ইসমাতে আম্বিয়া
মওদুদীর ভুল খুজছেন,আর কিছু চোখে পড়ছে না। একটি মাত্র তাফসীর থেকে আমার চোখে যতটুকু পড়েছে তা থেকে উদ্ধৃতি দিলাম,পৃষ্ঠার স্ক্রিন শট দিলাম - যে তাফসীরটি কাওমি এবং রেজাখানি ও রেজভী সুন্নী সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। তাফসীরে মারেফুল কোরআন, যা লিখেছেন মুফতি মোহাম্মদ শফী। যার বাংলা অনুবাদ করেছেন মাওলানা মহিউদ্দিন খান। সেটা থেকে নিচের তথ্যগুলো দেখুন- ১) সূরা আরাফ, আয়াত ১৯৯- ২০০,পৃষ্ঠা ৫১১,"( নবী সাঃ) আপনার মনে শয়তানের ওয়াসওয়াসা আসতে আরম্ভ করলে সাথে সাথে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করুন"।(নবী সঃ এর মনে শয়তানের ওয়াসওয়াসা?)। ২) সূরা আনফাল, আয়াত ৬৭-৬৮, পৃষ্ঠা ৫৪৫, "সে কারণে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভৎসনা অবতীর্ণ হয়, এই ভৎসনা ও অসন্তুষ্টি ওহির মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে"।(সাহাবায়ে কেরাম রাঃ এর প্রতি আল্লাহর অসন্তোষ্টি ও ভৎসনা?)। ৩) সূরা ইউনুস, আয়াত ৯৮, পৃষ্ঠা ৬১৮, "ইউনুস আঃ এর পদলঙ্ঘনটি ছিল এই যে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদন আসার পূর্বেই হিজরতের উদ্দেশ্যে নৌকায় আরোহন করেছেন"। (ইউনুস আঃ এর পদলঙ্ঘন?)। ৪) সূরা হুদ, আয়াত ৪৬, পৃষ্ঠা ৬৩৩," নুহ আলাই সালাম বলবেন আমি এমন একটি ভুল করেছি যার ফলে আজ সুপারিশের হিম্মত হয় না"।(নবীর ভুল?)। ৫) সূরা গাফের/ মোমিন, আয়াত ৫৫, অর্থ করেছেন "(নবী সঃ) আপনি গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন"।(নবী সঃ এর গুণাহ?) ৬) সূরা ইউসুফ আয়াত ৮৩, পৃষ্ঠা ৬৮৫, তাফসীরে কুরতুবির বরাত দিয়ে বলেন "পয়গম্বরগণ ও যদি ইজতেহাদ করে কোন কথা বলেন তা সঠিক না হওয়া সম্ভবপর"।(নবীদের ইজতেহাদে ভুল?)। ৭) সূরা ইউসুফ, আয়াত ৮৮, পৃষ্ঠা ৬৮৮, তাফসীরে কুরতুবী ও তাফসীরে মাজহারীর বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন- ইয়াকুব আঃ মিশরের অধিপতির নিকট পত্র লিখেন- "ইয়াকুব শফিউল্লাহ ইবনে ইসহাক জবিউল্লাহ ইবনে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ এর পক্ষ থেকে আজিজে মিশরের নিকট"।(ইহুদীদের মত ইসমাইল আঃ এর পরিবর্তে ইসহাক আঃ কে জবিহুল্লাহ মনে করা?)। ৮) সূরা নাজম, আয়াত ৩- ৪, পৃষ্ঠা ১৩০৩, "রাসুল সাঃ ইজতেহাদ করে বিধানাবলী বের করেন এই ইজতেহাদে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে"।(রাসুল সঃ এর ইজতেহাদে ভুল?)। ৯) সূরা হিজর, আয়াত ৪০, পৃষ্ঠা ৭৩০," আদম ও হাওয়ার উপর শয়তানের চক্রান্ত সফল হয়েছে", " সাহাবায়ে কেরামের উপরও শয়তানের ধোঁকা কার্যকর হয়েছে"।(নবী ও সাহাবায়ে কেরাম এর উপর শয়তানের ধোঁকা?)। ৯) সূরা তোহা, আয়াত ১২১, পৃষ্ঠা ৮৬৬, ৮৬৮," আদম তার পালনকর্তার অবাধ্যতা করল ফলে সে পথভ্রান্ত হয়ে গেল", " নবুওয়াতের পূর্বে পয়গম্বরদের কাছ থেকে গুনাহ হওয়া আহলে সুন্নাতের মতে নিষ্পাপ হওয়ার পরিপন্থী নয়"।(নবীর পথভ্রান্ত হওয়া, নবুয়তের পুর্বে গুণাহ হওয়া, নিষ্পাপ না থাকা?)। ১০) সূরা শোয়ারা, আয়াত বিশ পৃষ্ঠা ৯৭৪ মুসা বলল আমি সে অপরাধ তখন করেছি যখন আমি ভ্রান্ত ছিলাম (নবীর ভ্রান্তি) ১১)সূরা নম্বর আয়াত ১০-১১, পৃষ্ঠা ৯৯০," পয়গম্বরগণের যে সব পদলঙ্ঘন হয় সেগুলো কবিরা ছগিরা গুনাহ নয় তবে গুনাহর আকারে থাকে"।(নবীর গুণাহ?)। ১২) সূরা নমল , আয়াত ৪০, পৃষ্ঠা ৯৯৮, "প্রত্যেক অলির গুণাবলী পয়গম্বরের গুনাবলির প্রতিবিম্ব এবং তার কাছ থেকেই অর্জিত, তাই উম্মতের ওলীদের কারামত পয়গম্বরের মোজেজা রুপে গণ্য"।(অলির কেরামত মুজেজারুপে গণ্য)। ১৩) সূরা কাসাস,আয়াত ১৬, পৃষ্ঠা ১০০৮," এক্ষেত্রে মুসা আঃ অনুমতির অপেক্ষা না করে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, এটাকে গুনাহ সাব্যস্ত করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিল, মুসা আঃ এর এ বিচ্যুতি আল্লাহ ক্ষমা করলেন"।(নবীর গুণাহ ও বিচ্যুতি?)। ১৪) সূরা সোয়াদ, আয়াত ২৫, পৃষ্ঠা ১১৬২, ১১৬৩, ১১৬৪ "আমি দাউদ এর অপরাধ ক্ষমা করলাম, দাউদ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল কিন্তু একটি ভুল রয়ে গেল"।(নবীর অপরাধ,ভুল?)। ১৫) সূরা সোয়াদ, আয়াত ৫৫, পৃষ্ঠা ১১৬৭," সোলাইমান আঃ এর অশ্বপরিদর্শনে সূর্য ডুবে যায়, নামাজের সময় চলে যায়,--- এর কারণ এটা নয় যে সূর্যকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালার নেই"।(নবীর নামাজেরসময় চলে যাওয়া?)। ১৬) সূরা মুহাম্মদ, আয়াত ১৯, পৃষ্ঠা ১২৫৯," পয়গম্বরগণ গুনাহ থেকে পবিত্র হওয়া সত্ত্বেও স্থান বিশেষে ইসতেহাদি ভুল হওয়া বিচিত্র নয়, ভুল গুনাহ নয় কিন্তু তাদের মর্যাদার কারণে ভুলকে ذنب তথা গুনার মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়"।(নবীদের ভুল ও গুণাহ?)। ১৭) সূরা ফাতহ , আয়াত ২, পৃষ্ঠা ১২৬৫, "নবীদের অনুত্তম কাজকরা ও ত্রুটি, যাকে শাসানোর ভঙ্গিতে কুরআনে জাম্ব তথা গুনাহ বলা হয়েছে, মা তাকাদ্দামা নবুয়তের পুর্ববর্তী ত্রুটি,মা তায়াখ্খারা নবুয়তের পরবর্তী ত্রুটি বুঝানো হয়েছে (তাফসীরে মাযহারী, মারুল কোরআন)"।(নবীর ত্রুটি, অনুত্তম কাজ,গুণাহ?)। ১৮) সূরা হাদীদ, আয়াত ১১- ১৪, পৃষ্ঠা ১৩০৩, "রাসুলুল্লাহ সাঃ ইজতেহাদ করে বিধানাবলী বের করেন, এই ইজতেহাদে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, ইজতেহাদের ভুল ওহি দ্বারা শুধরিয়ে দেয়া হয়"।(রাসুল সঃ এর ইজতেহাদে ভুল?)। ১৯) সূরা মুমতাহিনা, আয়াত ১২, পৃষ্ঠা ১৩৬৫ "আল্লাহর আদেশের বিপরীতে কোন মানুষের আনুগত্য জায়েজ নয়, এমনকি সে মানুষটি যদি রাসূলও হন। তাই রাসূল সাঃ এর আনুগত্যের সাথে এই শর্তটি যুক্ত করে দেয়া হয়েছে"।(রাসুল সঃ এর আনুগত্য করতে কোরআনের আলোকে যাচাই করে নিতে হবে?)। ২০) সূরা আলা, পৃষ্ঠা ১৪৫০," নবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কোরআনের আয়াত পড়তে ভুল করেছেন"।(নবীর কোরআন ভুল করা?)। কাওমী বড় এক মুরব্বি তার তাফসীরে বলেছেন সাহাবায়ে কেরাম রাঃ ইহুদীদের সাথে সুদের ব্যবসা করতেন। তাফসীরে জালালাইন, সূরা সোয়াদের ২১ থেকে ২৪ নং আয়াতে তাফসীরে লিখেছেন- "দাউদ আঃ এর ৯৯ জন স্ত্রী ছিল,তারপরও তিনি অপর সৈনিকের সুন্দরী স্ত্রীকে দেখে তিনি আসক্ত হন, ঐ সৈনিককে যুদ্ধে পাঠিয়ে সেনাপতিকে বলে দেন-------। এ ভাবে অসংখ্য তাফসীরে, অনেক বিখ্যাতদের কিতাবে, লেখায় দেখা যায়(তাদের লেখা থেকে ভবিষ্যতে অন্য পোস্টে উদ্ধৃতি দেয়ার আশা) এ লেখার প্রেক্ষিতে কেহ বলে না তাদের আকিদা খারাপ,তারা ভুল করেছেন । শুধু আকিদা খারাপ ও ভুল দেখেন মওদুদীর।যার ইসলামী রাষ্ট্রের রূপরেখা সহ বিভিন্ন বিষয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা গবেষণা, কিছু ভুল কি অস্বাভাবিক? ইকামতে দ্বীনের চেষ্টাকে প্রশ্নবোধক করতে কিছু লোক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সেটার পিছনে পড়ে রয়েছে।
নবীদের নিষ্পাপ হওয়া প্রসঙ্গে মাওলানা মওদূদী(রহ.)-এর প্রতি অভিযোগ
সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী(রহ.) বলেন,"এটি একটি বড়ই মজার কথা যে, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করে প্রত্যেক নবী থেকে কোন না কোন সময় তাঁর হেফাজত উঠিয়ে নিয়ে দু'একটি ভুল ত্রুটি হতে দিয়েছেন, যাতে মানুষ নবীদেরকে খোদা না বুঝে এবং জেনে নেয় যে,এরা খোদা নয় বরং মানুষ।'
নির্বাচিত রচনাবলী, ২য় খন্ড,আধুনিক সাইয়েদ আবুৃল আ'লা মওদূদী,প্রকাশণী, ঢাকা,চট্রগ্রাম, খুলনা,১ম প্রকাশ;১৯৯১)পৃ.৭৪।
অন্যান্য আলিমগণের অভিমত
ঈমাম ফখরুদ্দিন রাযীর অভিমতঃ-
আম্বিয়া কিরামগণ নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় থেকে ইচ্ছাকৃত কবিরা গুনাহ ও ছগিরা গুনাহ থেকে পবিত্র।তবে অনিচ্ছাকৃত কবীরা ও ছগিরা দুটোই হতে পারে। ফখরুদ্দিন রাযী,ইসমতে আম্বিয়া,পৃ. ২৮।
ইমাম ইবনু তাইমিয়া(রহ)-এর অভিমতঃ-
নবীগণ কবিরা গুনাহ থেকে পবিত্র,ছগিরা গুনাহ থেকে নয়।ইবনু তাইমিয়া,মাজমুউল ফাতওয়া(৪/৩১৯)।
আল্লামা আলুসী (রহ) এর অভিমতঃ-
আল্লামা আলুসী(রহ.)(১২৭০ হি.) তাঁর বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ 'রুহুল মাআ'নীতে সুরা 'ত্বহা,-এর তাফসিরে বলেন,'অধিকাংশ আলিমদের মতানুসারে নবুওয়্যত প্রাপ্তির পরও নবীদের থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছগিরা গুনাহ হতে পারে।কিন্তু ঘৃণিত স্বভাবের পরিচয় বহন করে ওই ধরণের ছগিরা গুনাহ হতে পারনা।তিনি আরো বলেন,'আদম(আঃ) থেকে যা সংঘটিত হয়েছিল তা কবিরা গুনাহ ছিল।ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী (রহ.)-এর থেকে এমনটি বুঝা যায়। শিহাব উদ্দীন আলুসী,রহুল মাআ'নী (৮/৫৮৩)।
আল্লামা তাফজানী(রহ.)-এর অভিমতঃ-
আল্লামা সা'দ উদ্দীন তাফজানী (৭৯২ হি.) নবীদের ইসমত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন,'নবীগণ মিথ্যা হতে পবিত্র।বিশেষ করে শরিয়ত ও রিসালাত প্রচার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ব্যাপারে তারা মিথ্যা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র এবং ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা থেকে পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত।
তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা হতে পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে।অধিকাংশ আলিমদের মতে তারা এ ধরণের মিথ্যা হতে পবিত্র।অন্যান্য যাবতীয় গুনাহ হতে নবীগণ পবিত্র হওয়ার ব্যাপারে কথা রয়েছে।আর তা হচ্ছে এই যে,সকলের ঐক্যমতে নবুওয়্যতের আগে হোক বা পরে হোক নবীগণ কুফুরি হতে পবিত্র।
অনুরুপভাবে অধিকাংশ আলিমদের নিকট তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কবিরা গুনাহ হতেও পবিত্র।আর ভুলবশত কবিরা হওয়ার ব্যাপারে অধিকাংশ আলিমের মতে তা সম্ভব।
জমহুর আলিমদের মতে নবীদের থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছগিরা গুনাহ হতে পারে।আর অনিচ্ছাকৃতভাবে ছগিরা গুনাহ হওয়ার ব্যাপারে সকলেই একমত।'
মোল্লা আলী কারী,মিরকাতুল মাফাতীহ,(৫/১৭২০)।
ঈমাম আবু হানিফা বলেন,নবীগণ ছগীরা গুনাহ,কবিরা গুনাহ,কুফর ও অশালীন কর্ম থেকে পবিত্র ও বিমুক্ত ছিলেন।তবে কখনো পদস্খলন ও ভুলক্রটি তাঁদের হয়েছে।
নুমান বিন সাবিত,আল ফিকহুল আকবার,পৃ, ৩৭; ড খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আল ফিকহুল আকবার,বঙ্গানুবাদ ও ব্যাখ্যা,(প্রকাশক,উসামা খোন্দকার,আস-সুন্নাহ পাবলিকেশন্স,ঝিনাইদহ, প্রকাশকাল;২০১৪)পৃ.৩০৪।
তথ্যসূত্রঃ-আলোচিত অভিযোগের কাঙ্ক্ষিত জবাব,আসলাম হোসাইন, পৃ,(২৫-২৬-৩০-৩১)।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে,ওলামায়ে কেরামের বক্তব্যের সারাংশ হল,নবীগন সর্বাবস্থায় কুফুরি থেকে পবিত্র এবং তারা ইচ্ছাকৃত কবিরা, ছগিরা গুনাহ থেকে মুক্ত।তবে ভুলবশত কবিরা গুনাহ হতে পারে।আর অনিচ্ছাকৃতভাবে ছগিরা গুনাহ হতে পারে।
মাওলনা মওদূদী (রহ) কবিরা গুনাহ তো দূরের কথা,ছগিরা গুনাহর কথাও বলেননি।তিনি শুধু নবীদের দ্বারা ভুলত্রুটি সংঘটিত হয়েছে এটুকু বলেছেন।
“ ইসমতে আম্বিয়া (নবীদের নিস্পাপ হওয়া) সম্পর্কে মাওলানা মওদূদী (রহ) এর আকীদা !!!”
আমার ফেসবুক বন্ধুরা মাঝে মাঝে পেরেশানিতে পড়ে যান এবং ইনবক্সে প্রশ্ন পাঠান যে, ভাই অমুকে বলছে মাওলানা মওদূদী (রহ) সহ জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীদে আকীদা হলো নবীরাও গোনাহ করতে পারেন। তারা দাবি করেন আমরা নবীদের ভূলত্রুটি হতে পারে বলে বিশ্বাস করলেও মওদূদীর ভুল ত্রটি স্বিকার করতে রাজী নই। এই বিষয়ে আপনার মতামত কি ? ”
আমি সোজা উত্তর দিয়ে দেই, আলহামদুলিল্লাহ ! মাওলানা মওদূদীর (রহ) যত আর্টিকেল আমি পড়েছি এবং এই বিষয়ে তিনি যত পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাতে তিনি স্পষ্টভাবে নিজের আকীদা বিশ্বাস বয়ান করেছেন। নবীদের প্রতি মানুষের আকীদা বিশ্বাস কেমন হওয়া উচিত সেটাও তিনি সঠিক ভাবে বিশ্লেষন করে বর্ণনা করে দিয়েছেন। আমাদের বিরুদ্ধে কেউ মিথ্যাচার করে এমন দাবী করলেই হবে না যে, আমরা নবীদের ইসমত নিয়ে সন্দেহ পোষন করি। তাকে প্রমাণ পেশ করতে হবে।
আলহামদুলিল্লাহ মাওলানা মওদূদী সহ প্রত্যেক জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মীদের আকীদাও তাই যেটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতে আকীদা। তবে মাওলানা লেখা না পড়ে কেউ কেউ তার বক্তব্যের খন্ডিত উদ্ধৃতি বা নিজেদের বিশ্লেষনকে মাওলানা বক্তব্য বলে চালিয়ে গিয়ে ফেতনাবাজী করে বেড়াচ্ছেন।
আজকে এমন একটটি উদাহারণ দেবো।
তরজমানুল কোরআনে একজন পাঠক প্রশ্ন করেন, নবীরা যে মা’সুম এটা স্বীকৃত ব্যাপার, কিন্তু হযরত আদম আ সম্পর্কে কোরআনের একটি আয়াত প্রমাণ করে যে, তিনি আল্লাহ পাকের হুকুম অমান্য করে গোনাহ করেছেন। এ সম্পর্কে আপনার গবেষণার ফলাফল জানিয়ে উপকৃত করবেন।
উত্তরে মাওলানা লিখেন-“নবীর মাসুম হওয়ার অর্থ এই নয় যে, ফেরেস্তাদের মতো তারও ভুল করার সম্ভাবনা বিলুপ্ত করা হয়েছে। বরঞ্চ এর প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে,জেনে শুনে নবী কখনো নাফরমানী করেন না। আর তার দ্বারা কোন ভূল হয়ে গেলেও আল্লাহ তায়ালা তাকে সেই ভুলের ওপর কায়েম থাকতে দেন না। ( অহীর সাহায্যে তাকে সঠিক পথ দেখান)।”
এরপরে তিনি লিখেন, “সংক্ষিপ্ত কথায় নীতিগত ভাবে আপনি একথাটিই বুঝে নিন যে, নবীর নিস্পাপ হওয়াটা ফেরেস্তাদের নিস্পাপ হওয়ার মতো নয় যে, ভুল ত্রুটি ও গুনাহ খাতা করার শক্তিই তিনি লাভ করেননি। না তা নয়। বরঞ্চ এর অর্থ হলো, নবুওয়াতের দায়িত্বপুর্ণ পদে অভিষিক্ত করার পর আল্লাহ তায়ালা বিশেষ ভাবে তার হেফাজত ও তত্ত্ববধান করে থাকেন এবং তাকে ভুল ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে থাকেন। কোনো ছোটো খাটো পদস্থলন যদি তার দ্বারা হয়েও যায় তবে অহীর সাহায্যে সাথে সাথে সংশোধন করে দেন, যেনো তার ভ্রান্তি গোটা উম্মাতের গোমরাহীর কারণ না হয়ে দাড়ায়। (তরজমানুল কোরআন রজব-শাওয়াল-১০৬৩ হিঃ, জুলাই - অক্টোবর-১৯৪৪)”
ইসমতে আম্বিয়া সম্পর্কে এরকম দ্যার্থহীন বক্তব্য দেওয়ার পরেও যারা মাওলানার ওপর নবীদের নিস্পাপ হওয়ার আকীদা পোষনা না করার অভিযোগ এনে গোটা জামায়াত শিবিরের কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালান তারা অতি শিগ্রই এর প্রতিফল ভোগ করবেন। মিথ্যার বেশ্যাতি করে বেশি দিন সত্যকে ঢেকে রাখা যায় না, এই মহাসত্যটি এসব ভদ্রলোকরা যত তাড়াতাড়ি উপলদ্ধি করতে পারবেন, ততই তাদের জন্য মঙ্গল, মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণকর।
নবীদের (আ) নিস্পাপ থাকা আর ফেরেস্তাদের নিস্পাপ হওয়ার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে এটা যারা মানেন না তারাই মাওলানা মওদূদী (রহ) এর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে বেড়ান যে, তিনি নবীদের (আ) নিস্পাপ মনে করেন না। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে তার উল্টো। তিনি তার তাযকিয়ায়ে দ্বীন গ্রন্থে স্পষ্ট করে বলেছেন, নবীরা ছাড়া অন্য কারো নিস্পাপ হওয়ার বিশ্বাস লালন করা নির্ভেজাল শীয়া চিন্তাধারা। আমি নবী ছাড়া কাউকে নিস্পাপ মনে করি না।
নবুওয়াতী দায়িত্ব্য পালণ কালে নবীরা (আ) ছোট খাটো সগিরা গুনাহ করতে পারেন মর্মে কয়েকজন ইমামের বক্তব্যকে মাওলানা মওদূদী মানতে অস্বিকৃতি জানিয়ে লিখেছেন, নবুওয়াতের পুর্বে হয়তো কেউ কেউ ছোট খাটো গোনাহ করতে পারেন, কিন্তু নবী হওয়ার পরে তাদের দ্বারা নুন্যতম গোনহা হওয়ার সম্ভবনা নেই। মাঝে মাঝে ছোট খাটো পদস্থলণ হলে তারা সেটাও ওপর কায়েম থাকেন না, অহির সাহায্যে তাদের পথ দেখানো হয়। ফলে ভূল সিদ্ধান্ত বা কর্ম থেকে তারা মাহফুজ থাকেন।
হযরত ইব্রাহিম (আ) এর পক্ষ নিয়ে বুখারীতে বর্ণিত একটি হাদিস- যাতে বলা হয়েছে যে, ইব্রাহিম (আ) জীবনে তিনবার মিথ্যা বলেছেন- তাকে বাতিল করে দিয়েছেন এটা বলে যে, ওটা বর্ণনাকারীর শুনার ভূল। তিনি দাবি করেন, কোন নবী গুনাহ করতে পারেন না, তাও আবার মিথ্যার মতো কদর্যতায় জড়ানোর তো প্রশ্নই আসে না। এ হাদিসের তাহকিক করে তাফহিমুল কোরআনে তিনি তিব্র প্রতিবাদ করেছেন। তাফহিমে তার গোটা আলোচনা মনোযোগ দিয়ে পড়ার পরে যে কোন মানুষ বুঝতে পারবেন যে, যে তিনটি ঘটনায় ইব্রাহিম (আ) এর ওপর মিথ্যা বলার অভিযোগ করা হয়, সেগুলো মোটেও সঠিক নয়।
মনে রাখা দরকার যে, হাদিসের দুটো অংশ, এক সনদ, দুই মতন। অনেক হাদিসের সনদ সহিহ হওয়ার পরেও মতনের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপণ করা হয়েছে অন্যান্য সহিহ হাদিসের দলিল দিয়ে। ফলে সন্দেহযুক্ত সেই হাদিসটি স্বাভাবিক ভাবে শ্রোতার শুনার ভূল হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এরকম হাদিস কয়েকটি রয়েছে। আলোচনা দির্ঘ হওয়ার ভয় না থাকলে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। অন্য দিকে এসব হাদিসকে উদ্ধৃত করেই হাদিস অস্বিকারকারীরা গোটা হাদিস শ্রাস্ত্রকে বাতিল করে দেওয়ার যুদ্ধে নেমেছে। যেটার বিরুদ্ধে দির্ঘকাল মাওলানাকে কলম যুদ্ধ চালাতে হয়েছে।
যে ব্যক্তি একটি সহিহ হাদিস এ কারণে মানতে অস্বিকার করেন যে, এতে নবীদের ইসমতের ওপর অভিযোগ আসতে পারে, তাকে যদি বলা হয় তিনি নবীদের (আ) নিস্পাপ মনে করেন না, তাহলে বিষয়টি কেমন বেমানান হয়ে যায় না ? আসল ঘটনা হচ্ছে কুচক্রিরা মুফতিদের কাছে মাওলানার বিভিন্ন আলোনার ভিতর থেকে একটি বাক্য বা শব্দকে কেটে এনে ফতোয়া জানতে চাইতো, ফলে বিজ্ঞ মুফতিরাও সেই বাক্যের বিপরিতে ফতোয়া দিযে দিতেন, পুরো প্যারা বা আলোচনা দেখার দরকার মনে করতেন না। ফলে সম্মানিত বুজুর্গরা যেমন বিভ্রান্ত হতেন তেমনি আসল ঘটনার বিপরিত রায় দিয়ে দিতেন।
এসব কথায় কান দিয়ে অনেক ভদ্রলোক আমাদের প্রশ্ন করেন, আপনাদের জামায়াত শিবিরের লোকেরা নাকি নবীদের (আ) নিস্পাপ মনে করে না ? তখন হাসি দেওয়া ছাড়া কোন কথাই বলি না। চিন্তা করি, মাওলানা মওদূদীর (রহ) ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্ন মনমানসিতা নিয়ে তার কিতাব পত্র অধ্যায়ণ করলে জ্ঞানী ব্যক্তিদের এ জাতিয় অজ্ঞতার দরিয়ায় হাবুডুব খেতে দেখতে হতো না যে, দৃশ্যমান বিষয়ে অনর্থক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে নিজের ওপর জুলুমের পাশাপাশি তার আরেক ভাইয়ের ওপরও সিমাহীন জুলুম করা থেকে বিরত থাকতো।
আল্লামা মওদুদীর ( রহ) বক্তব্যঃ "এটি একটি সূক্ষ রহস্য যে মহান আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করে প্রত্যেক নবী থেকে কোন না কোন সময় তাঁর হেফাজত উঠিয়ে নিয়ে দু'একটি ভুল ত্রুটি হতে দিয়েছেন যাতে মানুষ নবীদেরকে খোদা না বুঝে।" (তাফহীমাত ২/৪৩) মাওলানা আশরাফ আলী থানবীর ( রহ) বক্তব্যঃ "কোন কোন সময় নবীদের থেকে ভুল ত্রুটি হওয়ার যে ঘটনাসমূহ কুরআনে উল্লেখিত হয়েছে এগুলো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর হেকমত ও রহমত। এর মধ্য এক বড় ফায়দা এও যে মানুষের মনে যেন নবীদের খোদা হওয়ার সন্দেহ না হয়।" (মাজালিসে হাকীমুল উম্মাতঃ মুফতী শফী, ৬৫ পৃষ্ঠা) প্রিয় পাঠক! আল্লামা মওদুদী আর মাওলানা থানবীর বক্তব্যের মাঝে কি অমিল পাওয়া গেছে? না, তবুও এই কারণে আল্লামা মওদুদী কাফের। কিন্তু মাওলানা থানবী কাফের নন ! উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা সুলাইমান নদভীর ( রহ) বক্তব্যঃ "মানুষ হিসেবে তাদের থেকেও ভুল ত্রুটি হতে পারে । কিন্তু আল্লাহ তাঁর ওহীর দ্বারা এসমস্ত ভুল ত্রুটিরও সংশোধন করে থাকেন।" (সিরাতুন্নবী ৪/৭০) আল্লামা নদভীকে কিন্তু এই কথা বলার কারণে কেউ কাফের বা ভ্রান্ত বলেনা। কিন্তু মওদুদী বললেই যত গাত্রদাহ ! ফারায়েয শাস্ত্রের ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর বক্তব্যঃ "আম্বিয়া কিরাম নবুওত প্রাপ্তির পর থেকে ইচ্ছাকৃত কবীরা ও সগীরা গুনাহ থেকে পবিত্র। কিন্তু ভুলবশতঃ কবীরা ও সগীরা গুনাহ হতে পারে।" (ইছমতে আম্বিয়া, ২৮ পৃষ্ঠা) "আদম (আঃ) অবাধ্য ছিলেন। আর অবাধ্য হওয়াকে আমরা কবীরা গুনাহ মনে করি।" (ইছমতে আম্বিয়া, ৩৬ পৃষ্ঠা) এই কথাটি মওদুদী বললে কেমন হত? আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাঃ "ভুলবশতঃ কবীরা গুনাহ হওয়ার ব্যপারে অধিকাংশ আলেমদের মত হলো তা জায়েয ও সম্ভব। এমনকি জমহুর উলামার মতে নবীদের থেকে ছগীরা গুনাহ ইচ্ছাকৃতও হতে পারে।" (কওমী ও আলীয়া মাদ্রাসায় পাঠ্য আকীদার কিতাব শরহে আকাঈদে নসফীঃ ইছমতে আম্বিয়া) ধৈর্যশীল পাঠক! চিন্তা করুন, মওদূদী ( রহ) বলেছেন ভুল হতে পারে। তাতেই তাঁকে ভ্রান্ত, কাফির ইত্যাদি বলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে একশ্রেণীর কাওমী মূর্খ ও মিথ্যাবাদী আলেম অপবাদ দেয় তিনি নাকি নবীদেরকে নিস্পাপ মনে করেন নি! তাদের দলিলঃ উপরোল্লেখিত মওদূদীর বক্তব্য। অথচ যেসকল ইমামরা গুনাহ হতে পারে বলেছেন তাদেরকে কিছু বলা হয়না। এবার কি বুঝতে পেরেছেন সত্যটা ? হোসাইন আহমাদ মাদানী ( রহ) মওদূদীর ( রহ) এই বক্তব্যের জন্য বলেছেন "এবার বলুন জামায়াতে ইসলামী ও এর প্রতিষ্ঠাতা মুসলমান কিনা?" (মওদুদী দস্তর) এ থেকে বুঝা যায় মওদূদীর ( রহ) জ্ঞানের পরিধি হোসাইন মাদানীর (রহ) চেয়ে কত বেশী ছিল ! যারা এতদিন ভুলের মধ্য ছিলেন তারা কি সন্দেহমুক্ত হয়েছেন ? নাকি জামায়াত ইসলামী করা ই তার একমাত্র অপরাধ? নাকি প্রাণের নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনকে পূর্ণাঙ্গ ভাবে অনুসরণ করার চেষ্টায় তার ভূল ? নাকি অন্যান্য আলেমদের মত ইসলামের অর্ধেক মেনে নিয়ে অর্ধেক মেনে অর্ধেক মেনে না নিয়ে চলেন নি তাই তিনি বড় অপরাধী?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন