*বেথলেহেম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া: ঈসার দ্বিতীয় মৃত্যু*
✝️
যীশু/ক্রাইস্ট/ঈসা এবং হোলি গ্রেইল নিয়ে থ্রিলার লিখেছেন ড্যান ব্রাউন। তার সেই বেস্টসেলার উপন্যাস (যেটা পরে ব্লকবাস্টার ফিল্মও হয়েছে) দ্য ভিঞ্চি কোডের পটভূমি ইউরোপে: ফ্রান্স, ভ্যাটিকান, ইউকে। ড্যান ব্রাউনের গল্পের মতোই আরেকটা জো-ড্রপিং গল্পের প্লট লুকিয়ে আছে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই। অবশ্য এই গল্পটার প্লট, সাবপ্লট এতো বেশি যে উপন্যাসটা ট্রিলোজি আকারেই লিখতে হবে।
এই গল্পটারও মূল চরিত্র ঈসা।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে যারা কিছুটা হলেও পড়াশোনা করেছেন তারাই জানেন যে এই ঈসা হলেন একজন ফ্যাসিনেটিং ক্যারেক্টার। বিভিন্ন ধর্মের শাখা-প্রশাখায় ঈসা এবং মসীহ হিসাবে তার দ্বিতীয় আগমন নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নাই।
ঈসা কি হিন্দুধর্মের বিভিন্ন প্রফেসিতে বর্ণিত কৃষ্ণের অবতার নাকি বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন প্রফেসিতে বর্ণিত মৈত্রেয় বুদ্ধ? এই নিয়ে আলাপ অনেক বছর ধরেই চলছে।
আবার, ঈসা আসলে বুদ্ধিস্ট ছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিতে ভারতবর্ষেও এসেছিলেন, এমন থিওরিও অনেক স্কলার দিয়েছেন। এইরকম একটা দাবী জওহরলাল নেহেরুর গ্লিম্পসেস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি বইতেও আছে।
মথি লিখিত সুসমাচারে যে তিন জ্ঞানী ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, পূর্বদেশ থেকে নতুন একটি স্টার ফলো করে করে যারা নবজাতক ঈসার জন্য উপহার নিয়ে বেথলেহেমে উপস্থিত হয়েছিলেন, তারা আসলে কারা ছিলেন?
একটা থিওরি বলছে, এরা আসলে ছিলেন বুদ্ধিস্ট মঙ্ক, যারা ভারত থেকে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে হেরদের রাজসভা হয়ে বেথলেহেমের আস্তাবল পর্যন্ত গিয়েছিলেন ঈসার খোঁজে। ঈসা যখন কিশোর তখন এই মঙ্কের দলই আবার ঈসাকে ভারতে নিয়ে আসেন এবং তাকে বৌদ্ধধর্মের দীক্ষা দেন।
এইটা একটা মজার থিওরি, কারণ ১২ বছর থেকে ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত ঈসা কই ছিলেন এবং কী করেছেন, এইটার কোনও বিবরণ বাইবেল বা অন্যান্য মেইনস্ট্রিম খ্রিস্টান লিটারেচারে পাওয়া যায়না। এই বছরগুলো লস্ট ইয়ারস অফ জেসাস বলেই পরিচিত।
কিশোর ঈসার এই ভারত গমনের গল্প বিবিসি ফোরে প্রচারিত একটি ডকুমেন্টারিতেও স্থান পেয়েছিলো। ডকুমেন্টারিটির নাম: ডিড জেসাস ডাই (ঈসা কি মারা গিয়েছিলেন)?
থিওলোজিক্যাল ক্যাচাল নিয়ে যে কী সাংঘাতিক, ফ্যাসিনেটিং সাংবাদিক অনুসন্ধান হতে পারে তার একটা নমুনা এই ডকুমেন্টারি।
এখানে মূলত বলা হয়েছে, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে সম্ভবত ঈসা মারা যাননি, বরং তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন অথবা কোমায় চলে গিয়েছিলেন। এই থিওরিটা সুওন হাইপোথিসিস (swoon hypothesis) নামে পরিচিত।
বাইবেলের বিবরণেই আমরা দেখি যে ঈসাকে অনেক কম সময়ের জন্য (তুলনামূলকভাবে) ক্রুশে রাখা হয়েছিলো, ছয় ঘন্টার মতো। এতো কম সময়ে আসলে কোনও ক্রুশবিদ্ধ ব্যক্তির মারা যাওয়ার কথা না। এভাবে একজন মানুষের মৃত্যু হতে সাধারণত দুই থেকে চারদিন সময় লাগতো।
মার্ক লিখিত সুসমাচারে (১৫:৪৪) যেমন খোদ পীলাতের (ঈসাকে মৃত্যুদণ্ড দানকারী রোমান গভর্নর) কথা বলা হয়েছে: "পীলাত আশ্চর্য হলেন যে, ঈসা এত তাড়াতাড়ি মারা গেছেন। সত্যি সত্যি ঈসার মৃত্যু হয়েছে কি না, তা সেনাপতিকে ডেকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।"
সুওন হাইপোথিসিস বলছে, ক্রুশ থেকে নামানোর পরে আপাত মৃত ঈসাকে বিভিন্ন হার্ব দিয়ে সেবা-শুশ্রুষা করে জাগিয়ে তোলেন তার কয়েকজন অনুসারী। এরপর ঈসার অন্য অনুসারীদের সাথে তার দেখাও হয় এবং তিনি তাদের সাথে খাদ্য গ্রহণও করেন। এরপরে ঈসা নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং অনুসারীদের বলে যান যে তিনি আবার আসবেন। এইটাই সেকেন্ড কামিং-সংক্রান্ত প্রফেসির মূল উৎস।
এখন তাইলে প্রশ্ন উঠবে, ঈসা গেলেন কই?
ঈসা গেলেন ইন্ডিয়া, আর কই!
ইন্ডিয়াতে যাওয়ার আগে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ একটা পয়েন্ট বলে নেই। সুওন হাইপোথিসিস যদি ঠিক হয়, তাহলে খ্রিস্টধর্মের একেবারে বেসিকটাই ভেঙ্গে পড়ে। ঈসার তাহলে ক্রুশে মৃত্যু হয়নি; ঈসার তাহলে রিজারেকশন হয়নি; ঈশ্বর তাহলে ঈসাকে স্বশরীরে তুলেও নেননি। এইটা একটা ক্যান অফ ওয়র্ম, যেটা আমি এখানে খুলতে চাইনা।
✡️
ঈসা ছিলেন ইহুদি বা বনি ঈসরাইলের জন্য প্রেরিত নবী। নবী মুসার উত্তরসূরী হিসেবেই তিনি এসেছিলেন এবং নবুয়ত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঈসরাইলের বারোটি গোত্রের মধ্যে মাত্র দুইটি গোত্রের লোকজনকে ধর্মের বাণী শোনাতে পেরেছিলেন।
বাকি যে দশটি গোত্র, এইগুলাকে আমরা বলি লস্ট ট্রাইবস অফ ঈসরাইল। এরা ইহুদিদের আদি ভূমি থেকে নির্বাসিত হয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। এখন কথা হলো, ঈসাতো বারোটা গোত্রের উদ্দেশ্যে প্রেরিত নবী, মাত্র দুইটা গোত্রের মাঝে ধর্ম প্রচার সীমাবদ্ধ রাখলে তার প্রফেটিক মিশন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ক্রুশ থেকে সার্ভাইভ করে ঈসা যদি জীবিত অবস্থায় জেরুজালেম থেকে যাত্রা করে থাকেন, তাহলে এটাই স্বাভাবিক যে তিনি ওই হারানো গোত্রগুলোকেই খুঁজতে বের হবেন।
একটা থিওরি বলছে, বনি ঈসরাইলের ওই হারানো দশ গোত্রের খোঁজেই ঈসা (দ্বিতীয়বারের মতো) ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
ভারতীয় উপমহাদেশের অনেকগুলো গ্রুপই কিন্তু নিজেদেরকে বনি ঈসরাইলের হারানো গোত্রগুলোর অংশ দাবী করে।
এদের অনেকের চেহারা-সুরৎ, শারীরিক গঠনও সেমিটিকদের মতো। যেমন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পশতুনরা বলে যে তারা ওই লস্ট ট্রাইবগুলোর অংশ। নোবেল-বিজয়ী যে মালালা ইউসুফজাই (ইউসুফ + জাই), তার লাস্টনেমের মানে হলো ইউসুফের পুত্র বা জাত। আর এই ইউসুফ হলেন ট্রাইব অফ জোসেফের (ইউসুফ) আদি পিতা।
মহারাষ্ট্র, মিজোরাম, মনিপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা এবং কাশ্মীরেও বনি ঈসরাইলের হারিয়ে যাওয়া গোত্রগুলোর উত্তরাধিকারের দাবীদাররা এখনও আছেন।
ঈসা কি তাহলে এদের কাছে এসেছিলেন?
ডিড জেসাস ডাই ডকুমেন্টারির প্রডিউসাররা বলছেন এসেছিলেন। ঈসার ভারতে আসার সম্ভাব্য দুইটি রুট তারা দেখিয়েছেন এবং সেই রুট ধরে তারা কাশ্মীরে এমন এক ঐতিহাসিক চরিত্রের সন্ধান পেয়েছেন যিনি ছিলেন একজন ইহুদি নবী। এই নবীর নাম ছিলো ইউজাসাফ।
এখানে বলে নেই, ইহুদিদের নবী ঈসা ক্রুশ থেকে সার্ভাইভ করার পর কাশ্মীরে পালিয়ে এসে ধর্মপ্রচার করেছেন এই দাবীটা হিন্দুদের ভবিষ্য মহাপুরাণেও আছে। লেখা সংক্ষিপ্ত রাখার জন্য আমি ওই আলাপে যাচ্ছিনা।
কাশ্মীরি এক স্কলারের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ডিড জেসাস ডাই ডকুমেন্টারিতে বলার চেষ্টা করা করেছে যে ওই ইউজাসাফ আর ঈসা একই ব্যক্তি। তিনি অনেক বছর ধরে কাশ্মীরে ধর্মপ্রচার করেছেন এবং বৃদ্ধ বয়সে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এবং এই কাশ্মীরেই তার কবর হয়েছে।
সেই কবরটাই এখন রোজা (রওজা) বাল নামে পরিচিত, যার অবস্থান শ্রীনগরে। এইটা এখন একটা মাজার যেখানে ইউজাসাফের সাথে মীর নাসিরউদ্দিন নামক এক শিয়া আউলিয়ারও কবর আছে: নাসিরউদ্দিনের কবর মুসলিম রীতি অনুযায়ী উত্তর-দক্ষিণ অরিয়েন্টেশনে এবং ইউজাসাফের কবর ইহুদি রীতি অনুযায়ী পূর্ব-পশ্চিম অরিয়েন্টেশনে।
এই মাজারেই ইউজাসাফের দুই পায়ের ছাপ মেটালের মধ্যে সংরক্ষিত আছে, যেখানে দুইটা ক্ষতের উপস্থিতি দেখা যায়। ডকুমেন্টারির প্রডিউসাররা এনিমেশন করে এটাও দেখিয়েছেন কীভাবে এই ক্ষতচিহ্নগুলো ক্রুশবিদ্ধ দুটি পায়ের (একটা পায়ের উপর আরেকটা পা রেখে পেরেক মারলে যেমন হবে) সাথে মিলে যায়।
☪️
ঈসা বেঁচে ছিলেন এবং বৃদ্ধ বয়সে কাশ্মীরে মৃত্যুবরণ করেছেন, এই দাবীটা মেইনস্ট্রিম খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের জন্য খুবই সমস্যাজনক। কারণ, খ্রিস্টানদের মতো মুসলমানরাও মনে করেন যে আল্লাহ শরীরসমেত ঈসাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং শেষ জমানায় তিনি আবার দুনিয়ায় ফেরত আসবেন।
কোরআনে অবশ্য এই কথাটা ডাইরেক্ট নাই, তবে কিছু হাদিসে এটার সমর্থন পাওয়া যায়। আবার অন্য কিছু হাদিসে এর বিপরীত দাবীও আছে: যেমন ঈসা ১২০ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, এমন হাদিসও আছে। সহি হাদিস, দূর্বল হাদিস, জাল হাদিসের র্যাবিট হোলে আমি এখন ঢুকছিনা।
ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টধর্মের প্রচারকালে পশ্চিমা মিশনারিরা এই পয়েন্টটাই সরলমতি মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করতে ব্যবহার করতো এবং এখনও করে।
: ঈসা নবী জীবিত আছেন, এটাতো মানেন?
: হ্যা, মানি!
: আল্লাহ তাকে শরীরসমেত তুলে নিয়েছেন এবং শেষ জমানায় তিনি ফেরত আসবেন, এটাতো মানেন?
: হ্যা, মানি!
: ঈসা ফেরত এসে মুসলমানদের ত্রাতা হবেন এবং মুসলমানরা তার অনুগত হবেন, এটাতো মানেন?
: হ্যা, মানি!
: আমরাওতো এটাই বলছি। ঈসা জীবিত অবস্থায় আল্লাহর কাছে আছেন; তিনি ত্রাতারুপে (মসিহ, সেইভর) দুনিয়ায় ফিরে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করবেন। এই বিশ্বাস আপনারও, আমারও। তাহলে সেই ত্রাতার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আমাদের সাথে যোগ দিবেন না কেন?
: 😵💫
এই চ্যালেঞ্জটা — জেসাস দ্য লিভিং প্রফেট চ্যালেঞ্জ — ডাইরেক্টলি ডিল করা একজন সাধারণ মুসলমানের পক্ষে খুবই দূরহ। এমনকি অভিজ্ঞ আলেমদেরও এটা ডিল করতে হলে ডাইনে-বায়ে ইনডাইরেক্ট ডিফেন্সে যেতে হবে। ত্রিত্ববাদ, ঈসার অভিশপ্ত মৃত্যুর দাবী ইত্যাদি পয়েন্ট ধরে কাউন্টার-আর্গুমেন্ট দিতে হবে। ইসলামী আকিদার ডিপে গিয়ে তারা যে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে, সেটার কাউন্টারে তাদের আকিদার ডিপে গিয়ে উত্তর দিতে হবে। এই জ্ঞান কয়জন আলেমের আছে?
ঈসা যদি জীবিত থাকেন তাইলে কি তার নবুয়তও বহাল আছে? যদি সেটাই হয় তাহলে নবী মুহাম্মদকে কি শেষ নবী বলা যাবে? আবার একজন নবী কি দুনিয়ায় ফিরে আরেকজন নবীর উম্মত হবেন? এই ট্রানজিশন কি আসমানে হবে নাকি জমিনে? এইখানে শ্রেষ্ঠ/শেষ নবী তাইলে কে?
খ্রিস্টান মিশনারি আর মুসলমান আলেমদের এই ক্যাচাল থেকেই মূলত আহমদিয়া নামক মুসলিম সেক্টের প্রতিষ্ঠাতা পাঞ্জাবের কাদিয়ান-নিবাসী মির্জা গোলাম আহমদের উত্থান।
মির্জা এই থিওলোজিক্যাল আলাপটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রাস্তায় নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন ঈসার অনেক আগেই মৃত্যু হয়েছে এবং তিনি নশ্বর শরীর নিয়ে আসমানে অবস্থান করছেন না, বরং তার কবর আছে কাশ্মীরের রোজা বালে। অরিজিন্যাল ঈসা নবী আর দুনিয়ায় ফিরবেন না, বরং মুসার মৃত্যুর ১৩০০ বছর পরে যেমন ঈসা এসেছিলেন, সেই ঈসার অনুরূপ, নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর ১৩০০ বছর পরে একজন *উম্মতি নবী* (রেগুলার নবী বা রসূল না কিন্তু) আসবেন। ঈসা আসার বিষয়টা এলিগোরিক্যাল, লিটারাল না।
কে সেই নয়া/শেষ জমানার ঈসা?
মির্জা বললেন তিনি নিজেই সেই উম্মতি নবী বা প্রতিশ্রুত ঈসা। তিনি আরও বললেন যে হাদিসের প্রফেসিতে যে মাহদির কথা বলা হয়েছিলো, সেই মাহদি আর ঈসা একই ব্যক্তি (তিনি নিজে)। অন্য কথায়, মুসার যেমন ঈসা, মুহাম্মদের তেমনই আহমদ। মাহদি হলেন শেষ জমানার সেই মাসিহ, যার মধ্যে ঈসার সকল গুণ বিদ্যমান।
আমার মুসলমান পাঠকরা এখন প্রশ্ন তুলবেন, মাহদি আর ঈসাতো আসবেন দাজ্জালের আবির্ভাবের পরে! তাইলে দাজ্জাল কই?
মির্জার থিওরি অনুযায়ী, ওই খ্রিস্টান মিশনারিরাই হলো দাজ্জাল। এটাও এলিগোরিক্যাল। দাজ্জাল লিটারালি কোনও রাক্ষস টাইপ কিছু না।
আমার মতে ইসলামী এসক্যাটোলজিতে এইটা একটা স্ট্রং আর্গুমেন্ট। নবী মুহাম্মদ যেমন বলে গিয়েছিলেন যে দাজ্জালের আবির্ভাব হলে মুসলমানরা যেন সূরা কাহাফের প্রথম ও শেষ দশটা আয়াত পাঠ করেন। খ্রিস্টান মিশনারিদের সাথে দাজ্জালের তুলনা বুঝতে এই বিশটা আয়াত আপনারাও পড়ে দেখতে পারেন।
এই তথাকথিত দাজ্জাল বা মিশনারিদের সাথে বাহাস করতে করতেই মির্জার জীবনের বাকিটা সময়ের বেশিরভাগটা পার হয়ে যায়। কোরআন, হাদিস, হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি ইত্যাদি ঘেঁটে তিনি অসংখ্য বই লিখেন তার থিওরি বা দাবীর পক্ষে। এবং ভারতীয় উপমহাদেশে খ্রিস্টান মিশনারিদের রিলিজিয়াস কনভার্শন ক্যাম্পেইনটাও তার ও তার অনুসারীদের কারণে অনেকটাই ধাক্কা খায়।
বিপরীতে মির্জার প্রতিষ্ঠিত আহমদিয়া মুসলিম জামাতই একটা ইসলামিক মিশনারি মুভমেন্টে পরিণত হয়, যার বিস্তার এখন পুরো পৃথিবী জুড়েই।
মির্জা বনাম মিশনারিদের এই গ্যাঞ্জামে মেইনস্ট্রিম মুসলমান আলেমরা আরেক সমস্যায় পড়লেন। তারা কি মির্জার দাবী সত্য মেনে নিয়ে তার হাতে বায়াত নিবেন? নাকি মির্জাকে ভুয়া নবী/মাহদি ধরে নিয়ে তাকফির (কাফের ঘোষণা, এক্সকম্যুনিকেট) করে দিবেন? মেইনস্ট্রিম সুন্নি মুসলমানদের সাথে আহমদিয়া মুসলমানদের দ্বন্দ্বটার এখানেই শুরু।
এই যে আমরা শুনি যে অমুক কাফের, তমুক কাফের, এইটা যে মানবেনা সে এবং তার দুলাভাইও কাফের — এই টাইপের চেইন তাকফিরের উৎসও ওইটা।
মেইনস্ট্রিম মুসলমান বনাম আহমদিয়া মুসলমানদের দ্বন্দ্বটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ব্রিটিশ শাসনের অবসানের অনেক পরে, খ্রিস্টান মিশনারিদের থ্রেট তখন আর নাই। লাহোরে আহমদিয়া-বিরোধী রায়ট হয় ১৯৫৩ সালে এবং পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয় ১৯৭৪ সালে। পাকিস্তানের সেই আহমদিয়া-বিরোধী আন্দোলনটাই গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে ছড়িয়েছে।
🚼
বিবিসি ফোরে প্রচারিত বেথলেহেমের এক শিশুর গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, এখন বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক শিশুর গল্প দিয়ে শেষ করি।
২০২০ সালের জুলাই মাসের এক প্রতিবেদনে বিবিসি বাংলা জানাচ্ছে:
*আহমদিয়া শিশুর লাশ কবর থেকে তুলে ফেলে দেবার ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চাঞ্চল্য*
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক নবজাতকের লাশ কবর থেকে তুলে রাস্তায় ফেলে রাখার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
[...]
আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম আখ্যা দিয়ে এই লাশ তুলে ফেলার ঘটনাকে বিধিসম্মত বলে দাবি করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইসলামি ঐক্যজোটের সেক্রেটারি মোহাম্মদ এনামুল হক।
"আহমদিয়া শিশুর পরিবার অনেক অন্যায় করেছে। তারা জানতো এখানে কবর দিলে দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে। অবশ্যই তাদের ভেতরগত ষড়যন্ত্র ছিল। মুসলমানদের কবরে অমুসলিমদের দাফন হলে সেটা তুলে ফেলার বিধিবিধান আছে। যেহেতু তারা অমুসলিম, এজন্য স্থানীয়রা ওই বাচ্চার লাশ কবর থেকে তুলেছে।"
👣
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন