আল্লামা ইকবালের গোমরাহী
আল্লামা ইকবাল নামে পরিচিত এই কবি উপমহাদেশ তো বটেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ পরিচিত। উর্দু ও ফার্সি ভাষার সুপরিচিত এই কবির শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়েছিল স্কটিশ মিশনারি স্কুল থেকে। যৌবন কালেই তিনি টমাস আর্নল্ড দ্বারা তীব্র প্রভাবিত হন এবং উচ্চ শিক্ষাগ্রহণে ইউরোপ গমন করেন। জীবনের শুরুতে ইকবাল উর্দু-ফার্সি ভাষা শিক্ষা করলেও ধর্মীয় বিষয়ে তার পড়াশোনা ছিল ব্যক্তিগত অধ্যয়ননির্ভর। এ ক্ষেত্রে তার নির্ভরযোগ্য কোনো শিক্ষকের কথাও জানা যায় না!
শিক্ষাজীবন শেষে ইকবাল আইনব্যবসার পাশাপাশি কাব্যচর্চা শুরু করেন। অল্প দিনেই তিনি বেশ খ্যাতি অর্জন করেন এবং ইংরেজদের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ তাকে নাইট ব্যাচেলর উপাধিতে ভূষিত করেন।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসাবে ইকবাল সুপরিচিত। তার অনেক কবিতাই এই রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা তীব্র প্রভাবিত। তবে ইকবাল তার কাব্যে ইসলামি চেতনা ও ঐতিহ্যের কথা বলতেন। তার কবিতাগুলো উপমহাদেশের লাখো মানুষকে আলোড়িত করেছে। অখণ্ড ভারতের পক্ষে থাকা আলেম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানিকে তীব্র কটাক্ষ করেও ইকবাল কবিতা রচনা করেছিলেন। পরে অবশ্য জনরোষের মুখে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন এবং মাওলানার প্রশংসা করে দুটি চিঠি পাঠান। ইকবাল পশ্চিমা সভ্যতার কঠোর সমালোচক ছিলেন এবং তার কাব্যে তিনি তীব্রভাবে একে আঘাত করেছেন। কিন্তু নিজের অজান্তেই তিনি পশ্চিমা দার্শনিকদের অনেকের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, যা তার ধর্মীয় বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রায়ই ধরা পড়ত। ইকবালের এমন কিছু বক্তব্য দেখা যাক!
১. নবুওত সম্পর্কে তিনি বলেছেন-
"নবীকে বলা যেতে পারে এক ধরনের মরমীয় চৈতন্যের প্রতীক, যার মধ্যে অখণ্ড অভিজ্ঞতা আপনার সীমা অতিক্রম করে এবং সমষ্টিগত জীবনের গতির মোড় ফেরাবার অথবা একে নতুন রূপ দেওয়ার সুযোগ সন্ধান করে।"
- {ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, ১১০। অন্যত্র ইকবাল বলেন, 'মরমীয় অভিজ্ঞতা একটা জীবস্তু ব্যাপার। এই অভিজ্ঞতা গুণগত বিচারে নবীর অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্ন জাতীয় নয়।', পৃষ্ঠা, ১১১}
নবুওতকে মরমি অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা দেওয়া বড় মাপের ভুল। সাইয়েদ হুসাইন আফফানি বলেন, 'ইকবালের এই কথা সঠিক নয়। মরমি অনুভূতি যে কেউ চাইলেই অর্জন করতে পারে। সুফিদের রিয়াজত-মুজাহাদার মাধ্যমেই এটি অর্জিত হয়; কিন্তু নবুওত কেউ নিজের চেষ্টা-মেহনত দ্বারা অর্জন করতে পারে না।'
- {আলাম ওয়া আকযাম ফি মিজানিল ইসলাম, ২/৩০১}
ওহি সম্পর্কেও ইকবালের বক্তব্য বেশ অস্পষ্ট। তার মতে-
"বস্তুত কুরআনে ওহি শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে দেখা যায়-ওহি হচ্ছে জীবনের একটি বিশ্বজনীন ধর্ম, যদিও এর প্রকৃতি এবং স্বরূপ জীবনের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন প্রকার।"
- {ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, ১১০}
দেখা যাচ্ছে, ইকবালের দার্শনিক মারপ্যাঁচে ওহির মূল মর্মই যেন হারাতে বসেছে। ইকবালের এ সম্পর্কিত বক্তব্যটি ধোঁয়াশাপূর্ণ ও অস্পষ্ট।
২. ইকবালের মতে জান্নাত-জাহান্নাম দুটি হালত বা অবস্থামাত্র, এটি কোনো বিশেষ স্থান নয়। তিনি বলেন-
"বেহেশত ও দোজখ, দুটি অবস্থাবিশেষ, স্থান নয়। কুরআনের এ সব বর্ণনা হল একটি অন্তর্নিহিত সত্যের বাহ্য দৃষ্টিসুলভ রূপ।"
- {ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, ১০৯। ইকবালের মতে, চিরন্তন দোজখ বলে কিছু নেই।}
ইকবালের মতে- জান্নাত হল, ধ্বংসাত্মক শক্তিসমূহের উপর বিজয় লাভজনিত পরম আনন্দ। দোজখ হল, ব্যক্তির মানুষ হিসাবে কর্তব্যচ্যুতির পরম বেদনাদায়ক অনুভূতি। অর্থাৎ, দুটিই মানসিক দুটি অবস্থামাত্র! এটি কোনো স্থান বা কাঠামো নয়।
বলা বাহুল্য, ইকবালের এই বক্তব্য আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদা-বিশ্বাসবিরোধী মনগড়া আলাপ। তার এই কথা থেকে বোঝা যায়, তিনি একাধারে ভ্রান্ত সুফি ও পশ্চিমা দার্শনিকদের বক্তব্য দ্বারা তুমুল প্রভাবিত ছিলেন এবং তার শরয়ি জ্ঞান ও বিশুদ্ধ আকিদা- বিশ্বাসের অভাব ছিল। ড. মুহাম্মদ আল-বাহি বলেন, 'ইকবাল শরয়ি নুসুস থেকে অনেক দূরে গিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।'
- {আল-ফিকরুল ইসলামিল হাদিস ওয়া সিলাতুহু বিল ইস্তিমারিল গরবি}
৫. আদম হাওয়া আ. কে অসীকার ও বিবর্তনবাদকে সমর্থন
ইকবাল লিখেছেন "আদমের ‘পতন’ বললে আমরা যা বুঝি, তা আসলে মানুষের পৃথিবীতে আসার শুরুকে বোঝায় না। এটি কোনো পাপের গল্প নয়। বরং, এটা মানুষ যখন কেবল নিজের চাহিদা ও প্রবৃত্তির ওপর নির্ভর করে চলত, সেই অবস্থান থেকে নিজের স্বাধীন সত্ত্বার সচেতনতায় পৌঁছানোর গল্প। এটা সেই সময়ের কথা, যখন মানুষ প্রথম বুঝতে শুরু করল—সে শুধু প্রকৃতির অংশ নয়, তার নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের ইচ্ছা আছে। এই ‘পতন’ আসলে এক ধরণের জাগরণ—যেখানে মানুষ নিজের মধ্যে ভালো-মন্দ বাছাই করার ক্ষমতা অনুভব করল। এটা এক অর্থে পতন নয়, বরং উন্নয়ন—প্রকৃতির ঘুমন্ত অবস্থা থেকে নিজের আত্মচেতনায় জেগে ওঠার শুরু।"
৩. মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে যে সেক্যুলারধারা তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, ইকবাল তাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এ সময় তিনি খেলাফত-ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নেই বলেও ঘোষণা দেন। ইকবাল বলেন-
"তুর্কিদের যুক্তি এই যে, কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার বেলায় অতীত ইতিহাসের অভিজ্ঞতার দিকে আমরা কিছুতেই চোখ বন্ধ করতে পারি না। সে অভিজ্ঞতার অকুণ্ঠিত রায় এই যে, কার্যক্ষেত্রে সর্বজনীন ইমামত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মুসলিম সাম্রাজ্য যখন একচ্ছত্র ছিল, তখনও এ ধরনের ধারণা কার্যকরী ছিল। এ সাম্রাজ্য ভেঙেচুরে ভিন্ন ভিন্ন নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের জন্ম দিয়েছে। অতএব, ইসলামের অধুনাতন ব্যবস্থাপনায় খেলাফতের ধারণা আর নতুন করে কার্যকারী হতে পারে না। জীবন্ত শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করবার ক্ষমতা এর আর নেই। খেলাফতের দ্বারা এখন কোনো উপকার হওয়া তো দূরের কথা, বরং এই খেলাফতের ধারণাই বর্তমানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের একত্রীকরণের পথে বড় বিঘ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাফত- সংক্রান্ত মতভেদের দরুন ইরান তুরস্ক থেকে দূরে সরে গেছে, মরক্কো এ ব্যাপারে রয়েছে বক্র দৃষ্টিতে চেয়ে আর আরব এ নিয়ে প্রচ্ছন্ন দুরাশা পোষণ করছে। এ এক নিতান্ত হাস্যকর ব্যাপার যে, ক্ষমতার একটি অকিঞ্চিৎকর প্রতীকমাত্র নিয়ে এত কাড়াকাড়ি, যার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেছে অনেক কাল আগে। ইতিহাসের যুক্তি তুর্কিদের এই মতবাদকে সমর্থন করে।"
- {ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, ১৩৬}
ইকবালের মতে তুর্কিদের এই যুক্তিগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারলে তা থেকে একটি আদর্শিক জাতি জন্মলাভ করতে পারে। ইকবালের মতে, এমনকি এটিই ইসলামের মৌলিক ভিত্তি! নাউজুবিল্লাহ!
ইকবাল ছিলেন তুরস্কের সেক্যুলারিজমের অন্ধ সমর্থক। মূলত শরয়ি জ্ঞানশূন্য চিন্তাবিদদের চিন্তাধারাগুলো এমন বিভ্রান্ত পথেই ঘুরপাক খায়। আতাতুর্কের সবগুলো সিদ্ধান্তকে ইকবাল স্বাগত জানান, তুরস্কের সেক্যুলার কবিদের কবিতা তিনি উদ্ধৃত করেন পরম মুগ্ধতায়। কথিত নারী অধিকার, আরবি ভাষার চর্চা সীমিত করা-প্রতিটি বিষয়কেই ইকবালের মনে হয়েছে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। ইকবাল মুগ্ধ কণ্ঠে বলেছেন, 'তুরস্ক আজ নতুন মূল্যমান সৃষ্টির কাজে লেগে গেছে।'
- {ইকবাল মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রশংসা করেও কবিতা লিখেছিলেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত পয়ামে মাশরেকে এমন একটি কবিতা আছে। কিন্তু দেড় দশক পরে ইকবালের চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়। তিনি আতাতুর্কের বিরোধী হয়ে ওঠেন। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত জরবে কালিম গ্রন্থে তিনি আতাতুর্কের বিরোধিতাও করেন। কিন্তু এ সবই ছিল ব্যক্তির বিরোধিতামাত্র। তুরস্কের সেক্যুলারিজমের যে কাঠামোকে তিনি মুসলমানদের উন্নতির মাধ্যম মনে করতেন, সে বিষয়ে তার চিন্তাধারা পরিবর্তিত হয়নি।}
৪. ইকবালের ধর্মীয় চিন্তা মডার্নিজম দ্বারা কী পরিমাণ প্রভাবিত ছিল, তা বোঝা যায় তার দ্য রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম বইটি পাঠ করলেই। এই বইতে ধর্মীয় যে কোনো বিষয় ব্যাখ্যার জন্য সালাফে সালেহিনের বক্তব্য উপস্থাপনের পরিবর্তে তিনি পশ্চিমা দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজ- গবেষক প্রমুখের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। শরিয়ার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয় ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও সাহায্য নিয়েছেন পশ্চিমাদের। ইসলামি জ্ঞানশাস্ত্রের মধ্যে শুধু কুরআনকেই উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু সেখানে ব্যাখ্যা করেছেন নিজের মতো মনগড়া ব্যাখ্যা! পাশ কাটিয়ে গেছেন মুফাসসিরদের স্বীকৃত মূলনীতি, কুরআন থেকেই প্রমাণ করেছেন জান্নাত-জাহান্নাম দুটি অবস্থা বা অনুভূতিমাত্র, স্থান নয়! নাউজুবিল্লাহ!
ইকবালের পাশ্চাত্য-মুগ্ধতা বোঝাতে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ইসলামি আইনের চার ভিত্তি সম্পর্কে আলোচনার সময় তিনি গোল্ডজিহার, নওমান প্রমুখের উদ্ধৃতি দিয়েছেন; এমনকি হাদিসশাস্ত্রের উপর গোল্ডজিহারের চালানো অপপ্রচারেও ইকবাল ছিলেন মুগ্ধ! উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই তিনি লিখেছেন- 'আধুনিক সমালোচকদের মধ্যে অধ্যাপক গোল্ডজিহার ঐতিহাসিক সমালোচনার এ কালগ্রাহ্য সূত্রাবলির সাহায্যে হাদিসশাস্ত্রের অন্তর্ভেদী পর্যালোচনা করেছেন। তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, 'এই শাস্ত্রসম্ভার মোটের উপর বিশ্বাসের অযোগ্য।'
- {ইসলামে ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন, ১৪৬}
হাদিসশাস্ত্র পর্যালোচনায় গোল্ডজিহার ও আরেকজন প্রাচ্যবিদকে উদ্ধৃত করতে পারলেও কোনো মুহাদ্দিসকে উদ্ধৃত করার মুরোদ হয়নি তার! মুহাদ্দিসিনদের যাচাই-পদ্ধতির উপর আস্থা না রেখে সমাধান পেয়েছেন গোল্ডজিহারের কাছেই। তার পাশ্চাত্য-মুগ্ধতার এক হাস্যকর নমুনা হয়ে রইল তার এই বইটি। আজকাল যারা কথায় কথায় ইকবালকে থানভি, জাফর আহমদ উসমানি বা কাশ্মিরির চেয়ে বড় ইসলামবেত্তা বলে ঘোষণা দেন, এই বইটি যেন তাদের দাবিকেই বিদ্রুপ করছে!
- {ইকবালের চিন্তাগত বিচ্যুতির তালিকা আরও দীর্ঘ। কিন্তু আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার ভয়ে এখানেই আলোচনা সংক্ষিপ্ত করা হল।}
বই: আধুনিক কালের বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি
পৃষ্ঠা: ১৪৪ - ১৪৯
#বিঃদ্রঃ মূল বইতে ইকবালের ইংরেজি বক্তব্যগুলো সহই উদ্ধৃত হয়েছে। পোস্ট বড় হয়ে যাবে তাই এখানে সেগুলো বাদ দেয়া হয়েছে।
এখানে পুরো বইটি পিডিএফ দেয়া আছে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন