বাংলাদেশে সুন্নী কারা
বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে কারা আহলে সুন্নত আর কারা আহলে সুন্নত না?
.
ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল বাহরুর রাইক’ (তাকমিলাহ)-এ ফিকহের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘আলহাভী’ থেকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে :
“আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত সে, যার মধ্যে দশটি বৈশিষ্ট্য থাকবে :
১. আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এমন কিছু না বলা যা তাঁর গুণাবলির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২. স্বীকার করা যে, কুরআন আল্লাহর কালাম, তা মাখলুক বা তাঁর সৃষ্টি নয়।
৩. নেককার ও গুনাহগার উভয় শ্রেণির মানুষের পিছনেই জুমুআ ও দুই ঈদের নামায পড়াকে জায়েয মনে করা।
৪. তাকদীরের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়ার বিশ্বাস রাখা।
৫. চামড়ার মোজার উপর মাসাহ করাকে জায়েয মনে করা।
৬. আমীরের বিরুদ্ধে তরবারি উত্তোলন করা থেকে বিরত থাকা।
৭. আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা.-কে অন্য সকল সাহাবি থেকে শ্রেষ্ঠ বিশ্বাস করা।
৮. গুনাহের কারণে কোনো আহলে কিবলাকে কাফের আখ্যা না দেওয়া।
৯. আহলে কিবলার অন্তর্ভুক্ত কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযার নামায আদায় করা।
১০. মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যকে রহমত ও অনৈক্যকে আজাব মনে করা। (আল বাহরুর রাইক, তাকমিলাহ, খ- ৮, পৃ. ১৮২ কিতাবুল কারাহিয়্যাত)
কাশশাফ গ্রন্থকার বলেন :
في هذا الفصل شروط وزيادات لأصحابنا يجب أن تراعى.
এ প্রসঙ্গে আমাদের আলেমগণের আরো কিছু বিষয়াদি রয়েছে, যার প্রতি লক্ষ্য রাখাও অপরিহার্য।
...
উপরের পরিচিতি দ্বারা সমঝদার ও আহলে ইলমের কাছে পরিষ্কার হয়েছে কারা আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত আর কারা আহলে সুন্নত বহির্ভূত।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। এটা অত্যন্ত ভালো একটি দিক। আমাদের দেশে শিয়াদের সংখ্যা ও প্রভাবে একেবারে কম, নগণ্য। শিয়াদের সবাই ঢালাওভাবে কাফের না, তবে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক বিষয় থাকার কারণে তাদের কিছু ফিরকা অবশ্যই কাফের।
বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান ঐতিহ্যগতভাবে হানাফি মাযহাবের অনুসারী এবং প্রায় সবাই তাসাওইফ বা সুফিধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম শাসকদের প্রায় সবাই হানাফি ছিলেন এবং তাদের মাছে সুফি ধারার প্রভাব ছিল। বিখ্যাত মুঘল বাদশা আওরঙ্গযেব আলমগির রহ. এর তত্ত্বাবধানে রচিত হয় হানাফি ফিকহের প্রসিদ্ধ সঙ্কলন ‘ফাতাওয়া আলমগিরি।’ মুঘলদের শেষ সময়ের বিখ্যাত আলেম ও যুগশ্রেষ্ঠ সংস্কারক শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকেই পুরো হিন্দুস্তানের আলেমদের শিরোমণি মনে করা হয়। তাঁর ছেলেদের সময় ইংরেজদের যুগ শুরু হয়। তাঁর ছেলে ও উত্তরসূরিগণের মাঝে তাঁর ইলমি ও চিন্তাগত ধারা অব্যাহত ছিল। যারা জিহাদ ও তাসাওউফের ধারক ছিলেন। শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ. এর চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। দারুল উলুম দেওবন্দ ওয়ালীউল্লাহি চিন্তার ধারক ও বাহক। দারুল উলুম দেওবন্দের মতাদের্শর ওলামায়ে কেরামই উপমহাদেশের ইলমি ও ফিকরি চিন্তার নেতৃত্ব দেন। ফলে স্বভাবই এ উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানদের মাঝে তাসাওউফ ও হানাফি ফিকহের চর্চা বেশি হয়।
