আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত
আমাদের এক সালাফি ভাবধারার ভাই কয়েকদিন আগে আবুল হাসান আশআরি ও হাম্বলিদের মিথষ্ক্রিয়া নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, ইমাম আবুল হাসান আল আশআরি হাম্বলিদের মাঝে কোন গ্রহণযোগ্যতা পান নি। তার মাযহাব খিলাফতের তৎকালীন রাজধানী বাগদাদে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়। আসলেই কি এটা সত্য ঘটনা? রিদওয়ান ভাইয়ের অঙ্কিত চিত্র অনুযায়ী, আবুল হাসান আশআরি ছিলেন হিজরি তৃতীয় শতকের শেষদিকে বাগদাদে অস্থিরতা ও উত্তেজনার মূল কারণ। তিনি গিয়েই সেখানে ফিতনা সৃষ্টি করেন। হাম্বলিদের উসকে দেন, অথচ "আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম..." তার দৃশ্যায়নে আমরা দেখি যে, হাম্বলিরা সর্বসম্মতভাবে আবুল হাসান আশআরিকে প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে আশআরির মাথা ঠেকানোর কোন সুযোগ হয় বাগদাদে হয় নি।
আমি বলব, এই সবগুলো দাবি বাস্তবতার আংশিক রূপায়ন, সম্পূর্ণ না। আমাদের জানা উচিত যে, বাগদাদে হাম্বলিদের দুইটি ধারা ছিল। একদিকে তামিমিদের ধারা, আরেকদিকে বারবাহারির গ্যাং। এই বারবাহারি গং এর সাথেই মূলত ছিল আশআরি ও শাফেয়িদের গ্যাঞ্জাম। আর এই গ্যাঞ্জাম বহু যুগ ধরেই জীবিত ছিল। তিনি শরিফ আবু জাফর ও কুশাইরির যে ফিতনার কথা বলেছেন, সেটা ছিল এই পুরোনো কাসুন্দির নবউন্মোচন।প্রথমত আমরা দেখি আবুল হাসান আশআরি হাম্বলিদের মাঝে কীভাবে গৃহীত হয়েছিলেন। ইবনে তায়মিয়্যাহর বিবরণ দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি বলেন,
وسَنَتَكَلَّمُ عَلى هَذا بِما يُيَسِّرُهُ اللَّهُ مُتَحَرِّينَ لِلْكَلامِ ... *
(* শব্দগুলো দিয়ে সার্চ করলেই পুরো ইবারত পেয়ে যাবেন। কলেবর কমাতে ইবারত দিচ্ছি না।)
"আল্লাহ সহজ করে দিলে আমরা এই বিষয়টি নিয়ে সতর্কতা, ইলম ও ইনসাফের সাথে কথা বলব। আল্লাহ ছাড়া কোন শক্তি, সামর্থের উৎস নেই। বস্তুত, হাম্বলিদের মাঝে সদাসর্বদাই দুইটি ধারা ছিল যাদের একটার ঝোঁক ছিল ইসবাতের দিকে, আরেকটার ঝোঁক ছিল নফির দিকে। আরেক ধারাও পাওয়া যেত যারা নফি ইসবাত দুটো থেকেই বিরত থাকত। তো হাম্বলিদের মধ্যকার এই বিরোধ অন্যান্য সব দলের মধ্যবর্তী বিরোধের মতই। কিন্তু এই বিরোধ ছিল সূক্ষ্ম বিষয়ে। বড় বড় উসুলি বিষয়ে তাদের ঐকমত্য ছিল। আর একারণে অন্য যেকোন দলের চেয়ে তাদের মাঝেই সবচেয়ে কম মতভিন্নতা ও বিভেদ দেখা যায়, কারণ তারা সুন্নাত, আছারকে আঁকড়ে থাকে। এছাড়াও ইমাম আহমদের উসুলে দীন সংক্রান্ত এবং বিতর্কিত বিষয়গুলোতে যত বেশি কথাবার্তা আছে তা অন্যান্য ইমামের নেই। আর তার কথাবার্তা ছিল সালাফের পবিত্র পথের অনুসরণপূর্ণ।
ولِهَذا لَمّا كانَ أبُو الحَسَنِ الأشْعَرِيُّ وأصْحابُهُ مُنْتَسِبِينَ إلى السُّنَّةِ والجَماعَةِ: كانَ مُنْتَحِلًا لِلْإمامِ أحْمَدَ ...
আর একারণে উম্মতের সবাই - কি ফুকাহা, কি মুতাকাল্লিম, কি সুফী - সুন্নাতের ক্ষেত্রে সবাই তার দিকে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। আর একারণেই আবুল হাসান আশআরি, আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত বলে পরিচয় দানকারী তার অনুসারীরা নিজেদেরকে ইমাম আহমদের দিকে সম্পৃক্ত করত এবং বলত যে, তিনি তাদের অনুসরণীয় এবং তার পথেই তারা চলছে। আশআরি ধারার অনেক বিশিষ্ট ব্যাক্তিত্বের সাথেই হাম্বলি অনেক ব্যাক্তিবর্গের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। আর এটা সুপ্রসিদ্ধ বিষয়। এমনকি আবু বকর বিন আব্দুল আযিয (গুলামে খাল্লাল) তার লেখনীতে ঠিক সেভাবেই আবুল হাসান আশআরির যুক্তি উল্লেখ করতেন, যেভাবে তিনি তার হাম্বলি সঙ্গীদের যুক্তি উল্লেখ করতেন।
وكانَ بَيْنَ أبِي الحَسَنِ التَّمِيمِيِّ وبَيْنَ القاضِي أبِي بَكْرٍ بْنِ الباقِلانِي مِن المَوَدَّةِ والصُّحْبَةِ ...
আর আশআরির প্রতি সবচেয়ে নিকটবর্তী ছিল হাম্বলিদের তামিমি ধারা — আবুল হাসান তামিমি, তার ছেলে, তার নাতি প্রমুখ। আবুল হাসান তামিমি এবং কাযী আবু বকর আল বাকিল্লানির সাথে ছিল সহৃদ্যতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আর এটাও বিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ বিষয়। আর একারণে (আশআরি ধারার মুহাদ্দিস) হাফেয আবু বকর বায়হাকি যখন ইমাম আহমদের প্রশংসায় বই রচনা করেন তখন সেখানে ইমাম আহমদের আকিদা-বিশ্বাসের আলোচনায় তিনি আবুল হাসান তামিমির ছেলে আবুল ফযল আব্দুল ওয়াহেদের বক্তব্য উল্লেখ করেন। আবুল ফযল তামিমি ইমাম আহমদের আকিদা বিষয়ে একটি বই লিখেছিলেন, আর সেখানে তিনি ইমাম আহমদের আকিদা সম্পর্কে যা বুঝেছেন, তা উল্লেখ করেছেন। আর নিজের বুঝকে তিনি "আবু আব্দিল্লাহ (ইমাম আহমদের কুনিয়া) বলতেন..." বলে উল্লেখ করতেন।
সুত্র - মাজমুউল ফাতাওয়া, ৪/১৬৬-৮।
ইবনে তায়মিয়্যাহ নিজে একজন হাম্বলি। তিনি নিজেই বলছেন আবুল হাসান আশআরি ছিলেন হাম্বলিদের এক ঘরানার কাছে সমাদৃত। একই কথা আমরা হাফেয ইবনে আসাকিরের কাছেও দেখতে পাই। তিনি লেখেন,
.. رجلانِ صالحان بُليا بأصحاب سوءٍ جَعْفَر بن مُحَمَّد وأحمد بن حَنْبَل ...
তোমরা আবুল হাসান আশআরির ফযিলত ভাল করে জান, তার ইনসাফের কদর কর, ইমাম আহমদের মর্যাদা ও তার স্বীকৃতি সম্পর্কে তার বিবরণ ভালো করে শোন; তোমরা বুঝবে যে, আকিদা বিশ্বাস, ধর্মের মূলনীতি, সুন্নাতের ব্যাখ্যার দিক থেকে এই দুইজন একই মতের ছিলেন, বিরোধী ছিলেন না। বাগদাদের হাম্বলিরা সেই প্রাচীন কাল থেকে নিয়ে সবসময়ই বিদআতিদের প্রতিরোধ করার জন্য আশআরিদের সহযোগিতা নিয়ে আসছে। কারণ আশআরিরা ছিলেন সিফাত স্বীকারকারীদের মধ্যকার মুতাকাল্লিম (ধর্মতাত্ত্বিক)। হাম্বলিরা যখন বিদআতিদের বিপক্ষে কথা বলত, তখন আশআরিদের ভাষাতেই কথা বলত। কোন উসুলি মাসআলাতে যদি তাদের কেউ তাহকিক করত তবে সেটার শিক্ষা তারা আশআরিদের কাছ থেকেই পেত। তাদের সম্পর্ক এমনটাই ছিল সবসময় যতক্ষণ নিযামে মুলকের হস্তক্ষেপে আবু নসর কুশাইরির মাধ্যমে ফিতনা সংঘটিত না হয়। এই নিযামে মুলকের কারণেই তাদের একে অন্যের প্রতি উগ্রতা তৈরি হয়। অন্যদিকে হাম্বলিদের মধ্যে একটি দলও সবসময় ছিল যারা সুন্নাতের (আকিদা) ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করত, এমনসব বিষয়কে এর অন্তর্ভূক্ত করত যা ছিল অপ্রাসঙ্গিক, ফিতনা সৃষ্টির ব্যাপারে তারা ছিল সদা উদগ্রীব। তাদের কর্মকাণ্ডের কোন কলংক ইমাম আহমদের ওপর পড়বে না। আর তারা নিজেরাও সব বিষয়ে একমত হতে পারে না। আর একারণেই ইবনে শাহিন, যিনি দারাকুতনির সঙ্গী ও সমযুগের ছিলেন এবং সুন্নি মুহাদ্দিসদের একজন ছিলেন, মন্তব্য করেছিলেন, "দুইজন ভালো মানুষ খারাপ অনুসারীর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন — জাফর সাদেক ও আহমদ বিন হাম্বল।"
সুত্র - তাবয়িনু কাযিবিল মুফতারি, ১৬৩।
ইবনে আসাকির হাম্বলিদের যেই ফিতনাবাজ দলের উল্লেখ করেছিলেন, তাদের শীর্ষে ছিলেন আল বারবাহারি এবং তার গ্যাং। ইমাম ইবনে আসীর তার "কামেল" গ্রন্থে বারবাহারি গ্রুপের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন।
তিনি বলেন,
ذِكْرُ فِتْنَةِ الحَنابِلَةِ بِبَغْداذَ ...
বাগদাদে হাম্বলিদের ফিতনার বৃত্তান্ত
হিজরি ৩২৩ সালে হাম্বলিদের প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। তাদের দাপট বেড়ে যায়। তার নেতৃস্থানীয় কিংবা সাধারণ মানুষ সবার ওপর ছড়ি ঘোড়ানো শুরু করে। যখনই তারা কোথাও নাবিয পেত, ভাসিয়ে দিত। কোথাও গায়িকা নারী পেলে, তাকে প্রহার করত, বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করত, কেনাবেচায় বাঁধা দিত। শিশু ও নারীদের সাথে পুরুষদের হাঁটতে দেখলে "সাথে কে?" এই নিয়ে জেরা শুরু করত। যদি সে ঠিকঠাক বলতে না পারত, তাকে মারপিট করে, পুলিশ প্রধানের কাছে নিয়ে যেত এবং তাকে ফাসেক বলে সাক্ষ্য দিত। বাগদাদকে তারা অরাজক বানিয়ে ফেলেছিল।
এসব দেখে পুলিশপ্রধান বদর আল খারশানী জুমাদাল উখরা মাসের শেষের দিকে ঘোড়ায় চড়ে বাগদাদের দুই দিক থেকে ঘোষণা দেন এই মর্মে, আজ থেকে বারবাহারির অনুসারী হাম্বলিদের কোথাও একত্রিত হওয়া নিষেধ, দুইজনও না। তাদের মাযহাব নিয়ে তর্কবিতর্ক করা নিষেধ। তাদের কেউ যদি ইমাম হিসেবে নামায পড়ায় তাহলে শাফেয়িদের মত করে ফজর, আসর ও ইশার নামাযে কিরাআতে উচ্চস্বরে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়বে। কিন্তু এসবে কোন কাজ হয় নি। আর তাদের অশান্তি ও ফিতনা আরো বাড়তে থাকে। এমনকি মসজিদে যেসব অন্ধরা আশ্রয় নিত, তাদেরকে নিজেদের দলে টেনে নেয়। যখনই কোন শাফেয়ী মাযহাবের কেউ হেঁটে যেত, তারা এই অন্ধদেরকে তার উপর চড়াও করে দিত। ফলে তারা নিজেদের লাঠি দিয়ে তাদের বেদম পেটানো শুরু করত এমনকি মারতে মারতে মরণাপন্ন করে ফেলত।
অবশেষে খলিফা রাযীর পক্ষ থেকে ফরমান আসে, যাতে হাম্বলিদের কাজকর্মের নিন্দা করা হয়, তাদের তাশবিহ-পূর্ণ আকিদা ও অন্যান্য বিষয়ে তিরস্কার করা হয়। তিনি বলেন, তোমরা কখনো কখনো ভাব যে, তোমাদের কুৎসিত চেহারাগুলোর সুরত মহান প্রভুর মত, তোমাদের নিকৃষ্ট আকৃতিগুলো খোদার আকৃতির মত। তোমরা তাঁর তালু, আঙ্গুল, পা, জুতা, চুল, কটকট শব্দ, আকাশে ওঠা, দুনিয়াতে নামা এসব সাব্যস্ত কর। আল্লাহ অত্যাচারী ও অস্বীকারকারীদের অপবাদ থেকে পবিত্র। তারপর তোমরা শ্রেষ্ঠ ইমামদের প্রশ্নবিদ্ধ করলে শিয়াতু আহলে বায়তের ওপর কুফর ও গোমরাহির তকমা দিলে। তারপর মুসলিমদের তোমরা প্রকাশ্য বিদআত ও অন্যায়পূর্ণ মতামতের দিকে আহ্বান করলে, কোরআন যার সমর্থন করে না। তোমরা (আহলে বায়তের) ইমামদের কবর যিয়ারত করতে মানুষকে নিষেধ করলে, যারা যায় তাদের বিদআতি বললে, অথচ তোমরা মানুষক সর্বসাধারণের মধ্যকার এক ব্যাক্তির (আহমদ বিন হাম্বল) কবর নিয়ে মাতামাতি করলে যার না আছে আভিজাত্য, না উচ্চবংশ, আর না রাসুলের সাথে কোন আত্মীয়তা। তোমরা তার কবর যিয়ারত করতে মানুষকে আদেশ দাও, তার ব্যাপারে নবিদের মোজেযা ও ওলিদের কারামতের অনুরূপ দাবি কর। শয়তানের ওপর অভিশাপ হোক, যে তোমাদের চোখে এসব অপকর্মকে সুন্দর হিসেবে দেখিয়েছে, তোমাদের বিপথগামী করেছে।
আমিরুল মুমিনিন আল্লাহর ওপর কসম করে বলছেন, আল্লাহর সাথে প্রতিজ্ঞা করে বলছেন যা তিনি পূরণ করেই ছাড়বেন, যদি তোমাদের এইসব নিন্দিত মতামত এবং বক্রতার পথ পরিত্যাগ না কর, তোমাদের ওপর তিনি প্রহার, বহিষ্কার, হত্যা ও ধ্বংসের ঢল বইয়ে দিবেন। তোমাদের ঘাড়ে তিনি তরবারি চালাবেন, তোমাদের ঘরবাড়ি ও মহল্লাগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিবেন।
সুত্র - আল কামেল, ৭/৪০-১।
কার কথা মেনে মুতাজিলাদের আপনি আহলে সুন্নাত থেকে বের করে দিচ্ছেন? বের করে দেয়ার যুক্তিটাই-বা কী? তারা আল্লাহর কালামকে মাখলুক বলেছে? আল্লাহর যেই কালামকে তারা সিফাত হিসেবে মানতে অস্বীকার করেছে, সেটা আশআরী ও মাতুরীদীরাও তো করেছে। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী তার 'আল আরবাইন' ও ইবনুল জাওযী তার 'আল মুনতাযাম' এ কী লিখেছেন পড়ে দেখুন।
ইবনুল জাওযী বলেন,
والمعتزلة قالوا هُوَ مخلوق، فوافق الأشعري المعتزلة في أن هذا مخلوق، وقال: ليس هذا كلام الله
"মুতাজিলারা একে (কোরআনের শব্দগুলো) মাখলুক বলেছে। আশআরী মুতাজিলাদের সাথে একমত হয়েছে যে, এটা আল্লাহর কালাম না, বরং মাখলুক।"
রাযী বলেন,
كونه تعالى متكلما بالمعنى الّذي يقوله «المعتزلة» مما نقول به ونعترف به ولا ننكره بوجه من الوجوه
"মুতাজিলারা আল্লাহকে যে অর্থে মুতাকাল্লিম বলে স্বীকার করে থাকে, আমরাও সেই অর্থেই বলে থাকি ও স্বীকার করি। তাদের কথায় আমাদের কোনদিক থেকেই আপত্তি নেই।"
মুতাজিলাদের তাকদীর সম্পর্কে বক্তব্য প্রবলেমেটিক? শায়খুল ইসলাম মুস্তাফা সাবরী তার মাওকিফে আকল ওয়াল ইলম বইয়ে সাফ লিখেছেন যে, মুতাজিলিদের তাকদীর বিষয়ক আকীদা হুবহু মাতুরীদীদের আকীদা –
إنَّ مذهب المعتزلة القدريَّة الذي انقرضَ رجاله ما زال يعيشُ في هذه المسألة تحتَ اسم الماتُريديَّة
"কাদারিয়া মুতাজিলাদের মাযহাবের অনুসারীরা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদের তাকদীর বিষয়ের আকিদা আজও মাতুরীদী নামের ছায়াতলে বেঁচে আছে।"
আচ্ছা, তাদের উপসংহার বাদ দিলাম। মেথডোলোজি নিয়ে সমস্যা? তারা আকলকে প্রাধান্য দেয় যেকোন দলীলের উপর। এটা সমস্যা? এটা তো আশআরীদেরও কথা! ইমাম রাজী তো লিখেছেনই –
والقول بترجيح النقل على العقل محال لأن العقل أصل النقل فلو كذبنا العقل لكنا كذبنا أصل النقل ومتى كذبنا أصل النقل فقد كذبنا النقل فتصحيح النقل بتكذيب العقل يستلزم تكذيب النقل
"আকলের উপর নকলকে প্রাধান্য দেয়া একটা অসম্ভব কথা। কারণ নকলের মূল হল আকল। যদি আমরা আকলকে মিথ্যাবাদী বলি, তবে নকলের গোড়াতেই আঘাত করা হবে। আর নকলের মূলোৎপাটন করা হলে খোদ নকলকেই মিথ্যা আখ্যা দেয়া হবে। সুতরাং আকলকে ভ্রান্ত সাব্যস্ত করে নকলকে বিশুদ্ধ আখ্যা দেয়া হলে আদতে নকলকেই ভ্রান্ত সাব্যস্ত করা হয়।"
মুতাজিলাদের মৌলিক দাবি এই মূলনীতি থেকে একটুও ভিন্ন না। মুতাজিলারা সুন্নত ও ইজমা অস্বীকার করে না। তারা সাহাবীদের অনুসরণ অস্বীকার করে না।
প্রসিদ্ধ মুতাজিলি ইমাম কাযী আব্দুল জাব্বার আশ শাফেয়ী তার ফাদলুল ইতিযাল গ্রন্থে বলেছেন:
ثبت بالتواتر والإجماع يجب أن يقال به وما عداه يجب أن يجوز إذا لم يمنع الدليل
"মুতাওয়াতির কিংবা ইজমার মাধ্যমে যা প্রমাণিত হবে তা স্বীকার করা কর্তব্য। কিন্তু এর বাইরে যেসব বর্ণনা আছে সেগুলোর বিরূদ্ধে যদি কোন দলিল না থাকে তবে একে সঠিক হওয়া সম্ভব বলা কর্তব্য।"
واعلم أن كثيرا من يشنعون مثل ذلك لا يعرف حقيقة السنة والجماعة فكيف يجوز أن يحتج بكلامه ومعنى سنة إذا أضيفت اليه صلى الله عليه هو ما أمر أن يدام عليه او فعله ليدام الاقتداء به فما هذا حاله يعد سنة الرسول وإنما يقع هذا الاسم على ما ثبت أنه قاله أو فعله وأما ما ينقل من أخبار الآحاد فإن صح فيه شروط القبول يقال فيه إنه سنة على وجه التعارف لأن إذا لم نعلم ذلك القول أو ذلك الفعل فالقول بأنه سنة يقبح لأن لا نأمن أن نكون كاذبين في ذلك وعلى هذا الوجه لا يجوز في العقل أن يقول في خبر الواحد قال رسول الله قطعا وإنما يجوز أن يقال روي عنه صلى الله عليه ذلك وأما الجماعه فالمراد به ما أجمع عليه الأمة وثبت ذلك من إجماعها فأما ما لم ما لم يثبت لم يجز التمسك به فهو بمنزلة أخبار الآحاد وإذا صح ما ذكرناه في الجملة فالمتمسك بالسنة والجماعة هم أصحابنا
"জেনে নাও এসকল বিষয় যারা নিন্দা করে থাকে তাদের অধিকাংশেরই সুন্নত এবং জামাতের বাস্তবতা সম্পর্কে অবগতি নেই, তাহলে কিভাবে তাদের কথাকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যায়? সুন্নত শব্দটি যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দিকে সম্পৃক্ত করে বলা হয় তখন এর অর্থ হচ্ছে এমন কোন কাজের আদেশ যা তিনি সর্বাবস্থায় করতে বলেছেন কিংবা তার এমন কোন কাজ যা সর্বাবস্থায় অনুসরণ করা হউক এমন তিনি চেয়েছেন। কোন বিষয়ের অবস্থায় যদি এমনই হয় তখনই কেবল তাকে রাসুলের সুন্নত বলা যেতে পারে। আর এই শব্দটি সে বিষয়ের ব্যাপারেই প্রযোজ্য যা তিনি বলেছেন কিংবা করেছেন বলে প্রমাণিত। খবরে ওয়াহেদ যেসকল হাদীস বর্ণনা করা হয়, যদি সেসবের ক্ষেত্রে কবুল করার শর্তগুলো পরিপূর্ণ হয়, তবে একে প্রচলিত ভাষায় সুন্নত বলা যেতে পারে। কিন্তু যদি আমরা কোন কাজ কিংবা কোনো কথার ব্যাপারে এই বিষয়টা জানতে না পারি, তবে একে সুন্নত আখ্যা দেওয়া মন্দ বিষয়। কেননা আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না যে, আমরা এসব ক্ষেত্রে রাসূলের নামে মিথ্যা কথা বলে ফেলছি কিনা। আর এ যুক্তিতেই আকলিভাবে খবরে ওয়াহেদকে আমাদের জন্য অকাট্যভাবে "রাসূল সা: বলেছেন” শব্দ ব্যবহার করে উল্লেখ করা অসম্ভব। বরং বলা উচিত হচ্ছে, “রাসূল থেকে বর্ণিত আছে।” আর জামাতের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, জামাত হল এমন বিষয় যার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা হয়েছে। কিন্তু যে বিষয়ে ইজমা প্রমাণিত নয়, সেগুলো খবরে ওয়াহিদের মতই। আর তাই একে আঁকড়ে থাকা উচিত নয়। আমরা এতক্ষণ সার্বিকভাবে যা বললাম তা যদি সঠিক হয়, তবে সুন্নত ও জামাতকে আঁকড়ে থাকা দল আমরাই।" (সমাপ্ত)
শুরুতে দাবি করেছিলাম মুতাজিলাদের আহলে সুন্নাত থেকে বহিস্কার করার বিষয়টি রাজনৈতিক। কারণ মুতাজিলারা সাহাবীদের সম্মান করে, এমনকি তাদেরকেও মুতাজিলা বলে। সুন্নত ও ইজমাকে হুজ্জত মানে। আকিদার বিষয়ে তারা খবরে ওয়াহেদ গ্রহণ করে না। ফিকহে তারা আবু হানিফা ও শাফেয়ীর মুকাল্লিদ। এমনকি হানাফি মাযহাবের সর্বপ্রথম উসুলের বইটি লিখেছেন একজন মুতাজিলি – ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসানের (আবু হানিফার ছাত্র) হাতে গড়ে ওঠা ছাত্র ঈসা বিন আবান। আশআরী ও মাতুরীদীদের সাথে তাদের উসুলের মোটাদাগে কোন পার্থক্য নেই। তারা খলকে আফআলুল ইবাদ অস্বীকার করে না। ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়। হ্যাঁ, সালাহ ও আসলাহ, শাফায়াত, তওবা না করে মারা গেলে চিরদিন দোজখে থাকবে ইত্যাদি বিষয়ে তাদের কথা বিতর্কিত ও ক্ষেত্র বিশেষে আপত্তিকর। কিন্তু এক-দুইটি আপত্তিকর কথা পেলেই, পুরোপুরি ডিসমিস করে দিতে হবে, এটা কেমন কথা?
ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন,
وعبد الرحمن الأصم وإن كان معتزليًّا فإنه من فضلاء الناس وعلمائهم، وله تفسير، ومن تلاميذه إبراهيم بن إسماعيل بن علية، ولإبراهيم مناظرات في الفقه وأصوله مع الشافعي وغيره، وفي الجملة فهؤلاء من أذكياء الناس وأحدهم أذهانا، وإذا ضلوا في مسألة لم يلزم أن يضلوا في الأمور الظاهرة التي لا تخفى على الصبيان وهذا كما أن الأطباء وأهل الهندسة من أذكياء الناس ولهم علوم صحيحة طبية وحسابية وإن كان ضل منهم طوائف في الأمور الإلهية فذلك لا يستلزم أن يضلوا في الأمور الواضحة في الطب والحساب فمن حكى عن مثل أرسطو أو جالينوس أو غيرهما قولا في الطبيعيات ظاهر البطلان علم أنه غلط في النقل عليه وإن لم يكن تعمد الكذب علي
মূলত মুতাজিলাদের আগাগোড়া ডিসমিস করে দেয়ার চল শুরু হয়েছিল ইমাম আহমদের সময় থেকে। মুতাজিলাদের এক অংশই প্রথম বাড়াবাড়ি শুরু করেছিল। ইমাম আহমদ ও আহলে হাদীসদের বিদআতি আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্যাতন করে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইমাম আহমদ ও তার সমর্থকরা মুতাজিলাদের সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেন। তাদের বিদআতি ও পথভ্রষ্ট আখ্যা দেন। মুতাজিলারা দ্রুতই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের জায়গায় অব্বাসিরা হাম্বলীদের পৃষ্ঠপোষণ শুরু করে এবং ইমাম আহমদের আকিদাকে অফিসিয়াল আকিদা হিসেবে ফরমান জারি করে। কিন্তু সময় থেমে থাকে নি। মুতাজিলাদের পরিণতি হাম্বলীদেরও বরণ করতে হয়েছে। আশআরীরা আহলে সুন্নত বলে স্বীকৃতি পেত না যদি তাদের মদদ করার জন্য সেলযুক, আইয়ুবী ও মামলুক সুলতানরা না থাকত। আর একারণেই বাগদাদে ক্ষয়িষ্ণু আব্বাসীদের অনুগত হাম্বলী ও সেলযুকদের অনুগত আশআরীদের মাঝে কারা আহলে সুন্নত এই নিয়ে রক্তক্ষয়ী মারামারি হয়েছিল, যা আমাদের ইতিহাসে কুশাইরির ফিতনা নামে কুখ্যাত। বেচারা মুতাজিলাদের কপাল খারাপ, ইমাম আহমদের বদদোয়াতেই কিনা আল্লাহ জানেন, কিন্তু তারপর থেকে রাজনৈতিক কোন পৃষ্ঠপোষক না পেয়ে তারা সুন্নিদের সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সচেতন সবাই জানেন ইমাম আহমদ কেবল মুতাজিলা নয়, ইমাম আবু হানিফার অনুসারীদেরকেও বাতিল গোমরাহ বলে ডিসমিস করে দিয়েছিলেন! তিনি যেসব কথা বলেছেন সেগুলো হাম্বলী আলেমদের নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থ, ইবনে আবি ইয়ালার 'তাবাকাতে হানাবিলা'তে পাবেন।
ইমাম আহমদ শিয়া, খারেজি, কাদারিয়াদের নিন্দা ও তিরস্কার করার পর হানাফিদের প্রসঙ্গে বলেন:
وأصحاب الرأي وهم مبتدعة ضلال أعداء للسنة والأثر يبطلون الحديث ويردون على الرسول ويتخذون أبا حنيفة ومن قال بقوله إماما ويدينون بدينهم وأي ضلالة أبين ممن قال بهذا وترك قول الرسول وأصحابه واتبع قول أبي حنيفة وأصحابه فكفى بهذا غيا مرديا وطغيانا.
"আসহাবে রায় হল বিদআতি, গোমরাহ, রাসূলের সুন্নত ও সাহাবীদের আছারের শত্রু। তারা হাদীসকে বাতিল করে দেয়, রাসূলের সুন্নতকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবু হানিফা ও তার মতাবলম্বীদের ইমাম হিসেবে গ্রহণ করে। এর চাইতে সুস্পষ্ট গোমরাহী আর কী হতে পারে যারা রাসুল ও তার সাহাবীদের বক্তব্য বর্জন করে আবু হানীফা ও তার ছাত্র ও সঙ্গীদের মতকে অনুসরণ করে? বিভ্রান্তি, ধ্বংস ও বিদ্রোহের জন্য এটাই তো যথেষ্ট!"
কখনো ভেবেছেন যে হানাফীদের ব্যাপার ইমাম আহমদের নিন্দা ও আপত্তি কেন ধোপে টিকলো না? কারণ আফ্রিকা মহাদেশ ও হাম্বলীদের আস্তানা বাগদাদ বাদ দিলে, গোটা মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ অঞ্চল হানাফী মাযহাবের অনুসারী শাসক ও সুলতানদের দ্বারা পরিচালিত হত। মঙ্গোলদের হাতে বাগদাদ ধ্বংস হওয়ার পর তো হাম্বলীরা এক প্রকার ভিটেমাটিহীন হয়ে পড়ে। এই যে বর্তমানে চার মাযহাবের ঐক্য ও সংহতির কথা বলা হয়, সেটা ইমাম আহমদের যুগে ছিল না। থাকলে তিনি হানাফীদের এত কর্কশ ভাষায় নিন্দা ও তিরস্কার করতেন না। এই ঐক্য ও সংহতি তৈরি হয়েছে শিয়াদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার তাকিদ থেকে এবং এমন এক সময়ে যখন মুতাজিলারা বিলুপ্ত হবার পথে। তাছাড়া এখনো যে এই বিতর্ক হারিয়ে গেছে এমন না। কট্টর আশআরী ও মাতুরীদীরা এখনো ইমাম আহমদের আকীদাকে (যা ইবনুল জাওযী কিংবা ইবনে কুদামা-রা পর্যন্ত উল্লেখ করে গিয়েছেন, ইবনে তাইমিয়্যাহ বাদ দিন!) গোমরাহী আকীদা বলে, যেমন: সাইদ ফুদা ও তার অনুসারীরা।
পরিশেষে আমার বক্তব্য হচ্ছে, রাসূল তার উম্মতকে সুন্নি ও বিদআতি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেন নি। কোরআনও মুসলিমদের মাঝে এই বিভাজনের কথা বলে নি। বরং মুসলিমদের মাঝে বিভাজন হবে আমল দিয়ে। যারা ভাল তারা সালেহীন, যারা খারাপ তারা ফাসেকীন। বিদআত বিষয়টা গোটা ইতিহাস জুড়ে অদ্যবধি সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মুসলিমদের মাঝে একাডেমিক বিতর্ক হতে পারে। কারো কোন বক্তব্যকে আপনি বিভ্রান্তিপূর্ণ ও পরিত্যাজ্য আখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু বিদআতি বলে সামাজিকভাবে একঘরে করে দেয়া কোন একাডেমিক ও স্কলারলি কাজ নয়। একাডেমিক বিষয়কে একাডেমিক জায়গাতে রাখতে হবে।
যারা খিলাফতের স্বপ্ন দেখেন, তাদের উচিত এই বিদআতের ইস্যুটাতে তাজদীদ আনার ব্যবস্থা করা। অন্যথায় আপনি কাকে খলিফা বানাবেন? দেওবন্দিকে বানালে বেরেলবী মেনে নিবে? হাম্বলীকে বানালে আশআরী মেনে নিবে? এই বিদআত নামক ধারালো অস্ত্রটা উম্মাতকে যেই পরিমাণ টুকরো টুকরো করেছে, তার তুলনা আর কিছুতেই নেই। মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব ও তার নজদি প্রজেক্ট দেখেও যদি আমরা এখনো এই সবকটা শিখতে না পারি, কেয়ামত পর্যন্ত আর শেখা হবে না। আর অযোগ্য কাউকে আল্লাহ কর্তৃত্ব দেন না।
ولقد كتبنا في الزبور من بعد الذكر أن الأرض يرثها عبادي الصالحون
"আমরা যাবুরগ্রন্থে উপদেশবাণী উল্লেখ করার পর লিখে দিয়েছিলাম যে, এই ভূখণ্ডের উত্তরাধিকারী হবে আমার সালেহ (সালাহিয়াত বা যোগ্যতা ধারী : তাফসীর আল মানার) বান্দারা।"
শেষের আগে ইমাম যাহাবীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করি যাকে আমরা মূলনীতি হিসেবে নিতে পারি। তিনি লিখেছেন :
غُلاَةُ المُعْتَزِلَةِ، وغُلاَة الشِّيعَة، وغُلاَة الحَنابِلَة، وغُلاَة الأشاعِرَةِ، وغلاَة المُرْجِئَة، وغُلاَة الجَهْمِيَّة، وغُلاَة الكَرّامِيَّة، قَدْ ماجت بِهِم الدُّنْيا، وكثرُوا، وفِيهِم أذكياءُ وعُبّاد وعُلَماء، نَسْألُ اللهَ العفوَ والمَغْفِرَة لأهْل التَّوحيد، ونبرَأُ إلى اللهِ مِنَ الهَوى والبِدَع، ونُحبُّ السُّنَّةَ وأهْلَها، ونُحِبُّ العالِمَ عَلى ما فِيهِ مِنَ الاتِّباعِ والصِّفاتِ الحمِيدَة، ولاَ نُحبُّ ما ابْتدعَ فِيهِ بتَأْوِيلٍ سائِغٍ، وإنَّما العبرة بكثرة المحاسن.
"কট্টর মুতাজিলা, কট্টর শিয়া, কট্টর হাম্বলী, কট্টর আশআরী, কট্টর মুরজিয়া, কট্টর জাহমিয়া, কট্টর কাররামিয়াদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে দুনিয়াটা ভরে গিয়েছে। এই কট্টর লোকগুলোর মাঝে অনেক মেধাবী আছে, জ্ঞানী আছে, এবাদতগুজার আছে। আল্লাহর কাছে সকল তাওহীদে বিশ্বাসীর জন্য ক্ষমা ও মাগফিরাত চাই। আল্লাহর কাছে খায়েশাত ও বিদআত থেকে দায়মুক্তির অঙ্গীকার করি। সুন্নত ও এর অনুসারীদের ভালবাসি। একজন আলেমকে তার মাঝে যতটুকু অনুসরণ ও প্রশংসনীয় গুণাবলী আছে সেই অনুপাতে ভালবাসি। সম্ভাবনাময় তাবিল করার মাধ্যমে যে বিদআত তৈরি হয় সেটা ভালবাসি না। বরং কোন ব্যাক্তিকে আমরা মাপি তার প্রশংসনীয় বিষয়ের আধিক্য অনুযায়ী।"
প্রাসঙ্গিক লেখা : কোরআন-সুন্নাহতে কি আহলুস সুন্নাত এবং আহলুল বিদআত বলে মুসলিমদের দুই ভাগ করা প্রমাণিত?
বিদআত বিদআত করে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থসিদ্ধির পায়তারা করা লোকদের কর্মকাণ্ডের আয়রনি দেখে মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড বিনোদন মিশ্রিত বেদনা দলা পাকিয়ে ওঠে। আমাদের আহলে হাদিস ভাইরা এই কর্মকাণ্ড খুব নিষ্ঠা এবং নিষ্ঠুরতার সাথে করে থাকেন। একদিকে সহিহ হাদিস পালনের নামে প্রতিষ্ঠিত ফিকহি মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন, উম্মাতের শ্রেষ্ঠ ফকিহ আবু হানিফার অবমাননা করে বেড়ায় এই বিদআতপক্ষীরা, অন্যদিকে নিজেদের উগ্র কর্মপদ্ধতিকে জাস্টিফাই করে সুস্পষ্ট জাল ও বানোয়াট হাদিস দিয়ে। এমনই এক হাদিস নিয়ে আজকের আলোচনা।
কোরআনে পাকের আয়াতে আল্লাহ বলেছেন,
يوم تبيض وجوه وتسود وجوه فأما الذين اسودت وجوههم
“যেদিন অনেক চেহারা অন্ধকার হয়ে যাবে, আর অনেক চেহারা হবে আলোকোজ্জ্বল … “ (সুরা আলে ইমরান ১০৬)
আয়াতের এই অংশের তাফসিরে তারা ইবনে উমার, ইবনে আব্বাস ও আবু সাঈদ খুদরি থেকে বর্ণনা উল্লেখ করে যে, তারা বলেছেন,
تبيض وجوه أهل السنة والجماعة، وتسود وجوه أهل البدع
“যাদের চেহারা আলোকোজ্জ্বল হবে তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত, আর যাদের চেহারা অন্ধকার হবে তারা আহলুল বিদআত।”
মূলত এই প্রত্যেকটা বর্ণনা কাট্টা জাল হাদিস। কীভাবে? বলছি …
গতকাল আমার পোস্টে লিখেছিলাম যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল মুসলিমদের একটিমাত্র সমাজ থাকার কথা বলেছেন। সেই সমাজে কেউ কেউ হবে সালেহ বা নেককার। কেউ কেউ হবে ফাসেক বা বদকার। কথা না আল্লাহ তা’আলা কোরআনে, না নবিয়ে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সুন্নাতে কারিমায় উম্মাতে মুসলিমাকে ‘আহলে সুন্নত’ এবং ‘আহলে বিদআত’ নামের ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছেন, আর না মুসলিমদের কোন দলকে ‘বিদআতি’ আখ্যা দিয়ে সামাজিকভাবে একঘরে করতে বলেছেন। আল্লাহর রাসুল (সাঃ) যেখানে তার সম্মানে মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের সুস্পষ্ট অবমাননা থাকা সত্তেও তাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, “মুহাম্মাদ তার সঙ্গীদের হত্যা করে এমন কেউ বলুক আমি চাই না”, সেখানে আজকে সুন্নাত ও জামাতের নাম নিয়ে উম্মাতের এক অংশ আরেক অংশকে সামাজিকভাবে বয়কট করা নিয়ম বানিয়ে নেয়া হয়েছে। অনেকে সালাফদের কতিপয় উক্তি ব্যবহার করে ‘বিদআতি’ মুসলিমদের সালাম দেয়া, তাদের দাওয়াতে অংশ নেয়া, জানাযায় শরিক হওয়াকে নিষিদ্ধ করে থাকে, আল্লাহর রাসুলের সুস্পষ্ট নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে।
সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,
حق المسلم على المسلم ستٌّ، قيل: ما هن يا رسول الله؟ قال: إذا لقيته فسلِّم عليه، وإذا دعاك فأجِبْه، وإذا استنصَحك فانصَح له، وإذا عطس فحمِد الله فشمِّته، وإذا مرِض فعُدْه، وإذا مات فاتَّبِعه
নবিয়ে করিম বলেন, এক মুসলিমের অন্য মুসলিমের ওপর ছয়টি অধিকার রাখে। জিজ্ঞেস করা হল: কী কী সেই অধিকার ইয়া রাসুলাল্লাহ! আল্লাহর রাসুল বললেন, (১) যখন তার সাথে সাক্ষাত হবে তাকে সালাম দিবে, (২) যখন তোমাকে সে দাওয়াত দিবে, দাওয়াত কবুল করবে, (৩) যদি তোমার কাছে পরামর্শ চায়, পরামর্শ দিবে, (৪) যদি হাঁচি দিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে, তাকে এর জবাব দিবে, (৫) যদি সে অসুস্থ হয়, তাকে পরিচর্যা করতে যাবে, (৬) যদি সে মারা যায়, তার জানাযার পিছু নিবে।
আল্লাহর রাসুল বলেছেন,
قد تركتكم على البيضاء ليلها كنهارها لا يزيغ عنها بعدي إلا هالك
“তোমাদের আমি শুভ্র-সাদা পথে রেখে যাচ্ছি, যে পথে রাত্র দিনের মতই উজ্জ্বল। আমার পর এই পথ থেকে কেবল ধ্বংসপ্রাপ্তরাই বিচ্যুত হবে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)
কী সেই শুভ্র পথ? সহিহ বুখারির হাদিসে আল্লাহর রাসুল বলেন,
من صلى صلاتنا واستقبل قبلتنا وأكل ذبيحتنا فذلك المسلم الذي له ذمة الله وذمة رسوله فلا تخفروا الله في ذمته
“যারা আমাদের নামায অনুযায়ী নামায পড়ে, আমাদের কিবলার দিকে মুখ ফেরায়, আমাদের জবাই করা পশুর মাংস খায়, জেনে নাও, সেই হচ্ছে মুসলিম। তার জন্য রয়েছে আল্লাহর যিম্মা (নিরাপত্তা), তাঁর রাসুলের যিম্মা। সাবধান, তোমরা আল্লাহর নিরাপত্তাকে নস্যাত করো না।”
আজ আমরা রাসুলের নির্দেশনাকে অবলীলায় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বেড়াচ্ছি। মুসলিমদের প্রথমে বিদআতি ডাকা দিয়ে শুরু করি, সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। এরপর কাফের আখ্যা দিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করি।
হ্যাঁ, আমি ইতিহাস অস্বীকার করি না। সালাফের যুগে বিদআতিদের ব্যাপারে প্রচণ্ড সামাজিক বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও সামাজিক মেলামেশায় বড় আলেমগণ নিন্দা জ্ঞাপন করেছিলেন। কিন্তু সেটারও সামাজিক ও রাজনৈতিক একটা কনটেক্সট ছিল। সালাফের যুগে খারেজি, রাফেযিদের সশস্ত্র উত্থান ঘটেছিল। কিছুদিন পরপর এই নতুন মতবাদের লোকেরা বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা পরিচালনা করত। বহু সাধারণ মুসলিমকে হত্যা করত। এই উগ্রবাদীরা নিজেরাই মুসলিমদের জামাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে সমাজের বিরুদ্ধে সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছিল। ফলে তাদের সাথে সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রেখে সহাবস্থান করা সম্ভবপর ছিল না। আল্লাহর রাসুলের বিশুদ্ধ সুন্নাত, কোআনে ঐক্যের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশনা মাথায় রেখে বিবেচনা করলে সালাফের যুগে বিদআতিদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের জন্য এর চেয়ে ভাল কোন ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু সালাফের যুগ মানেই নিষ্কলুশ না। সালাফের যুগেই উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদেরকে গোমরা ও পথভ্রষ্ট বলার ভুঁড়িভুঁড়ি নমুনা পাওয়া যায়। যেমন: ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মদ ও তাদের অনুসারীদেরকে ইমাম আহমাদ গোমরাহ ও বিদআতি আখ্যা দিয়েছেন। এছাড়াও ইমামে আজম আবু হানিফাকে কাফের পর্যন্তও বলেছেন গণ্যমান্য সালাফরা, যা আব্দুল্লাহ বিন ইমাম আহমদ কিংবা খতিবে বাগদাদী বিশদ বিবরণ সহ উল্লেখ করেছেন। আমাদের এই কালো ইতিহাস সম্পর্কেও জানতে হবে। ইমাম ইবনে আব্দুল বার আল আন্দালুসি বলেছেন, মানুষের মাঝে আবু হানিফার খ্যাতি ও স্বীকৃতিতে ঈর্ষাকাতরতা থেকেই আবু হানিফার মৃত্যুর পর সালাফদের বড় একটা অংশ আবু হানিফার পিণ্ডি চটকাতে মশগুল হয়ে ওঠেন। আজকে আমাদের সালাফের নামে যেই রূপকথার ইতিহাস শোনানো হয় বাস্তবতা এর ধারেকাছেও নেই। ইমাম ইসহাক বিন রাহাওয়াইহ থেকে বর্ণিত আছে, যা ফাতহুল বারীতে ইবনে হাজার, উমদাতুল কারীতে বদরুদ্দীন আইনী ছাড়াও বহু মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, আমিরে মুয়াবিয়ার ব্যাপারে একটা ফযিলতও বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত হয় নি। ইবনুল কাইয়্যিমও এটা উল্লেখ করেছেন। অথচ সর্বস্বীকৃত এই বিষয়টি দামেশকের মসজিদে ঘোষণা করায় সুনানে নাসাঈর মহান লেখক ইমাম নাসাঈকে পদদলিত করা হয়, যাতে গুরুতর আহত হয়ে ইমাম নাসাঈ ইন্তেকাল করেন। হ্যাঁ, ভাইয়েরা। এই সব লজ্জাজনক বৃত্তান্ত সবই সালাফের যুগের।
মূল আলাপে ফিরে আসি। আমাদের আহলে হাদিস ব্রাদাররা ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমারের বরাতে (কেউ কেউ আবার আবু সাঈদ খুদরি থেকে সনদবিহীন ভিত্তিহীন মারফু রেওয়ায়াতও উল্লেখ করে) বলেন যে, আহলুস সুন্নাহ ও আহলুল বিদআত নামে মুসলিমদের দুইভাগ করার কথা কোরআনের আয়াত (আলে ইমরান ১০৬) দ্বারাই প্রমাণিত। সারাক্ষণ সহিহ সহিহ করে বেড়ানো এই লোকগুলোর কপটতার মুখোশ উন্মোচন করার সময় হয়েছে।
প্রথম হাদিস : ইবনে উমারের বর্ণনা।
হাদিসের মান : বানোয়াট ও পরিত্যাক্ত
এই বর্ণনাটি দায়লামি ‘ফিরদাউসুল আখবার’ গ্রন্থে, ইবনে আররাক ‘তানযিহুশ শারিয়াহ’ গ্রন্থে, ইমাম কুরতুবি তার তাফসির গ্রন্থে, জালালুদ্দিন সুয়ুতি ‘আদ দুররুল মানসুর’ কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আলোচ্য আয়াতের তাফসির হাদিসটি উল্লেখ করার পর ইমাম কুরতুবি মন্তব্য করেন —
وَقَوْلُ ابْنِ عَبَّاسٍ هَذَا رَوَاهُ مَالِكُ بْنُ سُلَيْمَانَ الْهَرَوِيُّ أَخُو غَسَّانَ عَنْ مَالِكِ بْنِ أَنَسٍ عَنْ نَافِعٍ عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي قَوْلِ اللَّهِ تَعَالَى" يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ" قَالَ: (يَعْنِي تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ الْبِدْعَةِ) ذَكَرَهُ أَبُو بَكْرٍ أَحْمَدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ ثَابِتٍ الْخَطِيبُ. وَقَالَ فِيهِ: مُنْكَرٌ مِنْ حَدِيثِ مَالِكٍ
“ইবনে আব্বাসের এই তাফসিরটি ইবনে উমার থেকেও মালিক বিন সুলাইমান হারাবি (গাসসানের ভাই) বর্ণনা করেছেন, ইমাম মালেক বিন আনাসের বরাতে নাফে’ থেকে ইবনে উমারের সুত্রে যে, আল্লাহর রাসুল এরশাদ করেছেন, “যেদিন অনেক চেহারা অন্ধকার হয়ে যাবে, আর অনেক চেহারা হবে আলোকোজ্জ্বল … “ আয়াতের অর্থ হচ্ছে আহলুস সুন্নাতের চেহারা আলোকোজ্জ্বল হবে, আর আহলুল বিদআতের চেহারা অন্ধকার হবে।” খতিবে বাগদাদি (আবু বকর আহমদ বিন আলি বিন সাবেত) এই হাদিস উল্লেখ করে বলেছেন, এটা মালেক থেকে বর্ণিত একটি মুনকার (পরিত্যাজ্য) হাদিস।”
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি তার ‘লিসানুল মিযান’ কিতাবে এই হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন,
قال الدارقطني حدثني أبو الحسن محمد بن عبد الله المزني الهروي ثنا أبو نصر أحمد بن عبد الله الأنصاري ثنا الفضل بن عبد الله بن مسعود اليشكري ثنا مالك بن سليمان الهروي ثنا مالك عن نافع عن ابن عمر رضى الله تعالى عنهما رفعه في قوله تعالى: {يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ} فأما الذين ابيضت وجوههم أهل السنة والجماعة وأما الذين اسودت وجوههم أهل الأهواء والبدع قال هذا موضوع والحمل فيه على أبي نصر الأنصاري والفضل ضعيف وأخرجه الخطيب في الرواة عن مالك من طريق أبي زرعة حدثنا أحمد بن الحسين الحافظ ثنا أبو نصر أحمد بن محمد بن عبد الله القيسي بهراة ثنا الفضل به وقال منكر من حديث مالك ولا أعلمه يروي إلا من هذا الوجه
“দারাকুতনি স্বীয় সনদে মালেক বিন সুলায়মান আল হারাবির সুত্রে ইমাম মালেক থেকে নাফে’, অতঃপর ইবনে উমার থেকে মারফু সুত্রে যে, “যেদিন অনেক চেহারা অন্ধকার হয়ে যাবে, আর অনেক চেহারা হবে আলোকোজ্জ্বল…” এর ব্যাখ্যা হচ্ছে: যাদের চেহারা আলোকোজ্জ্বল হবে তারা আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত, আর যাদের চেহারা অন্ধকার হবে তারা আহলুল হাওয়া ওয়াল বিদআত।” দারাকুতনি বলেছেন এটা মাওদু অর্থাৎ বানোয়াট হাদিস। মূলত এটি আবু নাসর আল আনসারির কাজ। এছাড়াও সনদে থাকা ফাদ্বল দূর্বল রাবী। দারাকুতনি ছাড়াও এই বর্ণনাটি খতিবে বাগদাদি ইমাম মালেক থেকে বর্ণনাকারীদের সংকলন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন আবু যুরআর সুত্রে। অতঃপর বলেছেন, এটা ইমাম মালেকের নামে বর্ণিত মুনকার (পরিত্যাক্ত) হাদিস। আর কেউ এটি তার থেকে এই বর্ণনা উল্লেখ করেছেন বলে আমরা জানি না।”
দ্বিতীয় হাদিস : ইবনে উমারের বর্ণনা।
হাদিসের মান : বানোয়াট।
জর্ডানের বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাশহুর হাসান ‘ই’লামুল মুওয়াক্কিইন’ গ্রন্থের পাদটীকায় এই হাদিস সম্পর্কে মন্তব্য করেন:
أخرجه اللالكائي في "شرح السنة" (1/ 72 رقم 74) من طريق أحمد بن محمد بن مسروق الطوسي، والسهمي في "تاريخ جرجان" (ص 132 - 133) من طريق إسماعيل بن صالح الحلواني، والخطيب (7/ 379)، والآجري في "الشريعة" (3/ 589 - 590 رقم 2128 - ط وليد سيف)، من طريق أبي عمر الدوري، كلهم قالوا: حدثنا علي بن قدامة عن مجاشع بن عمرو عن ميسرة بن عبد ربه عن عبد الكريم به، وألفاظهم قريبة من بعضها.
وأخرجه ابن أبي حاتم في "التفسير" (2/ 464 رقم 339 - آل عمران) من طريق مجاشع به.
قلت: وإسناده ضعيف جدًا، إن لم يكن موضوعًا؛ ففيه علي بن قدامة ضعيف، وشيخه مجاشع بن عمرو اتهم بالكذب، وشيخه ميسرة مثله.
ثم إن المتأمل في هذا التفسير يجد فيه نكارة، وهي أنه مخالف لنص القرآن الكريم، فقد بيّن اللَّه تعالى لنا من هم الذين تبيض وجوههم، ومن الذين تسود وجوههم فقال: {يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ (106) وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ} [آل عمران: 106] واللَّه أعلم
"লালকায়ি এটি ‘শারহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে আহমদ বিন মুহাম্মদ বিন মাসরুক তুসীর সুত্রে, সাহমী একে ‘তারিখু জুরজান’ গ্রন্থে ইসমাইল বিন সালেহ হালওয়ানি সুত্রে, খতিবে বাগদাদি ও ‘আশ শারিয়াহ’ কিতাবে আজুররি এটি বর্ণনা করেছেন আবু উমার দাওরির সুত্রে।
এছাড়াও ইবনে আবি হাতেম তার তাফসিরে এটি মাজাশি’ থেকে বর্ণনা করেছেন।
আমার (মাশহুর হাসান) মতে, হাদিসটি যদি বানোয়াট জাল হাদিস নাও হয়, তবুও প্রচণ্ড দূর্বল হাদিস। কেননা এর সনদে আছে আলি বিন কুদামার ন্যায় দূর্বল রাবী, মাজাশি’ বিন আমর ও তার শায়খ মায়সারা - যারা দুইজনই মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত।
এছাড়াও এই তাফসির নিয়ে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, এটি আপত্তিকর। কারণ এটি খোদ কোরআনের আয়াতের সাথেই সাংঘর্ষিক, কারণ সম্পূর্ণ আয়াতটি হচ্ছে -
يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوهٌ وَتَسْوَدُّ وُجُوهٌ فَأَمَّا الَّذِينَ اسْوَدَّتْ وُجُوهُهُمْ أَكَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ وَأَمَّا الَّذِينَ ابْيَضَّتْ وُجُوهُهُمْ فَفِي رَحْمَةِ اللَّهِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
“যেদিন অনেক চেহারা অন্ধকার হয়ে যাবে, আর অনেক চেহারা হবে আলোকোজ্জ্বল। যাদের চেহারা অন্ধকার হবে তাদের বলা হবে, তোমরা কী ঈমান আনার পর কুফরি করেছ? শাস্তি আস্বাদান কর তোমাদের কুফরির কারণে। আর যাদের চেহারা আলোকোজ্জ্বল হবে, তারা থাকবে আল্লাহর রহমতে, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে “ ওয়াল্লাহু আ’লাম।"০ (সমাপ্ত)
তৃতীয় হাদিস : আবু সাঈদ খুদরী থেকে একটি অজ্ঞাত বর্ণনা যা জালালুদ্দিন সুয়ুতি বিনা সনদে আদ দুররুল মানসুরে উল্লেখ করেছেন। সনদবিহীন একটা বর্ণনা নিয়ে আলোচনা করার প্রশ্নই আসে না।
ইবনে আব্বাসের রেওয়ায়াতটাই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এমনকি ইবনে কাসির তার তাফসিরেও এটি সনদের আলোচনা ব্যতিরেকে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সনদ নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, এই বর্ণনাটি ব্যবহার করার কোন সুযোগ নেই।
এই বর্ণনার কেন্দ্রীয় দুই রাবী হচ্ছে — মাজাশি’ ও মায়সারা। আসুন তাদের সাথে পরিচিত হই।
(ক) মাজাশি’ বিন মায়সারা
أبو أحمد الحاكم : منكر الحديث
আবু আহমদ হাকেম বলেন, সে মুনকারুল হাদিস (তার হাদিস পরিত্যাজ্য)
أبو جعفر العقيلي : حديثه منكر غير محفوظ
আবু জাফর উকায়লী বলেন, তার হাদিস মুনকার ও অসংরক্ষিত।
أبو حاتم الرازي : متروك الحديث ضعيف ليس بشيء
আবু হাতেম রাযী বলেন, তার হাদিস বর্জনীয়। সে দূর্বল, কিছুই না।
أبو حاتم بن حبان البستي : كان ممن يضع الحديث على الثقات، ويروي الموضوعات عن أقوام ثقات، لا يحل ذكره في الكتب إلا على سبيل القدح فيه، ولا الرواية عنه إلا على سبيل الاعتبار للخواص
আবু হাতেম বিন হিব্বান বলেন, সে নির্ভরযোগ্য ব্যাক্তিদের নামে হাদিস জাল করত। নির্ভরযোগ্য ব্যাক্তিদের নামে বানোয়াট কথা বর্ণনা করত। কোন বইতে তাকে উল্লেখ করা বৈধ না। হ্যাঁ, যদি তার সমালোচনা ও নিন্দা করতে হয় তাহলে ভিন্ন কথা। তার বর্ণনাগুলো কেবলমাতর বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের সামনে পর্যালোচনার জন্য উল্লেখ করা বৈধ।
أبو نعيم الأصبهاني : لا يعتمد على روايته ومفاريده
আবু নুয়াইম আল ইসফাহানি বলেন, তার রেওয়ায়েত ও একক বর্ণনাগুলোর উপর নির্ভর করা যাবে না।
الذهبي : ذكر له حديثا فى تلخيصه وقال: ذا من وضعه
ইমাম যাহাবি তালখিস কিতাবে তার একটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, এটা তার বানানো হাদিসগুলোর একটা।
محمد بن إسماعيل البخاري : منكر مجهول
ইমাম বুখারি বলেন, সে পরিত্যাক্ত ও অজ্ঞাত।
يحيى بن معين : أحد الكذابين
ইয়াহিয়া বিন মাঈন বলেন, মিথ্যুকদের একজন।
(খ) মায়সারা বিন আব্দে রব্বিহি
أبو أحمد بن عدي الجرجاني : ضعيف، ويخلط في الأحاديث، وعامة حديثه يشبه بعضها بعضا في الضعف
ইবনে আদী আল জুরজানী বলেন, দূর্বল, সে তার হাদিসগুলো গুলিয়ে ফেলত। তার বর্ণিত অধিকাংশ হাদিসই দূর্বলতার দিক থেকে একে অন্যের সাদৃশ্যপূর্ণ।
أبو بشر الدولابي : كان كذابا
আবু বিশর আদ দুলাবী বলেন, সে একজন কাজ্জাব (মিথ্যুক)
أبو جعفر العقيلي : أحاديثه بواطيل غير محفوظة
ইমাম উকায়লী বলেন, তার হাদিসগুলো বাতিল ও অসংরক্ষিত।
أبو حاتم الرازي : كان يرمى بالكذب وكان يفتعل الحديث
আবু হাতেম রাযী বলেন, তার ব্যাপারে মিথ্যা বলার অভিযোগ আছে। সে হাদিস তৈরি করত।
أبو زرعة الرازي : كان يضع الحديث وضعا
আবু যুরআ রাযী বলেন, সে বানোয়াট হাদিস রচনা করত।
أبو عبد الله الحاكم النيسابوري : يروى عن قوم من المجهولين الموضوعات، وهو ساقط
আবু আব্দুল্লাহ হাকেম নিসাবুরী বলেন, সে অজ্ঞাত ব্যাক্তিদের সুত্রে জাল হাদিস বর্ণনা করত। সে পরিত্যাজ্য।
أحمد بن شعيب النسائي : كذاب، ومرة: متروك الحديث
ইমাম নাসায়ী বলেন, সে কাজ্জাব। আরেকবার বলেন, তার হাদিস বর্জনীয়।
ابن حجر العسقلاني : معروف بالوضع
ইবনে হাজার আসকালানী বলেন, হাদীস জাল করার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ।
الدارقطني : متروك
দারাকুতনী বলেন, বর্জনীয়।
الذهبي : كذاب معروف
যাহাবী বলেন, সুপরিচিত কাজ্জাব।
محمد بن عيسى بن الطباع : قال لي: وضعت الأحاديث أرغب فيها الناس
মুহাম্মদ বিন ঈসা বিন তাব্বা’ বলেন, মায়সারা আমাকে বলেছে, আমি হাদিস বানাই মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে।
مسلمة بن القاسم الأندلسي : كذاب روى أحاديث منكرة وكان ينتحل الزهد والعبادة
মাসলামা বিন কাসেম আন্দালুসি বলেন, একটা মিথ্যুক। বহু মুনকার হাদিস বর্ণনা করেছে। যুহদ ও এবাদতগুজার হিসেবে পরিচিত ছিল।
يحيى بن معين : ليس بشيء
ইয়াহিয়া বিন মাঈন বলেন, সে কিছুই না।
আমার মনে হয় না, আমাদের আহলে হাদিস ভাইরা এত সুস্পষ্ট দলিল থাকা সত্তেও সাহাবিদের নামে কোরআনের আয়াতের এই ব্যাখ্যা পরিত্যাগ করবেন। যাক তাদের কথা। আমরা বরং শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ইমাম আবু জাফর ইবন জারির আত তাবারীর কাছ থেকে এই আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যাটা জেনে নিই।
ইমাম তাবারী বলেন,
وأولى الأقوال التي ذكرناها في ذلك بالصواب ، القول الذي ذكرناه عن أبي بن كعب أنه عنى بذلك جميع الكفار ، وأن الإيمان الذي يوبخون على ارتدادهم عنه ، هو الإيمان الذي أقروا به يوم قيل لهم : ألست بربكم قالوا بلى شهدنا سورة الأعراف : 172
وذلك أن الله جل ثناؤه جعل جميع أهل الآخرة فريقين : أحدهما سودا وجوهه ، والآخر بيضا وجوهه . فمعلوم - إذ لم يكن هنالك إلا هذان الفريقان - أن جميع الكفار داخلون في فريق من سود وجهه ، وأن جميع المؤمنين داخلون في فريق من بيض وجهه . فلا وجه إذا لقول قائل : "عنى بقوله : " أكفرتم بعد إيمانكم " ، بعض الكفار دون بعض " ، وقد عم الله جل ثناؤه الخبر عنهم جميعهم ، وإذا دخل جميعهم في ذلك ، ثم لم يكن لجميعهم حالة آمنوا فيها ثم ارتدوا كافرين بعد إلا حالة واحدة ، كان معلوما أنها المرادة بذلك .
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় যেসব কথা উল্লিখিত হয়েছে তার মধ্যে সঠিকতর কথাটি হচ্ছে যা আমরা সাহাবি উবাই বিন কাবের সুত্রে বর্ণনা করেছি যে, আয়াতে (চেহারা অন্ধকার হয়ে যাবে বলে) সমস্ত কাফেরদের বোঝানো হয়েছে। আর ঈমান আনার পর কুফরি করার কারণে আয়াতে যে তিরস্কার করা হয়েছে, তাতে ঈমান বলে সেই দিনের কথা বলা হয়েছে যেদিন আল্লাহ বলেছিলেন “আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল: হ্যাঁ, অবশ্যই। আমরা সাক্ষী আছি।” (সুরা আরাফ ১৭২)
এই ব্যাখ্যার যুক্তি হচ্ছে, মহান আল্লাহ সমস্ত আখিরাতবাসীদের দুটি ভাগে ভাগ করবেন, একদলের চেহারা অন্ধকার থাকবে। আরেকদলের চেহারা থাকবে উজ্জ্বল। যেহেতু জানা কথা যে, এই দুই দলের বাইরে কোন দল থাকবে না, তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, সমস্ত কাফেররা অন্ধকার চেহারার দলে অন্তর্ভূক্ত হবে। আর সকল মুমিনরা উজ্জ্বল চেহারার দলে অন্তর্ভূক্ত হবে। সুতরাং যারা আয়াতের ‘ঈমান আনার পর কুফরি কেন করলে?’ অংশের জের ধরে সকল কাফেরকে এর অন্তর্ভূক্ত না করে কেবল একটি অংশকে এর অন্তর্ভূক্ত করে তাদের বক্তব্যের পক্ষে কোন যুক্তি নেই। কারণ আয়াতে আল্লাহ সকল কাফেরের ব্যাপারে সাধারণভাবে এটি উল্লেখ করেছেন। এখন ঈমান আনার পর কুফরি করার বিষয়টি যেহেতু সকল কাফেরের ক্ষেত্রে একবার অন্তত ঘটেছে, তাই বোঝা গেল যে, এই আয়াতে ঐ বিষয়টাই বোঝানো হয়েছে।” (সমাপ্ত)
আলোচনা শেষ করা যাক, ইমাম ফখরুদ্দিন রাযির তাফসির উল্লেখ করে। কাদের চেহারা অন্ধকার হয়ে যাবে, এই সম্পর্কে তিনি মুফাসসিরদের ৫টি মত উল্লেখ করেন,
ইমাম রাযী বলেন,
الرابع: قيل هم أهل البدع والأهواء من هذه الأمة الخامس: قيل هم الخوارج، فإنه عليه الصلاة والسلام قال فيهم: " إنهم يمرقون من الدين كما يمرق السهم من الرمية " وهذان الوجهان الأخيران في غاية البعد لأنهما لا يليقان بما قبل هذه الآية، ولأنه تخصيص لغير دليل، ولأن الخروج على الإمام لا يوجب الكفر البتة.
“৪ - বলা হয়, এর অর্থ এই উম্মতের মধ্যকার আহলুল বিদআত ওয়াল হাওয়া।
৫ - বলা হয়, এর অর্থ খারেজিরা। কারণ তাদের ব্যাপারে নবিজি বলেছেন, তারা দ্বীনদের এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেভাবে তীর লক্ষ্যভেদ করে বেরিয়ে যায়।
এই শেষ দুটি মত চূড়ান্তভাবে দূর্বল। কারণ এই ব্যাখ্যার সাথে আয়াতের পূর্বোক্ত কথাগুলোর কোন মিল নেই। এছাড়াও এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে একটি ব্যাপক বিষয়কে বিনা দলিলে নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও ইমামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ (খুরুজ) করা নিঃসন্দেহেই কুফর নয়
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন