রাসূলুল্লাহ (সা) আমাদের মাঝে কুরআন হিসাবে, আল্লাহর বাণী বলে যা কিছু পেশ করেছেন সবগুলো ওহী এবং হাদীসও সাধারণত ওহী ভিত্তিক, ওহীয়ে গাইরে মাতলূ। কিন্তু 'তিনি যত কথা বলেছেন বা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার সবগুলো ওহী, ওহী ব্যতীত তিনি নিজে থেকে কোন একটি কথা বা কোন একটি সিদ্ধান্তও নেন নি, তিনি সাহাবাগণ ও কাফের মুনাফিকদের সাথে যত কথা বলেছেন তা সবই ওহী ভিত্তিক, ওহী ছাড়া কোন কথা বলেনি'- এমন দাবি করা ভুল ছাড়া কিছুই নয়! দেখুনঃ
.
হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন যায়নব রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে একটু বেশি সময় অতিবাহিত করলেন এবং মধু পান করলেন। এতে আমার মনে ঈর্ষা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এবং আমি হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার সাথে পরামর্শ করে স্থির করলাম যে, তিনি আমাদের মধ্যে যার কাছে আসবেন, সেই বলবেঃ আপনি "মাগাফার” পান করেছেন। (মাগাফীর এক প্রকার বিশেষ দুৰ্গন্ধযুক্ত আঠাকে বলা হয়।) সেমতে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ না, আমি তার মধু-পান করেছি। সেই বিবি বললেনঃ সম্ভবত কোন মৌমাছি মাগাক্ষীর বৃক্ষে বসে তার রস চুষেছিল। এ কারণেই মধু দুৰ্গন্ধযুক্ত হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুৰ্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে সযত্নে বেঁচে থাকতেন। তাই অতঃপর মধু খাবেন না বলে কসম খেলেন। তখন আল্লাহ আয়াত নাজিল করে বলেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ ۚ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্য যা হালাল করেছেন তোমার স্ত্রীদের সন্তুষ্টি কামনায় তুমি কেন তা হারাম করছ? আর আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা তাহরীমঃ১)
[বুখারী: ৪৯১২, ৫২৬৭, ৬৬৯১, মুসলিম: ১৪৭৪]
.
রাসূলুল্লাহ (সা) কে আসহাবে কাহফের ঘটনা জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেনঃ "আগামীকাল আমি তোমাদেরকে এর উত্তর দিব।" কিন্তু তিনি ইনশাআল্লাহ বলেন নাই। এর ফলে ১৫ দিন পর্যন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) এর উপর কোন ওহী নাজিল হয় নি। এরপর ওহী নাজিল করে আল্লাহ বলেনঃ
وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَٰلِكَ غَدًا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ ۚ وَاذْكُرْ رَبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَىٰ أَنْ يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَٰذَا رَشَدًا
আর কোন কিছুর ব্যাপারে তুমি মোটেই বলবে না যে, ‘নিশ্চয় আমি তা আগামী কাল করব’, 'ইনশাআল্লাহ' তথা ‘আল্লাহ যদি চান’ বলা ব্যতীত। আর যখন ভুলে যাও, তখন তুমি তোমার রবের যিকির কর এবং বল, আশা করি, আল্লাহ আমাকে এর চেয়েও নিকটবর্তী সত্য পথের হিদায়াত দেবেন।(সূরা কাহফঃ২৩-২৪)
[তাফসীরে ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর দ্রঃ ]
.
সুতরাং কেউ যদি বলে রাসূলুল্লাহ (সা) ওহী ব্যতীত কোন কথাই বলতেন না তাহলে সে কুরআন অস্বীকারী বলে গণ্য।
.
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ صَلَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِحْدَى صَلاَتَىِ الْعَشِيِّ ـ قَالَ مُحَمَّدٌ وَأَكْثَرُ ظَنِّي الْعَصْرَ ـ رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ سَلَّمَ ثُمَّ قَامَ إِلَى خَشَبَةٍ فِي مُقَدَّمِ الْمَسْجِدِ فَوَضَعَ يَدَهُ عَلَيْهَا وَفِيهِمْ أَبُو بَكْرٍ وَعُمَرُ ـ رضى الله عنهما ـ فَهَابَا أَنْ يُكَلِّمَاهُ وَخَرَجَ سَرَعَانُ النَّاسِ فَقَالُوا أَقَصُرَتِ الصَّلاَةُ وَرَجُلٌ يَدْعُوهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ذُو الْيَدَيْنِ فَقَالَ أَنَسِيتَ أَمْ قَصُرَتْ فَقَالَ " لَمْ أَنْسَ وَلَمْ تُقْصَرْ ". قَالَ بَلَى قَدْ نَسِيتَ. فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ سَلَّمَ ثُمَّ كَبَّرَ فَسَجَدَ مِثْلَ سُجُودِهِ أَوْ أَطْوَلَ، ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ فَكَبَّرَ، ثُمَّ وَضَعَ رَأْسَهُ فَكَبَّرَ فَسَجَدَ مِثْلَ سُجُودِهِ أَوْ أَطْوَلَ، ثُمَّ رَفَعَ رَأْسَهُ وَكَبَّرَ.
.
আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিকালের কোন এক সালাত দু’ রাক‘আত আদায় করে সালাম ফিরালেন। মুহাম্মাদ (রহ.) বলেন, আমার প্রবল ধারণা, তা ছিল আসরের সালাত। অতঃপর মসজিদের একটি কাষ্ঠ খন্ডের নিকট গিয়ে দাঁড়ালেন এবং তার উপর হাত রাখলেন। মুসল্লীগণের ভিতরে সামনের দিকে আবূ বাকর (রাযি.) ও ‘উমার (রাযি.)ও ছিলেন। তাঁরা উভয়ে তাঁর সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। তাড়াহুড়াকারী মুসল্লীগণ বেরিয়ে পড়লেন। তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, সালাত কি কমিয়ে দেয়া হয়েছে? কিন্তু এক ব্যক্তি, যাঁকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যূল ইয়াদাইন বলে ডাকতেন, জিজ্ঞেস করল আপনি কি ভুলে গেছেন, না কি সালাত কমিয়ে দেয়া হয়েছে? তিনি (নবী সা. অনুমান করে) বললেনঃ আমি ভুলিনি আর সালাতও কম করা হয়নি। তখন তাকে বলা হল যে, আপনি ভুলে গেছেন। তখন তিনি দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে সালাম ফিরালেন। অতঃপর তাক্বীর বলে সাজ্দাহ্ করলেন, স্বাভাবিক সাজদাহর ন্যায় বা তার চেয়ে দীর্ঘ। অতঃপর মাথা উঠিয়ে আবার তাক্বীর বলে মাথা রাখলেন অর্থাৎ তাক্বীর বলে সাজদাহ্য় গিয়ে স্বাভাবিক সাজদাহর মত অথবা তার চেয়ে দীর্ঘ সাজদাহ্ করলেন। অতঃপর মাথা উঠিয়ে তাক্বীর বললেন।
(সহীহ বুখারী হাঃ১২২৯, আধুনিক প্রকাশনীঃ ১১৫০, ইসলামী ফাউন্ডেশনঃ ১১৫৭)
.
রাসূলুল্লাহ (সা) যে, বলিলেনঃ "আমি ভুলিনি আর সালাতও কম করা হয়নি।" এ কথা কি ওহী ভিত্তিক ছিল? না অনুমান নির্ভর ছিল?
.
মদীনাবাসীদের খেজুর বৃক্ষে তাবীর তথা পরাগায়ণ করতে দেখে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ
لعلكم لو لم تفعلوا كان خيرا فتركوه فنقصت قال فذكروا ذلك له فقال انما انا بشر اذا امرتكم بشي من امر دينكم فخذوا به واذا امرتكم بشي من راءي فانما انا بشر. (رواه مسلم.)
.
"তোমরা এরূপ না করলে সম্ভাবতো তা তোমাদের কল্যাণকর হতো।" ফলে তারা তা পরিত্যাগ করল কিন্তু এতে সে বছর ফলন কম হলো। (রাবী) বলেন, বিষয়টি অবহিত করা হলে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, "নিশ্চয় আমি মানুষ। যখন আমি তোমাদের কে দ্বীনের ব্যাপারে নির্দেশ প্রদান করি তখন তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, আর যখন আমি (ওহী ব্যতীত) নিজেস্ব মতামতের ভিত্তিতে কোন নির্দেশ প্রদান করি তখন জানবে যে, নিশ্চয় আমিও একজন মানুষ।
(সহীহ মুসলিম; মিশকাত, কিতাবুল ঈমান, বাব: কিতাব ও সুন্নাহর উপর দৃঢ় থাকা)
.
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
.
إن يخرج وأنا فيكم، فأنا حجيجه دونكم، وإن يخرج ولست فيكم، فامرو حجيج نفسه.
.
"আমি তোমাদের মাঝে থাকা কালে দাজ্জাল যদি আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে আমি স্বয়ং তোমাদের পক্ষ থেকে তার প্রতিরোধ করব। আর যদি তার আত্মপ্রকাশ হয় এবং আমি তোমাদের মাঝে না থাকি, তাহলে তোমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ আত্মরক্ষা করবে।
(মুসলিম:২৯৩৭, তিরমিজী:২২৪০, ৪০০১, আবূ দাউদ:৪৩২১, ইবনু মাজা:৪০৭৫, আহমদ:১৭১৭৭)
.
এ হাদীস থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় এটি রাসূলুল্লাহ (সা) এর ওহী ভিত্তিক কথা নয় বরং অনুমান। এ কথা ওহী ভিত্তিক হলে রাসূলুল্লাহ (সা) স্পষ্ট ভাবে বলে দিতেন, দাজ্জাল তাঁর সময়ে বের হবে, না কি তাঁর পরে বের হবে।
.
আল্লামা মওদুদী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ
"নবী করীম (সা) থেকে দাজ্জাল সম্পর্কে যতগুলো হাদীস বর্ণিত হয়েছে সামগ্রিক ভাবে সেগুলোরর বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যে জ্ঞান (ওহী) লাভ করা গেছে তা কেবল একটুকুই ছিল যে, এক বিরাট দাজ্জাল আবির্ভূত হবে এবং তার চিহ্ন ও বৈশিষ্ট্য হবে এরূপ এরুপ। কিন্তু সে কবে কোথায় আবির্ভূত হবে এ কথা নবী (সা) কে বলে দেওয়া হয় নি। তার জন্ম কি নবী করীম (সা) এর যুগেই হয়েছিল না বহু যুগ পরে তার জন্ম হবে, এ কথাও তাঁকে (ওহীর মাধ্যমে) বলে দেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে নবী (সা) থেকে যে সব কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, প্রকৃত পক্ষে সেগুলো ছিল তাঁর কিয়াস অনুমান।"
[রাসায়েল ও মাসায়েল, ১/৪০]
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন