ইবনে তাইমিয়া
ইবনে তায়মিয়্যাহ সম্পর্কে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত অনুযায়ী সঠিক অবস্থান বুঝতে শায়খুল ইসলাম ইবনে হাজার আসকালানীর পর্যালোচনা পড়া এবং তার পদ্ধতি গ্রহণ করা সবার জন্য আবশ্যক। ইবনে তায়মিয়্যাহর বিষয়ে ইবনে হাজার দুইটি পর্যালোচনা করেছেন – আদ দুরারুল কামিনা গ্রন্থে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এবং ইবনে নাসিরুদ্দিন দিমাশকির সংকলিত মানপত্রের জন্য তার লেখা রিসালা, যা তার ঘনিষ্ট ছাত্র, ইমাম সাখাভি, তার জীবনীগ্রন্থে সম্পূর্ণ উল্লেখ করেছেন। আর ইবনে তায়মিয়্যাহ থেকে ইলমি ফায়দা গ্রহণের পদ্ধতি জানতে পড়তে হবে তার ফাতহুল বারী।
ইবনে তায়মিয়্যাহ সম্পর্কে ইমাম ইবনে হাজারের পর্যালোচনাকে তিন ভাগ করা যায়।
১ - ইবনে তায়মিয়্যাহর ইলমি যোগ্যতা ও খেদমতের প্রশংসা (আর রদ্দুল ওয়াফির)
২ - ইবনে তায়মিয়্যাহর ভুল ও গোঁড়ামিগুলো চিহ্নিত করা (আদ দুরারুল কামিনা)
৩ - ইবনে তায়মিয়্যাহর ইলম থেকে ফায়দা গ্রহণ (ফাতহুল বারী)
ইবনে তায়মিয়্যাহ খুবই পোলারাইজিং পারসোনালিটি। ইলমে নবীন ও দূর্বলরা হয়ত তার ডাই-হার্ড ভক্ত হয়ে যায় নয়ত তার ডাই-হার্ড হেটার হয়ে যায়। কেবল মাত্র রাসেখিন আলেমরাই ইবনে তায়মিয়্যাহর ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন।
ইবনে তায়মিয়্যাহকে কীভাবে পাঠ ও পর্যালোচনা করতে হবে তা বুঝতে তিন জন ব্যাক্তির নাম আমি বিশেষভাবে বলব, যারা ইবনে তায়মিয়্যাহর পরম বন্ধু হওয়া কিংবা চরম শত্রু হবার উগ্রতা পরিত্যাগ করে মধ্যমপন্থী রাস্তা গ্রহণ করেছিলেন – ইবনে হাজার আসকালানি, মোল্লা আলী কারী এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি।
১. ইবনে তায়মিয়্যাহর প্রাপ্য সম্মান প্রদান
ইবনে হাজার বলেন,
وشهرة إمامه الشيخ تقي الدين ابن تيمية أشهرُ مِنَ الشَّمس، وتلقيبُه بشيخ الإسلام في عصره باقٍ إلى الآن على الألسنة الزكيَّة، ويستمر غدًا كما كان بالأمس، ولا يُنكِرُ ذلك إلّا من جهل مقداره، أو تجنَّب الإنصاف
তার ইমাম, শায়খ তাকিউদ্দিন ইবনে তায়মিয়্যাহর খ্যাতি, সূর্যের চেয়েও বেশি। শায়খুল ইসলামের উপাধি যেটা তাকে তার যুগে তাকে দেয়া হয়েছিল সেটা আজও (দেড়শ বছর পর) পবিত্র জিহ্বাগুলোতে উচ্চারিত হয়। এটা ভবিষ্যতেও সেভাবে চলমান থাকবে যেভাবে অতীতে ছিল। এটা কেবল সেই অস্বীকার করে যে তার মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা ইনসাফ বর্জিত।
২. ইবনে তায়মিয়্যাহর সমস্যা চিহ্নিতকরণ
ইবনে হাজার আসকালানি তার "আদ দুরারুল কামিনা"তে লিখেছেন,
كانَ يتَكَلَّم على المِنبَر على طَريقَة المُفَسّرين مَعَ الفِقْه والحَدِيث فيورد فِي ساعَة من الكتاب والسّنة واللغة والنَّظَر ما لا يقدر أحد على أن يُورِدهُ فِي عدَّة مجالِس كَأن هَذِه العُلُوم بَين عَيْنَيْهِ فَأخذ مِنها ما يَشاء ويذر ومن ثمَّ نسب أصْحابه إلى الغلو فِيهِ واقْتضى لَهُ ذَلِك العجب بِنَفسِهِ حَتّى زها على أبناء جنسه واستشعر أنه مُجْتَهد فَصارَ يرد على صَغِير العلماء وكَبِيرهمْ قويهم وحديثهم حَتّى انْتهى إلى عمر فخطأه فِي شَيْء فَبلغ الشَّيْخ إبْراهِيم الرقي فَأنْكر عَلَيْهِ فَذهب إلَيْهِ واعْتذر واستغفر وقالَ فِي حق عَليّ أخطَأ فِي سَبْعَة عشر شَيْئا ثمَّ خالف فِيها نَص الكتاب مِنها اعْتِداد المتوفي عَنْها زَوجها أطول الأجَليْنِ وكانَ لتعصبه لمَذْهَب الحَنابِلَة يَقع فِي الأشاعرة حَتّى أنه سبّ الغَزالِيّ فَقامَ عَلَيْهِ قوم كادُوا يقتلونه
ইবনে তায়মিয়্যাহ মিম্বরে বসে কথা বলতেন মুফাসসিরদের পদ্ধতিতে, সাথে থাকত ফিকহ ও হাদিসের সম্মিলন। তিনি মুহুর্তের মধ্যে কিতাব, সুন্নাত, ভাষা ও দর্শনের এমন সব বিষয় নিয়ে আসতেন যা অন্যইয়া একাধিক মজলিসে বসেও করতে পারত না। তার এমন অবস্থা হয়েছিল যেন সকল ইলম তার চোখের সামনে থাকত, যেটা চাইতেন নিয়ে নিতেন, যেটা চাইতেন না রেখে দিতেন। আর এখান থেকেই তার সঙ্গীরা তার ব্যাপারে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়। আর এর ফলে ইবনে তায়মিয়্যাহর মনে নিজেকে নিয়ে গরিমা তৈরি হয়। ফলে তিনি তার সমকালীনদের ওপর গর্ব করা শুরু করেন, নিজেকে তিনি মুজতাহিদ ভাবতেন এবং ছোট-বড় সকল আলেমকে খণ্ডন করা শুরু করেন। এমনকি খণ্ডন করতে করতে তিনি হযরত ওমর পর্যন্ত চলে যান এবং তাকে একটি বিষয়ে ভুল সাব্যস্ত করেন। শায়খ ইব্রাহিম রাকির কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে তিনি তার নিন্দা করেন। পরে তিনি তার কাছে গিয়ে নিজের ওযর উল্লেখ করে ক্ষমা চেয়ে আসেন। তিনি আলীর ব্যাপারে বলেন, তিনি সতেরটি বিষয়ে ভুল করেছেন, যার একটি কোরআনের স্পষ্ট বক্তব্যের বিরোধী - মৃত স্বামীর বিধবা দুই সময়ের (স্বাভাবিক ইদ্দত ও প্রসব) দীর্ঘটা গ্রহণ করবে। তিনি হাম্বলিদের মাযহাবের প্রতি পক্ষপাত থেকে আশআরিদের সমালোচনায় লিপ্ত হতেন এমনকি তিনি গাযালিকে গালি দিয়ে বসেন। এর ফলে এক দল লোক তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং তাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়।
৩. ইবনে তায়মিয়্যাহর ইলম থেকে ফায়দা গ্রহণ
ফাতহুল বারী'তে ইবনে হাজার বলেন,
وقَعَ فِي بَعْضِ الكُتُبِ فِي هَذا الحَدِيثِ كانَ اللَّهُ ولا شَيْءَ مَعَهُ وهُوَ الآنَ عَلى ما عَلَيْهِ كانَ وهِيَ زِيادَةٌ لَيْسَتْ فِي شَيْءٍ مِن كُتُبِ الحَدِيثِ نَبَّهَ عَلى ذَلِكَ العَلّامَةُ تَقِيُّ الدِّينِ بْنُ تَيْمِيَةَ وهُوَ مُسَلَّمٌ فِي قَوْلِهِ
কিছু কিছু বইতে এই হাদিসটা এভাবে আছে "আল্লাহ ছিলেন, তাঁর সাথে কিছু ছিল না। তিনি এখন সেভাবেই আছেন, যেভাবে তিনি তখন ছিলেন।" এই শেষোক্ত কথাটি হাদিসের কোন বইতে আসে নি। আল্লামা তাকিউদ্দিন ইবনে তায়মিয়্যাহ এই বিষয়ে সতর্ক করেছেন, আর এই দাবিতে তিনি সঠিক ছিলেন।
ইবনে তায়মিয়্যাহর ব্যাপারে আমাদের তুরাসে (স্কলারলি ট্র্যাডিশনে) তিনটা ধারা পাওয়া যায়। একদল তাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে। যেমন হানাফিদের বড় আলেম আলাউদ্দিন বুখারি। তিনি ইবনে তায়মিয়্যাহকে কাফের বলেন, যারা ইবনে তায়মিয়্যাহকে শায়খুল ইসলাম ডাকে তাদেরকেও কাফের আখ্যা দেন। তাদের কেউ কেউ তাকে গোমরাহ বলে দেন এককথায়, যেমন শাফেয়ী মাযহাবের সর্বশেষ মুহাক্কিক ইমাম ইবনে হাজার আল হায়তামি আল মাক্কি। এটা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন একটা সংখ্যালঘু দল। আরেক দল আছে, ইবনে তায়মিয়্যাহ যাই বলেন, তাই নিয়ে মাতামাতি করেন। ইবনুল কাইয়্যিম, ইবনুল মিবরাদ, ইবনে আবিল ইয, ইবনে কাসির যেমন। তাদের কোন সময়ই ইবনে তায়মিয়্যাহর কোন ভুল-ত্রুটি নিয়ে কথা বলতে দেখবেন না (ছোটখাট বিষয় নিয়ে কথা বলছি না)। আরেকটা দল আছে, তারাই মূলধারা এবং তারাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রকৃত অবস্থানের প্রতিনিধি, যারা ইবনে তায়মিয়্যাহর ভুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে মানুষকে দেখিয়ে দেয়, কিন্তু ইবনে তায়মিয়্যাহকে নিয়ে কুৎসা রটায় না, নিন্দা ও সমালোচনা করে বেড়ায় না। তারা ইবনে তায়মিয়্যহর গুনগুলো উল্লেখ করে, কিন্তু ইবনে তায়মিয়্যাহর মাঝে নিজেদের বিলীন করে দেয় না। এই দলের উদাহরণ হলেন ইবনে হাজার আসকালানি যিনি আলাউদ্দিন বুখারির উগ্রতার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন, মোল্লা আলী কারী যিনি ইবনে হাজার হায়তামির খণ্ডন করেছেন তার মেরকাত কিতাবে।
পরিশেষে, শায়খ হাতেম আল আওনি বলেছেন, ইবনে তায়মিয়্যাহর বইপত্র প্রাথমিক এমনকি মাধ্যমিক কোন ছাত্রের জন্য পড়াও নিষিদ্ধ। কারণ ইবনে তায়মিয়্যাহর লেখার যে শক্তি সেটা হয়ত তাকে ইবনে তায়মিয়্যাহর উগ্র সমর্থক বানিয়ে দিবে, নয়ত উগ্র নিন্দুক বানিয়ে দিবে। কেবল মাত্র উচ্চতর পর্যায়ের ছাত্র, যারা ইলম, উসুল, ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বে ম্যাচিউর কেবল তাদের জন্যই ইবনে তায়মিয়্যাহকে সরাসরি পাঠ করা অনুমোদিত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন