বর্তমান ইহুদী খৃষ্টানগনকি কাফের (চিরস্থায়ী জাহান্নামী)?
সত্য সন্ধান করেও যারা সত্য খুঁজে পায় না, তাদের পরিণতি কী হবে?
সপ্তম শতাব্দীর মক্কা নগরীতে কুরাইশ গোত্রের আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবী হওয়ার দাবি করেছিলেন, বিশ্ববিধাতার পক্ষ থেকে কোরআন নামক ঐশী বানী প্রাপ্ত হবার ঘোষণা দিয়েছিলেন - কেবল এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলো জানাই কি বান্দার উপর আল্লাহর প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হবার জন্য যথেষ্ট? অথচ আল্লাহ বলছেন,
وَلَوْ أَنَّا أَهْلَكْنَاهُم بِعَذَابٍ مِّن قَبْلِهِ لَقَالُوا رَبَّنَا لَوْلَا أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آيَاتِكَ مِن قَبْلِ أَن نَّذِلَّ وَنَخْزَىٰ
“আমরা যদি (রাসুল প্রেরণ করার) পূর্বেই তাদের আযাব দিয়ে ধ্বংস করতাম, তারা বলত - প্রভু আমাদের! কেন তুমি আমাদের কাছে রাসুল পাঠালে না? লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হওয়ার পূর্বে কেন আমাদেরকে তোমার আয়াতের অনুসরণের সুযোগ দিলে না?” (তাহা ১৩৪)
আল্লাহ রাসুল পাঠাতেন - ভূপৃষ্ঠে মানুষের উপর হুজ্জাত কায়েম বা প্রমাণ প্রতিষ্ঠা করতে, যেন কোন মানুষ রোজ হাশরে আল্লাহর কাছে কোন অজুহাত দেখানোর সুযোগ না পায়। নবীয়ে পাক সা. জাবালে সাফার উপর দাঁড়িয়ে কুরাইশকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এর মাধ্যমেই কি নবী তার দায়িত্ব সমাপ্ত ঘোষণা করেছিলেন? নুহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতি প্রচেষ্টার বিবরণ আল্লাহ কোরআনে দিয়েছেন। মানুষকে কনভিন্স করার জন্য তিনি কতকিছু করেছেন -
رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلَّا فِرَارًا وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا
“প্রভু হে! আমি রাত-দিন আমার কওমকে তোমার দিকে ডেকেছি। আমার আহ্বান যত বেড়েছে ততই তারা আমার কাছ থেকে ভেগেছে। আমি যখনই তাদেরকে ডেকেছি যেন তাদের তুমি ক্ষমা কর, তারা কানে আঙুল ঢুকিয়েছে, কাপড় দিয়ে নিজেদের আড়াল করেছে, একরোখামি করেছে, চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। আমি তো তাদের প্রকাশ্যে দাওয়াত দিয়েছি। তাদের মাঝে উচ্চস্বরে ঘোষণা দিয়েছি। গোপনেও তাদের দাওয়াত দেয়া অব্যাহত রেখেছি।” (নুহ ৮)
এই আলাপ অবতারণার কারণ হচ্ছে, বর্তমানে আমাদের মুসলিম সমাজ থেকে মানুষের ব্যাপারে সহানুভূতি ও এমপ্যাথি বিদায় নিয়েছে। দুনিয়ার সব অমুসলিমকে এক কাতারে এনে দেখার যে স্বভাব তৈরি হয়েছে তার অসারতা স্পষ্ট করতে এই আলাপ প্রয়োজন। আমি এখানে ফিকহ বা আইন নিয়ে কথা তুলছি না। ফিকহি আইন-কানুন মানুষকে তার বাহ্যিক অবস্থার ওপর বিচার করে। ফিকহি বিধান অনুযায়ী, আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের ন্যায় কুখ্যাত মুনাফেকও কেবল বাহ্যিকভাবে ইসলাম পালনের কারণে সমাজে মুসলিম হিসেবে সামাজিক মর্যাদা পায়, মৃত্যুর পর শরয়ী জানাজা পায়, এমনকি মুসলিমদের কবরস্থানেও তার লাশের মাটি হয়। এই আলোচনায় আমার লক্ষ্য হচ্ছে, আধ্যাত্মিক জায়গা থেকে বিষয়টি এক্সপ্লোর করা, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যবর্তী সম্পর্কের দিক থেকে অমুসলিমদের পরিণতি নিয়ে চিন্তা করা। নিঃসন্দেহে যমিনের প্রত্যেক অমুসলিম সমপর্যায়ের নয়। বহু বিধর্মী এমন আছে যাদের কাছে ইসলামের নামটুকুই কেবল পৌঁছেছে, এবং সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বদনাম। ইসলামের বাস্তবতা ও এর প্রকৃত বাণী সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই নেই। বরং উলটো ইসলামোফোবিক মিডিয়ার কারণে তাদের মনে ইসলাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি ছবি তৈরি রয়েছে। এই শ্রেণির যারা অমুসলিম, তাদের অনেকেই আছেন যারা বিনয়ী। যাদেরকে বুঝিয়ে বললে, হয়ত তারা বুঝত। কিন্তু সেই তৌফিক তাদের দুনিয়াতে নসিব হয় নি।
ইমাম গাযালী রহিমাহুল্লাহ তার “ফায়সালুত তাফরিকা” গ্রন্থে বলেছেন,
بل أقول أكثر نصارى الروم والترك في هذا الزمان تشملهم الرحمة أعني الذين هم في أقاصي الروم والترك ولم تبلغهم الدعوة فإنهم ثلاثة أصناف صنف لم يبلغهم اسم محمد أصلا فهم معذورون وصنف بلغهم اسمه وبعثه وما ظهر عليه من المعجزات وهم المجاورون لبلاد الإسلام والمخالطون لهم وهم الكفار المخلدون وصنف ثالث بين الدرجتين بلغهم اسم محمد ولم يبلغهم بعثه وصفته بل سمعوا منذ الصبا أن كذابا ملبسا اسمه محمد ادعى النبوة كما سمع صبياننا أن كذابا يقال له المقنع تحدى النبوة كاذبا فهؤلاء عندي في معنى الصنف الأول فإنهم مع انهم لم يسمعوا صفته سمعوا ضد أوصافه وهذا لا يحرك داعية النظر والطلب
“বরং আমি বলি বর্তমান সময়কার অধিকাংশ রোম (ইউরোপীয়) ও তুর্করা (মধ্যএশীয়) আল্লাহর রহমতে শামিল হবে। আমি তাদের কথা বলছি যারা রোম ও তুর্কের প্রান্তবর্তী অঞ্চলে থাকে। যাদের কাছে দাওয়াত পৌঁছে নি তাদের তিনটি শ্রেণী আছে।
প্রথম - যাদের কাছে মুহাম্মদের নামই পৌঁছে নি। তারা ওজরপ্রাপ্ত।
দ্বিতীয় - যাদের কাছে তার নাম পৌঁছেছে, তার আগমণের সংবাদ পৌঁছেছে, তার মুজেযার বৃত্তান্ত পৌঁছেছে; যারা মুসলিমদের দেশগুলোর প্রতিবেশী এবং মুসলিমদের সাথে মেলামেশা করে। তারাই স্থায়ী শাস্তির যোগ্য কাফের।
তৃতীয় - যারা এই দুইয়ের মাঝামাঝি। তাদের কাছে মুহাম্মদের নাম পৌঁছেছে, তবে তার আগমণ ও বিবরণ যথাযথ পৌঁছে নি, বরং শৈশব থেকেই তারা শুনেছে যে মুহাম্মাদ নামধারী এক মিথ্যুক নবুওতের দাবি করেছে, যেমনটি আমাদের শিশুরা শুনে থাকে যে মুকাফ্ফা নামক মিথ্যুক নিজেকে নবি দাবি করেছে। আমার কাছে এই শ্রেণী প্রথম শ্রেণীর মতই কারণ তাদের কাছে যথাযথ বিবরণ পৌঁছার বদলে বিকৃত বিবরণ পৌঁছেছে, যা চিন্তাভাবনা ও অনুসন্ধান করার আগ্রহ তৈরি করে না।”
সুত্র : ফায়সালুত তাফরিকা, পৃষ্ঠা ১০৪-৫, দারুল মিনহাজ।
ইমাম ইবনে কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ “তরিকুল হিজরাতাইন” গ্রন্থে পুরো বিষয়টা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন,
لا بدَّ في هذا المقام من تفصيل به يزول الإشكال، وهو الفرق بين مقلّد تمكن من العلم ومعرفة الحق فأعرض عنه، ومقلّد لم يتمكن من ذلك بوجه، والقسمان واقعان في الوجود. فالمتمكن المعرض مفرِّط تارك للواجب عليه، لا عذر له عند اللَّه. وأمّا العاجز عن السؤال والعلم الذي لا يتمكن من العلم بوجه، فهم قسمان أيضًا:
أحدهما: مريد للهدى مؤثر له محبٌّ له، غير قادر عليه ولا على طلبه لعدم من يرشده، فهذا حكمه حكم أرباب الفترات، ومن لم تبلغه الدعوة.
الثاني: معرِض لا إرادة له، ولا يحدِّث نفسه بغير ما هو عليه.
“এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা আবশ্যক যাতে সংশয় দূর হয়। সেটা হচ্ছে জ্ঞান অর্জন ও সত্যকে চেনার সক্ষমতা থাকা সত্তেও এর প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে এমন মুকাল্লিদ এবং যার পক্ষে কোন সামর্থ ছিল না এমন মুকাল্লিদের মাঝে পার্থক্য করা। এই দুই প্রকারের মুকাল্লিদেরই অস্তিত্ব আছে। (মুকাল্লিদ হচ্ছে সে ব্যক্তি যে অন্যের অনুকরণে কোন কিছু করে থাকে)
সক্ষমতা সত্তেও অবহেলাকারী তার কর্তব্য পরিত্যাগ করেছে, আল্লাহর সামনে তার কোন অজুহাত নেই। অন্যদিকে প্রশ্ন করা ও জানার ক্ষেত্রে অপারগ ব্যক্তি যার জ্ঞান লাভের কোন সুযোগ নেই, তাদের দুইটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগ হচ্ছে, যারা সত্যের প্রতি উন্মুখ, সত্যকে প্রাধান্য দেয় ও ভালবাসে। তবে সত্যকে খুঁজে পায় না কারণ তাকে পথ দেখানোর কেউ নেই। এই শ্রেণীর লোকদের হুকুম ফাতরাত বা নবির অনুপস্থিতির সময়কার মানুষ ও দাওয়াত পৌঁছায় নি এমন মানুষের মতই। দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে, যারা উপেক্ষা প্রদর্শনকারী, সত্যের ব্যাপারে অনাগ্রহী। সে নিজে যে অবস্থায় আছে তা ব্যতিরেকে তার মনে কিছু আসে না।”
فالأول يقول: يا ربّ لو أعلم لك دينًا خيرًا مما أنا عليه لَدِنْتُ به وتركت ما أنا عليه، ولكن لا أعرف غير ما أنا عليه ولا أقدر على غيره، فهو غاية جهدي ونهاية معرفتي. والثاني راضٍ بما هو عليه، لا يؤثر غيره عليه، ولا تطلب نفسه سواه؛ ولا فرق عنده بين حال عجزه وقدرته، وكلاهما عاجز. وهذا لا يجب أن يلحق بالأول لما بينهما من الفرق. فالأول كمن طلب الدين في الفترة ولم يظفر به، فعدل عنه بعد استفراغه الوسعَ في طلبه عجزًا وجهلًا. والثاني كمن لم يطلبه، بل مات على شركه، وإن كان لو طلبه لَعَجز عنه. ففرق بين عجز الطالب وعجز المعرض. فتأمّل هذا الموضع
“প্রথম ভাগের লোকেরা মনে মনে বলে, হে প্রভু! আমি যে ধর্মের উপর আছি তার চেয়ে উত্তম কোন ধর্ম যদি আমি জানতাম, তবে আমি সেই ধর্মই গ্রহণ করতাম এবং আমি যে ধর্মে আছি সেটা ত্যাগ করতাম। কিন্তু আমি নিজের ধর্ম ছাড়া আর কোন ধর্ম জানি না এবং জানার সামর্থও আমার নেই। আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা ও চূড়ান্ত জ্ঞান এতটুকুই।
অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগের লোকেরা নিজেরা যে অবস্থায় আছে তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট আছে, এর উপর ভিন্ন কোন কিছুকে প্রাধান্য দেয় না, ভিন্ন কিছু সন্ধানও করে না। তার কাছে সামর্থ আছে কি নেই তা নিয়ে কোন পরোয়া নেই।
যদিও এই দুই ভাগই সত্যকে জানার ব্যাপারে অক্ষম কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের লোকদের প্রথম প্রকারের সাথে মেলানো অনুচিত, কারণ তাদের অবস্থার মাঝে পার্থক্য আছে। প্রথম প্রকারের মানুষগুলো হল ফাতরাতের সময়কার সেই মানুষদের মত যারা সত্য ধর্ম সন্ধান করেও এর সন্ধান পায় নি। এই সন্ধানে সর্বাত্মক শক্তি ব্যয় করার পর সে অক্ষমতা ও অজ্ঞতার কারণে পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষগুলো কোন খোঁজই করে নি। বরং শিরকের অবস্থাতেই মারা গেছে। হতে পারে সে সন্ধান করলেও খুঁজে পেত না। কিন্তু সন্ধান করেও ব্যর্থ হওয়া এবং উপেক্ষার কারণে ব্যর্থ হওয়া সমান না। সুতরাং এই বিষয়টা ভেবে দেখ।”
واللَّه يقضي بين عباده يوم القيامة بحكمه وعدله، ولا يعذّب إلَّا من قامت عليه حجته بالرسل، فهذا مقطوع به في جملة الخلق. وأمّا كون زيد بعينه وعمرو بعينه قامت عليه الحجة أم لا، فذلك مما لا يمكن الدخول بين اللَّه وبين عباده فيه. بل الواجب على العبد أن يعتقد أنّ كلّ من دان بدين غير دين الإسلام فهو كافر، وأن اللَّه سبحانه لا يعذّب أحدًا إلَّا بعد قيام الحجة عليه بالرسول. هذا في الجملة، والتعيين موكول إلى علم اللَّه عزّ وجلّ وحكمه. هذا في أحكام الثواب والعقاب، وأما في أحكام الدنيا فهي جارية على ظاهر الأمر. فأطفال الكفّار ومجانينهم كفّار في أحكام الدنيا، لهم حكم أوليائهم.
وبهذا التفصيل يزول الإشكال في المسألة. وهو مبنيّ على أربعة أصول :
“আল্লাহ কেয়ামতের দিন তাঁর বান্দাদের উপর তাঁর প্রজ্ঞা ও ন্যায়পরায়নতা অনুযায়ী বিচার করবেন। তিনি এমন কাউকে শাস্তি দিবেন না যার উপর রাসুলদের মাধ্যমে হুজ্জাত কায়েম বা প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হয় নি। সৃষ্টির সকলের ব্যাপারে অকাট্যভাবে এটা বলা যায়। তবে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি যেমন যায়দের উপর হুজ্জাত কায়েম হয়েছে কিনা কিংবা আমরের উপর হয়েছে কিনা এই বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে অনুপ্রবেশের সুযোগ কারো নেই। বরং প্রত্যেকের উপর ওয়াজিব হল এই কথায় বিশ্বাস করা যে, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মের অনুসারী কাফের। আর আল্লাহ রাসুলের মাধ্যমে প্রমাণ প্রতিষ্ঠা বিনা কাউকে শাস্তি দিবেন না। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কোন মানুষের পরিণতি কী হবে তা আল্লাহর জ্ঞানের কাছেই ছেড়ে দিতে হবে। এটা হচ্ছে পুরষ্কার ও শাস্তির হিসেবে বলা। তবে দুনিয়ার বিধিবিধানের ক্ষেত্রে বাহ্যিক অনুযায়ী কাজ নেয়া হবে। কাফেরদের শিশু, পাগলদের দুনিয়ার বিচারে কাফের ধরা হবে এবং তাদের জন্য তাদের অভিভাবকদের অনুরূপ বিধান সাব্যস্ত করা হবে। আর এই বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই বিষয়ে সন্দেহ-সংশয় দূর হয়ে যায়। মূলত চারটি মূলনীতির উপর এই বক্তব্য দাঁড়িয়ে আছে।
أحدها: أن اللَّه سبحانه لا يعذب أحدًا إلَّا بعد قيام الحجة عليه، كما قال تعالى: {وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا } [الإسراء/ 15]. وقال: {رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ} [النساء/ 165]. وقال: {كُلَّمَا أُلْقِيَ فِيهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيرٌ قَالُوا بَلَى قَدْ جَاءَنَا نَذِيرٌ فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ} [الملك/ 8 - 9]. وقال تعالى: {فَاعْتَرَفُوا بِذَنْبِهِمْ فَسُحْقًا لِأَصْحَابِ السَّعِيرِ } [الملك/ 11]. وقال تعالى: {يَامَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَذَا قَالُوا شَهِدْنَا عَلَى أَنْفُسِنَا وَغَرَّتْهُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَشَهِدُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَنَّهُمْ كَانُوا كَافِرِينَ } [الأنعام/ 130]. وهذا كثير في القرآن، يخبر أنَّه إنَّما يعذب من جاءَه الرسول وقامت عليه الحجة، وهو المذنب الذي يعترف بذنبه.
وقال تعالى: {وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَكِنْ كَانُوا هُمُ الظَّالِمِينَ } [الزخرف/ 76]. والظالم من عرف ما جاءَ به الرسول أو تمكن من معرفته، ثمَّ خالفه وأعرض عنه. وأمَّا من لم يكن عنده من الرسول خبر أصلًا، ولا تمكن من معرفته بوجه، وعجز عن ذلك، فكيف يقال إنَّه ظالم؟
“প্রথম মূলনীতি হচ্ছে, পবিত্র আল্লাহ কেবলমাত্র প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হবার পরই কাউকে শাস্তি দেন। যেমনটি তিনি বলেছেন, "রাসুল না পাঠিয়ে আমি শাস্তি দেবার নই" (ইসরা ১৫) আরো বলেছেন, "রাসুলগণ সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী। যাতে রাসুলদের পর মানুষের কাছে আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি না থাকে।" (নিসা ১৬৫) আল্লাহ বলেছেন, "যখনই তাদের কোন দলকে ওতে নিক্ষেপ করা হবে, প্রহরীরা বলবে তোমাদের কাছে কি সতর্ককারী কেউ আসে নি? তারা বলবে, হ্যাঁ সতর্ককারী এসেছিল। কিন্তু আমরা তাদের মিথ্যুক সাব্যস্ত করেছি এবং বলেছি আল্লাহ কোন কিছুই নাযিল করেন নি।" (মুলক ৮-৯) আল্লাহ বলেছেন, "তারা তাদের দোষ স্বীকার করবে। ধিক্কার হোক আগুনের অধিবাসীদের জন্য।" (মুলক ১১) আল্লাহ বলেছেন, "হে জিন ও মানবজাতি! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকেই রাসুলগণ আসে নি, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতগুলোর বিবরণ শোনাবে এবং এই দিনের সাক্ষাত লাভের ব্যাপারে সতর্ক করবে? তারা বলবে, হ্যাঁ এসেছে। আমরা নিজেদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছি। মূলত দুনিয়ার জীবন তাদের ধোঁকায় ফেলেছিল এবং তারা নিজেদের ব্যাপারেই সাক্ষ্য দিয়েছে যে, তারা ছিল কাফের।" (আনআম ১৩০) এরকম আয়াত কোরআনে বহু আছে যাতে আল্লাহ জানিয়েছেন যে, তিনি কেবল তাদেরই শাস্তি দিবেন যাদের কাছে রাসুল এসেছে এবং প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। আর সেই হচ্ছে অপরাধী যে তার দোষ স্বীকার করবে। আল্লাহ বলেছেন, "আমি তাদের উপর যুলুম করি নি, তারা নিজেরাই ছিল যালেম" (যুখরুফ ৭৬)
যালেম হল সেই ব্যক্তি যে রাসুল যা নিয়ে এসেছেন তা জানে কিংবা জানার সামর্থ্য রাখে, এসত্তেও সে বিরোধিতা করে কিংবা উদাসীনতা প্রদর্শন করে। অন্যদিকে যার কাছে রাসুলের খবর একদমই পৌঁছে নি, কোনভাবেই সেটা জানা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি, ফলে সে জানতে অক্ষম হয়েছে, তার ব্যাপারে কী করে বলা যায় যে, সে যালেম?
الأصل الثاني: أنَّ العذاب يُستَحَق بشيئين: أحدهما: الإعراضُ عن الحجة، وعدمُ إرادة العلم بها وبموجَبها. الثاني: العنادُ لها بعد قيامها، وترك إرادة موجبها. فالأَوَّل كفر إعراض، والثاني كفر عناد وأما كفر الجهل مع عدم قيام الحجة وعدم التمكن من معرفتها، فهذا الذي نفى اللَّه التعذيب عليه حتَّى تقوم حجَّته بالرسل.
“দ্বিতীয় মূলনীতি : দুইটি বিষয় বিদ্যমান থাকলেই কেউ আযাবের উপযুক্ত হয়। এক - প্রমাণের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন, একে ও এর নির্দেশনাকে জানার ব্যাপারে আগ্রহ না রাখা। দুই - প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হবার পর বিদ্রোহ করা এবং এর নির্দেশনার প্রতি ইচ্ছা-আগ্রহ বর্জন করা। প্রথমটি হল - উপেক্ষা করার কুফর, দ্বিতীয়টি হল - বিদ্রোহ করার কুফর। অন্যদিকে অজ্ঞতার কারণে যে কুফর সেটা হল প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং তা জানার সামর্থ না থাকার ক্ষেত্রে। এই প্রকারের ব্যক্তিদের ব্যাপারে আল্লাহ শাস্তি প্রদানের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন যতক্ষণ তাদের উপর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে।
الأصل الثالث: أنَّ قيام الحجة يختلف باختلاف الأزمنة والأمكنة والأشخاص، فقد تقوم حجة اللَّه على الكفار في زمان دون زمان، وفي بقعة وناحية دون أخرى. كما أنَّها تقوم على شخص دون آخر، إمَّا لعدم عقله وتمييزه كالصغير والمجنون، وإمَّا لعدم فهمه كمن لا يفهم الخطاب، ولم يحضر ترجمان يُترجِم له، فهذا بمنزلة الأصمّ الذي لا يسمع شيئًا ولا يتمكّن من الفهم. وهو أحد الأربعة الذين يُدْلُون على اللَّه بالحجَّة يوم القيامة، كما تقدَّم في حديث الأسود وأبي هريرة وغيرهما.
“তৃতীয় মূলনীতি হল, প্রমাণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি আপেক্ষিক বিষয়। স্থান, কাল, পাত্র অনুযায়ী এটি ভিন্ন হতে পারে। এমন হতে পারে যে, কোন এক যুগের কাফেরদের উপর আল্লাহর প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু অন্য যুগে হয় নি। কোন একটি স্থানে হয়েছে, কিন্তু অন্য স্থানে হয় নি। কোন এক ব্যক্তির উপর হয়েছে, কিন্তু অন্য ব্যক্তির উপর হয় নি, হয়তবা তার বিবেক-বুদ্ধি না থাকার কারণে যেমন শিশু কিংবা পাগল; অথবা কথাবার্তা না বোঝার কারণে, যেমন কোন অনুবাদক উপস্থিত না থাকার কারণে যে তাকে অনুবাদ করে বুঝিয়ে দিবে। এই ব্যক্তির দৃষ্টান্ত বধির ব্যক্তির মতই যে কিছু শুনতে পায় নি এবং ফলে বোঝাও সম্ভব হয় নি। আর সে ঐ চার প্রকারের অন্তর্ভূক্ত যারা কেয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে নিজেদের পক্ষে যুক্তি পেশ করবে, যেমনটি আসওয়াদ ও আবু হুরায়রার হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে।
الأصل الرَّابع: أنَّ أفعال اللَّه عزَّ وجلَّ تابعة لحكمته التي لا يخلّ بها سبحانه، وأنَّها مقصودة لغاياتها المحبوبة وعواقبها الحميدة
“চতুর্থ মূলনীতি হল - মহামহিম আল্লাহর সকল কাজকর্ম তাঁর হিকমত ও প্রজ্ঞার অধীন এবং এই হিকমতের মাঝে কোন ত্রুটিবিচ্যুতি নেই। আর আল্লাহর সকল কাজকর্ম উদ্দেশ্যের দিক থেকে পছন্দনীয় ও পরিণতির দিক থেকে প্রশংসনীয়।”
সুত্র : তরিকুল হিজরাতাইন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৮৯৯-৯০২।
ইমাম জাহেয রহিমাহুল্লাহ এই বিষয়গুলো তার এক বক্তব্যে তুলে ধরেছেন, যা গাযালী তার “আল মুসতাসফা” গ্রন্থে নিজ ভাষায় উল্লেখ করেছেন –
ذهب الجاحظ إلى أن مخالف ملة الاسلام من اليهود والنصارى والدهرية إن كان معاندا على خلاف اعتقاده فهو آثم، وإن نظر فعجز عن درك الحق فهو معذور غير آثم، وإن لم ينظر من حيث لم يعرف وجوب النظر فهو أيضا معذور، وإنما الآثم المعذب هو المعاند فقط، لان الله تعالى لا يكلف نفسا إلا وسعها وهؤلاء قد عجزوا عن درك الحق ولزموا عقائدهم خوفا من الله تعالى إذ استد عليهم طريق المعرفة
“জাহেযের মতে, ইসলাম ধর্ম বিরোধিতাকারী ইহুদি, নাসারা, নাস্তিকরা যদি তাদের অন্তরের বিশ্বাসের বিপরীতে গিয়ে সত্যের প্রতি বিদ্রোহমূলক মনোভাব থেকে ইসলাম বিরোধী হয়, তবে তারা গুনাহগার। কিন্তু যদি তারা চিন্তা ও অনুসন্ধান করে, আর এসত্তেও সত্যকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়, তবে সে অপারগ ওজরপ্রাপ্ত, গুনাহগার না। এমনকি যদি সে চিন্তা ও অনুসন্ধান করার আবশ্যকতা না জানার কারণে চিন্তা-অনুসন্ধান না করে থাকে, তবে সেও ওজরপ্রাপ্ত হবে। গুনাহগার ও শাস্তিযোগ্য হবে কেবল সে যে, সত্য জেনেও বিদ্রোহ করে। কারণ আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যাতীত বোঝা আরোপ করেন না। আর এই মানুষগুলো সত্য জানার ক্ষেত্রে অক্ষম হয়েছে, এবং সত্য জানার পথ রুদ্ধ থাকায় এবং আল্লাহর ভয়ে, তাদের পূর্ব বিশ্বাসকেই আঁকড়ে থেকেছে।”
ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি তার প্রথিতযশা “হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা” গ্রন্থে এই বিষয়ে নিজের যে মত ব্যক্ত করেছেন তা উপরে উল্লিখিত ইমামদের মতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনি বলেন,
أصحاب الأعراف وهم جنسان : قوم صحت أمزجتهم ، وزكت فطرتهم ، ولم تبلغهم الدعوة الإسلامية أصلا أو بلغتهم ، ولكن بنحو لا تقوم به الحجة ، ولا تزول به الشبهة فنشأوا غير منهمكين في الملكات الخسيسة والأعمال المردية ولا ملتفتين إلى جناب الحق لا نفيا ، ولا إثباتا ، كان أكثر أمرهم الاشتغال بالارتفاقات العاجلة ، فأولئك إذا ماتوا رجعوا إلى حالة عمياء لا إلى عذاب ، ولا إلى ثواب حتى تنفسخ بهيمتهم ، فيبرق عليهم شيء من بوارق الملكية . وقوم نقصت عقولهم كأكثر الصبيان والمعتوهين والفلاحين والأرقاء ، وكثير يزعمهم الناس أنهم لا بأس بهم ، وإذا نقح حالهم عن الرسوم بقوا لا عقل لهم ، فأولئك يكتفي من إيمانهم بمثل ما اكتفى رسول الله صلى الله عليه وسلم من الجارية السوداء سألها ' أين الله ' فأشارت إلى السماء ، إنما يراد منهم أن يتشبهوا بالمسلمين لئلا تتفرق الكلمة . أما الذين نشأوا منهمكين في الرذائل والتفتوا إلى جناب الحق على غير الوجه الذي ينبغي أن يكون ، فهم أهل الجاهلية يعذبون بأصناف العذاب
“জান্নাত ও জাহান্নাম ছাড়াও আরাফ নামের যে মনযিল রয়েছে, তার বাসিন্দা হবে দুই শ্রেণির লোক। প্রথম দলে আছে তারা যাদের সুস্থ মস্তিষ্ক ও শুদ্ধ বিবেক আছে, কিন্তু তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত একদম পৌঁছেই নি কিংবা পৌঁছলেও এমনভাবে পৌঁছেছে যার মাধ্যমে প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত হয় না, সংশয়-সন্দেহ দূরও হয় না। এরা নিজেদের জীবন নিকৃষ্ট ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডেও অতিবাহিত করে নি, আবার সত্য অনুসন্ধানের ব্যাপারে কোন অবস্থানও গ্রহণ করে নি - হ্যাঁ-ও বলে নি, না-ও বলে নি। এদের অধিকাংশের জীবন পাড় হয়েছে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ায় উপকার লাভের ধান্দায়। এই শ্রেণির মানুষজন যখন মারা যাবে তখন তারা দিশেহারা অবস্থায় ফিরে যাবে, তারা আযাবের দিকেও যাবে না, সোয়াবের দিকেও না, যতক্ষণ তাদের মধ্যকার পশুবৃত্তি লোপ পেয়ে ফেরেশতাসুলভ কিছু গুণ উদ্ভাসিত না হচ্ছে।
দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে - যাদের বিবেক-বুদ্ধি ত্রুটিপূর্ণ যেমন অধিকাংশ শিশু, পাগল, কৃষক ও দাসশ্রেণি। অনেকেই তাদের ব্যাপারে ভাবে যে, তাদের ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আবরণ সরিয়ে তাদের প্রকৃতাবস্থা বিচার করলে দেখা যায় যে, তাদের আকল-বুদ্ধি নেই। এই শ্রেণির মানুষের জন্য সেই পর্যায়ের ঈমান আনাই যথেষ্ট যে পর্যায়ের ঈমান আল্লাহর রাসুল সা. সেই ক্রীতদাসীর জন্য যথেষ্ট মনে করেছিলেন যাকে নবিজি ‘আল্লাহ কোথায়?’ প্রশ্ন করলে সে আসমানের দিকে ইশারা করে। এই শ্রেণির মানুষের কাছে কেবল চাওয়া হয় যেন তারা মুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য গ্রহণ করে এবং সমাজে তাদের সাথে মিলেমিশে থাকে।
কিন্তু যারা জঘন্য কাজকর্ম করে জীবন কাটিয়েছে এবং সত্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে যথাযথ পদ্ধতি গ্রহণ করে নি, তবে তারা জাহেলি যুগের লোকদের মতই। নানান প্রকারের আযাব তাদেরকে দেয়া হবে।”
সুত্র: হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা, ১/২৪৫-৬।
এই আলোচনা থেকে আমরা যেটা বুঝতে পারলাম – এমনও অনেক অমুসলিম আছে যাদের উপর হুজ্জাত প্রতিষ্ঠা হয় নি এবং তারা আল্লাহর রহমতে অন্তর্ভূক্ত হবার সম্ভাবনা রাখে। এছাড়াও জানা গেল যে, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যবর্তী বিষয়ে আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই। কে জান্নাতে যাবে, আর কে জাহান্নামে যাবে এই জ্ঞান ওহি ছাড়া কারোরই জানার সুযোগ নেই। বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে দেখা যায়, কোন বিধর্মীর মৃত্যুর পর রেস্ট ইন পিস বলা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলে তারা ধরেই নেয় যে, আল্লাহর দরবারে সেই অমুসলিমের কোন ওজর-অজুহাত নেই, আল্লাহ তাঁর ওপর দয়া করবেন না, তাকে ক্ষমা করে জাহান্নাম থেকে রেহাই দিবেন না। মূলত এ সবই অজ্ঞতাপ্রসূত মানসিকতা যার অবসান ঘটা জরুরি।
নিঃসন্দেহে যারা মুসলমান হয়েছে এবং যারা ইহুদী, নাসারা ও সাবেঈন, (তাদের মধ্য থেকে) যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি ও কিয়ামত দিবসের প্রতি এবং সৎকাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে তার সওয়াব তাদের পালনকর্তার কাছে। আর তাদের কোনই ভয়-ভীতি নেই, তারা দুঃখিতও হবে না। (সুরা বাকারাহঃ ৬২)
আল্লাহ্ তা‘আলা প্রকৃত মু’মিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে এরশাদ করেন :
الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الألْبَابِ
“যারা কথা শ্রবণ করে, অতঃপর তার মধ্য থেকে সর্বোত্তমটি অনুসরণ করে; এরাই হচ্ছে এমন লোক আল্লাহ্ যাদেরকে পথপ্রদর্শন করেছেন এবং এরাই প্রকৃত বুদ্ধিমান। ” (সূরাহ্ আয্-যুমার্ : ১৮)
এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা কোনো কথা কে বলেছে তা বিবেচনা করতে বলেন নি, বরং কী বলেছে তা-ই বিবেচনা করতে বলেছেন।
বলা বাহুল্য যে, আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে বিশেষভাবে মনোনীত ব্যক্তিগণ (‘আঃ) ব্যতীত যে কারোই কোনো কথা ভুল বা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে এমনও হতে পারে যে, একটি বিষয়ে একজন বিরাট জ্ঞানী ভুল কথা বলতে পারেন এবং একই বিষয়ে একজন সাধারণ মানুষের কথা সঠিক হতে পারে। সুতরাং কে বলছে তা না দেখে কী বলছে তা-ই বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু একান্ত বিরল ব্যতিক্রম বাদে আমরা এমন মুসলমান যারা কে বলছে তার ভিত্তিতে বক্তব্য বিবেচনা করি; আমরা আমাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের কথার সাথে না মিললে এমনকি কোরআন মজীদের বক্তব্য মেনে নিতেও প্রস্তুত হই না। আমরা সাধারণতঃ অকাট্য ‘আক্বলী দলীল ও কোরআন মজীদের বক্তব্যের প্রতি ব্যক্তির বক্তব্যের চশমার ভিতর দিয়ে দৃষ্টিপাত করি, যদিও উচিত হচ্ছে অকাট্য ‘আক্বলী দলীল ও কোরআন মজীদের বক্তব্যের চশমার ভিতর দিয়ে ব্যক্তির বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করা।
তবে প্রকৃত জ্ঞানী ব্যক্তিগণ উপরোদ্ধৃত আয়াত অনুযায়ী আমল করেন এবং যে কারো বক্তব্য সঠিক হিসেবে পেলে গ্রহণ করেন; যার বক্তব্য সে জ্ঞানী কিনা তা বিবেচনা করেন না। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় একাধিক ঘটনায় এটা দেখেছি।
১৯৮০-র দশকের শুরুর দিকে Ñ যখন আমার বয়স মাত্র ত্রিশ এবং আমি দেশের শ্রেষ্ঠতম ইসলামী চিন্তাবিদ ও অর্থনীতিবিশেষজ্ঞ মওলানা আবদুর রহীম (র.)-এর মালিকানাধীন সাপ্তাহিক জাহানে নও-এ চাকরি করছিলাম Ñ অর্থনীতি বিষয়ক তাঁর একটি মতের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করলে তাঁর কাছে সেটি সঠিক মনে হয় এবং তিনি সেটি ইসলামিক ইকোনোমিকস্ রিসার্চ ব্যুরোর বৈঠকে লিখিতভাবে পেশ করতে বলেন। আমি তা-ই করি এবং বৈঠকে সকলে আমার মতকে সঠিক বলে গ্রহণ করেন।
আমি তেহরানে বুনিঅদে আন্দিশে ইসলামীতে চাকরি করার সময় (১৯৮৭-১৯৯২) যখন বিকাল বেলা ইরাকী উস্তাদ অধ্যাপক মোহাম্মাদ কাযেম গারাভীর নিকট আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা করছিলাম তখন ইবনে হিশামের “শারহে ক্বাত্বরুন্-নাদা ওয়া বাললুছ ছাদা” গ্রন্থ অধ্যয়নের এক পর্যায়ে ইবনে হিশামের একটি মতের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করি এবং তার কারণ ব্যাখ্যা করি; উস্তাদ আমার মতের সত্যায়ন করেন এবং বলেন : ইবনে হিশাম্ এখানে ভুল করেছেন।
বুনিঅদে আমার চাকরির শুরুর দিকে আমি যখন মাসিক একো অব্ ইসলাম্-এর সহকারী সম্পাদক ছিলাম তখন এর সম্পাদক হুজ্জাতুল ইসলাম বাহমানপূর-এর সাথে একটি ফিক্বহী মাস্আলাহর ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করি এবং আমার যুক্তি শোনার পর তিনি আমার মতের সত্যায়ন করেন।
উল্লেখ্য, আমি ইরানী শিয়া আলেমদের মধ্যে একটি চমৎকার অভ্যাস লক্ষ্য করি; কারো সাথে আলোচনায় অপর পক্ষের মত সঠিক বুঝতে পারলে বলেন : حق با شما است Ñ “সত্য আপনার পক্ষে। ”
ইরানের দ্বীনী জ্ঞানকেন্দ্র কোম্ থেকে “কেইহন্ আন্দিশে” নামে একটি দ্বিমাসিক পত্র প্রকাশিত হতো (হয়তো এখনো প্রকাশিত হয়) Ñ যাতে সাধারণতঃ মুজতাহিদ আলেম ও দার্শনিকদের লেখা প্রকাশিত হতো এবং বর্তমানে যেভাবে ফেসবুকের লেখায় কমেন্ট-রিপ্লাই চলে তাতে যে কোনো লেখায় সেভাবে কমেন্ট-রিপ্লাই চলতো; ক্ষেত্রবিশেষে একটি লেখার কমেন্ট-রিপ্লাই বছর ধরেও চলতে দেখেছি। বুনিঅদে চাকরির মাঝামাঝি সময় “কেইহন্ আন্দিশে”-তে দুই ধরনের নুযূলে কোরআন সম্বন্ধে ফার্সীতে একটি প্রবন্ধ লিখি; আমার সহকর্মী বন্ধু জনাব মোহসেন ক্বাসেমপূর্ (যিনি এখন একজন স্বীকৃত শীর্ষস্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ) সেটির ভাষাগত সম্পাদনা করে দেন। লেখাটি প্রকাশিত হলে অনেকে এর ওপর কমেন্ট করতে থাকেন এবং আমি জবাব দিতে থাকি; এভাবে যদ্দূর মনে আছে আরো তিন সংখ্যা চলে এবং শেষ পর্যন্ত আমার মত সকলে মেনে নেন।
এরপর আমি দর্শনশাস্ত্রের ওপর একটি প্রবন্ধ লিখি এবং তাতে অস্তিত্বের প্রাথমিক বিভাজন সম্পর্কে ইসলামী ও পাশ্চাত্য নির্বিশেষে সমস্ত দার্শনিকের মতকে বিরাট ভুল বলে অভিহিত করি। ক্বাসেমপূরকে ভাষাগত সম্পাদনা করতে দিলে তিনি বলেন : ‘তুমি দার্শনিকদেরকে ঘাটাচ্ছো; তুমি তাঁদের কথার জবাব দিতে পারবে?’ আমি বললাম : ‘আমার চোখে যে ভুল ধরা পড়েছে আমি তা-ই লিখেছি; যদি ভুল লিখে থাকি তো তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে আমার ভুল সংশোধন হবে।’’ লেখাটি প্রকাশিত হয়, কিন্তু কেউই আমার মতের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করেন নি।
কয়েক বছর আগে ইরানের আল্-মুস্তাফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ ক্যাম্পাসের তৎকালীন প্রধান হুজ্জাতুল্ ইসলাম আনছারীর সাথে আমার একটি বৈঠক হয়। আমি চার অকাট্য দলীলের কথা বললে তিনি বলেন যে, দ্বীনী বিষয়ে যে ‘আক্বলী দলীল গ্রহণযোগ্য তাকে অবশ্যই ‘আক্বলে মুস্তানাদী হতে হবে অর্থাৎ তা কোরআন মজীদ, রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) সুন্নাত্, মা‘ছূম্ ইমামগণের (‘আঃ) মত ও শীর্ষস্থানীয় মুজতাহিদগণের মতের ওপর ভিত্তিশীল হতে হবে এবং তার রেফারেন্স থাকতে হবে। জবাবে আমি বলি যে, মুস্তানাদী আকারে উপস্থাপন করা হলে আর তা ‘আক্বলী দলীল থাকবে না; কোরআন মজীদ ও অন্যান্য জ্ঞানসূত্র আমাদের ‘আক্বলকে শানিত করবে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমরা যখন বিশেষতঃ অমুসলিমদের সামনে কোনো ‘আক্বলী দলীল উপস্থাপন করবো তখন কেবল সর্বজনীন সুস্থ ‘আক্ব্ল্-এর দ্বারা সমর্থিত দলীলগুলোই উপস্থাপন করবো, কোরআন মজীদের বা অন্য কোনো সূত্রের দলীল হিসেবে নয়, আর এর বাইরে অন্যান্য বিষয়ে কোরআন মজীদ ও অকাট্যভাবে প্রমাণিত সুন্নাহর যে সব দলীল সেগুলো কেবল মুসলমানদের সামনে পেশ করবো। তখন তিনি আমার কথা মেনে নেন।
ইরানে শীর্ষস্থানীয় মুজতাহিদগণের মতামতের সাথে অন্য মুজতাহিদ ও মুহাক্বক্বিক্বগণের ভিন্নমত প্রকাশের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। “কেইহন্ আন্দিশে”-তে এর দৃষ্টান্ত প্রচুর। এছাড়া পত্রিকা ও রেডিও-টিভি-তেও ভিন্নমত প্রকাশ করতে দেখেছি। এ সব নিয়ে কেউ ভিন্নমত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে সমালোচনা, বিষোদ্গার বা কটাক্ষ করে না। কারণ, একজন মনীষী কর্তৃক অনেক বিষয়ে প্রকাশিত মতামতের মধ্যে দু’-চারটি মতামত ভুল হতেই পারে; এতে তাঁর গুরুত্ব হ্রাস পায় না এবং মনীষীগণ স্বীয় ভুল সংশোধনে দ্বিধা করেন না; ওপরে এর উদাহরণ দিয়েছি। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রায়শঃই দেখা যায়, অন্ধ ভক্তরা তাদের অনুসৃত মনীষী বা মনীষীগণের ভুল হতে পারে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না এবং এর বিপরীতে ‘মনীষী নয়’ এমন কারো ভিন্নমত সঠিক হলেও কিছুতেই তা সঠিক বলে মেনে নিতে পারে না।
* * *
হযরত আয়াতুল্লাহ্ নাছে¡র মাকারেম্ শীরাযী ইরানের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের অন্যতম; তাঁর তত্ত্বাবধানে দশজন আলেম কর্তৃক প্রণীত “তাফসীরে নামুনে” একটি গুরুত্বপূর্ণ তাফসীর। ২০১২ সালে ঢাকাস্থ ইরানী কালচারাল সেন্টার কর্তৃক এটি বাংলা ভাষায় অনুবাদের পদক্ষেপ নেয়া হয় এবং এটির প্রথম খণ্ডের অনুবাদের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়। অনুবাদকের দৃষ্টিতে মূল গ্রন্থে কোনো দুর্বলতা বা ত্রæটি ধরা পড়লে সে সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবে নোট দিতে বলা হয় এবং বলা হয় যে, তা মূল গ্রন্থের লেখকদের জানানো হবে। এতে প্রকাশিত সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞান সম্পর্কিত মতটি আমার কাছে ভুল বলে মনে হয় এবং আমি আমার মতের সপক্ষে দলীল উপস্থাপন সহ তা লিখে জানাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা মূল গ্রন্থের লেখকদের বা এ তাফসীরের তত্ত্বাবধানকারী আয়াতুল্লাহ্ নাছে¡র মাকারেম্ শীরাযীকে জানানো হয়েছিলো কিনা জানি না। কারণ, এ বিষয়ে আমাকে তাঁর বা তাঁদের কোনো মতামত জানানো হয় নি। [পরে এ নোটটি ফার্সী ভাষায় آيندهء خلق در علم الهی শিরোনামে এবং বাংলা ভাষায় “আল্লাহ্ তা‘আলার জ্ঞানে সৃষ্টিকুলের ভবিষ্যত” শিরোনামে ফেসবুকে দুই বার প্রকাশ করেছি।]
* * *
সম্প্রতি “কোরআনের ধর্ম : মানুষের ধর্ম” শিরোনামে আমার একটি ভিডিও-বক্তব্য ফেসবুকের একটি প্রাইভেট গ্রæপে প্রকাশিত হলে এবং পরে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তরের বক্তব্য সমন্বিত করে আমি তা পোস্ট আকারে প্রকাশ করলে এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয় এবং আমার বিরুদ্ধে বহু বিরূপ সমালোচনা ও কটাক্ষ করা হয়। উক্ত বক্তব্যে ও পোস্টে আমি মতামত ব্যক্ত করেছি যে, সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ৬২ নং আয়াত অনুযায়ী আহলে কিতাবের মধ্যকার যে সব সত্যান্বেষী লোকের জন্য রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াত ও কোরআন মজীদের ঐশিতার ব্যাপারে ইতমামে হুজ্জাত্ হয় নি তারা তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমান এবং ‘আমালে ছালেহর অধিকারী হলে নাজাত পাবে।
কয়েক দিন আগে দেখলাম, আমি আমার মতের সপক্ষে আরো যে সব ‘আক্বলী দলীল ও কোরআন মজীদের দলীল উপস্থাপন করেছি তার উল্লেখ ব্যতীতই তথা আমার পুরো মতামত উল্লেখ ব্যতীতই উক্ত আয়াত উদ্ধৃত করে আয়াতুল্লাহ্ নাছে¡র মাকারেম্ শীরাযীর কাছে প্রশ্ন করা হয় এবং প্রশ্ন ও তার উত্তর উক্ত প্রাইভেট গ্রæপে পোস্ট করা হয়। (শুধু ভাষাগত সংশোধন সহ তা হুবহু নীচে উদ্ধৃত করা হলো। )
প্রশ্ন করা হয় : “এ আয়াতটি কি নবুওয়াত-পরবর্তী (৬১০ খৃস্টাব্দ থেকে বর্তমান) সময়ের ইয়াহূদী-খৃস্টানদের জন্য প্রযোজ্য? পুরো ইতিহাস জুড়ে বেশীরভাগ ইউরোপীয়, আফ্রিকান ও আমেরিকা মহাদেশের আহলে কিতাব (ইয়াহূদী-খৃস্টান) ইসলাম ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের ব্যাপারে অবগত ছিলো না (যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে)। ইয়াহূদী-খৃস্টানরা যদি আয়াতে উল্লিখিত তিনটি শর্ত মেনে চলে তাহলে তারাও কি জান্নাতে যাবে?”
এরপর আয়াতুল্লাহ্ নাছে¡র মাকারেম্ শীরাযীর নিম্নোক্ত জবাব উদ্ধৃত করা হয়েছে :
“ইয়াহূদী, খৃস্টান ও এ রকম আরো যারা আছে তারা যদি নিজ নিজ আসমানী কিতাবগুলো ঠিকমতো মেনে চলে তাহলে তারা নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ (ছাঃ)কে বিশ্বাস করবে। কারণ, পূর্বেকার আসমানী কিতাবগুলোতে তাঁর আবির্ভাবের সুসংবাদ [নবীর (ছাঃ) বৈশিষ্ট্যগুলো ও মু‘জিযাহগুলো] বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। তদুপরি এর ব্যাখ্যা সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ১৪৬ নং আয়াতে ও সূরাহ্ আল্-মাএদাহর ৬৮ নং আয়াতে এসেছে যেখানে বলা হয়েছে : “(হে রাসূল!) বলুন : হে আহলে কিতাব্! তোমরা কোনো ভিত্তিতেই নেই যতোক্ষণ না পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করবে তাওরাত্, ইনজীল্ ও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বিষয়কে, ....। ” আর নবী মুহাম্মাদের (ছাঃ) উপরে ঈমান আনা এ তিনটি শর্তের মধ্যেই পড়ে, যেহেতু তাঁর আবির্ভাবের সুসংবাদ আসমানী কিতাবগুলোতে এসেছে।
“যা হোক, যে ব্যক্তি নিজের যুগের প্রেরিত নবীর ওপর ঈমান আনবে এবং সেই নবীর ওপর অবতীর্ণ কিতাবের অনুসরণ করবে ও ভালো কাজ করবে সে নাজাতপ্রাপ্ত হবে। সুতরাং ‘ঈসা (‘আঃ)-এর আবির্ভাবের আগের যুগের যে ইয়াহূদীরা বিশ্বাসী ছিলো ও ভালো কাজ করতো তারা নাজাত পাবে। একইভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের আগে যে খৃস্টানরা বিশ্বাসী ছিলো তারা নাজাত পাবে।
“এগুলো বাদেও যদি এই লোকেরা তাদের সাধ্যমতো সত্যের অনুসন্ধান করে থাকে তাহলে তাদেরকে সেই দলের ভিতরে গ্রহণ করা হবে যাদের কাছে সত্য পৌঁছে নি (অর্থাৎ যারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও সত্যের খোঁজ পায় নি)। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না, বরং তারা তাদের ভালো কাজের পুরষ্কার পাবে। ” (উদ্ধৃতি সমাপ্ত)
আমার পুরো বক্তব্যের অনুবাদ করে মতামতের জন্য পাঠানো হলে আয়াতুল্লাহ্ নাছের মাকারেম্ শীরাযীর জবাব কী হতো জানি না, তবে তাঁর জবাবের শেষ প্যারাগ্রাফে আমার বক্তব্য থেকে কোনো ভিন্নমত আছে বলে মনে করি না। কিন্তু ঐ প্যারাগ্রাফের আগে তিনি যা বলেছেন তা প্রশ্নের সাথে এবং সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ৬২ নং আয়াতের সাথে সম্পর্কহীন ও সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করি। কারণ, প্রশ্ন করা হয়েছে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হওয়ার পরবর্তী আহলে কিতাবের সম্পর্কে; পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে নয়।
উল্লিখিত আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَادُوا وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحًا فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ
“নিঃসন্দেহে যারা (এই নবীর প্রতি) ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহূদী, খৃস্টান ও ছাবেঈ, তাদের মধ্যে যারাই (যথার্থভাবেই) ঈমান এনেছে আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি এবং যথাযথ কর্ম সম্পাদন করেছে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে তাদের পুরষ্কার রয়েছে; তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না। ” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৬২)
এ আয়াতে অভিন্ন ক্রিয়াপদের আওতায় মুসলমানদের ও অন্যদের কথা বলা হয়েছে এবং অভিন্ন শর্তে তাদের নাজাতের কথা বলা হয়েছে, আর মদীনায় ইয়াহূদীদের উপস্থিতিতে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) ওপর এ আয়াত নাযিল হয়। সুতরাং সুস্পষ্ট যে, এতে তাঁর নবুওয়াতের দায়িত্বে অভিষিক্ত হওয়ার পূর্ববর্তী আহলে কিতাব সম্পর্কে বলা উদ্দেশ্য নয়; সেরূপ হলে মুসলমানদেরকে এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হতো না। অন্যদিকে নাজাতের শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে স্রেফ আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমানকে এবং ‘আমালে ছালেহকে; রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) প্রতি ঈমানের শর্ত রাখা হয় নি।
সম্মানিত আয়াতুল্লাহ্ তাঁর জবাবে যে সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ১৪৬ নং আয়াত ও সূরাহ্ আল্-মাএদাহর ৬৮ নং আয়াতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তার প্রযোজ্যতা রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) যুগের ও তাঁর পরবর্তীকালীন সকল আহলে কিতাবের ক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ (মুত্বলাক্ব) নয়।
সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহর ১৪৬ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে ঃ
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
“আমি যাদেরকে কিতাব্ দিয়েছি তারা তাঁকে চিনে ঠিক যেভাবে চিনে তাদের পুত্রদেরকে, আর অবশ্যই তাদের মধ্যকার একটি গোষ্ঠী জেনেশুনে সত্য গোপন করে। ”
এ আয়াতে “আমি যাদেরকে কিতাব্ দিয়েছি” বলতে নিঃসন্দেহে আহলে কিতাবের মধ্যকার ধর্মীয় পণ্ডিতদেরকে বুঝানো হয়েছে যাদের কাছে কিতাব ছিলো; এতে যাদের কাছে কিতাব ছিলো না এমন সাধারণ আহলে কিতাবকে বুঝানো হয় নি। নিঃসন্দেহে কোরআন মজীদ নাযিলের যুগে আহলে কিতাবের মধ্যে মক্কাহর লোকদের তুলনায় অক্ষরজ্ঞানের হার বেশী থাকলেও তাদের মধ্যে শতকরা একশ’ ভাগই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ছিলো না এবং মুদ্রণযন্ত্রবিহীন সে যুগে তাদের মধ্যকার অক্ষরজ্ঞানের অধিকারী লোকদেরও প্রত্যেকের ঘরেই ঐশী গ্রন্থ ছিলো না। এমনটি হলে ঐ সব ঐশী গ্রন্থ বিকৃত হয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। আর রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) যুগে আহলে কিতাবের কতক আলেমের কাছে তাওরাতের অবিকৃত কপি থাকলেও তাদের অনেকের কাছে তাওরাতের বিকৃত কপি ছিলো এবং অচিরেই তাওরাত মূল ভাষা থেকেও হারিয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) যুগে (এবং তার পূর্বেও) আহলে কিতাবের আলেমদের দ্বারা পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের বিকৃতি সাধন একটি অনস্বীকার্য বিষয়। এ কারণে কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা দ্বারা সত্যকে আবৃত করা, সত্য গোপন করা, (কিতাবের) কথাকে তার অবস্থানসমূহ থেকে বিচ্যুত করা এবং নিজে কিতাব্ রচনা করে আল্লাহর নামে চালানোর অভিযোগ করা হয়েছে। উপরোদ্ধৃত আয়াতেও জেনেশুনে সত্য গোপন করার অভিযোগ করা হয়েছে।
বর্তমানে ইয়াহূদী ও খৃস্টানদের কাছে যে তাওরাত আছে তা মূল ভাষায় তো নেইই, যা আছে তাতে প্রচুর বিকৃতি সহজ দৃষ্টিগ্রাহ্য। আর ইনজীলের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। ইনজীলের পঁচাত্তরটির মতো সংস্করণ আছে - যা বিকৃতির অকাট্য প্রমাণ বহন করছে - যেগুলোর মধ্য থেকে মাত্র চারটিকে খৃস্টানদের বাইবেলে স্থান দেয়া হয়েছে। সবগুলো ইনজীলের মধ্যে বারনাবাসের ইনজীল মোটামুটি বিশুদ্ধ, কিন্তু এতে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নাম [মুহাম্মাদ (ছাঃ)] থাকায়, আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ‘ঈসাকে (‘আঃ) তুলে নেয়ার পর অচিরেই সেন্ট পল কর্তৃক তা বর্জিত হয় বিধায় খৃস্টানদের মধ্যে প্রচলিত নেই। এই যেখানে অবস্থা তখন আহলে কিতাবের মধ্যকার যে সাধারণ লোকদের কাছে কিতাব্ ছিলো না নিঃসন্দেহে “তারা তাঁকে চিনে” কথাটি তাদের সম্পর্কে বলা হয় নি।
আর সূরাহ্ আল্-মাএদাহর ৬৮ নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে :
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالإنْجِيلَ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِنْهُمْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا فَلا تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ
“(হে রাসূল!) বলুন : হে আহলে কিতাব্! তোমরা কোনো ভিত্তির ওপরে নেই যতোক্ষণ না তোমরা তাওরাত্, ইনজীল্ ও তোমাদের ওপর তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল হয়েছে তার ওপর ক্বাএম্ থাকো। আর (হে রাসূল!) আপনার প্রতি আপনার রবের পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে তা অবশ্যই তাদের অনেকেরই নাফরমানী ও কুফর্ বৃদ্ধি করবে; সুতরাং আপনি কাফের জনগোষ্ঠীর জন্য আফসোস্ করবেন না। ”
এখানে সুস্পষ্ট যে, “তোমাদের ওপর তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল হয়েছে” বলতে “আপনার প্রতি আপনার রবের পক্ষ হতে যা নাযিল হয়েছে” বলে যা বুঝানো হয়েছে তা (অর্থাৎ কোরআন মজীদ) থেকে স্বতন্ত্র কিছু বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ যাবূর ও পূর্ববর্তী অন্যান্য কিতাবকে বুঝানো হয়েছে - তাওরাত্ ও ইনজীল সহ যেগুলো “কিতাবে মুক্বাদ্দাস্” (বাইবেল) নামে সকলিত হয়েছে। তাছাড়া কেউ কোরআন মজীদের ওপর ঈমান আনলে তাকে তাওরাত্ ও ইনজীলের ওপর ক্বাএম্ থাকতে বলা অর্থহীন, কারণ, তাওরাত্ ও ইনজীলের যে সব বিধান মানসূখ্ হয় নি সেগুলো কোরআন মজীদে ও ওয়াহীয়ে গায়রে মাতলূর ভিত্তিতে সুন্নাতে মুহাম্মাদীতে (ছাঃ) স্থানলাভ করেছে।
মোদ্দা কথা, আহলে কিতাবের আলেমগণ ব্যতীত সাধারণ আহলে কিতাবের জন্য রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াত্ ও কোরআন মজীদের ঐশিতা সম্পর্কে ইতমামে হুজ্জাত্ হয় নি। তবে গড়পরতা আহলে কিতাবের মধ্যে অধিকাংশই পাপাচারী, অবশ্য তাদের মধ্যে প্রকৃত ঈমানদারও আছে (সূরাহ্ আালে ‘ইমরান্ : ১১০) - যারা তাওহীদ ও আখেরাতে ঈমানদার এবং ‘আমালে ছালেহর অধিকারী; এরাই আহলে নাজাত্। বর্তমানে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞার মুসলমানদের অবস্থাও তা-ই; তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই “হে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা ঈমান আনো ....। ” (সূরাহ্ আন্-নিসা’ : ১৩৬) আয়াত অনুযায়ী আমল করে যথার্থভাবেই ঈমানদার হয়েছে তথা নিজেদেরকে আখেরাতের ক্ষতি থেকে রক্ষা করছে।
রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াত্ ও কোরআন মজীদের ঐশিতা সম্পর্কে সাধারণ আহলে কিতাবের জন্য এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর জন্যও ইতমামে হুজ্জাত না হওয়ার কারণ আহলে কিতাবের ধর্মনেতাদের দ্বারা সত্য গোপন ও বিকৃতকরণ ছাড়াও মুসলমানদের পক্ষ হতে আল্লাহ্ তা‘আলা, রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) ও কোরআন মজীদ সম্পর্কে কতক ভ্রান্ত ধারণা পোষণ ও প্রচার। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) ও অন্যান্য নবী-রাসূলের (‘আঃ) ‘ইছমাত্ সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি এবং কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতা আরোপ অন্যতম - যে সম্পর্কে অতীতে বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি।
সুতরাং অমুসলিমদের জন্য - এবং বংশানুক্রমিক নামসর্বস্ব মুসলমানদের জন্যও - রাসূলুল্লাহর (ছাঃ) নবুওয়াত ও কোরআন মজীদের ঐশিতা সম্পর্কে ইতমামে হুজ্জাত্ সৃষ্টির লক্ষ্যে অকাট্য ‘আক্বলী ও নাক্বলী দলীলের ভিত্তিতে আল্লাহ্, রাসূল (ছাঃ) ও আখেরাতের সঠিক পরিচয় এবং কোরআন মজীদের সঠিক তাৎপর্য তুলে ধরা অপরিহার্য।
ঈমানের ঘোষণা কি জান্নাতের নিশ্চয়তা দেয়?
সাধারণভাবে মুসলমানদের মধ্যে এ মর্মে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে, মুসলমান যতোই গুনাহ্ করুক চিরদিন জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে না, বরং যে কেউই একবার কালেমায়ে তাইয়্যেবাহ্ পাঠ করেছে সে গুনাহগার হলে সাময়িকভাবে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করার পর শেষ পর্যন্ত জান্নাতে যাবে। এ মর্মে হাদীছও বর্ণনা করা হয় এবং কোরআন মজীদ নিয়ে তাদাব্বুর্ করেন না এমন গতানুগতিক ধরনের আলেমদেরকে এ-ও বলতে শোনা যায় যে, কারো অন্তঃকরণে যাররাহ্ (অণু) পরিমাণ ঈমান থাকলেও সে শেষ পর্যন্ত জান্নাতে যাবে।
এটা ভিত্তিহীন অন্ধ বিশ্বাস মাত্র এবং সংশ্লিষ্ট হাদীছ নিঃসন্দেহে জাল - যার সপক্ষে কোনোই অকাট্য দলীল নেই, বরং এ ধরনের বিশ্বাস কোরআন মজীদের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক। কারণ, কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে যথাযথ আমল (‘আমালে ছালেহ্) বিহীন ঈমানের ঘোষণার কোনোই মূল্য নেই। ইয়াহূদীরাও এ ধরনের ভিত্তিহীন বিশ্বাস পোষণ করে, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের সে বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এরশাদ হয়েছে :
وَقَالُوا لَنْ تَمَسَّنَا النَّارُ إِلا أَيَّامًا مَعْدُودَةً. قُلْ أَتَّخَذْتُمْ عِنْدَ اللَّهِ عَهْدًا فَلَنْ يُخْلِفَ اللَّهُ عَهْدَهُ أَمْ تَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ. بَلَى مَنْ كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ. وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ.
“তারা বলে : “অগ্নি আমাদেরকে কখনোই স্পর্শ করবে না মাত্র কয়েক দিনের জন্য ব্যতীত। ” (হে রাসূল! তাদেরকে) বলুন : “তোমরা কি আল্লাহর নিকট থেকে কোনো অঙ্গীকার গ্রহণ করেছো, আর যেহেতু আল্লাহ্ কখনোই তাঁর অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না? নাকি তোমরা আল্লাহ্ সম্পর্কে এমন কথা বলছো যা তোমাদের জানা নেই?” হ্যা, যে ব্যক্তি মন্দ অর্জন করেছে এবং তার গুনাহ্ তাকে ঘিরে ফেলেছে এমন লোকেরা হবে দোযখের অধিবাসী এবং সেখানে তারা চিরদিন থাকবে। আর যারা ঈমান এনেছে ও যথাযথ কর্ম সম্পাদন করেছে তারা হবে জান্নাতের অধিবাসী এবং তারা সেখানে চিরদিন থাকবে। ” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ : ৮০-৮২)
কোরআন মজীদে অতীতের লোকদের সম্পর্কে উল্লেখের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে এই যে, কোরআন মজীদের পাঠকরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। সুতরাং ইয়াহূদীদের যে ভিত্তিহীন বিশ্বাস আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যাখ্যান করেছেন মুসলমানরা একই বিশ্বাস পোষণ করলে তা-ও নিঃসন্দেহে প্রত্যাখ্যাত।
এ ধরনের অন্ধ বিশ্বাস পোষণকারীরা অনেক সময় কোরআন মজীদের আয়াত থেকে ভুল অর্থ গ্রহণ করে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের সপক্ষে ব্যবহার করে। যেমন, এরশাদ হয়েছে :
إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তাঁর সাথে শিরক্ করাকে ক্ষমা করবেন না এবং এতদ্ব্যতীত যা তা তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। ” (সূরাহ্ আন্-নিসা’ : ৪৮)
কিন্তু এখানে তো আল্লাহ্ তা‘আলা সকল মুসলমানের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করার প্রতিশ্রæতি দেন নি, বরং যার যে গুনাহ্ ইচ্ছা ক্ষমা করবেন Ñ এটাই বলেছেন। নিঃসন্দেহে তিনি সে ক্ষেত্রে দেখবেন যে, ব্যক্তি কী ধরনের গুনাহ্ করেছিলো এবং তা কী অবস্থায় করেছিলো।
তারা কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াত থেকেও ভুল অর্থ গ্রহণ করে তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের সপক্ষে ব্যবহার করে যাতে এরশাদ হয়েছে :
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ.
“(হে রাসূল!) বলুন : (আল্লাহ্ বলছেন,) হে আমার বান্দাহরা যারা স্বীয় সত্তার অপচয় করেছো! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; আল্লাহ্ অবশ্যই তোমাদের সকল যাম্ব্ (ذنب Ñ ভুলত্রæটি ও ছোটখাট গুনাহ্) ক্ষমা করে দেবেন; অবশ্যই তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়াবান। ” (সূরাহ্ আয্-যুমার্ : ৫৩)
তারা এ আয়াতের ذنوب শব্দের (যা ذنب শব্দের বহুবচন) অর্থ করে ‘গুনাহ্’। অর্থাৎ, তাদের মতে, আল্লাহ্ তা‘আলা সব গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। তারা বলে, কেউ যদি পাহাড় পরিমাণ গুনাহ্ করেও তাওবাহ্ করে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে ক্ষমা চায় তো আল্লাহ্ তা‘আলা তা ক্ষমা করে দেবেন। বস্তুতঃ অনেক লোকেরই বেপরোয়াভাবে গুনাহ্ করার পিছনে এ ভ্রান্ত বিশ্বাসই দায়ী। প্রকৃত ব্যাপার যদি এমনই হতো তাহলে আল্লাহ্ তা‘আলার দ্বীন অর্থহীন হয়ে যেতো।
এদের দ্বারা কোরআন মজীদের আয়াত থেকে এ ধরনের ভুল অর্থ গ্রহণের কারণ কোরআন মজীদের আয়াত থেকে অর্থ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই এ কাজে হাত দেয়া।
আরবী সহ যে কোনো ভাষায়ই এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলোর একেকটি শব্দের একাধিক আভিধানিক ও পারিভাষিক তাৎপর্য আছে। কোরআন মজীদের আয়াত থেকে সঠিক তাৎপর্য গ্রহণের জন্য এর শব্দাবলীর আভিধানিক ও পারিভাষিক তাৎপর্যসমূহের সাথে পরিচিত থাকা অপরিহার্য। তাছাড়া একই বিষয়ে ‘আাম্ (সাধারণ) বক্তব্য ও খাছ (বিশেষ) বক্তব্য সম্পর্কে ধারণা সহ আরো অনেক বিষয়ে ধারণা থাকা অপরিহার্য। নচেৎ কোরআন মজীদের অনেক আয়াতের তাৎপর্য পরস্পরবিরোধী বলে মনে হবে, অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন যে, কোরআন মজীদে কোনো স্ববিরোধিতা নেই (সূরাহ্ আন্-নিসা’: ৮২)।
‘গুনাহ্’ (گناه) একটি ফার্সী শব্দ যাকে বাংলা ‘পাপ’ শব্দের সমার্থক গণ্য করা হয়। তারা উপরোদ্ধৃত আয়াতে বহুবচনে ব্যবহৃত ذنب শব্দের অর্থ করেছে ‘গুনাহ্’, অথচ গুনাহ্ একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ Ñ যাতে আল্লাহ্ তা‘আলার অপসন্দনীয় ও তাঁর প্রতি নাফরমানীমূলক ছোট-বড় যে কোনো কাজকেই বুঝানো হয় Ñ যে জন্য কোরআন মজীদে বিভিন্ন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এ জন্য কোরআন মজীদে ব্যবহৃত শব্দাবলীর মধ্যে আছে : ذنب, اسراف (علی نفس), ظلم (علی نفس), ظلم (علی غير), خطاء, منکر, فجور, اثم, جُرم, فسق, فساد, عدوان, عصيان, طغيان, بغي کفر, شرک ইত্যাদি। এ সব পরিভাষার মধ্যে কতোগুলো এমন যে, একেটির একাধিক অর্থ আছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা অত্র প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে সম্ভব নয়। তবে ذنب বলতে কখনো কখনো দোষত্রæটি ও ছোটখাট গুনাহ্ বুঝানো হয় (যেমন : উপরোদ্ধৃত সূরাহ্ আয্-যুমার্-এর ৫৩ নং আয়াতে) এবং কখনো কখনো পাপাচার বুঝানো হয়। অন্যত্র ذنب বলতে এমন পাপাচার বুঝানো হয়েছে Ñ যা আল্লাহ্ তা‘আলার আযাব নাযিলের কারণ; এরশাদ হয়েছে :
فَأَهْلَكْنَاهُمْ بِذُنُوبِهِمْ
“অতঃপর তাদের পাপাচারের কারণে তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। ” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আাম্ : ৬)
সূরাহ্ আয্-যুমার্-এর উপরোদ্ধৃত ৫৩ নং আয়াতে اسراف علی نفس (স্বীয় সত্তার অপচয়) বলতে এমন গুনাহ্ বুঝানো হয়েছে যাতে বান্দাহর নিজের ক্ষতি হয়, কিন্তু অন্য বান্দাহদের ক্ষতি হয় না। প্রায় একই অর্থে অন্যত্র ظلم علی نفس (স্বীয় সত্তার প্রতি অন্যায়) ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন : নিষিদ্ধ গাছ থেকে ভক্ষণ করার পর হযরত আদম (‘আঃ)-এর স্বীকারোক্তিতে। خطاء মানে ভুল, দোষ ও পাপ। তেমনি کفر মানে যেমন আল্লাহ্ তা‘আলাকে অস্বীকার, তেমনি এর অর্থ অকৃতজ্ঞতা। আল্লাহ্ তা‘আলার নাফরমানী বুঝাতে ব্যবহৃত অন্যান্য পরিভাষার মধ্যে ظلم علی غير (অন্যের ওপর যুলুম), فجور (উচ্ছৃঙ্খলা), اثم (পাপাচার), فسق (ফাসেক্বী), فساد (বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি), عدوان (সীমালঙ্ঘন) এবং عصيان, طغيان ও بغي (আল্লাহ্ তা‘আলার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ঔদ্ধত্য সহকারে নাফরমানীর বিভিন্ন স্তর) গুরুতর পর্যায়ের। আর এগুলোর সবই منکر (গুনাহ্) ও جُرم (অপরাধ)।
অনেক ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে কোরআন মজীদের একটি আয়াতে ‘আাম্ (সাধারণ)ভাবে বলা হয়েছে এবং অন্য একটি আয়াতে খাছ (বিশেষ)ভাবে বলা হয়েছে; এ ধরনের বিষয়ে উভয় আয়াতের সমন্বিত তাৎপর্য গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ্ তা‘আলা চাইলে কারো শিরক্ ব্যতীত যে কোনো গুনাহ্ ক্ষমা করবেন Ñ এটা ‘আাম্ বক্তব্য, কিন্তু বিভিন্ন আয়াতের সমন্বিত তাৎপর্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে ইজমা‘এ উম্মাহ্ প্রতিষ্ঠিত আছে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা স্বেচ্ছায় বান্দাহর হক্ব বিনষ্টকরণজনিত গুনাহ্ ক্ষমা করবেন না। উদাহরণস্বরূপ, এরশাদ হয়েছে :
وَمَنْ يَقْتُلْ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا فَجَزَاؤُهُ جَهَنَّمُ خَالِدًا فِيهَا وَغَضِبَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَلَعَنَهُ وَأَعَدَّ لَهُ عَذَابًا عَظِيمًا
“যে কেউ কোনো মু’মিনকে স্বেচ্ছায় হত্যা করলো তার প্রতিদান জাহান্নাম - যেখানে সে চিরদিন থাকবে; আল্লাহ্ তার ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তার ওপর লা‘নত্ করেছেন এবং তার জন্য বিরাট শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। ” (সূরাহ্ আন্-নিসা’ : ৯৩)
বস্তুতঃ একজন ঈমানদার মানুষ মানবিক দুর্বলতার কারণে গুনাহ্ করে বসতে পারে এবং গুনাহ্ সংঘটিত হয়ে গেলে এরপর সে অবশ্যই অনুতপ্ত হবে, তাওবাহ্ করবে ও আল্লাহ্ তা‘আলার কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু যে ব্যক্তি মানবিক দুর্বলতার কারণে গুনাহ্ করে না, বরং ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে গুনাহ্ করে, বা গুনাহ্ করার ব্যাপারে ধৃষ্টতার পরিচয় দেয়, বা গুনাহর পুনরাবৃত্তি করে চলে, আল্লাহ্ তা‘আলা এ ধরনের ব্যক্তির অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন এমনটা কোনোভাবেই আশা করা যায় না। এ ধরনের ব্যক্তিদের অপরাধ ক্ষমা করা হলে দ্বীন অর্থহীন হয়ে যায়।
আর গুনাহগার মুসলমানদেরকে একটি মেয়াদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি দেয়ার পরে জান্নাতে পাঠানো হবে - এরূপ ধারণা কোরআন মজীদের সুস্পষ্ট ঘোষণার পুরোপুরি বিরোধী। কারণ, পরকালীন জান্নাত ও জাহান্নাম কোনো সাময়িক আবাসস্থল নয়, বরং অনন্তকালীন আবাসস্থল। জান্নাত ও জাহান্নামের অধিবাসীদের সম্পর্কে বার বার বলা হয়েছে : خالدين فيها - “তারা সেখানে অনন্তকাল থাকবে। ” আর অনন্তকালীন বাসস্থানে এক বার কেউ প্রবেশ করলে সেখান থেকে তাকে বের করে আনা ঐ বাসস্থানের অনন্তকালীন বৈশিষ্ট্যের বরখেলাফ।
কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতের সমন্বয় থেকে যে তাৎপর্য নিষ্পন্ন হয় তা হচ্ছে, হাশরের সমাবেশ থেকে একদল লোককে আমলনামা হাতে দিয়ে সরাসরি জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হবে ও একদল লোককে আমলনামা হাতে দিয়ে সরাসরি জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়া হবে, একদল লোকের ছোটখাট গুনাহ্ ক্ষমা করে তাদেরকে জান্নাতে পাঠানো হবে, একদল লোকের বড় ধরনের নেক আমলের কারণে শাফা‘আতের ভিত্তিতে তাদের বড় গুনাহ্ ক্ষমা করে তাদেরকে জান্নাতে পাঠানো হবে, একদল লোকের গুরুতর ধরনের গুনাহর কারণে তাদের নেক আমল সমূহ বরবাদ হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়ে তাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো হবে। এছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলার ক্ষমা ও করুণার ব্যাপারে আশাবাদী একদল মিশ্রিত আমলের অধিকারী লোককে জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী আ‘রাফে (উঁচু স্থানে) রাখা হবে এবং তারা জান্নাতী ও জাহান্নামীদের অবস্থা দেখে অনবরত আশা ও আতঙ্কের মধ্যে থাকবে। আর যেহেতু তাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো হবে না সেহেতু শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতে পাঠানো হবে বলে আশা করা যায়।
বস্তুতঃ ভিত্তিহীন আশার কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার নাফরমানী করা হবে নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। তাই
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا
“হে ঈমানদারগণ (ঈমানের ঘোষণা প্রদানকারীগণ)! (ঘোষণা অনুযায়ী আমল করার মাধ্যমে কার্যতঃ) ঈমান আনো। ” (সূরাহ্ আন্-নিসা’ : ১৩৬)
কারণ,
وَلا تُجْزَوْنَ إِلا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ.
“তোমরা যা কিছু করছো তজ্জন্য ব্যতীত কোনো প্রতিদানপ্রাপ্ত হবে না। ” (সূরাহ্ ইয়া-সীন্ : ৫৪)
* * *
* * *
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন