গান বাজনা কি আসলেই হারাম?
বিশ্বসেরা আলেমদের মতে ইসলামে সংগীত হারাম নয়
সরকারের কাছে প্রস্তাব করছি ড. কারযাভীকে আমন্ত্রণ করে এনে আমাদের আলেমদের সাথে বসিয়ে দেয়া হোক যাতে সামনাসামনি আলোচনা করে সংগীত নিয়ে জাতির বিভক্তির চির-নিরসন হয়।
জবাবটা সিম্পল। ইমামরাই দাবি করেন, “মোহাম্মদী ইসলাম একটি ফিৎরাতি (অর্থাৎ প্রাকৃতিক) ধর্ম”। সংগীত মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। সেজন্যই প্রতিটি দেশ জাতি সভ্যতার ব্যতিক্রমহীন অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সংগীত। যখন মানুষের ভাষা ছিল না, কাপড় ছিল না, তখনও মানুষ বিভিন্ন উচ্চারণে গান গেয়েছে, অতীত সভ্যতার গুহার দেয়ালে সেসব চিত্র আজও উৎকীর্ণ। এবং সেজন্যই সৌদি, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, আমিরাত, জর্দান, সিরিয়া, মিসর, ইরাক, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেনসহ প্রতিটি মুসলিম দেশ ও প্রতিটি দেশের জাতীয় সংগীত আছে।
অসুখ নিয়ে ডাক্তারদের মধ্যে মতভেদ হলে রোগীর যে করুণ দশা সংগীত নিয়ে আমাদেরও তাই। বিভিন্ন আলেম বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন, জনগণের কে কার মতামত মানবেন সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা মানছি ‘দুনিয়ার সর্বোচ্চ প্রভাবশালী ইসলামী বিশেষজ্ঞ’দের মতামত, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাণ্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক এবং ডক্টর ইউসুফ কারযাভীর মত।
ইউসুফ কারযাভী তার প্রজ্ঞার জন্য সুপ্রসিদ্ধ। তার পরিচয় :-
১. বিশ্বের সর্ববৃহৎ অন লাইন ফতোয়া-সংগঠন “ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অব ফতোয়া অ্যান্ড রিসার্চ”-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট,
২. আন্তর্জাতিক সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড-এর উপদেষ্টা ছিলেন,
৩. আন্তর্জাতিক আলেম-সংগঠন “ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলার্স”-এর চেয়ারম্যান ছিলেন,
৪. বিশ্বময় “ইসলামী ব্যাঙ্কিং” এর প্রভাবশালী আলেম,
৫. কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান,
৬. “মুসলিম-বিশ্বের নোবেল” নামে বিখ্যাত “বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কার” পদক পান,
৭. “ব্যাংক ফয়সল” পুরস্কার লাভ করেন।
৮. ব্রুনাই সরকার তাকে “হাসান বাকলি” পুরস্কার প্রদান করে।
মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রয়াত) গ্র্যান্ড মুফতি (১৯৮২ – ১৯৯৬) শেখ জাদ আল হক (বিস্তারিতের জন্য সার্চ করুন “Al Azhar university – music in Islam, দি ইসলামিক টেক্সট ইনস্টিটিউট) এর মতে-
“অনৈতিক ও গুনাহ-এর কর্মকাণ্ডের সহিত যুক্ত না হইলে, কিংবা সেই বাহানায় মানুষকে হারামের দিকে না টানিলে, কিংবা মানুষকে ফরজ ইবাদত (আল ওয়াজিবাত) হইতে সরাইয়া (বা ভুলাইয়া) না দিলে সংগীত শোনা, সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা, এবং বাদ্যযন্ত্র বৈধ”।
ডক্টর কারযাভীও একই কথা বলেছেন- “কাজী আবুবকর ইবনুল আরাবী বলিয়াছেন ‘গান হারাম হওয়া পর্যায়ে একটি হাদিসও সহীহ নহে’। ইবনে হাজম বলিয়াছেন – ‘এ পর্যায়ের সকল বর্ণনাই বাতিল ও মনগড়া রচিত’… এ পর্যায়ে বর্ণিত নিষেধমূলক হাদিসগুলি সমালোচনার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ….বহুসংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীন গান শুনিয়াছেন,… যে গানের সাথে মদ্যপান, ফষ্টিনষ্টি ও চরিত্রহীনতার মতো কোনো হারাম জিনিসের সংমিশ্রণ হয় সেই গান হারাম… রাসূলে করীম (স) বলিয়াছেন- ‘কার্যাবলীর ভালোমন্দ নির্ভর করে তাহার নিয়তের ওপর।’ কাজেই যেই লোক এই নিয়তে গান শুনিল যে তাহার দ্বারা গুনাহের কাজে উৎসাহ পাওয়া যাইবে তাহা হইলে সে ফাসিক। পক্ষান্তরে যেই লোক স্বভাব মেজাজের সুস্থতা লাভের উদ্দেশ্যে শুনিল, আল্লাহর আনুগত্য কাজে শক্তি সাহস পাওয়ার এবং ভালো ও সৎকাজে আগ্রহ ও উৎসাহ বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে শুনিল, তাহার এই কাজ নিশ্চয়ই অন্যায় বা বাতিল নহে। আর যেই ব্যক্তি না আল্লাহনুগত্যের নিয়তে শুনিল না নাফরমানি নিয়তে, তার এই কাজ নিষ্ফল কাজের পর্যায়ে গণ্য।” (ইসলামে হালাল হারামের বিধান- পৃষ্ঠা ৪০৬ – ৪১১)
এবারে কোরান।
সংগীতের আরবী হচ্ছে “মুসিকি”, সারা কোরানে ওই “মুসিকি” শব্দটাই নেই। কোরান কোথাও সংগীতকে নিষিদ্ধ করেনি অথচ “সঙ্গীত হারাম” দাবি করা হয় কোরানের দুটো আয়াত দিয়ে-
(১) সুরা লোকমান ৬ নম্বর আয়াত− “একশ্রেণির লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ হইতে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে,
এবং
(২) বনি ইসরাইল ৬৪ নম্বর আয়াত (আল্লাহ শয়তানকে বলছেন) −“তুই তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে সত্যচ্যুত করে তাদেরকে আক্রমণ কর।”
সঙ্গীত-বিরোধীরা বলেন সুরা লোকমান ৬-এর ‘অবান্তর কথাবার্তা-ই নাকি ‘সঙ্গীত’ (মওলানা মুহিউদ্দিনের কোরানের অনুবাদ, পৃঃ ৭৮৩ ও ১০৫৩-৫৪)। কি হাস্যকর! আম জিনিসটা আম-ই। জামও নয়, কাঁঠালও নয়। ‘অবান্তর কথাবার্তা’ অবান্তর কথাবার্তাই, অন্যকিছু নয়। একই খেলা করা হয়েছে বনি ইসরাইলের ৬৪ নম্বর আয়াত নিয়েও। আয়াতটা হলো, মানুষকে পথভ্রষ্ট করার ব্যাপারে আল্লাহ শয়তানকে অনুমতি দিচ্ছেন: “তুই সত্যচ্যুত করে তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়াজ দ্বারা, স্বীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ কর”। অথচ এর অনুবাদ করা হয়েছে: “তুই তোর…রাগ-রাগিনী গান-বাজনা ও বাদ্যবাজনা দ্বারা …।”
সংগীত-বিরোধী হাদিসগুলো ভিত্তিহীন তা আমরা বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলারদের কাছ থেকে শুনলাম। সংগীতের পক্ষে অজস্র হাদিস আছে, লম্বা হয়ে যাবে বলে উদ্ধৃতি দিচ্ছিনা। এবারে চলুন আরো কিছু দলিল দেখা যাক।
১. অখণ্ড ভারতের সর্বোচ্চ ইসলামি নেতাদের অন্যতম, ভারতীয় কংগ্রেসের দুইবারের সভাপতি, কলকাতার ঈদের নামাজ পড়ানোর পেশ ইমাম মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন: “পয়গম্বর দাউদ (আঃ)-এর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মিষ্টি ছিল। তিনি সর্বপ্রথম হিব্রু সংগীতের সংকলন করেন ও মিশরের ও ব্যাবিলনের গাছ হইতে উচ্চমানের বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনা করেন”। (তর্জুমান আল্ কুরান, ২য় খণ্ড পৃঃ ৪৮০।)
২. “হজরত ওমর(রঃ)-এর আবাদকৃত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় হইল বসরা। আরবি ব্যাকরণ, আরূয শাস্ত্র এবং সংগীতশাস্ত্র এই শহরেরই অবদান” (বিখ্যাত কেতাব ‘আশারা মোবাশশারা’, মওলানা গরীবুল্লাহ ইসলামাবাদী, ফাজেল-এ দেওবন্দ, পৃষ্ঠা ১০৬।)
৩. ইমাম গাজ্জালী: “নবী করিম (সাঃ) হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) সম্পর্কে বলিয়াছেন − তাঁহাকে হযরত দাউদ (আঃ) এর সংগীতের অংশ প্রদান করা হইয়াছে।” (মুরশিদে আমিন, পৃষ্ঠা ১৭০ − এমদাদিয়া লাইব্রেরি)
এরকম অজস্র দলিল আছে। ‘অশ্লীল আদেশ শয়তান দেয়’ (সুরা নূর ২১)। কাজেই সংগীতসহ শ্লীল কোনোকিছু হারাম হবার প্রশ্নই ওঠেনা। গানের কুৎসিৎ কথা, কুৎসিৎ অঙ্গভঙ্গি বা গানের অতিরিক্ত নেশায় জীবনের ক্ষতি ইত্যাদির সীমা টানেননি ধর্মান্ধরা, পুরো সংগীতকেই ঢালাওভাবে বাতিল করেছেন। করে লাভ কিছুই হয়নি বরং সংগীত আজ সুবিশাল বিশ্ব-ইন্ডাস্ট্রি। দুনিয়ায় কোটি কোটি সংগীতপ্রেমী পরিবার পালছেন, বাচ্চাদের বড় করছেন, প্রতিভার বিকাশ ঘটাচ্ছেন। সংগীত হলো আমাদের সসীম জীবনে এক টুকরো অসীমের ছোঁয়া। চারদিকের আকাশবাতাস সাগর-পর্বত গ্রহ-নক্ষত্র, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এক বিপুল সুরস্রষ্টার মহাসংগীত। তাই, গান শুনুন এবং বাচ্চাদের গান শোনান। গান করুন এবং বাচ্চাদের গান শেখান। গান যে ভালবাসে না, সে মানুষ খুন করতে পারে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ হারাম নয়। ‘আমি বাংলার গান গাই’, ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর’, ‘কান্দে হাছন রাজার মন ময়না’, মায়েদের মধুকণ্ঠে ‘আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ হারাম হবার প্রশ্নই ওঠেনা। শ্লীল সংগীত ইসলামে হারাম নয়।
‘কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ইসলামে নিষিদ্ধ’ (মায়েদা ৭৭, নিসা ১৭১ ও বিদায় হজ্বের ভাষণ)। সঙ্গীত হারাম মনে করলে শুনবেন না, অসুবিধে কী। কিন্তু যারা সংগীত ভালোবাসেন, সংগীতের পক্ষের বিশ্ববরেণ্য ইসলামী স্কলারদের কথা বিশ্বাস করেন, তাদেরকে আঘাত করাই সেই ইসলাম-বিরোধী বাড়াবাড়ি।
গানবাদ্য বিষয়ে কিছু লেখা
১. মিউজিকের বিপক্ষে প্রচলিত কিছু হাদীসের জবাব।
https://sheiksadi.medium.com/134070a17c43
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_61.html
২. রাসুলের যুগে সাহাবিদের গানবাদ্য
https://sheiksadi.medium.com/a61cea43a3eb
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_18.html
৩. বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার মতটি কীভাবে মুসলিম বিশ্বে প্রচার-প্রসার পেল?
https://sheiksadi.medium.com/dca68e3732c3
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_79.html
৪. মাজিশুন পরিবার ও মদীনায় গানবাদ্য
https://sheiksadi.medium.com/cc170a9cdd2e
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_51.html
৫. সঙ্গীত ও বাদ্য ব্যবহার — কাযি আবু বকর ইবনুল আরাবি।
https://sheiksadi.medium.com/5101e022b96a
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_42.html
৬. বাদ্যযন্ত্র ও ইজমা
https://sheiksadi.medium.com/788184025cf5
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_60.html
৭. ইসলামী জীবনদর্শনের আলোকে সঙ্গীত : শায়খ মাহমুদ শালতুত
https://sheiksadi.medium.com/2487891040d7
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_33.html
৮. ইসলামের স্বর্ণযুগে সঙ্গীতচর্চা — ইসহাক আন-নাদীম ও উলাইয়্যা বিনতে মাহদী।
https://sheiksadi.medium.com/8635e5fbe84b
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_31.html
৯. নারীকণ্ঠে গান শোনা
https://sheiksadi.medium.com/49decef389f5
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_50.html
১০. সঙ্গীতচর্চার গুরুত্ব ও এর সাথে নিফাকের কথিত সম্পর্ক
https://sheiksadi.medium.com/21b9506273c
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_90.html
১১. সঙ্গীতের জারজিকরণ প্রতিরোধ
https://sheiksadi.medium.com/bea5cf83eb41
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_16.html
১২. সভ্যতাগত সমৃদ্ধির সাথে সঙ্গীতশিল্পের সম্পর্ক : ইবন খালদুন।
https://sheiksadi.medium.com/f545c275cc44
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post.html
১৩. আধ্যাত্মিকতার উদ্দেশ্যে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে হানাফি মাযহাবের অবস্থান
https://sheiksadi.medium.com/9b693a2c9f5e
https://sheiksadi.blogspot.com/2022/01/blog-post_40.html
আরবে প্রাক-ইসলামী দরবারে গায়ক-গায়িকারা
মধ্যযুগে ইসলামিক পণ্ডিতদের যে জ্ঞানতাত্ত্বিক উত্থান বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রায় সবই অষ্টম থেকে ত্রয়োবিংশ শতাব্দীর কথা। ইসলামিক বলতে এখনো যেভাবে আমাদের মাথায় আরব বিশ্বের কথা আসে, তাদের সবাই কিন্তু প্রাচ্যের আরবের মানুষ ছিলেন না, ভাবতে হবে তুর্কি, পারস্য, মিসর মিলিয়ে। এদের মধ্যে গণিত ও চিকিৎসাবিদ্যায় অবদান রাখা আল কিন্দী, আল ফারাবি, আল বায়যানি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, কিংবা দার্শনিক ঈমাম গাজ্জালি ও ইবনে রুশদের নাম আমাদের জানা আছে। সেসব ক্ষেত্রে তাদের অবদান আজও সবার মনে আছে। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হলো সচরাচর তাদের সংগীতজ্ঞ বলে কেউ চেনে না অথচ সংগীত নিয়ে তাদের সবার বই আছে! সেই সময়ে সংগীত একই সঙ্গে তর্ক ও স্বীকৃতির জন্ম দিয়েছিল। ইসলামিক পণ্ডিতদেরও এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল না।
ষষ্ঠ শতকে বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্য ছাড়া সর্বত্র খ্রিস্টীয় সমাজ ইহুদিদের তুলনায় ছিল বিত্তহীন, সুতরাং অনভিজাত। বিত্ত তথা আভিজাত্যের কারণেই ট্রাইবাল আরব সমাজমানসে তাদের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরবিরোধিতা ছিল: ঈর্ষাজনিত দ্বন্দ্ব একদিকে, আবার অন্যদিকে তাদের সংস্কৃতিকে অনুসরণের প্রয়াস। এ প্রভাব ও দ্বন্দ্ব ইসলাম ধর্মেও শুরু থেকে বিচার্য।
প্রাক-ইসলামী আরব সমাজে তথা ইহুদিদের মধ্যে সংগীতের প্রভাব ছিল। প্রাক-আরবে সে যুগে নারীরাই মূলত সংগীতের চর্চা করতেন। বরং সেখানে পুরুষদের অনুপ্রবেশ কঠোরভাবে রহিত করা হতো।
প্রাক-ইসলামী সময়ে ঘনীভূত হতে থাকা বাণিজ্য খলিফাদের সময়ে বিকশিত হলো, কিংবা বাগদাদ নগরীর পত্তনের পর চূড়ান্ত বিস্তার হয়েছিল। বিশেষ করে ভারত, গ্রিস, পারস্যের সঙ্গে যে বাণিজ্য স্থাপন হয়েছিল, তার জন্যও নগরে বিনোদনের দরকার হয়ে পড়ে ছিল। এজন্যও বাদ্য ও সংগীতশিল্পীদের একটা ব্যবসায়িক, ধনিক ও রাজ্যপ্রধানের পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন, তা অস্বীকার করা যায় না। ভারত, পারস্য, গ্রিসের তুলনায় গোত্রনির্ভর আরবে তা ভিন্ন ছিল না।
প্রাচীন নিকট প্রাচ্য ও মিসরে পেশাদার সংগীতশিল্পীদের ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার অব্দেও নারীদের নেত্বত্বের কথা জানা যায়। কিছু বাদ্যযন্ত্র প্রায় নারীদের উপযোগী করেই তৈরি করা হতো। ছোট্ট ঢোলক, খঞ্জনী, বাঁশি ও নোয়ানে তারের বাদ্যযন্ত্রে সজ্জিত নারীরা শোকস্তবক ও বিলাপ ধরনের সংগীতের জন্য সমাদৃত হতেন। মিসর, সুমেরু ও অ্যাসিরিয়ার অঞ্চলের অজস্র প্রাচীন লিপিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। খোদ বাইবেলেও তার স্বীকৃতি মেলে।
শুধু বাইরে থেকে প্রভাবিত হওয়া নয়, আরবের ভেতরেও সংগীতচর্চার পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস আছে। এর মধ্যে নারী শিল্পীদের ‘কিয়ান’, ক্রস-জেন্ডারের পুরুষ গায়কের ‘মুখান্নাথুন’ কিংবা যেকোনো লিঙ্গের শোকসংগীত শিল্পী ও রচয়িতা পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। প্রাক-আরব যুগের এ ঐহিত্যবাহী সংগীতচর্চা নবম শতকে বাগদাদ দরবারে চূড়ান্ত বিকশিত হয়। সংগীতসংশ্লিষ্ট বিষয় প্রথমে গায়কের সংগীতের দক্ষতা ও ছন্দ জ্ঞান এবং দ্বিতীয়ত, বাদ্যযন্ত্র বাজানোর ওপর নির্ভর করত। কিন্তু নবম-দশম শতকে বাগদাদ দরবারে এর সঙ্গে শিল্পীর উপস্থাপনাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সেই সময় শিল্পীর পোশাক-পরিচ্ছদ, ব্যবহার, রাজনৈতিক, খাদ্য ও মদগ্রহণের সক্ষমতাকে বিবেচনার আনা হতো। লিঙ্গভেদে এর বৈচিত্র্য তো ছিল। সব মিলিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কৌশল-দক্ষতা, অসাধারণ মেধা আর দর্শকের চাহিদা বুঝতে পারাকে গুরুত্ব দেয়া হতো। অর্থাৎ শিল্পী ও উপস্থাপন প্রায় সমান্তরালে দাঁড়িয়ে যায়। এই সময় আরবের সংগীতে কিয়ান (নারী শিল্পী), জাওয়ারি (নারীদাস বা উপপত্নী), মুখান্নাথুন (মেয়েলি), মুজিকার (পুরুষ বাদ্যশিল্পী) ও মুগান্নি (গায়ক) পরিভাষাগুলো তৈরি হয়।
সবাই না হলেও খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে শুরু প্রাক-ইসলামী যুগ পর্যন্ত অধিকাংশ নারী বাদ্যশিল্পীরা ছিলেন দাসী ও উপপত্নী ধরনের। ফলে সেই সময়ের যন্ত্রশিল্পীরা অনেকটা জৈব পণ্য, বাণিজ্যিক পণ্য বা কূটনৈতিক উপহার হিসেবে ব্যবহার হতেন। ফলে উপস্থাপনের জন্য কখনো বাদ্যশিল্পী পুরস্কৃত হওয়া মানে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া ছাড়া কিছুই ছিল না। তবে দাসির বাইরে নারীদের যন্ত্রসংগীতে পারদর্শী হয়ে ওঠা ও আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়টি সামাজিক মর্যাদা ও পদের ওপর নির্ভর করত। আরব, মিসর, মেসোপটেমিয়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী, বিশেষ করে রাজকন্যার সংগীতপটীয়সী হয়ে ওঠা বিরাট সম্মানের ব্যাপার ছিল। তারা এসব করতেনও বিশেষ যন্ত্রে দেবতাদের উদ্দেশে কিংবা বিশেষভাবে তৈরি স্তবে।
উর তৃতীয় সুমের সময় মন্দিরে মুক্ত নারীরাও থাকতেন, এই বাসকে মঠ বা নির্জনবাস হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। তাদের অনেকের সামাজিক মর্যাদা, শেষ বয়সের দেখাশোনার জন্য দাসী পোষার মতো অর্থকড়িও ছিল, তবে মঠে তাদের বিশেষ কোনো কাজ থাকত না। প্রাচীন নথি নির্দেশ করে, তারা সেখানে মন্দিরে আমলাতান্ত্রিক কাজ করতেন, নয়তো আচার অনুযায়ী দেবীকে বিয়ের ব্রত পালন করতেন।
নবম শতাব্দীর আগ পর্যন্ত প্রাক-ইসলামিক আরব ও মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে সংগীতাঙ্গন প্রাথমিকভাবে নারী দিয়ে ভর্তি ছিল। পুরুষদের সামাজিকভাবে প্রায় নিষেধই করা হতো বাদ্যশিল্পী হতে। যদিও নারী পোশাক ও তাদের বাদ্য বাজানোর শর্তে কিছু পরিবর্তী লিঙ্গের পুরুষ সেই সুযোগ পেতেন।
ব্যাপারটা হলো, বাদ্যশিল্পীদের মধ্যের নারীদের বাইরে পুরুষদের দেখাই যেত না, কিন্তু স্বভাবে নারী-পুরুষ উভয় থাকা পুরুষরা দরবার ও মন্দিরে সংগীত প্রদর্শনের সুযোগ পেতেন। কথাটা খানিকটা খটকাই লাগে। এটাকে বোঝা যায় প্রাচীন নিকট প্রাচ্যে সেই সময়ের শব্দবন্ধের ভেতর। সে সময় লিঙ্গ বলতে জৈবিক অবস্থার চেয়ে আরো বিস্তৃত বিষয়কে বোঝাত। মানে, পোশাক ও আচরণের কারণেও ভিন্ন লিঙ্গ ধরা হতো। এমনকি অন্ধ, খোঁড়া, শারীরিক নানা অক্ষমতাও লিঙ্গ বিচারে বিবেচ্য ছিল। যেমন সুমের-এর সময় তিনটি, কখনো চারটি লিঙ্গ ধরা হতো, আলাদাভাবে তারা বাদ্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী বা পুরোহিত। আধুনিক লিঙ্গ ধারণাই যে জৈবিকভাবে সেই সব শিল্পীদের লিঙ্গ নির্ধারণ কঠিন করে তুলেছে, তা নয়; বরং সুমেরিয়ান ভাষায় লিঙ্গের শ্রেণীবিন্যাসেরই ঘাটতি ছিল।
সেই হিসাবে, ব্যতিক্রম সত্ত্বেও তৃতীয় লিঙ্গ বলতে পুরুষদের বোঝানো হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ যে নপুংসক ছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এদের অনেকেই উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সন্তান বা প্রতিপালিত সন্তানদের বিয়ে করতেন। প্রাচীন নথিতে তাদের বর্ণনা করা হয়েছে, তারা জৈবিক ও আধ্যাত্মিক জগতের সমন্বয়কারী হিসেবে। সুমেরিয়ান অধিকাংশ প্রাচীন নথিতে তৃতীয় লিঙ্গের বাদ্যশিল্পীদের ‘গালা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা নারী গোত্রীয় বিলাপে দক্ষ এবং নারী ভাষা ‘ইমেসাল’ শব্দে কথা বলেন। নারীদের মতো পোশাক পরেন, চুল বাঁধেন এবং তাদের বাদ্যযন্ত্রই বাজান।
নিকটা প্রাচ্যের সংস্কৃতি অনুযায়ী, নগর ও সম্ভ্রান্ত আরবেরা ‘গান গাওয়া মেয়ে’ ও উপপত্নী রাখতেন। প্রাক-ইসলামিক আরবে গান গাওয়া মেয়ে ছিল সবচেয়ে লক্ষণীয় সংগীত উদযাপন। ‘গান গাওয়া মেয়ে’ বলতে দাসী বা মুক্ত গোত্রে জন্ম নেয়া নারীদের বোঝাত। ইতিহাসবিদরা প্রমাণ করেছেন, ব্যক্তিগত আমোদ দেয়ার মাধ্যমে মেয়েরা বেশি অর্থ উপার্জন করতেন।
প্রথম দিকের কবিতায় ‘গান গাওয়া মেয়েরা’ চোখ, চুল, পোশাক দিয়ে সংগীত ও যৌনানন্দ দিতেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
সপ্তম শতক পর্যন্ত আরব পুরুষদের পেশাগতভাবে সংগীতচর্চায় নিরুৎসাহিত করা হতো। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এ নিষেধ বেশ কড়াকড়ি ছিল। তার মানে এই নয় যে, কোনো পুরুষ একে পেশা হিসেবে নেয়নি। তবে তা হতো শর্ত মেনে। মানে, নারীর পোশাক পরা, তাদের আচার-রীতি অনুসরণ ও বাদ্য বাজাতে হতো।
বিশেষ নবম শতকে ইসলামিক সাম্রাজ্য যখন উত্তর আফ্রিকা, পারস্য, আনাতোলিয়া ও ইউরোপের কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়ল, তখন স্বাভাবিকভাবেই পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে নিয়ে সম্পদ আনার মতো দরবারি সংস্কৃতিও গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল। ৬৬১ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উমাইয়াদের শাসনের পর যখন আব্বাসীদের শাসনের পত্তন হলো তখন এর বিস্তার আরো বেড়ে গিয়েছিল। উমাইয়াদের দামাস্কাসের রাজধানী ছেড়ে আব্বাসীদের বাগদাদ নগরীর পত্তনও তার ফল। বলা যেতে পারে, বাগদাদ কেন্দ্র হিসেবে সংস্কৃতির চেয়ে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিকাশ বেশি হয়েছে। এ সময়ই গ্রিসের সাহিত্য ও দর্শনের বইগুলো আরবি ও সিরীয় ভাষায় বেশি অনূদিত হয়।
তখনকার গণিকারা সংগীত পরিবেশক ও শিল্প পটীয়সী ছিলেন। এদের পাণিপ্রার্থী ও পৃষ্ঠপোষকরা সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোক ছিলেন। এরা একই সঙ্গে অর্থশালী ও ক্ষমতাশালী ছিলেন। কিন্তু ক্রমেই পবিত্রতা বনাম জাগতিক সংগীতচর্চার তর্ক সংগীতের আবেগে আঘাত করে। বিশেষ করে সংগীতের সঙ্গে জুয়া, মদপানসহ স্পর্শকাতর বিষয়গুলো জড়িয়ে থাকায় এ আঘাত বড় হয়ে ওঠে। পৃষ্ঠপোষকতা বলে গড়ে ওঠা গণিকা শ্রেণীর পক্ষে যুক্তি ও সমর্থন তখন নীতির ওপর শিল্পীর জয় এনে দেয়।
পেশাদার নারী সংগীতশিল্পী, বিভিন্ন সুবিধা দেয়ার মতো বাদ্যযন্ত্রের দক্ষতার ওপর নানা ডিগ্রি, যৌনতা বা আমোদ মূলত নগর সংস্কৃতির অংশ। বাণিজ্য ও রাজ্য জয়ের উপহার হিসেবে স্বীকৃত গান গাওয়া মেয়েদের রাখা ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। তা ছাড়া এই মেয়েদের বাছাই করা হতো শারীরিক সৌন্দর্য ও অঞ্চলভেদে। ফলে এরা অনেকের কাছে বিদেশিনী হিসেবেই মর্যাদা পেতেন। সেই সুবাদে তাদের বাহারি নামও জুটে যেত। আজকের দিনেও যেমন বাহারি নামের গণিকাদের কথা শোনা যায়।
আরবে প্রাক-ইসলামী দরবারে গান গাওয়া মেয়েরা একক ও সম্মিলিত সংগীত পরিবেশন করতেন। সাংগীতিক এই আয়োজনকে বলা হতো ‘মজালিস’ আর একক আয়োজনকে বলত ‘মলিস’। ‘মজালিস’ আয়োজনের ক্ষেত্রে সংগীত পরিবেশকদের পোশাক, দক্ষতা, শিষ্টাচারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে কড়া বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে ‘একক সংগীত’ আয়োজন হতো শাসকের ইচ্ছেমতো। শাসকের ইচ্ছে ও মনোভাব অনুযায়ী সংগীত, কবিতা, বাদ্য বাজাতে হতো শিল্পীকে। যদি তিনি খলিফাকে খুশি করতে পারেন, তাহলে উপঢৌকন মিলত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ব্যর্থ হলে প্রকাশ্যে মারধর বা বেত্রাঘাতেরও নজির আছে।
এসব দিয়ে বোঝায়, সেই সময় দরবারে সংগীত কতটা দক্ষতা অর্জন করেছিল। শেষ পর্যন্ত সব আয়োজনই দর্শক-শ্রোতার মনের অবস্থা, চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন হতো। আধুনিক সংগীত-তত্ত্ব বলে যে মধ্যযুগে আরবে দরবারে সংগীত শুরুতে পারস্য, মেসোপটেমিয়া, পরে গ্রিক সংগীত-তত্ত্বের সংস্পর্শে সবচেয়ে বিকশিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
১. Music and Musicians in the Medieval Islamicate World : A Social History, by Lisa Nielson, Bloomsbury Publishing, 2021.
২. Gender and the Politics of Music in the Early Islamic Courts, by Lisa Nielson, an article in Cambridge : Early Music History, Volume 31, January 2012, page 235 to 261.
৩. মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব ও অন্যান্য, সৈয়ত মুস্তাফা সিরাজ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ১৪০০
প্রাক ইসললামী ও ইসলাম প্রচারের যুগে সংগীতও প্রচারিত হয়েছিল। তবে আজ আমরা সংগীত বলতে যা বুঝি তেমন ছিল না। আরব ও আরব উপদ্বীপ অঞ্চলের ছিল নিজস্ব সংগীত ধারা। আজ সংগীত নিয়ে যত বিতর্ক, প্রাক-ইসলামী যুগে তা ছিল না। ইসলামী বা আরবের সংগীত বলে যদি কিছু বোঝানো হয়, তার সূচনা হয়েছিল ইসলামের আগেই। এরপর ইসলাম প্রসারের সঙ্গে আরবের সংগীত গিয়েছিল অন্যান্য অঞ্চলে এবং সেসব স্থানের নিজস্ব সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন নতুন ধারা তৈরি হয়। তবে আরব ও ইসলামী সংগীতের ‘স্টাইল’ আলাদা করা কিছুটা কঠিন। কেননা সংগীতের ধারা এ অঞ্চলে বিধিবদ্ধ করা হয়নি। তবে হুদা, নাশিদ, সামা, মাদি নাবাওয়ি নামে কিছু ধারা পাওয়া যায়। কখনো কখনো হামদ, না’ত, মৌলুদকেও সংগীতের ধারায় যোগ করে উপস্থাপন করা হয়।
ইসলামী সংগীতের সূচনার আগের অবস্থাটি ছিল জাহিলিয়া যুগের কবিতা। সেকালের কবিদের এখনো জাহিলিয়া যুগের কবি বলেই সম্বোধন করা হয়। আরবে সে সময় কবিতার খুব চল ছিল। মরুর বুকে ঘুরে বেড়ানো পুরুষরা কখনো প্রেয়সী, কখনো প্রকৃতি, কখনো বিমূর্ত কোনো সত্তাকে উদ্দেশ করে কবিতা রচনা করত। রচনা পর্যন্তই থেমে থাকত না বিষয়টা। তারা এ কবিতা পাঠ করতেন। তারা এ কবিতাগুলো হাই নোটে আবৃত্তি করতেন। এভাবে আবৃত্তি করার কারণে কবিতার মধ্যেই গানের একটা আবেশ আসে। এরপর আবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয় বাদ্যযন্ত্র। ধীরে ধীরে কবিদের নামডাক হতে শুরু করলে তারা নিজেরা কবিতা পড়তেন না। এর জন্য নারীদের নিযুক্ত করা হতো। অর্থাৎ কবিতা থেকে এভাবেই তৈরি হয় গান, গীতিকার ও গায়িকা।
লুট ও রাবাবের বাজনার সঙ্গে গাওয়া এসব আরবের মরুর বুকে মানুষের জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। এ ধারার নির্দিষ্ট কোনো নাম নেই, তবে এখান থেকেই শুরু হয় হুদা, গিনা, নাসব, সনদ ও রুকবানি। এর মধ্যে হুদা জনপ্রিয় হয় খুব বেশি। ইংরেজিতে এ ধারাকে কখনো কখনো ‘সঙ অব ক্যারাভানস’ অর্থাৎ কাফেলার সংগীত বলা হয়। তবে হুদাকে উটের গান বলেও উল্লেখ করা হয়। উটচালকরা এক ধরনের গান গাইতেন বলেই এ ধরনের নামকরণ। তবে হুদার এ ব্যাখ্যা ও নামকরণ থেকে একটা জিনিস নিশ্চিত হওয়া যায় যে আরবের সংগীত মূলত তৈরি হয়েছিল এর প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাপনের ধারার ওপর নির্ভর করে।
হুদা, রুকবানি ও সনদ গাওয়ার এক ধরনের নিয়ম ছিল। প্রাথমিক অবস্থায় আলাদা করে সুর তৈরি করা হতো না। কবিতায় কবির ব্যবহূত মাত্রা অনুসারে পাঠ করা হতো এগুলো। মাত্রার টান অনুসারে তৈরি হতো সুর। এরপর কবিরা নিজস্ব এক ধরনের স্বকীয়তা তৈরি করেন। তারা নির্দিষ্ট ‘মাকাম’ অনুসারে পাঠ করতেন। গানগুলোর কম্পোজিশন তাই ছিল তুলনামূলক সহজ। কিন্তু দিনে দিনে গান ও গাওয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে মাকামে পরিবর্তন আসে। মাকাম বলতে মূলত আরবের গানের সুরকে বোঝানো হয়। শাব্দিক অর্থ ‘স্থান’ বা ‘পর্যায়’। কিন্তু গানের যুগ শুরু হলে পরে মাকাম যুক্ত হয় সুরের সঙ্গে এবং ধীরে ধীরে সাত সুরের সঙ্গে মিলে গিয়ে আরবের নিজস্ব ধারার সুর তৈরি হয়ে সংগীতে যুক্ত হতে থাকে।
আরবে ইসলামের প্রথম যুগে দফ বাজিয়ে গান গাওয়ার প্রচলন ছিল। বিয়ে প্রভৃতি উৎসব আয়োজনে গান গাওয়া হতো। এছাড়া ‘ইসলামী সংগীত’ বললে সেখানে যুক্ত হয় স্রষ্টার আরাধনায় গাওয়া গান। সামষ্টিকভাবে এ ধারাটিকে বলা হয় ‘নাশিদ’। হামদ, না’ত এ ধরনের সংগীতের অংশ। হামদে আল্লাহর গুণগান করা হয় এবং না’তে রাসুলের। হামদ ও না’তে বাদ্য ব্যবহার করা হয় না, তবে এতে সুরের ব্যবহার সেই প্রথম যুগ থেকেই আছে। এর বাইরে ইসলামের ইতিহাস, নানা ঘটনার বর্ণনা করা গানগুলোও নাশিদের অন্তর্গত হিসেবে ধরা হয়।
ইসলামী সংগীত ইসলামের প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ করে। আরব উপদ্বীপের রেশ নিয়ে যায় মিসর, সিরিয়া থেকে শুরু করে আন্দালুসিয়ায়। এর মধ্যে মিসরে এ অঞ্চলের নিজস্ব সংগীত ছিল। মিসরের উচ্চ অঞ্চল ও নিম্ন অঞ্চলে নানা ধরনের ফোক সংগীত ছিল, যার সুরের ধারাটি আরবের মরুর সুরের সঙ্গে মেলে। ইসলাম প্রসারিত হওয়ার পর মিসরের এ ধরনের গানের সঙ্গে হুদার সংমিশ্রণ হয়। একই ধরনের সংমিশ্রণ হয় ইরানে। তৃতীয় আরব খলিফার সময়কার এবরাহিম মা’সেলি একজন বিখ্যাত গায়ক। তার পুত্র ইসহাক ও ইসহাকের এক ছাত্র জিরিয়াব (জারিয়াব) ছিলেন আন্দালুসিয়ার সংগীত-প্রভাবিত। তিনি ইরানের সংগীতের সঙ্গে আন্দালুসিয়ার সংগীতের মিশ্রণ ঘটান।
আন্দালুসিয়ার সংগীতের ক্ষেত্রে ইসলাম ও ইসলামী সংগীতের প্রভাব ছিল প্রবল। বিশেষত ধারাটিতে জিরিয়াবের অবদান সবচেয়ে বেশি। ইরাক থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি কর্ডোভার আবদ আল-রহমানের দরবারে সংগীতকার হিসেবে কাজ করেছেন। এর বাইরে মরক্কোর মালহুন ছিল এক ধরনের কবিতা, যার অন্ত্যমিল ও ছন্দের কারণে তা গানের মর্যাদা পায়। এ ধরনের গান ইসলামী আমলে জনপ্রিয় হতে থাকে। আব্দুল আজিজ আল-মাগরাওয়ি, আবদের রহমান আল-মাজদুব এ ধারার গায়ক। মরক্কো ও তিউনিসিয়ার ‘নুবা’র উত্কর্ষ সাধিত হয়েছিল আন্দালুসিয়ায়। কোরাসে গাওয়া হতো এ ধারার গান। নানা ধরনের সুর ব্যবহারে সমৃদ্ধ হয় নুবা। এর সঙ্গে ব্যবহার হতো উদ রবাব, নেইয়ের মতো বাদ্যযন্ত্র।
ইসলামী সংগীতে টার্কিশ প্রভাবও অনস্বীকার্য। তুরস্কে এক সময় খ্রিস্টান আধিপত্য ছিল। কিন্তু ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার পর এখানে সংগীতে ইসলামী সংগীতের পুরনো ধারার নানা বিষয় যুক্ত হয়। তুরস্কে ইসলাম আসার আগেও ইসলামী সংগীতে তুর্ক প্রভাব ছিল। যেমন নেইয়ের ব্যবহার এর প্রমাণ দেয়। অন্যদিকে তুরস্কের ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকে মাকামের ব্যবহার তুরস্কের সংগীতে ইসলামী ধারার প্রভাবের প্রমাণ রাখে।
সংগীতের যে ধারাগুলোতে ইসলাম ও ইসলামী বিষয়ের সরাসরি সংযোগ পাওয়া যায়, তার একটি হলো ‘মাদি নাবাওয়ি’। সপ্তম শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এর সূচনা হয়। মাদি নাবাওয়িতে রাসুল (স.) ও তার পরিবারের গুণকীর্তন করা হয়। সাধারণত এ ধরনের গানে একজন মূল গায়ক থাকেন ও তার সঙ্গে কোরাসে কয়েকজন নির্দিষ্ট কিছু লাইন পুনরাবৃত্তি করে থাকেন। এ ধরনের গান ইসলামী বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও অঞ্চলে জনপ্রিয় ও প্রচলিত। নুবার সঙ্গে এ ধারার সংগীতের মিল রয়েছে। মিসরে বলা হয় দুর, সিরিয়ায় মুয়াসসা ও ইরাকে মাকাম আল ইরাকি।
ইসলামী সংগীতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে সুফিবাদের। আজও ইসলামী অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে যুক্ত সংগীতের আলাপ হলে সামা নৃত্যের কথা আসে। সামা কেবল নৃত্য নয়, এর সঙ্গে যুক্ত থাকে সংগীত। স্রষ্টার গুণকীর্তন ও অন্যান্য কথার পাশাপাশি এখানে জিকির করা হয়। জিকিরকে সংগীতের ধারায় ধরা হবে কিনা তা নিয়ে তর্ক হতেই পারে, তবে বৃহত্তর পরিসরে জিকিরের তাল, লয়, সুর মিলে তা সংগীতই তৈরি করে। তাছাড়া জিকির কেবল আল্লাহর নাম করে তসবি জপাই নয়, নানা ধরনের কথা সুর দিয়ে গাওয়াও জিকিরের অংশ। এছাড়া সামায় ঘূর্ণায়মান নৃত্যে যে সুরটি রয়েছে, তাও ইসলামী সংগীতের অংশ।
ইসলামের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনাকে জড়িয়েও তৈরি হয়েছে সংগীত। কারবালার ঘটনা স্মরণে যে ধরনের গান গাওয়া হয় তাকে বলে মার্সিয়া। মূলত শিয়া মতাবলম্বীদের মধ্যে এ সংগীত বেশি জনপ্রিয়। তবে বাংলাদেশেও মার্সিয়ার সুরে তৈরি হয়েছে নানা গান এবং তাকে ইসলামী সংগীতের মধ্যেই হিসাব করতে হবে। তাজিয়া মিছিলের সময় মার্সিয়া গাওয়া হয়। অন্যদিকে রুমির হাত ধরে যে জিকির ও সামার উত্পত্তি তা সময়ের স্রোতে এসে পৌঁছেছে ভারতীয় উপমহাদেশেও। আর তৈরি হয়েছে মুর্শিদি, কাফি ও কাওয়ালির মতো সংগীতের নানা ধারা। এর মধ্যে গুরু-শিষ্যের কথোপকথনের কাফি আফগানিস্তানে জনপ্রিয়।
কাওয়ালি পুরোপুরিই ইসলামী সংগীতের অংশ। যদিও আরব থেকে এর সূচনা নয়। তবে আল্লাহ ও রাসুলের (সা.) গুণকীর্তনের পাশাপাশি কাফির ধারাটি যুক্ত করে তৈরি কাওয়ালি ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। সুফিবাদ এ ধারাটিকে প্রভাবিত করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কাফিতে সুফিবাদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি আর সেটিই পড়েছে কাওয়ালিতে। ওরস ও অন্যান্য ধর্মীয় দিবসে কাওয়ালির আয়োজন করা হয়। কাওয়ালির একটি অংশ বলা যায় কাসিদাকে। কাসিদা মূলত প্রশংসাসূচক কবিতা। আল্লাহ ও নবীদের প্রশংসা করে কাসিদা গীত হয়। কাসিদাকে বলা চলে ইসলামী সংগীতের প্রাথমিক পর্যায়ের একটি উদাহরণ। তবে কাসিদাকে সে সময় আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়নি।
বাংলাদেশে সাহরির সময় কাসিদা গাওয়ার সংস্কৃতি লুপ্তপ্রায় হলেও দুই দশক আগেও তা দেখা যেত। আশ্চর্যজনক একটি বিষয় হলো রমজানকেন্দ্রিক এক ধরনের গানও প্রচলিত ছিল, যার উৎস তুরস্ক। ফাসিল নামে পরিচিত এ সংগীত প্রাথমিকভাবে চার হাজার বছর আগে থেকে প্রচলিত বলে ধারণা করা হয়। ফাসিলের প্রচলন ছিল মধ্য এশিয়ার। তুরস্কের নানা গোত্র কবিতার মতো করে ফাসিল লিখত। ফাসিলের শুরুতে থাকত তাকসিম (বাদ্য দিয়ে শুরু), এরপর চার পর্বে চার ধরনের সুর ও লয়ে পাসরেভের পর ‘কার’ নামে একটি অংশ গাওয়া হতো। ফাসিলে আরব সংগীতের সেই পুরনো নিয়মটি পাওয়া যায়। পুরো গানটি একটি নির্দিষ্ট মাকামে গাওয়া হয়। আরব থেকে মধ্য এশিয়া, এ নিয়মের ব্যতিক্রম খুব কমই হয়েছে
আরবি সংগীতের ভুলে যাওয়া অতীত
পেটের দুপাশে ভারী বোঝা আর মরুভূমির তপ্ত সূর্যটাকে মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে উট। তার গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পিঠে উপবিষ্ট হাদি বা রাখাল প্রতি পদক্ষেপে বুনছে গান। এক সুরের ও সরল গঠনের আরবি রজয ছন্দের সে গান চলবে গন্তব্যের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। হিদা নামে পরিচিত এ গান আরবের মরুসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ জানে না, কখন এ গানের প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু বালিময় সমুদ্র পেরিয়ে উট ও রাখালের নিঃসঙ্গতা দূরকারী এ সংগীত আজও টিকে আছে। রাখালের গুনগুন বোলের সঙ্গে আরবের মরুপথে তা ছড়িয়ে গেছে দূরকে দূর। বেদুইনের অনিশ্চিত গন্তব্যের সঙ্গী এ হিদা সংগীতের পদচিহ্ন ধরে আরবি সংগীত আরব উপদ্বীপ থেকে যাত্রা করে ইরাক, মিসর আর আন্দালুস পেরিয়ে স্বর্ণ আখরে নিজের নামটি লিখিয়েছে এসব রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। এ কথা সত্য যে আরবের সংগীতের যে অনন্য উচ্চতা আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি তা মূলত শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শেষ দিকে, আরব পুনর্জন্মের ভেতর দিয়ে। তখন থেকে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয়-চতুর্থাংশ পর্যন্ত এর অভিযাত্রা সদর্পে বহাল ছিল।
খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে নীল নদের তীরে বাস করত এমন এক জাতির কথা আমরা জানতে পারি। সেখানে সংগীতে সমৃদ্ধ এক নগর ছিল। শোনা যায়, সে নগরে বাদ্যযন্ত্রের চরম উত্কর্ষ সাধিত হয়েছিল এবং ঘাত, শুষির ও তত প্রভৃতি শ্রেণীর বাদ্যযন্ত্র সেখানেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। মিসরীয় লোকেদের সংগীত যখন নীল নদের তীরকে আন্দোলিত করছিল তখন মেসোপটেমিয়া ও এর আশপাশে বাবেল ও আশুরের মতো সংগীতের লীলাভূমি আমরা দেখতে পাই। কানানি, ফিনিকি ও হিট্টিরাও এ লীলাভূমির অংশ যার ছায়া পশ্চিম এশিয়া পেরিয়ে সুদূর উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। এসব অঞ্চলে বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে গভীর আত্মিক বন্ধন ছিল, যা থেকেই মূলত সাধারণ একক সাংগীতিক ঐতিহ্য রচিত হয়েছিল। যদিও সে ঐতিহ্যের রঙ-রূপ ও ভাষিক প্রজাতি ভিন্ন ভিন্ন ছিল।
আশ্চর্যের বিষয় হলো উল্লিখিত অঞ্চলগুলোসহ সারা বিশ্বে সংগীত একই প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়েছিল। পুরনো সভ্যতাগুলোতে সংগীত পূজা-অর্চনার অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গরূপে বিকাশ লাভ করেছিল। মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার অন্যতম দুই প্রধান অঞ্চল বাবেল ও সুমেরে অবস্থিত বিভিন্ন মন্দিরের আচারপ্রথার সঙ্গে সংগীতের অগ্রগতি ও উত্কর্ষ সম্পর্কিত ছিল যা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে ধন্য হতো। এমনকি রোমকদের দেশেও সংগীতের এমন মাহাত্ম্য আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। আরব উপদ্বীপের সভ্যতা সংগীত দ্বারা কী পরিমাণ প্রভাবিত ছিল তা আমরা জাহেলি যুগের কবিতা থেকেই বুঝতে পারি। এ উপদ্বীপের বাসিন্দাদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ইহুদি ও গ্রিক জনগোষ্ঠী এবং মেসোপটেমিয়ার বিভিন্ন জাতি-উপজাতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। সুতরাং আরব অঞ্চল সংগীতের সাধারণ ক্ষেত্রভূমিতেই বিরাজ করত।
জাহেলি যুগে আরব বেদুইনদের মধ্যে সাদাসিধে কিছু গান প্রচলিত ছিল। সঙ্গীহীন মরুজীবন তাদের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করত তা থেকে এসব গানের জন্ম হতো, যার প্রতিটি স্তবক ও পঙিক্ততে অনুভূতির ভিন্নতা ছিল। দুই পঙিক্তর একটি গানও তারা গুনগুন করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিত তখন। দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লেশ থেকে তারা এভাবে নিজেদের চাঙ্গা করত। এই মরুগীতি হিদা নামে পরিচিতি পায়, যার নামকরণের পেছনে রয়েছে মজার একটি গল্প। নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর সপ্তদশ পূর্বপুরুষ ছিলেন মুজার বিন নিজার। আরব ইতিহাসবিদ মাসউদির মুরুজুয যাহাব কেতাবে উল্লেখ আছে, একবার উট চরাতে গিয়ে তিনি হাত ভেঙে ফেলেন। হাতের ব্যথায় তিনি ‘ইয়া ইয়াদাহ্! ইয়া ইয়াদাহ্!’ বা হাত! হাত! বলে চিত্কার দিতে শুরু করেন। তার চিত্কার শুনতে পেয়ে উটগুলো তার পাশে এসে জড়ো হয়। ‘ইয়া ইয়াদাহ্!’ থেকেই হিদা নামের উদ্ভব বলে আরব ভাষাবিদদের অভিমত। উটের রাখালকে মাওয়াল বলা হয়ে থাকে। হিদা হলো এ মাওয়ালদের গান। সর্বজনস্বীকৃত যে বিষয়টি হিদা সম্পর্কে পাওয়া যায় তা হলো মরুভূমিতে মাওয়ালরা উটকে নিজের কাছে ডেকে আনতে এগুলো গাইত। এসব গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে উটের পাল রাখালের কাছে এসে জড়ো হতো। অর্থাৎ এ গানগুলো যোগাযোগের মাধ্যমও বটে। কারণ এর মাধ্যমে উট নিজের মনিবের ডাক চিনতে পারত এবং সে অনুসারে তার ডাকে সাড়া দিত। উট নিয়ে বহুদূর অতিক্রম করার সময়েও মাওয়ালরা হিদা গাইত। ভারী বোঝা নিয়ে ভ্রমণের কষ্ট থেকে উটকে এ গান কিছুটা স্বস্তিও হয়তো দিয়ে থাকবে। ইসহাক মুসলির মতে, জাহেলি যুগে আরবদের মধ্যে নসব, সানাদ ও হযজ নামে কিছু সংগীত প্রচলিত ছিল। নসব ছিল মৃতের জন্য শোকগান। সানাদ বিপুল আয়োজনে গাওয়া হতো। দফ ও মিজমারের বাদনের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হযজ গাওয়া হতো। এ যুগে আরবে যেসব বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যেত সেগুলোকে ঘাত ও শুষির এই দুই শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। ঘাতযন্ত্রের মধ্যে তবল, দফ, সান্জ্ (করতাল), জুলজুল এবং শুষিরযন্ত্রের মধ্যে মিজমার ব্যবহূত হতো। ফারাবি অবশ্য ততযন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন। উদ, তানবুর, মুয়াত্তির, বারবুত প্রভৃতি ততযন্ত্রের সঙ্গে মিজহার নামে একটি উদযন্ত্রের কথাও তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন। মিজহারের পেট চামড়া দিয়ে তৈরি করা হতো। এগুলোর বাদনের সঙ্গে কবিতা গানের মতো গীত হতো।
অতঃপর ইসলামের আবির্ভাবের সময় থেকে ফারসি, তুর্কি ও মিসরীয় সভ্যতা আরবের সুর-সংগীতে প্রভাব ফেলে। আর এ কারণেই এর সঙ্গে প্রাচ্য সংগীতের মেলবন্ধন রচিত হয়েছিল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরের সম্পর্ক সুসমন্বিত ও গভীর হয়েছে। এ সময়ে আরবদের হাতে সুরের বিন্যাস বৈচিত্র্য লাভ করে এবং আরবি সংগীতের সুর ও স্বরের ভিত্তি মাকামাত প্রতিষ্ঠা পায়। তাদের কাছে সংগীতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ বিরাজ করলেও সংগীত যে আরব সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল তা অস্বীকার করার কোনো জো নেই। মুসলমান আলেম, বিজ্ঞানী, ফকিহ, ব্যাকরণবিদ ও দার্শনিকরা ভালোবেসে আপন মনের তাগিদে এ শাস্ত্র নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং অন্য জ্ঞানের সঙ্গে এ সম্পর্কিত জ্ঞানের অধ্যয়ন চালিয়ে গেছেন। বলা যায়, তাদের গবেষণার ফলেই এটি স্বপ্রতিষ্ঠিত একটি শাস্ত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। তাদের অনেকেই আরব বীণা উদ বাজাতে পারতেন। এদের লেখায় ও সাহিত্যে আমরা সমৃদ্ধ সংগীত-ঐতিহ্যের ঝলক দেখতে পাই। এ সময়ে রাজপ্রাসাদ ও জনমানুষের উৎসবে সংগীত যেমন উপস্থিত ছিল তেমনি সংগীতের মাধ্যমে রোগের চিকিৎসা করার বিষয়ে তাদের চিন্তাভাবনা খুঁজে পাওয়া যায়।
সংগীতের ইতিহাসে আব্বাসী আমলকে স্বর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। আব্বাসী যুগে আরবদের এ সংগীত-বিপ্লব সম্পর্কে ইবন খালদুন তার মুকাদ্দিমায় বলেন, ‘সংগীত শিল্প তখনো চর্চিত হতে থাকে এবং তা বনু আব্বাসের যুগে এসে পূর্ণতা পায়।’ আব্বাসী খেলাফতের শুরুতে যে বিপ্লব বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে তা পরের শতাব্দীগুলোতেও চলমান ছিল। ইতিহাসবিদ আবুল হাসান মাসউদি আব্বাসী খেলাফতের প্রতিষ্ঠাতা আবুল আব্বাস সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘এ খলিফারা সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বলেই এ শিল্প সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তিনি নিজে যেমন ছিলেন শিল্প ও সুরের ভক্ত তেমনি তার ভাই আল-মনসুরও। তার হাতেই বাগদাদ নগরী প্রতিষ্ঠিত হয়।’
খলিফা আল-মামুনের রাজত্বকালে বাগদাদে ইসলামী সংগীতের উত্কর্ষ সাধিত হয়। কারণ তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানকে উৎসাহ প্রদান করার নিমিত্তে বাইতুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেমন অনুবাদ হতো, তেমনি সংগীতের জ্ঞানও প্রাধান্য লাভ করে। দর্শন, চিকিৎসা, ফালাক প্রভৃতির জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মুসলিম বিদ্বানরা এখানে সুর ও স্বর নিয়ে গবেষণা করেন। হেনরি জর্জ ফার্মারের মতে, আব্বাসী খেলাফতের প্রথমাংশ সংগীতের স্বর্ণযুগ ছিল যার ধারা খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর রাজত্বকালেও অব্যাহত ছিল। জাঁকজমক ও আভিজাত্যের দিক দিয়ে তার দরবার খলিফা হারুন আল রশিদের দরবারের সঙ্গে তুলনীয়। তার প্রাসাদ সর্বদা তার যুগের শ্রেষ্ঠ সংগীতকারদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকত। ইসহাক মুসলি ছিলেন তার দরবারের সংগীতকারদের অন্যতম যাকে ‘নাদিমুল খালিফাহ্’ উপাধি প্রদান করা হয়েছিল। এর পরের খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহ নিজেই উদ বাজাতে পারতেন। হাম্মাদ বিন ইসহাক আল-মুসলি এ বিষয়ে প্রমাণ দাখিল করে বলেছেন, ‘উদ বাজানোর ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল।’ কিতাবুল আগানিতেও বিষয়টি এসেছে। এ বিষয়ে ফার্মারও তার মন্তব্যে বলেছেন, ‘শিল্প ও সংগীত তার দরবারে উৎসাহ ও বদান্যতা পেয়েছে, যা এর আগে আর দেখা যায়নি। এমনকি যারা তার দরবার পরিদর্শনে আসতেন তাদের কাছে মনে হতো ইব্রাহিম মুসলির নেতৃত্বে এ যেন সংগীত ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে।’ আব্বাসী খলিফাদের দরবার জ্ঞানীগুণী ও চিন্তক সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এ সময়ে কোনো সংগীত উৎসবে অংশ নিতে বাগদাদের অলিগলিতে গায়ক দলের উপচে পড়া ভিড় হতো। অধিবাসীরা নিজেরাই এসব উৎসবে ও অনুষ্ঠানে গান গাইত। এই ঐতিহ্যটিই পরে ইউরোপের রাজদরবারে প্রবাহিত হয়, যখন এই মুসলিম গায়করা ফ্রান্স, উত্তর স্পেন, সিসিলি প্রভৃতি দেশের রাজদরবারে গিয়ে উপস্থিত হয়। এ যুগের খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহ গান ও সংগীতের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন। তিনি নিজেও সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। সংগীতের বিভিন্ন নিয়মকানুন নিয়ে রচিত বিভিন্ন বইও এ সময়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফারাবি রচিত আল-মুসিকা আল-কাবির ও আবুল ফরজ আল-ইসফাহানি রচিত কিতাবুল আগানি এ সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা।
আন্দালুসে মুওয়াশশাহর আবির্ভাবের ফলে ভিন্ন রকমের এক সংগীতের উত্থান ঘটে। নবম শতকে শিল্পের প্রয়োজনে এবং একই সঙ্গে সামাজিক প্রপঞ্চ হিসেবে সেখানে মুওয়াশশাহর আগমন ঘটে। মূলত কবিতা লেখার কড়াকড়ি নিয়ম থেকে ও কবিতার ছন্দ থেকে মুক্তির প্রচেষ্টায় এর উদ্ভব ঘটে। এ কবিতাগুলো পাঁচটি স্তবকে সজ্জিত হতো এবং গান হিসেবে ব্যবহূত হতো। এতে সংগীত বিকশিত হয়, গান গাওয়া বেশ জনপ্রিয় হয় এবং আরবি ঐতিহ্যের সঙ্গে হিস্পান ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ ঘটে। ছন্দ ও অন্ত্যমিলের কড়াকড়ি নিয়মকে অগ্রাহ্য করে যে মুওয়াশশাহ রচিত হয় তাতে কবিতা নয় বরং একেবারে শুরু থেকেই গানের প্রাধান্য ছিল। সংগীতের প্রতি আন্দালুসিদের অনুরাগ ছিল অবিশ্বাস্য এবং গান গাওয়ায় হামেশা তাদের ডাক পড়ত। এমনকি জরইয়াবের সেখানে আগমন ও তার সংগীত আন্দালুসে ছড়িয়ে পড়ার পরও তাদের গান গাইতে ডাকা হতো। এভাবে গান ও সংগীত সংমিশ্রিত হয়ে কবিতাকে প্রভাবিত করে। এর পরের যুগে গীতিকাব্যে যজল নামে আরেকটি ধারা সংযুক্ত হয়, যাতে লাহজাহ বা আরবি উপভাষা প্রাধান্য লাভ করে। এমন গানে ভিনদেশী শব্দও যুক্ত করা হতো। ইবন কুজমান এ ধারার প্রবক্তা বলে প্রশংসিত হন।
হিস্পানি প্রাচ্যতাত্ত্বিক হুলিয়ান রিবেরা হিস্পানি সংগীত ও তার ইতিহাস নিয়ে বেশ কয়েকটি বই রচনা করেছেন। এসব বইয়ে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করেছেন যে মধ্যযুগের হিস্পানি সংগীতের মূল প্রোথিত রয়েছে আরবে। আরবরা সেখানে প্রবেশের আগে হিস্পানের সংগীত ছিল গ্রিসের গির্জার সংগীত দ্বারা প্রভাবিত। হিস্পানে আরবের প্রবেশ এবং সেখানে আন্দালুস নগরের প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের সংগীতকে উন্নতির চরম শিখবে পৌঁছে দিয়েছে। আন্দালুসকে বলা যায় সভ্যতার করিডোর, যা দিয়ে পূর্বের সংগীত পশ্চিমে প্রবাহিত হয়েছে। এর মাধ্যমে মধ্যযুগে প্রাচ্য ইউরোপকে অধিকার করেছে। শুধু তাই নয়, উদ নামক আরব বীণা সপ্তদশ শতকেও ইউরোপে বাজানো হতো। কুর্ট জাকসের মতো বেশকিছু গবেষক বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদের অধিকাংশের মতে, পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ বাদ্যযন্ত্রের উত্পত্তিস্থল হলো পূর্ব। যেমন সারা বিশ্বে পিয়ানোকে একটি বিশুদ্ধ ইউরোপীয় বাদ্যযন্ত্র মনে করা হয়। কিন্তু কুর্ট জাকসের মতে, এটি আন্দালুসি আরবি বাদ্যযন্ত্র। তিনি একে জিরিয়াবের সময়ের মনে করেন। যন্ত্রটির জন্য হিস্পানি, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় সবচেয়ে প্রাচীন যে শব্দটি পাওয়া যায় তা হলো Echiquier (এশিকিয়ের)। অর্থাৎ আরবে শাকির নামে যে বাদ্যযন্ত্র ছিল তা হলো পিয়ানোর পূর্বপুরুষ। শাকির ছিল ছোট একটি যন্ত্র, যার চাবিগুলো সাদা ও কালো রঙের হতো। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এটি আরবে পাওয়া যেত। সুতরাং আরবরা যখন আন্দালুসে প্রবেশ করল তখন তারা জ্ঞান ও দর্শনের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রও সেখানে নিয়ে গেল। একাধিক তারের পলিফোনিক সুর সম্পর্কে তখনো পশ্চিমের জানাশোনা ছিল না। আন্দালুসি ইমারতের তৃতীয় খলিফার রাজত্বকালে (৭৯৬-৮২২) এ শিল্প সেখানে উত্কর্ষ লাভ করে। আব্বাসীদের মতো তারাও শিল্পী ও জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। দ্বিতীয় আবদুর রহমানের সময় পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত ছিল।
অনদালুসের রাজদরবারের প্রথম সারির সংগীতজ্ঞ জিরিয়াবের জীবন থেকে সেখানে সংগীতের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারি। তিনি সুলতানের নাদিম বা বন্ধু ছিলেন এবং তিনি তার সঙ্গে একই পাত্র থেকে খাবার খেতেন। তিনিই আন্দালুসের প্রথম মিউজিক স্কুল তৈরি করেছিলেন। এজন্য তাকে ‘মিউজিকার আল-আন্দালুস’ নামে অভিহিত করা হয়। আন্দালুসের পতন অবধি এ স্কুল চালু ছিল। সংগীতে জিরিয়াবের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। তিনিই উদের পঞ্চম তারটি সংযুক্ত করেন এবং বাগদাদ থেকে আন্দালুসে সংগীতের দুটো রীতিকে নিয়ে গিয়েছেন যেগুলো হলো: ১. নুবা অঞ্চলের গায়কি ও ২. কবিতার তালের সঙ্গে সংগীতের তালের প্রয়োগ ঘটানো। তার হাত দিয়েই উদ, কানুন ও রাবাবের মতো বাদ্যযন্ত্র আন্দালুসে প্রবেশ করে। ইরাক থেকে জিরিয়াবের আন্দালুসে গমন এবং সংগীতজ্ঞানে নিজের প্রভাব স্থাপন করায় ইরাকি ঘরানা থেকে তার হাতে আন্দালুসি ঘরানার উদ্ভব ঘটে। এ সময়ে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সংগীত পরিবেশন করা হিস্পানির লোকেদের কাছে জনপ্রিয় হয়। এ প্রসঙ্গে প্রাচ্যবিদ হুলিয়ান রিবেরির মন্তব্য হলো এভাবে আন্দালুসের আনাচেকানাচে সংগীত ছড়িয়ে পড়ায় শহরের অধিকাংশ লোকেদের ঘরে সংগীতযন্ত্র প্রবেশ করে। দোকানে দোকানেও সংগীত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গ্রানাডার বিষয়ে শোনা যায়, সেখানে সংগীতের এত প্রাচুর্য ছিল যে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও মাকহাগুলোতে সংগীতের বহুল চর্চা হতো।
সংগীতকে বলা হয়ে থাকে হূদয়ের ভাষা, পরম সত্যের ভাষা যা শ্রবণেন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে সরাসরি পৌঁছে যায় মর্মমূলে। মানুষের এ শিল্প প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বহমান এবং তা পুরো বিশ্বের অভিব্যক্তিকে মাত্র একটি সাংগীতিক নোটের মধ্যে ধারণ করতে সক্ষম। আরবদের সংগীতের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য।
আরবি গানের মাকাম
সপ্তম শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে যে ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সমাজতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে তা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসপাঠে এক অপরিহার্য অধ্যায়। ইতিহাসের এ অধ্যায়কে ঐতিহাসিকরা আরব দখলাভিযান, মুসলিম দখলাভিযান, ইসলামের প্রসার ইত্যাদি বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করেছেন। যে নামেই ডাকা হোক, আলোচিত অঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোয় এবং আরো বড় পরিসরে সমগ্র পৃথিবীর জন্য পরিবর্তনটি ছিল এক বৈশ্বিক ঘটনা। কারণ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক যুগ-পূর্ববর্তী পৃথিবীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থলীয় পথের শাখা-প্রশাখাগুলো বিছানো ছিল অঞ্চলটির বুকজুড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ধারক এ পথগুলো দিয়ে প্রাচীন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তজুড়ে বেচাকেনা হতো নানা রকমের মসলা, হরেক ধরনের সুগন্ধি ও আসবাব। এর মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান যে জিনিসটি ছিল তা হলো রেশম। প্রাচীন পৃথিবীতে ধনাঢ্যের পরিধেয় ছিল রেশম বস্ত্র। ঐতিহাসিকরা তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের এ পথগুলোকে একত্রে বলেন ‘রেশম মার্গ’।
এ রেশম মার্গ দিয়ে কেবল জিনিসপত্রের বেচাকেনা হতো না। আদান-প্রদান হতো তথ্য, খবর, গল্প, ইতিহাস, ধারণা ও বিশ্বাসের। যারাই এ পথকে নিয়ন্ত্রণ করেছে এ রেশম মার্গ ইতিহাসে তারাই অধিষ্ঠিত হয়েছে পরাশক্তিরূপে আর অবয়ব দান করেছে বিশ্বসভ্যতাকে। সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের উত্থান ঘটে মূলত এ রেশম মার্গের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার কারণে। আরবরা নিঃসন্দেহে একটি সভ্যতা স্থাপন করে, কিন্তু তা শূন্য হতে সৃষ্টি করেনি। এ অঞ্চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপাদান ছিল। দিগ্বিজয়ী আলেক্সান্ডার এ অঞ্চল দখল করার পর এখানে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ অঞ্চলের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজতত্ত্ব প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি আকার-আকৃতি ধারণ করে। আরব দখলাভিযানের পর নব্য ক্ষমতাসীনরা এ আকার-আকৃতিতে রুহ ফুঁকে দিয়ে প্রাণ সঞ্চারিত করে এক সুদূরপ্রসারী সভ্যতার।
সভ্যতা-সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য উপাদান সংগীত। প্রকৃতির শব্দ-কোলাহলের সঙ্গে মানুষ একাত্মতা বোধ করে আসছে আদিমকাল থেকে। পাখির কূজন, পশুর ডাক কিংবা প্রকৃতির কাকলির মানব অনুকরণ থেকেই সম্ভবত সুর ও সংগীতের উদ্ভব। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা সংগীতের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুণ সম্পর্কে আলোচনা ও উক্তি করেছেন। সুরের বিভিন্ন ধরনের ওপর নির্দিষ্ট আবেগের বৈশিষ্ট্য আরোপ করেছিলেন প্লাতো ও তার সমসাময়িকরা। গ্রিক ভাষায় এসব ধরনকে বলা হয় হারমোনিয়া। গ্রিক দর্শনে এ হারমোনিয়াগুলো সুরের একেক রকম সারিবদ্ধকরণ ও শ্রেণীবিন্যাস। প্লাতোর মতে, একেক হারমোনিয়া মানব চরিত্রকে একেক রকমভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম।
আরবরা সপ্তম শতাব্দী-পরবর্তী সময়ে সভ্যতা-সংস্কৃতির সঙ্গে এখানকার সংগীতচর্চাও আহরণ করে এবং একে এক স্বতন্ত্র রূপ দেয়। তবে ফরাসি প্রবাদ বাক্যটি এখানে যথার্থভাবেই উল্লেখ করা যেতে পারে—plus ça change, plus c’est la même chose (প্লুস সা শঁজ, প্লুস সে লা মেম শোজ)—যতই তা বদলায়, ততই তা একই রকম। আরব সংগীতেও সুরের ধারার ধারণাটি রয়েছে। আরবি এ ধারাগুলোকে বলা হয় মাকাম। মাকামগুলো কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত—আজাম, বয়াত, হিজাজ, কুদর্্, নাহাওয়ান্দ, নওয়া আসার, রাস্ত্, সাবা ও সিকাহ্। গ্রিক হারমোনিয়ার ধারণার সঙ্গে তুলনাযোগ্য বয়াত মাকামের বৈশিষ্ট্য বিরহ, সাবা মাকাম তৈরি করে বেদনার আবহ, কুদর্্ মাকাম জাগিয়ে তোলে বিধুরতা, নাহাওয়ান্দ মাকাম প্রেমকাতরতার ধারক, হিজাজ মাকাম আনন্দের আহ্বায়ক ইত্যাদি।
সুরের সঙ্গে আবেগের এ সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে আরব দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা সুরের বহু দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। আল-কিন্দি মানব চিকিৎসায় সুরের ব্যবহার করেছিলেন। আল-ফারাবি তার রচিত কিতাবুল মুসিকাতুল কাবিরে সংগীত ও সুরের তাত্ত্বিক বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। ইবনে সিনা সংগীত ও সুরের ব্যাপারে গ্রিকদের ধারণার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তার বেশকিছু গ্রন্থে। ইসলাম ধর্মচর্চায় সুরের প্রধান ব্যবহার দেখা যায় মুয়াজ্জিনের আজানে। ওসামানী খিলাফতকালে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান পাঁচ রকমের মাকামে দেয়া হতো। তাই মুয়াজ্জিনের সুর সম্পর্কে ধারণা থাকা ছিল অপরিহার্য
সংগীতে মুসলমান তাত্ত্বিকদের অবদান
আরবদের মধ্যে যখন সচ্ছলতার আবির্ভাব ঘটল, তখন পারস্য ও রোমের সংগীতবিদরা হেজাজে চলে আসলেন। সারাঙ্গী, তানপুরা, বীণা ও বাঁশিসহযোগে গান গাইতে শুরু করলেন। সে সুর আরবরা তুলে নিল নিজেদের কবিতাগুলোয়। মদিনায় নাশিত ফারেসি, তোয়েস ও সায়িবের মতো গুণীরা আভির্ভূত হলেন। আরবদের কবিতায় সুর দিয়ে পেলেন অদ্ভুত সাফল্য। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের নাম।
(আল মুকাদ্দিমা, ইবনে খালদুন)
মুসলিম সংগীতচর্চার ইতিহাসে প্রথম দিকের পরিচিত নাম নাশিত ফারেসি। পারসিক বংশোদ্ভূত এ গায়ক আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর ইবনে আবি তালিবের দাস হিসেবে মদিনায় বেড়ে ওঠেন। পারসিক ধাঁচে গাওয়া তার গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সে যুগে। তার ছাত্র মাবাদ ও ছাত্রী আযযাহ আল মাইলা পরবর্তী সময়ে খ্যাতি অর্জন করেন। অন্যদিকে সায়িব কাসির (মৃত্যু-৬৮৩ খ্রি.) ছিলেন নাশিত থেকে প্রভাবিত। খলিফা মুয়াবিয়ার আমলে তার সামনেই গান পরিবেশন করেন ইয়াজিদের জন্য। সায়িব ছিলেন পারসিক বংশোদ্ভূত মাওয়ালি এবং পেশায় গম ব্যবসায়ী। হেজাজ ও মদিনায় তখন সংগীতের যে পাটাতন প্রস্তুত হচ্ছিল, প্রথম সারিতে থেকে তার নেতৃত্ব দিয়েছেন সায়িব। তার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় সংগীতচর্চার দরবারি ঐতিহ্য। আরবি কবিতার সঙ্গে পারসিক যন্ত্র ও সুরের সমাবেশে তৈরি হয় নতুন সংগীত ধারা।
মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ইবনে মিসজাহ। উমাইয়া খলিফা আল ওয়ালিদের (৭০৫-৭১৫) সময় সংগীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। আরবি, ফারসি ও বাইজেন্টাইন রীতির সুষম মিশেল ঘটে তার প্রচেষ্টায়। এই যুগেই মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন মা’বাদ বিন ওয়াহহাব (মৃত্যু-৭৪৪)। বস্তুত তিনি নাশিত ফারেসি, সায়িব কাসির ও ইবনে মিসজাহ—সবার কাছেই সংগীতের পাঠ নেন। ফলে আরব সংগীতের মাইলফলক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বেগ পেতে হয়নি। মক্কা ও মদিনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তার নাম।
ইউনুস আল কাতিব আল মুগান্নিকে বলা যায় প্রথম বড় তাত্ত্বিক। হিজরি দ্বিতীয় শতকের প্রথম ভাগে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। জুবাইর ইবনে আওয়ামের (রা.) পরিবারে মাওয়ালি ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকে কবিতায় দক্ষতা থাকলেও সংগীতে পাঠ নেন মা’বাদের কাছে থেকে। উমাইয়া খলিফা হিশামের (৭২৪-৭৪৩ খ্রি.) যুগে লাভ করেন চূড়ান্ত খ্যাতি। সেই খ্যাতি এতটাই উঁচুতে পৌঁছেছিল যে পরবর্তী প্রজন্ম তার সংগীতের ধরনকে অনুসরণ করতে থাকে ‘গিনা জায়ানিবি’ নামে। সংগীত নিয়ে লেখা তার কয়েকটি গ্রন্থ বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মদিনা কেন্দ্রিক সংগীত নিয়ে ‘কিতাবুন নাগাম’, বিখ্যাত নারী সংগীতকারদের নিয়ে ‘কিতাবুল কিয়ান’ এবং নিজের লেখা গানের সংকলন ‘কিতাবুল মুজাররাদ ইউনুস’ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
ইবরাহিম আল মাউসিলি (৭৪২-৮০৪ খ্রিস্টাব্দ) সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সংগীতবিশারদদের একজন। কুফাতে জন্মগ্রহণ করলেও পিতার মৃত্যুর পর মসুল চলে যান সংগীতচর্চার জন্য। সেখান থেকেই নামের সঙ্গে মাউসিলি যুক্ত হয়। আব্বাসীয় খলিফা আবু জাফর আল মানসুরকে (৭৫৪-৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ) গান শুনিয়ে দরবারে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেন। পরবর্তী খলিফা আল মাহদি (৭৭৫-৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ) এবং হাদির (৭৮৫-৭৮৬ খ্রিস্টাব্দ) দরবারেও ছিলেন সমাদৃত। দরবারকে কেন্দ্র করে সংগীতের প্রশিক্ষণ চালু হয় তার তত্ত্বাবধানে। খলিফা হারুন-অর-রশিদ (৭৮৬-৮০৯ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ইবরাহিম আল মাউসিলি এবং ইবনে জামিকে নির্বাচিত ১০০ গানের সংকলন তৈরির দায়িত্ব দেন; এ সংকলনই পরবর্তী সময়ে ‘কিতাবুল আগানি’ তৈরির অনুপ্রেরণা দিয়েছে আবুল ফারাজ ইসফাহানিকে। ইবরাহিম ছিলেন ধ্রুপদী হেজাজি ঘরানার; অন্যদিকে ইবনে জামি আধুনিকতাবাদী। ইবনে জামির প্রকৃত নাম আবুল কাসিম ইসমাইল। কুরাইশ বংশের শাহম গোত্রে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে বাগদাদে দরবারে পৃষ্ঠপোষকতা পান।
ইসহাক আল মাউসিলি (মৃত্যু-৮৫০) ছিলেন ইবরাহিম আল মাউসিলির পুত্র। সংগীতের ওপর ৪০টির মতো গ্রন্থ এবং প্রায় ৪০০ গান রচনা করেন তিনি। বিশিষ্ট আরব সংগীতজ্ঞ জিরিয়াব তার ছাত্র। জিরিয়াবের পূর্ণ নাম আবুল হাসান আলি ইবনে নাফি। শুধু মুসলিম সংগীতকার হিসেবে না; খোদ সংগীতের ইতিহাসে তার মতো প্রতিভা বিরল। ৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন। আন্দালুসিয়ায় তখন উমাইয়া শাসক আল হাকিমের আমন্ত্রণে কর্ডোবাতে গিয়ে থিতু হন। কেবল সংগীতে না, ভূমিকা রেখেছেন আন্দালুসিয়ার সাংস্কৃতিক অভিমুখ নির্ধারণেও। সংগীতে পাশ্চাত্য সঙ্গে প্রাচ্য ঘরানার মধ্যে তৈরি হয় নতুন সম্পর্ক। তার পরিচয় করিয়ে দেয়া নতুন বাদ্যযন্ত্র, পুনর্গঠন করা সংগীতের পরিমাপ পদ্ধতি এবং সংগীতবিষয়ক তাত্ত্বিক আলোচনা কয়েক শতক ধরে চর্চিত হয়েছে পরবর্তী ইউরোপে। ইতিহাসে তিনিই প্রথম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সংগীতচর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেন।
কর্ডোবার উমাইয়া শাসক তৃতীয় মুহম্মদের (১০২৪-২৫ খ্রিস্টাব্দ) কন্যা ছিলেন ওয়াল্লাদা বিনতে আল-মুসতাকফি। কাব্য ও সংগীতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার সঙ্গে ইবনে জায়দুনের রোমান্টিক সম্পর্কের খবর ঐতিহাসিক মহলে বেশ সুপরিচিত। ইবনে জায়দুন নিজেও ছিলেন আন্দালুসের আধুনিক ধারার কবি। দুর্ভাগ্যক্রমে দুজনেই বেড়ে উঠেছেন কর্ডোবার পতনের যুগে।
প্রাথমিক যুগে আরব তাত্ত্বিকরা সংগীতের উপরে লেখা পিথাগোরাস ও অ্যারিস্টটলসহ বিভিন্ন গ্রিক এবং লাতিন লেখকের পুস্তক অনুবাদ করেন। উন্নতি সাধন করেন সংগীতবিষয়ক সেই সব তত্ত্বে। অবসাদ, দুশ্চিন্তা, রাগসহ নানা রকম মানসিক চিকিৎসার ওষুধ হিসেবেই কদর পেয়েছে নানা ঘরানার সংগীত। গড়ে উঠেছে বিন্যাস ও পদ্ধতিগত আলোচনা। সংগীতের পদ্ধতিগত আলোচনায় এখন পর্যন্ত ইউনুস আল কাতিবকেই সামনে রাখেন ঐতিহাসিকরা। তারপর আসে আরবি ছন্দশাস্ত্রের জনক আল-খলিলের নাম। আল-খলিল ইবনে আহমদ আল ফরহাদি ৭১৮ সালে বর্তমান ওমানে জন্মগ্রহণ করেন। কিতাবুল আইন, কিতাবুল ফিহরিস্ত ও কিতাবুল মুয়াম্মা তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তিনিই প্রথম প্রণয়ন করেন আরবি ভাষার অভিধান। সংগীতবিষয়ক তার তত্ত্ব পরবর্তী সময়ে আব্বাস ইবনে ফিরনাস (৮১০-৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ) আন্দালুসিয়ায় প্রসার ঘটান। অন্যদিকে ইবনে আল মুনাজ্জিম (মৃত্যু-৯১২) ‘রিসালাহ ফিল মুসিকা’ গ্রন্থে সংগীতের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। যদিও তত্ত্বগুলো ইসহাক আল মাউসিলি থেকে প্রভাবিত।
বাগদাদ তখন জ্ঞানচর্চার তীর্থস্থান। অষ্টম থেকে দশম শতাব্দীতে সংগীত ও স্বরবিজ্ঞানের ওপর লেখা অনেক গ্রিক ও সিরিয়াক রচনা অনূদিত হয় আরবিতে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন আসিরীয় পণ্ডিত ইউহান্না ইবনে আল বাতরিক (মৃত্যু-৮১৫), হুনাইন ইবনে ইসহাক (মৃত্যু-৮৭৩) ও সাবিত ইবনে কুররা (মৃত্যু-৯০১)। আরব চিন্তায় প্রবেশ করে পিথাগোরাস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো, অ্যারিস্টোজেনাস, গ্যালেন ও সিমপ্লিসিয়াসের সংগীতবিষয়ক বিভিন্ন মতবাদ। কেবল সাবিত ইবনে কুরার সংগীতবিষয়ক গ্রন্থের সংখ্যাই আট।
সমসাময়িক ছিলেন আল কিন্দী (মৃত্যু-৮৭৩)। আরব দর্শনের জনক হিসেবে পরিচিত এ পণ্ডিত কেবল সংগীত নিয়েই সাতটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। অন্তত তিনটি এখনো সংরক্ষিত। ‘দি এসেনশিয়ালস অব নলেজ ইন মিউজিক’, ‘অন দ্য মেলোডিজ’ এবং ‘দ্য নেসেসারি বুক ইন দ্য কম্পোজিশন অব মেলোডিজ’। সংগীতকে তিনি গণিত শাস্ত্রের চমত্কার শাখা হিসেবে প্রশংসা করেছেন। শরীর ও মনের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের এ ব্যাপারে পরমর্শও দিয়েছেন। তার ছাত্রদের মধ্যে আল সারাকশি (মৃত্যু-৮৯৯), মানসুর ইবনে তালহা (মৃত্যু-৯১০) ও ইবনে তাহিরের (মৃত্যু-৯১৩) নাম বেশ সমাদৃত। জ্ঞানচর্চার গুপ্ত সংগঠন ‘ইখওয়ানুস সাফা’ তাকে অনুসরণ করেই সংগীতের আলোচনা লিপিবদ্ধ করেন ‘রাসায়েলে ইখওয়ানুস সাফা’ বিশ্বকোষে। এই দিক থেকে পিছিয়ে থাকনেনি সেই সময়ের জনপ্রিয় দার্শনিক আবু বকর আল রাজি (মৃত্যু-৯২৫)। সংগীতের ওপর তিনি লেখেন ‘কিতাব ফি জুমাল আল মুসিকা’।
আবু নসর আল ফারাবি (মৃত্যু-৯৫০)—পরিচিত ছিলেন ‘আল মুয়াল্লিমুস সানি’ বা দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে। ফারব অঞ্চলে জন্মের কারণে নামের সঙ্গে ফারাবি যুক্ত। দর্শন, মনোবিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা ও আলকেমির পাশাপাশি সংগীত নিয়েও তার জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়; তার প্রমাণ ‘কিতাবুল মুসিকা আল কাবির’। ইতিহাসে মুসলমানদের উত্থান থেকে তার সময়কাল পর্যন্ত তাত্ত্বিকভাবে সংগীতে সবচেয়ে বড় অবদান এ গ্রন্থ। গ্রিক লেখকরা কিংবা পূর্ববর্তী দার্শনিক আল-কিন্দির প্রভাবকে ছাপিয়ে গিয়ে দাঁড় করান মৌলিক মতবাদ। ‘স্টাইলস ইন মিউজিক’ এবং ‘অন দ্য ক্ল্যাসিফিকেশন অব রিদম’ গ্রন্থগুলোয় তার মৌলিকতার ছাপ স্পষ্ট। এছাড়া ‘ক্ল্যাসিফিকেশন অব দ্য সায়েন্সেস’ এবং ‘দ্য অরিজিন অব দ্য সায়েন্সেস’ গ্রন্থ দুটিতেও আলোচনা করেন সংগীত নিয়ে। কেবল তাত্ত্বিক ছিলেন না ফারাবি, নিজেও চর্চা করতেন।
মুহম্মদ ইবনে আহমদ আল খাওয়ারিজমি (মৃত্যু-৯৮০) সামানীয় শাসনামলে উজিরের পদে আসীন ছিলেন। তার রচিত ‘মাফাতিহুল উলুম’ গ্রন্থে এসেছে সংগীত প্রসঙ্গ। কাছাকাছি সময়েই ছিলেন আবুল ওয়াফা আল বুজজানি (মৃত্যু-৯৯৮)। ত্রিকোণমিতিতে সেক্যান্ট এবং কোসেক্যান্ট ধারণা প্রবর্তনের জন্য তিনি খ্যাতি লাভ করলেও সংগীত নিয়ে নীরব থাকেননি। ‘মুখতাসারু ফিল ফান আল ইকা’ গ্রন্থে তিনি আলোচনা করেন সুর ও সংগীতের তত্ত্ব নিয়ে।
ঐতিহাসিকরা ইবনে সিনাকে (৯৮০-১০৩৭ খ্রিস্টাব্দ) চিকিৎসাবিজ্ঞানী আর দার্শনিকদের তালিকায় দেখে অভ্যস্ত। বাস্তবিক অর্থেই আধুনিক যুগের আগ অব্দি ইবনে সিনার মতো প্রভাবশালী দার্শনিক প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যে খুব অল্প ছিলেন। তার লেখা ৪৫০টি গ্রন্থের মধ্যে ২৪০টি এখনো সুরক্ষিত। সেখানে সংগীতশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা নেহাত কম না। ‘কিতাবুশ শিফা’ গ্রন্থের ‘ফান’ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে সংগীত। প্রসঙ্গ এসেছে ‘কিতাবুন নাজাত’-তেও। সংগীতকে তিনি অনেক রোগের ওষুধ হিসেবে গণ্য করতেন। ইবনে সিনার ছাত্র ছিলেন আবু মানসুর ইবনে জাইলাহ (মৃত্যু-১০৪৮)। তিনি লেখেন ‘কিতাব আল কাফি ফিল মুসিকা’। শুধু সংগীতকে উপজীব্য করে সমৃদ্ধ ও সম্পূর্ণ গ্রন্থ।
হাসান ইবনে আল হাইসাম (৯৬৫-১০৪০ খ্রিস্টাব্দ) গণিত ও আলোকবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্য পরিচিত। তিনি ইউক্লিডের রচনায় টীকা যুক্ত করেন। সংগীত নিয়ে তার রচনা ‘মাকালাহ ফি শরহি আল আরমুনিকি’ ও ‘রিসালাহ ফি তাসিরাতুল লুহুন আল মুসিকিয়াহ ফিল নাফুসু আল হায়ওয়ানিয়্যাহ’। দ্বিতীয় গ্রন্থ এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ, তাতে প্রাণীর মনে ও আত্মায় সংগীতের প্রভাব নিয়ে আলোচিত হয়েছে।
মানুষের আকাশে উড়ার চেষ্টার ইতিহাসে বেশ উজ্জ্বল নাম আব্বাস ইবনে ফিরনাস (৮১০-৮৮৭ খ্রিস্টাব্দ)। জ্যোতির্বিদ্যা আর চিকিৎসাবিদ্যায়ও তার দখল ছিল অসামান্য। সংগীতসংক্রান্ত যে তত্ত্ব তিনি আন্দালুসিয়ায় আলোচনা করেন, তা বাগদাদের পণ্ডিত আল খলিলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে বাগদাদে ‘ইখওয়ানুস সাফা’-এর মতবাদগুলো সেখানে প্রচার করেন মাসলামাহ আল মাজরিতি (৯৫০-১০০৭) এবং আবুল হাকাম আল কিরমানি (মৃত্যু-১০৬৬ খ্রিস্টাব্দ)। আল মাজরিতি আন্দালুসিয়ার উমাইয়া শাসক দ্বিতীয় হাকিমের (৯৬১-৭৬) পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আল কিরমানি ছিলেন তার ছাত্র।
ইবনে সিদাহ আল আন্দালুসি (১০০৭-১০৬৬ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন আরবি ভাষাবিদ। ‘কিতাব আল মুখাসসাস’ গ্রন্থের কয়েকটি অধ্যায়জুড়ে সংগীত ও সংগীত সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। পরবর্তী প্রজন্মে আবু সালত উমাইয়া আল আন্দালুসির (মৃত্যু-১১৩৪ খ্রিস্টাব্দ) নাম উত্তর আফ্রিকায় ছিল প্রসিদ্ধ। তার রচিত গ্রন্থ ‘রিসালাহ ফিল মুসিকা’ পরবর্তী সময়ে হিব্রু ভাষায় অনূদিত হয়। আফ্রিকার মাটিতে ‘রিসালাহ আল মুসিকা’ নামে আরো একটি বই প্রচলিত ছিল; যার লেখক ইবনে বাজা (১০৮৫-১১৩৮ খ্রিস্টাব্দ)। মুসলিম স্পেনের সারাগোসায় জন্মগ্রহণ করা এ পণ্ডিত স্পেনীয় জ্ঞানচর্চায় প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব।
পরবর্তী যুগে সংগীতসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক আল হাসান ইবনে আহমদ ইবনে আলি আল কাতিব (মৃত্যু-১২২৮)। তিনি ছিলেন একাধারে সুফি ও সংগীতবিশারদ। সংগীদের দর্শন নিয়ে তার লেখা ‘কামাল আল-আদাব আল গিনা’। মোট ৪০টি অধ্যায়ে সংগীতসংক্রান্ত সব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে এখানে। এরপর আসেন সফিউদ্দিন আবদুল মুমুন আল উরমাওয়ি আল বাগদাদী (মৃত্যু-১২৯৪)। সংগীত নিয়ে তার লেখা ‘কিতাবুল আদওয়ার’ ও ‘রিসালাহ আল শারাফিয়্যাহ ফি নাসাব আল তালিফিয়্যাহ’। বাগদাদ থেকে শাম হয়ে মাগরিব অঞ্চলে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে। তৈরি করেছে নতুন স্রোত। সেই স্রোতের উত্তরসূরি হিসেবে আছেন ইসা ইবনে কারা (মৃত্যু-১৩৫৮), আমর ইবনে খিজির আল কুর্দি (মৃত্যু-১৩৯৭) ও আবদুল কাদির ইবনে গায়িবি (মৃত্যু-১৪৩৫)।
মূলধারার বাইরে থেকেও সংগীত নিয়ে আলোচনা করেছেন কেউ কেউ। তুলে এনেছেন সংগীতের পরিচিতি, ইতিহাস, ধরন ও সংগীতসংশ্লিষ্ট নানা যন্ত্রপাতির বর্ণনা। আবুল হাসান আলি আল ইসফাহানির (মৃত্যু-৯৬৭) লেখা ‘কিতবুল আগানি’ তার উদাহরণ। ঐতিহাসিক আল মাসুদি (মৃত্যু-৯৫৬) ‘মুরুজুজ জাহাব ওয়া মায়দানুল জাওয়াহির’ এবং ইবনে খালদুন (মৃত্যু-১৪০৬) ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে আলোচনা করেছেন সংগীত নিয়ে।
সভ্যতার অনিবার্য উপাদান সংগীত। সেই সংগীতের ইতিহাসে মুসলিম সভ্যতার নায়কদের গল্প কম দীর্ঘ না। হেজাজ ও বাগদাদ থেকে যে আলো জ্বলে উঠেছিল, শিগগিরই তা আলোকিত করে তুলে খোরাসান থেকে আন্দালুসিয়া পর্যন্ত। পূর্ব দিক থেকে বলকান অঞ্চল এবং পশ্চিম দিক থেকে স্পেন দিয়ে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। একদিকে ইউরোপ ক্রমে উজ্জ্বল হয়ে উঠল; আর ক্রমে স্তিমিত হয়ে পড়ল বাগদাদ ও কায়রো। এ ব্যাপারে ইবনে খালদুনের একটা কথা প্রণিধানযোগ্য— “কোন সভ্যতার প্রয়োজনীয় সকল উপাদানের শেষে আবির্ভূত হয় সংগীতশিল্প। কারণ এটা পরিপূর্ণতা বিধায়ক অভ্যাস এবং আনন্দ সৃষ্টির উপকরণ। একে পেশা হিসাবে গ্রহণ করা সম্ভব না। এই জন্যই সভ্যতার অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিলে এই সংগীত
শিল্পই সবার আগে বিলুপ্ত হয়।”
উমাইয়া-আব্বাসী শাসনামলে সংগীতচর্চা এবং ‘কিতাব আল আগানি’
উমাইয়া খেলাফতের অধীনে ইসলামী সংগীতের শাস্ত্রীয় ধারা ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করে। এই সময় মুসলিম জাহানের রাজধানী মদিনা থেকে সিরিয়ার দামেস্ক নগরে স্থানান্তরিত হয়। দামেস্কের রাজদরবার সর্বদা নারী ও পুরুষ সংগীতজ্ঞ দ্বারা ভরপুর থাকত। তাদের মধ্যে অধিকাংশ জন্মসূত্রে কিংবা সাংস্কৃতিক অভিযোজনের সূত্রে আরবীয় হলেও তাদের মূল ছিল অনারবীয়। উমাইয়া খিলাফতের সময় পারস্য, আফ্রিকা, তুরস্ক ইত্যাদি অঞ্চল থেকে বিপুলসংখ্যক অনারব ইসলাম গ্রহণ করে। এই নওমুসলিমদের কারণে গোত্রীয় আরব সমাজে কিছু সামাজিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এর সমাধান হিসেবে এসব অনারব নওমুসলিমকে কোনো একটি আরব গোত্র কিংবা কোনো একজন আরব ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় থাকতে হতো। এই নওমুসলিমদের অমুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য জিজিয়া নামক কর দিতে হতো এবং তারা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে স্থান পেত না। তত্কালীন আরব সমাজে এ শ্রেণীর লোকদের মাওলা, বহুবচনে মাওয়ালি বলা হতো। উমাইয়া শাসনামলে সংগীতের চর্চা ও বিকাশ সাধনে এ মাওলারাই মূল ভূমিকা পালন করে। মাওলাদের মধ্যে একশ্রেণীর নারীদের শিল্প, সাহিত্য ও সংগীতের নানা কলায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ বিনোদনকর্মী হিসেবে প্রস্তুত করা হতো। আরবীয় পরিভাষায় তাদের বলা হতো ‘ক্বায়েনা’।
এ ক্বায়েনাদেরই অনুসরণে, খুব সম্ভবত, ভারতীয় উপমহাদেশে বাঈজিদের আবির্ভাব ঘটে। এসব অনারব মাওলা ও ক্বায়েনার অবদানে ইসলামী সংগীতে ব্যাপক অনারবীয়, বিশেষত পারস্য সংস্কৃতির সংযোগ ঘটে। উমাইয়া যুগের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ছিলেন আবু উসমান সাঈদ, যিনি ‘ইবনে মিসজা’ উপনামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মক্কার ‘বনু মখযুম’ গোত্রের অধীন মাওলা। তাকে ইসলামী সংগীতের জনক বলা হয়। মক্কার এক পারসি পরিবারে জন্ম নেয়া এ কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি ছিলেন একজন সংগীতবিশারদ, দক্ষ গায়ক ও বীণাবাদক। ইবনে মিসজা সিরিয়া ও পারস্য ভ্রমণ করে বাইজেন্টানীয় ও পারস্য সংগীতের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং আরবীয় গানে তার এ অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটান। উমাইয়া যুগের আরেক উল্লেখযোগ্য সংগীতজ্ঞ হলেন আবুল খাত্তাব মুসলিম (মৃত্যু ৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ)। ‘ইবনে মুহরিয’ তার উপনাম। তার শিক্ষক ইবনে মিসজার মতো তিনিও মক্কার এক পারসি পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং ‘বনু আবদ যর’, মতান্তরে ‘বনু মখযুম’ গোত্রের অধীন মাওলা ছিলেন। তার পিতা পবিত্র কা’বা ঘরের দ্বাররক্ষী ছিলেন। আজজা আল মায়েলা নামক মদিনার এক ক্বায়েনার কাছেও তিনি সংগীতের শিক্ষা গ্রহণ করেন। উমাইয়া রাজদরবারের জনপ্রিয় সংগীতজ্ঞ উবাইদ ইবনে সুরাইজি ‘খোলাফায়ে রাশেদিন’-এর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনে আল খাত্তাবের (রা.) খেলাফতকালে মক্কার এক তুর্কি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং দশম উমাইয়া খলিফা হিশাম ইবনে আবদুল মালিকের খেলাফত কালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন মক্কার ‘বনু নওফেল’, মতান্তরে ‘বনু হারিস’ গোত্রের অধীন মাওলা। তিনি শোকগাথা রচনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। এই সময়ে মা’বাদ নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ সংগীতবিশারদের পরিচয় পাওয়া যায়, যিনি সপ্তম শতাব্দীর মদিনার এক বিখ্যাত ক্বায়েনা জামিলার শিষ্য ছিলেন।
এক আফ্রিকান ক্রীতদাসের সন্তান এই মা’বাদ ইসলামী সংগীতে এক স্বতন্ত্র ধারার উদ্ভব ঘটান, যা পরবর্তী সময়ে বহু বছর সংগীতের এক শক্তিশালী ঘরানা হিসেবে টিকে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই সংগীতবিদ্যার পাশাপাশি অন্যান্য জ্ঞান, যেমন ইলমে কোরআন, ইলমে হাদিস, ইলমে ফিক্বহ ইত্যাদিতেও পারদর্শী ছিলেন। তাদের ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানের এসব শাখায় খ্যাতি অর্জন করেন। উমাইয়া শাসনামলে ক্বায়েনারা নিয়মিত সংগীতের আসর বসাতেন। এসব আসরে নারী-পুরুষ সবাই সমবেত হতেন। নিছক বিনোদনের ঊর্ধ্বে উঠে তত্কালীন সামাজিক যোগাযোগের এক অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল এসব সংগীত আসর। ক্বায়েনাদের অর্থনৈতিক স্বার্থও এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এ আসরগুলো থেকে ক্বায়েনারা তাদের সম্ভাব্য পৃষ্ঠপোষক এবং একই সঙ্গে তাদের শিষ্যদের খুঁজে নিতেন। উমাইয়াদের রাজত্বকালে মদিনা শহরে নিয়মিত সংগীতের মজলিস করতেন, এমন দুজন বিখ্যাত ক্বায়েনার নাম পাওয়া যায়। তারা হলেন জামিলা এবং আজজা আল মায়েলা। সপ্তম শতাব্দীতে এ দুজনের নিয়মিত সংগীত পরিবেশনায় মদিনার পরিবেশ থাকত সতত প্রাণবন্ত। জামিলা (মৃত্যু ৭২০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন মদিনার বনু সুলাইম গোত্রের অধীন একজন মাওলা। তিনি অনেক বিখ্যাত সংগীতজ্ঞের শিক্ষক ছিলেন। তার এক শিষ্য সংগীতবিশারদ মা’বাদ (মৃত্যু ৭৪৩ খ্রিস্টাব্দ) তার সম্পর্কে বলেন, ‘সংগীত কলায় জামিলা হলেন মহীরুহ, আর আমরা হলাম তার শাখা।’
জামিলা যখন মদিনা থেকে মক্কায় তীর্থযাত্রা করেন, তখন তার কাফেলায় পঞ্চাশ জন গায়িকাসহ সেই কালের মুখ্য সংগীতজ্ঞরা ছিলেন। এ তীর্থযাত্রা করার সময় বিভিন্ন স্থানে তিনি সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন করেন, যা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। পবিত্র মক্কায় হজব্রত পালন করে মদিনায় ফিরে এসে তিনি তিনদিনব্যাপী এক সংগীত মেলার আসর করেন। আজজা আল মায়েলা (মৃত্যু ৭০৫ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন মদিনার আনসারদের অধীন একজন মাওলা।
৭৫০ খ্রিস্টাব্দে আব্বাসীয় খেলাফতের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাগদাদ সংগীতচর্চার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইসলামী সংগীতের স্বর্ণযুগ হলো আব্বাসীয় খেলাফত। নীতিশাস্ত্র, অধ্যাত্মবাদ, গণিত শাস্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে এ সময়ে সংগীত শিক্ষার ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়। তখন একজন শিল্পীর একই সঙ্গে কারিগরি দক্ষতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকতে হতো। অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সংগীত তত্ত্ববিষয়ক ইসলামী সাহিত্যের উত্কর্ষ সাধন শুরু হয়। এই সময় গ্রিক গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু হয়। গ্রিক লেখনীর সঙ্গে পরিচিত পণ্ডিতরা সংগীত শাস্ত্রে অবদান রাখতে শুরু করেন। তাদের রচনায় তারা গ্রিক সংগীত শাস্ত্রের নানাবিধ পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন সাধন করেন। সংগীতের ধারায় তারা নব নব দিক উন্মোচন করেন। বিখ্যাত আরব মুসলিম দার্শনিক আবু ইউসুফ ইয়া’কুব আল কিন্দী (৮০১-৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ), যাকে আরবীয় দর্শনের জনক বলা হয়, যিনি কুফায় জন্মগ্রহণ করেন এবং বাগদাদে শিক্ষা লাভ করেন, তিনি সংগীতের ওপর তেরোটিরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। আরবীয় সংগীত তত্ত্বের ওপর এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রথম গ্রন্থটি তার লেখা। দার্শনিক আবু নসর আল ফারাবি (৮৭০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) সংগীতশাস্ত্রের বিশালাকার কিতাব ‘কিতাব আল মুসিক্বী আল কবির’ রচনা করেন। এছাড়া আবু আলী ইবনে সিনা, আল সারাখসী, সাবিত ইবনে কুররাহ, ইবনে জায়লা প্রমুখ দার্শনিক সুর, তাল, লয়, শব্দ, বিরাম, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে এ সময়ে ব্যাপক গবেষণা করেন।
মনসুর জালজাল আল দারিব (মৃত্যু ৮৪২ খ্রিস্টাব্দ) নামে আব্বাসীয় আমলে একজন বিখ্যাত বীণাবাদক ছিলেন। তার ভাতিজা এবং শিষ্য ইসহাক আল মাওসিলি তাকে সর্বোত্তম বীণাবাদক হিসেবে অভিহিত করেন। এছাড়া হুনাইন ইবনে ইসহাক (মৃত্যু ৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ), বনু মুসা ভাইয়েরা (৮০০-৮৬০ খ্রিস্টাব্দ), আবু আল হাসান আলী বিন নাফি ওরফে জিরিয়াব (৭৮৯-৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ) আব্বাসীয় আমলে সংগীতজ্ঞ হিসেবে গুরুত্ব অর্জন করেন। এদের মধ্যে শেষোক্তজন তথা জিরিয়াব ছিলেন আন্দালুসিয়ার অধিবাসী। সেখান থেকে বাগদাদে এসে তিনি ইসহাক আল মাওসিলির কাছে সংগীতের তালিম নেন এবং কালক্রমে বাগদাদের রাজদরবারে সংগীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
খলিফা হারুন আল রশিদের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতে খলিফা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, বিশেষ করে বীণা এবং বাঁশি বাজানোতে তার ওস্তাদি দেখে অভিভূত হন। তবে তিনি বাগদাদে টিকে থাকতে পারেননি। এর কারণ হিসেবে তার প্রতি তার গুরু ইসহাক আল মাওসিলির ঈর্ষা কিংবা বিরাগকে দায়ী করা হয়। যিরাবের কণ্ঠ তার গুরুর চেয়ে বহু গুণে আকর্ষণীয় ছিল। শিষ্যের কাছে নিজের জনপ্রিয়তা হারানোর আশঙ্কা থেকে একপর্যায়ে ইসহাক আল মাওসিলি তাকে বাগদাদ থেকে হাওয়া করে দেয়ার হুমকি দেন। জিরিয়াব তখন তিউনিসিয়ায় চলে যান। সেখান থেকে তিনি তত্কালীন স্পেনের মুসলিম নগর কর্ডোভার আমির দ্বিতীয় আবদুর রহমানের (৭৯২-৮৫২) আমন্ত্রণে কর্ডোভায় গিয়ে সেখানকার রাজসভা অলংকৃত করেন। অতঃপর যিরাবের তত্ত্বাবধানে সমগ্র আন্দালুসিয়া অঞ্চলে ইসলামী সংগীত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আব্বাসীয় খলিফারা এতটাই সংগীতপ্রেমী ছিলেন যে তারা তাদের দরবারসংলগ্ন একটি কক্ষকেই জলসা ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন, যা কেবল একটি পর্দা দ্বারা আলাদা করা থাকত। এই জলসা ঘরের তত্ত্বাবধানে থাকত রাজকীয় সংগীতজ্ঞদের একটি দল, যাদের ‘সিতারা’ বলা হতো।
সংগীতের এ জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় একসময় এটি আর নিছক বিনোদনের মাধ্যম থাকে না, বরং ধর্মীয় বাহন হিসেবেও এটি মুসলিমদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। নবীজি মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসাকীর্তনের সঙ্গে সংগীত যোজনার চল শুরু হয়। এছাড়া শিশু জন্মগ্রহণের সময়, গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে, যুদ্ধযাত্রায় সৈনিকদের ক্লান্তি দূর করতে সংগীতায়োজন করা হতো। মানসিক অবস্থার উন্নতি সাধনে মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা হিসেবেও সংগীতের ব্যবহার ছিল। এই সময়ে বিখ্যাত দার্শনিক এবং সুফি হযরত আবু হামিদ আল গাজালি (১০৫৮-১১১১) আধ্যাত্মিকতা ও সংগীতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক দেখিয়ে সংগীতের নতুন তত্ত্ব দেন। তার মতে, স্রষ্টার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো সংগীত। তবে তিনি স্রেফ ইন্দ্রিয়সর্বস্ব সংগীত এবং আধ্যাত্মিক সংগীতের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি করেন এবং এই মত প্রদান করেন যে মানুষের আত্মার ওপর গান, সুর, ছন্দ—এসবের উপকারী একটা প্রভাব রয়েছে। তার বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ ‘ইহইয়া উলুম আল দীন’ এবং ‘কিতাব আদাব আল সামা ওয়া আল ওয়ায়েয’-এ তিনি সংগীতের আধ্যাত্মিক ধারণা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। নবম-দশম শতকে ‘ইখওয়ান আল সাফা’ নামক বসরার একটি মরমি গোষ্ঠীও ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ সাধনের একটি মাধ্যম হিসেবে সংগীতকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করে।
আব্বাসীয় আমলেই রচিত হয় সংগীতের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাব আল আগানি’ (গানের বই)। ইমাম আবুল ফারায আল ইসফাহানি রচিত ও সংকলিত ২৪ খণ্ডে এই কিতাব ইসলামী সংগীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অমূল্য খনি হিসেবে স্বীকৃত। দশম শতকে রচিত এ মহাকাব্যিক প্রয়াস এর রচনাকাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সমানভাবে জনপ্রিয় এবং গবেষকদের প্রধান তথ্যসূত্র হিসেবে বিবেচিত। আল ইসফাহানি ৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদের বংশধর ছিলেন। উমাইয়া খেলাফতের পতনের পর মারওয়ানের কয়েকজন উত্তরসূরি পালিয়ে ইসফাহান চলে যান। সেখান থেকে আল ইসফাহানির পরিবার ইরাকে গিয়ে সেখানকার প্রশাসনে জায়গা করে নেয়। তার বাবার চাচা আবদুল আজিজ ইবনে আহমদ সামারা নগরে খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের অধীনে একজন নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তা ছিলেন। তার চাচা আল হাসান ইবনে মুহাম্মদও সামারায় একজন ‘কাতিব’ তথা লেখক হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন। তিনিও খলিফা আল মুতাওয়াক্কিলের সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। কিতাব আল আগানির অন্যতম উৎস ছিলেন এই আল হাসান ইবনে মুহাম্মদ। এছাড়া আল ইসফাহানি তার পরিবারের অন্যান্য সদস্য, যেমন তার বাবা আল হোসাইন ইবনে মুহাম্মদ, বাবার চাচা আবদুল আজিজ, দাদা মুহাম্মদ ইবনে আহমদ এবং চাচাতো ভাই আবু আবদুল্লাহ আহমদ ইবনে আল হোসাইন থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। তার নানা আবু আলী ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তাওয়াবা তার জন্য একটি দিনলিপি রেখে যান, যেখান থেকে তিনি উমাইয়া এবং আব্বাসীয় কবিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন।
আল ইসফাহানি তত্কালীন জ্ঞানচর্চার দুই প্রধান কেন্দ্র কুফা এবং বাগদাদে অধ্যয়ন করেন। এই সময়ে যেসব মানুষের সংস্পর্শে তিনি আসেন, তাদের থেকেও তিনি ‘কিতাব আল আগানি’ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। কুফায় অধ্যয়নকালে তিনি সেখানকার স্থানীয় গায়কদের সম্পর্কে অবগত হন, যাদের খ্যাতি তখনো নিজ শহরকে অতিক্রম করেনি। ‘কিতাব আল আগানি’ তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে (প্রথম-নবম খণ্ড) তিনি একশটি গান অন্তর্ভুক্ত করে সেগুলোর ওপর আলোচনা করেন, যেই গানগুলো বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ইসহাক আল মাওসিলি খলিফা আল ওয়াসিকের জন্য সেরা একশ গান হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। পাশাপাশি এই অংশে তিনি মা’বাদ এবং ইবনে সুরাইজির গানও অন্তর্ভুক্ত করেন। দ্বিতীয় অংশে (নবম-দশম খণ্ড) তিনি খলিফা এবং তাদের পরিবারের মধ্যে যারা গান রচনা করেছেন, তাদের নিয়ে আলোচনা করেন। এই অংশে তিনি উমাইয়া খেলাফতের অষ্টম খলিফা উমর ইবনে আবদুল আযীয (৬৮০-৭২০ খ্রিস্টাব্দ), যিনি দ্বিতীয় উমর নামে পরিচিত ছিলেন, থেকে শুরু করে আব্বাসীয় খলিফা আল মু’তাদিদ বিল্লাহ (৮৫৭-৯০২ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত খলিফাদের পর্যায়ক্রমিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করেন। তৃতীয় অংশে (দশম-২৪তম খণ্ড) তিনি নিজের বাছাই করা গান এবং সংগীতজ্ঞদের নিয়ে আলোচনা করেন। মোট কথা, প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে শুরু করে নবম শতক পর্যন্ত সংগীতের সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য এখনো পর্যন্ত টিকে থাকা মূল আকর মহাত্মা আল ইসফাহানি রচিত এই ‘কিতাব আল আগানি’ আব্বাসীয় খেলাফতকালের এক অনন্য কীর্তি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন