লালন ফকির - বিকৃত যৌনাচারী অভিনব যোগী
মুসলমান নামধারী বাউল,মারফতী বা নেড়ার পীর-ফকীরদের সাধন পদ্ধতি বৈষ্ণবদের মতোই অশালীন । এ ফকীরের দল বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। যথা আউল, বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়া প্রভৃতি। এগুলি হচ্ছে হিন্দু বৈষ্ণব ও চৈতন্য সম্প্রদায়ের মুসলিম সংস্করণ যাতে করে সাধারণ অজ্ঞ মুসলমানদেরকে বিপথগামী করা যায়।
এদের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। মদ্য পান, নারীপুরুষে অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়েরই সাধনপদ্ধতির মধ্যে অনিবার্যরূপে শামিল।
মওলানা আকরাম খাঁ তাঁর রচিত মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস গ্রন্থে এসব বাউলদের সম্পর্কে বলেনঃ
“কোরআন মজিদের বিভিন্ন শব্দ ও মূলতত্বের যে ব্যাখ্যা এই সমস্ত শয়তান নেড়ার ফকীরের দল দিয়াছে, তাহাও অদ্ভুত। ‘হাওজে কাওসার’ বলিতে তারা বেহেশতী সঞ্জীবনী সুধার পরিবর্তে স্ত্রীলোকের রজঃ বা ঋতুশ্রাব বুঝে। যে পূজাপদ্ধতিতে এ ঘৃণ্য ফকীরের দল বীর্য পান করে, তাহার সূচনায় বীজ মে আল্লাহ (মায়াযাল্লাহ, মায়াযাল্লাহ) অর্থাৎ বীর্যে আল্লাহ অবস্থান করেন –এই অর্থে ‘বিসমিল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করে থাকে।
“এই মুসলিম ভিক্ষোপবীজী নেড়ার ফকীর দলের পুরোহিত বা পীরেরা শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপিনীদের বস্ত্র হরণের অনুরূপ এক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে ।
(মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস-মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ । )
ড. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন,
“ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
বাউলরা ওহী বা ঐশী ভিত্তিক কোন ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থাকে স্বীকার করে না । তারা দেশ জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে কেবল মানুষকে জানতে,মানতে ও শ্রদ্ধা জানাতে চায় । মানুষের ভিতর মনের মানুষকে খুঁজে পেতে চায় ।
শ্রী চৈতন্যকে বৈষ্ণব সমাজ শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে, এমনকি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণরূপে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। গোটা হিন্দু সমাজের মধ্যে শ্রীচৈতন্য এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন।
স্যার যদুনাথ সরকার বলেনঃ
“এ এমন এক সময় যখন প্রভু গৌরাংগের প্রতীক স্বরূপ বাংগালীর মনের পূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাঁর প্রেম ও ক্ষমার বাণী সমগ্র ভারতকে বিমোহিত করে। বাংগালীর হৃদয়মন সকল বন্ধন ছিন্ন করে রাধাকৃষ্ণের লীলা গীতিকার দ্বারা সম্মোহিত হয়। বৈষ্ণব ধর্মের আবেগ অনুভূতিতে, কাব্যে, গানে, সামাজিক সহনশীলতা এবং ধর্মীয় অনুরাগে মনের উচ্ছ্বাস পরবর্তী দেড় শতাব্দী যাবত অব্যাহত গতিতে চলে। এ হিন্দু রেনেসাঁ এবং হোসেন শাহী বংশ ওতপ্রোত জড়িত। এ যুগে বৈষ্ণব ধর্মের এবং বাংলা সাহিত্যের যে উন্নতি অগ্রততি হয়েছিল তা অনুধাবন করতে গেলে গৌড়ের মুসলমান প্রভুর উদার ও সংস্কৃতি সম্পন্ন শাসনের কথা অবশ্যই মনে পড়ে”।
‘যদুনাথ সরকার, দি হিষ্ট্রী অব বেঙল, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৪৭)
প্রকৃতপক্ষে চৈতণ্যের আবির্ভাবের উদ্দেশ্য কি ছিল, তা তাঁর নিজের কথায় আমরা সুস্পষ্টরূপে জানতে পারি। চৈতন্য চরিতামৃত আদি লীলা, ১২০ পৃষ্ঠায় তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন-
“পাষণ্ডি সংহারিতে মোর এই অবতার।
পাষণ্ডি সংহারি ভক্তি করিমু প্রচার”।
এখন বুঝা গেল পাষণ্ডি সংহার করাই তাঁর জীবনের আসল লক্ষ্য। ইতিহাস আলোচনা করলে জানা যায়, মুসলমানগণ বাংলা অধিকার করার সময় বৌদ্ধ মতবাদ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের যে বিপুলসংখ্যক লোক এদেশে বাস করতো, ব্রাহ্মগণ তাদেঁরকে ধর্মের আশ্রয়ে আনতে অস্বীকার করেন। তার ফলে তারা বৈষ্ণব সমাজে প্রবেশ করতে থাকে। তাহলে এদেশে হিন্দু, বৈষ্ণব সমাজ ও মুসলমান ব্যতীত সে সময়ে আর কোন ধর্মাবলম্বীর অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে পাষণ্ডি ছিল কারা যাদের সংহারের জন্যে চৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল?
মওলানা আকরাম খাঁ বলেনঃ
“মনুর মতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী অহিন্দু মাত্রই এই পর্যায়ভুক্ত (সরল বাংলা অভিধান)। আভিধানিক সুবল চন্দ্র মিত্র তাঁহার Beng-Eng Dictionary তে পাষন্ডি শব্দের অর্তে বলিতেছেন- “Not conforming himself to the tenets Vedas: Atheistic. Jaina or Buddha. A non-Hindu –বেদ অমান্যকারী, অন্য বর্ণের চিহ্নধারী এবং অহিন্দু –পাষন্ডির এই তিনটি বিশ্লেষণ সর্বত্র প্রতত্ত হইয়াছে”।
এখন পাষন্ডি বলতে যে একমাত্র মুসলমানদেরকেই বুঝায়, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ রইলো না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, সত্য সত্যই কি চৈতন্য পাষন্ডি তথা মুসলমানদেরকে এদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে পেরেছিলেন? আপাতঃদৃষ্টিতে দেখা যায়, চৈতন্যের সমসাময়িক সুলতান হোসেন শাহের পরেও এদেশে কয়েক শতাব্দী পর্যণ্ত মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু হোসেন শাহ কর্তৃক চৈতন্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ ও বৈষ্ণব সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সাহায্য সহযোগিতার দ্বারা মুসলমানদের আকীদাহ বিশ্বাসের মধ্যে শির্ক বিদয়াতের যে আবর্জনা জমে উঠেছিল তা-ই পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ হয়।
আজকে ফরহাদ মজহার একটি পোষ্ট দিয়েছেন ফেসবুকে । এর সাথে উপরে উল্লিখিত বক্তব্যের সাযুজ্য দেখুন । ফরহাদ মজহার আমাদের কোথায় নিতে চান?
"এবার ছেঁউড়িয়া, কুষ্টিয়ায় ( বা নদিয়ায় ) গৌর পূর্ণিমার সাধুসঙ্গ ও উৎসব হবে। নবপ্রাণ আখড়াবাড়ি যথারীতি ফকির লালন শাহের প্রবর্তিত গৌরপূর্ণিমার তিথি মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এবারের বিষয়ঃ 'আপন ঘরের খবর নে না'।
ফকির লালন শাহ শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবকে স্মরণীয় রাখার জন্য তাঁর জীবদ্দশায় ফাল্গুনি পূর্ণিমায় যে সাধুসঙ্গ প্রবর্তন করেছেন তার তাৎপর্য দুর্দান্ত।
কৃষ্ণ পুরাণে ভগবান, কিন্তু তিনি মানুষ লীলা করবার জন্য ভবে অবতীর্ণ হয়েছেন। স্বয়ং ঈশ্বর এরপর থেকে আর পুরাণ, কল্পনা, বেদ, শাস্ত্র বা বুদ্ধির নির্মাণ হয়ে রইলেন না, রক্তমাংসের মানুষ হিশাবে 'অবতরণ' করলেন। চৈতন্য তাই 'অবতার'। একই কারণে 'কলিযুগে মানুষই অবতার'। কারন ঈশ্বর এখন মানুষের ইতিহাস হবেন এবং মানুষের মধ্য দিয়ে নিজেকে নিজে 'আস্বাদন' করবেন। তিনি পুরাণের কেচ্ছা হয়ে থাকবেন না।
এরপর থেকে ঈশ্বরকে বুঝতে হলে 'মানুষ'কে বুঝতে হবে। মানুষের বিবর্তন ও ইতিহাস বুঝতে হবে। মানুষ ভজনাই তাই নদীয়ার ফকিরি ধ্যান ও চর্চার কেন্দ্রীয় বিষয়। হোসেন শাহের বাংলায় প্রথম ফকির হিশাবে চৈতন্য নদীয়ায় হাজির হলেন। ফাল্গুনি পূর্ণিমা চৈতন্যের কারণে 'গৌরপূর্ণিমা' নামে বাংলায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত হোল। ফকির লালন শাহের বিখ্যাত সাধুসঙ্গও সেই জন্য গৌরপূর্ণিমার তিথি মেনে শুরু হয়, তিথি মেনে শেষ হয়।
পুরানে ভগবান ছিলেন 'কৃষ্ণ', অর্থাৎ ঘোর কালো। কিন্তু নদিয়ায় সাধন গুণে তিনি 'গৌর' বা ফর্শা হলেন। কি সাধনে কালো 'গোরা' হোল নদিয়ার ফকিরি তত্ত্বের এটাই গোড়ার জিজ্ঞাসা। অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ বহিরঙ্গে রাধার ভেদবিচারের মধ্য দিয়ে এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে হবে। ফকিরি ভাষায় তার আরেক নাম 'নিহেতু প্রেম'। যে ভালবাসার কোন হেতু নাই।
অপরের প্রতি নিঃশর্ত প্রেমের অপর নামই ফকিরি। কিন্তু ডুগি-তবলা বাজিয়ে নেচেকুঁদে গান করা, মাজার পূজা, গাঁজা-ভাঙ নেশাকে দম সাধনা বলা আর বড় বড় মালা পরে ফকির-সন্যাসীর বেশ ধরে ঘুরে বেড়ানোকে ফকিরি বলে না। নিহেতু প্রেমের সামাজিক-রাজনৈতিক চর্চার রূপ আছে। কিন্তু এক ধরণের মাজারি চর্চা ও বাউলগিরি নদীয়ার ফকির লালন শাহের ধারাকে অস্পষ্ট ও ম্লান করে দিচ্ছে। লালন নিজেকে কোত্থাও 'বাউল' বলেন নি। কিন্তু তাঁকে সুফি, বাউল ইত্যাদি বানিয়ে তিনি যা পরিহার ও বিরোধিতা করে গিয়েছেন সেটাই তার নামে চালানো হয়। মড়ার ওপর খাঁড়া হেনে কল্লা কাটার মতো লালনের ধাম এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যা কিছু রেশ অবশিষ্ট তাকে রক্ষা করা ভীষণ কঠিন হয়ে গিয়েছে।
তিনটি দিক মনে রাখলে নদিয়ার ভাবচর্চার সামাজিক-রাজনৈতিক রূপ আমরা মোটামুটি বুঝতে পারি। প্রথমত কঠোর ভাবে জাতপাতের বিরোধিতা, দ্বিতীয়ত ধনি গরিব ভেদের বিরোধিতা -- বিশেষত যে ব্যবস্থা মানুষকে ধনি গরিবে বিভক্ত করে সেই ব্যবস্থাকে মেনে না নেওয়া। এবং তৃতীয়ত নারী-পুরুষ ভেদ অস্বীকার করা।
নারী-পুরুষ ভেদ অস্বীকার করতে হবে কেন? কারণ লিঙ্গ দিয়ে 'মানুষ' চেনা যায় না, শুধু জীব কি করে নিজেকে নিজে জীব হিশাবে পয়দা করে কেবল সেটাই বোঝা যায়। এই জানাবোঝার মানে প্রকৃতিকে বোঝা। 'প্রকৃতি' নদীয়ার ধারণা অনুযায়ী স্থির বা অচল কোন বিষয় না, বরং চলমান প্রক্রিয়া, বিবর্তন বা প্রাকৃতিকতা। সব মানুষই প্রকৃতি কারণ তারা প্রাকৃতিক বিবর্তনের অন্তর্গত। জীবের জন্মমৃত্যু আছে। বায়লজিকাল পুরুষকে আলাদা ভাবে বুঝলে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বোঝা যায় না। তাই ভজনা করতে হবে বা বুঝতে হবে মাকে 'মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা'। মাকে চিনলে বাপকে চেনা যায়। নদীয়া এই দিক থেকে প্রকৃতিবাদী -- অর্থাৎ প্রক্রিয়াবাদিও বটে:
"পুরুষ পরওয়ারদিগার
অঙ্গে ছিল প্রকৃতি তার
প্রকৃতি প্রকৃত সংসার সৃষ্টি সবজনা
মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা।
তাহলে মনুষ্যকুলের চ্যালেঞ্জ কি? সেটা নিশ্চয়ই জীব হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া নয় জীবাবস্থা অতিক্রম করে মানুষের মধ্যে যে বিপুল সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে তার বিকাশ ঘটানো। সেই জন্য নদীয়ারা হাহাকার:
কতো কোটি লক্ষ যোনি
ভ্রমণ করেছ তুমি
মানব জন্মে মনরে তুমি
কি করিলে কি করিলে কি করিলে?
আর কি হবে এমন জনম বসব সাধুর মেলে!!
যারা এবার সাধুসঙ্গ ও উৎসবে আসবেন তার এই হাহাকার মনে রাখবেন। মানব জন্ম পেয়েছেন, কিন্তু করলেনটা কী? সাধুসঙ্গ জবাবাদিহির 'মেল' বা ক্ষেত্র। বুঝে শুনে আসবেন। সবাইকে স্বাগতম"।
লালন তো বাউল অবশ্যই ছিলেন. বাউল-শ্রেষ্ঠ ছিলেন বলা হলেও অত্যুক্তি হবে
না. বাউল সঙ্গীত বাংলার লোকসংস্কৃতির এবং লোকগাঁথার এক বিশেষ অঙ্গ. বাংলার
জলবায়ূতেই তার পরিপুষ্টি. অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত তথাকথিত অসংস্কৃত
একশ্রেণীর গ্রাম্য লোকদের মুখে মুখে রচিত হত বাউল গান. ধর্মীয় বা
লোকাচারের মোড়কে গ্রাম্যমানুষকে নীতি কথা শেখানোর জন্য বাউলশ্রেণীর উদ্ভব
হয় নি, যেমনটি দেখা যায় অন্যান্য কিছু লোকসঙ্গীতের ক্ষেত্রে.
বাউল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এই অজ্ঞেয়-অধরা আর কোথাও নয়, মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, গীর্জায় নয় আছেন এই শরীরের খোলেই. যদিও তিনি রহস্যময় কিন্তু সঠিক ভাবে ডাকলে তাঁর সাড়া অবশ্যই পাওয়া যায়.
আসলে সেটা নেশার ঘোরে সেল্ফ ক্রিয়েটেড হেলুসিনেসন। তারা বলে যেখানে সাঁঈ এর বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে,,,,,,,
অর্থাৎ সাঈ বা ঈশ্বর থাকে নারীর যৌনাংগের ভিতর।
' মানুষ হাওয়ায় চলে, হাওয়ায় ফিরে, হাওয়ার সনে রয়.
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয় '
এই রহস্যভেদের জন্য বাউল দ্বারস্থ হন গুরু বা মুর্শিদের কাছে ঠিক যেমন সুফিভক্ত যান পীরের দরজায়. গৎ বাঁধা ধর্মাচরণ বাউলের নয়. তীর্থভ্রমণ, পূজাপাঠ, এবং অনুষ্ঠান-আচার যেমন বাউলের কাছে পরিত্যাজ্য সুফির কাছেও তেমনি.
'আমার নাই মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিক '.
সুফিসাধক এবং হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মত বাউলও বিশ্বাস করেন সংসার মায়াময়. এই পার্থিব জীবন মরীচিকা. তাই তো বাউল নিজের চারপাশে গড়ে তোলে পার্থিব জীবন বিমুখ মনোভাব. সুফি অনুগামী বা হিন্দু তাত্ত্বিকের থেকে বাউল এখানে স্বতন্ত্র. সুফি চিন্তার সঙ্গে অনেক সমাপতন সত্বেও বাউলকে দেখা যায় এক নিজস্ব রীতিনিয়ম তৈরী করে নিতে. তিনি কোন জাতপাতের উপর নির্ভরশীল নন. তাঁর নিজস্ব পথ স্বকীয় চিন্তার আলোকে উদ্ভাসিত হয়. তুলনামূলকভাবে সুফিবাদ দৃশ্যতই এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামনির্ভর. সুফি ভাববাদ যেহেতু 'আল্লা' নির্ভর, তাই তাঁদের 'পরম লক্ষ্য'-এর ব্যাপারে ধ্যানধারণা অনেক স্বচ্ছ. এ ব্যাপারে বাউলদর্শন অনেকটাই অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত.
ইসলাম ধর্মমতে- আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন আপনার মূর্তিতে. এই সূত্রে বাউল মনে করে, আল্লার কোনো রূপ নাই, মানুষের রূপের ভিতরেই রয়েছে আল্লাহর রূপ. এই কারণেই 'দেব-দেবীগণ করে আরাধন' মানুষ জন্মের জন্য. লালনের গানে পাওয়া যায় এরূপ সাক্ষ্য
খোদার নাহি ছায়া কায়া
স্বরূপে ধরেছে মায়া
রূপে মেশে রূপের ছায়া
ফুলকলি হয় প্রেমের গাছে.
মানুষ তার নিজেকে না চিনে জগৎ এবং জগদীশ্বরকে চিনতে পারে না. ঈশ্বর বা দেবতা মানুষের সৃষ্টি. সাধন পূজনে
গুরুভক্তি: গুরুকে সর্বোচ্চ মর্যদায় স্থান দেওয়া হয়. গুরু ছাড়া সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছানো যায় না. বাউলগানে গুরুকে এঁরা বন্ধু, উদ্ধারকর্তা, পথপ্রদর্শক ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকেন. প্রতিটি মানুষের ভিতরে যে 'আমি' থাকে, সে 'আমি' নানা ধরনের পার্থিব মোহে জ্ঞান মার্গে পৌঁছাতে পারে না. বংশগৌরব, অর্থের গৌরব, নানা ধরনের প্রতিত্তির গৌরব এমন কি জ্ঞানের অহঙ্কারও মানুষকে বন্দী করে রাখে. এই বন্দী দশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায় বাউল. বাউল মনে করে, বন্ধনমুক্তির পথই আনন্দমার্গে পৌঁছার পথ. রবীন্দ্রনাথে গানে তাঁর ইঙ্গিত মেলে-।সর্বপরি এরা রাধা কৃষ্নের উপাসক।।
আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ!
খুলে দেখ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন.
এই বন্ধনমুক্তির পথের সন্ধান দিতে পারেন একমাত্র গুরু. সেই সূত্রে বাউলতত্ত্বে সূচিত হয়েছিল মানুষগুরুর সাধনা. কালক্রমে এঁরা মানুষকে প্রধান আরাধ্য দেবতার স্থানে বসিয়েছে. মানুষগুরুকে সাধনা করলেই মুক্তি এমন বাণী বহু বাউল গানে পাওয়া যায়.
একই সূত্রে এসেছে সাধনসঙ্গীর সাথে সাধনার তত্ত্ব.
সাধনসঙ্গী: বাউল তত্ত্বে পুরুষের সাধনসঙ্গী হিসেবে নারীকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে. লালন শিষ্য দুদ্দু শাহ-এর গানে পাওয়া যায়-
বাউল মানুষ ভজে
যেখানে নিত্য বিরাজে,
বস্তুর অমৃতে মজে নারী সঙ্গী তাই.
কিন্তু সাধনসঙ্গী হিসেবে নারী ভোগের না জ্ঞানমার্গে পৌঁছার মাধ্যম সে বিষয়ে বিতর্ক আছে. নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্বারা সবচেয়ে নিন্দিত হয়েছে, বাউল দর্শনের যৌনাচার নিয়ে. এক্ষেত্রে যে অভিযোগ উঠে, তা হলো নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের গুরুর বাড়িতে বাউল নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে গণ-যৌনাচারে মিলিত হয়. বাউল নারী গুরুর বীর্য পান করে আর পুরুষ বাউল নারীর রজ: পানকরে। যারা নারীর লাল রক্ত পান করে তারা সাঈজী আর যারা কালো রজ: পান করে তারা কাইজী।।এরপর তারা চারিচন্দ্র তথা রজ: বীর্য, মল মূত্র,মদের সাথে মিশ্রণ করে সর্বসাধন করে, একে বলে " প্রেমভাজা"।।
কোনো কোনো বাউল সম্প্রদায়ের অবৈধ যৌনাচার বিষয়টি বাউল গানে পাওয়া যায়. কারণ 'সাধনসঙ্গী'র বিষয়টিও এক ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক. তবে এই বন্ধন গড়ে উঠে বাউলদের লালনের নির্দিষ্ট রীতিতে. এই রীতিকে হিন্দু মুসলমানরা বিবাহ হিসেবে স্বীকার করতে চান না তারা কারন তাদের দর্শন হলো নিজেদের মন গড়া তৈরী করা, এর কারন লালন হিন্দু ধর্ম হতে বহিস্কার ছিল আর দ্বিক্ষা নিয়ে ছিল মুসলিম গুরু হতে. সেই জন্য কোনো বিশেষ ধর্মের বিধি মোতাবেক তাদের বিবাহটাই অবৈধ, আর সেই জন্য তাদের মতাদর্শে বিয়ে করে তারা, যেখানে বাউলরা নিজেদের পরিচয় দেয় হিন্দু-মুসলমান হিসেবে নয়, বাউল হিসেবে. যেখানে বাউলের 'সাধনসঙ্গী' নিয়ে থাকাটা ব্যাভিচার , কারন তাদের নিয়মাদির মাঝে রয়েছে. লালনের গানে যে পরের নারী বলা হয়েছে, তা হলো সাধনসঙ্গী হিসেবে আবদ্ধ নয় এমন নারী. সাধনসঙ্গীর সান্নিধ্যে পুরুষের সাধনলাভ হয়, আর নারীর জ্ঞান ধারণের ক্ষমতা বাড়ে. গুরুর সেবার ভিতর দিয়েই তার মুক্তি.গুরুকে দেহদান করা বৈধ।
কোনো কোনো বাউল সম্প্রদায়ের গুরুর বীর্যপানের রীতি প্রচলিত আছে. তবে সাধনসঙ্গী হিসেবে নারীদের বীর্যপান করার রীতি শোনা যায়. নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটে যৌনাচারের ভিতর দিয়ে. গুরুর সকল জ্ঞান ধারণ করার অপারগতা থেকে এই রীতি প্রচলিত হয়েছিল. গুরুর জ্ঞান ধারণ করার মতো ক্ষমতা সবার থাকে না. সেক্ষেত্রে পুরুষের গুরুর বীর্যপান করে আর নারীরা যৌনাচারের ভিতর দিয়ে তা গ্রহণ করে. 'বস্তুর (বীর্য) অমৃতে মজে নারী সঙ্গী তাই' এই ভাবনা বাউল লালন দর্শনের একটি বিশিষ্ট অধ্যায়. জ্ঞান ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই অভিনব পদ্ধতির অনুসরণ করার ধারণা সম্ভবত অন্য কোনো সম্প্রদায়ের ভিতরে নেই.
এদের কাছে হাওজে কাওছার হলো নারীর রজ:শ্রাব,আর কুমারী নারীর স্তন চুষে কষ পান করা হলো সর্বরোগের মহৌষধ।
বাউলগুরু গুরু শুধু নিজের সাধনসঙ্গী নয়, শিষ্যের সাধনসঙ্গীর সাথে মিলিত হওয়ার অধিকার রাখে, এমন দর্শন যে কোনো বাউল সাধকরা মানতেন. যেমন কালু শাহর এর একটি গানে পাওয়া যায়, শিষ্য তার সাধনসঙ্গীকে গুরুর ভোগে নিবেদন করবে, তাহলে সংসারে সে অমর হবে.
প্রেমের গাছে একটি ফল
রসে করে টলমল
তাতে ভ্রমর হয় পাগল.
সেই ফল গুরুকে দিয়া শিষ্য খাইলে
অমর হয় তারা সংসারে.
সাধনসঙ্গী হিসেবে শুধু নয়, বাউল মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের মতোই. এই ভূমিকায় প্রথম পাওয়া যায় মাধব বিবিকে, যিনি বীরভদ্রকে দীক্ষা দিয়েছিলেন. আর বীরভদ্র সে মতকে ছড়িয়ে দিয়ে, বাংলাদেশে বাউলমতের ভিত্তি স্থাপনে কৃতী হয়েছিলেন. দ্বিতীয়বার পাই বাউল সম্রাট লালনের ক্ষেত্রে. অসুস্থ লালনকে মাতৃস্নেহে সুস্থ করে তুলেছিলেন মতিজান ফকিরানী. তিনি লালনের জীবনদাত্রী এবং তাঁর বাউলদর্শনের আদি গুরু. বাউলসম্প্রদায়ের ঐক্য এবং সেবার ভূমিকায় নারীদের বিশেষ অবদান সব সময়ই ছিল.
দেহতত্ত্ব ও পুনর্জন্মবাদ: মানুষ ভজনার সূত্রে বাউল তত্ত্বে প্রবেশ করেছিল দেহতত্ত্ব. এই দেহতত্ত্বে শরীর ও মন কখনো এককভাবে কখনো সমন্বয়ে নতুন দর্শন করে. এর সাথে যুক্ত হয়ে হয়েছে আত্মা, পরমাত্মা, আত্মার ক্রমোন্নতির নানা কথা. বাউল দর্শনে বৌদ্ধ ও হিন্দু দর্শনের পুনর্জন্মবাদের সাক্ষ্য পাওয়া যায় এই গানে. বাউল দর্শনে দৃঢ়তার সাথেই বলা হয়, পাপের কারণেই মানুষের বার বার জন্ম হয়. সত্য পথ এবং লোভহীন জীবন-যাপনই মানুষের বার বার জন্মের বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত করতে পারবে.
পোশাক: বাউলার বৈষ্ণবদের কাছ থেকে আত্ম শিক্ষা খাওয়া রজঃ বীর্য পায়খানা ও প্রসাব গ্রহণ করেছিল গেরুয়া রঙ. আর সুফিদের কাছ থেকে নিয়েছিল আলখাল্লা. উভয়ই ছিলে ঢিলে ঢালা. আর নারীর পোশাক ছিল তাদের বিধানা বলি থেকে শাড়ি. শড়ির নিচে পেটিকোট বা ব্লাউজের মতো কোনো আবরণ ছিল না. একালের বাউল নারীরা শাড়ির সাথে অন্যান্য অন্তর্বাস পড়ে ..
লালনবাদে ও বাউলদের মাঝে রুপ-স্বরূপ তত্ত্ব - দেহ বা কান্তি চেতনাই সব. রুপ হচ্ছে নারী বা প্রকৃতি আর স্বরূপ হচ্ছে নর বা পুরুষ. রুপ এবং স্বরূপ এর দৈহিক মিলনেই সাধন সম্পূর্ণ হতে পারে..মুল কথা হলো সেক্স করতে করতে আমি আমার সেক্স এর পাটনার এর চোখের ভিতর আমার রুপ দেখলেই আমার সরুপ দেখা হয়ে গেল আর আমার মেয়ে সঙ্গিনি আমার সাথে সেক্স করতে করতে আমার চোখের ভিতর তার রুপ দেখলেই সরুপ দেখা হয়ে যায়. রুপ - সরূপ এর ভবের তাৎপর্য বুঝার জন্য হলেও তাদের মিলনের প্রয়োজন. মূল বাউল তত্ব এর কোন জাত বিচার নেই. শ্রেণীহীন সহজ সরল জীবনের অভিসারী বাউলরা একেশ্বরবাদী, ত্যাগের আদর্শবাদী. কিন্তু সেই একেশ্বরবাদী সত্ত্বা মানেই আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা প্রচালিত কোন সৃষ্টিকর্তা হতেই হবে এমন কোন বাধ্য নিয়ম নেই, অনেক বাউল-ই মিস্টিসিজম বা অতীন্দ্রিয়বাদে বা অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাসী যাকে কোন নিদিষ্ট সৃষ্টিকর্তার আওতায় ফেলাকে এক অর্থে অসম্ভব ব্যাপার. কোন কোন বাউল সম্প্রদয়ের মতে, বাউল সাধনায় 'দেহ সাধনা' প্রধান বলেই নর-নারীর আঙ্গিক মিলন অপরিহার্য. এ হচ্ছে যুগল সাধনা. যুগল সাধনা দুই প্রকার - স্বকীয়া এবং পরকীয়া. তবে পরকীয়া বেশি করে তারা. বাউলদের মতে 'পঞ্চরস' পান না করলে প্রকৃত সাধক হওয়া যায়না. পঞ্চরসের উপকরন হচ্ছে - মল, মুত্র, ঋতুরক্ত, রতিজনিত স্ত্রী-পুরুষের ক্ষরিত রস ও বীর্য. যুগল সাধনার ক্ষেত্রে বাউল স্বকীয়া তথা স্ত্রীকেই সাধারণত সাধন-সঙ্গিনী করে ..
বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথায় এক ঘর পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না
দেখিলাম তারে.
বাউলদের মুক্তির বিধান গুলো তারা মনে করে তাদের গুরু মাতার সাথে সেক্স করে আর যৌনাঙ্গ চুসে চুসে মুক্তি লাভ হয়. আর কম বয়সি 13; 14; 15: 16: মেয়েদের স্তন চুসে চুসে একধরনের রস বের হয় সেটা পান করলেই মুক্তি লাভ করা যায়. এই হলো তাদের মুক্তির চিন্তা চেতনা. যদি এই ভাবে মুক্তি হতো তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক পতিতা পল্লী রয়েছে সেই সব পতিতার অনেক আগেই মুক্তি হয়ে গেছে এবং সবার আগে মুক্তি হয়ে গেছে সানি লিওনের. টোটালি ভুলের মাঝে বাস করে তারা.
লালন শাঁইজি, কে যখন নির্বাসিত করে দিল তখন ওনাকে একটি মুসলিম পরিবার পালন করেন সুস্থতা করে তোলে এবং লালন সুস্থ হয়ে নিজ বাড়িতে গেলে তার মা তাকে আর বাড়ি তুলে না এবং সে মুসলিম পরিবারে ছিল বলে জাতের দোহাই দিয়ে জাত কুল গেছে এই বলে তাকে আর গ্রহন করে না তার মা ও বৌ. এবং পরে লালন সেই মুসলিম পরিবারে আবার আসে এবং ঐ বাড়িতে থাকাকালিন দরবেশ সিরাজশাঁই আসতো মাঝে মাঝে এবং সিরাজশাঁই এর অনেক ভাল লেগে যায় লালন কে. এর কারন হলো লালন ছোট থেকে টুক টাক গান গাইতে পারতো. আর গান গাইতে গাইতে লালন সিরাজশাঁইয়ের অনুসারী হয়ে যায়. এবং উনি সুফিবাদ অনুসারে সাধন ভজন করে. এবং সিরাজশাঁইয়ের নিকটে দ্বিক্ষায় দ্বিক্ষিত হয়ে লালন চলে আসে অন্য যাইগাতে. লালন সুফিবাদে সাধন ভজন করে উনি কেন চার চন্দ্রে সাধনা করালেন ওনার শিষ্যদের? এর কারন হলো উনি হিন্দু পরিবারে জন্মে সুত্রে মানুষ এবং মুসলিম পরিবার থেকে সুফিবাদে এসে সাধনা নিয়েছে, এখন তাকে হিন্দুগন কখনো মেনে নিবেনা এবং মুসলিমগন কখনো মেনে নিবেনা যে একজন নির্বাসিত হিন্দুলোকের থেকে সাধনা বা গুরু ধরবো সেই জন্য লালন বুঝে শুনে কৌসলে বৈষ্ণব ধর্মের দিকে মোর নেয় আর বৈষ্ণব সংমিশ্রিত তৈরী করে তার সাধন ভজনে. আর এই রস রতি সাধনা মুলতো বৈষ্ণবদের এবং পায়খানা এবং প্রসাব এবং বীর্য খাওয়া এবং যুবুতি মেয়েদের মাসিকের রক্ত খাওয়া এই গুলো হলো তথাকথিত সনাতনী বাদ আর বৈষ্ণবদের হতে নেওয়া আর বাউলদের কে বৈষ্ণব বলা হয়. দেখুন লালন কোন ধর্ম মানতো না কিন্তুু কৌসলে উনি ভাতটি খায় অন্য ভাবে? দেখুন কি ভাবে, ওনাদের যে বিয়ের প্রচলন আছে সেটা ধামে চোখ বন্দ করে সাত পাক ঘুরে বিয়ে হয় তাদের ফর্মুলাতে, আর সনাতনবাদে আগুনের চারিদিকে সাত পাক ঘুরে বিয়ে হয় হিন্দুদের. এবং সনাতনী বাদে তাদের গুরুদের কবর কে বলে ধাম আর মুসলিমদের বলে মাজার. এখন প্রস্ন হলো লালন শাঁইজী ভাতটি একটু ঘুরিয়ে খেলেন সনাতনী দিয়ে. আর কৌসলে জাত গেল জাত গেল জাতের কি আসে? আপনার একটু গভীরতম ভাবে বুঝে দেখুন. এর পরে আসুন লালন শাঁইজি ছিলেন মুজ্জব শ্রেণির মানুষ আর মুজ্জুব শ্রেণির মানুষ কখনো কাওকে খেলাফত বা খেরকা দিতে পারে না দেখুন এই খেরকা শব্দটি নেয়া হয়েছে বৈষ্ণববাদ হতে তথাকথিত সনাতনীবাদ হতে নেওয়া. খেরকা কিন্তুু কোন প্রকার খেলাফত নয়. তাহলে উনি নিজের সুবিধার জন্য সুফিবাদ কে আরাল করে দিয়ে কৌসলে বৈষ্ণব হয়ে গেলেন. আর এই কারনে লালনবাদে আমার রাসুল এর নামে কোন দরুদ কিয়াম নেই. উনি সাধরন একজন সাধক ছিলেন উনি কখনো উচু মানের ফকির ছিলেন না উনি মুলতো নির্বাসিত হওয়ার কারনে মর্ম্ম গান গাইতো আর এইটায় সাভাবিক. আর উনি এই গান গেয়েই জগতে নাম কামিয়েছেন. এবং উনি কখনো বড় মাপের সাধক ছিলেন না এবং উনি শুধু মাত্র নিজেকে উদ্ধারকৃত করেছেন কখনো পরিপূর্ণ মুক্তিপ্রাপ্ত ছিলেন না. এবং লালনবাদের অনুসারীগন কেও কখনো মুক্তি পাবে না.বৈষ্ণববাদ হতে রস রতি ঠুকে পরেছে লালন বাদে আর লালন বাদ হতে ঠুকে পরেছে সুফিবাদে. বৈষ্ণবগন এরা মুলতো সেক্স সাধনা কেই প্রাধান্যদান করে আর এই কারনে সুফিবাদ আজ কুলশিত হয়ে যাইতেছে দিনের পর দিন. যারা আমার নবীর উপরে দরুদ পড়ে না তারা কখনো সুফিবাদেরর অংশ নয়. তারা নতুন নিয়মে বৈষ্ণবতীর্থ চালু করেছে.
এদের ইসলামী পরিভাষা ব্যাবহারের কারণে কেউ কেউ এদের মুসলিম ভাবে,আর রাধা কৃষনের উপাশনার কারনে কেউ কেউ হিন্দু ভাবে, আসলে এরা হিন্দু ও না মুসলিম ও না। এরা বাউল সহজিয়া বৈষনব।
ন্যাড়ার ফকির লালন নিজেই বলেন,
আমি মন মন্দিরে পুজা দেব
পড়ব নামাজ দিল কাবায়,
মন্দির মসজিদে যেতে বলনা আমায়।।।
বাউলরা সন্তান নেয় না তাই এরা ন্যাড়ার ফকির।
ইসলাম বলে আল্লাহর শরীক নাই,
বাউলরা বলে আল্লাহর শরীক আছে,মানুষই তার শরীক।।
১ম পর্ব ★curtecy,rayedtalukder, edeted
1- baul totto by Dr ahmod shorif
2- lalon fokir- anowarul karim
ন্যাড়ার ফকির লালন চন্দ্রের অনুসারীরা সর্বকেশী,তারা দাঁড়ি-গোফ বা সর্বাঙ্গের কোন লোমই পরিস্কার করে না।
লালনকে নিয়ে যে সব সমস্যা আছে, যা শুধু প্রবল কি প্রকট নয়, রীতিমত বিপজ্জনকও বটে। লালনের আসল নাম লালন চন্দ্র কর, নারীর গোপনাঙ্গ ভজনই এদের একমাত্র কাজ, বৈষ্নবদের উপাস্য দেবতাই এরা উপাসনা করে। গুরু আর সাধন সঙ্গীর মল মুত্র রজ:বির্য্য পান করা, কুমারী নারীর স্তনচোষা এদের সর্বরোগের মহৌষধ।কেউ কেউ লালনকে বলেন, আউলিয়া। খুবই বিপদ যে, এই ধরণের গবেষকদের প্রলাপোক্তির কোন সীমা পরিসীমা নেই। যে ব্যক্তি জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়েন নি, একটি রোজা রাখেন নি, যিনি চৈত্র-মাসের দোল পূর্ণিমাকে গ্রহণ করেছেন তার বাৎসরিক পূণ্যযজ্ঞের মাহেন্দ্র রজনীরূপে, যিনি যাপন করেছেন ইসলামের সঙ্গে গুরুতরভাবে সম্পর্করিক্ত এক মুশরেকী জীবন, যার শিষ্য প্রশিষ্যদের আধ্যাত্নিক সাধনার শ্রেষ্ঠতম অনুপান গঞ্জিকা(গাঁজা) আর সাধনঙ্গীর সাথে বিকৃত যৌনাচার-তিনিও একজন আউলিয়া। আউলিয়াই বটে। কোন কোন গবেষকের প্রেম ও কল্পনা শক্তি যে সত্যই বড় প্রবল, এটা তারই প্রমাণ।
জন্মসূত্রে লালন কী ছিলেন এ নিয়ে কিছু সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু তার জীবনাচারে যে ইসলাম ও মুসলমানিত্বের গন্ধমাত্র ছিল না, এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তবু তাকে আউলিয়া দরবেশ অভিহিত করে কিছু কিছু গবেষক কী যে তৃপ্তি ও সুখ ও ফায়দা লাভ করেন, আল্লাহপাক জানেন। এবং পন্ডিতজনেরা কিন্তু যথেষ্ট সাফল্যও লাভ করেছেন; কারণ অবস্থা অতিদ্রুত এমন রূপ পরিগ্রহ করেছে যে, গঞ্জিকাপায়ী সংসার পলাতক কিছু লালনভক্ত শুধু নয়, বহু সাধারণ মুসলমানও বিশ্বাস করে, লালন একজন খুবই বড় মাপের আউলিয়া ছিলেন। বদনসীব, বাঙ্গালী মুসলমানদের সত্যই বড় বদনসীব।
বর্তমান লালনপ্রেমীদের খুব কষ্ট হবে, তবু দু একটি বিষয়ে আলোকপাত করা বিশেষ জরুরী। প্রকৃত পক্ষে লালনের যথার্থ পরিচয় অতভাবে বিধৃত হয়ে আছে তার সমসাময়িক ও তৎপরবর্তী প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর ইতিহাস এবং তার গানের মধ্যে। লালনকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালের পর। সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের প্রতিপ হিসেবে দাঁড় করানোর একটি নিরর্থক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যলালিত লক্ষ্য নিয়েই এই বিকৃতি প্রক্রিয়ার শুরু। এবং আজকের আমরা যে লালনকে দেখতে পাচ্ছি, সেটা অংশত ওই প্রক্রিয়ারই পরিণতি। তবে বর্তমান প্রবন্ধে এ নিয়ে আলোচনার বেশী অবকাশ নেই কারণ বর্তমান লেখাটির প্রতিপাদ্য একটু ভিন্ন।
লালন কিভাবে ও কতখানি বিপজ্জনক ছিল এবং এখনো যে বিপদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সমস্যাটি তুলে ধরাই বর্তমান আলোচনার মূল লক্ষ্য। সমস্যাটা হলো, লালন মুসলমান ছিলেন না মুমেনও ছিলেন না এবং আউলিয়া হওয়ার তো কোন প্রশ্নই উঠে না; অথচ এই সকল অভিধায় আজ তাকে অভিহিত করা হচ্ছে। যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে, ইসলামের জন্যে নিভূ নিভূ হলেও কিছুটা অন্তত প্রীতি আছে, তার পক্ষে এসব অকথ্য মিথ্যাচার সহ্য করা কষ্টকর।
লালনকে এখন আদর করে বলা হয় বাউল সম্রাট। আমাদের কোন আপত্তি নেই; আমরা বরং এই ভেবে খুশীই যে, আমাদের এই দরিদ্র দেশে এমন একজন সম্রাটের জন্ম যার গানের ছত্রছায়া এখনো আমাদের উপর ছায়া বিস্তার করে আছে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করেন না, করতেও পারেন না যে, অদ্যকার এই বাউল সম্রাট তার স্বসময়ে এবং পরবর্তীকালেও অনেকদিন পর্যন্ত বেশরা ন্যাড়ার ফকির বলেই আখ্যায়িত হয়ে এসেছেন। এবং আজ যাকে বলা হচ্ছে মাজার; কিছুদিন মাত্র আগেও তার নাম ছিল লালনের আখড়া; আর ঝোপজঙ্গল পরিকীর্ণ সেই আখড়াটি ছিল গঞ্জিকাসেবী-প্রেমী রসিকজনের নিরিবিলি আশ্রয়স্থল। এই আখড়াই পরিবর্তিত বর্তমান রূপ হলো লালন শাহের মাজার।
সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও অন্য অনেক কারণে ইতোমধ্যে এই মাজার-এর একটি অপরিহার্য প্রভাব বলয়ও তৈরী হয়েছে, যে কারণে দুরদুরান্ত থেকে ডুগি-একতারা ও গাঁজার কল্কি নিয়ে 'সাধক পুরুষেরা' তো আসছেনই, শীরনি-মানতসহ বহু সরল প্রাণ মুসলমানও আসছে এই মাজার জিয়ারত করতে। এটা একটা ফিতনা এবং এমন ফিতনা যার কারণে বহু ঈমান নষ্ট হচ্ছে। বলাই বাহুল্য', লালনের আখড়া কেন্দ্রিক এই ফিতনাটি একেবারে নতুন নয়, তিন সাড়ে তিন দশক আগে এই বিপদের আরম্ভ এবং তারপর থেকে ক্রমাগতই এই ফিতনা প্রবল হয়ে উঠেছে। অথচ সকল সরকার ও সকল সচেতন মানুষের একথা বলা উচিত ছিল-যত বড় আউলিয়াই হোন তার মাজারে গিয়ে কোন কিছু প্রার্থনা করা সুস্পষ্ট র্শিক। অতএব, নিষিদ্ধ; আর এটা তো কোন মাজারই নয়, এটা একজন বাউল গীতিকারের সমাধিত্রে। বিশেষ করে আমাদের আলেম উলামাদের প থেকে এ কথা উচ্চারণ করা খুবই জরুরী ছিল, কারণ এটা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু না, তাঁরাও কিছু বলেন না। সম্ভবতঃ বলেন না তার কারণ, তাদের অধিকাংশেরই এমন অবস্থা যে, দোয়ার মাহফিলে ওয়াজ করতে করতেই তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। সামান্য যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট থাকে, তা তারা তসলিমা নাসরিন নামক এক বিপ্তিচিত্ত বালিকা ও কতিপয় মুরতাদ বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে নাটুকে লড়াইয়ের মধ্যেই নিঃশেষ করে ফেলেন। অবশ্য এটি ভিন্ন আলোচনার বস্তু, লালন প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
আমাদের কাছে এটা দুর্বোধ্য যে, লালন যা নয় তা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে কিছু মানুষের এত উৎসাহ কেন? আবহমান বাংলা গানের ইতিহাসে লালন যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ, এ নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই; এবং শ্রোতারা তার গানে যদি আনন্দে আন্দোলিত হয় সেখানেও কিছু বলার নেই। কারণ তার সুর ও বাণীর মধ্যে এমন এক ধরণের নান্দনিকতা আছে, যা চিরকালই সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে কম-বেশী আকর্ষণ করবেই। কিন্তু এটা তো মনে রাখা উচিত যে, তিনি না কোন দরবেশ এবং তার গান না এতটুকু ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নামাজ রোজা রাসুল ইত্যাদি ধরণের কিছু ইসলামী শব্দ ও দু একটি ইসলামসম্মত পক্তি দেখে কেউ কেউ বিপুলভাবে উৎসাহিত হতে পারেন, কিন্তু বস্তুত তার গানের পুরো আবহই যে ইসলামী আকীদার পরিপন্থী, এ কথা না মানার কোন যুক্তি নেই, কোন উপায়ও নেই। দু একটি মাত্র উদারহণ পেশ করলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যে, লালন আসলেই কি পরিমাণে ইসলামের সম্পূর্ণ বর্হিভূত এক বেশরা জিন্দিক।
আপনি খোদা আপনি নবী,
আপনি হন আদম সফি
অথবা,
আল্লাহ নবী দুটি অবতার,
গাছ বীজ দেখি যে প্রকার
কিংবা
যে মুরশিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভূল, খোদাও সে হয়-
এই সকল গান কী প্রমাণ করে? প্রমাণিত হয়, ইসলামের মৌলিক ও অলঙ্ঘ্য দাবি যে তওহিদ, সেই তওহিদের সরাসরি মোকাবিলায় দন্ডায়মান লালন এক কুশলী কবি তীরন্দাজ। তার গান শুনতে যতই মধুরই হোক, তাৎণিক আবেদন হোক যতই মর্মস্পর্শী, আসলে এই গান মুসলমানদের ঈমান ও আকীদা বিধ্বংসী এক একটি দুর্বার মারণাস্ত্র। অথচ কী বদনসীব আমাদের, এমন ঈমানবিনাশী মারণাস্ত্র নির্মাতাকেই আমরা বলছি সুফী দরবেশ আউলিয়া এবং কখনো কখনো বলছি মারেফাতের নিগূঢ় রহস্যভেদী এক ইনসানে-ই-কামেল। কালেমই বটে, না হলে এই কথা কি আর যে কেউ গানে বাধতে পারে-
এক এক দেশের এক এক বাণী,
পাঠান কি সাঁই গুণমনি,
মানুষের রচিত বাণী লালন ফকির কয়।
এমন ইসলাম দরদী কামেল পুরুষ ছাড়া কে আর এমন করে বলতে পারে-
কে বোঝে তোমার অপার লীলে,
তুমি আপনি আল্লাহ ডাকে আল্লাহ বলে।
তুমি আগমেরই ফুল নিগমে রসূল,
এসে আদমের ধড়ে জান হইলে।
কী গর্হিত ও ভয়াবহ উক্তি! রাসূলকে আল্লাহ এবং আল্লাহকে রাসূল মনে করার এই জঘন্যতম আকীদা ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করারই অপচেষ্টা। লালন ফকিরের এই এক ধরণের গান, যেখানে তওহিদ-রেসালাত, কোরআন সুন্নাহ ইসলামের মূল আকীদা বিশ্বাস সবকিছুকে অস্বীকার করে, এক জাতীয় কুহকভরা মরমিয়া নান্দনিকতার মোড়কে এমন সব কথা বলা হয়েছে যা রীতিমত শিরক-কুফর নিফাক ও গোমরাহীর চুড়ান্ত। আফসোস, যা কিছু উৎখাত করবার জন্য এই ধরাপৃষ্ঠে ইসলামের আগমন, লালনের গানে সেই সকল নিষিদ্ধ বিষয়ই বার বার বাঙময় হয়ে উঠে; এবং আরো আফসোস যে, সেই সকল দুর্বাক্যপূর্ণ গান সসম্মান প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
বাউলরা যে জীবনাচারে অভ্যস্ত তা যদি আদর্শ হয় তাহলে মানুষকে আর কোন কিছু করতে হবেনা। শুধু গাঁজা খাও, নেশা করো, নষ্টামি করো এসবই হবে জীবন। যারা বাউল জীবনের পক্ষে বলে তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে সেই বাউলের আস্তানায় পাঠাক। তারপর বাউল জীবনকে আদর্শ মানে কিনা বুঝা যাবে…
বাউলদের যারা উচ্ছিষ্ট গোঁফ দাড়ি কেটে দিয়েছেন সে সকল স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার আমরা টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখেছি। তাদের কথায়ও বোঝা গিয়েছে; এটা একটি স্বাভাবিক সামাজিক প্রতিরোধ। এখানে কোন মতাদর্শ বা রাজনৈতিক চিন্তা কাজ করেনি। স্থানীয় সমাজের মাতুব্বর, বয়জেষ্ঠগণ, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি সবাই একত্রিত হয়ে বিনা প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। পরবর্তীতে আমাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক মনোভাব এই ঘটনা থেকে যে যার মত ফায়দা লুটতে উঠে পড়ে লেগেছে।
আমরা সম্প্রতি আওয়ামী নেতাকমী কর্তৃক বাউলদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার ঘটনা শুনেছি। অনেকে বিষয়টি নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি গেল গেল বলে রব তুলেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি বাউলতত্ত্ব কী? বা এতে কী বলা রয়েছে? আমরা কিন্তু জানি না। আনুশেহ, সুমীর মতো কিছু অধুনা গায়িকা বাউলতত্ত্বের প্রচারপ্রসারে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রসেনজিৎ এসে কয়েকদিন আগে লালন নিয়ে সিনেমা করে গেল। মূলত ইন্ডিয়াপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীর লালনপ্রেম যে উথলে উঠেছে তা আমাদের ভাবনার বিষয়। তারচেয়ে বড় কথা আমরা জানি না লালন আসলে কে? তার ধর্ম আসলে কি? এই প্রশ্নের জবাব দিবে নিন্মোক্ত লেখাটি
লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের গুরু। আমরা কি জানি কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম এক্সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাঁই তাদের বলে মাসিকের তিনদিন পরের রক্ত পান করে,আর আছে কাঁই বাবা যারা রজ:শ্রাবের প্রথম তিন দিনের কালো রক্ত পান করে। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা।লালন বলে,
আমি মন্দিরে পুজা দেব
পড়ব নামাজ দিলকাবায়
মন্দির মসজিদে যেতে বলো না আমায়।।
তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,
“বাড়ির পাশে আরশি নগর/সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯)
বাউল সাধকরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারন মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ “বাউল ধ্বংশ ফতওয়া” নামে বাউলবিরধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।
বাউলদের সাধনা হল নারী পুরুষের যুগল সাধনা,বিকৃত যৌন সাধনা,নারী থাকে পুরুষের কোলে,সে নারী তার স্ত্রী নয়, সাধন সঙ্গী,নারীদের মুখে" মা" সম্মোধন করে,সে মায়ের কাছথেকে সব পাওয়া যায়,তা হোকনা যৌনকামনা।।সন্তান ধারন এদের কাম্য নয়, রতি নস্ট এরা করে না। মৈথুনের সময় স্খলন হলে উভয়েই রতি চেটে পুটে খেয়ে ফেলে। লালন বলে-
সমূদ্রের কিনারায় বসে
জল বিনে চাতকী ম' ল।
অর্থাৎ হাতের কাছে আবে হায়াৎ এর পানি বা নারীর শ্রাব থাকতে বোকারা জল বিনে মরে। হাওজে কাউছার বলতে এরা নারীর র:জশ্রাবকেই বোঝে।
তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীনন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। তারা যদি নিজেদের অর্থ-সম্পদ খরচ করে তাদের অধিকৃত জায়গায় আকাসছোঁইয়া লালনমূর্তি বানাতে চায়, তাতেও হয়তো কেউ কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে ‘লালন চত্বর’ ঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
বিষয়:সময় গেলে
সাধন হবে না
""""''''""""""""""""'"""
বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের ক্লাস৯-১০ এর বাংলা বইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউল লালনের একটি কবিতা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কবিতাটি নিম্নরূপ-
“সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দিনের সাধন কেন করলে না
জান না মন খালে বিলে
মীন থাকে না জল শুকালে
কী হয় তার বাঁধন দিয়ে
শুকনা মোহনা”
অসময়ে কৃষি করে
মিছামিছি খেটে মরে
গাছ যদি হয় বীজের জোরে
ফল তো ধরে না ।।”
আচ্ছা, কবিতাটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা কি আদৌ পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা বুঝতে পেরেছে ?? আমার মনে হয় না। কারণ বাউলদের গান বা শ্লোক হচ্ছে দেহতাত্বিক যৌনতা নির্ভর। বাউলরা বিভিন্ন উদহারণের মাধ্যমে তাদের বিকৃত যৌনাচারের বর্ণনা দিয়ে থাকে, এই কবিতায় ঠিক সেটাই করা হয়েছে।
---- যেমন কবিতার শূরুতেই বলা হয়েছে- সময় গেলে সাধন হবে না। যেহেতু কবিতাটি লিখেছে বাউল লালন, তাই সাধন শব্দটিকে বাউলের পরিভাষায় ধরতে হবে। -বাউল পরিভাষায় সাধন বলতে বোঝায়-
“নারী-পুরুষে মিলন বাউলদের সাধনার সারবস্তু। পুরুষের বীজ আর নারীর রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। যৌন উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ বা কথিত ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয় বলে এদের বিশ্বাস। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিম্নমুখী ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী করে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে যারা, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ। তাদের মতে, লালন ফকির একজন সিদ্ধপুরুষ।” (তথ্যসূত্র: লালন গবেষক নিয়ামত আলী মাস্টার ও বাউল ডাক্তার আতিক)
---- ‘সময় গেলে’ বলতে কোন সময় বলা হয়েছে ?
উত্তর হচ্ছে- সময় বলতে এখানে মহিলাদের মাসিকের একটি নির্দ্দিষ্ট সময়কে বোঝানো হয়েছে, যা পার হয়ে গেছে বাউলদের সাধন আর হয়ে উঠে না।
--- কবিতার মাঝে বলা হয়েছে ‘মীন থাকে না জল শুকালে’। এখানে মীন কাকে বলে ?
উত্তর:
ক) বাউল গবেষক ড. আনোয়ারুল করীমের রচিত ‘বাংলাদেশের বাউল’ গ্রন্থে মীন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- “মানুষ সৃষ্টির মূল এই স্ত্রীজননাঙ্গ। এখানেই চন্দ্রের উদয়, এখানেই মীন বা মাছরূপে সাঁই বিরাজ করে। তাই বাউল ভক্তি নিবেদন করে এই যোনিপ্রদেশকে। এখানেই তার সিদ্ধি। এই স্তর অতিক্রম করতে পারলেই সে সাধক।” (সূত্র: বাংলাদেশের বাউল, পৃষ্ঠা- ৩৫৭)
খ) বাউল গবেষক ড. আবদুল করিম মিঞা রচিত ‘বাউল-লালন পরিভাষা’ গ্রন্থে ‘মীন’ শব্দটির অর্থে বলা হয়েছে- “মাছ, ঈশ্বরের প্রতীক। বাউলের বিশ্বাস নারীর রজঃধারায় মীনরূপী পরমাত্মা ভেসে বেড়ায়। নারীর রজঃ ব্যতীরেকে সেই ‘মীন’ ধরার কোনো উপায় নেই। এই মীনের হস্ত পদ স্কন্দ মাথা নেই। যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে পরমে স্বরূপ উপলব্ধি হয়। (মীনরূপে সাঁই বিহার করে-লালন)” (তথ্যসূত্র: বাউল-লালন পরিভাষা, পৃষ্ঠা- ৮০)
---- কবিতায় বলা হয়েছে- “কী হয় তার বাঁধন দিয়ে, শুকনা মোহনা”। এখানে কি বুঝানো হয়েছে ?
উত্তর: নারী জাতির মাসিক বন্ধ হওয়ার পর মেয়েলোকের গোপনাঙ্গকে তুলনা করা হয়েছে ‘শুকনা মোহনা’র সাথে। বলা হচ্ছে- ঐ কথিত ‘শুকনা মোহনা’য় ‘বাঁধন’ দেয়া তথা বাউলসাধনা করে কোনো লাভ হবে না।
---কবিতায় বলা হচ্ছে- “অসময়ে কৃষি করে,মিছামিছি খেটে মরে। গাছ যদি হয় বীজের জোরে
ফল তো ধরে না ।।” অর্থ কি ?
উত্তর: মাসিকের নির্দ্দিষ্ট সময় যৌনতা করতে হবে, নয়ত মিছিমিছি খেটে মরতে হবে। অসময়ে কাজ করলে বাচ্চা-কাচ্চা হবে, কিন্তু বাউলীয় সাধনা হবে না।
অর্থাৎ বাউল লালনের লেখা ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ এই কবিতার দ্বারা কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের বাউলদের বিকৃতযৌনচার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যা বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের সত্যিই দুঃখের বিষয়। বাউলদের সম্পর্কে অজানা তথ্য
১) বাউলদের আগমন ঘটেছে হিন্দু ও বৌদ্ধদের সংমিশ্রন থেকে।
২) বাউলরা প্রেমভাজা নামক এক অদ্ভূত বস্তু খায়।যা মানুষের মল-মূত্র এবং পুরুষের বীর্জ এবং মহিলাদের রক্তস্রাব মিশ্রিত থাকে।
৩) বাউলরা অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্থ। তারা দাবি করে, অবাধ যৌনাচার ও গাজা সেবন
ছাড়া সিদ্ধি (!) লাভ করা যায় না।
৪) বাউলদের বলা হয় ‘নাড়ার ফকির’। নাড়া অর্থ শাখাহীন, যাদের কোন সন্তান হয় না।
যদিও তাদের মূল সাধনা যৌনসাধনা, কিন্তু সে যৌন সাধনায় যেন সন্তান না হয় সেজন্য দীক্ষা গ্রহণের কালে তাদের গুরু কর্তৃক তাদেরকে sexo-yoga art বা যৌনযোগসাধনার শিক্ষা দেয়া হয়। এর ফলে তারা সঙ্গমকালে বীর্যপাত ঠেকিয়ে রাখে। সঙ্গমশেষে প্রজনন উপাদান
দিয়ে তারা প্রেমভাজা বানিয়ে খায়, অথবা তার সঙ্গিনী তা পান করে।
৫) বাউলরা লালন সাইকে তাদের নবী বলে দাবি করে।
৬) বাউলরা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ বলে অভিহিত করে থাকে।
৭) বাউলরা পুরুষদের বীর্যকে ঈশ্বরজ্ঞান করে,তারা দাবি করে মহিলাদের রজ: পান করলে রোগ
প্রতিরোধ বাড়ে। এছাড়া তারা নারী দুগ্ধও পান করে থাকে।
৮) একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে।বাউলদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে--
১) http://blog.bdnews24.com/Habibb/14103
২) বাউলদের বিকৃত জীবন কাহিনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত সিনেমা ‘কসমিক সেক্স’ দেখতে পারেন - https://youtu.be/jwUEpxvJs_A
বাউলদের খাদ্যাভাস নিয়ে ব্লগে অধুনা অনেক লেখা হচ্ছে। তারা নারী ও পুরুষের বিভিন্ন দেহবর্জ্য যেমন মলমূত্র থেকে শুরু করে বীর্য ও রজ: রক্তও পান করে। এখন বাউলতত্ত্বের বইয়ে দেখা যায় বাউলদের সাই বা প্রভুর মধ্যে তাদের নারী সঙ্গিনীও রয়েছে। যাকে বাউলরা বলে ‘চেতন প্রভু’। এবং লালনের গানে বলা হয়েছে “গুরুরতি সাধন কর”। অর্থাৎ নারীর রতি বা মাসিকের সাধনা।
মাসিকের প্রতি বাউলদের এই যে মনোভাব তা বুঝতে হলে আমাদের রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেতে হবে। বলা আছে, একবার কৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে অবস্থানকালে রাধার মাসিক শুরু হয়। কৃষ্ণ তা টের পেয়ে রাধাকে যেন লজ্জার মুখে পড়তে না হয় এজন্য সে মুহুর্তেই গোপীদের নিয়ে রং বা দোল খেলা শুরু করে। বাউলদেরও দোল পুর্ণিমা মহা উৎসবের দিন।
মূলত বাউলরা বৈষ্ণব।এরা গানের মঞ্চে গান গাওয়ার আগে বলে, জয় সাধু গুরু বৈষ্নব, বৈষ্ণবদের সাথে বাউলদের প্রধান পার্থক্য বাউলরা ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যেমন তারা লুঙ্গি এবং পাগড়ি পরে।এতে তাদের মুসলমান মনে হয়। কিন্তু খাঁটি বৈষ্ণবরা পরে না। বাউলদের খাদ্যাভাস মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের দেহতত্ত্ব হতে আগত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই রোগ থেকে মুক্তিকল্পে স্বমূত্র পান করত।যেমন ভারতের হিন্দুদের মধ্যে এখন গোমূত্রপান জনপ্রিয় হচ্ছে।
ঠিক তেমনি বাউলরা পান করে মূত্র ও মল তো বটেই সাথে রজ:রক্ত ও বীর্য। আর আমরা তো জানিই পরকীয়া প্রেমে দেহ ব্যতীত কিছুই নেই।
এ লেখার মূল লক্ষ্য হলো, ভুলক্রমে অথবা যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আমরা যে লালনকে নিয়ে কামপন্কিল অমার্জনীয় অশ্লীলতা ও বিকৃত যৌনাচারের এক গভীর গহবরে নিজেদেরকে নিক্ষেপ করছি, এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটানো। সুখের বিষয় আমার আগের আলোচনা একেবারে বিফলে যায় নি, কেউ কেউ কিছুটা ক্রুদ্ধ হলেও, কারো কারো মধ্যে অল্পাধিক পরিবর্তনও এসেছে। আসলে ইসলাম এমন একটা শ্লীল, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবনের কথা বলে, যেখানে কোন কপট ও বর্নচোরা লালন ফকিরের স্থান নেই। স্থান তো নয়ই বরং এই জাতীয় জঘণ্য যৌনদর্শনকে যথাসাধ্য প্রতিরোধ করা যে কোন হিন্দু মুসলমানের বা যে কোন মানুষের জন্য নৈতিক দায়িত্ব। এবং এটা শুধু হঠাৎ আমিই বলেছি তা নয়, লালনের সমসায়িককালে এবং পরে বহু মানুষ তাকে ইসলামের ঘোরতর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে এই ফিতনাকে উৎপাটন করার যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিয়েছেন।
এই ধরণের বাউল বা নাড়ার ফকির সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লাহর ধারণা ছিল, বানাইল পশু তারা বহুতর নরে। মীর মোশাররফ হোসেনও বাউল সম্পর্কে অকেশে বলেছেন, এরা আসলে শয়তান, কাফের, বেঈমান, তা কি তোমরা জান না। কবি জোনাব আলী প্রচন্ড ঘৃণায় ও আক্রোশে সরাসরি এই উক্তি করেছেন, লাঠি মারো মাথে দাগাবাজ ফরিরের। (সূত্র লালন শাহঃ আবুল আহসান চৌধুরী) লালনের মৃত্যুর ঠিক সাথে সাথেই প্রকাশিত (১৯০০ সাল, লালনের মৃত্যু ১৮৯০) মৌলভী আবদুল ওয়ালী তার একটি ইংরেজী প্রবন্ধে খুব সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, কিছু তথাকথিত মুসলমান ফকির অন্য মুসলমানকে ইসলামের বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের কাজ হলো নিজেদের মতবাদের সমর্থনে (কুরআরন করিম থেকে) ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও ভুল উদ্বৃতি তুলে ধরা। মুন্সী এমদাদ আলী লালনের নাম পরিস্কার নামোল্লেখ করে বলেছেন, নাড়া যে কি ধর্ম তাহা ব্যক্ত করা বড়ই দুরূহ। এমন অসভ্য অশ্লীল ব্যবহার জগতে কোন মনুষ্যের দ্বারা হইতে পারে, এমন বিশ্বাস হয় না। এমনকি সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁও মুসলিম সমাজের অধঃপাত ও শোচনীয় অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মারেফতি ফকিরদের উদ্ভবকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন সামাজিক জীবনের মারাত্বক ব্যাধি।
মোঃ আবু তাহের বর্ধমানী লালনকে বলেছেন, ইসলামবিরোধী, শরীয়ত বিরোধী, বেশরাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ফকির; বলেছেন, লালনের গানে আছে নরনারীর অবাধ মিলনের প্রেরণা, লালনের গানে আছে গুপ্ত যৌনপ্রক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার গভীর উৎসাহ, লালনের গাছে আছে নাপাক দ্রব্য (কামাচারপ্রসূত বীর্য ও রতিরস) পান করার প্রেরণা, লালনের গানে আছে
কুমারী মেয়ের স্তন চুষে সর্বরোগের আরগ্যের বিধান।
শুধু কি তাই? লালন বলে
গোপনে খায় বেশ্যার হাতে ভাত
তাতে কি যায় ধর্মের জাত?
ন্যাড়ার ফকিরেরা গোপনে বা প্রকাস্যে বেশ্যার ভাত খেলে জাত যায় না।
এরপরও লালন আজ আমাদের কাছে আউলিয়া, গভীর আধ্যাত্নিক জগতের এক অবিসংবাদিত কামেল পুরুষ। কামেলই বটে! কিন্তু এই মহাপুরুষের শিষ্য-প্রশিষ্যেরা এখন যদিও মুক্তবুদ্ধি, উদার, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিসেবীদের ব্যবস্থাপনা ও সরকারী পৃষ্টপোষকতায় আনন্দে-নির্বিঘ্ন বছরে অন্তত দু’বার লালন আখড়ায় জমজমাট গঞ্জিকাসেবন ও রসরতির আসর বসায়, কিন্তু একদা বড় বিপদের মধ্যে ছিল। অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী জনাব শামসুদ্দিন আহমদের অগ্রজ মাওলানা আফসার উদ্দিন ছিলেন ইসলামপ্রেমী এক তেজস্বী পুরুষ। তিনি দোলপূর্ণিমার বার্ষিক উৎসবে আগত বহু ফকিরের ঝুটি বাবরি কেটে দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় লালনের আখড়া ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বাউলদের কোন অনুষ্ঠানতো হতেই পারেনি, ভয়ে অনেক লালন শিষ্য বহুদিন পলাতকও ছিল।
এই হলো লালন ও বাউল তথা ফাউল ফকিরদের নিয়ে সমসামিয়ক ও অব্যবহিত পরবর্তীকালের প্রতিক্রিয়া। আজ অনেকটা স্তিমিত বটে, কিন্তু এই ঘৃনা ও প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। এই মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর আগেও মওলানা মেছবাহুর রহমান লালনের বিরুদ্ধে একটি ছোটখাটো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার প্রচারপত্রে লিখেছিলেন, চারিচন্দ্রভেদ ষড়চক্র…….. প্রেমভাজা প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ সমূহের তাৎপর্য কি তা জানলে যে কোন রুচিসম্পন্ন মানুষ লালন এবং তার অনুসারীদের নাম মুখে আনতেও ঘৃণা বোধ করবে। এই ঘৃণা এখনো অত। ম. আ. সোবহান, মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ লেখকের সাম্প্রতিক রচনাসমূহে এই ঘৃণারই তীব্রতা লক্ষ্য করি।
অবশ্য লালনের প্রতি অনেকের মধ্যে অনেক সহানুভূতি আছে। ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী প্রতিরোধের এই অবিরাম ধারাবাহিকতার কারণে কিঞ্চিত বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, একতারার বিরুদ্ধে চলছে লাঠির সংগ্রাম। বাঙলার সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের এ এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। তিনি আরও বলেন, লালনের প্রতি আলেম সমাজের একটি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। লালন বলে-
যেখানে সাঁই এর বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে
দেখিতে যেমন ভূজঙ্গনা।।
ভুজঙ্গনা মানে ফনাধরা সাপ, নারীর ইউরেটাস দেখতে ফনাধরা সাপের মত,তাদের মতে যেহেতু সাঁই নারীর গুপ্তাঙ্গের ভিতর বাসকরে, তা শুনলে ত প্রাণ চমকে ওঠারই কথা,লালন বলে --
থাকে না সে বিনারসে
তিনজনা এক রসে ভাসে,
যে খেয়েছে মাসে মাসে।
অর্থাৎ মাসে মাসে নারীর রজ:শ্রাব খাওয়ার কথা আছে ন্যাড়ার ফকির লালনের গানে গানে।
আসলে এরা মুক্তির পথ খুঁজে পায় না।
পারার কথাও না; কারণ মিথ্যা, অন্ধকার ও অশ্লীলতাকে আঁকড়ে থাকাও একটি অতিক্রমণ্য প্রচন্ড নেশা। অতএব লালন বা লালন শিষ্য প্রশিষ্যেরা যদি প্রচন্ড ঘৃণার মুখেও নিজেদের নোংরা মত ও ততোধিক নোংরা পথকে আঁকড়ে ধরে থাকেন, সেটাই স্বাভাবিক।
একটু ব্যতিক্রম ভাবে ন্যাড়ার ফকির লালন এর কিছু কবিতা বা গান এর লাইনের ব্যাখ্যা করব আজ। আসলে লালনের গান গুলোকে বাংলা ভাষার কুরান মনে করে গাঁজা খোর লালন ভক্তরা, তার গান গুলা কুরান এর আয়াত এর মতই বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে, আমার গবেষণায় লালন কে প্রথমে সূফিতাত্ত্বিক মহাপুরুষ মনে হলেও মূলত তিনি ছিলেন একজন সু-চতুর ঠান্ডা মাথার নাস্তিক।। ইসলাম,আল্লাহ এমনকি কৌশলে নবীকেও তিনি কটুউক্তি করতে ছাড়েননি। বাজারে যেসব বই পাওয়া যায় লালন সাইকে নিয়ে তা মূলত এককেন্দ্রিক ভাবে সূফি ব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সর্বমতে গ্রহনযোগ্য যে লালন এর গুরু ছিলেন সিরাজ সাই। কিন্তু,সিরাজ সাই ছাড়াও তিনি আরও অনেক গুরুর সান্নিধ্যে জ্ঞান লাভ করেন। তবে অফিসিয়ালি তিনি সিরাজ সাইজি কেই হাইলাইট করে গেছেন। আর জীবনের শেষের দিকে এসে তিনি মনে করতে থাকেন যে সব অরগানাইজড রিলিজন-ই ভূয়া। তাইতো তিনি সকল ধর্মকে অস্বিকার করে,একমাত্র পরকৃয়া অশ্লিল যৌনসাধনাকে সাধনার মূলমন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে অবশেষে বলেছেন,
এমন দিন কবে হবে
যেদিন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান নাহি রবে।
লালনের ভাষায় সংসারত্যাগী, সমাজচ্যুত,গাঁজাখোর, অশিক্ষিত মানুষগুলই সোনার মানুষ, লালন বলে,
"মানুষ ভজলে, সোনার মানুষ হবি"
লালন স্রস্টাকে ভজনা না করে মানুষকে বা গুরুকে ভজন করতে বলেছেন। লালন বলেন,
শোন মওলানা
মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না,
লালনের মতে মসজিদ,মন্দিরে আল্লাহ থাকে না। তবে স্রস্টা কোথায় থাকেন তাও লালন বলেছেন,যেমন-
যেখানে সাঁইয়ের বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে
দেখতে যেমন ভুজংগনা।।
অর্থাৎ সাঁই বা স্রস্টা থাকে নারীর যৌনাংগের ভিতর, যার ইউরেটাস দেখতে ফনাধরা সাপের মত।
প্রতিটা মানুষ জন্মগত ভাবে নাস্তিক হলেও পরিবেশ তাকে এসব ফালতু যুক্তিহীন ধর্মে বিলিভ করতে বাধ্য করে বলে লালন মনে করে এবং সকল ধর্ম অস্বীকার করে কুৎসিত দেহ সাধনায় লিপ্ত হয়।লালন ধাপে ধাপে আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে বুঝতে পারেন প্রকৃতপক্ষে নারীর জননেন্রিয় গমন, লেহন, মৈথুন, বিন্দু ধারন, বিন্দু উর্ধনিক্ষেপনের মাধ্যমেই মুক্তি লাভ সম্ভব।,লালন বুঝে ছিলেন সব ধর্মেই ভণ্ড, তাই তিনি নিজেই বাউল ধর্মের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, যে বাউল ধর্ম আজ ফাউল ধর্ম হিসাবে পরিচিত,
ইসলামের নবিকে খোচা মেরে অনেক গান তিনি গেয়েছেন। কিন্তু,তা অনেক ক্ষেত্রেই সূফি ব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নিচে ন্যাড়ার ফকির লালনের কিছু গানের লাইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হলঃ
"কী আইন যে আনলেন নবি সক্কলের শেষে!
রেজাবন্দির সালাত-জাকাত,
পূর্ব হতেই জাহের আছে!!
টীকাঃ সক্কল-সকলের বা সবার। রেজাবন্দি=স্রষ্টার জন্য বন্দনা বিশেষ। সালাত=আপন রবের সাথে সংযোগের মাধ্যম।
জাকাত=দান করা। জাহের=জারি করা।
ব্যাখ্যাঃ সুফিমতে এসব কথার ব্যাখ্যা অন্যরকম। কিন্ত,এসব উক্তির মাধ্যমে মূলত লালন ফকির মুহাম্মদের ভণ্ডামি প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন
"হে মুহাম্মদ তুমি যে এতো জ্ঞানী, উত্তম আল্লাহর বন্ধু তুমি মানবজাতির জন্য নতুন কি এনেছ যা আগে ছিল না"
কারণ,এসব সালাত-যাকাত পূর্ব হতেই ছিল। ইসলামের নবীকে চরম একজন নকলবাজ হিসাবে ইংগিত করেছেন এখানে। এখন মডারেটর ইসলামিস্টগন মনে করেন নবীতো নতুন কিছু আনবেন না শুধুমাত্র আগের জিনিস গুলাকে রি-ফর্ম করতে এসেছেন। সকল জাতিকে সংঘবদ্ধ করতে এসেছেন। তাহলে কোরানে ইহুদীদের প্রকাশ্য শত্রু কেন বলা হল? কারণ তারা নবীদের হত্যাকারী।
লালন চন্দ্র মনে করে আসলে মুহাম্মদ কিছুই না, লালন ফকিরই সবজান্তা, মহাগুরু, মহাসাধু, সিদ্ধপুরুষ, এরা হজরে আসওয়াদকে মনে করে স্ত্রীলিঙ,রজ:শ্রাবকে বলে হাওজে কাউছার,বা অমৃত সুধা,যা খেলে ক্ষুধা তৃশ্না থাকে না। বাউলদের আরাধ্য দেবতা তিনজন, এদের কথা লালনের গানের মইধ্যে ই আছে।
পাগলের নামটি এমন,
বলিতে ফকির লালন ভয় তরাইসে
চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে। এই শেষ অংশে এসে লালন তার গুরুদের নাম বলেছেন। গুরুর প্রতি ভক্তি করে গুরুর নাম মুখে নিতে শ্রদ্ধায় কুঁকড়ে বলেছেন, পাগলের নামটি এমন বলিতে ফকির লালন ভয় তরাইসে আর চৈত্যে, নিতেয়, অদ্বৈয় এই তিনজন হলেন শ্রীচৈতন্যদেব, শ্রী নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈত আচার্য।
বিকৃত যৌনাচারী, গাঁজাখোর, লালন যদি সিদ্ধপুরুষ হন তবে, সানি লিওনের অনেক আগেই মুক্তিলাভ হয়েছে, সকল লালন ভক্তদের এক্সরেটেড নায়ক নায়িকাদের কাছে দিক্ষা নিয়ে মুক্তি লাভ করা উচিৎ।।
লালনের জন্ম আসলে কোন ধর্মে ছিল? একজন বলেছে, সে হিন্দু কায়স্থ পরিবারের সন্তান আর অপরজন বলেছে, সে মুসলিম পরিবারের সন্তান। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় এসেছে বাউল লালন জন্মেছে হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। তবে আশ্রিত ছিল একটি মুসলিম পরিবারে।
একজন মানুষ কিন্তু মুসলমান হলে আত্মগোপন করে না, সে একজন খুনি বা ডাকাত হলেও। কেননা মুসলমান হলে তার হীনম্মন্যতা থাকবে না। লোক লজ্জার ভয় থাকবে না। কিন্তু লালন সযত্নে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে ছদ্মবেশীর মতো কেন? একজন হিন্দু লেখকও স্বীকার করেছে, লালন ছিল হিন্দু। নাম লালন চন্দ্র কর। অথচ লালন মানুষকে ধোঁকা দিয়ে লিখেছে-
“সব লোকে কয়, লালন কি জাত সংসারে?
লালন বলে, জাতির কীরূপ দেখলাম না দুই নজরে।”
নিজেকে মুসলমান হিসেবে ধারণা দেয়ার জন্য লিখেছে-
১। “ইলাহী আলমীন গো আল্লাহ,
বাদশাহ আলমপনা তুমি,
ডুবায়ে ভাসাইতে পারো,
ভাসায়ে কিনার দাও কারো,
রাখো-মারো, হাতও ধরো
তাই তোমায় ডাকি আমি।”
২। “পারে কে যাবি, নবীর নৌকাতে আয়।”
আবার সেই লিখেছে-
“আপনি খোদা আপনি নবী,
আপনি হন আদম সফি।
আবার
“আল্লাহ নবী দুটি অবতার,
গাছ-বীজ দেখি যে প্রকার।”
এ রকম অসংখ্য কুফরী কথা- যা লিখা সম্ভব নয়।
লালন বলে--
ত্রিবেনীর তিন ধারে
মীনরুপে সাঁই বিরাজ করে।।
ত্রিবেনী মানে নারীর যৌনাংগ,সেখানে সাঁই মীন বা মাছরুপে বিরাজ করে। তাই লালনের লালনের ভজন সাধনের কেন্দ্রবিন্দু হল নারীর যৌনাংগ। তারা কাবার পাথরকেও যোনী মনে করে,রজ:শ্রাবকে হাওজে কাউছার বা অমৃর সুধা মনে করে পান করে। পরিকল্পিতভাবেই লালন মানুষকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকাশ হয়েছে তার কুফরী আক্বীদা।
আজকে গাঁজাখোর বিকৃত যৌনাচারী লালনকে ছূফী-দরবেশ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে যে নিজে বা তার শিষ্যরা এক বেলাও নামাজ রোজা করে না।
ন্যাড়ার ফকির লালন চন্দ্র কর নিজ জাতীর কাছথেকে নির্বাসিত হয়ে মুসলিন গুরুর আশ্রয়ে থেকে তার গানে কিছু ইসলামী পরিভাষা গ্রহন করা হয়েছে তাও আবার ইসলামী ধ্যান ধারনার পরিপন্থি।
যার জীবনে ইসলাম ও মুসলমানিত্বের গন্ধমাত্র ছিল না। তবু তাকে কেন ছূফী-দরবেশ বানানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে? তার কবর গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদের আদলে, অথচ লালনকে জানাজা করা হয়নি, বা পোড়ানো হয়নি,মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে মাত্র। যে বেশরা ন্যাড়ার ফকির নামে আখ্যায়িত ছিল তাকে নিয়ে এখন সরকারি পর্যায়ে ঢের মাতামাতি। কিছুদিন আগেও তার জায়গাটিকে বলা হতো লালনের আখড়া আর ঝোঁপ-জঙ্গল পরিপূর্ণ আখড়াটি ছিল গঞ্জিকা সেবীদের আশ্রয়স্থল। সেই আখড়া এখন রূপ নিয়েছে লালনশাহের মাযার! একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে ‘লালনশাহ সেতু’। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক বিশেষ কারণে এই কথিত মাযারকে কেন্দ্র করে একটি বলয় তৈরি করা হয়েছে।
জানাযা ও দাফন-কাফনবিহীন যে লাশ একটি গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিলো, যার মৃত্যুর পর হরিণাম কীর্তন হয়েছিলো তার উপর নির্মিত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীআল্লাহ, মাহবুবে ইলাহী হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পবিত্র মাযার শরীফ-এর নকশার অনুকরণে মনোরম স্মৃতিসৌধ।
কি দুভার্গ্য এ জাতির! মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মহান আল্লাহ পাক উনার মাহবুব ওলীআল্লাহগণ উনাদের নির্দেশিত পথ উপেক্ষা করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক মুশরিক নাস্তিককে মা’রিফাত জগতের এক কথিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রমাণের অপচেষ্টা চলছে। বিভ্রান্ত শাসকদের অন্তর কতটা কলুষিত হলে এ রকম চিন্তার জন্ম হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। আর এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে রয়েছে- এদেশের মুসলমানদেরকে সঠিক ইসলাম থেকে সরিয়ে দিয়ে, সঠিক ছূফীগণের শিক্ষা থেকে সরিয়ে দিয়ে একটা বিভ্রান্তিকর পথে ঠেলে দেয়ার সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র।
অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, যোনীগবেষক ন্যাড়ার ফকির বাউল তথা ফাউল সমাজচ্যুত গাঁজা খোরেরা
ধর্ম দর্শনের নামে মিথ্যা বাউলিকরণ করেছে বাংলাদেশে। বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া মতবাদ, সূফী মতবাদের মিলনে বাংলার বাউল ভাবধারা।
বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এজন্য তারা নারীকে কোলের উপর বসিয়ে বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়।মনের মানুষ,অধর মানুষ কোথায় থাকে এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়।
এই কারণে বাউলরা জোড়ায় জোড়ায় থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের 'লিভিং টুগেদারের' সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের 'চারিচন্দ্রভেদ', 'ষড়চক্র', 'দ্বিদলপদ্ম', 'মূলধারাচক্র', 'সহস্রদলপদ্ম', 'অধর মানুষ', 'ত্রিবেণী', 'সাধনসঙ্গিণী', 'প্রেমভজা' প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে।
দেখুন বাউলগন কিভাবে পুরুষ-প্রকৃতি (নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কিভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কিভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে 'সহজ মানুষ' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ একটি মেয়ের মাসিকের সময় বাউল সাধুগন সাধনার নামে ধর্ষন করে তিন দিন কারন তারা মনে করে মাসিকের সময় সয়ং প্রভু উপর থেকে নারীর যৌনিতে নেমে আসে আর এই আসার সময় নারীর দেহের অধর চাঁদ নামক নীর অর্থাৎ নারীর সাথে সেক্স করতে করতে রস বের হবার পরে একটি সাদা বস্তুু আসে তারা তাকে অধর চাঁদ নামে অভিভূত করে এর পর তারা সেটা পান করে। এবং তারা মনে করে আমরা সয়ং প্রভু কে পেয়ে গেলাম।
প্রমান দেখুন কি বলে বাউল-ফকিরেরা ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রাণের ধারার সাথে কিভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। বীজ-রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা সহজ মানুষ সাধন করতে পারে, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ।
লালনের গানে বলা হয়েছে "গুরুরতি সাধন কর"। অর্থাৎ নারীর রতি বা মাসিকের সাধনা। যদিও অনেক বাউল বলে নিজ দেহের বীর্যের সাধনা মুলত নারীর।গুরুর রতি ভজন সাধন বলতে এরা সমকামিতায় পর্যন্ত লিপ্ত হয়।
মাসিকের প্রতি বাউলদের এই যে মনোভাব তা বুঝতে হলে আমাদের রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেতে হবে। বলা আছে, একবার কৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে অবস্থানকালে রাধার মাসিক শুরু হয়। কৃষ্ণ তা টের পেয়ে রাধাকে যেন লজ্জার মুখে পড়তে না হয় এজন্য সে মুহুর্তেই গোপীদের নিয়ে রং বা দোল খেলা শুরু করে।
দোলপূর্ণিমা বাউলদের প্রধান উৎসবগুলোর একটি। মূলত বাউলরা বৈষ্ণব। বৈষ্ণবদের সাথে বাউলদের প্রধান পার্থক্য বাউলরা ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যেমন তারা লুঙ্গি এবং পাগড়ি পরে। কিন্তু খাঁটি বৈষ্ণবরা পরে না। বাউলদের খাদ্যাভাস মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের দেহতত্ত্ব হতে আগত। বাউলরা পান করে মূত্র ও মল তো বটেই সাথে মাসিকের রক্ত ও বীর্য। এর মূলে রয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের কাহিনী। আর আমরা তো জানিই পরকীয়া প্রেমে দেহ ব্যতীত কিছুই নেই। আর তাদের পরকীয়া প্রমিকার নিকট হতে মাসিকের রক্ত চাই।
আর সেই জন্য বাউলদের নিকটে কোন নারী বেড়াতে গেলে বা কোন বাউলের নিকটে ফোন নাম্বার থাকলে সেই নারীকে বলে মা তুমি দেবি, মা তুমি জননী তুমি সাক্ষাৎ দেবি দূর্গা তুমি মা লক্ষি তুমি জগত জননী মা তোমার পায়ে ভক্তি মা তোমাকে প্রনাম মা তোমাতেই আমাদের মানব মুক্তি মা গো। বাউলদের এই চতুরতায় নারীগন ধরা খেয়ে যায়য় এবং এই ভাবে তারা বিভিন্ন কাহিনি তৈরী করে কারন মুলত তাদের উদ্দেশ্য সেই নারীর মাসিকের রক্ত পান করা আর সেক্স করা। বাউলগন, "ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। ... দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। বাউলদের মধ্যে রজঃপান অর্থাৎ মেয়েদের মাসিকের রক্ত পান করা একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক স েবাদাসী থাকে এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে
সাধারণ বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত .. 'নাড়া' শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার 'ওরসে' তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ 14) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ 1986 সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ । তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি .. ... আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। আমাদের কালেমা হলো" লা ই লা হা ইল্লাল্লাহ,
লালন সাঁই রাসুল্লাহ।
নারী পুরুষ একসাথে গাঁজা খেয়ে তথা কথিত সাধনা বা যৌনাচারে লিপ্ত হয়।।
বিস্তারিত জানতে " cosmic sex" ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করুন।
এক নজরে বাউল
বাউল শব্দের উতপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মতামত আছে।মোটামেটি ভাবে সবগুলিকে মিলালে পাই :
সংস্কৃত “ব্যাকুল” বা “বাতুল” শব্দের মূল[সং. ব্যাকুল বা বাতুল > বাউল]।এর অর্থ উন্মাদ বা পাগল।আবার কেউ চর্যাগীত ও অবহাট্ট রচনায় ব্যবহৃত বাজিল,বাজ্জিল,বাজুল.... শব্দগুলিকে বাউল শব্দের আদিরুপ বলে থাকেন।
বাউল শব্দটি খুব প্রাচীন নয়।মালাধর বসুর “শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য“ ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের “চৈতন্য চরিতামৃত”কাব্যে বাউল শব্দটি প্রথম দেখা যায়।প্রথমটির রচনা কাল পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে আর পরেরটির ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে।
প্রাচীন কালে যে অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হোকনা কেন বর্তমানে শব্দটি দ্বারা বিশেষ এক ভাবুক সম্প্রদায়কেই বোঝায়।কেন তাদের বাউল/পাগল বলা হয়?কারনটা হলো এদের আচার- আচরন,কথা-বার্তা,পোষাক-পরিচ্ছদ সবই প্রচলিত সামাজিক রুপ থেকে আলাদা।এরা কোন দেব-দেবী,পুজা- আচার,নামাজ-রোজা,মসজিদ-মন্দির মানেন না।কাজেই এরা থাকেন বা থাকতে ভালবাসেন সর্বজন পরিচিত জীবন ধারার বাইরে।এজন্যই এদের আরেক নাম ক্ষ্যাপা।বাউল সম্প্রদায়ের সাধারন বৈশিস্ট গুলি মোটামোটি নিম্নরুপ :
(১) বাউলরা চৈতন্যদেবকে তাদের আদিগুরু মানেন যদিও চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সাথে এদের মৌলিক পার্থক্য আছে।অধরা মনের মানুষকে তারা দেবতা মানেন যার বাস কোন মসজিদ মন্দিরে নয়।
(২)দেহভান্ডই হলো এদের কাছে ব্রক্ষান্ড।ওদের ভাষায়- যা নেই ভান্ডে তা নেই ব্রক্ষান্ডে।বা যা আছে ভান্ডে তাই আছে ব্রক্ষান্ডে।এই দেহ মন্দিরেই তাদের মনের মানুষের বাস।যাকে তারা কখনো সাঁই,আলেক নূর, শ্রীকৃষ্ণ বলে ডাকেন।এই দেহের মধ্যেই তারা সেই চিদানন্দ অনন্তের সন্ধান করে।সন্ধান পদ্ধতিটাও সম্পূর্ন দেহজাত।প্রকৃতি(নারী)-পুরুষের মিলনকে প্রেমে রুপদানের মাধ্যমে তারা তাই সিদ্ধি লাভের চেস্টা করেন।
(৩)বাউলরা দুধরনের।একদল গৃহী,আরেকদল সন্যাসী।গৃহীরা ঘর-সংসার করেন।সাধারনত সন্তানাদি নিয়ে সমাজের প্রান্তে বাস করেন।আর সন্যাসীরা থাকেন আশ্রমে(ওদের ভাষায় আখড়া)।তারা আখড়া থেকে আখড়ায় ঘুরে বেড়ায়,একজায়গায় থিতু হয়না কখনো।সাম্প্রদায়ের নিয়মঅনুযায়ী এদের সন্তানাদি থাকতে নেই।গৃহী বা সন্নাসী যেকোন বাউলের সাথেই সর্বাবস্থায় থাকেন একজন প্রকৃতি(নারী)।আখড়ার নারীরা মন চাইলেই সঙ্গী বদল করতে পারেন।এতে পুরুষের কাছ থেকে কোন বাধা আসে না।
(৪)বাউল ধর্ম গুরুমুখী।গুরুই শিষ্যকে শিক্ষাদেন/দেখিয়েদেন গোপন সাধনার পথ।গুরুর শিখানো বিদ্যা ওরা কখওনোই সাধারনের সাথে শেয়ার করেন না।যেহেতু ওদের কোন শাস্ত্র পুঁথি নেই তাই গুরুর নির্দেশিত রীতি-কৃত্যের সাধনা করাই এদের ধর্মাচার।আর আছে গুরু-শিষ্যের পরম্পরায় চলে আসা গান।
(৫)যেহেতু বাউলরা প্রচলিত ধর্মমত মানেন না তাই হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য বা মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য দেখা যায়।বাউল হিসাবে দিক্ষা নেওয়ার সময় একজনকে(নারী/পুরুষ) বিশেষধরনের পোষাক পড়তে হয়।এ অনুষ্ঠানকে “খিরকা প্রদান” অনুষ্ঠান বলে।অবার বয়োজেষ্ঠ বাউলরা যখন একেবারে সন্যাসব্রত দিক্ষানেন তখন তাদের জিন্দা-মরা নামে ডাকা হয়।এ অবস্থায় সন্তান নেয়া নিষিদ্ধ।
(৫)বাউলদের দেহ-দর্শন বেশ বিচিত্র।নারীদেহই তাদের মুক্তির সোপান।আলোচিত মনের মানুষ মাসের একটা বিশেষ সময়ে নারীদেহে অবস্থান করেন।পুরুষ বাউল সেই মহেন্দ্রক্ষনে মতসরুপি নারীদেহে মনের মানুষ,সহজ মানুষ,অধরচাঁদ শিকার করেন।আরও সহজ ভাষায় বললে বিষয়টা হলো-স্ত্রীধর্মের বিশেষ তিনটি দিনেই মনের মানুষের আবির্ভাব হয়,ইহাই মানুষ ধরার সময়।তিনদিনে শেষ দিনে মনের মানুষ পূর্নভাবে আবির্ভূত হন।চতুর্থ দিন তিনি পালিয়ে যান।কাজেই এই তিনদিনই বাউল সাধনার জন্য প্রশস্থ সময়।
(৬)“চারচন্দ্র ভেদ” প্রথা,পান প্রথার মতো সাধারন সমাজের চোখে অশ্লিল ও কুরুচিপর্ন কিছু গোপন অনুষ্ঠান এদের মধ্যে প্রচলিত আছে।যদিও তারা এটা স্বীকার করতে চায় না।তবে লালন,পাঞ্জুশাহ প্রভৃতি গুরুর গানে এর ইংগিত পাওয়া যায়।চার চন্দ্র ভেদ হলো দেহ নি:সৃত চারটি উপাদান রজ:,শুক্র,মল,মুত্র পুনরায় দেহে গ্রহন করা।বাউল পরিভাষায় বিষ্ঠাকে ক্ষিতি,মুত্রকে অপ,রজ: কে তেজ,,শুক্র কে মরুত বলে।সেই আদি বিশ্বাস দার্শনিক মতে বিশ্ব সৃস্টির চার উপাদান এভাবে দেহে গ্রহন করলে দেহ পরিপক্ক হয়,সাধক সাধিকার মন একটা স্থির অচঞ্চল শক্তির সৃস্টি হয়।
(৭)বাউলদের কায়া সাধনা মোটামোটি এ রকম- স্ত্রীলোকের নীর(রজ:) ও পুরুষের ক্ষীর(শুক্র)এই দুয়ের মিলিত সত্তার নাম হলো সহজ সত্তা।নীরে কামের অধিকার,ক্ষীরে প্রেমের অধিকার।সাধককে প্রকৃয়া বিশেষের সাহায্যে(গুরু নির্দেশিত)নীর থেকে ক্ষীর কে আলাদা করে নিতে হবে।অর্থাত স্ত্রী-পুরুষের দৈহিক আসক্তিকে প্রেমের দ্বারা জয় করতে হয়।
(৮)বাউলদের সাধনায় হিন্দু যোগ পদ্ধতি ও মুসলিম সুফি পদ্ধতির মিশ্রন দেখা য্য় ।তবে হিন্দু বাউলকে সুফি সাধনার শব্দদি ও মুসলিম বাউলকে হিন্দু যোগ সাধনার শব্দাদি ব্যবহার করতে দেখা যায়।লক্ষ্যকরলে দেখা যায় হিন্দু বাউলরা বাউল পদবী আর মুসলিম বাউলরা ফকির পদবী ব্যবহার করে।
(৯)গানই তাদের মন্ত্র।গানের শব্দগুলির আলাদা পারিভাষিক অর্থ আছে যা কেবল এই ধর্মাবলম্বীরাই বোঝেন।সাধারনের বোঝা বেশ কঠিন।গানের মাধ্যমেই এরা এদের দর্শন ও শিক্ষা প্রচার করেন।শব্দগুলির বাউল অর্থ বুঝতে হলে পড়ুন বাউল পরিভাষার বই।
(১০)উদার মানসিকতাই বাউল সাধনার মূল।সাম্য আর প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই তাদের সাধনা।এজন্য এই ধর্মে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা জাতি-ধর্মের ভেদ নেই।তবে জাতপাতের ভেদ না থাকলেও সহজিয়াপন্থী হিন্দু বাউল আর সুফিপন্থী মুসলিম বাউল নামে দুটি আলাদা সাধনা পদ্ধতি লক্ষ্য কার যায়।
(১১)বাউলদের সম্যক বুঝতে হলে আমাদের মোটামুটি জানতে হবে দেহতত্ত্ব,আত্মতত্ত্ব,মনের মানুষ তত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব।
পরকীয়া প্রেম
শ্রীচৈতন্যের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব ধর্মের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হলো পরকীয়া প্রেম। অর্থাৎ বর্তমান যুগের ভাষায় পরস্ত্রীর সাথে অবৈধ প্রেম ও ব্যভিচার। বিখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার তার লিখিত ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, বর্তমান কালের রুচির অমর্যাদা না করে এর বিস্তৃত বর্ণনা করা অসম্ভব। তার মতে, আশ্চর্য বিষয় এই যে, এই পরকীয়া, অর্থাৎ পরিণীতা স্ত্রীর সাথে বৈধ প্রেম অপেক্ষা আধ্যাত্মিক দিক থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ ভাবা।
বৈষ্ণবরা মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন, প্রেমের মাধ্যমে ভগবানের সঙ্গ লাভ সম্ভব। আর এই প্রেমের প্রথম সোপান হচ্ছে পরকীয়া। পরকীয়ার মাধ্যমে ভগবত প্রেমের আবির্ভাব ঘটে। সম্ভব হয় প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধির। আর এই প্রেমের সাধনার মাধ্যমে লাভ করা যায় ভগবানের সান্নিধ্য। (দ্রষ্টব্য : রমেশচন্দ্র মজুমদার; বাংলা দেশের ইতিহাস; দ্বিতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠা ২৬৭। মাঘ ১৩৮০; জেনারেল প্রিন্টার্স। কলকাতা)
আমার বাড়ি রাজশাহী শহরে। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে, উত্তর-পশ্চিমে খেতুর নামে একটি জায়গা আছে। এখানে সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণব মহাজন নরত্তম ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৮২ সালে (১৫০৪ শকাব্দে) নরত্তম ঠাকুর খেতুরে চৈতন্যবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি আহ্বান করেছিলেন এক বিরাট বৈষ্ণব সম্মেলন। খেতুর হয়ে ওঠে তখনকার সারা বাংলার বৈষ্ণবদের বিশেষ তীর্থ। এই তীর্থ উপলক্ষে, সেখানে প্রতি বছর বহুলোকের সমাগম হতে আরম্ভ করে। পরে নরত্তম ঠাকুরের তিরধান উপলক্ষে মাঘ মাসের শেষে সাত দিন একটি বড় মেলা বসতে আরম্ভ করে।
এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাব, বাঁশ ও বেতের তৈরি দ্রব্য, সুন্দর নকশা আঁকা শখের হাঁড়ি বিক্রি হতো। যারা বৈষ্ণব নন, তারাও যেতেন ওই মেলায় এসব জিনিস কিনতে। বাংলাদেশে এ সময় যত মেলা বসত, তার মধ্যে খেতুর মেলা ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। এ সময় মেলায় প্রতি বছর প্রায় ২৫-৩০ হাজার লোকের সমাগম হতো। এই মেলা এ সময় কার্যত হয়ে উঠত একটি বড় অস্থায়ী ব্যবসাকেন্দ্র। এই খেতুর মেলায় লোকসমাগম হওয়ার অন্য আর একটি কারণও ছিল। তা হলো, বৈষ্ণব যুবতী মেয়েরা (বৈষ্টমী) আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে কেবল এক হাতের তালু বাইরে বের করে রাখত। তাদের হাতের এই তালুতে কিছু অর্থ দিলে এসব বৈষ্ণব মেয়ে যেকোনো লোকের অস্থায়ী যৌনসঙ্গী হতো। এই প্রথাও হয়ে উঠেছিল কিছুটা বৈষ্ণব ধর্ম সাধনারই অঙ্গ। বৈষ্ণব মতে
দাস্য সখ্য বাৎসল্য শৃঙ্গার এই চারি রস।
চারি রসে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার দাস।
উল্লেখ্য, বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের পূজারী। কৃষ্ণকে মনে করা হয় দেবতা বিষ্ণুর অবতার। রাধা ও কৃষ্ণকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বিরাট বৈষ্ণব সাহিত্য। আর রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার বর্ণনা আজকের মাপকাঠিতে মনে হয় খুবই অশ্লীল।
আমি একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতাম। বহু দিন হলো অবসর জীবন যাপন করছি। শুনলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি অনেক প্রগতিশীল অধ্যাপক বলছেন বৈষ্ণব ধর্ম হলো একটি মানবতাবাদী ধর্ম। আর তার মধ্যেই খুঁজে পেতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির আদিম উৎসকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষ্ণব পরকীয়া সাধনপদ্ধতি শুরু হলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোনো পরিবেশ কি অবশিষ্ট থাকবে? বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাস বলেছেন
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ॥
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা বিদ্যমান। ছেলেমেয়েরা এখানে একসাথে লেখাপড়া করে। এখানে যদি তারা বৈষ্ণব হয়ে ওঠেন, তবে তাদের লেখাপড়ার পরিস্থিতি বাস্তবে কী দাঁড়াবে, সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। নিশ্চয় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাই না এ রকম কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হোক।
লালন ফকিরকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাকে নিয়েও কিছু আলোচনা হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক। ‘ফকির’ শব্দটি আরবি (বহুবচনে ফকরা)। মুসলিম বিশ্বে একসময় সৃষ্টি হয়েছিল একাধিক ফকির সম্প্রদায়। ফকিরেরা মনে করতেন মানবজীবনে ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয় সম্পত্তিকে ঘিরে। তাই শান্তিময় জীবনযাপন করতে হলে অনুসরণ করতে হবে ফকির বা নিঃস্ব মানুষের জীবন। লালনকে অনেকে বলেন, ফকির লালন শাহ্। কিন্তু লালন মুসলিম বিশ্বের ফকির আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন না। মুসলিম ফকিরেরা একত্রে বাস করতেন আশ্রমে। আশ্রমকে আরবিতে বলে রিবাত। আর ফারসিতে বলে খানঘা। বাংলায় খানঘা শব্দটা রূপান্তরিত হয়েছে খানকা শব্দে।
লালন শাহ ঠিক কোনো আশ্রমবাসী ফকির ছিলেন না। বাংলাদেশে প্রধানত চারটি ফকির সম্প্রদায় ছিল। এরা হলো, কাদেরিয়া, নকস্বন্দী, সুরাবর্দী ও চিশতিয়া। এসব ফকির সম্প্রদায়ের মধ্যে একসময় সবচেয়ে বড় ফকির সম্প্রদায় ছিল কাদেরিয়া। কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হলেন, আবদ আল্-কাদির জিলানী (১০৭৭-১১৬৬ খ্রিষ্টাব্দ)। ইনি ছিলেন বাগদাদ শহরের লোক। ইনি তার রিবাদ গড়েন বাগদাদ শহরের উপকণ্ঠে, যা মুসলিম বিশ্বে হয়ে উঠেছিল খুবই খ্যাত। জিলানী তার অনুসারীদের বলেছেন, জনকল্যাণে ব্রতী হতে। দুস্থদের সাহায্য করতে এবং অসুস্থদের সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলতে। জিলানীর অনুসারী ফকিরেরা বিভিন্ন ধরনের বনৌষধি জানতেন, যা দিয়ে তারা চাইতেন রোগীকে রোগমুক্ত করতে। একে বলা হতো ফকিরি চিকিৎসা। আবদ আল্-কাদির জিলানীকে বাংলায় বলা হতো বড় পীর সাহেব।
উপরিউক্তভাবে লালন ফকিরের শিষ্যরা কোনো দিনই এভাবে ধর্মসাধনা করেননি। তাদের মধ্যে কাজ করেছে বৈষ্ণব ধ্যানধারণা। আমি একবার অনেক দিন আগে (প্রায় ৪২ বছর) লালন ফকিরের আখড়ায় গিয়েছিলাম, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। সেখানে গিয়ে দেখেছিলাম কিছু নর-নারীকে একত্রে গঞ্জিকা সেবন করতে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলোম, গঞ্জিকা সেবিনী ওই সব নারী যাপন করে খুবই শীথিল যৌনজীবন। ইসলামে নেশাভাঙ ব্যভিচার করা নিষিদ্ধ। লালন (১৭৭৪-১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মেছিলেন হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। তিনি একবার তীর্থে যাওয়ার সময় পথে আক্রান্ত হন গুটিবসন্ত রোগে। তার সহযাত্রী বন্ধুরা তাকে পথে ফেলে রেখে চলে যান। অসুস্থ লালনকে একটি মুসলমান পরিবার পথ থেকে তুলে এনে সেবাসুশ্রষা করে সারিয়ে তোলেন।
লালন মুসলমানের গৃহে অন্ন গ্রহণ করার জন্য আর ফিরতে পারেন না হিন্দুসমাজে। কিন্তু লালনের ধ্যানধারণা থেকে যায় হিন্দুভাবাপন্ন হয়েই। আর তার ওপর পড়ে বিরাট বৈষ্ণব প্রভাব। আমি এসব কথা বলছি কারণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক বলছেন আমাদের হওয়া উচিত লালন অনুসারী। কিন্তু লালন অনুসারীরা এখন ভিখারি ছাড়া আর কিছুই হন না। তারা একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করে খান। লালন অনুসারী হলে আমরা পরিণত হব ভিখারির জাতে। কিন্তু সবাই ভিখারি হতে গেলে প্রশ্ন দেখা দেবে, ভিক্ষাটা আসবে কোথা থেকে?
চলবে
লেখক : ইবনে গোলাম সামাদ,professor, rajshahi university
লালনের গান অজস্র হলেও সবই শ্রবণ সুখকর নয় – সব গানই কিন্তু আমাদের কানের ভিতরে যেয়ে মরমে পশে না। অধিকাংশ গানই ক্লান্তিকর। হয়তো কয়েক পঙক্তি মুগ্ধ করার মতো। তাছাড়া পুনরাবৃত্তিও প্রচুর। এই জন্যেই রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশটি গান পছন্দ করেছিলেন। লালন হিন্দু না মুসলমান এ নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কারো মতে তিনি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমান ফকিরের কাছে দীক্ষা নেন। কারো মতে জন্মসূত্রেই মুসলমান। কিন্তু লালন মনে হয় এসব সংশয় তার জীবদ্দশায় ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। আসলে ব্যক্তিজীবনে তার নিজস্ব বাউল মত ছাড়া আর কোনো ধর্মের তিনি অনুসরণ করেননি।
তার বিখ্যাত গানেই তিনি বলেছেনঃ
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,
লালন ভাবে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।
এই কারণেই তার শেষকৃত্য কোনো ধর্মমতে হয়নি। তার শিষ্যরা তার মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিলেন মাত্র।
লালনের গানে যে আকর্ষণ থাকুক না কেন তার সাধনার ক্ষেত্র হচ্ছে দেহতত্ত্ব। একটি চিন্তার গুরুত্ব বোঝা যায় তার প্রায়োগিক ফলাফলের উপর। লালনের দেহতত্ত্ব সেই অর্থে বিপজ্জনক ও ভয়ংকর। লালনের সাধনা দেহবর্জিতও নয়। এই সাধনা নারীবর্জিতও নয় অথচ সন্তানবর্জিত যা নিয়ে সামাজিক মানুষের সন্দেহ ও অশ্রদ্ধা স্বাভাবিক। বাউলরা সমাজে থাকে না, গৃহীত হয় না। এদের সম্পত্তি থাকে না। দিনভর গান গেয়ে বেড়ায়। রাত্রে আখড়ায় মিলিত হয়। এরা ভিক্ষাজীবী। এই সাধনায় নারী হচ্ছে অপরিহার্য সঙ্গিণী। এদের সাথে মিল আছে বৌদ্ধ সহজিয়া ও হিন্দু বৈষ্ণব সাধনার। কিন্তু মিল নেই মুসলিম সুফিদের। সুফিদের সাধনা নারীবর্জিত। ভগবত প্রেমই হলো সুফিদের আসল কথা।
লালনের গানে আছে ‘এই মানুষে দেখ সেই মানুষ আছে।’ লালনের ভাষায় সেই মানুষ হচ্ছে আলেক মানুষ বা অলখ মানুষ। এই অলখ মানুষ ঠিক আল্লাহ, ঈশ্বর বা গড নন। সেদিক দিয়ে লালন ও তার বাউল সম্প্রদায় হিউম্যানিস্ট – মানবিকবাদী। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বাউলরা এই মানবিকবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়েছেন এক কুশ্রী কাম সাধনার পথ, যাকে এক ধরনের ব্যাভিচারের সংস্কৃতি বলা যেতে পারে।
লালনের একটা গানে আছেঃ
করি কেমনে শুদ্ধ প্রেম রসের সাধন
প্রেম সাধিতে কেঁপে ওঠে কাম নদীর তুফান…।
বলবো কী হইলো প্রেমের কথা
কাম হইলো প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা, তথা নাইরে আগমন।
এই মানুষে সেই মানুষকে দেখার কথা বলে বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়। এই কারণে বাউলরা জোড়ে জোড়ে থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের ‘লিভিং টুগেদারের’ সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের ‘চারিচন্দ্রভেদ’, ‘ষড়চক্র’, ‘দ্বিদলপদ্ম’, ‘মূলধারাচক্র’, ‘সহস্রদলপদ্ম’, ‘অধর মানুষ’, ‘ত্রিবেণী’, ‘সাধনসঙ্গিণী’, ‘প্রেমভজা’ প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে।
বাউলদের এই ব্যাভিচারী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ায় কয়েকবার বাউল-খেদাও আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪২ সালের বাউল-খেদাও আন্দোলন খুবই বিখ্যাত। লালনের বাউল সাধনা সেদিন হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেরই নিন্দা কুড়িয়েছে।
লালন যতো না ফকির তার চেয়ে বেশি বাউল। কারণ ফকির, দরবেশ, আউলিয়া, সুফি শব্দগুলো হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতিজাত। মুসলিম মিস্টিকদের বুঝাতে এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাউলরা সেরকম কোনো সুফি ধারার অনুসারী নয়। সুফিবাদের প্রথম কথা হচ্ছে নিজের কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিশুদ্ধ হওয়া, সদভ্যাস গড়ে তোলা এবং আল্লাহর প্রেমে এমনভাবে নিমজ্জিত হওয়া যাতে দুনিয়ার কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ না করে। সুফি পরিভাষায় একে বলে ফানা। আজকে জেহাদ শব্দটা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া এমনভাবে হৈচৈ শুরু করেছে যাতে এর মৌলবাণী হারিয়ে যেতে বসেছে। এ শব্দটাকে এখন খুনোখুনি, সন্ত্রাসের সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নিজের কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে সর্বোত্তম জেহাদ। ইসলামী পরিভাষায় একে বলে জেহাদে আকবর। সুফিরা জেহাদের এই তাৎপর্যকে গ্রহণ করে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান। সুফিদের পরিভাষায় একে বলে সুলহিকুল- সকলের জন্য শান্তি।
সুফিদের যে সাধন পদ্ধতি সেটা এতো সহজ নয়। সংযম, কৃচ্ছসাধন ও পরিশুদ্ধ জীবন-যাপন এগুলো হচ্ছে সুফি জীবনধারার অপরিহার্য অংশ। সক্রেটিস একবার বলেছিলেন Having the fewest wants, I am nearest to the gods। এ অনেক পুরনো চিন্তা। পার্থিব আকর্ষণকে যে জয় করতে পারে না, সে কখনো সুফি হতে পারবে না।
সুফি সাধনমার্গের তিনটি স্তর আছে – শরিয়ত, তরিকত ও হাকিকত। সুফিদের রাস্তায় হাঁটতে হলে প্রথমেই ইসলামী শরিয়তের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করতে হবে। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে তরিকত- সুফি সাধনার বিশেষ ধারা। সুফিদের মধ্যে চিশতিয়া, নকশাবন্দিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া এরকম বহু তরিকা আছে। এই তরিকার পথে যারা হাঁটেন তাদেরকে বলা হয় সালিক- পরিব্রাজক। এই সুফি পরিব্রাজনা নানা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে, নানা মঞ্জিল অতিক্রম করে (সুফি পরিভাষায় মাকাম) হাকিকত – আল্লাহর দর্শনে সমাপ্তি ঘটে। এই দর্শনকে বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। সুফিরা তখন নিরবে আল্লাহর জিকির করেন, আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী নিজেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে উন্নত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেন। সুফি সাধনার সাথে তাই বাউল সাধনার তফাৎটা মৌলিক। বাউল সাধন পদ্ধতিতে যে যৌন বিকারগ্রস্ত মনের প্রতিচ্ছবি আমরা পাই, সুফি সাধনায় এসব কল্পনাই করা যায় না। তাই বাউল দর্শনকে কোনোক্রমেই ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত করা চলে না। সেই অর্থে লালনও মুসলিম সংস্কৃতির কেউ নন।
আমাদের কিছু সেকুলার বুদ্ধিজীবী আছেন যারা অনবরত বুঝাতে ব্যস্ত ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন এদেশে যা কিছু আছে তাই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল এবং এখানকার সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার ভিত্তি। এদের কথা শুনলে মনে হতে পারে বাউল ধর্ম একটা প্রবল জনপ্রিয় ও বিপ্লবী ধর্ম যার বন্যায় অবগাহন করে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির আস্বাদ পেয়েছে। আসল কথা হচ্ছে বাউল ধর্ম হিন্দু-মুসলমান উভয়ের দ্বারা বর্জিত হয়েছে। কারণ বাউল দর্শনের মধ্যে মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-আধ্যাত্মিক মুক্তির কথা নেই, মানুষের স্বাধীনতার কথা নেই। এর মধ্যে নেই মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা মোকাবেলা করার কথা। জীবনের সাথে অসম্পৃক্ত এরকম দর্শন নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। বাউলের চিন্তাভাবনা দিয়ে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কোনো কৌশল উদ্ভাবন। মাত্র কয়েক হাজার লোকের একটি সম্প্রদায় বা তাদের কয়েকটি গান কিংবা যৌন বিকারগ্রস্ততা একটি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হতে পারে না।
লালন যে ঊনিশ শতকে জন্মেছিলেন সেই সময় পূর্ববাংলার লোক-মানসে এক বড় ধরনের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এখানকার মানুষ ওহাবী ও ফরায়েজী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক গভীর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক শক্তি হিসেবে দেশে ইসলাম যে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পূর্বশর্ত তৈরি করেছিল ওহাবী ও ফরায়েজী আন্দোলন তার নমুনা। এ আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে আমাদের এখানে বেশি আলোচনা হয়নি। কারণ তখন বাংলার সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিয়েছে হিন্দুরা। এ আন্দোলন ছিল প্রকৃতিগতভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। এই ‘অপরাধে’ ব্রিটিশ ও তার অনুগত হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনকে অবমূল্যায়ন করে এবং আন্দোলনের নেতাদের চরিত্র হননে লিপ্ত হয়। ফরায়েজী আন্দোলনের অন্যতম নেতা দুদুমিয়া ব্রিটিশ ও তার দালাল জমিদার শ্রেণির অত্যাচার থেকে দরিদ্র কৃষকদের মুক্ত করার জন্য এক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ঘোষণা দেন-জমির মালিক জমিদার নয়, আল্লাহ। সেই জমিতে কৃষক, শ্রমিক, উৎপীড়িতের সবার অধিকার আছে। এর চেয়ে বিপ্লবী কথা আর হতে পারে না। আজ যারা লালনকে পূর্ববাংলার মানুষের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার সাথে জুড়ে দিতে চাচ্ছেন তারা জানেন না ঊনিশ শতকে পূর্ববাংলার লোক-মানসকে সত্যিকারভাবে উজ্জীবিত করেছিল বাংলার এই ওহাবী ও ফরায়েজীদের ক্রিয়াকাণ্ড – কোনোভাবেই বাউল ধর্ম নয়। ঊনিশ শতকে আমাদের জাতিসত্তার শিকড় খুঁজতে হবে ওহাবী, ফরায়েজী ও ফকির বিদ্রোহের মধ্যে।
একটা জিনিস বোঝা দরকার যে লোক-সংস্কৃতি সব দেশে থাকে। কিন্তু সে দেশের সংস্কৃতি বলতে কেবল লোক-সংস্কৃতিকে বোঝায় না। তার চেয়ে উঁচু স্তরের সংস্কৃতিও একটা থাকে। সেই সংস্কৃতি দেশের মানুষের মননশীলতার প্রতীক। সেই সংস্কৃতি হয় ঐ দেশের জাতিসত্তা, রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি। আমাদের এখানকার এই ভিত্তিটা হচ্ছে ইসলাম। এটাই হচ্ছে পূর্ববাংলার মুসলিম জনমানসের আইডেন্টিটি।
লোক-সংস্কৃতি লোকরঞ্জণের অনুপম উৎস। লালনের গান লোকরঞ্জণকারী হিসেবে বহুদিন বেঁচে থাকবে। একে আমাদের আইডেন্টিটির সাথে তুল্য করে তোলা বাহুল্য মাত্র। বিশেষ করে লালনের ধর্মের ফলিত দিকগুলোর মধ্যে যে যৌন বিকারগ্রস্ততা দৃশ্যমান তা একেবারেই অগ্রহণীয়।
বাংলাদেশের জনমানসে লোক-সংস্কৃতির যে জায়গা আছে সেটা সব সময় থাকবে। সেই জায়গায় লালনের স্থান। লোক-সংস্কৃতিকে ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে খাড়া করার চেষ্টা পণ্ডশ্রম, যা আমাদের সেকুলারবাদীদের আরাধ্য। লোক-সংস্কৃতির জায়গায় লোক-সংস্কৃতি থাকবে, ইসলামের জায়গায় ইসলাম।
আজ আমাদের সেকুলারবাদী বুদ্ধিজীবীরা লালনকে নিয়ে হৈচৈ করছেন। কারণ তারা চান আমাদের জাতিসত্তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে। তারা চান লালনকে দিয়ে পূর্ববাংলার মুসলিম জনমানসে বিপন্নতা তৈরি করতে। এরকম চেষ্টা অতীতেও হয়েছে এবং আমাদের জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির মতো বহু ঘটনা ঘটেছে।
লালন তত্ত্ব এবং বাউল সমাজের ধর্ম বিশ্বাস
১২৪৮ সালে মালাধর বসু কর্তৃক লিখিত 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থে প্রথম বাউল শব্দটি পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদদের মতে, "সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধব বিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন [1]।" প্রফেসর উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য তার ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান' গ্রন্থে লিখেছেন, বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ খৃস্টাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে,"বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব [2]।" "তবে জগমোহন গোসাঈ কে (জগন্মোহিনী বাউল) সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলা হয়। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয় [3]।" বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। অনেকে বলেন ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল এসেছে। বাতুল শব্দের অর্থ উন্মাদ, পাগল ইত্যাদি। অনেকে বলেন বৌদ্ধ সহজিয়া মতে ব্যবহৃত ‘ব্রজকুল’ থেকে ‘বাজুল’ এবং তা থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। "আরবি 'আউল' বা হিন্দি 'বাউর' থেকেও শব্দটি আসতে পারে [4]।" সংসদ বাংলা অভিধানে বাউল শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে, "ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও সংস্কার হইতে মুক্তসাধক সম্প্রদায় বিশেষ, খেপা লোক, পাগল [5]।" অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' বইতে বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের সন্ধান দেন তা হলো - বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ,কর্তাভজা, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই,পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পণারায়নী, বড়ী, অতি বড়ী, রাধাবল্লভী, সখি ভাবুকী। সেই সময়ে এই রকম অনেকে উপধর্ম চালু ছিল॥ বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ড. আনোয়ারুল করিম লিখেছেন, "প্রাচীন প্যালেস্টাইনের রাসসামরায় (বা'আল) নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। এবং এই ধর্মের লোকদের মধ্যে মৈথুন যৌনচার গুরত্বপুর্ণ বিষয় ছিল॥ এই বা'আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল, যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগ নির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা'আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে [6]।" বাউলদের সাধনার দুটি মুখ্য রীতি - জ্ঞানমার্গীয় যোগসাধনা আর মিথুনাত্মক যোগসাধনা। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারী সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী সম্ভোহ বাউল ধর্মে স্বীকৃত। বাউলরা দেহ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নর-নারীর মিলন ও সঙ্গমকে ধর্মীয় ভাবে বৈধ করে। তাদের কাছে গুরুই সব। প্রয়োজনে গুরুর উপস্থিতিতে মিলন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাইতো বাউলরা গায়, "আমার দেহ-জমি আবাদ হইল না গুরুর বীজ বুনতে পারলাম না। ও বীজ বুনতে পারলে হত কামরাঙ্গা ফলপুষ্ট হত দানা..." অদ্ভুত বাউলদের ধর্ম বিশ্বাস।
"বাউলদের মধ্যে হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা হিন্দু ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,"কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
...মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে [7]।"
তবে অনেক বাউল গান আছে যেখানে সাধন তত্ত্ব ও সাধন রীতির কথা সরাসরি বলা হয়েছে। আবার কতক গানে সাধনার রীতি পদ্ধতি রহস্যময়॥ তবে বাউলরা বিশ্বাস করে যে, 'আপন সাধন কথা, না কহিবে যথা তথা'। "বাউলদের যে গোপন সাধনাটি নিয়ে বারবার নানা জায়গায় আলোচনা দেখা যায় তা হল ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ প্রক্রিয়া। অনেক বাউল গানে এর উল্লেখ আছে॥ বিভিন্ন গানে উল্লিখিত চারটি চন্দ্র হল – শুক্র, রজঃ, বিষ্ঠা ও মূত্র। দেহ নিঃসৃত এই চার পদাত্থকে প্রতীকের ভাষায় ‘চারি চন্দ্র’ বলে [8]।"
বাউলরা চারিচন্দ্র ভেদ করতো অর্থাৎ "মল-মূত্র, রজঃবীর্য পান করতো [9]।"
বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। "এছাড়া, তারা রোগ মুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র পান করে॥ সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে [10]।" নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে।
বাউল সম্প্রদায়ই মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। "মদ্যপান, নারী পুরুষের অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল। বাউলগণ যৌন সঙ্গমকে যৌন পূজা মনে করে [11]। তবে বাউলদের কথা উঠলে বাউল সম্রাট লালনের কথা উঠবেই॥ বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। গবেষক লেখক শক্তিনাথ ঝা শান্তি নিকেতন থেকে লালনের নির্ভরযোগ্য যে গানের খাতাটি উদ্ধার করেন সেখানে লেখা ছিল, "শ্রী লালনশাহ দরবেসের তালেব শ্রী ভোলাই শা ফকির এই বহির মালিক [12]।" আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয় [13]। ১৩৩৩ সালে রংপুরের মাওলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়। তিনি সেখানে মত দেন ,"লালন সাহার ধর্মের কোনো ঠিক ছিল না। তিনি কেবল মুসলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদই ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই হিন্দু সমাজ তাঁহাকে সমাজচ্যূত করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্নভোজন ব্যতীত এছলাম গ্রহণ করেন নাই বা মোছলমান বলিয়া নিজেকে স্বীকার করেন নাই বা এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজ রোজা প্রভৃতির কোনো আচার-ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল না, যা দ্বারা তাহাকে মোছলমান বলা যাইতে পারে। তিনি যত বড় মুনি ঋষি উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন [14]।"
অবশ্য এইসব নিয়ে গবেষনার অন্ত নাই॥ জীবদ্দশায় লালন ফকিরের সাথে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির আলাপ-পরিচয় ছিল॥ 'সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক ছাড়াও সেই সময়কার জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল [15]॥' রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের নাম জড়িয়ে অনেক কল্প-কাহিনী রচনা করেছেন বিভিন্ন গবেষক। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে লালন অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন। "বরং লালনের মৃত্যুর পর তার সমাধি তৈরি করার জন্য কোনো জমিদারই সাহায্য করেনি। পরবর্তীতে আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পরে গেলে জমিদারগণ ১৯৪৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য লালনের আখড়াটি নিলামে তোলেন। লালনের শিষ্যরা ১ শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি কিনে আখড়ার অস্তিত্ব রক্ষা করেন [16]।" তবে বাউল মানেই মনে করা হয় গাজাখোর॥ যা প্রমাণের জন্য বর্তমানে দেশের যেকোনো বাউলের আখড়ায় যাওয়াই যথেষ্ট। তবে ইতিহাস বলে, "লালন শাহের শিষ্য উজল শাহের গাঁজা সেবন করার বদ অভ্যাস থাকার কারণে লালন শাহ তাকে আখড়াবাড়ি হতে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন [17]। লালন শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী শিষ্য দুদ্দু শাহ গাঁজা সেবনকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ মনে করতেন। তাইতো তিনি বলেছেন,যেও না শুকনো বৈরাগীর দলে, গাঁজা খেয়ে মালা টিপে ফেলাবে গোলে। তবে বাউল গন বিভিন্ন সময়ে হিন্দু এবং মুসলমানদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশ শতকের গোড়ায় যে ‘বাউল ধ্বংস আন্দোলন’ হয় তাতে অন্যতম অভিযোগ ছিল বাউলরা ধর্মের নামে অবাধ যৌনলীলা ও নানা বিধ অশ্লীল আচার আচরন করে। যৌন ব্যাপারে বাউলদের কোন পাপবোধ ছিল না। এই যৌন স্বাধীনতার কারণেই অনেক তরুণ ও যুবক সেই সময় বাউল হতে আকৃষ্ট হয়। ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমির সভাপতি থাকাকালীন একজন প্রফেসর লালন সমাধিসৌধে বিভিন্ন সময় মিলাদ, কোরান পাঠ ইত্যাদি ইসলামিক কার্যক্রম চালান। এর প্রতিবাদে লালন শাহের অনুসারী বাউলগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের বরাবরে প্রফেসর সাহেবের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদলিপি দাখিল করেন। যার ভাষ্য ছিল এমন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না মুসলমান না হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। কিন্তু উক্ত অধ্যাপক আমাদের এই তীর্থ ভূমিতে ঢুকে কোরআন তেলোয়াত করেন,ইসলামের কথা বলেন - এসবই আমাদের তীর্থ ভূমিতে আপত্তিকর [18]।" আমরা আলাদা একটি জাতি, "আমাদের কালেমাও আলাদা – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ [19]।" হিন্দুবাদ ও সুফিবাদের মিশ্রণ বাউল দর্শনের মূল কথা হলো মানবতা৷
বাউলদের কাছে সংসার এবং সমাজ উভয়টাই পরিত্যাজ্য। জীবনের জৈবিক প্রয়োজনে তারা সাধন সঙ্গী সন্ধান করে; আর মানুষের দেয়া ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে— "তাহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাহাদের ছাড়িয়ে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন—আমরা পাগল, আমাদের ছাড়িয়া দাও, পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই।" আসলেই তারা পাগলামু উন্মাদনায় মেতে থাকে॥ বাউলদের আছে হাজার হাজার গান।
বাউলদের গান বুঝতে হলে আগে তাদের পরিভাষা বুঝতে হবে, অদ্ভুত তাদের শব্দ চয়ন। "যেমন- অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনী, কুমীর মানে কাম, লতা মানে সন্তান, চন্দ্রসাধন মানে মল মূত্র পান [20]।"
তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়,বাউলদের বিকৃত জীবন আর ‘ভাবের গান’ আমাদের সমাজ সংসারে কোন কাজে লাগবে???
তথ্যসুত্র
[1] লালন শাহঃ বিবেচনা-পূর্নবিবেচনা মুনশী আব্দুল মাননান বাংলা সাহিত্য ও লালন শাহ, পৃষ্ঠা ১১ , ২০০৫।
[2] হারামনি; অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন, সপ্তম খন্ড, পৃ-৮।
[3] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, প্রথম ভাগ, অষ্টম অধ্যায়, অচ্যুতচরণ ; ২০০৪।
[4] বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোক ঐতিহ্য, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ৩৪,২০০৫।
[5] সংসদ বাংলা অভিধান, পৃ ৪১৫,নভেম্বর ২০০৫,কলকাতা।
[6] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, ড. আনোয়ারুল করিম, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫॥
[7] বাউলতত্ত্ব, ড. আহমদ শরীফ, পৃঃ ৫৩-৫৪।
[8] বস্তুবাদী বাউল, শক্তিনাথ ঝা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ॥
[9] দেশ পত্রিকা , বাউল বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা, ৪ঠা মাঘ ১৩৯৮॥
[10] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, আনোয়ারুল করিম; পৃ ১৪-১৮ ;৩৫০- ৩৮২॥
[11] বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আববাস আলী খান,পৃ ৬৬।
[12] ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, শক্তিনাথ ঝা, কলকাতা ১৯৯৫।
[13] Bangladesh By Mikey Leung, Belinda Meggitt.
[14] বাঙলায় বাউল বিরোধী আন্দোলন : প্রেক্ষিত লালন শাহ, আবুল আহসান চৌধুরী॥
[15] লালন শাহের মরমী দর্শন; মো. সোলায়মান আলী সরকার,পৃ ৬, ১৯৯৩।
[16] হারামনি, শক্তিনাথ ঝা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪-৬৫।
[17] দুদ্দু সা’র পদাবলি; শক্তিনাথ ঝা, ৬৬ -১০৩ পদ।
[18] লালন শাহ জীবন ও গান; এস এম লুৎফর রহমান; পৃ-১০৭-১০৮।
[19] ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, সুধীর চক্রবর্তী, ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫॥
.
[20] গভীর নির্জন পথে, সুধীর চক্রবর্তী, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৪।
চলবে,,,,,,,,,
http://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/lovelyemon/30074137
বেশ তুঙ্গে উঠেছে বাউলরা। তাদেরকে এখন বলা হচ্ছে বাউল শিল্পী।
তারা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সক্রিয় সহযোগিতা পাচ্ছে। এমনকি তথাকথিত জাতীয় দৈনিকগুলোর শীর্ষ সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে।
গতকালও ইসলাম বিদ্বেষী একটি পত্রিকায় বক্স আইটেমে শীর্ষ সংবাদ হয়েছে-
“এবার শিবচরে নারী বাউল গণধর্ষণের শিকার”
খবরে বলা হয়েছে- “মাদারীপুরের শিবচরের চরাঞ্চলে এক নারী বাউলশিল্পী (২৮) গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিল্পীকে গুরুতর অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে এ ব্যাপারে শিবচর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
বাউলশিল্পী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জানায়, ও আমারে বিয়া করার জন্য আমার বাড়িতেই আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। তাই ওর জন্য মায়া লাগতো। কাইলকো আমারে কাবিনের কথা কইয়া নিয়া ৩ জনে মিইলা খারাপ কাম করলো। আমি ওগো বিচার চাই।”
উল্লেখ্য, মাদারীপুরের তথাকথিত বাউল শিল্পী বিয়ের কথা বলে প্রতারণার তথা কলঙ্কিত করার অভিযোগ তুলেছে। সমাজের সহমর্মিতা চাইছে। প্রকাশ করছে তারা বিয়েতে আগ্রহী ও বিশ্বাসী। কিন্তু আসলে কী তাই?
প্রসঙ্গত বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার ‘বাংলাদেশের বাউল’ বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হলো- “প্রাচীন প্যালেস্টাইন-এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তাওরাত, ইঞ্জিল (বাইবেল), কুরআন মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম একসময় এ উপমহাদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সূফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।” (বাংলাদেশের বাউল পৃষ্ঠা : পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডক্টর আহমদ শরীফ তার “বাউল তত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র মত। যার নাম নাথপন্থ। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে। তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরিদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরিদ গ্রহণে কোনো বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরীয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মতো করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোনো নামে নাহি বাধা
মন কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।”
(বাউল তত্ত্ব : পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪)
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হলো শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোনো সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনোকিছু বলেই পরিচয় দেয় না। লালন শাহ ছিল বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দফতরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তার গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি। আমাদের গুরুই আমাদের রসূল। ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কুরআন তিলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালিমাও আলাদা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রসূলুল্লাহ।“ (দ্রষ্টব্য : সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃষ্ঠা ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোনো মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায় না। জুমুয়ার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করে না। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামায নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায় না। এদের জানাযাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। ((বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্মসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। নাস্তিক ডক্টর আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরি হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারণ ঘটনা। এছাড়াও তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মূত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মূত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ৩৫০, ৩৮২)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলত বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচরণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রসূল, আনাল হক্ব, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো-
“বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথা এক পড়শি বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক গান মনে করা হলেও এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শি শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ৩৬৮-৩৬৯)
সমকাল ও উত্তরকালে লালন সম্পর্কে ইতি ও নেতিবাচক দুই ধরনের সামাজিক প্রতিক্রিয়াই প্রবল হয়েছিল। যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছিলেন তিনি। লৌকিক বাংলার এই অসাধারন মনীষী-ব্যক্তিত্ব তাঁর সমকালেই সুধীসমাজের মনোযোগ ও শ্রদ্ধা আকর্ষণে সক্ষম হন। তাঁর প্রতি ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের সানুরাগ কৌতূহল তাঁর পরিচয়ের ভূগোলকে আরো প্রসারিত করে। লালনের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ অনুরাগী ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
লালনের জীবৎকালেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া সূচনা হয়। বাউল বা লালন বিরোধী আন্দোলনের তথ্য-খতিয়ান সংগ্রহ করলে এই প্রতিক্রিয়ার যথার্থ স্বরূপ উপলব্দধি করা যাবে।
জন্মলগ্ন থেকেই বাউল সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা নিন্দা নিগ্রহ বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কিংবা ‘রাগাত্নিকা পদে’ ইঙ্গিত আছে বাউল সম্প্রদায়ের প্রতি সেকালের মানুষের অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা কতো তীব্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে শাস্ত্রাচারী হিন্দু আর শরীয়তপন্থী মুসলমান উভয়ের নিকট থেকেই বাউল অসহিঞ্জু আচরণ আর অবিচার অর্জন করেছে। উনিশ শতকে বাউল মতবাদ যেমন উৎকর্ষের শিখর স্পর্শ করে, আবার তেমনি পাশাপাশি এর অবক্ষয়ও আরম্ভ হয় এই সময় থেকেই। ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে এঁদের প্রতি অত্যাচার নিগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হয়ে পড়ে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮০-১৯৪৯), তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১), কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০-১৮৭৩), দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী (১৮৬৭-১৯২৩), প্রমুখ ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকের উদ্যেগ-প্রচেষ্টায় বাউলমতের প্রভাব-প্রসার খর্ব-ক্ষুণ্ণ হয়। অনেকক্ষেত্রেই বাউলদের প্রতি আলেম সমাজের একটি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বাউল বা নাড়ার ফকির সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লাহর ধারণা ছিল, ‘বানাইল পশু তাঁরা বহুতর নরে’ (‘মেহেরুল ইসলাম’)। এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে মীর মশারফ হোসেনও বাউলদের সম্পর্কে আক্লেশে বলেছেন, ‘এরা আসল সয়তান, কাফের, বেঈমান/ তা কি তোমরা জান না’ (‘সঙ্গীত লহরী’)। কবি জোনাব আলি প্রচণ্ড আক্রোশে সরাসরি বলেছেন, ‘লাঠি মার মাথে দাগাবাজ ফকিরের’ (‘কাব্য মালঞ্চ’)। এ ছাড়া বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে রচিত হয়েছে নানা বই, প্রদত্ত হয়েছে নানা বিঁধান আর ফতোয়া।
প্রচলিত শাস্ত্রধর্মের বিরোধী ও মানবমিলনের প্রয়াসী লালনের জীবৎকালেই লালন বিরোধী আন্দোলনের সুত্রপাত্র। তাঁর মতবাদ ও সাধনা হিন্দু মুসলাম উভয় সম্প্রদায়ের শাস্ত্রবাদী ধর্মগুরু ও রক্ষণশীল সমাজপতিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে;- বারংবার তিনি হয়েছেন লাঞ্ছিত-অপমানিত-সমালোচিত। কিন্তু লালন ধীর, স্থির, লক্ষ্যগামী। কোনো অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতায় তাঁকে নিরুৎসাহিত বা নিরুদ্ধ করতে পারেনি। সব বিরোধিতাকে তুচ্ছ করে তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছেন সত্যাভিমুখে-পরম প্রত্যাশিত মনের মানুষকে পাওয়ার আশায়। লালন গূঢ়-শুহ্য দেহবাদী সাধনার তত্ত্বজ্ঞ সাধক। তাই এসব দুঃখ-আঘাত-বেদনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তাঁর গানে সরাসরি প্রতিফলিত হয় নি।
কাঙ্গাল হরিনাথের সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকায়’ (ভাদ্র ১ম ১২৭৯/আগস্ট ১৮৭২) ‘জাতি’ শীর্ষক আলোচনায় লালন ফকির সন্মন্ধে প্রসঙ্গেক্রমে আলোকপাত করা হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের ‘জাতি’ বিপন্নতার জন্য লালন ও তাঁর সম্প্রদায়কে এখানে দায়ী করা হয়েছে। লালন জাতিভেদহীন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনার যে অভিনব প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন হিন্দু সমাজনেতারা তা অনুমোদন করনে নি। ‘গ্রামবার্তা’র নিবন্ধকার মন্তব্য করেছেনঃ
‘… এদিকে ব্রাক্ষধর্ম জাতির পশ্চাতে খোঁচা মারিতেছে, ওদিকে গৌরবাদিরা তাহাঁতে আঘাত করিতেছে, আবার সে দিকে লালন সম্প্রদায়িরা, ইহার পরেও স্বেচ্ছাচারের তাড়না আছে। এখন জাতি তিষ্ঠতে না পারিয়া, বাঘিনীর ন্যায় পলায়ন করিবার পথ দেখিতেছে।’
১৯০০ সালে প্রকাশিত মৌলভী আবদুল ওয়ালীর On Curious Tenets and Practices of a certain Class of Faqirs in Bengal প্রবন্ধে লালন সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিত ও মন্তব্য আছে। এই প্রবন্ধে একস্থানে মুসলমান বাউল ফকিরদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
The so-called Musalman Faqirs speaking to another Musalman try their best to agree against Islam, and to misinterpret or misquote passages in support to their doctrness.
বাউল ফকিরদের সম্পর্কে সেকালে এই ছিল প্রায় সর্বজনীন ধারণা। বলাবাহুল্য বাউলশ্রেষ্ঠ লালনও এই ধারণার আওতামুক্ত ছিলেন না।
মুন্সী এমদাদ আলী (১৮৮১-১৯৪১) প্রনীত ‘রদ্দে নাড়া’ (অপ্রকাশিতঃ ২৪ আষাঢ় ১২২৪) পুথিতে বাউল বা ‘নাড়ার ফকির’দের বিশদ পরিচয় দিয়ে তাঁদের তীব্র নিন্দা-সমালোচনা করা হয়েছে। লেখক প্রসঙ্গক্রমে পুথির ভুমিকায় লালন শাহের নামোল্লেখ করে বলেছেনঃ
‘নাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি ইহাদিগের মধ্যে আমাদের দেষে এই নাড়ার হট্টগোলই বেশী। আমাদের দেষে প্রধানত দুই শ্রেণীর নাড়া দেখিতে পাওায়া যায়। এক শ্রেণীর নেতা জেলা নদীয়া মহকুমা কুষ্টিয়ার অধিন ছেউড়িয়া নিবাসী লালন সা তাঁহার রচিত বহুবিধ গান লোকমুখে প্রচলিত আছে। কিন্তু রচিত কোন পুস্তকাদী নাই। নাড়ার ধর্ম সন্মন্ধেও আমি যতদূর নিজে অবগত হইয়াছি ইনশাল্লা পাঠক-পাঠীকাগনের নিকট উপস্থিত করিব বাসনা করিয়াছি। ইহার দ্বারা মছলেম সমাজে কোন উপকার হইলে শ্রম সফল জ্ঞান করিব।’
লেখক এরপর বাউল বা নাড়াধর্ম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেনঃ
‘নাড়া যে কি ধর্ম তাহা ব্যক্ত করা বড়ই দুরহ। এমন অসভ্য অশ্লীল ব্যবহার জগতে কোন মনুষ্যের দ্বারা হইতে পারে এমন বিশ্বাস হয় না।’
রংপুর জেলার বাঙ্গালীপুর নিবাসী মওলানা রেয়াজউদ্দিন আহমদ ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ অর্থাৎ ‘বাউলমত ধ্বংস বা রদকারী ফৎওয়া’ প্রণয়ন ও প্রচার করেন। বাংলা ১৩৩২ সালে এই ‘ফৎওয়া’র দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বাংলার প্রখ্যাত ওলামা ও নেতৃবৃন্দ এই ফতোয়া সমর্থন ও অনুমোদন করেছিলেন। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’র ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৩৩ সালে। ২য় খণ্ডের প্রধান উল্লেখ্য বিষয় হলো লালন সাঁই সম্পর্কে মন্তব্যসহ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রকাশ। এতে লালন সম্পর্কে মুসলিম সমাজ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মনোভাব ও দৃষ্টি ভঙ্গির যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ফৎওয়া’র এই ২য় খন্ডে বসন্তকুমার পালের ‘ফকির লালন শাহ্’ (‘প্রবাসী’, শ্রাবণ ১৩৩২) প্রবন্ধটি উদ্ধত করে মন্তব্য করে হয়েছেঃ
‘লালন সাহের জীবনী পাঠে বুঝা যায় লালন সাহার ধর্মের কোনই ঠিক ছিল না। বরঞ্চ তাঁহার ভাবের গান ও কবিতা বলির ভিতর দিয়া পরিস্ফুটিত হয় যে তিনি হিন্দু জাতির একজন উদাসীন ছিলেন। তিনি কেবল মোছলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদি ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই, হিন্দু সমাজ তাহাঁকে সমাজচুত্য করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্ন ভোজন ব্যতীত, এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজ, রোজা প্রভৃতির কোন চিহ্নই কিংবা আচার ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে ছিল না, যদ্দারা তাহাঁকে মোছলমান বলা যাইতে পারে, তিনি এছলামের হোলিয়া অনুসারে মোছলমানের দরবেশ ফকির হওয়া দূরে থাক একজন মোছলমান বলিয়াও পরিগনিত হইতে পারেন না। তিনি যত বড়ই মুনি, ঋষি, উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন। কেহ মোছলমানে অন্ন খাইয়াই মোছলমান হইতে পারেন না। কারণ মোছলমানই মোছলমানের পাকে ভোজন করিয়া থাকে। যাহার মধ্যে এছলামের রীতিনীতি ও কার্যকলাপ গুলি শরীয়তের কাটায় মিলিবে না, তিনি মুনি-ঋষি, দরবেশ ফকির যে কোন নামেই পরিচিত হইন না কেন, মোছলমান তাহাঁকে কোনই শ্রেণী-মধ্যে পরিগনিত করিয়া লইতে পারে না। অতএব লালন সাহার মধ্যে শরীয়তের চিহ্ন না থাকায় তিনি মোছলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নহেন। সুতারাং বাউল বা ন্যাড়ার ফকিরগন যে লালন সাহাকে মোছলমানের সেরা পীর, দরবেশ বলিয়া তাঁহার পদ অনুসরনকরতঃ মোছলমানের দরবেশ ফকিরের দাবী করিয়া দুনিয়াটাতে তোলপাড় করিয়া তুলিয়াছে, ইহা তাহাঁদের পথভ্রষ্টের পরিচয় মাত্র।’
‘লালন সাহার পরিচয় ত ইহাই দাঁড়াইল কিন্তু বাউল, ন্যাড়ার ফকিরগন লালন শাহ্ সন্মন্ধে কোনই পরিচয় না জানিয়া হুজুগে মাতিয়া হিন্দু বৈষ্ণবগনের দেখাদিখি লালন সার পদে গা ঢালিয়া দিয়া মুসলিমসমাজের কলঙ্কস্বরূপ হইয়াছে ইহা অতিশয় পরিতাপের বিষয় তাহাঁদের ধাঁধা এখন ঘুচাইবে কে ?’
বাউল নাকি ফাউলঃ কাদের সংস্কৃতি, কাদের বিশ্বাস?
গত ১৫ অক্টোবর কিছু ইসলামী দল ও এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের চত্বর থেকে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য অপসারণ করেছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপর থেকে এদেশের সংস্কৃতিমনা, বাউলপ্রেমিক এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় ক্ষোভে দুঃখে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এ ভয়ঙ্কর ঘটনার (?) তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বাউল ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে এবং তা পূনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা (?) প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। তাদের ভাষায় মৌলবাদের আখড়া (?) স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যা হচ্ছে, কোন সভ্য-ভব্য দেশে তা ঘটার কথা নয়। খোলা চিঠিতে তারা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে “লালন চত্বর”
নামকরণ করা এবং সেখানে মান সম্মত বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের দাবী জানিয়েছে। প্রগতিশীলতার একতরফা দাবীদার চিহ্নিত কিছু পত্রিকায় তাদের ধারাবাহিকভাবে বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে বাউলপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের জ্বালাময়ী কিছু রচনাও প্রকাশিত হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় “চাই মুক্তসমাজ এবং শিল্প ও জ্ঞানচর্চার অবাধ পরিবেশ” নামক রচনায় বলা হয়, “গীতিকার ও বাউল সাধক লালন শাহ বাংলাদেশ ও বাঙালীর অমূল্য সম্পদ। বাউল ভাস্কর্যের উপর অপশক্তির এ ধরণের ঘৃণ্য হামলা কার্যত আমাদের চিরায়ত সামাজিক ধর্মীয় সম্প্রীতি ও আত্মপরিচিতির বন্ধনমূলে কুঠারাঘাত হানার সামিল। আমাদের লড়াই এমন এক শক্তির বিরুদ্ধে, যারা বোঝে না সৌন্দর্য্য কি, পাখি-ফুল-নদী কি, সংস্কৃতি কি, গান নাটক কবিতা কি? এরা অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ, আর এদের প্রশ্রয় দেওয়ায় এই অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। সংস্কৃতি ও রাজনীতির উপর মৌলবাদীদের অব্যাহত আগ্রাসন যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। মৌলবাদের ভয়ে নতজানু হলে উত্থান ঘটবে জঙ্গিবাদের, আমাদের বাস করতে হবে প্রশ্নহীন এক মৃত সমাজে।” একই দৈনিকে গত ২৭ অক্টোবর লেখক হুমায়ুন আহমেদ “এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব?” নামক রচনায় লিখেছেন, “আফগানিস্তানের তালেবানরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি (যা ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ) ভেঙ্গে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাঙছি সাঁইজির মূর্তি। যার জীবনের সাধনায় ছিল আল্লাহর অনুসন্ধান।”
বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে যখন জোরদার আন্দোলন চলছে, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্যে আলোচনায় চলে এসেছে। কেউ কেউ বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে আবার কেউবা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আসলে বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থহান নেয়ার পূর্বে আমাদের জানর প্রয়োজন কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? ৯৭ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। “বাউল” শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার “বাংলাদেশের বাউল” বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল তথা হুবাল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম এক সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।”
(বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি। আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরআন তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।” (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
বাউলদের গুরু লালিন ফকিরের জীবন সম্পর্কে বেশী কিছু জানা যায় না। তার মৃত্যুর দু সপ্তাহ পর বাংলা ১২৯৭ সালে কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে “পাক্ষিক হিতকারী” পত্রিকায় লালন ফকির সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, “ …… লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, অথচ সকল ধর্মের লোকেরা তাহাকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমানদিগের সহিত তাহার আহার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাহাকে মুসলমান মনে করিত। বৈষ্ণব ধর্মেও মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। …… অধিক কি ইহার শিষ্যগণ ইহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারো উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিত না। …… ইনি নোমাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায়? তবে জাতিভেদ বিহীন অভিনব বৈষ্ণব বলা যাইতে পারে; বৈষ্ণব ধর্মের দিকে ইহার অধিক টান। শ্রী কৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাস করিতেন। …… মৃত্যুকালে কোন সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিম কার্য্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই।” (বাংলাদেশের বাউল পৃঃ ৪১৮-৪১৯)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,
“বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯) এছাড়া গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লালন ফকির এবং বাউলদের গানে এমন অনেক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যা কাফের ও মুরতাদের সমগোত্রীয়। সুধীর চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুসারে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে লালনতত্ত্ব মুশরিক। কারণ, লালন ফকির বিশ্বাস করতো যিনি আল্লাহ, তিনিই রাসুল, তিনিই নবী। এটি ইসলামী আকিদার ঘোরতর পরিপন্থী। যেমন।
“যেহিতো মুরশিদ সেহিতো রাসুল
এই দুইয়ে নেই কোন ভুল
মুরশিদ খোদা ভাবলে জুদা
তুই পড়বি প্যাঁচে।”
বিকৃত যৌনাচারী লালন বলে--
ত্রিবেনীর তিন ধারে মীনরুপে সাঁঈ বিরাজ করে।
অর্থাৎ সাঁঈ বা মনের মানুষ মাছ রুপে নারীর যোনীতে বাস করে, রজ:শ্রাবের সময় তাকে ধরতে হয়।
বাউল সুফীসাধকেরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারণ মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ “বাউল ধ্বংস ফতওয়া” নামে বাউলবিরোধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।
তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে ‘লালন চত্বর’ ঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী বিশ্বের এজেন্ট ও ভোগবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী এইসব গণবিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবি, যাদের নিজেদের জীবনে ইসলামের নামনিশানা নেই, তারা ইসলামের দোহাই দিয়েই এই ভোগবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। হুমায়ুন আহমেদ তার রচনায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এবং ইসলামের শত্রুপক্ষের অনুদিত বই “দি লাইফ অব মোহাম্মদ” গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে লালন মুর্তিকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমি বলবো তিনি কি জানেন এই বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং প্রখ্যাত মুসলিম স্কলারদের কাছে ওরিয়েন্টালিস্টদের হাতে অনুদিত বই প্রত্যাখ্যাত? কাফির মুশরিকরা ইসলামের ইতিহাস বিকৃতিতে কতোখানি পারঙ্গম তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস “দ্যা জুয়েল অফ মদিনা”। যেহেতু হুমায়ুন আহমেদ প্রসিদ্ধ মুসলিম স্কলারদের অনুদিত সীরাত গ্রন্থকে পাশ কাটিয়ে ইহুদী নাসারাদের অনুবাদকে রেফারেন্স হিসেবে নিয়েছেন, সেহেতু আমরা ধরে নেব তিনিও শত্রুপক্ষের একজন। এছাড়া যারা মুহম্মাদ (সা) এর কিছু হাদিস এবং তার জীবনের দু একটি ঘটনাকে এর সপক্ষে যুক্তিপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করাতে চাইছেন তাদের আমরা বলব মুর্খ মোল্লাদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্য খুব একটা দায়ী করা যায় না। কিন্তু যারা দেশে বিদেশে বড় বড় ডিগ্রী নিয়েছেন, যারা স্বগর্বে নিজেদের নামের পূর্বে ডক্টরেট উপাধি লাগিয়ে থাকেন, জন্মসূত্রে মুসলিম হবার পরও প্রিয়নবীর জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রসূত বক্তব্যের জন্য অবশ্যই তাদের দায়ী করা যায়।তারা চায়, এদেশের তরুণ সমাজও ধ্বংসম্মুখ পাশ্চাত্য বিশ্বের মত লাগামহীন নৈতিকতা বিবর্জিত জীবনে অভ্যস্থ হোক। কুকুর-বিড়ালের মত বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার হোক তাদের নিত্যসঙ্গী। আর তাই, কৃষ্টি, কালচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আধুনিকতা, ইত্যাদির উছিলায় বিকৃত বাউল সংস্কৃতিকে তারা জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরাই হচ্ছে সেই শক্তি যারা নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী মুক্তি ইত্যাদি আকর্ষণীয় ব্যনারে পশ্চিমের নারীদের মত এদেশের নারীদেরও পুরুষের বিকৃত বাসনা পূরণের সেবাদাসীতে পরিণত করতে চায়। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভোগবাদী জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে সুগম করতে চায় পশ্চিমা পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জনের পথ।
তাই যারা না বুঝে বাউল সংস্কৃতির পক্ষ নিচ্ছেন তাদের উচিত, রাও ভেবে চিন্তে পক্ষ নেয়া। কারণ, যারা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইমান আকিদার বিরুদ্ধে, যারা সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদার পুঁজিবাদীগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী, যারা শোষক আর শোষিতের চিরন্তন আদর্শিক সংগ্রামে বঞ্চিত – অসহায় মানুষের বিপক্ষের কাতারের মানুষ তারা কখনো এদেশ ও জাতির বন্ধু হতে পারে না। যারা এদেশে সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথকে সুগম করতে চায় তারা কখনো দেশপ্রেমিক হতে পারে না। যাদের কর্ণকুহরে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, দারফুর, কঙ্গো, পাকিস্তান, কাশ্মীর সহ পৃথিবীর আপামর নির্যাতিত গোষ্ঠীর আর্তনাদ পৌছায় না তারা কখনো মানবদরদী হতে পারে না। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী কথিত নাস্তিক শ্রেণী বাউল প্রেমের নামে দেশ ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একথা স্পস্টভাবেই বলা যায়।।
“বাউল তত্ত্ব” – ডঃ আহমদ শরীফ।
“বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” – লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডঃ আনোয়ারুল করিম।
ফাহমিদা ফারহানা খানম,https://liberatethethinkers.wordpress.com/…/বাউল-নাক…/amp/০৭ নভেম্বর ২০০৮
২০০৮
বাউল লোকসম্প্রদায়ের একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী, যারা গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা গেলেও সাধারণত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর এবং পাবনা অঞ্চলেই এদের বেশি দেখা যায়। বাউলরা দেহভিত্তিক গুপ্ত সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সহজিয়া ও সুফি সাধনার সম্মিলন ঘটেছে; তবে সুফি ভাবনার প্রভাবই বেশি। বাউলরা মসজিদ বা মন্দিরে যায় না। কোনো ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই। মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য বা জাতিভেদে তারা বিশ্বাসী নয়। তারা মানবতাবাদী। তাদের বিশ্বাস জন্মগতভাবে কেউ বাউল নয়, গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়েই বাউল হতে হয়। বাউল সাধনা মূলত নারী-পুরুষের যুগলসাধনা। তবে জ্ঞানমার্গীয় একক যোগসাধনাও আছে।
কুষ্টিয়ার লালন শাহর মাজারে একদল বাউল
বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘বাউল’ শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পনের শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ-জুলেখা, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়, ষোলো শতকের বাহরাম খানের লায়লী-মজনু এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে ‘বাউল’ শব্দের ব্যবহার আছে। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, অন্ততঃপক্ষে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। সাম্প্রতিককালের এক গবেষণায় জানা যায় যে, পারস্যে অষ্টম-নবম শতকে সুফিসাধনা প্রবর্তনকালে ‘বা’আল’ নামে সুফি সাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। তারা ছিল সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্ত সাধনপন্থী। মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে তারা গান গেয়ে বেড়াত। অন্যান্য সুফিসাধকদের মতো তারাও এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই বাংলায় বাউল সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে।
বাউলদের আচার-আচরণ অদ্ভুত এবং বিচিত্র হওয়ায় কেউ কেউ তাদের ‘পাগল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ কারণে সংস্কৃত ‘বাতুল’ (পাগল, কান্ডজ্ঞানহীন) ও ‘ব্যাকুল’ (বিহবল, উদ্ভ্রান্ত) শব্দদ্বয়কে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তিমূল বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ পারসি ‘বা‘আল’ বা আরবি ‘আউলিয়া’ (বন্ধু, ভক্ত) শব্দ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন। বা‘আলরা তাদের প্রেমাস্পদের উদ্দেশে মরুভূমিতে ‘পাগল’ বা ‘ক্ষ্যাপা’র মতো গান গেয়ে বেড়ায়। তারা সংসারত্যাগী এবং সকল বাধা-বন্ধনহীন। বাউলরাও অনেকটা পাগল বা ক্ষ্যাপার মতো।তবে তারা যে অর্থে ‘পাগল’ বা ‘ক্ষ্যাপা’ তা কেবল সুফি ‘দিওয়ানা’ শব্দের সঙ্গেই তুলনীয়।
সুফি সাধনায় যিনি সাধকের পরমারাধ্য বা পরমার্থ, তিনিই বাউলের মনের মানুষ এবং বাউলদের মতে তাঁর অবস্থান মানবদেহে। বাউলরা তাঁকে সাঁই (স্বামী), মুর্শিদ (পথনির্দেশক), গুরু (বিধানদাতা) ইত্যাদি নামে অভিহিত করে এবং তাঁরই সান্নিধ্যলাভে পাগল হয়।
প্রকারভেদ বাউলদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহী বা সংসারী বাউল। যারা গুরুর নিকট ভেক খিলাফৎ-এর মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করে তাদের ত্যাগী বা ভেকধারী বাউল বলা হয়। এই শ্রেণির বাউলরা সংসার ও সমাজত্যাগী। ভিক্ষাই তাদের একমাত্র পেশা। তারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করে। পুরুষরা সাদা লুঙ্গি এবং সাদা আলখাল্লা এবং মহিলারা সাদা শাড়ি পরিধান করে। তাদের কাঁধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না। এ ধরনের জীবনকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’ বা জীবন্মৃত। মহিলাদেরকে বলা হয় সেবাদাসী। পুরুষ বাউল এক বা একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারে। এই সেবাদাসীরা বাউলদের সাধনসঙ্গিনী। ১৯৭৬ সাল অবধি বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় ২৫২ জন ভেকধারী বাউল ছিল। ১৯৮২-৮৩ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০৫ জনে দাঁড়ায়। বর্তমানে সমগ্র দেশে ভেকধারী বাউলের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।
গৃহী বা সংসারী বাউলরা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ লোকালয়ে একটি স্বতন্ত্র পাড়ায় বাস করে। সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা, বিবাহ ইত্যাদি নিষিদ্ধ। ভেকধারী বাউলদের মতো তাদের কঠোর সাধনা করতে হয় না; ‘কলমা’ বা ‘বীজমন্ত্র’ পাঠ এবং নির্দিষ্ট কিছু সাধন-ভজন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই হয়। ভেকধারী বাউলরা গৃহী বাউলদের দীক্ষা দিয়ে থাকে। উভয়ের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। দীক্ষা নেওয়ার পর সন্তানধারণ নিষিদ্ধ, তবে গুরুর অনুমতিক্রমে কেউ কেউ সন্তান ধারণ করতে পারে। বর্তমানে কৃষিজীবী, তন্তুবায় এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাউল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে অনেকে কলকারখানার শ্রমিক ও দৈনন্দিন মজুর পর্যায়ভুক্ত। বাউলমতে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে বিবাহ হয়ে থাকলে নতুন করে কোনো অনুষ্ঠান করতে হয় না। ত্যাগী বাউলদের সেবাদাসী ‘কণ্ঠিবদল’ করে একজনকে ছেড়ে অন্য জনের সঙ্গে চলে যেতে পারে। বর্তমানে গৃহী বাউলদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গুরুধারা বাউলদের ‘ঘর’ বা ‘গুরুধারা’ আছে। এক একজন প্রধান বাউলগুরুর নামানুসারে এই ‘ঘর’ নির্দিষ্ট হয়। যেমন লালন শাহী, পাঞ্জু শাহী, দেলবার শাহী, পাঁচু শাহী ইত্যাদি। বাউলদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় হলো কর্তাভজা। এরা বৈষ্ণবপন্থী এবং ‘সতীমায়ের ঘর’ বলে পরিচিত। সতী মা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান গুরু। বাউলদের এসব ঘর বা গুরুধারার মধ্যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য উভয়ই আছে। বৈসাদৃশ্য তাদের সাধন-ভজন এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। লালন শাহ্র মধ্যে সুফি সাধনপ্রক্রিয়াসহ তন্ত্রযোগ এবং সহজিয়া সাধনতত্ত্ব এবং পাঞ্জু শাহ্র মধ্যে সুফিভাবনা ও দর্শন অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।
আখড়া বাউল-ফকিরদের সাময়িক আবাসস্থলের নাম আখড়া। এসব আখড়া পল্লিগ্রামের লোকালয় থেকে একটু দূরে অবস্থিত। সাধারণত সংসারত্যাগী এবং ভেকধারী বাউল-ফকিররাই এখানে অবস্থান করে। গুরুগৃহ এবং তার সমাধিকে কেন্দ্র করেও আখড়া গড়ে ওঠে। লালন শাহ্র সমকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকার বিক্রমপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, শ্রীহট্ট (সিলেট), ত্রিপুরা (কুমিল্লা), রংপুর, নিলফামারী, পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়াতে বাউল-ফকিরদের আখড়া ছিল। ঝিনাইদহ অঞ্চলে হরিণাকুন্ড থানার কুলবেড়ে হরিশপুর গ্রামে পাঞ্জু শাহ্র বসতবাড়ি ও সমাধিকে কেন্দ্র করে আখড়া গড়ে উঠেছে। লালন ফকিরের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে। আখড়ায় ভক্তরা জড় হয়ে গান গেয়ে ধর্মকর্ম পালন করে। ছেঁউড়িয়ায় প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় তিনদিন ব্যাপী ‘মচ্ছব’ (মহোৎসব) ও ‘সাধুসেবা’ অনুষ্ঠিত হয়।
বাউলবিরোধী আন্দোলন বাউল সম্প্রদায় অতীতকাল থেকেই এক শ্রেণির মানুষের কাছে যেমন সমাদৃত হয়েছে, তেমনি অন্য এক শ্রেণির গোঁড়া সম্প্রদায়ের নিকট ধিকৃত ও নিন্দিতও হয়েছে। লালন নিজেও এর শিকার হয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্বপ্রদায়ই বাউলদের প্রতি কমবেশি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিল। এর কারণ বাউলরা সকল প্রকার শাস্ত্রাচার ও জাতিভেদপ্রথাকে অস্বীকার করে এবং দেহবাদী অধ্যাত্মসাধনায় নিয়োজিত থাকে। তাদের এই সাধনায় নারীকে তারা সঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের সাধনা প্রেমনির্ভর অধ্যাত্মবাদী হলেও তা মিথুনাত্মক যৌনাচারমূলক হওয়ায় সুশীল সমাজ কর্তৃক নিন্দিত। ১৯৪২ সালে কুষ্টিয়া অঞ্চলে মওলানা আফসারউদ্দিনের নেতৃত্বে ‘বাউল খেদা’ নামে একটি আন্দোলনও হয়।
বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। এটি লোকসঙ্গীতের অন্তর্গত। এ গানের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এ গানের প্রচলন ছিল। বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ এবং দুদ্দু শাহ্ প্রধান। এঁদের ও অন্যান্য বাউল সাধকের রচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এসব গানকে ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া’ গান নামেও অভিহিত করেন।
বাউল গান সাধারণত দুপ্রকার দৈন্য ও প্রবর্ত। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে রাগ দৈন্য ও রাগ প্রবর্ত। এই ‘রাগ’ অবশ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ নয়, ভজন-সাধনের রাগ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউল গানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থে অভিমান এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। কাঙ্ক্ষিতজনের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় অবস্থার নামই রাগ। রাগ দৈন্যে এমন ভাবই লক্ষণীয়। বাউলরা তাদের সাধনপন্থাকে রাগের কারণ বলে অভিহিত করে (আমার হয় না রে সে মনের মত মন/ আগে জানব কি সে রাগের কারণ)।
বাউল গান সাধারণত দুটি ধারায় পরিবেশিত হয় আখড়া আশ্রিত সাধনসঙ্গীত এবং আখড়াবহির্ভূত অনুষ্ঠানভিত্তিক। আখড়া আশ্রিত গানের ঢং ও সুর শান্ত এবং মৃদু তালের। অনেকটা হাম্দ, গজল কিংবা নাত সদৃশ্য। লালন শাহ্র আখড়ায় বসে ফকিররা এ শ্রেণির গান করে থাকে। অপর ধারার চর্চা হয় আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানাদিতে, জনসমক্ষে। এ গান চড়া সুরে গীত হয়। সঙ্গে একতারা, ডুগডুগি, খমক, ঢোলক, সারিন্দা, দোতারা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। তাল দাদরা, কাহারবা, কখনও ঝুমুর, একতালা কিংবা ঝাঁপতাল। শিল্পীরা নেচে নেচে গান করে। কখনও গ্রাম এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে বাউল গানের মাধ্যমে তা নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। বাউলরা কখনও একক আবার কখনও দলবদ্ধভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে। এ গানের একজন মুল প্রবক্তা থাকে। তার সঙ্গে অন্যরা ধুয়া বা ‘পাছ দোয়ার’ ধরে।
বাউল গানে কেউ কেউ শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এ গান মূলত ধর্মীয় লোকসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ও বিকাশ লোকসঙ্গীতের অনেক পরে। আধুনিক শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও কখনও রাগের ব্যবহার হলেও তা সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়।
বাউল গানে সাধারণত দুধরনের সুর লক্ষ করা যায় প্রথম কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর এবং অন্য সব কলিতে কিছুটা ভিন্ন সুর। সবশেষে দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ পুনরায় গীত হয়। এ গানে অস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। অস্থায়ীকে কখনও ধুয়া, মুখ বা মহড়া বলা হয়। দ্রুত লয়ের এ গানে প্রতি অন্তরার পর অস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো গানে সঞ্চারী থাকে; আবার কোনো কোনো গানে নাচেরও প্রচলন রয়েছে, যার উৎস গ্রামীণ পাঁচালি গান বলে মনে করা হয়। তবে আখড়া আশ্রিত বাউল গানে নাচের প্রচলন নেই।
কিছু কিছু বাউল গান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। তবে বাউল গানে সুফিভাবনাই প্রবল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাউল গানে সুরের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণব সুরের আধিক্য, আর বাংলাদেশে সুফি গজলের প্রভাব, যার একটি দেশজরূপ ভাবগান ও শব্দগান। বাউল গানের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এতে একটা উদাসী ভাব লক্ষ করা যায়; এর সুরে যেন মিশে থাকে না-পাওয়ার এক বেদনা।
বাউল গানের একটি বড় সম্পদ তার গায়কী বা গায়নশৈলী। উল্লেখ্য যে, বাউল গান একটি বিশেষ অঞ্চলে রচিত হলেও সঙ্গীতশিল্পীদের কারণে এর ওপর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাব পড়ে। ফলে সুর ও গায়কিতে আসে পরিবর্তন। কখনও কখনও শব্দেও পরিবর্তন ঘটে। লক্ষ করা গেছে, কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গান যখন সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী বা দিনাজপুরে গীত হয়, তখন বাণীর উচ্চারণে, সুরের প্রক্ষেপণে এবং গায়কিতে পরিবর্তন আসে। কিন্তু তারমধ্যেও মূল সুর ও বাণীর মধ্যে কমবেশি ঐক্য বজায় থাকে।
অতীতে বাউল বা লালনের গানে নির্দিষ্ট কোনো সুর ছিল না। পরবর্তীকালে লালনশিষ্য মনিরুদ্দিন ফকির এবং তাঁর শিষ্য খোদা বক্স এই গানের একটি ‘ছক‘ বাঁধার প্রচেষ্টা নেন। খোদা বক্সের শিষ্য অমূল্য শাহ্ ছিলেন একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি বাউল তথা লালনগীতির একটি সঙ্গীতকাঠামো নির্মাণ করেন। তাঁর শিষ্য বেহাল শাহ্, শুকচাঁদ, দাসী ফকিরানী, চাঁদার গহর, নিমাই শাহ্, মহেন্দ্র, কানাই ক্ষ্যাপা, মতি ফকিরানী প্রমুখ এ গানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। পরবর্তী সময়ে মহিম শাহ্, খোদাবক্স শাহ্, ঝড়ু শাহ্, করিম, বেল্লা, ফকিরচাঁদ, জোমেলা, খোরশেদ ফকির, লাইলি, ইয়াছিন শাহ্ প্রমুখ এর আরও উৎকর্ষ সাধন করেন। বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী মকছেদ আলী খান বাউল গান ও লালনগীতির আধুনিকীকরণ করেন এবং তাঁর শিষ্য ফরিদা পারভীন বর্তমানে লালনগীতির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শিল্পী। তিনি বাউল গান ও লালন গীতিতে নতুন মাত্রা ও সুর সংযোজন করেন।
বাউল গানের একাধিক ঘরানা আছে। অবশ্য এ ঘরানা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রীতি অনুযায়ী নয়। এ ঘরানা সাধন-ভজন সংক্রান্ত। বাউল গানের ঘরানার সংখ্যা পাঁচ লালন শাহী, পাঞ্জু শাহী, দেলবার শাহী, উজল শাহী এবং পাঁচু শাহী। লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্ প্রমুখ পঞ্চ বাউলকে কেন্দ্র করে এই পাঁচটি ঘরানা গড়ে উঠেছে।
বাউল গানে নানা তত্ত্বকথা আছে যেমন দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব অথবা নবীতত্ত্ব, লীলা অথবা মনের মানুষ তত্ত্ব ইত্যাদি। প্রতি গানে দুটি পদ থাকে দেহতত্ত্ব এবং ভজনতত্ত্ব। বাউলরা নিজেদের ভাষায় এ দুটিকে উপর পদ এবং নিচের পদ বলে উল্লেখ করে। বাউল গানের সুরে কখনও কখনও ভাটিয়ালি সুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ মাঝিমাল্লারাও অনেক সময় নৌকা বাইতে বাইতে ধীর লয়ে এ গান গেয়ে থাকে। বাউল গানের বিশেষত্ব এই যে, এ গান কেবল বাউল সাধকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাউলের সাধন-ভজন জানে না এমন সাধারণ মানুষও অধ্যাত্মরসের কারণে এ গান নিজের করে নিয়েছে। [আনোয়ারুল করীম]
লালন তত্ত্ব এবং বাউল সমাজের ধর্ম বিশ্বাস
১২৪৮ সালে মালাধর বসু কর্তৃক লিখিত 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থে প্রথম বাউল শব্দটি পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদদের মতে, "সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধব বিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন [1]।" প্রফেসর উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য তার ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান' গ্রন্থে লিখেছেন, বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ খৃস্টাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে,"বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব [2]।" "তবে জগমোহন গোসাঈ কে (জগন্মোহিনী বাউল) সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলা হয়। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয় [3]।" বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। অনেকে বলেন ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল এসেছে। বাতুল শব্দের অর্থ উন্মাদ, পাগল ইত্যাদি। অনেকে বলেন বৌদ্ধ সহজিয়া মতে ব্যবহৃত ‘ব্রজকুল’ থেকে ‘বাজুল’ এবং তা থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। "আরবি 'আউল' বা হিন্দি 'বাউর' থেকেও শব্দটি আসতে পারে [4]।" সংসদ বাংলা অভিধানে বাউল শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে, "ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও সংস্কার হইতে মুক্তসাধক সম্প্রদায় বিশেষ, খেপা লোক, পাগল [5]।" অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' বইতে বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের সন্ধান দেন তা হলো - বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ,কর্তাভজা, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই,পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পণারায়নী, বড়ী, অতি বড়ী, রাধাবল্লভী, সখি ভাবুকী। সেই সময়ে এই রকম অনেকে উপধর্ম চালু ছিল॥ বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ড. আনোয়ারুল করিম লিখেছেন, "প্রাচীন প্যালেস্টাইনের রাসসামরায় (বা'আল) নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। এবং এই ধর্মের লোকদের মধ্যে মৈথুন যৌনচার গুরত্বপুর্ণ বিষয় ছিল॥ এই বা'আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল, যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগ নির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা'আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে [6]।" বাউলদের সাধনার দুটি মুখ্য রীতি - জ্ঞানমার্গীয় যোগসাধনা আর মিথুনাত্মক যোগসাধনা। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারী সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী সম্ভোহ বাউল ধর্মে স্বীকৃত। বাউলরা দেহ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নর-নারীর মিলন ও সঙ্গমকে ধর্মীয় ভাবে বৈধ করে। তাদের কাছে গুরুই সব। প্রয়োজনে গুরুর উপস্থিতিতে মিলন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাইতো বাউলরা গায়, "আমার দেহ-জমি আবাদ হইল না গুরুর বীজ বুনতে পারলাম না। ও বীজ বুনতে পারলে হত কামরাঙ্গা ফলপুষ্ট হত দানা..." অদ্ভুত বাউলদের ধর্ম বিশ্বাস।
"বাউলদের মধ্যে হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা হিন্দু ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,"কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
...মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে [7]।"
তবে অনেক বাউল গান আছে যেখানে সাধন তত্ত্ব ও সাধন রীতির কথা সরাসরি বলা হয়েছে। আবার কতক গানে সাধনার রীতি পদ্ধতি রহস্যময়॥ তবে বাউলরা বিশ্বাস করে যে, 'আপন সাধন কথা, না কহিবে যথা তথা'। "বাউলদের যে গোপন সাধনাটি নিয়ে বারবার নানা জায়গায় আলোচনা দেখা যায় তা হল ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ প্রক্রিয়া। অনেক বাউল গানে এর উল্লেখ আছে॥ বিভিন্ন গানে উল্লিখিত চারটি চন্দ্র হল – শুক্র, রজঃ, বিষ্ঠা ও মূত্র। দেহ নিঃসৃত এই চার পদাত্থকে প্রতীকের ভাষায় ‘চারি চন্দ্র’ বলে [8]।"
বাউলরা চারিচন্দ্র ভেদ করতো অর্থাৎ "মল-মূত্র, রজঃবীর্য পান করতো [9]।"
বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। "এছাড়া, তারা রোগ মুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র পান করে॥ সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে [10]।" নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে।
বাউল সম্প্রদায়ই মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। "মদ্যপান, নারী পুরুষের অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল। বাউলগণ যৌন সঙ্গমকে যৌন পূজা মনে করে [11]। তবে বাউলদের কথা উঠলে বাউল সম্রাট লালনের কথা উঠবেই॥ বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। গবেষক লেখক শক্তিনাথ ঝা শান্তি নিকেতন থেকে লালনের নির্ভরযোগ্য যে গানের খাতাটি উদ্ধার করেন সেখানে লেখা ছিল, "শ্রী লালনশাহ দরবেসের তালেব শ্রী ভোলাই শা ফকির এই বহির মালিক [12]।" আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয় [13]। ১৩৩৩ সালে রংপুরের মাওলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়। তিনি সেখানে মত দেন ,"লালন সাহার ধর্মের কোনো ঠিক ছিল না। তিনি কেবল মুসলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদই ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই হিন্দু সমাজ তাঁহাকে সমাজচ্যূত করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্নভোজন ব্যতীত এছলাম গ্রহণ করেন নাই বা মোছলমান বলিয়া নিজেকে স্বীকার করেন নাই বা এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজ রোজা প্রভৃতির কোনো আচার-ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল না, যা দ্বারা তাহাকে মোছলমান বলা যাইতে পারে। তিনি যত বড় মুনি ঋষি উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন [14]।"
অবশ্য এইসব নিয়ে গবেষনার অন্ত নাই॥ জীবদ্দশায় লালন ফকিরের সাথে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির আলাপ-পরিচয় ছিল॥ 'সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক ছাড়াও সেই সময়কার জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল [15]॥' রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের নাম জড়িয়ে অনেক কল্প-কাহিনী রচনা করেছেন বিভিন্ন গবেষক। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে লালন অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন। "বরং লালনের মৃত্যুর পর তার সমাধি তৈরি করার জন্য কোনো জমিদারই সাহায্য করেনি। পরবর্তীতে আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পরে গেলে জমিদারগণ ১৯৪৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য লালনের আখড়াটি নিলামে তোলেন। লালনের শিষ্যরা ১ শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি কিনে আখড়ার অস্তিত্ব রক্ষা করেন [16]।" তবে বাউল মানেই মনে করা হয় গাজাখোর॥ যা প্রমাণের জন্য বর্তমানে দেশের যেকোনো বাউলের আখড়ায় যাওয়াই যথেষ্ট। তবে ইতিহাস বলে, "লালন শাহের শিষ্য উজল শাহের গাঁজা সেবন করার বদ অভ্যাস থাকার কারণে লালন শাহ তাকে আখড়াবাড়ি হতে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন [17]। লালন শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী শিষ্য দুদ্দু শাহ গাঁজা সেবনকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ মনে করতেন। তাইতো তিনি বলেছেন,যেও না শুকনো বৈরাগীর দলে, গাঁজা খেয়ে মালা টিপে ফেলাবে গোলে। তবে বাউল গন বিভিন্ন সময়ে হিন্দু এবং মুসলমানদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশ শতকের গোড়ায় যে ‘বাউল ধ্বংস আন্দোলন’ হয় তাতে অন্যতম অভিযোগ ছিল বাউলরা ধর্মের নামে অবাধ যৌনলীলা ও নানা বিধ অশ্লীল আচার আচরন করে। যৌন ব্যাপারে বাউলদের কোন পাপবোধ ছিল না। এই যৌন স্বাধীনতার কারণেই অনেক তরুণ ও যুবক সেই সময় বাউল হতে আকৃষ্ট হয়। ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমির সভাপতি থাকাকালীন একজন প্রফেসর লালন সমাধিসৌধে বিভিন্ন সময় মিলাদ, কোরান পাঠ ইত্যাদি ইসলামিক কার্যক্রম চালান। এর প্রতিবাদে লালন শাহের অনুসারী বাউলগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের বরাবরে প্রফেসর সাহেবের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদলিপি দাখিল করেন। যার ভাষ্য ছিল এমন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না মুসলমান না হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। কিন্তু উক্ত অধ্যাপক আমাদের এই তীর্থ ভূমিতে ঢুকে কোরআন তেলোয়াত করেন,ইসলামের কথা বলেন - এসবই আমাদের তীর্থ ভূমিতে আপত্তিকর [18]।" আমরা আলাদা একটি জাতি, "আমাদের কালেমাও আলাদা – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ [19]।" হিন্দুবাদ ও সুফিবাদের মিশ্রণ বাউল দর্শনের মূল কথা হলো মানবতা৷
বাউলদের কাছে সংসার এবং সমাজ উভয়টাই পরিত্যাজ্য। জীবনের জৈবিক প্রয়োজনে তারা সাধন সঙ্গী সন্ধান করে; আর মানুষের দেয়া ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে— "তাহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাহাদের ছাড়িয়ে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন—আমরা পাগল, আমাদের ছাড়িয়া দাও, পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই।" আসলেই তারা পাগলামু উন্মাদনায় মেতে থাকে॥ বাউলদের আছে হাজার হাজার গান।
বাউলদের গান বুঝতে হলে আগে তাদের পরিভাষা বুঝতে হবে, অদ্ভুত তাদের শব্দ চয়ন। "যেমন- অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনী, কুমীর মানে কাম, লতা মানে সন্তান, চন্দ্রসাধন মানে মল মূত্র পান [20]।"
তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়,বাউলদের বিকৃত জীবন আর ‘ভাবের গান’ আমাদের সমাজ সংসারে কোন কাজে লাগবে???
.
তথ্যসুত্র
.
[1] লালন শাহঃ বিবেচনা-পূর্নবিবেচনা মুনশী আব্দুল মাননান বাংলা সাহিত্য ও লালন শাহ, পৃষ্ঠা ১১ , ২০০৫।
.
[2] হারামনি; অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন, সপ্তম খন্ড, পৃ-৮।
.
[3] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, প্রথম ভাগ, অষ্টম অধ্যায়, অচ্যুতচরণ ; ২০০৪।
.
[4] বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোক ঐতিহ্য, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ৩৪,২০০৫।
.
[5] সংসদ বাংলা অভিধান, পৃ ৪১৫,নভেম্বর ২০০৫,কলকাতা।
.
[6] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, ড. আনোয়ারুল করিম, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫॥
.
[7] বাউলতত্ত্ব, ড. আহমদ শরীফ, পৃঃ ৫৩-৫৪।
.
[8] বস্তুবাদী বাউল, শক্তিনাথ ঝা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ॥
.
[9] দেশ পত্রিকা , বাউল বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা, ৪ঠা মাঘ ১৩৯৮॥
.
[10] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, আনোয়ারুল করিম; পৃ ১৪-১৮ ;৩৫০- ৩৮২॥
.
[11] বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আববাস আলী খান,পৃ ৬৬।
.
[12] ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, শক্তিনাথ ঝা, কলকাতা ১৯৯৫।
.
[13] Bangladesh By Mikey Leung, Belinda Meggitt.
.
[14] বাঙলায় বাউল বিরোধী আন্দোলন : প্রেক্ষিত লালন শাহ, আবুল আহসান চৌধুরী॥
.
[15] লালন শাহের মরমী দর্শন; মো. সোলায়মান আলী সরকার,পৃ ৬, ১৯৯৩।
.
[16] হারামনি, শক্তিনাথ ঝা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪-৬৫।
.
[17] দুদ্দু সা’র পদাবলি; শক্তিনাথ ঝা, ৬৬ -১০৩ পদ।
.
[18] লালন শাহ জীবন ও গান; এস এম লুৎফর রহমান; পৃ-১০৭-১০৮।
.
[19] ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, সুধীর চক্রবর্তী, ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫॥
.
[20] গভীর নির্জন পথে, সুধীর চক্রবর্তী, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৪।
বাউলরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করে না। লালনশাহের কোনো মূর্তি স্থাপনের কোনো দাবিও তারা তোলেনি। কিন্ত– এখন বাউল মতবাদ হয়ে উঠতে যাচ্ছে একটা রাজনৈতিক ইস্যু। বিষয়টি আগামী নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একজন বুদ্ধিজীবী বলছেন, বাউলরা বাংলা সংস্কৃতির প্রতীক। লালনের মূর্তি সরানোর মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলেছে। কিন্ত– বাউলদের ইতিহাস অনুসরণ করলে আমরা তাদের দাবির কোনো ভিত্তি খুঁজে পাই না। অষ্টম-নবম শতকে পারস্যে সুফিসাধনার প্রবর্তনকালে, ‘বা’আল’ নামে সুফিসাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। এরা ছিল সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্তসাধনপন্থী, হুবাল দেবীর অঅনুসারী,
বিকৃত যৌনাচারই তাদের ধর্মাচার।।
পারস্য থেকে এরা অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায়ও ঘটে এদের আগমন। বাংলার বাউলরা এদের ঐতিহ্যবাহী। ঘটনা যদি এই হয় যে, এরা এসেছিল পারস্য থেকে, তবে বাউল-দর্শনকে বাংলাদেশের মধ্যে উদ্ভূত একটি আদি অকৃত্রিম চিন্তা বলে গণ্য করা যায় না। বাউলদের বলা যায় না বাংলার সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্ত– বিস্বয়করভাবে এটা করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাউল দর্শনকে আমাদের আপন দর্শন বলে চিহিপ্তত করা। ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে না। বাউলদের দর্শন আমাদের আজকের জীবনে কি কোনো কাজে আসতে পারে? বাউলরা তাদের মুক্তি খোঁজেন এক নিখিল যৌন চেতনার মধ্যে। আমাদের তরুণ-তরুণীরা যদি বাউল আচার গ্রহণ করতে চায়, তবে গোটা জাতিই কি পঙ্গু হয়ে পড়বে না? বাউল-দর্শনের উদ্ভব হয়েছিল ইরানে। এখন ইরান আর কোনো রকম সুফিবাদেই আস্থাবান নয়। সে চাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে একটা শক্তিমান জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রƒকুটিকে অ¯¦ীকার করে সে আজ বানাতে যাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র। আর আমরা এখন মানুষকে যেন উত্সাহ দিতে চাচ্ছি খাঁচার মধ্যে অচিন পাখিকে খুঁজতে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে নাকি নতুন করে ওহাবি ভাবধারার আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। মানুষ নাকি মারফতি ইসলাম ছেড়ে শরিয়তি ইসলাম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কিন্ত– এরা জানে না যে, মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্কে ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজে হাত দেন, তা হলো মারফতি দরবেশদের আখড়াগুলো ভেঙে দেয়া। কামাল আর যাই হন, ওহাবি ছিলেন না। শরিয়তি ইসলাম অতীতে এ দেশে ছিল না, এমন নয়। মুসলমানদের উত্তরাধিকার আইন শরিয়াভিত্তিক। বিবাহ তথা পরিবারবšধন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে শরিয়া আইন দিয়ে। মুসলমানরা গ্রামে-গঞ্জে গড়েছেন মসজিদ। সেখানে পড়েছেন নিয়মিত নামাজ। তারা বাউলদের মতো কোনো মৈথুন প্রক্রিয়ার মধ্যে আপনার মুক্তি খুঁজতে চাননি। মুসলিম সমাজে আউল-বাউলরা সেভাবে স্থান পেতে পারেনি। এটাই হলো সাধারণ ইতিহাস। জানি না আজ কেন শরিয়তি ইসলাম আর মারফতি ইসলামের মধ্যে তফাতটা এত বড় করে দেখা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মুসলমান এক সময় ছিলেন মারফতি, এখন হতে যাচ্ছেন শরিয়তী? মারফতিরাও বলেন, প্রথমে হলো শরিয়ত। তার পরে হলো তরিকত, তার পরে আসে মারেফত আর সব শেষে হকিকত। অর্থাৎ শরিয়তকে মারেফতপন্থীরাও যে একেবারেই অ¯¦ীকার করতে পেরেছেন, তা নয়। তাদেরও মানতে হয়েছে শরিয়তের বিধান। আগামী নির্বাচনে শরিয়ত ও মারেফত একটা ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। আর সেটা করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে মহলবিশেষের পক্ষ থেকে; যা এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ গণতন্ত্র চাচ্ছে। চাচ্ছে না কোনো ‘বাউল গণতন্ত্র’। চাচ্ছে না পরিবার ভেঙে গড়তে অবাধ যৌনজীবন। তারা হতে চাচ্ছে না বাউলপন্থী। কোনো কোনো স্থানে কিছু তরুণ-তরুণী মিছিল ও মানবন্ধন করছেন লালনভাস্কর্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। এরা মনে করছেন তথাকথিত মৌলবাদী ইসলাম লালনমূর্তি সরিয়ে ফেলেছে। আর তারা চাচ্ছে চারুকলার অংশ হিসেবে ভাস্কযচর্চাই বাতিল করে দিতে। কিন্ত– এ রকম দাবি এখনো ওঠেনি এ দেশের মানুষের মধ্য থেকে। চারুকলার অংশ হিসেবে ভাস্কর্যচর্চাকে এ দেশের মানুষ বšধ করতে চাচ্ছে না। তারা যা চাচ্ছে তা হলো, বাউলবাদের প্রতিষ্ঠা বšধ করতে। লালনের মূর্তি স্থাপন করা হচ্ছিল ঢাকা বিমানবন্দরের শোভা বৃদ্ধির জন্য নয়। এই মূর্তি স্থাপনের লক্ষ্য হলো, দেশে বিশেষ এক ধরনের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়া, যেটা এ দেশে বৃহত্তর জনসমাজে বাঞ্ছিত নয়। অনেকে দাবি করছেন, তারা গণতন্ত্রী। লালনের মূর্তি অপসারণ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কিন্ত– মুক্তচিন্তা ছাড়া গণতন্ত্র বলিষ্ঠ হতে পারে না। লালনপন্থীরা ভয়ঙ্করভাবে গুরুবাদী। এদের সংগঠনকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা চলে না। বলা হয় বাউলরা উদারমনা। কিন্ত– আসলে তা নয়। বাউলদের মধ্যে আছে হাজারো ভেদ। এক গুরুর শিষ্য আর এক গুরুর শিষ্যকে অতি তুচ্ছ ভাবে। করে না কোনোভাবেই শ্রদ্ধা। আমরা আমাদের বর্তমান গণতান্ত্রিক চেতনা লাভ করেছি ব্রিটেনের কাছ থেকে। ব্রিটেনের একজন নামকরা চিত্রশিল্পী ছিলেন উইলিয়াম হোগার্থ (১৬৯৭-১৭৬৪)। তিনি নানা বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। তার ছবি থেকে রাজনীতিও বাদ পড়েনি। একটি ছবিতে তিনি এঁকেছেন, একটি লোক বক্তৃতা দিচ্ছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য। আরেকটি ছবিতে তিনি এঁকেছেন ওই একই লোক গুণ্ডা ভাড়া করছেন, যে গুণ্ডারা লোককে ভয় দেখাবে। তাদের বাধ্য করবে তাকে ভোট দিতে। হোগার্থ আর একটি ছবিতে দেখিয়েছেন, লোকটা ভোটারদের ঘুষ দিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে তাকে ভোট দেয়ার প্রতিশ্র“তি নিয়ে। ছবিগুলো হোগার্থের সময় বিলাতের লোকের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেকে বলেন, হোগার্থের ছবি বিলাতের নির্বাচনের প্রথার অনেক উন্নতি ঘটায়। বিলাতের নির্বাচন হয়ে ওঠে গুণ্ডাদের এবং টাকার প্রভাবমুক্ত। আমাদের দেশে হোগার্থের মতো কোনো সমাজসচেতন শিল্পী এখনো জন্মেছেন বলে মনে হয় না। আমাদের শিল্পীরা মেতে উঠেছেন লালন ফকির নিয়ে। কিন্ত– দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিল্পীদের বলা যাচ্ছে না সমাজ সচেতন।
রাজশাহী এখনো ছোট শহর। এখানে অনেকেই অনেকের চেনা। লালনমূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে যেসব অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী হইচই করছেন, তাদের অনেকেই এক সময় নিজেদের দাবি করতেন বামপন্থী বলে। অনেকে বলতেন, তারা হলেন দ্বন্দ্বমূলক বস্ত–বাদী। কিন্ত– এখন তারা সমর্থন দিচ্ছেন রহস্যময় বাউল-দর্শনকেই। এদের এই মানসিক পরিবর্তন কী করে ঘটতে পারল সেটা সু¯পষ্ট নয়। এরা এখন কেবলই ছড়াতে ব্যস্ত জঙ্গি ইসলামের ভীতি। জঙ্গি ইসলামের ভীতি ছড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হতে পারে এরা এখন মার্কিন লবির ভক্ত হয়ে উঠেছেন। এরা বলছেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা। কিন্ত– এদের এই বিরাট পরিবর্তন কি এসেছে কেবল গণতন্ত্রের আকুতি থেকেই? এদের বোঝা উচিত মুক্তবাজার গণতন্ত্র টিকতে পারছে না। আর আসছে সম্ভবত তারও পতন।
https://www.amarblog.com/sakib2008/posts/20592
সাঁই শব্দটি স্বামী শব্দের অপভ্রংশ। যেমন হিন্দুরা তাদের একটি উপাধি গোস্বামীকে গোসাঁই বলে ডাকে। স্বামী শব্দের অর্থ গুরু, প্রভু ইত্যাদি। অশিক্ষিত এবং ইতর জীবনাচরণে অভ্যস্ত বাউলরা লালনকে সাঁই বলে ডাকে। কিন্তু লালনকে ভদ্রসমাজে সুফী দরবেশ হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টায় রয়েছে একটি গোষ্ঠী। তারা লালনের নামের শেষে ‘শাহ’ লাগিয়ে দিয়েছে, যে শব্দ মুবারক মুসলিমরা তাদের পীর সাহেব উনাকে সম্বোধন করতে ব্যবহার করে।
বাউল মতবাদ সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদ থেকে এসেছে। বাউলরা এরকম জীবনযাপন করেও। লালন যে কাজটা করেছিল, তা হলো ছূফী কবিতায় ইশারা করার যে বিষয়টি, সেটি সে তার গান লেখায় ব্যবহার করে। সে ইসলামী শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে দেহতত্ত্বের বিষয়গুলো ইশারা করেছে। ইসলামী ভাবধারায় সে সহজিয়া বৈষ্ণব মতকে উপস্থাপন করেছে। ফলে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কথাটি দ্বারা মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়, কারণ গানের বিষয়টি আদৌ আখিরাত সম্পর্কিত নয়। এই বিভ্রান্ত হওয়াটা থেকে মুসলমানদের দূরে থাকতে হবে।
তার গানে যে ‘আল্লাহ’ ‘রাসূল’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, তা সে খুব কদর্য্য অর্থে ব্যবহার করেছে। কারণ সহজিয়া বা দেহতত্ত্বে দেহই সবকিছু। এটাকে খুশি রাখতে পরকীয়া তো কিছুই নয়। এবং এই দেহের সৃষ্টি হলো পুরুষের স্খলিত তরলের উসীলায়। ওটাকেই তারা বলে সৃষ্টিকর্তা। তারা বলে থাকে, বীজমে আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ), বাউল গবেষক ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য বাউলধর্ম সম্পর্কে বলেছে, “বাউলগণ পুরুষদের বীজরূপী সত্ত্বাকে ঈশ্বর বলে। বাউলদের মতে এই বীজসত্ত্বা বা ঈশ্বররস ভোক্তা, লীলাময় ও কাম ক্রীড়াশীল।”
পশুরা তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী চালিত হয়ে থাকে। আর দেহতত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপনকারী বাউলরা, কতগুলো সমাজচ্যুত পশু ব্যতীত কিছু নয়। মুসলমানদে কে এদের থেকে সাবধান থাকা উচিত।
বাউল সম্প্রদায়ের গুরু হল লালন। লালনের কিছু কিছু গানে আল্লাহরাসূল প্রভৃতি শব্দ থাকায় অনেকে লালন ও তার অনুসারী বাউলদের অনৈসলামিক মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মুসলমানরা যখন লালনের অনুসারী বাউলদের অসামাজিক কাজের বিরোধিতা করে তখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের গুটিকয়েক সমাজচ্যুত বাউলদের জন্য সইতে হয় সাম্প্রদায়িকতার অপবাদ। যারা বাউলদের পক্ষাবলম্বন করছে তারা কি জানে বাউল তত্ত্বের উদ্দেশ্য কি? বাউল নামটি এসেছে বা’ল বা হোবল দেবতার নাম হতে। এবং বাউল তত্ত্বের বাইরে হল ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ, ভেতরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের কাহিনীনির্ভর বৈষ্ণব বা সহজিয়া মতবাদ। গুরুরতি সাধন করা বা গুরুর মলমূত্র বীর্য রজঃপান বাউলমতে দীক্ষা নেয়ার প্রথম ধাপ(নাউযুবিল্লাহ)। লালনের অধিকাংশ গান রাধাকৃষ্ণ দেহসাধনা নিয়ে লেখা, দু একটি গানে ইসলামের কথা যা আছে তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলামের জন্য অবমাননাকর। হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে আমাদের দেশে একটি গুজব রয়েছে আর তা হল তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন ডাকাত, পরে আউলিয়া হন। কিন্তু কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। তিনি ছিলেন আওলাদে রাসূল মাদারজাদ ওলীআল্লাহ, উনার যামানার মুজাদ্দিদ। আর এ গুজবের হোতা হল লালন তথা বাউল সম্প্রদায়। লালনের গানে আছে
নিজাম নামের বাটপার সেতো পাপেতে ডুবিয়া রইত
তার মনে সুমতি দিলে,কুমতি তার গেল চলে
আউলিয়া নাম খাতায় লিখিলে, জানা গেল এই রহমই
বাউলতত্ত্ব বইতে রয়েছে ““ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র মত। যার নাম নাথপন্থা। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থা এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে”
বস্তুতঃ বাউলরা হল মুসলমানের ছদ্মবেশে হিন্দু বৈষ্ণব, যারা মুসলমানের ঈমান কেড়ে নিতে চায়। তারা আল্লাহরাসূলের কথা বলে পুরোন প্রথা তথা রাধাকৃষ্ণের দেহতত্ত্বের সাধনা করে। যবনলালন মুসলমানদের প্রতি কীরূপ মনোভাব পোষণ করতো তা কিন্তু তার গানেই রয়েছে। লালন তার গানে সাধারণত কখনোই মুসলমানদের মুসলমান বলে সম্বোধন করতোনা, করতো যবন বলে(নাউযুবিল্লাহ)। সে হিন্দুদের হিন্দু বলত, বৌদ্ধদের বৌদ্ধ বলত, খ্রিস্টানদের বলত খ্রিস্টান। কিন্তু এক মুসলমানকে সর্বদা বলত যবন। এ অবমাননাকর উপাধি সর্বদাই সে মুসলমানদের জন্যই ব্যবহার করতো, অন্য কারো জন্য নয়। যেমন লালনসমগ্র(আবদেল মাননান,প্রকাশক নালন্দা) এর স্থুলদেশ অধ্যায়ের ৩৮ নম্বর গানে রয়েছে
জাত বলিতে কি হয় বিধান
হিন্দু যবন বৌদ্ধ খৃস্টান
এরকম আরো বহু গান রয়েছে যার উদ্ধৃতি দিলে লেখার কলেবর বেড়ে চলবে। সে তার সাঁই বা যাকে মুর্শিদ মানতো তাকেও যবন বলতো। কারণ তার মুর্শিদের নাম ছিল সিরাজ সাঁই, সে ছিল মুসলমান ঘরের সন্তান। তার গানে (স্থূলদেশ ৫২ নং)রয়েছে
ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছে সাঁই
হিন্দু কি যবন বলে
জাতের বিচার নাই
অর্থাৎ লালনকে যতই অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা গন্ডমূর্খরা করুক না কেন, সে কিন্তু এমন একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে যেখানে মুসলমান তো বটেই এমনকি মুসলমান সাঁইকেও হতে হয় অপমানিত। লালনের যে গানটিকে(স্থুলদেশ ৩৫ নং) পুঁজি করে লালনভক্তরা তাকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা চালায় তা হলো
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যে দিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান
জাতিগোত্র নাহি রবে
এ গানটিতেই কেবল মুসলমান শব্দের দেখা মেলে, কিন্তু কখন? যখন মুসলমান জাতির বিনাশ কামনা করা হয়! নাউযুবিল্লাহ। লালনের কোন গানে মুসলমানকে মুসলমান বলার সম্মানটুকু দেয়া হয় নাই। যাও একবার বলা হয়েছে, তাও ধ্বংস কামনা করে। চৈতন্যদেবের মত বৈষ্ণব(হিন্দুধর্মের একটি ফেরকা) ধর্মপ্রচারকের যে স্বভাব তার পুরোটাই লালনের মধ্যে ছিল। চৈতন্যদেব বৈষ্ণবমত গ্রহণকারী মুসলমান ঘরের মুরতাদকেও যবন বলে হিন্দুদের তুলনায় নিকৃষ্ট গণ্য করতে ছাড়তো না, তাদের মত গ্রহণ করলেও তাদের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করত না। অর্থাৎ তারা যতই উদারতার ভেক ধরুক না কেন তাদের অন্তর গরলে পরিপূর্ণ। উল্লেখ্য লালন নিজেও ছিল চৈতন্যদেবের অনুসারী। প্রত্যেক বৈষ্ণবধর্মপ্রচারকের স্তুতি লালনের গানে আছে। নিমাই, নিতাই, গৌর বা চৈতন্যদেব প্রত্যেকের ছানাছিফত সে করেছে। এবং এত বেশি করেছে যে লালনসমগ্র গ্রন্থে নিমাইলীলা, নিতাইলীলা, গৌরলীলা এ তিন ধর্মপ্রচারকের নামে তিনটি আলাদা আলাদা অধ্যায় রয়েছে। কিন্তু বাউলরা পাগড়ি পরে, দাড়ি রাখে, লুঙ্গি পরে। যা বৈষ্ণবরা করে না। পাগড়ি দাড়ি লুঙ্গির আড়ালে তারা বৈষ্ণবসাধনা করে।
অর্থাৎ লালন কখনোই অসাম্প্রদায়িক নয়। সে হল দুরাচার যবন অনুপ্রবেশকারী, যে ইসলামের ভেক ধরে মুসলমানদের সর্বনাশ করতে উদগ্রীব থাকতো। শুধু তাই নয়, যারা বাউল সম্প্রদায়ের ইতিহাস জানেন তারা অনেকেই মানবেন, এদেশের মুসলমানদের পথভ্রষ্টকারী যেসব মতবাদ ছিল তার মধ্যে বাউল মতবাদ অন্যতম। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে প্রায় সকল মুসলিম লেখকগণ মুসলমান সমাজে বাউল মতের বিধ্বংসী প্রভাব দেখে এ মতবাদের বিরুদ্ধে লিখে গিয়েছেন।
কোলকাতার যবনরা আমাদের দেশে লালন মতবাদের প্রচারপ্রসারে উদগ্রীব। কিছুদিন আগেই কোলকাতার কিছু যবন এদেশে ‘মনের মানুষ’ নামে একটি সিনেমা করে গিয়েছে। এর কারণ লালন মতবাদ হল ইসলামের ছদ্মবেশে রাধাকৃষ্ণ তথা হিন্দুদের মতবাদ। এদেশে এখন ব্যান্ডসংগীতের নাম দিয়ে কৃষ্ণকীর্তন করা হয়। রাস্তাঘাটের গানের দোকান থেকে কৃষ্ণলীলার গান ভেসে আসে, যা এখন দেশের মানুষের কাছে দুঃখজনকভাবে স্বাভাবিক। এবার নববর্ষে চারুকলার শিক্ষার্থীরা ভার্সিটি এলাকার দেয়াল কৃষ্ণের ছবি দিয়ে ভরে ফেলেছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। এদেশের সংবিধান সংস্কৃতি মানুষের চিন্তাচেতনা থেকে যারা ইসলামকে উঠিয়ে দিতে চায় তারা জানে, একদিনে এ মহাযজ্ঞ সম্ভব নয়। এজন্য তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, বাউল মতবাদের আড়ালে মুসলমানদের মনমগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণের অভিশপ্ত পরকীয়ার শিক্ষা। স্লো পয়জনিংয়ের মতো হিন্দুরা আমাদের মুসলমানিত্বকে আমাদের মধ্যে থেকে কেড়ে নিয়ে হিন্দুধর্মের দীক্ষা দিচ্ছে, কথিত সংস্কৃতির নামে। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকরাও তা চায়। এজন্য কিছুদিন আগেই এপ্রিল মাসে রাজবাড়ীর পাংশায় বাউলদের কথিত সাধুসঙ্গে তাদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার পরই সরকার তৎপর হয়ে উঠল। কথিত সুশীল সমাজ এবং লালনের গান গেয়ে জীবিকা অর্জনকারী ব্যান্ড গায়করা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। প্রথম আলোর মত সাম্প্রদায়িক ইসলামবিদ্বেষী পত্রিকাগুলো বাউলদের সপক্ষে লেখা শুরু করল। ফলশ্রুতিতে সরকার বাউলদের জন্য ৯৭ শতাংশ মুসলমানের টাকায় চালিত পুলিশ প্রশাসন দিয়ে পুনরায় বাউল গায়কদের সাধুসঙ্গের আয়োজন করল। অথচ চুলদাড়ি কেটে নিয়েছিল আওয়ামীলীগেরই তৃণমূল নেতাকর্মীরা, মিডিয়াকর্মীরাও কবুল করেছে বাউলদের অসামাজিক কার্যের বিরুদ্ধে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকদেরও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। স্থানীয়রাই উদ্যোগী হয়ে বাউলদের জটাদাড়ি কেটে নিয়েছিল(সুন্নতী দাড়ি নয়), কারণ বাউল সম্পর্কে আরেকটি বিষয় হলো তারা গাঁজায় আসক্ত, যুবসমাজ থেকে তারা তাদের নিজেদের উত্তরসূরি বেছে নেয়। এজন্য তারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে বাউলদের জটা কেটে,দাড়ি সিনা পর্যন্ত কেটে ইমাম দিয়ে তওবা পড়িয়েছিল, যেন বাউলরা সৎপথে ফিরে আসে। কিন্তু সরকার আসল বাউলদের ত্রাণকর্তারূপে, আবারও বসল সাধুসঙ্গ। যারা সাধুসঙ্গ সম্পর্কে জানে তারা বলেছে, সাধুসঙ্গ হলো বাউলদের কুকর্মের আনুষ্ঠানিক মহাযজ্ঞ। অর্থাৎ তাদের নাপাক বস্তু ভক্ষণ এবং কৃষ্ণের অনুকরণে তারা যে অবাধ মেলামেশা করে তার আসর। সাধুসঙ্গে সকালে মাইকে গান হয়, রাতে সমস্ত বাতি নিভিয়ে হয় জেনার আসর।নাউযুবিল্লাহ।
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
“আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।...আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ...ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন... এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃসঠা ৪৮
ধর্ম দর্শনের নামে মিথ্যা বাউলিকরণ হয়েছে বাংলায়। বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া মতবাদ, সূফী মতবাদের মিলনে বাংলার বাউল ভাবধারা। ★ বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়। এই কারণে বাউলরা জোড়ায় জোড়ায় থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের 'লিভিং টুগেদারের' সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের 'চারিচন্দ্রভেদ', 'ষড়চক্র', 'দ্বিদলপদ্ম', 'মূলধারাচক্র', 'সহস্রদলপদ্ম', 'অধর মানুষ', 'ত্রিবেণী', 'সাধনসঙ্গিণী', 'প্রেমভজা' প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে। ★ দেখুন বাউলগন কিভাবে পুরুষ-প্রকৃতি (নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কিভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কিভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে 'সহজ মানুষ' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ একটি মেয়ের মাসিকের সময় বাউল সাধুগন সাধনার নামে ধর্ষন করে তিন দিন কারন তারা মনে করে মাসিকের সময় সয়ং প্রভু উপর থেকে নারীর যৌনিতে নেমে আসে আর এই আসার সময় নারীর দেহের অধর চাঁদ নামক নীর অর্থাৎ নারীর সাথে সেক্স করতে করতে রস বের হবার পরে একটি সাদা বস্তুু আসে তারা তাকে অধর চাঁদ নামে অভিভূত করে এর পর তারা সেটা পান করে। এবং তারা মনে করে আমরা সয়ং প্রভু কে পেয়ে গেলাম। ★ প্রমান দেখুন কি বলে ★ বাউল-ফকিরেরা ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রাণের ধারার সাথে কিভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। বীজ-রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা সহজ মানুষ সাধন করতে পারে, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ। লালন তার গানে বলছে-
আমি কি সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।
যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।
রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।
লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে
আমি মনিহারা ফণির মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।★লালনের গানে বলা হয়েছে "গুরুরতি সাধন কর"। অর্থাৎ নারীর রতি বা মাসিকের সাধনা। যদিও অনেক বাউল বলে নিজ দেহের বীর্যের সাধনা মুলত নারীর।
মাসিকের প্রতি বাউলদের এই যে মনোভাব তা বুঝতে হলে আমাদের রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেতে হবে। বলা আছে, একবার কৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে অবস্থানকালে রাধার মাসিক শুরু হয়। কৃষ্ণ তা টের পেয়ে রাধাকে যেন লজ্জার মুখে পড়তে না হয় এজন্য সে মুহুর্তেই গোপীদের নিয়ে রং বা দোল খেলা শুরু করে। আর এই রং খেলা পরবর্তীকালে সনাতনী হিন্দু দাদা ও দিদিগন হলি খেলা শুরু করেছে আর আমি নাম দিয়েছি মাসিকের লাল রক্তের এর পুজা অর্চনা করন।
দোলপূর্ণিমা বাউলদের প্রধান উৎসবগুলোর একটি। মূলত বাউলরা বৈষ্ণব। বৈষ্ণবদের সাথে বাউলদের প্রধান পার্থক্য বাউলরা ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যেমন তারা লুঙ্গি এবং পাগড়ি পরে। কিন্তু খাঁটি বৈষ্ণবরা পরে না। বাউলদের খাদ্যাভাস মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের দেহতত্ত্ব হতে আগত। বাউলরা পান করে মূত্র ও মল তো বটেই সাথে মাসিকের রক্ত ও বীর্য। এর মূলে রয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের কাহিনী। আর আমরা তো জানিই পরকীয়া প্রেমে দেহ ব্যতীত কিছুই নেই। আর তাদের পরকীয়া প্রমিকার নিকট হতে মাসিকের রক্ত চাই। ★ আর সেই জন্য বাউলদের নিকটে কোন নারী বেড়াতে গেলে বা কোন বাউলের নিকটে ফোন নাম্বার থাকলে সেই নারীকে বলে মা তুমি দেবি, মা তুমি জননী তুমি সাক্ষাৎ দেবি দূর্গা তুমি মা লক্ষি তুমি জগত জননী মা তোমার পায়ে ভক্তি মা তোমাকে প্রনাম মা তোমাতেই আমাদের মানব মুক্তি মা গো। বাউলদের এই চতুরতায় নারীগন ধরা খেয়ে যায়য় এবং এই ভাবে তারা বিভিন্ন কাহিনি তৈরী করে কারন মুলত তাদের উদ্দেশ্য সেই নারীর মাসিকের রক্ত পান করা আর সেক্স করা। ★বাউলগন, "ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তুু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই ★ বাউলদের মধ্যে রজঃপান অর্থাৎ মেয়েদের মাসিকের রক্ত পান করা একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে ★ সাধারণ বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত 'নাড়া' শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার 'ওরসে' তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ 14) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ 1986 সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ । তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি .. ... আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ... ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থ ভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন ... এই সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা -লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ। "(দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২ য় সংস্করণ, আগস্ট 1998 পৃঃ 4-95) ★ উপরের কথা গুলো কোন মুসলিম। যদি ভাল ভাবে বুঝে তাহলে কখনো বাউলবাদ তথা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করবে না আর এই বাউলবাদ তথা বৈষ্ণববাদ মুসলিম ও সনাতনী হিন্দু ধর্মাবলি দের ও ক্ষতি করে চলছে দিনের পর দিন । দেখুন মহান রাব্বুল আলামিন আল কোরআনে কি বলে, ★83 - তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? । আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে ★ সূরা আল ইমরান। 85 - যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত ★ সূরা আল ইমরান: 101 - আর তোমরা কেমন করে কাফের হতে পার, অথচ তোমাদের সামনে পাঠ করা হয় আল্লাহর আয়াত সমূহ এবং তোমাদের মধ্যে রয়েছেন আল্লাহর রসূল। আর যারা আল্লাহর কথা দৃঢ়ভাবে ধরবে, তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হবে সরল পথের ★ সূরা আল ইমরান: 102 - হে ঈমানদারগণ। আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না ★ সূরা আল ইমরান। 104 - আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম ★ সূরা আল ইমরান: । 105 - আর তাদের মত হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শন সমূহ আসার পরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে-তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর আযাব। ★ এই আয়াত গুলো একটু গভীরতম ভাবে পড়ে তার পরে আপনারা বাউল তথা বৈষ্ণবধর্ম গ্রহন করিয়েন।★বাউলবাদ সুফিবাদ এর মাঝে প্রবেশ করে কলঙ্কিত করে ফেলেছে দিনের পর দিন তাই আসুন বাউলবাদ না বলুন। ★ বিঃদ্রঃ বৈষ্ণব মতবাদে সবচে বাজে জঘন্যতম কাজটি হলো এদের মাঝে মা বোন মাসি কাকি বলে কিছু নেই তারা মনে প্রানে বিশ্বাস করে আমাদের সকল আত্মায় একি তাই আমাদের মাঝে ভেদাভেদ থাকতে পারে না। আর বৈষ্ণব মতাদর্শ হতে এই রস রতি অর্থাৎ সেক্স এর সাধনা ঢুকে পরেছে লালনবাদে।
copyed, Rayed Talukder
বাউল প্রসঙ্গে নতুন করে সামনে চলে এসেছে। পাংশা উপজেলার আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষক কিছু বাউলকে তওবা পড়ান এবং তাদের লম্বা গোঁফ ও চুল কেটে দেন।
একটি জাতীয় দৈনিকে একজন কলাম লেখক ইতিহাস থেকে বাউলদের তওবা পড়ার কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন যা ঘটেছিল ১৯৩২ সালে, ১৯৪২ এবং ১৯৮৪ সালে। প্রায় একশত বছরের এ রকম কয়েকটি ঘটনাকে ব্যাতিক্রম হিসাবে গন্য করা যায়, তবে এ কথা বিবেচনা যোগ্য যে বাউলরা যেহেতু মুসলিম নামধারী সেহেতু তাদেরকে মুসলিম সমাজ কিছুটা নিয়ন্ত্রন করবেই, সামাজিক নিয়ন্ত্রন বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না, সমাজ অস্বাভাবিক কাজ গ্রহণ করেনা।
লেখক বাউলদের অনেক প্রশংসা করেছেন, তার ভাষ্য মতে “তাদের দ্বারা বাংলাদেশে এক মানবতাবাদী এক জাগরণ ঘটে” “তাদের হাত ধরেই কৃষক সমাজের মধ্যে ঘটেছিল দেশজ রেঁনেসা” “বাউলরাই হচ্ছে আমাদের আদর্শ নারী পূরুষ”। এ সবই হচ্ছে অতিরঞ্জিত কথা। লালন নিজে সংগীতের ক্ষেত্রে অনেক অনেক বড়। কিন্তু সাধারণ বাউররা তা নয়। তারা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করে, তারা অপরিচ্ছসন্ন তাকে, অবাধ যৌনাচারে বিশ্বাস করে, তাদের পূরুষরা হায়েজের রক্তপান বৈধ মনে করে। তাদের নারীরা পূরুষের বীর্যপান বৈধ মনে করে। এসব আমি জেনেছি লালন গবেষক লালনের উপর পিএইচডি করেছেন এক ক্লাসমেটের কাছ থেকে।
বাউলরা কখনই কোন আদর্শ নয়, তারা সাধারণ মানুষ, তারা সভ্যতার কিছুই জানে না। তারা সত্যিকার অর্থে কোন ধার্মিক লোকও না। কিন্তু একথা অবশ্যই বলতে হবে যে, এসব নিরীহ লোকদের উপর কোনো অত্যাচার বৈধ হতে পারেনা, যা করতে হবে মুসলিম সমাজকে তা বৈধ ভাবে করতে হবে।
আমার বাড়ির পাশে এক বাউল ছিল। সে তার নিজের প্রসাব পান করত। আর ওনার পাশ দিয়ে দুর্গন্ধের কারনে হেটে যাওয়া যেত না।
চরম বিকৃত, অজ্ঞ, নেশাগ্রস্ত, অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা মনের অধিকারী তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শশূন্য সুশীলদের আদর্শ এসব তথাকথিত বাউলদের জ্ঞানের আলো দ্বারা অন্ধকার পথ থেকে উদ্ধার করতে হবে।
আরও অবাক করা ব্যাপার হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শ শূন্য বাউলপ্রেমী হাসিনা সরকারের বিটিভিতে ইসলামী অনুষ্ঠানের থিম সং মূল হলো অনেকটা এরকম–
বাউলদের বাংলাদেশ
মাইজভান্ডারির বাংলাদেশ
সুফি-সাধকের বাংলাদেশ
মাঝারের বাংলাদেশ……
বাউলরা যে জীবনাচারে অভ্যস্ত তা যদি আদর্শ হয় তাহলে মানুষকে আর কোন কিছু করতে হবেনা। শুধু গাঁজা খাও, নেশা করো, নষ্টামি করো এসবই হবে জীবন। যারা বাউল জীবনের পক্ষে বলে তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে সেই বাউলের আস্তানায় পাঠাক। তারপর বাউল জীবনকে আদর্শ মানে কিনা বুঝা যাবে…
বাউলদের যারা উচ্ছিষ্ট গোঁফ দাড়ি কেটে দিয়েছেন সে সকল স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার আমরা টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখেছি। তাদের কথায়ও বোঝা গিয়েছে; এটা একটি স্বাভাবিক সামাজিক প্রতিরোধ। এখানে কোন মতাদর্শ বা রাজনৈতিক চিন্তা কাজ করেনি। স্থানীয় সমাজের মাতুব্বর, বয়জেষ্ঠগণ, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি সবাই একত্রিত হয়ে বিনা প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। পরবর্তীতে আমাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক মনোভাব এই ঘটনা থেকে যে যার মত ফায়দা লুটতে উঠে পড়ে লেগেছে।
আমরা সম্প্রতি আওয়ামী নেতাকমী কর্তৃক বাউলদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার ঘটনা শুনেছি। অনেকে বিষয়টি নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি গেল গেল বলে রব তুলেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি বাউলতত্ত্ব কী? বা এতে কী বলা রয়েছে? আমরা কিন্তু জানি না। আনুশেহ, সুমীর মতো কিছু অধুনা গায়িকা বাউলতত্ত্বের প্রচারপ্রসারে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রসেনজিৎ এসে কয়েকদিন আগে লালন নিয়ে সিনেমা করে গেল। মূলত ইন্ডিয়াপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীর লালনপ্রেম যে উথলে উঠেছে তা আমাদের ভাবনার বিষয়। তারচেয়ে বড় কথা আমরা জানি না লালন আসলে কে? তার ধর্ম আসলে কি? এই প্রশ্নের জবাব দিবে নিন্মোক্ত লেখাটি
লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের গুরু। আমরা কি জানি কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম এক্সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,
“বাড়ির পাশে আরশি নগর/সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯)
বাউল সাধকরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারন মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ “বাউল ধ্বংশ ফতওয়া” নামে বাউলবিরধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।
তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীনন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। তারা যদি নিজেদের অর্থ-সম্পদ খরচ করে তাদের অধিকৃত জায়গায় আকাসছোঁইয়া লালনমূর্তি বানাতে চায়, তাতেও হয়তো কেউ কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে ‘লালন চত্বর’ ঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
বাউল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এই অজ্ঞেয়-অধরা আর কোথাও নয়, মন্দিরে নয়, মসজিদে নয়, গীর্জায় নয় আছেন এই শরীরের খোলেই. যদিও তিনি রহস্যময় কিন্তু সঠিক ভাবে ডাকলে তাঁর সাড়া অবশ্যই পাওয়া যায়.
আসলে সেটা নেশার ঘোরে সেল্ফ ক্রিয়েটেড হেলুসিনেসন। তারা বলে যেখানে সাঁঈ এর বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে,,,,,,,
অর্থাৎ সাঈ বা ঈশ্বর থাকে নারীর যৌনাংগের ভিতর।
' মানুষ হাওয়ায় চলে, হাওয়ায় ফিরে, হাওয়ার সনে রয়.
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয় '
এই রহস্যভেদের জন্য বাউল দ্বারস্থ হন গুরু বা মুর্শিদের কাছে ঠিক যেমন সুফিভক্ত যান পীরের দরজায়. গৎ বাঁধা ধর্মাচরণ বাউলের নয়. তীর্থভ্রমণ, পূজাপাঠ, এবং অনুষ্ঠান-আচার যেমন বাউলের কাছে পরিত্যাজ্য সুফির কাছেও তেমনি.
'আমার নাই মন্দির কি মসজিদ
পূজা কি বকরিদ
তিলে তিলে মোর মক্কা কাশী
পলে পলে সুদিক '.
সুফিসাধক এবং হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মত বাউলও বিশ্বাস করেন সংসার মায়াময়. এই পার্থিব জীবন মরীচিকা. তাই তো বাউল নিজের চারপাশে গড়ে তোলে পার্থিব জীবন বিমুখ মনোভাব. সুফি অনুগামী বা হিন্দু তাত্ত্বিকের থেকে বাউল এখানে স্বতন্ত্র. সুফি চিন্তার সঙ্গে অনেক সমাপতন সত্বেও বাউলকে দেখা যায় এক নিজস্ব রীতিনিয়ম তৈরী করে নিতে. তিনি কোন জাতপাতের উপর নির্ভরশীল নন. তাঁর নিজস্ব পথ স্বকীয় চিন্তার আলোকে উদ্ভাসিত হয়. তুলনামূলকভাবে সুফিবাদ দৃশ্যতই এবং পরিপূর্ণভাবে ইসলামনির্ভর. সুফি ভাববাদ যেহেতু 'আল্লা' নির্ভর, তাই তাঁদের 'পরম লক্ষ্য'-এর ব্যাপারে ধ্যানধারণা অনেক স্বচ্ছ. এ ব্যাপারে বাউলদর্শন অনেকটাই অনিশ্চিয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত.
ইসলাম ধর্মমতে- আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন আপনার মূর্তিতে. এই সূত্রে বাউল মনে করে, আল্লার কোনো রূপ নাই, মানুষের রূপের ভিতরেই রয়েছে আল্লাহর রূপ. এই কারণেই 'দেব-দেবীগণ করে আরাধন' মানুষ জন্মের জন্য. লালনের গানে পাওয়া যায় এরূপ সাক্ষ্য
খোদার নাহি ছায়া কায়া
স্বরূপে ধরেছে মায়া
রূপে মেশে রূপের ছায়া
ফুলকলি হয় প্রেমের গাছে.
মানুষ তার নিজেকে না চিনে জগৎ এবং জগদীশ্বরকে চিনতে পারে না. ঈশ্বর বা দেবতা মানুষের সৃষ্টি. সাধন পূজনে
গুরুভক্তি: গুরুকে সর্বোচ্চ মর্যদায় স্থান দেওয়া হয়. গুরু ছাড়া সাধনার উচ্চমার্গে পৌঁছানো যায় না. বাউলগানে গুরুকে এঁরা বন্ধু, উদ্ধারকর্তা, পথপ্রদর্শক ইত্যাদি নামে অভিহিত করে থাকেন. প্রতিটি মানুষের ভিতরে যে 'আমি' থাকে, সে 'আমি' নানা ধরনের পার্থিব মোহে জ্ঞান মার্গে পৌঁছাতে পারে না. বংশগৌরব, অর্থের গৌরব, নানা ধরনের প্রতিত্তির গৌরব এমন কি জ্ঞানের অহঙ্কারও মানুষকে বন্দী করে রাখে. এই বন্দী দশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়ায় বাউল. বাউল মনে করে, বন্ধনমুক্তির পথই আনন্দমার্গে পৌঁছার পথ. রবীন্দ্রনাথে গানে তাঁর ইঙ্গিত মেলে-।সর্বপরি এরা রাধা কৃষ্নের উপাসক।।
আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ!
খুলে দেখ দ্বার, অন্তরে তার আনন্দনিকেতন.
এই বন্ধনমুক্তির পথের সন্ধান দিতে পারেন একমাত্র গুরু. সেই সূত্রে বাউলতত্ত্বে সূচিত হয়েছিল মানুষগুরুর সাধনা. কালক্রমে এঁরা মানুষকে প্রধান আরাধ্য দেবতার স্থানে বসিয়েছে. মানুষগুরুকে সাধনা করলেই মুক্তি এমন বাণী বহু বাউল গানে পাওয়া যায়.
একই সূত্রে এসেছে সাধনসঙ্গীর সাথে সাধনার তত্ত্ব.
সাধনসঙ্গী: বাউল তত্ত্বে পুরুষের সাধনসঙ্গী হিসেবে নারীকে সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে. লালন শিষ্য দুদ্দু শাহ-এর গানে পাওয়া যায়-
বাউল মানুষ ভজে
যেখানে নিত্য বিরাজে,
বস্তুর অমৃতে মজে নারী সঙ্গী তাই.
কিন্তু সাধনসঙ্গী হিসেবে নারী ভোগের না জ্ঞানমার্গে পৌঁছার মাধ্যম সে বিষয়ে বিতর্ক আছে. নাগরিক সমাজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্বারা সবচেয়ে নিন্দিত হয়েছে, বাউল দর্শনের যৌনাচার নিয়ে. এক্ষেত্রে যে অভিযোগ উঠে, তা হলো নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের গুরুর বাড়িতে বাউল নারী-পুরুষ উলঙ্গ হয়ে গণ-যৌনাচারে মিলিত হয়. বাউল নারী গুরুর বীর্য পান করে আর পুরুষ বাউল নারীর রজ: পানকরে। যারা নারীর লাল রক্ত পান করে তারা সাঈজী আর যারা কালো রজ: পান করে তারা কাইজী।।এরপর তারা চারিচন্দ্র তথা রজ: বীর্য, মল মূত্র,মদের সাথে মিশ্রণ করে সর্বসাধন করে, একে বলে " প্রেমভাজা"।।
কোনো কোনো বাউল সম্প্রদায়ের অবৈধ যৌনাচার বিষয়টি বাউল গানে পাওয়া যায়. কারণ 'সাধনসঙ্গী'র বিষয়টিও এক ধরনের বৈবাহিক সম্পর্ক. তবে এই বন্ধন গড়ে উঠে বাউলদের লালনের নির্দিষ্ট রীতিতে. এই রীতিকে হিন্দু মুসলমানরা বিবাহ হিসেবে স্বীকার করতে চান না তারা কারন তাদের দর্শন হলো নিজেদের মন গড়া তৈরী করা, এর কারন লালন হিন্দু ধর্ম হতে বহিস্কার ছিল আর দ্বিক্ষা নিয়ে ছিল মুসলিম গুরু হতে. সেই জন্য কোনো বিশেষ ধর্মের বিধি মোতাবেক তাদের বিবাহটাই অবৈধ, আর সেই জন্য তাদের মতাদর্শে বিয়ে করে তারা, যেখানে বাউলরা নিজেদের পরিচয় দেয় হিন্দু-মুসলমান হিসেবে নয়, বাউল হিসেবে. যেখানে বাউলের 'সাধনসঙ্গী' নিয়ে থাকাটা ব্যাভিচার , কারন তাদের নিয়মাদির মাঝে রয়েছে. লালনের গানে যে পরের নারী বলা হয়েছে, তা হলো সাধনসঙ্গী হিসেবে আবদ্ধ নয় এমন নারী. সাধনসঙ্গীর সান্নিধ্যে পুরুষের সাধনলাভ হয়, আর নারীর জ্ঞান ধারণের ক্ষমতা বাড়ে. গুরুর সেবার ভিতর দিয়েই তার মুক্তি.গুরুকে দেহদান করা বৈধ।
কোনো কোনো বাউল সম্প্রদায়ের গুরুর বীর্যপানের রীতি প্রচলিত আছে. তবে সাধনসঙ্গী হিসেবে নারীদের বীর্যপান করার রীতি শোনা যায়. নারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটে যৌনাচারের ভিতর দিয়ে. গুরুর সকল জ্ঞান ধারণ করার অপারগতা থেকে এই রীতি প্রচলিত হয়েছিল. গুরুর জ্ঞান ধারণ করার মতো ক্ষমতা সবার থাকে না. সেক্ষেত্রে পুরুষের গুরুর বীর্যপান করে আর নারীরা যৌনাচারের ভিতর দিয়ে তা গ্রহণ করে. 'বস্তুর (বীর্য) অমৃতে মজে নারী সঙ্গী তাই' এই ভাবনা বাউল লালন দর্শনের একটি বিশিষ্ট অধ্যায়. জ্ঞান ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই অভিনব পদ্ধতির অনুসরণ করার ধারণা সম্ভবত অন্য কোনো সম্প্রদায়ের ভিতরে নেই.
এদের কাছে হাওজে কাওছার হলো নারীর রজ:শ্রাব,আর কুমারী নারীর স্তন চুষে কষ পান করা হলো সর্বরোগের মহৌষধ।
বাউলগুরু গুরু শুধু নিজের সাধনসঙ্গী নয়, শিষ্যের সাধনসঙ্গীর সাথে মিলিত হওয়ার অধিকার রাখে, এমন দর্শন যে কোনো বাউল সাধকরা মানতেন. যেমন কালু শাহর এর একটি গানে পাওয়া যায়, শিষ্য তার সাধনসঙ্গীকে গুরুর ভোগে নিবেদন করবে, তাহলে সংসারে সে অমর হবে.
প্রেমের গাছে একটি ফল
রসে করে টলমল
তাতে ভ্রমর হয় পাগল.
সেই ফল গুরুকে দিয়া শিষ্য খাইলে
অমর হয় তারা সংসারে.
সাধনসঙ্গী হিসেবে শুধু নয়, বাউল মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের মতোই. এই ভূমিকায় প্রথম পাওয়া যায় মাধব বিবিকে, যিনি বীরভদ্রকে দীক্ষা দিয়েছিলেন. আর বীরভদ্র সে মতকে ছড়িয়ে দিয়ে, বাংলাদেশে বাউলমতের ভিত্তি স্থাপনে কৃতী হয়েছিলেন. দ্বিতীয়বার পাই বাউল সম্রাট লালনের ক্ষেত্রে. অসুস্থ লালনকে মাতৃস্নেহে সুস্থ করে তুলেছিলেন মতিজান ফকিরানী. তিনি লালনের জীবনদাত্রী এবং তাঁর বাউলদর্শনের আদি গুরু. বাউলসম্প্রদায়ের ঐক্য এবং সেবার ভূমিকায় নারীদের বিশেষ অবদান সব সময়ই ছিল.
দেহতত্ত্ব ও পুনর্জন্মবাদ: মানুষ ভজনার সূত্রে বাউল তত্ত্বে প্রবেশ করেছিল দেহতত্ত্ব. এই দেহতত্ত্বে শরীর ও মন কখনো এককভাবে কখনো সমন্বয়ে নতুন দর্শন করে. এর সাথে যুক্ত হয়ে হয়েছে আত্মা, পরমাত্মা, আত্মার ক্রমোন্নতির নানা কথা. বাউল দর্শনে বৌদ্ধ ও হিন্দু দর্শনের পুনর্জন্মবাদের সাক্ষ্য পাওয়া যায় এই গানে. বাউল দর্শনে দৃঢ়তার সাথেই বলা হয়, পাপের কারণেই মানুষের বার বার জন্ম হয়. সত্য পথ এবং লোভহীন জীবন-যাপনই মানুষের বার বার জন্মের বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত করতে পারবে.
পোশাক: বাউলার বৈষ্ণবদের কাছ থেকে আত্ম শিক্ষা খাওয়া রজঃ বীর্য পায়খানা ও প্রসাব গ্রহণ করেছিল গেরুয়া রঙ. আর সুফিদের কাছ থেকে নিয়েছিল আলখাল্লা. উভয়ই ছিলে ঢিলে ঢালা. আর নারীর পোশাক ছিল তাদের বিধানা বলি থেকে শাড়ি. শড়ির নিচে পেটিকোট বা ব্লাউজের মতো কোনো আবরণ ছিল না. একালের বাউল নারীরা শাড়ির সাথে অন্যান্য অন্তর্বাস পড়ে ..
লালনবাদে ও বাউলদের মাঝে রুপ-স্বরূপ তত্ত্ব - দেহ বা কান্তি চেতনাই সব. রুপ হচ্ছে নারী বা প্রকৃতি আর স্বরূপ হচ্ছে নর বা পুরুষ. রুপ এবং স্বরূপ এর দৈহিক মিলনেই সাধন সম্পূর্ণ হতে পারে..মুল কথা হলো সেক্স করতে করতে আমি আমার সেক্স এর পাটনার এর চোখের ভিতর আমার রুপ দেখলেই আমার সরুপ দেখা হয়ে গেল আর আমার মেয়ে সঙ্গিনি আমার সাথে সেক্স করতে করতে আমার চোখের ভিতর তার রুপ দেখলেই সরুপ দেখা হয়ে যায়. রুপ - সরূপ এর ভবের তাৎপর্য বুঝার জন্য হলেও তাদের মিলনের প্রয়োজন. মূল বাউল তত্ব এর কোন জাত বিচার নেই. শ্রেণীহীন সহজ সরল জীবনের অভিসারী বাউলরা একেশ্বরবাদী, ত্যাগের আদর্শবাদী. কিন্তু সেই একেশ্বরবাদী সত্ত্বা মানেই আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর কিংবা প্রচালিত কোন সৃষ্টিকর্তা হতেই হবে এমন কোন বাধ্য নিয়ম নেই, অনেক বাউল-ই মিস্টিসিজম বা অতীন্দ্রিয়বাদে বা অদৃশ্য সত্ত্বায় বিশ্বাসী যাকে কোন নিদিষ্ট সৃষ্টিকর্তার আওতায় ফেলাকে এক অর্থে অসম্ভব ব্যাপার. কোন কোন বাউল সম্প্রদয়ের মতে, বাউল সাধনায় 'দেহ সাধনা' প্রধান বলেই নর-নারীর আঙ্গিক মিলন অপরিহার্য. এ হচ্ছে যুগল সাধনা. যুগল সাধনা দুই প্রকার - স্বকীয়া এবং পরকীয়া. তবে পরকীয়া বেশি করে তারা. বাউলদের মতে 'পঞ্চরস' পান না করলে প্রকৃত সাধক হওয়া যায়না. পঞ্চরসের উপকরন হচ্ছে - মল, মুত্র, ঋতুরক্ত, রতিজনিত স্ত্রী-পুরুষের ক্ষরিত রস ও বীর্য. যুগল সাধনার ক্ষেত্রে বাউল স্বকীয়া তথা স্ত্রীকেই সাধারণত সাধন-সঙ্গিনী করে ..
বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথায় এক ঘর পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না
দেখিলাম তারে.
বাউলদের মুক্তির বিধান গুলো তারা মনে করে তাদের গুরু মাতার সাথে সেক্স করে আর যৌনাঙ্গ চুসে চুসে মুক্তি লাভ হয়. আর কম বয়সি 13; 14; 15: 16: মেয়েদের স্তন চুসে চুসে একধরনের রস বের হয় সেটা পান করলেই মুক্তি লাভ করা যায়. এই হলো তাদের মুক্তির চিন্তা চেতনা. যদি এই ভাবে মুক্তি হতো তাহলে বাংলাদেশ ও ভারতে অনেক পতিতা পল্লী রয়েছে সেই সব পতিতার অনেক আগেই মুক্তি হয়ে গেছে এবং সবার আগে মুক্তি হয়ে গেছে সানি লিওনের. টোটালি ভুলের মাঝে বাস করে তারা.
লালন শাঁইজি, কে যখন নির্বাসিত করে দিল তখন ওনাকে একটি মুসলিম পরিবার পালন করেন সুস্থতা করে তোলে এবং লালন সুস্থ হয়ে নিজ বাড়িতে গেলে তার মা তাকে আর বাড়ি তুলে না এবং সে মুসলিম পরিবারে ছিল বলে জাতের দোহাই দিয়ে জাত কুল গেছে এই বলে তাকে আর গ্রহন করে না তার মা ও বৌ. এবং পরে লালন সেই মুসলিম পরিবারে আবার আসে এবং ঐ বাড়িতে থাকাকালিন দরবেশ সিরাজশাঁই আসতো মাঝে মাঝে এবং সিরাজশাঁই এর অনেক ভাল লেগে যায় লালন কে. এর কারন হলো লালন ছোট থেকে টুক টাক গান গাইতে পারতো. আর গান গাইতে গাইতে লালন সিরাজশাঁইয়ের অনুসারী হয়ে যায়. এবং উনি সুফিবাদ অনুসারে সাধন ভজন করে. এবং সিরাজশাঁইয়ের নিকটে দ্বিক্ষায় দ্বিক্ষিত হয়ে লালন চলে আসে অন্য যাইগাতে. লালন সুফিবাদে সাধন ভজন করে উনি কেন চার চন্দ্রে সাধনা করালেন ওনার শিষ্যদের? এর কারন হলো উনি হিন্দু পরিবারে জন্মে সুত্রে মানুষ এবং মুসলিম পরিবার থেকে সুফিবাদে এসে সাধনা নিয়েছে, এখন তাকে হিন্দুগন কখনো মেনে নিবেনা এবং মুসলিমগন কখনো মেনে নিবেনা যে একজন নির্বাসিত হিন্দুলোকের থেকে সাধনা বা গুরু ধরবো সেই জন্য লালন বুঝে শুনে কৌসলে বৈষ্ণব ধর্মের দিকে মোর নেয় আর বৈষ্ণব সংমিশ্রিত তৈরী করে তার সাধন ভজনে. আর এই রস রতি সাধনা মুলতো বৈষ্ণবদের এবং পায়খানা এবং প্রসাব এবং বীর্য খাওয়া এবং যুবুতি মেয়েদের মাসিকের রক্ত খাওয়া এই গুলো হলো তথাকথিত সনাতনী বাদ আর বৈষ্ণবদের হতে নেওয়া আর বাউলদের কে বৈষ্ণব বলা হয়. দেখুন লালন কোন ধর্ম মানতো না কিন্তুু কৌসলে উনি ভাতটি খায় অন্য ভাবে? দেখুন কি ভাবে, ওনাদের যে বিয়ের প্রচলন আছে সেটা ধামে চোখ বন্দ করে সাত পাক ঘুরে বিয়ে হয় তাদের ফর্মুলাতে, আর সনাতনবাদে আগুনের চারিদিকে সাত পাক ঘুরে বিয়ে হয় হিন্দুদের. এবং সনাতনী বাদে তাদের গুরুদের কবর কে বলে ধাম আর মুসলিমদের বলে মাজার. এখন প্রস্ন হলো লালন শাঁইজী ভাতটি একটু ঘুরিয়ে খেলেন সনাতনী দিয়ে. আর কৌসলে জাত গেল জাত গেল জাতের কি আসে? আপনার একটু গভীরতম ভাবে বুঝে দেখুন. এর পরে আসুন লালন শাঁইজি ছিলেন মুজ্জব শ্রেণির মানুষ আর মুজ্জুব শ্রেণির মানুষ কখনো কাওকে খেলাফত বা খেরকা দিতে পারে না দেখুন এই খেরকা শব্দটি নেয়া হয়েছে বৈষ্ণববাদ হতে তথাকথিত সনাতনীবাদ হতে নেওয়া. খেরকা কিন্তুু কোন প্রকার খেলাফত নয়. তাহলে উনি নিজের সুবিধার জন্য সুফিবাদ কে আরাল করে দিয়ে কৌসলে বৈষ্ণব হয়ে গেলেন. আর এই কারনে লালনবাদে আমার রাসুল এর নামে কোন দরুদ কিয়াম নেই. উনি সাধরন একজন সাধক ছিলেন উনি কখনো উচু মানের ফকির ছিলেন না উনি মুলতো নির্বাসিত হওয়ার কারনে মর্ম্ম গান গাইতো আর এইটায় সাভাবিক. আর উনি এই গান গেয়েই জগতে নাম কামিয়েছেন. এবং উনি কখনো বড় মাপের সাধক ছিলেন না এবং উনি শুধু মাত্র নিজেকে উদ্ধারকৃত করেছেন কখনো পরিপূর্ণ মুক্তিপ্রাপ্ত ছিলেন না. এবং লালনবাদের অনুসারীগন কেও কখনো মুক্তি পাবে না.বৈষ্ণববাদ হতে রস রতি ঠুকে পরেছে লালন বাদে আর লালন বাদ হতে ঠুকে পরেছে সুফিবাদে. বৈষ্ণবগন এরা মুলতো সেক্স সাধনা কেই প্রাধান্যদান করে আর এই কারনে সুফিবাদ আজ কুলশিত হয়ে যাইতেছে দিনের পর দিন. যারা আমার নবীর উপরে দরুদ পড়ে না তারা কখনো সুফিবাদেরর অংশ নয়. তারা নতুন নিয়মে বৈষ্ণবতীর্থ চালু করেছে.
এদের ইসলামী পরিভাষা ব্যাবহারের কারণে কেউ কেউ এদের মুসলিম ভাবে,আর রাধা কৃষনের উপাশনার কারনে কেউ কেউ হিন্দু ভাবে, আসলে এরা হিন্দু ও না মুসলিম ও না। এরা বাউল সহজিয়া বৈষনব।
ন্যাড়ার ফকির লালন নিজেই বলেন,
আমি মন মন্দিরে পুজা দেব
পড়ব নামাজ দিল কাবায়,
মন্দির মসজিদে যেতে বলনা আমায়।।।
বাউলরা সন্তান নেয় না তাই এরা ন্যাড়ার ফকির।
ইসলাম বলে আল্লাহর শরীক নাই,
বাউলরা বলে আল্লাহর শরীক আছে,মানুষই তার শরীক।।
১ম পর্ব ★curtecy,rayedtalukder, edeted
1- baul totto by Dr ahmod shorif
2- lalon fokir- anowarul karim
ন্যাড়ার ফকির লালন চন্দ্রের অনুসারীরা সর্বকেশী,তারা দাঁড়ি-গোফ বা সর্বাঙ্গের কোন লোমই পরিস্কার করে না।
লালনকে নিয়ে যে সব সমস্যা আছে, যা শুধু প্রবল কি প্রকট নয়, রীতিমত বিপজ্জনকও বটে। লালনের আসল নাম লালন চন্দ্র কর, নারীর গোপনাঙ্গ ভজনই এদের একমাত্র কাজ, বৈষ্নবদের উপাস্য দেবতাই এরা উপাসনা করে। গুরু আর সাধন সঙ্গীর মল মুত্র রজ:বির্য্য পান করা, কুমারী নারীর স্তনচোষা এদের সর্বরোগের মহৌষধ।কেউ কেউ লালনকে বলেন, আউলিয়া। খুবই বিপদ যে, এই ধরণের গবেষকদের প্রলাপোক্তির কোন সীমা পরিসীমা নেই। যে ব্যক্তি জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়েন নি, একটি রোজা রাখেন নি, যিনি চৈত্র-মাসের দোল পূর্ণিমাকে গ্রহণ করেছেন তার বাৎসরিক পূণ্যযজ্ঞের মাহেন্দ্র রজনীরূপে, যিনি যাপন করেছেন ইসলামের সঙ্গে গুরুতরভাবে সম্পর্করিক্ত এক মুশরেকী জীবন, যার শিষ্য প্রশিষ্যদের আধ্যাত্নিক সাধনার শ্রেষ্ঠতম অনুপান গঞ্জিকা(গাঁজা) আর সাধনঙ্গীর সাথে বিকৃত যৌনাচার-তিনিও একজন আউলিয়া। আউলিয়াই বটে। কোন কোন গবেষকের প্রেম ও কল্পনা শক্তি যে সত্যই বড় প্রবল, এটা তারই প্রমাণ।
জন্মসূত্রে লালন কী ছিলেন এ নিয়ে কিছু সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু তার জীবনাচারে যে ইসলাম ও মুসলমানিত্বের গন্ধমাত্র ছিল না, এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তবু তাকে আউলিয়া দরবেশ অভিহিত করে কিছু কিছু গবেষক কী যে তৃপ্তি ও সুখ ও ফায়দা লাভ করেন, আল্লাহপাক জানেন। এবং পন্ডিতজনেরা কিন্তু যথেষ্ট সাফল্যও লাভ করেছেন; কারণ অবস্থা অতিদ্রুত এমন রূপ পরিগ্রহ করেছে যে, গঞ্জিকাপায়ী সংসার পলাতক কিছু লালনভক্ত শুধু নয়, বহু সাধারণ মুসলমানও বিশ্বাস করে, লালন একজন খুবই বড় মাপের আউলিয়া ছিলেন। বদনসীব, বাঙ্গালী মুসলমানদের সত্যই বড় বদনসীব।
বর্তমান লালনপ্রেমীদের খুব কষ্ট হবে, তবু দু একটি বিষয়ে আলোকপাত করা বিশেষ জরুরী। প্রকৃত পক্ষে লালনের যথার্থ পরিচয় অতভাবে বিধৃত হয়ে আছে তার সমসাময়িক ও তৎপরবর্তী প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর ইতিহাস এবং তার গানের মধ্যে। লালনকে নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি শুরু হয়েছে পাকিস্তান আমলে ১৯৬৫ সালের পর। সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথের প্রতিপ হিসেবে দাঁড় করানোর একটি নিরর্থক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যলালিত লক্ষ্য নিয়েই এই বিকৃতি প্রক্রিয়ার শুরু। এবং আজকের আমরা যে লালনকে দেখতে পাচ্ছি, সেটা অংশত ওই প্রক্রিয়ারই পরিণতি। তবে বর্তমান প্রবন্ধে এ নিয়ে আলোচনার বেশী অবকাশ নেই কারণ বর্তমান লেখাটির প্রতিপাদ্য একটু ভিন্ন।
লালন কিভাবে ও কতখানি বিপজ্জনক ছিল এবং এখনো যে বিপদ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সমস্যাটি তুলে ধরাই বর্তমান আলোচনার মূল লক্ষ্য। সমস্যাটা হলো, লালন মুসলমান ছিলেন না মুমেনও ছিলেন না এবং আউলিয়া হওয়ার তো কোন প্রশ্নই উঠে না; অথচ এই সকল অভিধায় আজ তাকে অভিহিত করা হচ্ছে। যার মধ্যে সামান্যতম ঈমান আছে, ইসলামের জন্যে নিভূ নিভূ হলেও কিছুটা অন্তত প্রীতি আছে, তার পক্ষে এসব অকথ্য মিথ্যাচার সহ্য করা কষ্টকর।
লালনকে এখন আদর করে বলা হয় বাউল সম্রাট। আমাদের কোন আপত্তি নেই; আমরা বরং এই ভেবে খুশীই যে, আমাদের এই দরিদ্র দেশে এমন একজন সম্রাটের জন্ম যার গানের ছত্রছায়া এখনো আমাদের উপর ছায়া বিস্তার করে আছে। কিন্তু কেউ অস্বীকার করেন না, করতেও পারেন না যে, অদ্যকার এই বাউল সম্রাট তার স্বসময়ে এবং পরবর্তীকালেও অনেকদিন পর্যন্ত বেশরা ন্যাড়ার ফকির বলেই আখ্যায়িত হয়ে এসেছেন। এবং আজ যাকে বলা হচ্ছে মাজার; কিছুদিন মাত্র আগেও তার নাম ছিল লালনের আখড়া; আর ঝোপজঙ্গল পরিকীর্ণ সেই আখড়াটি ছিল গঞ্জিকাসেবী-প্রেমী রসিকজনের নিরিবিলি আশ্রয়স্থল। এই আখড়াই পরিবর্তিত বর্তমান রূপ হলো লালন শাহের মাজার।
সরকারী পৃষ্টপোষকতা ও অন্য অনেক কারণে ইতোমধ্যে এই মাজার-এর একটি অপরিহার্য প্রভাব বলয়ও তৈরী হয়েছে, যে কারণে দুরদুরান্ত থেকে ডুগি-একতারা ও গাঁজার কল্কি নিয়ে 'সাধক পুরুষেরা' তো আসছেনই, শীরনি-মানতসহ বহু সরল প্রাণ মুসলমানও আসছে এই মাজার জিয়ারত করতে। এটা একটা ফিতনা এবং এমন ফিতনা যার কারণে বহু ঈমান নষ্ট হচ্ছে। বলাই বাহুল্য', লালনের আখড়া কেন্দ্রিক এই ফিতনাটি একেবারে নতুন নয়, তিন সাড়ে তিন দশক আগে এই বিপদের আরম্ভ এবং তারপর থেকে ক্রমাগতই এই ফিতনা প্রবল হয়ে উঠেছে। অথচ সকল সরকার ও সকল সচেতন মানুষের একথা বলা উচিত ছিল-যত বড় আউলিয়াই হোন তার মাজারে গিয়ে কোন কিছু প্রার্থনা করা সুস্পষ্ট র্শিক। অতএব, নিষিদ্ধ; আর এটা তো কোন মাজারই নয়, এটা একজন বাউল গীতিকারের সমাধিত্রে। বিশেষ করে আমাদের আলেম উলামাদের প থেকে এ কথা উচ্চারণ করা খুবই জরুরী ছিল, কারণ এটা তাদের ঈমানী দায়িত্ব। কিন্তু না, তাঁরাও কিছু বলেন না। সম্ভবতঃ বলেন না তার কারণ, তাদের অধিকাংশেরই এমন অবস্থা যে, দোয়ার মাহফিলে ওয়াজ করতে করতেই তারা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েন। সামান্য যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট থাকে, তা তারা তসলিমা নাসরিন নামক এক বিপ্তিচিত্ত বালিকা ও কতিপয় মুরতাদ বুদ্ধিজীবিদের বিরুদ্ধে নাটুকে লড়াইয়ের মধ্যেই নিঃশেষ করে ফেলেন। অবশ্য এটি ভিন্ন আলোচনার বস্তু, লালন প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
আমাদের কাছে এটা দুর্বোধ্য যে, লালন যা নয় তা প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করতে কিছু মানুষের এত উৎসাহ কেন? আবহমান বাংলা গানের ইতিহাসে লালন যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষ, এ নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই; এবং শ্রোতারা তার গানে যদি আনন্দে আন্দোলিত হয় সেখানেও কিছু বলার নেই। কারণ তার সুর ও বাণীর মধ্যে এমন এক ধরণের নান্দনিকতা আছে, যা চিরকালই সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষকে কম-বেশী আকর্ষণ করবেই। কিন্তু এটা তো মনে রাখা উচিত যে, তিনি না কোন দরবেশ এবং তার গান না এতটুকু ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। নামাজ রোজা রাসুল ইত্যাদি ধরণের কিছু ইসলামী শব্দ ও দু একটি ইসলামসম্মত পক্তি দেখে কেউ কেউ বিপুলভাবে উৎসাহিত হতে পারেন, কিন্তু বস্তুত তার গানের পুরো আবহই যে ইসলামী আকীদার পরিপন্থী, এ কথা না মানার কোন যুক্তি নেই, কোন উপায়ও নেই। দু একটি মাত্র উদারহণ পেশ করলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায় যে, লালন আসলেই কি পরিমাণে ইসলামের সম্পূর্ণ বর্হিভূত এক বেশরা জিন্দিক।
আপনি খোদা আপনি নবী,
আপনি হন আদম সফি
অথবা,
আল্লাহ নবী দুটি অবতার,
গাছ বীজ দেখি যে প্রকার
কিংবা
যে মুরশিদ সেই তো রাসুল, ইহাতে নাই কোন ভূল, খোদাও সে হয়-
এই সকল গান কী প্রমাণ করে? প্রমাণিত হয়, ইসলামের মৌলিক ও অলঙ্ঘ্য দাবি যে তওহিদ, সেই তওহিদের সরাসরি মোকাবিলায় দন্ডায়মান লালন এক কুশলী কবি তীরন্দাজ। তার গান শুনতে যতই মধুরই হোক, তাৎণিক আবেদন হোক যতই মর্মস্পর্শী, আসলে এই গান মুসলমানদের ঈমান ও আকীদা বিধ্বংসী এক একটি দুর্বার মারণাস্ত্র। অথচ কী বদনসীব আমাদের, এমন ঈমানবিনাশী মারণাস্ত্র নির্মাতাকেই আমরা বলছি সুফী দরবেশ আউলিয়া এবং কখনো কখনো বলছি মারেফাতের নিগূঢ় রহস্যভেদী এক ইনসানে-ই-কামেল। কালেমই বটে, না হলে এই কথা কি আর যে কেউ গানে বাধতে পারে-
এক এক দেশের এক এক বাণী,
পাঠান কি সাঁই গুণমনি,
মানুষের রচিত বাণী লালন ফকির কয়।
এমন ইসলাম দরদী কামেল পুরুষ ছাড়া কে আর এমন করে বলতে পারে-
কে বোঝে তোমার অপার লীলে,
তুমি আপনি আল্লাহ ডাকে আল্লাহ বলে।
তুমি আগমেরই ফুল নিগমে রসূল,
এসে আদমের ধড়ে জান হইলে।
কী গর্হিত ও ভয়াবহ উক্তি! রাসূলকে আল্লাহ এবং আল্লাহকে রাসূল মনে করার এই জঘন্যতম আকীদা ইসলামের মূলে কুঠারাঘাত করারই অপচেষ্টা। লালন ফকিরের এই এক ধরণের গান, যেখানে তওহিদ-রেসালাত, কোরআন সুন্নাহ ইসলামের মূল আকীদা বিশ্বাস সবকিছুকে অস্বীকার করে, এক জাতীয় কুহকভরা মরমিয়া নান্দনিকতার মোড়কে এমন সব কথা বলা হয়েছে যা রীতিমত শিরক-কুফর নিফাক ও গোমরাহীর চুড়ান্ত। আফসোস, যা কিছু উৎখাত করবার জন্য এই ধরাপৃষ্ঠে ইসলামের আগমন, লালনের গানে সেই সকল নিষিদ্ধ বিষয়ই বার বার বাঙময় হয়ে উঠে; এবং আরো আফসোস যে, সেই সকল দুর্বাক্যপূর্ণ গান সসম্মান প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
বাউলরা যে জীবনাচারে অভ্যস্ত তা যদি আদর্শ হয় তাহলে মানুষকে আর কোন কিছু করতে হবেনা। শুধু গাঁজা খাও, নেশা করো, নষ্টামি করো এসবই হবে জীবন। যারা বাউল জীবনের পক্ষে বলে তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে সেই বাউলের আস্তানায় পাঠাক। তারপর বাউল জীবনকে আদর্শ মানে কিনা বুঝা যাবে…
বাউলদের যারা উচ্ছিষ্ট গোঁফ দাড়ি কেটে দিয়েছেন সে সকল স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার আমরা টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখেছি। তাদের কথায়ও বোঝা গিয়েছে; এটা একটি স্বাভাবিক সামাজিক প্রতিরোধ। এখানে কোন মতাদর্শ বা রাজনৈতিক চিন্তা কাজ করেনি। স্থানীয় সমাজের মাতুব্বর, বয়জেষ্ঠগণ, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি সবাই একত্রিত হয়ে বিনা প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। পরবর্তীতে আমাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক মনোভাব এই ঘটনা থেকে যে যার মত ফায়দা লুটতে উঠে পড়ে লেগেছে।
আমরা সম্প্রতি আওয়ামী নেতাকমী কর্তৃক বাউলদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার ঘটনা শুনেছি। অনেকে বিষয়টি নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি গেল গেল বলে রব তুলেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি বাউলতত্ত্ব কী? বা এতে কী বলা রয়েছে? আমরা কিন্তু জানি না। আনুশেহ, সুমীর মতো কিছু অধুনা গায়িকা বাউলতত্ত্বের প্রচারপ্রসারে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রসেনজিৎ এসে কয়েকদিন আগে লালন নিয়ে সিনেমা করে গেল। মূলত ইন্ডিয়াপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীর লালনপ্রেম যে উথলে উঠেছে তা আমাদের ভাবনার বিষয়। তারচেয়ে বড় কথা আমরা জানি না লালন আসলে কে? তার ধর্ম আসলে কি? এই প্রশ্নের জবাব দিবে নিন্মোক্ত লেখাটি
লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের গুরু। আমরা কি জানি কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম এক্সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাঁই তাদের বলে মাসিকের তিনদিন পরের রক্ত পান করে,আর আছে কাঁই বাবা যারা রজ:শ্রাবের প্রথম তিন দিনের কালো রক্ত পান করে। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা।লালন বলে,
আমি মন্দিরে পুজা দেব
পড়ব নামাজ দিলকাবায়
মন্দির মসজিদে যেতে বলো না আমায়।।
তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,
“বাড়ির পাশে আরশি নগর/সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯)
বাউল সাধকরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারন মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ “বাউল ধ্বংশ ফতওয়া” নামে বাউলবিরধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।
বাউলদের সাধনা হল নারী পুরুষের যুগল সাধনা,বিকৃত যৌন সাধনা,নারী থাকে পুরুষের কোলে,সে নারী তার স্ত্রী নয়, সাধন সঙ্গী,নারীদের মুখে" মা" সম্মোধন করে,সে মায়ের কাছথেকে সব পাওয়া যায়,তা হোকনা যৌনকামনা।।সন্তান ধারন এদের কাম্য নয়, রতি নস্ট এরা করে না। মৈথুনের সময় স্খলন হলে উভয়েই রতি চেটে পুটে খেয়ে ফেলে। লালন বলে-
সমূদ্রের কিনারায় বসে
জল বিনে চাতকী ম' ল।
অর্থাৎ হাতের কাছে আবে হায়াৎ এর পানি বা নারীর শ্রাব থাকতে বোকারা জল বিনে মরে। হাওজে কাউছার বলতে এরা নারীর র:জশ্রাবকেই বোঝে।
তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীনন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। তারা যদি নিজেদের অর্থ-সম্পদ খরচ করে তাদের অধিকৃত জায়গায় আকাসছোঁইয়া লালনমূর্তি বানাতে চায়, তাতেও হয়তো কেউ কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে ‘লালন চত্বর’ ঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
বিষয়:সময় গেলে
সাধন হবে না
""""''''""""""""""""'"""
বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের ক্লাস৯-১০ এর বাংলা বইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউল লালনের একটি কবিতা অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কবিতাটি নিম্নরূপ-
“সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দিনের সাধন কেন করলে না
জান না মন খালে বিলে
মীন থাকে না জল শুকালে
কী হয় তার বাঁধন দিয়ে
শুকনা মোহনা”
অসময়ে কৃষি করে
মিছামিছি খেটে মরে
গাছ যদি হয় বীজের জোরে
ফল তো ধরে না ।।”
আচ্ছা, কবিতাটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের কি শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা কি আদৌ পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা বুঝতে পেরেছে ?? আমার মনে হয় না। কারণ বাউলদের গান বা শ্লোক হচ্ছে দেহতাত্বিক যৌনতা নির্ভর। বাউলরা বিভিন্ন উদহারণের মাধ্যমে তাদের বিকৃত যৌনাচারের বর্ণনা দিয়ে থাকে, এই কবিতায় ঠিক সেটাই করা হয়েছে।
---- যেমন কবিতার শূরুতেই বলা হয়েছে- সময় গেলে সাধন হবে না। যেহেতু কবিতাটি লিখেছে বাউল লালন, তাই সাধন শব্দটিকে বাউলের পরিভাষায় ধরতে হবে। -বাউল পরিভাষায় সাধন বলতে বোঝায়-
“নারী-পুরুষে মিলন বাউলদের সাধনার সারবস্তু। পুরুষের বীজ আর নারীর রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। যৌন উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ বা কথিত ঈশ্বরের অটলরূপ উপস্থিত হয় বলে এদের বিশ্বাস। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিম্নমুখী ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী করে সহজ মানুষ সাধন করতে পারে যারা, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ। তাদের মতে, লালন ফকির একজন সিদ্ধপুরুষ।” (তথ্যসূত্র: লালন গবেষক নিয়ামত আলী মাস্টার ও বাউল ডাক্তার আতিক)
---- ‘সময় গেলে’ বলতে কোন সময় বলা হয়েছে ?
উত্তর হচ্ছে- সময় বলতে এখানে মহিলাদের মাসিকের একটি নির্দ্দিষ্ট সময়কে বোঝানো হয়েছে, যা পার হয়ে গেছে বাউলদের সাধন আর হয়ে উঠে না।
--- কবিতার মাঝে বলা হয়েছে ‘মীন থাকে না জল শুকালে’। এখানে মীন কাকে বলে ?
উত্তর:
ক) বাউল গবেষক ড. আনোয়ারুল করীমের রচিত ‘বাংলাদেশের বাউল’ গ্রন্থে মীন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- “মানুষ সৃষ্টির মূল এই স্ত্রীজননাঙ্গ। এখানেই চন্দ্রের উদয়, এখানেই মীন বা মাছরূপে সাঁই বিরাজ করে। তাই বাউল ভক্তি নিবেদন করে এই যোনিপ্রদেশকে। এখানেই তার সিদ্ধি। এই স্তর অতিক্রম করতে পারলেই সে সাধক।” (সূত্র: বাংলাদেশের বাউল, পৃষ্ঠা- ৩৫৭)
খ) বাউল গবেষক ড. আবদুল করিম মিঞা রচিত ‘বাউল-লালন পরিভাষা’ গ্রন্থে ‘মীন’ শব্দটির অর্থে বলা হয়েছে- “মাছ, ঈশ্বরের প্রতীক। বাউলের বিশ্বাস নারীর রজঃধারায় মীনরূপী পরমাত্মা ভেসে বেড়ায়। নারীর রজঃ ব্যতীরেকে সেই ‘মীন’ ধরার কোনো উপায় নেই। এই মীনের হস্ত পদ স্কন্দ মাথা নেই। যৌন সম্ভোগের মাধ্যমে পরমে স্বরূপ উপলব্ধি হয়। (মীনরূপে সাঁই বিহার করে-লালন)” (তথ্যসূত্র: বাউল-লালন পরিভাষা, পৃষ্ঠা- ৮০)
---- কবিতায় বলা হয়েছে- “কী হয় তার বাঁধন দিয়ে, শুকনা মোহনা”। এখানে কি বুঝানো হয়েছে ?
উত্তর: নারী জাতির মাসিক বন্ধ হওয়ার পর মেয়েলোকের গোপনাঙ্গকে তুলনা করা হয়েছে ‘শুকনা মোহনা’র সাথে। বলা হচ্ছে- ঐ কথিত ‘শুকনা মোহনা’য় ‘বাঁধন’ দেয়া তথা বাউলসাধনা করে কোনো লাভ হবে না।
---কবিতায় বলা হচ্ছে- “অসময়ে কৃষি করে,মিছামিছি খেটে মরে। গাছ যদি হয় বীজের জোরে
ফল তো ধরে না ।।” অর্থ কি ?
উত্তর: মাসিকের নির্দ্দিষ্ট সময় যৌনতা করতে হবে, নয়ত মিছিমিছি খেটে মরতে হবে। অসময়ে কাজ করলে বাচ্চা-কাচ্চা হবে, কিন্তু বাউলীয় সাধনা হবে না।
অর্থাৎ বাউল লালনের লেখা ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ এই কবিতার দ্বারা কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের বাউলদের বিকৃতযৌনচার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যা বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের সত্যিই দুঃখের বিষয়। বাউলদের সম্পর্কে অজানা তথ্য
১) বাউলদের আগমন ঘটেছে হিন্দু ও বৌদ্ধদের সংমিশ্রন থেকে।
২) বাউলরা প্রেমভাজা নামক এক অদ্ভূত বস্তু খায়।যা মানুষের মল-মূত্র এবং পুরুষের বীর্জ এবং মহিলাদের রক্তস্রাব মিশ্রিত থাকে।
৩) বাউলরা অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্থ। তারা দাবি করে, অবাধ যৌনাচার ও গাজা সেবন
ছাড়া সিদ্ধি (!) লাভ করা যায় না।
৪) বাউলদের বলা হয় ‘নাড়ার ফকির’। নাড়া অর্থ শাখাহীন, যাদের কোন সন্তান হয় না।
যদিও তাদের মূল সাধনা যৌনসাধনা, কিন্তু সে যৌন সাধনায় যেন সন্তান না হয় সেজন্য দীক্ষা গ্রহণের কালে তাদের গুরু কর্তৃক তাদেরকে sexo-yoga art বা যৌনযোগসাধনার শিক্ষা দেয়া হয়। এর ফলে তারা সঙ্গমকালে বীর্যপাত ঠেকিয়ে রাখে। সঙ্গমশেষে প্রজনন উপাদান
দিয়ে তারা প্রেমভাজা বানিয়ে খায়, অথবা তার সঙ্গিনী তা পান করে।
৫) বাউলরা লালন সাইকে তাদের নবী বলে দাবি করে।
৬) বাউলরা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ বলে অভিহিত করে থাকে।
৭) বাউলরা পুরুষদের বীর্যকে ঈশ্বরজ্ঞান করে,তারা দাবি করে মহিলাদের রজ: পান করলে রোগ
প্রতিরোধ বাড়ে। এছাড়া তারা নারী দুগ্ধও পান করে থাকে।
৮) একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে।বাউলদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে--
১) http://blog.bdnews24.com/Habibb/14103
২) বাউলদের বিকৃত জীবন কাহিনী নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত সিনেমা ‘কসমিক সেক্স’ দেখতে পারেন - https://youtu.be/jwUEpxvJs_A
বাউলদের খাদ্যাভাস নিয়ে ব্লগে অধুনা অনেক লেখা হচ্ছে। তারা নারী ও পুরুষের বিভিন্ন দেহবর্জ্য যেমন মলমূত্র থেকে শুরু করে বীর্য ও রজ: রক্তও পান করে। এখন বাউলতত্ত্বের বইয়ে দেখা যায় বাউলদের সাই বা প্রভুর মধ্যে তাদের নারী সঙ্গিনীও রয়েছে। যাকে বাউলরা বলে ‘চেতন প্রভু’। এবং লালনের গানে বলা হয়েছে “গুরুরতি সাধন কর”। অর্থাৎ নারীর রতি বা মাসিকের সাধনা।
মাসিকের প্রতি বাউলদের এই যে মনোভাব তা বুঝতে হলে আমাদের রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেতে হবে। বলা আছে, একবার কৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে অবস্থানকালে রাধার মাসিক শুরু হয়। কৃষ্ণ তা টের পেয়ে রাধাকে যেন লজ্জার মুখে পড়তে না হয় এজন্য সে মুহুর্তেই গোপীদের নিয়ে রং বা দোল খেলা শুরু করে। বাউলদেরও দোল পুর্ণিমা মহা উৎসবের দিন।
মূলত বাউলরা বৈষ্ণব।এরা গানের মঞ্চে গান গাওয়ার আগে বলে, জয় সাধু গুরু বৈষ্নব, বৈষ্ণবদের সাথে বাউলদের প্রধান পার্থক্য বাউলরা ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যেমন তারা লুঙ্গি এবং পাগড়ি পরে।এতে তাদের মুসলমান মনে হয়। কিন্তু খাঁটি বৈষ্ণবরা পরে না। বাউলদের খাদ্যাভাস মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের দেহতত্ত্ব হতে আগত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই রোগ থেকে মুক্তিকল্পে স্বমূত্র পান করত।যেমন ভারতের হিন্দুদের মধ্যে এখন গোমূত্রপান জনপ্রিয় হচ্ছে।
ঠিক তেমনি বাউলরা পান করে মূত্র ও মল তো বটেই সাথে রজ:রক্ত ও বীর্য। আর আমরা তো জানিই পরকীয়া প্রেমে দেহ ব্যতীত কিছুই নেই।
এ লেখার মূল লক্ষ্য হলো, ভুলক্রমে অথবা যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়ার কারণে আমরা যে লালনকে নিয়ে কামপন্কিল অমার্জনীয় অশ্লীলতা ও বিকৃত যৌনাচারের এক গভীর গহবরে নিজেদেরকে নিক্ষেপ করছি, এক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বোধোদয় ঘটানো। সুখের বিষয় আমার আগের আলোচনা একেবারে বিফলে যায় নি, কেউ কেউ কিছুটা ক্রুদ্ধ হলেও, কারো কারো মধ্যে অল্পাধিক পরিবর্তনও এসেছে। আসলে ইসলাম এমন একটা শ্লীল, পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন জীবনের কথা বলে, যেখানে কোন কপট ও বর্নচোরা লালন ফকিরের স্থান নেই। স্থান তো নয়ই বরং এই জাতীয় জঘণ্য যৌনদর্শনকে যথাসাধ্য প্রতিরোধ করা যে কোন হিন্দু মুসলমানের বা যে কোন মানুষের জন্য নৈতিক দায়িত্ব। এবং এটা শুধু হঠাৎ আমিই বলেছি তা নয়, লালনের সমসায়িককালে এবং পরে বহু মানুষ তাকে ইসলামের ঘোরতর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে এই ফিতনাকে উৎপাটন করার যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিয়েছেন।
এই ধরণের বাউল বা নাড়ার ফকির সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লাহর ধারণা ছিল, বানাইল পশু তারা বহুতর নরে। মীর মোশাররফ হোসেনও বাউল সম্পর্কে অকেশে বলেছেন, এরা আসলে শয়তান, কাফের, বেঈমান, তা কি তোমরা জান না। কবি জোনাব আলী প্রচন্ড ঘৃণায় ও আক্রোশে সরাসরি এই উক্তি করেছেন, লাঠি মারো মাথে দাগাবাজ ফরিরের। (সূত্র লালন শাহঃ আবুল আহসান চৌধুরী) লালনের মৃত্যুর ঠিক সাথে সাথেই প্রকাশিত (১৯০০ সাল, লালনের মৃত্যু ১৮৯০) মৌলভী আবদুল ওয়ালী তার একটি ইংরেজী প্রবন্ধে খুব সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, কিছু তথাকথিত মুসলমান ফকির অন্য মুসলমানকে ইসলামের বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করছে, তাদের কাজ হলো নিজেদের মতবাদের সমর্থনে (কুরআরন করিম থেকে) ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও ভুল উদ্বৃতি তুলে ধরা। মুন্সী এমদাদ আলী লালনের নাম পরিস্কার নামোল্লেখ করে বলেছেন, নাড়া যে কি ধর্ম তাহা ব্যক্ত করা বড়ই দুরূহ। এমন অসভ্য অশ্লীল ব্যবহার জগতে কোন মনুষ্যের দ্বারা হইতে পারে, এমন বিশ্বাস হয় না। এমনকি সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁও মুসলিম সমাজের অধঃপাত ও শোচনীয় অবস্থার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে মারেফতি ফকিরদের উদ্ভবকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন সামাজিক জীবনের মারাত্বক ব্যাধি।
মোঃ আবু তাহের বর্ধমানী লালনকে বলেছেন, ইসলামবিরোধী, শরীয়ত বিরোধী, বেশরাহ, বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট ফকির; বলেছেন, লালনের গানে আছে নরনারীর অবাধ মিলনের প্রেরণা, লালনের গানে আছে গুপ্ত যৌনপ্রক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়ার গভীর উৎসাহ, লালনের গাছে আছে নাপাক দ্রব্য (কামাচারপ্রসূত বীর্য ও রতিরস) পান করার প্রেরণা, লালনের গানে আছে
কুমারী মেয়ের স্তন চুষে সর্বরোগের আরগ্যের বিধান।
শুধু কি তাই? লালন বলে
গোপনে খায় বেশ্যার হাতে ভাত
তাতে কি যায় ধর্মের জাত?
ন্যাড়ার ফকিরেরা গোপনে বা প্রকাস্যে বেশ্যার ভাত খেলে জাত যায় না।
এরপরও লালন আজ আমাদের কাছে আউলিয়া, গভীর আধ্যাত্নিক জগতের এক অবিসংবাদিত কামেল পুরুষ। কামেলই বটে! কিন্তু এই মহাপুরুষের শিষ্য-প্রশিষ্যেরা এখন যদিও মুক্তবুদ্ধি, উদার, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিসেবীদের ব্যবস্থাপনা ও সরকারী পৃষ্টপোষকতায় আনন্দে-নির্বিঘ্ন বছরে অন্তত দু’বার লালন আখড়ায় জমজমাট গঞ্জিকাসেবন ও রসরতির আসর বসায়, কিন্তু একদা বড় বিপদের মধ্যে ছিল। অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী জনাব শামসুদ্দিন আহমদের অগ্রজ মাওলানা আফসার উদ্দিন ছিলেন ইসলামপ্রেমী এক তেজস্বী পুরুষ। তিনি দোলপূর্ণিমার বার্ষিক উৎসবে আগত বহু ফকিরের ঝুটি বাবরি কেটে দিয়েছিলেন। তার জীবদ্দশায় লালনের আখড়া ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে বাউলদের কোন অনুষ্ঠানতো হতেই পারেনি, ভয়ে অনেক লালন শিষ্য বহুদিন পলাতকও ছিল।
এই হলো লালন ও বাউল তথা ফাউল ফকিরদের নিয়ে সমসামিয়ক ও অব্যবহিত পরবর্তীকালের প্রতিক্রিয়া। আজ অনেকটা স্তিমিত বটে, কিন্তু এই ঘৃনা ও প্রতিরোধের ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। এই মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর আগেও মওলানা মেছবাহুর রহমান লালনের বিরুদ্ধে একটি ছোটখাটো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি তার প্রচারপত্রে লিখেছিলেন, চারিচন্দ্রভেদ ষড়চক্র…….. প্রেমভাজা প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ সমূহের তাৎপর্য কি তা জানলে যে কোন রুচিসম্পন্ন মানুষ লালন এবং তার অনুসারীদের নাম মুখে আনতেও ঘৃণা বোধ করবে। এই ঘৃণা এখনো অত। ম. আ. সোবহান, মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন প্রমুখ লেখকের সাম্প্রতিক রচনাসমূহে এই ঘৃণারই তীব্রতা লক্ষ্য করি।
অবশ্য লালনের প্রতি অনেকের মধ্যে অনেক সহানুভূতি আছে। ডঃ আবুল আহসান চৌধুরী প্রতিরোধের এই অবিরাম ধারাবাহিকতার কারণে কিঞ্চিত বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, একতারার বিরুদ্ধে চলছে লাঠির সংগ্রাম। বাঙলার সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের এ এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। তিনি আরও বলেন, লালনের প্রতি আলেম সমাজের একটি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। লালন বলে-
যেখানে সাঁই এর বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে
দেখিতে যেমন ভূজঙ্গনা।।
ভুজঙ্গনা মানে ফনাধরা সাপ, নারীর ইউরেটাস দেখতে ফনাধরা সাপের মত,তাদের মতে যেহেতু সাঁই নারীর গুপ্তাঙ্গের ভিতর বাসকরে, তা শুনলে ত প্রাণ চমকে ওঠারই কথা,লালন বলে --
থাকে না সে বিনারসে
তিনজনা এক রসে ভাসে,
যে খেয়েছে মাসে মাসে।
অর্থাৎ মাসে মাসে নারীর রজ:শ্রাব খাওয়ার কথা আছে ন্যাড়ার ফকির লালনের গানে গানে।
আসলে এরা মুক্তির পথ খুঁজে পায় না।
পারার কথাও না; কারণ মিথ্যা, অন্ধকার ও অশ্লীলতাকে আঁকড়ে থাকাও একটি অতিক্রমণ্য প্রচন্ড নেশা। অতএব লালন বা লালন শিষ্য প্রশিষ্যেরা যদি প্রচন্ড ঘৃণার মুখেও নিজেদের নোংরা মত ও ততোধিক নোংরা পথকে আঁকড়ে ধরে থাকেন, সেটাই স্বাভাবিক।
একটু ব্যতিক্রম ভাবে ন্যাড়ার ফকির লালন এর কিছু কবিতা বা গান এর লাইনের ব্যাখ্যা করব আজ। আসলে লালনের গান গুলোকে বাংলা ভাষার কুরান মনে করে গাঁজা খোর লালন ভক্তরা, তার গান গুলা কুরান এর আয়াত এর মতই বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে, আমার গবেষণায় লালন কে প্রথমে সূফিতাত্ত্বিক মহাপুরুষ মনে হলেও মূলত তিনি ছিলেন একজন সু-চতুর ঠান্ডা মাথার নাস্তিক।। ইসলাম,আল্লাহ এমনকি কৌশলে নবীকেও তিনি কটুউক্তি করতে ছাড়েননি। বাজারে যেসব বই পাওয়া যায় লালন সাইকে নিয়ে তা মূলত এককেন্দ্রিক ভাবে সূফি ব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সর্বমতে গ্রহনযোগ্য যে লালন এর গুরু ছিলেন সিরাজ সাই। কিন্তু,সিরাজ সাই ছাড়াও তিনি আরও অনেক গুরুর সান্নিধ্যে জ্ঞান লাভ করেন। তবে অফিসিয়ালি তিনি সিরাজ সাইজি কেই হাইলাইট করে গেছেন। আর জীবনের শেষের দিকে এসে তিনি মনে করতে থাকেন যে সব অরগানাইজড রিলিজন-ই ভূয়া। তাইতো তিনি সকল ধর্মকে অস্বিকার করে,একমাত্র পরকৃয়া অশ্লিল যৌনসাধনাকে সাধনার মূলমন্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে অবশেষে বলেছেন,
এমন দিন কবে হবে
যেদিন হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান নাহি রবে।
লালনের ভাষায় সংসারত্যাগী, সমাজচ্যুত,গাঁজাখোর, অশিক্ষিত মানুষগুলই সোনার মানুষ, লালন বলে,
"মানুষ ভজলে, সোনার মানুষ হবি"
লালন স্রস্টাকে ভজনা না করে মানুষকে বা গুরুকে ভজন করতে বলেছেন। লালন বলেন,
শোন মওলানা
মসজিদ ঘরে আল্লাহ থাকে না,
লালনের মতে মসজিদ,মন্দিরে আল্লাহ থাকে না। তবে স্রস্টা কোথায় থাকেন তাও লালন বলেছেন,যেমন-
যেখানে সাঁইয়ের বারামখানা
শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে
দেখতে যেমন ভুজংগনা।।
অর্থাৎ সাঁই বা স্রস্টা থাকে নারীর যৌনাংগের ভিতর, যার ইউরেটাস দেখতে ফনাধরা সাপের মত।
প্রতিটা মানুষ জন্মগত ভাবে নাস্তিক হলেও পরিবেশ তাকে এসব ফালতু যুক্তিহীন ধর্মে বিলিভ করতে বাধ্য করে বলে লালন মনে করে এবং সকল ধর্ম অস্বীকার করে কুৎসিত দেহ সাধনায় লিপ্ত হয়।লালন ধাপে ধাপে আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে বুঝতে পারেন প্রকৃতপক্ষে নারীর জননেন্রিয় গমন, লেহন, মৈথুন, বিন্দু ধারন, বিন্দু উর্ধনিক্ষেপনের মাধ্যমেই মুক্তি লাভ সম্ভব।,লালন বুঝে ছিলেন সব ধর্মেই ভণ্ড, তাই তিনি নিজেই বাউল ধর্মের প্রবক্তা হয়ে ওঠেন, যে বাউল ধর্ম আজ ফাউল ধর্ম হিসাবে পরিচিত,
ইসলামের নবিকে খোচা মেরে অনেক গান তিনি গেয়েছেন। কিন্তু,তা অনেক ক্ষেত্রেই সূফি ব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নিচে ন্যাড়ার ফকির লালনের কিছু গানের লাইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হলঃ
"কী আইন যে আনলেন নবি সক্কলের শেষে!
রেজাবন্দির সালাত-জাকাত,
পূর্ব হতেই জাহের আছে!!
টীকাঃ সক্কল-সকলের বা সবার। রেজাবন্দি=স্রষ্টার জন্য বন্দনা বিশেষ। সালাত=আপন রবের সাথে সংযোগের মাধ্যম।
জাকাত=দান করা। জাহের=জারি করা।
ব্যাখ্যাঃ সুফিমতে এসব কথার ব্যাখ্যা অন্যরকম। কিন্ত,এসব উক্তির মাধ্যমে মূলত লালন ফকির মুহাম্মদের ভণ্ডামি প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন
"হে মুহাম্মদ তুমি যে এতো জ্ঞানী, উত্তম আল্লাহর বন্ধু তুমি মানবজাতির জন্য নতুন কি এনেছ যা আগে ছিল না"
কারণ,এসব সালাত-যাকাত পূর্ব হতেই ছিল। ইসলামের নবীকে চরম একজন নকলবাজ হিসাবে ইংগিত করেছেন এখানে। এখন মডারেটর ইসলামিস্টগন মনে করেন নবীতো নতুন কিছু আনবেন না শুধুমাত্র আগের জিনিস গুলাকে রি-ফর্ম করতে এসেছেন। সকল জাতিকে সংঘবদ্ধ করতে এসেছেন। তাহলে কোরানে ইহুদীদের প্রকাশ্য শত্রু কেন বলা হল? কারণ তারা নবীদের হত্যাকারী।
লালন চন্দ্র মনে করে আসলে মুহাম্মদ কিছুই না, লালন ফকিরই সবজান্তা, মহাগুরু, মহাসাধু, সিদ্ধপুরুষ, এরা হজরে আসওয়াদকে মনে করে স্ত্রীলিঙ,রজ:শ্রাবকে বলে হাওজে কাউছার,বা অমৃত সুধা,যা খেলে ক্ষুধা তৃশ্না থাকে না। বাউলদের আরাধ্য দেবতা তিনজন, এদের কথা লালনের গানের মইধ্যে ই আছে।
পাগলের নামটি এমন,
বলিতে ফকির লালন ভয় তরাইসে
চৈতে নিতে অদ্বৈয় পাগল নাম ধরেছে। এই শেষ অংশে এসে লালন তার গুরুদের নাম বলেছেন। গুরুর প্রতি ভক্তি করে গুরুর নাম মুখে নিতে শ্রদ্ধায় কুঁকড়ে বলেছেন, পাগলের নামটি এমন বলিতে ফকির লালন ভয় তরাইসে আর চৈত্যে, নিতেয়, অদ্বৈয় এই তিনজন হলেন শ্রীচৈতন্যদেব, শ্রী নিত্যানন্দ এবং অদ্বৈত আচার্য।
বিকৃত যৌনাচারী, গাঁজাখোর, লালন যদি সিদ্ধপুরুষ হন তবে, সানি লিওনের অনেক আগেই মুক্তিলাভ হয়েছে, সকল লালন ভক্তদের এক্সরেটেড নায়ক নায়িকাদের কাছে দিক্ষা নিয়ে মুক্তি লাভ করা উচিৎ।।
লালনের জন্ম আসলে কোন ধর্মে ছিল? একজন বলেছে, সে হিন্দু কায়স্থ পরিবারের সন্তান আর অপরজন বলেছে, সে মুসলিম পরিবারের সন্তান। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় এসেছে বাউল লালন জন্মেছে হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। তবে আশ্রিত ছিল একটি মুসলিম পরিবারে।
একজন মানুষ কিন্তু মুসলমান হলে আত্মগোপন করে না, সে একজন খুনি বা ডাকাত হলেও। কেননা মুসলমান হলে তার হীনম্মন্যতা থাকবে না। লোক লজ্জার ভয় থাকবে না। কিন্তু লালন সযত্নে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে ছদ্মবেশীর মতো কেন? একজন হিন্দু লেখকও স্বীকার করেছে, লালন ছিল হিন্দু। নাম লালন চন্দ্র কর। অথচ লালন মানুষকে ধোঁকা দিয়ে লিখেছে-
“সব লোকে কয়, লালন কি জাত সংসারে?
লালন বলে, জাতির কীরূপ দেখলাম না দুই নজরে।”
নিজেকে মুসলমান হিসেবে ধারণা দেয়ার জন্য লিখেছে-
১। “ইলাহী আলমীন গো আল্লাহ,
বাদশাহ আলমপনা তুমি,
ডুবায়ে ভাসাইতে পারো,
ভাসায়ে কিনার দাও কারো,
রাখো-মারো, হাতও ধরো
তাই তোমায় ডাকি আমি।”
২। “পারে কে যাবি, নবীর নৌকাতে আয়।”
আবার সেই লিখেছে-
“আপনি খোদা আপনি নবী,
আপনি হন আদম সফি।
আবার
“আল্লাহ নবী দুটি অবতার,
গাছ-বীজ দেখি যে প্রকার।”
এ রকম অসংখ্য কুফরী কথা- যা লিখা সম্ভব নয়।
লালন বলে--
ত্রিবেনীর তিন ধারে
মীনরুপে সাঁই বিরাজ করে।।
ত্রিবেনী মানে নারীর যৌনাংগ,সেখানে সাঁই মীন বা মাছরুপে বিরাজ করে। তাই লালনের লালনের ভজন সাধনের কেন্দ্রবিন্দু হল নারীর যৌনাংগ। তারা কাবার পাথরকেও যোনী মনে করে,রজ:শ্রাবকে হাওজে কাউছার বা অমৃর সুধা মনে করে পান করে। পরিকল্পিতভাবেই লালন মানুষকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকাশ হয়েছে তার কুফরী আক্বীদা।
আজকে গাঁজাখোর বিকৃত যৌনাচারী লালনকে ছূফী-দরবেশ বানানোর চেষ্টা হচ্ছে যে নিজে বা তার শিষ্যরা এক বেলাও নামাজ রোজা করে না।
ন্যাড়ার ফকির লালন চন্দ্র কর নিজ জাতীর কাছথেকে নির্বাসিত হয়ে মুসলিন গুরুর আশ্রয়ে থেকে তার গানে কিছু ইসলামী পরিভাষা গ্রহন করা হয়েছে তাও আবার ইসলামী ধ্যান ধারনার পরিপন্থি।
যার জীবনে ইসলাম ও মুসলমানিত্বের গন্ধমাত্র ছিল না। তবু তাকে কেন ছূফী-দরবেশ বানানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে? তার কবর গড়ে তোলা হয়েছে মসজিদের আদলে, অথচ লালনকে জানাজা করা হয়নি, বা পোড়ানো হয়নি,মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে মাত্র। যে বেশরা ন্যাড়ার ফকির নামে আখ্যায়িত ছিল তাকে নিয়ে এখন সরকারি পর্যায়ে ঢের মাতামাতি। কিছুদিন আগেও তার জায়গাটিকে বলা হতো লালনের আখড়া আর ঝোঁপ-জঙ্গল পরিপূর্ণ আখড়াটি ছিল গঞ্জিকা সেবীদের আশ্রয়স্থল। সেই আখড়া এখন রূপ নিয়েছে লালনশাহের মাযার! একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে ‘লালনশাহ সেতু’। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক বিশেষ কারণে এই কথিত মাযারকে কেন্দ্র করে একটি বলয় তৈরি করা হয়েছে।
জানাযা ও দাফন-কাফনবিহীন যে লাশ একটি গর্তে পুঁতে রাখা হয়েছিলো, যার মৃত্যুর পর হরিণাম কীর্তন হয়েছিলো তার উপর নির্মিত হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীআল্লাহ, মাহবুবে ইলাহী হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার পবিত্র মাযার শরীফ-এর নকশার অনুকরণে মনোরম স্মৃতিসৌধ।
কি দুভার্গ্য এ জাতির! মহান আল্লাহ পাক এবং উনার রসূল নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মহান আল্লাহ পাক উনার মাহবুব ওলীআল্লাহগণ উনাদের নির্দেশিত পথ উপেক্ষা করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক মুশরিক নাস্তিককে মা’রিফাত জগতের এক কথিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রমাণের অপচেষ্টা চলছে। বিভ্রান্ত শাসকদের অন্তর কতটা কলুষিত হলে এ রকম চিন্তার জন্ম হতে পারে, তা বলাই বাহুল্য। আর এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে রয়েছে- এদেশের মুসলমানদেরকে সঠিক ইসলাম থেকে সরিয়ে দিয়ে, সঠিক ছূফীগণের শিক্ষা থেকে সরিয়ে দিয়ে একটা বিভ্রান্তিকর পথে ঠেলে দেয়ার সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র।
অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, যোনীগবেষক ন্যাড়ার ফকির বাউল তথা ফাউল সমাজচ্যুত গাঁজা খোরেরা
ধর্ম দর্শনের নামে মিথ্যা বাউলিকরণ করেছে বাংলাদেশে। বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া মতবাদ, সূফী মতবাদের মিলনে বাংলার বাউল ভাবধারা।
বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এজন্য তারা নারীকে কোলের উপর বসিয়ে বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হয়।মনের মানুষ,অধর মানুষ কোথায় থাকে এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়।
এই কারণে বাউলরা জোড়ায় জোড়ায় থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের 'লিভিং টুগেদারের' সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের 'চারিচন্দ্রভেদ', 'ষড়চক্র', 'দ্বিদলপদ্ম', 'মূলধারাচক্র', 'সহস্রদলপদ্ম', 'অধর মানুষ', 'ত্রিবেণী', 'সাধনসঙ্গিণী', 'প্রেমভজা' প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে।
দেখুন বাউলগন কিভাবে পুরুষ-প্রকৃতি (নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কিভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কিভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে 'সহজ মানুষ' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ একটি মেয়ের মাসিকের সময় বাউল সাধুগন সাধনার নামে ধর্ষন করে তিন দিন কারন তারা মনে করে মাসিকের সময় সয়ং প্রভু উপর থেকে নারীর যৌনিতে নেমে আসে আর এই আসার সময় নারীর দেহের অধর চাঁদ নামক নীর অর্থাৎ নারীর সাথে সেক্স করতে করতে রস বের হবার পরে একটি সাদা বস্তুু আসে তারা তাকে অধর চাঁদ নামে অভিভূত করে এর পর তারা সেটা পান করে। এবং তারা মনে করে আমরা সয়ং প্রভু কে পেয়ে গেলাম।
প্রমান দেখুন কি বলে বাউল-ফকিরেরা ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রাণের ধারার সাথে কিভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। বীজ-রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা সহজ মানুষ সাধন করতে পারে, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ।
লালনের গানে বলা হয়েছে "গুরুরতি সাধন কর"। অর্থাৎ নারীর রতি বা মাসিকের সাধনা। যদিও অনেক বাউল বলে নিজ দেহের বীর্যের সাধনা মুলত নারীর।গুরুর রতি ভজন সাধন বলতে এরা সমকামিতায় পর্যন্ত লিপ্ত হয়।
মাসিকের প্রতি বাউলদের এই যে মনোভাব তা বুঝতে হলে আমাদের রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেতে হবে। বলা আছে, একবার কৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে অবস্থানকালে রাধার মাসিক শুরু হয়। কৃষ্ণ তা টের পেয়ে রাধাকে যেন লজ্জার মুখে পড়তে না হয় এজন্য সে মুহুর্তেই গোপীদের নিয়ে রং বা দোল খেলা শুরু করে।
দোলপূর্ণিমা বাউলদের প্রধান উৎসবগুলোর একটি। মূলত বাউলরা বৈষ্ণব। বৈষ্ণবদের সাথে বাউলদের প্রধান পার্থক্য বাউলরা ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যেমন তারা লুঙ্গি এবং পাগড়ি পরে। কিন্তু খাঁটি বৈষ্ণবরা পরে না। বাউলদের খাদ্যাভাস মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের দেহতত্ত্ব হতে আগত। বাউলরা পান করে মূত্র ও মল তো বটেই সাথে মাসিকের রক্ত ও বীর্য। এর মূলে রয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের কাহিনী। আর আমরা তো জানিই পরকীয়া প্রেমে দেহ ব্যতীত কিছুই নেই। আর তাদের পরকীয়া প্রমিকার নিকট হতে মাসিকের রক্ত চাই।
আর সেই জন্য বাউলদের নিকটে কোন নারী বেড়াতে গেলে বা কোন বাউলের নিকটে ফোন নাম্বার থাকলে সেই নারীকে বলে মা তুমি দেবি, মা তুমি জননী তুমি সাক্ষাৎ দেবি দূর্গা তুমি মা লক্ষি তুমি জগত জননী মা তোমার পায়ে ভক্তি মা তোমাকে প্রনাম মা তোমাতেই আমাদের মানব মুক্তি মা গো। বাউলদের এই চতুরতায় নারীগন ধরা খেয়ে যায়য় এবং এই ভাবে তারা বিভিন্ন কাহিনি তৈরী করে কারন মুলত তাদের উদ্দেশ্য সেই নারীর মাসিকের রক্ত পান করা আর সেক্স করা। বাউলগন, "ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। ... দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। বাউলদের মধ্যে রজঃপান অর্থাৎ মেয়েদের মাসিকের রক্ত পান করা একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক স েবাদাসী থাকে এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে
সাধারণ বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত .. 'নাড়া' শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার 'ওরসে' তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ 14) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ 1986 সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ । তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি .. ... আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। আমাদের কালেমা হলো" লা ই লা হা ইল্লাল্লাহ,
লালন সাঁই রাসুল্লাহ।
নারী পুরুষ একসাথে গাঁজা খেয়ে তথা কথিত সাধনা বা যৌনাচারে লিপ্ত হয়।।
বিস্তারিত জানতে " cosmic sex" ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করুন।
এক নজরে বাউল
বাউল শব্দের উতপত্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি মতামত আছে।মোটামেটি ভাবে সবগুলিকে মিলালে পাই :
সংস্কৃত “ব্যাকুল” বা “বাতুল” শব্দের মূল[সং. ব্যাকুল বা বাতুল > বাউল]।এর অর্থ উন্মাদ বা পাগল।আবার কেউ চর্যাগীত ও অবহাট্ট রচনায় ব্যবহৃত বাজিল,বাজ্জিল,বাজুল.... শব্দগুলিকে বাউল শব্দের আদিরুপ বলে থাকেন।
বাউল শব্দটি খুব প্রাচীন নয়।মালাধর বসুর “শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্য“ ও কৃষ্ণদাস কবিরাজের “চৈতন্য চরিতামৃত”কাব্যে বাউল শব্দটি প্রথম দেখা যায়।প্রথমটির রচনা কাল পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পাদে আর পরেরটির ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে।
প্রাচীন কালে যে অর্থেই শব্দটি ব্যবহৃত হোকনা কেন বর্তমানে শব্দটি দ্বারা বিশেষ এক ভাবুক সম্প্রদায়কেই বোঝায়।কেন তাদের বাউল/পাগল বলা হয়?কারনটা হলো এদের আচার- আচরন,কথা-বার্তা,পোষাক-পরিচ্ছদ সবই প্রচলিত সামাজিক রুপ থেকে আলাদা।এরা কোন দেব-দেবী,পুজা- আচার,নামাজ-রোজা,মসজিদ-মন্দির মানেন না।কাজেই এরা থাকেন বা থাকতে ভালবাসেন সর্বজন পরিচিত জীবন ধারার বাইরে।এজন্যই এদের আরেক নাম ক্ষ্যাপা।বাউল সম্প্রদায়ের সাধারন বৈশিস্ট গুলি মোটামোটি নিম্নরুপ :
(১) বাউলরা চৈতন্যদেবকে তাদের আদিগুরু মানেন যদিও চৈতন্যদেবের প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সাথে এদের মৌলিক পার্থক্য আছে।অধরা মনের মানুষকে তারা দেবতা মানেন যার বাস কোন মসজিদ মন্দিরে নয়।
(২)দেহভান্ডই হলো এদের কাছে ব্রক্ষান্ড।ওদের ভাষায়- যা নেই ভান্ডে তা নেই ব্রক্ষান্ডে।বা যা আছে ভান্ডে তাই আছে ব্রক্ষান্ডে।এই দেহ মন্দিরেই তাদের মনের মানুষের বাস।যাকে তারা কখনো সাঁই,আলেক নূর, শ্রীকৃষ্ণ বলে ডাকেন।এই দেহের মধ্যেই তারা সেই চিদানন্দ অনন্তের সন্ধান করে।সন্ধান পদ্ধতিটাও সম্পূর্ন দেহজাত।প্রকৃতি(নারী)-পুরুষের মিলনকে প্রেমে রুপদানের মাধ্যমে তারা তাই সিদ্ধি লাভের চেস্টা করেন।
(৩)বাউলরা দুধরনের।একদল গৃহী,আরেকদল সন্যাসী।গৃহীরা ঘর-সংসার করেন।সাধারনত সন্তানাদি নিয়ে সমাজের প্রান্তে বাস করেন।আর সন্যাসীরা থাকেন আশ্রমে(ওদের ভাষায় আখড়া)।তারা আখড়া থেকে আখড়ায় ঘুরে বেড়ায়,একজায়গায় থিতু হয়না কখনো।সাম্প্রদায়ের নিয়মঅনুযায়ী এদের সন্তানাদি থাকতে নেই।গৃহী বা সন্নাসী যেকোন বাউলের সাথেই সর্বাবস্থায় থাকেন একজন প্রকৃতি(নারী)।আখড়ার নারীরা মন চাইলেই সঙ্গী বদল করতে পারেন।এতে পুরুষের কাছ থেকে কোন বাধা আসে না।
(৪)বাউল ধর্ম গুরুমুখী।গুরুই শিষ্যকে শিক্ষাদেন/দেখিয়েদেন গোপন সাধনার পথ।গুরুর শিখানো বিদ্যা ওরা কখওনোই সাধারনের সাথে শেয়ার করেন না।যেহেতু ওদের কোন শাস্ত্র পুঁথি নেই তাই গুরুর নির্দেশিত রীতি-কৃত্যের সাধনা করাই এদের ধর্মাচার।আর আছে গুরু-শিষ্যের পরম্পরায় চলে আসা গান।
(৫)যেহেতু বাউলরা প্রচলিত ধর্মমত মানেন না তাই হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য বা মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য দেখা যায়।বাউল হিসাবে দিক্ষা নেওয়ার সময় একজনকে(নারী/পুরুষ) বিশেষধরনের পোষাক পড়তে হয়।এ অনুষ্ঠানকে “খিরকা প্রদান” অনুষ্ঠান বলে।অবার বয়োজেষ্ঠ বাউলরা যখন একেবারে সন্যাসব্রত দিক্ষানেন তখন তাদের জিন্দা-মরা নামে ডাকা হয়।এ অবস্থায় সন্তান নেয়া নিষিদ্ধ।
(৫)বাউলদের দেহ-দর্শন বেশ বিচিত্র।নারীদেহই তাদের মুক্তির সোপান।আলোচিত মনের মানুষ মাসের একটা বিশেষ সময়ে নারীদেহে অবস্থান করেন।পুরুষ বাউল সেই মহেন্দ্রক্ষনে মতসরুপি নারীদেহে মনের মানুষ,সহজ মানুষ,অধরচাঁদ শিকার করেন।আরও সহজ ভাষায় বললে বিষয়টা হলো-স্ত্রীধর্মের বিশেষ তিনটি দিনেই মনের মানুষের আবির্ভাব হয়,ইহাই মানুষ ধরার সময়।তিনদিনে শেষ দিনে মনের মানুষ পূর্নভাবে আবির্ভূত হন।চতুর্থ দিন তিনি পালিয়ে যান।কাজেই এই তিনদিনই বাউল সাধনার জন্য প্রশস্থ সময়।
(৬)“চারচন্দ্র ভেদ” প্রথা,পান প্রথার মতো সাধারন সমাজের চোখে অশ্লিল ও কুরুচিপর্ন কিছু গোপন অনুষ্ঠান এদের মধ্যে প্রচলিত আছে।যদিও তারা এটা স্বীকার করতে চায় না।তবে লালন,পাঞ্জুশাহ প্রভৃতি গুরুর গানে এর ইংগিত পাওয়া যায়।চার চন্দ্র ভেদ হলো দেহ নি:সৃত চারটি উপাদান রজ:,শুক্র,মল,মুত্র পুনরায় দেহে গ্রহন করা।বাউল পরিভাষায় বিষ্ঠাকে ক্ষিতি,মুত্রকে অপ,রজ: কে তেজ,,শুক্র কে মরুত বলে।সেই আদি বিশ্বাস দার্শনিক মতে বিশ্ব সৃস্টির চার উপাদান এভাবে দেহে গ্রহন করলে দেহ পরিপক্ক হয়,সাধক সাধিকার মন একটা স্থির অচঞ্চল শক্তির সৃস্টি হয়।
(৭)বাউলদের কায়া সাধনা মোটামোটি এ রকম- স্ত্রীলোকের নীর(রজ:) ও পুরুষের ক্ষীর(শুক্র)এই দুয়ের মিলিত সত্তার নাম হলো সহজ সত্তা।নীরে কামের অধিকার,ক্ষীরে প্রেমের অধিকার।সাধককে প্রকৃয়া বিশেষের সাহায্যে(গুরু নির্দেশিত)নীর থেকে ক্ষীর কে আলাদা করে নিতে হবে।অর্থাত স্ত্রী-পুরুষের দৈহিক আসক্তিকে প্রেমের দ্বারা জয় করতে হয়।
(৮)বাউলদের সাধনায় হিন্দু যোগ পদ্ধতি ও মুসলিম সুফি পদ্ধতির মিশ্রন দেখা য্য় ।তবে হিন্দু বাউলকে সুফি সাধনার শব্দদি ও মুসলিম বাউলকে হিন্দু যোগ সাধনার শব্দাদি ব্যবহার করতে দেখা যায়।লক্ষ্যকরলে দেখা যায় হিন্দু বাউলরা বাউল পদবী আর মুসলিম বাউলরা ফকির পদবী ব্যবহার করে।
(৯)গানই তাদের মন্ত্র।গানের শব্দগুলির আলাদা পারিভাষিক অর্থ আছে যা কেবল এই ধর্মাবলম্বীরাই বোঝেন।সাধারনের বোঝা বেশ কঠিন।গানের মাধ্যমেই এরা এদের দর্শন ও শিক্ষা প্রচার করেন।শব্দগুলির বাউল অর্থ বুঝতে হলে পড়ুন বাউল পরিভাষার বই।
(১০)উদার মানসিকতাই বাউল সাধনার মূল।সাম্য আর প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই তাদের সাধনা।এজন্য এই ধর্মে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা জাতি-ধর্মের ভেদ নেই।তবে জাতপাতের ভেদ না থাকলেও সহজিয়াপন্থী হিন্দু বাউল আর সুফিপন্থী মুসলিম বাউল নামে দুটি আলাদা সাধনা পদ্ধতি লক্ষ্য কার যায়।
(১১)বাউলদের সম্যক বুঝতে হলে আমাদের মোটামুটি জানতে হবে দেহতত্ত্ব,আত্মতত্ত্ব,মনের মানুষ তত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব।
পরকীয়া প্রেম
শ্রীচৈতন্যের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব ধর্মের একটি বিশিষ্ট অঙ্গ হলো পরকীয়া প্রেম। অর্থাৎ বর্তমান যুগের ভাষায় পরস্ত্রীর সাথে অবৈধ প্রেম ও ব্যভিচার। বিখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী রমেশচন্দ্র মজুমদার তার লিখিত ‘বাংলা দেশের ইতিহাস’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন, বর্তমান কালের রুচির অমর্যাদা না করে এর বিস্তৃত বর্ণনা করা অসম্ভব। তার মতে, আশ্চর্য বিষয় এই যে, এই পরকীয়া, অর্থাৎ পরিণীতা স্ত্রীর সাথে বৈধ প্রেম অপেক্ষা আধ্যাত্মিক দিক থেকে অনেক শ্রেষ্ঠ ভাবা।
বৈষ্ণবরা মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন, প্রেমের মাধ্যমে ভগবানের সঙ্গ লাভ সম্ভব। আর এই প্রেমের প্রথম সোপান হচ্ছে পরকীয়া। পরকীয়ার মাধ্যমে ভগবত প্রেমের আবির্ভাব ঘটে। সম্ভব হয় প্রেমের স্বরূপ উপলব্ধির। আর এই প্রেমের সাধনার মাধ্যমে লাভ করা যায় ভগবানের সান্নিধ্য। (দ্রষ্টব্য : রমেশচন্দ্র মজুমদার; বাংলা দেশের ইতিহাস; দ্বিতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠা ২৬৭। মাঘ ১৩৮০; জেনারেল প্রিন্টার্স। কলকাতা)
আমার বাড়ি রাজশাহী শহরে। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ২১ কিলোমিটার দূরে, উত্তর-পশ্চিমে খেতুর নামে একটি জায়গা আছে। এখানে সুপ্রসিদ্ধ বৈষ্ণব মহাজন নরত্তম ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৮২ সালে (১৫০৪ শকাব্দে) নরত্তম ঠাকুর খেতুরে চৈতন্যবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তিনি আহ্বান করেছিলেন এক বিরাট বৈষ্ণব সম্মেলন। খেতুর হয়ে ওঠে তখনকার সারা বাংলার বৈষ্ণবদের বিশেষ তীর্থ। এই তীর্থ উপলক্ষে, সেখানে প্রতি বছর বহুলোকের সমাগম হতে আরম্ভ করে। পরে নরত্তম ঠাকুরের তিরধান উপলক্ষে মাঘ মাসের শেষে সাত দিন একটি বড় মেলা বসতে আরম্ভ করে।
এই মেলায় বিভিন্ন ধরনের কাঠের আসবাব, বাঁশ ও বেতের তৈরি দ্রব্য, সুন্দর নকশা আঁকা শখের হাঁড়ি বিক্রি হতো। যারা বৈষ্ণব নন, তারাও যেতেন ওই মেলায় এসব জিনিস কিনতে। বাংলাদেশে এ সময় যত মেলা বসত, তার মধ্যে খেতুর মেলা ছিল খুবই প্রসিদ্ধ। এ সময় মেলায় প্রতি বছর প্রায় ২৫-৩০ হাজার লোকের সমাগম হতো। এই মেলা এ সময় কার্যত হয়ে উঠত একটি বড় অস্থায়ী ব্যবসাকেন্দ্র। এই খেতুর মেলায় লোকসমাগম হওয়ার অন্য আর একটি কারণও ছিল। তা হলো, বৈষ্ণব যুবতী মেয়েরা (বৈষ্টমী) আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে কেবল এক হাতের তালু বাইরে বের করে রাখত। তাদের হাতের এই তালুতে কিছু অর্থ দিলে এসব বৈষ্ণব মেয়ে যেকোনো লোকের অস্থায়ী যৌনসঙ্গী হতো। এই প্রথাও হয়ে উঠেছিল কিছুটা বৈষ্ণব ধর্ম সাধনারই অঙ্গ। বৈষ্ণব মতে
দাস্য সখ্য বাৎসল্য শৃঙ্গার এই চারি রস।
চারি রসে ভক্ত যত কৃষ্ণ তার দাস।
উল্লেখ্য, বৈষ্ণবরা কৃষ্ণের পূজারী। কৃষ্ণকে মনে করা হয় দেবতা বিষ্ণুর অবতার। রাধা ও কৃষ্ণকে নিয়ে গড়ে উঠেছে বিরাট বৈষ্ণব সাহিত্য। আর রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলার বর্ণনা আজকের মাপকাঠিতে মনে হয় খুবই অশ্লীল।
আমি একসময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতাম। বহু দিন হলো অবসর জীবন যাপন করছি। শুনলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাকি অনেক প্রগতিশীল অধ্যাপক বলছেন বৈষ্ণব ধর্ম হলো একটি মানবতাবাদী ধর্ম। আর তার মধ্যেই খুঁজে পেতে হবে বাঙালি সংস্কৃতির আদিম উৎসকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষ্ণব পরকীয়া সাধনপদ্ধতি শুরু হলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কোনো পরিবেশ কি অবশিষ্ট থাকবে? বৈষ্ণব কবি জ্ঞানদাস বলেছেন
রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর ॥
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা বিদ্যমান। ছেলেমেয়েরা এখানে একসাথে লেখাপড়া করে। এখানে যদি তারা বৈষ্ণব হয়ে ওঠেন, তবে তাদের লেখাপড়ার পরিস্থিতি বাস্তবে কী দাঁড়াবে, সেটা সহজেই অনুমান করা চলে। নিশ্চয় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাই না এ রকম কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হোক।
লালন ফকিরকে নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। তাকে নিয়েও কিছু আলোচনা হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক। ‘ফকির’ শব্দটি আরবি (বহুবচনে ফকরা)। মুসলিম বিশ্বে একসময় সৃষ্টি হয়েছিল একাধিক ফকির সম্প্রদায়। ফকিরেরা মনে করতেন মানবজীবনে ঝগড়া ফ্যাসাদ সৃষ্টি হয় সম্পত্তিকে ঘিরে। তাই শান্তিময় জীবনযাপন করতে হলে অনুসরণ করতে হবে ফকির বা নিঃস্ব মানুষের জীবন। লালনকে অনেকে বলেন, ফকির লালন শাহ্। কিন্তু লালন মুসলিম বিশ্বের ফকির আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন না। মুসলিম ফকিরেরা একত্রে বাস করতেন আশ্রমে। আশ্রমকে আরবিতে বলে রিবাত। আর ফারসিতে বলে খানঘা। বাংলায় খানঘা শব্দটা রূপান্তরিত হয়েছে খানকা শব্দে।
লালন শাহ ঠিক কোনো আশ্রমবাসী ফকির ছিলেন না। বাংলাদেশে প্রধানত চারটি ফকির সম্প্রদায় ছিল। এরা হলো, কাদেরিয়া, নকস্বন্দী, সুরাবর্দী ও চিশতিয়া। এসব ফকির সম্প্রদায়ের মধ্যে একসময় সবচেয়ে বড় ফকির সম্প্রদায় ছিল কাদেরিয়া। কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হলেন, আবদ আল্-কাদির জিলানী (১০৭৭-১১৬৬ খ্রিষ্টাব্দ)। ইনি ছিলেন বাগদাদ শহরের লোক। ইনি তার রিবাদ গড়েন বাগদাদ শহরের উপকণ্ঠে, যা মুসলিম বিশ্বে হয়ে উঠেছিল খুবই খ্যাত। জিলানী তার অনুসারীদের বলেছেন, জনকল্যাণে ব্রতী হতে। দুস্থদের সাহায্য করতে এবং অসুস্থদের সেবাযত্ন করে সারিয়ে তুলতে। জিলানীর অনুসারী ফকিরেরা বিভিন্ন ধরনের বনৌষধি জানতেন, যা দিয়ে তারা চাইতেন রোগীকে রোগমুক্ত করতে। একে বলা হতো ফকিরি চিকিৎসা। আবদ আল্-কাদির জিলানীকে বাংলায় বলা হতো বড় পীর সাহেব।
উপরিউক্তভাবে লালন ফকিরের শিষ্যরা কোনো দিনই এভাবে ধর্মসাধনা করেননি। তাদের মধ্যে কাজ করেছে বৈষ্ণব ধ্যানধারণা। আমি একবার অনেক দিন আগে (প্রায় ৪২ বছর) লালন ফকিরের আখড়ায় গিয়েছিলাম, কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। সেখানে গিয়ে দেখেছিলাম কিছু নর-নারীকে একত্রে গঞ্জিকা সেবন করতে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলোম, গঞ্জিকা সেবিনী ওই সব নারী যাপন করে খুবই শীথিল যৌনজীবন। ইসলামে নেশাভাঙ ব্যভিচার করা নিষিদ্ধ। লালন (১৭৭৪-১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মেছিলেন হিন্দু কায়স্থ পরিবারে। তিনি একবার তীর্থে যাওয়ার সময় পথে আক্রান্ত হন গুটিবসন্ত রোগে। তার সহযাত্রী বন্ধুরা তাকে পথে ফেলে রেখে চলে যান। অসুস্থ লালনকে একটি মুসলমান পরিবার পথ থেকে তুলে এনে সেবাসুশ্রষা করে সারিয়ে তোলেন।
লালন মুসলমানের গৃহে অন্ন গ্রহণ করার জন্য আর ফিরতে পারেন না হিন্দুসমাজে। কিন্তু লালনের ধ্যানধারণা থেকে যায় হিন্দুভাবাপন্ন হয়েই। আর তার ওপর পড়ে বিরাট বৈষ্ণব প্রভাব। আমি এসব কথা বলছি কারণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল অধ্যাপক বলছেন আমাদের হওয়া উচিত লালন অনুসারী। কিন্তু লালন অনুসারীরা এখন ভিখারি ছাড়া আর কিছুই হন না। তারা একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে ভিক্ষা করে খান। লালন অনুসারী হলে আমরা পরিণত হব ভিখারির জাতে। কিন্তু সবাই ভিখারি হতে গেলে প্রশ্ন দেখা দেবে, ভিক্ষাটা আসবে কোথা থেকে?
চলবে
লেখক : ইবনে গোলাম সামাদ,professor, rajshahi university
লালনের গান অজস্র হলেও সবই শ্রবণ সুখকর নয় – সব গানই কিন্তু আমাদের কানের ভিতরে যেয়ে মরমে পশে না। অধিকাংশ গানই ক্লান্তিকর। হয়তো কয়েক পঙক্তি মুগ্ধ করার মতো। তাছাড়া পুনরাবৃত্তিও প্রচুর। এই জন্যেই রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশটি গান পছন্দ করেছিলেন। লালন হিন্দু না মুসলমান এ নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কারো মতে তিনি হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমান ফকিরের কাছে দীক্ষা নেন। কারো মতে জন্মসূত্রেই মুসলমান। কিন্তু লালন মনে হয় এসব সংশয় তার জীবদ্দশায় ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। আসলে ব্যক্তিজীবনে তার নিজস্ব বাউল মত ছাড়া আর কোনো ধর্মের তিনি অনুসরণ করেননি।
তার বিখ্যাত গানেই তিনি বলেছেনঃ
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,
লালন ভাবে জাতের কী রূপ দেখলাম না এই নজরে।
এই কারণেই তার শেষকৃত্য কোনো ধর্মমতে হয়নি। তার শিষ্যরা তার মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিলেন মাত্র।
লালনের গানে যে আকর্ষণ থাকুক না কেন তার সাধনার ক্ষেত্র হচ্ছে দেহতত্ত্ব। একটি চিন্তার গুরুত্ব বোঝা যায় তার প্রায়োগিক ফলাফলের উপর। লালনের দেহতত্ত্ব সেই অর্থে বিপজ্জনক ও ভয়ংকর। লালনের সাধনা দেহবর্জিতও নয়। এই সাধনা নারীবর্জিতও নয় অথচ সন্তানবর্জিত যা নিয়ে সামাজিক মানুষের সন্দেহ ও অশ্রদ্ধা স্বাভাবিক। বাউলরা সমাজে থাকে না, গৃহীত হয় না। এদের সম্পত্তি থাকে না। দিনভর গান গেয়ে বেড়ায়। রাত্রে আখড়ায় মিলিত হয়। এরা ভিক্ষাজীবী। এই সাধনায় নারী হচ্ছে অপরিহার্য সঙ্গিণী। এদের সাথে মিল আছে বৌদ্ধ সহজিয়া ও হিন্দু বৈষ্ণব সাধনার। কিন্তু মিল নেই মুসলিম সুফিদের। সুফিদের সাধনা নারীবর্জিত। ভগবত প্রেমই হলো সুফিদের আসল কথা।
লালনের গানে আছে ‘এই মানুষে দেখ সেই মানুষ আছে।’ লালনের ভাষায় সেই মানুষ হচ্ছে আলেক মানুষ বা অলখ মানুষ। এই অলখ মানুষ ঠিক আল্লাহ, ঈশ্বর বা গড নন। সেদিক দিয়ে লালন ও তার বাউল সম্প্রদায় হিউম্যানিস্ট – মানবিকবাদী। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বাউলরা এই মানবিকবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়েছেন এক কুশ্রী কাম সাধনার পথ, যাকে এক ধরনের ব্যাভিচারের সংস্কৃতি বলা যেতে পারে।
লালনের একটা গানে আছেঃ
করি কেমনে শুদ্ধ প্রেম রসের সাধন
প্রেম সাধিতে কেঁপে ওঠে কাম নদীর তুফান…।
বলবো কী হইলো প্রেমের কথা
কাম হইলো প্রেমের লতা
কাম ছাড়া প্রেম যথা, তথা নাইরে আগমন।
এই মানুষে সেই মানুষকে দেখার কথা বলে বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়। এই কারণে বাউলরা জোড়ে জোড়ে থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের ‘লিভিং টুগেদারের’ সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের ‘চারিচন্দ্রভেদ’, ‘ষড়চক্র’, ‘দ্বিদলপদ্ম’, ‘মূলধারাচক্র’, ‘সহস্রদলপদ্ম’, ‘অধর মানুষ’, ‘ত্রিবেণী’, ‘সাধনসঙ্গিণী’, ‘প্রেমভজা’ প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে।
বাউলদের এই ব্যাভিচারী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ায় কয়েকবার বাউল-খেদাও আন্দোলন হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪২ সালের বাউল-খেদাও আন্দোলন খুবই বিখ্যাত। লালনের বাউল সাধনা সেদিন হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজেরই নিন্দা কুড়িয়েছে।
লালন যতো না ফকির তার চেয়ে বেশি বাউল। কারণ ফকির, দরবেশ, আউলিয়া, সুফি শব্দগুলো হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতিজাত। মুসলিম মিস্টিকদের বুঝাতে এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাউলরা সেরকম কোনো সুফি ধারার অনুসারী নয়। সুফিবাদের প্রথম কথা হচ্ছে নিজের কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করে পরিশুদ্ধ হওয়া, সদভ্যাস গড়ে তোলা এবং আল্লাহর প্রেমে এমনভাবে নিমজ্জিত হওয়া যাতে দুনিয়ার কোনো কিছুই তাকে আকর্ষণ না করে। সুফি পরিভাষায় একে বলে ফানা। আজকে জেহাদ শব্দটা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া এমনভাবে হৈচৈ শুরু করেছে যাতে এর মৌলবাণী হারিয়ে যেতে বসেছে। এ শব্দটাকে এখন খুনোখুনি, সন্ত্রাসের সমার্থক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন নিজের কামনার বিরুদ্ধে লড়াই করা হচ্ছে সর্বোত্তম জেহাদ। ইসলামী পরিভাষায় একে বলে জেহাদে আকবর। সুফিরা জেহাদের এই তাৎপর্যকে গ্রহণ করে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চান। সুফিদের পরিভাষায় একে বলে সুলহিকুল- সকলের জন্য শান্তি।
সুফিদের যে সাধন পদ্ধতি সেটা এতো সহজ নয়। সংযম, কৃচ্ছসাধন ও পরিশুদ্ধ জীবন-যাপন এগুলো হচ্ছে সুফি জীবনধারার অপরিহার্য অংশ। সক্রেটিস একবার বলেছিলেন Having the fewest wants, I am nearest to the gods। এ অনেক পুরনো চিন্তা। পার্থিব আকর্ষণকে যে জয় করতে পারে না, সে কখনো সুফি হতে পারবে না।
সুফি সাধনমার্গের তিনটি স্তর আছে – শরিয়ত, তরিকত ও হাকিকত। সুফিদের রাস্তায় হাঁটতে হলে প্রথমেই ইসলামী শরিয়তের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করতে হবে। দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে তরিকত- সুফি সাধনার বিশেষ ধারা। সুফিদের মধ্যে চিশতিয়া, নকশাবন্দিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া এরকম বহু তরিকা আছে। এই তরিকার পথে যারা হাঁটেন তাদেরকে বলা হয় সালিক- পরিব্রাজক। এই সুফি পরিব্রাজনা নানা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে, নানা মঞ্জিল অতিক্রম করে (সুফি পরিভাষায় মাকাম) হাকিকত – আল্লাহর দর্শনে সমাপ্তি ঘটে। এই দর্শনকে বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। সুফিরা তখন নিরবে আল্লাহর জিকির করেন, আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলী নিজেদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করে উন্নত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেন। সুফি সাধনার সাথে তাই বাউল সাধনার তফাৎটা মৌলিক। বাউল সাধন পদ্ধতিতে যে যৌন বিকারগ্রস্ত মনের প্রতিচ্ছবি আমরা পাই, সুফি সাধনায় এসব কল্পনাই করা যায় না। তাই বাউল দর্শনকে কোনোক্রমেই ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত করা চলে না। সেই অর্থে লালনও মুসলিম সংস্কৃতির কেউ নন।
আমাদের কিছু সেকুলার বুদ্ধিজীবী আছেন যারা অনবরত বুঝাতে ব্যস্ত ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন এদেশে যা কিছু আছে তাই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল এবং এখানকার সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার ভিত্তি। এদের কথা শুনলে মনে হতে পারে বাউল ধর্ম একটা প্রবল জনপ্রিয় ও বিপ্লবী ধর্ম যার বন্যায় অবগাহন করে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির আস্বাদ পেয়েছে। আসল কথা হচ্ছে বাউল ধর্ম হিন্দু-মুসলমান উভয়ের দ্বারা বর্জিত হয়েছে। কারণ বাউল দর্শনের মধ্যে মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-আধ্যাত্মিক মুক্তির কথা নেই, মানুষের স্বাধীনতার কথা নেই। এর মধ্যে নেই মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা মোকাবেলা করার কথা। জীবনের সাথে অসম্পৃক্ত এরকম দর্শন নিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। বাউলের চিন্তাভাবনা দিয়ে জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কোনো কৌশল উদ্ভাবন। মাত্র কয়েক হাজার লোকের একটি সম্প্রদায় বা তাদের কয়েকটি গান কিংবা যৌন বিকারগ্রস্ততা একটি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হতে পারে না।
লালন যে ঊনিশ শতকে জন্মেছিলেন সেই সময় পূর্ববাংলার লোক-মানসে এক বড় ধরনের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। এখানকার মানুষ ওহাবী ও ফরায়েজী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক গভীর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিল। সামাজিক শক্তি হিসেবে দেশে ইসলাম যে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পূর্বশর্ত তৈরি করেছিল ওহাবী ও ফরায়েজী আন্দোলন তার নমুনা। এ আন্দোলনের তাৎপর্য নিয়ে আমাদের এখানে বেশি আলোচনা হয়নি। কারণ তখন বাংলার সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব দিয়েছে হিন্দুরা। এ আন্দোলন ছিল প্রকৃতিগতভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। এই ‘অপরাধে’ ব্রিটিশ ও তার অনুগত হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা এ আন্দোলনকে অবমূল্যায়ন করে এবং আন্দোলনের নেতাদের চরিত্র হননে লিপ্ত হয়। ফরায়েজী আন্দোলনের অন্যতম নেতা দুদুমিয়া ব্রিটিশ ও তার দালাল জমিদার শ্রেণির অত্যাচার থেকে দরিদ্র কৃষকদের মুক্ত করার জন্য এক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ঘোষণা দেন-জমির মালিক জমিদার নয়, আল্লাহ। সেই জমিতে কৃষক, শ্রমিক, উৎপীড়িতের সবার অধিকার আছে। এর চেয়ে বিপ্লবী কথা আর হতে পারে না। আজ যারা লালনকে পূর্ববাংলার মানুষের সংস্কৃতি ও জাতিসত্তার সাথে জুড়ে দিতে চাচ্ছেন তারা জানেন না ঊনিশ শতকে পূর্ববাংলার লোক-মানসকে সত্যিকারভাবে উজ্জীবিত করেছিল বাংলার এই ওহাবী ও ফরায়েজীদের ক্রিয়াকাণ্ড – কোনোভাবেই বাউল ধর্ম নয়। ঊনিশ শতকে আমাদের জাতিসত্তার শিকড় খুঁজতে হবে ওহাবী, ফরায়েজী ও ফকির বিদ্রোহের মধ্যে।
একটা জিনিস বোঝা দরকার যে লোক-সংস্কৃতি সব দেশে থাকে। কিন্তু সে দেশের সংস্কৃতি বলতে কেবল লোক-সংস্কৃতিকে বোঝায় না। তার চেয়ে উঁচু স্তরের সংস্কৃতিও একটা থাকে। সেই সংস্কৃতি দেশের মানুষের মননশীলতার প্রতীক। সেই সংস্কৃতি হয় ঐ দেশের জাতিসত্তা, রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি। আমাদের এখানকার এই ভিত্তিটা হচ্ছে ইসলাম। এটাই হচ্ছে পূর্ববাংলার মুসলিম জনমানসের আইডেন্টিটি।
লোক-সংস্কৃতি লোকরঞ্জণের অনুপম উৎস। লালনের গান লোকরঞ্জণকারী হিসেবে বহুদিন বেঁচে থাকবে। একে আমাদের আইডেন্টিটির সাথে তুল্য করে তোলা বাহুল্য মাত্র। বিশেষ করে লালনের ধর্মের ফলিত দিকগুলোর মধ্যে যে যৌন বিকারগ্রস্ততা দৃশ্যমান তা একেবারেই অগ্রহণীয়।
বাংলাদেশের জনমানসে লোক-সংস্কৃতির যে জায়গা আছে সেটা সব সময় থাকবে। সেই জায়গায় লালনের স্থান। লোক-সংস্কৃতিকে ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে খাড়া করার চেষ্টা পণ্ডশ্রম, যা আমাদের সেকুলারবাদীদের আরাধ্য। লোক-সংস্কৃতির জায়গায় লোক-সংস্কৃতি থাকবে, ইসলামের জায়গায় ইসলাম।
আজ আমাদের সেকুলারবাদী বুদ্ধিজীবীরা লালনকে নিয়ে হৈচৈ করছেন। কারণ তারা চান আমাদের জাতিসত্তা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে। তারা চান লালনকে দিয়ে পূর্ববাংলার মুসলিম জনমানসে বিপন্নতা তৈরি করতে। এরকম চেষ্টা অতীতেও হয়েছে এবং আমাদের জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির মতো বহু ঘটনা ঘটেছে।
লালন তত্ত্ব এবং বাউল সমাজের ধর্ম বিশ্বাস
১২৪৮ সালে মালাধর বসু কর্তৃক লিখিত 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থে প্রথম বাউল শব্দটি পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদদের মতে, "সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধব বিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন [1]।" প্রফেসর উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য তার ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান' গ্রন্থে লিখেছেন, বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ খৃস্টাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে,"বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব [2]।" "তবে জগমোহন গোসাঈ কে (জগন্মোহিনী বাউল) সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলা হয়। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয় [3]।" বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। অনেকে বলেন ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল এসেছে। বাতুল শব্দের অর্থ উন্মাদ, পাগল ইত্যাদি। অনেকে বলেন বৌদ্ধ সহজিয়া মতে ব্যবহৃত ‘ব্রজকুল’ থেকে ‘বাজুল’ এবং তা থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। "আরবি 'আউল' বা হিন্দি 'বাউর' থেকেও শব্দটি আসতে পারে [4]।" সংসদ বাংলা অভিধানে বাউল শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে, "ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও সংস্কার হইতে মুক্তসাধক সম্প্রদায় বিশেষ, খেপা লোক, পাগল [5]।" অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' বইতে বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের সন্ধান দেন তা হলো - বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ,কর্তাভজা, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই,পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পণারায়নী, বড়ী, অতি বড়ী, রাধাবল্লভী, সখি ভাবুকী। সেই সময়ে এই রকম অনেকে উপধর্ম চালু ছিল॥ বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ড. আনোয়ারুল করিম লিখেছেন, "প্রাচীন প্যালেস্টাইনের রাসসামরায় (বা'আল) নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। এবং এই ধর্মের লোকদের মধ্যে মৈথুন যৌনচার গুরত্বপুর্ণ বিষয় ছিল॥ এই বা'আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল, যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগ নির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা'আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে [6]।" বাউলদের সাধনার দুটি মুখ্য রীতি - জ্ঞানমার্গীয় যোগসাধনা আর মিথুনাত্মক যোগসাধনা। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারী সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী সম্ভোহ বাউল ধর্মে স্বীকৃত। বাউলরা দেহ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নর-নারীর মিলন ও সঙ্গমকে ধর্মীয় ভাবে বৈধ করে। তাদের কাছে গুরুই সব। প্রয়োজনে গুরুর উপস্থিতিতে মিলন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাইতো বাউলরা গায়, "আমার দেহ-জমি আবাদ হইল না গুরুর বীজ বুনতে পারলাম না। ও বীজ বুনতে পারলে হত কামরাঙ্গা ফলপুষ্ট হত দানা..." অদ্ভুত বাউলদের ধর্ম বিশ্বাস।
"বাউলদের মধ্যে হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা হিন্দু ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,"কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
...মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে [7]।"
তবে অনেক বাউল গান আছে যেখানে সাধন তত্ত্ব ও সাধন রীতির কথা সরাসরি বলা হয়েছে। আবার কতক গানে সাধনার রীতি পদ্ধতি রহস্যময়॥ তবে বাউলরা বিশ্বাস করে যে, 'আপন সাধন কথা, না কহিবে যথা তথা'। "বাউলদের যে গোপন সাধনাটি নিয়ে বারবার নানা জায়গায় আলোচনা দেখা যায় তা হল ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ প্রক্রিয়া। অনেক বাউল গানে এর উল্লেখ আছে॥ বিভিন্ন গানে উল্লিখিত চারটি চন্দ্র হল – শুক্র, রজঃ, বিষ্ঠা ও মূত্র। দেহ নিঃসৃত এই চার পদাত্থকে প্রতীকের ভাষায় ‘চারি চন্দ্র’ বলে [8]।"
বাউলরা চারিচন্দ্র ভেদ করতো অর্থাৎ "মল-মূত্র, রজঃবীর্য পান করতো [9]।"
বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। "এছাড়া, তারা রোগ মুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র পান করে॥ সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে [10]।" নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে।
বাউল সম্প্রদায়ই মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। "মদ্যপান, নারী পুরুষের অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল। বাউলগণ যৌন সঙ্গমকে যৌন পূজা মনে করে [11]। তবে বাউলদের কথা উঠলে বাউল সম্রাট লালনের কথা উঠবেই॥ বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। গবেষক লেখক শক্তিনাথ ঝা শান্তি নিকেতন থেকে লালনের নির্ভরযোগ্য যে গানের খাতাটি উদ্ধার করেন সেখানে লেখা ছিল, "শ্রী লালনশাহ দরবেসের তালেব শ্রী ভোলাই শা ফকির এই বহির মালিক [12]।" আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয় [13]। ১৩৩৩ সালে রংপুরের মাওলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়। তিনি সেখানে মত দেন ,"লালন সাহার ধর্মের কোনো ঠিক ছিল না। তিনি কেবল মুসলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদই ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই হিন্দু সমাজ তাঁহাকে সমাজচ্যূত করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্নভোজন ব্যতীত এছলাম গ্রহণ করেন নাই বা মোছলমান বলিয়া নিজেকে স্বীকার করেন নাই বা এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজ রোজা প্রভৃতির কোনো আচার-ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল না, যা দ্বারা তাহাকে মোছলমান বলা যাইতে পারে। তিনি যত বড় মুনি ঋষি উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন [14]।"
অবশ্য এইসব নিয়ে গবেষনার অন্ত নাই॥ জীবদ্দশায় লালন ফকিরের সাথে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির আলাপ-পরিচয় ছিল॥ 'সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক ছাড়াও সেই সময়কার জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল [15]॥' রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের নাম জড়িয়ে অনেক কল্প-কাহিনী রচনা করেছেন বিভিন্ন গবেষক। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে লালন অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন। "বরং লালনের মৃত্যুর পর তার সমাধি তৈরি করার জন্য কোনো জমিদারই সাহায্য করেনি। পরবর্তীতে আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পরে গেলে জমিদারগণ ১৯৪৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য লালনের আখড়াটি নিলামে তোলেন। লালনের শিষ্যরা ১ শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি কিনে আখড়ার অস্তিত্ব রক্ষা করেন [16]।" তবে বাউল মানেই মনে করা হয় গাজাখোর॥ যা প্রমাণের জন্য বর্তমানে দেশের যেকোনো বাউলের আখড়ায় যাওয়াই যথেষ্ট। তবে ইতিহাস বলে, "লালন শাহের শিষ্য উজল শাহের গাঁজা সেবন করার বদ অভ্যাস থাকার কারণে লালন শাহ তাকে আখড়াবাড়ি হতে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন [17]। লালন শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী শিষ্য দুদ্দু শাহ গাঁজা সেবনকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ মনে করতেন। তাইতো তিনি বলেছেন,যেও না শুকনো বৈরাগীর দলে, গাঁজা খেয়ে মালা টিপে ফেলাবে গোলে। তবে বাউল গন বিভিন্ন সময়ে হিন্দু এবং মুসলমানদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশ শতকের গোড়ায় যে ‘বাউল ধ্বংস আন্দোলন’ হয় তাতে অন্যতম অভিযোগ ছিল বাউলরা ধর্মের নামে অবাধ যৌনলীলা ও নানা বিধ অশ্লীল আচার আচরন করে। যৌন ব্যাপারে বাউলদের কোন পাপবোধ ছিল না। এই যৌন স্বাধীনতার কারণেই অনেক তরুণ ও যুবক সেই সময় বাউল হতে আকৃষ্ট হয়। ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমির সভাপতি থাকাকালীন একজন প্রফেসর লালন সমাধিসৌধে বিভিন্ন সময় মিলাদ, কোরান পাঠ ইত্যাদি ইসলামিক কার্যক্রম চালান। এর প্রতিবাদে লালন শাহের অনুসারী বাউলগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের বরাবরে প্রফেসর সাহেবের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদলিপি দাখিল করেন। যার ভাষ্য ছিল এমন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না মুসলমান না হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। কিন্তু উক্ত অধ্যাপক আমাদের এই তীর্থ ভূমিতে ঢুকে কোরআন তেলোয়াত করেন,ইসলামের কথা বলেন - এসবই আমাদের তীর্থ ভূমিতে আপত্তিকর [18]।" আমরা আলাদা একটি জাতি, "আমাদের কালেমাও আলাদা – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ [19]।" হিন্দুবাদ ও সুফিবাদের মিশ্রণ বাউল দর্শনের মূল কথা হলো মানবতা৷
বাউলদের কাছে সংসার এবং সমাজ উভয়টাই পরিত্যাজ্য। জীবনের জৈবিক প্রয়োজনে তারা সাধন সঙ্গী সন্ধান করে; আর মানুষের দেয়া ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে— "তাহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাহাদের ছাড়িয়ে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন—আমরা পাগল, আমাদের ছাড়িয়া দাও, পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই।" আসলেই তারা পাগলামু উন্মাদনায় মেতে থাকে॥ বাউলদের আছে হাজার হাজার গান।
বাউলদের গান বুঝতে হলে আগে তাদের পরিভাষা বুঝতে হবে, অদ্ভুত তাদের শব্দ চয়ন। "যেমন- অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনী, কুমীর মানে কাম, লতা মানে সন্তান, চন্দ্রসাধন মানে মল মূত্র পান [20]।"
তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়,বাউলদের বিকৃত জীবন আর ‘ভাবের গান’ আমাদের সমাজ সংসারে কোন কাজে লাগবে???
তথ্যসুত্র
[1] লালন শাহঃ বিবেচনা-পূর্নবিবেচনা মুনশী আব্দুল মাননান বাংলা সাহিত্য ও লালন শাহ, পৃষ্ঠা ১১ , ২০০৫।
[2] হারামনি; অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন, সপ্তম খন্ড, পৃ-৮।
[3] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, প্রথম ভাগ, অষ্টম অধ্যায়, অচ্যুতচরণ ; ২০০৪।
[4] বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোক ঐতিহ্য, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ৩৪,২০০৫।
[5] সংসদ বাংলা অভিধান, পৃ ৪১৫,নভেম্বর ২০০৫,কলকাতা।
[6] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, ড. আনোয়ারুল করিম, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫॥
[7] বাউলতত্ত্ব, ড. আহমদ শরীফ, পৃঃ ৫৩-৫৪।
[8] বস্তুবাদী বাউল, শক্তিনাথ ঝা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ॥
[9] দেশ পত্রিকা , বাউল বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা, ৪ঠা মাঘ ১৩৯৮॥
[10] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, আনোয়ারুল করিম; পৃ ১৪-১৮ ;৩৫০- ৩৮২॥
[11] বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আববাস আলী খান,পৃ ৬৬।
[12] ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, শক্তিনাথ ঝা, কলকাতা ১৯৯৫।
[13] Bangladesh By Mikey Leung, Belinda Meggitt.
[14] বাঙলায় বাউল বিরোধী আন্দোলন : প্রেক্ষিত লালন শাহ, আবুল আহসান চৌধুরী॥
[15] লালন শাহের মরমী দর্শন; মো. সোলায়মান আলী সরকার,পৃ ৬, ১৯৯৩।
[16] হারামনি, শক্তিনাথ ঝা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪-৬৫।
[17] দুদ্দু সা’র পদাবলি; শক্তিনাথ ঝা, ৬৬ -১০৩ পদ।
[18] লালন শাহ জীবন ও গান; এস এম লুৎফর রহমান; পৃ-১০৭-১০৮।
[19] ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, সুধীর চক্রবর্তী, ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫॥
.
[20] গভীর নির্জন পথে, সুধীর চক্রবর্তী, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৪।
চলবে,,,,,,,,,
http://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/lovelyemon/30074137
বেশ তুঙ্গে উঠেছে বাউলরা। তাদেরকে এখন বলা হচ্ছে বাউল শিল্পী।
তারা পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। সক্রিয় সহযোগিতা পাচ্ছে। এমনকি তথাকথিত জাতীয় দৈনিকগুলোর শীর্ষ সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে।
গতকালও ইসলাম বিদ্বেষী একটি পত্রিকায় বক্স আইটেমে শীর্ষ সংবাদ হয়েছে-
“এবার শিবচরে নারী বাউল গণধর্ষণের শিকার”
খবরে বলা হয়েছে- “মাদারীপুরের শিবচরের চরাঞ্চলে এক নারী বাউলশিল্পী (২৮) গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিল্পীকে গুরুতর অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে এ ব্যাপারে শিবচর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
বাউলশিল্পী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জানায়, ও আমারে বিয়া করার জন্য আমার বাড়িতেই আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। তাই ওর জন্য মায়া লাগতো। কাইলকো আমারে কাবিনের কথা কইয়া নিয়া ৩ জনে মিইলা খারাপ কাম করলো। আমি ওগো বিচার চাই।”
উল্লেখ্য, মাদারীপুরের তথাকথিত বাউল শিল্পী বিয়ের কথা বলে প্রতারণার তথা কলঙ্কিত করার অভিযোগ তুলেছে। সমাজের সহমর্মিতা চাইছে। প্রকাশ করছে তারা বিয়েতে আগ্রহী ও বিশ্বাসী। কিন্তু আসলে কী তাই?
প্রসঙ্গত বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার ‘বাংলাদেশের বাউল’ বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হলো- “প্রাচীন প্যালেস্টাইন-এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তাওরাত, ইঞ্জিল (বাইবেল), কুরআন মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম একসময় এ উপমহাদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সূফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।” (বাংলাদেশের বাউল পৃষ্ঠা : পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডক্টর আহমদ শরীফ তার “বাউল তত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র মত। যার নাম নাথপন্থ। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে। তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরিদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরিদ গ্রহণে কোনো বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরীয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মতো করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোনো নামে নাহি বাধা
মন কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।”
(বাউল তত্ত্ব : পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪)
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হলো শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোনো সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনোকিছু বলেই পরিচয় দেয় না। লালন শাহ ছিল বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দফতরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলে, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তার গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি। আমাদের গুরুই আমাদের রসূল। ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কুরআন তিলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালিমাও আলাদা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রসূলুল্লাহ।“ (দ্রষ্টব্য : সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃষ্ঠা ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোনো মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায় না। জুমুয়ার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করে না। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামায নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায় না। এদের জানাযাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। ((বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্মসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। নাস্তিক ডক্টর আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্মক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরি হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারণ ঘটনা। এছাড়াও তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মূত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মূত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ৩৫০, ৩৮২)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলত বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচরণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রসূল, আনাল হক্ব, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো-
“বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথা এক পড়শি বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাত্মিক গান মনে করা হলেও এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শি শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বাংলাদেশের বাউল : পৃষ্ঠা ৩৬৮-৩৬৯)
সমকাল ও উত্তরকালে লালন সম্পর্কে ইতি ও নেতিবাচক দুই ধরনের সামাজিক প্রতিক্রিয়াই প্রবল হয়েছিল। যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত হয়েছিলেন তিনি। লৌকিক বাংলার এই অসাধারন মনীষী-ব্যক্তিত্ব তাঁর সমকালেই সুধীসমাজের মনোযোগ ও শ্রদ্ধা আকর্ষণে সক্ষম হন। তাঁর প্রতি ঠাকুরবাড়ির একাধিক সদস্যের সানুরাগ কৌতূহল তাঁর পরিচয়ের ভূগোলকে আরো প্রসারিত করে। লালনের মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ অনুরাগী ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
লালনের জীবৎকালেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিক্রিয়া সূচনা হয়। বাউল বা লালন বিরোধী আন্দোলনের তথ্য-খতিয়ান সংগ্রহ করলে এই প্রতিক্রিয়ার যথার্থ স্বরূপ উপলব্দধি করা যাবে।
জন্মলগ্ন থেকেই বাউল সম্প্রদায়কে অবজ্ঞা নিন্দা নিগ্রহ বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কিংবা ‘রাগাত্নিকা পদে’ ইঙ্গিত আছে বাউল সম্প্রদায়ের প্রতি সেকালের মানুষের অবজ্ঞা-অশ্রদ্ধা কতো তীব্র ছিল। প্রকৃতপক্ষে শাস্ত্রাচারী হিন্দু আর শরীয়তপন্থী মুসলমান উভয়ের নিকট থেকেই বাউল অসহিঞ্জু আচরণ আর অবিচার অর্জন করেছে। উনিশ শতকে বাউল মতবাদ যেমন উৎকর্ষের শিখর স্পর্শ করে, আবার তেমনি পাশাপাশি এর অবক্ষয়ও আরম্ভ হয় এই সময় থেকেই। ওহাবি, ফারায়জি, আহলে হাদিস প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফলে এঁদের প্রতি অত্যাচার নিগ্রহ বৃদ্ধি পায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অনেকাংশে বিপন্ন হয়ে পড়ে।
হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮০-১৯৪৯), তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১), কারামত আলী জৌনপুরী (১৮০০-১৮৭৩), দুদু মিয়া (১৮১৯-১৮৬২), মুনশী মেহেরুল্লাহ (১৮৬১-১৯০৭), সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস রুমী (১৮৬৭-১৯২৩), প্রমুখ ধর্ম ও সমাজ-সংস্কারকের উদ্যেগ-প্রচেষ্টায় বাউলমতের প্রভাব-প্রসার খর্ব-ক্ষুণ্ণ হয়। অনেকক্ষেত্রেই বাউলদের প্রতি আলেম সমাজের একটি বিদ্বেষপ্রসূত মনোভাবের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। বাউল বা নাড়ার ফকির সম্পর্কে মুন্সী মেহেরুল্লাহর ধারণা ছিল, ‘বানাইল পশু তাঁরা বহুতর নরে’ (‘মেহেরুল ইসলাম’)। এই সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে মীর মশারফ হোসেনও বাউলদের সম্পর্কে আক্লেশে বলেছেন, ‘এরা আসল সয়তান, কাফের, বেঈমান/ তা কি তোমরা জান না’ (‘সঙ্গীত লহরী’)। কবি জোনাব আলি প্রচণ্ড আক্রোশে সরাসরি বলেছেন, ‘লাঠি মার মাথে দাগাবাজ ফকিরের’ (‘কাব্য মালঞ্চ’)। এ ছাড়া বাউল ফকিরদের বিরুদ্ধে রচিত হয়েছে নানা বই, প্রদত্ত হয়েছে নানা বিঁধান আর ফতোয়া।
প্রচলিত শাস্ত্রধর্মের বিরোধী ও মানবমিলনের প্রয়াসী লালনের জীবৎকালেই লালন বিরোধী আন্দোলনের সুত্রপাত্র। তাঁর মতবাদ ও সাধনা হিন্দু মুসলাম উভয় সম্প্রদায়ের শাস্ত্রবাদী ধর্মগুরু ও রক্ষণশীল সমাজপতিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে;- বারংবার তিনি হয়েছেন লাঞ্ছিত-অপমানিত-সমালোচিত। কিন্তু লালন ধীর, স্থির, লক্ষ্যগামী। কোনো অন্তরায়, প্রতিবন্ধকতায় তাঁকে নিরুৎসাহিত বা নিরুদ্ধ করতে পারেনি। সব বিরোধিতাকে তুচ্ছ করে তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছেন সত্যাভিমুখে-পরম প্রত্যাশিত মনের মানুষকে পাওয়ার আশায়। লালন গূঢ়-শুহ্য দেহবাদী সাধনার তত্ত্বজ্ঞ সাধক। তাই এসব দুঃখ-আঘাত-বেদনার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তাঁর গানে সরাসরি প্রতিফলিত হয় নি।
কাঙ্গাল হরিনাথের সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকায়’ (ভাদ্র ১ম ১২৭৯/আগস্ট ১৮৭২) ‘জাতি’ শীর্ষক আলোচনায় লালন ফকির সন্মন্ধে প্রসঙ্গেক্রমে আলোকপাত করা হয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের ‘জাতি’ বিপন্নতার জন্য লালন ও তাঁর সম্প্রদায়কে এখানে দায়ী করা হয়েছে। লালন জাতিভেদহীন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সাধনার যে অভিনব প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন হিন্দু সমাজনেতারা তা অনুমোদন করনে নি। ‘গ্রামবার্তা’র নিবন্ধকার মন্তব্য করেছেনঃ
‘… এদিকে ব্রাক্ষধর্ম জাতির পশ্চাতে খোঁচা মারিতেছে, ওদিকে গৌরবাদিরা তাহাঁতে আঘাত করিতেছে, আবার সে দিকে লালন সম্প্রদায়িরা, ইহার পরেও স্বেচ্ছাচারের তাড়না আছে। এখন জাতি তিষ্ঠতে না পারিয়া, বাঘিনীর ন্যায় পলায়ন করিবার পথ দেখিতেছে।’
১৯০০ সালে প্রকাশিত মৌলভী আবদুল ওয়ালীর On Curious Tenets and Practices of a certain Class of Faqirs in Bengal প্রবন্ধে লালন সম্পর্কে সামান্য ইঙ্গিত ও মন্তব্য আছে। এই প্রবন্ধে একস্থানে মুসলমান বাউল ফকিরদের সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
The so-called Musalman Faqirs speaking to another Musalman try their best to agree against Islam, and to misinterpret or misquote passages in support to their doctrness.
বাউল ফকিরদের সম্পর্কে সেকালে এই ছিল প্রায় সর্বজনীন ধারণা। বলাবাহুল্য বাউলশ্রেষ্ঠ লালনও এই ধারণার আওতামুক্ত ছিলেন না।
মুন্সী এমদাদ আলী (১৮৮১-১৯৪১) প্রনীত ‘রদ্দে নাড়া’ (অপ্রকাশিতঃ ২৪ আষাঢ় ১২২৪) পুথিতে বাউল বা ‘নাড়ার ফকির’দের বিশদ পরিচয় দিয়ে তাঁদের তীব্র নিন্দা-সমালোচনা করা হয়েছে। লেখক প্রসঙ্গক্রমে পুথির ভুমিকায় লালন শাহের নামোল্লেখ করে বলেছেনঃ
‘নাড়া ইত্যাদি ইত্যাদি ইহাদিগের মধ্যে আমাদের দেষে এই নাড়ার হট্টগোলই বেশী। আমাদের দেষে প্রধানত দুই শ্রেণীর নাড়া দেখিতে পাওায়া যায়। এক শ্রেণীর নেতা জেলা নদীয়া মহকুমা কুষ্টিয়ার অধিন ছেউড়িয়া নিবাসী লালন সা তাঁহার রচিত বহুবিধ গান লোকমুখে প্রচলিত আছে। কিন্তু রচিত কোন পুস্তকাদী নাই। নাড়ার ধর্ম সন্মন্ধেও আমি যতদূর নিজে অবগত হইয়াছি ইনশাল্লা পাঠক-পাঠীকাগনের নিকট উপস্থিত করিব বাসনা করিয়াছি। ইহার দ্বারা মছলেম সমাজে কোন উপকার হইলে শ্রম সফল জ্ঞান করিব।’
লেখক এরপর বাউল বা নাড়াধর্ম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেনঃ
‘নাড়া যে কি ধর্ম তাহা ব্যক্ত করা বড়ই দুরহ। এমন অসভ্য অশ্লীল ব্যবহার জগতে কোন মনুষ্যের দ্বারা হইতে পারে এমন বিশ্বাস হয় না।’
রংপুর জেলার বাঙ্গালীপুর নিবাসী মওলানা রেয়াজউদ্দিন আহমদ ‘বাউলধ্বংস ফৎওয়া’ অর্থাৎ ‘বাউলমত ধ্বংস বা রদকারী ফৎওয়া’ প্রণয়ন ও প্রচার করেন। বাংলা ১৩৩২ সালে এই ‘ফৎওয়া’র দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বাংলার প্রখ্যাত ওলামা ও নেতৃবৃন্দ এই ফতোয়া সমর্থন ও অনুমোদন করেছিলেন। ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’র ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৩৩ সালে। ২য় খণ্ডের প্রধান উল্লেখ্য বিষয় হলো লালন সাঁই সম্পর্কে মন্তব্যসহ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা প্রকাশ। এতে লালন সম্পর্কে মুসলিম সমাজ ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মনোভাব ও দৃষ্টি ভঙ্গির যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ফৎওয়া’র এই ২য় খন্ডে বসন্তকুমার পালের ‘ফকির লালন শাহ্’ (‘প্রবাসী’, শ্রাবণ ১৩৩২) প্রবন্ধটি উদ্ধত করে মন্তব্য করে হয়েছেঃ
‘লালন সাহের জীবনী পাঠে বুঝা যায় লালন সাহার ধর্মের কোনই ঠিক ছিল না। বরঞ্চ তাঁহার ভাবের গান ও কবিতা বলির ভিতর দিয়া পরিস্ফুটিত হয় যে তিনি হিন্দু জাতির একজন উদাসীন ছিলেন। তিনি কেবল মোছলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদি ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই, হিন্দু সমাজ তাহাঁকে সমাজচুত্য করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্ন ভোজন ব্যতীত, এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজ, রোজা প্রভৃতির কোন চিহ্নই কিংবা আচার ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে ছিল না, যদ্দারা তাহাঁকে মোছলমান বলা যাইতে পারে, তিনি এছলামের হোলিয়া অনুসারে মোছলমানের দরবেশ ফকির হওয়া দূরে থাক একজন মোছলমান বলিয়াও পরিগনিত হইতে পারেন না। তিনি যত বড়ই মুনি, ঋষি, উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন। কেহ মোছলমানে অন্ন খাইয়াই মোছলমান হইতে পারেন না। কারণ মোছলমানই মোছলমানের পাকে ভোজন করিয়া থাকে। যাহার মধ্যে এছলামের রীতিনীতি ও কার্যকলাপ গুলি শরীয়তের কাটায় মিলিবে না, তিনি মুনি-ঋষি, দরবেশ ফকির যে কোন নামেই পরিচিত হইন না কেন, মোছলমান তাহাঁকে কোনই শ্রেণী-মধ্যে পরিগনিত করিয়া লইতে পারে না। অতএব লালন সাহার মধ্যে শরীয়তের চিহ্ন না থাকায় তিনি মোছলমান সম্প্রদায়ভুক্ত নহেন। সুতারাং বাউল বা ন্যাড়ার ফকিরগন যে লালন সাহাকে মোছলমানের সেরা পীর, দরবেশ বলিয়া তাঁহার পদ অনুসরনকরতঃ মোছলমানের দরবেশ ফকিরের দাবী করিয়া দুনিয়াটাতে তোলপাড় করিয়া তুলিয়াছে, ইহা তাহাঁদের পথভ্রষ্টের পরিচয় মাত্র।’
‘লালন সাহার পরিচয় ত ইহাই দাঁড়াইল কিন্তু বাউল, ন্যাড়ার ফকিরগন লালন শাহ্ সন্মন্ধে কোনই পরিচয় না জানিয়া হুজুগে মাতিয়া হিন্দু বৈষ্ণবগনের দেখাদিখি লালন সার পদে গা ঢালিয়া দিয়া মুসলিমসমাজের কলঙ্কস্বরূপ হইয়াছে ইহা অতিশয় পরিতাপের বিষয় তাহাঁদের ধাঁধা এখন ঘুচাইবে কে ?’
বাউল নাকি ফাউলঃ কাদের সংস্কৃতি, কাদের বিশ্বাস?
গত ১৫ অক্টোবর কিছু ইসলামী দল ও এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের চত্বর থেকে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য অপসারণ করেছিল তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তারপর থেকে এদেশের সংস্কৃতিমনা, বাউলপ্রেমিক এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় ক্ষোভে দুঃখে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এ ভয়ঙ্কর ঘটনার (?) তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বাউল ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে এবং তা পূনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা (?) প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি খোলা চিঠি দিয়েছে। তাদের ভাষায় মৌলবাদের আখড়া (?) স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যা হচ্ছে, কোন সভ্য-ভব্য দেশে তা ঘটার কথা নয়। খোলা চিঠিতে তারা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে “লালন চত্বর”
নামকরণ করা এবং সেখানে মান সম্মত বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের দাবী জানিয়েছে। প্রগতিশীলতার একতরফা দাবীদার চিহ্নিত কিছু পত্রিকায় তাদের ধারাবাহিকভাবে বাউল ভাস্কর্য স্থাপনের পক্ষে বাউলপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গের জ্বালাময়ী কিছু রচনাও প্রকাশিত হয়েছে।
গত ২৮ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় “চাই মুক্তসমাজ এবং শিল্প ও জ্ঞানচর্চার অবাধ পরিবেশ” নামক রচনায় বলা হয়, “গীতিকার ও বাউল সাধক লালন শাহ বাংলাদেশ ও বাঙালীর অমূল্য সম্পদ। বাউল ভাস্কর্যের উপর অপশক্তির এ ধরণের ঘৃণ্য হামলা কার্যত আমাদের চিরায়ত সামাজিক ধর্মীয় সম্প্রীতি ও আত্মপরিচিতির বন্ধনমূলে কুঠারাঘাত হানার সামিল। আমাদের লড়াই এমন এক শক্তির বিরুদ্ধে, যারা বোঝে না সৌন্দর্য্য কি, পাখি-ফুল-নদী কি, সংস্কৃতি কি, গান নাটক কবিতা কি? এরা অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ, আর এদের প্রশ্রয় দেওয়ায় এই অন্ধকার আরও গাঢ় হচ্ছে। সংস্কৃতি ও রাজনীতির উপর মৌলবাদীদের অব্যাহত আগ্রাসন যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। মৌলবাদের ভয়ে নতজানু হলে উত্থান ঘটবে জঙ্গিবাদের, আমাদের বাস করতে হবে প্রশ্নহীন এক মৃত সমাজে।” একই দৈনিকে গত ২৭ অক্টোবর লেখক হুমায়ুন আহমেদ “এখন কোথায় যাব, কার কাছে যাব?” নামক রচনায় লিখেছেন, “আফগানিস্তানের তালেবানরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মূর্তি (যা ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ) ভেঙ্গে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। আমরা ভাঙছি সাঁইজির মূর্তি। যার জীবনের সাধনায় ছিল আল্লাহর অনুসন্ধান।”
বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে যখন জোরদার আন্দোলন চলছে, তখন তা স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্যে আলোচনায় চলে এসেছে। কেউ কেউ বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে আবার কেউবা বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আসলে বাউল ভাস্কর্যের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থহান নেয়ার পূর্বে আমাদের জানর প্রয়োজন কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? ৯৭ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। “বাউল” শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার “বাংলাদেশের বাউল” বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল তথা হুবাল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম এক সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা
কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।”
(বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি। আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরআন তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।” (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
বাউলদের গুরু লালিন ফকিরের জীবন সম্পর্কে বেশী কিছু জানা যায় না। তার মৃত্যুর দু সপ্তাহ পর বাংলা ১২৯৭ সালে কুষ্টিয়া লাহিনীপাড়া থেকে “পাক্ষিক হিতকারী” পত্রিকায় লালন ফকির সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। যেখানে বলা হয়, “ …… লালন নিজে কোন সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না, অথচ সকল ধর্মের লোকেরা তাহাকে আপন বলিয়া জানিত। মুসলমানদিগের সহিত তাহার আহার-ব্যবহার থাকায় অনেকে তাহাকে মুসলমান মনে করিত। বৈষ্ণব ধর্মেও মত পোষণ করিতে দেখিয়া হিন্দুরা ইহাকে বৈষ্ণব ঠাওরাইত। …… অধিক কি ইহার শিষ্যগণ ইহার উপাসনা ব্যতীত আর কাহারো উপাসনা শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিত না। …… ইনি নোমাজ করিতেন না। সুতরাং মুসলমান কি প্রকারে বলা যায়? তবে জাতিভেদ বিহীন অভিনব বৈষ্ণব বলা যাইতে পারে; বৈষ্ণব ধর্মের দিকে ইহার অধিক টান। শ্রী কৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাস করিতেন। …… মৃত্যুকালে কোন সম্প্রদায়ী মতানুসারে তাঁহার অন্তিম কার্য্য সম্পন্ন হওয়া তাঁহার অভিপ্রায় ও উপদেশ ছিল না। তজ্জন্য মোল্লা বা পুরোহিত কিছুই লাগে নাই।” (বাংলাদেশের বাউল পৃঃ ৪১৮-৪১৯)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,
“বাড়ির পাশে আরশি নগর
সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯) এছাড়া গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, লালন ফকির এবং বাউলদের গানে এমন অনেক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যা কাফের ও মুরতাদের সমগোত্রীয়। সুধীর চক্রবর্তীর বক্তব্য অনুসারে, ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে লালনতত্ত্ব মুশরিক। কারণ, লালন ফকির বিশ্বাস করতো যিনি আল্লাহ, তিনিই রাসুল, তিনিই নবী। এটি ইসলামী আকিদার ঘোরতর পরিপন্থী। যেমন।
“যেহিতো মুরশিদ সেহিতো রাসুল
এই দুইয়ে নেই কোন ভুল
মুরশিদ খোদা ভাবলে জুদা
তুই পড়বি প্যাঁচে।”
বিকৃত যৌনাচারী লালন বলে--
ত্রিবেনীর তিন ধারে মীনরুপে সাঁঈ বিরাজ করে।
অর্থাৎ সাঁঈ বা মনের মানুষ মাছ রুপে নারীর যোনীতে বাস করে, রজ:শ্রাবের সময় তাকে ধরতে হয়।
বাউল সুফীসাধকেরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারণ মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ “বাউল ধ্বংস ফতওয়া” নামে বাউলবিরোধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।
তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে ‘লালন চত্বর’ ঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী বিশ্বের এজেন্ট ও ভোগবাদী জীবনাদর্শে বিশ্বাসী এইসব গণবিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবি, যাদের নিজেদের জীবনে ইসলামের নামনিশানা নেই, তারা ইসলামের দোহাই দিয়েই এই ভোগবাদী দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। হুমায়ুন আহমেদ তার রচনায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত এবং ইসলামের শত্রুপক্ষের অনুদিত বই “দি লাইফ অব মোহাম্মদ” গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে লালন মুর্তিকে যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমি বলবো তিনি কি জানেন এই বিশ্বের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম এবং প্রখ্যাত মুসলিম স্কলারদের কাছে ওরিয়েন্টালিস্টদের হাতে অনুদিত বই প্রত্যাখ্যাত? কাফির মুশরিকরা ইসলামের ইতিহাস বিকৃতিতে কতোখানি পারঙ্গম তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস “দ্যা জুয়েল অফ মদিনা”। যেহেতু হুমায়ুন আহমেদ প্রসিদ্ধ মুসলিম স্কলারদের অনুদিত সীরাত গ্রন্থকে পাশ কাটিয়ে ইহুদী নাসারাদের অনুবাদকে রেফারেন্স হিসেবে নিয়েছেন, সেহেতু আমরা ধরে নেব তিনিও শত্রুপক্ষের একজন। এছাড়া যারা মুহম্মাদ (সা) এর কিছু হাদিস এবং তার জীবনের দু একটি ঘটনাকে এর সপক্ষে যুক্তিপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করাতে চাইছেন তাদের আমরা বলব মুর্খ মোল্লাদের ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতার জন্য খুব একটা দায়ী করা যায় না। কিন্তু যারা দেশে বিদেশে বড় বড় ডিগ্রী নিয়েছেন, যারা স্বগর্বে নিজেদের নামের পূর্বে ডক্টরেট উপাধি লাগিয়ে থাকেন, জন্মসূত্রে মুসলিম হবার পরও প্রিয়নবীর জীবন সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রসূত বক্তব্যের জন্য অবশ্যই তাদের দায়ী করা যায়।তারা চায়, এদেশের তরুণ সমাজও ধ্বংসম্মুখ পাশ্চাত্য বিশ্বের মত লাগামহীন নৈতিকতা বিবর্জিত জীবনে অভ্যস্থ হোক। কুকুর-বিড়ালের মত বিবাহ বহির্ভূত যৌনাচার হোক তাদের নিত্যসঙ্গী। আর তাই, কৃষ্টি, কালচার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আধুনিকতা, ইত্যাদির উছিলায় বিকৃত বাউল সংস্কৃতিকে তারা জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরাই হচ্ছে সেই শক্তি যারা নারী উন্নয়ন নীতিমালা, নারীর ক্ষমতায়ন, নারী মুক্তি ইত্যাদি আকর্ষণীয় ব্যনারে পশ্চিমের নারীদের মত এদেশের নারীদেরও পুরুষের বিকৃত বাসনা পূরণের সেবাদাসীতে পরিণত করতে চায়। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে ভোগবাদী জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে সুগম করতে চায় পশ্চিমা পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জনের পথ।
তাই যারা না বুঝে বাউল সংস্কৃতির পক্ষ নিচ্ছেন তাদের উচিত, রাও ভেবে চিন্তে পক্ষ নেয়া। কারণ, যারা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইমান আকিদার বিরুদ্ধে, যারা সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদার পুঁজিবাদীগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী, যারা শোষক আর শোষিতের চিরন্তন আদর্শিক সংগ্রামে বঞ্চিত – অসহায় মানুষের বিপক্ষের কাতারের মানুষ তারা কখনো এদেশ ও জাতির বন্ধু হতে পারে না। যারা এদেশে সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথকে সুগম করতে চায় তারা কখনো দেশপ্রেমিক হতে পারে না। যাদের কর্ণকুহরে আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, দারফুর, কঙ্গো, পাকিস্তান, কাশ্মীর সহ পৃথিবীর আপামর নির্যাতিত গোষ্ঠীর আর্তনাদ পৌছায় না তারা কখনো মানবদরদী হতে পারে না। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী কথিত নাস্তিক শ্রেণী বাউল প্রেমের নামে দেশ ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একথা স্পস্টভাবেই বলা যায়।।
“বাউল তত্ত্ব” – ডঃ আহমদ শরীফ।
“বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” – লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডঃ আনোয়ারুল করিম।
ফাহমিদা ফারহানা খানম,https://liberatethethinkers.wordpress.com/…/বাউল-নাক…/amp/০৭ নভেম্বর ২০০৮
২০০৮
বাউল লোকসম্প্রদায়ের একটি সাধন-ভজন গোষ্ঠী, যারা গ্রামে-গঞ্জে গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদের দেখা গেলেও সাধারণত কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, যশোর এবং পাবনা অঞ্চলেই এদের বেশি দেখা যায়। বাউলরা দেহভিত্তিক গুপ্ত সাধনার অনুসারী। এই সাধনায় সহজিয়া ও সুফি সাধনার সম্মিলন ঘটেছে; তবে সুফি ভাবনার প্রভাবই বেশি। বাউলরা মসজিদ বা মন্দিরে যায় না। কোনো ধর্মগ্রন্থে তাদের বিশ্বাস নেই। মূর্তিপূজা, বর্ণবৈষম্য বা জাতিভেদে তারা বিশ্বাসী নয়। তারা মানবতাবাদী। তাদের বিশ্বাস জন্মগতভাবে কেউ বাউল নয়, গুরুর নিকট দীক্ষা নিয়েই বাউল হতে হয়। বাউল সাধনা মূলত নারী-পুরুষের যুগলসাধনা। তবে জ্ঞানমার্গীয় একক যোগসাধনাও আছে।
কুষ্টিয়ার লালন শাহর মাজারে একদল বাউল
বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘বাউল’ শব্দের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পনের শতকের শাহ মোহাম্মদ সগীরের ইউসুফ-জুলেখা, মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয়, ষোলো শতকের বাহরাম খানের লায়লী-মজনু এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে ‘বাউল’ শব্দের ব্যবহার আছে। এ থেকে অনুমান করা হয় যে, অন্ততঃপক্ষে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার পূর্ব থেকেই বাংলাদেশে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। সাম্প্রতিককালের এক গবেষণায় জানা যায় যে, পারস্যে অষ্টম-নবম শতকে সুফিসাধনা প্রবর্তনকালে ‘বা’আল’ নামে সুফি সাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। তারা ছিল সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্ত সাধনপন্থী। মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে তারা গান গেয়ে বেড়াত। অন্যান্য সুফিসাধকদের মতো তারাও এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করে এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই বাংলায় বাউল সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে।
বাউলদের আচার-আচরণ অদ্ভুত এবং বিচিত্র হওয়ায় কেউ কেউ তাদের ‘পাগল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ কারণে সংস্কৃত ‘বাতুল’ (পাগল, কান্ডজ্ঞানহীন) ও ‘ব্যাকুল’ (বিহবল, উদ্ভ্রান্ত) শব্দদ্বয়কে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তিমূল বলে মনে করা হয়। কেউ কেউ পারসি ‘বা‘আল’ বা আরবি ‘আউলিয়া’ (বন্ধু, ভক্ত) শব্দ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন। বা‘আলরা তাদের প্রেমাস্পদের উদ্দেশে মরুভূমিতে ‘পাগল’ বা ‘ক্ষ্যাপা’র মতো গান গেয়ে বেড়ায়। তারা সংসারত্যাগী এবং সকল বাধা-বন্ধনহীন। বাউলরাও অনেকটা পাগল বা ক্ষ্যাপার মতো।তবে তারা যে অর্থে ‘পাগল’ বা ‘ক্ষ্যাপা’ তা কেবল সুফি ‘দিওয়ানা’ শব্দের সঙ্গেই তুলনীয়।
সুফি সাধনায় যিনি সাধকের পরমারাধ্য বা পরমার্থ, তিনিই বাউলের মনের মানুষ এবং বাউলদের মতে তাঁর অবস্থান মানবদেহে। বাউলরা তাঁকে সাঁই (স্বামী), মুর্শিদ (পথনির্দেশক), গুরু (বিধানদাতা) ইত্যাদি নামে অভিহিত করে এবং তাঁরই সান্নিধ্যলাভে পাগল হয়।
প্রকারভেদ বাউলদের মধ্যে দুটি শ্রেণি আছে গৃহত্যাগী বাউল ও গৃহী বা সংসারী বাউল। যারা গুরুর নিকট ভেক খিলাফৎ-এর মাধ্যমে দীক্ষা গ্রহণ করে তাদের ত্যাগী বা ভেকধারী বাউল বলা হয়। এই শ্রেণির বাউলরা সংসার ও সমাজত্যাগী। ভিক্ষাই তাদের একমাত্র পেশা। তারা আখড়ায় আখড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং সেখানে সাময়িকভাবে অবস্থান করে। পুরুষরা সাদা লুঙ্গি এবং সাদা আলখাল্লা এবং মহিলারা সাদা শাড়ি পরিধান করে। তাদের কাঁধে থাকে ভিক্ষার ঝুলি। তারা সন্তান ধারণ বা প্রতিপালন করতে পারে না। এ ধরনের জীবনকে বলা হয় ‘জ্যান্তে মরা’ বা জীবন্মৃত। মহিলাদেরকে বলা হয় সেবাদাসী। পুরুষ বাউল এক বা একাধিক সেবাদাসী রাখতে পারে। এই সেবাদাসীরা বাউলদের সাধনসঙ্গিনী। ১৯৭৬ সাল অবধি বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলায় ২৫২ জন ভেকধারী বাউল ছিল। ১৯৮২-৮৩ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৯০৫ জনে দাঁড়ায়। বর্তমানে সমগ্র দেশে ভেকধারী বাউলের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।
গৃহী বা সংসারী বাউলরা স্ত্রী-পুত্র-পরিজনসহ লোকালয়ে একটি স্বতন্ত্র পাড়ায় বাস করে। সমাজের অন্যদের সঙ্গে তাদের ওঠা-বসা, বিবাহ ইত্যাদি নিষিদ্ধ। ভেকধারী বাউলদের মতো তাদের কঠোর সাধনা করতে হয় না; ‘কলমা’ বা ‘বীজমন্ত্র’ পাঠ এবং নির্দিষ্ট কিছু সাধন-ভজন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই হয়। ভেকধারী বাউলরা গৃহী বাউলদের দীক্ষা দিয়ে থাকে। উভয়ের সম্পর্ক অনেকটা পীর-মুরিদের মতো। দীক্ষা নেওয়ার পর সন্তানধারণ নিষিদ্ধ, তবে গুরুর অনুমতিক্রমে কেউ কেউ সন্তান ধারণ করতে পারে। বর্তমানে কৃষিজীবী, তন্তুবায় এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে বাউল হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ব্যক্তির মধ্যে অনেকে কলকারখানার শ্রমিক ও দৈনন্দিন মজুর পর্যায়ভুক্ত। বাউলমতে দীক্ষিত হওয়ার পূর্বে বিবাহ হয়ে থাকলে নতুন করে কোনো অনুষ্ঠান করতে হয় না। ত্যাগী বাউলদের সেবাদাসী ‘কণ্ঠিবদল’ করে একজনকে ছেড়ে অন্য জনের সঙ্গে চলে যেতে পারে। বর্তমানে গৃহী বাউলদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গুরুধারা বাউলদের ‘ঘর’ বা ‘গুরুধারা’ আছে। এক একজন প্রধান বাউলগুরুর নামানুসারে এই ‘ঘর’ নির্দিষ্ট হয়। যেমন লালন শাহী, পাঞ্জু শাহী, দেলবার শাহী, পাঁচু শাহী ইত্যাদি। বাউলদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় হলো কর্তাভজা। এরা বৈষ্ণবপন্থী এবং ‘সতীমায়ের ঘর’ বলে পরিচিত। সতী মা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান গুরু। বাউলদের এসব ঘর বা গুরুধারার মধ্যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য উভয়ই আছে। বৈসাদৃশ্য তাদের সাধন-ভজন এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়। লালন শাহ্র মধ্যে সুফি সাধনপ্রক্রিয়াসহ তন্ত্রযোগ এবং সহজিয়া সাধনতত্ত্ব এবং পাঞ্জু শাহ্র মধ্যে সুফিভাবনা ও দর্শন অধিক গুরুত্ব পেয়েছে।
আখড়া বাউল-ফকিরদের সাময়িক আবাসস্থলের নাম আখড়া। এসব আখড়া পল্লিগ্রামের লোকালয় থেকে একটু দূরে অবস্থিত। সাধারণত সংসারত্যাগী এবং ভেকধারী বাউল-ফকিররাই এখানে অবস্থান করে। গুরুগৃহ এবং তার সমাধিকে কেন্দ্র করেও আখড়া গড়ে ওঠে। লালন শাহ্র সমকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকার বিক্রমপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, শ্রীহট্ট (সিলেট), ত্রিপুরা (কুমিল্লা), রংপুর, নিলফামারী, পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং কুষ্টিয়াতে বাউল-ফকিরদের আখড়া ছিল। ঝিনাইদহ অঞ্চলে হরিণাকুন্ড থানার কুলবেড়ে হরিশপুর গ্রামে পাঞ্জু শাহ্র বসতবাড়ি ও সমাধিকে কেন্দ্র করে আখড়া গড়ে উঠেছে। লালন ফকিরের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া গ্রামে। আখড়ায় ভক্তরা জড় হয়ে গান গেয়ে ধর্মকর্ম পালন করে। ছেঁউড়িয়ায় প্রতি বছর দোল পূর্ণিমায় তিনদিন ব্যাপী ‘মচ্ছব’ (মহোৎসব) ও ‘সাধুসেবা’ অনুষ্ঠিত হয়।
বাউলবিরোধী আন্দোলন বাউল সম্প্রদায় অতীতকাল থেকেই এক শ্রেণির মানুষের কাছে যেমন সমাদৃত হয়েছে, তেমনি অন্য এক শ্রেণির গোঁড়া সম্প্রদায়ের নিকট ধিকৃত ও নিন্দিতও হয়েছে। লালন নিজেও এর শিকার হয়েছেন। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্বপ্রদায়ই বাউলদের প্রতি কমবেশি বিদ্বেষভাবাপন্ন ছিল। এর কারণ বাউলরা সকল প্রকার শাস্ত্রাচার ও জাতিভেদপ্রথাকে অস্বীকার করে এবং দেহবাদী অধ্যাত্মসাধনায় নিয়োজিত থাকে। তাদের এই সাধনায় নারীকে তারা সঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করে। তাদের সাধনা প্রেমনির্ভর অধ্যাত্মবাদী হলেও তা মিথুনাত্মক যৌনাচারমূলক হওয়ায় সুশীল সমাজ কর্তৃক নিন্দিত। ১৯৪২ সালে কুষ্টিয়া অঞ্চলে মওলানা আফসারউদ্দিনের নেতৃত্বে ‘বাউল খেদা’ নামে একটি আন্দোলনও হয়।
বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। এটি লোকসঙ্গীতের অন্তর্গত। এ গানের উদ্ভব সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য জানা যায় না। অনুমান করা হয় যে, খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক কিংবা তার আগে থেকেই বাংলায় এ গানের প্রচলন ছিল। বাউল গানের প্রবক্তাদের মধ্যে লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্, সিরাজ শাহ্ এবং দুদ্দু শাহ্ প্রধান। এঁদের ও অন্যান্য বাউল সাধকের রচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ এসব গানকে ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া’ গান নামেও অভিহিত করেন।
বাউল গান সাধারণত দুপ্রকার দৈন্য ও প্রবর্ত। এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে রাগ দৈন্য ও রাগ প্রবর্ত। এই ‘রাগ’ অবশ্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ নয়, ভজন-সাধনের রাগ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউল গানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থে অভিমান এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। কাঙ্ক্ষিতজনের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় অবস্থার নামই রাগ। রাগ দৈন্যে এমন ভাবই লক্ষণীয়। বাউলরা তাদের সাধনপন্থাকে রাগের কারণ বলে অভিহিত করে (আমার হয় না রে সে মনের মত মন/ আগে জানব কি সে রাগের কারণ)।
বাউল গান সাধারণত দুটি ধারায় পরিবেশিত হয় আখড়া আশ্রিত সাধনসঙ্গীত এবং আখড়াবহির্ভূত অনুষ্ঠানভিত্তিক। আখড়া আশ্রিত গানের ঢং ও সুর শান্ত এবং মৃদু তালের। অনেকটা হাম্দ, গজল কিংবা নাত সদৃশ্য। লালন শাহ্র আখড়ায় বসে ফকিররা এ শ্রেণির গান করে থাকে। অপর ধারার চর্চা হয় আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানাদিতে, জনসমক্ষে। এ গান চড়া সুরে গীত হয়। সঙ্গে একতারা, ডুগডুগি, খমক, ঢোলক, সারিন্দা, দোতারা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়। তাল দাদরা, কাহারবা, কখনও ঝুমুর, একতালা কিংবা ঝাঁপতাল। শিল্পীরা নেচে নেচে গান করে। কখনও গ্রাম এলাকায় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে বাউল গানের মাধ্যমে তা নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। বাউলরা কখনও একক আবার কখনও দলবদ্ধভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে। এ গানের একজন মুল প্রবক্তা থাকে। তার সঙ্গে অন্যরা ধুয়া বা ‘পাছ দোয়ার’ ধরে।
বাউল গানে কেউ কেউ শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাবের কথা বলেছেন। কিন্তু এ গান মূলত ধর্মীয় লোকসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ও বিকাশ লোকসঙ্গীতের অনেক পরে। আধুনিক শিল্পীদের কণ্ঠে কখনও কখনও রাগের ব্যবহার হলেও তা সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়।
বাউল গানে সাধারণত দুধরনের সুর লক্ষ করা যায় প্রথম কলি অর্থাৎ অস্থায়ীতে এক সুর এবং অন্য সব কলিতে কিছুটা ভিন্ন সুর। সবশেষে দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ পুনরায় গীত হয়। এ গানে অস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। অস্থায়ীকে কখনও ধুয়া, মুখ বা মহড়া বলা হয়। দ্রুত লয়ের এ গানে প্রতি অন্তরার পর অস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো গানে সঞ্চারী থাকে; আবার কোনো কোনো গানে নাচেরও প্রচলন রয়েছে, যার উৎস গ্রামীণ পাঁচালি গান বলে মনে করা হয়। তবে আখড়া আশ্রিত বাউল গানে নাচের প্রচলন নেই।
কিছু কিছু বাউল গান কীর্তন আশ্রিত। বৈষ্ণবধর্মের প্রভাবে এমনটি হয়েছে। তবে বাউল গানে সুফিভাবনাই প্রবল। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাউল গানে সুরের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সহজিয়া বৈষ্ণব সুরের আধিক্য, আর বাংলাদেশে সুফি গজলের প্রভাব, যার একটি দেশজরূপ ভাবগান ও শব্দগান। বাউল গানের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এতে একটা উদাসী ভাব লক্ষ করা যায়; এর সুরে যেন মিশে থাকে না-পাওয়ার এক বেদনা।
বাউল গানের একটি বড় সম্পদ তার গায়কী বা গায়নশৈলী। উল্লেখ্য যে, বাউল গান একটি বিশেষ অঞ্চলে রচিত হলেও সঙ্গীতশিল্পীদের কারণে এর ওপর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাব পড়ে। ফলে সুর ও গায়কিতে আসে পরিবর্তন। কখনও কখনও শব্দেও পরিবর্তন ঘটে। লক্ষ করা গেছে, কুষ্টিয়া অঞ্চলের বাউল গান যখন সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী বা দিনাজপুরে গীত হয়, তখন বাণীর উচ্চারণে, সুরের প্রক্ষেপণে এবং গায়কিতে পরিবর্তন আসে। কিন্তু তারমধ্যেও মূল সুর ও বাণীর মধ্যে কমবেশি ঐক্য বজায় থাকে।
অতীতে বাউল বা লালনের গানে নির্দিষ্ট কোনো সুর ছিল না। পরবর্তীকালে লালনশিষ্য মনিরুদ্দিন ফকির এবং তাঁর শিষ্য খোদা বক্স এই গানের একটি ‘ছক‘ বাঁধার প্রচেষ্টা নেন। খোদা বক্সের শিষ্য অমূল্য শাহ্ ছিলেন একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি বাউল তথা লালনগীতির একটি সঙ্গীতকাঠামো নির্মাণ করেন। তাঁর শিষ্য বেহাল শাহ্, শুকচাঁদ, দাসী ফকিরানী, চাঁদার গহর, নিমাই শাহ্, মহেন্দ্র, কানাই ক্ষ্যাপা, মতি ফকিরানী প্রমুখ এ গানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। পরবর্তী সময়ে মহিম শাহ্, খোদাবক্স শাহ্, ঝড়ু শাহ্, করিম, বেল্লা, ফকিরচাঁদ, জোমেলা, খোরশেদ ফকির, লাইলি, ইয়াছিন শাহ্ প্রমুখ এর আরও উৎকর্ষ সাধন করেন। বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী মকছেদ আলী খান বাউল গান ও লালনগীতির আধুনিকীকরণ করেন এবং তাঁর শিষ্য ফরিদা পারভীন বর্তমানে লালনগীতির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শিল্পী। তিনি বাউল গান ও লালন গীতিতে নতুন মাত্রা ও সুর সংযোজন করেন।
বাউল গানের একাধিক ঘরানা আছে। অবশ্য এ ঘরানা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রীতি অনুযায়ী নয়। এ ঘরানা সাধন-ভজন সংক্রান্ত। বাউল গানের ঘরানার সংখ্যা পাঁচ লালন শাহী, পাঞ্জু শাহী, দেলবার শাহী, উজল শাহী এবং পাঁচু শাহী। লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্ প্রমুখ পঞ্চ বাউলকে কেন্দ্র করে এই পাঁচটি ঘরানা গড়ে উঠেছে।
বাউল গানে নানা তত্ত্বকথা আছে যেমন দেহতত্ত্ব, গুরু বা মুর্শিদতত্ত্ব অথবা নবীতত্ত্ব, লীলা অথবা মনের মানুষ তত্ত্ব ইত্যাদি। প্রতি গানে দুটি পদ থাকে দেহতত্ত্ব এবং ভজনতত্ত্ব। বাউলরা নিজেদের ভাষায় এ দুটিকে উপর পদ এবং নিচের পদ বলে উল্লেখ করে। বাউল গানের সুরে কখনও কখনও ভাটিয়ালি সুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এর কারণ মাঝিমাল্লারাও অনেক সময় নৌকা বাইতে বাইতে ধীর লয়ে এ গান গেয়ে থাকে। বাউল গানের বিশেষত্ব এই যে, এ গান কেবল বাউল সাধকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বাউলের সাধন-ভজন জানে না এমন সাধারণ মানুষও অধ্যাত্মরসের কারণে এ গান নিজের করে নিয়েছে। [আনোয়ারুল করীম]
লালন তত্ত্ব এবং বাউল সমাজের ধর্ম বিশ্বাস
১২৪৮ সালে মালাধর বসু কর্তৃক লিখিত 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' গ্রন্থে প্রথম বাউল শব্দটি পাওয়া যায় বলে ধারণা করা হয়। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদদের মতে, "সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধব বিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন [1]।" প্রফেসর উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য তার ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান' গ্রন্থে লিখেছেন, বাউল ও বাউলা মতবাদের উৎপত্তিকাল আনুমানিক ১৬৫০ খৃস্টাব্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে,"বৌদ্ধদের মহাযান পন্থী থেকে বাউলদের উদ্ভব [2]।" "তবে জগমোহন গোসাঈ কে (জগন্মোহিনী বাউল) সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলা হয়। তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয় [3]।" বাউল শব্দের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। কেউ মনে করেন সংস্কৃত ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। অনেকে বলেন ‘বাতুল’ শব্দ থেকেই বাউল এসেছে। বাতুল শব্দের অর্থ উন্মাদ, পাগল ইত্যাদি। অনেকে বলেন বৌদ্ধ সহজিয়া মতে ব্যবহৃত ‘ব্রজকুল’ থেকে ‘বাজুল’ এবং তা থেকেই ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তি। "আরবি 'আউল' বা হিন্দি 'বাউর' থেকেও শব্দটি আসতে পারে [4]।" সংসদ বাংলা অভিধানে বাউল শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে, "ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও সংস্কার হইতে মুক্তসাধক সম্প্রদায় বিশেষ, খেপা লোক, পাগল [5]।" অক্ষয় কুমার দত্ত তাঁর 'ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়' বইতে বাংলার বিভিন্ন উপধর্মের সন্ধান দেন তা হলো - বাউল, ন্যাড়া, দরবেশ, সাঁই, আউল, সাধ্বিনী পন্থী, সহজিয়া, রামসাধনীয়া, জগবন্ধু-ভজনীয়া, দাদুপন্থী, রুইদাসী, সেনপন্থী, রামসনেহী, মীরাবাঈ,কর্তাভজা, রামবল্লভী, সাহেবধনী, বলরামী, হজরতী, গোবরাই,পাগলনাথী, তিলকদাসী, দর্পণারায়নী, বড়ী, অতি বড়ী, রাধাবল্লভী, সখি ভাবুকী। সেই সময়ে এই রকম অনেকে উপধর্ম চালু ছিল॥ বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ড. আনোয়ারুল করিম লিখেছেন, "প্রাচীন প্যালেস্টাইনের রাসসামরায় (বা'আল) নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। এবং এই ধর্মের লোকদের মধ্যে মৈথুন যৌনচার গুরত্বপুর্ণ বিষয় ছিল॥ এই বা'আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপক ভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোক ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল, যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগ নির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা'আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে [6]।" বাউলদের সাধনার দুটি মুখ্য রীতি - জ্ঞানমার্গীয় যোগসাধনা আর মিথুনাত্মক যোগসাধনা। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারী সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী সম্ভোহ বাউল ধর্মে স্বীকৃত। বাউলরা দেহ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নর-নারীর মিলন ও সঙ্গমকে ধর্মীয় ভাবে বৈধ করে। তাদের কাছে গুরুই সব। প্রয়োজনে গুরুর উপস্থিতিতে মিলন ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। তাইতো বাউলরা গায়, "আমার দেহ-জমি আবাদ হইল না গুরুর বীজ বুনতে পারলাম না। ও বীজ বুনতে পারলে হত কামরাঙ্গা ফলপুষ্ট হত দানা..." অদ্ভুত বাউলদের ধর্ম বিশ্বাস।
"বাউলদের মধ্যে হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা হিন্দু ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,"কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
...মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে [7]।"
তবে অনেক বাউল গান আছে যেখানে সাধন তত্ত্ব ও সাধন রীতির কথা সরাসরি বলা হয়েছে। আবার কতক গানে সাধনার রীতি পদ্ধতি রহস্যময়॥ তবে বাউলরা বিশ্বাস করে যে, 'আপন সাধন কথা, না কহিবে যথা তথা'। "বাউলদের যে গোপন সাধনাটি নিয়ে বারবার নানা জায়গায় আলোচনা দেখা যায় তা হল ‘চারিচন্দ্র ভেদ’ প্রক্রিয়া। অনেক বাউল গানে এর উল্লেখ আছে॥ বিভিন্ন গানে উল্লিখিত চারটি চন্দ্র হল – শুক্র, রজঃ, বিষ্ঠা ও মূত্র। দেহ নিঃসৃত এই চার পদাত্থকে প্রতীকের ভাষায় ‘চারি চন্দ্র’ বলে [8]।"
বাউলরা চারিচন্দ্র ভেদ করতো অর্থাৎ "মল-মূত্র, রজঃবীর্য পান করতো [9]।"
বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। "এছাড়া, তারা রোগ মুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র পান করে॥ সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে [10]।" নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে।
বাউল সম্প্রদায়ই মনে হয় সর্বাপেক্ষা জঘন্য ও যৌনপ্রবণ। "মদ্যপান, নারী পুরুষের অবাধ যৌনক্রিয়া এদের সকল সম্প্রদায়ের সাধন পদ্ধতির মধ্যে অনিবার্য রূপে শামিল। বাউলগণ যৌন সঙ্গমকে যৌন পূজা মনে করে [11]। তবে বাউলদের কথা উঠলে বাউল সম্রাট লালনের কথা উঠবেই॥ বাংলা ১৩৪৮ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত মাসিক মোহম্মদী পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লালনের জন্ম মুসলিম পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয়। গবেষক লেখক শক্তিনাথ ঝা শান্তি নিকেতন থেকে লালনের নির্ভরযোগ্য যে গানের খাতাটি উদ্ধার করেন সেখানে লেখা ছিল, "শ্রী লালনশাহ দরবেসের তালেব শ্রী ভোলাই শা ফকির এই বহির মালিক [12]।" আবার ভিন্ন তথ্যসূত্রে তার জন্ম হিন্দু পরিবারে বলে উল্লেখ করা হয় [13]। ১৩৩৩ সালে রংপুরের মাওলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা বইটির দ্বিতীয় খণ্ড বের হয়। তিনি সেখানে মত দেন ,"লালন সাহার ধর্মের কোনো ঠিক ছিল না। তিনি কেবল মুসলমানের হস্তে অন্নব্যঞ্জনাদই ভোজন করিয়াছিলেন বলিয়াই হিন্দু সমাজ তাঁহাকে সমাজচ্যূত করিয়াছিলেন। তিনি মোছলমানের অন্নভোজন ব্যতীত এছলাম গ্রহণ করেন নাই বা মোছলমান বলিয়া নিজেকে স্বীকার করেন নাই বা এছলামের আকিদা, বিশ্বাস ও নামাজ রোজা প্রভৃতির কোনো আচার-ব্যবহার কিছুই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল না, যা দ্বারা তাহাকে মোছলমান বলা যাইতে পারে। তিনি যত বড় মুনি ঋষি উদাসীন হউন না কেন, মোছলমানের তিনি কেহই নহেন [14]।"
অবশ্য এইসব নিয়ে গবেষনার অন্ত নাই॥ জীবদ্দশায় লালন ফকিরের সাথে সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির আলাপ-পরিচয় ছিল॥ 'সমাজ সংস্কারক, ধর্ম সংস্কারক ছাড়াও সেই সময়কার জমিদার দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও তার সম্পর্ক ছিল [15]॥' রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে লালনের নাম জড়িয়ে অনেক কল্প-কাহিনী রচনা করেছেন বিভিন্ন গবেষক। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে লালন অনেক কিছু গ্রহণ করেছেন। "বরং লালনের মৃত্যুর পর তার সমাধি তৈরি করার জন্য কোনো জমিদারই সাহায্য করেনি। পরবর্তীতে আখড়ার অনেক খাজনা বাকি পরে গেলে জমিদারগণ ১৯৪৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর খাজনার জন্য লালনের আখড়াটি নিলামে তোলেন। লালনের শিষ্যরা ১ শত ৭ টাকা ৪ আনা দিয়ে নিলামে সম্পত্তি কিনে আখড়ার অস্তিত্ব রক্ষা করেন [16]।" তবে বাউল মানেই মনে করা হয় গাজাখোর॥ যা প্রমাণের জন্য বর্তমানে দেশের যেকোনো বাউলের আখড়ায় যাওয়াই যথেষ্ট। তবে ইতিহাস বলে, "লালন শাহের শিষ্য উজল শাহের গাঁজা সেবন করার বদ অভ্যাস থাকার কারণে লালন শাহ তাকে আখড়াবাড়ি হতে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন [17]। লালন শিষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী শিষ্য দুদ্দু শাহ গাঁজা সেবনকে অত্যন্ত গর্হিত কাজ মনে করতেন। তাইতো তিনি বলেছেন,যেও না শুকনো বৈরাগীর দলে, গাঁজা খেয়ে মালা টিপে ফেলাবে গোলে। তবে বাউল গন বিভিন্ন সময়ে হিন্দু এবং মুসলমানদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশ শতকের গোড়ায় যে ‘বাউল ধ্বংস আন্দোলন’ হয় তাতে অন্যতম অভিযোগ ছিল বাউলরা ধর্মের নামে অবাধ যৌনলীলা ও নানা বিধ অশ্লীল আচার আচরন করে। যৌন ব্যাপারে বাউলদের কোন পাপবোধ ছিল না। এই যৌন স্বাধীনতার কারণেই অনেক তরুণ ও যুবক সেই সময় বাউল হতে আকৃষ্ট হয়। ১৯৮৬ সালে কুষ্টিয়ার লালন একাডেমির সভাপতি থাকাকালীন একজন প্রফেসর লালন সমাধিসৌধে বিভিন্ন সময় মিলাদ, কোরান পাঠ ইত্যাদি ইসলামিক কার্যক্রম চালান। এর প্রতিবাদে লালন শাহের অনুসারী বাউলগণ ক্ষুব্ধ হয়ে ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসকের বরাবরে প্রফেসর সাহেবের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদলিপি দাখিল করেন। যার ভাষ্য ছিল এমন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না মুসলমান না হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। কিন্তু উক্ত অধ্যাপক আমাদের এই তীর্থ ভূমিতে ঢুকে কোরআন তেলোয়াত করেন,ইসলামের কথা বলেন - এসবই আমাদের তীর্থ ভূমিতে আপত্তিকর [18]।" আমরা আলাদা একটি জাতি, "আমাদের কালেমাও আলাদা – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ [19]।" হিন্দুবাদ ও সুফিবাদের মিশ্রণ বাউল দর্শনের মূল কথা হলো মানবতা৷
বাউলদের কাছে সংসার এবং সমাজ উভয়টাই পরিত্যাজ্য। জীবনের জৈবিক প্রয়োজনে তারা সাধন সঙ্গী সন্ধান করে; আর মানুষের দেয়া ভিক্ষার ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকা। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রীর মতে— "তাহারা মুক্ত পুরুষ, তাই সমাজের কোনো বাঁধন মানেন নাই। তবে সমাজ তাহাদের ছাড়িয়ে কেন? তখন তাঁহারা বলিয়াছেন—আমরা পাগল, আমাদের ছাড়িয়া দাও, পাগলের তো কোনো দায়িত্ব নাই।" আসলেই তারা পাগলামু উন্মাদনায় মেতে থাকে॥ বাউলদের আছে হাজার হাজার গান।
বাউলদের গান বুঝতে হলে আগে তাদের পরিভাষা বুঝতে হবে, অদ্ভুত তাদের শব্দ চয়ন। "যেমন- অমাবস্যা মানে নারীর ঋতুকাল, বাঁকানদী মানে স্ত্রী যোনী, কুমীর মানে কাম, লতা মানে সন্তান, চন্দ্রসাধন মানে মল মূত্র পান [20]।"
তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়,বাউলদের বিকৃত জীবন আর ‘ভাবের গান’ আমাদের সমাজ সংসারে কোন কাজে লাগবে???
.
তথ্যসুত্র
.
[1] লালন শাহঃ বিবেচনা-পূর্নবিবেচনা মুনশী আব্দুল মাননান বাংলা সাহিত্য ও লালন শাহ, পৃষ্ঠা ১১ , ২০০৫।
.
[2] হারামনি; অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন, সপ্তম খন্ড, পৃ-৮।
.
[3] শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, প্রথম ভাগ, অষ্টম অধ্যায়, অচ্যুতচরণ ; ২০০৪।
.
[4] বাংলাদেশের লোকসাহিত্য ও লোক ঐতিহ্য, ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী, পৃষ্ঠা ৩৪,২০০৫।
.
[5] সংসদ বাংলা অভিধান, পৃ ৪১৫,নভেম্বর ২০০৫,কলকাতা।
.
[6] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, ড. আনোয়ারুল করিম, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫॥
.
[7] বাউলতত্ত্ব, ড. আহমদ শরীফ, পৃঃ ৫৩-৫৪।
.
[8] বস্তুবাদী বাউল, শক্তিনাথ ঝা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ॥
.
[9] দেশ পত্রিকা , বাউল বিষয়ে প্রচ্ছদ রচনা, ৪ঠা মাঘ ১৩৯৮॥
.
[10] বাংলাদেশের বাউল সমাজ, আনোয়ারুল করিম; পৃ ১৪-১৮ ;৩৫০- ৩৮২॥
.
[11] বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আববাস আলী খান,পৃ ৬৬।
.
[12] ফকির লালন সাঁই: দেশ কাল শিল্প। সংবাদ, শক্তিনাথ ঝা, কলকাতা ১৯৯৫।
.
[13] Bangladesh By Mikey Leung, Belinda Meggitt.
.
[14] বাঙলায় বাউল বিরোধী আন্দোলন : প্রেক্ষিত লালন শাহ, আবুল আহসান চৌধুরী॥
.
[15] লালন শাহের মরমী দর্শন; মো. সোলায়মান আলী সরকার,পৃ ৬, ১৯৯৩।
.
[16] হারামনি, শক্তিনাথ ঝা, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৬৪-৬৫।
.
[17] দুদ্দু সা’র পদাবলি; শক্তিনাথ ঝা, ৬৬ -১০৩ পদ।
.
[18] লালন শাহ জীবন ও গান; এস এম লুৎফর রহমান; পৃ-১০৭-১০৮।
.
[19] ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, সুধীর চক্রবর্তী, ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫॥
.
[20] গভীর নির্জন পথে, সুধীর চক্রবর্তী, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৪।
বাউলরা মূর্তিপূজায় বিশ্বাস করে না। লালনশাহের কোনো মূর্তি স্থাপনের কোনো দাবিও তারা তোলেনি। কিন্ত– এখন বাউল মতবাদ হয়ে উঠতে যাচ্ছে একটা রাজনৈতিক ইস্যু। বিষয়টি আগামী নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে। একজন বুদ্ধিজীবী বলছেন, বাউলরা বাংলা সংস্কৃতির প্রতীক। লালনের মূর্তি সরানোর মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলেছে। কিন্ত– বাউলদের ইতিহাস অনুসরণ করলে আমরা তাদের দাবির কোনো ভিত্তি খুঁজে পাই না। অষ্টম-নবম শতকে পারস্যে সুফিসাধনার প্রবর্তনকালে, ‘বা’আল’ নামে সুফিসাধনার একটি শাখা গড়ে ওঠে। এরা ছিল সঙ্গীতাশ্রয়ী এবং মৈথুনভিত্তিক গুপ্তসাধনপন্থী, হুবাল দেবীর অঅনুসারী,
বিকৃত যৌনাচারই তাদের ধর্মাচার।।
পারস্য থেকে এরা অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলায়ও ঘটে এদের আগমন। বাংলার বাউলরা এদের ঐতিহ্যবাহী। ঘটনা যদি এই হয় যে, এরা এসেছিল পারস্য থেকে, তবে বাউল-দর্শনকে বাংলাদেশের মধ্যে উদ্ভূত একটি আদি অকৃত্রিম চিন্তা বলে গণ্য করা যায় না। বাউলদের বলা যায় না বাংলার সংস্কৃতির প্রতীক। কিন্ত– বিস্বয়করভাবে এটা করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাউল দর্শনকে আমাদের আপন দর্শন বলে চিহিপ্তত করা। ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া আর কিছু বলা যেতে পারে না। বাউলদের দর্শন আমাদের আজকের জীবনে কি কোনো কাজে আসতে পারে? বাউলরা তাদের মুক্তি খোঁজেন এক নিখিল যৌন চেতনার মধ্যে। আমাদের তরুণ-তরুণীরা যদি বাউল আচার গ্রহণ করতে চায়, তবে গোটা জাতিই কি পঙ্গু হয়ে পড়বে না? বাউল-দর্শনের উদ্ভব হয়েছিল ইরানে। এখন ইরান আর কোনো রকম সুফিবাদেই আস্থাবান নয়। সে চাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে একটা শক্তিমান জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রƒকুটিকে অ¯¦ীকার করে সে আজ বানাতে যাচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র। আর আমরা এখন মানুষকে যেন উত্সাহ দিতে চাচ্ছি খাঁচার মধ্যে অচিন পাখিকে খুঁজতে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে নাকি নতুন করে ওহাবি ভাবধারার আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। মানুষ নাকি মারফতি ইসলাম ছেড়ে শরিয়তি ইসলাম গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কিন্ত– এরা জানে না যে, মোস্তফা কামাল পাশা তুরস্কে ক্ষমতায় এসে প্রথম যে কাজে হাত দেন, তা হলো মারফতি দরবেশদের আখড়াগুলো ভেঙে দেয়া। কামাল আর যাই হন, ওহাবি ছিলেন না। শরিয়তি ইসলাম অতীতে এ দেশে ছিল না, এমন নয়। মুসলমানদের উত্তরাধিকার আইন শরিয়াভিত্তিক। বিবাহ তথা পরিবারবšধন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে শরিয়া আইন দিয়ে। মুসলমানরা গ্রামে-গঞ্জে গড়েছেন মসজিদ। সেখানে পড়েছেন নিয়মিত নামাজ। তারা বাউলদের মতো কোনো মৈথুন প্রক্রিয়ার মধ্যে আপনার মুক্তি খুঁজতে চাননি। মুসলিম সমাজে আউল-বাউলরা সেভাবে স্থান পেতে পারেনি। এটাই হলো সাধারণ ইতিহাস। জানি না আজ কেন শরিয়তি ইসলাম আর মারফতি ইসলামের মধ্যে তফাতটা এত বড় করে দেখা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মুসলমান এক সময় ছিলেন মারফতি, এখন হতে যাচ্ছেন শরিয়তী? মারফতিরাও বলেন, প্রথমে হলো শরিয়ত। তার পরে হলো তরিকত, তার পরে আসে মারেফত আর সব শেষে হকিকত। অর্থাৎ শরিয়তকে মারেফতপন্থীরাও যে একেবারেই অ¯¦ীকার করতে পেরেছেন, তা নয়। তাদেরও মানতে হয়েছে শরিয়তের বিধান। আগামী নির্বাচনে শরিয়ত ও মারেফত একটা ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। আর সেটা করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে মহলবিশেষের পক্ষ থেকে; যা এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ গণতন্ত্র চাচ্ছে। চাচ্ছে না কোনো ‘বাউল গণতন্ত্র’। চাচ্ছে না পরিবার ভেঙে গড়তে অবাধ যৌনজীবন। তারা হতে চাচ্ছে না বাউলপন্থী। কোনো কোনো স্থানে কিছু তরুণ-তরুণী মিছিল ও মানবন্ধন করছেন লালনভাস্কর্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য। এরা মনে করছেন তথাকথিত মৌলবাদী ইসলাম লালনমূর্তি সরিয়ে ফেলেছে। আর তারা চাচ্ছে চারুকলার অংশ হিসেবে ভাস্কযচর্চাই বাতিল করে দিতে। কিন্ত– এ রকম দাবি এখনো ওঠেনি এ দেশের মানুষের মধ্য থেকে। চারুকলার অংশ হিসেবে ভাস্কর্যচর্চাকে এ দেশের মানুষ বšধ করতে চাচ্ছে না। তারা যা চাচ্ছে তা হলো, বাউলবাদের প্রতিষ্ঠা বšধ করতে। লালনের মূর্তি স্থাপন করা হচ্ছিল ঢাকা বিমানবন্দরের শোভা বৃদ্ধির জন্য নয়। এই মূর্তি স্থাপনের লক্ষ্য হলো, দেশে বিশেষ এক ধরনের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়া, যেটা এ দেশে বৃহত্তর জনসমাজে বাঞ্ছিত নয়। অনেকে দাবি করছেন, তারা গণতন্ত্রী। লালনের মূর্তি অপসারণ গণতন্ত্রের পরিপন্থী। কিন্ত– মুক্তচিন্তা ছাড়া গণতন্ত্র বলিষ্ঠ হতে পারে না। লালনপন্থীরা ভয়ঙ্করভাবে গুরুবাদী। এদের সংগঠনকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা চলে না। বলা হয় বাউলরা উদারমনা। কিন্ত– আসলে তা নয়। বাউলদের মধ্যে আছে হাজারো ভেদ। এক গুরুর শিষ্য আর এক গুরুর শিষ্যকে অতি তুচ্ছ ভাবে। করে না কোনোভাবেই শ্রদ্ধা। আমরা আমাদের বর্তমান গণতান্ত্রিক চেতনা লাভ করেছি ব্রিটেনের কাছ থেকে। ব্রিটেনের একজন নামকরা চিত্রশিল্পী ছিলেন উইলিয়াম হোগার্থ (১৬৯৭-১৭৬৪)। তিনি নানা বিষয় নিয়ে ছবি এঁকেছেন। তার ছবি থেকে রাজনীতিও বাদ পড়েনি। একটি ছবিতে তিনি এঁকেছেন, একটি লোক বক্তৃতা দিচ্ছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য। আরেকটি ছবিতে তিনি এঁকেছেন ওই একই লোক গুণ্ডা ভাড়া করছেন, যে গুণ্ডারা লোককে ভয় দেখাবে। তাদের বাধ্য করবে তাকে ভোট দিতে। হোগার্থ আর একটি ছবিতে দেখিয়েছেন, লোকটা ভোটারদের ঘুষ দিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে তাকে ভোট দেয়ার প্রতিশ্র“তি নিয়ে। ছবিগুলো হোগার্থের সময় বিলাতের লোকের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। অনেকে বলেন, হোগার্থের ছবি বিলাতের নির্বাচনের প্রথার অনেক উন্নতি ঘটায়। বিলাতের নির্বাচন হয়ে ওঠে গুণ্ডাদের এবং টাকার প্রভাবমুক্ত। আমাদের দেশে হোগার্থের মতো কোনো সমাজসচেতন শিল্পী এখনো জন্মেছেন বলে মনে হয় না। আমাদের শিল্পীরা মেতে উঠেছেন লালন ফকির নিয়ে। কিন্ত– দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের শিল্পীদের বলা যাচ্ছে না সমাজ সচেতন।
রাজশাহী এখনো ছোট শহর। এখানে অনেকেই অনেকের চেনা। লালনমূর্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে যেসব অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবী হইচই করছেন, তাদের অনেকেই এক সময় নিজেদের দাবি করতেন বামপন্থী বলে। অনেকে বলতেন, তারা হলেন দ্বন্দ্বমূলক বস্ত–বাদী। কিন্ত– এখন তারা সমর্থন দিচ্ছেন রহস্যময় বাউল-দর্শনকেই। এদের এই মানসিক পরিবর্তন কী করে ঘটতে পারল সেটা সু¯পষ্ট নয়। এরা এখন কেবলই ছড়াতে ব্যস্ত জঙ্গি ইসলামের ভীতি। জঙ্গি ইসলামের ভীতি ছড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। হতে পারে এরা এখন মার্কিন লবির ভক্ত হয়ে উঠেছেন। এরা বলছেন, গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা। কিন্ত– এদের এই বিরাট পরিবর্তন কি এসেছে কেবল গণতন্ত্রের আকুতি থেকেই? এদের বোঝা উচিত মুক্তবাজার গণতন্ত্র টিকতে পারছে না। আর আসছে সম্ভবত তারও পতন।
https://www.amarblog.com/sakib2008/posts/20592
সাঁই শব্দটি স্বামী শব্দের অপভ্রংশ। যেমন হিন্দুরা তাদের একটি উপাধি গোস্বামীকে গোসাঁই বলে ডাকে। স্বামী শব্দের অর্থ গুরু, প্রভু ইত্যাদি। অশিক্ষিত এবং ইতর জীবনাচরণে অভ্যস্ত বাউলরা লালনকে সাঁই বলে ডাকে। কিন্তু লালনকে ভদ্রসমাজে সুফী দরবেশ হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টায় রয়েছে একটি গোষ্ঠী। তারা লালনের নামের শেষে ‘শাহ’ লাগিয়ে দিয়েছে, যে শব্দ মুবারক মুসলিমরা তাদের পীর সাহেব উনাকে সম্বোধন করতে ব্যবহার করে।
বাউল মতবাদ সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদ থেকে এসেছে। বাউলরা এরকম জীবনযাপন করেও। লালন যে কাজটা করেছিল, তা হলো ছূফী কবিতায় ইশারা করার যে বিষয়টি, সেটি সে তার গান লেখায় ব্যবহার করে। সে ইসলামী শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করে দেহতত্ত্বের বিষয়গুলো ইশারা করেছে। ইসলামী ভাবধারায় সে সহজিয়া বৈষ্ণব মতকে উপস্থাপন করেছে। ফলে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ কথাটি দ্বারা মুসলমানরা বিভ্রান্ত হয়, কারণ গানের বিষয়টি আদৌ আখিরাত সম্পর্কিত নয়। এই বিভ্রান্ত হওয়াটা থেকে মুসলমানদের দূরে থাকতে হবে।
তার গানে যে ‘আল্লাহ’ ‘রাসূল’ শব্দের উল্লেখ রয়েছে, তা সে খুব কদর্য্য অর্থে ব্যবহার করেছে। কারণ সহজিয়া বা দেহতত্ত্বে দেহই সবকিছু। এটাকে খুশি রাখতে পরকীয়া তো কিছুই নয়। এবং এই দেহের সৃষ্টি হলো পুরুষের স্খলিত তরলের উসীলায়। ওটাকেই তারা বলে সৃষ্টিকর্তা। তারা বলে থাকে, বীজমে আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ), বাউল গবেষক ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য বাউলধর্ম সম্পর্কে বলেছে, “বাউলগণ পুরুষদের বীজরূপী সত্ত্বাকে ঈশ্বর বলে। বাউলদের মতে এই বীজসত্ত্বা বা ঈশ্বররস ভোক্তা, লীলাময় ও কাম ক্রীড়াশীল।”
পশুরা তাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী চালিত হয়ে থাকে। আর দেহতত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপনকারী বাউলরা, কতগুলো সমাজচ্যুত পশু ব্যতীত কিছু নয়। মুসলমানদে কে এদের থেকে সাবধান থাকা উচিত।
বাউল সম্প্রদায়ের গুরু হল লালন। লালনের কিছু কিছু গানে আল্লাহরাসূল প্রভৃতি শব্দ থাকায় অনেকে লালন ও তার অনুসারী বাউলদের অনৈসলামিক মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মুসলমানরা যখন লালনের অনুসারী বাউলদের অসামাজিক কাজের বিরোধিতা করে তখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের গুটিকয়েক সমাজচ্যুত বাউলদের জন্য সইতে হয় সাম্প্রদায়িকতার অপবাদ। যারা বাউলদের পক্ষাবলম্বন করছে তারা কি জানে বাউল তত্ত্বের উদ্দেশ্য কি? বাউল নামটি এসেছে বা’ল বা হোবল দেবতার নাম হতে। এবং বাউল তত্ত্বের বাইরে হল ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ, ভেতরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের কাহিনীনির্ভর বৈষ্ণব বা সহজিয়া মতবাদ। গুরুরতি সাধন করা বা গুরুর মলমূত্র বীর্য রজঃপান বাউলমতে দীক্ষা নেয়ার প্রথম ধাপ(নাউযুবিল্লাহ)। লালনের অধিকাংশ গান রাধাকৃষ্ণ দেহসাধনা নিয়ে লেখা, দু একটি গানে ইসলামের কথা যা আছে তাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইসলামের জন্য অবমাননাকর। হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে আমাদের দেশে একটি গুজব রয়েছে আর তা হল তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন ডাকাত, পরে আউলিয়া হন। কিন্তু কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। তিনি ছিলেন আওলাদে রাসূল মাদারজাদ ওলীআল্লাহ, উনার যামানার মুজাদ্দিদ। আর এ গুজবের হোতা হল লালন তথা বাউল সম্প্রদায়। লালনের গানে আছে
নিজাম নামের বাটপার সেতো পাপেতে ডুবিয়া রইত
তার মনে সুমতি দিলে,কুমতি তার গেল চলে
আউলিয়া নাম খাতায় লিখিলে, জানা গেল এই রহমই
বাউলতত্ত্ব বইতে রয়েছে ““ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্র মত। যার নাম নাথপন্থা। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপন্থা এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে”
বস্তুতঃ বাউলরা হল মুসলমানের ছদ্মবেশে হিন্দু বৈষ্ণব, যারা মুসলমানের ঈমান কেড়ে নিতে চায়। তারা আল্লাহরাসূলের কথা বলে পুরোন প্রথা তথা রাধাকৃষ্ণের দেহতত্ত্বের সাধনা করে। যবনলালন মুসলমানদের প্রতি কীরূপ মনোভাব পোষণ করতো তা কিন্তু তার গানেই রয়েছে। লালন তার গানে সাধারণত কখনোই মুসলমানদের মুসলমান বলে সম্বোধন করতোনা, করতো যবন বলে(নাউযুবিল্লাহ)। সে হিন্দুদের হিন্দু বলত, বৌদ্ধদের বৌদ্ধ বলত, খ্রিস্টানদের বলত খ্রিস্টান। কিন্তু এক মুসলমানকে সর্বদা বলত যবন। এ অবমাননাকর উপাধি সর্বদাই সে মুসলমানদের জন্যই ব্যবহার করতো, অন্য কারো জন্য নয়। যেমন লালনসমগ্র(আবদেল মাননান,প্রকাশক নালন্দা) এর স্থুলদেশ অধ্যায়ের ৩৮ নম্বর গানে রয়েছে
জাত বলিতে কি হয় বিধান
হিন্দু যবন বৌদ্ধ খৃস্টান
এরকম আরো বহু গান রয়েছে যার উদ্ধৃতি দিলে লেখার কলেবর বেড়ে চলবে। সে তার সাঁই বা যাকে মুর্শিদ মানতো তাকেও যবন বলতো। কারণ তার মুর্শিদের নাম ছিল সিরাজ সাঁই, সে ছিল মুসলমান ঘরের সন্তান। তার গানে (স্থূলদেশ ৫২ নং)রয়েছে
ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছে সাঁই
হিন্দু কি যবন বলে
জাতের বিচার নাই
অর্থাৎ লালনকে যতই অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা গন্ডমূর্খরা করুক না কেন, সে কিন্তু এমন একটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে যেখানে মুসলমান তো বটেই এমনকি মুসলমান সাঁইকেও হতে হয় অপমানিত। লালনের যে গানটিকে(স্থুলদেশ ৩৫ নং) পুঁজি করে লালনভক্তরা তাকে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণের চেষ্টা চালায় তা হলো
এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে
যে দিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃস্টান
জাতিগোত্র নাহি রবে
এ গানটিতেই কেবল মুসলমান শব্দের দেখা মেলে, কিন্তু কখন? যখন মুসলমান জাতির বিনাশ কামনা করা হয়! নাউযুবিল্লাহ। লালনের কোন গানে মুসলমানকে মুসলমান বলার সম্মানটুকু দেয়া হয় নাই। যাও একবার বলা হয়েছে, তাও ধ্বংস কামনা করে। চৈতন্যদেবের মত বৈষ্ণব(হিন্দুধর্মের একটি ফেরকা) ধর্মপ্রচারকের যে স্বভাব তার পুরোটাই লালনের মধ্যে ছিল। চৈতন্যদেব বৈষ্ণবমত গ্রহণকারী মুসলমান ঘরের মুরতাদকেও যবন বলে হিন্দুদের তুলনায় নিকৃষ্ট গণ্য করতে ছাড়তো না, তাদের মত গ্রহণ করলেও তাদের অন্তর্ভূক্ত গণ্য করত না। অর্থাৎ তারা যতই উদারতার ভেক ধরুক না কেন তাদের অন্তর গরলে পরিপূর্ণ। উল্লেখ্য লালন নিজেও ছিল চৈতন্যদেবের অনুসারী। প্রত্যেক বৈষ্ণবধর্মপ্রচারকের স্তুতি লালনের গানে আছে। নিমাই, নিতাই, গৌর বা চৈতন্যদেব প্রত্যেকের ছানাছিফত সে করেছে। এবং এত বেশি করেছে যে লালনসমগ্র গ্রন্থে নিমাইলীলা, নিতাইলীলা, গৌরলীলা এ তিন ধর্মপ্রচারকের নামে তিনটি আলাদা আলাদা অধ্যায় রয়েছে। কিন্তু বাউলরা পাগড়ি পরে, দাড়ি রাখে, লুঙ্গি পরে। যা বৈষ্ণবরা করে না। পাগড়ি দাড়ি লুঙ্গির আড়ালে তারা বৈষ্ণবসাধনা করে।
অর্থাৎ লালন কখনোই অসাম্প্রদায়িক নয়। সে হল দুরাচার যবন অনুপ্রবেশকারী, যে ইসলামের ভেক ধরে মুসলমানদের সর্বনাশ করতে উদগ্রীব থাকতো। শুধু তাই নয়, যারা বাউল সম্প্রদায়ের ইতিহাস জানেন তারা অনেকেই মানবেন, এদেশের মুসলমানদের পথভ্রষ্টকারী যেসব মতবাদ ছিল তার মধ্যে বাউল মতবাদ অন্যতম। উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে প্রায় সকল মুসলিম লেখকগণ মুসলমান সমাজে বাউল মতের বিধ্বংসী প্রভাব দেখে এ মতবাদের বিরুদ্ধে লিখে গিয়েছেন।
কোলকাতার যবনরা আমাদের দেশে লালন মতবাদের প্রচারপ্রসারে উদগ্রীব। কিছুদিন আগেই কোলকাতার কিছু যবন এদেশে ‘মনের মানুষ’ নামে একটি সিনেমা করে গিয়েছে। এর কারণ লালন মতবাদ হল ইসলামের ছদ্মবেশে রাধাকৃষ্ণ তথা হিন্দুদের মতবাদ। এদেশে এখন ব্যান্ডসংগীতের নাম দিয়ে কৃষ্ণকীর্তন করা হয়। রাস্তাঘাটের গানের দোকান থেকে কৃষ্ণলীলার গান ভেসে আসে, যা এখন দেশের মানুষের কাছে দুঃখজনকভাবে স্বাভাবিক। এবার নববর্ষে চারুকলার শিক্ষার্থীরা ভার্সিটি এলাকার দেয়াল কৃষ্ণের ছবি দিয়ে ভরে ফেলেছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। এদেশের সংবিধান সংস্কৃতি মানুষের চিন্তাচেতনা থেকে যারা ইসলামকে উঠিয়ে দিতে চায় তারা জানে, একদিনে এ মহাযজ্ঞ সম্ভব নয়। এজন্য তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, বাউল মতবাদের আড়ালে মুসলমানদের মনমগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে কৃষ্ণের অভিশপ্ত পরকীয়ার শিক্ষা। স্লো পয়জনিংয়ের মতো হিন্দুরা আমাদের মুসলমানিত্বকে আমাদের মধ্যে থেকে কেড়ে নিয়ে হিন্দুধর্মের দীক্ষা দিচ্ছে, কথিত সংস্কৃতির নামে। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মুনাফিকরাও তা চায়। এজন্য কিছুদিন আগেই এপ্রিল মাসে রাজবাড়ীর পাংশায় বাউলদের কথিত সাধুসঙ্গে তাদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার পরই সরকার তৎপর হয়ে উঠল। কথিত সুশীল সমাজ এবং লালনের গান গেয়ে জীবিকা অর্জনকারী ব্যান্ড গায়করা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। প্রথম আলোর মত সাম্প্রদায়িক ইসলামবিদ্বেষী পত্রিকাগুলো বাউলদের সপক্ষে লেখা শুরু করল। ফলশ্রুতিতে সরকার বাউলদের জন্য ৯৭ শতাংশ মুসলমানের টাকায় চালিত পুলিশ প্রশাসন দিয়ে পুনরায় বাউল গায়কদের সাধুসঙ্গের আয়োজন করল। অথচ চুলদাড়ি কেটে নিয়েছিল আওয়ামীলীগেরই তৃণমূল নেতাকর্মীরা, মিডিয়াকর্মীরাও কবুল করেছে বাউলদের অসামাজিক কার্যের বিরুদ্ধে মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকদেরও ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। স্থানীয়রাই উদ্যোগী হয়ে বাউলদের জটাদাড়ি কেটে নিয়েছিল(সুন্নতী দাড়ি নয়), কারণ বাউল সম্পর্কে আরেকটি বিষয় হলো তারা গাঁজায় আসক্ত, যুবসমাজ থেকে তারা তাদের নিজেদের উত্তরসূরি বেছে নেয়। এজন্য তারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে বাউলদের জটা কেটে,দাড়ি সিনা পর্যন্ত কেটে ইমাম দিয়ে তওবা পড়িয়েছিল, যেন বাউলরা সৎপথে ফিরে আসে। কিন্তু সরকার আসল বাউলদের ত্রাণকর্তারূপে, আবারও বসল সাধুসঙ্গ। যারা সাধুসঙ্গ সম্পর্কে জানে তারা বলেছে, সাধুসঙ্গ হলো বাউলদের কুকর্মের আনুষ্ঠানিক মহাযজ্ঞ। অর্থাৎ তাদের নাপাক বস্তু ভক্ষণ এবং কৃষ্ণের অনুকরণে তারা যে অবাধ মেলামেশা করে তার আসর। সাধুসঙ্গে সকালে মাইকে গান হয়, রাতে সমস্ত বাতি নিভিয়ে হয় জেনার আসর।নাউযুবিল্লাহ।
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম একসময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
“আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।...আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ...ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন... এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃসঠা ৪৮
ধর্ম দর্শনের নামে মিথ্যা বাউলিকরণ হয়েছে বাংলায়। বৈষ্ণব ধর্ম, সহজিয়া মতবাদ, সূফী মতবাদের মিলনে বাংলার বাউল ভাবধারা। ★ বাউলরা দেহের ভিতর দেহাতীতের সন্ধান করেন নরনারীর যুগল সাধনার মাধ্যমে। দেহের সাথে দেহের মিলন না হলে মাধুর্য ভজন হয় না। মাধুর্য ভজন না হলে মানুষ হয়ে জন্মানোর স্বার্থকতা কোথায়? এই হলো বাউলদের মৌল জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার উত্তর তারা খোঁজেন বিকৃতরুচি কাম সাধনায়। এই কারণে বাউলরা জোড়ায় জোড়ায় থাকেন। বাউল সাধনা একাকী পুরুষের বা একাকী নারীর সাধনা নয়। একে এক ধরনের পাশ্চাত্যের 'লিভিং টুগেদারের' সাথেও তুলনা করা চলে। লালনের ধর্মমতের 'চারিচন্দ্রভেদ', 'ষড়চক্র', 'দ্বিদলপদ্ম', 'মূলধারাচক্র', 'সহস্রদলপদ্ম', 'অধর মানুষ', 'ত্রিবেণী', 'সাধনসঙ্গিণী', 'প্রেমভজা' প্রভৃতি কাম আরাধনার ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দের তাৎপর্য জানলে বা শুনলে যে কোনো মানুষের লালনের প্রতি শ্রদ্ধা কমে যাবে। ★ দেখুন বাউলগন কিভাবে পুরুষ-প্রকৃতি (নারী-পুরুষ) বিভক্ত হ'ল এবং কিভাবে দুই দেশে না থেকে একত্রে রইল। পদ্ম কোথায় প্রস্ফুটিত হয়, পদ্ম পুস্পের রসে কিভাবে সাধন হয় এবং সহস্রদল হতে রজঃস্রোতের সঙ্গে রসরাজ লীলা করতে করতে অগ্রসর হয়ে তিন দিন তিন রূপ ধারণ করে শেষে 'সহজ মানুষ' রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ একটি মেয়ের মাসিকের সময় বাউল সাধুগন সাধনার নামে ধর্ষন করে তিন দিন কারন তারা মনে করে মাসিকের সময় সয়ং প্রভু উপর থেকে নারীর যৌনিতে নেমে আসে আর এই আসার সময় নারীর দেহের অধর চাঁদ নামক নীর অর্থাৎ নারীর সাথে সেক্স করতে করতে রস বের হবার পরে একটি সাদা বস্তুু আসে তারা তাকে অধর চাঁদ নামে অভিভূত করে এর পর তারা সেটা পান করে। এবং তারা মনে করে আমরা সয়ং প্রভু কে পেয়ে গেলাম। ★ প্রমান দেখুন কি বলে ★ বাউল-ফকিরেরা ঈশ্বরের সর্বোচ্চ রূপ মানবদেহের প্রাণের ধারার সাথে কিভাবে মিশে থাকে সে রহস্য উৎঘাটনে সচেষ্ট ছিলেন। বীজ-রজঃ মিলিত হয়ে মানবের জন্ম। আর এই দু'য়ের উৎপত্তি সঙ্গমকালে। উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সহজ মানুষ উপস্থিত হয়। বাউলরা এই স্তরে পৌঁছে স্থির থেকে সাধন করতে চায়। কাম নদীর নিন্মমূখী ধারাকে ঊর্ধমূখী করে যারা সহজ মানুষ সাধন করতে পারে, তারা হলো সিদ্ধ পুরুষ। লালন তার গানে বলছে-
আমি কি সন্ধানে যাই সেখানে
মনের মানুষ যেখানে।
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবা রাতি নাই সেখানে।
যেতে পথে কাম নদীতে
পারি দিতে ত্রিবিণে
কত ধনীর ধারা যাচ্ছে মারা
পইড়ে নদীর তোড় তুফানে।
রসিক যারা চতুর তারা
তারাই নদীর ধারা চিনে
উজান তরী যাচ্ছে বেয়ে
তারাই স্বরূপ সাধন জানে।
লালন বলে মইলাম জ্বলে
মইলাম আমি নিশি দিনে
আমি মনিহারা ফণির মতো
হারা হলাম পিতৃধনে।★লালনের গানে বলা হয়েছে "গুরুরতি সাধন কর"। অর্থাৎ নারীর রতি বা মাসিকের সাধনা। যদিও অনেক বাউল বলে নিজ দেহের বীর্যের সাধনা মুলত নারীর।
মাসিকের প্রতি বাউলদের এই যে মনোভাব তা বুঝতে হলে আমাদের রাধাকৃষ্ণের কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করেতে হবে। বলা আছে, একবার কৃষ্ণ রাধা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে অবস্থানকালে রাধার মাসিক শুরু হয়। কৃষ্ণ তা টের পেয়ে রাধাকে যেন লজ্জার মুখে পড়তে না হয় এজন্য সে মুহুর্তেই গোপীদের নিয়ে রং বা দোল খেলা শুরু করে। আর এই রং খেলা পরবর্তীকালে সনাতনী হিন্দু দাদা ও দিদিগন হলি খেলা শুরু করেছে আর আমি নাম দিয়েছি মাসিকের লাল রক্তের এর পুজা অর্চনা করন।
দোলপূর্ণিমা বাউলদের প্রধান উৎসবগুলোর একটি। মূলত বাউলরা বৈষ্ণব। বৈষ্ণবদের সাথে বাউলদের প্রধান পার্থক্য বাউলরা ইসলামের ভেক বা ছদ্মবেশ ধরে থাকে। যেমন তারা লুঙ্গি এবং পাগড়ি পরে। কিন্তু খাঁটি বৈষ্ণবরা পরে না। বাউলদের খাদ্যাভাস মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের দেহতত্ত্ব হতে আগত। বাউলরা পান করে মূত্র ও মল তো বটেই সাথে মাসিকের রক্ত ও বীর্য। এর মূলে রয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের পরকীয়া প্রেমের কাহিনী। আর আমরা তো জানিই পরকীয়া প্রেমে দেহ ব্যতীত কিছুই নেই। আর তাদের পরকীয়া প্রমিকার নিকট হতে মাসিকের রক্ত চাই। ★ আর সেই জন্য বাউলদের নিকটে কোন নারী বেড়াতে গেলে বা কোন বাউলের নিকটে ফোন নাম্বার থাকলে সেই নারীকে বলে মা তুমি দেবি, মা তুমি জননী তুমি সাক্ষাৎ দেবি দূর্গা তুমি মা লক্ষি তুমি জগত জননী মা তোমার পায়ে ভক্তি মা তোমাকে প্রনাম মা তোমাতেই আমাদের মানব মুক্তি মা গো। বাউলদের এই চতুরতায় নারীগন ধরা খেয়ে যায়য় এবং এই ভাবে তারা বিভিন্ন কাহিনি তৈরী করে কারন মুলত তাদের উদ্দেশ্য সেই নারীর মাসিকের রক্ত পান করা আর সেক্স করা। ★বাউলগন, "ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তুু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত উল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই ★ বাউলদের মধ্যে রজঃপান অর্থাৎ মেয়েদের মাসিকের রক্ত পান করা একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে ★ সাধারণ বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত 'নাড়া' শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার 'ওরসে' তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ 14) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ 1986 সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, "আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ । তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি .. ... আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। ... ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থ ভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন ... এই সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা -লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ। "(দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২ য় সংস্করণ, আগস্ট 1998 পৃঃ 4-95) ★ উপরের কথা গুলো কোন মুসলিম। যদি ভাল ভাবে বুঝে তাহলে কখনো বাউলবাদ তথা বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহন করবে না আর এই বাউলবাদ তথা বৈষ্ণববাদ মুসলিম ও সনাতনী হিন্দু ধর্মাবলি দের ও ক্ষতি করে চলছে দিনের পর দিন । দেখুন মহান রাব্বুল আলামিন আল কোরআনে কি বলে, ★83 - তারা কি আল্লাহর দ্বীনের পরিবর্তে অন্য দ্বীন তালাশ করছে? । আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, তাঁরই অনুগত হবে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যাবে ★ সূরা আল ইমরান। 85 - যে লোক ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম তালাশ করে, কস্মিণকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে ক্ষতি গ্রস্ত ★ সূরা আল ইমরান: 101 - আর তোমরা কেমন করে কাফের হতে পার, অথচ তোমাদের সামনে পাঠ করা হয় আল্লাহর আয়াত সমূহ এবং তোমাদের মধ্যে রয়েছেন আল্লাহর রসূল। আর যারা আল্লাহর কথা দৃঢ়ভাবে ধরবে, তারা হেদায়েত প্রাপ্ত হবে সরল পথের ★ সূরা আল ইমরান: 102 - হে ঈমানদারগণ। আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিৎ ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না ★ সূরা আল ইমরান। 104 - আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহবান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দেবে ভাল কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম ★ সূরা আল ইমরান: । 105 - আর তাদের মত হয়ো না, যারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং নিদর্শন সমূহ আসার পরও বিরোধিতা করতে শুরু করেছে-তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর আযাব। ★ এই আয়াত গুলো একটু গভীরতম ভাবে পড়ে তার পরে আপনারা বাউল তথা বৈষ্ণবধর্ম গ্রহন করিয়েন।★বাউলবাদ সুফিবাদ এর মাঝে প্রবেশ করে কলঙ্কিত করে ফেলেছে দিনের পর দিন তাই আসুন বাউলবাদ না বলুন। ★ বিঃদ্রঃ বৈষ্ণব মতবাদে সবচে বাজে জঘন্যতম কাজটি হলো এদের মাঝে মা বোন মাসি কাকি বলে কিছু নেই তারা মনে প্রানে বিশ্বাস করে আমাদের সকল আত্মায় একি তাই আমাদের মাঝে ভেদাভেদ থাকতে পারে না। আর বৈষ্ণব মতাদর্শ হতে এই রস রতি অর্থাৎ সেক্স এর সাধনা ঢুকে পরেছে লালনবাদে।
copyed, Rayed Talukder
বাউল প্রসঙ্গে নতুন করে সামনে চলে এসেছে। পাংশা উপজেলার আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কয়েকজন মাদ্রাসা শিক্ষক কিছু বাউলকে তওবা পড়ান এবং তাদের লম্বা গোঁফ ও চুল কেটে দেন।
একটি জাতীয় দৈনিকে একজন কলাম লেখক ইতিহাস থেকে বাউলদের তওবা পড়ার কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন যা ঘটেছিল ১৯৩২ সালে, ১৯৪২ এবং ১৯৮৪ সালে। প্রায় একশত বছরের এ রকম কয়েকটি ঘটনাকে ব্যাতিক্রম হিসাবে গন্য করা যায়, তবে এ কথা বিবেচনা যোগ্য যে বাউলরা যেহেতু মুসলিম নামধারী সেহেতু তাদেরকে মুসলিম সমাজ কিছুটা নিয়ন্ত্রন করবেই, সামাজিক নিয়ন্ত্রন বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না, সমাজ অস্বাভাবিক কাজ গ্রহণ করেনা।
লেখক বাউলদের অনেক প্রশংসা করেছেন, তার ভাষ্য মতে “তাদের দ্বারা বাংলাদেশে এক মানবতাবাদী এক জাগরণ ঘটে” “তাদের হাত ধরেই কৃষক সমাজের মধ্যে ঘটেছিল দেশজ রেঁনেসা” “বাউলরাই হচ্ছে আমাদের আদর্শ নারী পূরুষ”। এ সবই হচ্ছে অতিরঞ্জিত কথা। লালন নিজে সংগীতের ক্ষেত্রে অনেক অনেক বড়। কিন্তু সাধারণ বাউররা তা নয়। তারা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করে, তারা অপরিচ্ছসন্ন তাকে, অবাধ যৌনাচারে বিশ্বাস করে, তাদের পূরুষরা হায়েজের রক্তপান বৈধ মনে করে। তাদের নারীরা পূরুষের বীর্যপান বৈধ মনে করে। এসব আমি জেনেছি লালন গবেষক লালনের উপর পিএইচডি করেছেন এক ক্লাসমেটের কাছ থেকে।
বাউলরা কখনই কোন আদর্শ নয়, তারা সাধারণ মানুষ, তারা সভ্যতার কিছুই জানে না। তারা সত্যিকার অর্থে কোন ধার্মিক লোকও না। কিন্তু একথা অবশ্যই বলতে হবে যে, এসব নিরীহ লোকদের উপর কোনো অত্যাচার বৈধ হতে পারেনা, যা করতে হবে মুসলিম সমাজকে তা বৈধ ভাবে করতে হবে।
আমার বাড়ির পাশে এক বাউল ছিল। সে তার নিজের প্রসাব পান করত। আর ওনার পাশ দিয়ে দুর্গন্ধের কারনে হেটে যাওয়া যেত না।
চরম বিকৃত, অজ্ঞ, নেশাগ্রস্ত, অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা মনের অধিকারী তথা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শশূন্য সুশীলদের আদর্শ এসব তথাকথিত বাউলদের জ্ঞানের আলো দ্বারা অন্ধকার পথ থেকে উদ্ধার করতে হবে।
আরও অবাক করা ব্যাপার হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আদর্শ শূন্য বাউলপ্রেমী হাসিনা সরকারের বিটিভিতে ইসলামী অনুষ্ঠানের থিম সং মূল হলো অনেকটা এরকম–
বাউলদের বাংলাদেশ
মাইজভান্ডারির বাংলাদেশ
সুফি-সাধকের বাংলাদেশ
মাঝারের বাংলাদেশ……
বাউলরা যে জীবনাচারে অভ্যস্ত তা যদি আদর্শ হয় তাহলে মানুষকে আর কোন কিছু করতে হবেনা। শুধু গাঁজা খাও, নেশা করো, নষ্টামি করো এসবই হবে জীবন। যারা বাউল জীবনের পক্ষে বলে তারা তাদের ছেলে-মেয়েকে সেই বাউলের আস্তানায় পাঠাক। তারপর বাউল জীবনকে আদর্শ মানে কিনা বুঝা যাবে…
বাউলদের যারা উচ্ছিষ্ট গোঁফ দাড়ি কেটে দিয়েছেন সে সকল স্থানীয়দের সাক্ষাৎকার আমরা টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখেছি। তাদের কথায়ও বোঝা গিয়েছে; এটা একটি স্বাভাবিক সামাজিক প্রতিরোধ। এখানে কোন মতাদর্শ বা রাজনৈতিক চিন্তা কাজ করেনি। স্থানীয় সমাজের মাতুব্বর, বয়জেষ্ঠগণ, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি সবাই একত্রিত হয়ে বিনা প্ররোচনায় এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন। পরবর্তীতে আমাদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক মনোভাব এই ঘটনা থেকে যে যার মত ফায়দা লুটতে উঠে পড়ে লেগেছে।
আমরা সম্প্রতি আওয়ামী নেতাকমী কর্তৃক বাউলদের চুলদাড়ি কেটে নেয়ার ঘটনা শুনেছি। অনেকে বিষয়টি নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি গেল গেল বলে রব তুলেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি বাউলতত্ত্ব কী? বা এতে কী বলা রয়েছে? আমরা কিন্তু জানি না। আনুশেহ, সুমীর মতো কিছু অধুনা গায়িকা বাউলতত্ত্বের প্রচারপ্রসারে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রসেনজিৎ এসে কয়েকদিন আগে লালন নিয়ে সিনেমা করে গেল। মূলত ইন্ডিয়াপন্থী কিছু বুদ্ধিজীবীর লালনপ্রেম যে উথলে উঠেছে তা আমাদের ভাবনার বিষয়। তারচেয়ে বড় কথা আমরা জানি না লালন আসলে কে? তার ধর্ম আসলে কি? এই প্রশ্নের জবাব দিবে নিন্মোক্ত লেখাটি
লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের গুরু। আমরা কি জানি কারা এই বাউল সম্প্রদায়? কি তাদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণ? নব্বই ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে লালন ফকির বা বাউল সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ, বিশ্বাস ও মূ্ল্যবোধ আসলে কতটুকু সম্পর্কিত? সর্বোপরি যারা বাউল সংস্কৃতিকে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি বলে ১২ কোটি মুসলিমের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদের এসব কর্মকান্ডের উদ্দেশ্যই বা কি?
বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে যারা পড়াশোনা করেছেন তাদের কাছে প্রয়াত লেখক আহমদ শরীফের “বাউল তত্ত্ব” এবং লালন একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ডক্টর আনোয়ারুল করিমের “বাংলাদেশের বাউল- সমাজ, সাহিত্য ও সংগীত” নামের বই দুটো খুবই পরিচিত। বাউল শব্দটির উৎস ও এই সম্প্রদায়ের ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে ডক্টর আনোয়ারুল করিম তার বাংলাদেশের বাউল বইতে যা লিখেছেন তার সারাংশ হল, প্রাচীন প্যালেস্টাইন এর রাসসামরায় বা’আল নামের একজন প্রজনন দেবতার উপাসনা করা হতো। তৌরাত, ইঞ্জিল(বাইবেল), কোরান মজিদসহ সকল ধর্মগ্রন্থেই এই দেবতাকে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে এবং তার উপাসনা থেকে সকলকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মূলত বা’আল প্রজনন-দেবতা হওয়ায় মৈথুন বা যৌনাচার এই ধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এই বা’আল ধর্ম এক্সময় এ উপমদেশীয় অঞ্চলেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলে। পরবর্তীতে এ অঞ্চলে ইসলামের সুফীবাদী মতবাদের প্রচার-প্রসার ঘটার পর সম্ভবত ইসলাম ও পৌত্তলিকতা উভয় মতবাদের সংমিশ্রণে একটি নতুন লোকধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল যার উপরিভাগে ছিল মুসলিম সূফীবাদের প্রাধান্য, অভ্যন্তরে ছিল তন্ত্র ও যোগনির্ভর দেহজ সাধনা। তাই তার ধারণা মতে কালক্রমে এই বা’আল লোকধর্মই পরবর্তীতে বাউল লোকধর্মে পরিণত হয়েছে এবং লোকনিরুক্তি অনুসারে বাউল শব্দটি বা’আল>বাওল>বাউল এভাবে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। (বা.বা পৃষ্ঠা ১৩৩-১৪৫) ডা. আহমদ শরীফ তার “বাউলতত্ত্ব” বইটিতে বাউল ধর্মমত সম্পর্কে বলেন, “ব্রাহ্মণ্য, শৈব ও বৌদ্ধ সহজিয়া মতের সমবায়ে গড়ে উথেছে একটি মিশ্রমত যার নাম নাথপন্থ। …দেহতাত্ত্বিক সাধনাই এদের লক্ষ্য। (নাথপ্নথ এবং সহজিয়া) এ দুটো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু পুরনো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও এরা পুরনো প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে, তার ফলেই হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বাউল মতের উদ্ভব। তাই হিন্দু গুরুর মুসলিম সাগরেদ বা মুসলিম গুরুর হিন্দু সাগরেদ গ্রহণে কোন বাধা নেই। তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শরিয়তী ইসলামের বেড়া ভেঙে নিজের মনের মত করে পথ তৈরি করে নিয়েছে। এজন্য তারা বলে,
“কালী কৃষ্ণ গড খোদা/কোন নামে নাহি বাধা
মন কালী কৃষ্ণ গড খোদা বলো রে।” (বাউলতত্ত্ব পৃঃ ৫৩-৫৪)।
সাধারণ জনারণ্যে বাউলরা নাড়ার ফকির নামে পরিচিত। ‘নাড়া’ শব্দটির অর্থ হল শাখাহীন অর্থাৎ এদের কোন সন্তান হয়না। তারা নিজেদের হিন্দু মুসলমান কোনকিছু বলেই পরিচয় দেয়না। লালন শাহ ছিলেন বাউলদের গুরু। লালনকে বাউলরা দেবতা জ্ঞানে পূজা করে। তাই তার ‘ওরসে’ তাদের আগমন এবং ভক্তি অর্পণ বাউলদের ধর্মের অঙ্গ। (বা.বা পৃঃ ১৪) লালন শাহের অনুসারীদের একটি অংশ ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে একজন মুসলমান অধ্যাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, “আমরা বাউল। আমাদের ধর্ম আলাদা। আমরা না-মুসলমান, না-হিন্দু। আমাদের নবী সাঁইজি লালন শাহ। তাঁর গান আমাদের ধর্মীয় শ্লোক। সাঁইজির মাজার আমাদের তীর্থভূমি।।…আমাদের গুরুই আমাদের রাসুল। …ডক্টর সাহেব [অর্থাৎ উক্ত মুসলিম অধ্যাপক] আমাদের তীর্থভূমিতে ঢুকে আমাদের ধর্মীয় কাজে বাধা দেন। কোরান তেলাওয়াত করেন, ইসলামের কথা বলেন… এ সবই আমাদের তীর্থভূমিতে আপত্তিকর। আমরা আলাদা একটি জাতি, আমাদের কালেমাও আলাদা –লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লালন রাসুলুল্লাহ।“ (দ্রঃ সুধীর চক্রবর্তী, ব্রাত্য লোকায়ত লালন, ২য় সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৮ পৃঃ ৪-৯৫)
বাউল সাধনায় গুরুশ্রেষ্ঠকে ‘সাঁই’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সাধনসঙ্গিনীকেও গুরু নামে অভিহিত করা হয়। মূলত সাধনসঙ্গিনীর সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত সাধনায় সিদ্ধী লাভ করা যায় না। তাই তাকে ‘চেতন গুরু’ বলা হয়। বাউলরা বিশ্বাস করে গুরুর কোন মৃত্যু নেই। তিনি কেবল দেহরক্ষা করতে পারেন। তিনি চিরঞ্জীবী। বাউলরা মন্দিরে কিংবা মসজিদে যায়না। জুম্মার নামায, ঈদ এবং রোযাও পালন করেনা। তারা তাদের সঙ্গিনীকে জায়নামাজ নামে অভিহিত করে। বাউলরা মৃতদেহকে পোড়ায়না। এদের জানাজাও হয়না। হিন্দু মুসলমান নামের সব বাউলদের মধ্যেই এই রীতি। এরা সামাজিক বিবাহ বন্ধনকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষের একত্রে অবাধ মেলামেশা এবং বসবাসকে দর্শন হিসেবে অনুসরণ করে। (বা.বা পৃঃ ১৫-১৭)
বাউল সাধনা মূলত একটি আধ্যাত্বসাধনা, তবে যৌনাচার এই সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় কামাচার বা মিথুনাত্বক যোগসাধনাই বাউল পদ্ধতি। বাউল সাধনায় পরকীয়া প্রেম এবং গাঁজা সেবন প্রচলিত। বাউলরা বিশ্বাস করে যে, কুমারী মেয়ের রজঃপান করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধক তৈরী হয়। তাই বাউলদের মধ্যে রজঃপান একটি সাধারন ঘটনা। এছাড়া, তারা রোগমুক্তির জন্য স্বীয় মুত্র ও স্তনদুগ্ধ পান করে। সর্বরোগ থেকে মুক্তির জন্য তারা মল, মুত্র, রজঃ ও বীর্য মিশ্রণে প্রেমভাজা নামক একপ্রকার পদার্থ তৈরি করে তা ভক্ষণ করে। একজন বাউলের একাধিক সেবাদাসী থাকে। এদের অধিকাংশই কমবয়সী মেয়ে। (বা.বা পৃ ৩৫০, ৩৮২)
এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায়, অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিমও ধর্মবিবর্জিত বিকৃত যৌনাচারী মুসলিম নামধারী বাউলদেরকে সূফী-সাধকের মর্যাদায় বসিয়েছে। মূলতঃ বিকৃত যৌনাচারে অভ্যস্ত ভেকধারী এসব বাউলরা তাদের বিকৃত ও কুৎসিত জীবনাচারণকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখার জন্য বিভিন্ন গানে মোকাম, মঞ্জিল, আল্লাহ, রাসূল, আনল হক, আদম-হাওয়া, মুহাম্মদ-খাদিজাসহ বিভিন্ন আরবী পরিভাষা, আরবী হরফ ও বাংলা শব্দ প্রতীকরূপে ইচ্ছাকৃতভাবেই ব্যবহার করেছে। এদেশে বহুল প্রচলিত একটি লালন সঙ্গীত হলো,
“বাড়ির পাশে আরশি নগর/সেথা এক পড়শী বসত করে,
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”
এই গানটিকে আমাদের সমাজে খুবই উচ্চমার্গের আধ্যাতিক গান মনে করা হলেও, এটি মূলত একটি নিছক যৌনাচারমূলক গান, যাতে আরশিনগর, পড়শী শব্দগুলো প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের বিকৃত জীবনাচারকে গোপন রাখার উদ্দেশ্যে। (বা.বা পৃঃ ৩৬৮-৩৬৯)
বাউল সাধকরা বস্তুতঃ নিরাকার আল্লাহকে সাকারত্ব প্রদান করে তাদের অনুসারীদের পৌত্তলিকতার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা সাধারন মানুষের সারল্য, অশিক্ষা ও অজ্ঞতার কারণে তাদের বিভ্রান্ত করেছে এবং এইসব বিকৃত সাধনাসম্বলিত লোকধর্ম আসলে আমাদের সমাজ জীবনকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সমাজ জীবনে বাউল লোকধর্মের এই ভয়ঙ্কর প্রভাব লক্ষ্য করে বাংলা ১৩৩৩ সালে হাজী মৌলভী রেয়াজউদ্দীন আহমদ “বাউল ধ্বংশ ফতওয়া” নামে বাউলবিরধী একটি বই লেখেন। যেখানে তিনি এই বাউল সম্প্রদায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ইসলাম, ইসলামী আকিদাহ্ যা এদেশের আপামর মুসলিমের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের সাথে বাউল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের দূরতম সম্পর্ক নেই এবং তা পুরোপুরি ষাংঘর্ষিক। শুধু তাই নয়, বিশ্বাসে পৌত্তলিক, আচার-আচরণে ভয়ঙ্কর কুসংস্কারাচ্ছন্ন, বিকৃত জীবানাচারণ ও অবাধ যৌনাচারে অভ্যস্ত বাউল সম্প্রদায় কোনভাবেই এদেশের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বা আত্বপরিচিতির বন্ধনমূল হতে পারেনা। কবীর চৌধুরী, হামিদা হোসেন, আয়েশা খানম এবং তাদের অনুসারীরা বস্তুতঃ প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা ও দেশীয় কৃষ্টি-কালচারের নামে, ফুল-পাখি-গান-কবিতা-সৌন্দর্য ইত্যাদির উছিলায় এদেশের মানুষকে অশ্লীল, বিকৃত ও নৈতিক মূল্যবোধ বিবর্জিত এক ভয়ঙ্কর অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যে নিকষ কালো আঁধারের মূলে রয়েছে বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা এবং শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করছে নিশ্চিত ধ্বংস। স্বনামধন্য লেখক হুমাইয়ূন আহমেদ, সাঁইজির মূর্তি ভাঙায় যার অন্তরে হাহাকার উঠেছে, তার বিতর্কিত ব্যক্তিজীবনই আমাদের বলে দেয় এই হাহাকারের উৎস কোথায়। এছাড়া, রোবায়েত ফেরদৌসের মত ব্যক্তি, যারা কিনা এদেশের তরুন-তরুনীদের বিয়ের আগেই শারীরিক সম্পর্ক তৈরীর ফ্রি লাইসেন্স দিতে চায় তাদের তো বল্গাহীন উদ্দাম বাউলিয়া জীবনাচারণই কাম্য।
তবে, একই সাথে এটাও ঠিক যে, এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা পরধর্ম মতে সহনশীল। যদিও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী সুশীল সমাজের একটি অংশ মাঝে মাঝেই এদেশের মানুষের বিরুদ্ধে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভি্যোগ এনে থাকেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ভারতের মতো এদেশের মানুষ কখনোই সংখ্যালঘুদের উপর বর্বরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না, অন্য ধর্ম বা মতে বিশ্বাসী মানুষদের জীনন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে না, কিংবা তাদের ঘরবাড়ী, উপাসনালয়ও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়না। তাই, যদি হামিদা হোসেন এবং কবীর চৌধুরীর অনুসারীরা বাউল ধর্মকে তাদের নিজস্ব ধর্ম বা সংস্কৃতি বলে মানতে চায় কিংবা শ্রীকৃষ্ণের অবতারে বিশ্বাসী লালন ফকিরকে তাদের দেবতা বলে ঘোষণা তবে, তবে নিঃসন্দেহে তাদের কেউ বাধা দেবে না। তারা যদি নিজেদের অর্থ-সম্পদ খরচ করে তাদের অধিকৃত জায়গায় আকাসছোঁইয়া লালনমূর্তি বানাতে চায়, তাতেও হয়তো কেউ কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু জাতীয় বিমানবন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, হাজী ক্যাম্পের সামনে জনগণের অর্থ ব্যয় করে লালনমূর্তি তৈরী বা বিমানবন্দরের সামনের চত্বরকে ‘লালন চত্বর’ ঘোষণার দাবী একেবারেই অযৌক্তিক। কারণ, তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিশ্বাস বা বিকৃত মূল্যবোধকে জাতীয় কৃষ্টি-কালচার হিসেবে সমস্ত জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই।
কিন্তু বাংলাদেশী স্বঘোষিত অবিশ্বাসী /এক্স মুসলিম/প্রগতিশীল চেতনায় বিশ্বাসী ভাইয়েরা মরমী কবি লালনকে সদ্গুরু হিসেবে মেনে নিয়েছে। ধর্মে আস্থা বা বিশ্বাস না থাকলেও তাদের লালন ভক্তি মনে প্রশ্ন উদ্রেগ করে, আহম্মদ শরীফের
উত্তরমুছুনন্যায় গুনীজন ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম মানেননি, কিন্ত চন্দ্রসাধনা,প্রেমভাজার সাধ নিতে ভুল করেননি। সেলুকাস সত্যিই অবাক
বাঙ্গালী সংস্কৃতির রুপকার নাকী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,লালন তত্ব রবীন্দ্রনাথের লেখায় কতটুক প্রভাব বিস্তার করেছে তা বোঝার জন্য আবুল আহসান চৌধুরীর লালন সমগ্রই যতেষ্ঠ। ওদিকে মুক্তমনা ব্লগে অভিজিত রায় লিখেছেন বংগ ভঙ্গ নাকী বাঙালী সংস্কৃতির সহায়ক অঙ্গ নয়,সে হিসেবে লালন ও রবীন্দ্রনাথ বাঙালী সাংস্কৃতির অগ্রপথিক,জমজ পথ প্রদর্শকও বটেন। তাই সকল বাঙালী কে মূলধারায় থাকতে চাইলে চন্দ্রসাধন ও প্রেমভাজার স্বাদ আস্বাদন করতে হবে ।
উত্তরমুছুনএই লেখাগুলো কই পাইলেন? এগুলো তো অন্যের লেখা পাইরেসি করে নেয়া।
উত্তরমুছুন