বাংলাদেশের মুসলমানদের দিকে তাকালেও আমরা এ বাস্তবতা দেখতে পাব। এখানকার অধিকাংশ মুসলমান হানাফি ফিকহের অনুসারী এবং তাসাওউফের ওপর আমলকারী।
তাসাওউফের দুটি দিক রয়েছে। ভালো দিক এবং খারাপ দিক। ওলামায়ে দেওবন্দ তাসাওউফের ভালো দিকের প্রতিষ্ঠা ও প্রচারকারী। তাসাওউফের ছিদ্রপথে বিদআত ও শরিয়তবিরোধী কিছু প্রকাশ পেলে তারা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন।
হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী রহ. এর পীর ও মুর্শিদ ছিলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রাহিমাহুল্লাহ। একবার গাঙ্গোহী রহ. এর কাছে হাজী সাহেবের একটি পুস্তিকা “ফয়সালা হাফত মাসআলা” পেশ করা হলে তিনি বললেন, এ পুস্তিকা হাম্মামে ফেলে দাও। একজনে সাহস করে জিজ্ঞেস করল, আপনার পীর সাহেবের পুস্তিকা ফেলে দিতে বলছেন?! গাঙ্গোহী রহ. বললেন, আমি তাঁর কাছে তাসাওউফের মুরিদ হয়েছি, ফিকহের ক্ষেত্রে না। ফিকহের অর্থাৎ শরিয়তের বিধানের ক্ষেত্রে তিনি আমাদের অনুসারী, আমরা তাঁর অনুসারী না। (মাজালিসে হাকিমুল ইসলাম, বা-হাওয়ালা খুতুবাতে সাঈদ)
তাসাওউফের নামে অনেক বিভ্রান্তি, কুসংস্কার, রুসম ও বিদআত সমাজে ঢুকেছে, এ কথা অনস্বীকার্য। অনেক বাতিল ফিরকারও জন্ম হয়েছে তাসাওউফের নামে। বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের কার্যক্রম বেশি। বাংলাদেশের তাসাওউফপন্থী বাতিল ফিরকা অনেক।
চার মাযহাবের বাইরেও কিছু মুজতাহিদ ও ইমামগণের মত ছিল এবং আছে। যাদের মাঝে ইবনে হজম জাহেরি, দাউদ জাহেরি রহ. অন্যতম। কিছু বিষয়ে ও মাসআলায় তাঁদের মতোই মত দিয়েছেন আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ও ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহ.। এ দুজন হাম্বলি মাযহাবের অনুসারী ছিলেন।
জাহেরি মতের প্রবক্তারাই কালক্রমে সালাফি, আহলে হাদিস বা লা-মাযহাবি নাম ধারণ করে কিংবা তাদেরকে এসব নামে অভিহিত করা হয়। উল্লেখ্য, পৃথিবীর কোনো খেলাফত বা ইসলামী শাসনই জাহেরি মতে চলতে পারে না। কারণ, ইজতিহাদ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র চলা অসম্ভব। যে কারণে পৃথিবীর সকল খেলাফতই ছিল ইজতিহাদের ওপর কিংবা মাযহাবের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর সর্বশেষ খেলাফত ছিল উসমানি খেলাফত। এই খেলাফতও ছিল হানাফি মাযহাবের অনুসারী। ফলে যতদিন উসমানি খেলাফত কায়েম ছিল ততো দিন জাহেরি মতাদর্শের রাষ্ট্রীয় প্রচার ও পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি।
উসমানি খেলাফতের পতনের পর আরব বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র কায়েম হয় সৌদি আরবে। তাঁদের দীনি আদর্শ ছিল ওয়াহিবজম। যা ছিল হাম্বলি মাযহাবের অনুসারী। আলে সৌদের সন্তানদের হাতে আছে রাষ্ট্র আর দীনি কার্যাবলির নেতৃত্বে রয়েছেন আলে শায়খ। বলে রাখা ভালো, হাম্বলি মাযহাবের অনেক বিষয় জাহেরি মতের সঙ্গে মিলে যায়।
সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্র। একসময় তেল ও স্বর্ণের মাধ্যমে তারা বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ফলে তারা ধর্মীয় ও রাজননৈতিক নেতৃত্বের স্থানে চলে আসে। তারা মুসলিম বিশ্বের সমস্যা নিয়েও কথা বলতে থাকে এবং পুরো বিশ্বের সুন্নি মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে যায়।
ইখওয়ান বা মুসলিম ব্রাদারহুডের কথা আমরা জানি। সৌদি সরকার একসময় ইখওয়ানের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিল। কারণ, মুসলিম বিশ্বের তাবৎ ইসলামী স্কলারগণ ইখওয়ানের নেতৃত্বে ছিলেন। ইখওয়ান সালাফি ধারার না। একসময় সৌদি সরকার মনে করল, ইখওয়ান শক্তিশালী হয়ে গেলে কোনো দিন তাদের রাজত্ব চলে যেতে পারে। শুধু রাজনৈতিক কারণে সৌদি সরকার ইখওয়ানের বিরোধিতা শুরু করে। তাদের বিরোধিতায় মাঠে নামিয়ে দিল জাহেরি মতের লোকদের। এরা সহিহ আকিদা, সালাফি আকিদার নামে মুসলমানদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম কায়েম থেকে দূরে রাখতে চায়। দীন ইসলামকে কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখার এজেন্ডা নিয়ে তারা মাঠে নামে। সৌদি সরকার এখনও এই এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। যে কারণে আমরা বিগত ৩০/৪০ বছর আগেকার সৌদি সরকার এবং বর্তমান সৌদি সরকারের নীতির মাঝে অনেক পার্থক্য দেখতে পাবেন।
সৌদি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের জাহেরি/সালাফি লোকজন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। অনেকে বুঝে আবার অনেকে না বুঝে মুসলমানদের বৃহৎ ঐক্যের মাঝে তারা ফাটল ধরাচ্ছে। শতশত বছর আগের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে মুসলমানদের মাঝে সন্দেহ সংশয় ঢুকাচ্ছে।
সালাফিদের দুটি ধারা। একটি হচ্ছে কট্টরপন্থী। তারা মাযহাবকে শিরকের পর্যায় মনে করে। আরেকটি ধারা উদারপন্থী। তারা মাযহাবের ইমামদের শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তারা নিজেদের মতাদর্শকে উত্তম মনে করলেও হানাফি বা মাযহাবিদের আদর্শকে বাতিল মনে করে না। সংক্ষিপ্ত এই পর্যালোচনার পর আসুন দেখি কারা আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত আর কারা বহির্ভূত?
০১. হানাফি ও দেওবন্দি ঘরানা। তাদের মাঝে অনেক উপঘরানা রয়েছে। যেমন :
ক. তাবলিগ।
খ. জমিয়ত, খেলাফত মজলিস ইত্যাদি রাজনৈতিক দল।
গ. চরমোনাই তরিকা
০২. শাফেয়ি, হাম্বলি, মালেকি মাযহাবের অনুসারী কেউ থাকলে।
০৩. আহলে হাদিসের উদারপন্থী গ্রæপ।
০৪. জামায়াতে ইসলামী। [তবে তাদের কেউ যদি সাহাবাবিদ্বেষ বা এমন কোনো গলদ আকিদা রাখে, তাহলে তারা বহির্ভুত। জামায়াত মূলত দেওবন্দি ঘরানার ফিরকা। কারণ, মাও. মওদুদি রহ. এর উঠাবসা, কর্মকাÐ দেওবন্দি আলেমদের সঙ্গেই ছিল।)
০৫. তাসাওউফপন্থী কিছু ফিরকা। যেমন :
ক. শর্ষিনা, ফুরফুরা, জৌনপুরী, বায়তুশ শরফ, কায়েদ সাহেব রহ. ও তাঁর উত্তরসূরি ইত্যাদি। [তাঁদের মাঝে দুয়েকটা বিষয় প্রশ্নবিদ্ধ। তবে আহলে সুন্নতের মৌলিক বিষয়গুলো উপস্থিত রয়েছে।]
.
আমাদের বর্ণিত এই পাঁচটি ফিরকার মাঝে বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমান চলে আসবে। আমার ধারণা প্রায় ৮০ বা ৮৫ ভাগ হতে পারে।
আর কিছু গ্রুপ বা ফিরকা আছে যাদেরকে আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত বা বহির্ভুত ফয়সালা করা সন্দেপূর্ণ। তাদের মাঝে মানিকগঞ্জের পীর সাহেব ও তার মুরিদান রয়েছে।
.
যারা আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত না
১. এনায়েতপুরি, ২. আটরশি, ৩. চন্দ্রপুরি, ৪. দেওয়ানবাগী, ৫. রাজারবাগী, ৬. মাইজভাণ্ডারী, ৭. সুরেশ্বরী, ৮. বে-শরা পীর-ফকির, ৯. বাউল স¤প্রদায়, ১০. রেজভী/বেরলবী ইত্যাদি।
নির্দিষ্ট ফেরকাকে আহলে সুন্নত বলার মানে এই না যে, তাদের সকল লোকের বিশ্বাস আহলে সুন্নতের মতো। তাদের কেউ কেউ আহলে সুন্নতের বহির্ভুত হতে পারে। তদ্রূপ যাদেরকে আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত করিনি, হতে পারে তাদের কেউ কেউ আহলে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, আহলে সুন্নতের বিশ্বাস তার মাঝে ছিল বা আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন