আহলে কুরআন দল কেনো পথভ্রষ্ট

 




কুরআনিস্ট মতবাদের সূচনা ও ইতিহাস এবং তাদের ভ্রান্তি। 


আহলে কুরআন বা কুরআনিস্ট বলতে মোটাদাগে তাদেরকেই বুঝায় যারা সাধারণত হাদিস অস্বীকার করে। এই ভ্রান্ত মতবাদ আজকের নতুন কোনো মতবাদ নয়। এই ভ্রান্ত দলের যাত্রা শুরু হয় হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর সূচনা লগ্নে। তাদের সাথে আহলুস সুন্নাহ'র আলিমগণের প্রচুর দালিলিক তর্ক বিতর্ক হয়েছে। সালাফদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাদের এই ভ্রান্ত চিন্তা দাফন হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও তারা থামেনি। তারা আল্লাহ তা'আলার শরীয়তকে নিজের প্রবৃত্তির শরীয়ত দিয়ে পরিবর্তন করতে সর্বাবস্থায় সচেষ্ট ছিল। এই মতবাদের প্রবক্তাদের উত্থান এবং ইতিহাস শিয়া সম্প্রদায়ের উত্থানের ইতিহাসের সাথে মিলে যায়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর সাহাবা আজমাঈন রাদিয়াল্লাহু আনহুম হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নেতা ও খলিফা হিসাবে মেনে নেয়ায় শিয়ারা সাহাবায়ে কেরামের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করা শুরু করে এবং ছিদ্দিকে আকবরের প্রতি অনুগত সাহাবীদেরকে কুফরের তকমা দিয়ে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবার ঘোষণা দেয়।


তৃতীয় শতাব্দীকাল পর্যন্ত হাদিস অস্বীকারকারীদের এই ধারার কথা কেউ জানতোনা। এবং তাদের কোনো আলোচনা ইতিহাসের সেসময়কার বই পুস্তকেও পাওয়া যায় না। বহু পরে ব্রিটিশরা যখন হিন্দুস্তানে ইসলামী শাসন আমলের একটি কেন্দ্রের দখল নেয় এবং রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করেছিল তখন তারা বুঝতে পেরেছিল তাদের এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রথমত মুসলিম জনতার মনস্তাত্ত্বিক অঞ্চল থেকে ইসলামী ভাবধারা ও সঠিক বিশ্বাস তুলে নিতে হবে। এই চিন্তা সামনে রেখে তারা মুসলিম জনতার অজ্ঞতা ও নিরক্ষরতার সুযোগ নিয়ে অর্থলোভী ও প্রবৃত্তি পূজারী আলিমদের কাজে লাগিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণে আদাজল খেয়ে নামে। প্রাথমিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন হিসেবে তারা আল্লাহ তাআলার কুরআনকে শরীয়তের প্রধান উৎস বলে প্রতিষ্ঠা করে। শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস তথা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদিস সমূহকে প্রান্তিক বানিয়ে ফেলে। হাদিসকে অস্বীকারের প্রথম পর্যায় ছিল- হাদিসের বৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা। অতঃপর হাদিসের সাথে সম্পর্কিত শরীয়তের অন্যান্য বিধানের বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা। এই মৌলিক দুটি বিষয় অর্জনের জন্য তারা বেশকিছু পথ বেছে নেয়। এর মধ্যে ছিলো হাদিসের মতন বা টেক্সট ও বর্ণনার পদ্ধতি এবং বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে অগ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে পুরো হাদিসকে বাদ দিয়ে দেয়া। 


এ ভ্রান্তির সূচনা ভারত বর্ষ থেকে শুরু হলেও পরবর্তীতে তা ইরাক, মিশর, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য মুসলিম ভূখন্ডেও পাচার হয়। মিশরে মুনকিরিনে হাদিসের দাওয়াত শুরু হয় মুহাম্মাদ আলী পাশার সময়ে। সময়কালটি ছিলো ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দ। সেসময় ইতালিতে প্রযুক্তি বিপ্লব শুরু হয়। পরবর্তীতে তা ফ্রান্সেও শুরু হয়। 


মিশরে হাদিস অস্বীকারের ধারা শুরু হয় প্রাচ্যবিদদের হাত ধরে। কয়েক ডজন প্রাচ্যবিদ তখন কায়রো ইউনিভার্সিটি এবং কায়রোতে অবস্থিত আমেরিকান প্রোটেস্ট্যান্ট ইভাঞ্জেলিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে কলা অনুষদ ও বিজ্ঞান অনুষদে পড়াতে এসেছিল। তাদের কিছু অনুসারী ও শিষ্য তৈরি হয়। এই অনুসারী ও শিষ্যদের মধ্য থেকেই একটি দল হাদিস অস্বীকারকারী তথা মুনকিরিনে হাদিসে পরিণত হয়। তাদেরকে সামগ্রিকভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।


১. একদল সরাসরি রিদ্দা গ্রহণ করে এবং আল্লাহর সাথে সকল সম্পর্ক বিনষ্ট করে।


২. আরেকদল জীবনের সকল সমস্যা সমাধানের জন্য কুরআনকে যথেষ্ট মনে করে ও সরাসরি হাদিস শাস্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করে।


৩. তৃতীয় দল নিজেদের প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হাদিসগুলোকে গ্রহণ করে এবং নিজেদের মতের বিপক্ষে হাদিসগুলোকে অস্বীকার করে। (তুরস্কের মেহমেদ গরমেজকে আমি এই তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত মনে করি। এই ব্যাপারে আমার কাছে দালিলিক প্রমাণ রয়েছে। তবে আজকের আলোচনার বিষয় এটি নয়। আরেকদিন আলোচনা করা হবে। শুধু এখানে একটা নুকতা দিয়ে রাখলাম)


ঐতিহাসিক সূত্রমতে হাদিস অস্বীকারকারী দলগুলোর মৌলিক উৎস চারটি। 


১. আধুনিক যুগের খারেজি সম্প্রদায়।

২. শিয়া।

৩. মু'তাজিলা।

৪. ওরেয়েন্টালিস্ট ভাবধারায় প্রভাবিত।


গত শতাব্দীর সত্তর এবং আশির দশক থেকে হাদিস অস্বীকারের এই ভ্রান্ত চিন্তা যারা পুনর্জীবিত করতে চাচ্ছিল তাদের মূল হোতা হলো আহমদ সুবহী মনসুর। যাকে যায়োনিস্ট ও মার্কিনিরা ইসলামী চিন্তক উপাধি দেয়। এই ব্যক্তি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি অনুষদ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিল। ১৯৭৭ সালে তার কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হলে সেখানে হাদিস অস্বীকারের বিষয়টি ফুটে উঠে। যার ফলে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে বরখাস্ত করে। এই লোক ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ'র মত মুহাদ্দিসকে ইসলামের শত্রু এবং কুরআনের শত্রু হিসেবে অভিহিত করে এবং ইসলামী আইনের উৎস হিসেবে কুরআনকেই যথেষ্ট বলে প্রচার করতে থাকে। মিশরে তার এই মতবাদের সাথে রাশাদ খলিফা নামে আরেক ব্যক্তি যুক্ত হয়। আহমদ সুবহী মনসুর রাশাদের সাথে দেখা করতে আমেরিকায় যায়। অথচ এই রাশাদ ছিল সে সময়ের সবচেয়ে বড় যিন্দিক। যে ব্যক্তি নবুওতের দাবি করেছিল। আমেরিকা অ্যাসাইলেম দিয়ে তাকে নিরাপত্তা দিয়েছিল। অবশ্য নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তাকে সেখানে হত্যা করা হয়। এই যিন্দিক হাদিসকে শয়তানের পক্ষ থেকে আসা বক্তব্য বলে মনে করত। কুরআনের কিছু আয়াতকে শয়তানী আয়াত বলে প্রচার করত। আহলুস সুন্নাহর আলিমগণকে পৌত্তলিক বলতো। ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহিকে কাফির বলতো। এবং সে দাবি করত, চল্লিশ বছর বয়সে তার কাছে নবুয়ত এসেছে। যারা তাকে অনুসরণ করবে তাদেরকে আল্লাহর কাছে কোনো হিসাব দিতে হবে না। সে নিজেকে মুসা, ঈসা ও মুহাম্মাদ আলাইহিমুস সালাম থেকে বড় নবী দাবী করত। কেননা উক্ত নবী গনের মু'জিযা বর্তমান সময়ের লোকেরা দেখতে পায়নি। সে তার অনুসারীদের উদ্দেশ্যে বলতো-


'তোমাদের নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত সবই ভুল এবং একজন রাসুল হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো তোমাদের এই ভুলগুলো শুধরে দেয়া।' মাআযাল্লাহ!


আহমদ সুবহী মনসুর আমেরিকা থেকে কায়রো ফিরে আসে। এসেই মসজিদের মিম্বার থাকে হাদিসের সমস্ত বিধানকে অস্বীকার করে অবমাননা করতে থাকে। সাধারণ মুসলমানরা তার এই বিভ্রান্তি বুঝতে না পারলেও হাদিস অস্বীকার বিষয়টি ধরতে পেরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। ফলশ্রুতিতে তাকে কয়েকসপ্তাহ কারাগারে কাটাতে হয়। ছাড়া পেয়ে আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে কয়েক মাস লেকচারার হিসেবে কাজ করে। ইবনে খালদুন সেন্টারেও পাঁচ বছর কাজ করে। ইবনে খালদুন সেন্টার আমেরিকা ও ইহুদিদের অনুগত হিসেবে পরিচিত ছিলো এবং তাদের চিন্তাধারার প্রচার করত। ২০০০ সালে মিশরীয় পুলিশ এই প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে এই সেন্টারের পরিচালক সা'দ ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করে। একপর্যায়ে সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়। গ্রেফতার এড়াতে আহমদ সুবহী মনসুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়। সে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাশনাল এন্ডডাউনমেন্ট ফর ডেমোক্রেসিতে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিল। পরবর্তীতে সে নিজেই 'আল মারকাযুল আলাম লিল কুরআনিল কারিম - (Global centre for Quran)' নামে একটি সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে।


২০০৪ সালে 'পিপল অফ কুরআন' নামে একটি ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করে। যেখানে সে রীতিমত নিবন্ধ প্রকাশ করে যায়। তার বিভ্রান্তিমূলক বইপত্র এই সাইটে এবং অন্যান্য কিছু সাইটে এখনো পাওয়া যায়। 


আহমদ সুবহী মনসুরের প্রতিষ্ঠান সালাফদের মধ্য থেকে যারা কুরআন এবং হাদিস উভয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদেরকে ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়। কুরআনিস্টদের মতে হাদিস শব্দটি কুরআনেরই একটি ধারণা। আলাদা শাস্ত্র নয়। যা আল্লাহ তাআলা কুরআনে  উল্লেখ করেছেন। যে সমস্ত 'ক্বওলী' হাদিস রয়েছে তা তাদের কাছে আল্লাহ তা'আলারই বক্তব্য। কেননা, আল্লাহ তাআলা কুরআনে হাদিস শব্দের বারংবার উল্লেখ করেছেন। সুরা আ'রাফে এসেছে-


فَبِاَیِّ حَدِیۡثٍۭ بَعۡدَہٗ یُؤۡمِنُوۡنَ

'এরপর তারা আর কোন কথায় ঈমান আনবে?'


সুতরাং তাদের বক্তব্য হলো- কুরআনুল কারীমের বাইরের কোন হাদিসে তথা কথায় তাদের ঈমান নেই।


এধারণার উপর ভিত্তি করে তারা  বুখারী, মুসলিম, শাফেঈ ও মালেক সহ অন্যান্য সকল ইমামগণের বর্ণিত হাদিসকে প্রত্যাখ্যান করে এবং সেগুলোকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পর্কিত করাকে অস্বীকার করে। ইসলামের অংশ হিসেবে গণ্য করে না। সুবহী মনসুরের মতে- ইসলাম কুরআনের মাধ্যমে সমাপ্ত ও সম্পূর্ণ। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনে সুরা মায়িদাতে বলেছেন-


اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا


'আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।'


তারা এও মনে করে যে, তারা তাদের এই দাবির মাধ্যমে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসকল মিথ্যা হাদিসের (!) দায় থেকে মুক্ত করছে। এবং যে রিসালাত নবীকে পৌঁছানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তা কুরআনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা নবীর ওফাতের পর ইসলামকে পরিবর্তন করে ফেলেছে। নিজেদের কর্মকাণ্ডকে বৈধ করার জন্য হাদিস আবিষ্কার করেছে। সাধারণ জনতাকে কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। 


সুবহী মনসুর আরো বলেছে-


'আমি মনে করি বুখারী ও মুসলিম সহ অন্যান্য যে সমস্ত হাদিসকে তারা সুন্নাহ বলে তা মূলত একটি ধর্মীয় সংস্কৃতি ছাড়া কিছুই নয়। যা বর্ণনাকারীর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশ করেছে। ইসলাম এবং ইসলামের নবীর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। হাদিস একটি মধ্যযুগীয় সংস্কৃতি। মধ্যযুগীয় সংস্কৃতিতে প্রচলিত ধর্মের নামে যুদ্ধকে বৈধতা দিতে হাদিস এসেছে। সুতরাং যুগে যুগে প্রচলিত সংস্কৃতি থেকে আমরা দূরে থাকি এবং পবিত্র কুরআনকে আঁকড়ে ধরি।'


মিশরের 'আশ শারকুল আওসাত' পত্রিকায় ২০০৪ সালের ২০শে জুলাই কুরআনিস্টদের সাথে মার্কিন লিবারেল গোষ্টীর একটি বৈঠকের সংবাদ প্রচারিত হয়। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়-


'হাদিসকে প্রান্তিক বানিয়ে ফেলতে হবে। এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাদিস চর্চা ও পাঠদান থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা হাদিস মু্ক্তচিন্তা ও মুক্তবিশ্বাসের চর্চা থেকে মানুষকে দূরে রাখতে একটি ধর্মীয় বাধা হিসেবে কাজ করে।'


এই কমিটির একজন সদস্যের বক্তব্য এমন ছিল যে, 


'কুরআনিস্টদের প্রতিনিধি মুহাম্মাদ ওসমান মার্কিন লিবারেল গোষ্ঠীর কাছে এই মত ব্যক্ত করেন যে, মিশরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে হাদিস শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। যার অর্থ হলো ইসলামী মতবাদ প্রত্যেকের উপর চাপিয়ে দেয়া। অথচ মিশরের মুসলিম জনসংখ্যার সবাই সুন্নি নয়। সেখানে কুরানিস্ট, শিয়া ও বাহাইজমসহ আরো অনেক মতবাদের অনুসারী রয়েছে।'


আহমদ সুবহী মনসুরকে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করার পর তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছিল। সে কয়েক সপ্তাহ কারাগারেও ছিল। কিন্তু হাদিস অস্বীকারের কারণে সে জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়ে। যার ফলে তার বিচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাশ তাকে আদালতে নিয়ে আসা হয়েছিল।  পরবর্তীতে ২০০০ ও ২০০১ সালে বিচারের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়। এ সময় পুলিশ তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা তাঁর চিন্তার অনুসরণ ও প্রচার-প্রসার করছিল তাদেরকে গ্রেফতার করে। ফলে আহমদ সুবহী মনসুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে সেখানে পালিয়ে যায়। ২০০২ সালের জুন মাসে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে। 


২০০০ সালের এপ্রিল মাসে কুরআনিস্ট মতবাদের মামলার রায় হয়। যেখানে একজন মহিলা সহ আটজন আসামীকে আদালত বিকৃত চরমপন্থী মতাদর্শ প্রচারের দায়ে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। এই আসামিদের বিপক্ষে যে সমস্ত অভিযোগ ছিল তার মধ্যে এটিও ছিল- তারা কাবাকে পৌত্তলিকদের উপসানালয় দাবি করে। এবং আরাফাতের ময়দানকে পবিত্র বলে অস্বীকার করে।




যে আটজন আসামীকে তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয় তাদের অপরাধ কেবলমাত্র নিজেদেরকে কুরআনিস্ট বা আহলে কুরআন দাবি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা আরো বেশ কিছু ভয়াবহ দাবি করেছিল। এবং তাদের অস্বীকৃতির মাত্রাও কেবল হাদিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। তাদের বিষয়গুলো নিম্নোক্ত:


১. তারা মি'রাজকে অস্বীকার করেছিলো।

২. নামাজের মধ্যে কেবলামুখী হওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। 

৩. তারা দাবি করত সিয়াম আদায়ের মূল মাস শা'বান। রমাদ্বান মাস নয়। অথচ কুরআনের আয়াত রামদ্বানের ব্যাপারে সুস্পষ্ঠ।


আসামীরা তাদের এ সকল দাবী স্বীকার করলেও এসকল ভ্রান্ত নাস্তিক্যবাদী চিন্তা থেকে ফিরে আসেনি। তাই মিশরে তাদের বিচার কার্য চলমান ছিলো। এই মামলার প্রধান আসামি ছিল সুবহি মনসুর। যদিও সে মিশরে অনুপস্থিত ছিলো এবং ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আশ্রয় সেখানেই অবস্থান করছিলো। তবুও মিশরে চলমান মামলায় তার বিপক্ষেও রায় দেয়া হয়। 


২০০৭ সালে কুরআনিস্টদের বিরুদ্ধে তৃতীয় আরেকটি মামলা হয়। এই মামলায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারী হলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলো: আমর থারওয়াত। আবদুল লতিফ সাঈদ। আবদুল হামিদ আবদুর রহমান। আহমাদ দাহমেশ। আইমান আবদুল হামিদ। এরা সকলেই কুরআনিস্ট ছিলো এবং হাদিস অস্বীকার করত। ইসলাম অবমাননার অভিযোগে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং হাদিস অস্বীকার বিষয়টি সাব্যস্ত হলে সুপ্রীম স্টেইট সিকিউরিটি প্রসিকিউশন তাদের সর্বোচ্চ বিচারের প্রস্তুতির জন্য মামলা মুলতবি রেখে তাদেরকে কারাবন্দী রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদিস সমূহকে অস্বীকার করার দায়ে এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে তাদের এই ভ্রান্ত ও বিকৃত মতাদর্শ প্রচার প্রচেষ্টার কারণে তাদের বিরুদ্ধে চরমপন্থী ধারণা প্রচারের অভিযোগ আনা হয়। কারণ এসকল কর্মকান্ড রাষ্ট্রদ্রোহ ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে। একই বছরের ৮ই জুন শারকিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সুবহী মনসুরের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তার বেশ কিছু বই জব্দ করে এবং তা তাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। 


আহমদ সুবহী মনসুরের নাম বারংবার উচ্চারিত হলেও শরীয়তের মূল উৎস হিসেবে কুরআনকে মেনে নিয়ে হাদিসকে বাদ দেয়ার ফিতনা আরো বহু আগে শুরু হয়েছিল। সর্বপ্রথম তা খারিজিদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। তারা যিনার শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা এবং মোজার উপর মাসেহ করার বিধানসহ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত বহু বিধিবিধানকে বাদ দিয়ে ফেলেছিল কেবলমাত্র কুরআনে স্পষ্ট করে উল্লেখ না থাকার কারণে। আব্বাসীদের যুগে ইব্রাহিম আন নিজাম ইসলামের বিধি-বিধানের ব্যাপারে হাদিসের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার একটি চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং শরীয়তের উৎস হিসেবে কুরআনের উপরেই ভরসা করার কথা বলেছিল। তার প্রসিদ্ধ ছাত্র আল-জাহিয যারা হাদিস অনুসরণ করে তাদের কঠোর সমালোচনা করত। 


বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মিশরের মুহাম্মাদ তৌফিক সেদকি দাবি করলো, মুসলিম সমাজে ফিতনা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা অনুপ্রবেশ না করা অবধি হাদিসের কোনো কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয়নি। সে মিশরের প্রসিদ্ধ ম্যাগাজিন আল-মানারে 'কুরআনই একমাত্র ইসলাম' নামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। যেখানে সে সুস্পষ্ট উল্লেখ করে- 'মুসলমান হিসেবে কুরআন মেনে চলাই যথেষ্ট।' 


ভারতবর্ষে হাদিস অস্বীকার প্রবণতা শুরু হয় আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্টাতা সৈয়দ আহমদ খানের হাত ধরে। সৈয়দ আহমদ খান সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে কুরআনের তাফসির করে এবং হাদিস গ্রহণের জন্য এমন সব কঠিন শর্ত স্থাপন করে যা তাকে হাদিস অস্বীকারের দিকে নিয়ে যায়। পাকিস্তানের আব্দুল্লাহ জাকরালোয়ী সৈয়দ আহমদ খানকে অনুসরণ করে হাদিস অস্বীকারে মেতে উঠে। এক পর্যায়ে সমস্ত হাদিস অস্বীকার করে কুরআনকে শরীয়তের একমাত্র উৎস দাবি করে একটি দল প্রতিষ্ঠা করে। দলের নাম দেওয়া হয় 'আহলুয যিকরি ওয়াল কুরআন'। এক্ষেত্রে দলীল হিসেবে কিছু আয়াত তারা উপস্থাপন করে। বহু বইপুস্তকও রচনা করে তা ছড়িয়েও দেয়। আব্দুল্লাহ জাকরালোয়ির পর ভারতের পূর্ব প্রান্তে মুহিব্বুল হক আজিমাবাদী কুরআনিস্ট আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে এবং বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে আন্দোলন চালিয়ে যায়। তারপর আসে আহমদ উদ্দিন। এরপর আসে গোলাম আহমদ পারভেজ। এভাবে একের পর এক গোষ্টী ভারতবর্ষে এই আন্দোলন চালিয়ে যায়। তবে ভারতবর্ষে কুরআনিস্ট আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব রাখে গোলাম আহমদ পারভেজ। গোলাম আহমেদ পারভেজ আধুনিক বিজ্ঞানে বিশ্বাস করত এবং সে নিজেও একটি দল প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ দলের নাম ছিল 'তুলুয়ে ইসলাম'। তার দলকে কুরআনিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সক্রিয় দল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তারা বেশ সক্রিয় ছিল। কিন্তু তাদের ব্যাপারে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ ও ফতোয়ার কারনে তাদের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়। সারা বিশ্ব থেকে আহলুস সুন্নাহ'র আলিমগণের ক্রমাগত ফতোয়া তাদের আন্দোলনকে পতনের দিকে ত্বরান্বিত করে। তাদের মধ্যেও নানা বিভক্তি তৈরি হয়। যেমন গোলাম আহমদ পারভেজের সাথে কুরআনের কিছু আয়াত থেকে সরাসরি বিধান নেয়ার ব্যাপারে আবদুল্লাহ জাকরালোয়ির মতানৈক্য হয়। 


কুরআনিস্টদের মূল দলীল হিসেবে যেসকল আয়াত তারা উপস্থাপন করে তার দুটি গতপর্বে উল্লেখ করা হয়েছিলো। এছাড়াও তারা আরো কিছু আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে। যেমন সুরা মায়িদার আয়াত-


فَاحۡکُمۡ بَیۡنَہُمۡ بِمَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰہُ وَ لَا تَتَّبِعۡ اَہۡوَآءَہُمۡ عَمَّا جَآءَکَ مِنَ الۡحَقِّ

'সুতরাং আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী আপনি তাদের ফায়াালা করুন এবং যে সত্য আপনার নিকট এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না।'


সুরা আ'রাফের আয়াত-


کِتٰبٌ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ فَلَا یَکُنۡ فِیۡ صَدۡرِکَ حَرَجٌ مِّنۡہُ لِتُنۡذِرَ بِہٖ وَ ذِکۡرٰی لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ

'এমন কিতাব যা আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে, সুতরাং আপনার মনে যেন এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ না থাকে। যাতে আপনি এর দ্বারা সতর্ক করতে পারেন। আর তা মুমিনদের জন্য উপদেশ।'


উত্তরাধিকার সম্পদের ব্যাপারে অবতীর্ণ সূরা নিসার এ আয়াতটি তারা উপস্থাপন করে বলে-


یُوۡصِیۡکُمُ اللّٰہُ فِیۡۤ اَوۡلَادِکُمۡ ٭ لِلذَّکَرِ مِثۡلُ حَظِّ الۡاُنۡثَیَیۡنِ

'আল্লাহ তোমাদের সন্তান সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন: এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান।' 


এ আয়াতের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম সন্তান ও কাফের সন্তানকে আলাদা করে বিভক্ত করেন নি তাই মুসলিম পিতার উত্তরাধিকার কাফির সন্তান হতে পারবে। তাদের এই বক্তব্য ঈমান-কুফরের সীমারেখাও ঘুচিয়ে ফেলে। কুরআনিস্টদের মতে কুরআনে কোনো নাসিখ মানসুখ আয়াতও নেই। 


শিয়ারা যেমন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ঠিক তেমনিভাবে কুরআনিস্টরাও কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। মোটাদাগে তাদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়।


প্রথম ভাগ: এই দলটি কট্টরপন্থী কুরআনিস্ট যারা শরীয়তের প্রধান উৎস হিসেবে কুরআন ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে উৎস হিসেবে মানতে নারাজ। এমনকি শরীয়তের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিধিবিধানের ক্ষেত্রেও তারা কোনো ধরনের ইজমা বা সাহাবীদের সিরাতসহ জ্ঞানের কোনো উৎসকেই গ্রহণ করতে নারাজ। তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, শরীয়তের ক্ষেত্রে কুরআন ছাড়া অন্য যে কোনো উৎস অগ্রহণযোগ্য। এবং আমাদের সামনে কুরআন ছাড়া ইসলাম বোঝার জন্য অন্য কোনো ক্বত্বঈ গ্রন্থ উপস্থিত নেই। 


তবে এই দলটি হাদিস অস্বীকারের দুটি প্রামানিক বক্তব্যকে সামনে রাখে। তারা বলতে চায়, 


'যেহেতু কুরআন ছাড়া দ্বীন বোঝার ক্ষেত্রে অন্যকোনো সহায়ক জ্ঞান নেই এবং কুরআনই একমাত্র জ্ঞান তাই আমরা যদি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপস্থিত থাকতাম এবং তিনি আমাদেরকে কোনো কাজ করার আদেশ দিতেন বা এমন কোনো বক্তব্য আমাদের সামনে পেশ করতেন যা কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো না তবে আমাদের জন্য কোনোভাবেই তা দ্বীনের অংশ হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব হত না। আমরা আল্লাহর রাসুলের শ্রবণকারী হিসেবে আবশ্যকীয় ভাবে তা মেনে নিতাম বা পালন করতাম তবে তাকে দ্বীনের অংশ বানাতাম না। কেননা যেহেতু আল্লাহর রাসুল কুরআন নিয়ে এসেছেন তাই সেই সময়ের মুসলমানদের জন্য আবশ্যকীয় কর্তব্য ছিল আল্লাহর রাসুলের আদেশের ওপর আমল করা কিন্তু কোনোভাবেই তা দ্বীনের অংশ হিসেবে গণ্য হবে না।'


মোটকথা, তারা কুরআন ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই মানতে নারাজ এমনকি তা যদি আল্লাহর রাসুলের কাছ থেকে মুতাওয়াতির সাব্যস্তও হয়। আল্লাহর রাসুলের ইন্তেকালের পরে তো আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে বর্ণিত হাদীস তাদের কাছে কোনো গুরুত্ব রাখেনা।


তাদের আরেকটি বক্তব্য হল, 'যদি আমরা আল্লাহর রাসুলের সামনে উপস্থিত থাকতাম তবে আমরা আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে শোনা বা আদেশকৃত হাদিসকে আমরা মেনে নিয়ে আমল করতাম। কিন্তু যেহেতু আমরা আল্লাহর রাসুলের সামনে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ পাইনি তাই তাঁর পক্ষ থেকে পরবর্তীতে বর্ণিত হাদিস বা বক্তব্য আবশ্যকীয় সাব্যস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তাতে নানান মতপার্থক্য ও মতভেদ রয়েছে।


এই প্রথমোক্ত দলটিকে মূলত কুরআনিস্ট বা আহলে কুরআন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।


দ্বিতীয়ত: এই দলটি কট্টরপন্থী কুরআনিস্ট নয়। তারা হাদিসকে সরাসরি অস্বীকার করে না তবে কুরআনের উপরে কোনো কিছুকেই তারা প্রাধান্য দিতে রাজি নয়। তবে আহলুস সুন্নাহর আলিমগণের কুরআনের উপরে হাদিসকে প্রাধান্য না দেয়ার কনসেপ্ট এবং তাদের কনসেপ্ট একই নয়। এই দলটি মৌলিকভাবে হাদিসকে স্বীকার করে। তবে সে হাদিস অবশ্যই কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে এবং তা পুরোপুরি হতে হবে। আংশিকভাবে নয়। যদি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়ে থাকে বা কুরআন হাদিসটিকে পুরোপুরি স্বীকৃতি না দেয় তবে তা উৎস হিসেবে ধর্তব্য হবে না।



কুরআনিস্টরা হাদিসের সত্যতা স্বীকার না করা কিংবা হাদীসকে গুরুত্ব না দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু যুক্তি উপস্থাপন করে।


প্রথমত: হাদিসের সত্যতা স্বীকার করে নিতে যে আস্থার প্রয়োজন তা কয়েকটি সমস্যার কারণে অর্জন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। তাদের দৃষ্টিতে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।


প্রথম সমস্যা: মৌখিক রিওয়ায়াত।


এ ব্যাপারে তাদের বক্তব্য হল হিজরী প্রথম শতাব্দীতে হাদিস কোথাও লিপিবদ্ধ হয়নি এবং এই সময়ে বর্ণিত হাদীসগুলোর লিপিবদ্ধ কোনো পুস্তক আমাদের কাছে পৌঁছেনি। বরং এই সময়ে বর্ণিত সকল হাদিস ছিলো একে অপরের কাছ থেকে মৌখিকভাবে নেয়া। সুতরাং যেখানে একাধিক ব্যক্তির পারস্পরিক বর্ণনার মাধ্যমে কোনো হাদিস আমাদের পর্যন্ত আসে তবে তার সত্যতার ব্যাপারে কিভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যায়! আর তাছাড়া একজন ব্যক্তি কোনো হাদিস বর্ণনা করে কিংবা কোনো বক্তব্য দেয় তা সে তার চিন্তা অনুসারে দেয়। সুতরাং সে যখন কোনো হাদিস অপরের কাছে বর্ণনা করবে তখন সে তা একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারাকে সামনে রেখে বর্ণনা করবে। অতঃপর তার কাছ থেকে নেয়া হাদিসটি উক্ত ব্যক্তি অপরজনের কাছে একই রকম তার ব্যক্তিগত ধারণার উপর ভিত্তি করে বর্ণনা করবে। এভাবে প্রত্যেকে একে অপরের কাছে একটি সুনির্দিষ্ট চিন্তাধারার ভিত্তিতে হাদিস বর্ণনা করতে করতে এক পর্যায়ে হাদীসটিতে সংকোচন, সংযোজন, সংশোধন ও বিকৃতি তৈরি হয়।


দ্বিতীয় সমস্যা: হাদিসের মূলভাব পরিবর্তন।


কুরআনিস্টদের মতে, যে হাদিসসমূহ আমাদের কাছে এসেছে তা সঠিক শব্দে আসেনি বরং উক্ত হাদীসগুলোতে যে শব্দগুলো সংযোজিত তা মূলত বর্ণনাকারীদের নিজেদের শব্দ। একটি হাদিসও সঠিক শব্দ পাওয়া যায় না। বলা হয়ে থাকে, আরবদের মুখস্তের ক্ষমতা অসাধারণ। যতই অসাধারণ হোক না কেন, একজন মানুষের পক্ষে হুবহু কোনো বক্তব্য অক্ষরে অক্ষরে মুখস্ত রাখা সম্ভব নয়। তারা যেহেতু মানুষ ছিলেন তাই তাদের বর্ণিত হাদিসের শব্দ ও মূলভাবে পরিবর্তন থাকতেই পারে  যদি শব্দের পরিবর্তন হয় তবে অর্থ পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। সুতরাং তাদের বর্ণনা দুর্বল। আর এই দুর্বল বর্ণনার কারণে হাদিসের গুরুত্ব কমে যায়।


তৃতীয় সমস্যা: রাবীগণ ও 'জরাহ তা'দীলের' ইমামগণের মধ্যকার যুগের পার্থক্য।


তাদের মতে, রাবীগণ ও 'জরাহ তা'দীলের' ইমামগণের মধ্যকার যুগের পার্থক্য শতাব্দীকালের এত সুদীর্ঘ সময়ের পার্থক্যের পরেও কিভাবে তারা বর্ণনাকারীদের নির্ভরযোগ্যতা ও আদালত সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হলো? জরাহ ও তা'দীলের ইমামগণ রাবীর নির্ভরযোগ্যতা নির্ধারণ করেছেন নিজেদের ব্যক্তিগত পরিমাপকে। যেমন, তারা রাবীদের ক্ষেত্রে দেখেছেন, যদি কোন রাবী হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে বেশি মর্যাদা দিয়ে ফেলে এবং অন্যান্য সাহাবীকে খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে তবে তাকে 'কাযযাব' তকমা দিয়েছেন। আবার যদি দেখা যায়, তারা সাহাবীদেরকে এগিয়ে রেখেছেন এবং হযরত আলীকে পিছিয়ে রেখেছেন তবে তার ব্যাপারে নির্ভরযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়েছেন। আর যদি দেখা যায়, রাবী 'ক্বদারিয়া' আক্বীদার তবে তারা তার বর্ণনাকে প্রশ্নবিদ্ধ বলেছেন।  সুতরাং যখন একজন ব্যক্তি ঈমান ও কুফরের বিষয়ে ব্যক্তিগত পরিমাপক নির্ধারণ করে ফেলে তবে কিভাবে আমরা তার বর্ণনায় হাদিসের নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ খুঁজে পাব?


এছাড়াও আরও অনেক ধরনের সমস্যার কথা কুরআনিস্টরা বলে। যেমন, হাদিসের সবচেয়ে পুরনো কপিগুলো আমাদের কাছে এসেছে নবী যুগের দেড়শত বছরের পর থেকে। আমরা সেগুলোতে নানান মতপার্থক্য ও সমস্যা দেখতে পাই। এছাড়াও তারা এমন সব হাদিস নিয়ে আলোচনা করে যেসমস্ত হাদিস বিজ্ঞানবিরোধী। তারা বিজ্ঞানকে প্রাধান্য দেয় হাদিসের উপর। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে আলোকপাত করে হাদিসের গুরুত্বহীনতা সাব্যস্ত করে। তারা আরও বলতে চায়, বেশিরভাগ হাদীস মুতাওয়াতির নয় এবং একই হাদিসের একাধিক বর্ণনার মধ্যেও বড়সড় মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান এবং তা অনেকটা পারস্পরিক ভাবে একে অপরের বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করে। তাদের আরো বক্তব্য হলো, আমরা কেবল হাদিসের ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করে নেতিবাচক দিকগুলোকে বাদ দিয়ে ফেলি। অথচ হাদিস শাস্ত্রের ইতিহাসের মত যেখানে কিছু বর্ণনা শক্তিশালী থাকে কিছু বর্ণনা দুর্বল থাকে। কিছু বর্ণনা অতিরঞ্জিত থাকে। 


তারা আরও বলতে চায়, হাদিসজনিত এই সমস্যাগুলো অনেকের কাছেই স্পষ্ট ছিল এবং এ নিয়ে প্রচুর পুস্তক ও গ্রন্থাবলী লিখিত হয়েছে। তারপরেও আমরা এই সমস্যাগুলো স্বীকার করে তা মেনে নিইনি। এটাই সত্য যে, হাদিসের এই নেতিবাচক দিকগুলোই হাদিস বাতিল করার জন্য যথেষ্ট। 


দ্বিতীয় যুক্তি: সুন্নাহর সত্যতার প্রমাণ কুরআনে মেলেনা।


কোরআন ও সুন্নাহকে বাদ দিয়ে ফেলতে কুরআনে সুন্নাহ বিষয়ক যত আয়াত নাযিল হয়েছে সবকটি নিয়ে আলোচনা করেছে। প্রথম আয়াত সুরা নিসা'র-


یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡکُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡہُ اِلَی اللّٰہِ وَ الرَّسُوۡل اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا


'হে ঈমাদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রাসুলের আনুগত্য করো, আরো আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যকার ক্ষমতাশীলদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটলে তা উপস্থাপিত করো আল্লাহ ও রাসুলের নিকট। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান এনে থাকো। এই পন্থাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।'


এই আয়াতে নির্দেশকৃত আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে তারা সন্দেহ পোষণ করে। তারা বলতে চায়, আয়াতের মধ্যে আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য বলতে যা বোঝানো হয়েছে তা হলো একজন শাসক হিসেবে তিনি কুরআনের যে আয়াত গুলো এবং আল্লাহর যে সমস্ত আদেশসমূহ জাতির প্রতি দিবেন তার প্রতি আনুগত্যের দিক থেকে আল্লাহর রাসুলের আনুগত্য। এই আনুগত্য কুরআনের বাইরে গিয়ে নয় অথবা আল্লাহর আনুগত্যের সমান আনুগত্য নয়। বরং এই আনুগত্য আল্লাহর আনুগত্য এবং কুরআনে বর্ণিত আদেশের আনুগত্য। কিন্তু মজার বিষয় হলো, তারা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কুরআনের যে আনুগত্যের কথা বলেছে তার সুস্পষ্ট কোনো কারণ কোথাও তারা দেখাতে পারেনি। কারণ, এই আয়াতের যে শাব্দিক গঠন, তাতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর আনুগত্যের পরে রাসুলের আনুগত্যে শব্দ এসেছে। ঠিক যেমনভাবে আল্লাহর আনুগত্যকে বিশেষায়িত করা হয়েছে সেই একই শব্দ দিয়ে আল্লাহর রাসিলের আনুগত্যের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। সুতরাং কোনো ভাষাবিদের পক্ষে এমন পার্থক্য করা সম্ভব নয়। সুস্পষ্ট শব্দের পরেও প্রথম শব্দের মূলভাবে দ্বিতীয় শব্দের মূলভাব ঢুকিয়ে দেয়া যায়না।


এবার দ্বিতীয় আয়াত। এই আয়াতটি সূরা নাজমে'র-


اِنۡ ہُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی


'তাতো কেবল ওহী- যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরিত হয়।'


এই আয়াতটি আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ ও হাদিসের নির্ভরযোগ্যতার সুস্পষ্ট প্রমাণ। কিন্তু কুরআনিস্টরা এই আয়াতটিও প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলতে চেয়েছে, এই আয়াতটি সরাসরি উদ্দিষ্ট অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে না। বরং তা মুশরিকদের পাল্টা যুক্তি হিসেবে এসেছে। কারণ, এর আগের দুটি আয়াতে মূলত মুশরিকদেরকে খন্ডন করা হয়েছে। আয়াত দুটি হলো এই-


مَا ضَلَّ صَاحِبُکُمۡ وَ مَا غَوٰی-وَ مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡہَوٰی


'তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়। আর তিনি মনগড়া কথা বলেন না।'


তারা মি'রাজকে অস্বীকার করে বলেছিল, 


'মুহাম্মদ নিজ থেকে বানিয়ে কথা বলে।'


সুতরাং আল্লাহ পরবর্তী আয়াত দিয়ে তাদের এই যুক্তিকে ধরাশায়ী করেন। সুতরাং আয়াতের এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী কুরআনিস্টদের বক্তব্য হল এই আয়াতের মধ্যে 'ইন হুয়া' এই শব্দটি দিয়ে আল্লাহর রাসুলের সমস্ত কথাকে বুঝানো যেতে পারে আবার বিশেষভাবে কুরআনের যে ওহী তিনি তাদের কাছে প্রকাশ করেন তাও বোঝানো যেতে পারে। এখানে দ্বিতীয় সম্ভাবনাই বেশি অগ্রগণ্য এবং উপযুক্ত। মুশরিকদের সাথে আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ ও হাদীসের প্রামাণ্যতা নিয়ে দ্বন্ধ ছিলো না। বরং কুআনের আয়াতের প্রামাণ্যতা নিয়েই ছিলো। এবং সে যুগে মুশরিকদের সাথে ইসলামের দ্বন্দ্বটা হাদিস নিয়ে ছিলো না। বরং কুরআন নিয়েই ছিলো। আল্লাহর রাসুলের প্রতি নাযিলকৃত কিতাব এবং সেই কিতাবের দাওয়াত নিয়েই ছিলো। সুতরাং এখানে অধিক যুক্তিযুক্ত এটাই যে, আয়াত দিয়ে কুরআনকে বোঝানো হয়েছে  হাদীসে বুঝানো হয়নি। এবং হাদিসের গ্রহণযোগ্যতাও এই আয়াত থেকে সাব্যস্ত করা সম্ভবপর নয়। 


এবার সুরা হাশরের আরেকটি আয়াত-


وَ مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡہُ ٭ وَ مَا نَہٰىکُمۡ عَنۡہُ فَانۡتَہُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ


'রাসুল তোমাদেরকে যা দেয় তা তোমরা গ্ৰহণ করো এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো। এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।'


কুরআনিস্টরা আয়াতের মূল বক্তব্য থেকে অর্থাৎ সুন্নাহ ও হাদিসের প্রামাণ্যতা থেকে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সরিয়ে ফেলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নুকতা বেছে নিয়েছে। তারা বলতে চায়, এই আয়াত যে ব্যাপারে নাযিল হয়েছে তা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এই আয়াত আল্লাহ মূলত গনিমতের সম্পদের ব্যাপারে এবং আল্লাহ রাসুল যাকে যা কিছু দেন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে কোনো আপত্তি প্রকাশ না করার জন্য নাজিল করেছেন। 


তাদের বক্তব্যের খন্ডনে আমরা কুরআনের উসুলবিদগণের এই বক্তব্যকে সামনে নিয়ে আসতে পারি। উসুল বিজ্ঞানের মন্তব্য অনুযায়ী এই আয়াত মূলত গনিমতের ব্যাপারে নাযিল হলেও তা সামগ্রিকভাবে আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্ব ও আনুগত্যের দিকেই ইঙ্গিত করে। এমনকি তা যদি অজু এবং পবিত্রতার ব্যাপারে হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রেও এই আয়াতটি দলিল হিসেবে সাব্যস্ত। সুতরাং আনুগত্যের ক্ষেত্রে আরো অন্যান্য যেসকল বিষয়াবলী আছে তা সকলেই এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে। এই আয়াত বিষয়ে কুরআনিস্টদের খন্ডনে উসুলবিদগণেরর এই বক্তব্যের প্রতি আমরা সন্তুষ্ট। আমাদের অন্য


কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই। 


তৃতীয় যুক্তি: হাদিস লিপিবদ্ধ করতে রাসুল বলে যাননি।


 তৃতীয় যুক্তিঃ 

কুরআনিস্টরা সুন্নাহ'র প্রামাণ্যতার বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে কেবলমাত্র কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে দলিল দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি বরং তারা আরো অনেক যুক্তি উপস্থাপন করেছে। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো-


*তারা বলতে চায়- যদি হাদিস শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হতো তবে তা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সংকলন করা হতো। এবং খোদ আল্লাহর রাসুলও কাজ করার আদেশ দিতেন। যেহেতু আল্লাহর রাসুলের পক্ষ থেকে এমন কোনোকিছুই প্রমাণিত নয় সুতরাং হাদিস কোনোভাবেই শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে যৌক্তিক নয়। 


*তারা আরও বলতে চায়- কুরআনুল কারীমের সুস্পষ্টতা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাদিসকে প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, কুরআনই সবকিছুর জন্যই সুস্পষ্ট প্রমাণ। যেহেতু কুরআন নিজে একথা বলেনি যে, 'আমার এই ধারা বর্ণনার বিষয়ের গুরুত্ব হাদিস থেকে সাব্যস্ত হয়' সেহেতু কুরআন নিজেই নিজের প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তাই হাদিসের প্রয়োজন নেই।


আহলুস সুন্নাহ'র আলিমগণ তাদের এই যুক্তি বিপরীতের বলেছেন, কুরআনুল কারীমের সব কিছু বোঝার সামর্থ্য সবার নেই। বরং তা কেবলমাত্র নবী আলাইহিস সালাম এবং তাঁর সম্মানিত পরিবারের যোগ্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।  আমরা যা নিজ থেজে বুঝি তা মূলত এই মহাগ্রন্থের ক্ষুদ্রাংশ। 


*তারা আরো বলতে চায়- আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআন সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। হাদিস সুরক্ষার দায়িত্ব নেননি। যেহেতু কুরআন সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন তাই কুরআনই শরীয়তের একমাত্র মানদণ্ড। হাদিস নয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-


اِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا الذِّکۡرَ وَ اِنَّا لَہٗ لَحٰفِظُوۡنَ


'নিশ্চয় আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই অবশ্যই এটির সংরক্ষক।'


তাদের এই যুক্তি কতটা অযৌক্তিক তা খোদ তাদের দাবী থেকে প্রমাণিত হয়। কারণ আল্লাহ তা'আলা হাদিস যেমন সংরক্ষণের দায়িত্ব নেননি ঠিক তেমনি ভাবে তাওরাত-ইঞ্জিল হেফাজতের দায়িত্বও নেননি। তাওরাত ও ইঞ্জিলকে তাদের লোকেরাই পুরোপুরি বিকৃত করে ফেলেছে। অথচ তা সুরক্ষা করা তাদেরই দায়িত্ব ছিল। আল্লাহর দায়িত্ব ছিল না। তাই বলে কি তাওরাত-ইঞ্জিল আল্লাহর কিতাব না হওয়া কিংবা তাদের শরীয়তের মানদন্ড না হওয়া সাব্যস্ত হয়? হয়না তো। একইভাবে আল্লাহর রাসুলের হাদিসের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি প্রযোজ্য। আল্লাহ তা'আলা হাদিস সংরক্ষণের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেননি বলে তা বিকৃত ও মানহীন হয়ে যায়না। বরং তা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। 


যাই হোক, তারা এমন আরো অনেক কথা বলে। তবে তাদের মূল এজেন্ডা তিনটি।


প্রথমতঃ হাদিসের উপর কঠিন আঘাত করে হাদিসকে মানুষের কাছে সন্দেহজনক করে তোলা। যদিও হাদিস বর্ণনার বহু পদ্ধতি এবং নিয়ম-নীতিমালা থাকুক না কেন। 


দ্বিতীয়তঃ হাদিস শরীয়তের দ্বিতীয় স্তম্ভ হওয়ার যে সকল দলিল আছে সেসব দলিলকে সন্দেহজনক করে তোলা। যা আমরা ইতিপূর্বে সংক্ষেপে আলোচনা করে এসেছি। 


তৃতীয়তঃ হাদিসের প্রামাণ্যতার বিপক্ষে প্রমাণ উপস্থাপন করা। তন্মধ্যে একটি হলো হাদিস সংকলনের বিষয়। 


তাদের প্রতিটি এজেন্ডা বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে। তাই আমরা এখানে সংক্ষেপে এজেন্ডাগুলো উল্লেখ করলাম। ভবিষ্যতে কখনো পূর্ণ রচনায় এ বিষয়ে লেখা আসলে সেখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। এবার আমরা আরেকটি বিষয়ে যাই। 


যেহেতু কুরআনিস্টরা কুরআন দিয়ে সবকিছু যাচাই করে তাই তাদের কিছু ইজতিহাদের মূল নীতিমালা থাকা বাঞ্ছনীয়। যদিও তাদের দ্বীনের বিষয়ে ইজতিহাদের তেমন কোনো মূলনীতিমালাই নেই। তবুও তাদের দিক থেকে তারা তিনটি মূল নীতিমালাকে সামনে রাখে।


প্রথম মূলনীতিঃ কোনোভাবেই কোনো মাসআলায় হাদিসের কাছে যাওয়া যাবে না। হাদিসের বিশাল ইলমী তুরাসের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। এটাই তাদের ইজতিহাদের প্রথম মূলনীতি। 


দ্বিতীয় মূলনীতিঃ কুরআনের টেক্সট বোঝার ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থকে প্রাধান্য দেয়া। এমনকি তারা শানে নুযুলকেও পাত্তা দেয় না। কারণ, তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে শানে নুযুল সীমাবদ্ধ। একইভাবে তারা কোনো হাদিস বর্ণনার প্রেক্ষাপটকেও গুরুত্ব দেয় না। এমনকি তারা এও বলে যে, কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থের বিকল্প নেই। এ কারণে তারা রাসুল পরবর্তী যুগের ইজতিহাদের যে কোনো পদ্ধতি ও দ্বীনি ইলমের অন্যান্য সকল শাখাকে অস্বীকার করে। তাদের ব্যাপারে আমাদের আপত্তি মূল জায়গা এটাই যে, তারা মারাত্মকভাবে শাব্দিক অর্থের উপর নির্ভরশীল। এ কারণে তারা হাদিস অস্বীকার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে শাব্দিক অর্থের ভিন্নতাকে আমলে নেয়। তারা বক্সের বাইরে চিন্তা করতে পারে না।


তৃতীয় মূলনীতিঃ যখন তারা কোনো বিষয়ে ইজতিহাদ করে ভেবেচিন্তে কোন মূলনীতি নির্বাচন করে তখন তা কুরআনিক মূলনীতির সাথে মিলিয়ে দেখে। যদি সে মূলনীতিগুলোর কোনোটা সরাসরি কুরআন বৈধতা না দেয় এবং ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হয় সেক্ষেত্রে তারা তা গ্রহণ করেনা। অর্থাৎ বাস্তবতার সাথে তারা সেটাকে মিলিয়ে দেখেনা। যা আহলুস সুন্নাহ'র আলিমগণ করে দেখেন। এমনকি তা শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ হলেও সেটার উপরে হারামের হুকুম লাগিয়ে দেয়। 


কুরআনিস্টদের কাছে ফিকহী বিষয়াদি বাছাইয়ের নিজস্ব কিছু পন্থা ও পদ্ধতি আছে। উপরোক্ত তিন মূলনীতিকে  সামনে রেখে কুরআনিস্টরা কোনো মাসআলা দেয়ার কিছু পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। 


প্রথমতঃ সর্বাবস্থায় নামাজের আগে ওযু করা ওয়াজিব। ব্যক্তির অজু এক ওয়াক্ত নামাজের পর অপর ওয়াক্তের আগে ছুটে যাক বা না যাক তাকে অজু করতেই হবে। তাদের মতে, কেননা আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদাতে বলেছেন- 


یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا قُمۡتُمۡ اِلَی الصَّلٰوۃِ فَاغۡسِلُوۡا وُجُوۡہَکُمۡ وَ اَیۡدِیَکُمۡ اِلَی الۡمَرَافِقِ وَ امۡسَحُوۡا بِرُءُوۡسِکُمۡ وَ اَرۡجُلَکُمۡ اِلَی الۡکَعۡبَیۡنِ ؕ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ جُنُبًا فَاطَّہَّرُوۡا ؕ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مَّرۡضٰۤی اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ اَوۡ جَآءَ اَحَدٌ مِّنۡکُمۡ مِّنَ الۡغَآئِطِ اَوۡ لٰمَسۡتُمُ النِّسَآءَ فَلَمۡ تَجِدُوۡا مَآءً فَتَیَمَّمُوۡا صَعِیۡدًا طَیِّبًا فَامۡسَحُوۡا بِوُجُوۡہِکُمۡ وَ اَیۡدِیۡکُمۡ مِّنۡہُ ؕ مَا یُرِیۡدُ اللّٰہُ لِیَجۡعَلَ عَلَیۡکُمۡ مِّنۡ حَرَجٍ وَّ لٰکِنۡ یُّرِیۡدُ لِیُطَہِّرَکُمۡ وَ لِیُتِمَّ نِعۡمَتَہٗ عَلَیۡکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ


'হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতের জন্য দাঁড়াতে চাও তখন তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল ও হাতগুলো কনুই পর্যন্ত ধুয়ে নাও এবং তোমাদের মাথায় মাসেহ কর এবং পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধুয়ে নাও। এবং যদি তোমরা অপবিত্র থাকো তবে বিশেষভাবে পবিত্র হবে। আর যদি তোমরা অসুস্থ হও বা সফরে থাকো বা তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে, বা তোমরা স্ত্রীর সাথে সংগত হও এবং পানি না পাও তবে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করবে। সুতরাং তা দ্বারা মুখমণ্ডলে ও হাতে মাসেহ করবে। আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না। বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তার নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।' 


এ আয়াত অনুসারে তাদের মূলনীতির সাথে মিলিয়ে তারা প্রত্যেক নামাজের আগে ওযু ছুটে যাক বা না যাক অজু করাকে ওয়াজিব সাব্যস্ত করে।


দ্বিতীয়তঃ তাদের মতে, কুরআন কোনো কিছু করতে বাধ্য করেনি। কোনো হুকুম মানতে হবে এমন কথা বলেনি। উদাহরণস্বরূপ, আহলুস সুন্নাহ'র আলিমগণের মতে, জিহাদ করা ফরয। ধর্ম ত্যাগ করলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু কুরআনিস্টরা তা মানেনা। তারা বলে, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা এসব বাধ্যতামূলক করেননি। কারণ সূরা কাহাফে আছে-


وَ قُلِ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکُمۡ ۟ فَمَنۡ شَآءَ فَلۡیُؤۡمِنۡ وَّ مَنۡ شَآءَ فَلۡیَکۡفُرۡ


'আর বলুন সত্য তোমাদের রবের কাছ থেকে এসেছে। কাজেই যার ইচ্ছে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছে কুফরী করুক।'


এ আয়াত থেকে তারা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সাব্যস্ত করেছে। সকল বিধি-বিধান নিরঙ্কুশ ভাবে পালন করার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়। নাউযুবিল্লাহ! তারা আসলে কুরআনপন্থী নয়। বরং তারা নিজেদের চিন্তা চেতনাকে পাশ্চাত্য চিন্তা চেতনার সাথে মেলানোর জন্য কুরআনকে ব্যবহার করেছে।


তৃতীয়তঃ স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোনো সমস্যা দেখা দিলে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন বিচারক নিয়োগকে তারা বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করেছে। যেহেতু কুরআন বলেছে-


وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِہِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰہُ بَیۡنَہُمَا ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا


'আর তাদের উভয়ের মধ্যে বিরোধ আশংকা করলে তোমরা স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করো। তারা উভয়ে নিস্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সবিশেষ অবহিত।'


এই আয়াতের মাধ্যমে তারা যে বিচারক নিয়োগকে বাধ্যতামূলক সাব্যস্ত করে তা আমাদের ফকিহগণ করেন না। আমাদের ফকিহগণ একে মুস্তাহাব পর্যায়ের বিবেচনা করেন যেন উভয়ের মাঝে পুনর্মিলন ঘটে। কিন্তু কুরআনিস্টরা সমস্যা নিরসনের জন্য তাদের মূল নীতিমালা অনুসারে বিচারক নিয়োগকে উভয়পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক হুকুম দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে দেখা যাবে, পারিবারিক আদালত গঠন করতে হবে যেখানে উভয়পক্ষই উভয়পক্ষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখবে। এতে সমস্যা নিরসন হবে না বরং সমস্যা বৃদ্ধি পাবে। এ থেকে বোঝা যায় তারা কুরআনের অনুসরণ নয় বরং কুরআনের বিপরীতে গিয়ে আমল করছে। 


চতুর্থতঃ কুরআনিস্টদের মতে যিনার শাস্তি কেবলমাত্র দোররা মারা। রজম নয়। হাদিসে বর্ণিত কুমারী ও বিবাহিত নারী পুরুষের যে পার্থক্য ও বর্ণনা এসেছে তার সবকিছুকেই প্রত্যাখ্যান করে তারা কুরআনের আয়াতের উপর হুকুম দিয়ে বসে। যেহেতু কুরআন  বলেছে-


اَلزَّانِیَۃُ وَ الزَّانِیۡ فَاجۡلِدُوۡا کُلَّ وَاحِدٍ مِّنۡہُمَا مِائَۃَ جَلۡدَۃٍ ۪ وَّ لَا تَاۡخُذۡکُمۡ بِہِمَا رَاۡفَۃٌ فِیۡ دِیۡنِ اللّٰہِ اِنۡ کُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰہِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ۚ وَ لۡیَشۡہَدۡ عَذَابَہُمَا طَآئِفَۃٌ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ


'ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী— তাদের প্ৰত্যেককে একশত বেত্ৰাঘাত করবে। আল্লাহর বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে প্রভাবান্বিত না করে। যদি তোমরা আল্লাহ্‌ এবং আখেরাতের উপর ঈমানদার হও। আর মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্ৰত্যক্ষ করে।' 


পঞ্চমতঃ দাসপ্রথাকে কুরআনিস্টরা অবৈধ হিসেবে দেখে। তারা বলতে চায় কুরআন দাসপ্রথাকে অবৈধ হিসেবে দেখেছে। কারণ কুরআনে এসেছে-


فَاِذَا لَقِیۡتُمُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَضَرۡبَ الرِّقَابِ ؕ حَتّٰۤی اِذَاۤ اَثۡخَنۡتُمُوۡہُمۡ فَشُدُّوا الۡوَثَاقَ ٭ۙ فَاِمَّا مَنًّۢا بَعۡدُ وَ اِمَّا فِدَآءً حَتّٰی تَضَعَ الۡحَرۡبُ اَوۡزَارَہَا


'অতএব যখন তোমরা কাফিরদের সাথে মুকাবিলা করো তখন ঘাড়ে আঘাত কর। অবশেষে যখন তোমরা তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করবে তখন তাদেরকে মজবুতভাবে বাঁধো। তারপর হয় অনুকম্প নয় মুক্তিপণ। যতক্ষণ না যুদ্ধ এর ভার (অস্ত্র) নামিয়ে না ফেলে।' 


দাসপ্রথা তখন বহুলভাবে প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও কুরআনিস্টরা এটাকে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে না  অথচ পবিত্র কুরআন নাযিলের যুগে এমন অনেক ক্রীতদাস ছিল যাদেরকে নিজেদের কাছে রাখা কুরআন অবৈধ বলেনি। বরং কেবলমাত্র তাদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে। সুতরাং এখানে কোনোভাবে নতুন করে দাসপ্রথাকে অবৈধ কিংবা আরোপিত বলার সুযোগ নেই। কিন্তু তারা অন্যান্য আয়াতের ক্ষেত্রে নানাবিধ পার্থক্য ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় না রেখে সরাসরি হুকুম দিয়েছে। কিন্তু এই আয়াতের ক্ষেত্রে নিজস্ব ব্যাখার দিকে চলে গেছে। অথচ কুরআনে স্পষ্ট ভাবে দাসপ্রথা বন্ধ করার কোনো বাধ্যতামূলক হুকুম নাযিল হয়নি। এবং উম্মতের জমহুর আলিমগণও একে সরাসরি অবৈধ ও কুরআনে নিষিদ্ধ উল্লেখ করেননি। যেহেতু কুরআন সরাসরি একে নিষিদ্ধ উল্লেখ করেনি। এ ব্যাপারে বিশদ বর্ণনা হাদিসে আছে। কিন্তু কুরআনিস্টরা এসব আমলে না নিয়ে নিজেদের ব্যাখার দিকে চলে গেছে। এখানেই তাদের দ্বিচারিতা প্রমাণিত হয়।



ষষ্টতঃ কুরআনিস্টদের কিছু পন্ডিত এই মত পোষণ করে যে, একজন মহিলার জন্য যা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ তা হল শুধুমাত্র তার সৌন্দর্য। এই নিষেধাজ্ঞা তার পুরো শরীরের উপর নয়। তারা এক্ষেত্রে মহান আল্লাহর বাণী দলীল হিসেবে উপস্থাপন করে। আল্লাহ তা'য়ালা সুরা আহযাবে বলেছেন,


یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلۡ لِّاَزۡوَاجِکَ وَ بَنٰتِکَ وَ نِسَآءِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ یُدۡنِیۡنَ عَلَیۡهِنَّ مِنۡ جَلَابِیۡبِهِنَّ ؕ ذٰلِکَ اَدۡنٰۤی اَنۡ یُّعۡرَفۡنَ فَلَا یُؤۡذَیۡنَ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا


'হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনগণের নারীদেরকে বলুন, ‘তারা যেন তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'


এই আয়াত এবং সৌন্দর্য প্রদর্শনের ক্ষেত্রে মাহরাম ব্যতীত অন্যদের সামনে নিজেদেরকে উপস্থাপন না করার বিষয়ে তাদের মত হলো, কেবলমাত্র সৌন্দর্য প্রকাশক উপাদান তথা চেহারার সাজসজ্জা অথবা যা কিছু তার সৌন্দর্যকে প্রকাশ করবে তা-ই নিষিদ্ধ। উদ্দেশ্য শরীর নয়। অথচ, এই চিন্তা পুরোটাই গলদ। জমহুর ফকীহগণের মত হলো, একজন নারীর সমস্তটাই 'যীনাহ'-এর অন্তর্ভুক্ত। ক্ষেত্রবিশেষে মুখ ও হাত ব্যতীত তাকে অবশ্যই তার সমস্ত শরীর ঢেকে রাখতে হবে। ফকিহগণের এই মত আয়াত, আয়াতের তাফসীর, প্রেক্ষাপট এবং মুসলমানদের ইতিহাস থেকে সহজেই সাব্যস্ত হয়। কিন্তু কুরআনিস্টরা বলে, যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে মূলত একজন নারী যে সাজসজ্জা প্রদর্শন করে তা। তার পুরো শরীর নয়। তাদের মতে, শরীর যখন তাকে বিপদের মুখোমুখি করে না। করে শারীরিক সাজসজ্জা।


এইখানে একটা কথা বলে রাখি, পাকিস্তানের গোমরাহ জাভেদ গামেদীও এসব বলে। সে বলতে চায়, নারীদের পর্দা হলো শালীন পোষাক। নির্দিষ্ট কোনো পর্দা নয়।


সপ্তমতঃ অনেক কুরআনিস্ট পন্ডিত হজ্বের নিষিদ্ধ কার্যাবলী শুধুমাত্র অশ্লীলতা, অনৈতিকতা এবং বিতর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। তাদের দলীল সুরা বাকারাহ'র ঐ আয়াত-


اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕؔ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ


'হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ্ব আরোপ করে নিলো, তার জন্য হজ্বে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভালো কাজের যা করো, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ করো। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় করো।'


তাদের মতে আয়াতে উল্লিখিত বিষয়াবলী ব্যতীত বাকী সবই হজ্বের সময় করা বৈধ। অথচ, এমন অনেক বিষয় আছে যা পবিত্র হজ্বকে বাধাগ্রস্ত করে এবং গোনাহের দরজা খুলে দেয়। একারণেই বিখ্যাত ফকীহগণ যারা মুহরিম তথা হাজ্বী তাদের জন্য অনেক কিছু নিষিদ্ধ করেছেন।


উপরন্তু, আরবদের ভাষায় 'জিদাল' মানে তর্ক করা। স্রেফ শাব্দিকতা বিবেচনায় রেখে দুয়েক কথা কাটাকাটি করলেই হজ্ব বিনষ্ট হয়ে যায় না। তাই কুরআনিস্ট এই অক্ষরবাদী আচরণ কুরআনের আয়াতের সুস্পষ্ট বিকৃতি। এখানে শাব্দিকতা ধরে নিয়েই হুকুম আবর্তিত হয় না। 


তাছাড়া হজ্বের সময আরো যে নিষেধাজ্ঞাগুলো আছে সেগুলো যখন আপনি তাদেরকে বলবেন যে, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো মুতাওয়াতির হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। যেমন, চেহারা ঢাকা নিষেধ, আয়না দেখা নিষেধ ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন তারা আপনাকে বলবে, 'আমরা এসব মানি না। মুতাওয়াতির হাদিসের কোনো গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে নেই। আমরা কেবল কুরআনে যা আছে তা-ই মানব।'


অষ্টমতঃ কুরআনিস্টরা নিষিদ্ধ বস্তু আহার হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে কুরআনের আয়াতে উল্লিখিত বস্তুগুলোকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। তারা দলীল হিসেবে দুটি আয়াত উপস্থাপন করে। আয়াতগুলো এই,


قُلۡ لَّاۤ اَجِدُ فِیۡ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیَّ مُحَرَّمًا عَلٰی طَاعِمٍ یَّطۡعَمُهٗۤ اِلَّاۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ مَیۡتَۃً اَوۡ دَمًا مَّسۡفُوۡحًا اَوۡ لَحۡمَ خِنۡزِیۡرٍ فَاِنَّهٗ رِجۡسٌ اَوۡ فِسۡقًا اُهِلَّ لِغَیۡرِ اللّٰهِ بِهٖ ۚ فَمَنِ اضۡطُرَّ غَیۡرَ بَاغٍ وَّ لَا عَادٍ فَاِنَّ رَبَّکَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ


'বলুন, ‘আমার নিকট যে ওহী পাঠানো হয়, তাতে আমি আহারকারীর উপর কোনোকিছু হারাম পাই না, যা সে আহার করে। তবে যদি মৃত কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের গোশত হয়,তবে তা হারাম। কারণ, নিশ্চয় তা অপবিত্র কিংবা এমন অবৈধ যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য যবেহ করা হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে অবাধ্য ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে তা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে, তাহলে নিশ্চয় আপনার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'


یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنَّمَا الۡخَمۡرُ وَ الۡمَیۡسِرُ وَ الۡاَنۡصَابُ وَ الۡاَزۡلَامُ رِجۡسٌ مِّنۡ عَمَلِ الشَّیۡطٰنِ فَاجۡتَنِبُوۡهُ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ


'হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।'


কুরআনিস্টদের মতে, এই খাবারগুলো বাদে যাকিছু মানবদেহের ক্ষতি করে না সবই খাওয়া যাবে। অথচ, হাদীসে এমন অনেক খাবারের কথা উল্লেখ আছে যা মানব অভিরুচি বিরুদ্ধ হওয়ার কারণে খাওয়া নিষেধ। হোক তা উপকারী বা ক্ষতিমুক্ত। 


নবমতঃ কিছু কুরআনিস্ট এই মত পোষণ করে যে, পবিত্র কুরাআনে মাহরামের আয়াতটিতেই কারা মাহরাম, কারা মাহরাম নয় তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুরা নুরের এই আয়াত,


قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِهِنَّ ۪ وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا لِبُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اٰبَآئِهِنَّ اَوۡ اٰبَآءِ بُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اَبۡنَآئِهِنَّ اَوۡ اَبۡنَآءِ بُعُوۡلَتِهِنَّ اَوۡ اِخۡوَانِهِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اِخۡوَانِهِنَّ اَوۡ بَنِیۡۤ اَخَوٰتِهِنَّ اَوۡ نِسَآئِهِنَّ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُهُنَّ اَوِ التّٰبِعِیۡنَ غَیۡرِ اُولِی الۡاِرۡبَۃِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفۡلِ الَّذِیۡنَ لَمۡ یَظۡهَرُوۡا عَلٰی عَوۡرٰتِ النِّسَآءِ ۪ وَ لَا یَضۡرِبۡنَ بِاَرۡجُلِهِنَّ لِیُعۡلَمَ مَا یُخۡفِیۡنَ مِنۡ زِیۡنَتِهِنَّ ؕ وَ تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ جَمِیۡعًا اَیُّهَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ


'আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। আর যা সাধারণত প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য তারা প্রকাশ করবে না। তারা যেন তাদের ওড়না দিয়ে বক্ষদেশকে আবৃত করে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজেদের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, আপন নারীগণ, তাদের দাস, যাদের মালিক তারা হয়েছে, অধীনস্থ যৌনকামনামুক্ত পুরুষ অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ বালক ছাড়া কারো কাছে নিজেদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন নিজদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য সজোরে পদচারণা না করে। হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।'


তাদের মতে, যেহেতু এই আয়াতে চাচা, মামা এবং ফুফুর কথা উল্লেখ করা হয়নি, তাই তাদের সামনে সাজসজ্জা প্রদর্শন করা জায়েয নয়। যদিও মুসলমানদের ঐক্যমত যে, চাচা, মামা ও ফুফুর সামনে পর্দা না করা এবং সাজসজ্জা দেখানো জায়েজ। এই বৈধ প্রদর্শনকে অবৈধ ঘোষণা করে তারা যুগযুগ ধরে চলে আসা ইসলামী ফিকহ ও তাওয়াতুর হাদিসকে অস্বীকার করে গৌণ করে ফেলে। 


দশমতঃ উত্তরাধিকার সম্পদের বিষয়েও কুরআনিস্টদের মতামত জমহুর ফকিহ ও আহলুস সুন্নাহর মতের বিরোধী। আল্লাহ তা'য়ালা সুরা নিসায় বলেছেন,


یُوۡصِیۡکُمُ اللّٰهُ فِیۡۤ اَوۡلَادِکُمۡ ٭ لِلذَّکَرِ مِثۡلُ حَظِّ الۡاُنۡثَیَیۡنِ ۚ فَاِنۡ کُنَّ نِسَآءً فَوۡقَ اثۡنَتَیۡنِ فَلَهُنَّ ثُلُثَا مَا تَرَکَ ۚ وَ اِنۡ کَانَتۡ وَاحِدَۃً فَلَهَا النِّصۡفُ ؕ وَ لِاَبَوَیۡهِ لِکُلِّ وَاحِدٍ مِّنۡهُمَا السُّدُسُ مِمَّا تَرَکَ اِنۡ کَانَ لَهٗ وَلَدٌ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یَکُنۡ لَّهٗ وَلَدٌ وَّ وَرِثَهٗۤ اَبَوٰهُ فَلِاُمِّهِ الثُّلُثُ ۚ فَاِنۡ کَانَ لَهٗۤ اِخۡوَۃٌ فَلِاُمِّهِ السُّدُسُ مِنۡۢ بَعۡدِ وَصِیَّۃٍ یُّوۡصِیۡ بِهَاۤ اَوۡ دَیۡنٍ ؕ اٰبَآؤُکُمۡ وَ اَبۡنَآؤُکُمۡ لَا تَدۡرُوۡنَ اَیُّهُمۡ اَقۡرَبُ لَکُمۡ نَفۡعًا ؕ فَرِیۡضَۃً مِّنَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا


'আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানদের সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, এক ছেলের জন্য দুই মেয়ের অংশের সমপরিমাণ। তবে যদি তারা দুইয়ের অধিক মেয়ে হয়, তাহলে তাদের জন্য হবে, যা সে রেখে গেছে তার তিন ভাগের দুই ভাগ; আর যদি একজন মেয়ে হয় তখন তার জন্য অর্ধেক। আর তার মাতা পিতা উভয়ের প্রত্যেকের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ সে যা রেখে গেছে তা থেকে, যদি তার সন্তান থাকে। আর যদি তার সন্তান না থাকে এবং তার ওয়ারিছ হয় তার মাতা পিতা তখন তার মাতার জন্য তিন ভাগের এক ভাগ। আর যদি তার ভাই-বোন থাকে তবে তার মায়ের জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ। অসিয়ত পালনের পর, যা দ্বারা সে অসিয়ত করেছে অথবা ঋণ পরিশোধের পর। তোমাদের মাতা পিতা ও তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্য থেকে তোমাদের উপকারে কে অধিক নিকটবর্তী তা তোমরা জানো না। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।'


এই আয়াতের মাধ্যমে কুরআনিস্টরা বলতে চায়, যেহেতু আয়াতে মুসলমান কিংবা কাফির সন্তানসন্ততি/মাতা-পিতার কথা স্পষ্ট করা হয় নি সেহেতু উভয়ই উভয়ের উত্তরাধিকার হতে পারবে! 


এই চিন্তাধারা থেকেই তো তাদের গোমরাহী স্পষ্ট হয়ে যায়!


উল্লিখিত দশটি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, কুরআনিস্টদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মতামত তাদের জন্য আলাদা শাস্ত্রীয় জগত নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা আহলুস সুন্নাহর সম্পূর্ণ বিপরীত! তাদের সে জগত থেকে সাহাবীদের ইজমা, ফুকাহাদের মতামত এবং আমল সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হয়েছে। আমি যে কটি উদাহরণ পেশ করেছি, সবকটিতেই হাদিসকে পরিত্যাগ করার ফলে অসামঞ্জস্যতা দেখা দিয়েছে। এবং সবকটি উদাহরণই হাদিস সহকারে ইসলামী ফিকহের মৌলিক বিষয়াবলীর অন্তর্ভুক্ত।


শুধু এতটুকুই নয়, ইবাদের ক্ষেত্রেও রয়েছে কুরআনিস্টদের নানান  বিচ্ছিন্নতা ও সংকট। তাদের জন্য সম্ভবত সবচে বড় সংকট হলো ইবাদত। কারণ, আহলুস সুন্নাহর জমহুর জনগোষ্ঠী কিছু বিষয়ে মতানৈক্য পোষণ করা ব্যতীত যেখানে নামাজ, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের বিধানে সকলেই একরকম সেখানে কুরআনিস্টরা কুরআন থেকে সরাসরি নামাজ, রোযার পদ্ধতি বের করতে গিয়ে বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে। কারণ, নামাজের পদ্ধতি তো আর সরাসরি কুরআনে উল্লেখ করা নেই। তাই তারা কুরআন মানতে গিয়ে নামাজ বানিয়ে ফেলেছে এক রাকআত!


যেহেতু ইবাদতের প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে করলে হাদিস লাগবেই, তাই তারা নিয়ে এসেছে নতুন যুক্তি। তাদের এক পন্ডিত, কুরআনিস্ট ডক্টর কাসিম আহমেদ বিবৃতি দিলো যে, এই ইবাদতগুলো মূলত আব্রাহামিক ধর্মের আচার। ইহুদী-খৃষ্টানরাও আমাদের মতই নামাজ, রোযা, হজ্ব করতো। কুরআন শুধু কিছু সংযুক্তি দিয়েছে। যেমন অজু করা, গোসল ফরজ হলে গোসল করা। বাকীসব তো পূর্বেকার ধর্ম থেকেই আসা। তাই এসব নাকি তারা কুরআন থেকেই পেয়েছে। হাদিস থেকে নয়!




সুতরাং কুর'আনিস্ট তথা যারা হাদিস অস্বীকার করে তাদের ব্যাপারে ওলামায়ে কিরামের ঐক্যমত হলো তারা কাফির, মুরতাদ, যিন্দিক। কেননা, দ্বীনের দ্বিতীয় মূলনীতিই হলো হাদিস। ইমাম সুয়ুতী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন,


'আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন। জেনে রাখো, যারা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্বওলী কিংবা ফে'লী (বক্তব্য ও কর্ম) কোনো হাদিসকে শরীয়তের মৌলিক প্রমাণ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করবে, সে কাফির হয়ে যাবে এবং ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। তার হাশর হবে ইহুদী, খ্রিষ্টান অথবা তার ইচ্ছামত অন্যকোনো কাফির সম্প্রদায়ের সাথে।'


ইমামগণ যে মূলনীতির আলোকে তাদের ভ্রান্তি ও কুফর প্রমাণ করেছেন তা আমরা ইমাম বায়হাকী রহিমাহুল্লাহর একটি বর্ণনা থেকে পাই। তিনি শোয়াইব বিন আবি ফাদ্বালাহ আল মাক্কীর সনদে ইমরান বিন হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। একবার তিনি শাফাআত তথা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ বিষয়ে আলোচনা করছিকেন। এক লোক বললো, 


-আপনি আমাদেরকে যেসকল হাদিস বর্ণনা করেন তার কোনো ভিত্তি তো আমরা কুরআনে পাই না। 


ইমরান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রেগেমেগে বললেন, 


-কুরআন পড়েছো কখনো?


লোকটি বললো,


-জি। পড়েছি।


তিনি বললেন,


-কুরআনে কোথাও পেয়েছো যে, ইশার নামাজ চার রাকআত, ফজর দুই রাকআত, যোহর চার রাকআত মাগরিব তিন রাকআত, আসর চার রাকআত?


লোকটি বললো, 


-না কখনো পাইনি এমন। 


এরপর ইমরান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন,


'তবে কোথা থেকে পেলে? তোমরা এবং আমরা সবাই এগুলো আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে পেয়েছি।'


এরপর তিনি যাকাতের নিসাব, হজ্বের নিয়মকানুন বিস্তারিত আলোচনা করলেন। আরো অনেককিছু বলে কথা শেষ করলেন এই বলে যে,


مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ ٭ وَ مَا نَهٰىکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ۘ﴿۷﴾


রাসুল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ করো, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর।


এরপর বললেন, 


'আমরা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনেক কিছুই পেয়েছি, যা তোমরা জানো না।'


সুতরাং আল্লাহ যা তাঁর কিতাবে হারাম করেছেন তা যেমন হারাম, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা হাদিসে হারাম করেছেন তাও হারাম। তেমনিভাবে আল্লাহ যা বাধ্যতামূলক করেছেন সেসবের মত রাসুল আলাইহিস সালাম যা বাধ্যতামূলক করেছেন তাও বাধ্যতামূলক। যে ব্যক্তি শুধু কিতাবুল্লাহকে যথেষ্ট মনে করবে, হাদিস থেকে দূরে থাকবে সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাবে। ইসলাম ও কুরআনের অনুসারী দাবীদার এই ব্যক্তি মূলত মিথ্যাবাদী। কারণ, হাদিসই কুরআনকে মানুষের সামনে ব্যাখা করেছে। ইসলামের অনেকগুলো বিধানের উৎসও হাদিস। আর হাদিসও আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা একপ্রকার ওহী। কুরআনে এসেছে,


مَا یَنۡطِقُ عَنِ الۡهَوٰی ؕ﴿۳﴾اِنۡ هُوَ اِلَّا وَحۡیٌ یُّوۡحٰی


'আর সে মনগড়া কথা বলে না। তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়।'


যে ব্যক্তি কুরআনকেই যথেষ্ট মনে করবে, তারপক্ষে কোনোভাবেই পরিপূর্ণ নামাজ, যাকাত, হজ্বসহ অনেকগুলো মৌলিক ইবাদত আদায় করা সম্ভব হবে না। কারণ, এই ইবাদাতের নিয়মনীতি ও বিস্তারিত বিশ্লেষণ হাদিসেই এসেছে। কুরআনে কি ফজর, যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশার নামাজের রাকআত, সময় এবং পদ্ধতি উল্লেখ আছে? তা তো নেই। কুরআনে কি স্বর্ণ, রৌপ্য, গৃহপালিত পশু ও শস্যের যাকাতের নিসাব উল্লেখ আছে? তা তো নেই। মুসলমান কি কুরআনে রমাদ্বানে দিনের বেলায় সহবাসের কাফফারার হুকুম খুঁজে পায়? সাদাকাতুল ফিতরের হুকুম এবং  প্রয়োজনীয় পরিমাণ কি কুরআনে উল্লেখ আছে? হজ্বের সময় সাফা মারওয়ায় সাতবার সাঈ করার কথা কুরআনে কোথায় আছে? হজ্বের বর্ণনা, জামারাতে পাথর ছুড়ে মারা এবং মিনায় রাত্রি যাপনের বিবরণ খুঁজে পাবে কেউ কুরআনে? মোদ্দাকথা, হজ্বের বিধানাবলী কি কুরআনে পাওয়া যায়? 


সুতরাং, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস শরীয়তের মৌলিক উৎস এটা প্রমাণিত হয়। শরীয়াহ প্রণয়ন হোক কিংবা পদ্ধতি বর্ণনার জন্য হোক। সব দিক থেকেই হাদিস অবশ্যম্ভাবী। যারা সুন্নাহকে অস্বীকার করে, তাদের আসলে কোনো যুক্তি নেই। সুন্নাহ ছাড়া কুরআন কিভাবে বুঝে তারা? যেখানে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমৃত্যু ইসলামের কর্মগত দিক বর্ণনা করে গেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ইসলামের বিধিবিধানের বিশদ বর্ণনাই করে গেছেন। তাঁর পন্থা ছিল ভারসাম্যতা এবং পরিপূর্ণতার সমন্বয়। সুতরাং, এরপরেও যারা সুন্নাহকে অস্বীকার করে, প্রকারান্তরে তারা কুরআনকেই অস্বীকার করে। 


আমরা যদি সুন্নাহ অস্বীকারকারীদের ধারণার প্রতি ইসলামের অবস্থানের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, ইমাম ও মুজতাহিদগণ সকলেই একমত হয়েছেন যে, নবীর সুন্নাহ ইসলামী শরীয়াহ'র অন্যতম ভিত্তি। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো কর্ম বা বর্ণনা যখন বিশুদ্ধভাবে সামনে আসবে তখন তা গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা এতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পাওয়া যায়। 


১. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের প্রতি ঈমান আনয়ন। রিসালাতের প্রতি ঈমান আনার দাবী হলো, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু বর্ণনা করেছেন তা বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নেয়া। কারণ, আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন,


یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اٰمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ الۡکِتٰبِ الَّذِیۡ نَزَّلَ عَلٰی رَسُوۡلِهٖ وَ الۡکِتٰبِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا


'হে মুমিনগণ, তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি তাঁর রাসুলের উপর নাযিল করেছেন এবং সে কিতাবের প্রতি যা তিনি পূর্বে নাযিল করেছেন। আর যে আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসুলগণ এবং শেষ দিনকে অস্বীকার করবে, সে ঘোর বিভ্রান্তিতে বিভ্রান্ত হবে।'


আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর শরীয়াহ'র দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং, তিনি কখনোই এমন কিছু মানুষের কাছে পৌঁছে দেননি যা আল্লাহর শরীয়াহতে নেই। এবং তিনি নিষ্পাপ। তার নিষ্পাপ হওয়ার ব্যাপারে সমগ্র উম্মাহ ঐক্যমত পোষণ করেছে। সুতরাং, তিনি কোনো অসত্য ও কুরআন বিরোধী বিধান দেবেন এটা কল্পনারও বহু উর্ধ্বে। একারণেই, তাঁর সুন্নাহ ইসলামের মৌলিক ভিত্তি। 


২. কুরআনুল কারীমের অনেকগুলো আয়াত আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্যের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,


یایها الذین امنوا اطیعوا الله و اطیعوا الرسول و اولی الامر منکم ۚ فان تنازعتم فی شیء فردوه الی الله و الرسول ان کنتم تؤمنون بالله و الیوم الاخر ذلک خیر و احسن تاویلا 


হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর ও আনুগত্য করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ করোতাহলে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তণ করাও- যদি তোমরা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখো। এটি উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্টতর।


আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করানোর অর্থ হলো আল্লাহর কিতাবের দিকে প্রত্যাবর্তন করানো। আর রাসুলের দিকে প্রত্যাবর্তন করানোর অর্থ হাদিসের দিকে প্রত্যাবর্তন করানো। 


আল্লাহ তা'আালা সুরা মায়িদাতে বলেছেন,


و اطیعوا الله و اطیعوا الرسول و احذروا ۚ فان تولیتم فاعلموا انما علی رسولنا البلغ المبین


আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো রাসুলের আর সাবধান হও। তারপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখো যে, আমার রাসূলের দায়িত্ব শুধু সুস্পষ্ট প্রচার। 


আর তাছাড়া রাসুলের আনুগত্য মানেই আল্লাহর আনুগত্য। আল্লাহ তা'আলা বলেছেন,


من یطع الرسول فقد اطاع الله ۚ و من تولی فما ارسلنک علیهم حفیظا


যে রাসুলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহরই আনুগত্য করল। আর যে বিমুখ হল, তবে আমি তোমাকে তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি।


কুরআনের অনেকগুলো আয়াত আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ অনুসরণের কথা বলে। সুরা হাশরে এসেছে,


مَاۤ اٰتٰىکُمُ الرَّسُوۡلُ فَخُذُوۡهُ ٭ وَ مَا نَهٰىکُمۡ عَنۡهُ فَانۡتَهُوۡا ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعِقَابِ ۘ﴿۷﴾


রাসুল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহণ করো, আর যা থেকে সে তোমাদের নিষেধ করে তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর।


সুরা নুরে এসেছে,


و اقیموا الصلوۃ و اتوا الزکوۃ و اطیعوا الرسول لعلکم ترحمون 


আর তোমরা সালাত কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রাসুলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হতে পারো।


সুরা নিসায় বলা হয়েছে,


فلا و ربک لا یؤمنون حتی یحکموک فیما شجر بینهم ثم لا یجدوا فی انفسهم حرجا مما قضیت و یسلموا تسلیما


অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোন দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।


সুরা আহযাবে,


و ما کان لمؤمن و لا مؤمنۃ اذا قضی الله و رسولهٗ امرا ان یکون لهم الخیرۃ من امرهم و من یعص الله و رسولهٗ فقد ضل ضللا مبینا


আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো নির্দেশ দিলে কোনো মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। 


আল্লাহ তা'আলা পবিত্র কুরআনে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর হিকমাহ নাযিলের কথা বলেছেন। ওলামায়ে কিরাম বলেছেন এখানে হিকমাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ। কুরআনে এসেছে,


و لو لا فضل الله علیک و رحمتهٗ لهمت طائفۃ منهم ان یضلوک و ما یضلون الا انفسهم و ما یضرونک من شیء و انزل الله علیک الکتب و الحکمۃ و علمک ما لم تکن تعلم و کان فضل الله علیک عظیما


আর তোমার উপর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া না হত তবে তাদের মধ্য থেকে একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করার সংকল্প করেই ফেলেছিলো! আর তারা নিজদের ছাড়া কাউকে পথভ্রষ্ট করে না এবং তারা তোমার কোনোই ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন কিতাব ও হিকমাহ এবং তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তুমি জানতে না। আর তোমার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ রয়েছে মহান। 


৩. অনেকগুলো হাদিস আছে, যেখানে হাদিস অনুসরণ এবং হাদিসের উৎসের স্পষ্টতার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,


تركت فيكم أمرين لن تضلوا ما تمسكتم بهما: كتاب الله و

سنتي...


তোমাদের মাঝে আমি দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত তোমরা তা আঁকড়ে ধরবে ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। বিষয় দুটি হলো আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। 


আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,


ألا إني أوتيت الكتاب ومثله


জেনে রাখো! আমাকে কিতাব এবং তার মত অন্য কিছু দান করা হয়েছে।


আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,


عليكم بسنتي، وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجد. 


তোমরা আমার সুন্নত এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরো এবং তা রীতিমতো মাড়ির দাঁত দিয়ে চেপে ধরো।


৪. মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত সমগ্র মুসলিম উম্মাহ আল্লাহ তা'আলার কিতাবকে যেভাবে বিনা ভাগ্যে গ্রহণ করে নিয়েছে তেমনিভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকেও সেভাবেই শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে।


এবার আমরা কুরআনিস্টদের ব্যাপারে বর্তমান সময়ের মিশরের আলিমদের মতামত কী সেটা জানব। 


শায়খুল আযহার ডক্টর সাঈদ তানতাভী কুরআনিস্টদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শ খণ্ডন করেছেন কড়া ভাষায়। কুরআনিস্ট নামধারী এই লোকদের ব্যাপারে বলেছেন,


'তারা জাহিল। দ্বীনের কোনো অনুধাবনই তাদের নেই। তিনি বেশ দৃঢ় ভাষায় বলেছেন যে, কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাদিস ও সুন্নাহকে অপাংক্তেয় করার সুযোগ নেই। কারন, আল্লাহর রাসুলের সুন্নাহ পবিত্র কুরআনকে মানবজাতির সামনে স্পষ্টত ব্যাখ্যা দেয়ার জন্যই এসেছে। বরং যা কিছু কুরআনে শুধুমাত্র সুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে হাদিস এসে তা বিস্তৃত করেছে। যেমন, নামাজ আদায়ের পদ্ধতি এবং নামাজের মাঝখানে আমরা কী কী পড়বো, হজ্বের নিয়ম নীতি, যাকাত ও যাকাতের প্রকারভেদ, নিসাব, পরিমাণ, রোযার যে ফরযিয়্যাত কুরআনে অবতীর্ণ হয়েছে তার ধরণ, কী কী কারণে রোযা ভেঙে যায় সেসবের বিশদ বর্ণনা হাদিসই আমাদের কাছে বয়ান করেছে।'


শায়খুল আযহার আরো বলেন,


'যে বা যারাই আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কুরআনকে অনুসরণ করার কথা বলে, তারা জাহিল। দ্বীনের কোনো স্পষ্ট ধারণা তাদের কাছে নেই। তারা দ্বীনের মৌলিক ভিত্তি তথা যেসবের উপরে দ্বীন প্রতিষ্ঠিত তা জানে না। কেননা, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হাদিস মূলত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই এসেছে। যদিও শব্দ রাসুলের কিন্তু রাসুলের হৃদয়ের সেই কথা ইলহাম করেছেন স্বয়ং আল্লাহ।'


শাইখুল আযহার মুসলিম উম্মাহকে হক্বের পক্ষে থাকা এবং কুরআনিস্টদের মত বাতিল, ভ্রান্ত ফিরকাহ'র বিরুদ্ধে হক্বপন্থীদেরও সাহায্য কামনা করেছেন। 


আল আযহারের শরীয়াহ বিভাগের প্রধাণ ডক্টর রাফাত উসমান বলেছেন,


'যে ব্যক্তি হাদিস কে অস্বীকার করবে সে মুসলমান নয়। কেননা, হাদিস হলো আল্লাহর কিতাবের পর ইসলামী শরীয়াহ'র দ্বিতীয় দলিল। আল্লাহর কুরআনে যা সুস্পষ্ট ভাবে নাযিল হয়েছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাদিস আমাদের কাছে দিয়েছে।'


মিশরের ওয়াকফ সম্পত্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মুহাম্মাদ হামদি যাকয্বওক বলেন,


'কোনো মুসলমানের পক্ষে স্রেফ কুরআনের উপর নির্ভর করে হাদিসকে বাদ দিয়ে ইসলামী শরীয়াহর পরিপূর্ণ অনুসরণ সম্ভব নয়। কেননা, হাদিস কুরআনের তাফসীর করেছে।'


আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে এই ভ্রান্তি থেকে হিফাজত করুন। আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণের তাওফিক দিন। আমীন।


এভাবে আরো বহু উপমহাদেশীয় আলিম কুরআনিস্টদের ফিতনা সম্পর্কে বিভিন্ন রচনায় আলোকপাত করেছেন। যা ফেইসবুক পোস্টে বিস্তারিত তুলে ধরা সম্ভব নয়। এবিষয়ে অচিরেই স্বতন্ত্র গ্রন্থ আসবে ইনশাআল্লাহ...




তথ্যসুত্র-


[১]- সুরা আ'রাফ, সুরা আনআম, সুরা মায়িদা, সুরা নুর, সুরা নিসা, সুরা নাজম, সুরা হাশর, সুরা আহযাব, সুরা আনফাল।


[২]- হুজ্জিয়াতুস সুন্নাহ ফিল ফিকরিল ইসলামী: হায়দার হুব্বুল্লাহ


[৩]- মিফতাহুল জান্নাহ ফিল ইহতিজাজি বিস সুন্নাহ: আল্লামা সুয়ুতী রহিমাহুল্লাহ


[৪]- আল কুরআনিয়্যুন ফি মিছরা ইলা আইনা- ডক্টর ঈমান আল খাশশাব


[৫]- আল কুরআনিয়্যুন, ইনহিরাফুন ফিকরিয়্যুন আম মাদলুলুন সিয়াসিয়্যুন: আল ইসলামুল ইয়াউম ম্যাগাজিন (০৮-০৪-২০০২)


[৬]- আয়্যুহাল কুরআনিয়্যুন! মা রা'য়ুকুম ফি হাযিহীল আদিল্লাহ: আব্বাস রহীম


[৭]- মুনকিরুস সুন্নাহ: মাওকিউ মুনতাদা আত তাওহিদ (ম্যাগাজিন- ০২-০৭-২০০৭)


[৮]- আমনুদ দাওলাতিল মিছরিয়্যি ইয়ামুরু বি হাবসিল কুরআনিয়্যিন (মুহিত্ব, পহেলা জুলাই, ২০০৭)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সাড়ে তিন হাত বডিতে ইসলাম !

নির্ভেজাল ইসলামের স্বরুপ সন্ধানে

শর্ষীনা, ফুরফুরা, জৌনপুরী, ফুলতলী, সোনাকান্দা সহ সকল বালাকোটি পীরগনের শেরেকী আকীদা