায়।
[16]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ২/১০, সনদ ছহীছ; আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫।
[17]. জামেউ‘ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৭১-৭২, হা/১০৮, সনদ হাসান।
[18]. দেখুন : তাজুল আরূস, ১১/৪; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, পৃঃ ২৬; আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ, পৃঃ ১৩৪।
[19]. জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২২২, হা/৯৫৫, সনদ হাসান; উপরন্তু দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫-৩৭।
[20]. ইবনু হাযম, আন-নুবযাতুল কাফিয়াহ, পৃঃ ৭১; সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩১-১৩২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৪-৩৫।
[21]. হাশিয়াতুত ত্বাহত্বাবী আলাদ দুর্রিল মুখতার, ১/৫১।
[22]. মুঈনুল ফিক্বহ, পৃঃ ৮৮।
[23]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ৩/৪৩০।
[24]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ, পৃঃ ২৩৪।
[25]. মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[26]. ইবনু আবী হাতেম, আদাবুশ শাফেঈ ওয়া মানাক্বিবুহু, পৃঃ ৫১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[27]. মাসাইলু আবুদাঊদ, পৃঃ ২৭৭।
[28]. শরহ ছহীহ মুসলিম, ১/২১০, হা/২১-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[29]. বায়হাক্বী, আল-জাওহারুন নাক্বী আলাস-সুনানিল কুবরা ৬/২১০।
[30]. দেখুন : আবূ মুহাম্মাদ বদীউদ্দীন রাশেদী সিন্ধী, তানক্বীদে সাদীদ বর রিসালায়ে ইজতিহাদ ওয়া তাক্বলীদ, পৃঃ ৩৩-৩৭।
[31]. মাজালিসে হাকীমুল উম্মাত, পৃঃ ৩৪৫; মালফূযাতে হাকীমুল উম্মাত, ২৪/৩৩২।
[32]. তারীখু ইয়াহ্ইয়া বিন মাঈন, দূরীর বর্ণনা, ২/৬০৭, ক্রমিক নং ২৪৬১; সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮-৩৯।
[33]. দেখুন : ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/১০, ২১১; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০০, ২০৭, ২১১, ২২৮; সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩২।
[34]. জুযওয়াতুল মুক্বতাবাস ফী যিকরি উলাতিল আন্দালুস, পৃঃ ১৬৮; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, ১০/২৭৯।
[35]. তারীখুল ইসলাম, ২০/৩১৩, ২৭৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণকারীরা।
[36]. আল-আনসাব, ১/৮৪।
[37]. ঐ, ৪/৯৯।
[38]. ঐ, ৩/২৭৩।
39]. যিনি তিন লাখ হাদীছের ইলম সনদ ও মতনসহ মুখস্থ রাখেন তাকে হুজ্জাত বলা হয়। দ্রঃ ড. সুহায়েল হাসান, মু‘জামু ইছতিলাহাতে হাদীছ, পৃঃ ১৬৩।-অনুবাদক।
[40]. তাযকিরাতুল হুফফায, ১/৩০৫, জীবনী ক্রমিক নং ২৮৩।
[41]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৬/৫৬০।
[42]. তাযকিরাতুল হুফফায, ২/৬৪৮, জীবনী ক্রমিক নং ৬৭১।
[43]. জুযওয়াতুল মুক্বতাবাস, ১/১১৮।
[44]. ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়া আল-কুবরা, ১/৫৩০।
[45]. আল-ওয়াফী বিল ওফায়াত, ২৪/১১৬।
[46]. ত্বাবাক্বাতুল হুফফায, পৃঃ ২৮৮, জীবনী ক্রমিক নং ৬৪৭।
[সালাফে ছালেহীন ও তাক্বলীদ]
১১. হারামের উস্তাদ আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আন-নিশাপুরী (মৃঃ ৩১৮ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان مجتهدا لا يقلد أحدا ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[1]
ইমাম নববী বলেছেন, ولا يلتزم التقيد فى الاختيار بمذهب أحد بعينه، ولا يتعصب لأحد، ولا على أحد على عادة أهل الخلاف، بل يدور مع ظهور الدليل ودلالة السنة الصحيحة، ويقول بها مع من كانت، ومع هذا فهو عند أصحابنا معدود من أصحاب الشافعى- ‘তিনি মাসআলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট মাযহাব অাঁকড়ে ধরাকে আবশ্যক মনে করতেন না। আর মতভেদকারীদের অভ্যাস মতো কারো জন্য গোঁড়ামি করতেন না। বরং তিনি সুস্পষ্ট দলীল ও ছহীহ হাদীছের সাথে চলতেন। দলীল যার নিকটেই থাক না কেন তিনি তার প্রবক্তা ছিলেন। এতদসত্ত্বেও আমাদের সাথীগণের নিকটে তিনি ইমাম শাফেঈর অনুসারীদের মধ্যে গণ্য’।[2]
নববীর বক্তব্যের একটি অংশ উল্লেখ করে হাফেয যাহাবী বলেছেন, مَا يَتَقَيَّدُ بِمَذْهَبٍ وَاحِدٍ إِلاَّ مَنْ هُوَ قَاصِرٌ فِي التَّمَكُّنِ مِنَ العِلْمِ، كَأَكْثَرِ عُلَمَاءِ زَمَانِنَا، أَوْ مَنْ هُوَ مُتَعَصِّبٌ ‘একজনের মাযহাব মানার বাধ্যবাধকতা সেই আরোপ করে যে ইলম অর্জনে অক্ষম। যেমন আমাদের যুগের অধিকাংশ আলেমগণ। অথবা যে গোঁড়া ও পক্ষপাতদুষ্ট’।[3]
উক্ত উদ্ধৃতি সমূহ হ’তে দু’টি বিষয় প্রতিভাত হয়-
ক. মাযহাবগুলোর তাক্বলীদ সেই করে যে অজ্ঞ অথবা গোঁড়া।
খ. মাযহাবসমূহের তাক্বলীদকারীরা কতিপয় আলেমকে স্ব স্ব ত্বাবাক্বাতে উল্লেখ করেছেন। অথচ উল্লেখিত আলেমদের মুক্বাল্লিদ হওয়া প্রমাণিত নয়। বরং তারা তাক্বলীদের বিরোধী ছিলেন। সুতরাং মুক্বাল্লিদদের রচিত ত্বাবাক্বাত গ্রন্থসমূহের কোনই মূল্য নেই।
১২. সত্যবাদী ও হাসানুল হাদীছ-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত আবূ আলী আল-হাসান বিন সা‘দ বিন ইদরীস আল-কুতামী আল-কুরতুবী (মৃঃ ৩৩১ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان علامة مجتهدًا لا يقلد ويميل إلى أقوال الشافعي. ‘তিনি আল্লামা ও মুজতাহিদ ছিলেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি শাফেঈর বক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন’।[4]
১৩. ইমাম আওযাঈ (মৃঃ ১৫৭ হিঃ)-এর খ্যাতিমান ছাত্র এবং (স্পেনের) আমীর (খলীফা) হিশাম বিন আব্দুর রহমান বিন মু‘আবিয়া আল-আন্দালুসীর বিচারক আবূ মুছ‘আব বিন ইমরান আল-কুরতুবী সম্পর্কে ইবনুল ফারাযী বলেছেন,وكان لايقلد مَذْهَباً ويقضى ما رآه صَوَاباً وكان خيراً فاضلاً. ‘তিনি কোন মাযহাবের তাক্বলীদ করতেন না। তিনি যা সঠিক মনে করতেন সে অনুযায়ী ফায়ছালা দিতেন। তিনি সৎ ও মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন’।[5]
১৪. আবূ জা‘ফর মুহাম্মাদ বিন জারীর বিন ইয়াযীদ আত- ত্বাবারী আস-সুন্নী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان مجتهداً لا يقلد أحداً. ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[6]
ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান বলেছেন, وكان من الأئمة المجتهدين، لم يقلد أحدا، ‘তিনি মুজতাহিদ ইমামদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করেননি’।[7]
১৫. সত্যবাদী ও হাসানুল হাদীছ ক্বাযী আবুবকর আহমাদ বিন কামিল বিন খালাফ বিন শাজারাহ আল-বাগদাদী (মৃঃ ৩৫০ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, كَانَ يختَارُ لِنَفْسِهِ، وَلاَ يُقَلِّد أَحداً ‘তিনি নিজের জন্য (প্রাধান্যযোগ্য মতকে) নির্বাচন করতেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[8]
১৬. আবুবকর মুহাম্মাদ বিন দাঊদ বিন আলী আয-যাহেরী (মৃঃ ২৯৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন,وَكَانَ يَجْتَهِدُ وَلاَ يُقَلِّدُ أَحَداً. ‘তিনি ইজতিহাদ করতেন এবং কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[9]
১৭. আবূ ছাওর ইবরাহীম বিন খালিদ আল-কালবী আল- বাগদাদী আল-ফক্বীহ (মৃঃ ২৪০ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وبرع في العلم ولم يقلد أحداً ‘তিনি ইলমে পারদর্শী হয়েছিলেন এবং কারো তাক্বলীদ করেননি’।[10]
১৮. শায়খুল ইসলাম হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ আশ-শামী (মৃঃ ৭২৮ হিঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, আবূদাঊদ আত-ত্বায়ালিসী, দারেমী, বায্যার, দারাকুৎনী, বায়হাক্বী, ইবনু খুযায়মাহ এবং আবূ ইয়া‘লা আল-মূছিলী এরা কি মুজতাহিদ ছিলেন? কোন একজন ইমামের তাক্বলীদ করেননি? নাকি তারা মুক্বাল্লিদ ছিলেন’? তখন হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) জবাব দিয়েছিলেন,
الحمد لله رب العالمين، أَمَّا الْبُخَارِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ فَإِمَامَانِ فِي الْفِقْهِ مِنْ أَهْلِ الْاِجْتِهَادِ. وَأَمَّا مُسْلِمٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَه وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَأَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ وَنَحْوُهُمْ فَهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيثِ. لَيْسُوا مُقَلِّدِينَ لِوَاحِدٍ بِعَيْنِهِ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَلَا هُمْ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْمُجْتَهِدِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ-
‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। অতঃপর বুখারী ও আবুদাঊদ ফিক্বহের ইমাম ও মুজতাহিদ (মুত্বলাক্ব) ছিলেন। পক্ষান্তরে মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু খুযায়মাহ, আবু ইয়া‘লা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। আর তারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বও ছিলেন না’।[11]
এই তাহক্বীক্ব ও সাক্ষ্য থেকে চারটি বিষয় প্রতীয়মান হয়-
১. হাফেয ইবনু তায়মিয়াহর নিকটে ইমাম বুখারী ও আবূদাঊদ মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন। এজন্য তাদেরকে হানাফী, শাফেঈ, হাম্বলী বা মালেকী আখ্যা দেয়া ভুল।
২. ইমাম মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ প্রমুখ সবাই আহলেহাদীছের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। সুতরাং তাঁদেরকে তাবাক্বাতে শাফেঈয়াহ প্রভৃতি ত্বাবাক্বাতের গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করা ভুল।
৩. মুহাদ্দিছীনে কেরামের মধ্য থেকে কেউই মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
৪. মুজতাহিদগণের দু’টি স্তর রয়েছে। ১. মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব[12] এবং ২. মুজতাহিদ ‘আম।[13]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর উক্ত তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ) মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। বরং মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন।
হাফেয যাহাবী ইমাম বুখারী সম্পর্কে বলেছেন,وكان إماما حافظا حجة رأسا في الفقه والحديث مجتهدا من أفراد العالم مع الدين والورع والتأله- ‘তিনি ইমাম, হাফেয, হুজ্জাত, ফিক্বহ ও হাদীছের নেতা, মুজতাহিদ এবং দ্বীনদারী, পরহেযগারিতা ও আল্লাহভীরুতার সাথে সাথে দুনিয়ার অনন্য সাধারণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[14]
এ ধরনের অসংখ্য সাক্ষ্যের সমর্থনে আরয হ’ল যে, ‘ফায়যুল বারী’র ভূমিকা লেখক গোঁড়া দেওবন্দী বলেছেন, واعلم أن البخارى مجتهد لاريب فيه ‘জেনে নাও যে, নিশ্চয়ই বুখারী একজন মুজতাহিদ। এতে কোন সন্দেহ নেই’।[15]
সালীমুল্লাহ খান দেওবন্দী (মুহতামিম, জামে‘আ ফারূক্বিয়া দেওবন্দিয়া, করাচী) বলেছেন, ‘বুখারী হ’লেন মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব’।[16]
মুজতাহিদ সম্পর্কে এ মূলনীতি রয়েছে যে, মুজতাহিদ তাক্বলীদ করেন না। নববী বলেছেন, ‘কেননা নিঃসন্দেহে মুজতাহিদ মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[17]
১৯. ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আন- নিশাপুরী আল-কুশায়রী (মৃঃ ২৬১ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছের মাযহাবের উপরে ছিলেন। কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮ নং উক্তি দ্রঃ)। ইমাম মুসলিম বলেছেন, قَدْ شَرَحْنَا مِنْ مَذْهَبِ الْحَدِيثِ وَأَهْلِهِ ‘আমরা হাদীছ এবং আহলেহাদীছদের মাযহাব-এর ব্যাখ্যা করেছি’।[18]
সতর্কীকরণ : ইমাম মুসলিমের মুক্বাল্লিদ হওয়া কোন একজন নির্ভরযোগ্য ইমাম থেকেও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত নেই।
২০. ইমাম আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব ইবনু খুযায়মাহ আন-নিশাপুরী (মৃঃ ৩১১ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছের মাযহাবের উপরে ছিলেন। নির্দিষ্ট কোন ইমামের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না’।[19]
আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আলী বিন আব্দুল কাফী আস-সুবকী (মৃঃ ৭৭১ হিঃ) বলেছেন, قلت : المحمدون الْأَرْبَعَة مُحَمَّد بن نصر وَمُحَمّد بن جرير وَابْن خُزَيْمَة وَابْن الْمُنْذر من أَصْحَابنَا وَقد بلغُوا دَرَجَة الِاجْتِهَاد الْمُطلق، وَلم يخرجهم ذَلِك عَن كَونهم من أَصْحَاب الشافعى المخرجين على أُصُوله المتمذهبين بمذهبه لوفاق اجتهادهم اجْتِهَاده، بل قد ادّعى من هُوَ بعد من أَصْحَابنَا الخلص كالشيخ أَبى على وَغَيره أَنهم وَافق رَأْيهمْ رأى الإِمَام الْأَعْظَم فتبعوه ونسبوا إِلَيْهِ لَا أَنهم مقلدون... ‘আমি বলেছি, চার মুহাম্মাদ- মুহাম্মাদ বিন নাছর, মুহাম্মাদ বিন জারীর, ইবনু খুযায়মাহ ও ইবুনল মুনযির আমাদের সাথীদের মধ্যে ছিলেন। তাঁরা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বের স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর এ বিষয়টি তাদেরকে শাফেঈর সাথীদের থেকে বের করে দেয়নি। তারা ইমাম শাফেঈর উছূল (মূলনীতি) অনুযায়ী তাখরীজকারী এবং তার মাযহাবকে পসন্দকারী। কেননা তাদের ইজতিহাদ তাঁর (ইমাম শাফেঈ) ইজতিহাদের অনুকূলে ছিল। বরং তাদের পরে আমাদের একনিষ্ঠ সাথীবৃন্দ যেমন- আবূ আলী ও অন্যরা দাবী করেছেন যে, তাদের রায় ইমামে আযমের (ইমাম শাফেঈ) রায়ের সাথে মিলে গিয়েছিল। তাই তারা তার অনুসরণ করেছেন এবং তার দিকে সম্পর্কিত হয়েছেন। এজন্য নয় যে, তারা মুক্বাল্লিদ ছিলেন’।[20]
المتمذهبين بمذهبه (তার মাযহাব গ্রহণকারীগণ) কথাটুকু তো সুবকী নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য বলেছেন। তবে তাঁর স্বীকারোক্তি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হ’ল যে, তার নিকটে মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী, মুহাম্মাদ বিন জারীর ত্বাবারী, মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব বিন খুযায়মাহ, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির ও আবূ আলী সকলেই গায়ের মুক্বাল্লিদ (এবং আহলেহাদীছ) ছিলেন।
ফায়েদা : যেভাবে হানাফী আলেমগণ নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য অথবা কতিপয় আলেম ইমাম আবূ হানীফাকে ‘ইমামে আযম’ বলেন, সেভাবে শাফেঈ আলেমগণও ইমাম শাফেঈকে ‘ইমামে আযম’ বলে থাকেন। যেমন- তাজুদ্দীন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন তাকিউদ্দীন আস-সুবকী বলেছেন, مُحَمَّد بْن الشَّافِعِي إمامنا، الإِمَام الْأَعْظَم المطلبي أَبِي عَبْد اللَّه مُحَمَّد بْن إِدْرِيس ‘মুহাম্মাদ বিন শাফেঈ হ’লেন আমাদের ইমাম। তিনি ইমামে আযম (বড় ইমাম) আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আল-মুত্ত্বালিবী’।[21]
আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন সালামাহ আল-ক্বালয়ূবী (মৃঃ ১০৬৯ হিঃ) বলেছেন, قوله (الشافعى): هو الإمام الأعظم ‘তার বক্তব্য (আশ-শাফেঈ) : তিনিই হ’লেন আল-ইমামুল আ‘যম (মহান ইমাম)’।[22]
ক্বাসত্বালানী (শাফেঈ) ইমাম মালেককে ‘ইমামে আ‘যম’ (الإمام الأعظم) বলেছেন।[23]
ক্বাসত্বালানী ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল-ইমামুল আ‘যম’ (الإمام الأعظم)।[24]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) মুসলমানদের খলীফাকে (ইমাম) ইমামে আ‘যম (الإمام الأعظم) বলেছেন।[25]
এক্ষণে এই মুক্বাল্লিদরা ফায়ছালা করুক যে, তাঁদের মধ্যে প্রকৃত ইমামে আ‘যম কে?
আবূ ইসহাক্ব আশ-শীরাযী কতিপয় ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, وَالصَّحِيحُ الَّذِي ذَهَبَ إلَيْهِ الْمُحَقِّقُونَ مَا ذَهَبَ إلَيْهِ أَصْحَابُنَا وَهُوَ أَنَّهُمْ صَارُوا إلَى مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّ لَا تَقْلِيدًا لَهُ، بَلْ لَمَّا وَجَدُوا طُرُقَهُ فِي الِاجْتِهَادِ وَالْقِيَاسِ أَسَدَّ الطُّرُقِ ‘আর ছহীহ সেটাই যেদিকে মুহাক্কিকগণ গিয়েছেন এবং যেদিকে আমাদের সাথীগণ গিয়েছেন। আর সেটা হ’ল তারা তাক্বলীদ করার জন্য শাফেঈ মাযহাবের প্রবক্তা হননি; বরং ইজতিহাদ ও ক্বিয়াসে তাঁর (ইমাম শাফেঈ) পদ্ধতিকে সবচেয়ে সঠিক পেয়েছিলেন তাই’।[26]
এরপর নববী বলেছেন,
وَذَكَرَ أَبُو عَلِيٍّ السِّنْجِيُّ بِكَسْرِ السِّينِ الْمُهْمَلَةِ نَحْوَ هَذَا فَقَالَ اتَّبَعْنَا الشَّافِعِيَّ دُونَ غَيْرِهِ لِأَنَّا وَجَدْنَا قَوْلَهُ أَرْجَحَ الْأَقْوَالِ وَأَعْدَلَهَا لَا أَنَّا قَلَّدْنَاهُ-
‘আবূ আলী আস-সিনজী (সীন বর্ণে যের) এমনটিই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা অন্যদের বাদ দিয়ে ইমাম শাফেঈর অনুসরণ করেছি। কারণ আমরা তাঁর মতামতকে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সঠিক পেয়েছি। এজন্য নয় যে, আমরা তাঁর তাক্বলীদ করেছি’।[27]
প্রমাণিত হ’ল যে, আলেমদের নামের সাথে শাফেঈ, হানাফী মালেকী প্রভৃতি লকব থাকার উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে, তাঁরা মুক্বাল্লিদ ছিলেন। বরং সঠিক এটাই যে, তাঁরা মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। বরং তাদের ইজতিহাদ উল্লেখিত নিসবতকৃত ইমামের ইজতিহাদের সাথে মিলে গিয়েছিল।
২১. জমহূর বিদ্বানের নিকটে নির্ভরযোগ্য ক্বাযী আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ওমর বিন ইসমাঈল দাঊদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) ইবনে শাহীন বাগদাদী নামে পরিচিত আবূ হাফছ ওমর বিন আহমাদ বিন ওছমান (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ) সম্পর্কে বলেছেন, وكان أيضا لا يعرف من الفقه قليلا ولا كثيرا، وكان إذا ذكر له مذاهب الفقهاء كالشافعي وغيره، يَقُولُ: أنا محمدي المذهب، ‘তিনিও (তাক্বলীদী) ফিক্বহ বিষয়ে কম বা বেশী কিছুই জানতেন না (অর্থাৎ তিনি উক্ত তাক্বলীদী ফিক্বহকে কোন গুরুত্বই দিতেন না)। যখন তার সামনে ফক্বীহদের মাযহাব যেমন শাফেঈ ইত্যাদি উল্লেখ করা হ’ত তখন তিনি বলতেন, ‘আমি মুহাম্মাদী মাযহাবের’।[28]
২২. হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) সুনানে আবূদাঊদের রচয়িতা ইমাম আবূদাঊদ সিজিস্তানী সুলায়মান বিন আশ‘আছ (মৃঃ ২৭৫ হিঃ)-কে মুক্বাল্লিদদের দল থেকে বের করে মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব আখ্যা দিয়েছেন (১৮নং উক্তি দ্রঃ)।
২৩. সুনানে তিরমিযীর রচয়িতা ইমাম আবূ ঈসা মুহাম্মাদ বিন ঈসা বিন সাওরাহ আত-তিরমিযী (মৃঃ ২৭৯ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮নং উক্তি দ্রঃ )।
২৪. সুনানে নাসাঈর লেখক ইমাম আহমাদ বিন শু‘আইব আন-নাসাঈ (মৃঃ ৩০৩ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮নং উক্তি দ্রঃ)।
২৫. সুনানে ইবনে মাজাহর লেখক ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইয়াযীদ বিন মাজাহ আল-ক্বাযবীনী (মৃঃ ২৭৩ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮নং উক্তি দ্রঃ)।
২৬. ইমাম আবূ ইয়া‘লা আহমাদ বিন আলী ইবনুল মুছান্না আল-মূছিলী (মৃঃ ৩০৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন। নির্দিষ্ট কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮ নং উক্তি দ্রঃ)।
২৭. আবুবকর আহমাদ বিন আমর বিন আব্দুল খালেক আল-বাযযার আল-বাছরী (সত্যবাদী ও হাসানুল হাদীছ) (মৃঃ ২৯২ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন। নির্দিষ্ট কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮ নং উক্তি দ্রঃ)।
২৮. হাফেয আবু মুহাম্মাদ আলী বিন আহমাদ বিন সাঈদ বিন হাযম আল-আন্দালুসী আল-কুরতুবী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) তাক্বলীদ সম্পর্কে বলেছেন, والتقليد حرام ... والعامي والعالم في ذلك سواء وعلى كل أحد حظه الذي يقدر عليه من الاجتهاد. ‘তাক্বলীদ হারাম...। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও আলেম সমান। আর প্রত্যেকের উপরে স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী ইজতিহাদ যরূরী’।[29]
হাফেয ইবনু হাযম স্বীয় আক্বীদা সংক্রান্ত গ্রন্থে বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তির জন্য তাক্বলীদ করা বৈধ নয়। চাই জীবিত ব্যক্তির তাক্বলীদ হোক অথবা মৃত ব্যক্তির’।[30]
হাফেয ইবনু হাযম দু‘আ করতে গিয়ে বলেছেন, وأن يعصمنا من بدعة التقليد المحدث بعد القرون الثلاثة المحمودة. آمين، ‘আল্লাহ যেন আমাদেরকে প্রশংসিত তৃতীয় শতকের পরে সৃষ্ট তাক্বলীদের (অর্থাৎ চার মাযহাবের বিদ‘আত) বিদ‘আত থেকে রক্ষা করেন।-আমীন’।[31]
২৯. হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) স্বীয় বিখ্যাত গ্রন্থে অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন- باب فساد التقليد ونفيه والفرق بين التقليد والاتباع ‘তাক্বলীদের অপকারিতা ও তার নাকচ হওয়া এবং তাক্বলীদ ও ইত্তিবার মধ্যে পার্থক্য’ অনুচ্ছেদ।[32]
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র-এর মুক্বাল্লিদ হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। বরং হাফেয যাহাবী বলেছেন, فإنه ممن بلغ رتبة الأئمة المجتهدين ‘নিশ্চয়ই তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত, যারা মুজতাহিদ ইমামগণের স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন’।[33]
আর এটা সাধারণ মানুষও জানে যে, মুজতাহিদ কখনো মুক্বাল্লিদ হন না (৫ নং উক্তি দ্রঃ)।
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (রহঃ) স্বয়ং বলেছেন, لا فرق بين مقلد وبهيمة ‘মুক্বাল্লিদ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই’।[34]
সতর্কীকরণ : হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র, খত্বীব বাগদাদী প্রমুখ কতিপয় ইবারতে সাধারণ মানুষের জন্য (জীবিত) আলেমের তাক্বলীদ করাকে জায়েয বলেছেন। যার উদ্দেশ্য স্রেফ এটা যে, মূর্খ ব্যক্তি আলেমের কাছ থেকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করে তার উপরে আমল করবে। আমরাও এটা বলি যে, মূর্খ ব্যক্তির উপরে এটা যরূরী যে, সে কুরআন ও সুন্নাহর ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেমের নিকট থেকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করে তার উপরে আমল করবে। কিন্তু এটাকে তাক্বলীদ বলা ভুল। উছূলে ফিক্বহের প্রসিদ্ধ মাসআলা রয়েছে যে, সাধারণ মানুষের মুফতীর (আলেম) দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়।[35]
৩০. আমীরুল মুমিনীন খলীফা আবু ইউসুফ ই‘য়াকূব বিন ইউসুফ বিন আব্দুল মুমিন বিন আলী আল-ক্বায়সী আল-কূমী আল-মার্রাকুশী আয-যাহেরী আল-মাগরেবী (মৃঃ ৫৯৫ হিঃ) স্বীয় সাম্রাজ্যে শরী‘আতের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করেন, জিহাদের ঝান্ডা বুলন্দ করেন, ন্যায়পরায়ণতার সাথে দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেন এবং ন্যায়ের মানদন্ড কায়েম করেন।
তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান লিখেছেন, ‘তিনি একজন দানশীল বাদশাহ এবং পবিত্র শরী‘আতকে ধারণকারী ছিলেন। তিনি নির্ভয়ে ও পক্ষপাতহীনভাবে সৎ কাজের আদেশ করতেন এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতেন, যেমনটি উচিৎ। তিনি লোকদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পড়াতেন এবং পশমের পোষাক পরিধান করতেন। নারী ও দুর্বলের পাশে দাঁড়াতেন এবং তাদের হক আদায় করে দিতেন। তিনি অছিয়ত করেন, তাকে যেন রাস্তার মাঝে অর্থাৎ নিকটে দাফন করা হয়। যাতে তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকারীরা তার জন্য রহমতের দো‘আ করে’।[36]
এই মুজাহিদ ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন খলীফা (রহঃ) সম্পর্কে ইবনু খাল্লিকান আরো লিখেছেন, وأمر برفض فروع الفقه، وأن العلماء لا يفتون إلا بالكتاب العزيز والسنة النبوية، ولا يقلدون أحداً من الأئمة المجتهدين المتقدمين، بل تكون أحكامهم بما يؤدي إليه اجتهادهم من استنباطهم القضايا من الكتاب والحديث والإجماع والقياس. ‘তিনি ফিক্বহের শাখা-প্রশাখাগত বিষয়গুলি (মালেকী ফিক্বহের গ্রন্থসমূহ) পরিত্যাগ করতে এবং আলেমগণকে কেবল কুরআন ও হাদীছ দ্বারা ফৎওয়া দেওয়ার আদেশ দেন। আর তারা যেন পূর্ববর্তী মুজতাহিদ ইমামদের মধ্য থেকে কারু তাক্বলীদ না করেন। বরং কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা ইস্তিমবাতের মাধ্যমে ইজতিহাদ দ্বারা যেন তাদের ফায়ছালা হয়’।[37]
ঠিক এটাই হ’ল আহলেহাদীছদের (আহলে সুন্নাত) মানহাজ (পদ্ধতি), মাসলাক (পথ) ও দাওয়াত। আলহামদুল্লিাহ।
আহলেহাদীছদেরকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ইংরেজ আমলের সৃষ্ট আখ্যায়িতকারীরা একটু চোখ খুলে ৬ষ্ঠ হিজরীর এই গায়ের মুক্বাল্লিদ খলীফার জীবনী পড়ুক। যাতে তাদের নযরে কিছু আসে।
এই মুজাহিদ খলীফা সম্পর্কে হাফেয যাহাবী লিখেছেন যে, তিনি মুক্বাল্লিদ সম্পর্কে বলেছেন, কুরআন ও সুনানে আবুদাউদের উপরে আমল কর। নতুবা এই তলোয়ার প্রস্ত্তত রয়েছে’।[38]
হাফেয যাহাবী আরো বলেছেন,وعظم صيت العباد والصالحين في زمانه، وكذلك أهل الحديث، وارتفعت منزلتهم عنده فكان يسألهم الدعاء. وانقطع في أيامه علم الفروع، وخاف منه الفقهاء، وأمر بإحراق كتب المذهب بعد أن يجرد ما فيها من الحديث، فأحرق منها جملة في سائر بلاده، كالمدوَّنة، وكتاب ابن يونس، ونوادر ابن أبي زيد، والتهذيب للبرادعي، والواضحة لابن حبيب. ‘তাঁর আমলে ইবাদতগুযার ও সৎ লোকদের সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনুরূপভাবে আহলেহাদীছদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি তাদের (আহলেহাদীছদের) নিকট দো‘আ চাইতেন। তাঁর শাসনামলে প্রশাখাগত ইলমের অবসান হয়েছিল (অর্থাৎ তাক্বীলীদী ফিক্বহ শেষ হয়ে গিয়েছিল)। (মুক্বাল্লিদ) ফক্বীহগণ তাকে ভয় পেতেন। তিনি হাদীছসমূহকে আলাদা করার পরে মাযহাবী গ্রন্থসমূহ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর সমগ্র দেশে অনেক মাযহাবী গ্রন্থ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। যেমন-আল-মুদাউওয়ানাহ, কিতাবু ইবনে ইউনুস, ইবনু আবী যায়েদের আন-নাওয়াদির, বারাদিঈর আত-তাহযীব ও ইবনু হাবীবের আল-ওয়াযিহাহ’।
قال محيي الدين عبد الواحد بن علي المراكشي في كتاب المعجب له: ولقد كنت بفاس، فشهدت يؤتى بالأحمال منها فتوضع ويطلق فيها النار. মুহিউদ্দীন আব্দুল ওয়াহিদ বিন আলী আল-মার্রাকুশী তার ‘আল-মু‘জাব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমি ফাস (নগরীতে) ছিলাম। আমি দেখেছি যে, (ফেক্বহী) কেতাবসমূহের বোঝা এনে রাখা হ’ত এবং সেগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হ’ত’।[39]
হে আল্লাহ! এই মুজাহিদ খলীফা ও আমীরুল মুমিনীনকে জান্নাতে উচ্চমর্যাদা নছীব করুন এবং আমাদের গোনাহখাতা মাফ করে স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে এরূপ ছহীহ আক্বাদীসম্পন্ন মুজাহিদ ও মুমিনদের সাহচর্য দান করুন-আমীন!
৩১. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেছেন, ‘অতঃপর তাদের পরে এমন ব্যক্তিরা আগমন করেছিলেন, যারা তাদের হেদায়াতকে অাঁকড়ে ধরেছেন ও তাদের পথে চলেছেন। যেমন- ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্ত্বান, আব্দুর রহমান বিন মাহদী, বিশর ইবনুল মুফায্যাল, খালেদ ইবনুল হারিছ, আব্দুর রায্যাক, ওয়াকী‘, ইয়াহ্ইয়া বিন আদম, হুমায়েদ বিন আব্দুর রহমান আর-রাওয়াসী, ওয়ালীদ বিন মুসলিম, হুমায়দী, শাফেঈ, ইবনুল মুবারক, হাফছ বিন গিয়াছ, ইয়াহ্ইয়া বিন যাকারিয়া বিন আবু যায়েদাহ, আবুদাঊদ ত্বায়ালিসী, আবুল ওয়ালীদ ত্বায়ালিসী, মুহাম্মাদ বিন আবু ‘আদী, মুহাম্মাদ বিন জা‘ফর, ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহ্ইয়া নিশাপুরী, ইয়াযীদ বিন যুরা‘ই, ইসমাঈল বিন ‘উলাইয়াহ, আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ এবং তার পুত্র আব্দুছ ছামাদ, ওয়াহাব বিন জারীর, আযহার বিন সা‘দ, ‘আফফান বিন মুসলিম, বিশর বিন ওমর, আবূ আছিম আন-নাবীল, মু‘তামির বিন সুলায়মান, নাযর বিন শুমাইল, মুসলিম বিন ইবরাহীম, হাজ্জাজ বিন মিনহাল, আবু ‘আমের আল-আক্বাদী, আব্দুল ওয়াহ্হাব আছ-ছাক্বাফী, ফিরইয়াবী, ওয়াহাব বিন খালিদ, আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের ও অন্যান্যগণ। এঁদের কেউই তাঁদের পূর্বের কোন ইমামের তাক্বলীদ করেননি’ (ما من هؤلاء أحد قلد إماما كان قبله)।[40]
জানা গেল যে, ইমাম আহমাদ, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মাঈন প্রমুখের শিক্ষক, নির্ভরযোগ্য, মুতক্বিন, হাফেয, আদর্শবান ইমাম আবু সা‘ঈদ ইয়াহ্ইয়া বিন সা‘ঈদ বিন ফার্রূখ আল-ক্বাত্তবান আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
ফায়েদা : ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তবান তাবেঈ সুলায়মান বিন ত্বারখান আত-তায়মী (রহঃ) সম্পর্কে বলেছেন, তিনি আমাদের নিকটে আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত’।[41]
৩২. ছিক্বাহ, ছাবত, হাফেয, রিজাল ও হাদীছের গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ইমাম আবু সাঈদ আব্দুর রহমান বিন মাহদী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) সুয়ূত্বীর ভাষ্য অনুযায়ী মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৩. ছিক্বাহ, ছাবত, আবেদ, ইমাম আবু ইসমাঈল বিশর ইবনুল মুফায্যাল বিন লাহিক্ব আর-রাক্বাশী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮৬ অথবা ১৮৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৪. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু ওছমান খালেদ ইবনুল হারিছ বিন ওবায়েদ বিন মুসলিম আল-হুজায়মী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮৬ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথা মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৫. জমহূর বিদ্বানগণের নিকট নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ইমাম আব্দুর রায্যাক বিন হুমাম আছ-ছান‘আনী আল-ইয়ামানী (মৃঃ ২১১ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য অনুযায়ী তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৬. নির্ভরযোগ্য, হাফেয, আবেদ, ইমাম আবু সুফিয়ান ওয়াকী‘ ইবনুল জার্রাহ বিন মুলাইহ আর-রাওয়াসী আল-কূফী (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর ভাষ্যমতে তাক্বলীদকারী ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৭. বিশ্বস্ত, হাফেয, ফাযেল, আবু যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া বিন আদম বিন সুলায়মান আল-কূফী (মৃঃ ২০৩ হিঃ) সম্পর্কে সুয়ূত্বী বলেছেন যে, তিনি তাঁর পূর্বের কোন একজন ইমামেরও তাক্বলীদ করেননি (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৮. ছিক্বাহ ইমাম আবু আওফ হুমায়েদ বিন আব্দুর রহমান বিন হুমায়েদ আর-রাওয়াসী আল-কূফী (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথানুসারে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৯. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, মুদাল্লিস, ইমাম আবুল আববাস ওয়ালীদ বিন মুসলিম আল-কুরাশী আদ-দিমাশক্বী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪০. ইমাম বুখারীর শিক্ষক ছিক্বাহ, হাফেয, ফক্বীহ, ইমাম আবুবকর আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের বিন ঈসা আল-হুমায়দী আল-মাক্কী (মৃঃ ২১৯ হিঃ) সুয়ূতবীর কথানুসারে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪১. ছিক্বাহ, ছাবত, ফক্বীহ, আলেম, দানশীল, মুজাহিদ, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক আল-মারওয়াযী (মৃঃ ১৮১ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথানুপাতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪২. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ফক্বীহ আবু ওমর হাফছ বিন গিয়াছ বিন ত্বালক্ব বিন মু‘আবিয়া আল-কূফী আল-ক্বাযী (মৃঃ ১৯৫ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্যানুপাতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
সতর্কীকরণ : হাফছ বিন গিয়াছ (রহঃ) বলেছেন,كنت أجلس إلى أبي حنيفة فأسمعه يسأل عن مسألة في اليوم الواحد فيفتي فيها بخمسة أقاويل، فلما رأيت ذلك تركته وأقبلت على الحديث ‘আমি আবু হানীফার কাছে বসতাম। একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’লে সে বিষয়ে তাঁকে এক দিনে পাঁচ রকম ফৎওয়া দিতে শুনলাম। যখন আমি এটা দেখলাম, তখন তাকে ত্যাগ করলাম এবং হাদীছের প্রতি মনোনিবেশ করলাম’।[42] ইবরাহীম বিন সাঈদ আল-জাওহারী (রহঃ) থেকে এই বর্ণনার রাবী আবুবকর আহমাদ বিন জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ বিন সালম ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য ছিলেন।[43]
আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল[44] এবং আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া বিন ওছমান[45] উভয়েই তার মুতাবা‘আত করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা উক্ত রেওয়ায়াতকে ইমাম ইবরাহীম বিন সাঈদ আল-জাওহারী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইমাম হাফছ বিন গিয়াছ আল-কূফী আহলে রায়-এর মাযহাব ছেড়ে আহলেহাদীছদের মাযহাবকে গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপরে রহম করুন!
৪৩. ছিক্বাহ, মুতক্বিন, ইমাম আবু সাঈদ ইয়াহ্ইয়া বিন যাকারিয়া বিন আবী যায়েদাহ আল-হামাদানী আল-কূফী (মৃঃ ১৮৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৪. ছিক্বাহ ও সত্যবাদী, হাফেয আবুদাঊদ সুলায়মান বিন দাঊদ ইবনুল জারূদ আত-ত্বায়ালিসী আল-বাছরী (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৫. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবুল ওয়ালীদ হিশাম বিন আব্দুল মালিক আল-বাহিলী আত-ত্বায়ালিসী আল-বাছরী (মৃঃ ২২৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৬. ছিক্বাহ ইমাম আবু ‘আমর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন আবু ‘আদী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৭. গুনদার নামে পরিচিত নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী, জমহূর যাকে ছিক্বাহ বলেছেন, ইমাম মুহাম্মাদ বিন জা‘ফর আল-হুযালী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৮. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহ্ইয়া বিন বকর বিন আব্দুর রহমান আত-তামীমী আন-নিশাপুরী (মৃঃ ২২৬ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু মু‘আবিয়া ইয়াযীদ বিন যুরাই‘ আল-বাছরী (মৃঃ ১৮২ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথানুসারে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫০. ইবনু উলাইয়াহ নামে পরিচিত ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবু বিশর ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মিক্বসাম আল-আসাদী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৩ হিঃ) সুয়ূতবীর মতানুসারে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫১. ছিক্বাহ, ছাবত, সুন্নী, ইমাম আবু ওবায়দা আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ বিন যাকওয়ান আল-আমবারী আত-তান্নূরী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮০ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
৫২. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবু সাহল আব্দুছ ছামাদ বিন আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ আল-বাছরী (মৃঃ ২০৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৩. ছিক্বাহ, ইমাম আবুল আববাস ওয়াহাব বিন জারীর বিন হাযেম বিন যায়েদ আল-বাছরী আল-আযদী (মৃঃ ২০৬ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৪. ছিক্বাহ ইমাম আবুবকর আযহার বিন সাঈদ আস-সাম্মান আল-বাহেলী আল-বাছরী (মৃঃ ২০৩ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৫. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু ওছমান ‘আফফান বিন মুসলিম বিন আব্দুল্লাহ আল-বাহেলী আছ-ছাফ্ফার আল-বাছরী (মৃঃ ২১৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
৫৬. ছিক্বাহ, ইমাম আবু মুহাম্মাদ বিশর বিন ওমর ইবনুল হাকাম আয-যাহরানী আল-আযদী আল-বাছরী (মৃঃ ২০৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৭. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু ‘আছেম যাহহাক বিন মাখলাদ বিন যাহ্হাক বিন মুসলিম আশ-শায়বানী আন-নাবীল আল-বাছরী (মৃঃ ২১২ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৮. ছিক্বাহ, ইমাম আবু মুহাম্মাদ মু‘তামির বিন সুলায়মান বিন ত্বারখান আত-তায়মী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবুল হাসান নাযর বিন শুমাইল আল-মাযেনী আল-বাছরী আন-নাহবী (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬০. ছিক্বাহ, ইমাম আবূ আমর মুসলিম বিন ইবরাহীম আল-আযদী আল-ফারাহীদী আল-বাছরী (মৃঃ ২২২ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬১. ছিক্বাহ, ফাযেল, ইমাম আবু মুহাম্মাদ হাজ্জাজ বিন মিনহাল আল-আনমাত্বী আস-সুলামী আল-বাছরী (মৃঃ ২১৭ হিঃ) সুয়ূতবীর মতানুসারে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬২. ছিক্বাহ, ইমাম আবু আমের আব্দুল মালেক বিন আমর আল-ক্বায়সী আল-আক্বাদী (মৃঃ ২০৫ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৩. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আব্দুল মাজীদ আছ-ছাক্বাফী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৪. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ বিন ওয়াক্বিদ আয-যাববী আল-ফিরইয়াবী (মৃঃ ২১২ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
ইমাম ফিরইয়াবী নিজের এবং নিজের সাথীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা আহলেহাদীছদের একটা জামা‘আত ছিলাম’।[46]
৬৫. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবুবকর ওহায়েব বিন খালেদ বিন আজলান আল-বাহিলী আল-বাছরী (মৃঃ ১৬৫ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
সতর্কীকরণ : মূল কপিতে ওয়াহাব বিন খালেদ লিখিত আছে। যেটি লেখক বা কপিকারীর ভুল বলে অনুমিত হয়। আর যদি এটি ভুল না হয় তাহলে এই ত্বাবাক্বাতে আবু খালেদ বিন ওয়াহাব বিন খালেদ আল-হুমায়রী আল-হিমছী ছিক্বাহ ছিলেন।[47]
৬৬. আহলে সুন্নাতের নির্ভরযোগ্য ইমাম আবু হিশাম আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের আল-কূফী আল-হামাদানী (মৃঃ ১৯৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৭. জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান বিন আবুবকর সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) আরো বলেছেন, ‘অতঃপর তাদের পরে আগমন করেছিলেন আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ, আবু ছাওর, আবু ওবায়েদ, আবু খায়ছামাহ, আবু আইয়ূব আল-হাশেমী, আবু ইসহাক্ব আল-ফাযারী, মাখলাদ ইবনুল হুসায়েন, মুহাম্মাদ বিন ইয়াহ্ইয়া আয-যুহলী, আবু শায়বার পুত্রদ্বয় আবুবকর ও ওছমান, সাঈদ বিন মানছূর, কুতায়বা, মুসাদ্দাদ, ফাযল বিন দুকায়েন, মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না, বুনদার, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের, মুহাম্মাদ ইবনুল ‘আলা, হাসান বিন মুহাম্মাদ আয-যা‘ফারানী, সুলায়মান বিন হারব, ‘আরেম ও তাদের মতো অন্যেরা। ليس منهم أحد قلد رجلاً، وقد شاهدوا من قبلهم ورأوهم فلو رأوا آنفسهم فى سعة من أن يقلدوا دينهم أحدًا منهم لقلّدوا তাদের মধ্যে কেউই কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ করনেনি। তারা তাদের পূর্বের লোকদেরকে দেখেছিলেন এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। যদি তারা তাদের দ্বীনে কারো তাক্বলীদ করা জায়েয মনে করতেন, তবে তারা তাদের (পূর্ববর্তীদের) তাক্বলীদ করতেন’।[48]
সুয়ূত্বীর এই সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হ’ল যে, ইবনু রাহওয়াইহ নামে পরিচিত নির্ভরযোগ্য ইমাম আবু মুহাম্মাদ ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম বিন মাখলাদ আল-হানযালী আল-মারওয়াযী (মৃঃ ২৩৮ হিঃ) মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। তার (ইমাম ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী লিখেছেন, مجتهد قرين أحمد بن حنبل ‘তিনি মুজতাহিদ, আহমাদ বিন হাম্বলের সাথী’।[49]
৬৮. ছিক্বাহ, ফাযেল, ইমাম আবু ওবায়েদ আল-ক্বাসেম বিন সাল্লাম আল-বাগদাদী (মৃঃ ২২৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্যানুপাতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু খায়ছামাহ যুহায়ের বিন হারব বিন শাদ্দাদ আন-নাসাঈ আল-বাগদাদী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য অনুযায়ী কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭০. ছিক্বাহ, জলীলুল কদর ইমাম আবু আইয়ূব সুলায়মান বিন দাঊদ বিন দাঊদ বিন আলী আল-হাশেমী আল-ফক্বীহ আল-বাগদাদী (মৃঃ ২১৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭১. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবু ইসহাকব ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ ইবনুল হারেছ আল-ফাযারী (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭২. ছিক্বাহ, ফাযেল, ইমাম আবু মুহাম্মাদ মাখলাদ ইবনুল হুসায়েন আল-মুহাল্লাবী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯১ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৩. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইয়াহ্ইয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন খালেদ আয-যুহলী আন-নিশাপুরী (মৃঃ ২৬৮ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৪. ছিক্বাহ, হাফেয ইমাম, আবুবকর আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আবু শায়বাহ ইবরাহীম বিন ওছমান আল-ওয়াসেত্বী আল-কূফী (মৃঃ ২৩৫ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য অনুযায়ী কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৫. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবুল হাসান ওছমান বিন আবী শায়বাহ আল-‘আবসী আল-কূফী (মৃঃ ২৩৯ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না।
৭৬. ছিক্বাহ লেখক, ইমাম আবু ওছমান সা‘ঈদ বিন মানছূর বিন শু‘বাহ আল-খুরাসানী আল-মাক্কী (মৃঃ ২২৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথা মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৭. ছিক্বাহ, ছাবত, সুন্নী, ইমাম আবু রাজা কুতায়বা বিন সা‘ঈদ বিন জামীল আছ-ছাক্বাফী আল-বাগলানী (মৃঃ ২৪০ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
ইমাম কুতায়বা বিন সা‘ঈদ বলেছেন, إذا رأيتَ الرجل يحب أهل الحديث، مثل يحيى بن سعيد القطان، وعبد الرحمن بن مهدي، وأحمد بن حنبل وإسحاق بن راهويه- وذكر قوما آخرين- فإنه على السنة ومن خالف هذا فاعلم أنه مبتدع- ‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে ইয়াহ্ইয়া বিন সা‘ঈদ আল-ক্বাত্তবান, আব্দুর রহমান বিন মাহদী, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক বিন রাহওয়াইহ-এর মত (এবং তিনি আরো অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন) আহলেহাদীছদের ভালবাসতে দেখবে তখন জানবে যে, নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে (অর্থাৎ সুন্নী) রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তাদের বিরোধিতা করবে, জানবে যে সে বিদ‘আতী’।[1]
ইমাম ইয়াহ্ইয়া আল-ক্বাত্তবান, ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদী, ইমাম আহমাদ ও ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াইহ এরা সবাই কারো তাক্বলীদ করতেন না (৫, ৩১, ৩২ ও ৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৮. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবুল হাসান মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদ বিন মুসারবাল বিন মুসতাওরিদ আল-আসাদী আল-বাছরী (মৃঃ ২২৮ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু নু‘আইম ফযল বিন দুকায়েন ‘আমর বিন হাম্মাদ আত-তায়মী আল-মুলাঈ আল-কূফী (মৃঃ ২১৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথামতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮০. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু মূসা মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না বিন ওবায়েদ আল-বাছরী আল-আনাযী (মৃঃ ২৫২ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮১. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবুবকর মুহাম্মাদ বিন বাশ্শার বিন ওছমান আল-‘আবদী আল-বাছরী ওরফে বুনদার (মৃঃ ২৫২ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮২. ছিক্বাহ, হাফেয, ফাযেল, ইমাম আবু আব্দুর রহমান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের আল-হামাদানী আল-কূফী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৩. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবু কুরাইব মুহাম্মাদ ইবনুল ‘আলা বিন কুরাইব আল-হামাদানী আল-কূফী (মৃঃ ২৪৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৪. ইমাম শাফে‘ঈর শিষ্য, ছিক্বাহ, ইমাম আবু আলী হাসান বিন মুহাম্মাদ ইবনুছ ছাবাহ আয-যা‘ফারানী আল-বাগদাদী (মৃঃ ২৬০ হিঃ) সুয়ূতবীর কথামতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৫. ছিক্বাহ, ইমাম, হাফেয সুলায়মান বিন হারব আল-আযদী আল-বাছরী আল-ওয়াশিহী (মৃঃ ২২৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৬. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবুন নু‘মান মুহাম্মাদ ইবনুল ফযল আস-সাদূসী আল-বাছরী ওরফে ‘আরিম (মৃঃ ২২৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
ফায়েদা : ইমাম আবুন নু‘মান সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, تغير قبل موته فما حدَّث ‘মৃত্যুর পূর্বে তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তবে তিনি (এ অবস্থায়) কোন হাদীছ বর্ণনা করেননি’।[2]
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইমাম আবুন নু‘মানের বর্ণনাসমূহের উপরে ইখতিলাত্বের অভিযোগ ভুল ও প্রত্যাখ্যাত ।
৮৭. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (সম্ভবতঃ হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী থেকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে) বলেছেন,ولم أجد أحدًا ممن يوصف بالعلم قديمًا وحديثًا يستجيز التقليد ولا يأمر به وكذلك ابن وهب وابن الماجشون والمغيرة بن أبى حازم ومطرف وابن كنانة لم يقلّدوا شيخهم مالكًا فى كل ما قال : بل خالفوه فى مواضع واختاروا غير قوله- ‘আমি প্রাচীন ও আধুনিক যুগের কোন আলেমকে পাইনি, যিনি তাক্বলীদকে জায়েয বলেন এবং এ ব্যাপারে হুকুম দেন। অনুরূপভাবে ইবনু ওয়াহাব, ইবনুল মাজিশূন, মুগীরাহ বিন আবু হাযিম, মুত্বাররিফ ও (ওছমান বিন ঈসা) ইবনু কিনানাহ তাদের শিক্ষক মালেক-এর প্রত্যেকটি কথার তাক্বলীদ করেননি। বরং অনেক জায়গায় তারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন এবং অন্যের বক্তব্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন’।[3]
জানা গেল যে, (সত্যপরায়ণ ইমাম) আবু মারওয়ান আব্দুল মালেক বিন আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন আবু সালামাহ আল-মাজিশূন আল-কুরাশী আত-তায়মী আল-মাদানী (মৃঃ ২১৩ হিঃ) সুয়ূত্বীর দৃষ্টিতে তাক্বলীদ করতেন না।
সতর্কীকরণ : মূলে মুগীরাহ বিন আবু হাযেম আছে। অথচ সঠিক হ’ল মুগীরাহ ও ইবনু আবী হাযেম। যেমনটি ইবনু হাযমের জাওয়ামিউস সীরাহ (১/৩২৬ পৃঃ) থেকে প্রতীয়মান হয়। মুগীরাহ দ্বারা উদ্দেশ্য ইবনু আব্দুর রহমান আল-মাখযূমী এবং ইবনু আবী হাযেম দ্বারা উদ্দেশ্য আব্দুল আযীয।
৮৮. সত্যবাদী, ফক্বীহ, মুগীরাহ বিন আব্দুর রহমান ইবনুল হারিছ বিন আব্দুল্লাহ বিন ‘আইয়াশ আল-মাখযূমী আল-মাদানী (মৃঃ ১৮৮ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৮৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৯. সত্যবাদী, ফক্বীহ, আব্দুল আযীয বিন আবু হাযেম আল-মাদানী (মৃঃ ১৮৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৮৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৯০. ইমাম মালেকের ভাগ্নে, নির্ভরযোগ্য ইমাম আবু মুছ‘আব মুত্বাররিফ বিন আব্দুল্লাহ বিন মুত্বাররিফ আল-ইয়াসারী আল-মাদানী (মৃঃ ২২০ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৮৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৯১. হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী বলেছেন,ثم أصحاب الشافعي، وكانوا مجتهدين غير مقلدين كأبي يعقوب البويطي وإسماعيل بن يحيى المزني- ‘অতঃপর ইমাম শাফে‘ঈর ছাত্রগণ। তারা মুজতাহিদ ও গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন। যেমন- আবু ইয়াকূব আল-বুওয়ায়ত্বী ও ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মুযানী’।[4]
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইবনু হাযমের নিকটে ইমাম শাফে‘ঈ (রহঃ)-এর শিষ্য আবু ইয়াকূব ইউসুফ বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মিছরী আল-বুওয়ায়ত্বী (নির্ভরযোগ্য ইমাম, ফক্বীহদের সর্দার, মৃঃ ২৩১ হিঃ) গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন।
৯২. ছিক্বাহ, ইমাম, ফক্বীহ আবু ইবরাহীম ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া বিন ইসমাঈল আল-মুযানী আল-মিসরী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ) ইবনু হাযমের কথামতে গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন (৪ ও ৯১ নং উক্তি দ্রঃ)।
আবু আলী আহমাদ বিন আলী ইবনুল হাসান বিন শু‘আইব বিন যিয়াদ আল-মাদায়েনী (মৃঃ ৩২৭ হিঃ) হাসানুল হাদীছ। জমহূর তাকে ছিক্বাহ বলেছেন। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইমাম মুযানী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাক্বলীদের ফায়ছালা করে তাকে বলা যায়, তোমার ফায়ছালার কোন দলীল কি তোমার কাছে আছে? যদি সে বলে, হ্যাঁ, তাহ’লে সে তাক্বলীদকে বাতিল করে দিল। কেননা দলীল সেই ফায়ছালাকে তার নিকটে আবশ্যক করেছে, তাক্বলীদ নয়। আর যদি সে বলে, দলীল ছাড়া। তবে তাকে বলা যায়, তাহ’লে তুমি কিসের জন্য রক্ত প্রবাহিত করেছ, লজ্জাস্থানকে হালাল করে দিয়েছ এবং সম্পদসমূহ নষ্ট করেছ? অথচ আল্লাহ তোমার উপরে এসব হারাম করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তুমি দলীল ছাড়াই তা হালাল করে দিলে’?[5]
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে ইমাম মুযানী অত্যন্ত সুন্দর ও সাধারণের বোধগম্য পদ্ধতিতে তাক্বলীদকে বাতিল সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন!
৯৩. মালাকাহর খতীব আল্লামা আবু মুহাম্মাদ আব্দুল আযীম বিন আব্দুল্লাহ বিন আবুল হাজ্জাজ ইবনুশ শায়খ বালাবী (মৃঃ ৬৬৬ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী এবং খলীল বিন আয়বাক আছ-ছাফাদী দু’জনেই বলেছেন, وله اختيارات لا يقلد فيها أحدا- ‘তার নির্দিষ্ট কিছু মাসআলা ছিল। সেগুলোতে তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[6]
৯৪. সুয়ূত্বী হাফেয ইবনু হাযম থেকে বর্ণনা করেছেন, ومن آخر ما أدركنا على ذلك شيخنا أبو عمر الطلمنكى فما كان يقلّد أحدًا وذهب إلى قول الشافعي فى بعض المسائل والآن محمد بن عوف لايقلّد أحدًا وقال بقول الشافعي فى بعض المسائل- ‘আমরা তাক্বলীদ না করার উপর সর্বশেষ যাদেরকে পেয়েছি তাদের মধ্যে আমাদের উস্তাদ আবু ওমর আত-ত্বলামানকী রয়েছেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি কতিপয় মাসআলায় শাফে‘ঈর মতাবলম্বন করেছেন। আর বর্তমানে রয়েছেন মুহাম্মাদ বিন ‘আওফ, যিনি কারো তাক্বলীদ করেন না। তিনি কতিপয় মাসআলায় শাফে‘ঈর কথামত ফৎওয়া দিয়েছেন’।[7]
প্রমাণিত হ’ল যে, ছিক্বাহ, ইমাম, হাফেয আবু ওমর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-মু‘আফিরী আল-আন্দালুসী আত-ত্বলামানকী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) হাফেয ইবনু হাযমের দৃষ্টিতে কারো তাক্বলীদ করতেন না।
ইমাম ত্বলামানকী সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, الإمام المقرئ المحقق المحدث الحافظ الأثري- ‘তিনি ইমাম, ক্বারী, মুহাক্কিক, মুহাদ্দিছ, (হাদীছের) হাফেয ও আছারী’।[8]
৯৫. কতিপয় হানাফী ও গায়ের হানাফী ফক্বীহ আবু বকর আল-ক্বাফফাল, আবু আলী এবং ক্বাযী হুসায়েন থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তারা বলেছেন,لسنا مقلّدين للشافعي بل وافق رأينا رأيه- ‘আমরা শাফে‘ঈর মুক্বাল্লিদ নই। বরং আমাদের
মত তাঁর মতের সাথে মিলে গিয়েছে’।[9]
জানা গেল যে, (এই আলেমদের নিকটে) আল্লামা আবু বকর আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-ক্বাফফাল আল-মারওয়াযী আল-খুরাসানী আশ-শাফে‘ঈ (মৃঃ ৪১৭ হিঃ) মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।
৯৬. পূর্বের উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, ক্বাযী আবু আলী হুসায়েন আল-মারওয়াযী আশ-শাফে‘ঈ (মৃঃ ৪৬২ হিঃ) মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না (৯৫ নং উক্তি দ্রঃ)।
৯৭. আবু আলী আল-হাসান (আল-হুসায়েন) বিন মুহাম্মাদ বিন শু‘আইব আস-সিনজী আল-মারওয়াযী আশ-শাফে‘ঈ (মৃঃ ৪৩২ হিঃ) মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না (৯৫ নং উক্তি দ্রঃ)।
প্রতীয়মান হ’ল যে, যে সকল আলেমকে শাফে‘ঈ বলা হয়, তারা তাদের ঘোষণা এবং সাক্ষ্য অনুযায়ী মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।[10]
৯৮. শায়খুল ইসলাম হাফেয তাক্বিউদ্দীন আবুল আববাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম আল-হার্রানী ওরফে ইবনু তায়মিয়াহ (মৃঃ ৭২৮ হিঃ) বলেছেন, إنَّمَا أَتَنَاوَلُ مَا أَتَنَاوَلُهُ مِنْهَا عَلَى مَعْرِفَتِي بِمَذْهَبِ أَحْمَدَ، لَا عَلَى تَقْلِيدِي لَهُ- ‘আহমাদের মাযহাব হ’তে আমি কেবলমাত্র ঐ বিষয়গুলি গ্রহণ করি, যেগুলি আমার জানা আছে। আমি তার তাকবলীদ করি না’।[11]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ বলেছেন, ‘যদি কেউ এটা বলে যে, সাধারণ মানুষের উপর অমুক অমুকের তাক্বলীদ ওয়াজিব, তাহ’লে এটা কোন মুসলমানের কথা নয়’।[12]
তিনি আরো বলেন, ‘কোন একজন মুসলমানের উপরেও আলেমদের মধ্য হ’তে কোন একজন নির্দিষ্ট আলেমের সকল কথায় তাক্বলীদ ওয়াজিব নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাযহাবকে অাঁকড়ে ধরা কোন একজন মুসলমানের উপর ওয়াজিব নয় যে, সব বিষয়ে তারই আনুগত্য শুরু করে দিবে’।[13]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ সম্পর্কে তার ছাত্র হাফেয যাহাবী বলেছেন, المجتهد المفسر ‘তিনি একজন মুফাসসির ও মুজতাহিদ’।[14]
৯৯. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিইয়াহ (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) তাক্বলীদের খন্ডনে ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ‘আন রবিবল ‘আলামীন’ নামে একটি জবরদস্ত কিতাব লিখেছেন এবং বলেছেন, وَإِنَّمَا حَدَثَتْ هَذِهِ الْبِدْعَةُ فِي الْقَرْنِ الرَّابِعِ الْمَذْمُومِ عَلَى لِسَانِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আর (তাক্বলীদের) এই বিদ‘আত চতুর্থ হিজরীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। যেটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যবানে নিন্দিত’।[15]
আহলেহাদীছদের নিকটে সালাফে ছালেহীনের ঐক্যমত পোষণকৃত বুঝের আলোকে কুরআন, হাদীছ ও ইজমার উপরে আমল হওয়া উচিত। আর তাক্বলীদ জায়েয নয়। যেহেতু হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িমও এই মাসলাকেরই প্রবক্তা ও আমলকারী ছিলেন, সেহেতু যাফর আহমাদ থানবী দেওবন্দী স্বীয় খাছ দেওবন্দী ধাঁচে বলেছেন,لأنا رأينا أن ابن القيم الذى هو الأب لنوع هذه الفرقة- ‘কেননা আমরা দেখেছি যে, ইবনুল ক্বাইয়িমই হ’লেন এই ধরনের (অর্থাৎ আহলেহাদীছ) ফিরক্বার জনক’।[16]
১০০. হাফেয আবূ আব্দুল্লাহ শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন ওছমান আয-যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) বহু জায়গায় স্পষ্টভাবে তাক্বলীদের বিরোধিতা করেছেন এবং বলেছেন,
وكل إمام يؤخذ من قوله ويُترك إلا إمام المتقين الصادق المصدوق الأمين المعصوم صلوات الله وسلامه عليه، فيا لله العجب من عالم يقلد دينه إماما بعينه في كل ما قال مع علمه بما يرد على مذهب إمامه من النصوص النبوية فلا قوة إلا بالله-
‘মুত্তাকীদের নেতা, সত্যবাদী, সত্যায়নকৃত, বিশ্বস্ত, নিষ্পাপ নবী (ছাঃ) ব্যতীত প্রত্যেক ইমামের কথা গ্রহণ ও বর্জন করা যায়। আল্লাহর কসম! এটা আশ্চর্যজনক যে, একজন আলেম তার দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট ইমামের প্রত্যেক কথায় তাক্বলীদ করে। অথচ সে জানে যে, ছহীহ হাদীছসমূহ তার ইমামের মাযহাবকে বাতিল করে দেয়। অতঃপর নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত’।[17]
হাফেয যাহাবীর উক্তির শেষে ‘(লা হাওলা) ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ লেখা একথার দলীল যে, তাঁর নিকটে তাক্বলীদ একটি শয়তানী কাজ। এজন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা তিনি আমাদেরকে এই শয়তানী কাজ থেকে সর্বদা রক্ষা করুন! আমীন!! (১১নং উক্তি দ্রঃ)।
আমরা আমাদের দাবী এবং তাক্বলীদ শব্দের শর্ত অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর একশ (১০০) আলেমের এমন উদ্ধৃতিসমূহ পেশ করেছি, যারা স্পষ্টভাবে তাক্বলীদ করতেন না অথবা তাক্বলীদের বিরোধী ছিলেন। আমাদের জানা মতে কোন একজন বিশ্বস্ত, সত্যবাদী, ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য ইমাম থেকে প্রচলিত তাক্বলীদের আবশ্যকতা অথবা এর উপরে আমল প্রমাণিত নেই। আর দুনিয়ার কোন ব্যক্তি এই গবেষণার বিপরীতে কোন নির্ভরযোগ্য ইমাম থেকে তাক্বলীদের অপরিহার্যতা বা এর উপরে আমলের একটি উদ্ধৃতিও পেশ করতে পারবে না। وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا ‘যদিও তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৮৮)। আল-হামদুলিল্লাহ।
সতর্কীকরণ : একশ উদ্ধৃতিসমৃদ্ধ এই গবেষণার উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে, এই প্রবন্ধে যে সকল আলেমের উল্লেখ নেই বা নাম নেই, তারা তাক্বলীদ করতেন। বরং তাক্বলীদের নিষিদ্ধতার উপরে তো খায়রূল কুরূনের (স্বর্ণ যুগ) ইজমা রয়েছে।[18]
এরা ছাড়া আরো অনেক আলেমও ছিলেন, যাদের থেকে সুস্পষ্টভাবে তাক্বলীদ শব্দ প্রয়োগের সাথে সাথে এর (তাক্বলীদ) নিষিদ্ধতা ও প্রত্যাখ্যান প্রমাণিত রয়েছে। যেমন-
(১) জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) তাক্বলীদের খন্ডনে ‘আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল ‘আরয ওয়া জাহেলা ‘আন্নাল ইজতিহাদা ফী কুল্লি আছরিন ফারয’ (الرد على من أخلد إلى الأرض وجهل أن الاجتهاد فى كل عصر فرض) শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন এবং এতে باب فساد التقليد ‘তাক্বলীদের ফিতনা’ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন। আর হাফেয ইবনু হাযম থেকে সমর্থনমূলকভাবে উদ্ধৃত করেছেন যে, التقليد حرام ‘তাক্বলীদ হারাম’ (ঐ, পৃঃ ১৩১)।
সুয়ূত্বী তাঁর অন্য একটি গ্রন্থে বলেছেন,
والذى يجب أن يقال : كل من انتسب إلى إمام غير رسول الله صلى الله عليه وسلم يوالى على ذلك ويعادى عليه فهو مبتدع خارج عن السنة والجماعة سواء كان فى الأصول أو الفروع-
‘এটা বলা ওয়াজিব (ফরয) যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন ইমামের দিকে সম্বন্ধিত হয়ে যায় এবং এই সম্বন্ধকরণের উপর সে বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা পোষণ করে, তবে সে বিদ‘আতী এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ। চাই (এই সম্বন্ধ) মূলনীতিতে হোক বা শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে হোক’।[19]
(২) যায়লাঈ (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ/১৩৪৩ খ্রিঃ) হানাফী (!) বলেছেন, فالمقلد ذهل والمقلد جهل ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ মূর্খতা করে’।[20]
(৩) বদরুদ্দীন ‘আয়নী (৭৬২-৮৫৫ হিঃ) হানাফী (!) বলেছেন,فالمقلد ذهل والمقلد جهل وآفة كل شيء من التقليد- ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ মূর্খতা করে। আর তাক্বলীদের কারণে সকল বস্ত্তর বিপদ’।[21]
(৪) ইমাম ত্বাহাবী (২৩৮-৩২১ হিঃ) হানাফী (!) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, وهل يقلد إلا عصبي أو غبي ‘গোঁড়া ও আহম্মক ব্যতীত কেউ তাক্বলীদ করে কি’?[22]
(৫) আবূ হাফছ ইবনুল মুলাক্কিন (মৃঃ ৮০৪ হিঃ) বলেছেন,وغالب ذلك إنما يقع (من) التقليد، ونحن (براء منه) بحمد الله ومنه- ‘সাধারণতঃ তাক্বলীদের কারণে এমন কথাবার্তা হয়। আর আমরা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর অনুগ্রহের সাথে তা থেকে মুক্ত’।[23]
(৬) আবূ যায়েদ কাযী ওবায়দুল্লাহ আদ-দাবূসী (মৃঃ ৪৩০ হিঃ/১০৩৯ খ্রিঃ) হানাফী (!) বলেছেন, ‘তাক্বলীদের সারমর্ম এই যে, মুক্বাল্লিদ নিজেকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে একাকার করে দেয়...। যদি মুক্বাল্লিদ নিজেকে এজন্য জন্তু বানিয়ে নিয়েছে যে, সে বিবেক ও অনুভূতি শূন্য। তাহ’লে তার (মস্তিষ্কের) চিকিৎসা করানো উচিৎ’।[24]
(৭) বড় আলেম, শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের বিন মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া বিন মুহাম্মাদ আমীন আল-আববাসী আস-সালাফী এলাহাবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ) তাক্বলীদ করতেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের দলীলের উপরে আমল করতেন এবং নিজে ইজতিহাদ করতেন।[25]
তিনি (ফাখের এলাহাবাদী) বলেছেন, জমহূর-এর নিকটে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের তাক্বলীদ করা জায়েয নেই। বরং ইজতিহাদ ওয়াজিব...। তাক্বলীদের বিদ‘আত হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়েছে’।[26]
আলেম কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা ইজতিহাদ করবেন। অন্যদিকে জাহেলের ইজতিহাদ এই যে, সে ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেমের কাছ থেকে কুরআন ও হাদীছের মাসআলাগুলি জিজ্ঞাসা করে সেগুলির উপর আমল করবে। আর এটা তাক্বলীদ নয়।
(৮) আবুবকর অথবা আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ ওরফে ইবনু খুওয়াইয মিনদাদ আল-বাছরী আল-মালেকী (হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর শেষে মৃত) বলেছেন,
اَلتَّقْلِيْدُ مَعْنَاهُ فِي الشَّرْعِ الرُّجُوْعُ إِلَى قَوْلٍ لاَ حُجَّةَ لِقَائِلِهِ عَلَيْهِ، وَهَذَا مَمْنُوْعٌ مِنْهُ فِي الشَّرِيْعَةِ، وَالِاتِّبَاعُ مَا ثَبَتَ عَلَيْهِ حُجَّةٌ-
‘শরী‘আতে তাক্বলীদের অর্থ হ’ল, এমন ব্যক্তির কথার দিকে ধাবিত হওয়া যে বিষয়ে তার কোন দলীল নেই। আর এটি শরী‘আতে নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে ইত্তেবা হ’ল যেটি দলীল দ্বারা সাব্যস্ত’।[27]
সতর্কীকরণ : হাফেয ইবনু আব্দুল বার্র এই উক্তিটি উল্লেখ করেছেন এবং কোন প্রত্যুত্তর দেননি। সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, এটি ইবনু খুওয়াইয মিনদাদের অপ্রচলিত উক্তিসমূহের মধ্য হ’তে নয়।[28]
(৯) সমকালীনদের মধ্য থেকে ইয়েমনের প্রসিদ্ধ শায়খ মুক্ববিল বিন হাদী আল-ওয়াদি‘ঈ বলেছেন, ‘তাক্বলীদ হারাম। কোন মুসলমানের জন্য জায়েয নয় যে, সে আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে (কারো) তাক্বলীদ করবে’।[29]
(১০) সঊদী আরবের প্রধান বিচারপতি (পরে গ্র্যান্ড মুফতী) শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (১৯১৩-১৯৯৯ খ্রিঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রশংসা যে আমি গোঁড়া নই। তবে আমি কুরআন ও হাদীছ অনুযায়ী ফায়ছালা করি। আমার ফৎওয়া সমূহের ভিত্তি ‘আল্লাহ বলেছেন’ এবং রাসূল বলেছেন’-এর উপর। হাম্বলী বা অন্যদের তাক্বলীদের উপরে নয়’।[30]
(১১) ইবনুল জাওযীর তাক্বলীদ না করার ব্যাপারে দেখুন তাঁর ‘আল-মুশকিলু মিন হাদীছিছ ছহীহায়েন’ (১/৮৩৩) গ্রন্থটি এবং মাসিক ‘আল-হাদীছ’ (হাযরো), ৭৩ সংখ্যা।
ব্রেলভীদের পীর সুলতান বাহূ বলেছেন, ‘চাবি হ’ল সরাসরি সংঘবদ্ধতা। আর তাক্বলীদ হ’ল অসংঘবদ্ধতা এবং পেরেশানী। বরং তাক্বলীদপন্থী জাহিল এবং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে থাকে’।[31]
সুলতান বাহূ আরো বলেছেন, ‘তাওহীদপন্থীরা হেদায়াতপ্রাপ্ত, সাহায্যপ্রাপ্ত এবং তাহকীককারী হয়। তাক্বলীদপন্থীরা দুনিয়াদার, অভিযোগকারী এবং মুশরিক হয়’।[32]
একশটি উদ্ধৃতির মধ্যে উল্লেখিত আলেমগণ এবং পরে উল্লেখিতদের মোকাবেলায় দেওবন্দী ও ব্রেলভী ফিরক্বার আলেমরা এটা বলেন যে, তাক্বলীদ ওয়াজিব এবং অতীত কালের আলেমগণ মুক্বাল্লিদ ছিলেন।
এই তাক্বলীদপন্থীদের চারটি উদ্ধৃতি এবং শেষে সেগুলির জবাব পেশ করা হ’ল-
(১) মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুভী দেওবন্দী (১২৪৮-১২৯৭ হিঃ) বলেছেন, ‘দ্বিতীয় এই যে, আমি ইমাম আবূ হানীফার মুক্বাল্লিদ। এজন্য আমার বিপরীতে আপনি যে কথাই বিরোধিতা স্বরূপ পেশ করবেন সেটা ইমাম আবূ হানীফার হতে হবে। এ কথা আমার উপর হুজ্জাত (দলীল) হবে না যে, শামী এটা লিখেছেন এবং দুর্রে মুখতার গ্রন্থকার এটা বলেছেন। আমি তাদের মুক্বাল্লিদ নই’।[33]
(২) মাহমূদ হাসান দেওবন্দী (১২৬৮-১৩৩৯ হিঃ) একটি মাসআলা সম্পর্কে বলেছেন, ‘হক ও ইনছাফ এই যে, এই মাসআলায় শাফে‘ঈর মত অগ্রগণ্য। আর আমরা মুক্বাল্লিদ। আমাদের উপর আমাদের ইমাম আবূ হানীফার তাক্বলীদ ওয়াজিব। আল্লাহই ভালো জানেন’।[34]
(৩) আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী (১২৭২-১৩৪০ হিঃ)أجلى الأعلام أن الفتوى مطلقا على قول الإمام শিরোনামে একটি পুস্তিকা লিখেছেন। যার অর্থ ‘ফৎওয়া কেবলমাত্র ইমাম আবূ হানীফার কথার উপরেই হবে’!
তাক্বলীদ সম্পর্কে মিথ্যা বলতে গিয়ে এবং ধোঁকা দিতে গিয়ে আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী বলেছেন, ‘বিশেষতঃ তাক্বলীদের মাসআলায় তাদের মাযহাব অনুযায়ী এগারোশ বছরের আইম্মায়ে দ্বীন, কামেল আলেম-ওলামা এবং আওলিয়ায়ে আরিফীন (আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন) সবাই মুশরিক আখ্যা পাচ্ছেন। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই’।[35]
(৪) আহমাদ ইয়ার নাঈমী ব্রেলভী বলেছেন, ‘আমাদের দলীল এই বর্ণনাগুলি নয়। আমাদের আসল দলীল তো ইমামে আযম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর আদেশ’।[36]
নিবেদন রইল যে, এগারোশ বছরে কোন একজন ছিক্বাহ ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেম থেকে আপনাদের প্রচলিত তাক্বলীদের আবশ্যকতা অথবা বৈধতার কথা বা কর্মে কোন প্রমাণ নেই। আমার পক্ষ থেকে সকল দেওবন্দী ও ব্রেলভীকে চ্যালেঞ্জ থাকল যে, এই গবেষণামূলক প্রবন্ধে উল্লেখিত একশটি নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতির মোকাবেলায় খায়রুল কুরূনের ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সালাফে ছালেহীন থেকে স্রেফ দশটি উদ্ধৃতি পেশ করুক। যেখানে এটি লিখিত আছে যে, মুসলমানদের উপরে চাই তারা (আলেম হোক বা সাধারণ মানুষ) ইমাম চতুষ্টয় (ইমাম আবূ হানীফা, মালেক, শাফে‘ঈ ও আহমাদ)-এর মধ্য থেকে স্রেফ একজনের তাক্বলীদ ওয়াজিব এবং অবশিষ্ট তিনজনের (তাক্বলীদ) হারাম। আর মুক্বাল্লিদের জন্য এটা জায়েয নয় যে, সে স্বীয় ইমামের কথাকে বর্জন করে কুরআন ও হাদীছের উপর আমল করবে। যদি থাকে তবে উদ্ধৃতি পেশ করুক।
আর যদি এমন কোন প্রমাণ না থাকে এবং আদৌ নেই। বরং আমার উল্লেখিত উদ্ধৃতিসমূহ এই বানোয়াট তাক্বলীদী মূর্তিকে টুকরো টুকরো করে ধ্বংস করে দিয়েছে। অতএব এগারো শত বছরের আলেমদের নাম বলে মিথ্যা ভয় দেখাবেন না। খায়রুল কুরূনের সকল সালাফে ছালেহীনের ইজমা এবং পরবর্তী জমহূর সালাফে ছালেহীনের তাক্বলীদ বিরোধিতা এবং খন্ডন করা এ কথার দলীল যে, এই মাসআলাটি (তাক্বলীদ করা) সালাফে ছালেহীনের একেবারেই বিপরীত। যদি প্রচলিত তাক্বলীদকে ওয়াজিব বলা হয় তাহলে কুরআন, হাদীছ ও ইজমার বিরোধিতা করার সাথে সাথে চৌদ্দশত বছরের সালাফে ছালেহীনের বিরোধিতা এবং খন্ডন আবশ্যক হয়ে যায়। যা মূলতঃ বাতিল। অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ।
কতিপয় ফায়েদা :
(১) আল্লামা সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেছেন, والذى يجب أن يقال : كل من انتسب إلى إمام غير رسول الله صلى الله عليه وسلم يوالى على ذلك ويعادى عليه فهو مبتدع خارج عن السنة والجماعة سواء كان فى الأصول أو الفروع- ‘এটা বলা ওয়াজিব (ফরয) যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন ইমামের দিকে সম্বন্ধিত হয়ে যায় এবং এই সম্বন্ধকরণের উপর সে বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা পোষণ করে, তবে সে বিদ‘আতী এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ। চাই (এই সম্বন্ধ) মূলনীতিতে হোক বা শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে হোক’।[37]
(২) ইমাম হাকাম বিন উতায়বা (মৃঃ ১১৫ হিঃ) বলেছেন, لَيْسَ أَحَدٌ مِنْ خَلْقِ اللهِ إِلَّا يُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِهِ وَيُتْرَكُ إِلَّا النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নবী (ছাঃ) ব্যতীত আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে এমন কেউ নেই যার কথা গ্রহণ বা বর্জন করা যাবে’।[38]
আহলেহাদীছ কখন থেকে আছে আর দেওবন্দী ও ব্রেলভী মতবাদের সূচনা কখন হয়েছে :
প্রশ্ন : আমরা এটা শুনতে থাকি যে, আহলেহাদীছগণ ইংরেজদের আমলে শুরু হয়েছে। পূর্বে এদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। দয়া করে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের অতীতকালের আহলেহাদীছ আলেমদের নাম সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ লিখবেন। ধন্যবাদ। -মুহাম্মাদ ফাইয়ায দামানভী, ব্রাডফোর্ড, ইংল্যান্ড।
জবাব : যেভাবে আরবী ভাষায় ‘আহলুস সুন্নাহ’ অর্থ সুন্নাতপন্থী, সেভাবে আহলুল হাদীছ অর্থ হাদীছপন্থী। যেভাবে সুন্নাতপন্থী দ্বারা ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সুন্নী ওলামা এবং তাদের অনুসারী ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণকে বুঝায়, সেভাবে হাদীছপন্থী দ্বারা ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দেছীনে কেরাম এবং তাদের অনুসারী ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণকে বুঝায়।
স্মর্তব্য যে, আহলে সুনণাত এবং আহলেহাদীছ একই দলের দু’টি গুণবাচক নাম মাত্র। ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দেছীনে কেরামের কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। যেমন-
(১) ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)। (২) তাবেঈনে এযাম (রহঃ)। (৩) তাবে তাবেঈন। (৪) আতবা‘এ তাবে তাবেঈন (তাবে তাবেঈন-এর শিষ্যগণ)। (৫) হাদীছের হাফেযগণ। (৬) হাদীছের রাবীগণ। (৭) হাদীছের ব্যাখ্যাকারীগণ এবং অন্যান্যগণ। আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন!
ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন জনগণের কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। যেমন-
(১) উচ্চশিক্ষিত। (২) মধ্যম শিক্ষিত। (৩) সামান্য শিক্ষিত এবং (৪) নিরক্ষর সাধারণ মানুষ।
এই সর্বমোট এগারোটি (৭+৪) শ্রেণীকে আহলেহাদীছ বলা হয়। আর তাদের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলি নিম্নরূপ-
১. কুরআন, হাদীছ ও ইজমায়ে উম্মতের উপরে আমল করা।
২. কুরআন, হাদীছ ও ইজমার বিপরীতে কারো কথা না মানা।
৩. তাক্বলীদ না করা।
৪. আল্লাহ তা‘আলাকে সাত আসমানের ঊর্ধ্বে স্বীয় আরশের উপরে সমুন্নীত হিসাবে মানা। যেটি তাঁর মর্যাদার উপযোগী সেভাবে।
৫. ঈমানের অর্থ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং কর্মে বাস্তবায়ন।
৬. ঈমানের হরাস-বৃদ্ধির আক্বীদা পোষণ করা।
৭. কুরআন ও হাদীছকে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী অনুধাবন করা এবং এর বিপরীতে সকলের কথা প্রত্যাখ্যান করা।
৮. সকল ছাহাবী, নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আতবা‘এ তাবে তাবেঈন এবং সকল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের প্রতি ভালবাসা পোষণ করা ইত্যাদি।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেছেন, صَاحِبُ الْحَدِيثِ عِنْدَنَا مَنْ يَسْتَعْمِلُ الْحَدِيثَ ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[39]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮) বলেছেন,
وَنَحْنُ لَا نَعْنِي بِأَهْلِ الْحَدِيثِ الْمُقْتَصِرِينَ عَلَى سَمَاعِهِ أَوْ كِتَابَتِهِ أَوْ رِوَايَتِهِ بَلْ نَعْنِي بِهِمْ: كُلَّ مَنْ كَانَ أَحَقَّ بِحِفْظِهِ وَمَعْرِفَتِهِ وَفَهْمِهِ ظَاهِرًا وَبَاطِنًا وَاتِّبَاعِهِ بَاطِنًا وَظَاهِرًا-
‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার’।[40]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহর উল্লেখিত উক্তি থেকেও আহলেহাদীছ-এর (আল্লাহ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন) দু’টি শ্রেণী সাব্যস্ত হয় :
১. হাদীছের প্রতি আমলকারী মুহাদ্দেছীনে কেরাম।
২. হাদীছের উপরে আমলকারী সাধারণ জনগণ।
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ আরো বলেছেন,
وَبِهَذَا يَتَبَيَّنُ أَنَّ أَحَقَّ النَّاسِ بِأَنْ تَكُونَ هِيَ الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ أَهْلُ الْحَدِيثِ وَالسُّنَّةِ؛ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ مَتْبُوعٌ يَتَعَصَّبُونَ لَهُ إلَّا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-
‘আর এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয় যে, লোকদের মধ্য হ’তে নাজাতপ্রাপ্ত ফিরক্বা হওয়ার সবচাইতে বেশী হকদার হ’ল আহলেহাদীছ ও আহলে সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত তাদের এমন কোন অনুসরণীয় ব্যক্তি (ইমাম) নেই, যার জন্য তারা পক্ষপাতিত্ব করে’।[41]
হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ)يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ‘যেদিন আমরা ডাকব প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা সহ’ (ইসরা ৭১) আয়াতের ব্যাখ্যায় কতিপয় সালাফ (ছালেহীন) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ الْحَدِيثِ لِأَنَّ إِمَامَهُمُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘আহলেহাদীছদের জন্য এটাই সর্বোচ্চ মর্যাদা যে, তাদের একমাত্র ইমাম হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)’।[42] তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন তাদের ইমামের নামে ডাকা হবে।
সুয়ূত্বীও (৮৪৯-৯১১ হিঃ) লিখেছেন,لَيْسَ لِأَهْلِ الْحَدِيثِ مَنْقَبَةٌ أَشْرَفَ مِنْ ذَلِكَ لِأَنَّهُ لَا إِمَامَ لَهُمْ غَيْرُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘আহলেহাদীছদের জন্য এর চাইতে অধিক
মর্যাদাপূর্ণ আর কিছুই নেই। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া
তাদের আর কোন ইমাম নেই’।[43]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারী এবং ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী ও অন্যান্যগণ (আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন) আহলুল হাদীছদেরকে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ অর্থাৎ সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।[44]
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের নির্ভরযোগ্য উস্তাদ ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (রহঃ) বলেছেন, ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে না’।[45]
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ আছ-ছাক্বাফী (মৃঃ ২৪০ হিঃ, বয়স ৯০ বছর) বলেছেন, ‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখবে যে সে আহলুল হাদীছের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে তখন (বুঝে নিবে যে) এই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে আছে’।[46]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) লিখেছেন, ‘মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু খুযায়মাহ, আবু ইয়া‘লা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না...’।[47]
উপরোল্লেখিত বক্তব্যসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল দু’টি দল-
(ক) ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন ও গায়ের মুক্বাল্লিদ সালাফে ছালেহীন ও সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ।
(খ) সালাফে ছালেহীন ও সম্মানিত মুহাদ্দিছগণের (অনুসারী) ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন এবং গায়ের মুক্বাল্লিদ সাধারণ জনগণ।
লেখক তার একটি গবেষণা প্রবন্ধে শতাধিক ওলামায়ে ইসলামের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। যারা তাক্বলীদ করতেন না। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের নাম নিম্নরূপ : ইমাম মালেক, ইমাম শাফে‘ঈ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্ত্বান, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূদাঊদ আস-সিজিস্তানী, ইমাম তিরমিযী, ইমাম ইবনু মাজাহ, ইমাম নাসাঈ, ইমাম আবুবকর ইবনু আবী শায়বাহ, ইমাম আবূদাঊদ আত্ব-ত্বায়ালিসী, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবায়ের আল-হুমায়দী, ইমাম আবূ ওবায়েদ আল-ক্বাসেম বিন সাল্লাম, ইমাম সাঈদ বিন মানছূর, ইমাম বাক্বী বিন মাখলাদ, ইমাম মুসাদ্দাদ, ইমাম আবূ ই‘য়ালা আল-মূছিলী, ইমাম ইবনু খুযায়মাহ, ইমাম যুহলী, ইমাম ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ, মুহাদ্দিছ বায্যার, মুহাদ্দিছ ইবনুল মুনযির, ইমাম ইবনু জারীর ত্বাবারী, ইমাম সুলতান ইয়াকূব বিন ইউসুফ আল-মার্রাকুশী আল-মুজাহিদ ও অন্যান্যগণ। তাদের সবার উপরে আল্লাহ রহম করুন! এ সকল আহলেহাদীছ আলেমগণ শত শত বছর পূর্বে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
আবূ মানছূর আব্দুল ক্বাহির বিন তাহের আল-বাগদাদী সিরিয়া, জাযীরাহ (আরব উপদ্বীপ), আযারবাইজান, বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি সীমান্তের অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা সকলেই আহলে সুন্নাত-এর অন্তর্ভুক্ত আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে আছেন’।[48]
আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইবনুল বান্না আল-বিশারী আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৩৮০ হিঃ) মুলতান সম্পর্কে বলেছেন,مذاهبهم : أكثرهم أصحاب حديث ‘তাদের মাযহাব হ’ল তারা অধিকাংশ আছহাবুল হাদীছ’।[49]
১৮৬৭ সালে দেওবন্দ মাদরাসা শুরুর মাধ্যমে দেওবন্দী ফিরক্বার সূচনা হয়েছে। আর ব্রেলভী ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী ১৮৫৬ সালের জুনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১. দেওবন্দী ও ব্রেলভী ফিরক্বা দু’টির জন্মের বহু পূর্বে শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের বিন মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া বিন মুহাম্মাদ আমীন আল-আববাসী আস-সালাফী এলাহাবাদী (১১৬৪ হিঃ/১৭৫১ইং) তাক্বলীদ করতেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের দলীলসমূহের উপরে আমল করতেন এবং নিজে ইজতিহাদ করতেন।[50]
২. শায়খ মুহাম্মাদ হায়াত বিন ইবরাহীম আস-সিন্ধী আল-মাদানী (১১৬৩ হিঃ/১৭৫০ইং) তাক্বলীদ করতেন না এবং তিনি আমল বিল-হাদীছ তথা হাদীছের উপরে আমলের প্রবক্তা ছিলেন।
মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধী, মুহাম্মাদ ফাখের এলাহাবাদী এবং আব্দুর রহমান মুবারকপুরী তিনজন সম্পর্কে মাস্টার আমীন উকাড়বী [নাভির নীচে হাত বাঁধার হাদীছের আলোচনা প্রসঙ্গে] লিখেছেন, ‘এই তিন গায়ের মুক্বাল্লিদ ব্যতীত কোন হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী, হাম্বলী এটাকে লেখকের ভুলও বলেননি’।[51]
৩. আবুল হাসান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল হাদী আস-সিন্ধী আল-কাবীর (মৃঃ ১১৪১ হিঃ/১৭২৯ ইং) সম্পর্কে আমীন উকাড়বী লিখেছেন, ‘মূলতঃ এই আবুল হাসান সিন্ধী গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন’।[52]
এসব উদ্ধৃতি হিন্দুস্তানের উপরে ইংরেজদের দখলদারিত্ব কায়েমের বহু পূর্বের। এজন্য আপনি যাদের কাছ থেকে এটা শুনেছেন যে, ‘আহলেহাদীছগণ ইংরেজদের আমলে সৃষ্টি হয়েছে, এর আগে এদের কোন নাম-গন্ধ ছিল না’ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অপবাদ।
রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘কাছাকাছি দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকে হকপন্থীদের মাঝে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা সমূহের সমাধানকল্পে সৃষ্ট মতভেদের প্রেক্ষিতে পাঁচটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ চার মাযহাব ও আহলেহাদীছ। তৎকালীন সময় থেকে অদ্যাবধি উক্ত পাঁচটি তরীকার মধ্যেই হক সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মনে করা হয়’।[53]
এই উক্তিতে লুধিয়ানবী ছাহেব আহলেহাদীছদের প্রাচীন হওয়া, ইংরেজদের আমলের বহু পূর্বে থেকে বিদ্যমান থাকা এবং হকপন্থী হওয়া স্বীকার করেছেন।
হাজী ইমদাদুল্লাহ মাক্কীর রূপক খলীফা মুহাম্মাদ আনওয়ারুল্লাহ ফারূক্বী ‘ফযীলত জঙ্গ’ লিখেছেন, ‘বস্ত্ততঃ সকল ছাহাবী আহলেহাদীছ ছিলেন’।[54]
মুহাম্মাদ ইদরীস কান্ধলবী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘আহলেহাদীছ তো ছিলেন সকল ছাহাবী’।[55]
আমার পক্ষ থেকে সকল দেওবন্দী ও ব্রেলভীর নিকট জিজ্ঞাসা, ঊনবিংশ বা বিংশ ঈসায়ী শতকের (অর্থাৎ ইংরেজদের হিন্দুস্তান দখলের আমল) পূর্বে কি দেওবন্দী বা ব্রেলভী মতবাদের মানুষ বিদ্যমান ছিল? যদি থাকে তাহ’লে স্রেফ একটি ছহীহ ও স্পষ্ট উদ্ধৃতি পেশ করুক। আর যদি না থেকে থাকে তাহ’লে প্রমাণিত হ’ল যে, ব্রেলভী ও দেওবন্দী মাযহাব উভয়টিই হিন্দুস্তানের উপর ইংরেজদের দখলদারিত্ব কায়েমের পরে সৃষ্ট। অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ।
(১৪ই ফেব্রুয়ারী ২০১২ইং)।
\ সমাপ্ত \
[1]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, সনদ ছহীহ।
[2]. যাহাবী, আল-কাশিফ, ৩/৭৯, রাবী নং ৫১৯৭।
[3]. সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩৭।
[4]. জাওয়ামিউস সীরাহ, ১/৩৩৩।
[5]. খতীব বাগদাদী, আল-ফক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ২/৬৯-৭০, সনদ হাসান।
[6]. তারীখুল ইসলাম, ৪৯/২২৬; আল-ওয়াফী বিল-অফায়াত, ১৯/১২।
[7]. আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩৮।
[8]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৭/৫৬৭; উপরন্তু দেখুন : ৭ নং উক্তি।
[9]. দেখুন : আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী, আন-নাফে‘উল কাবীর লিমায়ঁ য়ুতালি‘উ আল-জামে‘ আছ-ছাগীর, পৃঃ ৭; তাক্বরীরাতুর রাফি‘ঈ, ১/১১; আত্ব-তাক্বরীর ওয়াত-তাহবীর, ৩/৪৫৩।
[10]. উপরন্তু দেখুন : সুবকী, ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়াহ আল-কুবরা, ২/৭৮, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আন-নিশাপুরী-এর জীবনী এবং ১১ নং উক্তি দ্রঃ।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২৪১-২৪২।
[12]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২২/২৪৯।
[13]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/২০৯; আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪০।
[14]. তাযকিরাতুল হুফফায, ৪/১৪৯৬; হা/১১৭৫।
[15]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০৮; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩২।
[16]. ই‘লাউস সুনান, ২০/৮, শিরোনাম : ‘আদ-দ্বীনুল ক্বাইয়িম’; আরো দেখুন : ১নং উক্তির আগের ভূমিকা।
[17]. তাযকিরাতুল হুফফায, ১/১৬ , আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর জীবনী দ্রঃ।
[18]. দেখুন : আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩১-১৩২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৪-৩৫।
[19]. আল-কানযুল মাদফূন ওয়াল ফুলকুল মাশহূন, পৃঃ ১৪৯; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪০-৪১।
[20]. নাছবুর রায়াহ, ১/২১৯।
[21]. আল-বিনায়া শরহে হিদায়া, ১/৩১৭।
[22]. লিসানুল মীযান, ১/২৮০।
[23]. আল-বাদরুল মুনীর ফী তাখরীজিল আহাদীছ ওয়াল -আছার আল-ওয়াকি‘আহ ফিশ-শারহিল কাবীর, ১/২৯৩।
[24]. তাক্ববীমুল আদিল্লাহ ফী উছূলিল ফিক্বহ, পৃঃ ৩৯০; মাসিক ‘আল-হাদীছ’, হাযরো, সংখ্যা ২২, পৃঃ ১৬।
[25]. দেখুন : নুযহাতুল খাওয়াতির, ৬/৩৫০, ক্রমিক নং ৬৩৬।
[26]. রিসালাহ নাজাতিয়াহ, পৃঃ ৪১-৪২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪১।
[27]. জামে‘উ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহী, পৃঃ ২৩১।
[28]. দেখুন : লিসানুল মীযান, ৫/২৯৬।
[29]. তুহফাতুল মুজীব আলা আসইলাতিল হাযির ওয়াল গারীব, পৃঃ ২০৫; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪৩।
[30]. আল-ইক্বনা‘, পৃঃ ৯২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪৩।
[31]. তাওফীকুল হেদায়াত, পৃঃ ২০, প্রগ্রেসিভ বুক্স, লাহোর।
[32]. ঐ, পৃঃ ১৬৭।
[33]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/২২।
[34]. তাক্বরীরে তিরমিযী, পৃঃ ৩৬; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ২৪।
[35]. ফাতাওয়া রিযভিয়াহ, ১১/৩৮৭।
[36]. জাআল হাক্ব, ২/৯১, কুনূতে নাযেলাহ, ২য় অনুচ্ছেদ।
[37]. আল-কানযুল মাদফূন ওয়াল ফুলকুল মাশহূন, পৃঃ ১৪৯; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪০-৪১।
[38]. জামে‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/৯১, ২য় সংস্করণ, ২/১১২, ৩য় সংস্করণ, ২/১৮১, সনদ হাসান লি-যাতিহী।
[39]. খত্বীব, আল-জামে‘, হা/১৮৬, সনদ ছহীহ।
[40]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[41]. ঐ, ৩/৩৪৭।
[42]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/১৬৪।
[43]. তাদরীবুর রাবী, ২/১২৬, ২৭তম প্রকার।
[44]. দেখুন : হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, হা/২; ইবনু হাজার আসক্বালানী একে ছহীহ বলেছেন (ফাৎহুল বারী, ১৩/২৯৩, হা/৭৩১১-এর অধীনে); খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; সুনানে তিরমিযী, আরেযাতুল আহওয়াযী সহ, ৯/৪৭, হা/২২২৯।
[45]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ।
[46]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, সনদ ছহীহ। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : আমার গ্রন্থ তাহক্বীক্বী মাক্বালাত (১/১৬১-১৭৪)।
[47]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/৩৯-৪০; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ১/১৬৮।
[48]. উছূলুদ্দীন, পৃঃ ৩১৭।
[49]. আহসানুত তাক্বাসীম ফী মা‘রিফাতিল আক্বালীম, পৃঃ ৪৮১।
[50]. দেখুন : নুযহাতুল খওয়াতির, ৬/৩৫১; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ২/৫৮।
[51]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ২/২৪৩, আরো দেখুন : ঐ ৫/৩৫৫।
[52]. ঐ, ৬/৪৪।
[53]. আহসানুল ফাতাওয়া, ১/৩১৬।
[54]. হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, ২য় খন্ড (করাচী : ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূম আল-ইসলামিয়াহ), পৃঃ ২২৮।
[55]. ইজতিহাদ আওর তাক্বলীদ কী বেমিছাল তাহক্বীক্ব, পৃঃ ৪৮।
মূল - শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ
উপমহাদেশে কারা প্রাচীন আহলুল হাদিস নাকি দেওবন্দী ব্রেরলভী -কারা ইংরেজদের শাসনামলে সৃষ্টি?!! - http://www.bdeditor.net/blog/blogdetail/detail/11281/saaaa/76293#.VyYZzTEdwdU
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث، فلا أدري من هم ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[2]
ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, ‘ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) এই হাদীছের ব্যাখ্যায় অত্যন্ত চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সাহায্যপ্রাপ্ত দলটি হচ্ছে আছহাবে হাদীছের দল। আহলেহাদীছের চাইতে কারা এ হাদীছের আওতাভুক্ত হওয়ার অধিক হক্বদার হ’তে পারেন? যারা (আহলেহাদীছগণ) সৎ মানুষদের পথে চলেন, সালাফে ছালেহীনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতের দ্বারা বিরুদ্ধবাদীদের এবং বিদ‘আতীদের সামনে বুক ফুলিয়ে জবাব প্রদানের মাধ্যমে তাদের যবান বন্ধ করে দেন। যারা আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতার জীবনকে ত্যাগ করে বিশুষ্ক মরুভূমি এবং তৃণ-লতা ও পত্রহীন এলাকায় (হাদীছ সংগ্রহের জন্য) সফর করাকে অগ্রাধিকার প্রদান করেন। তারা আহলে ইলম এবং আহলে আখবারের সংস্পর্শে আসার জন্য ভ্রমণের কঠিন পরিস্থিতিকেও শোভনীয় মনে করেন।[3]
ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর উস্তাদ ইমাম আলী ইবনুল মাদিনী (রহঃ) বলেছেন, هم أصحاب الحديث ‘তারা হচ্ছে আছহাবুল হাদীছ’। অর্থাৎ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’ দ্বারা আহলেহাদীছগণ উদ্দেশ্য।[4]
হাদীছ জগতের সম্রাট ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ সম্পর্কে বলেন, هم أهل الحديث ‘তারা হ’লেন আহলেহাদীছ’।[5]
ইমাম ইবনে হিববান উপরোক্ত হাদীছের উপর এই মর্মে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন যে,ذِكْرُ إِثْبَاتِ النُّصْرَةِ لِأَصْحَابِ الْحَدِيثِ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ ‘ক্বিয়ামত অবধি আল্লাহ কর্তৃক আহলেহাদীছদের সাহায্যপ্রাপ্তি প্রমাণিত হওয়ার বিবরণ’।[6]
ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন মুফলিহ আল-মাক্বদেসী বলেন, أَهْلُ الْحَدِيثِ هُمْ الطَّائِفَةُ النَّاجِيَةُ الْقَائِمُونَ عَلَى الْحَقِّ ‘আহলেহাদীছরাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যারা হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন’।[7]
ইমাম হাফছ বিন গিয়াছ এবং ইমাম আবুবকর বিন আইয়াশ (রহঃ)-এর বক্তব্যকে সমর্থন ও সত্যায়ন করতঃ ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, তারা দু’জন সত্যই বলেছেন যে, আহলেহাদীছগণ সৎ মানুষ। আর এমনটা কেনইবা হবেন না, তারা তো (কুরআন ও হাদীছের (মুকাবিলায়) দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে তাদের পশ্চাতে নিক্ষেপ করেছেন।[8]
প্রখ্যাত ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, أَوْلَى النَّاسِ بِىْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَىَّ صَلاَةً ‘ক্বিয়ামতের দিন ঐ সমস্ত ব্যক্তি আমার সর্বাধিক নিকটবর্তী হবে, যারা সবচেয়ে বেশী আমার উপরে দরূদ পাঠ করে’।[9] এজন্যই আহলেহাদীছ পরিবারের ছোট ছোট বালক-বালিকাদের অন্তরে হাদীছের প্রতি গভীর অনুরাগ ও আকর্ষণ বিরাজিত। আর আহলেহাদীছগণ ক্বিয়াসী দৃষ্টিভঙ্গি এবং ফিক্বহী মাসআলার খুঁটিনাটি বিষয়ের পরিবর্তে কেবলমাত্র নবী করীম (ছাঃ)-এর হাদীছ বর্ণনাকেই পরকালে সৌভাগ্যবান হওয়ার মাধ্যম মনে করেন। তাই ইমাম আবূ হাতেম ইবনে হিববান আল-বাসতী (রহঃ) উপরোক্ত হাদীছ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা উদ্ভাবন করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্বিয়ামত দিবসে আহলেহাদীছগণের রাসূল (ছাঃ)-এর সর্বাধিক নিকটে থাকার দলীল উক্ত হাদীছে বিদ্যমান। কেননা এই উম্মতের মধ্যে আহলেহাদীছদের চাইতে কোন দল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর বেশী দরূদ পাঠ করে না।[10]
এত ফযীলত ও মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্তেবও কতিপয় ব্যক্তি আহলেহাদীছদের বিরোধিতা করা, তাদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ, উপহাস-পরিহাস এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করাকে নিজেদের পৈত্রিক অধিকার মনে করে। সম্ভবত এই সকল আহলেহাদীছ বিরোধীদের উদ্দেশ্য করেই ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (রহঃ) মন্তব্য করেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[11]
ইমাম হাকেম (রহঃ) বলেন, ‘আমি সর্বত্র যত বিদ‘আতী এবং নাস্তিকমনা মানুষ পেয়েছি, তারা সকলেই ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ তথা আহলেহাদীছদেরকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখত এবং আহলেহাদীছদেরকে নিকৃষ্টভাবে সম্বোধন করত (যেমন হাশাবিয়া)।[12]
অথচ আমরা তাদেরকে বুঝাতে চাই যে, أهل الحديث همُو أهل النبي وإن لم يصحبوا نفسه أنفاسه صحبوا ‘আহলেহাদীছগণই মূলত আহলে নবী বা নবী (ছাঃ)-এর পরিবার। যদিও তারা সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর সাহচর্য লাভ করেননি। তথাপি তারা রাসূল (ছাঃ)-এর সুগন্ধীযুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে নির্গত অমর বাণী দ্বারা উপকৃত হয়েই আসছেন’।
আলোচ্য গ্রন্থটি শায়খ হাফেয যুবায়ের আলী যাঈ রচিত একটি চমৎকার গ্রন্থ। এতে বৈশিষ্ট্যগত নাম ‘আহলেহাদীছ’-এর বিরুদ্ধে উত্থাপিত যাবতীয় প্রশ্ন, আপত্তি ও সমালোচনার জবাব প্রদান করা হয়েছে। দলীল-প্রমাণাদি উপস্থাপনের দৃষ্টিকোণ হ’তে এটি একটি সারগর্ভ ও অনন্য পুস্তক।*
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম এবং এর পরিচিতি :
মুসলমানদের অনেক গুণবাচক নাম রয়েছে। যেমন মুমিন, ইবাদুল্লাহ (আল্লাহ্র বান্দা), হিযবুল্লাহ (আল্লাহ্র দল)। তদ্রূপ ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, মুহাজির, আনছার ইত্যাদি নামসমূহ। ঠিক তেমনিভাবে ঐসকল গুণবাচক নাম সমূহের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ’ ও ‘আহলে সুন্নাত’ উপাধিদ্বয় ‘খায়রুল কুরূন’ বা সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ হ’তে সাব্যস্ত রয়েছে। মুসলমানদের মাঝে উভয় গুণবাচক উপাধির ব্যবহার নির্দ্বিধায় প্রচলিত আছে। বরং এর বৈধতার পক্ষে মুসলিম উম্মাহ্র ইজমা রয়েছে।
‘আহলেহাদীছ’ এবং ‘আহলে সুন্নাত’ দু’টি সমার্থবোধক গুণবাচক নাম। যার দ্বারা ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুসলমানদের অর্থাৎ সাহায্য ও নাজাতপ্রাপ্ত দলের পরিচয় পাওয়া যায়।
‘আহলেহাদীছ’ এই গুণবাচক নাম এবং প্রিয় উপাধি দ্বারা দুই শ্রেণীর ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমান উদ্দেশ্য।
ক. সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ।
খ. তাদের অনুসারী আম জনতা, যারা হাদীছের উপরে আমল করে থাকে।
প্রথম প্রকার সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, ইমাম ইবনে তায়মিয়া (রহঃ) মুহাদ্দিছগণকে ‘আহলেহাদীছ’ বলে অভিহিত করেছেন।[13]
ইমাম ইয়াহইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান একজন রাবী প্রসঙ্গে বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছ ছিলেন না।[14]
প্রমাণিত হ’ল যে, শুধুমাত্র হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকেই আহলেহাদীছ বলা হ’ত না। বরং ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন হাদীছ বর্ণনাকারী তথা মুহাদ্দিছগণকেও আহলেহাদীছ বলা হ’ত।
এক জায়গায় হাফেয ইবনে হিববান আহলেহাদীছদের ৩টি আলামত বর্ণনা করেছেন :
ক. তারা হাদীছের উপর আমল করেন।
খ. তারা সুন্নাত তথা হাদীছের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকেন।
গ. তারা সুন্নাত বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন।[15]
আহলেহাদীছদের প্রসিদ্ধ দুশমন এবং যাকে তাকে কাফের আখ্যা দানকারী খারেজী জামা‘আত ‘জামাআতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড’-এর প্রতিষ্ঠাতা মাসঊদ আহমাদ বিএসসি পরিষ্কারভাবে লিখেছেন, আমরাও মুহাদ্দিছগণকে আহলেহাদীছ বলে থাকি।[16]
বর্তমানে জীবিত দেওবন্দী আলেমদের ‘ইমাম’ খ্যাত সরফরায খান ছফদর গাখড়ুভী লিখেছেন, আহলেহাদীছ বলতে ঐ সমস্ত ব্যক্তি উদ্দেশ্য, যারা হাদীছ সংরক্ষণ ও অনুধাবনে এবং হাদীছ অনুসরণে প্রবল অনুরাগী।[17]
অতঃপর সরফরায খান দীর্ঘ আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘এতে প্রতীয়মান হয় যে, যিনি হাদীছের ইলম হাছিল করেছেন, তা সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করেছেন এবং হাদীছ তাহকীক করেছেন, তাকেই আহলেহাদীছ বলা হয়। চাই সে ব্যক্তি হানাফী, মালেকী, শাফেঈ কিংবা হাম্বলী হৌক। এমনকি সে যদি শী‘আও হয়ে থাকে, তথাপি সে আহলেহাদীছ।[18]
এই উক্তিতে খান ছাহেব মুহাদ্দিছগণকে ‘আহলেহাদীছ’ নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তিনি শী‘আ এবং অন্যদেরকেও আহলেহাদীছ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা দলীলের ভিত্তিতে একেবারেই বাতিল এবং ভিত্তিহীন। এই বিষয়ে সামনে আলোচনা আসছে ইনশাআল্লাহ।
যুগ বিবেচনায় মুহাদ্দিছগণের কয়েকটি জামা‘আত বা দল রয়েছে। যথা :
১. ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) :
হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কীর খলীফা ও জামে‘আ নিযামিয়া, হায়দারাবাদের প্রতিষ্ঠাতা আনওয়ারুল্লাহ ফারূকী ফযীলত জঙ্গ লিখেছেন, ‘প্রত্যেক ছাহাবী (রাঃ) আহলেহাদীছ ছিলেন। কেননা হাদীছ শাস্ত্রের সূচনা তাঁদের আমল থেকেই শুরু হয়েছে। কারণ তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছ থেকে হাদীছ গ্রহণ করে সরাসরি উম্মতের কাছে পেঁŠছে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের আহলেহাদীছ হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।[19]
এখানে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ উল্লেখ্য যে, হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ গ্রন্থটি ক্বারী আব্দুল ক্বাইয়ূম যহীর আমাকে উপহার দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
দেওবন্দীদের প্রসিদ্ধ আলেম এবং বহু গ্রন্থ প্রণেতা মুহাম্মাদ ইদরীস কান্দলভী লাহোরী লিখেছেন, ‘সকল ছাহাবীই তো আহলেহাদীছ ছিলেন। কিন্তু আহলে রায়গণই ফৎওয়া প্রদান করতেন। পরবর্তীতে আহলে রায় উপাধিটি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) এবং তার শিষ্যদেরকে প্রদান করা হয়েছে। ঐ যুগের সকল আহলেহাদীছ ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে আহলে রায়দের ইমাম উপাধিতে ভূষিত করেছেন।[20]
এই উক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর সময়েও আহলেহাদীছগণ বিদ্যমান ছিলেন।
২. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং পরবর্তীগণ :
শী‘আ এবং বিদ‘আতীদেরকে কয়েকটি কারণে আহলেহাদীছ বলা ভুল ও বাতিল। যেমন :
প্রথমত : ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ সর্বদা বিজয়ী থাকবে...। উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছ ইমামগণ বলেছেন, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ হচ্ছে ‘আহলেহাদীছ’।[21]
সুতরাং এমন কথা বলা কেবল বাতিলই নয়, বরং চরম ভ্রষ্টতা যে, শী‘আ এবং বিদ‘আতীরাও সাহায্যপ্রাপ্ত দলের অন্তর্ভুক্ত।
দ্বিতীয়ত : ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিতী (রহঃ) বলেছেনে, ليس في الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أصحاب الحديث ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই যে আহলেহাদীছের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[22]
এই মূল্যবান উক্তি দ্বারা স্পষ্টত বুঝা গেল যে, আহলেহাদীছ এবং আহলে বিদ‘আত ভিন্ন ভিন্ন দল।
তৃতীয়ত : ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ حَيًّا- ‘আমি যখন কোন ‘আহলেহাদীছ’ ব্যক্তিকে দেখি তখন যেন রাসূল (ছাঃ)-কেই জীবন্ত দেখি’।[23] অর্থাৎ আহলেহাদীছগণের মাধ্যমেই নবী করীম (ছাঃ)-এর দাওয়াত জীবিত রয়েছে।
এক্ষণে ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা যদি শী‘আ ও বিদ‘আতীকেও বুঝানো হয়, তবে কি ইমাম শাফেঈ (রহঃ) শী‘আ, মু‘তাযিলা, জাহমিয়া, মুরজিয়া এবং হরেক রকমের বিদ‘আতীদেরকে দেখে আনন্দিত হ’তেন?
চতুর্থত : আহমাদ বিন আলী লাহোরী দেওবন্দী স্বীয় ‘মালফূযাত’-এ লিখেছেন, ‘আমি ক্বাদেরী (আব্দুল কাদের জিলানী-এর তরীকা) এবং হানাফী। আহলেহাদীছগণ কাদেরীও নয়, আবার হানাফীও নয়। কিন্তু তারা আমার মসজিদে চল্লিশ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করে আসছে। আমি তাদেরকে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত মনে করি।[24]
উক্ত উক্তি থেকে পাঁচটি বিষয় সাব্যস্ত হয়েছে :
১. আহলেহাদীছগণ হকের উপরে প্রতিষ্ঠিত আছেন।
২.‘আহলেহাদীছ’ ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুসলমানদের উপাধি। এজন্য শী‘আ ও অন্যান্য দল সমূহ ‘আহলেহাদীছ’ নয়। তারা তো আহলে বিদ‘আত-এর অন্তর্ভুক্ত।
৩. শুধু মুহাদ্দিছগণকেই ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয় না। বরং মুহাদ্দিছগণের অনুসারী সাধারণ জনগণকেও ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়। নতুবা মুহাদ্দিছগণের কোন জামা‘আতটি লাহোরী ছাহেবের মসজিদে চল্লিশ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করেছেন?
৪. মানুষ যদি হানাফী বা কাদেরী নাও হয়, তথাপি সে আহলে হক তথা হক্বপন্থী হ’তে পারেন।
৫. জনাব সরফরায খান কর্তৃক শী‘আদেরকে আহলেহাদীছ গণ্য করা বাতিল।
এমনিতরো আরো অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে যদ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, মুহাদ্দিছ হৌক কিংবা হাদীছের অনুসারী সাধারণ জনতা হৌক, ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা ‘আহলে সুন্নাত’ তথা ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মানুষ উদ্দেশ্য। আর বিদ‘আতীরা আদৌ ‘আহলেহাদীছ’ উপাধিতে শামিল নয়। বরং তারা তো ‘আহলেহাদীছের’ প্রতি কেবল বিদ্বেষই পোষণ করে থাকে।
দ্বিতীয় বিষয়টি অর্থাৎ মুহাদ্দিছগণের অনুসারী এবং হাদীছের উপরে আমলকারী সাধারণ জনতার ব্যাপারে বক্তব্য হ’ল, কতিপয় লোক এ অপপ্রচার চালিয়ে থাকেন যে, ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা কেবল সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ উদ্দেশ্য, এর দ্বারা সাধারণ জনতা উদ্দেশ্য নয়। সেকারণে এই লোকদের অপপ্রচারের জবাবে বিশটি উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল :
১. অসংখ্য হক্বপন্থী আলেম যেমন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইমাম বুখারী প্রমুখ ‘আহলেহাদীছ’-কে সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।
এর আলোকে বক্তব্য হ’ল কেবল মুহাদ্দিছগণই ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল, তাদের সাধারণ অনুসারীগণ নন। অথবা শুধু মুহাদ্দিছগণ জান্নাতে প্রবেশ করবেন এবং তাদের অনুসারীগণ জান্নাতের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন’ এমন ধারণা শুধু বাতিলই নয়, বরং ইসলামের সাথে ঠাট্টা-মশকরা করার শামিল।
২. হাফিয ইবনে হিববান ‘আহলেহাদীছদে’র সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘তারা হাদীছের উপরে আমল করেন, হাদীছ সংরক্ষণ করেন এবং হাদীছ বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন’।[25] আর এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, আহলেহাদীছ সাধারণ জনগণও হাদীছের উপরেই আমল করে থাকেন।
৩. ইমাম আবুদাঊদ (রহঃ)-এর ছেলে ইমাম আবু বকর বলেছেন, ‘তুমি ঐ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা নিজ দ্বীন নিয়ে খেল-তামাশা করে’। (যদি তুমি দ্বীনকে তাচ্ছিল্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও) তাহ’লে তুমি আহলেহাদীছদেরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করবে।[26]
এ উক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, যারা আহলেহাদীছদের সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন, তারা দ্বীনকে নিয়ে তামাশা করেন। অর্থাৎ তারা বিদ‘আতী। আর এও দিবালোকের ন্যায় পরিস্ফূট যে, বিদ‘আতীরা শুধু মুহাদ্দিছগণের সাথেই শত্রুতা পোষণ করে না; বরং তারা হাদীছের অনুসারী আম জনতার প্রতিও চরম-বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে।
আমীন উকাড়বী দেওবন্দী ‘গায়ের মুক্বাল্লিদের পরিচয়’ শিরোনামে লিখেছেন যে, ‘কিন্তু যে ব্যক্তি ইমামও নয়, মুক্তাদীও নয় তথা বেনামাযী। কখনো সে ইমামকে গালি দেয় আবার কখনো মুক্তাদির সাথে ঝগড়া বাধায়- তবে বুঝতে হবে সে একজন গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[27]
আবার অন্য স্থানে উকাড়বী লিখেছেন, ‘এজন্যই যে যত বড় গায়ের মুক্বাল্লিদ হবে, সে তত বড় বেআদব ও অভদ্র হবে’।[28]
উকাড়বী আরো লিখেছেন, প্রতিটি গায়ের মুক্বাল্লিদ ব্যক্তিই ‘নিজের রায় নিয়ে গর্ববোধকারী’-এর প্রতিকৃতি। আর রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষ্যানুসারে এমন লোকদের জন্য (গায়ের মুকাল্লিদদের) তওবা করার পথ রুদ্ধ।[29]
এই বক্তব্য এবং অনুরূপ অন্যান্য বক্তব্যের কারণে তাকলীদপন্থীদের আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে ‘গায়ের মুকাল্লিদ’ শব্দ ব্যবহার করা একেবারেই ভ্রান্ত, বাতিল ও পরিত্যাজ্য।
৪. ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (রহঃ) বলেছেন, দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[30]
আর এটা সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেক আহলেহাদীছ তথা মুহাদ্দিছ, আলেম ও হাদীছের অনুসারী সাধারণ মানুষদের প্রতি সকল বিদ‘আতীই বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে এবং হরেক রকমের উদ্ভট নামে যেমন ‘গায়ের মুকাল্লিদ’ বলার দ্বারা আহলেহাদীছদের সাথে মশকরা করে থাকে।
৫. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) স্বীয় প্রসিদ্ধ ‘ক্বাছীদায়ে নূনিয়াহ’তে লিখেছেন, ‘ওহে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী এবং গালি প্রদানকারী! তুমি শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা গড়ার সুসংবাদ গ্রহণ করো’।[31]
এটা আপামর জনসাধারণেরও জানা আছে যে, প্রত্যেক কট্টর বিদ‘আতী জামা‘আত হিসাবে প্রত্যেক আহলেহাদীছের সাথে শত্রুতা রাখে এবং আহলেহাদীছ আলেম হৌক কিংবা সাধারণ জনতা হৌক তাদেরকে মন্দ নামে ডাকে।
৬. হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) আহলেহাদীছদের একটি ফযীলত উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কতিপয় সালাফে ছালেহীন এই আয়াতটি (বাণী ইসরাঈল ১৭/৭১) সম্পর্কে বলেছেন,هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ الْحَدِيْثِ لِأَنَّ إِمَامَهُمْ النَّبِىُّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ ‘এটি আহলেহাদীছের জন্য সবচেয়ে বড় ফযীলত। কেননা তাদের ইমাম হচ্ছেন স্বয়ং রাসূল (ছাঃ)।[32]
যেমনিভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ) মুহাদ্দিছগণের ইমামে আযম (মহান ইমাম), তদ্রূপ তিনি সাধারণ আহলেহাদীছগণেরও ইমামে আযম। এটা কোন লুকোচুরি কথা নয়; বরং আহলেহাদীছদের খ্যাতিমান বাগ্মী ও সাধারণ বক্তাদের আলোচনা থেকেও এটা সুস্পষ্ট।
৭. হাদীছের ভিত্তি (قوام السنة ) খ্যাত ইমাম ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ আল-ফযল আল-ইস্পাহানী (রহঃ) আহলেহাদীছের প্রসঙ্গে বলেছেন, এরাই ক্বিয়ামত পর্যন্ত হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে।[33]
এতে প্রমাণিত হয় যে, ‘আহলেহাদীছ’ বলতে মুহাদ্দিছ এবং হাদীছের অনুসারী সাধারণ জনতা উভয়কেই বুঝানো হয়। আর এ দলটি ক্বিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান থাকবে। এজন্য মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের নিম্নোক্ত বক্তব্যটি অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘মুহাদ্দিছগণ তো মারা গেছেন। বর্তমানে তো ঐ সকল লোক জীবিত রয়েছেন, যারা তাঁদের গ্রন্থ সমূহ থেকে নকল করে থাকে’।[34]
৮. আবূ ইসমাঈল আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল আছ-ছাবূনী বলেছেন, ‘আহলেহাদীছগণ এই আক্বীদা পোষণ করেন এবং একথার সাক্ষ্য দেন যে, আল্লাহ তা‘আলা সাত আসমানের উপরে স্বীয় আরশের উপরে সমাসীন আছেন’।[35]
মুহাদ্দিছীনে কেরাম হৌক কিংবা তাঁদের অনুসারী সাধারণ জনগণ হৌক সবার এটাই আক্বীদা যে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের উপরে সমাসীন আছেন এবং তিনি স্বীয় সত্তায় সর্বত্র বিরাজমান নন। বরং তাঁর জ্ঞানের পরিধি এবং ক্ষমতার ব্যাপকতা সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে।
৯. আবূ মানছূর আব্দুল ক্বাহের বিন ত্বাহের আল-বাগদাদী সিরিয়া ও অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ ‘তারা সকলেই আহলে সুন্নাত। আর তারা আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে রয়েছে’।[36]
১০. শায়খুল ইসলাম হাফেয ইবনে তায়মিয়া (রহঃ)-হাদীছের উপর আমলকারী সাধারণ লোকদেরকেও ‘আহলেহাদীছ’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।[37]
১১. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, আমার নিকটে ঐ ব্যক্তিই আহলেহাদীছ, যিনি হাদীছের উপর আমল করেন।[38]
১২. সূরা বণী ইসরাইলের ৭১ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহঃ) মন্তব্য করেছেন, আহলেহাদীছদের জন্য এর চেয়ে অধিক ফযীলতপূর্ণ আর কোন বক্তব্য নেই। কেননা রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত আহলেহাদীছদের আর কোন ইমামে আ‘যম বা বড় ইমাম নেই।[39]
১৩. রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী দেওবন্দী লিখেছেন, প্রায় দ্বিতীয় তৃতীয় হিজরী শতকে হক্বপন্থীদের মাঝে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা সমূহের সমাধানকল্পে সৃষ্ট মতভেদের প্রেক্ষিতে পাঁচটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ চার মাযহাব ও আহলেহাদীছ। তৎকালীন সময় হ’তে অদ্যাবধি উক্ত পাঁচটি তরীকার মধ্যেই হক্ব সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মনে করা হয়।[40]
উক্ত বক্তব্য দ্বারা তিনটি বিষয় পরিষ্কারভাবে সাব্যস্ত হয়।
ক. ‘আহলেহাদীছ’ হক্বের উপর রয়েছে।
খ. ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছীনে কেরাম এবং তাদের অনুসারী আম জনতা উভয়েই উদ্দেশ্য।
গ. চার মাযহাব ব্যতিরেকে পঞ্চম দল হ’ল ‘আহলেহাদীছ’। এজন্য সরফরায খান ছফদরের মতানুসারে অন্যদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ বলে স্বীকৃতি দেয়া ভুল হয়েছে ।
১৪. আহমাদ আলী লাহোরীর এই বক্তব্যটি পূর্বেই উল্লিখিত হয়ে গেছে যে, তিনি বলেছেন, আহলেহাদীছগণ কাদরিয়া তরীকার অনুসারীও নন, আবার হানাফীও নন। তবে তারা আমার মসজিদে চল্লিশ বছর যাবৎ ছলাত আদায় করে আসছে। আমি তাদেরকে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করি।[41]
আহমাদ আলী লাহোরীর বক্তব্য দ্বারা এটি একেবারেই পরিষ্কার যে, স্রেফ মুহাদ্দিছগণই আহলেহাদীছ নন। বরং তাদের অনুসারী সাধারণ লোকজনও আহলেহাদীছ।
১৫. দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুবীর পসন্দনীয় গ্রন্থ ‘হক্কানী আক্বায়েদে ইসলাম’ গ্রন্থে আব্দুল হক হক্কানী দেহলভী বলেছেন, শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী, হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর আহলেহাদীছগণও আহলে সুন্নাতের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত।[42]
এই বক্তব্যে যেমনভাবে হানাফী, শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী নামগুলি দ্বারা তাদের আম জনতাকেও বুঝানো হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে উক্ত বক্তব্যে ‘আহলেহাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছীনে কেরামের সাধারণ অনুসারীদেরকেও বুঝানো হয়েছে।
১৬. মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলভী (দেওবন্দী) একটি প্রশ্নের জবাবে লিখেছেন, ‘হ্যা, আহলেহাদীছগণ মুসলমান এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সাথে বিয়ে-শাদীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয। শুধু তাক্বলীদ বর্জন করাতে ইসলামে কোন যায় আসে না। এমনকি তাক্বলীদ বর্জনকারী ব্যক্তি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত হ’তেও বের হয়ে যায় না।[43]
এই ফৎওয়া ও পূর্বোক্ত (১৩ নং) ফৎওয়া দ্বারা সুস্পষ্ট হ’ল যে, ‘আহলেহাদীছ’ আহলে সুন্নাতেরই অন্তর্ভুক্ত এবং হাদীছের উপরে আমলকারী সাধারণ লোকদেরকেও ‘আহলেহাদীছ’ উপাধিতে ভূষিত করা সম্পূর্ণ সঠিক।
১৭. চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর ইতিহাসবিদ বিশারী মাক্বদেসী (মৃঃ ৩৭৫ হিঃ) মানছূরার (সিন্ধুর) অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, أَكْثَرُهُمْ أَصْحَابُ حَدِيْثٍ ‘তাদের অধিকাংশই আহলেহাদীছ’।[44]
আর যুক্তির নিরীখে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সে সময় সিন্ধু প্রদেশের সকল অধিবাসী মুহাদ্দিছ ছিলেন না। বরং তাদের মধ্যে মুহাদ্দিছগণের অনুসারী বহু সাধারণ লোক ছিলেন।
১৮. ইশারাতে ফরীদী অর্থাৎ ‘মাক্বাবীসুল মাজালিস’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ‘আহলেহাদীছগণের ইমাম হযরত ক্বাযী মুহাম্মাদ বিন আলী শাওকানী ইয়ামানী (রহঃ) ‘সামা’ (সঙ্গীত)-এর উপর একটি প্রামাণ্য পুস্তিকা লিখেছেন। পুস্তিকাটির নাম ‘ইবত্বালু দা‘ওয়া ইজমা’ (ইজমা দাবীর অসারতা)। উক্ত বইয়ে তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, ‘সামা’ জায়েয।[45]
উক্ত বক্তব্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, ‘আহলেহাদীছ’ অর্থ হিন্দুস্তান সহ অন্যান্য দেশের সাধারণ আহলেহাদীছগণ। আর অবশিষ্ট বক্তব্য সম্পর্কে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হ’ল :
প্রথমত : শাওকানী সমস্ত আহলেহাদীছের ‘ইমামে আযম’-নন। বরং আহলেহাদীছের ইমামে আযম হ’লেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। শাওকানী তো পরবর্তীদের মধ্য হ’তে একজন আলেম ছিলেন।
দ্বিতীয়ত : যদি ‘সামা’ দ্বারা কাওয়ালী, গান-বাজনা এবং বাদ্যযন্ত্র সম্বলিত সংগীত উদ্দেশ্য হয়, তাহ’লে ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী তা হারাম। অনুরূপভাবে শিরকী-বিদ‘আতী কবিতা পাঠ করাও হারাম।
১৯. দেওবন্দী মুফতী মুহাম্মাদ আনওয়ার ছূফী আব্দুল হামীদ সোয়াতী কর্তৃক প্রণীত ‘নামাযে মাসনূন’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, নিঃসন্দেহে হানাফী মাযহাব অনুসারীদের স্বীয় মাযহাবের সত্যতার এবং আত্মিক প্রশান্তির জন্য ‘নামাযে মাসনূন’-একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। ৮৩৭ পৃষ্ঠাব্যাপী উক্ত গ্রন্থে ছালাতের যরূরী বিষয়াবলী বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। আমার মতে এ গ্রন্থটি পাঠ করা শুধু হানাফী মাযহাবের প্রতিটি ইমাম ও খত্বীবের জন্যই উপকারী নয়। বরং সাধারণ হানাফীদের জন্যও উপকারী। এমনকি মধ্যপন্থী আহলেহাদীছ ব্যক্তিদের জন্যও উক্ত গ্রন্থখানি আলোকবর্তিকা স্বরূপ হবে ইনশাআল্লাহ।[46] উক্ত উক্তিতে মুহাম্মাদ আনওয়ারও হাদীছের অনুসারী সাধারণ ব্যক্তিদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন।
২০. মুহাম্মাদ ওমর নামক এক কট্টর দেওবন্দী লিখেছেন, সাধারণ আহলেহাদীছগণের নিকটে আমাদের বিনীত নিবেদন এই যে, আপনাদেরকে এই সত্য থেকে বঞ্চিত রেখে আপনাদের চিন্তাগত শূন্যতা এনে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ আহলেহাদীছগণ এটা ভেবে থাকবেন যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত হানাফীগণ কেন আহলেহাদীছ আলেমদের কিতাবগুলোর উপরে আমল করেন না?[47]
এই শঠতাপূর্ণ উক্তিতেও সাধারণ আহলেহাদীছ জনগণকে ‘আহলেহাদীছ’ বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
উল্লিখিত ২০টি উদ্ধৃতি স্তূপ থেকে একটি মুষ্টি মাত্র। নইলে এগুলি ব্যতীত আরো বহু উদ্ধৃতি মওজুদ রয়েছে।
কতিপয় ব্যক্তি নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য নিজেকে আহলেহাদীছ বলেন না। বরং তারা নিজেকে আহলেহাদীছ বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন এবং বিভিন্ন নামে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। আবার কেউ কেউ গায়ের আহলেহাদীছদের বিরোধিতার কারণে ‘আহলেহাদীছ’ নাম বলতে ভয় পান। আবার কেউ নিজেকে ‘আহলে ছহীহ হাদীছ’ ইত্যাদি বলে বিশ্বাস করাতে চেষ্টা করে থাকেন। এ ধরনের কাজ-কারবার ও ছলচাতুরি ভ্রান্তি বৈ কিছুই নয়। হকপন্থীদের বৈশিষ্ট্যগত নাম সমূহের মধ্যে আহলে সুন্নাত, আহলেহাদীছ, সালাফী, আছারী ইত্যাদি অনেক সুন্দর সুন্দর উপাধি রয়েছে। তবে এসবের মধ্যে ‘আহলেহাদীছ’ নামটি সর্বশ্রেষ্ঠ। এ নামটির জায়েয হওয়ার ব্যাপারে সালাফে ছালেহীনের ইজমা রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।
সময়ের অনিবার্য দাবী হ’ল সকল ‘আহলেহাদীছ’ আলেম ও আহলেহাদীছ আম জনতা পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক। সমস্ত মতানৈক্যকে বিদায় জানিয়ে কুরআন ও হাদীছের ঝান্ডাকে পৃথিবীর বুকে উড্ডীন করার জন্য মনেপ্রাণে সচেষ্ট হোক। ওমা আলায়না ইল্লাল বালাগ।
[চলবে]
* সৈয়দপুর, নীলফামারী।
[1]. ইবনে মাজাহ হা/৬; তিরমিযী হা/২১৯২, সনদ ছহীহ।
[2]. ইমাম হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ হা/২, সনদ হাসান।
[3]. ঐ, পৃঃ ১১২।
[4]. তিরমিযী হা/২১৯২ প্রভৃতি।
[5]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ।
[6]. ছহীহ ইবনে হিববান, ১ম খন্ড, পৃঃ ২৬১, হা/৬১।
[7]. আল-আদাবুশ শারঈয়্যাহ, ১/২১১।
[8]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ১১৩।
[9]. তিরমিযী, হা/৪৮৪; সনদ হাসান।
[10]. ইবনে হিববান, হা/৯১১।
* হাফেয নাদীম যহীর, ১২ই শা‘বান, ১৪৩৩ হিজরী
[11]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, হা/৬, সনদ ছহীহ।
[12]. ঐ, পৃঃ ১১৫।
[13]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[14]. ইমাম বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ২/৪২৯; আল-জারহু ওয়াত-তা‘দীল, ৬/৩০৩।
[15]. ছহীহ ইবনে হিববান, আল-ইহসান, হা/৬১২৯; অন্য একটি কপির হাদীছ নং ৬১৬২।
[16]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ বেজওয়াবে আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ৫।
[17]. ত্বায়েফাহ মানছূরাহ, পৃঃ ৩৮; আল-কালামুল মুফীদ, পৃঃ ১৩৯।
[18]. ত্বায়েফাহ মানছূরাহ, পৃঃ ৩৯।
[19]. হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, ২য় খন্ড (করাচী : ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূম আল-ইসলামিয়া), পৃঃ ২২৮।
[20]. ইজতিহাদ আওর তাক্বলীদ কী বে-মিছাল তাহক্বীক্ব (পশ্চিম পাকিস্তান : ইলমী মারকায আনারকলী লাহোর), পৃঃ ৪৮।
[21]. দ্র: মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; তিরমিযী, হা/২২২৯; ইমাম হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, হা/২।
[22]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪।
[23]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/৮৫।
[24]. মালফূযাতে ত্বাইয়েবাহ, পৃঃ ১১৫; অন্য একটি সংস্করণের পৃঃ নং ১২৬।
[25]. ছহীহ ইবনে হিববান হা/৬১২৯; অন্য একটি সংস্করণের হাদীছ নং ৬১৬২।
[26]. ইমাম আজুর্রী, আশ-শারী‘আহ, পৃঃ ৯৭৫।
[27]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ৩/৩৭৭।
[28]. ঐ, ৩/৫৯০।
[29]. ঐ, ৬/১৬৪।
[30]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪।
[31]. ক্বাছীদায়ে নূনিয়া, পৃঃ ১৯৯।
[32]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ৪/১৬৪।
[33]. আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ, ১/২৪৬।
[34]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ, পৃঃ ২৯।
[35]. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবুল হাদীছ, পৃঃ ১৪।
[36]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩১৭।
[37]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[38]. ইমাম খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘ ১/৪৪।
[39]. তাদরীবুর রাবী, ২/১২৬, ২৭তম প্রকার।
[40]. আহসানুল ফাতাওয়া, ১/৩১৬।
[41]. মালফূযাতে ত্বাইয়েবাহ, পৃঃ ১১৫; পুরানা সংস্করণের পৃঃ নং ১২৬।
[42]. হক্কানী আক্বায়েদে ইসলাম, পৃঃ ৩।
[43]. কিফায়াতুল মুফতী, ১/৩২৫।
[44]. আহসানুত তাক্বাসীম ফি মা‘রিফাতিল আক্বালীম, পৃঃ ৪৮১।
[45]. ইশারাতে ফরীদী, পৃঃ ১৫৬।
[46]. নামাযে মাসনূন, ভূমিকা দ্রঃ।
[47]. ছুপে রায, ৪/২
আহলেহাদীছ নামটি কি সঠিক?প্রশ্ন : আমরা কেন আহলেহাদীছ? আমরা কেন মুসলিম নই? কোন ছাহাবী কি আহলেহাদীছ ছিলেন বা তারা কি নিজেদের নাম আহলেহাদীছ রেখেছিলেন? দলীল দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করুন যে, আমরা কেন আহলেহাদীছ? জাযাকুমুল্লাহ খায়রান (আল্লাহ আপনাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিন)।
এ প্রশ্নগুলি ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ তথা ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার পক্ষ হ’তে করা হয়েছে এবং ছহীহ বুখারীর হাদীছও উপস্থাপন করা হয়েছে যে, জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে আঁকড়ে ধর।
-উম্মে খালেদ, ক্যান্টনমেন্ট।
জবাব : ‘মুসলিমীন’ শব্দটি মুসলিম শব্দের বহুবচন এবং সর্বসম্মতিক্রমে আত্মসমর্পণকারী, আনুগত্যকারী ও বাধ্য ও অনুগত ব্যক্তিদেরকে মুসলিম বলা হয়। মুসলমানদের অনেক নাম ও উপাধি রয়েছে। যেমন মুহাজিরীন, আনছার, ছাহাবা, তাবেঈন ইত্যাদি। একটি ছহীহ হাদীছে এসেছে, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِى سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নামে ডাকো। যিনি তোমাদেরকে মুসলিমীন, মুমিনীন এবং ইবাদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) নামে অভিহিত করেছেন’।[1]
এই হাদীছের সনদ ছহীহ। ইয়াহ্ইয়া বিন আবী কাছীর ‘আমি শুনেছি’ বাক্যটি পরিষ্কারভাবে বলেছেন।
মূসা বিন খালাফ আবু খালাফ কর্তৃক ইয়াহইয়া বিন আবী কাছীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, فَادْعُوا الْمُسْلِمِيْنَ بِأَسْمَائِهِمْ بِمَا سَمَّاهُمُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ الْمُسْلِمِيْنَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ‘তোমরা মুসলমানদেরকে তাদের নামসমূহ মুসলিমীন, মুমিনীন ও ইবাদুল্লাহ দ্বারা ডাকো। যে নামগুলি আল্লাহ তা‘আলা রেখেছেন’।[2]
এই হাদীছের সনদ হাসান লি-যাতিহি। এতে আবু খালফ মূসা বিন খালাফ নামক একজন রাবী রয়েছেন। যিনি জমহূর মুহাদ্দিছগণের নিকটে বিশ্বস্ত। এজন্য তিনি সত্যবাদী, হাসানুল হাদীছ।
মুসনাদে আহমাদে (৫/২৪৪, হা/২৩২৯৮) উক্ত হাদীছের একটি ছহীহ শাহেদ অর্থাৎ সমর্থনমূলক হাদীছও বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত বর্ণনাটি একেবারেই ছহীহ। আল-হামদুলিল্লাহ।
উক্ত হাদীছ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মুসলমানদের ‘মুসলিম’ ছাড়া আরো নাম রয়েছে। এজন্য ‘আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম’ কতিপয় লোকের এমনটা বলা ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য।
ছহীহ মুসলিমের ভূমিকাতে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ)-এর বক্তব্য লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ ‘সুতরাং আহলে সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য করা হ’ত। অতঃপর তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত’।[3]
এ উক্তির বর্ণনাকারীগণ এবং ইমাম মুসলিমের সম্মতিতে তা (ইবনে সিরীনের বক্তব্য) ছহীহ মুসলিমে মওজুদ রয়েছে। ছহীহ মুসলিম হাযার হাযার লক্ষ লক্ষ আলেম পড়েছেন। কিন্তু কেউই উক্ত বক্তব্যের সমালোচনা করেননি যে, মুসলমানদের ‘আহলে সুন্নাত’ নাম ভুল। প্রতীয়মান হ’ল যে, ‘আহলে সুন্নাত’ নামটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা রয়েছে।
একটি ছহীহ হাদীছে এসেছে যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা ‘সাহায্যপ্রাপ্ত দল’ সর্বদা বিজয়ী থাকবে। এর ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী (রহঃ) বলছেন, يعني أهل الحديث অর্থাৎ আহলেহাদীছগণ। তার অর্থ ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ দ্বারা আহলেহাদীছ উদ্দেশ্য।[4]
ইমাম বুখারীর শিক্ষক আলী ইবনুল মাদীনী এই হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, هم أهل الحديث ‘তারা হ’লেন আহলুল হাদীছ’।[5]
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ বলেছেন, إذا رأيت الرجل يحب أهل الحديث، ... فإنه على السنة ‘যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে আহলেহাদীছদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করতে দেখ, ... (তখন বুঝবে যে,) সেই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে (আছে)’।[6]
ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَ هُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[7]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث، فلا أدري من هم. ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি দ্বারা যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) উদ্দেশ্য না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[8]
হাফছ বিন গিয়াছ আহলেহাদীছদের সম্পর্কে বলেছেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ’।[9]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إِذَا رَأَيْتُ رَجُلاً مِّنْ أَصْحَابِ الْحَدِيْثِ فَكَأَنِّيْ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ حَيًّا- ‘আমি যখন কোন আহলেহাদীছ ব্যক্তিকে দেখি, তখন যেন আমি নবী কারীম (ছাঃ)-কেই জীবিত দেখি’।[10]
সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনু কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) ‘তাবীলু মুখতালাফিল হাদীছ ফির রাদ্দি আলা আ‘দায়ি আহলিল হাদীছ’ (تأويل مختلف الحديث فى الرد على أعداء أهل الحديث) শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেখানে তিনি আহলেহাদীছদের দুশমনদের কঠিনভাবে জবাব প্রদান করেছেন।
এই বক্তব্যগুলি মুহাদ্দিছগণের মাঝে কোনরূপ অস্বীকৃতি ও আপত্তি ব্যতিরেকেই প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ রয়েছে। সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ নামটি জায়েয ও বিশুদ্ধ হওয়ার পক্ষে ইমামগণের ইজমা রয়েছে। আর একথা সূর্যকিরণের চেয়েও সুস্পষ্ট যে, মুসলিম উম্মাহ ভ্রষ্টতার উপর একমত হ’তে পারেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لا يجمع الله أمتي أو قال هذه الأمة على الضلالة أبدا ويد الله على الجماعة- ‘আল্লাহ আমার উম্মতকে কিংবা বলেছেন এই উম্মতকে কখনো গুমরাহীর উপরে একত্রিত করবেন না এবং জামা‘আতের উপরে আল্লাহর হাত রয়েছে’।[11]
উপরোল্লেখিত দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছ এবং আহলুস সুন্নাহ মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যগত নাম এবং উপাধি। আর এই দলটিই ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল।
আহলেহাদীছ-এর দু’টি অর্থই হ’তে পারে। ১. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছীনে কেরাম। ২. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণ। যারা দলীলের ভিত্তিতে মুহাদ্দিছগণের পথে চলেন এবং তাদের অনুসরণ করেন।[12]
একথা প্রমাণিত যে, ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ জান্নাতে যাবে। কেননা এটি হক্বপন্থী জামা‘আত। তবে কি শুধু মুহাদ্দিছগণই জান্নাতে যাবেন আর তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ জান্নাতের বাইরে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন?
সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ-এর মধ্যে মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী উভয়ই শামিল রয়েছেন। স্বীয় বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা কুরআন-হাদীছ অনুধাবনকারী এবং ইজমা অস্বীকারকারী মাসঊদ আহমাদ (বিএসসি) তাকফীরী লিখেছেন, ‘আমরাও মুহাদ্দিছগণকে আহলুল হাদীছ বলে থাকি’। যুবায়ের ছাহেবের (লেখকের) উল্লেখিত বক্তব্যগুলি আমাদের সমর্থনে, প্রত্যুত্তরে নয়।[13]
হাদীছ বর্ণনাকারীদেরকে মুহাদ্দিছীন বলা হয়। সাধারণ মুসলমানগণও জানেন যে, ছাহাবী ও তাবেঈগণ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। সুতরাং প্রমাণিত হ’ল যে, ছাহাবী ও তাবেঈগণ মুহাদ্দিছ তথা আহলেহাদীছ ছিলেন।
মাসঊদ আহমাদের উপরে একটি নতুন অহী অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি উদ্ধত গলায় প্রচার চালাচ্ছেন যে, ‘মুহাদ্দিছগণ তো চলে গেছেন। এখন তো ঐ সমস্ত ব্যক্তি জীবিত রয়েছেন, যারা তাদের গ্রন্থ সমূহ থেকে নকল করেন মাত্র’।[14]
মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের উক্ত বক্তব্যের পর্যালোচনা করতে গিয়ে মুহতারাম ভাই ড. আবু জাবের আদ-দামানভী বলছেন, ‘মাসঊদ আহমাদের বক্তব্যের সারমর্ম এই যে, যেভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে নবুঅতের সিলসিলা বন্ধ হয়ে গেছে, ঠিক তেমনিভাবে মুহাদ্দিছগণের আগমনের সিলসিলাও কোন বিশেষ মুহাদ্দিছ ব্যক্তি পর্যন্ত সমাপ্ত হয়ে গেছে। এখন ক্বিয়ামত পর্যন্ত আর কোন মুহাদ্দিছ জন্ম নিবেন না এবং বর্তমানে যারাই আসবেন তারা শুধুমাত্র পূর্ববর্তী মুহাদ্দিছগণের গ্রন্থ হ’তে নকলকারীই হবেন। যেভাবে লোকেরা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ বারজন ইমামের পরে তাদের সিলসিলা খতম করে দিয়েছেন। মাসঊদ আহমাদ ছাহেবের মনে হ’তে পারে যে, এভাবে মুহাদ্দিছগণের আগমনের ধারাবাহিকতাও বর্তমানে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি (মাসঊদ আহমাদ) এ ব্যাপারে কোন দলীল উল্লেখ করেননি। তার দৃষ্টিতে ইমামদের বক্তব্যতো ভ্রূক্ষেপযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে তিনি নিজের বক্তব্যকেই দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। অথচ যে ব্যক্তিই ইলমে হাদীছের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন, তাকে মুহাদ্দিছগণের দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে।[15]
ছহীহ বুখারীর হাদীছ, تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِيْنَ وَإِمَامَهُمْ ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’।[16] এই হাদীছের অনুকূলে ইমাম বুখারী (রহঃ) লিখিত অনুচ্ছেদ كَيْفَ الأَمْرُ إِذَا لَمْ تَكُنْ جَمَاعَةٌ ‘যখন জামা‘আত থাকবে না তখন কি করতে হবে’-এর ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেছেন, وَالْمَعْنَى مَا الَّذِي يَفْعَلُ الْمُسلمُ فِي حَال الِاخْتِلاَفِ مِنْ قبل ان يَقع الْإِجْمَاعُ عَلَى خَليْفَةٍ ‘উক্ত হাদীছের মর্মার্থ এই যে, একজন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমতের পূর্বে মতভেদপূর্ণ পরিস্থিতিতে মুসলমানগণ কি করবেন’?[17]
বদরুদ্দীন আইনী হানাফী লিখছেন, وَحَاصِل معنى التَّرْجَمَة أَنه إِذا وَقع اخْتِلَاف وَلم يكن خَليفَة فَكيف يفعل الْمُسلم من قبل أَن يَقع الِاجْتِمَاع على خَليفَة ‘এ অনুচ্ছেদের সারমর্ম হ’ল, যখন মুসলমানদের মাঝে মতপার্থক্য হবে এবং কোন খলীফা থাকবে না, এমতাবস্থায় একজন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণের পূর্বে মুসলমানগণ কি করবেন’?[18]
‘জামা‘আত’ শব্দের ব্যাখ্যায় বুখারীর ভাষ্যকার ইমাম ক্বাসত্বালানী (রহঃ) লিখছেন, مجتمعون على خَليفَة ‘একজন খলীফার অধীনে ঐক্যবদ্ধ ব্যক্তিগণ’।[19]
ইমাম কুরতুবী (মৃঃ ৬৫৬ হিঃ) লিখছেন,
يعني : أنه متى اجتمع المسلمون على إمام فلا يُخرج عليه وإنْ جَارَ كما تقدّم، وكما قال في الرواية الأخرى: فاسمع، وأطع. وعلى هذا فتُشهد مع أئمة الْجَوْر الصلوات، والجماعات، والجهاد، والحج، وتُجْتَنَبُ معاصيهم، ولا يطاعون فيها.
অর্থাৎ যখন মুসলমানগণ কোন খলীফার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করবেন, তখন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। যদিও তিনি অত্যাচারী হন। যেমনটি পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। যেমনভাবে অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তুমি তার আদেশ শোন এবং তার আনুগত্য কর (যদিও সে তোমার পিঠে প্রহার করে)। এ হাদীছের আলোকে অত্যাচারী ইমাম তথা শাসকদের সাথে ছালাত, ঈদের জামা‘আত, জিহাদ, হজ্জ (প্রভৃতি) আদায় করা যাবে। তবে তাদের পাপকার্য সমূহ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এ ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা যাবে না।[20]
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) আরো বলেন, فلو بايع أهل الحل والعقد لواحدٍ موصوف بشروط الإمامة لانعقدت له الخلافة، وحرمت على كل أحدٍ المخالفة ‘যদি জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ খেলাফতের শর্তাবলী পূরণকারী কোন ব্যক্তির নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন, তাহ’লে তার খেলাফত কায়েম হয়ে যাবে এবং প্রত্যেক মুসলমানের উপরে তার বিরোধিতা করা হারাম সাব্যস্ত হয়ে যাবে’।[21]
হাদীছের ব্যাখ্যাকারদের উক্ত ভাষ্য সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ এবং তাদের ইমাম দ্বারা খিলাফত এবং খলীফা উদ্দেশ্য। এই ব্যাখ্যার সমর্থন এর দ্বারাও হয় যে, হুযায়ফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অন্য আরেকটি বর্ণনায় এসছে যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, فَإِنْ لَمْ تَجِدْ يَوْمَئِذٍ خَلِيْفَةً فَاهْرَبْ حَتَّى تَمُوْتَ ‘তুমি যদি তখন কোন খলীফা না পাও, তাহ’লে মৃত্যু অবধি পালিয়ে থাকবে’।[22]
একটি গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা : ইবনু বাত্তাল কুরতুবী (মৃঃ ৪৪৯হিঃ) বলেছেন,فإذا لم يكن لهم إمام فافترق أهل الإسلام أحزابًا فواجب اعتزال تلك الفرق كلها ‘সুতরাং যখন তাদের কোন ইমাম (খলীফা) থাকবে না এবং মুসলমানেরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে যাবে, তখন ঐ দলসমূহ হ’তে দূরে থাকা আবশ্যক’।[23]
হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছ দ্বারা দুই শ্রেণীর মানুষ ফায়েদা লোটার চেষ্টা করেছে।
১. ঐ সকল লোক, যারা ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ নামে একটি কাগুজে দল গঠন করেছে এবং একজন সাধারণ ব্যক্তি সেই পার্টির নেতা বনে গেছে। অথচ এ দলটি মুসলমানদের খেলাফতভিত্তিক জামা‘আত নয় এবং সেই দলের নেতাও ইমাম বা খলীফা নয়।
২. ঐ সকল লোক, যারা একজন কাগুজে খলীফা বানিয়েছে। যার নিকটে না আছে সৈন্য, আর না আছে কোন ক্ষমতা। এই কাগুজে খলীফার এক ইঞ্চি মাটির উপরেও কোন কর্তৃত্ব নেই। ঐ খলীফা না কোন কাফেরদের সাথে জিহাদ করেছে, আর না কোন শারঈ দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেছে। তাকে খলীফা বলা খেলাফতের সাথে ঠাট্টা করার শামিল। সূরা বাক্বারার ৩০ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) লিখেছেন,
وَقَدِ اسْتَدَلَّ الْقُرْطُبِيُّ وَغَيْرُهُ بِهَذِهِ الْآيَةِ عَلَى وُجُوبِ نَصْبِ الْخَلِيفَةِ لِيَفْصِلَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا يَخْتَلِفُونَ فِيهِ، وَيَقْطَعَ تَنَازُعَهُمْ، وَيَنْتَصِرَ لِمَظْلُومِهِمْ مِنْ ظَالِمِهِمْ، وَيُقِيمَ الْحُدُودَ، وَيَزْجُرَ عَنْ تَعَاطِي الْفَوَاحِشِ-
‘কুরতুবী প্রমুখ এ আয়াত দ্বারা খলীফা কায়েম করা ওয়াজিব হওয়া সাব্যস্ত করেছেন। যাতে তিনি লোকদের মধ্যে বিবদমান বিষয়ের ফায়ছালা করেন এবং তাদের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান। যালেমের বিরুদ্ধে মাযলূমকে সাহায্য করতে পারেন, দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেন এবং যাবতীয় অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে বিরত রাখেন’।[24]
ক্বাযী আবু ইয়া‘লা মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-ফার্রা এবং ক্বাযী আলী বিন মুহাম্মাদ বিন হাবীব আল-মাওয়ার্দী ও খলীফা হওয়ার জন্য জিহাদ, রাজনৈতিক শক্তি এবং হুদূদ বা দন্ডবিধি প্রয়োগ করার শর্তাবলী আরোপ করেছেন।[25]
মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী (রহঃ) লিখছেন, ولأن المسلمين لا بد لهم من إمام، يقوم بتنفيذ أحكامهم، وإقامة حدودهم، وسدّ ثغورهم، وتجهيز جيوشهم، وأخذ صدقاتهم. ‘মুসলমানদের জন্য এমন একজন ইমাম (খলীফা) হওয়া যরূরী, যিনি হুকুম-আহকাম বাস্তবায়ন করবেন, তাদের মাঝে দন্ডবিধি কায়েম করবেন, সীমান্ত এলাকার হেফাযত করবেন, সৈন্য-বাহিনী প্রস্ত্তত করবেন এবং মানুষদের নিকট থেকে যাকাত-ছাদাক্বা আদায় করবেন’।[26]
ওলামায়ে কেরামের উল্লিখিত বক্তব্যের সরাসরি বিপরীত একজন কাগুজে খলীফা বানানো, যিনি নিজের ঘরেই শারঈ হুদূদ কায়েমে ব্যর্থ হন এবং নিজের ঘর-বাড়ীকে হেফাযত করতে সক্ষম হন না, এগুলি ঐ সমস্ত লোকের কাজ যারা মুসলিম উম্মাহর মাঝে দলাদলি সৃষ্টি করতে এবং বাতিল মতবাদ সমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে চায়।
একটি হাদীছে এসেছে, وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মারা যায় এমতাবস্থায় যে তার গর্দানে কোন ইমামের বায়‘আত নেই, সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’।[27]
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন,تدري ما الإمام؟ الذي يجتمع المسلمون عليه كلهم يقول: هذا إمام، فهذا معناه ‘তুমি কি জান (উক্ত হাদীছে বর্ণিত) ইমাম কাকে বলে? ইমাম তিনিই, যার ইমাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। প্রতিটি লোকই বলবে যে, ইনিই ইমাম (খলীফা)। এটাই উক্ত হাদীছের মর্মার্থ।[28]
সারসংক্ষেপ এই যে, ইমাম এবং জামা‘আতুল মুসলিমীন সংক্রান্ত হাদীছ সমূহ দ্বারা দলীল সাব্যস্ত করে কিছু লোকের কাগুজে জামা‘আত এবং কাগুজে আমীর বানানো একেবারেই ভ্রান্ত এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের সরাসরি বরখেলাফ।
কিছু মানুষ ‘আহলেহাদীছ’ নাম শুনে জ্বলে-পুড়ে মরেন এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে অপচেষ্টা চালান যে, আহলেহাদীছ নামটি দলবাজি। আমরা যেহেতু মুসলিম তাই আমাদেরকে মুসলিম বলাই উচিত। সেজন্যই আমরা সালাফে ছালেহীন, মুহাদ্দিছ এবং ইমামগণের অসংখ্য দলীল পেশ করেছি এ মর্মে যে, আহলেহাদীছ বলা কেবল জায়েযই নয়; বরং পসন্দনীয়ও বটে। আর এটাই ত্বায়েফাহ মানছূরাহ তথা সাহায্যপ্রাপ্ত দল।
[1]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩; ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে হাসান ছহীহ গরীব বলেছেন। ইবনু হিববান, মাওয়ারিদ, হা/১২২২, ১৫৫০) এবং হাকেম একে ছহীহ বলেছেন (১/১১৭, ১১৮, ২৩৬, ৪২১, ৪২২) এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন।
[2]. আহমাদ, ৪/১৩০, হা/১৭৩০২; ৪/২০২, হা/১৭৯৫৩, সনদ হাসান।
[3]. মুসলিম, হা/২৭ অনুচেছদ-৫; দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের ক্রমিক নং অনুসারে।
[4]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; সনদ ছহীহ।
[5]. তিরমিযী হা/২২২৯; ‘ফিতান’ অধ্যায়, ‘পথভ্রষ্ট শাসকদের আলোচনা’ অনুচ্ছেদ; আরেযাতুল আহওয়াযী, ৯/৭৪; সনদ ছহীহ।
[6]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, পৃঃ ১৩৪; সনদ ছহীহ।
[7]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ।
[8]. ঐ, পৃঃ ২; ইবনু হাজার আসক্বালানী ফাতহুল বারীতে (১৩/২৫০) একে ছহীহ বলেছেন।
[9]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, সনদ ছহীহ।
[10]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/৮৫, পৃঃ ৯৪, সনদ ছহীহ।
[11]. মুস্তাদরাকে হাকেম, হা/৩৯৮, ৩৯৯, ১/১১৬, সনদ ছহীহ।
[12]. মুক্বাদ্দামাতুল ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ১৯; ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[13]. আল-জামা‘আতুল ক্বাদীমাহ বা-জাওয়াবে আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ, পৃঃ ৫।
[14]. ঐ, পৃঃ ২৯।
[15]. খুলাছাতুল ফিরক্বাতিল জাদীদাহ, পৃঃ ৫৫।
[16]. বুখারী, হা/৭০৮৪।
[17]. ফাতহুল বারী, হা/৭০৮৪, ১৩/৩৫।
[18]. উমদাতুল ক্বারী, ২৪/১৯৩, ‘ফিতান’ অধ্যায়।
[19]. ইরশাদুস সারী, ১০/১৮৩।
[20]. আল-মুফহাম লিমা আশকালা মিন তালখীছে কিতাবে মুসলিম, ৪/৫৭।
[21]. ঐ, ৪/৫৭-৫৮।
[22]. আবুদাঊদ হা/৪২৪৭; ছহীহ আবু ‘আওয়ানাহ, ৪/৪৭৬; সনদ হাসান। রাবী ছাখর বিন বদরকে ইবনে হিববান ও আবু ‘আওয়ানাহ ছিক্বাহ বলেছেন। অপর রাবী সুবাই‘ ইবনে খালেদকে ইজলী এবং ইবনে হিববান ছিক্বাহ বলেছেন। এ হাদীছটির অনেক শাহেদ তথা সমর্থক হাদীছ রয়েছে।
[23]. ইবনু বাত্তাল, শারহুল বুখারী, ১০/৩২। [এই ব্যাখ্যা ভ্রমাত্মক। কেননা পৃথিবীতে সর্বত্র সর্বদা হকপন্থী খলীফা থাকবেন না। সে অবস্থায় মুসলিম উম্মাহ বাধ্যগতভাবে বাতিলপন্থী শাসকদের আনুগত্য করবে। কিন্তু ইসলামী অনুশাসন পালনের জন্য তারা নিজেদের মধ্যকার ইসলামী আমীরের আনুগত্য করবে। যদিও তিনি শারঈ দন্ডবিধি কায়েম করবেন না। যেভাবে মাক্কী জীবনে রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের আনুগত্য লাভ করেছেন। কিন্তু তাদের উপর শারঈ দন্ডবিধি জারী করেননি। কারণ এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা তখন তিনি লাভ করেননি। এ নীতি সকল যুগেই প্রযোজ্য। ইমারত ও বায়‘আত বিহীন জীবন বিশৃংখল জীবনের নামান্তর। যাকে হাদীছে জাহেলিয়াতের জীবন বলা হয়েছে এবং যা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অতএব সর্বাবস্থায় মুসলমানকে একজন শারঈ আমীরের প্রতি আনুগত্যশীল হয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।- স.স.]
[24]. তাফসীর ইবনে কাছীর, ১/২০৪।
[25]. আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ২২; মাওয়ার্দী, আল-আহকামুস সুলতানিয়াহ, পৃঃ ৬; মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২২, পৃঃ ৩৯।
[26]. শারহুল ফিক্বহিল আকবার, পৃঃ ১৪৬।
[27]. ইবনু আবী আছেম, আস-সুন্নাহ, হা/১০৫৭, সনদ হাসান; মুসলিম, হা/১৮৫১।
[28]. সুওয়ালাতু ইবনে হানী, পৃঃ ১৮৫; অনুচ্ছেদ ২০১১; খাল্লাল, আস-সুন্নাহ, পৃঃ ৮১, অনুচ্ছেদ ১০; আল-মুসনাদ মিন মাসাইলিল ইমাম আহমাদ, অনুচ্ছেদ-১। গৃহীত : আল-ইমামাতুল উযমা ইনদা আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ২১৭।
আহলেহাদীছ একটি গুণবাচক নাম ও ইজমা :
সালাফে ছালেহীন-এর আছার হ’তে নিম্নে ৫০টি উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল। যেগুলোর মাধ্যমে এটা প্রমাণিত হয় যে, আহলেহাদীছ উপাধি ও গুণবাচক নামটি সম্পূর্ণ সঠিক। আর এর উপরেই ইজমা রয়েছে।
১. বুখারী : ইমাম বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ) ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল সম্পর্কে বলেছেন, يعني أَهْلُ الْحَدِيثِ অর্থাৎ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘আহলেহাদীছ’।[1]
ইমাম বুখারী (রহঃ) ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তানের (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) সূত্রে একজন রাবী (বর্ণনাকারী) সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, لم يكن من أهل الحديث ‘তিনি আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।[2]
২. মুসলিম : ইমাম মুসলিম (মৃঃ ২৬১ হিঃ) ‘মাজরূহ’ বা সমালোচিত রাবীদের সম্পর্কে বলছেন, هم عند أهل الحديث متهمون ‘তারা আহলেহাদীছদের নিকটে (মিথ্যার দোষে) অপবাদগ্রস্ত’।[3]
ইমাম মুসলিম (রহঃ) আরো বলেছেন, وقد شرحنا من مذهب الحديث وأهله، ‘আমরা হাদীছ ও আহলেহাদীছদের মাযহাব-এর ব্যাখ্যা করেছি’।[4]
ইমাম মুসলিম আইয়ূব আস-সিখতিয়ানী, ইবনে আওন, মালেক বিন আনাস, শু‘বাহ বিন হাজ্জাজ, ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান, আব্দুর রহমান বিন মাহদী এবং তাদের পরে আগতদেরকে আহলেহাদীছদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত (من أهل الحديث) বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন।[5]
৩. শাফেঈ : একটি দুর্বল বর্ণনার ব্যাপারে ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (মৃঃ ২০৪ হিঃ) বলেছেন, لا يثبت أهل الحديث مثله، ‘এ জাতীয় বর্ণনাকে আহলেহাদীছগণ প্রমাণিত মনে করেন না’।[6]
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, إذا رأيت رجلا من أصحاب الحديث فكأني رأيت النبي صلى الله عليه وسلم حيا، ‘আমি যখন আহলেহাদীছ-এর কোন ব্যক্তিকে দেখি, তখন যেন আমি রাসূল (ছাঃ)-কেই জীবিত দেখি’।[7]
৪. আহমাদ বিন হাম্বল : ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ)-কে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’লে তিনি বলেন, إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث فلا أدري من هم؟ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[8]
৫. ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান : ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তান (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) সুলাইমান বিন ত্বারখান আত-তায়মী সম্পর্কে বলেছেন, كان التيمي عندنا من أهل الحديث، ‘আমাদের নিকট তায়মী আহলেহাদীছদের অন্যতম ছিলেন’।[9]
হাদীছের একজন রাবী ইমরান বিন কুদামাহ আল-‘আম্মী সম্পর্কে ইয়াহ্ইয়া আল-ক্বাত্তান বলেছেন,ولكنه لم يكن من أهل الحديث، ‘কিন্তু তিনি আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।[10]
৬. তিরমিযী : আবু যায়েদ নামক একজন রাবীর ব্যাপারে ইমাম তিরমিযী (মৃঃ ২৭৯ হিঃ) বলেছেন, وأبو زيد رجل مجهول عند أهل الحديث، ‘আহলেহাদীছদের নিকটে আবু যায়েদ একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি’।[11]
৭. আবুদাঊদ : ইমাম আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানী (মৃঃ ২৭৫ হিঃ) বলেছেন, عند عامة أهل الحديث ‘সাধারণ আহলেহাদীছদের নিকটে...’।[12]
৮. নাসাঈ : ইমাম নাসাঈ (মৃঃ ৩০৩ হিঃ) বলেছেন, ومنفعةً لأهل الإسلام ومن أهل الحديث والعلم والفقه والقرآن، ‘ইসলামের অনুসারীগণ, আহলেহাদীছ, আহলে ইলম, আহলে ফিক্বহ এবং আহলে কুরআন-এর উপকারিতার জন্য’।[13]
৯. ইবনে খুযায়মাহ : ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব ইবনে খুযায়মাহ নিশাপুরী (মৃঃ ৩১১ হিঃ) একটি হাদীছের ব্যাপারে বলেছেন, لم نر خلافا بين علماء أهل الحديث أن هذا الخبر صحيح من جهة النقل، ‘আমরা আহলেহাদীছ আলেমদের মাঝে কোন মতানৈক্য দেখিনি যে, এই হাদীছটি বর্ণনার দিক থেকে ছহীহ’।[14]
১০. ইবনু হিববান : হাফেয মুহাম্মাদ ইবনে হিববান আল-বুসতী (মৃঃ ৩৫৪ হিঃ) একটি হাদীছের উপর নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন : ذكر خبر شنع به بعض المعطلة على أهل الحديث، حيث حرموا توفيق الإصابة لمعناه، ‘ঐ হাদীছের বর্ণনা, যার মাধ্যমে কতিপয় মু‘আত্তিলা (নির্গুণবাদী) আহলেহাদীছদের প্রতি দোষারোপ করেছে। কেননা এরা এ হাদীছের সঠিক মর্ম অনুধাবনের তেŠফিক থেকে বঞ্চিত হয়েছে’।[15]
অন্য এক জায়গায় হাফেয ইবনু হিববান আহলেহাদীছদের এই গুণ বর্ণনা করেছেন যে, ينتحلون السنن ويذبون عنها ويقمعون من خالفها، ‘তারা হাদীছের প্রতি আমল করেন, এর হেফাযত করেন এবং সুন্নাত বিরোধীদের মূলোৎপাটন করেন’।[16]
১১. আবু ‘আওয়ানাহ : ইমাম আবু ‘আওয়ানাহ আল-ইসফারাইনী (মৃঃ ৩১৬ হিঃ) একটি মাসআলা সম্পর্কে ইমাম মুযানী (রহঃ)-কে বলছেন, اختلاف بين أهل الحديث ‘এ বিষয়ে আহলেহাদীছদের মাঝে মতভেদ রয়েছে’।[17]
১২. ইজলী : ইমাম আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন ছালেহ আল-ইজলী (মৃঃ ২৬১ হিঃ) ইমাম সুফিয়ান বিন উয়াইনা সম্পর্কে বলেন, وكان بعض أهل الحديث يقول هو أثبت الناس في حديث الزهري، ‘কতিপয় আহলেহাদীছ বলতেন যে, তিনি যুহরীর হাদীছ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী বিশবস্ত’।[18]
১৩. হাকেম : আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকেম নিশাপুরী (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) ইয়াহ্ইয়া ইবনে মাঈন (রহঃ) সম্পর্কে বলেছেন, إمام أهل الحديث ‘তিনি আহলেহাদীছদের ইমাম’।[19]
১৪. হাকেম কাবীর : আবু আহমাদ আল-হাকেম আল-কাবীর (মৃঃ ৩৭৮ হিঃ) شعار أصحاب الحديث ‘আহলেহাদীছদের নিদর্শন’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই গ্রন্থটির অনুবাদ লেখকের তাহকীক সহ প্রকাশিত হয়েছে।[20]
১৫. ফিরইয়াবী : মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ আল-ফিরইয়াবী (মৃঃ ২১২ হিঃ) বলেছেন, رأينا سفيان الثوري بالكوفة وكنا جماعة من أهل الحديث، ‘আমরা সুফিয়ান ছাওরীকে কুফাতে দেখেছি। এমতাবস্থায় আমরা আহলেহাদীছদের একটা জামা‘আত ছিলাম’।[21]
১৬. ফিরইয়াবী : জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ আল-ফিরইয়াবী (মৃঃ ৩০১ হিঃ) ইবরাহীম বিন মূসা আল-ওয়াযদূলী (রহঃ) সম্পর্কে বলেছেন, وله ابن من أصحاب الحديث يقال له اسحاق ‘তার এক আহলেহাদীছ পুত্র রয়েছে। যার নাম ইসহাক্ব’।[22]
১৭. আবু হাতিম আর-রাযী : আসমাউর রিজালের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু হাতিম আর-রাযী (মৃঃ ২৭৭ হিঃ) বলেছেন, واتفاق أهل الحديث على شيء يكون حجة، ‘কোন বিষয়ের উপরে আহলেহাদীছদের ঐক্যমত হুজ্জাত বা দলীল হিসাবে গণ্য হয়’।[23]
১৮. আবু ওবাইদ : ইমাম আবু ওবাইদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম (মৃঃ ২২৪ হিঃ) একটি আছার সম্পর্কে বলেছেন, وقد يأخذ بهذا بعض أهل الحديث، ‘কতিপয় আহলেহাদীছ এই আছারটি গ্রহণ করেছেন’।[24]
১৯. আবুবকর বিন আবুদাঊদ : ইমাম আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানীর অধিকাংশের নিকট বিশ্বস্ত পুত্র আবুবকর বিন আবুদাঊদ বলছেন,
ولا تك من قوم تلهو بدينهم * فتطعن في أهل الحديث وتقدح
‘তুমি ঐ লোকদের দলভুক্ত হয়ো না, যারা স্বীয় দ্বীনকে নিয়ে খেল-তামাশা করে। নতুবা তুমিও আহলেহাদীছদেরকে তিরষ্কার ও দোষারোপ করবে’।[25]
২০. ইবনু আবী আছিম : ইমাম আহমাদ বিন আমর বিন আয-যাহহাক বিন মাখলাদ ওরফে ইবনে আবী আছিম (মৃঃ ২৮৭ হিঃ) একজন রাবী সম্পর্কে বলছেন, رجل من أهل الحديث ثقة ‘তিনি আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি’।[26]
২১. ইবনু শাহীন : হাফেয আবু হাফছ ওমর বিন শাহীন (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ) ইমরান আল-‘আম্মী সম্পর্কে ইয়াহ্ইয়া আল-ক্বাত্তবানের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন, ولكن لم يكن من أهل الحديث ‘কিন্তু তিনি (ইমরান) আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’।[27]
২২. আল-জাওযাজানী : আবু ইসহাক্ব ইবরাহীম বিন ইয়াকূব আল-জাওযাজানী (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) বলেছেন, ثم الشائع في أهل الحديث ‘অতঃপর আহলেহাদীছদের মাঝে প্রসিদ্ধ রয়েছে...’।[28]
২৩. আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী : ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) বলেছেন, ليس في الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أهل الحديث، ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[29]
প্রতীয়মান হ’ল যে, যে ব্যক্তি আহলেহাদীছদের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে অথবা আহলেহাদীছদেরকে মন্দ নামে ডাকে, সে ব্যক্তি পাক্কা বিদ‘আতী।
২৪. আলী বিন আব্দুল্লাহ আল-মাদীনী : ইমাম বুখারী ও অন্যান্যদের উস্তাদ ইমাম আলী বিন আব্দুল্লাহ আল-মাদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) একটি হাদীছের ব্যাখ্যায় বলছেন, يعني أهل الحديث ‘অর্থাৎ তারা হ’লেন আহলেহাদীছ (আছহাবুল হাদীছ)’।[30]
২৫. কুতায়বা বিন সাঈদ : ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ (মৃঃ ২৪০ হিঃ) বলেছেন, إذا رأية الرجل يحب أهل الحديث ... فإنه على السنة ‘যদি তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখ যে সে আহলেহাদীছদেরকে ভালোবাসে, তবে বুঝবে সে সুন্নাতের উপরে আছে’।[31]
২৬. ইবনু কুতায়বা দীনাওয়ারী : বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনু কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ)। ‘তাবীলু মুখতালাফিল হাদীছ ফির রদ্দি আলা আ‘দায়ে আহলিল হাদীছ’ (تأويل مختلف الحديث في الرد على أعداء أهل الحديث) নামে একটি গ্রন্থ লিখেছেন। এই গ্রন্থে তিনি আহলেহাদীছ-এর দুশমনদের কঠিনভাবে জবাব প্রদান করেছেন।
২৭. বায়হাক্বী : আহমাদ ইবনুল হুসাইন আল-বায়হাক্বী (মৃঃ ৪৫৮ হিঃ) মালেক বিন আনাস, আওযাঈ, সুফিয়ান ছাওরী, সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা, হাম্মাদ বিন যায়েদ, হাম্মাদ বিন সালামাহ, শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ প্রমুখকে আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত (من أهل الحديث) লিখেছেন।[32]
২৮. ইসমাঈলী : হাফেয আবু বকর আহমাদ বিন ইবরাহীম আল-ইসমাঈলী (মৃঃ ৩৭১ হিঃ) একজন রাবী সম্পর্কে বলেছেন, لم يكن من أهل الحديث، ‘তিনি আহলেহাদীছ ছিলেন না’।[33]
২৯. খত্বীব : খত্বীব বাগদাদী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) আহলেহাদীছদের ফযীলত সম্পর্কে ‘শারফু আছহাবিল হাদীছ’ (شرف أصحاب الحديث) নামে একখানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেটি প্রকাশিত। ‘নাছীহাতু আহলিল হাদীছ’ (نصيحة أهل الحديث) নামক গ্রন্থখানাও খত্বীবের দিকে সম্পর্কিত।[34]
৩০. আবু নু‘আইম ইস্পাহানী : আবু নু‘আইম ইস্পাহানী (মৃঃ ৪৩০ হিঃ) একজন রাবী সম্পর্কে বলেছেন, لا يخفى على علماء أهل الحديث فساده، ‘আহলেহাদীছ আলেমদের নিকটে তার ফাসাদ গোপন নয়’।[35]
তিনি বলেছেন, وذهب الشافعي مذهب أهل الحديث ‘ইমাম শাফেঈ আহলেহাদীছের মাযহাবের অনুকূলে গেছেন’।[36]
৩১. ইবনুল মুনযির : হাফেয মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আন-নায়সাপুরী (মৃঃ ৩১৮ হিঃ) স্বীয় সঙ্গী-সাথী এবং ইমাম শাফেঈ ও অন্যান্যদেরকে আহলেহাদীছ বলেছেন।[37]
৩২. আজুর্রী : ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-আজুর্রী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) আহলেহাদীছদেরকে নিজ ভাই সম্বোধন করে বলেছেন, نصيحة لإخواني من أهل القرآن وأهل الحديث وأهل الفقه وغيرهم من سائر المسلمين، ‘আমার ভ্রাতৃমন্ডলী আহলে কুরআন, আহলেহাদীছ, আহলে ফিক্বহ এবং অন্যান্য সকল মুসলিমের প্রতি আমার নছীহত’।[38]
সতর্কীকরণ : হাদীছ অস্বীকারকারীদেরকে আহলে কুরআন বা আহলে ফিক্বহ বলা ভুল। আহলে কুরআন, আহলেহাদীছ, আহলে ফিক্বহ প্রভৃতি উপাধি ও গুণবাচক নাম একই জামা‘আতের নাম। আল- হামদুলিল্লাহ।
৩৩. ইবনু আব্দিল বার্র : হাফেয ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল বার্র আল-আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন, وقالت طائفة من أهل الحديث، ‘আহলেহাদীছদের একটি দল বলেছে...’।[39]
৩৪. ইবনু তায়মিয়া : হাফেয ইবনু তায়মিয়া আল-হার্রানী (মৃঃ ৭২৮ হিঃ) একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، أَمَّا الْبُخَارِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ فَإِمَامَانِ فِي الْفِقْهِ مِنْ أَهْلِ الِاجْتِهَادِ. وَأَمَّا مُسْلِمٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَه وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَأَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ وَنَحْوُهُمْ فَهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيثِ. لَيْسُوا مُقَلِّدِينَ لِوَاحِدٍ بِعَيْنِهِ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَلَا هُمْ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْمُجْتَهِدِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ- ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। ইমাম বুখারী ও আবুদাঊদ ফিক্বহের ইমাম ও মুজতাহিদ (মুত্বলাক্ব) ছিলেন। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে খুযায়মাহ, আবু ই‘য়ালা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। আর তারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বও ছিলেন না’।[40]
সতর্কীকরণ : উক্ত বড় বড় মুহাদ্দিছ ইমামগণের সম্পর্কে ইমাম ইবনে তায়মিয়ার এমনটা বলা যে, ‘তারা কোন মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন না’ অগ্রহণযোগ্য।
৩৫. ইবনে রশীদ : ইবনে রশীদ আল-ফিহরী (মৃঃ ৭২১ হিঃ) ইমাম আইয়ূব আস-সিখতিয়ানী এবং অন্যান্য বড় বড় আলেমদের সম্পর্কে বলেছেন, من أهل الحديث ‘তারা আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[41]
৩৬. ইবনুল ক্বাইয়িম : হাফেয ইবনুল কবাইয়িম (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) স্বীয় প্রসিদ্ধ ‘ক্বাছীদা নূনিয়া’তে লিখেছেন,
يا مبغضا أهل الحديث وشاتما * أبشر بعقد ولاية الشيطان
‘হে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ও গালি প্রদানকারী! তুমি শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের সুসংবাদ গ্রহণ কর’।[42]
৩৭. ইবনু কাছীর : হাফেয ইসমাঈল ইবনে কাছীর আদ-দিমাশক্বী (মৃঃ ৭৭৪ হিঃ) সূরা বনু ইসরাঈলের ৭১ আয়াতের তাফসীরে বলেছেন, وقال بعض السلف: هذا أكبر شرف لأصحاب الحديث؛ لأن إمامهم النبي صلى الله عليه وسلم. ‘কতিপয় সালাফ বলেছেন, আহলেহাদীছদের জন্য এটি সবচেয়ে বড় মর্যাদা। কেননা তাদের ইমাম হ’লেন নবী করীম (ছাঃ)’।[43]
৩৮. ইবনুল মুনাদী : ইমাম ইবনুল মুনাদী আল-বাগদাদী (মৃঃ ৩৩৬ হিঃ) ক্বাসেম বিন যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া আল-মুতার্রিয সম্পর্কে বলেছেন, وكان من أهل الحديث والصدق ‘তিনি আহলেহাদীছ ও সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[44]
৩৯. শীরাওয়াইহ আদ-দায়লামী : দায়লামের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইমাম শীরাওয়াইহ (মৃঃ ৫০৯ হিঃ) বিন শাহারদার আদ-দায়লামী আব্দূস (আব্দুর রহমান) বিন আহমাদ বিন আববাদ আছ-ছাক্বাফী আল-হামাদানী সম্পর্কে স্বীয় ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন, روى عنه عامت أهل الحديث ببلدنا وكان ثقت متقنا- ‘আমাদের এলাকার আম আহলেহাদীছগণ তার থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন’।[45]
৪০. মুহাম্মাদ বিন আলী আছ-ছূরী : বাগদাদের প্রসিদ্ধ ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আলী বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আছ-ছূরী (মৃঃ ৪৪১ হিঃ) বলেছেন,
قل لمن عاند الحديث * وأضحى عائبا أهله ومن يدعيه
أبعلم تقول هذا، أبن لي * أم بجهل فالجهل خلق السفيه
أيعاب الذين هم حفظوا * الدين من الترهات والتمويه-
‘হাদীছের সাথে শত্রুতা পোষণকারী এবং আহলেহাদীছদেরকে দোষারোপকারীদেরকে বলে দাও! আমাকে বল যে, তুমি কি জেনে-বুঝে নাকি অজ্ঞতাবশে এমনটি বলছ? আর অজ্ঞতা তো নির্বোধের স্বভাব। তাদেরকে কি দোষারোপ করা যায়, যারা দ্বীনকে বাতিল ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা থেকে হেফাযত করেছে’?[46]
৪১. সুয়ূত্বী : يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ‘(স্মরণ কর) যেদিন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা (অর্থাৎ নবী অথবা আমলনামা সহ) আহবান করব’ (বনু ইসরাঈল ৭১) আয়াতের ব্যাখ্যায় জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেন, ليس لأهل الحديث منقبة أشرف من ذلك لأنه لا إمام لهم غيره- ‘আহলেহাদীছদের জন্য এর চাইতে অধিক ফযীলতপূর্ণ বক্তব্য আর নেই। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া আহলেহাদীছদের কোন ইমাম নেই’।[47]
৪২. ক্বিওয়ামুস সুন্নাহ : ক্বিওয়ামুস সুন্নাহ (হাদীছের ভিত্তি) খ্যাত ইসমাঈল বিন মুহাম্মাদ ইবনুল ফযল (মৃঃ ৫৩৫ হিঃ) ইস্পাহানী বলেছেন, ذكر أهل الحديث وأنهم الفرقة الظاهرة على الحق إلى أن ةقوم الساعة- ‘আহলেহাদীছদের বর্ণনা। আর এরাই ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে’।[48]
৪৩. রামহুরমুযী : কাযী হাসান বিন আব্দুর রহমান বিন খাল্লাদ আর-রামহুরমুযী (মৃঃ ৩৬০ হিঃ) বলেছেন, وقد شرف الله الحديث وفضل أهله ‘আল্লাহ হাদীছ ও আহলেহাদীছদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন’।[49]
৪৪. হাফছ বিন গিয়াছ : হাফছ বিন গিয়াছ (মৃঃ ১৯৪ হিঃ)-কে আছহাবুল হাদীছ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা (আহলেহাদীছ) দুনিয়ার মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি’।[50]
৪৫. নাছর বিন ইবরাহীম আল-মাক্বদেসী : আবুল ফাতহ নাছর বিন ইবরাহীম আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৪৯০ হিঃ) লিখেছেন, باب فضيلة أهل الحديث، ‘আহলেহাদীছদের মর্যাদা সম্পর্কে অনুচ্ছেদ’।[51]
৪৬. ইবনু মুফলিহ : আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন মুফলিহ আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৭৬৩ হিঃ) বলেছেন, أهل الحديث هم الطائفة الناجية القائمون على الحق- ‘আহলেহাদীছরাই মুক্তিপ্রাপ্ত দল। যারা হক্বের উপরে প্রতিষ্ঠিত আছেন’।[52]
৪৭. আল-আমীর আল-ইয়ামানী : মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-আমীর আল-ইয়ামানী (মৃঃ ১১৮২ হিঃ) বলেছেন, عليك بأصحاب الحديث الأفاضل تجد عندهم كل الهدي والفضائل- ‘মর্যাদাবান আহলেহাদীছদেরকে অাঁকড়ে ধরবে। তুমি তাদের নিকটে সব ধরনের হেদায়াত ও গুণাবলী পাবে’।[53]
৪৮. ইবনুছ ছালাহ : ছহীহ হাদীছের সংজ্ঞা প্রদানের পরে হাফেয ইবনুছ ছালাহ আশ-শাহরাযূরী (মৃঃ ৮০৬ হিঃ) লিখেছেন, فهذا هو الحديث الذي يحكم له بالصحة بلا خلاف بين أهل الحديث، ‘এটি ঐ হাদীছ, যাকে ছহীহ হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে আহলেহাদীছদের মাঝে কোন মতভেদ নেই’।[54]
৪৯. আছ-ছাবূনী : আবূ ইসমাঈল আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ) عقيدة السلف أصحاب الحديث ‘সালাফ : আহলেহাদীছদের আক্বীদা’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন । এতে তিনি বলেছেন, ويعتقد أهل الحديث ويشهدون أن الله سبحانه وتعالى فوق سبع سماوات على عرشه- ‘আহলেহাদীছগণ এ আক্বীদা পোষণ করেন এবং (এ কথার) সাক্ষ্য প্রদান করেন যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সাত আসমানের উপরে তাঁর আরশের উপরে রয়েছেন’।[55]
৫০. আব্দুল ক্বাহির আল-বাগদাদী : আবূ মানছূর আব্দুল ক্বাহির বিন ত্বাহের বিন মুহাম্মাদ আল-বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) সিরিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের সীমান্তবর্তী অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, كلهم على مذهب أهل الحديث من أهل السنة ‘তারা সকলেই আহলুস সুন্নাহ-এর মধ্য থেকে আহলুল হাদীছ-এর মাযহাবের উপরে আছেন’।[56]
উক্ত ৫০টি উদ্ধৃতি দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, মুহাজির, আনছার এবং আহলে সুন্নাত-এর মতই মুসলমানদের অন্যতম গুণবাচক নাম ও উপাধি হ’ল ‘আহলেহাদীছ’। এই (আহলেহাদীছ) উপাধিটি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। কোন একজন ইমামও আহলেহাদীছ নাম ও উপাধিকে কখনো ভুল, নাজায়েয বা বিদ‘আত বলেননি। এজন্য কতিপয় খারেজী এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত ব্যক্তিদের আহলেহাদীছ নামটিকে অপসন্দ করা, এটাকে বিদ‘আত এবং দলবাজি বলে আখ্যায়িত করে হাসি-ঠাট্টা করা আসলে সকল মুহাদ্দিছ এবং মুসলিম উম্মাহর ইজমার বিরোধিতা করার শামিল।[57]
এগুলো ব্যতীত আরো অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে। যেগুলোর দ্বারা ‘আহলুল হাদীছ’ বা ‘আছহাবুল হাদীছ’ প্রভৃতি গুণবাচক নামসমূহের প্রমাণ পাওয়া যায়। সম্মানিত মুহাদ্দিছগণের উক্ত সুস্পষ্ট বক্তব্য সমূহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছ ঐ সকল ছহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুহাদ্দিছ ও সাধারণ জনগণের উপাধি, যারা তাক্বলীদ ছাড়াই সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে কুরআন ও সুন্নাহর উপরে আমল করেন। আর তাদের আক্বীদা সম্পূর্ণরূপে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার অনুকূলে। স্মর্তব্য যে, আহলেহাদীছ ও আহলে সুন্নাত একই দলের গুণবাচক নাম।
কতিপয় বিদ‘আতী একথা বলে যে, শুধু মুহাদ্দিছগণকেই ‘আহলেহাদীছ’ বলা হয়ে থাকে। চাই তিনি (মুহাদ্দিছ) আহলে সুনণাতের মধ্য থেকে হোন বা বিদ‘আতীদের মধ্য থেকে হোন। তাদের এ বক্তব্য সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীত হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। বিদ‘আতীদের উক্ত বক্তব্য দ্বারা একথা মেনে নেয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় যে, পথভ্রষ্ট লোকদেরকেও ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ বলে অভিহিত করতে হবে। অথচ এ ধরনের বক্তব্য বাতিল হওয়ার বিষয়টি সাধারণ জনগণের কাছেও পরিষ্কার। কতিপয় রাবীর ব্যাপারে স্বয়ং মুহাদ্দিছগণ একথা সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, তিনি আহলেহাদীছের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।[58]
দুনিয়ার প্রত্যেক বিদ‘আতী আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। তবে কি প্রত্যেক বিদ‘আতীই নিজের প্রতিও ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করে? অতএব হক এটাই যে, ‘আহলেহাদীছ’-এর বৈশিষ্ট্যগত নাম ও উপাধির হকদার স্রেফ দু’শ্রেণীর লোক। ১. হাদীছ বর্ণনাকারীগণ (মুহাদ্দিছগণ)। ২. হাদীছের উপরে আমলকারীগণ (মুহাদ্দিছগণ এবং তাঁদের অনুসারী সাধারণ জনগণ)। হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলছেন,ونحن لا نعني بأهل الحديث المقتصرين على سماعه أو كتابته أو روايته بل نعني بهم : كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهراً وباطناً واتباعه باطناً وظاهراً وكذلك أهل القرآن- ‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবিদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার। অনুরূপভাবে আহলে কুরআনও’।[59] হাফেয ইবনে তায়মিয়ার উক্ত বক্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ দ্বারা মুহাদ্দিছগণ এবং তাদের অনুসারী সাধারণ জনগণ উদ্দেশ্য।
পরিশেষে নিবেদন এই যে, আহলেহাদীছ কোন বংশানুক্রমিক ফিরক্বা নয়। বরং এটি একটি আদর্শিক জামা‘আত। প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি আহলেহাদীছ, যিনি কুরআন, হাদীছ ও ইজমার উপরে সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে আমল করেন এবং এর উপরেই স্বীয় বিশ্বাস পোষণ করেন। আর নিজেকে আহলেহাদীছ (আহলে সুন্নাত) বলার অর্থ আদৌ এটা নয় যে, এখন এই ব্যক্তি জান্নাতী হয়ে গেছে। এখন নেক আমল সমূহ বর্জন, প্রবৃত্তির অনুসরণ এবং নিজের মন মতো জীবন যাপন করা যাবে। বরং ঐ ব্যক্তিই সফলকাম, যিনি আহলেহাদীছ (আহলে সুন্নাত) নামের মর্যাদা রক্ষা করে স্বীয় পূর্বসূরীদের মতো কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করবেন। প্রকাশ থাকে যে, মুক্তির জন্য কেবল নামের লেবেলই যথেষ্ট নয়। বরং হৃদয় ও মস্তিষ্কের পবিত্রতা এবং ঈমান ও আক্বীদার পরিশুদ্ধিতার সাথে সাথে সৎ কর্ম সমূহের উপরেই কেবল নাজাত নির্ভরশীল। এরূপ ব্যক্তিই আল্লাহর অনুগ্রহে চিরস্থায়ী মুক্তির হকদার হবে ইনশাআল্লাহ।
[1]. খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ; আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ, ১/২৪৬।
[2]. আত-তারীখুল কাবীর, ৬/৪২৯; আয-যু‘আফাউছ ছাগীর, পৃঃ ২৮১।
[3]. ছহীহ মুসলিম, ভূমিকা, পৃঃ ৬ (প্রথম অনুচ্ছেদের আগে); অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/৫।
[4]. ঐ।
[5]. ছহীহ মুসলিম, ভূমিকা, পৃঃ ২২, ‘মু‘আন‘আন’ হাদীছ দ্বারা দলীল পেশ করার বিশুদ্ধতা’ অনুচ্ছেদ; অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/২৬; তৃতীয় আরেকটি সংস্করণ, ১/২৩।
[6]. ইমাম বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ১/২৬০, সনদ ছহীহ।
[7]. খত্বীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ৮৫, সনদ ছহীহ।
[8]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ২, হা/২, সনদ হাসান; ইবনু হাজার আসক্বালানী এটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ফাৎহুল বারী, ১৩/২৯৩, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা।
[9]. মুসনাদু আলী ইবনুল জা‘দ, হা/১৩৫৪, ১/৫৯৪; সনদ ছহীহ; আরেকটি সংস্করণের হাদীছ নং ১৩১৪; ইবনু আবী হাতিম, আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল, ৪/১২৫, সনদ ছহীহ।
[10]. আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল, ৬/৩০৩, সনদ ছহীহ।
[11]. তিরমিযী, হা/ ৮৮।
[12]. রিসালাতু আবী দাঊদ ইলা মাক্কা ফী ওয়াছফি সুনানিহি, পৃঃ ৩০; পান্ডুলিপি, পৃঃ ১।
[13]. নাসাঈ, হা/৪১৪৭, ৭/১৩৫; আত-তা‘লীক্বাতুস সালাফিইয়াহ, হা/৪১৫২। [এখানে হাদীছকে অস্বীকারকারী প্রচলিত ‘আহলে কুরআন’ নামক ভ্রান্ত দলটিকে বুঝানো হয়নি। আর যারা হাদীছকে অস্বীকার করে তাদেরকে আহলে কুরআন বলে সম্বোধন করাও ঠিক নয়। কারণ তারা কুরআনের অনুসরণ করে না; বরং তারা প্রবৃত্তিপূজারী-অনুবাদক]।
[14]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ, হা/৩১, ১/২১।
[15]. ছহীহ ইবনে হিববান, আল-ইহসান, হা/৫৬৬; আরেকটি সংস্করণ, হা/ ৫৬৫; [যারা মহান আল্লাহর ছিফাতসমূহকে অস্বীকার করে তাদেরকে মু‘আত্তিলা বলা হয়।-অনুবাদক]।
[16]. ছহীহ ইবনে হিববান, আল-ইহসান, হা/৬১২৯; অন্য আরেকটি সংস্করণ, হা/৬১৬২; আরো দেখুন : আল-ইহসান, ১/১৪০, ৬১ নং হাদীছের পূর্বে।
[17]. মুসনাদু আবী ‘আওয়ানাহ, ১/৪৯।
[18]. মা‘রিফাতুছ ছিক্বাত, ১/৪১৭; নং ৬৩১; আরেকটি সংস্করণের নং ৫৭৭।
[19]. আল-মুস্তাদরাক, হা/৭১০, ১/১৯৮।
[20]. দেখুন: মাসিক ‘আল-হাদীছ’, ৯ম সংখ্যা, পৃঃ ৪-২৮।
[21]. আল জারহু ওয়াত তা‘দীল, ১/৬০, সনদ ছহীহ।
[22]. ইবনে আদী, আল-কামিল, ১/২৭১; আরেকটি সংস্করণ, ১/৪৪০, সনদ ছহীহ।
[23]. কিতাবুল মারাসীল, পৃঃ ১৯২, অনুচ্ছেদ ৭০৩।
[24]. আবু ওবাইদ, কিতাবুত তুহূর, পৃঃ ১৭৪; ইবনুল মুনযির, আল-আওসাত্ব, ১/২৬৫।
[25]. মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন আল-আজুর্রী, কিতাবুশ শরী‘আহ, পৃঃ ৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[26]. আল-আহাদ ওয়াল মাছানী, ১/৪২৮, হা/৬০৪।
[27]. ইবনে শাহীন, তারীখু আসমাইছ ছিক্বাত, হা/১০৮৪।
[28]. আহওয়ালুর রিজাল, পৃঃ ৪৩, রাবী নং ১০। আরো দেখুন : পৃঃ ২১৪।
[29]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, নং ৬, সনদ ছহীহ।
[30]. তিরমিযী, হা/২২২৯; আরিযাতুল আহওয়াযী, ৯/৭৪।
[31]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, সনদ ছহীহ।
[32]. বায়হাক্বী, কিতাবুল ই‘তিকাদ ওয়াল হিদায়াহ ইলা সাবীলির রাশাদ, পৃঃ ১৮০।
[33]. মুহাম্মাদ বিন জিবরীল আন-নিসবী, কিতাবুল মু‘জাম, ১/৪৬৯, নং ১২১।
[34]. তারীখু বাগদাদ, ১/২২৪, নং ৫১।
[35]. আল-মুস্তাখরাজ আলা ছহীহ মুসলিম, ১/৬৭, অনুচ্ছেদ ৮৯।
[36]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৯/১১২।
[37]. দেখুন: আল-আওসাত্ব, ২/৩০৭, হা/৯১৫-এর আলোচনা।
[38]. আশ-শারী‘আহ, পৃঃ ৩; অন্য আরেকটি সংস্করণ, পৃঃ ৭।
[39]. আত-তামহীদ, ১/১৬।
[40]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২০/৪০।
[41]. আস-সুনানুল আবয়ান, পৃঃ ১১৯, ১২৪।
[42]. আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ ফিল ইনতিছার লিল ফিরক্বাতিন নাজিয়াহ, পৃঃ ১৯৯, ‘নিশ্চয়ই আহলেহাদীছরাই রাসূল (ছাঃ)-এর সাহায্যকারী এবং তাদের বৈশিষ্ট্য’ অনুচ্ছেদ।
[43]. ইবনে কাছীর, ৪/১৬৪।
[44]. তারীখু বাগদাদ, ১২/৪৪১, নং ৬৯১০, সনদ হাসান।
[45]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৪/৪৩৮। আল-হামাদানীর দ্বারা দলীল গ্রহণ করা সঠিক। কারণ যাহাবী তার কিতাব হ’তে বর্ণনা করেন।
[46]. যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফায, ৩/১১১৭, নং ১০০২, সনদ হাসান; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৭/৬৩১; ইবনুল জাওযী, আল-মুন্তাযাম, ১৫/৩২৪।
[47]. তাদরীবুর রাবী, ২/১২৬, ২৭তম প্রকার।
[48]. আল-হুজ্জাহ ফী বায়ানিল মাহাজ্জাহ ওয়া শারহু আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ, ১/২৪৬।
[49]. আল-মুহাদ্দিছুল ফাছিল বাইনার রাবী ওয়াল ওয়া‘ঈ, পৃঃ ১৫৯, নং ১।
[50]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, হা/৩, সনদ ছহীহ।
[51]. আল-হুজ্জাতু ‘আলা তারিকিল মাহাজ্জাহ, ১/৩২৫।
[52]. আল-আদাবুশ শারঈয়াহ, ১/২১১।
[53]. আর-রাওযুল বাসিম ফিয যাবিব আন সুন্নাতি আবিল ক্বাসিম, ১/১৪৬।
[54]. মুক্বাদ্দামা ইবনুছ ছালাহ (ইরাকীর ব্যাখ্যা সহ), পৃঃ ২০।
[55]. আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ১৪।
[56]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩১৭।
[57]. এই সাথে পাঠ করুন বিগত যুগের ৩০৪ জন শ্রেষ্ঠ আহলেহাদীছ বিদ্বানগণের তালিকা মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বিরচিত ডক্টরেট থিসিস ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ’ পৃঃ ৫০-৫২ এবং ৬৬-৭৩।-অনুবাদক।
[58]. ৫, ২১ ও ২৮ নং উদ্ধৃতি দ্রঃ।
[59]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার জবাব
ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছীনে কেরাম এবং তাক্বলীদ ব্যতীত সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারীদের উপাধি ও বৈশিষ্ট্যগত নাম ‘আহলেহাদীছ’। আহলেহাদীছদের নিকটে কুরআন মাজীদ, ছহীহ হাদীছসমূহ (সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী) এবং ইজমা হ’ল শারঈ দলীল। এগুলিকে ‘আদিল্লায়ে শারঈয়াহ’ও বলা হয়ে থাকে। ‘আদিল্লায়ে শারঈয়াহ’ দ্বারা ইজতিহাদের বৈধতা প্রমাণিত। আর ইজতিহাদের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে।
১. কুরআন ও সুন্নাহর ‘উমূম’ (ব্যাপকতা) ও ‘মাফহূম’ (মর্ম) দ্বারা দলীল পেশ করা।
২. সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল প্রদান করা।
৩. আদিল্লায়ে শারঈয়াহর বিরোধী নয় এমন ক্বিয়াস।
৪. মাছালিহে মুরসালাহ প্রভৃতি।[1]
আহলেহাদীছদের নিকটে ইজতিহাদ জায়েয। এজন্য তিনটি শারঈ দলীল দ্বারা দলীল পেশের পরে চতুর্থ দলীলের উপরেও আমল জায়েয রয়েছে। এ শর্তে যে, তা কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও সালাফে ছালেহীনের আছার-এর বিরোধী হবে না। অন্য কথায় আহলেহাদীছদের নিকটে আদিল্লায়ে আরবা‘আহ (কুরআন, হাদীছ, ইজমা, ইজতিহাদ) উপরোল্লিখিত মর্মানুসারে হুজ্জাত বা দলীল।
সতর্কীকরণ : ইজতিহাদ আকস্মিক ও সাময়িক হয়ে থাকে। এজন্য ইজতিহাদকে স্থায়ী বিধানের মর্যাদা দেয়া যায় না। আর না একজন ব্যক্তির ইজতিহাদকে অন্য ব্যক্তির জন্য স্থায়ী ও অপরিহার্য দলীল হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া যায়। উক্ত ভূমিকার পরে কিছু মানুষের আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও ধোঁকাবাজির জবাব পেশ করা হ’ল।
সমালোচনা-১ : ‘আহলেহাদীছদের নিকটে শারঈ দলীল স্রেফ দু’টি। ১. কুরআন ২. হাদীছ। তৃতীয় কোন দলীল নেই’।
জবাব : নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لا يجمع الله أمتي على ضلالة أبدا ‘আল্লাহ আমার উম্মতকে কখনো গোমরাহীর উপরে ঐক্যবদ্ধ করবেন না’।[2] এই হাদীছ দ্বারা ইজমায়ে উম্মত (উম্মতের ইজমা)-এর দলীল হওয়া প্রমাণিত হয়।[3]
হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী মুহাদ্দিছ (মৃঃ ১৩৩৭ হিঃ) বলেন, ‘এর দ্বারা কেউ যেন এটা না বুঝেন যে, আহলেহাদীছরা ইজমায়ে উম্মত ও ক্বিয়াসে শারঈকে অস্বীকার করে। কেননা যখন এ দু’টি বস্ত্ত কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হবে, তখন কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করলেই ইজমা ও ক্বিয়াসকে মানা হয়ে যাবে’।[4]
প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছদের নিকটে ইজমায়ে উম্মত (যদি প্রমাণিত হয়) শারঈ দলীল। এ কারণেই মাসিক ‘আল-হাদীছ’ (হাযরো) পত্রিকার প্রায় প্রত্যেক সংখ্যাতেই লেখা থাকত যে, ‘কুরআন, হাদীছ ও ইজমার বার্তাবাহক’। এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে, আহলেহাদীছদের নিকটে ইজতিহাদ জায়েয। যেমনটা ভূমিকায় আলোচনা করা হয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।
সমালোচনা-২ : আহলেহাদীছদের নিকটে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনতা রয়েছে যে, সে সালাফে ছালেহীনের বুঝের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও হাদীছ বুঝার চেষ্টা করবে।
জবাব : এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভুল। বরং এর বিপরীতে হাফেয আব্দুল্লাহ রোপড়ী (মৃঃ ১৩৮৪ হিঃ) বলেন, ‘সারকথা এই যে, আমরা তো একটা কথাই জানি। তা এই যে, সালাফের খেলাফ (বিপরীত) করা নাজায়েয’।[5]
প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছদের নিকটে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী কুরআন ও হাদীছকে বুঝতে হবে এবং সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীতে ব্যক্তিগত বুঝকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে হবে। এ কারণেই মাসিক ‘আল-হাদীছ’ পত্রিকার প্রায় প্রত্যেক সংখ্যার শেষে লেখা থাকত যে, ‘সালাফে ছালেহীনের সর্বসম্মত বুঝের প্রচার’।
সমালোচনা-৩ : আহলেহাদীছদের নিকটে শুধু ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমই দলীল। তাঁরা অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থসমূহকে মানে না।
জবাব : এই অভিযোগও ভিত্তিহীন। কারণ আহলেহাদীছদের নিকটে ছহীহ হাদীছ সমূহ দলীল। চাই সেগুলো ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে থাকুক বা সুনানে আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থ সমূহে ছহীহ ও হাসান লি-যাতিহি সনদে মওজুদ থাকুক। মাসিক ‘আল-হাদীছ’ সহ আমাদের সকল গ্রন্থ এ কথার সাক্ষী যে, আমরা ছহীহায়েনের পাশাপাশি অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থাবলীর ছহীহ বর্ণনা সমূহ দ্বারাও দলীল পেশ করে থাকি।
সমালোচনা-৪ : আহলেহাদীছরা তাক্বলীদ করে না।
জবাব : জ্বী হ্যাঁ। আহলেহাদীছরা তাক্বলীদ করে না। কারণ তাক্বলীদ জায়েয বা ওয়াজিব হওয়ার কোন প্রমাণ কুরআন, হাদীছ ও ইজমায় নেই। আর সালাফে ছালেহীনের আছার সমূহ দ্বারাও তাক্বলীদ প্রমাণিত নয়। বরং মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন,وأما زلة عالم ، فإن اهتدى فلا تقلدوه دينكم ‘আলেমের ভুলের ব্যাপারে বক্তব্য হ’ল, যদি তিনি হেদায়াতের উপরেও চলেন, তবুও তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করো না’।[6] আহলে সুন্নাতের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (রহঃ) নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন।[7]
আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ আলেম হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন যে, وإنما حدثت هذه البدعة في القرن الرابع ‘এই (তাক্বলীদের) বিদ‘আত চতুর্থ (হিজরী) শতকে সৃষ্টি হয়েছে’।[8]
প্রকাশ থাকে যে, কুরআন ও সুন্নাহর উপরে আমল করা এবং বিদ‘আত থেকে বেঁচে থাকার মধ্যেই ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভের নিশ্চয়তা রয়েছে।
সমালোচনা-৫ : ওয়াহীদুয্যামান হায়দারাবাদী এটা লিখেছেন এবং নওয়াব ছিদ্দীক্ব হাসান খান ওটা লিখেছেন। নূরুল হাসান এটা লিখেছেন এবং বাটালভী ওটা লিখেছেন।
জবাব : ওয়াহীদুযযামান, নওয়াব ছিদ্দীক্ব হাসান খান, নূরুল হাসান, বাটালভী যেই হোন না কেন, এদের কেউই আহলেহাদীছদের আকাবের-এর অন্তর্ভুক্ত নন। যদি হ’তেন তবুও আহলেহাদীছরা আকাবের পূজারী নয়।
ওয়াহীদুযযামান ছাহেব তো একজন প্রত্যাখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন।[9] দেওবন্দী মুক্বাল্লিদ মাস্টার আমীন উকাড়বী এ কথা স্বীকার করেছেন যে, আহলেহাদীছ আলেম-ওলামা ও সাধারণ জনগণ সর্বসম্মতিক্রমে ওয়াহীদুযযামান ও অন্যদের গ্রন্থগুলোকে ভুল আখ্যা দিয়ে সেগুলোকে নাকচ করেছেন।[10]
শাববীর আহমাদ ওছমানী দেওবন্দীর নিকটে ওয়াহীদুযযামান-এর (ছহীহ বুখারীর) অনুবাদ পসন্দনীয় ছিল।[11] ওয়াহীদুযযামান ছাহেব সাধারণ মানুষের জন্য তাক্বলীদকে ওয়াজিব মনে করতেন।[12] এজন্য ওয়াহীদুযযামানের সকল উদ্ধৃতি দেওবন্দী ও তাক্বলীদপন্থীদের বিপক্ষে পেশ করা উচিত। নওয়াব ছিদ্দীক্ব হাসান খান ছাহেব (তাক্বলীদ না করা) হানাফী ছিলেন।[13]
নূরুল হাসান একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি এবং তার দিকে সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ আহলেহাদীছদের নিকটে গ্রহণযোগ্য গ্রন্থসমূহের তালিকাতে নেই। বরং এ সকল গ্রন্থে ফাতাওয়া বিহীন ও আমলবিহীন বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত থাকার কারণে সেগুলো প্রত্যাখ্যাত।
মুহাম্মাদ হুসাইন বাটালভী (রহঃ) আহলেহাদীছ আলেম ছিলেন। তবে তিনি আকাবের-এর মধ্যে ছিলেন না। বরং একজন সাধারণ আলেম ছিলেন। যিনি সর্বপ্রথম মির্যা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর বিরুদ্ধে কাফের ফৎওয়া দিয়েছিলেন। তাঁর ‘আল-ইক্বতিছাদ’ গ্রন্থটি পরিত্যাজ্য গ্রন্থ সমূহের অন্তর্ভুক্ত। বাটালভী ছাহেবের জন্মের শত শত বছর পূর্ব থেকেই দুনিয়ার বুকে আহলেহাদীছ মওজুদ ছিল।[14]
সারকথা এই যে, উক্ত আলেম-ওলামা ও অন্যান্য ছোট-খাটো আলেমদের বক্তব্যকে আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে পেশ করা মস্তবড় যুলুম। যদি কিছু পেশ করতেই হয় তাহ’লে আহলেহাদীছদের বিপক্ষে কুরআন মাজীদ, ছহীহ হাদীছ সমূহ, ইজমা এবং সালাফে ছালেহীন যেমন ছাহাবী, নির্ভরযোগ্য তাবেঈ ও তাবে তাবেঈ এবং বড় বড় মুহাদ্দিছগণের বক্তব্য পেশ করুক। অন্যথায় দাঁতভাঙ্গা জবাব পাবে ইনশাআল্লাহ।
সতর্কীকরণ : আহলেহাদীছদের নিকটে কুরআন, হাদীছ ও ইজমার সুস্পষ্ট বিরোধী সকল বক্তব্যই প্রত্যাখ্যাত। চাই সেগুলোর বর্ণনাকারী অথবা সেগুলোর লেখক যত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিই হোন না কেন।
সমালোচনা-৬ : ‘মুফতী’ আব্দুল হাদী দেওবন্দী ও অন্যেরা লিখেছেন যে, ‘এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য যে, গায়ের মুক্বাল্লিদীনের (যারা নিজেদেরকে আহলেহাদীছ বলে) অস্তিত্ব ইংরেজদের আমলের আগে ছিল না’।[15]
জবাব : দুই শ্রেণীর লোকদেরকে আহলেহাদীছ বলা হয়। ১. ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন (নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী) মুহাদ্দিছীনে কেরাম, যারা তাক্বলীদের প্রবক্তা নন। ২. মুহাদ্দিছীনে কেরামের অনুসারী ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণ। যারা তাক্বলীদ ছাড়াই কুরআন ও সুন্নাহর উপরে আমল করে। এই দুই শ্রেণী খায়রুল কুরূন (সোনালী যুগ) থেকে অদ্যাবধি প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান রয়েছে।
প্রথম দলীল : ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে তাক্বলীদে শাখছী ও তাক্বলীদে গায়ের শাখছীর কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। বরং মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন, ‘আলেমের ভুলের ব্যাপারে বক্তব্য হ’ল, যদি তিনি হেদায়াতের উপরেও চলেন, তবুও তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করবে না’।[16] ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, لاتقلدوا دينكم الرجال ‘তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে লোকদের তাক্বলীদ করো না’।[17]
কোন ছাহাবীই তাদের বক্তব্যের বিরোধী নেই। এজন্য প্রমাণিত হ’ল যে, এ বিষয়ে ছাহাবীগণের ইজমা রয়েছে যে, তাক্বলীদ নিষিদ্ধ। আর এটাও প্রমাণিত হ’ল যে, সকল ছাহাবী আহলেহাদীছ ছিলেন। স্মর্তব্য যে, এই ইজমার বিরোধিতাকারী ও অস্বীকারকারীরা যেসব দলীল-প্রমাণ পেশ করে থাকেন, তাতে ‘তাক্বলীদ’ শব্দটি নেই।
দ্বিতীয় দলীল : প্রসিদ্ধ উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন তাবেঈ ইমাম শা‘বী (রহঃ) বলেছেন, ما حدثوك هؤلاء عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فخذ به وما قالوه برأيهم فالقه في الحش (স্তূপে) ছুঁড়ে মারো’।[18]
ইবরাহীম নাখঈর সামনে জনৈক ব্যক্তি সাঈদ বিন জুবায়ের (রহঃ)-এর মন্তব্য পেশ করলে তিনি বলেন, ما تصنع بحديث سعيد بن جبير مع قول رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের মোকাবিলায় সাঈদ বিন জুবায়ের-এর বক্তব্য দিয়ে তুমি কি করবে?’[19]
কোন একজন তাবেঈ থেকেও তাক্বলীদ জায়েয বা ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত নয়। এজন্য উক্ত উদ্ধৃতি সমূহ এবং অন্যান্য উক্তি দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয় যে, তাক্বলীদ নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে তাবেঈগণেরও ইজমা রয়েছে। আর এটা একথার সুস্পষ্ট দলীল যে, সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন নির্ভরযোগ্য তাবেঈগণ আহলেহাদীছ ছিলেন।
তৃতীয় দলীল : তাবে তাবেঈ হাকাম বিন উতায়বা বলেন, ليس أحد من الناس إلا وأنت آخذ من قوله أو تارك إلا النبي صلى الله عليه وسلم ‘তুমি প্রত্যেক ব্যক্তির কথাকে গ্রহণ করতে পারো, আবার বর্জনও করতে পারো। কেবল রাসূল (ছাঃ)-এর কথা ব্যতীত’।[20]
তাবে তাবেঈনের কোন একজন নির্ভরযোগ্য তাবে তাবেঈ থেকে তাক্বলীদে শাখছী ও তাক্বলীদে গায়ের শাখছীর কোন প্রমাণ নেই। এজন্য এ বিষয়েও ইজমা রয়েছে যে, সকল নির্ভরযোগ্য ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন তাবে তাবেঈন আহলেহাদীছ ছিলেন।
চতুর্থ দলীল : তাবে তাবেঈনের অনুসারীদের মধ্য হ’তে একটি জামা‘আত তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন। যেমন ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফেঈ (রহঃ) নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন।[21] ইমাম শাফেঈ বলেছেন, لا تقلدوني ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ করো না’।[22] ইমাম আহমাদ বলেছেন,لا تقلد دينك أحدا من هؤلاء ‘তোমার দ্বীনের ব্যাপারে তাদের মধ্য হ’তে কোন একজনেরও তাক্বলীদ করো না’।[23]
একটি ছহীহ হাদীছে আছে যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ (হক্বপন্থীদের প্রকৃত দল) সর্বদাই হক্বের উপরে বিজয়ী থাকবে। এর ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন, ‘অর্থাৎ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল আহলেহাদীছ’।[24]
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ বলেছেন, إذا رأيت الرجل يحب أهل الحديث، ... فإنه على السنة ‘তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে আহলেহাদীছদেরকে ভালোবাসতে দেখ, ... (তখন জানবে যে,) সেই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে আছে’।[25]
ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, لَيْسَ فِى الدُّنْيَا مُبْتَدِعٌ إِلاَّ وَهُوَ يَبْغَضُ أَهْلَ الْحَدِيْثِ- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না’।[26]
প্রমাণিত হ’ল যে, সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য আতবায়ে তাবে তাবেঈন (তাবে তাবেঈগণের অনুসারীগণ) আহলেহাদীছ ছিলেন এবং তাঁরা তাক্বলীদ করতেন না। বরং তাঁরা অন্যদেরকেও তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করতেন।
পঞ্চম দলীল : হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) লিখেছেন,
أَمَّا الْبُخَارِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ فَإِمَامَانِ فِي الْفِقْهِ مِنْ أَهْلِ الْاِجْتِهَادِ. وَأَمَّا مُسْلِمٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَه وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَأَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ وَنَحْوُهُمْ فَهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيثِ. لَيْسُوا مُقَلِّدِينَ لِوَاحِدٍ بِعَيْنِهِ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَلَا هُمْ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْمُجْتَهِدِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ-
‘ইমাম বুখারী ও আবুদাঊদ ফিক্বহের ইমাম ও মুজতাহিদ (মুত্বলাক্ব) ছিলেন। পক্ষান্তরে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, ইবনে খুযায়মাহ, আবু ই‘য়ালা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। আর তারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বও ছিলেন না’।[27]
প্রমাণিত হ’ল যে, সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য মুহাদ্দিছগণ তাক্বলীদ করতেন না। বরং তাঁরা আহলেহাদীছ ছিলেন। বর্তমানে কিছু মানুষ এ দাবী করে যে, যারা মুজতাহিদ নন তাদের উপরে তাক্বলীদ ওয়াজিব। হাফেয ইবনু তায়মিয়ার উপরোল্লিখিত উক্তি দ্বারা তাদের দাবী নাকচ হয়ে যায়। কেননা উল্লিখিত মুহাদ্দিছগণ হাফেয ইবনু তায়মিয়ার দৃষ্টিতে না মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন, আর না তাক্বলীদ করতেন। স্মর্তব্য যে, ঐ সকল উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের মুজতাহিদ না হওয়ার ব্যাপারটি অগ্রহণযোগ্য।[28]
ষষ্ঠ দলীল : হিজরী তৃতীয় শতকের শেষের দিকে মৃত্যুবরণকারী ইমাম ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ আল-কুরতুবী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) তাক্বলীদের প্রতিবাদে ‘আল-ঈযাহ ফির রাদ্দি আলাল মুক্বাল্লিদীন’ (الإيضاح فى الرد على المقلدين) শীর্ষক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।[29]
সপ্তম দলীল : চতুর্থ হিজরী শতকে মৃত্যুবরণকারী সত্যবাদী ইমাম আবু বকর আব্দুল্লাহ বিন আবুদাঊদ আস-সিজিস্তানী (মৃঃ ৩১৬ হিঃ) বলেছেন,
ولا تك من قوم تلهو بدينهم * فتطعن في أهل الحديث وتقدح
‘তুমি ঐ লোকদের দলভুক্ত হয়ো না, যারা স্বীয় দ্বীনকে নিয়ে খেল-তামাশা করে। নতুবা তুমিও আহলেহাদীছদেরকে তিরষ্কার ও দোষারোপ করবে’।[30]
অষ্টম দলীল : ৫ম হিজরী শতকে হাফেয ইবনু হাযম যাহেরী আন্দালুসী দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, ‘তাক্বলীদ হারাম’।[31]
নবম দলীল : হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়াহ ঘোষণা করেছেন, وإنما حدثت هذه البدعة في القرن الرابع المذموم على لسان رسول الله ‘(তাক্বলীদের) এই বিদ‘আত চতুর্থ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর (পবিত্র) যবানে যেই শতক নিন্দিত’।[32]
হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম স্বীয় প্রসিদ্ধ ক্বাছীদাহ ‘নূনিয়াহ’তে বলেছেন,
يا مبغضا أهل الحديث وشاتما * أبشر بعقد ولاية الشيطان
‘হে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ও গালি প্রদানকারী! তুমি শয়তানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপনের সুসংবাদ গ্রহণ কর’।[33]
দশম দলীল : ৫ম হিজরী শতকে মৃত্যুবরণকারী আবু মানছূর আব্দুল ক্বাহের বিন ত্বাহের আত-তামীমী আল-বাগদাদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) স্বীয় গ্রন্থে বলেছেন,فِيْ ثُغُوْرِ الرُّوْمِ وَالْجَزِيْرَةِ وَثُغُوْرِ الشَّامِ وَثُغُوْرِ آذَرْبَيْجَانَ وَبَابِ الْأَبْوَابِ كُلُّهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيْثِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ ‘রোম সীমান্ত, আলজেরিয়া, সিরিয়া, আযারবাইজান এবং বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি এলাকার সকল মুসলিম অধিবাসী আহলে সুন্নাতের মধ্য থেকে আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন’।[34]
উল্লেখিত (ও অন্যান্য) দলীলসমূহ দ্বারা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হ’ল যে, আহলেহাদীছগণ ‘আহলে সুন্নাত’-এর অন্তর্ভুক্ত এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর যুগ থেকে শুরু করে সর্বযুগেই আহলেহাদীছগণ ছিলেন। আল-হামদুলিল্লাহ।
এক্ষণে কতিপয় ইলযামী দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা হ’ল :
প্রমাণ-১ : ‘মুফতী’ রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘কাছাকাছি দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকে হক্বপন্থীদের মাঝে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা সমূহের সমাধানকল্পে সৃষ্ট মতভেদের প্রেক্ষিতে পাঁচটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ চার মাযহাব ও আহলেহাদীছ। তৎকালীন সময় হ’তে অদ্যাবধি উক্ত পাঁচটি তরীকার মধ্যেই হক্ব সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মনে করা হয়’।[35] এই দেওবন্দীর স্বীকারোক্তি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছগণ ১০১ এবং ২০১ হিজরী থেকে পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান রয়েছেন।
প্রমাণ-২ : তাফসীরে হক্কানীর লেখক আব্দুল হক্ব হক্কানী দেহলভী বলেছেন, ‘শাফেঈ, হাম্বলী, মালেকী, হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আহলে সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর আহলেহাদীছগণও আহলে সুন্নাতের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত’।[36] এই গ্রন্থটি কাসেম নানূতুবীর পসন্দনীয়।[37]
প্রমাণ-৩ : উপরোল্লেখিত উদ্ধৃতির আলোকে মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুবী দেওবন্দীও আহলেহাদীছদেরকে আহলে সুন্নাত হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আর আহলে সুন্নাত সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) লিখেছেন, ومن أهل السنة والجماعة مذهب قديم معروف قبل أن يخلق الله أبا حنيفة ومالكا والشافعي وأحمد فإنه مذهب الصحابة মাযহাব বিদ্যমান রয়েছে। আর সেটি হ’ল ছাহাবীগণের মাযহাব’।[38]
এই উদ্ধৃতি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছগণ আহলে সুন্নাত ভুক্ত এবং চার মাযহাবের অস্তিত্ব লাভের পূর্ব থেকে ধরার বুকে বিদ্যমান রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।
প্রমাণ-৪ : ‘মুফতী’ কিফায়াতুল্লাহ দেহলভী দেওবন্দী একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘হ্যাঁ, আহলেহাদীছগণ মুসলমান এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্তর্ভুক্ত। তাদের সাথে বিয়ে-শাদীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া জায়েয। শুধু তাক্বলীদ বর্জন করাতে ইসলামে কোন যায় আসে না। এমনকি তাক্বলীদ বর্জনকারী ব্যক্তি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকেও খারিজ হয়ে যায় না’।[39]
প্রমাণ-৫ : আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘যদিচ এ বিষয়ে ইজমা উল্লেখ করা হয়েছে যে, চার মাযহাবকে বর্জন করে পঞ্চম মাযহাব সৃষ্টি করা জায়েয নয়। অর্থাৎ যে মাসআলাটি চার মাযহাব অনুসারীদের বিরোধী হবে, তার উপরে আমল করা জায়েয নয়। কারণ এই চার মাযহাবের মধ্যেই হক সীমাবদ্ধ ও সীমিত রয়েছে। কিন্তু এর পক্ষেও কোন দলীল নেই। কেননা আহলে যাহের বা যাহেরী মতবাদের লোকজন প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান রয়েছে। আর এটাও নয় যে, তারা প্রত্যেকে প্রবৃত্তিপূজারী এবং উক্ত ঐক্যমত থেকে আলাদা থাকবে। দ্বিতীয়তঃ যদি ইজমা সাব্যস্তও হয়ে যায়, তবুও তাক্বলীদে শাখছীর উপরে তো কখনো ইজমা-ই হয়নি’।[40]
পর্যালোচনার সারসংক্ষেপ : ‘মুফতী’ আব্দুল হাদী ও অন্যান্য মিথ্যুকদের বক্তব্য ‘ইংরেজদের আমলের পূর্বে আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব ছিল না’ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বাতিল। হক্বপন্থী আলেম-ওলামার উদ্ধৃতি এবং তাক্বলীদপন্থীদের স্বীকারোক্তি ও বর্ণনার মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে যে, তাক্বলীদ না করা আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব পুণ্যময় প্রথম হিজরী শতক থেকে শুরু করে প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান আছে। অন্যদিকে দেওবন্দী ও তাক্বলীদপন্থী ফির্কাগুলোর অস্তিত্ব খায়রুল কুরূন-এর বরকতময় যুগ অতিবাহিত হওয়ার পরে বিভিন্ন যুগে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ইংরেজদের আমলে ১৮৬৭ সালে দেওবন্দী মাযহাবের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে।
আশরাফ আলী থানভী দেওবন্দীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, যদি আপনাদের হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহ’লে ইংরেজদের সাথে কেমন আচরণ করবেন? তিনি উত্তর দেন,
محكوم بنا كر ركهيں كيونكہ جب خدا نے حكومت دي تو محكوم ہی بنا كر ركهيں گے مگر ساتھ ہى اسكے نہايت راحت اور آرام سے ركھا جاےٴ گا اس لئے كہ انهوں نے ہميں آرام ٍٍپہونچايا ہے اسلام كى بهى تعليم ہے اور اسلام جيسى تعليم تو دنيا كے كسى مذہب ميں نہيں مل سكتى-
‘প্রজা বানিয়ে রাখব। কেননা যখন আল্লাহ হুকুমত দিবেন তখন তো প্রজা বানিয়েই রাখব। তবে সাথে সাথে তাদেরকে অত্যন্ত আরাম-আয়েশের মধ্যে রাখা হবে। এজন্য যে, তারা (ইংরেজরা) আমাদেরকে শান্তি দিয়েছে। (এটা) ইসলামেরও শিক্ষা। আর পৃথিবীর অন্য কোন ধর্মে ইসলামের মতো শিক্ষা পাওয়া যাবে না’।[41]
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইংরেজরা দেওবন্দীদেরকে অনেক আরাম-আয়েশের মধ্যে রেখেছিল। একজন ইংরেজ যখন দেওবন্দ মাদরাসা পরিদর্শন করেন, তখন এই মাদরাসার ব্যাপারে অত্যন্ত সুধারণা প্রকাশ করে তিনি লিখেন,
يہ مدرسہ خلاف سركار نہيں بلكہ موافق سركار ممد معاون سركار ہے
‘এই মাদরাসাটি সরকার বিরোধী নয়। বরং সরকারের অনুকূলে এবং সরকারের মদদদাতা ও সাহায্যকারী’।[42]
ইংরেজ সরকারের মদদদাতা ও অনুকূল (রক্ষাকারী ও আনুকূল্য প্রদানকারী) এবং সাহায্যকারী মাদরাসা সম্পর্কে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি। যেটি স্বয়ং দেওবন্দীগণ লিখেছেন এবং কেউ এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করেনি।
সমালোচনা-৭ : ‘মুফতী’ আব্দুল হাদী দেওবন্দী ও অন্যরা বলে যে, সকল মুহাদ্দিছই মুক্বাল্লিদ ছিলেন।
জবাব : ইংরেজদের আমলে প্রতিষ্ঠিত দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ক্বাসেম নানূতুবীর জন্মের শত শত বছর পূর্বে হাফেয ইবনে তায়মিয়াহ (রহঃ) মুহাদ্দিছগণের (মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ প্রমুখ) সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাঁরা আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তাঁরা না কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন, আর না তাঁরা মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন’।[43]
শুধু এই একটি উদ্ধৃতির মাধ্যমেও আব্দুল হাদী (এবং তার সকল পৃষ্ঠপোষকের) মিথ্যাবাদী হওয়া প্রমাণিত হয়। স্মর্তব্য যে, নির্ভরযোগ্য ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের মধ্য থেকে কোন একজনেরও মুক্বাল্লিদ হওয়া প্রমাণিত নয়। ‘ত্বাবাকাতে হানাফিয়া’ প্রভৃতি গ্রন্থের উদ্দেশ্য কস্মিনকালেও এটা নয় যে, ঐ সকল গ্রন্থে উল্লিখিত সকল ব্যক্তি মুক্বাল্লিদ ছিলেন। আয়নী হানাফী (!) বলেছেন, ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ অজ্ঞতার পাপ করে। আর তাক্বলীদের কারণে সকল বস্ত্তর বিপদ’।[44]
যায়লাঈ হানাফী (!) বলেছেন, ‘বস্ত্ততঃ মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং অজ্ঞতার অপরাধ করে থাকে’।[45]
সমালোচনা-৮ : ইংরেজ আমলের আগে হিন্দুস্তানে আহলেহাদীছদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
জবাব : হিজরী চতুর্থ শতকের ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আবুবকর আল-বিশারী আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৩৭৫ হিঃ) মানছূরার (সিন্ধু) অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, مذاهبهم : أكثرهم أصحاب حديث ورأيت القاضي أبا محمد المنصوري داوديًا إمامًا في مذهبه وله تدريس وتصانيف، قد صنف كتبًا عدةً حسنةً- চমৎকার গ্রন্থ রচনা করেছেন’।[46]
দাঊদ বিন আলী আয-যাহেরীর মানহাজের উপরে আমলকারীদেরকে যাহেরী বলা হ’ত। তারা তাক্বলীদ থেকে দূরে ছিলেন।
আহমাদ শাহ দুর্রানীকে পরাজিতকারী মুগল বাদশাহ আহমাদ শাহ বিন নাছিরুদ্দীন মুহাম্মাদ শাহ (শাসনকাল : ১১৬১-১১৬৭হিঃ/১৭৪৮-১৭৫৩ খ্রিঃ)-এর আমলে মৃত্যুবরণকারী শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের ইলাহাবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ/১৭৫১ ইং) বলেছেন যে, ‘জমহূর বিদ্বানগণের নিকটে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের তাক্বলীদ করা জায়েয নয়। বরং ইজতিহাদ ওয়াজিব। হিজরী চতুর্থ শতকে তাক্বলীদের বিদ‘আত সৃষ্টি হয়েছে’।[47]
শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের আরো বলেছেন,لكن أحق مذاهب اهل حديث است ‘কিন্তু আহলেহাদীছদের মাযহাব অন্যান্য মাযহাবের চেয়ে বেশী হক্ব-এর উপরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে’।[48]
প্রতীয়মান হ’ল যে, দেওবন্দ ও ব্রেলভী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই হিন্দুস্তানে আহলেহাদীছরা মওজুদ ছিল। এজন্য ‘ইংরেজদের আমলের আগে আহলেহাদীছদের অস্তিতেবর প্রমাণ পাওয়া যায় না’- এমনটা বলা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভ্রান্ত।[49]
সমালোচনা-৯ : আব্দুর রহমান পানিপথী বলেছেন যে, (প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ আলেম) আব্দুল হক্ব বেনারসী (সাইয়েদা) আয়েশা (রাঃ)-কে মুরতাদ বলতেন এবং বলতেন যে, আমাদের চেয়ে ছাহাবীগণের ইলম কম ছিল।[50]
জবাব : আব্দুর রহমান পানিপথী একজন কট্টর ফির্কবাবাজ মুক্বাল্লিদ এবং মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসীর কঠিন বিরোধী ছিলেন। উক্ত পানিপথী উল্লেখিত অভিযোগের কোন সূত্র মাওলানা আব্দুল হক্বের কোন গ্রন্থ থেকে পেশ করেননি। আর না এ ধরনের কোন বক্তব্য বেনারসীর কোন গ্রন্থে আছে। এজন্য আব্দুর রহমান পানিপথী গোঁড়ামি ও বিরোধিতা প্রকাশ করতে গিয়ে মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসী (রহঃ)-এর নামে মিথ্যাচার করেছেন। মুক্বাল্লিদ আব্দুল খালেকও মাওলানা আব্দুল হক্ব-এর বিরোধী গোষ্ঠীর একজন ব্যক্তি ছিলেন।
মিয়াঁ সাইয়েদ নাযীর হুসাইন দেহলভী (রহঃ)-এর শ্বশুর হওয়ার মানে আদৌ এটা নয় যে, আব্দুল খালেক ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন ও সত্যবাদী ছিলেন। বহু দেওবন্দী শ্বশুর রয়েছেন, যাদের জামাই আহলেহাদীছ। এ কথা সাধারণ মানুষ জানে যে, কোন ব্যক্তির স্বীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সূত্রবিহীন ও অপ্রমাণিত বক্তব্য পরিত্যাজ্য হয়।
মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসী সম্পর্কে আবুল হাসান নাদভীর পিতা হাকীম আব্দুল হাই (মুক্বাল্লিদ) লিখেছেন, الشيخ العالم المحدث المعمر... أحد العلماء المشهورين- ‘তিনি শায়খ, আলেম, বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাদ্দিছ ... এবং বিখ্যাত আলেমদের একজন’।[51]
এরপর হাকীম আব্দুল হাই মাওলানা আব্দুল হক্ব-এর বিরুদ্ধে কিছু ঔদ্ধত্যপূর্ণ অসার বাক্য লিপিবদ্ধ করে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয আয-যায়নাবী থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ولم أر بعيني أفضل منه- ‘আমি আমার দু’চোখে তাঁর (আব্দুল হক্ব বেনারসী) চেয়ে উত্তম আর কাউকে দেখিনি’।[52]
‘নায়লুল আওত্বার’ গ্রন্থের লেখক মুহাম্মাদ বিন আলী আশ-শাওকানী স্বীয় ছাত্র আব্দুল হক্ব বেনারসী সম্পর্কে লিখেছেন, الشيخ العلامة... كثر الله فوائده بمنه وكرمه ونفع بمعارفه- ‘শায়খ, আল্লামা... আল্লাহ স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে তার কল্যাণকারিতা বৃদ্ধি করে দিন এবং তার জ্ঞান দ্বারা উপকৃত করুন’।[53]
সাইয়েদ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-আমীর আছ-ছান‘আনী লিখেছেন,الولد العلامة زينة أهل الاسةقامة ذو الطريقة الحميدة والخصال الشريفة المعمورة- ‘পুত্র, আল্লামা, অবিচল বান্দাদের সৌন্দর্য, প্রশংসনীয় পথের অনুসারী এবং উত্তম চরিত্রের অধিকারী’।[54]
আলেমদের এসব প্রশংসাসূচক বক্তব্যের পরে মাওলানা আব্দুল হক্ব বেনারসী (মৃঃ ১২৭৬ হিঃ/১৮৬০ খ্রিঃ)-এর বিরুদ্ধে আব্দুর রহমান পানিপথী, আব্দুল খালেক এবং তাক্বলীদপন্থীদের মিথ্যা প্রচারণার কি মূল্য রয়েছে?
স্মর্তব্য যে, ‘মিনা’-তে (মক্কা মুকাররমা) মৃত্যুবরণকারী মাওলানা বেনারসীর প্রতি তাক্বলীদপন্থীদের এই শত্রুতা ও ক্রোধ রয়েছে যে, তিনি তাক্বলীদের খন্ডনে ‘আদ-দুরারুল ফারীদ ফিল মানঈ আনিত তাক্বলীদ’ (الدرر الفريد فى المنع عن التقليد) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এবং তিনি তাক্বলীদের কট্টর বিরোধী ছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন!
সমালোচনা-১০ : আহলেহাদীছরা ইংরেজদেরকে সহায়তা করেছে।
জবাব : ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যখন মুসলমান ও কাফেররা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিল, তখন আলেমদেরকে জিহাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। আলেমরা জিহাদের ব্যাপারে ফৎওয়া দিয়েছিলেন যে, در صورت مرقومہ فرض عين ہے ‘বর্ণিত অবস্থায় জিহাদ ফরযে আইন’। এই ফৎওয়ার উপরে একজন প্রসিদ্ধ আহলেহাদীছ আলেম সাইয়েদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিছ দেহলভীর (সাবেক হানাফী এবং তাহকীকের মাধ্যমে আহলেহাদীছ) স্বাক্ষর দিবালোকের ন্যায় চমকাচ্ছে।[55]
এই ফৎওয়া প্রদানের পর যখন ইংরেজরা হিন্দুস্তান দখল করে নিয়েছিল, তখন সাইয়েদ নাযীর হুসাইনকে গ্রেফতার করে রাওয়ালপিন্ডি জেলে এক বছর যাবৎ বন্দী করে রেখেছিল। অন্যদিকে রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী ও মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুবী প্রমুখ সম্পর্কে আশিক ইলাহী মিরাঠী দেওবন্দী লিখেছেন, جيسا كہ آپ حضرات اپنى مہربان سركار كے دلى خيرخواه تهے تازيست خير خواه ہی ثابت رہے- ‘যেমনভাবে তাঁরা তাদের মহানুভব সরকারের (ইংরেজ সরকার) আন্তরিক হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তেমনিভাবে সারাজীবন তারা (ইংরেজদের) হিতাকাঙ্ক্ষী হিসাবেই থাকেন’।[56]
সারাজীবন ইংরেজ সরকারের ‘হিতাকাঙ্ক্ষী’ হিসাবে প্রমাণিত ব্যক্তিদের বুযর্গ ফযলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদী লিখেছেন, لڑنے كا كيا فائده خضر كو تو ميں انگريزوں كى صف ميں پارہا ہوں- ‘লড়াই করে কি লাভ? খিযিরকে তো আমি ইংরেজদের কাতারে দেখতে পাচ্ছি’।[57]
এ কথা অত্যন্ত বিস্ময়কর যে, খিযির (আঃ) (তাঁর মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে) কিভাবে ইংরেজ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন? দেওবন্দীদের খিযির (আঃ)-কে ইংরেজ সৈন্যদের মধ্যে শামিল করা, ইতিহাসের অত্যন্ত বড় মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজি।
সতর্কীকরণ : ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে ফৎওয়ায় একজন দেওবন্দীরও স্বাক্ষর নেই।
& & &
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন, صاحب الحديث عندنا من يستعمل الحديث ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি, যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[58]
[চলবে]
[1]. [এর অর্থ ঐসকল কর্ম যা কল্যাণ আনয়ন করে ও ক্ষতি প্রতিরোধ করে এবং যার আদেশে বা নিষেধে শরী‘আতে কোন দলীল পাওয়া যায় না। যেমন আবুবকর (রাঃ) ও ওছমান (রাঃ)-এর সময়ে কুরআন জমা করা এবং কুরায়শী ক্বিরাআত ব্যতীত কুরআনের অন্যান্য কপি পুড়িয়ে ফেলা, মসজিদের ক্বিবলা চিহ্নিত করার জন্য পরবর্তীতে মেহরাব নির্মাণ করা, মসজিদে মিনার নির্মাণ করা, মাইক লাগানো ইত্যাদি (আবুবকর আল-জাযায়েরী, আল-ইনছাফ (মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, তাবি), পৃঃ ২২-২৫।-স.স.]
[2]. হাকেম, আল-মুস্তাদরাক, ১/১১৬, হা/৩৯৯, সনদ ছহীহ।
[3]. দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’, ১ম সংখ্যা, পৃঃ ৪, জুন ২০০৪ খ্রিঃ। [এখানে উম্মত বলতে ছাহাবায়ে কেরামকে বুঝানো হয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলেন, من ادعى الاجماع فهو كاذب ‘যে ব্যক্তি (ছাহাবীগণের পরে) ইজমা-এর দাবী করে সে মিথ্যাবাদী’ (ইলামুল মুওয়াকক্বেঈন ১/২৪)।-স.স.]
[4]. ইবরাউ আহলিল হাদীছ ওয়াল কুরআন, পৃঃ ৩২।
[5]. ফাতাওয়া আহলেহাদীছ, ১/১১১।
[6]. ইমাম ওয়াকী, কিতাবুয যুহদ, ১/৩০০, হা/৭১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[7]. কিতাবুল উম্ম, মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[8]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ২/২০৮; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩২।
[9]. দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’ (হাযরো), সংখ্যা ২৩, পৃঃ ৩৬, ৪০।
[10]. তাহকীক মাসআলায়ে তাক্বলীদ, পৃঃ ৬।
[11]. দেখুন : মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া ছিদ্দীক্বী দেওবন্দী, ফাযলুল বারী, ১/২৩।
[12]. দেখুন : নুযুলুল আবরার, পৃঃ ৭, প্রকাশক : লাহোরের দেওবন্দীগণ।
[13]. মাআছিরে ছিদ্দীক্বী, ৪/১; হাদীছ আওর আহলেহাদীছ, পৃঃ ৮৪।
[14]. দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২৯, পৃঃ ১৩-৩৩।
[15]. নফস কে পূজারী, পৃঃ ১।
[16]. ইমাম ওয়াকী,‘ কিতাবুয যুহদ, ১/৩০০, হা/৭১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৬।
[17]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ২/১০, সনদ ছহীহ। আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫।
[18]. দারেমী ১/৬৭, হা/২০৬, সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৭।
[19]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম, ৬/২৯৩, সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[20]. আল-ইহকাম, ৬/২৯৩, সনদ ছহীহ।
[21]. কিতাবুল উম্ম, মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১।
[22]. ইবনু আবী হাতিম, আদাবুশ শাফেঈ ওয়া মানাকিবুহু, পৃঃ ৫১, সনদ হাসান।
[23]. মাসাইলু আবুদাঊদ, পৃঃ ২৭৭।
[24]. খতীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ।
[25]. ঐ, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, পৃঃ ১৩৪, সনদ ছহীহ।
[26]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ। আরো সূত্রের জন্য দেখুন : মাসিক ‘আল-হাদীছ’, সংখ্যা ২৯, পৃঃ ১৩-৩৩।
[27]. মাজমূঊ ফাতাওয়া, ২০/৪০।
[28]. দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৫১।
[29]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৩/৩২৯।
[30]. আজুর্রী, কিতাবুশ শরী‘আহ, পৃঃ ৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[31]. আন-নুবযাতুল কাফিয়াহ ফী আহকামি উছূলিদ্দীন, পৃঃ ৭০।
[32]. ই‘লামুল মুয়াক্কি‘ঈন, ২/২০৮।
[33]. আল-কাফিয়াতুশ শাফিয়াহ, পৃঃ ১৯৯।
[34]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩১৭।
[35]. আহসানুল ফাতাওয়া, ১/৩১৬; মওদূদী ছাহেব আওর তাখরীবে ইসলাম, পৃঃ ২০।
[36]. হক্কানী আক্বায়েদে ইসলাম, পৃঃ ৩।
[37]. দেখুন : ঐ, পৃঃ ২৬৪।
[38]. মিনহাজুস সুন্নাহ আন-নাবাবিইয়াহ (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ), ১/২৫৬।
[39]. কিফায়াতুল মুফতী, ১/৩২৫, উত্তর নং ৩৭০।
[40]. তাযকিরাতুর রশীদ, ১/১৩১।
[41]. মালফূযাতে হাকীমুল উম্মাত, ৬/৫৫, বচন নং ১০৭।
[42]. মুহাম্মাদ আইয়ূব কাদেরী, মুহাম্মাদ আহসান নানূতুবী, পৃঃ ২১৭; ফাখরুল ওলামা, পৃঃ ৬০।
[43]. মাজমূঊ ফাতাওয়া ২০/৪০।
[44]. আল-বিনায়া ফী শারহিল হেদায়া, ১/৩১৭।
[45]. নাছবুর রায়াহ, ১/২১৯। আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৯, ৪৬।
[46]. আহসানুত তাক্বাসীম ফী মা‘রিফাতিল আক্বালীম, পৃঃ ৪৮১।
[47]. রিসালাহ নাজাতিয়া (উর্দূ অনুবাদ), পৃঃ ৪১, ৪২।
[48]. ঐ, পৃঃ ৪১।
[49]. আরো দেখুন : ৬ নং সমালোচনার জবাব।
[50]. দেখুন : পানিপথী রচিত গ্রন্থ ‘কাশফুল হিজাব’, পৃঃ ৪৬। আব্দুল খালেক্ব ‘তামবীহুয যল্লীন’ গ্রন্থের ১৩ পৃষ্ঠায় আব্দুল হক্ব বেনারসীর সমালোচনা করেছেন।
[51]. নুযহাতুল খাওয়াত্বির, ৭/২৬৬।
[52]. ঐ, ৭/২৬৭।
[53]. ঐ, ৭/২৬৮।
[54]. ঐ, ৭/২৭০।
[55]. দেখুন : মুহাম্মাদ মিয়াঁ দেওবন্দী রচিত ‘ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’ ৪/১৭৯; জানবায মির্যা দেওবন্দী প্রণীত ‘আংরেজ কে বাগী মুসলমান’, পৃঃ ২৯৩।
[56]. তাযকিরাতুর রশীদ, ১/৭৯।
[57]. হাশিয়া সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/১০৩; ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, ৪/২৮০।
[58]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘, হা/১৮৩, ১/১৪৪, সনদ ছহীহ; ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃঃ ২০৮, সনদ ছহীহ।
ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়া ও আহলেহাদীছ
[ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়াসহ কিছু লোক ও খারেজীরা এই দাবী করতে থাকে যে, আমাদের নাম স্রে্রফ মুসলিম বা মুসলিমীন এবং অন্যান্য সকল নাম (চাই গুণবাচক নাম হোক বা উপাধি) রাখা নাজায়েয অথবা উত্তম নয়। আমাদের এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে সালাফে ছালেহীনের বুঝের আলোকে এ সকল লোকের দলীলসমূহের যথার্থ জবাব রয়েছে। আল-হামদুলিল্লাহ।]
করাচীর নতুন গজিয়ে উঠা একটি ফিরক্বা অনেক দিন যাবৎ আহলুল হাদীছ ওয়াল আছার-এর বিরুদ্ধে ‘তাকফীর’ (কাফের আখ্যায়িত করা), ‘তাবদী‘ (বিদ‘আতী আখ্যা দান), ভৎর্সনা ও তিরস্কারের বাজার গরম করে রেখেছে। কতিপয় অবুঝ লোকের উক্ত ফিরক্বার প্রতারণার জালে আটকা পড়ার আশঙ্কা থাকার কারণে এই প্রবন্ধটিকে বিস্তারিতভাবে দলীল সহ লেখা হয়েছে। যাতে ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার বাতিল দাবীসমূহ এবং অপবাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া যায়। আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে দ্বীন ইসলামের উপরে অটল রাখেন এবং গোমরাহীর পথসমূহের শয়তানী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত দাঈদের প্রতারণা থেকে রক্ষা করেন। -আমীন!
আহলুল হাদীছ : মুহাদ্দিছদের জামা‘আতকে আহলুল হাদীছ বলা হয়। যেভাবে মুফাসসিরদের জামা‘আতকে আহলুত তাফসীর এবং ঐতিহাসিকদের জামা‘আতকে আহলুত তারীখ বলা হয়।
দলীল-১ : ছহীহ বুখারীর রচয়িতা ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘জুযউল ক্বিরাআত খালফাল ইমাম’ গ্রন্থের ১৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ولا يحتج أهل الحديث بمثله ‘এরূপ বর্ণনাকারী দ্বারা আহলুল হাদীছগণ দলীল গ্রহণ করেন না’।[1] বরং ইমাম বুখারী (রহঃ) আহলেহাদীছদেরকে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ (জান্নাতী এবং হক্বপন্থী জামা‘আত) আখ্যা দিয়েছেন।[2]
দলীল-২ : জামে‘ তিরমিযীর লেখক ইমাম তিরমিযী (রহঃ) স্বীয় ‘আল-জামে’ গ্রন্থে (১/১৬ পৃঃ) বলেছেন, وَابْنُ لَهِيعَةَ ضَعِيفٌ عِنْدَ أَهْلِ الْحَدِيثِ ‘ইবনু লাহী‘আহ আহলুল হাদীছদের নিকটে যঈফ’।[3]
সতর্কীকরণ : যেহেতু আব্দুল্লাহ ইবনু লাহী‘আহ ইখতিলাতের কারণে যঈফ ছিলেন এবং মুদাল্লিসও ছিলেন, সেহেতু তার বর্ণিত হাদীছ দু’টি শর্তের ভিত্তিতে হাসান লি-যাতিহি হয় :
১. বর্ণনাটি ইখতিলাতের[4] পূর্বের হওয়া।[5]
২. বর্ণনায় ‘সামা‘[6] অর্থাৎ ‘আমি শুনেছি’ কথাটি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা।[7]
দলীল-৩ : আজ পর্যন্ত কোন মুসলিম আলেম একথা অস্বীকার করেননি যে, ‘আহলুল হাদীছ’ দ্বারা মুহাদ্দিছদের জামা‘আত উদ্দেশ্য। এজন্য এই গুণবাচক নাম ও নসব জায়েয হওয়ার ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।
আহলেহাদীছ উপাধি ও গুণবাচক নামটি বিশুদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে ৫০টি উদ্ধৃতির জন্য দেখুন আমার গ্রন্থ : ‘তাহক্বীক্বী, ইছলাহী আওর ইলমী মাক্বালাত’ (১/১৬১-১৭৪)।[8]
দলীল-৪ : ইমাম মুসলিমও মুহাদ্দিছগণকে আহলুল হাদীছ বলেছেন।[9]
ইমাম মুসলিম (রহঃ) নিজেও আহলেহাদীছ ছিলেন। যেমনটি হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,
ونحن لا نعني بأهل الحديث المقتصرين على سماعه أو كتابته أو روايته بل نعني بهم : كل من كان أحق بحفظه ومعرفته وفهمه ظاهراً وباطناً واتباعه باطناً وظاهراً وكذلك أهل القرآن-
‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার। অনুরূপভাবে আহলে কুরআন দ্বারাও এরাই উদ্দেশ্য’।[10]
হাফেয ইবনু তায়মিয়ার নিকটে ইমাম মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু খুযায়মাহ এবং আবূ ই‘য়ালা প্রমুখ সকলেই আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং তারা কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।[11]
আহলুল হাদীছ-এর ফযীলত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ ظَاهِرُونَ ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা বিজয়ী থাকবে। অবশেষে তাদের নিকটে আল্লাহর ফায়ছালা (কিয়ামত) এসে যাবে এমতাবস্থায় যে, তারা বিজয়ী থাকবে’।[12]
ছাওবান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত একটি হাদীছে আছে যে, ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হকের উপরে বিজয়ী থাকবে’।[13]
স্মর্তব্য যে, এই উচ্চমর্যাদাও দলীলের মাধ্যমে বর্ণিত হবে। যেমন-
১. আহমাদ বিন সিনান (মৃঃ ২৫৯ হিঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেছেন, هم أهل العلم وأصحاب الآثار ‘তাঁরা হ’লেন আহলুল ইলম (আলেমগণ) এবং আছহাবুল আছার (আহলেহাদীছগণ)’।[14]
২. আলী ইবনুল মাদীনী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) বলেন, هُمْ أَصْحَابُ الْحَدِيثِ ‘তারা হ’লেন আছহাবুল হাদীছ’।[15] অন্য বর্ণনায় এসেছে, هُمْ أَهْلُ الْحَدِيثِ ‘তারা হ’লেন আহলুল হাদীছ’।[16] প্রমাণিত হ’ল যে, আছহাবুল হাদীছ এবং আহলেহাদীছ একই জামা‘আতের দু’টি নাম।
৩. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ) উক্ত হাদীছের ব্যাখ্যায় বলেন,إن لم تكن هذه الطائفة المنصورة أصحاب الحديث فلا أدري من هم؟ ‘সাহায্যপ্রাপ্ত এই দলটি যদি আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছ) না হয়, তবে আমি জানি না তারা কারা’?[17]
তিনি বলেন, صاحب الحديث عندنا من يستعمل الحديث ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি, যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[18]
সতর্কীকরণ : উপরের উদ্ধৃতিতে ‘ছাহেবুল হাদীছ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল আহলুল হাদীছ।
৪. হাফছ বিন গিয়াছ (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) আছহাবুল হাদীছ সম্পর্কে বলেছেন, هم خير أهل الدنيا ‘তারা হ’লেন (আহলেহাদীছগণ) দুনিয়ায় সবার চাইতে শ্রেষ্ঠ’।[19]
৫. হাকেমও (মৃঃ ৪০৫ হিঃ) হাফছ বিন গিয়াছ (রহঃ)-এর বক্তব্যকে সত্যায়ন করেছেন এবং বলেছেন, إن أصحاب الحديث خير الناس ‘নিশ্চয়ই আছহাবুল হাদীছগণ (মুহাদ্দিছগণ) মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম’।[20]
উক্ত আইম্মায়ে মুসলিমীন-এর সুস্পষ্ট বক্তব্য দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, ত্বায়েফাহ মানছূরাহ সম্পর্কিত হাদীছের ব্যাখ্যা হ’ল আছহাবুল হাদীছ, আহলুল ইলম (আলেমগণ), আহলেহাদীছ (মুহাদ্দিছগণ)। আর এর উপরেই ইজমা রয়েছে।[21]
আহলুল হাদীছদের দুশমন : আহলুল হাদীছ-এর শত্রুরা তাঁদের উপরে নানাবিধ মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে থাকে।
এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কেই ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, ليس في الدنيا مبتدع إلا وهو يبغض أهل الحديث وإذا ابتدع الرجل نزع حلاوة الحديث من قلبه- ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। যখন কোন ব্যক্তি বিদ‘আত করে, তখন তার অন্তর থেকে হাদীছের স্বাদ ছিনিয়ে নেওয়া হয়’।[22]
আহলুল হাদীছদের সাথে শত্রুতার পরিণতি : মুসলমানদের মধ্যে আহলেহাদীছগণ অত্যন্ত উচ্চমর্যাদার অধিকারী এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই আল্লাহর ওলী।
আল্লাহর ওলীদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, مَنْ عَادَى لِى وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ ‘যে ব্যক্তি আমার কোন ওলীর সাথে শত্রুতা পোষণ করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি’।[23]
চিন্তা করুন! কত কঠিন ধমকি। এক্ষণে যে ব্যক্তি ঐসকল আল্লাহর ওলীকে কাফের বলে, তার পরিণাম কি হবে?
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-কে কাফের আখ্যা দান : তাক্বরীবুত তাহযীব, তাহযীবুত তাহযীব, আল-ইছাবাহ, লিসানুল মীযান, তা‘জীলুল মানফা‘আহ, আদ-দেরায়াহ এবং আত-তালখীছুল হাবীর প্রভৃতি উপকারী গ্রন্থসমূহের লেখক, নির্ভরযোগ্য ইমাম, সর্বশেষ হাফেয, ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ)-এর ন্যায়পরায়ণতা ও উচ্চমর্যাদার ব্যাপারে মুহাদ্দিছগণের ইজমা রয়েছে এবং তাঁর গ্রন্থাবলী দ্বারা ধারাবাহিকভাবে উপকার গ্রহণ করা জারী রয়েছে।
ফিরক্বা মাসঊদিয়ার জন্ম :
কয়েক বছর আগে করাচীতে ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়াহ নামে একটি ফিরক্বার জন্ম হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাতা হ’লেন মাসঊদ আহমাদ বিএসসি ছাহেব। এই ফিরক্বাটি নিজের নাম ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ রেখে অনৈসলামী এবং তাগূত্বী সরকারের নিকট থেকে রেজিস্ট্রেশন করে নিয়েছে। মাসঊদ ছাহেব একটি পুস্তিকা রচনা করেছেন। যার নাম রেখেছেন ‘মাযাহিবে খামসাহ’ বা পঞ্চ মাযহাব (অর্থাৎ আহলেহাদীছ, হানাফী, শাফেঈ, মালেকী, হাম্বলী) আওর দ্বীন ইসলাম’। উক্ত পুস্তিকায় ছয়টি ভাগ রয়েছে। ১. আহলুল হাদীছ ২. হানাফী ৩. শাফেঈ ৪. মালেকী ৫. হাম্বলী এবং ৬. দ্বীন ইসলাম।
এর উদ্দেশ্য হ’ল এই যে, মাসঊদ ছাহেবের নিকটে আহলেহাদীছ ও অন্যরা দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। মাসঊদ ছাহেব আহলেহাদীছদের ভাগে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ)-কে তাঁর ফাতহুল বারী সহ এনেছেন (পৃঃ ২৯ দ্রঃ)।
প্রতীয়মান হ’ল যে, মাসঊদ ছাহেবের নিকটে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) দ্বীন ইসলাম থেকে খারিজ। (আস্তাগফিরুল্লাহ)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَيُّمَا رَجُلٍ مُسْلِمٍ أَكْفَرَ رَجُلاً مُسْلِمًا فَإِنْ كَانَ كَافِرًا وَإِلاَّ كَانَ هُوَ الْكَافِرَ ‘যে মুসলিম অন্য মুসলিমকে কাফের বলল, যদি সে কাফের হয় (তবে ঠিক আছে)। অন্যথায় এরূপ ব্যক্তি নিজেই কাফের’।[24]
ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার মুসলিম দাবী : মাসঊদ ছাহেব এর উপরে জোর দিয়েছেন যে, আমাদের স্রেফ একটি নাম রয়েছে অর্থাৎ মুসলিম। এ নামটি আল্লাহর রাখা। (এটা) ফিরক্বাবাজি নাম নয়’।[25]
সতর্কীকরণ : আমাদের জানা মতে, মাসঊদ ছাহেবের পূর্বে মুসলিম উম্মাহর (খায়রুল কুরূনের যুগ হোক, হাদীছ সংকলনের যুগ হোক কিংবা হাদীছ ব্যাখার যুগ হোক) কোন আলেম এ দাবী করেননি যে, ‘আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম’। যদি কারো কাছে মাসঊদ ছাহেবের উল্লিখিত দাবীর ঘোষণা কোন আলেমের পক্ষ থেকে সাব্যস্ত হয়, তবে তিনি যেন দলীল পেশ করেন।
মাসঊদ ছাহেব স্বীয় মনগড়া দাবীর ‘দলীল’ পেশ করেন, هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِين ‘তিনি তোমাদের নাম রেখেছেন ‘মুসলিম’।[26]
জনাব মুহতারাম আবূ জাবের আব্দুল্লাহ দামানভী ছাহেব বলেছেন, ‘এই আয়াত দ্বারা এটা প্রতীয়মান হল যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন’। কিন্তু এই আয়াতের কোথাও এ কথার উল্লেখ নেই যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন। অন্য কথায় মুসলিম ছাড়া অন্য নাম রাখা নিষিদ্ধ। এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারে না যে, মুসলিমই আমাদের সত্তাগত নাম এবং দুনিয়াতে বর্তমানে আমরা এই নামেই পরিচিত। চৌদ্দশ বছর যাবৎ পৃথিবী আমাদের এ নাম সম্পর্কে অবগত আছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত আমরা সেই নামেই পরিচিত হ’তে থাকব। কিন্তু এই নামটি ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা আমাদের আরো অনেক নাম রেখেছেন। যেগুলিকে অস্বীকার করা যায় না’।
মুহতারাম দামানভী ছাহেবের সত্যায়ন : মুহতারাম দামানভী ছাহেব হাফিযাহুল্লাহর দাবীর সত্যায়নে আমরা কুরআন ও হাদীছ থেকে আরো কিছু নাম ও উপাধি পেশ করছি :
১. আল-মুমিন বা আল-মুমিনূন : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلَا تَقُولُوا لِمَنْ أَلْقَى إِلَيْكُمُ السَّلَامَ لَسْتَ مُؤْمِنًا تَبْتَغُونَ عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ‘যে তোমাদের সালাম করে তাকে বলো না যে তুমি মুমিন নও (অর্থাৎ কারো অন্তর ফেড়ে দেখার চেষ্টা করো না)। তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদ অনুসন্ধান কর’ (নিসা ৪/৯৪)। তিনি আরো বলেছেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০) এবং বলেছেন, قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ ‘নিশ্চয়ই ঐসব মুমিন সফলকাম’ (মুমিনূন ২৩/১)।
২. হিযবুল্লাহ : আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, أَلَا إِنَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْمُفْلِحُونَ ‘জেনে রাখ যে, অবশ্যই হিযবুল্লাহ সফলকাম হবে’ (মুজাদালাহ ৫৮/২২)।
সতর্কীকরণ : হিযবুল্লাহর (আল্লাহর দল) বিপরীতে হিযবুশ শয়তান (শয়তানের দল) রয়েছে এবং হিযবুশ শয়তান বা শয়তানের অনুসারীরাই প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে (মুজাদালাহ ৫৮/১৯)।
৩. আউলিয়াউল্লাহ : আল্লাহ বলেন, أَلَا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ ‘মনে রেখ আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (ইউনুস ১০/৬২)। আউলিয়াউল্লাহর (আল্লাহর বন্ধুরা) বিপরীতে আউলিয়াউশ শয়তান (শয়তানের বন্ধুরা) রয়েছে।
এগুলি ছাড়া নিম্নোক্ত নামগুলিও কুরআন মাজীদ দ্বারা সাব্যস্ত রয়েছে :
১. আল-মুহাজিরীন (তাওবাহ ৯/১০০) ২. আল-আনছার (ঐ) ৩. আস-সাবিকূনাল আউয়ালূন (ঐ) ৪. রববানিইয়ীন (আলে ইমরান ৩/৭৯) ৫. আল-ফুক্বারা (বাক্বারাহ ২/২৭৩) ৬. আছ-ছালেহীন (নিসা ৪/৬৯) ৭. আশ-শুহাদা (ঐ) ৮. আছ-ছিদ্দীক্বীন প্রভৃতি (ঐ)।
ছহীহ হাদীছসমূহেও মুসলমানদের কতিপয় নামের উল্লেখ রয়েছে। যেমন : ১. উম্মাতু মুহাম্মাদ (ছাঃ)।[27] ২. আল-গুরাবা।[28] ৩. ত্বায়েফাহ।[29] ৪. হাওয়ারীইঊন।[30] ৫. আছহাব।[31] ৬. আল-খলীফাহ।[32] ৭. আহলুল কুরআন।[33] ৮. আহলুল্লাহ।[34]
উক্ত দলীলসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মুসলমানদের আরও অনেক (গুণবাচক) নাম রয়েছে। যেগুলি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) রেখেছেন। এজন্য ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার প্রতিষ্ঠাতার এ দাবী ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের স্রেফ একটি নাম ‘মুসলিম’ রেখেছেন। যদি তিনি বলেন যে, এগুলি গুণবাচক নাম। তবে আরয এই যে, গুণবাচক নামও নাম-ই হয়ে থাকে।
দলীল-১ : আল্লাহ তা‘আলার যাতী বা সত্তাগত নাম ‘আল্লাহ’ এবং তাঁর অসংখ্য গুণবাচক নাম রয়েছে। যেমন :
(১) রব (ফাতিহা ১/১)। (২) আর-রহমান (ঐ)। (৩) আর-রহীম (ঐ)। (৪) ইলাহ (নাস ১৪/৩)। (৫) আল-আলীম (বাক্বারাহ ২/১৩৭)। (৬) আল-ক্বাদীর (রূম ৩০/৫৪)। (৭) আল-মালিক (হাশর ৫৯/২৩)। (৮) আল-কুদ্দূস (ঐ) ইত্যাদি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا ‘আর আল্লাহর জন্য রয়েছে সুন্দর নাম সমূহ। সে নামেই তোমরা তাঁকে ডাক’ (আ‘রাফ ৭/১৮০)।
তিনি আরো বলেছেন, قُلِ ادْعُوا اللهَ أَوِ ادْعُوا الرَّحْمَنَ أَيًّا مَا تَدْعُوا فَلَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى ‘তুমি বল, তোমরা ‘আল্লাহ’ নামে ডাক বা ‘রহমান’ নামে ডাক, তোমরা যে নামেই ডাকো না কেন, সকল সুন্দর নাম তো কেবল তাঁরই জন্য’ (বনু ইসরাঈল ১৭/১১০)। আল্লাহ তা‘আলার উক্ত গুণবাচক নাম সমূহকেও ‘নাম’-ই বলা হয়েছে।
দলীল-২ : মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সত্তাগত নাম মুহাম্মাদ এবং আহমাদও তাঁর সত্তাগত নাম। কুরআনে বলা হয়েছে, اسْمُهُ أَحْمَدُ ‘তাঁর নাম আহমাদ’ (ছফ্ফ ৬১/৬)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, أَنَا مُحَمَّدٌ وَأَحْمَدُ وَالْمُقَفِّى وَالْحَاشِرُ وَنَبِىُّ التَّوْبَةِ وَنَبِىُّ الرَّحْمَةِ ‘আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আহমাদ (অত্যধিক প্রশংসিত), মুক্বাফফী (শেষ নবী), হাশের (একত্রিতকারী), নবীয়ে তওবাহ ও নবীয়ে রহমত’।[35]
বাগাবীর শারহুস সুন্নাহ-তে আছে যে, নবী (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ لِى أَسْمَاءً أَنَا أَحْمَدُ وَأَنَا مُحَمَّدٌ، وَأَنَا الْمَاحِى الَّذِى يَمْحُو اللهُ بِهِ الْكُفْرَ، وَأَنَا الْحَاشِرُ الَّذِى يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى قَدَمِى، وَأَنَا الْعَاقِبُ ‘আমার কিছু নাম রয়েছে। আমি আহমাদ, আমি মুহাম্মাদ, আমি আল-মাহী, যার দ্বারা আল্লাহ কুফরকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি আল-হাশের। আমার পদতলে লোকদেরকে একত্রিত করা হবে এবং আমি আক্বিব (সর্বশেষ নবী)। ইমাম বাগাবী বলেন, ‘এ হাদীছের বিশুদ্ধতায় সবাই একমত। হাদীছটি ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেছেন’।[36]
এই হাদীছগুলি দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, সাইয়েদুনা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আরোও অনেক নাম রয়েছে। যেমন : আহমাদ, আল-মাহী, আল-হাশের, আল-আক্বিব, আল-মুক্বাফফী, নবীয়ে তওবাহ এবং নবীয়ে রহমত ইত্যাদি।
কুরআন ও হাদীছের উক্ত দলীলসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, গুণবাচক নামও নাম-ই হয়ে থাকে।
ছাহাবীগণ এবং মুসলিমীন :
১. হুযায়ফা (রাঃ)-এর সামনে একজন ব্যক্তি মুসলমানদেরকে ‘আল-মুছাল্লূন’ (اَلْمُصَلُّونَ) বা মুছল্লীগণ বলেছিলেন। হুযায়ফা (রাঃ) এর প্রতিবাদ করেননি; বরং তাকে অনেক ভালো পরামর্শও দিয়েছিলেন।[37]
২. ওমর (রাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ ‘হে কুরাইশদের দল’।[38]
৩. ওমর (রাঃ) বলেন, يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ ‘হে আনছারের দল’।[39]
৪. আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) ও অন্য খলীফাগণকে ছাহাবীগণ ‘আমীরুল মুমিনীন’ (أمير المؤمنين) বা মুমিনদের নেতা বলতেন। এ বিষয়টি মুতাওয়াতির বা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত।
এগুলি ছাড়া আরো অনেক নামও ছাহাবীগণ থেকে প্রমাণিত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের সবার উপরে সন্তুষ্ট হোন।
আহলুস সুন্নাহ : মুসলিমীন, মুহাদ্দিছীন এবং মুমিনীনকে ‘আহলুস সুন্নাহ’ (অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসারী)ও বলা হয়েছে।
দলীল-১ : তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (মৃঃ ১১০ হিঃ) বলেছেন,فَيُنْظَرُ إِلَى أَهْلِ السُّنَّةِ فَيُؤْخَذُ حَدِيْثُهُمْ ‘সুতরাং আহলে সুন্নাতের প্রতি লক্ষ্য করা হ’ত। অতঃপর তাদের হাদীছ গ্রহণ করা হ’ত’।[40]
সারমর্ম এই যে, ইবনু সীরীন (রহঃ) মুসলমানদের জন্য ‘আহলুস সুন্নাহ’ নামটি ব্যবহার করেছেন।
সতর্কীকরণ : এই নামটি ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার নিকটে অপ্রমাণিত, বিদ‘আত এবং নতুন শরী‘আত তৈরীর শামিল। এজন্য তাদের নিকটে ইবনু সীরীন (রহঃ)-যার ন্যায়পরায়ণতার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে, তিনি ইসলাম থেকে খারিজ এবং আহলুস সুন্নাহ ফিরক্বার একজন ব্যক্তি বলে গণ্য হবেন (নাঊযুবিল্লাহ)।
এবার লক্ষ্য করুন! তাবেঈ ইবনু সীরীন (রহঃ) (যিনি অসংখ্য ছাহাবীর শিষ্য এবং ছহীহায়েনের অন্যতম প্রধান রাবী) সম্পর্কে কখন ফৎওয়া দেয়া হচ্ছে?!
আহলুস সুন্নাহ বা এ জাতীয় শব্দ নিম্নোক্ত আইম্মায়ে মুসলিমীনও ব্যবহার করেছেন :
১. আইয়ূব আস-সাখতিয়ানী (মৃঃ ১৩১ হিঃ)।[41]
২. যায়েদাহ বিন কুদামাহ।[42] ৩. আহমাদ বিন হাম্বল।[43]
৪. বুখারী।[44] ৫. ইয়াহইয়া ইবনু মা‘ঈন।[45]
৬. আবূ ওবায়েদ ক্বাসেম বিন সাল্লাম।[46]
৭. মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী।[47]
৮. হাকেম নিশাপুরী।[48]
৯. আহমাদ ইবনুল হুসায়েন আল-বায়হাক্বী (মৃঃ ৪৫৭ হিঃ)।[49]
১০. আবূ হাতিম আর-রাযী (মৃঃ ২৭৭ হিঃ)।
ইমাম আবূ হাতিম (রহঃ) জাহমিয়াদের[50] এই নিদর্শন বর্ণনা করেছেন যে, তারা আহলুস সুন্নাহকে ‘মুশাবিবহা’[51] বলে।[52]
১১. ইমাম আবূ জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবনু জারীর আত-ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ)।[53]
১২. ফুযায়েল বিন ‘ইয়ায (মৃঃ ১৮৭ হিঃ)।[54]
১৩. শায়খুল ইসলাম আবূ ওছমান ইসমাঈল আছ-ছাবূনী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ)।[55]
১৪. ইবনু আব্দিল বার্র আল-আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ)।[56]
১৫. খত্বীব বাগদাদী (শারফু আছহাবিল হাদীছ)।
১৬. আবূ ইসহাক্ব ইবরাহীম বিন মূসা আল-কুরতুবী (মৃঃ ৭৯১ হিঃ)।[57]
১৭. হাফেয শামসুদ্দীন যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ)।[58]
১৮. হাফেয আহমাদ ইবনু হাজার আসক্বালানী (মৃঃ ৮৫২ হিঃ)।[59]
সুন্নী নাম :
১. হাফেয যাহাবী (রহঃ) একজন বিদ্বান সম্পর্কে বলেছেন, الرازي السني الفقيه أحد أئمة السنة ‘আর-রাযী একজন সুন্নী, ফক্বীহ এবং আহলুস সুন্নাহর অন্যতম ইমাম’।[60]
যায়েদাহ বিন কুদামাহ (রহঃ)-কে বহু ইমাম ‘ছাহেবু সুন্নাহ’ (صاحب سنة) বা হাদীছপন্থী এবং ‘আহলুস সুন্নাহ-এর অন্তর্ভুক্ত’ (من أهل السنة) বলেছেন।[61]
২. হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) তাক্বরীবুত তাহযীবে (রাবী ক্রমিক ৪২০৮) আব্দুল মালেক বিন ক্বারীব আল-আছমাঈ আল-বাছরী সম্পর্কে বলেছেন, صدوق سني ‘তিনি সত্যবাদী সুন্নী’।
মুহাম্মাদী মাযহাব : মুহাম্মাদ বিন ওমর আদ-দাঊদী (রহঃ) ইমাম, হাফেয, আল-মুফীদ (উপকারকারী), মুহাদ্দিছুল ইরাক (ইরাকের মুহাদ্দিছ) ইবনু শাহীন (রহঃ) সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, وكان إذا ذكر له مذهب أحد، يقول : أنا محمدي المذهب ‘যখন তার নিকটে কারো মাযহাবের কথা উল্লেখ করা হ’ত তখন তিনি বলতেন, ‘আমি মুহাম্মাদী মাযহাবের’।[62]
সারসংক্ষেপ : কুরআন, হাদীছ এবং মুসলিম ইমামগণের সর্বসম্মত উক্তিসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, মুসলমানদের আরো গুণবাচক নাম রয়েছে। যেগুলি দ্বারা তাদেরকে ডাকা হয়েছে। যেমন : আহলুস সুন্নাহ, আহলুল হাদীছ, সুন্নী, মুহাম্মাদী, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি। সুতরাং মাসঊদ ছাহেবের এ দাবী একেবারেই ভিত্তিহীন এবং দলীলবিহীন যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নাম স্রেফ মুসলিম রেখেছেন।
মাসঊদ ছাহেবের নিকটে ‘মুসলিম’ ব্যতীত অন্য সকল নাম (যেমন : আহলুস সুন্নাহ, আহলুল হাদীছ, হিযবুল্লাহ প্রভৃতি) বেঠিক এবং ফিরক্বা। আর তার নিকটে ফিরক্বাবন্দী শিরক, আযাব ও লা‘নত (‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ তথা ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার স্টীকার দ্রষ্টব্য)।
এজন্য আইম্মায়ে মুসলিমীন যেমন তাবেঈ বিদ্বান মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন (রহঃ) ও অন্যেরা তার নিকটে ইসলাম থেকে খারিজ এবং মুশরিক সাব্যস্ত হয়েছে। (আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই)।
তাকফীরের ফিৎনা : ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়া নির্লজ্জভাবে মুহাদ্দিছগণকে কাফের আখ্যাদান করছে। কার্যতঃ এরা না কোন মুসলমানকে সালাম করে, আর না তার পিছে ছালাত আদায় করে। তাদের নিকটে স্রেফ ঐ ব্যক্তিই ‘মুসলিম’, যে ব্যক্তি তাদের ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ায় (জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্ট্রার্ড) শামিল হয়েছে এবং মাসঊদ ছাহেবের বায়‘আত গ্রহণ করেছে। অন্য কোন ব্যক্তি নিজেকে লক্ষ বার মুসলিম বললেও তারা তাদের অবস্থানেই অবিচল থাকেন।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَلَّى صَلاَتَنَا، وَاسْتَقْبَلَ قِبْلَتَنَا، وَأَكَلَ ذَبِيحَتَنَا، فَذَلِكَ الْمُسْلِمُ الَّذِى لَهُ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُولِهِ ‘যে ব্যক্তি আমাদের মতো ছালাত আদায় করে, আমাদের কেবলার দিকে মুখ ফিরায় এবং আমাদের যবহকৃত প্রাণী ভক্ষণ করে, সে ব্যক্তি মুসলিম। যার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের যিম্মাদারী রয়েছে’।[63]
আলোচনার অকাট্য ফায়ছালা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, فَادْعُوا بِدَعْوَى اللهِ الَّذِى سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ الْمُؤْمِنِيْنَ عِبَادَ اللهِ ‘তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত নামে ডাকো। যিনি তোমাদের নাম রেখেছেন মুসলিমীন, মুমিনীন, ইবাদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা)’।[64]
এই সনদকে ইবনু খুযায়মাহ, হাকেম ও যাহাবী (রহঃ)ও ছহীহ বলেছেন।[65] ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেছেন, هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ ‘এটি হাসান ছহীহ গরীব হাদীছ’।[66]
ইয়াহইয়া ইবনু আবী কাছীর আবূ ইয়া‘লা ও অন্যদের সনদ সমূহে ‘সামা’ (আমি শুনেছি)-এর কথাও উল্লেখ করেছেন।
ফিরক্বার আলোচনা : ফিরক্বার প্রয়োগ হকপন্থীদের ক্ষেত্রেও হয়ে থাকে এবং বাতিলপন্থীদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু মাসঊদ ছাহেব ঢালাওভাবে বলেন, ‘ফিরক্বাবন্দী শিরক’!
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, تَكُونُ فِى أُمَّتِى فِرْقَتَانِ فَتَخْرُجُ مِنْ بَيْنِهِمَا مَارِقَةٌ يَلِى قَتْلَهُمْ أَوْلاَهُمْ بِالْحَقِّ ‘আমার উম্মতের মধ্যে দু’টি ফিরক্বা হবে। তারপর তাদের মধ্য থেকে একটি ‘মারিক্বাহ’ (পথভ্রষ্ট ফিরক্বাহ, খারেজীদের দল) বের হবে। তাদের সাথে লড়াই করবে ঐ দলটি, যেটি হক্বের অধিক নিকটবর্তী হবে’।[67] অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,تَفْتَرِقُ أُمَّتِى فِرْقَتَيْنِ فَتَمْرُقُ بَيْنَهُمَا مَارِقَةٌ فَيَقْتُلُهَا أَوْلَى الطَّائِفَتَيْنِ بِالْحَقِّ ‘আমার উম্মত দু’টি ফিরক্বায় বিভক্ত হবে এবং তাদের মধ্য থেকে একটি দল বের হবে (অর্থাৎ গোমরাহ (খারেজী) ফিরক্বা)। উভয় ফিরক্বার মধ্যে যে দলটি হক্বের অধিক নিকটবর্তী সেটি ঐ গোমরাহ দলকে হত্যা করবে’।[68]
এই ফিরক্বা দু’টি আলী (রাঃ) ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ফিরক্বা ছিল এবং তাঁদের মধ্য থেকে খারেজীদের জামা‘আত বের হয়েছিল। সেই ‘জামা‘আত’কে আলী (রাঃ) হত্যা করেছিলেন।
প্রতীয়মান হ’ল যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবায়ে কেরামের দু’টি জামা‘আতকে দু’টি ফিরক্বা আখ্যা দিয়েছেন। অতএব প্রমাণিত হ’ল যে, মুসলমানদের জামা‘আতকে ‘ফিরক্বা’ও বলা হয়েছে। অর্থাৎ নাজী (মুক্তিপ্রাপ্ত) ফিরক্বা। আর এই দু’টি ফিরক্বা (আলী ও মু‘আবিয়ার দল) হক্বের উপরে ছিল।
[1]. নাছরুল বারী ফী তাহকীকি জুযইল ক্বিরাআহ লিল-বুখারী, পৃঃ ৮৮ হা/৩৮,।
[2]. মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭, সনদ ছহীহ; যুবায়ের আলী যাঈ, তাহক্বীক্বী মাক্বালাত ১/১৬১।
[3]. তিরমিযী, হা/১০।
[4]. রাবীর হিফয শক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া, বিবেক-বুদ্ধি দুর্বল হয়ে যাওয়া, হাদীছকে সঠিকভাবে মনে রাখতে না পারায় হাদীছের বাক্যে তালগোল পাকিয়ে যাওয়াকে ইখতিলাত বলা হয়। বিভিন্ন কারণে ইখতিলাত হ’তে পারে। যেমন : বয়স বেড়ে যাওয়া, বই-পুস্তক জ্বলে যাওয়া, ধন-সম্পদের ক্ষতি হওয়া কিংবা সন্তান-সন্ততির মৃত্যু ঘটার কারণে মানসিক আঘাত পাওয়া ইত্যাদি (তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃঃ ১২৫ প্রভৃতি)।-অনুবাদক।
[5]. দেখুন : আমার গ্রন্থ ‘আল-ফাতহুল মুবীন’, পৃঃ ৭৭-৭৮।
[6]. ‘আমি শ্রবণ করেছি’, ‘আমাকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’ ‘আমাদেরকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন’, ‘আমাকে সংবাদ প্রদান করেছেন’ কিংবা ‘আমাদেরকে সংবাদ প্রদান করেছেন’ ইত্যাদি শব্দাবলী দ্বারা হাদীছের সনদ বর্ণনা করাকে ‘সামা’ বলা হয় (তায়সীরু মুছত্বলাহিল হাদীছ, পৃঃ ১৫৯ প্রভৃতি)।-অনুবাদক।
[7]. আল-ফাতহুল মুবীন, পৃঃ ৭৭।
[8]. বিস্তারিত আলোচনা দেখুন : আত-তাহরীক, জুন ২০১৫ সংখ্যা, পৃঃ ২৫-৩০।-অনুবাদক।
[9]. ছহীহ মুসলিম, শরহে নববী সহ, ১/৫৫; অন্য আরেকটি সংস্করণ, ১/৫, ২৬।
[10]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[11]. দেখুন : মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২০/৪০; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ১/১৬৮।
[12]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১১, মুগীরাহ বিন শু‘বাহ (রাঃ) হ’তে।
[13]. মুসলিম হা/১৯২০।
[14]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, পৃঃ ২৭, নং ৪৯, সনদ ছহীহ।
[15]. তিরমিযী, ২/৪৩, হা/২১৯২, সনদ ছহীহ।
[16]. তিরমিযী ৪/৫০৫, সুনানে তিরমিযী (আরেযাতুল আহওয়াযী সহ), ৯/৭৪।
[17]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ২, সনদ হাসান; ইবনু হাজার আসক্বালানী এটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ফাৎহুল বারী, ১৩/২৫০, হা/৭৩১১-এর ব্যাখ্যা।
[18]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘, হা/১৮৩, ১/১৪৪, অন্য আরেকটি সংস্করণ ১/১৪৪, হা/১৮৩ সনদ ছহীহ; ইবনুল জাওযী, মানাকিবুল ইমাম আহমাদ, পৃঃ ২০৭-২০৮।
[19]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৩, সনদ ছহীহ।
[20]. উলূমুল হাদীছ, পৃঃ ৩।
[21]. বিস্তারিত দেখুন আমার গ্রন্থ : তাহক্বীক্বী মাক্বালাত ১/১৬১-১৭৪।
[22]. মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, নং ৬, সনদ ছহীহ।
[23]. বুখারী হা/৬৫০২, ৮/১৩১।
[24]. আবুদাঊদ হা/৪৬৮৭, শব্দগুলি তাঁর এবং এর সনদ ছহীহ; মূল হাদীছ রয়েছে ছহীহ মুসলিমে, হা/৬০।
[25]. মাযহাবে আহলুল হাদীছ কী হাকীকাত, পৃঃ ১।
[26]. হজ্জ ২২/৭৮। গৃহীত : ‘আল-মুসলিম’ পত্রিকা ৪র্থ সংখ্যা ৪৬ পৃঃ।
[27]. ছহীহ বুখারী, হা/ ৫২২১, ৬৬৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/৯০১।
[28]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৪৫।
[29]. ছহীহ বুখারী, হা/৭৩১১; ছহীহ মুসলিম, হা/১৫৬ ইত্যাদি।
[30]. মুসলিম, হা/৫০।
[31]. মুসলিম, হা/৫০।
[32]. আহমাদ, ৫/১৩১, সনদ হাসান।
[33]. আল-মুস্তাদরাক, ১/৫৫৬, হা/২০৪৬, সনদ হাসান; মুসনাদে আবী দাঊদ আত-ত্বায়ালিসী, হা/২১২৪, ‘মাকতাবা শামেলা’ হ’তে।
[34]. ঐ ৭।
[35]. মুসলিম, হা/২৩৫৫।
[36]. শারহুস সুন্নাহ, হা/৩৬৩০, ১৩/২১২।
[37]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, হা/৩৮২৮৯, ১৫/১৭; আল-মুস্তাদরাক, ৪/৪৪৪-৪৪৫; ইমাম হাকেম বলেন, ‘শায়খায়নের শর্তানুযায়ী হাদীছটি ছহীহ। তবে তারা হাদীছটি বর্ণনা করেননি। মানছূর থেকে সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাটি শক্তিশালী। আর সনদের বাকী অংশটুকু ছহীহ।
[38]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১৪/৪৮২, সনদ ছহীহ। আল-হাকাম বিন মীনা ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য রাবী।
[39]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ, ১৪/৫৬৭, হা/৩৮১৯৯, সনদ হাসান।
[40]. মুসলিম, হা/২৭ অনুচ্ছেদ-৫; দারুস সালাম পাবলিকেশন্সের ক্রমিক নং অনুসারে।
[41]. ইবনু ‘আদী, আল-কামিল, ১/৭৫, সনদ ছহীহ; হিলয়াতুল আওলিয়া ৩/৯; আল-জুযউছ ছানী মিন হাদীছি ইয়াইইয়া ইবনে মা‘ঈন হা/১০২।
[42]. খত্বীব, আল-জামে‘, হা/৭৫৫।
[43]. আল-মুনতাখাব মিন ইলালিল খাল্লাল, হা/১৮৫।
[44]. বুখারী, জুযউ রফয়ে ইয়াদাইন, হা/১৫।
[45]. তারীখু ইবনে মা‘ঈন, দূরীর বর্ণনা, রাবী নং ২৯৫৫, আবুল মু‘তামির ইয়াযীদ বিন তিহমান-এর জীবনী দ্রষ্টব্য।
[46]. আল-আমওয়াল হা/১২১৮, ‘লা তাজ‘আল যাকাতাকা’, কিতাবুল ঈমানের শুরুতে।
[47]. কিতাবুছ ছালাত, হা/৫৮৮।
[48]. আল-মুসতাদরাক, ১/২০১, হা/৩৯৭।
[49]. দেখুন : কিতাবুল ই‘তিক্বাদ ওয়াল হিদায়া ইলা সাবীলির রাশাদ আলা মাযহাবিস সালাফ ওয়া আছহাবিল হাদীছ সহ বায়হাক্বীর অন্যান্য গ্রন্থসমূহ।
[50]. জাহমিয়া একটি ভ্রান্ত ফিরক্বা। জাহম বিন ছাফওয়ান এই ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করতেন। তিনি কুরআনকে সৃষ্ট মনে করতেন। তিনি আরো বলতেন যে, আল্লাহ তা‘আলা সর্বত্র বিরাজমান।
[51]. মুশাবিবহা : যারা রবের সাথে অন্য কিছুকে সাদৃশ্য প্রদান করে। এটি অন্যতম একটি গোমরাহ ফিরক্বা। এই ফিরক্বা দু’টি ভাগে বিভক্ত। ১. যারা স্রষ্টার সত্তার সাথে অন্যের সত্তার সাদৃশ্য প্রদান করে। যেমন: আল্লাহর হাত, মুখমন্ডল আমাদের হাত, মুখমন্ডলের মতই। চরমপন্থী শী‘আগণ যেমন সাবী’আহ, মুগীরীয়াহ ইত্যাদি এই আক্বীদা পোষণ করে। ২. যারা আল্লাহর গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করে। যেমন : আল্লাহর দর্শন আমাদের দর্শনের ন্যায়। তার শ্রবণ আমাদের শ্রবণের মতই। কার্রামিয়া, হিশামী শী‘আগণ এই শ্রেণীভুক্ত।- অনুবাদক।
[52]. উছূলুদ দ্বীন, পৃঃ ৩৮; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ২/২৩।
[53]. ত্বাবারী, ছরীহুস সুন্নাহ, পৃঃ ২০।
[54]. হিলয়াতুল আওলিয়া, ৮/১০৩, ১০৪, সনদ ছহীহ; ত্বাবারী, তাহযীবুল আছার, ৭/৪৪, হা/১৯৭৫, সনদ ছহীহ।
[55]. তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আক্বীদাতুস সালাফ আছহাবিল হাদীছ এবং আর-রিসালাহ ফী ই‘তিক্বাদি আহলিস সুন্নাহ ওয়া আছহাবিল হাদীছ ওয়াল আইম্মাহ’ দ্রষ্টব্য।
[56]. আত-তামহীদ, ১/৮, ২/২০৯ ইত্যাদি।
[57]. শাত্বিবী, আল-ই‘তিছাম, ১/৬১।
[58]. দেখুন : সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৫/৩৭৪।
[59]. ফাতহুল বারী ১/২৮১-এর বরাতে মাসঊদ আহমাদ, মাযাহিবে খামসাহ, পৃঃ ৩৯।
[60]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১০/৪৪৬।
[61]. দেখুন : তাহযীবুত তাহযীব, ৩/২৬৪।
[62]. খত্বীব, তারীখু বাগদাদ, ১১/২৬৭, সনদ ছহীহ, ওমর বিন আহমাদ বিন ওছমান ওরফে ইবনু শাহীন-এর জীবনী।
[63]. বুখারী, হা/৩৯১।
[64]. মুসনাদে আবী ই‘য়ালা আল-মূছেলী ৩/১৪২; ছহীহ ইবনু হিববান ৮/৪৩।
[65]. ছহীহ ইবনে খুযায়মাহ, হা/১৯৩০; আল-মুসতাদরাক, ১/৪২১, ১১৭, ২৩৬।
[66]. তিরমিযী, হা/২৮৬৩।
[67]. ছহীহ মুসলিম, হা/১০৬৫।
[68]. মুসনাদে আবী ইয়া‘লা আল-মূছিলী, ২/৪৯৯, হা/১৩৪৫, সনদ ছহীহ; ইবনু হিববান তার ছহীহ গ্রন্থে (৮/২৫৯) এবং আহমাদ (হা/১১৩২৬, ৩/৭৯) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা কি উদ্দেশ্য?
প্রশ্ন : নিবেদন হ’ল যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড) বুখারী ও মুসলিমের এই (সামনে আসছে) হাদীছকে নিজেদের পক্ষে পেশ করে থাকে। যখন তাদের এই বুঝ ও ইসতিফাদাহ (উপকৃত হওয়া) এবং এভাবে দলীল গ্রহণের ব্যাপারে আমাদের ভিন্নমত রয়েছে। দয়া করে খায়রুল কুরূনের (স্বর্ণ যুগ) বুঝ ও ইসতিফাদাহ দ্বারা উপকৃত করবেন।
كَيْفَ الأَمْرُ إِذَا لَمْ تَكُنْ جَمَاعَةٌ ‘যখন জামা‘আত থাকবে না তখন কি করতে হবে’ অনুচ্ছেদের অধীনে ১৯৬৮ নং হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ. قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلاَ إِمَامٌ؟ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا، وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ-
‘জামা‘আতুল মুসলিমীন এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে। আমি বললাম, যদি তাদের কোন জামা‘আত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তুমি ঐ দলগুলোকে পরিত্যাগ করবে। যদিও তোমাকে গাছের শিকড় কামড়ে ধরে থাকতে হয় এবং এমতাবস্থায় তোমার মৃত্যু এসে যায়’।[1]
মুহতারাম! এ সম্পর্কে তিনটি যুগের উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিন যে, ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড) এ হাদীছের ভিত্তিতে-
১. সবাইকে গোমরাহ এবং নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে সঠিক মনে করে।
২. তাদের কতিপয় গ্রন্থ যেমন (১) দাওয়াতে ইসলাম (পৃঃ ৪৭-৪৮)-এ ৩৪টি মাযহাবী জামা‘আত (২) দাওয়াতে ফিকর ও নযর (পৃঃ ৪৯) গ্রন্থে ৩৩টি মাযহাবী জামা‘আত এবং লামহায়ে ফিকরিয়াহ (পৃঃ ৪২) ও অন্যান্য গ্রন্থে ৩৩টি মাযহাবী জামা‘আতের নাম গণনা করেছে। সেখানে এই বুঝ দেয়ার চেষ্টা করেছে যে, এই (জামা‘আতগুলি) যেহেতু ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন’ (রেজিস্টার্ড)-এর সাথে সম্পৃক্ত নয়; সেহেতু (সেগুলি) গোমরাহ বা পথভ্রষ্ট।
৩. সাধারণভাবে তাতে রাজনৈতিক দলসমূহের উল্লেখ থাকা কোন আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়।
দয়া করে আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় বিশেষ দিকনির্দেশনার জন্য অবশ্যই উৎসর্গ করবেন।
-সংস্কার ও কল্যাণকামী : তারেক মাহমূদ, সাঈদ অটোজ, দীনা জেহলাম।
জবাব : এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ হুজ্জাত বা দলীল এবং কুরআন ও হাদীছ থেকে ইজমায়ে উম্মতের দলীল হওয়া সাব্যস্ত রয়েছে। এজন্য শরী‘আতের দলীল হ’ল তিনটি- ১. কুরআন মাজীদ ২. ছহীহ ও হাসান লি-যাতিহি এবং মারফূ‘ হাদীছ সমূহ ৩. ইজমায়ে উম্মত।
সাবীলুল মুমিনীন সংক্রান্ত আয়াত এবং অন্যান্য দলীল দ্বারা নিম্নোক্ত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতিও প্রমাণিত রয়েছে :
১. কুরআন ও সুন্নাহর স্রেফ ঐ মর্মই গ্রহণযোগ্য, যেটি সালাফে ছালেহীন (যেমন ছাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, মুহাদ্দিছগণ, ওলামায়ে দ্বীন ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন হাদীছ ব্যাখ্যাকারগণ) থেকে সর্বসম্মতিক্রমে অথবা কোন মতভেদ ছাড়াই সাব্যস্ত রয়েছে।
২. ইজতিহাদ যেমন সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা।
এই ভূমিকার পরে সাইয়েদুনা হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ ‘মুসলমানদের জামা‘আত এবং তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’-এর ব্যাখ্যায় আরয হ’ল যে, এখানে জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল মুসলমানদের খেলাফত এবং ‘তাদের ইমাম’ (إمامهم) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ‘তাদের খলীফা’ (خليفتهم) (অর্থাৎ মুসলমানদের খলীফা)। এই ব্যাখ্যার দু’টি দলীল নিম্নরূপ :
১. (সুবাই‘ বিন খালেদ) আল-ইয়াশকুরী (নির্ভরযোগ্য তাবেঈ)-এর সনদে বর্ণিত আছে যে, হুযায়ফা (রাঃ) বলেন, ‘যদি তুমি তখন কোন খলীফা না পাও, তবে মৃত্যু অবধি পালিয়ে থাকবে’।[2]
এই হাদীছের রাবীদের সংক্ষিপ্ত তাওছীক্ব নিম্নরূপ :
১. সুবাই‘ বিন খালেদ আল-ইয়াশকুরী (রহঃ) : তাঁকে ইবনু হিববান, ইমাম ইজলী, হাকেম, আবূ ‘আওয়ানাহ এবং যাহাবী ছিক্বাহ (নির্ভরযোগ্য) ও ছহীহুল হাদীছ বলেছেন। সুতরাং এই শক্তিশালী সত্যায়নের পর তাঁকে ‘মাজহূল’ (অজ্ঞাত) কিংবা ‘মাসতূর’ (অপরিচিত) বলা ভুল।
২. ছাখর বিন বদর আল-ইজলী (রহঃ) : ইবনু হিববান এবং আবূ ‘আওয়ানাহ তাঁকে ছিক্বাহ ও ছহীহুল হাদীছ বলেছেন। এই তাওছীক্বের পরে শায়খ আলবানীর তাঁকে মাজহূল বলা ভুল।
৩. আবুত তাইয়াহ ইয়াযীদ বিন হুমায়েদ (রহঃ) : তিনি ছহীহায়েন এবং সুনানে আরবা‘আর রাবী এবং ছিক্বাহ-ছাবত (নির্ভরযোগ্য) ছিলেন।
৪. আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ (রহঃ) : তিনি ছহীহায়েন ও সুনানে আরবা‘আর রাবী এবং ছিক্বাহ-ছাবত (নির্ভরযোগ্য) ছিলেন।
৫. মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদ (রহঃ) : ছহীহ বুখারী ও অন্য হাদীছ গ্রন্থের রাবী এবং ছিক্বাহ-হাফেয ছিলেন।
প্রমাণিত হ’ল যে, এ সনদটি হাসান লি-যাতিহি। আর ক্বাতাদা (ছিক্বাহ-মুদাল্লিস)-এর নাছর বিন আছেম হ’তে সুবাই‘ বিন খালেদ সূত্রের বর্ণনাটি ছাখর বিন বদরের হাদীছের শাহেদ বা সমর্থক। যেটি মাসঊদ আহমাদ বিএসসির ‘উছূলে হাদীছ’-এর আলোকে সুবাই‘ বিন খালেদ (রহঃ) পর্যন্ত ছহীহ।[3]
এই হাসান (এবং মাসঊদিয়ার মূলনীতি অনুযায়ী ছহীহ) বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, হুযায়ফা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল খলীফা। আর স্মর্তব্য যে, হাদীছ হাদীছকে ব্যাখ্যা করে।
২. হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী ‘জামা‘আতুল মুসলিমীন ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন,
قَالَ الْبَيْضَاوِيُّ : الْمَعْنَى إِذَا لَمْ يَكُنْ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةٌ فَعَلَيْكَ بِالْعُزْلَةِ وَالصَّبْرِ عَلَى تَحَمُّلِ شِدَّةِ الزَّمَانِ وَعَضُّ أَصْلِ الشَّجَرَةِ كِنَايَةٌ عَنْ مُكَابَدَةِ الْمَشَقَّةِ-
‘বায়যাবী (মৃঃ ৬৮৫ হিঃ) বলেছেন, এর অর্থ হ’ল, যখন যমীনে কোন খলীফা থাকবে না, তখন তোমার কর্তব্য হ’ল বিচ্ছিন্ন থাকা এবং যুগের কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা। আর গাছের শিকড় কামড়ে থাকা দ্বারা কষ্ট সহ্য করার প্রতি ইশারা করা হয়েছে’।[4]
হাফেয ইবনু হাজার মুহাম্মাদ বিন জারীর বিন ইয়াযীদ আত-ত্বাবারী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
وَالصَّوَابُ أَنَّ الْمُرَادَ مِنَ الْخَبَرِ لُزُومُ الْجَمَاعَةِ الَّذِينَ فِي طَاعَةِ مَنِ اجْتَمَعُوا عَلَى تَأْمِيرِهِ فَمَنْ نَكَثَ بَيْعَتَهُ خَرَجَ عَنِ الْجَمَاعَةِ، قَالَ : وَفِي الْحَدِيثِ أَنَّهُ مَتَى لَمْ يَكُنْ لِلنَّاسِ إِمَامٌ فَافْتَرَقَ النَّاسُ أَحْزَابًا فَلَا يَتَّبِعُ أَحَدًا فِي الْفُرْقَةِ وَيَعْتَزِلُ الْجَمِيعَ إِنِ اسْتَطَاعَ ذَلِكَ-
‘সঠিক হ’ল, হাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা, যে (দলটি) তার (ইমাম)-এর ইমারতের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আর যে ব্যক্তি তার বায়‘আতকে ভঙ্গ করল, সে জামা‘আত থেকে বের হয়ে গেল। তিনি (ইবনু জারীর) বলেন, আর হাদীছটিতে (এটাও) আছে যে, যখন মানুষের কোন ইমাম থাকবে না এবং লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন সে কোন দলেরই অনুসরণ করবে না এবং সক্ষম হলে সব দল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে’।[5]
ছহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাতা আল্লামা আলী বিন খালাফ বিন আব্দুল মালিক বিন বাত্ত্বাল কুরতুবী (মৃঃ ৪৪৯ হিঃ) বলেছেন, وفيه حجة لجماعة الفقهاء فى وجوب لزوم جماعة المسلمين وترك القيام على أئمة الجور، ‘এ হাদীছে ফক্বীহদের জন্য মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরার এবং যালিম শাসকদের বিরোধিতা না করার দলীল রয়েছে’।[6]
হাফেয ইবনু হাজার উক্ত হাদীছের একটি অংশের ব্যাখ্যায় বলেছেন,وَهُوَ كِنَايَةٌ عَنْ لُزُومِ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ وَطَاعَةِ سَلَاطِينِهِمْ وَلَوْ عَصَوْا ‘এটি মুসলমানদের জামা‘আতকে অাঁকড়ে ধরা এবং তাদের শাসকদের আনুগত্য করার ইঙ্গিতবাহী। যদিও তারা (শাসকবর্গ) নাফরমানী করে’।[7]
হাদীছ ব্যাখ্যাকারকদের (ইবনু জারীর ত্বাবারী, ক্বাযী বায়যাবী, ইবনু বাত্ত্বাল ও হাফেয ইবনু হাজার) উক্ত ব্যাখ্যাসমূহ (সালাফে ছালেহীনের বুঝ) দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, উল্লিখিত হাদীছ (জামা‘আতুল মুসলিমীন ও তাদের ইমামকে অাঁকড়ে ধরবে) দ্বারা প্রচলিত জামা‘আত ও দলসমূহ (যেমন মাসঊদ আহমাদ বিএসসির জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড) উদ্দেশ্য নয়। বরং মুসলমানদের সর্বসম্মত খেলাফত ও খলীফা উদ্দেশ্য।
একটি হাদীছে এসেছে যে, مَنْ مَاتَ وَلَيْسَ لَهَّ إِمَامٌ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً ‘যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে এমতাবস্থায় যে তার কোন ইমাম (খলীফা) নেই, সে জাহেলিয়াতের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করল’।[8]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) তাঁর এক ছাত্রকে বলেছেন যে, تدري ما الإمام؟ الذي يجتمع المسلمون عليه كلهم يقول: هذا إمام، فهذا معناه ‘তুমি কি জান (উক্ত হাদীছে বর্ণিত) ইমাম কাকে বলে? ইমাম তিনিই, যার ইমাম হওয়ার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। প্রতিটি লোকই বলবে যে, ইনিই ইমাম (খলীফা)। এটাই উক্ত হাদীছের মর্মার্থ’।[9]
এই ব্যাখ্যা দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হ’ল যে, ‘তাদের ইমাম’ (إمامهم) দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ ইমাম (খলীফা), যার খেলাফতের ব্যাপারে সকল মুসলমানের ইজমা হয়ে গেছে। যদি কারো ব্যাপারে প্রথম থেকেই মতানৈক্য হয়, তবে তিনি্ঐ হাদীছে উদ্দেশ্য নন। এজন্য ফিরক্বায়ে মাসঊদিয়ার (জামা‘আতুল মুসলিমীন রেজিস্টার্ড) উক্ত হাদীছ দ্বারা নিজের তৈরী ও নতুন গজিয়ে ওঠা ফিরক্বাকে উদ্দেশ্য নেয়া ভুল, বাতিল এবং অনেক বড় ধোঁকাবাজি।
আপনারা তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন যে, কোন নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী ইমাম, মুহাদ্দিছ, হাদীছের ভাষ্যকার অথবা আলেম খায়রুল কুরূনের (স্বর্ণ) যুগ, হাদীছ সংকলনের যুগ এবং হাদীছ ব্যাখ্যাতাদের যুগে (১ম হিজরী শতক থেকে ৯ম হিজরী শতক পর্যন্ত) কি এ হাদীছ দ্বারা এই দলীল সাব্যস্ত করেছেন যে, জামা‘আতুল মুসলিমীন দ্বারা খেলাফত উদ্দেশ্য নয় এবং ‘তাদের ইমাম’ দ্বারা খলীফা উদ্দেশ্য নয়। বরং কাগুজে রেজিস্টার্ড জামা‘আত এবং তার কাগুজে অমনোনীত আমীর উদ্দেশ্য? যদি এর কোন প্রমাণ থাকে তবে যেন পেশ করে। অন্যথায় সাধারণ মুসলমানদেরকে যেন বিভ্রান্ত না করে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : মুহতারাম আবূ জাবের আব্দুল্লাহ দামানভী হাফিযাহুল্লাহর গ্রন্থ ‘আল-ফিরক্বাতুল জাদীদাহ’।
আছহাবুল হাদীছ কারা?
আবূ ত্বাহের বারাকাত আল-হাউযী আল-ওয়াসিত্বী বলেছেন, আমি মালেক ও শাফেঈর শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে আবুল হাসান (আলী বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আত-ত্বাইয়িব) আল-মাগাযিলী (মৃঃ ৪৮৩ হিঃ)-এর সাথে বিতর্ক করি। আমি শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় শাফেঈকে শ্রেষ্ঠ সাব্যস্ত করি। আর তিনি মালেকী মাযহাবের অনুসারী হওয়ায় মালেক (বিন আনাস)-কে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন। অতঃপর আমরা দু’জন আবূ মুসলিম (ওমর বিন আলী বিন আহমাদ বিন লায়ছ) আল-লায়ছী আল-বুখারী (মৃঃ ৪৬৬ হিঃ বা ৪৬৮ হিঃ)-কে ফায়ছালাকারী তৃতীয় ব্যক্তি (বিচারক) নির্ধারণ করলে তিনি ইমাম শাফেঈকে শ্রেষ্ঠ আখ্যা দেন। এতে আবুল হাসান রেগে যান এবং বলেন, ‘সম্ভবতঃ আপনি তাঁর (ইমাম শাফেঈ) মাযহাবের উপরে আছেন’? জবাবে তিনি (ইমাম আবূ মুসলিম আল-লায়ছী আল-বুখারী) বললেন, نحن أصحاب الحديث، الناس على مذاهبنا فلسنا على مذهب أحد، ولوكنا ننتسب إلى مذهب أحد لقيل انتم تضعون له الأحاديث- ‘আমরা আছহাবুল হাদীছ। লোকেরা আমাদের মাযহাবের উপরে আছে। আমরা কারো মাযহাবের উপরে নেই। যদি আমরা কারো মাযহাবের দিকে সম্পর্কিত হ’তাম তাহলে বলা হ’ত, ‘তোমরা তার (মাযহাবের) জন্য হাদীছ জাল করো’।[10]
প্রতীয়মান হ’ল যে, আছহাবুল হাদীছ (আহলুল হাদীছ) কোন তাক্বলীদী মাযহাব যেমন- শাফেঈ ও মালেকী-এর মুক্বাল্লিদ ছিল না। বরং কুরআন ও হাদীছের উপরে আমলকারী ছিল। এই তাৎপর্যপূর্ণ উক্তির পরেও যদি কোন ব্যক্তি এ দাবী করে যে, আছহাবুল হাদীছ (আহলেহাদীছগণ) শাফেঈ, মালেকী ও অন্যদের তাক্বলীদকারী ছিলেন, তবে এ ব্যক্তি যেন তার মস্তিষ্কের চিকিৎসা করিয়ে নেয়।
সতর্কীকরণ : ইমাম আবূ মুসলিম আল-লায়ছী ছিক্বাহ ছিলেন।[11]
সালাফে ছালেহীন ও তাক্বলীদ
আল্লাহ তা‘আলার ঘোষণা, ‘বলুন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান হ’তে পারে’? (যুমার ৩৯/৯)। এই আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, মানুষদের দু’টি (বড়) শ্রেণী রয়েছে।
১. আলেমগণ (মর্যাদাগত দিক থেকে আলেমদের কয়েক প্রকার রয়েছে। আর তাদের মধ্যে ইলম অন্বেষণকারীও শামিল রয়েছে)।
২. সাধারণ মানুষ (সাধারণ মানুষের কতিপয় শ্রেণী রয়েছে। আর তাদের মধ্যে নিরক্ষর মূর্খও শামিল রয়েছে)।
সাধারণ মানুষের জন্য এই বিধান যে, তারা আহলে যিকরদের (আলেম-ওলামাদের) জিজ্ঞাসা করবে (নাহল ১৬/৪৩)। এই জিজ্ঞাসাবাদ তাক্বলীদ নয়।[12] যদি জিজ্ঞাসা করা তাক্বলীদ হ’ত তাহলে ব্রেলভী ও দেওবন্দীদের সাধারণ জনতা বর্তমান ব্রেলভী ও দেওবন্দী আলেমদের মুক্বাল্লিদ হ’ত এবং নিজেদেরকে কখনো হানাফী, মাতুরীদী বা নকশবন্দী ইত্যাদি বলত না। কেউ সরফরাযী হ’ত, কেউ আমীনী, কেউ তাকাবী এবং কেউ হত ঘুম্মানী (?)। অথচ কেউই এর প্রবক্তা নন। সুতরাং সাধারণভাবে জিজ্ঞাসা করাকে তাক্বলীদ আখ্যা দেয়া ভুল ও বাতিল।
আলেমদের জন্য তাক্বলীদ জায়েয নয়। বরং সাধ্যানুযায়ী কিতাব ও সুন্নাত এবং কথা ও কর্মে ইজমার উপরে আমল করা যরূরী। যদি তিনটি দলীলের মধ্যে কোন মাসআলা না পাওয়া যায় তাহ’লে ইজতিহাদ (যেমন- ঐক্যমত পোষণকৃত ও অবিতর্কিত সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা এবং ক্বিয়াসে ছহীহ ইত্যাদি) জায়েয আছে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) বলেছেন, وَإِذَا كَانَ الْمُقَلِّدُ لَيْسَ مِنْ الْعُلَمَاءِ بِاتِّفَاقِ الْعُلَمَاءِ لَمْ يَدْخُلْ فِي شَيْءٍ مِنْ هَذِهِ النُّصُوصِ- ‘আর যখন আলেমদের ঐক্যমত অনুযায়ী (ইজমা) মুক্বাল্লিদ আলেম নয়, তখন সে এ দলীল সমূহের (আয়াত ও হাদীছ সমূহে বর্ণিত ফযীলত সমূহের) অন্তর্ভুক্ত নয়’।[13] এ উক্তির মর্ম দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আলেম মুক্বাল্লিদ হন না।
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) বলেছেন,قَالُوْا : وَالْمُقَلِّدُ لَا عِلْمَ لَهُ وَلَمْ يَخْتَلِفُوا فِي ذَلِكَ ‘তারা (আলেমগণ) বলেছেন, মুক্বাল্লিদের কোন ইলম নেই। আর এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই’।[14]
এই ইজমা দ্বারাও এটাই প্রমাণিত হ’ল যে, আলেম মুক্বাল্লিদ হন না। বরং হানাফীদের ‘আল-হিদায়া’ গ্রন্থের টীকায় লেখা আছে যে, يُحْتَمَلُ أَنْ يَكُونَ مُرَادُهُ بِالْجَاهِلِ الْمُقَلِّدَ؛ لِأَنَّهُ ذَكَرَهُ فِي مُقَابَلَةِ الْمُجْتَهِدِ ‘সম্ভবতঃ জাহিল দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য মুক্বাল্লিদ। কেননা তিনি তাকে মুজতাহিদের বিপরীতে উল্লেখ করেছেন’।[15]
এই ভূমিকার পর এই গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে ১০০ জন আলেমের উদ্ধৃতি পেশ করা হ’ল। যাদের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত আছে যে, তারা তাক্বলীদ করতেন না।-
১. সাইয়েদুনা আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, لاتقلدوا دينكم الرجال ‘তোমরা তোমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে লোকদের তাক্বলীদ করবে না’।[16]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বলেছেন, اُغْدُ عَالِمًا أَوْ مُتَعَلِّمًا وَلَا تَغْدُ إِمَّعَةً بَيْنَ ذَلِكَ- ‘আলেম অথবা ছাত্র হও। এতদুভয়ের মাঝে (অর্থাৎ এছাড়া) মুক্বাল্লিদ হয়ো না’।[17] ‘ইম্মা‘আহ’র একটি অনুবাদ মুক্বাল্লিদও আছে।[18] বুঝা গেল যে, ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর নিকটে লোকদের তিনটি প্রকার রয়েছে। ক. আলেম খ. ছাত্র (طالب علم) গ. মুক্বাল্লিদ।
তিনি মানুষদেরকে মুক্বাল্লিদ হ’তে নিষেধ করে দিয়েছেন এবং আলেম অথবা ছাত্র হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
২. মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেছেন,وأما العالم فإن اهتدى فلا تقلدوه دينكم ‘আলেম হেদায়াতের উপরে থাকলেও তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার তাক্বলীদ করবে না’।[19]
সতর্কীকরণ : ছাহাবায়ে কেরামের মধ্য থেকে কোন একজন ছাহাবী থেকেও তাক্বলীদের সুস্পষ্ট বৈধতা কথা বা কর্মে সাব্যস্ত নেই। বরং হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) বলেছেন, ‘প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ছাহাবী এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকল তাবেঈর প্রমাণিত ইজমা রয়েছে যে, তাদের মধ্য থেকে বা তাদের পূর্বের কোন ব্যক্তির সকল কথা গ্রহণ করা নিষেধ এবং না জায়েয’।[20]
৩. ইমামু দারিল হিজরাহ (মদীনার ইমাম) মালিক বিন আনাস মাদানী (মৃঃ ১৭৯ হিঃ) অনেক বড় মুজতাহিদ ছিলেন। ত্বাহত্বাবী হানাফী ইমাম চতুষ্টয়ের ব্যাপারে (ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম মালেক, ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ) বলেছেন, وهم غير مقلدين ‘তারা গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[21]
মুহাম্মাদ হুসাইন ‘হানাফী’ নামক এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘প্রত্যেক মুজতাহিদ স্বীয় ধ্যান-ধারণার উপরে আমল করেন। এজন্য চার ইমামের সবাই গায়ের মুক্বাল্লিদ’।[22]
মাস্টার আমীন উকাড়বী বলেছেন, ‘মুজতাহিদের উপরে ইজতিহাদ ওয়াজিব। আর নিজের মতো (অন্য) মুজতাহিদের তাক্বলীদ করা হারাম’।[23]
সরফরায খান ছফদর গাখড়ুবী দেওবন্দী বলেছেন, ‘আর তাক্বলীদ জাহিলের জন্যেই। যে আহকাম ও দলীলসমূহ সম্পর্কে অনবগত অথবা পরস্পর বিরোধী দলীলসমূহের মাঝে সমন্বয় সাধন করার ও অগ্রাধিকার দেয়ার যোগ্যতা রাখে না...’।[24]
৪. ইমাম ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মুযানী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ) বলেছেন, ‘আমার এই ঘোষণা যে, ইমাম শাফেঈ নিজের এবং অন্যদের তাক্বলীদ করতে নিষেধ করেছেন। যাতে (প্রত্যেক ব্যক্তি) স্বীয় দ্বীনকে সামনে রাখে এবং নিজের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করে’।[25] ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, ولا تقلد وني ‘তোমরা আমার তাক্বলীদ করো না’।[26]
৫. আহলে সুন্নাতের প্রসিদ্ধ ইমাম ও মুজতাহিদ আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন হাম্বল (মৃঃ ২৪১ হিঃ) ইমাম আওযাঈ ও ইমাম মালেক সম্পর্কে স্বীয় ছাত্র ইমাম আবূদাঊদ সিজিস্তানী (রহঃ)-কে বলেছেন, لَا تُقَلِّدْ دِينَكَ أَحَدًا مِنْ هَؤُلَاءِ ‘তুমি তোমার দ্বীনের ব্যাপারে এদের কারো তাক্বলীদ করবে না’।[27]
ফায়েদা : ইমাম নববী বলেছেন, فَإِنَّ الْمُجْتَهِدَ لَا يُقَلِّدُ الْمُجْتَهِدَ ‘কেননা নিশ্চয়ই একজন মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[28]
ইবনুত তুরকুমানী (হানাফী) বলেছেন, فَإِنَّ الْمُجْتَهِدَ لَا يُقَلِّدُ الْمُجْتَهِدَ ‘কেননা নিঃসন্দেহে একজন মুজতাহিদ অন্য মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[29]
সতর্কীকরণ : কতিপয় ব্যক্তি (নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য) কতিপয় আলেমকে ত্বাবাক্বাতে মালেকিয়া, ত্বাবাক্বাতে শাফেঈয়া, ত্বাবাক্বাতে হানাবিলাহ ও ত্বাবাক্বাতে হানাফিয়াহতে উল্লেখ করেছেন। যা উল্লিখিত আলেমদের মুক্বাল্লিদ হওয়ার দলীল নয়। যেমন-
ক. ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলকে সুবকীর ত্বাবাক্বাতে শাফেঈয়াতে (১/১৯৯; অন্য সংস্করণ, ১/২৬৭) উল্লেখ করা হয়েছে।
খ. ইমাম শাফেঈকে ত্বাবাক্বাতে মালেকিয়াহতে (আদ-দীবাজুল মুযাহহাব, পৃঃ ৩২৬, ক্রমিক নং ৪৩৭) ও ত্বাবাক্বাতে হানাবিলাহতে (১/২৮০) উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম আহমাদ কি ইমাম শাফেঈর এবং ইমাম শাফেঈ কি ইমাম মালেক ও ইমাম আহমাদের মুক্বাল্লিদ ছিলেন?
প্রতীয়মান হ’ল যে, উল্লিখিত ত্বাবাক্বাতে কোন আলেমের উল্লেখ থাকা তার মুক্বাল্লিদ হওয়ার দলীল নয়।[30]
৬. ইমাম আবূ হানীফা নু‘মান বিন ছাবিত কূফী কাবুলী (রহঃ) সম্পর্কে ত্বাহত্বাবী হানাফীর বক্তব্য গত হয়েছে যে, তিনি গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন (৩নং উক্তি দ্রঃ)। আশরাফ আলী থানবী দেওবন্দী বলেছেন, ‘কেননা ইমামে আ‘যম আবূ হানীফার গায়ের মুক্বাল্লিদ হওয়া সুনিশ্চিত’।[31]
ইমাম আবূ হানীফা স্বীয় শিষ্য ক্বাযী আবূ ইউসুফকে বলেন, ‘আমার সকল কথা লিখবে না। আমার আজ এক রায় হয় এবং কাল বদলে যায়। কাল অন্য রায় হয় তো পরশু সেটাও পরিবর্তন হয়ে যায়’।[32]
ফায়েদা : শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ ও হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (উভয়ের উপর আল্লাহ রহম করুন) দু’জনেই বলেছেন যে, ইমাম আবূ হানীফা তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন।[33]
নিজেদেরকে হানাফী ধারণাকারীদের নিম্নোক্ত গ্রন্থসমূহেও লিখিত আছে যে, ইমাম আবূ হানীফা তাক্বলীদ থেকে নিষেধ করেছেন।
(১) মুক্বাদ্দামা উমদাতুর রি‘আয়াহ ফী হাল্লি শারহিল বেক্বায়া, পৃঃ ৯ (২) কাওছারী, লামাহাতুন নাযর ফী সীরাতিল ইমাম যুফার, পৃঃ ২১ (৩) হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ ১/১৫৭।
৭. শায়খুল ইসলাম আবূ আব্দুর রহমান বাক্বী বিন মাখলাদ বিন ইয়াযীদ কুরতুবী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) সম্পর্কে ইমাম আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনুল ফুতূহ বিন আব্দুল্লাহ আল- হুমায়দী আল-আযদী আল-আন্দালুসী আল-আছারী আয-যাহেরী (মৃঃ ৪৮৮ হিঃ) স্বীয় শিক্ষক আবূ মুহাম্মাদ আলী বিন আহমাদ ওরফে ইবনু হাযম থেকে বর্ণনা করেছেন, وكان متخيرا لا يقلد أحدا ‘তিনি (কুরআন, সুন্নাহ ও প্রাধান্যযোগ্য মতকে) বেছে নিতেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[34] হাফেয ইবনু হাযমের বক্তব্য ইবনে বাশকুওয়ালের কিতাবুছ ছিলাহ-তেও(১/১০৮, জীবনী ক্রমিক নং ২৮৪) উল্লেখ আছে।
হাফেয যাহাবী বাক্বী বিন মাখলাদ সম্পর্কে বলেছেন, وكان مجتهدا لايقلد أحدا بل يفتي بالأثر ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। বরং আছার (হাদীছ ও আছার) দ্বারা ফৎওয়া দিতেন’।[35]
ফায়েদা : হাফেয আবূ সা‘দ আব্দুল করীম বিন মুহাম্মাদ বিন মানছূর আত-তামীমী আস-সাম‘আনী (মৃঃ ৫৬২ হিঃ) বলেছেন, الأثري... هذه النسبة الى الأثر يعنى الحديث وطلبه واتباعه- ‘আল-আছারী... এই সম্বন্ধটি আছারের প্রতি অর্থাৎ হাদীছ, হাদীছ অনুসন্ধান এবং তার অনুসরণের দিকে সম্বন্ধ’।[36]
হাফেয সাম‘আনী বলেছেন,الظاهري... هذه النسبة إلى أصحاب الظاهر، وهم جماعة ينتحلون مذهب داود بن على الأصبهاني صاحب الظاهر، فإنهم يجرون النصوص على ظاهرها، وفيهم كثرة- ‘আয-যাহেরী... এ সম্বন্ধটি যাহেরীদের প্রতি। আর তারা ঐ জামা‘আত, যারা দাঊদ বিন আলী ইস্পাহানী যাহেরীর মাযহাবকে গ্রহণ করে। এরা নছকে (কুরআন ও হাদীছের দলীল সমূহকে) তার বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করে। আর এরা (সংখ্যায়) অনেক’।[37]
হাফেয সাম‘আনী (রহঃ) বলেছেন, اَلسَّلَفى... هذه النسبة إلى السلف وانتحال مذهبهم على ما سمعت- ‘আস-সালাফী.... এই সম্বন্ধটি সালাফ এবং তাদের মাযহাব গ্রহণ করার প্রতি। যেমনটি আমি শ্রবণ করেছি’।[38]
এর দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমানদের অসংখ্য গুণবাচক নাম ও উপাধি রয়েছে। এজন্য সালাফী, যাহেরী, আছারী, আহলেহাদীছ এবং আহলে সুন্নাত দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ঐ সকল ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলমান, যারা কুরআন, হাদীছ ও ইজমার অনুসরণ করে এবং কোন মানুষের তাক্বলীদ করে না। আল-হামদুল্লিাহ।
৮. ইমাম আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ বিন ওয়াহাব বিন মুসলিম আল-ফিহরী আল-মিসরী (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان ثقة حجة حافظا مجتهدا لا يقلد أحدا، ذا تعبد وزهد- ‘তিনি (হাদীছ বর্ণনায়) ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য, হুজ্জাত[39], হাফেয ও মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি ইবাদতগুযার ও দুনিয়া বিমুখ ছিলেন’।[40]
৯. মছূলের বিচারক আবূ আলী আল-হাসান বিন মূসা আল-আশয়াব আল-বাগদাদী (মৃঃ ২০৯ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وَكَانَ مِنْ أَوْعِيَةِ العِلْمِ لاَ يُقَلِّدُ أَحَداً ‘তিনি ইলমের অন্যতম ভান্ডার ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[41]
১০. আবূ মুহাম্মাদ আল-ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন ক্বাসেম বিন মুহাম্মাদ বিন ইয়াসার আল-বায়ানী আল-কুরতুবী আল-আন্দালুসী (মৃঃ ২৭৬ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন,
ولازم ابن عبد الحكم حتى برع في الفقه وصار إماما مجتهدا لا يقلد أحدا وهو مصنف كتاب الإيضاح في الرد على
المقلدين، ‘তিনি (মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ) ইবনে আব্দুল হাকাম (বিন আ‘য়ান বিন লায়ছ আল-মিসরী)-এর সাহচর্য লাভ করেছিলেন। এমনকি তিনি ফিক্বহে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এবং ইমাম ও মুজতাহিদ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি আল-ঈযাহ ফির রাদ্দি আলাল মুক্বাল্লিদীন গ্রন্থের রচয়িতা’।[42]
মুক্বাল্লিদদের প্রত্যুত্তরে তাঁর উক্ত গ্রন্থের নাম নিম্নোক্ত আলেমগণও উল্লেখ করেছেন-
ক. আল-হুমায়দী আল-আন্দালুসী আয-যাহেরী।[43]
খ. আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আলী বিন আব্দুল কাফী আস-সুবকী।[44]
গ. ছালাহুদ্দীন খলীল বিন আয়বাক আছ-ছাফাদী।[45]
ঘ. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী।[46]
সতর্কীকরণ : আমাদের জানা মতে হাদীছ সংকলনের যুগ (৫ম শতাব্দী হিঃ) বরং ৮ম শতাব্দী হিজরী পর্যন্ত কোন নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেম কিতাবুদ দিফা‘ আনিল মুক্বাল্লিদীন, কিতাবু জাওয়াযিত তাক্বলীদ, কিতাবু উজূবিত তাক্বলীদ বা এ মর্মের কোন গ্রন্থ রচনা করেননি। যদি কারো এই গবেষণা সম্পর্কে ভিন্নমত থাকে, তবে শুধুমাত্র একটি সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি পেশ করুন। কোন জবাবদাতা আছে কি?
[চলবে]
[1]. ছহীহ বুখারী, হা/৭০৮৪, ৩/৭৭৯; ছহীহ মুসলিম, ৫/১৩৭, হা/১৮৪৭ ‘নেতৃত্ব’ অধ্যায়, ‘ফিতনা আবির্ভাবের সময় এবং সর্বাবস্থায় জামা‘আতুল মুসলিমীনকে অাঁকড়ে ধরা ওয়াজিব’ অনুচ্ছেদ।
[2]. আবূদাউদ, হা/৪২৪৭, সনদ হাসান; মুসনাদে আবী ‘আওয়ানাহ, ৪/৪২০, হা/৭১৬৮।
[3]. দেখুন : সুনানে আবূদাঊদ, হা/৪২৪৪; হাকেম (৪/৪৩২-৪৩৩) একে ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাঁর সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
[4]. ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।
[5]. ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।
[6]. ইবনু বাত্ত্বাল, শরহে ছহীহ বুখারী, ১০/৩৩।
[7]. ফাৎহুল বারী, ১৩/৩৬।
[8]. ছহীহ ইবনে হিববান, ১০/৪৩৪, হা/৪৫৭৩, হাদীছ হাসান।
[9]. সুওয়ালাতু ইবনে হানী, পৃঃ ১৮৫, অনুচ্ছেদ ২০১১; তাহকীকী মাকালাত ১/৪০৩।
[10]. সুওয়ালাতুল হাফেয আস-সালাফী লিখুমাইয়েস আল-হাউযী, পৃঃ ১১৮, ক্রমিক নং ১১৩।
[11]. দেখুন : আমার গ্রন্থ ‘আল-ফাতহুল মুবীন ফী তাহক্বীক্বি ত্বাবাক্বাতিল মুদাল্লিসীন’, পৃঃ ৫৮; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৮/৪০৮।
[12]. দেখুন : ইবনুল হাজিব নাহবী, মুনতাহাল উছূল, পৃঃ ২১৮-২১৯ এবং আমার গ্রন্থ : ‘দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা’, পৃঃ ১৬।
[13]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০০।
[14]. জামেউ‘ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২৩১, ‘তাক্বলীদের ফিতনা’ অনুচ্ছেদ।
[15]. হেদায়া আখীরায়েন, পৃঃ ১৩২, টীকা-৬, ‘বিচারকের বৈশিষ্ট্য’ অধ্যায়।
[16]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা, ২/১০, সনদ ছহীছ; আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫।
[17]. জামেউ‘ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৭১-৭২, হা/১০৮, সনদ হাসান।
[18]. দেখুন : তাজুল আরূস, ১১/৪; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব, পৃঃ ২৬; আল-ক্বামূসুল ওয়াহীদ, পৃঃ ১৩৪।
[19]. জামেউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/২২২, হা/৯৫৫, সনদ হাসান; উপরন্তু দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৫-৩৭।
[20]. ইবনু হাযম, আন-নুবযাতুল কাফিয়াহ, পৃঃ ৭১; সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩১-১৩২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৪-৩৫।
[21]. হাশিয়াতুত ত্বাহত্বাবী আলাদ দুর্রিল মুখতার, ১/৫১।
[22]. মুঈনুল ফিক্বহ, পৃঃ ৮৮।
[23]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ৩/৪৩০।
[24]. আল-কালামুল মুফীদ ফী ইছবাতিত তাক্বলীদ, পৃঃ ২৩৪।
[25]. মুখতাছারুল মুযানী, পৃঃ ১; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[26]. ইবনু আবী হাতেম, আদাবুশ শাফেঈ ওয়া মানাক্বিবুহু, পৃঃ ৫১, সনদ হাসান; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮।
[27]. মাসাইলু আবুদাঊদ, পৃঃ ২৭৭।
[28]. শরহ ছহীহ মুসলিম, ১/২১০, হা/২১-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।
[29]. বায়হাক্বী, আল-জাওহারুন নাক্বী আলাস-সুনানিল কুবরা ৬/২১০।
[30]. দেখুন : আবূ মুহাম্মাদ বদীউদ্দীন রাশেদী সিন্ধী, তানক্বীদে সাদীদ বর রিসালায়ে ইজতিহাদ ওয়া তাক্বলীদ, পৃঃ ৩৩-৩৭।
[31]. মাজালিসে হাকীমুল উম্মাত, পৃঃ ৩৪৫; মালফূযাতে হাকীমুল উম্মাত, ২৪/৩৩২।
[32]. তারীখু ইয়াহ্ইয়া বিন মাঈন, দূরীর বর্ণনা, ২/৬০৭, ক্রমিক নং ২৪৬১; সনদ ছহীহ; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৮-৩৯।
[33]. দেখুন : ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/১০, ২১১; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০০, ২০৭, ২১১, ২২৮; সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩২।
[34]. জুযওয়াতুল মুক্বতাবাস ফী যিকরি উলাতিল আন্দালুস, পৃঃ ১৬৮; ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক্ব, ১০/২৭৯।
[35]. তারীখুল ইসলাম, ২০/৩১৩, ২৭৬ হিজরীতে মৃত্যুবরণকারীরা।
[36]. আল-আনসাব, ১/৮৪।
[37]. ঐ, ৪/৯৯।
[38]. ঐ, ৩/২৭৩।
39]. যিনি তিন লাখ হাদীছের ইলম সনদ ও মতনসহ মুখস্থ রাখেন তাকে হুজ্জাত বলা হয়। দ্রঃ ড. সুহায়েল হাসান, মু‘জামু ইছতিলাহাতে হাদীছ, পৃঃ ১৬৩।-অনুবাদক।
[40]. তাযকিরাতুল হুফফায, ১/৩০৫, জীবনী ক্রমিক নং ২৮৩।
[41]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ৬/৫৬০।
[42]. তাযকিরাতুল হুফফায, ২/৬৪৮, জীবনী ক্রমিক নং ৬৭১।
[43]. জুযওয়াতুল মুক্বতাবাস, ১/১১৮।
[44]. ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়া আল-কুবরা, ১/৫৩০।
[45]. আল-ওয়াফী বিল ওফায়াত, ২৪/১১৬।
[46]. ত্বাবাক্বাতুল হুফফায, পৃঃ ২৮৮, জীবনী ক্রমিক নং ৬৪৭।
[সালাফে ছালেহীন ও তাক্বলীদ]
১১. হারামের উস্তাদ আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আন-নিশাপুরী (মৃঃ ৩১৮ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان مجتهدا لا يقلد أحدا ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[1]
ইমাম নববী বলেছেন, ولا يلتزم التقيد فى الاختيار بمذهب أحد بعينه، ولا يتعصب لأحد، ولا على أحد على عادة أهل الخلاف، بل يدور مع ظهور الدليل ودلالة السنة الصحيحة، ويقول بها مع من كانت، ومع هذا فهو عند أصحابنا معدود من أصحاب الشافعى- ‘তিনি মাসআলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট মাযহাব অাঁকড়ে ধরাকে আবশ্যক মনে করতেন না। আর মতভেদকারীদের অভ্যাস মতো কারো জন্য গোঁড়ামি করতেন না। বরং তিনি সুস্পষ্ট দলীল ও ছহীহ হাদীছের সাথে চলতেন। দলীল যার নিকটেই থাক না কেন তিনি তার প্রবক্তা ছিলেন। এতদসত্ত্বেও আমাদের সাথীগণের নিকটে তিনি ইমাম শাফেঈর অনুসারীদের মধ্যে গণ্য’।[2]
নববীর বক্তব্যের একটি অংশ উল্লেখ করে হাফেয যাহাবী বলেছেন, مَا يَتَقَيَّدُ بِمَذْهَبٍ وَاحِدٍ إِلاَّ مَنْ هُوَ قَاصِرٌ فِي التَّمَكُّنِ مِنَ العِلْمِ، كَأَكْثَرِ عُلَمَاءِ زَمَانِنَا، أَوْ مَنْ هُوَ مُتَعَصِّبٌ ‘একজনের মাযহাব মানার বাধ্যবাধকতা সেই আরোপ করে যে ইলম অর্জনে অক্ষম। যেমন আমাদের যুগের অধিকাংশ আলেমগণ। অথবা যে গোঁড়া ও পক্ষপাতদুষ্ট’।[3]
উক্ত উদ্ধৃতি সমূহ হ’তে দু’টি বিষয় প্রতিভাত হয়-
ক. মাযহাবগুলোর তাক্বলীদ সেই করে যে অজ্ঞ অথবা গোঁড়া।
খ. মাযহাবসমূহের তাক্বলীদকারীরা কতিপয় আলেমকে স্ব স্ব ত্বাবাক্বাতে উল্লেখ করেছেন। অথচ উল্লেখিত আলেমদের মুক্বাল্লিদ হওয়া প্রমাণিত নয়। বরং তারা তাক্বলীদের বিরোধী ছিলেন। সুতরাং মুক্বাল্লিদদের রচিত ত্বাবাক্বাত গ্রন্থসমূহের কোনই মূল্য নেই।
১২. সত্যবাদী ও হাসানুল হাদীছ-এর মর্যাদায় অভিষিক্ত আবূ আলী আল-হাসান বিন সা‘দ বিন ইদরীস আল-কুতামী আল-কুরতুবী (মৃঃ ৩৩১ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان علامة مجتهدًا لا يقلد ويميل إلى أقوال الشافعي. ‘তিনি আল্লামা ও মুজতাহিদ ছিলেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি শাফেঈর বক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন’।[4]
১৩. ইমাম আওযাঈ (মৃঃ ১৫৭ হিঃ)-এর খ্যাতিমান ছাত্র এবং (স্পেনের) আমীর (খলীফা) হিশাম বিন আব্দুর রহমান বিন মু‘আবিয়া আল-আন্দালুসীর বিচারক আবূ মুছ‘আব বিন ইমরান আল-কুরতুবী সম্পর্কে ইবনুল ফারাযী বলেছেন,وكان لايقلد مَذْهَباً ويقضى ما رآه صَوَاباً وكان خيراً فاضلاً. ‘তিনি কোন মাযহাবের তাক্বলীদ করতেন না। তিনি যা সঠিক মনে করতেন সে অনুযায়ী ফায়ছালা দিতেন। তিনি সৎ ও মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন’।[5]
১৪. আবূ জা‘ফর মুহাম্মাদ বিন জারীর বিন ইয়াযীদ আত- ত্বাবারী আস-সুন্নী (মৃঃ ৩১০ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وكان مجتهداً لا يقلد أحداً. ‘তিনি মুজতাহিদ ছিলেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[6]
ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান বলেছেন, وكان من الأئمة المجتهدين، لم يقلد أحدا، ‘তিনি মুজতাহিদ ইমামদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করেননি’।[7]
১৫. সত্যবাদী ও হাসানুল হাদীছ ক্বাযী আবুবকর আহমাদ বিন কামিল বিন খালাফ বিন শাজারাহ আল-বাগদাদী (মৃঃ ৩৫০ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, كَانَ يختَارُ لِنَفْسِهِ، وَلاَ يُقَلِّد أَحداً ‘তিনি নিজের জন্য (প্রাধান্যযোগ্য মতকে) নির্বাচন করতেন। কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[8]
১৬. আবুবকর মুহাম্মাদ বিন দাঊদ বিন আলী আয-যাহেরী (মৃঃ ২৯৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন,وَكَانَ يَجْتَهِدُ وَلاَ يُقَلِّدُ أَحَداً. ‘তিনি ইজতিহাদ করতেন এবং কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[9]
১৭. আবূ ছাওর ইবরাহীম বিন খালিদ আল-কালবী আল- বাগদাদী আল-ফক্বীহ (মৃঃ ২৪০ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, وبرع في العلم ولم يقلد أحداً ‘তিনি ইলমে পারদর্শী হয়েছিলেন এবং কারো তাক্বলীদ করেননি’।[10]
১৮. শায়খুল ইসলাম হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ আশ-শামী (মৃঃ ৭২৮ হিঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘বুখারী, মুসলিম, আবূদাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, আবূদাঊদ আত-ত্বায়ালিসী, দারেমী, বায্যার, দারাকুৎনী, বায়হাক্বী, ইবনু খুযায়মাহ এবং আবূ ইয়া‘লা আল-মূছিলী এরা কি মুজতাহিদ ছিলেন? কোন একজন ইমামের তাক্বলীদ করেননি? নাকি তারা মুক্বাল্লিদ ছিলেন’? তখন হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) জবাব দিয়েছিলেন,
الحمد لله رب العالمين، أَمَّا الْبُخَارِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ فَإِمَامَانِ فِي الْفِقْهِ مِنْ أَهْلِ الْاِجْتِهَادِ. وَأَمَّا مُسْلِمٌ وَالتِّرْمِذِيُّ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَه وَابْنُ خُزَيْمَةَ وَأَبُو يَعْلَى وَالْبَزَّارُ وَنَحْوُهُمْ فَهُمْ عَلَى مَذْهَبِ أَهْلِ الْحَدِيثِ. لَيْسُوا مُقَلِّدِينَ لِوَاحِدٍ بِعَيْنِهِ مِنَ الْعُلَمَاءِ وَلَا هُمْ مِنَ الْأَئِمَّةِ الْمُجْتَهِدِينَ عَلَى الْإِطْلَاقِ-
‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। অতঃপর বুখারী ও আবুদাঊদ ফিক্বহের ইমাম ও মুজতাহিদ (মুত্বলাক্ব) ছিলেন। পক্ষান্তরে মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু খুযায়মাহ, আবু ইয়া‘লা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। আর তারা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বও ছিলেন না’।[11]
এই তাহক্বীক্ব ও সাক্ষ্য থেকে চারটি বিষয় প্রতীয়মান হয়-
১. হাফেয ইবনু তায়মিয়াহর নিকটে ইমাম বুখারী ও আবূদাঊদ মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন। এজন্য তাদেরকে হানাফী, শাফেঈ, হাম্বলী বা মালেকী আখ্যা দেয়া ভুল।
২. ইমাম মুসলিম, তিরমিযী ও নাসাঈ প্রমুখ সবাই আহলেহাদীছের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। সুতরাং তাঁদেরকে তাবাক্বাতে শাফেঈয়াহ প্রভৃতি ত্বাবাক্বাতের গ্রন্থসমূহে উল্লেখ করা ভুল।
৩. মুহাদ্দিছীনে কেরামের মধ্য থেকে কেউই মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
৪. মুজতাহিদগণের দু’টি স্তর রয়েছে। ১. মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব[12] এবং ২. মুজতাহিদ ‘আম।[13]
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর উক্ত তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হ’ল যে, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী (মৃঃ ২৫৬ হিঃ) মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। বরং মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব ছিলেন।
হাফেয যাহাবী ইমাম বুখারী সম্পর্কে বলেছেন,وكان إماما حافظا حجة رأسا في الفقه والحديث مجتهدا من أفراد العالم مع الدين والورع والتأله- ‘তিনি ইমাম, হাফেয, হুজ্জাত, ফিক্বহ ও হাদীছের নেতা, মুজতাহিদ এবং দ্বীনদারী, পরহেযগারিতা ও আল্লাহভীরুতার সাথে সাথে দুনিয়ার অনন্য সাধারণ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’।[14]
এ ধরনের অসংখ্য সাক্ষ্যের সমর্থনে আরয হ’ল যে, ‘ফায়যুল বারী’র ভূমিকা লেখক গোঁড়া দেওবন্দী বলেছেন, واعلم أن البخارى مجتهد لاريب فيه ‘জেনে নাও যে, নিশ্চয়ই বুখারী একজন মুজতাহিদ। এতে কোন সন্দেহ নেই’।[15]
সালীমুল্লাহ খান দেওবন্দী (মুহতামিম, জামে‘আ ফারূক্বিয়া দেওবন্দিয়া, করাচী) বলেছেন, ‘বুখারী হ’লেন মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব’।[16]
মুজতাহিদ সম্পর্কে এ মূলনীতি রয়েছে যে, মুজতাহিদ তাক্বলীদ করেন না। নববী বলেছেন, ‘কেননা নিঃসন্দেহে মুজতাহিদ মুজতাহিদের তাক্বলীদ করেন না’।[17]
১৯. ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আন- নিশাপুরী আল-কুশায়রী (মৃঃ ২৬১ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছের মাযহাবের উপরে ছিলেন। কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮ নং উক্তি দ্রঃ)। ইমাম মুসলিম বলেছেন, قَدْ شَرَحْنَا مِنْ مَذْهَبِ الْحَدِيثِ وَأَهْلِهِ ‘আমরা হাদীছ এবং আহলেহাদীছদের মাযহাব-এর ব্যাখ্যা করেছি’।[18]
সতর্কীকরণ : ইমাম মুসলিমের মুক্বাল্লিদ হওয়া কোন একজন নির্ভরযোগ্য ইমাম থেকেও সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত নেই।
২০. ইমাম আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব ইবনু খুযায়মাহ আন-নিশাপুরী (মৃঃ ৩১১ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছের মাযহাবের উপরে ছিলেন। নির্দিষ্ট কোন ইমামের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না’।[19]
আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আলী বিন আব্দুল কাফী আস-সুবকী (মৃঃ ৭৭১ হিঃ) বলেছেন, قلت : المحمدون الْأَرْبَعَة مُحَمَّد بن نصر وَمُحَمّد بن جرير وَابْن خُزَيْمَة وَابْن الْمُنْذر من أَصْحَابنَا وَقد بلغُوا دَرَجَة الِاجْتِهَاد الْمُطلق، وَلم يخرجهم ذَلِك عَن كَونهم من أَصْحَاب الشافعى المخرجين على أُصُوله المتمذهبين بمذهبه لوفاق اجتهادهم اجْتِهَاده، بل قد ادّعى من هُوَ بعد من أَصْحَابنَا الخلص كالشيخ أَبى على وَغَيره أَنهم وَافق رَأْيهمْ رأى الإِمَام الْأَعْظَم فتبعوه ونسبوا إِلَيْهِ لَا أَنهم مقلدون... ‘আমি বলেছি, চার মুহাম্মাদ- মুহাম্মাদ বিন নাছর, মুহাম্মাদ বিন জারীর, ইবনু খুযায়মাহ ও ইবুনল মুনযির আমাদের সাথীদের মধ্যে ছিলেন। তাঁরা মুজতাহিদ মুত্বলাক্বের স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। আর এ বিষয়টি তাদেরকে শাফেঈর সাথীদের থেকে বের করে দেয়নি। তারা ইমাম শাফেঈর উছূল (মূলনীতি) অনুযায়ী তাখরীজকারী এবং তার মাযহাবকে পসন্দকারী। কেননা তাদের ইজতিহাদ তাঁর (ইমাম শাফেঈ) ইজতিহাদের অনুকূলে ছিল। বরং তাদের পরে আমাদের একনিষ্ঠ সাথীবৃন্দ যেমন- আবূ আলী ও অন্যরা দাবী করেছেন যে, তাদের রায় ইমামে আযমের (ইমাম শাফেঈ) রায়ের সাথে মিলে গিয়েছিল। তাই তারা তার অনুসরণ করেছেন এবং তার দিকে সম্পর্কিত হয়েছেন। এজন্য নয় যে, তারা মুক্বাল্লিদ ছিলেন’।[20]
المتمذهبين بمذهبه (তার মাযহাব গ্রহণকারীগণ) কথাটুকু তো সুবকী নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য বলেছেন। তবে তাঁর স্বীকারোক্তি থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হ’ল যে, তার নিকটে মুহাম্মাদ বিন নাছর আল-মারওয়াযী, মুহাম্মাদ বিন জারীর ত্বাবারী, মুহাম্মাদ বিন ইসহাক্ব বিন খুযায়মাহ, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির ও আবূ আলী সকলেই গায়ের মুক্বাল্লিদ (এবং আহলেহাদীছ) ছিলেন।
ফায়েদা : যেভাবে হানাফী আলেমগণ নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য অথবা কতিপয় আলেম ইমাম আবূ হানীফাকে ‘ইমামে আযম’ বলেন, সেভাবে শাফেঈ আলেমগণও ইমাম শাফেঈকে ‘ইমামে আযম’ বলে থাকেন। যেমন- তাজুদ্দীন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন তাকিউদ্দীন আস-সুবকী বলেছেন, مُحَمَّد بْن الشَّافِعِي إمامنا، الإِمَام الْأَعْظَم المطلبي أَبِي عَبْد اللَّه مُحَمَّد بْن إِدْرِيس ‘মুহাম্মাদ বিন শাফেঈ হ’লেন আমাদের ইমাম। তিনি ইমামে আযম (বড় ইমাম) আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আল-মুত্ত্বালিবী’।[21]
আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন সালামাহ আল-ক্বালয়ূবী (মৃঃ ১০৬৯ হিঃ) বলেছেন, قوله (الشافعى): هو الإمام الأعظم ‘তার বক্তব্য (আশ-শাফেঈ) : তিনিই হ’লেন আল-ইমামুল আ‘যম (মহান ইমাম)’।[22]
ক্বাসত্বালানী (শাফেঈ) ইমাম মালেককে ‘ইমামে আ‘যম’ (الإمام الأعظم) বলেছেন।[23]
ক্বাসত্বালানী ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল সম্পর্কে বলেছেন, ‘আল-ইমামুল আ‘যম’ (الإمام الأعظم)।[24]
হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) মুসলমানদের খলীফাকে (ইমাম) ইমামে আ‘যম (الإمام الأعظم) বলেছেন।[25]
এক্ষণে এই মুক্বাল্লিদরা ফায়ছালা করুক যে, তাঁদের মধ্যে প্রকৃত ইমামে আ‘যম কে?
আবূ ইসহাক্ব আশ-শীরাযী কতিপয় ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, وَالصَّحِيحُ الَّذِي ذَهَبَ إلَيْهِ الْمُحَقِّقُونَ مَا ذَهَبَ إلَيْهِ أَصْحَابُنَا وَهُوَ أَنَّهُمْ صَارُوا إلَى مَذْهَبِ الشَّافِعِيِّ لَا تَقْلِيدًا لَهُ، بَلْ لَمَّا وَجَدُوا طُرُقَهُ فِي الِاجْتِهَادِ وَالْقِيَاسِ أَسَدَّ الطُّرُقِ ‘আর ছহীহ সেটাই যেদিকে মুহাক্কিকগণ গিয়েছেন এবং যেদিকে আমাদের সাথীগণ গিয়েছেন। আর সেটা হ’ল তারা তাক্বলীদ করার জন্য শাফেঈ মাযহাবের প্রবক্তা হননি; বরং ইজতিহাদ ও ক্বিয়াসে তাঁর (ইমাম শাফেঈ) পদ্ধতিকে সবচেয়ে সঠিক পেয়েছিলেন তাই’।[26]
এরপর নববী বলেছেন,
وَذَكَرَ أَبُو عَلِيٍّ السِّنْجِيُّ بِكَسْرِ السِّينِ الْمُهْمَلَةِ نَحْوَ هَذَا فَقَالَ اتَّبَعْنَا الشَّافِعِيَّ دُونَ غَيْرِهِ لِأَنَّا وَجَدْنَا قَوْلَهُ أَرْجَحَ الْأَقْوَالِ وَأَعْدَلَهَا لَا أَنَّا قَلَّدْنَاهُ-
‘আবূ আলী আস-সিনজী (সীন বর্ণে যের) এমনটিই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা অন্যদের বাদ দিয়ে ইমাম শাফেঈর অনুসরণ করেছি। কারণ আমরা তাঁর মতামতকে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ও সঠিক পেয়েছি। এজন্য নয় যে, আমরা তাঁর তাক্বলীদ করেছি’।[27]
প্রমাণিত হ’ল যে, আলেমদের নামের সাথে শাফেঈ, হানাফী মালেকী প্রভৃতি লকব থাকার উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে, তাঁরা মুক্বাল্লিদ ছিলেন। বরং সঠিক এটাই যে, তাঁরা মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। বরং তাদের ইজতিহাদ উল্লেখিত নিসবতকৃত ইমামের ইজতিহাদের সাথে মিলে গিয়েছিল।
২১. জমহূর বিদ্বানের নিকটে নির্ভরযোগ্য ক্বাযী আবুবকর মুহাম্মাদ বিন ওমর বিন ইসমাঈল দাঊদী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) ইবনে শাহীন বাগদাদী নামে পরিচিত আবূ হাফছ ওমর বিন আহমাদ বিন ওছমান (মৃঃ ৩৮৫ হিঃ) সম্পর্কে বলেছেন, وكان أيضا لا يعرف من الفقه قليلا ولا كثيرا، وكان إذا ذكر له مذاهب الفقهاء كالشافعي وغيره، يَقُولُ: أنا محمدي المذهب، ‘তিনিও (তাক্বলীদী) ফিক্বহ বিষয়ে কম বা বেশী কিছুই জানতেন না (অর্থাৎ তিনি উক্ত তাক্বলীদী ফিক্বহকে কোন গুরুত্বই দিতেন না)। যখন তার সামনে ফক্বীহদের মাযহাব যেমন শাফেঈ ইত্যাদি উল্লেখ করা হ’ত তখন তিনি বলতেন, ‘আমি মুহাম্মাদী মাযহাবের’।[28]
২২. হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) সুনানে আবূদাঊদের রচয়িতা ইমাম আবূদাঊদ সিজিস্তানী সুলায়মান বিন আশ‘আছ (মৃঃ ২৭৫ হিঃ)-কে মুক্বাল্লিদদের দল থেকে বের করে মুজতাহিদ মুত্বলাক্ব আখ্যা দিয়েছেন (১৮নং উক্তি দ্রঃ)।
২৩. সুনানে তিরমিযীর রচয়িতা ইমাম আবূ ঈসা মুহাম্মাদ বিন ঈসা বিন সাওরাহ আত-তিরমিযী (মৃঃ ২৭৯ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮নং উক্তি দ্রঃ )।
২৪. সুনানে নাসাঈর লেখক ইমাম আহমাদ বিন শু‘আইব আন-নাসাঈ (মৃঃ ৩০৩ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮নং উক্তি দ্রঃ)।
২৫. সুনানে ইবনে মাজাহর লেখক ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইয়াযীদ বিন মাজাহ আল-ক্বাযবীনী (মৃঃ ২৭৩ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮নং উক্তি দ্রঃ)।
২৬. ইমাম আবূ ইয়া‘লা আহমাদ বিন আলী ইবনুল মুছান্না আল-মূছিলী (মৃঃ ৩০৭ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন। নির্দিষ্ট কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮ নং উক্তি দ্রঃ)।
২৭. আবুবকর আহমাদ বিন আমর বিন আব্দুল খালেক আল-বাযযার আল-বাছরী (সত্যবাদী ও হাসানুল হাদীছ) (মৃঃ ২৯২ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন, তিনি আহলেহাদীছদের মাযহাবের উপরে ছিলেন। নির্দিষ্ট কোন আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (১৮ নং উক্তি দ্রঃ)।
২৮. হাফেয আবু মুহাম্মাদ আলী বিন আহমাদ বিন সাঈদ বিন হাযম আল-আন্দালুসী আল-কুরতুবী (মৃঃ ৪৫৬ হিঃ) তাক্বলীদ সম্পর্কে বলেছেন, والتقليد حرام ... والعامي والعالم في ذلك سواء وعلى كل أحد حظه الذي يقدر عليه من الاجتهاد. ‘তাক্বলীদ হারাম...। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষ ও আলেম সমান। আর প্রত্যেকের উপরে স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী ইজতিহাদ যরূরী’।[29]
হাফেয ইবনু হাযম স্বীয় আক্বীদা সংক্রান্ত গ্রন্থে বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তির জন্য তাক্বলীদ করা বৈধ নয়। চাই জীবিত ব্যক্তির তাক্বলীদ হোক অথবা মৃত ব্যক্তির’।[30]
হাফেয ইবনু হাযম দু‘আ করতে গিয়ে বলেছেন, وأن يعصمنا من بدعة التقليد المحدث بعد القرون الثلاثة المحمودة. آمين، ‘আল্লাহ যেন আমাদেরকে প্রশংসিত তৃতীয় শতকের পরে সৃষ্ট তাক্বলীদের (অর্থাৎ চার মাযহাবের বিদ‘আত) বিদ‘আত থেকে রক্ষা করেন।-আমীন’।[31]
২৯. হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (মৃঃ ৪৬৩ হিঃ) স্বীয় বিখ্যাত গ্রন্থে অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন- باب فساد التقليد ونفيه والفرق بين التقليد والاتباع ‘তাক্বলীদের অপকারিতা ও তার নাকচ হওয়া এবং তাক্বলীদ ও ইত্তিবার মধ্যে পার্থক্য’ অনুচ্ছেদ।[32]
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র-এর মুক্বাল্লিদ হওয়া অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। বরং হাফেয যাহাবী বলেছেন, فإنه ممن بلغ رتبة الأئمة المجتهدين ‘নিশ্চয়ই তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত, যারা মুজতাহিদ ইমামগণের স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন’।[33]
আর এটা সাধারণ মানুষও জানে যে, মুজতাহিদ কখনো মুক্বাল্লিদ হন না (৫ নং উক্তি দ্রঃ)।
হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র আন্দালুসী (রহঃ) স্বয়ং বলেছেন, لا فرق بين مقلد وبهيمة ‘মুক্বাল্লিদ ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই’।[34]
সতর্কীকরণ : হাফেয ইবনু আব্দিল বার্র, খত্বীব বাগদাদী প্রমুখ কতিপয় ইবারতে সাধারণ মানুষের জন্য (জীবিত) আলেমের তাক্বলীদ করাকে জায়েয বলেছেন। যার উদ্দেশ্য স্রেফ এটা যে, মূর্খ ব্যক্তি আলেমের কাছ থেকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করে তার উপরে আমল করবে। আমরাও এটা বলি যে, মূর্খ ব্যক্তির উপরে এটা যরূরী যে, সে কুরআন ও সুন্নাহর ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেমের নিকট থেকে মাসআলা জিজ্ঞাসা করে তার উপরে আমল করবে। কিন্তু এটাকে তাক্বলীদ বলা ভুল। উছূলে ফিক্বহের প্রসিদ্ধ মাসআলা রয়েছে যে, সাধারণ মানুষের মুফতীর (আলেম) দিকে প্রত্যাবর্তন করা তাক্বলীদ নয়।[35]
৩০. আমীরুল মুমিনীন খলীফা আবু ইউসুফ ই‘য়াকূব বিন ইউসুফ বিন আব্দুল মুমিন বিন আলী আল-ক্বায়সী আল-কূমী আল-মার্রাকুশী আয-যাহেরী আল-মাগরেবী (মৃঃ ৫৯৫ হিঃ) স্বীয় সাম্রাজ্যে শরী‘আতের বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করেন, জিহাদের ঝান্ডা বুলন্দ করেন, ন্যায়পরায়ণতার সাথে দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করেন এবং ন্যায়ের মানদন্ড কায়েম করেন।
তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিক ইবনু খাল্লিকান লিখেছেন, ‘তিনি একজন দানশীল বাদশাহ এবং পবিত্র শরী‘আতকে ধারণকারী ছিলেন। তিনি নির্ভয়ে ও পক্ষপাতহীনভাবে সৎ কাজের আদেশ করতেন এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতেন, যেমনটি উচিৎ। তিনি লোকদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত পড়াতেন এবং পশমের পোষাক পরিধান করতেন। নারী ও দুর্বলের পাশে দাঁড়াতেন এবং তাদের হক আদায় করে দিতেন। তিনি অছিয়ত করেন, তাকে যেন রাস্তার মাঝে অর্থাৎ নিকটে দাফন করা হয়। যাতে তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকারীরা তার জন্য রহমতের দো‘আ করে’।[36]
এই মুজাহিদ ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন খলীফা (রহঃ) সম্পর্কে ইবনু খাল্লিকান আরো লিখেছেন, وأمر برفض فروع الفقه، وأن العلماء لا يفتون إلا بالكتاب العزيز والسنة النبوية، ولا يقلدون أحداً من الأئمة المجتهدين المتقدمين، بل تكون أحكامهم بما يؤدي إليه اجتهادهم من استنباطهم القضايا من الكتاب والحديث والإجماع والقياس. ‘তিনি ফিক্বহের শাখা-প্রশাখাগত বিষয়গুলি (মালেকী ফিক্বহের গ্রন্থসমূহ) পরিত্যাগ করতে এবং আলেমগণকে কেবল কুরআন ও হাদীছ দ্বারা ফৎওয়া দেওয়ার আদেশ দেন। আর তারা যেন পূর্ববর্তী মুজতাহিদ ইমামদের মধ্য থেকে কারু তাক্বলীদ না করেন। বরং কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা ইস্তিমবাতের মাধ্যমে ইজতিহাদ দ্বারা যেন তাদের ফায়ছালা হয়’।[37]
ঠিক এটাই হ’ল আহলেহাদীছদের (আহলে সুন্নাত) মানহাজ (পদ্ধতি), মাসলাক (পথ) ও দাওয়াত। আলহামদুল্লিাহ।
আহলেহাদীছদেরকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ইংরেজ আমলের সৃষ্ট আখ্যায়িতকারীরা একটু চোখ খুলে ৬ষ্ঠ হিজরীর এই গায়ের মুক্বাল্লিদ খলীফার জীবনী পড়ুক। যাতে তাদের নযরে কিছু আসে।
এই মুজাহিদ খলীফা সম্পর্কে হাফেয যাহাবী লিখেছেন যে, তিনি মুক্বাল্লিদ সম্পর্কে বলেছেন, কুরআন ও সুনানে আবুদাউদের উপরে আমল কর। নতুবা এই তলোয়ার প্রস্ত্তত রয়েছে’।[38]
হাফেয যাহাবী আরো বলেছেন,وعظم صيت العباد والصالحين في زمانه، وكذلك أهل الحديث، وارتفعت منزلتهم عنده فكان يسألهم الدعاء. وانقطع في أيامه علم الفروع، وخاف منه الفقهاء، وأمر بإحراق كتب المذهب بعد أن يجرد ما فيها من الحديث، فأحرق منها جملة في سائر بلاده، كالمدوَّنة، وكتاب ابن يونس، ونوادر ابن أبي زيد، والتهذيب للبرادعي، والواضحة لابن حبيب. ‘তাঁর আমলে ইবাদতগুযার ও সৎ লোকদের সুখ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনুরূপভাবে আহলেহাদীছদের মর্যাদাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি তাদের (আহলেহাদীছদের) নিকট দো‘আ চাইতেন। তাঁর শাসনামলে প্রশাখাগত ইলমের অবসান হয়েছিল (অর্থাৎ তাক্বীলীদী ফিক্বহ শেষ হয়ে গিয়েছিল)। (মুক্বাল্লিদ) ফক্বীহগণ তাকে ভয় পেতেন। তিনি হাদীছসমূহকে আলাদা করার পরে মাযহাবী গ্রন্থসমূহ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতঃপর সমগ্র দেশে অনেক মাযহাবী গ্রন্থ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। যেমন-আল-মুদাউওয়ানাহ, কিতাবু ইবনে ইউনুস, ইবনু আবী যায়েদের আন-নাওয়াদির, বারাদিঈর আত-তাহযীব ও ইবনু হাবীবের আল-ওয়াযিহাহ’।
قال محيي الدين عبد الواحد بن علي المراكشي في كتاب المعجب له: ولقد كنت بفاس، فشهدت يؤتى بالأحمال منها فتوضع ويطلق فيها النار. মুহিউদ্দীন আব্দুল ওয়াহিদ বিন আলী আল-মার্রাকুশী তার ‘আল-মু‘জাব’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমি ফাস (নগরীতে) ছিলাম। আমি দেখেছি যে, (ফেক্বহী) কেতাবসমূহের বোঝা এনে রাখা হ’ত এবং সেগুলিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হ’ত’।[39]
হে আল্লাহ! এই মুজাহিদ খলীফা ও আমীরুল মুমিনীনকে জান্নাতে উচ্চমর্যাদা নছীব করুন এবং আমাদের গোনাহখাতা মাফ করে স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহে এরূপ ছহীহ আক্বাদীসম্পন্ন মুজাহিদ ও মুমিনদের সাহচর্য দান করুন-আমীন!
৩১. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেছেন, ‘অতঃপর তাদের পরে এমন ব্যক্তিরা আগমন করেছিলেন, যারা তাদের হেদায়াতকে অাঁকড়ে ধরেছেন ও তাদের পথে চলেছেন। যেমন- ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্ত্বান, আব্দুর রহমান বিন মাহদী, বিশর ইবনুল মুফায্যাল, খালেদ ইবনুল হারিছ, আব্দুর রায্যাক, ওয়াকী‘, ইয়াহ্ইয়া বিন আদম, হুমায়েদ বিন আব্দুর রহমান আর-রাওয়াসী, ওয়ালীদ বিন মুসলিম, হুমায়দী, শাফেঈ, ইবনুল মুবারক, হাফছ বিন গিয়াছ, ইয়াহ্ইয়া বিন যাকারিয়া বিন আবু যায়েদাহ, আবুদাঊদ ত্বায়ালিসী, আবুল ওয়ালীদ ত্বায়ালিসী, মুহাম্মাদ বিন আবু ‘আদী, মুহাম্মাদ বিন জা‘ফর, ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহ্ইয়া নিশাপুরী, ইয়াযীদ বিন যুরা‘ই, ইসমাঈল বিন ‘উলাইয়াহ, আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ এবং তার পুত্র আব্দুছ ছামাদ, ওয়াহাব বিন জারীর, আযহার বিন সা‘দ, ‘আফফান বিন মুসলিম, বিশর বিন ওমর, আবূ আছিম আন-নাবীল, মু‘তামির বিন সুলায়মান, নাযর বিন শুমাইল, মুসলিম বিন ইবরাহীম, হাজ্জাজ বিন মিনহাল, আবু ‘আমের আল-আক্বাদী, আব্দুল ওয়াহ্হাব আছ-ছাক্বাফী, ফিরইয়াবী, ওয়াহাব বিন খালিদ, আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের ও অন্যান্যগণ। এঁদের কেউই তাঁদের পূর্বের কোন ইমামের তাক্বলীদ করেননি’ (ما من هؤلاء أحد قلد إماما كان قبله)।[40]
জানা গেল যে, ইমাম আহমাদ, ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী, ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন মাঈন প্রমুখের শিক্ষক, নির্ভরযোগ্য, মুতক্বিন, হাফেয, আদর্শবান ইমাম আবু সা‘ঈদ ইয়াহ্ইয়া বিন সা‘ঈদ বিন ফার্রূখ আল-ক্বাত্তবান আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
ফায়েদা : ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্তবান তাবেঈ সুলায়মান বিন ত্বারখান আত-তায়মী (রহঃ) সম্পর্কে বলেছেন, তিনি আমাদের নিকটে আহলেহাদীছদের অন্তর্ভুক্ত’।[41]
৩২. ছিক্বাহ, ছাবত, হাফেয, রিজাল ও হাদীছের গভীর জ্ঞানসম্পন্ন ইমাম আবু সাঈদ আব্দুর রহমান বিন মাহদী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৮ হিঃ) সুয়ূত্বীর ভাষ্য অনুযায়ী মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৩. ছিক্বাহ, ছাবত, আবেদ, ইমাম আবু ইসমাঈল বিশর ইবনুল মুফায্যাল বিন লাহিক্ব আর-রাক্বাশী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮৬ অথবা ১৮৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৪. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু ওছমান খালেদ ইবনুল হারিছ বিন ওবায়েদ বিন মুসলিম আল-হুজায়মী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮৬ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথা মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৫. জমহূর বিদ্বানগণের নিকট নির্ভরযোগ্য, সত্যবাদী ইমাম আব্দুর রায্যাক বিন হুমাম আছ-ছান‘আনী আল-ইয়ামানী (মৃঃ ২১১ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য অনুযায়ী তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৬. নির্ভরযোগ্য, হাফেয, আবেদ, ইমাম আবু সুফিয়ান ওয়াকী‘ ইবনুল জার্রাহ বিন মুলাইহ আর-রাওয়াসী আল-কূফী (মৃঃ ১৯৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর ভাষ্যমতে তাক্বলীদকারী ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৭. বিশ্বস্ত, হাফেয, ফাযেল, আবু যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া বিন আদম বিন সুলায়মান আল-কূফী (মৃঃ ২০৩ হিঃ) সম্পর্কে সুয়ূত্বী বলেছেন যে, তিনি তাঁর পূর্বের কোন একজন ইমামেরও তাক্বলীদ করেননি (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৮. ছিক্বাহ ইমাম আবু আওফ হুমায়েদ বিন আব্দুর রহমান বিন হুমায়েদ আর-রাওয়াসী আল-কূফী (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথানুসারে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৩৯. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, মুদাল্লিস, ইমাম আবুল আববাস ওয়ালীদ বিন মুসলিম আল-কুরাশী আদ-দিমাশক্বী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪০. ইমাম বুখারীর শিক্ষক ছিক্বাহ, হাফেয, ফক্বীহ, ইমাম আবুবকর আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের বিন ঈসা আল-হুমায়দী আল-মাক্কী (মৃঃ ২১৯ হিঃ) সুয়ূতবীর কথানুসারে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪১. ছিক্বাহ, ছাবত, ফক্বীহ, আলেম, দানশীল, মুজাহিদ, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক আল-মারওয়াযী (মৃঃ ১৮১ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথানুপাতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪২. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ফক্বীহ আবু ওমর হাফছ বিন গিয়াছ বিন ত্বালক্ব বিন মু‘আবিয়া আল-কূফী আল-ক্বাযী (মৃঃ ১৯৫ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্যানুপাতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
সতর্কীকরণ : হাফছ বিন গিয়াছ (রহঃ) বলেছেন,كنت أجلس إلى أبي حنيفة فأسمعه يسأل عن مسألة في اليوم الواحد فيفتي فيها بخمسة أقاويل، فلما رأيت ذلك تركته وأقبلت على الحديث ‘আমি আবু হানীফার কাছে বসতাম। একটি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’লে সে বিষয়ে তাঁকে এক দিনে পাঁচ রকম ফৎওয়া দিতে শুনলাম। যখন আমি এটা দেখলাম, তখন তাকে ত্যাগ করলাম এবং হাদীছের প্রতি মনোনিবেশ করলাম’।[42] ইবরাহীম বিন সাঈদ আল-জাওহারী (রহঃ) থেকে এই বর্ণনার রাবী আবুবকর আহমাদ বিন জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ বিন সালম ছিক্বাহ বা নির্ভরযোগ্য ছিলেন।[43]
আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বল[44] এবং আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়া বিন ওছমান[45] উভয়েই তার মুতাবা‘আত করেছেন। অর্থাৎ তাঁরা উক্ত রেওয়ায়াতকে ইমাম ইবরাহীম বিন সাঈদ আল-জাওহারী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন।
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইমাম হাফছ বিন গিয়াছ আল-কূফী আহলে রায়-এর মাযহাব ছেড়ে আহলেহাদীছদের মাযহাবকে গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর উপরে রহম করুন!
৪৩. ছিক্বাহ, মুতক্বিন, ইমাম আবু সাঈদ ইয়াহ্ইয়া বিন যাকারিয়া বিন আবী যায়েদাহ আল-হামাদানী আল-কূফী (মৃঃ ১৮৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৪. ছিক্বাহ ও সত্যবাদী, হাফেয আবুদাঊদ সুলায়মান বিন দাঊদ ইবনুল জারূদ আত-ত্বায়ালিসী আল-বাছরী (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৫. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবুল ওয়ালীদ হিশাম বিন আব্দুল মালিক আল-বাহিলী আত-ত্বায়ালিসী আল-বাছরী (মৃঃ ২২৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৬. ছিক্বাহ ইমাম আবু ‘আমর মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম বিন আবু ‘আদী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৭. গুনদার নামে পরিচিত নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী, জমহূর যাকে ছিক্বাহ বলেছেন, ইমাম মুহাম্মাদ বিন জা‘ফর আল-হুযালী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৮. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া বিন ইয়াহ্ইয়া বিন বকর বিন আব্দুর রহমান আত-তামীমী আন-নিশাপুরী (মৃঃ ২২৬ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৪৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু মু‘আবিয়া ইয়াযীদ বিন যুরাই‘ আল-বাছরী (মৃঃ ১৮২ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথানুসারে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫০. ইবনু উলাইয়াহ নামে পরিচিত ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবু বিশর ইসমাঈল বিন ইবরাহীম বিন মিক্বসাম আল-আসাদী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৩ হিঃ) সুয়ূতবীর মতানুসারে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫১. ছিক্বাহ, ছাবত, সুন্নী, ইমাম আবু ওবায়দা আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ বিন যাকওয়ান আল-আমবারী আত-তান্নূরী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮০ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
৫২. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবু সাহল আব্দুছ ছামাদ বিন আব্দুল ওয়ারিছ বিন সাঈদ আল-বাছরী (মৃঃ ২০৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৩. ছিক্বাহ, ইমাম আবুল আববাস ওয়াহাব বিন জারীর বিন হাযেম বিন যায়েদ আল-বাছরী আল-আযদী (মৃঃ ২০৬ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৪. ছিক্বাহ ইমাম আবুবকর আযহার বিন সাঈদ আস-সাম্মান আল-বাহেলী আল-বাছরী (মৃঃ ২০৩ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে মুক্বাল্লিদ ছিলেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৫. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু ওছমান ‘আফফান বিন মুসলিম বিন আব্দুল্লাহ আল-বাহেলী আছ-ছাফ্ফার আল-বাছরী (মৃঃ ২১৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো মুক্বাল্লিদ ছিলেন না।
৫৬. ছিক্বাহ, ইমাম আবু মুহাম্মাদ বিশর বিন ওমর ইবনুল হাকাম আয-যাহরানী আল-আযদী আল-বাছরী (মৃঃ ২০৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৭. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু ‘আছেম যাহহাক বিন মাখলাদ বিন যাহ্হাক বিন মুসলিম আশ-শায়বানী আন-নাবীল আল-বাছরী (মৃঃ ২১২ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৮. ছিক্বাহ, ইমাম আবু মুহাম্মাদ মু‘তামির বিন সুলায়মান বিন ত্বারখান আত-তায়মী আল-বাছরী (মৃঃ ১৮৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৫৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবুল হাসান নাযর বিন শুমাইল আল-মাযেনী আল-বাছরী আন-নাহবী (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬০. ছিক্বাহ, ইমাম আবূ আমর মুসলিম বিন ইবরাহীম আল-আযদী আল-ফারাহীদী আল-বাছরী (মৃঃ ২২২ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬১. ছিক্বাহ, ফাযেল, ইমাম আবু মুহাম্মাদ হাজ্জাজ বিন মিনহাল আল-আনমাত্বী আস-সুলামী আল-বাছরী (মৃঃ ২১৭ হিঃ) সুয়ূতবীর মতানুসারে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬২. ছিক্বাহ, ইমাম আবু আমের আব্দুল মালেক বিন আমর আল-ক্বায়সী আল-আক্বাদী (মৃঃ ২০৫ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৩. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন আব্দুল মাজীদ আছ-ছাক্বাফী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯৪ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৪. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইউসুফ বিন ওয়াক্বিদ আয-যাববী আল-ফিরইয়াবী (মৃঃ ২১২ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
ইমাম ফিরইয়াবী নিজের এবং নিজের সাথীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমরা আহলেহাদীছদের একটা জামা‘আত ছিলাম’।[46]
৬৫. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবুবকর ওহায়েব বিন খালেদ বিন আজলান আল-বাহিলী আল-বাছরী (মৃঃ ১৬৫ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
সতর্কীকরণ : মূল কপিতে ওয়াহাব বিন খালেদ লিখিত আছে। যেটি লেখক বা কপিকারীর ভুল বলে অনুমিত হয়। আর যদি এটি ভুল না হয় তাহলে এই ত্বাবাক্বাতে আবু খালেদ বিন ওয়াহাব বিন খালেদ আল-হুমায়রী আল-হিমছী ছিক্বাহ ছিলেন।[47]
৬৬. আহলে সুন্নাতের নির্ভরযোগ্য ইমাম আবু হিশাম আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের আল-কূফী আল-হামাদানী (মৃঃ ১৯৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৭. জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান বিন আবুবকর সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) আরো বলেছেন, ‘অতঃপর তাদের পরে আগমন করেছিলেন আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ, আবু ছাওর, আবু ওবায়েদ, আবু খায়ছামাহ, আবু আইয়ূব আল-হাশেমী, আবু ইসহাক্ব আল-ফাযারী, মাখলাদ ইবনুল হুসায়েন, মুহাম্মাদ বিন ইয়াহ্ইয়া আয-যুহলী, আবু শায়বার পুত্রদ্বয় আবুবকর ও ওছমান, সাঈদ বিন মানছূর, কুতায়বা, মুসাদ্দাদ, ফাযল বিন দুকায়েন, মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না, বুনদার, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের, মুহাম্মাদ ইবনুল ‘আলা, হাসান বিন মুহাম্মাদ আয-যা‘ফারানী, সুলায়মান বিন হারব, ‘আরেম ও তাদের মতো অন্যেরা। ليس منهم أحد قلد رجلاً، وقد شاهدوا من قبلهم ورأوهم فلو رأوا آنفسهم فى سعة من أن يقلدوا دينهم أحدًا منهم لقلّدوا তাদের মধ্যে কেউই কোন ব্যক্তির তাক্বলীদ করনেনি। তারা তাদের পূর্বের লোকদেরকে দেখেছিলেন এবং তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। যদি তারা তাদের দ্বীনে কারো তাক্বলীদ করা জায়েয মনে করতেন, তবে তারা তাদের (পূর্ববর্তীদের) তাক্বলীদ করতেন’।[48]
সুয়ূত্বীর এই সুস্পষ্ট উদ্ধৃতি থেকে প্রতীয়মান হ’ল যে, ইবনু রাহওয়াইহ নামে পরিচিত নির্ভরযোগ্য ইমাম আবু মুহাম্মাদ ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম বিন মাখলাদ আল-হানযালী আল-মারওয়াযী (মৃঃ ২৩৮ হিঃ) মুক্বাল্লিদ ছিলেন না। তার (ইমাম ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ) সম্পর্কে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী লিখেছেন, مجتهد قرين أحمد بن حنبل ‘তিনি মুজতাহিদ, আহমাদ বিন হাম্বলের সাথী’।[49]
৬৮. ছিক্বাহ, ফাযেল, ইমাম আবু ওবায়েদ আল-ক্বাসেম বিন সাল্লাম আল-বাগদাদী (মৃঃ ২২৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্যানুপাতে তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৬৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু খায়ছামাহ যুহায়ের বিন হারব বিন শাদ্দাদ আন-নাসাঈ আল-বাগদাদী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য অনুযায়ী কারো তাক্বলীদ করতেন না (৩১ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭০. ছিক্বাহ, জলীলুল কদর ইমাম আবু আইয়ূব সুলায়মান বিন দাঊদ বিন দাঊদ বিন আলী আল-হাশেমী আল-ফক্বীহ আল-বাগদাদী (মৃঃ ২১৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭১. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবু ইসহাকব ইবরাহীম বিন মুহাম্মাদ ইবনুল হারেছ আল-ফাযারী (মৃঃ ১৮৯ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭২. ছিক্বাহ, ফাযেল, ইমাম আবু মুহাম্মাদ মাখলাদ ইবনুল হুসায়েন আল-মুহাল্লাবী আল-বাছরী (মৃঃ ১৯১ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৩. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইয়াহ্ইয়া বিন আব্দুল্লাহ বিন খালেদ আয-যুহলী আন-নিশাপুরী (মৃঃ ২৬৮ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৪. ছিক্বাহ, হাফেয ইমাম, আবুবকর আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ বিন আবু শায়বাহ ইবরাহীম বিন ওছমান আল-ওয়াসেত্বী আল-কূফী (মৃঃ ২৩৫ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য অনুযায়ী কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৫. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবুল হাসান ওছমান বিন আবী শায়বাহ আল-‘আবসী আল-কূফী (মৃঃ ২৩৯ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না।
৭৬. ছিক্বাহ লেখক, ইমাম আবু ওছমান সা‘ঈদ বিন মানছূর বিন শু‘বাহ আল-খুরাসানী আল-মাক্কী (মৃঃ ২২৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথা মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৭. ছিক্বাহ, ছাবত, সুন্নী, ইমাম আবু রাজা কুতায়বা বিন সা‘ঈদ বিন জামীল আছ-ছাক্বাফী আল-বাগলানী (মৃঃ ২৪০ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
ইমাম কুতায়বা বিন সা‘ঈদ বলেছেন, إذا رأيتَ الرجل يحب أهل الحديث، مثل يحيى بن سعيد القطان، وعبد الرحمن بن مهدي، وأحمد بن حنبل وإسحاق بن راهويه- وذكر قوما آخرين- فإنه على السنة ومن خالف هذا فاعلم أنه مبتدع- ‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে ইয়াহ্ইয়া বিন সা‘ঈদ আল-ক্বাত্তবান, আব্দুর রহমান বিন মাহদী, আহমাদ বিন হাম্বল, ইসহাক বিন রাহওয়াইহ-এর মত (এবং তিনি আরো অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন) আহলেহাদীছদের ভালবাসতে দেখবে তখন জানবে যে, নিশ্চয়ই সে ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে (অর্থাৎ সুন্নী) রয়েছে। আর যে ব্যক্তি তাদের বিরোধিতা করবে, জানবে যে সে বিদ‘আতী’।[1]
ইমাম ইয়াহ্ইয়া আল-ক্বাত্তবান, ইমাম আব্দুর রহমান বিন মাহদী, ইমাম আহমাদ ও ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াইহ এরা সবাই কারো তাক্বলীদ করতেন না (৫, ৩১, ৩২ ও ৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৮. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবুল হাসান মুসাদ্দাদ বিন মুসারহাদ বিন মুসারবাল বিন মুসতাওরিদ আল-আসাদী আল-বাছরী (মৃঃ ২২৮ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৭৯. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু নু‘আইম ফযল বিন দুকায়েন ‘আমর বিন হাম্মাদ আত-তায়মী আল-মুলাঈ আল-কূফী (মৃঃ ২১৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর কথামতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮০. ছিক্বাহ, ছাবত, ইমাম আবু মূসা মুহাম্মাদ ইবনুল মুছান্না বিন ওবায়েদ আল-বাছরী আল-আনাযী (মৃঃ ২৫২ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮১. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবুবকর মুহাম্মাদ বিন বাশ্শার বিন ওছমান আল-‘আবদী আল-বাছরী ওরফে বুনদার (মৃঃ ২৫২ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮২. ছিক্বাহ, হাফেয, ফাযেল, ইমাম আবু আব্দুর রহমান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন নুমায়ের আল-হামাদানী আল-কূফী (মৃঃ ২৩৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৩. ছিক্বাহ, হাফেয, ইমাম আবু কুরাইব মুহাম্মাদ ইবনুল ‘আলা বিন কুরাইব আল-হামাদানী আল-কূফী (মৃঃ ২৪৭ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৪. ইমাম শাফে‘ঈর শিষ্য, ছিক্বাহ, ইমাম আবু আলী হাসান বিন মুহাম্মাদ ইবনুছ ছাবাহ আয-যা‘ফারানী আল-বাগদাদী (মৃঃ ২৬০ হিঃ) সুয়ূতবীর কথামতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৫. ছিক্বাহ, ইমাম, হাফেয সুলায়মান বিন হারব আল-আযদী আল-বাছরী আল-ওয়াশিহী (মৃঃ ২২৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৬. ছিক্বাহ, সত্যবাদী, ইমাম আবুন নু‘মান মুহাম্মাদ ইবনুল ফযল আস-সাদূসী আল-বাছরী ওরফে ‘আরিম (মৃঃ ২২৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর বক্তব্য মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৬৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
ফায়েদা : ইমাম আবুন নু‘মান সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, تغير قبل موته فما حدَّث ‘মৃত্যুর পূর্বে তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। তবে তিনি (এ অবস্থায়) কোন হাদীছ বর্ণনা করেননি’।[2]
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইমাম আবুন নু‘মানের বর্ণনাসমূহের উপরে ইখতিলাত্বের অভিযোগ ভুল ও প্রত্যাখ্যাত ।
৮৭. জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (সম্ভবতঃ হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী থেকে উদ্ধৃত করতে গিয়ে) বলেছেন,ولم أجد أحدًا ممن يوصف بالعلم قديمًا وحديثًا يستجيز التقليد ولا يأمر به وكذلك ابن وهب وابن الماجشون والمغيرة بن أبى حازم ومطرف وابن كنانة لم يقلّدوا شيخهم مالكًا فى كل ما قال : بل خالفوه فى مواضع واختاروا غير قوله- ‘আমি প্রাচীন ও আধুনিক যুগের কোন আলেমকে পাইনি, যিনি তাক্বলীদকে জায়েয বলেন এবং এ ব্যাপারে হুকুম দেন। অনুরূপভাবে ইবনু ওয়াহাব, ইবনুল মাজিশূন, মুগীরাহ বিন আবু হাযিম, মুত্বাররিফ ও (ওছমান বিন ঈসা) ইবনু কিনানাহ তাদের শিক্ষক মালেক-এর প্রত্যেকটি কথার তাক্বলীদ করেননি। বরং অনেক জায়গায় তারা তাঁর বিরোধিতা করেছেন এবং অন্যের বক্তব্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন’।[3]
জানা গেল যে, (সত্যপরায়ণ ইমাম) আবু মারওয়ান আব্দুল মালেক বিন আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন আবু সালামাহ আল-মাজিশূন আল-কুরাশী আত-তায়মী আল-মাদানী (মৃঃ ২১৩ হিঃ) সুয়ূত্বীর দৃষ্টিতে তাক্বলীদ করতেন না।
সতর্কীকরণ : মূলে মুগীরাহ বিন আবু হাযেম আছে। অথচ সঠিক হ’ল মুগীরাহ ও ইবনু আবী হাযেম। যেমনটি ইবনু হাযমের জাওয়ামিউস সীরাহ (১/৩২৬ পৃঃ) থেকে প্রতীয়মান হয়। মুগীরাহ দ্বারা উদ্দেশ্য ইবনু আব্দুর রহমান আল-মাখযূমী এবং ইবনু আবী হাযেম দ্বারা উদ্দেশ্য আব্দুল আযীয।
৮৮. সত্যবাদী, ফক্বীহ, মুগীরাহ বিন আব্দুর রহমান ইবনুল হারিছ বিন আব্দুল্লাহ বিন ‘আইয়াশ আল-মাখযূমী আল-মাদানী (মৃঃ ১৮৮ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে কারো তাক্বলীদ করতেন না (৮৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৮৯. সত্যবাদী, ফক্বীহ, আব্দুল আযীয বিন আবু হাযেম আল-মাদানী (মৃঃ ১৮৪ হিঃ) সুয়ূত্বীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৮৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৯০. ইমাম মালেকের ভাগ্নে, নির্ভরযোগ্য ইমাম আবু মুছ‘আব মুত্বাররিফ বিন আব্দুল্লাহ বিন মুত্বাররিফ আল-ইয়াসারী আল-মাদানী (মৃঃ ২২০ হিঃ) সুয়ূতবীর মতে তাক্বলীদ করতেন না (৮৭ নং উক্তি দ্রঃ)।
৯১. হাফেয ইবনু হাযম আন্দালুসী বলেছেন,ثم أصحاب الشافعي، وكانوا مجتهدين غير مقلدين كأبي يعقوب البويطي وإسماعيل بن يحيى المزني- ‘অতঃপর ইমাম শাফে‘ঈর ছাত্রগণ। তারা মুজতাহিদ ও গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন। যেমন- আবু ইয়াকূব আল-বুওয়ায়ত্বী ও ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মুযানী’।[4]
প্রতীয়মান হ’ল যে, ইবনু হাযমের নিকটে ইমাম শাফে‘ঈ (রহঃ)-এর শিষ্য আবু ইয়াকূব ইউসুফ বিন ইয়াহ্ইয়া আল-মিছরী আল-বুওয়ায়ত্বী (নির্ভরযোগ্য ইমাম, ফক্বীহদের সর্দার, মৃঃ ২৩১ হিঃ) গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন।
৯২. ছিক্বাহ, ইমাম, ফক্বীহ আবু ইবরাহীম ইসমাঈল বিন ইয়াহ্ইয়া বিন ইসমাঈল আল-মুযানী আল-মিসরী (মৃঃ ২৬৪ হিঃ) ইবনু হাযমের কথামতে গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন (৪ ও ৯১ নং উক্তি দ্রঃ)।
আবু আলী আহমাদ বিন আলী ইবনুল হাসান বিন শু‘আইব বিন যিয়াদ আল-মাদায়েনী (মৃঃ ৩২৭ হিঃ) হাসানুল হাদীছ। জমহূর তাকে ছিক্বাহ বলেছেন। তিনি স্বীয় শিক্ষক ইমাম মুযানী (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাক্বলীদের ফায়ছালা করে তাকে বলা যায়, তোমার ফায়ছালার কোন দলীল কি তোমার কাছে আছে? যদি সে বলে, হ্যাঁ, তাহ’লে সে তাক্বলীদকে বাতিল করে দিল। কেননা দলীল সেই ফায়ছালাকে তার নিকটে আবশ্যক করেছে, তাক্বলীদ নয়। আর যদি সে বলে, দলীল ছাড়া। তবে তাকে বলা যায়, তাহ’লে তুমি কিসের জন্য রক্ত প্রবাহিত করেছ, লজ্জাস্থানকে হালাল করে দিয়েছ এবং সম্পদসমূহ নষ্ট করেছ? অথচ আল্লাহ তোমার উপরে এসব হারাম করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তুমি দলীল ছাড়াই তা হালাল করে দিলে’?[5]
এই দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে ইমাম মুযানী অত্যন্ত সুন্দর ও সাধারণের বোধগম্য পদ্ধতিতে তাক্বলীদকে বাতিল সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন!
৯৩. মালাকাহর খতীব আল্লামা আবু মুহাম্মাদ আব্দুল আযীম বিন আব্দুল্লাহ বিন আবুল হাজ্জাজ ইবনুশ শায়খ বালাবী (মৃঃ ৬৬৬ হিঃ) সম্পর্কে হাফেয যাহাবী এবং খলীল বিন আয়বাক আছ-ছাফাদী দু’জনেই বলেছেন, وله اختيارات لا يقلد فيها أحدا- ‘তার নির্দিষ্ট কিছু মাসআলা ছিল। সেগুলোতে তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না’।[6]
৯৪. সুয়ূত্বী হাফেয ইবনু হাযম থেকে বর্ণনা করেছেন, ومن آخر ما أدركنا على ذلك شيخنا أبو عمر الطلمنكى فما كان يقلّد أحدًا وذهب إلى قول الشافعي فى بعض المسائل والآن محمد بن عوف لايقلّد أحدًا وقال بقول الشافعي فى بعض المسائل- ‘আমরা তাক্বলীদ না করার উপর সর্বশেষ যাদেরকে পেয়েছি তাদের মধ্যে আমাদের উস্তাদ আবু ওমর আত-ত্বলামানকী রয়েছেন। তিনি কারো তাক্বলীদ করতেন না। তিনি কতিপয় মাসআলায় শাফে‘ঈর মতাবলম্বন করেছেন। আর বর্তমানে রয়েছেন মুহাম্মাদ বিন ‘আওফ, যিনি কারো তাক্বলীদ করেন না। তিনি কতিপয় মাসআলায় শাফে‘ঈর কথামত ফৎওয়া দিয়েছেন’।[7]
প্রমাণিত হ’ল যে, ছিক্বাহ, ইমাম, হাফেয আবু ওমর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-মু‘আফিরী আল-আন্দালুসী আত-ত্বলামানকী (মৃঃ ৪২৯ হিঃ) হাফেয ইবনু হাযমের দৃষ্টিতে কারো তাক্বলীদ করতেন না।
ইমাম ত্বলামানকী সম্পর্কে হাফেয যাহাবী বলেছেন, الإمام المقرئ المحقق المحدث الحافظ الأثري- ‘তিনি ইমাম, ক্বারী, মুহাক্কিক, মুহাদ্দিছ, (হাদীছের) হাফেয ও আছারী’।[8]
৯৫. কতিপয় হানাফী ও গায়ের হানাফী ফক্বীহ আবু বকর আল-ক্বাফফাল, আবু আলী এবং ক্বাযী হুসায়েন থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তারা বলেছেন,لسنا مقلّدين للشافعي بل وافق رأينا رأيه- ‘আমরা শাফে‘ঈর মুক্বাল্লিদ নই। বরং আমাদের
মত তাঁর মতের সাথে মিলে গিয়েছে’।[9]
জানা গেল যে, (এই আলেমদের নিকটে) আল্লামা আবু বকর আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ আল-ক্বাফফাল আল-মারওয়াযী আল-খুরাসানী আশ-শাফে‘ঈ (মৃঃ ৪১৭ হিঃ) মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।
৯৬. পূর্বের উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা প্রমাণিত রয়েছে যে, ক্বাযী আবু আলী হুসায়েন আল-মারওয়াযী আশ-শাফে‘ঈ (মৃঃ ৪৬২ হিঃ) মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না (৯৫ নং উক্তি দ্রঃ)।
৯৭. আবু আলী আল-হাসান (আল-হুসায়েন) বিন মুহাম্মাদ বিন শু‘আইব আস-সিনজী আল-মারওয়াযী আশ-শাফে‘ঈ (মৃঃ ৪৩২ হিঃ) মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না (৯৫ নং উক্তি দ্রঃ)।
প্রতীয়মান হ’ল যে, যে সকল আলেমকে শাফে‘ঈ বলা হয়, তারা তাদের ঘোষণা এবং সাক্ষ্য অনুযায়ী মুক্বাল্লিদদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।[10]
৯৮. শায়খুল ইসলাম হাফেয তাক্বিউদ্দীন আবুল আববাস আহমাদ বিন আব্দুল হালীম আল-হার্রানী ওরফে ইবনু তায়মিয়াহ (মৃঃ ৭২৮ হিঃ) বলেছেন, إنَّمَا أَتَنَاوَلُ مَا أَتَنَاوَلُهُ مِنْهَا عَلَى مَعْرِفَتِي بِمَذْهَبِ أَحْمَدَ، لَا عَلَى تَقْلِيدِي لَهُ- ‘আহমাদের মাযহাব হ’তে আমি কেবলমাত্র ঐ বিষয়গুলি গ্রহণ করি, যেগুলি আমার জানা আছে। আমি তার তাকবলীদ করি না’।[11]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ বলেছেন, ‘যদি কেউ এটা বলে যে, সাধারণ মানুষের উপর অমুক অমুকের তাক্বলীদ ওয়াজিব, তাহ’লে এটা কোন মুসলমানের কথা নয়’।[12]
তিনি আরো বলেন, ‘কোন একজন মুসলমানের উপরেও আলেমদের মধ্য হ’তে কোন একজন নির্দিষ্ট আলেমের সকল কথায় তাক্বলীদ ওয়াজিব নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির মাযহাবকে অাঁকড়ে ধরা কোন একজন মুসলমানের উপর ওয়াজিব নয় যে, সব বিষয়ে তারই আনুগত্য শুরু করে দিবে’।[13]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ সম্পর্কে তার ছাত্র হাফেয যাহাবী বলেছেন, المجتهد المفسر ‘তিনি একজন মুফাসসির ও মুজতাহিদ’।[14]
৯৯. হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিইয়াহ (মৃঃ ৭৫১ হিঃ) তাক্বলীদের খন্ডনে ‘ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন ‘আন রবিবল ‘আলামীন’ নামে একটি জবরদস্ত কিতাব লিখেছেন এবং বলেছেন, وَإِنَّمَا حَدَثَتْ هَذِهِ الْبِدْعَةُ فِي الْقَرْنِ الرَّابِعِ الْمَذْمُومِ عَلَى لِسَانِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আর (তাক্বলীদের) এই বিদ‘আত চতুর্থ হিজরীতে আবিষ্কৃত হয়েছে। যেটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যবানে নিন্দিত’।[15]
আহলেহাদীছদের নিকটে সালাফে ছালেহীনের ঐক্যমত পোষণকৃত বুঝের আলোকে কুরআন, হাদীছ ও ইজমার উপরে আমল হওয়া উচিত। আর তাক্বলীদ জায়েয নয়। যেহেতু হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িমও এই মাসলাকেরই প্রবক্তা ও আমলকারী ছিলেন, সেহেতু যাফর আহমাদ থানবী দেওবন্দী স্বীয় খাছ দেওবন্দী ধাঁচে বলেছেন,لأنا رأينا أن ابن القيم الذى هو الأب لنوع هذه الفرقة- ‘কেননা আমরা দেখেছি যে, ইবনুল ক্বাইয়িমই হ’লেন এই ধরনের (অর্থাৎ আহলেহাদীছ) ফিরক্বার জনক’।[16]
১০০. হাফেয আবূ আব্দুল্লাহ শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন ওছমান আয-যাহাবী (মৃঃ ৭৪৮ হিঃ) বহু জায়গায় স্পষ্টভাবে তাক্বলীদের বিরোধিতা করেছেন এবং বলেছেন,
وكل إمام يؤخذ من قوله ويُترك إلا إمام المتقين الصادق المصدوق الأمين المعصوم صلوات الله وسلامه عليه، فيا لله العجب من عالم يقلد دينه إماما بعينه في كل ما قال مع علمه بما يرد على مذهب إمامه من النصوص النبوية فلا قوة إلا بالله-
‘মুত্তাকীদের নেতা, সত্যবাদী, সত্যায়নকৃত, বিশ্বস্ত, নিষ্পাপ নবী (ছাঃ) ব্যতীত প্রত্যেক ইমামের কথা গ্রহণ ও বর্জন করা যায়। আল্লাহর কসম! এটা আশ্চর্যজনক যে, একজন আলেম তার দ্বীনের ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট ইমামের প্রত্যেক কথায় তাক্বলীদ করে। অথচ সে জানে যে, ছহীহ হাদীছসমূহ তার ইমামের মাযহাবকে বাতিল করে দেয়। অতঃপর নেই কোন শক্তি আল্লাহ ব্যতীত’।[17]
হাফেয যাহাবীর উক্তির শেষে ‘(লা হাওলা) ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ লেখা একথার দলীল যে, তাঁর নিকটে তাক্বলীদ একটি শয়তানী কাজ। এজন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা তিনি আমাদেরকে এই শয়তানী কাজ থেকে সর্বদা রক্ষা করুন! আমীন!! (১১নং উক্তি দ্রঃ)।
আমরা আমাদের দাবী এবং তাক্বলীদ শব্দের শর্ত অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর একশ (১০০) আলেমের এমন উদ্ধৃতিসমূহ পেশ করেছি, যারা স্পষ্টভাবে তাক্বলীদ করতেন না অথবা তাক্বলীদের বিরোধী ছিলেন। আমাদের জানা মতে কোন একজন বিশ্বস্ত, সত্যবাদী, ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য ইমাম থেকে প্রচলিত তাক্বলীদের আবশ্যকতা অথবা এর উপরে আমল প্রমাণিত নেই। আর দুনিয়ার কোন ব্যক্তি এই গবেষণার বিপরীতে কোন নির্ভরযোগ্য ইমাম থেকে তাক্বলীদের অপরিহার্যতা বা এর উপরে আমলের একটি উদ্ধৃতিও পেশ করতে পারবে না। وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا ‘যদিও তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৮৮)। আল-হামদুলিল্লাহ।
সতর্কীকরণ : একশ উদ্ধৃতিসমৃদ্ধ এই গবেষণার উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে, এই প্রবন্ধে যে সকল আলেমের উল্লেখ নেই বা নাম নেই, তারা তাক্বলীদ করতেন। বরং তাক্বলীদের নিষিদ্ধতার উপরে তো খায়রূল কুরূনের (স্বর্ণ যুগ) ইজমা রয়েছে।[18]
এরা ছাড়া আরো অনেক আলেমও ছিলেন, যাদের থেকে সুস্পষ্টভাবে তাক্বলীদ শব্দ প্রয়োগের সাথে সাথে এর (তাক্বলীদ) নিষিদ্ধতা ও প্রত্যাখ্যান প্রমাণিত রয়েছে। যেমন-
(১) জালালুদ্দীন সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) তাক্বলীদের খন্ডনে ‘আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল ‘আরয ওয়া জাহেলা ‘আন্নাল ইজতিহাদা ফী কুল্লি আছরিন ফারয’ (الرد على من أخلد إلى الأرض وجهل أن الاجتهاد فى كل عصر فرض) শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন এবং এতে باب فساد التقليد ‘তাক্বলীদের ফিতনা’ অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন। আর হাফেয ইবনু হাযম থেকে সমর্থনমূলকভাবে উদ্ধৃত করেছেন যে, التقليد حرام ‘তাক্বলীদ হারাম’ (ঐ, পৃঃ ১৩১)।
সুয়ূত্বী তাঁর অন্য একটি গ্রন্থে বলেছেন,
والذى يجب أن يقال : كل من انتسب إلى إمام غير رسول الله صلى الله عليه وسلم يوالى على ذلك ويعادى عليه فهو مبتدع خارج عن السنة والجماعة سواء كان فى الأصول أو الفروع-
‘এটা বলা ওয়াজিব (ফরয) যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন ইমামের দিকে সম্বন্ধিত হয়ে যায় এবং এই সম্বন্ধকরণের উপর সে বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা পোষণ করে, তবে সে বিদ‘আতী এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ। চাই (এই সম্বন্ধ) মূলনীতিতে হোক বা শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে হোক’।[19]
(২) যায়লাঈ (মৃঃ ৭৪৩ হিঃ/১৩৪৩ খ্রিঃ) হানাফী (!) বলেছেন, فالمقلد ذهل والمقلد جهل ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ মূর্খতা করে’।[20]
(৩) বদরুদ্দীন ‘আয়নী (৭৬২-৮৫৫ হিঃ) হানাফী (!) বলেছেন,فالمقلد ذهل والمقلد جهل وآفة كل شيء من التقليد- ‘মুক্বাল্লিদ ভুল করে এবং মুক্বাল্লিদ মূর্খতা করে। আর তাক্বলীদের কারণে সকল বস্ত্তর বিপদ’।[21]
(৪) ইমাম ত্বাহাবী (২৩৮-৩২১ হিঃ) হানাফী (!) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, وهل يقلد إلا عصبي أو غبي ‘গোঁড়া ও আহম্মক ব্যতীত কেউ তাক্বলীদ করে কি’?[22]
(৫) আবূ হাফছ ইবনুল মুলাক্কিন (মৃঃ ৮০৪ হিঃ) বলেছেন,وغالب ذلك إنما يقع (من) التقليد، ونحن (براء منه) بحمد الله ومنه- ‘সাধারণতঃ তাক্বলীদের কারণে এমন কথাবার্তা হয়। আর আমরা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর অনুগ্রহের সাথে তা থেকে মুক্ত’।[23]
(৬) আবূ যায়েদ কাযী ওবায়দুল্লাহ আদ-দাবূসী (মৃঃ ৪৩০ হিঃ/১০৩৯ খ্রিঃ) হানাফী (!) বলেছেন, ‘তাক্বলীদের সারমর্ম এই যে, মুক্বাল্লিদ নিজেকে চতুষ্পদ জন্তুর সাথে একাকার করে দেয়...। যদি মুক্বাল্লিদ নিজেকে এজন্য জন্তু বানিয়ে নিয়েছে যে, সে বিবেক ও অনুভূতি শূন্য। তাহ’লে তার (মস্তিষ্কের) চিকিৎসা করানো উচিৎ’।[24]
(৭) বড় আলেম, শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের বিন মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া বিন মুহাম্মাদ আমীন আল-আববাসী আস-সালাফী এলাহাবাদী (মৃঃ ১১৬৪ হিঃ) তাক্বলীদ করতেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের দলীলের উপরে আমল করতেন এবং নিজে ইজতিহাদ করতেন।[25]
তিনি (ফাখের এলাহাবাদী) বলেছেন, জমহূর-এর নিকটে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের তাক্বলীদ করা জায়েয নেই। বরং ইজতিহাদ ওয়াজিব...। তাক্বলীদের বিদ‘আত হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে সৃষ্টি হয়েছে’।[26]
আলেম কুরআন, হাদীছ, ইজমা ও সালাফে ছালেহীনের আছার দ্বারা ইজতিহাদ করবেন। অন্যদিকে জাহেলের ইজতিহাদ এই যে, সে ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেমের কাছ থেকে কুরআন ও হাদীছের মাসআলাগুলি জিজ্ঞাসা করে সেগুলির উপর আমল করবে। আর এটা তাক্বলীদ নয়।
(৮) আবুবকর অথবা আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ ওরফে ইবনু খুওয়াইয মিনদাদ আল-বাছরী আল-মালেকী (হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর শেষে মৃত) বলেছেন,
اَلتَّقْلِيْدُ مَعْنَاهُ فِي الشَّرْعِ الرُّجُوْعُ إِلَى قَوْلٍ لاَ حُجَّةَ لِقَائِلِهِ عَلَيْهِ، وَهَذَا مَمْنُوْعٌ مِنْهُ فِي الشَّرِيْعَةِ، وَالِاتِّبَاعُ مَا ثَبَتَ عَلَيْهِ حُجَّةٌ-
‘শরী‘আতে তাক্বলীদের অর্থ হ’ল, এমন ব্যক্তির কথার দিকে ধাবিত হওয়া যে বিষয়ে তার কোন দলীল নেই। আর এটি শরী‘আতে নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে ইত্তেবা হ’ল যেটি দলীল দ্বারা সাব্যস্ত’।[27]
সতর্কীকরণ : হাফেয ইবনু আব্দুল বার্র এই উক্তিটি উল্লেখ করেছেন এবং কোন প্রত্যুত্তর দেননি। সুতরাং প্রতীয়মান হ’ল যে, এটি ইবনু খুওয়াইয মিনদাদের অপ্রচলিত উক্তিসমূহের মধ্য হ’তে নয়।[28]
(৯) সমকালীনদের মধ্য থেকে ইয়েমনের প্রসিদ্ধ শায়খ মুক্ববিল বিন হাদী আল-ওয়াদি‘ঈ বলেছেন, ‘তাক্বলীদ হারাম। কোন মুসলমানের জন্য জায়েয নয় যে, সে আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে (কারো) তাক্বলীদ করবে’।[29]
(১০) সঊদী আরবের প্রধান বিচারপতি (পরে গ্র্যান্ড মুফতী) শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (১৯১৩-১৯৯৯ খ্রিঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রশংসা যে আমি গোঁড়া নই। তবে আমি কুরআন ও হাদীছ অনুযায়ী ফায়ছালা করি। আমার ফৎওয়া সমূহের ভিত্তি ‘আল্লাহ বলেছেন’ এবং রাসূল বলেছেন’-এর উপর। হাম্বলী বা অন্যদের তাক্বলীদের উপরে নয়’।[30]
(১১) ইবনুল জাওযীর তাক্বলীদ না করার ব্যাপারে দেখুন তাঁর ‘আল-মুশকিলু মিন হাদীছিছ ছহীহায়েন’ (১/৮৩৩) গ্রন্থটি এবং মাসিক ‘আল-হাদীছ’ (হাযরো), ৭৩ সংখ্যা।
ব্রেলভীদের পীর সুলতান বাহূ বলেছেন, ‘চাবি হ’ল সরাসরি সংঘবদ্ধতা। আর তাক্বলীদ হ’ল অসংঘবদ্ধতা এবং পেরেশানী। বরং তাক্বলীদপন্থী জাহিল এবং পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট হয়ে থাকে’।[31]
সুলতান বাহূ আরো বলেছেন, ‘তাওহীদপন্থীরা হেদায়াতপ্রাপ্ত, সাহায্যপ্রাপ্ত এবং তাহকীককারী হয়। তাক্বলীদপন্থীরা দুনিয়াদার, অভিযোগকারী এবং মুশরিক হয়’।[32]
একশটি উদ্ধৃতির মধ্যে উল্লেখিত আলেমগণ এবং পরে উল্লেখিতদের মোকাবেলায় দেওবন্দী ও ব্রেলভী ফিরক্বার আলেমরা এটা বলেন যে, তাক্বলীদ ওয়াজিব এবং অতীত কালের আলেমগণ মুক্বাল্লিদ ছিলেন।
এই তাক্বলীদপন্থীদের চারটি উদ্ধৃতি এবং শেষে সেগুলির জবাব পেশ করা হ’ল-
(১) মুহাম্মাদ ক্বাসেম নানূতুভী দেওবন্দী (১২৪৮-১২৯৭ হিঃ) বলেছেন, ‘দ্বিতীয় এই যে, আমি ইমাম আবূ হানীফার মুক্বাল্লিদ। এজন্য আমার বিপরীতে আপনি যে কথাই বিরোধিতা স্বরূপ পেশ করবেন সেটা ইমাম আবূ হানীফার হতে হবে। এ কথা আমার উপর হুজ্জাত (দলীল) হবে না যে, শামী এটা লিখেছেন এবং দুর্রে মুখতার গ্রন্থকার এটা বলেছেন। আমি তাদের মুক্বাল্লিদ নই’।[33]
(২) মাহমূদ হাসান দেওবন্দী (১২৬৮-১৩৩৯ হিঃ) একটি মাসআলা সম্পর্কে বলেছেন, ‘হক ও ইনছাফ এই যে, এই মাসআলায় শাফে‘ঈর মত অগ্রগণ্য। আর আমরা মুক্বাল্লিদ। আমাদের উপর আমাদের ইমাম আবূ হানীফার তাক্বলীদ ওয়াজিব। আল্লাহই ভালো জানেন’।[34]
(৩) আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী (১২৭২-১৩৪০ হিঃ)أجلى الأعلام أن الفتوى مطلقا على قول الإمام শিরোনামে একটি পুস্তিকা লিখেছেন। যার অর্থ ‘ফৎওয়া কেবলমাত্র ইমাম আবূ হানীফার কথার উপরেই হবে’!
তাক্বলীদ সম্পর্কে মিথ্যা বলতে গিয়ে এবং ধোঁকা দিতে গিয়ে আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী বলেছেন, ‘বিশেষতঃ তাক্বলীদের মাসআলায় তাদের মাযহাব অনুযায়ী এগারোশ বছরের আইম্মায়ে দ্বীন, কামেল আলেম-ওলামা এবং আওলিয়ায়ে আরিফীন (আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন) সবাই মুশরিক আখ্যা পাচ্ছেন। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই’।[35]
(৪) আহমাদ ইয়ার নাঈমী ব্রেলভী বলেছেন, ‘আমাদের দলীল এই বর্ণনাগুলি নয়। আমাদের আসল দলীল তো ইমামে আযম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর আদেশ’।[36]
নিবেদন রইল যে, এগারোশ বছরে কোন একজন ছিক্বাহ ও ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন আলেম থেকে আপনাদের প্রচলিত তাক্বলীদের আবশ্যকতা অথবা বৈধতার কথা বা কর্মে কোন প্রমাণ নেই। আমার পক্ষ থেকে সকল দেওবন্দী ও ব্রেলভীকে চ্যালেঞ্জ থাকল যে, এই গবেষণামূলক প্রবন্ধে উল্লেখিত একশটি নির্ভরযোগ্য উদ্ধৃতির মোকাবেলায় খায়রুল কুরূনের ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সালাফে ছালেহীন থেকে স্রেফ দশটি উদ্ধৃতি পেশ করুক। যেখানে এটি লিখিত আছে যে, মুসলমানদের উপরে চাই তারা (আলেম হোক বা সাধারণ মানুষ) ইমাম চতুষ্টয় (ইমাম আবূ হানীফা, মালেক, শাফে‘ঈ ও আহমাদ)-এর মধ্য থেকে স্রেফ একজনের তাক্বলীদ ওয়াজিব এবং অবশিষ্ট তিনজনের (তাক্বলীদ) হারাম। আর মুক্বাল্লিদের জন্য এটা জায়েয নয় যে, সে স্বীয় ইমামের কথাকে বর্জন করে কুরআন ও হাদীছের উপর আমল করবে। যদি থাকে তবে উদ্ধৃতি পেশ করুক।
আর যদি এমন কোন প্রমাণ না থাকে এবং আদৌ নেই। বরং আমার উল্লেখিত উদ্ধৃতিসমূহ এই বানোয়াট তাক্বলীদী মূর্তিকে টুকরো টুকরো করে ধ্বংস করে দিয়েছে। অতএব এগারো শত বছরের আলেমদের নাম বলে মিথ্যা ভয় দেখাবেন না। খায়রুল কুরূনের সকল সালাফে ছালেহীনের ইজমা এবং পরবর্তী জমহূর সালাফে ছালেহীনের তাক্বলীদ বিরোধিতা এবং খন্ডন করা এ কথার দলীল যে, এই মাসআলাটি (তাক্বলীদ করা) সালাফে ছালেহীনের একেবারেই বিপরীত। যদি প্রচলিত তাক্বলীদকে ওয়াজিব বলা হয় তাহলে কুরআন, হাদীছ ও ইজমার বিরোধিতা করার সাথে সাথে চৌদ্দশত বছরের সালাফে ছালেহীনের বিরোধিতা এবং খন্ডন আবশ্যক হয়ে যায়। যা মূলতঃ বাতিল। অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ।
কতিপয় ফায়েদা :
(১) আল্লামা সুয়ূত্বী (মৃঃ ৯১১ হিঃ) বলেছেন, والذى يجب أن يقال : كل من انتسب إلى إمام غير رسول الله صلى الله عليه وسلم يوالى على ذلك ويعادى عليه فهو مبتدع خارج عن السنة والجماعة سواء كان فى الأصول أو الفروع- ‘এটা বলা ওয়াজিব (ফরয) যে, প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত অন্য কোন ইমামের দিকে সম্বন্ধিত হয়ে যায় এবং এই সম্বন্ধকরণের উপর সে বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা পোষণ করে, তবে সে বিদ‘আতী এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত থেকে খারিজ। চাই (এই সম্বন্ধ) মূলনীতিতে হোক বা শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে হোক’।[37]
(২) ইমাম হাকাম বিন উতায়বা (মৃঃ ১১৫ হিঃ) বলেছেন, لَيْسَ أَحَدٌ مِنْ خَلْقِ اللهِ إِلَّا يُؤْخَذُ مِنْ قَوْلِهِ وَيُتْرَكُ إِلَّا النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘নবী (ছাঃ) ব্যতীত আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে এমন কেউ নেই যার কথা গ্রহণ বা বর্জন করা যাবে’।[38]
আহলেহাদীছ কখন থেকে আছে আর দেওবন্দী ও ব্রেলভী মতবাদের সূচনা কখন হয়েছে :
প্রশ্ন : আমরা এটা শুনতে থাকি যে, আহলেহাদীছগণ ইংরেজদের আমলে শুরু হয়েছে। পূর্বে এদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। দয়া করে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের অতীতকালের আহলেহাদীছ আলেমদের নাম সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ লিখবেন। ধন্যবাদ। -মুহাম্মাদ ফাইয়ায দামানভী, ব্রাডফোর্ড, ইংল্যান্ড।
জবাব : যেভাবে আরবী ভাষায় ‘আহলুস সুন্নাহ’ অর্থ সুন্নাতপন্থী, সেভাবে আহলুল হাদীছ অর্থ হাদীছপন্থী। যেভাবে সুন্নাতপন্থী দ্বারা ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সুন্নী ওলামা এবং তাদের অনুসারী ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণকে বুঝায়, সেভাবে হাদীছপন্থী দ্বারা ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দেছীনে কেরাম এবং তাদের অনুসারী ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন সাধারণ জনগণকে বুঝায়।
স্মর্তব্য যে, আহলে সুনণাত এবং আহলেহাদীছ একই দলের দু’টি গুণবাচক নাম মাত্র। ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দেছীনে কেরামের কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। যেমন-
(১) ছাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)। (২) তাবেঈনে এযাম (রহঃ)। (৩) তাবে তাবেঈন। (৪) আতবা‘এ তাবে তাবেঈন (তাবে তাবেঈন-এর শিষ্যগণ)। (৫) হাদীছের হাফেযগণ। (৬) হাদীছের রাবীগণ। (৭) হাদীছের ব্যাখ্যাকারীগণ এবং অন্যান্যগণ। আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন!
ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন জনগণের কয়েকটি শ্রেণী রয়েছে। যেমন-
(১) উচ্চশিক্ষিত। (২) মধ্যম শিক্ষিত। (৩) সামান্য শিক্ষিত এবং (৪) নিরক্ষর সাধারণ মানুষ।
এই সর্বমোট এগারোটি (৭+৪) শ্রেণীকে আহলেহাদীছ বলা হয়। আর তাদের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনগুলি নিম্নরূপ-
১. কুরআন, হাদীছ ও ইজমায়ে উম্মতের উপরে আমল করা।
২. কুরআন, হাদীছ ও ইজমার বিপরীতে কারো কথা না মানা।
৩. তাক্বলীদ না করা।
৪. আল্লাহ তা‘আলাকে সাত আসমানের ঊর্ধ্বে স্বীয় আরশের উপরে সমুন্নীত হিসাবে মানা। যেটি তাঁর মর্যাদার উপযোগী সেভাবে।
৫. ঈমানের অর্থ হৃদয়ে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি এবং কর্মে বাস্তবায়ন।
৬. ঈমানের হরাস-বৃদ্ধির আক্বীদা পোষণ করা।
৭. কুরআন ও হাদীছকে সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী অনুধাবন করা এবং এর বিপরীতে সকলের কথা প্রত্যাখ্যান করা।
৮. সকল ছাহাবী, নির্ভরযোগ্য ও সত্যবাদী তাবেঈন, তাবে তাবেঈন, আতবা‘এ তাবে তাবেঈন এবং সকল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুহাদ্দিছগণের প্রতি ভালবাসা পোষণ করা ইত্যাদি।
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (৬৬১-৭২৮ হিঃ) বলেছেন, صَاحِبُ الْحَدِيثِ عِنْدَنَا مَنْ يَسْتَعْمِلُ الْحَدِيثَ ‘আমাদের নিকটে আহলেহাদীছ ঐ ব্যক্তি যিনি হাদীছের উপরে আমল করেন’।[39]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮) বলেছেন,
وَنَحْنُ لَا نَعْنِي بِأَهْلِ الْحَدِيثِ الْمُقْتَصِرِينَ عَلَى سَمَاعِهِ أَوْ كِتَابَتِهِ أَوْ رِوَايَتِهِ بَلْ نَعْنِي بِهِمْ: كُلَّ مَنْ كَانَ أَحَقَّ بِحِفْظِهِ وَمَعْرِفَتِهِ وَفَهْمِهِ ظَاهِرًا وَبَاطِنًا وَاتِّبَاعِهِ بَاطِنًا وَظَاهِرًا-
‘আমরা আহলেহাদীছ বলতে কেবল তাদেরকেই বুঝি না যারা হাদীছ শুনেছেন, লিপিবদ্ধ করেছেন বা বর্ণনা করেছেন। বরং আমরা আহলেহাদীছ দ্বারা ঐ সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকি, যারা হাদীছ মুখস্থকরণ এবং গোপন ও প্রকাশ্যভাবে তার জ্ঞান লাভ ও অনুধাবন এবং অনুসরণ করার অধিক হকদার’।[40]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহর উল্লেখিত উক্তি থেকেও আহলেহাদীছ-এর (আল্লাহ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন) দু’টি শ্রেণী সাব্যস্ত হয় :
১. হাদীছের প্রতি আমলকারী মুহাদ্দেছীনে কেরাম।
২. হাদীছের উপরে আমলকারী সাধারণ জনগণ।
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ আরো বলেছেন,
وَبِهَذَا يَتَبَيَّنُ أَنَّ أَحَقَّ النَّاسِ بِأَنْ تَكُونَ هِيَ الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ أَهْلُ الْحَدِيثِ وَالسُّنَّةِ؛ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ مَتْبُوعٌ يَتَعَصَّبُونَ لَهُ إلَّا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-
‘আর এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয় যে, লোকদের মধ্য হ’তে নাজাতপ্রাপ্ত ফিরক্বা হওয়ার সবচাইতে বেশী হকদার হ’ল আহলেহাদীছ ও আহলে সুন্নাহ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ব্যতীত তাদের এমন কোন অনুসরণীয় ব্যক্তি (ইমাম) নেই, যার জন্য তারা পক্ষপাতিত্ব করে’।[41]
হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হিঃ)يَوْمَ نَدْعُو كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ ‘যেদিন আমরা ডাকব প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতা সহ’ (ইসরা ৭১) আয়াতের ব্যাখ্যায় কতিপয় সালাফ (ছালেহীন) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,هَذَا أَكْبَرُ شَرَفٍ لِأَصْحَابِ الْحَدِيثِ لِأَنَّ إِمَامَهُمُ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘আহলেহাদীছদের জন্য এটাই সর্বোচ্চ মর্যাদা যে, তাদের একমাত্র ইমাম হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)’।[42] তাদেরকে ক্বিয়ামতের দিন তাদের ইমামের নামে ডাকা হবে।
সুয়ূত্বীও (৮৪৯-৯১১ হিঃ) লিখেছেন,لَيْسَ لِأَهْلِ الْحَدِيثِ مَنْقَبَةٌ أَشْرَفَ مِنْ ذَلِكَ لِأَنَّهُ لَا إِمَامَ لَهُمْ غَيْرُهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- ‘আহলেহাদীছদের জন্য এর চাইতে অধিক
মর্যাদাপূর্ণ আর কিছুই নেই। কেননা মুহাম্মাদ (ছাঃ) ছাড়া
তাদের আর কোন ইমাম নেই’।[43]
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারী এবং ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী ও অন্যান্যগণ (আল্লাহ তাদের উপর রহম করুন) আহলুল হাদীছদেরকে ‘ত্বায়েফাহ মানছূরাহ’ অর্থাৎ সাহায্যপ্রাপ্ত দল হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।[44]
ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের নির্ভরযোগ্য উস্তাদ ইমাম আহমাদ বিন সিনান আল-ওয়াসিত্বী (রহঃ) বলেছেন, ‘দুনিয়াতে এমন কোন বিদ‘আতী নেই, যে আহলেহাদীছদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে না’।[45]
ইমাম কুতায়বা বিন সাঈদ আছ-ছাক্বাফী (মৃঃ ২৪০ হিঃ, বয়স ৯০ বছর) বলেছেন, ‘যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখবে যে সে আহলুল হাদীছের প্রতি ভালবাসা পোষণ করে তখন (বুঝে নিবে যে) এই ব্যক্তি সুন্নাতের উপরে আছে’।[46]
হাফেয ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) লিখেছেন, ‘মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, ইবনু খুযায়মাহ, আবু ইয়া‘লা, বাযযার প্রমুখ আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে ছিলেন। তারা কোন নির্দিষ্ট আলেমের মুক্বাল্লিদ ছিলেন না...’।[47]
উপরোল্লেখিত বক্তব্যসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হ’ল যে, আহলেহাদীছ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল দু’টি দল-
(ক) ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন ও গায়ের মুক্বাল্লিদ সালাফে ছালেহীন ও সম্মানিত মুহাদ্দিছগণ।
(খ) সালাফে ছালেহীন ও সম্মানিত মুহাদ্দিছগণের (অনুসারী) ছহীহ আক্বীদাসম্পন্ন এবং গায়ের মুক্বাল্লিদ সাধারণ জনগণ।
লেখক তার একটি গবেষণা প্রবন্ধে শতাধিক ওলামায়ে ইসলামের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। যারা তাক্বলীদ করতেন না। তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের নাম নিম্নরূপ : ইমাম মালেক, ইমাম শাফে‘ঈ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম ইয়াহ্ইয়া বিন সাঈদ আল-ক্বাত্ত্বান, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূদাঊদ আস-সিজিস্তানী, ইমাম তিরমিযী, ইমাম ইবনু মাজাহ, ইমাম নাসাঈ, ইমাম আবুবকর ইবনু আবী শায়বাহ, ইমাম আবূদাঊদ আত্ব-ত্বায়ালিসী, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবায়ের আল-হুমায়দী, ইমাম আবূ ওবায়েদ আল-ক্বাসেম বিন সাল্লাম, ইমাম সাঈদ বিন মানছূর, ইমাম বাক্বী বিন মাখলাদ, ইমাম মুসাদ্দাদ, ইমাম আবূ ই‘য়ালা আল-মূছিলী, ইমাম ইবনু খুযায়মাহ, ইমাম যুহলী, ইমাম ইসহাক্ব বিন রাহওয়াইহ, মুহাদ্দিছ বায্যার, মুহাদ্দিছ ইবনুল মুনযির, ইমাম ইবনু জারীর ত্বাবারী, ইমাম সুলতান ইয়াকূব বিন ইউসুফ আল-মার্রাকুশী আল-মুজাহিদ ও অন্যান্যগণ। তাদের সবার উপরে আল্লাহ রহম করুন! এ সকল আহলেহাদীছ আলেমগণ শত শত বছর পূর্বে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
আবূ মানছূর আব্দুল ক্বাহির বিন তাহের আল-বাগদাদী সিরিয়া, জাযীরাহ (আরব উপদ্বীপ), আযারবাইজান, বাবুল আবওয়াব (মধ্য তুর্কিস্তান) প্রভৃতি সীমান্তের অধিবাসীদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘তারা সকলেই আহলে সুন্নাত-এর অন্তর্ভুক্ত আহলেহাদীছ মাযহাবের উপরে আছেন’।[48]
আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ ইবনুল বান্না আল-বিশারী আল-মাক্বদেসী (মৃঃ ৩৮০ হিঃ) মুলতান সম্পর্কে বলেছেন,مذاهبهم : أكثرهم أصحاب حديث ‘তাদের মাযহাব হ’ল তারা অধিকাংশ আছহাবুল হাদীছ’।[49]
১৮৬৭ সালে দেওবন্দ মাদরাসা শুরুর মাধ্যমে দেওবন্দী ফিরক্বার সূচনা হয়েছে। আর ব্রেলভী ফিরক্বার প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ রেযা খান ব্রেলভী ১৮৫৬ সালের জুনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
১. দেওবন্দী ও ব্রেলভী ফিরক্বা দু’টির জন্মের বহু পূর্বে শায়খ মুহাম্মাদ ফাখের বিন মুহাম্মাদ ইয়াহ্ইয়া বিন মুহাম্মাদ আমীন আল-আববাসী আস-সালাফী এলাহাবাদী (১১৬৪ হিঃ/১৭৫১ইং) তাক্বলীদ করতেন না। বরং কুরআন ও হাদীছের দলীলসমূহের উপরে আমল করতেন এবং নিজে ইজতিহাদ করতেন।[50]
২. শায়খ মুহাম্মাদ হায়াত বিন ইবরাহীম আস-সিন্ধী আল-মাদানী (১১৬৩ হিঃ/১৭৫০ইং) তাক্বলীদ করতেন না এবং তিনি আমল বিল-হাদীছ তথা হাদীছের উপরে আমলের প্রবক্তা ছিলেন।
মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধী, মুহাম্মাদ ফাখের এলাহাবাদী এবং আব্দুর রহমান মুবারকপুরী তিনজন সম্পর্কে মাস্টার আমীন উকাড়বী [নাভির নীচে হাত বাঁধার হাদীছের আলোচনা প্রসঙ্গে] লিখেছেন, ‘এই তিন গায়ের মুক্বাল্লিদ ব্যতীত কোন হানাফী, শাফে‘ঈ, মালেকী, হাম্বলী এটাকে লেখকের ভুলও বলেননি’।[51]
৩. আবুল হাসান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল হাদী আস-সিন্ধী আল-কাবীর (মৃঃ ১১৪১ হিঃ/১৭২৯ ইং) সম্পর্কে আমীন উকাড়বী লিখেছেন, ‘মূলতঃ এই আবুল হাসান সিন্ধী গায়ের মুক্বাল্লিদ ছিলেন’।[52]
এসব উদ্ধৃতি হিন্দুস্তানের উপরে ইংরেজদের দখলদারিত্ব কায়েমের বহু পূর্বের। এজন্য আপনি যাদের কাছ থেকে এটা শুনেছেন যে, ‘আহলেহাদীছগণ ইংরেজদের আমলে সৃষ্টি হয়েছে, এর আগে এদের কোন নাম-গন্ধ ছিল না’ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অপবাদ।
রশীদ আহমাদ লুধিয়ানবী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘কাছাকাছি দ্বিতীয়-তৃতীয় হিজরী শতকে হকপন্থীদের মাঝে শাখা-প্রশাখাগত মাসআলা সমূহের সমাধানকল্পে সৃষ্ট মতভেদের প্রেক্ষিতে পাঁচটি মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ চার মাযহাব ও আহলেহাদীছ। তৎকালীন সময় থেকে অদ্যাবধি উক্ত পাঁচটি তরীকার মধ্যেই হক সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে মনে করা হয়’।[53]
এই উক্তিতে লুধিয়ানবী ছাহেব আহলেহাদীছদের প্রাচীন হওয়া, ইংরেজদের আমলের বহু পূর্বে থেকে বিদ্যমান থাকা এবং হকপন্থী হওয়া স্বীকার করেছেন।
হাজী ইমদাদুল্লাহ মাক্কীর রূপক খলীফা মুহাম্মাদ আনওয়ারুল্লাহ ফারূক্বী ‘ফযীলত জঙ্গ’ লিখেছেন, ‘বস্ত্ততঃ সকল ছাহাবী আহলেহাদীছ ছিলেন’।[54]
মুহাম্মাদ ইদরীস কান্ধলবী দেওবন্দী লিখেছেন, ‘আহলেহাদীছ তো ছিলেন সকল ছাহাবী’।[55]
আমার পক্ষ থেকে সকল দেওবন্দী ও ব্রেলভীর নিকট জিজ্ঞাসা, ঊনবিংশ বা বিংশ ঈসায়ী শতকের (অর্থাৎ ইংরেজদের হিন্দুস্তান দখলের আমল) পূর্বে কি দেওবন্দী বা ব্রেলভী মতবাদের মানুষ বিদ্যমান ছিল? যদি থাকে তাহ’লে স্রেফ একটি ছহীহ ও স্পষ্ট উদ্ধৃতি পেশ করুক। আর যদি না থেকে থাকে তাহ’লে প্রমাণিত হ’ল যে, ব্রেলভী ও দেওবন্দী মাযহাব উভয়টিই হিন্দুস্তানের উপর ইংরেজদের দখলদারিত্ব কায়েমের পরে সৃষ্ট। অমা ‘আলায়না ইল্লাল বালাগ।
(১৪ই ফেব্রুয়ারী ২০১২ইং)।
\ সমাপ্ত \
[1]. খতীব বাগদাদী, শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, সনদ ছহীহ।
[2]. যাহাবী, আল-কাশিফ, ৩/৭৯, রাবী নং ৫১৯৭।
[3]. সুয়ূত্বী, আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩৭।
[4]. জাওয়ামিউস সীরাহ, ১/৩৩৩।
[5]. খতীব বাগদাদী, আল-ফক্বীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ, ২/৬৯-৭০, সনদ হাসান।
[6]. তারীখুল ইসলাম, ৪৯/২২৬; আল-ওয়াফী বিল-অফায়াত, ১৯/১২।
[7]. আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩৮।
[8]. সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ১৭/৫৬৭; উপরন্তু দেখুন : ৭ নং উক্তি।
[9]. দেখুন : আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী, আন-নাফে‘উল কাবীর লিমায়ঁ য়ুতালি‘উ আল-জামে‘ আছ-ছাগীর, পৃঃ ৭; তাক্বরীরাতুর রাফি‘ঈ, ১/১১; আত্ব-তাক্বরীর ওয়াত-তাহবীর, ৩/৪৫৩।
[10]. উপরন্তু দেখুন : সুবকী, ত্বাবাক্বাতুশ শাফেঈয়াহ আল-কুবরা, ২/৭৮, মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ইবনুল মুনযির আন-নিশাপুরী-এর জীবনী এবং ১১ নং উক্তি দ্রঃ।
[11]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২৪১-২৪২।
[12]. ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২২/২৪৯।
[13]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/২০৯; আরো দেখুন : দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪০।
[14]. তাযকিরাতুল হুফফায, ৪/১৪৯৬; হা/১১৭৫।
[15]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০৮; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩২।
[16]. ই‘লাউস সুনান, ২০/৮, শিরোনাম : ‘আদ-দ্বীনুল ক্বাইয়িম’; আরো দেখুন : ১নং উক্তির আগের ভূমিকা।
[17]. তাযকিরাতুল হুফফায, ১/১৬ , আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর জীবনী দ্রঃ।
[18]. দেখুন : আর-রাদ্দু ‘আলা মান উখলিদা ইলাল আরয, পৃঃ ১৩১-১৩২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৩৪-৩৫।
[19]. আল-কানযুল মাদফূন ওয়াল ফুলকুল মাশহূন, পৃঃ ১৪৯; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪০-৪১।
[20]. নাছবুর রায়াহ, ১/২১৯।
[21]. আল-বিনায়া শরহে হিদায়া, ১/৩১৭।
[22]. লিসানুল মীযান, ১/২৮০।
[23]. আল-বাদরুল মুনীর ফী তাখরীজিল আহাদীছ ওয়াল -আছার আল-ওয়াকি‘আহ ফিশ-শারহিল কাবীর, ১/২৯৩।
[24]. তাক্ববীমুল আদিল্লাহ ফী উছূলিল ফিক্বহ, পৃঃ ৩৯০; মাসিক ‘আল-হাদীছ’, হাযরো, সংখ্যা ২২, পৃঃ ১৬।
[25]. দেখুন : নুযহাতুল খাওয়াতির, ৬/৩৫০, ক্রমিক নং ৬৩৬।
[26]. রিসালাহ নাজাতিয়াহ, পৃঃ ৪১-৪২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪১।
[27]. জামে‘উ বায়ানিল ইলম ওয়া ফাযলিহী, পৃঃ ২৩১।
[28]. দেখুন : লিসানুল মীযান, ৫/২৯৬।
[29]. তুহফাতুল মুজীব আলা আসইলাতিল হাযির ওয়াল গারীব, পৃঃ ২০৫; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪৩।
[30]. আল-ইক্বনা‘, পৃঃ ৯২; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪৩।
[31]. তাওফীকুল হেদায়াত, পৃঃ ২০, প্রগ্রেসিভ বুক্স, লাহোর।
[32]. ঐ, পৃঃ ১৬৭।
[33]. সাওয়ানিহে ক্বাসেমী, ২/২২।
[34]. তাক্বরীরে তিরমিযী, পৃঃ ৩৬; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ২৪।
[35]. ফাতাওয়া রিযভিয়াহ, ১১/৩৮৭।
[36]. জাআল হাক্ব, ২/৯১, কুনূতে নাযেলাহ, ২য় অনুচ্ছেদ।
[37]. আল-কানযুল মাদফূন ওয়াল ফুলকুল মাশহূন, পৃঃ ১৪৯; দ্বীন মেঁ তাক্বলীদ কা মাসআলা, পৃঃ ৪০-৪১।
[38]. জামে‘উ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহী, ২/৯১, ২য় সংস্করণ, ২/১১২, ৩য় সংস্করণ, ২/১৮১, সনদ হাসান লি-যাতিহী।
[39]. খত্বীব, আল-জামে‘, হা/১৮৬, সনদ ছহীহ।
[40]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ৪/৯৫।
[41]. ঐ, ৩/৩৪৭।
[42]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/১৬৪।
[43]. তাদরীবুর রাবী, ২/১২৬, ২৭তম প্রকার।
[44]. দেখুন : হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, হা/২; ইবনু হাজার আসক্বালানী একে ছহীহ বলেছেন (ফাৎহুল বারী, ১৩/২৯৩, হা/৭৩১১-এর অধীনে); খত্বীব বাগদাদী, মাসআলাতুল ইহতিজাজ বিশ-শাফেঈ, পৃঃ ৪৭; সুনানে তিরমিযী, আরেযাতুল আহওয়াযী সহ, ৯/৪৭, হা/২২২৯।
[45]. হাকেম, মা‘রিফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৪, সনদ ছহীহ।
[46]. শারফু আছহাবিল হাদীছ, হা/১৪৩, সনদ ছহীহ। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : আমার গ্রন্থ তাহক্বীক্বী মাক্বালাত (১/১৬১-১৭৪)।
[47]. মাজমূ‘ ফাতাওয়া, ২০/৩৯-৪০; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ১/১৬৮।
[48]. উছূলুদ্দীন, পৃঃ ৩১৭।
[49]. আহসানুত তাক্বাসীম ফী মা‘রিফাতিল আক্বালীম, পৃঃ ৪৮১।
[50]. দেখুন : নুযহাতুল খওয়াতির, ৬/৩৫১; তাহক্বীক্বী মাক্বালাত, ২/৫৮।
[51]. তাজাল্লিয়াতে ছফদর, ২/২৪৩, আরো দেখুন : ঐ ৫/৩৫৫।
[52]. ঐ, ৬/৪৪।
[53]. আহসানুল ফাতাওয়া, ১/৩১৬।
[54]. হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, ২য় খন্ড (করাচী : ইদারাতুল কুরআন ওয়াল উলূম আল-ইসলামিয়াহ), পৃঃ ২২৮।
[55]. ইজতিহাদ আওর তাক্বলীদ কী বেমিছাল তাহক্বীক্ব, পৃঃ ৪৮।
মূল - শায়েখ যুবায়ের আলী যাঈ
উপমহাদেশে কারা প্রাচীন আহলুল হাদিস নাকি দেওবন্দী ব্রেরলভী -কারা ইংরেজদের শাসনামলে সৃষ্টি?!! - http://www.bdeditor.net/blog/blogdetail/detail/11281/saaaa/76293#.VyYZzTEdwdU
আহলে হাদিস মানে মুহাদ্দিসীন, প্রচলিত আহলে হাদিস ফিরকা নয়। এরকম ধোঁকাবাজি করে দলের প্রচার করাটা খুবি হাস্যকর।
উত্তরমুছুন